শার্লক হোমস অ্যারাইভস টু লেট

শার্লক হোমস অ্যারাইভস টু লেট

অনুবাদ: খালেদ নকীব

“ব্যাপারটা আসলেই অসাধারণ, ভেলমোঁ, আর্সেন লুপাঁর চেহারার সাথে কী অদ্ভুত মিল আপনার!”

“আপনি কীভাবে বুঝলেন?”

“ওহ! আর সবার মতোই, ফটো দেখে। দুটো হুবুহু এক না হলেও প্রতিটি ছবিই এমন, মানসপটে একটা ছাপ রেখে যায়… অনেকটা আপনার মতো।”

অসহিষ্ণুতার ছাপ পড়ল হোরেস ভেলমোঁর অভিব্যক্তিতে।

“আসলেই তাই, প্রিয় ডিভান। আর বিশ্বাস করুন, আপনি-ই প্রথম নন যিনি এই ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন।”

“বিষয়টা এতটাই চমকপ্রদ যে,” বলতে লাগল ডিভান,”আমার কাজিন ডেস্টিভান আপনার ব্যাপারে সুপারিশ না করলে এবং আপনার মতো সেলিব্রিটি আর্টিস্টের চমৎকার মেরিন ভিউর ভক্ত না হলে, নিশ্চিত ভাবেই আপনার ডিয়েপে উপস্থিতির ব্যাপারে পুলিশকে সতর্ক করতাম।”

সোল্লাসে বক্তব্যটা গ্রহণ করল সবাই। শ্যাতো দ্য টিবারমেসনিল (Chateau de Thibermesnil) এর সুবিশাল ডাইনিং হলে জমায়েত হয়েছে সবাই। ভেলমোঁ ছাড়াও আরও হাজির হয়েছে গির্জার প্রিস্ট, ফাদার জেলি, আশেপাশের এলাকায় সেনা কোয়ার্টারে থাকা ডজন খানেক সেনা কর্মকর্তা, যারা ব্যাংকার জর্জ ডিভান এবং তার মায়ের আমন্ত্রণে উপস্থিত হয়েছেন এখানে। এবার মন্তব্য করলেন অফিসারদের একজন:

“আমার জানামতে প্যারি-হার্ভ এক্সপ্রেসে আর্সেন লুপাঁর দুর্ধর্ষ কর্মকাণ্ডের পর পুলিশকে তার নিখুঁত বিবরণ সরবরাহ করা হয়েছে।”

“আমারও সেরকমই ধারণা,” বলল ডিভান। “সেটা তিন মাস আগের ঘটনা; এবং তার এক সপ্তাহ পরে, ক্যাসিনোতে আমাদের বন্ধু ভেলমোঁর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল। পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার আমন্ত্রণ গ্রহণ করে তিনি আমাকে সম্মানিত করেছেন। সেই সাথে আবারও সম্মানিত করেছেন আজকের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটা দিনে-বরং বলা ভালো আজকের মতো একটা রাতে এখানে উপস্থিত হয়ে।”

এই কথায় আরেক দফা উল্লাস প্রকাশ করল অতিথিরা। তারপর প্রবেশ করল প্রাচীন ‘হল অভ দি গার্ডস’-এ: উঁচু ছাতঅলা বিশাল এক কক্ষে। ট্যুর গিয়াম তথা উইলিয়াম’স টাওয়ারের নিচের অংশের পুরোটাই দখল করে রেখেছে কক্ষটা। বহু শতাব্দী ধরে টিবারমেসনিলের লর্ডদের সংগৃহীত অতুলনীয় সব সম্পদ রাখা আছে এই প্রাচীন কক্ষে। যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন সিন্দুক, ক্রিডেনস (এক ধরনের সাইড টেবিল), অ্যানডাইরনস (ফায়ারপ্লেসের ভেতরের ধাতব ফ্রেম) আর ঝাড়বাতি। পাথুরে দেওয়ালে ঝুলানো আছে রাজকীয় ট্যাপেস্ট্রি। চারটি জানালার বর্ধিত অংশে পেতে রাখা হয়েছে বেঞ্চ। গথিক ধরনের জানালাগুলোতে সিসার ফ্রেমে আটকানো আছে ছোটো ছোটো রঙিন কাচের শার্সি। বাঁ দিকের দরজা আর জানালার মাঝে রয়েছে রেনেসাঁ স্টাইলের সুবিস্তৃত বুককেস। পেডিমেন্টে (অট্টালিকার সম্মুখভাগের উপরিদেশে ত্রিকোণ গঠন বিশেষ) সোনালি হরফে লেখা ‘টিবারমেসনিল’ আর তার নিচে গর্বিত পারিবারিক বচন: ‘ফ্যাসে ক্যু ভ্যু’ (যা ইচ্ছে কর)। অতিথিরা সিগার ধরাতেই আলাপ শুরু করল ডিভান।

“এবং কথাটা স্মরণ রাখবেন, ভেলমোঁ, নষ্ট করার মতো সময় নেই আপনার হাতে; সত্যি বলতে কী, আজ রাতটাই আপনার জন্য শেষ সুযোগ।”

“তা কেন?” জানতে চাইল চিত্রকর। কথাটাকে সে রসিকতা হিসেবেই ধরে নিয়েছে। জবাব দেওয়ার উপক্রম করতেই ডিভানকে কথা বলতে নিষেধ করল তার মা। তবে অনুষ্ঠানের উত্তেজনা আর অতিথিদের তীব্র আগ্রহ কথা বলতে উৎসাহিত করল ডিভানকে।

“আশ্চর্য!” বিড়বিড় করে বলল সে। “এটা এখনই বলতে পারি। তাতে কোনো রকম ক্ষতি হবে না।’

আরও এগিয়ে এলো অতিথিরা। সন্তুষ্ট চিত্তে কথা বলা শুরু করল ডিভান, যেন গুরুত্বপূর্ণ কোনো ঘোষণা দিচ্ছে।

“আগামীকাল অপরাহ্ চারটায় হাজির হচ্ছেন বিখ্যাত ইংরেজ ডিটেকটিভ শার্লক হোমস-যার কাছে কোনো রহস্যই গোপন থাকতে পারে না; শার্লক হোমস, যাকে তামাম বিশ্বে রহস্য সমাধানের ক্ষেত্রে প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব মনে করা হয়, যার কথা শুনলে মনে হয়, কোনো রোমান্টিক ঔপন্যাসিকের তৈরি করা চরিত্র, সেই শার্লক হোমস আসছেন আমার অতিথি হয়ে!”

ঘোষণা শেষ হতে না হতেই উৎসুক অতিথিদের একগাদা প্রশ্নবাণের মুখোমুখি হলো ডিভান।

“শার্লক হোমস কি আসলেই আসছেন?”

“বিষয়টা কি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ?”

“আর্সেন লুপাঁ কি আসলেই কি এই এলাকায় আছে?”

“আর্সেন লুপাঁর দৌরাত্ম্য আর বেশি দিন চলবে না। ব্যারন কাহন-এর প্রাসাদে ডাকাতি ছাড়াও মন্টিনি, গ্রাচেট আর ক্র্যাসভিল-এর চুরির ঘটনার ব্যাপারেও তাকে দায়ী করা হয়।”

“ব্যারন কাহর্নের মতো সে কি আপনার কাছেও কোনো হুমকি দেওয়া বার্তা পাঠিয়েছে?”

“সেক্ষেত্রে কী হতে পারে?”

“আমি আপনাদের দেখাচ্ছি,” বলল ডিভান। তারপর উঠে দাঁড়াল। এগোল বুককেসের একটা তাক লক্ষ্য করে। স্তূপ হয়ে থাকা দু’সারি বইয়ের মাঝের ছোট্ট একটা ফাঁকা জায়গার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল অতিথিদের।

“ওখানে একটা বই ছিল: ষোড়শ শতাব্দীর একটা বই-’ক্রনিক ডি টিবারমেসনিল’, সাবেক সামন্ত দুর্গের জায়গায় ডিউক রলো এই ক্যাসেল নির্মাণের পর থেকে এর পুরো ইতিহাস লিপিবদ্ধ ছিল সেখানে। বইটিতে তিনটি খোদাই করা প্লেট ছিল; যার একটায় চিত্রিত ছিল পুরো ক্যাসেলের দৃশ্য, আরেকটায় পুরো বিল্ডিংয়ের প্ল্যান আর তৃতীয়টায় ছিল, এটার দিকেই আপনাদের বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করছি; তৃতীয়টি ছিল ভূগর্ভস্থ প্যাসেজের স্কেচ। যার প্রবেশ পথ ছিল র‍্যামপার্টের (দুর্গপ্রাচীর) প্রথম লাইনের বাইরে, আর অপর প্রান্ত ছিল এখানে, ঠিক এই কক্ষে। সেই বইটাই উধাও হয়ে গেছে এক মাস আগে।”

“হায় খোদা!” বলে উঠল ভেলমোঁ। “এটাতো খুবই খারাপ কথা। কিন্তু মনে হয় না শার্লক হোমসকে ডাকার মতো কোনো কারণ এটা।”

“ঠিক, তাকে ডাকার জন্য শুধু এই কারণটাই যথেষ্ট নয়। তবে আরেকটা ঘটনা ঘটেছে যার কারণে এই বই উধাও হওয়ার বিষয়টা আরও তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এই বইয়ের আরেকটা কপি প্যারিসের ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ছিল। ভূগর্ভস্থ প্যাসেজের বিস্তারিত বর্ণনার ক্ষেত্রে বই দুটোর মধ্যে কিছুটা ভিন্নতা ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, দুটো বইতেই ড্রইং আর টিকা সন্নিবেশিত ছিল। দুটো বই-ই হাতে লেখা এবং ঝাপসা হয়ে গেছে কালির আঁচড়। বিষয়গুলোর ব্যাপারে আমি আগে থেকেই ওয়াকিবহাল এবং সাথে সাথে এটাও জানতাম যে, প্যাসেজের সঠিক লোকেশন বের করতে হলে অবশ্যই দুটো বইয়ের সাহায্য লাগবে। এখন বিষয় হলো, আমার বইটা অদৃশ্য হওয়ার পরদিন-ই কোনো এক পাঠক ন্যাশনাল লাইব্রেরির বইটাও নিয়ে যায়।”

অতিথিদের মধ্যে থেকে নানান ধরনের বিস্ময়সূচক ধ্বনি শোনা গেল।

“বিষয়টা আসলেই গুরুতর মনে হচ্ছে,” বলল অতিথিদের একজন।

“সে যা-ই হোক, পুলিশ বিষয়টা তদন্ত করে দেখেছে এবং যথারীতি কোনো ক্লু খুঁজে পায়নি।”

“আর্সেন লুপাঁ সম্পৃক্ত থাকলে পুলিশ সেখানে কখনোই কোনো ক্লু খুঁজে পায় না।’

“একদম ঠিক। আর সেজন্যই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি শার্লক হোমসের শরণাপন্ন হওয়ার। তিনি জানিয়েছেন, আর্সেন লুপাঁর মুখোমুখি হওয়ার জন্য তিনি তৈরি এবং অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছেন।”

“আর্সেন লুপাঁর কী সৌভাগ্য!” বলে উঠল ভেলমোঁ। “কিন্তু যদি আমাদের ‘জাতীয় চোর’, যেমনটা সবাই তাকে বলে, তার যদি আপনার প্রাসাদে কোনো হীন উদ্দেশ্য না থাকে, তবে শার্লক হোমসের এই ট্রিপটা পুরোপুরি ভেস্তে যাবে।”

“আরেকটা বিষয়ও তাকে আকৃষ্ট করতে পারে, যেমন ভূগর্ভস্থ প্যাসেজটা আবিষ্কার করা।”

“কিন্ত একটু আগেই না বললেন প্যাসেজের একটা প্রান্ত র‍্যামপার্টের বাইরে, আর আরেকটা প্রান্ত শেষ হয়েছে এখানে?”

“হ্যাঁ, কিন্তু সেটা এই কক্ষের কোন জায়গায়?”

“চার্টে থাকা প্যাসেজ নির্দেশনাকারী লাইনটি এখানে এসে শেষ হয়েছে, যেখানে ছোট্ট একটা বৃত্তের মাঝে লেখা আছে ‘টিজি’, যা নিঃসন্দেহে ট্যুর গুইয়াম’-এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এখন কথা হলো টাওয়ারটা গোলাকার, তাই নিশ্চিত করে কারও পক্ষে কী বলা সম্ভব প্যাসেজটা কোথায় টাওয়ারটাকে স্পর্শ করেছে?”

দ্বিতীয় সিগারে অগ্নিসংযোগ করল ডিভান, সেই সাথে একটা গ্লাসে নিজের জন্য ঢেলে নিল বেনেডিক্টিন। ওদিকে আগত অতিথি বৃন্দ প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলেছে তাকে। তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে পেরে মনে মনে সন্তুষ্ট বোধ করছে ডিভান। কথা বলা অব্যহত রাখল সে :

“হারিয়ে গেছে সেই গোপন তথ্যটা। কেউ-ই এটার হদিস জানে না। কিংবদন্তি আছে, এই গোপন তথ্যটা প্রজন্মান্তরে হস্তান্তরিত হতো: মৃত্যুশয্যায় পিতা তার পুত্রকে বলে যেত গোপন তথ্যটা। আর এই ধারাটা অব্যহত ছিল এই বংশের শেষ প্রদীপ, জেফ্রয় পর্যন্ত: ফরাসি বিপ্লবের সময়, উনিশ বছর বয়সে যার শিরশ্ছেদ করা হয়।”

“সেটাও তো এক শতাব্দীরও আগের কথা। তারপর কেউ না কেউ সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে নিশ্চয়ই?”

“হ্যাঁ, কিন্তু তারা সবাই এটা খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়েছে। ক্যাসেলটা কেনার পর আমিও ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছি, ফলাফল যথারীতি হতাশাব্যঞ্জক। আপনাদের অবশ্যই একটা কথা খেয়াল রাখতে হবে যে, এই টাওয়ারটা পানি পূর্ণ পরিখা দিয়ে ঘেরা। শুধু ব্রিজ দিয়ে-ই এটা ক্যাসেলের সাথে সংযুক্ত। আর সে কারণেই প্যাসেজটার অবস্থান হতে হবে পুরোনো পরিখাটার নিচে। ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে যে বইটা ছিল, সেখানকার প্ল্যানে উল্লেখ ছিল, আটচল্লিশটা সিঁড়ির ধাপ ভেঙে নামতে হতো প্যাসেজে, যা থেকে ধারণা করা যায়, এর গভীরতা দশ মিটারেরও বেশি। বুঝতেই পারছেন, রহস্যটা এই কক্ষের চারদেওয়ালের মাঝেই রয়েছে। তবে এগুলো ভেঙে রহস্য উদ্ঘাটন করার কোনো চিন্তাভাবনা আমার নেই।“

“এটা কোথায়, তা জানার আর কোনো উপায় নেই?”

“নেই।”

“মঁসিয়ে ডিভান, আমাদের মনোযোগ দুটো উদ্ধৃতির দিকে ফেরানো উচিত,” পরামর্শ দিল ফাদার জেলিস।

“ওহ!” হাস্যোজ্জ্বল অভিব্যক্তি নিয়ে বলল মঁসিয়ে ডিভান। “আমাদের বিজ্ঞ ফাদার ক্যাসেলের আর্কাইভে থাকা ধুলোমলিন স্মৃতিচারণ গ্রন্থগুলো পাঠ করার ব্যাপারে বিশেষ উৎসাহী। টিবারমেসনিলের সাথে সম্পৃক্ত প্রতিটি বিষয়-ই তাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। তবে তিনি যে দুটো উদ্ধৃতির কথা বলতে চাইছেন, তা রহস্যকে কেবল আরও ঘনীভূত করেছে। তিনি কোথাও পড়েছেন যে, ফ্রান্সের দুই রাজা এই ধাঁধার উত্তর জানতেন।”

“ফ্রান্সের দুই রাজা! কোন দু’জন?”

“চতুর্থ হেনরি আর ষোড়শ লুই। কিংবদন্তি আছে যে, ব্যাটেল অভ আর্কস- এর প্রাক্কালে এই ক্যাসেলে এক রাত কাটিয়েছিলেন চতুর্থ হেনরি। রাত এগারোটায় ভূগর্ভস্থ এই প্যাসেজ দিয়ে নরম্যান্ডির সবচেয়ে সুন্দরি নারী লুইস দ্য ট্যাংকারভিলকে নিয়ে আর্সেন ডিউক এডগার্ড। গোপন পথের হদিসও রাজাকে জানিয়ে দেন তিনি। এই গোপন তথ্যটা রাজা বলেছিলেন তার মন্ত্রী সালিকে, যিনি পরবর্তীতে এই ঘটনাটা লিপিবদ্ধ করেন তার বই ‘রয়েলস ইকোনমিস ডিটা’-তে। যদিও সালি সেটার বিস্তারিত বিবরণ না দিয়ে একটি হেঁয়ালিপূর্ণ বাক্য সংযুক্ত করেন: নড়ছে যে মৌমাছি চোখ ফেরাও তার দিকে, অন্য চোখ যাবে নিয়ে ঈশ্বরের কাছে – (‘Turn one eye on the bee that shakes, the other eye will lead to God!’-)”

ক্ষণিকের জন্য নীরবতা নামল কক্ষে। তারপর হেসে উঠে কথা বলতে শুরু করল ভেলমোঁ:

“নিশ্চিত ভাবেই এটা মূল বিষয়টার ওপর কোনো রকম আলোকসম্পাত করে না।”

“তা করে না, তবে ফাদার জেলিসের দাবি, সালি এই রহস্যের চাবিকাঠি এই হেঁয়ালিপূর্ণ বাক্যের মধ্যেই লুকিয়ে রেখেছেন।”

“এটা একটা উর্বর মস্তিস্কপ্রসূত তত্ত্ব,” বলল ভেলমোঁ।

“হ্যাঁ, এটি তেমন কিছু না-ও হতে পারে। এই রহস্য সমাধানে আদৌ কোনো ভূমিকা রাখতে পারছে বলে তো মনে হচ্ছে না।”

“আর ষোড়শ লুইয়ের ক্ষেত্রেও কি কোনো লেডির আগমন উপলক্ষে খুলে গিয়েছিল প্যাসেজের দরজা?”

“আমি জানি না।” জবাব দিল মঁসিয়ে ডিভান। “কেবল এটুকু বলতে পারি ১৭৮৪-এর কোনো এক রাতে তিনি এই প্রাসাদে থেমেছিলেন, এবং লুভ-এ পাওয়া বিখ্যাত আয়রন কাসকেট-এ তার হস্তলিখিত একটা কাগজ পাওয়া যায়, যেখানে লেখা ছিল : ‘টিবারমেসনিল ৩-৪-১১’।”

হো হো করে হেসে উঠল হোরেস ভেলমোঁ। “যাক, শেষ পর্যন্ত তাহলে জাদুর চাবিটা পাওয়া গেল। তা সেই ভদ্রলোক কোথায়, যিনি এই চাবিটা দিয়ে সেই অদৃশ্য তালাটা খুলতে পারবেন?” বলল সে।

“যত খুশি হাসুন, মঁসিয়ে,” বলল ফাদার জেলিস, “তবে আমি নিশ্চিত রহস্যের সমাধান ওই বাক্য দুটোর মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আর কোনো একদিন কেউ হয়তো সেটার অর্থ বের করতে করতে পারবে।”

“শার্লক হোমস-ই সেই লোক,” বলল মঁসিয়ে ডিভান, “যদি না আর্সেন লুপাঁ তার চেয়ে এগিয়ে থাকে। আপনার কী ধারণা, ভেলমোঁ?”

উঠে দাঁড়াল ভেলমোঁ। ডিভানের কাঁধে হাত রেখে ঘোষণা করল:

“আমার ধারণা, আপনার বই আর ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে থাকা বইতে যে তথ্য ঘাটতি ছিল, তার গুরুত্বপূর্ণ আর বিশদ বিবরণ এখন আপনারা সরবরাহ করেছেন। এজন্য আপনাদের ধন্যবাদ।”

“কী সেটা?”

“সেই হারানো চাবি। এখন সেটা আমি পেয়ে গেছি। এক্ষুনি আমি কাজে নেমে পড়তে পারি,” বলল ভেলমোঁ।

“নিশ্চয়ই,” হাসিমুখে বলল ডিভান, “একটা মিনিট নষ্ট করাও ঠিক হবে না।”

“একটা সেকেন্ডও না,” জবাবে বলল ভেলমোঁ। “আজ রাতে, শার্লক হোমস পৌঁছানোর আগে, অবশ্যই আপনার ক্যাসেল লুটে নিব আমি।”

“আপনার হাতে একদমই সময় নেই। ওহ! যা বলছিলাম, আজ রাতে আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।”

“ডিয়েপে?”

“হ্যাঁ। আমি মঁসিয়ে এবং মাদাম ড্যানড্রল আর তাদের পরিচিতা এক তরুণীকে আনতে যাচ্ছি।ওরা আজ মাঝরাতের ট্রেনে আসবে।” বলল ডিভান, তারপর অফিসারদের লক্ষ করে বলল, “জেন্টেলম্যান, আশা করি আপনাদের সবার সাথে আগামীকাল প্রাতরাশের সময় আবার দেখা হবে।”

সাদরে গৃহীত হলো ডিভানের আমন্ত্রণ। একে একে বিদায় নিল অতিথিরা। তার খানিক পরেই একটা মোটরে চড়ে ডিয়েপের দিকে দ্রুত এগোল ডিভান আর ভেলমোঁ। আর্টিস্টকে একটা ক্যাসিনোর সামনে নামিয়ে দিয়ে রেল স্টেশনের দিকে এগোল ডিভান। বারোটায় তার বন্ধুরা নেমে এলো ট্রেন থেকে। আরও আধ ঘণ্টা পরে মোটর গাড়িটা প্রবেশ করল ক্যাসেলে। হালকা সাপার সেরে রাত একটায় তারা নিজ নিজ কক্ষে আশ্রয় নিল বিশ্রামের জন্য। সব আলো নিভে গেল। আঁধার আর নীরবতায় ঢাকা পড়ল পুরো ক্যাসেল।

***

মেঘের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো চাঁদ, রুপালি আলোয় উদ্ভাসিত হলো ড্রইংরুম। তবে সেটা শুধু ক্ষণিকের তরে। আবারও মেঘের ভেতর মুখ লুকাল চাঁদ, আঁধার আর নৈঃশব্দ ঘিরে ধরল চারদিক। জমাট বাঁধা নৈঃশব্দ্যের সাথে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে ঘড়ির টিকটিক আওয়াজ। দুটো বাজার ঘণ্টাধ্বনি করল দেওয়াল ঘড়ি। তবে বিরাম নেই ঘড়ির কাঁটার। তিনটা বাজার সময় সঙ্কেত জানালো গ্র্যান্ডফাদার ক্লক।

আচমকাই ক্লিক করে একটা শব্দ হলো: অনেকটা পাসিং ট্রেনকে সতর্ক করা সিগনাল ডিস্ক পরিবর্তন করার মতো। আলোর একটা সরু ধারা ঘুরে বেড়াতে লাগলো ঘরের প্রতিটি কোণে, যেন পেছনে আলোর ট্রেইল রেখে ছুটে চলেছে কোনো তীর। আর সেই আলো আসছে বুককেসের পেডিমেন্টকে ধরে রাখা কলামের খাঁজের আড়াল থেকে। ক্ষণিকের জন্য জ্বলজ্বলে রুপালি চাকতির মতো আলোটা স্থির হলো বিপরীত দিকের প্যানেলে। তারপর অনেকটা যেন অপরাধী চোখে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো প্রতিটি ছায়া। সামান্য সময়ের জন্য নিভে গেল আলো, সেই সাথে সশব্দে ভিত সহ ঘুরে গেল বুককেসের একটা অংশ, আর ভল্টের মতো একটা প্রবেশপথ উন্মুক্ত হলো।

বৈদ্যুতিক লণ্ঠন হাতে এক ব্যাক্তি প্রবেশ করল ভেতরে। তাকে অনুসরণ করে প্রবেশ করল আরেকজন, হাতে রশির বান্ডিল আর একগাদা যন্ত্রপাতি। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রুমটা পর্যবেক্ষণ করল দলনেতা। কান পেতে শোনার চেষ্টা করল কোনো সন্দেহজনক আওয়াজ। তারপর নির্দেশ দিলো, “অন্যদের ডাকো। “

আরও আট জন লোক প্রবেশ করল ভেতরে; প্রত্যেকেই বলিষ্ঠ, চেহারায় দৃঢ় সংকল্পের ছাপ। ভেতরে ঢুকেই আসবাবপত্র সরানোর কাজ শুরু করল তারা। দ্রুততার সাথে একটার পর একটা আসবাব পরীক্ষা করছে আর্সেন লুপাঁ, সঙ্গীদের নির্দেশ দিচ্ছে কোনটা কোনটা নিতে হবে। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে টানেলের মুখে। নির্দয় ভাবে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে টানেলের উদরে। একে একে ছটা আর্মচেয়ার, ছটা চতুর্থ লুই চেয়ারের ঠাঁই হলো টানেলের ভেতর। তার সাথে আরও যোগ হলো একগাদা অবুসন ট্যাপেস্ট্রি, কিছু মোমদানি, ফ্র্যাগোনার্ড আর ন্যাটিয়া-র পেইন্টিংস, হুডন-এর তৈরি আবক্ষ ভাস্কর্য, আর কিছু ছোটো ছোটো মূর্তি। দুর্দান্ত একটা সিন্দুক আর অপূর্ব একটা ছবির কাছে কিছুক্ষণ থেমে থেকে দীর্ঘশ্বাস ফেলল লুপাঁ:

“আফসোস, এটা খুব বেশি ভারী… আর এটা খুব বেশি রকম বড়ো।“

চল্লিশ মিনিটের মধ্যেই প্রায় খালি হলো ঘরটা। এমন সুশৃঙ্খল আর প্রায় নিঃশব্দে কাজটা সারা হলো, যেন কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্যাক করা হয়েছে জিনিসপত্র।

“তোমাকে আর ফিরে আসতে হবে না,” শেষ লোকটা টানেলে নামতেই তাকে লক্ষ্য করে বলল লুপাঁ, “বুঝতে পেরেছ তো অটোভ্যান লোড হওয়া মাত্রই রোকফোর্ট-এর খামারবাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে।”

“আর আপনি, প্যাট্রন?”

“মোটর সাইকেলটা রেখে যেয়ো আমার জন্য।”

শেষ লোকটি চলে যেতেই বুককেসের অংশটাকে ঠেলে আগের অবস্থানে নিয়ে এলো আর্সেন লুপাঁ, সতর্কতার সাথে মুছে ফেলল লোকজনের পায়ের ছাপ। তারপর পর্দা সরিয়ে প্রবেশ করল একটা গ্যালারিতে। এই গ্যালারিটাই টাওয়ার আর ক্যাসেলের একমাত্র সংযোগস্থল। গ্যালারির কেন্দ্রে থাকা একটা গ্লাস কেবিনেট বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করল লুপাঁর। মূল্যবান সংগ্রহে ঠাসা কেবিনেটের ভেতরটা। যার মধ্যে রয়েছে, ঘড়ি, নস্যির কৌটা, আংটি, আর দুষ্প্রাপ্য ক্ষুদ্রাকার প্রতিকৃিতি। ছোটো একটা যন্ত্রের সাহায্যে তালাটা ভেঙে ফেলল সে। পরমানন্দে হাতড়াতে লাগল নিখুঁত কাজের স্বর্ণ আর রৌপ্য নির্মিত জিনিসগুলো।

সাথে বড়ো একটা লিলেনের ব্যাগ নিয়ে এসেছে সে। এই ধরনের জিনিসপত্র নেওয়ার জন্য বিশেষ ভাবে তৈরি করা হয়েছে ব্যাগটা। দ্রুত হাতে ব্যাগটা পূর্ণ করল সে। নিজের কোট, ওয়েস্টকোট আর ট্রাউজারের পকেট পূর্ণ করে কেবল হাত বাড়িয়েছে একটা মুক্তোর থলের দিকে, তখনই কানে এলো হালকা একটা শব্দ। কান পাতলো লুপাঁ। না, ভুল শুনেনি সে। এখনও পাওয়া যাচ্ছে আওয়াজটা। আর তখনই মনে পড়ল, গ্যালারির অন্য প্রান্তে একপ্রস্থ সিঁড়ি চলে গেছে খালি একটা অ্যাপার্টমেন্টের দিকে। তবে আজ রাতে মনে হয় স্থানটা ফাঁকা নয়, মঁসিয়ে ডিভান ডিয়েপ থেকে যাদের নিয়ে এসেছে, তাদের সাথে থাকা সেই তরুণী অতিথি সম্ভবত রয়েছে সেখানে।

সাথে সাথে হাতের লণ্ঠনটা নিভিয়ে ফেলল সে।

সিঁড়ির শেষ ধাপের দরজাটা খুলে যেতেই মৃদু আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল গ্যালারিটা। তবে তার আগেই জানালার বর্ধিতাংশের কাছে আড়াল নিয়েছে সে। পর্দার আড়ালে থাকায় দেখতে না পেলেও অনুভব করছে লুপাঁ, সতর্কতার সাথে ধাপ বেয়ে নেমে আসছে তরুণী। মনে মনে আশা করছে ও, তরুণী যেন আর বেশিদূর অগ্রসর না হয়। তবে আশাটা পূর্ণ হলো না লুপাঁর। রুমের বেশ কিছুটা ভেতরে ঢুকে পড়ল তরুণী। সেই সাথে অস্ফুটে চিৎকার করে উঠল। কোনো সন্দেহ নেই, ভাঙা কেবিনেটটা দেখে ফেলেছে সে।

আবারও সামনের দিকে এগোতে লাগল অতিথি। লুপাঁর আশ্রয়স্থল, জানালাটার কাছাকাছি চলে এসেছে সে। তার পারফিউমের সুবাস পাচ্ছে লুপাঁ। মনে হচ্ছে, কান পাতলে বুকের ধুকপুকানির শব্দও শুনতে পাবে। সে এতটা কাছ দিয়ে এগোল যে, জানালার পর্দায় ঘষা খেল তার স্কার্ট। অনুভব করতে পারছে লুপাঁ, কারও উপস্থিতি সন্দেহ করছে তরুণী। ‘ভয় পেয়েছে সে। চলে যাবে এখান থেকে, মনে মনে বলল লুপাঁ। তবে আবারও ভুল হলো ধারণা। চলে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই তার মাঝে। মোমবাতি ধরা হাতটা কাঁপছে তিরতির করে। সেই সাথে উজ্জ্বলতর হচ্ছে মোমের আলো। ঘুরলো সে। এক মুহূর্ত ইতস্তত করল। কান পেতে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল। তারপর আচমকা এক ঝটকায় সরিয়ে দিলো পদাটা।

পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে দু’জন। চমকে উঠল আর্সেন। পুরোপুরি হতভম্ব। নিজের অজান্তেই বিড়বিড় করে উঠল:

“আপনি-আপনি এখানে মাদমোয়াজেল!”

ইনি তো মিস নেলি। সেই মিস নেলি! ট্রান্স আটলান্টিক স্টিমারে ওর সহযাত্রী। সেই স্মরণীয় সমুদ্র যাত্রায় ওর স্বপ্নের রাজকন্যা, যে ছিল ওর বন্দি হওয়ার প্রত্যক্ষদর্শী, যে বিশ্বাসঘাতকতার পরিবর্তে কোডাকটিকে পানিতে ছুঁড়ে ফেলেছিল, যেখানে টাকা আর হীরে লুকিয়ে রেখেছিল লুপাঁ। মিস নেলি! সেই অপরূপা সুন্দরী, বন্দি থাকাকালীন যে মুখের স্মৃতি কখনও শিহরিত কখনও বিষণ্ণ করে তুলতো ওকে।

ক্যাসেলের এই গ্যালারিতে, রাতের এই সময়ে, এই অপ্রত্যাশিত সাক্ষাতে দুজনে এতটাই হতভম্ব যে, কথা বলা তো দূর, নড়তে চড়তে পর্যন্ত ভুলে গেছে। পরস্পরের আকস্মিক আবির্ভাবে যুগপৎ বিস্মিত, সম্মোহিত। হতচকিত মিস নেলি কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল সামনের একটা আসনে। ঠায় দাঁড়িয়ে রইল লুপাঁ।

ধীরে ধীরে পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছে ও। এই মুহূর্তে ওর দুই হাত, পকেট আর লিলেনের ব্যাগে উপচে পড়া লুটের মাল। ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছে লুপাঁ। হাতে নাতে ধরা পড়ায় রক্ত জমেছে চেহারায়। এই মুহূর্তে তার কাছে ও কেবলই একটা চোর, যে অন্যের পকেটে হাত ঢুকায়, ঘুমন্ত গৃহস্থের্ বাড়ি ঢুকে সাফ করে দেয় তাদের সম্পদ।

লুপাঁর হাত থেকে একটা ঘড়ি খসে পড়ল মেঝেতে; তারপর আরেকটা। একে একে হাতের মুঠোয় থাকা অন্য জিনিসগুলোও খসে পড়ল মেঝেতে। তারপর অনেকটা আকস্মিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতোই অন্য জিনিসগুলোও নামিয়ে রাখল আর্মচেয়ারে, পকেট খালি করে দিলো, লিনেনের ব্যাগে থাকা জিনিসগুলোও নামিয়ে রাখল সেখানে। খুবই অস্বস্তি বোধ করছে নেলির উপস্থিতিতে। কিছু একটা বলার জন্য এগোল নেলির দিকে। তবে কম্পিত শরীরে উঠে দাঁড়াল নেলি, ছুটল স্যালুন লক্ষ্য করে। জানালার পর্দাটা দৃষ্টির আড়ালে নিয়ে গেল তাকে। অনুসরণ করল লুপাঁ। স্যালুনের হতচ্ছাড়া অবস্থা দেখে তিরতির করে কাঁপছে নেলি। এতক্ষণে তাকে লক্ষ্য করে কথা বলল লুপাঁ, “আগামীকাল, ঠিক বেলা তিনটায়, সবকিছু ফেরত দেওয়া হবে। আসবাবপত্রগুলোও ফেরত আসবে।

কোনো জবাব নেই নেলির। কথাগুলো পুনরাবৃত্তি করল লুপাঁ, “ কথা দিচ্ছি, আগামীকাল ঠিক তিনটায়। কোনো ভাবেই এই প্রতিশ্রুতির নড়চড় হবে না… আগামীকাল ঠিক তিনটায়।”

নীরবতার চাদরে ঢাকা পড়ল স্যালুন। সেই মৌনতা ভাঙার সাহস করছে না লুপাঁ, তরুণীর উৎকণ্ঠা দেখে অনুশোচনায় দগ্ধ হচ্ছে। কোনো কথা না বলে নীরবে ঘুরে দাঁড়াল ও। ‘আশা করি সে এখন চলে যাবে,’ মনে মনে বলল ও, ‘তার উপস্থিতি সহ্য করতে পারছি না আমি।’

তবে আচমকাই কথা বলে উঠল তরুণী, তোতলাচ্ছে:

“শুনুন… পায়ের আওয়াজ… কেউ আসছে…”

বিস্মিত দৃষ্টিতে তরুণীর দিকে তাকাল লুপাঁ; আসন্ন বিপদের কথা ভেবে যেন কুঁকড়ে গেছে মেয়েটা।

“আমি কিছু শুনতে পাচ্ছি না,” বলল লুপাঁ।

“কিন্তু আপনাকে অবশ্যই চলে যেতে হবে—পালান এখান থেকে!”

“পালাবো কেন?”

“কারণ-আপনাকে যেতেই হবে। ইশ! আমি আর এক মিনিটও থাকতে পারছি না এখানে। আপনি যান এখান থেকে!”

গ্যালারি-মুখো দরজাটার দিকে ছুটে গেল সে, কান পাতল কিছু শোনার আশায়। না, কেউ নেই ওখানে। আওয়াজটা সম্ভবত বাইরে থেকে এসেছে। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল সে। তারপর নিশ্চিত হয়ে ঘুরল।

তবে ততক্ষণে উধাও হয়ে গেছে আর্সেন লুপাঁ।

****

প্রাসাদ লুটের খবরটা পাওয়া মাত্র-ই যে ধারণাটা মঁসিয়ে ডিভানের মাথায় খেলে গেল, তা হলো, কাজটা ভেলমোঁর, আর ভেলমোঁ-ই হচ্ছে আর্সেন লুপাঁ। কেবল এই থিয়োরি-ই পুরো বিষয়টাকে যৌক্তিক ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে। যদিও ধারণাটাকে নিজের কাছেই অসার মনে হচ্ছে ডিভানের। এটা ধরে নেওয়াটাই হাস্যকর মনে হচ্ছে যে, বিখ্যাত শিল্পী, তার কাজিন ডেস্টিভান-এর ক্লাবের মেম্বার ভেলমোঁ আসলে ভেলমোঁ নয়, অন্য কেউ। আর সেজন্যই জনডাম (সশস্ত্র পুলিশ)-এর ক্যাপ্টেন যখন তদন্তে এলো, নিজের এই উদ্ভট থিয়োরি পুরোপুরি চেপে গেল ডিভান।

পুর্বাহ্ণের পুরো সময়টা সরগরম রইল ক্যাসেল। জনডাম, স্থানীয় পুলিশ, ডিয়েপ থেকে আসা পুলিশ চিফ, গ্রামবাসী, সকলেই ঘুরঘুর করছে হলঘরে। তন্নতন্ন করে খুঁটিয়ে দেখছে উন্মুক্ত প্রতিটি কোণ। সেই সাথে সৈন্যদের মাস্কেটগান (গাদাবন্দুক) নিয়ে মহড়া ভিন্ন একটা আবহ সৃষ্টি করেছে চারপাশে।

তবে কোনো ব্লু-ই পাওয়া গেল না প্রাথমিক তদন্তে। জানালা কিংবা দরজা কোনোটাতেই কোনো রকম কারসাজির লক্ষণ নেই। ফলশ্রুতিতে এই উপসংহারে পৌঁছতে হলো, গোপন প্যাসেজ দিয়েই লুট করা হয়েছে ক্যাসেলের জিনিসপত্র। যদিও কোনো পায়ের ছাপ পাওয়া গেল না মেঝেতে, দেওয়ালেও নেই কোনো অস্বাভাবিক চিহ্ন। তবে তাদের তদন্তে একটা বিষয় উঠে এলো, যা আর্সেন লুপাঁর খামখেয়ালি আচরণের সাথে মিলে যায়: সেই বিখ্যাত ষোড়শ শতাব্দীর ক্রনিক-টা ঠিক আগের জায়গায় শোভা পাচ্ছে, আর তার পাশেই রয়েছে একই রকম আরেকটা বই-যেটা নিঃসন্দেহে ন্যাশনাল লাইব্রেরি থেকে হারিয়ে যাওয়া সেই বইটা।

বেলা এগারোটায় হাজির হলো আগের রাতের সেই সেনা কর্মকর্তারা। মূল্যবান শিল্পসম্পদ হারানোর মনঃকষ্ট আড়াল করে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই তাদের স্বাগত জানাল ডিভান। রাতে আসা অতিথি, মঁসিয়ে এবং মাদাম ড্যানড্রল আর মিস নেলির সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হলো। আর তখনই সবাই খেয়াল করল তাদের একজন প্রত্যাশিত অতিথি এখনও এসে পৌঁছেনি। আর সে হলো, হোরেস ভেলমোঁ। সে কি আদৌ আসবে? তার অনুপস্থিতিতে সন্দেহটা আবারও চাগাল দিল মঁসিয়ে ডিভানের মনে। তবে বারোটার সময় ঠিকই হাজির হলো সে। তাকে দেখে বিস্ময় ঝরল ডিভানের কণ্ঠে:

“আহ! আপনি এসেছেন তাহলে?”

“কেন, আমি কি সময়ানুবর্তিতা রক্ষা করিনি?” পালটা প্রশ্ন করল ভেলমোঁ।

“হ্যাঁ, সেটা ঠিক। তবে আপনাকে দেখে বিস্মিত হয়েছি… মানে ব্যস্ত একটা রাত! ধরে নিচ্ছি, আপনি খবরটা জানেন।”

“কোন খবর?”

“আপনি ক্যাসেল লুট করেছেন।”

“ওহ তাই না-কি!” বিস্ময় ফুটলো ভেলমোঁর কণ্ঠে, ঠোঁটে হাসি অমলিন।

“ঠিক, এটাই আমি ধারণা করেছিলাম। যাক সে সব, এখন মিস আন্ডারডন-কে ডাইনিং রুম পর্যন্ত সঙ্গ দিন। মাদমোয়াজেল, যদি অনুমতি পাই–”

তবে এগোতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল ডিভান, তীব্র উৎকণ্ঠার ছাপ দেখতে পেয়েছে তরুণীর অভিব্যক্তিতে। আর বিষয়টা মনে পড়তেই বলে উঠল সে:

“আহ! অবশ্য আটক হওয়ার আগে স্টিমারে আর্সেন লুপাঁর সাথে সাক্ষাৎ হয়েছিল তোমার। আর তাই তার সাথে চেহারার মিল দেখে ঘাবড়ে গেছ, তাই না?”

কোনো জবাব দিল না মিস আন্ডারডন। হাসি মুখে তার পাশে এসে দাঁড়াল ভেলমোঁ, কেতাদুরস্ত ভঙ্গিতে অভিবাদন জানাল। তার বাড়ানো হাতটা ধরল তরুণী। এসকর্ট করে তাকে নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দিল লুপাঁ, নিজে বসল তার বিপরীত আসনে।

ব্রেকফাস্টের পুরো সময়টাই অতিথিদের মধ্যে তুমুল আলোচনা চলল আর্সেন লুপাঁকে নিয়ে। সাথে যোগ হলো, লুট হওয়া মালামাল, গোপন প্যাসেজ আর শার্লক হোমস। কেবল ভোজন পর্বের শেষ দিকে আলোচনার বিষয়বস্তু পালটালো যেখানে অংশগ্রহন করল ভেলমোঁ। সেখানে সে কখনও আনন্দোচ্ছল কখনও গুরুগম্ভীর, আবার কখনও প্রগলভ এবং চিন্তাশীল। আর তার সব কথা, সব মন্তব্যই যেন আবর্তিত হলো মিস নেলিকে লক্ষ্য করে। যদিও সেই তরুণী পুরোপুরি আত্মমগ্ন, মনেই হচ্ছে না ভেলমোঁর কোনো কথা আদৌ খেয়াল করছে সে।

কোর্ট অভ অনার এবং প্রাসাদেও সামনের বাগিচা উপেক্ষা করে কফি পরিবেশন করা হলো টেরেসে। লনে রেজিমেন্টাল ব্যান্ড কুচকাওয়াজ করছে। গ্রামবাসীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে পার্কে।

তবে মুহূর্তের জন্যও লুপাঁর প্রতিজ্ঞার কথা বিস্মৃত হয়নি মিস নেলি

‘আগামীকাল, বেলা তিনটায়, সবকিছু ফেরত দেওয়া হবে।‘

বেলা তিনটায়! আবারও ক্যাসেলের দক্ষিণ দিকের বিশাল ঘড়িটার দিকে তাকাল নেলি, তিনটা বাজতে কুড়ি মিনিট বাকি। নিজের অজান্তেই মিনিটে মিনিটে ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে মিস নেলি, একইসাথে লক্ষ করছে ভেলমোঁকে। যদিও কোনো বিকার নেই ভেলমোঁর, আপন মনে দোল খাচ্ছে রকিং চেয়ারে।

তিনটা বাজতে দশ মিনিট বাকি! …আর পাঁচ মিনিট!… ক্রমেই উদ্বিগ্ন আর অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে নেলি। এটা কি আদৌ সম্ভব, আর্সেন লুপাঁ যথাসময়ে তার প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবে, বিশেষ করে যখন ক্যাসেল, কোর্টইয়ার্ড আর পার্কে গিজগিজ করছে লোকে, আর যখন ল অফিসাররা তাদের তদন্ত অব্যহত রেখেছে? বিশেষ করে… আর্সেন লুপাঁ যেখানে দৃঢ় কণ্ঠে প্রতিজ্ঞা করেছে। ‘এটা তার কথা মতো একদম সঠিক সময়েই হওয়ার কথা,’ ভাবল নেলি। কারণ সেই অনন্য সাধারণ লোকটার বলিষ্ঠ প্রত্যয়, দৃঢ় আস্থা আর কর্তৃত্বপূর্ণ আশ্বাসে মুগ্ধ হয়েছিল সে। তার কাছে বিষয়টাকে মোটেও অলৌকিক কিছু মনে হচ্ছে না, বরং আর দশটা সাধারণ ঘটনার মতোই যেন ঘটবে বিষয়টা। চেহারায় যেন আবির ছড়াল মিস নেলির, ঘাড় ঘুরাল সে।

তিনটা! যেন জীবন্ত হয়ে উঠল ক্যাসেলের সুবিশাল ঘড়িটা। ধীর লয়ে বেজে উঠল ঘণ্টাধ্বনি: এক… দুই… তিন… নিজের ঘড়িটা পকেট থেকে বের করে চকিতে একবার দৃষ্টি বুলালো হোরেস ভেলমোঁ, তারপর আবারও জায়গামতো রেখে দিলো ঘড়িটা। নীরবে পেরিয়ে গেল আরও কয়েকটা সেকেন্ড। পরমুহূর্তেই কোর্টইয়ার্ডের ভিড় দু’ভাগ হয়ে জায়গা করে দিলো দুটো ওয়াগনকে: যেগুলো কেবলই আঙিনায় প্রবেশ করেছে পার্কের গেট দিয়ে, আর ওগুলোর প্রত্যেকটিকে চালিয়ে আনছে দুটো করে ঘোড়া। আর্মি ওয়াগন ওগুলো। রসদ, তাঁবু-সহ প্রয়োজনীয় সামরিক সরঞ্জামাদি পরিবহন করে। প্রধান প্রবেশদ্বারের সামনে এসে থামলে ওয়াগনদুটো। এক সার্জেন্ট প্রায় লাফিয়ে নামল একটা ওয়াগন থেকে। খোঁজ করল মঁসিয়ে ডিভানের। খানিক পরে-ই বেরিয়ে এলো গৃহকর্তা। সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল নিচে। ওয়াগনের ক্যানভাস সরাতেই দেখতে পেল তার আসবাবপত্র, পেইন্টিং আর অলংকারাদি, সযত্নে সাজানো রয়েছে সেখানে।

জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে অফিসার অভ দ্য ডে-র একটা আদেশনামা বের করে দেখাল সার্জেন্ট। আদেশনামায় বলা হয়েছে,

‘চতুর্থ ব্যাটেলিয়নের দ্বিতীয় কোম্পানিকে আর্কস-এর বনাঞ্চলের হ্যালে চৌরাস্তায় হাজির হওয়ার নির্দেশ প্রদান করা হচ্ছে এবং সেখানে রক্ষিত আসবাবপত্র-সহ অন্যান্য সামগ্রী সংগ্রহ করে জিনিসগুলো টিবারমেসনিল ক্যাসেলের মালিক, জর্জ ডিভানের কাছে বেলা ঠিক তিনটায় পৌঁছে দিতে হবে।

স্বাক্ষর: কর্নেল বোভেল।‘

“চৌরাস্তায় পৌঁছে,” ব্যাখ্যা দিলো সার্জেন্ট, “সবকিছু একদম তৈরি অবস্থাতেই পেয়েছি, ঘাসের ওপর রাখা। একদল পথচারী পাহারা দিচ্ছিল জিনিসগুলো। বিষয়টা অদ্ভুত লাগলেও… আদেশ বলে কথা, পালন করতেই হবে।”

অফিসারদের একজন স্বাক্ষরটা পরীক্ষা করে জাল বলে ঘোষণা করল, যদিও কাজটা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করা হয়েছে। মালপত্র সব নামানো হলো ওয়াগন থেকে। তারপর রাখা হলো ক্যাসেলে, আগের জায়গায়।

হট্টগোলের পুরো সময়টা টেরেসের দূর প্রান্তে একাকী দাঁড়িয়েছিল নেলি বিক্ষিপ্ত চিন্তা আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে আচ্ছন্ন হয়ে আছে মন। হঠাৎ-ই খেয়াল করল ভেলমোঁকে, এগিয়ে আসছে তার দিকে। এড়াতে চাইলেও বাধা হয়ে দাঁড়াল টেরেসের রেলিং। কোনঠাসা অবস্থা ওর, পেছানোর উপায় নেই। বাঁশঝাড়ের ফাঁকফোকড় দিয়ে আসা রোদ পড়েছে তার অপূর্ব সোনালি চুলে। কেউ একজন মৃদু কণ্ঠে কথা বলে উঠল ওর কানের পেছনে:

“আমি কি আমার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি?”

আর্সেন লুপাঁ দাঁড়িয়ে আছে পেছনে, কাছাকাছি আর কেউ নেই। ধীর, শান্ত কণ্ঠে কথাটা পুনরাবৃত্তি করল সে, “আমি কি আমার প্রতিশ্রুতি পালন করিনি?”

নেলির কাছ থেকে একটা মৌখিক ধন্যবাদ অন্তত আশা করেছিল লুপাঁ, নিদেন পক্ষে সামান্য ইতিবাচক অভিব্যক্তি, যাতে বোঝা যায় ওর প্রতিশ্রুতি পালনে খুশি হয়েছে সে। তবে নেলি একেবারেই ভাবলেশহীন-নির্লিপ্ত।

তার এই অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণে মনে মনে ক্ষুব্ধ আর্সেন লুপাঁ। হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছে তিক্ত সত্যটা: ওর আর মিস নেলির মাঝে যোজন যোজন ব্যবধান। চাইলে সন্তুষ্ট মনে তার কাছে নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারত লুপাঁ, কিংবা পরিবেশটাকে হালকা করার প্রয়াস চালাতে পারত, তবে সব কিছুই অসার আর অযৌক্তিক মনে হচ্ছে ওর কাছে। শেষ পর্যন্ত বিষণ্ণ স্মৃতিকাতরতা ভারাক্রান্ত করে তুলল ওকে। আপন মনেই বিড়বিড় করতে লাগল:

“আহ! কতদিন আগের কথা! ‘লা প্রভেন্স’-এর ডেকে সেই লম্বা সময়টার কথা হয়তো মনে নেই আপনার। সেদিনও আপনার হাতে একটা গোলাপ ছিল, সাদা গোলাপ, ঠিক যেমনটা আজও রয়েছে আপনার হাতে। সেদিন চেয়েছিলাম ওটা, আর আপনি না শোনার ভান করে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। আপনি চলে যাওয়ার পর গোলাপটা আমি খুঁজে পেয়েছিলাম—সন্দেহ নেই, ভুল করেই হয়তো ফেলে গিয়েছিলেন ওটা-কিন্তু আমি সেটা সযত্নে তুলে রেখেছিলাম।”

কোনো কথা নেই নেলির মুখে। মনে হচ্ছে, দূরে কোথাও যেন হারিয়ে গেছে সে। নিজের কথা অব্যহত রাখল লুপাঁ।

“সেই সুখময় স্মৃতির খাতিরে ভুলে যান পরবর্তীতে কী শুনেছেন। আলাদা করে ফেলুন অতীত আর বর্তমানকে। গতরাতের আমাকে উপেক্ষা করে কেবল একটি বারের জন্য ঘুরে তাকান আমার দিকে। ঠিক সেই দূর অতীতের দিনগুলোর মতো। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য হলেও যখন আমার পরিচয় ছিল বার্নার্ড ডি’আন্দ্রেজি। তাকাবেন না?”

ওর অনুরোধ রাখতেই যেন চোখ তুলে তাকাল সে। তারপর কোনো কথা না বলে ইশারা করল তর্জনিতে পরা আংটিটার দিকে। এতক্ষণ শুধু আংটিটা দৃশ্যমান ছিল: এখন আংটির পুরো সেটিংটা ঘুরানো লুপাঁর দিকে। জমকালো একটা রুবি শোভা পাচ্ছে সেখানে। চেহারায় রক্ত জমাট বাঁধল লুপাঁর, এই আংটি জর্জ ডিভানের। তিক্ত হাসি ফুটল লুপাঁর ঠোঁটে।

“আপনার কথাই ঠিক। কোনো কিছুই পরিবর্তন করা যায় না। আর্সেন লুপাঁ এখন যেমন, ভবিষ্যতেও তা-ই থাকবে। এমনকি আপনার কাছে একটা স্মৃতিরও যোগ্য নয় সে। ক্ষমা করবেন… এখন আপনার যে-কোনো ধরনের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা অমর্যাদারই নামান্তর। আমাকে মাফ করবেন।”

হ্যাটটা হাতে নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল ও। ওকে পাশ কাটিয়ে অগ্রসর হলো নেলি। একবার ইচ্ছে হলো নেলিকে থামায়, তবে সাহস হলো না। বরং তার গমন পথের দিকে তাকিয়ে রইল লুপাঁ, ঠিক যেভাবে তাকিয়েছিল নিউইয়র্কে, গ্যাংওয়ে ধরে তার নেমে যাওয়ার সময়। সিঁড়ি বেয়ে দরজার দিকে উঠতে লাগল সে। তারপর এক সময় হারিয়ে গেল বাড়ির ভেতর। দেখা মিলল না আর।

কালো মেঘে ঢাকা পড়েছে সূর্য। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে ও। তাকিয়ে আছে বালির ওপর পড়া নেলির ছোটো ছোটো পায়ের ছাপের দিকে। আচমকা সক্রিয় হলো লুপাঁ। বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নেলি যেখানে দাঁড়ানো ছিল তার পাশের বাক্সটার দিকে: দেখতে পেল পড়ে থাকা গোলাপটি, সাদা গোলাপ, যেটা চাওয়ার সাহস করে উঠতে পারেনি ও। ভুলে ফেলে গেছে, কোনো সন্দেহ নেই, আবারও! সেটা কীভাবে – পূর্বপরিকল্পনা না কি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ? ঝটিতে ফুলটা তুলে নিল ও। কয়েকটা পাঁপড়ি খসে পড়ল মাটিতে। একটা একটা করে পাঁপড়িগুলো তুলে নিল ও, মহামূল্যবান স্মারকের মতো।

‘তাহলে,’ নিজেকে শুনিয়ে বলল লুপাঁ, ‘এখানে আর কোনো কাজ নেই। এখন অবশ্যই নিজের নিরাপত্তার দিকটা ভাবতে হবে আমাকে, শার্লক হোমস চলে আসার আগেই।

***

পার্কটা নির্জন হলেও গেটের কাছে এখনও অবস্থান করছে কয়েক জন ফ্রেঞ্চ সৈনিক। ওয়াল টপকে পাইন বনে ঢুকে পড়ল সে। রেল স্টেশনে যাওয়ার শর্টকাট পথ ধরল। এগোল মাঠের মাঝখান দিয়ে। আরও মিনিট দশেক হাঁটতে-ই সে এমন একটা জায়গায় এসে পৌঁছল যেখানে রাস্তাটা আরও সংকীর্ণ হয়ে এগিয়েছে একটা গিরিখাতের মাঝ দিয়ে। এই গিরিখাতেই দেখা হলো বিপরীত দিক থেকে আসা লোকটার সাথে। লোকটার বয়স আনুমানিক পঞ্চাশ, দীর্ঘ-দেহী, নিখুঁত ভাবে কামানো গাল, পরনে বিদেশি কাটের পোশাক। হাতে ভারী একটা ছড়ি আর কাঁধে ছোট একটা ব্যাগ ঝুলানো রয়েছে লোকটার। কাছাকাছি হতেই ইংরেজি উচ্চারণে কথা বলে উঠল আগন্তুক:

“এক্সকিউজ মি, মঁসিয়ে, ক্যাসেলে যাওয়ার পথ কি এটাই?”

“হ্যাঁ, মঁসিয়ে। সোজা এগিয়ে যান। সামনে দেওয়াল পড়লে বাঁয়ে বাঁক নেবেন। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।”

“তাই?”

“হ্যাঁ, আমার বন্ধু ডিভান গত রাতে বলেছিল আপনার আসার কথা। আমি খুবই আনন্দিত যে আমিই সবার আগে আপনাকে স্বাগত জানাতে পারলাম। আমার চেয়ে পাঁড় ভক্ত নেই শার্লক হোমসের।”

কণ্ঠে কিছুটা বিদ্রুপের ছোঁয়া থাকায় তাৎক্ষণিক ভাবেই মনে মনে আফসোস করল সে, কারণ শার্লক হোমস তার অন্তরভেদী দৃষ্টি দিয়ে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করছে ওকে। আর্সেন লুপাঁর মনে হলো, সেই দৃষ্টি যেন ওকে নির্দিষ্ট একটা ফ্রেমে বন্দি করে রেখেছে যা কোনো ক্যামেরার পক্ষে ও কখনও সম্ভব হয়নি।

‘সে আমার নেগেটিভ তৈরি করে নিয়েছে,’ মনে মনে ভাবল লুপাঁ। ‘এখন আর এর সামনে ছদ্মবেশে থাকা নিরর্থক। তার ভেতর দিয়েই সে আসল চেহারাটা দেখে নিতে পারবে। কিন্তু একটা কথা ভাবছি, সে কি আমায় চিনতে পেরেছে?’

বিদায় নেওয়ার জন্য পরস্পরকে বাউ করল তারা, আর তখনই শুনতে পেল ঘোড়ার খুর আর সেই সাথে লোহালক্করের ঘষা খাওয়ার ক্লিক ক্লিক শব্দ; একদল সৈনিক। ঘোড়াগুলো এড়াতে বাধ্য হয়ে দুজনেই বাঁধের দিকে আরেকটু সেঁধিয়ে গেল। ওদের অতিক্রম করতে বেশ কয়েক মিনিট সময় লাগল দলটার এখনও ভেবে চলেছে লুপাঁ:

‘সব কিছুই নির্ভর করছে সেই প্রশ্নটার ওপর; সে কি আমায় চিনতে পেরেছে? যদি তাই হতো, তবে সে সম্ভবত এই সুযোগটা নেওয়ার চেষ্টা করত। জটিল এক পরিস্থিতি।’

শেষ ঘোড়সওয়ার অতিক্রম করে যেতেই সামনে এগোল শার্লক হোমস। ধুলো ঝাড়ার প্রয়াস পেল পোশাক থেকে। পরমুহূর্তে সে এবং আর্সেন লুপাঁ পরস্পরের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছু সময়ের জন্য। এই মুহূর্তে কেউ যদি তাদের দেখত, তবে বিরল আর স্মরণীয় এক দৃশ্যের সাক্ষী হতো: এই ব্রহ্মাণ্ডের দুই অনন্য সাধারণ ব্যক্তিত্ব, অসাধারণ বুদ্ধি আর প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও দুই বিপরীত মেরুর বাসিন্দা, প্রথম সাক্ষাতে পরস্পরের মুখোমুখি হয়েছে বিশ্বের এই প্রান্তে।

“ধন্যবাদ, মঁসিয়ে,” বলল ইংরেজ লোকটা

পরস্পরের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হলো তারা। রেলস্টেশনের দিকে এগোল লুপাঁ, ক্যাসেলের দিকে যাত্রা অব্যহত রাখল শার্লক হোমস।

বেশ কয়েক ঘণ্টার নিস্ফল প্রচেষ্টার পর তদন্তে ক্ষান্ত দিয়েছে স্থানীয় কর্মকর্তারা। তাই ইংরেজ ডিটেকটিভের আগমনের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ক্যাসেলের লোকজন। তবে প্রথম দর্শনে ইংরেজ ডিটেকটিভের সাদামাটা চেহারা হতাশ করল তাদের: মানস পটে যে কাল্পনিক ছবি এঁকেছিল, তার সাথে কোনোই মিল নেই এই ইংরেজ গোয়েন্দার। শার্লক হোমসের নাম শুনলে যে রোমান্টিক হিরো, যে ধুরন্ধর আর রহস্যময় ব্যক্তিত্বের ছবি ভেসে উঠে তার সাথে কোনো মিল নেই এই লোকের। তবে তাকে দেখে উৎসাহে চেঁচিয়ে উঠল মঁসিয়ে ডিভান।

“আহ, মঁসিয়ে, আপনি এসেছেন! আপনাকে দেখে ভীষণ খুশি হয়েছি। বহুল প্রতীক্ষিত ছিল এই আনন্দ। সত্যি বলতে কী, যা ঘটেছে তার জন্য মোটেও আফসোস নেই, কারণ এটাই আপনার সাথে দেখা করার একটা উপলক্ষ্য তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু আপনি এলেন কীভাবে?”

“ট্রেনে করে।”

“কিন্তু আপনাকে আনার জন্য আমার গাড়ি পাঠিয়েছিলাম স্টেশনে।

“আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা, তাই না? আতশবাজি আর সঙ্গীতের তালে তালে। নাহ, ওসব আমার চলে না। আমি ওভাবে কাজ করি না,” অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল সে।

তার কথায় কিছুটা অপ্রতিভ হলো ডিভান। তারপরও জোর করে হাসি ফুটানো চেহারায় বলল, “সৌভাগ্যক্রমে আপনাকে চিঠি লেখার পর কাজটা একেবারেই সোজা-সাপটা হয়ে গেছে।”

“কীভাবে?”

“গত রাতেই ডাকাতি হয়ে গেছে।”

“আমার আগমনের সংবাদ ঘোষণা না করলে গতরাতে সম্ভবত ডাকাতিটা হতো না।”

“তাহলে কবে হতো?”

“আগামীকাল অথবা অন্য কোনো দিন। “

“সেক্ষেত্রে কী লাভ হতো?”

“লুপাঁকে ফাঁদে ফেলা যেত,” জবাব দিলো ডিটেকটিভ।

“আর আমার আসবাবপত্র?”

“সেগুলো বাইরে নেওয়া সম্ভব হতো না।”

“আহ! কিন্তু আমার জিনিসপত্র সব এখানেই আছে। তিনটার সময় ওগুলো ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।”

“লুপাঁ নিজে দিয়েছে।”

“দুটো আর্মি ওয়াগন।”

টুপিটা মাথায় দিয়ে কাঁধের ঝোলাটা ঠিকঠাক করল শার্লক হোমস। একইসাথে বিস্ময় আর উদ্‌বেগের সাথে প্রায় চিৎকার করে উঠল ডিভান, “কিন্তু মঁসিয়ে, আপনি কী করতে যাচ্ছেন?”

“আমি ফিরে যাচ্ছি।”

“কিন্তু কেন?”

“আপনার জিনিসপত্র ফেরত পেয়েছেন; আর্সেন লুপাঁ অনেক দূরে চলে গেছে—এখানে করার মতো আর কিছু নেই আমার।”

“নিশ্চয়ই আছে। আপনার সাহায্য দরকার আমার। গতকাল যেটা ঘটেছে, আগামীকাল আবারও সেটা ঘটতে পারে, যদি আমরা খুঁজে বের করতে না পারি সে কীভাবে ভেতরে প্রবেশ করল, আর বেরিয়ে গেল। আর কেন-ই বা কয়েক ঘণ্টা পর জিনিসগুলো ফেরত দিলো।”

“ওহ! আপনার এটা জানা নেই যে–”

সমস্যা সমাধানের বিষয়টা আগ্রহান্বিত করে তুলল শার্লক হোমসকে।

“চমৎকার। চলুন অনুসন্ধান করা যাক ব্যাপারটা-এক্ষুনি-আর একা, যদি সেটা সম্ভব হয়।”

বিষয়টা অনুধাবন করতে পেরেছে ডিভান। ইংরেজ গোয়েন্দাকে নিয়ে হাজির হলো স্যালুনে। নীরস চাঁছাছোলা কণ্ঠে বেশ কয়েকটা প্রশ্ন করল হোমস, যেন আগে থেকেই তৈরি করা ছিল প্রশ্নগুলো। জানতে চাইল, গত সন্ধ্যার অনুষ্ঠানের ব্যাপারে, বাড়ির লোকজন আর আগত অতিথিদের ব্যাপারে। তারপর পরীক্ষা করল ‘ক্রনিক’-এর ভলিউম দুটো; তুলনা করে দেখল ভূগর্ভস্থ প্যাসেজের প্ল্যান। বেশ কয়েকবার জিজ্ঞেস করে জেনে নিল ফাদার জেলিসের আবিষ্কার করা বাক্য দুটো। অবশেষে কথা বলল ডিভানের সাথে:

“গতকালই কি প্রথমবারের মতো বাক্য দুটো নিয়ে কারও সাথে কথা বলেছেন?”

“হ্যাঁ।”

“তার আগে হোরেস ভেলমোঁর সাথে এই ব্যাপারে আর কখনও কথা হয়নি?”

“না।”

“বেশ, আপনার গাড়িটাকে হাজির করার নির্দেশ দিন। এক ঘণ্টার মধ্যেই আমি এখান থেকে বিদায় নিব।”

“এক ঘণ্টার মধ্যেই?”

“হ্যাঁ; আপনার সরবরাহ করা তথ্যে আর্সেন লুপাঁ সেই সময়ই সমস্যাটার সমাধান করে ফেলেছিল।”

“আমার… তাকে সরবরাহ করা… তথ্য-”

“হ্যাঁ, আর্সেন লুপাঁ অথবা হোরেস ভেলমোঁ—একই কথা।”

“আমিও এরকমই ভেবেছিলাম। ইশ, খতরনাক শয়তান!”

“এখন শুনুন,” বলল হোমস, “গত রাত দশটার মধ্যেই আপনি লুপাঁকে প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়েছেন, যেটা তার অজানা ছিল আর সপ্তাহের পর সপ্তাহ সে যেগুলো খোঁজ করছিল। রাতের মধ্যেই সে সমস্যাটার সমাধান করে, লোকজন জোগাড় করে আর লুট করে আপনার ক্যাসেল। আমি খুব দ্রুত কাজ সারব।”

রুমের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত হেঁটে গেল হোমস, গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। তারপর পায়ের ওপর পা তুলে বসে পড়ল, চোখ বন্ধ।

অপেক্ষা করছে ডিভান, বিভ্রান্ত। ভাবছে: ‘ঘুমিয়ে গেল না কি লোকটা? না- কি ধ্যান করা শুরু করল।’

তবে শার্লক হোমসের কথামতো মোটরকারের খবর নিতে গেল। যখন ফিরল, হোমস তখন গ্যালারির সিঁড়ির কাছে হাঁটু গেড়ে কার্পেট পর্যবেক্ষণ করছে।

“কী এটা?” জানতে চাইলো ডিভান।

“দেখুন… এখানে… মোমবাতি থেকে পড়া মোমের চিহ্ন।”

“একদম ঠিক। একেবারে তরতাজা।”

“সিঁড়ির ওপরের ধাপেও দেখা মিলবে এই বস্তুর এবং কেবিনেটের চারপাশে, আর্সেন লুপাঁ যেটা ভেঙেছে। আর যেখান থেকে সে ছোটো ছোটো অলঙ্কারগুলো তুলে নিয়ে আর্মচেয়ারে রেখেছে।”

“এটা থেকে কী উপসংহারে পৌঁছলেন?”

“কিছু-ই না। এটা নিঃসন্দেহে জিনিসপত্রগুলো ফেরত দেওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করবে। তবে সেটা ভিন্ন ইস্যু, ওটার তদন্তের জন্য আমি অপেক্ষা করতে পারি না। এখন প্রধান সমস্যা হচ্ছে, প্যাসেজের হদিস বের করা। এখন প্রথমে আমাকে বলুন, ক্যাসেলের দু-তিনশ মিটারের মধ্যে কোনো চ্যাপেল আছে?”

“আছে। ধ্বংসপ্রাপ্ত একটা চ্যাপেল আছে, ডিউক রোলো-র সমাধি রয়েছে সেখানে।”

“আপনার শোফারকে বলুন চ্যাপেলের কাছে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে।“

“আমার শোফার এখনও ফেরেনি। সে ফিরলে লোকজন আমাকে জানাত। আপনার কী ধারণা গুপ্ত প্যাসেজ চ্যাপেলের দিকে গেছে? কী কারণ থাকতে পারে—”

“আমি চাই,” তার কথা থামিয়ে বলে উঠল ইংরেজ গোয়েন্দা, “আপনি একটা মই আর লণ্ঠনের ব্যবস্থা করুন।

“কি! আপনার মই আর লণ্ঠন দরকার?”

“নিশ্চয়ই, নইলে আপনাকে বলতাম না।”

এই ধরনের চাঁছাছোলা বক্তব্যে কিছুটা হতাশ ডিভান। তবে বেল বাজিয়ে প্রয়োজনীয় নির্দেশ দিলো লোকদের। সামরিক দক্ষতায় তার নির্দেশনা পালিত হলো।

“বুককেস বরাবর রাখুন মইটা। টিবারমেসনিল লেখা শব্দটার বাঁয়ে।”

কথামতো কাজ করল ডিভান। এখনও নির্দেশনা অব্যহত রেখেছে ইংরেজ ভদ্রলোক:

“আর একটু বাঁয়ে… একটু ডানে… এবার উঠে পড়ুন মইয়ে… সবকটা বর্ণ-ই উন্মুক্ত আছে, তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“প্রথমে ‘আই’ অক্ষরটাকে ঘুরান, বাম অথবা ডান দিকে।”

“কোনটা? এখানে দুটো ‘আই’ আছে।”

“প্রথমটা।“

“আরে তাই তো! এটা ডান দিকে ঘুরছে। আপনি কীভাবে জানলেন?”

জবাব না দিয়ে নির্দেশনা দিয়ে যেতে লাগল শার্লক হোমস:

“এবার ‘বি’ অক্ষরটি নিন। হুড়কোর মতো আগুপিছু করুন।”

কথা মতো কাজ করল ডিভান। বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করল তীক্ষ্ণ একটা শব্দ হচ্ছে।

“একদম ঠিক,” বলল হোমস। “এবার আমরা টিবারমেসনিল শব্দটার অন্য প্রান্তে যাব। ‘আই’ অক্ষরটা দিয়ে শুরু করুন। দেখুন ওটা দরজার মতো খুলে যায় কি না।”

গভীর মনোযোগ দিয়ে অক্ষরটা আঁকড়ে ধরল ডিভান। খুলে গেল ওটা। সেই সাথে ডিভানও পড়ে গেল মই থেকে। কারণ প্রথম আর শেষ অক্ষরের মাঝে থাকা বুককেসের অংশটা স্থানচ্যূত হয়েছে। আর সেখান থেকেই উন্মুক্ত হয়েছে গোপন প্যাসেজের পথ।

“ব্যথা পাননি তো,” শান্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল হোমস।

“না, না, মোটেও না,” উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল ডিভান। “আঘাত পাইনি, কেবল হতভম্ব হয়ে গেছি। ব্যাপারটা এখনও মাথায় খেলছে না আমার… ওই অক্ষরগুলো ঘুরানো… গুপ্ত প্যাসেজ মুক্ত হওয়া…”

“নিশ্চয়ই। কেন এটা কি সালির দেওয়া সূত্রের সাথে পুরোপুরি মিলেনি? “Turn one eye on the bee that shakes, the other eye will lead to God.”

“কিন্তু ষোড়শ লুইয়ের ব্যাপারটা?” জিজ্ঞেস করল ডিভান।

“ষোড়শ লুই ছিলেন তালার জাদুকর। কম্বিনেশন লক-এর ওপর লেখা তার একটা বই পড়েছি আমি। টিবারমেসনিলের মালিকের পক্ষ থেকে মহামান্য রাজাকে তালার এই দুরন্ত কৌশলটা দেখানো চমৎকার একটা বিষয় ছিল। মনে রাখার সুবিধার্থে রাজা লিখে রেখেছিলেন ৩-৪-১১, পরিস্কার করে বললে Thibermesnil শব্দটার তৃতীয়, চতুর্থ আর একাদশতম অক্ষর।”

“ঠিক। এখন বুঝতে পারছি। এখন বোঝা যাচ্ছে, লুপাঁ কীভাবে এই রুম ছেড়ে বেরিয়েছে। কিন্তু ভেতরে ঢুকার ব্যাপারটা ঠিক পরিস্কার হচ্ছে না। আর এটা তো একেবারেই নিশ্চিত যে, সে বাইরে থেকে এসেছিল।”

হাতের লণ্ঠনটা জ্বেলে প্যাসেজের ভেতর ঢুকে পড়ল শার্লক হোমস।

“দেখুন! পুরো মেকানিজমটাই একদম পরিস্কার, ঠিক ঘড়ির কাঁটার মতো। যার মাধ্যমে অক্ষরগুলোর বিপরীত ক্রমেও কাজ করা যায়। লুপাঁ এই পাশ থেকে সেই কাজটাই করেছে। পুরো ব্যাপারটা একদম জলবৎ তরলং।”

“এই কথার কী প্রমাণ আছে?”

“প্রমাণ? কেন, পড়ে থাকা তেলগুলো খেয়াল করুন। লুপাঁ আগেই ধারণা করেছিল হুইলগুলোর জ্যাম ছাড়াতে তেল লাগতে পারে।”

“সে কি অন্য প্রবেশদ্বারের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিল?”

“নিশ্চয়ই। ঠিক আমি যেমন জানি,” জবাব দিল হোমস। “আমাকে অনুসরণ করুন।”

“এই অন্ধকার প্যাসেজে?”

“ভয় পাচ্ছেন?”

“ঠিক তা নয়। কিন্তু আপনি কি নিশ্চিত অন্য পথটা খুঁজে পাবেন?”

“চোখ বন্ধ করে।”

“প্রথমে বারো ধাপ নামলো তারা, তারপর আরও বারো ধাপ। পরবর্তীতে দুই পর্যায়ে প্রতিবার বারো ধাপ করে নামলো তারা। অতঃপর এগোল দীর্ঘ একটা প্যাসেজ ধরে। দেয়ালগুলোতে বহুকাল আগে করা অসংখ্য সংস্কারের ছাপ। কোথাও কোথাও পানি চুঁইয়ে পড়ার আভাস। মাটিও খুব স্যাঁতসেঁতে।

“আমরা পুকুরের নিচ দিয়ে এগোচ্ছি,” কিছুটা বিচলিত কণ্ঠে বলল ডিভান।

অবশেষে তারা হাজির হল বারো ধাপের একটা সিঁড়ির সামনে। একই ভাবে আরও তিন স্তর সিঁড়ি পেরোল, প্রত্যেকটি বারো ধাপের। শেষ পর্যন্ত তারা নিজেদের আবিষ্কার করল ছোটো একটা পাথুরে গহ্বরে। এখান থেকে আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই।

“ডিউস!” বিড়বিড় করে বলল হোমস, “দেওয়াল ছাড়া আর কিছু নেই দেখছি। এ তো দেখছি মহাজ্বালা।”

“ফিরে চলুন,” তাগিদ দিল ডিভান। “যা দেখেছি তাতেই আমি সন্তুষ্ট।

ওপরের দিকে তাকাল ইংরেজ গোয়েন্দা, সেই সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সেখানে একই মেকানিজম চোখে পড়েছে তার, সেই আগে দেখা শব্দটাই। এখানেও কেবল তিনটে অক্ষর নিয়ে কাজ করতে হলো তাকে। আর তাতেই সরে গেল গ্র্যানাইটের একটা স্ল্যাব। স্ল্যাবের অন্য পাশটা তৈরি করেছে ডিউক রোলোর টুম্বস্টোন (সমাধিস্তম্ভ)। আর সেখানে খোদাই করে লেখা টিবারমেসনিল এখন তারা রয়েছে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত ছোট্ট চ্যাপেলটায়। কথা বলে উঠল ডিটেকটিভ:

“The other eye leads to God,” বলল হোমস, “তার মানে চ্যাপেল।”

“দুর্দান্ত ব্যাপার!” বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল ডিভান। ইংরেজ ডিটেকটিভের দৃষ্টিভঙ্গি আর সূক্ষ্ণ রসবোধে মুগ্ধ। “ওই কয়েকটা শব্দই কি আপনার জন্য যথেষ্ট ছিল?”

“ওগুলো” তাচ্ছিল্য ফুটল হোমসের কণ্ঠে, “ওগুলোর আদৌ কোনো প্রয়োজনই ছিল না। ন্যাশনাল লাইব্রেরির বইতে যে চার্টটা আছে, আপনি জানেন, সেই ড্রইংটার বাম দিকটা শেষ হয়েছে একটা বৃত্তে, আর ডান পাশটা, যেটা আপনার জানা নেই, শেষ হয়েছে একটা ক্রসে। আর সেই ক্রসটা দিয়ে বোঝানো হচ্ছে এই চ্যাপেলটা, যেখানে এই মুহূর্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি।”

হতবিহ্বল অবস্থা বেচারা ডিভানের। বিষয়টা তার কাছে এতটাই অভিনব যে, নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছে না। “এটা তো অবিশ্বাস্য, অকল্পনীয় আবার সেই সাথে রয়েছে ছেলেমানুষি সরলতা!” বিস্মিত কণ্ঠে বলল সে। “তাহলে এতদিনেও কেন কেউ এটা সমাধান করতে পারল না?”

“কারণ, কেউ-ই প্রয়োজনীয় তথ্যগুলোর মেলবন্ধন ঘটাতে পারেনি। যেমন বলা যায়, দুটো বই কিংবা দুটো বাক্য। কেউ-ই না, কেবল লুপাঁ আর আমি ছাড়া।”

“কিন্তু ফাদার জেলিস এবং আমি ওই জিনিসগুলোর ব্যাপারে সবই জানতাম এবং একই ভাবে—”

হাসিমুখে তার কথার মাঝে কথা বলে উঠল হোমস, “মঁসিয়ে ডিভান, সবাই ধাঁধার সমাধান করতে পারে না।“

“আমি গত দশ বছর যে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছি তা আপনি দশ মিনিটেই করে ফেললেন!”

“হুমম, আমি এই ধরনের কাজ করতে অভ্যস্ত।’

চ্যাপেল থেকে বেরোতেই গাড়িটা চোখে পড়ল তাদের।

“যাক, একটা গাড়ি আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে।”

“হ্যাঁ, এটা আমার,” বলল ডিভান।

“আপনার? বলেছিলেন, আপনার শোফার এখনও ফেরেনি?”

দুজনেই এগোল গাড়ির দিকে। শোফারকে জিজ্ঞাসাবাদ করল মঁসিয়ে ডিভান :

“এডোয়ার্ড, তোমাকে এখানে কে আসতে বলেছে?”

“কেন, মঁসিয়ে ভেলমোঁ। “

“মঁসিয়ে ভেলমোঁ? তার সাথে দেখা হয়েছে তোমার?”

“রেল স্টেশনের কাছে দেখা হয়েছিল। বলল, চ্যাপেলের এখানে আসতে।”

“চ্যাপেলের এখানে আসতে! কেন?”

“আপনি আর আপনার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করতে, মঁসিয়ে।”

চকিতে পরস্পরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল ডিভান আর হোমস আর কথা বলে উঠল মঁসিয়ে ডিভান, “সে জানত এই ধাঁধা আপনার জন্য একেবারেই সহজ। খুবই সূক্ষ্ণ প্রশংসা।”

মুহূর্তের জন্য সন্তুষ্টির ছাপ পড়ল ডিটেকটিভের ভাবলেশহীন চেহারায়। প্রশংসাটা মনে ধরেছে তার। মাথা দুলিয়ে জবাব দিলো, “খুবই বুদ্ধিমান একজন মানুষ। প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিলাম।”

“তার সাথে দেখা হয়েছে আপনার?”

“কিছুক্ষণ আগে দেখা হয়েছিল তার সাথে – স্টেশন থেকে আসার পথে।“

“এবং আপনি জানতেন যে, সে-ই হোরেস ভেলমোঁ, মানে আর্সেন লুপাঁ?”

“সেটা ঠিক। ভাবছিলাম এটা কীভাবে সম্ভব – না, আসলে ধারণা করেছিলাম—তার কয়েকটা বিদ্রুপাত্মক মন্তব্যের কারণে।”

“আর আপনি তাকে পালানোর সুযোগ দিলেন?”

“অবশ্যই দিলাম। যদিও পরিস্থিতি পুরোপুরি অনুকূলে ছিল। পাশ দিয়েই জনডামরা অতিক্রম করছিল।”

‘স্যকাব্লু!’ চিৎকার করে বলল ডিভান। “আপনার উচিত ছিল সুযোগটার সদ্ব্যবহার করা।“

“তাই না-কি মঁসিয়ে,” গর্বোদ্ধত কণ্ঠে বলল ইংরেজ, “আর্সেন লুপাঁর মতো প্রতিপক্ষের যখন মুখোমুখি হই, তখন আমি আচমকা পাওয়া সুযোগের সাহায্য নেই না। আমি ওগুলো তৈরি করে নিই।”

তবে হাতে যেহেতু সময় কম, আর সহৃদয়তার সাথে লুপাঁ গাড়িটাকে এখানে পাঠিয়েছে, এই সুযোগটার সদ্ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নিল তারা। এডোয়ার্ড বসল ড্রাইভিং আসনে। তাদের নিয়ে রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে রওনা হলো আরামদায়ক লিমোজিন। হঠাৎ-ই ক্যারিজের পকেটে থাকা একটা ছোট্ট প্যাকেটের দিকে দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো ডিভানের 1

“আরে! কী এটা? একটা প্যাকেট! কার এটা? এটা দেখছি আপনার জন্য।”

“আমার জন্য?”

“হ্যাঁ, ঠিকানা তো তাই লেখা আছে: শার্লক হোমস। প্রেরক: আর্সেন লুপাঁ।”

প্যাকেটটা হাতে নিল হোমস। প্যাকেটটা খুলতেই ভেতর থেকে বেরোল একটা ঘড়ি।

“ইশ!” ক্ষুব্ধ অভিব্যক্তি প্রকাশ পেল হোমসের কণ্ঠে।

“একটা ঘড়ি,” বলল ডিভান। “এটা এখানে কীভাবে এলো?”

কোনো জবাব এলো না ডিটেকটিভের তরফ থেকে।

“ওহ! এটা আপনার ঘড়ি? আর্সেন লুপাঁ আপনার ঘড়ি ফেরত দিয়েছে? তবে তার আগে নিশ্চয় তাকে এটা নিতে হয়েছে। হায় খোদা, সে আপনার ঘড়ি নিয়ে গিয়েছিল! ব্যাপারটা দারুণ না, শার্লক হোমসের ঘড়ি চুরি করেছে আর্সেন লুপাঁ? ক্ষমা করবেন, মঁসিয়ে,আমি আসলে হাসি ঠেকাতে পারছি না।“

অদম্য হাসিতে ফেটে পড়ল ডিভান। হাসির তোড় কিছুটা কমতেই আন্তরিক কণ্ঠে বলল, “তবে লোকটা আসলেই চতুর।”

একটা পেশিও নড়াচড়া করল না ইংরেজ ভদ্রলোকের। ডিয়েপ যাওয়ার পথে আর একটা কথাও উচ্চারণ করল না সে। দৃষ্টি স্থির রাখল পেছোতে থাকা দৃশ্যাবলীর দিকে। তার এই গভীর নীরবতা বুনো গর্জনের চেয়েও ভয়ানক মনে হচ্ছে ডিভানের কাছে। রেল স্টেশনে পৌঁছে শান্ত কণ্ঠে কথা বলল হোমস। তার কণ্ঠে ফুটে উঠল এই বিখ্যাত লোকের সেই চিরপরিচিত দৃঢ় আস্থা আর প্রাণ প্রাচুর্যের আভাস। বলল সে:

“হ্যাঁ, সে চালাক লোক নিঃসন্দেহে। তবে যে হাতটা আমি এই মুহূর্তে আপনার দিকে বাড়িয়ে দিয়েছি, সেটা একদিন তার কাঁধে রাখতে পারলে খুশি হবো, মঁসিয়ে ডিভান। আমার ধারণা, আর্সেন লুপাঁ আর শার্লক হোমস আবারও একদিন মুখোমুখি হবে। হ্যাঁ, পৃথিবীটা আসলে খুবই ছোটো—আমাদের দেখা হবে-অবশ্যই দেখা হবে—আর সেদিন–“

1 Comment
Collapse Comments
দারাশিকো (darashiko.com) August 19, 2023 at 1:33 pm

খালেদ নকীবের অনুবাদ জঘন্য হয়েছে। পড়ার আগ্রহই পাওয়া যাচ্ছে না৷ উনি ব্যবসায়ী মানুষ, অনুবাদের কাজটা অন্য কাউকে দিয়ে করিয়ে নিলে পারতেন।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *