শার্ল দ্য গল (১৮৯০-১৯৭০) – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রতিরোধ আন্দোলনের নেতা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী নাটকের অধিকাংশ দৃশ্যের মঞ্চায়ন হয়েছিল ফ্রান্সের মাটিতে। তারপর ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর এই যুদ্ধের অবসানে বেলজিয়াম থেকে আস্ পর্বতমালা পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর বিজয় পতাকা উড্ডীন হয়।
এরই বিশ বছর পর দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময়ও ঘটে প্রায় একই রকমের ঘটনা। এবারও ফরাসিরা এই যুদ্ধের দাবানলের শিকারে পরিণত হয়। জার্মানদের প্রচণ্ড মারের মুখে ফরাসিদের তখন নাভিশ্বাস উঠবার যোগাড়। দেশটির প্রথম চরম অপমানজনক সব শর্ত মেনে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলেন তাদের হাতের অস্ত্র। উদাহরণত, ১৯৪০ সালের ১৬ জুন ক্ষমতাসীন ফরাসি সরকার জার্মানির সঙ্গে অধীনতামূলক মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনে রাজি হন। কিন্তু তখন একমাত্র ব্যক্তি যিনি এই পরাজয়ের কাছে মাথা নত না করে বিদ্রোহ করেছিলেন, তিনি আর কেউ নন, শার্ল দ্য গল, য়ার পুরো নাম শার্ল আন্দ্রে জোসেফ মারি দ্য গল (Charles Andre Joseph Marie de Gaulle)।
জার্মান দখলাদার বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ না করে দ্য গল জাতীয় নেতাদের এই বিশ্বাসঘাতকতায় মর্মাহত হয়ে একাকী গোপনে পালিয়ে যান ইংল্যান্ডে। তাঁর একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল ফ্রান্সের স্বাধীনতা সংগ্রামকে জিইয়ে রাখা এবং দখলদার জার্মান বাহিনীকে হটিয়ে দেওয়া।
ফ্রান্সের অন্যতম প্রধান সমরনেতা দ্য গল ফ্রান্সের পক্ষ ত্যাগ করে ইল্যান্ডে উপস্থিত হলে চার্চিল তাঁকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানান এবং লন্ডনের বেতার মারফত দেশের স্বাধীনতার পক্ষে তাঁকে প্রচার চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ করে দেন।
দ্য গলও এই সুযোগ পেয়ে তাঁর দেশবাসী, বিশেষ করে তাঁর দেশের তরুণসমাজের প্রতি এই বলে আহ্বান জানালেন যে, একটি খণ্ডযুদ্ধে আমাদের হার হয়েছে বটে, কিন্তু সামগ্রিক যুদ্ধের পটভূমিকায় আমাদের হার হয়নি। তিনি তাঁর সাথে ইংল্যান্ডে এসে কাজ করার জন্য ফরাসি শ্রমিক, যুবক ও সৈনিকদের প্রতি শুধু আহ্বান জানিয়েই ক্ষান্ত থাকলেন না, সক্রিয়ভাবে কাজও করতে লাগলেন।
তাঁর এই আহ্বানে ফ্রান্সের অগণিত যুবক এসে তাঁর পাশে ভিড় করে দাঁড়াতে লাগল। তারা ফ্রান্স থেকে চুরি করে আনতে লাগল গোলাবারুদ। এমনকি বিমান পর্যন্ত নিয়ে এল কেউ কেউ। একজন পাইলট, যাঁকে মাত্র পনেরো ঘণ্টা আগে বিমানবাহিনীতে ভর্তি করা হয়েছিল, তিনিও বিধ্বস্ত বিমানের খুচরো যন্ত্রাংশ জড়ো করে একটি বিমান তৈরি করে ফরাসি জাতির প্রতিরোধ সংগ্রামে অভূতপূর্ব অবদান রাখেন।
এদিকে দ্য গলকে দমন করার জন্য ১৯৪০ সালে ফ্রান্সের সামরিক আদালতে এক বিচারের প্রহসন অনুষ্ঠিত হয়। এই বিচারে দ্য গলকে দেওয়া হয় মৃতুদণ্ড। জার্মান বাহিনী তাঁর ঔদ্ধত্যে খেপে গিয়ে ঘোষণা করে, যে-ব্যক্তি জেনারেল দ্য গলকে জীবিত অথবা মৃত অবস্থায় ধরে এনে দিতে পারবে, তাকে ৪০,০০০ পাউন্ড পুরস্কার প্রদান করা হবে।
কিন্তু কোটি কোটি ফরাসি, যারা জার্মান দখলদার বাহিনীর অত্যাচারী শাসনে ধুঁকে ধুঁকে মরছিল, তাদের কাছে দ্য গলই ছিলেন একমাত্র স্বাধীনতার প্রতীক, তাঁদের ত্রাণকর্তাতুল্য বীরপুরুষ। ফরাসি জনগণ গভীর নিরাশার অন্ধকারে তাঁর মাধ্যমেই দেখতে পেলেন আশার আলোর বিচ্ছুরণ।
দ্য গলই ছিলেন একমাত্র ফরাসি সমরনায়ক, যিনি বর্বর জার্মান বাহিনীকে চিনতে পেরেছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধের শেষে চার বছরের রক্তাক্ত যুদ্ধের পর এবং পঞ্চাশ লক্ষ মানবসন্তানের রক্ত নিয়ে হোলি খেলার পর ১৯১৮ সালের ১১ নভেম্বর পরাজিত জার্মান বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছিল।
ফ্রান্স যদি শার্ল দ্য গলের পরামর্শমতো মাত্র ১০ ডিভিশন সাঁজোয়া বাহিনী গঠন করত, তা হলে হিটলারের দু ডিভিশন সাঁজোয়া বাহিনীর পক্ষে রাইনল্যান্ডে অবতরণ করা শুধু দুরূহই হতো না, অস্ট্রিয়া এবং পোল্যান্ড আক্রমণ করার সাহসও হতো না।
দ্য গলই প্রথম বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যৎ যুদ্ধ কেমন হবে। তিনি ‘ভবিষ্যৎ সেনাবাহিনী’ নামে একটি পুস্তক রচনা করে তাতে তাঁর নিজের এই দূরদৃষ্টির কথা লিখে জানান। তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী ছিল : দ্রুতগতিই হবে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের নিয়ামক।
এসময় ফরাসি সেনাবাহিনীর পদানত কর্তাব্যক্তিরা জার্মান ও ফরাসি সীমান্তে লোহা ও পাথর দিয়ে একটি প্রাচীর গড়ে তোলেন। তাকেই তাঁরা দুর্ভেদ্য দুর্গ বলে মনে করতেন। আসলে তাঁরা প্রথম মহাযুদ্ধের গতিপ্রকৃতির অনুসরনেই ভবিষ্যৎ যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
কিন্তু দ্য গল সামরিক কর্তাব্যক্তিদের হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেছিলেন, ভবিষ্যৎ যুদ্ধে এই প্রাচীন পন্থায় তৈরি প্রাচীর কোনো কাজেই আসবে না। তিনি আরও বলেছিলেন, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের দুশো মাইলের মধ্যে কোনো প্রাচীর নেই। জার্মানি বেলজিয়াম আক্রমণ করে এই পথ দিয়েই ফ্রান্সে ঢুকবে।
নেপোলিয়নের যুগে এক মিনিটে দুবারের বেশি বন্দুকের গুলি ছোড়া যেত না। কিন্তু সে যুগ এখন অনেক পেছনে। ভবিষৎ যুদ্ধে পেট্রোলচালিত ইঞ্জিন, সাঁজোয়া গাড়ি, ট্যাংক ও বিমান বাহিনীই হবে মুখ্য শক্তি।
কিন্তু তখনকার ফরাসি সমরনায়কেরা দ্য গলের এই চিন্তাধারাকে উদ্ভট ও আজগুবি বলে বিদ্রূপ করেছিলেন। ফরাসি জেনারেল পঁতে ভিগাঁ দ্য গলের রচিত ওই গ্রন্থকে গাঁজাখুরি এবং ফরাসি বাহিনীর জন্য ক্ষতিকর বলে নিন্দা করেন।
অথচ জার্মান বাহিনী দ্য গলের এই আধুনিক চিন্তাধারাকেই কাজে লাগায় এবং সেই মোতাবেক আধুনিক পদ্ধতিতে তাদের সেনাবাহিনীকে সজ্জিত করে এবং তার সুফলও ভোগ করে।
দ্য গল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় মাত্র দু ডিভিশন সৈন্য নিয়ে ৪০ দিনের মধ্যে ৫,০০০টি ট্যাংক ও তিন হাজার বিমানের সাহায্যে জার্মান মদদপুষ্ট ৫০ লক্ষ ফরাসি পদাতিক বাহিনীকে পরাজিত করে ফরাসি প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাসে এক নজিরবিহীন সাফল্যের সূচনা করেন।
মহান এই সমরনায়কের জন্ম ১৮৯০ সালের ২২ নভেম্বর। একজন ঝানু সমরনায়ক হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন ভারি লাজুক প্রকৃতির মানুষ। তিনি এত লাজুক ছিলেন যে, ভালো করে কারও সাথে কথা বলতে কিংবা মিশতেও পারতেন না। তাই অনেকে ভুল করে তাঁকে দাম্ভিক বলে মনে করতেন। তাঁর মা একবার বলেছিলেন, ছেলেটা এত ঠাণ্ডা যে বরফের বাক্সে ওর স্থান হওয়া উচিত ছিল।
তখন তিনি কেবল সামরিক বিভাগে চাকরি নিয়েছেন ক্যাপ্টেন পদে। যৌবনের জোয়ার সারা অঙ্গে। সেই তখনকারই একদিনের ঘটনা। তিনি গিয়েছিলেন প্যারিসের আর্ট গ্যালারিতে। সেখানে এক সুন্দরী তরুণীর সাথে তার দেখা। তাঁর চোখ-ঝলসানো রূপ দেখে তারতো ভিরমি খাবার যোগাড়। মেয়েটিকে চায়ের আমন্ত্রণ জানাতে সেদিন তাঁকে যে সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছিল, এমন সাহসের মহড়া তাঁকে কোনো রণাঙ্গনেও দিতে হয়েছিল কি না, সন্দেহ। তারপর চায়ের টেবিলেও তিনি এতখানি ঘাবড়ে গিয়েছিলেন যে, তাঁর চায়ের পেয়ালাটি মেয়েটির গায়ের ওপর পড়ে গিয়েছিল। যা হোক, এই মেয়েটির সাথে দীর্ঘ পাঁচ বছর মেলামেশার পর তার সঙ্গেই তিনি বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হন।
প্রথম মহাযুদ্ধের সময় তিনি তিনবার আহত হন। তৃতীয়বার আহত অবস্থায় যখন তিনি বেহুঁশ হয়ে পড়েন, তখন জার্মান বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। তিনি পাঁচবার বন্দি হন, কিন্তু পাঁচবারই জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন। একবার একটিমাত্র ছুরির সাহায্যে গর্ত খুঁড়ে তিনি জেল থেকে পালিয়েছিলেন।
১৯৪৫ সালের মার্চ মাসে পশ্চিম ইউরোপে পুরোদমে যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে যায়। ইংরেজ ও মার্কিন বাহিনীর পাশাপাশি দ্য গল পরিচালিত জাতীয়তাবাদী ফরাসিরাও ফ্রান্সে অবতরণ করে। তাঁবেদার বাহিনী তাদের সামনে দাঁড়াতেই পারল না।
জেনারেল দ্য গল স্বাধীন ফ্রান্সের নতুন সরকার গঠন করলেন। তা ইংল্যান্ড ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের অনুমোদনও লাভ করল।
মার্শাল পেতেঁকে দেশদ্রোহের অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো।
জেনারেল দ্য গল ১৯৪৪ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ১৯৪৬ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এরপর ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত অন্তত কুড়িজন প্রধানমন্ত্রী হন। এভাবে বারবার প্রধানমন্ত্রী পরিবর্তিত হওয়ায় দেশবাসী ১৯৫৮ সালে দ্য গলকে আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে।
এরপর তিনি ১৯৫৯ সালের ২১ ডিসেম্বর ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন।
১৯৭০ সালে ফ্রান্সের এই মহান রাষ্ট্রনায়কের জীবনাবসান ঘটে।
‘দি মেমোরিজ অব হোপ’ (The Memories of Hope) নামে তিনি তাঁর রোমাঞ্চকর জীবনের কাহিনীও লিখতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু শেষ করতে পারেননি। প্রথম খণ্ড প্রকাশের একমাসের মধ্যেই তিনি মারা যান।