শারদপ্রাতে

শারদপ্রাতে

‘পুজো তো আসছে, এসেই গেল, এবার পুজোয় কী করবি রে তুই বুলবুলি?’

বুলবুলি বসেছিল একটা মস্ত কদম গাছের শোয়ানো ডালে দু-টি পা একদিকে ঝুলিয়ে৷ কদম ফোটা শেষ হয়ে গেছে অনেকদিন৷ তবু গাছতলা থেকে প্রায় পচে যাওয়া ক-টি কদম কুড়িয়ে নিয়ে ঘাস দিয়ে গেঁথে মুকুটের মতো মাথায় পরেছে বুলবুলি পাগলি৷

ও ঋভুকে বলল, ‘দ্যাখ, দ্যাখ, আমি রাধা হয়েছি৷ তুই কৃষ্ণ হবি? এই রিভে?’

ঋভু উত্তর না দিয়ে বুলবুলির দুটি উজ্জ্বল কালো চোখের দিকে চেয়ে রইল৷

পাগলির কথা! পাগলে কী না বলে ছাগলে কী না খায়!

কদমের দিন শেষ, এখন শিউলির দিন৷ শিউলি বনের নীচে তাকালেই চোখ আটকে যায়৷ চাপ চাপ সবুজ ঘাসে শরতের শিশিরের শারদ গন্ধ ভাসে৷ সেই ঘাস ঠেলে ঠেলে নীলচে-বাদামি শামুক হেঁটে যায় নিজের চালে৷ তার কোনোই তাড়া নেই৷ সময়ের পায়ে জুতো পরিয়ে সে হাত ধরে তার পাশে পাশেই নিয়ে চলে সময়কে৷

শিউলির দুধ-সাদা গা আর গা শিউরানো কমলা-রঙা বোঁটাগুলি সবুজ বনতলিকে সাদা আর কমলা শিশিরভেজা আভায় বিছিয়ে দিয়েছে৷ পুকুরের মধ্যে থেকে একটা হাঁস উঠে এল৷ গ্রীবা ঘুরিয়ে পিঠের পালক মুছল ঠোঁট দিয়ে৷ নিজের মনে শিস দিল হিস হিস করে৷ তার পেছনে পেছনে তিনটি হাঁসি৷ তাদের ঠোঁটের রং পচা পাতার মতো হলুদ৷ আর পায়ের রং ঠিক শিউলি ফুলের বোঁটারই মতো৷ কমলা৷ সাদা হাঁস আর হাঁসিরা পেট দুলিয়ে দুলিয়ে থপথপিয়ে চলে গেল, ঋভুর মনে হল যেন শিউলি ফুলেই তৈরি ওরা৷ যেন শোলার হাঁস সব৷ সরস্বতীর৷

জলঢোঁড়া সাপটা, ধোপার পাটের উপর তার মস্ত হলুদ-কালো শরীরটা নিয়ে আস্তে আস্তে একটু একটু করে উঠে এল৷ তারপর কুণ্ডলী পাকিয়ে মড়ার মতো শুয়ে রইল তার উপরে৷ তার বড়ো শীত৷ জলের গভীরেও শরতের পরশ লেগেছে৷ রোদ পোয়াবে এখন ও সারাটা দিন৷ ওর গায়ের উপরে হলুদ আর ঘন নীল জলফড়িংরা এক্কাদোক্কা খেলবে এবারে৷ এক্কাদোক্কা নয়, অ্যাই কুমির, তোর জলে নেমেছি৷ সাপটাকে ছুঁই-ছুঁই করেও ছোঁবে না ওরা৷ সাপটা কুমিরের মতো নির্বিকার শুয়ে থাকবে৷ সাপ আর কুমির কুম্ভকর্ণর জাতভাই৷

সোনালি মৌমাছিরা ঘুরে-ঘুরে উড়ে-উড়ে পুকুরপাড়ের কিসিনা-ঝোপের সাদা-সাদা ফুলের মধু খেয়ে বেড়াচ্ছে৷ সাদা-সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘে ভরা ঘন নীল আকাশে দুটি ডানা সটান মেলে দিয়ে, একটুও না নাড়িয়ে ভেসে যাচ্ছে সোনালি ডানার চিল৷ নিষ্কম্প৷ তিস্তার জলের আর পচা পাটের আর কলমি শাক আর মিরগেল মাছের রুপোলি বাচ্চার গন্ধ তার নাকে সুড়সুড়ি দিচ্ছে৷

শরৎ যে এসেছে, তা জানতে আর কারও বাকি নেই৷ এমনকি জেনে গেছে মাছরাঙাটাও৷ কী দারুণ খুশিতে সে একবার জলে ছোঁ মারছে, আর একবার মরে যাওয়া শিরীষ গাছটার ডালে তেকোনা কোটরে এসে বসে জল ছিটোচ্ছে মাথা ঝেড়ে ঝেড়ে৷ হাজার হিরে ছিটকে যাচ্ছে শরতের মাঝ-সকালের রোদে৷ মাছ কিন্তু পাচ্ছে না ও একটিও৷ তবু খুশি৷ খুশি বড়ো ছোঁয়াচে রোগ৷ পুজো-পুজো গন্ধ লেগেছে আকাশে৷ কোরা শাড়ির গন্ধ উড়ছে রোদে৷ কুমোরপাড়ায় প্রতিমা গড়া শেষ৷ ঢাকিরা সকাল-বিকেল ঢাকে চাঁটি দিয়ে দেখে নিচ্ছে ঢাক-ঢিক-ঢাক! সব ঠিকঠাক আছে কি নেই!

জমিদারবাবুর বাড়ির সামনে হাড়িকাঠ বসেছে দুটি৷ একটি মোষবলির৷ অন্যটি পাঁঠা৷ একশো আটটি পাঁঠা বলি হবে নাকি এবারে৷ জমিদারবাড়ির আলসের হাজার পায়রা ছটফট করে উঠে ফটফট শব্দে উঠোনময় উড়ে বেড়াচ্ছে৷ রক্তের আগাম গন্ধ অনেক আগে পায় ওরা৷ ওদের ত্রস্ত চোখের মণি একবার এদিক, আরবার ওদিক হচ্ছে ভয়ে৷

জমিদারবাবু এবার পুজোয় সিমলে পাহাড়ে না গিয়ে গ্রামে এসে সক্কলকে কৃতার্থ করবেন বলেছেন৷ ছুঁচোয় কাটা মস্ত মস্ত শামিয়ানা রোজ রোদে পড়ছে৷ ঝাড়াই-পেটাই হচ্ছে৷ অষ্টমী পুজোর দিন নেমন্তন্ন হয়েছে সকলেরই৷ গরিবগুর্বোরাও বাদ যায়নি৷

ওই হাড়িকাঠগুলোর কাছে গেলেই রক্তের গন্ধ পায় ঋভু৷ বড়ো বিচ্ছিরি সেই গন্ধ৷ জল থেকে সদ্য ওঠা হাঁসের গায়ের গন্ধ ঋভুর ভালো লাগে, ভালো লাগে শিউলির গন্ধ, শেষ রাতের তারাদের গায়ের নীল কুচি গন্ধ আর ওর মায়ের গায়ের গন্ধও৷ রক্তের গন্ধ ভালো লাগে না৷

বুলবুলি শুনে হাসে৷ হিঃ-হিঃ-হিঃ৷ ওর খালি গা থেকে ছিঁড়ে যাওয়া ফলসা রঙা পাড়ের খড়কে ডুরে শাড়ির আঁচল খসে পড়ে৷ বলে, ‘রক্ত ভালো লাগে না? বলিস কী তুই রিভে? রক্তই তো জীবন রে৷ রক্তই তো মরণ৷ তুই না এখনও বড়োই ছেলেমানুষ আছিস৷’

‘বললি না তুই, পুজো আসছে, এবার কী করবি তুই পুজোয়?’ ঋভু আবার বলল৷

‘আমি? আমি আবার কী করব?’

‘কেন, মজা করবি না?’

‘কীসের মজা? আমি কি তোর মতো বড়োলোকের পুঃ?’

‘বা রে! বোকা বোকা কথা বলিস না৷ পুজো আবার বড়োলোক-গরিবলোকের আলাদা হয় নাকি?’

‘একশোবার হয়৷’

‘জানি না৷’

‘তুই কতটুকু জানিস?’

‘অঞ্জলি দিবি না? বুলবুলি?’

‘দেব তো৷’

‘কী বলবি?’

‘ন্যাকা! সবাই যা বলে৷ যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা৷ নমস্তস্যৈ নমস্তস্যৈ নমন্তস্যৈ নমো নমঃ৷’

‘সে তো মন্ত্র হল৷ অঞ্জলি দেবার সময় কিছু চাইবি না? মায়ের কাছে?’

‘এ মাঃ৷ দেখেছিস আসল কথাটাই তো বলতে ভুলে গেছিলাম৷ এবার তো একটা স্পেশ্যাল জিনিস চাইব মায়ের কাছ থেকে৷ কয়েকটা বরই চাইব এবারে৷ নইলে চলছে না৷ আমার খুবই দরকার,’ কদমগাছে বসে জোড়া পা দুলিয়ে বুলবুলি বলল৷

ঋভু বলল, ‘অতগুলো বর নিয়ে কী করবি? বিয়ে করতে তো একটা বরই লাগে?’

‘আঃ তুই না৷ ওই বর নয় রে গাধা৷ বর সে মানে আশীর্বাদ৷’

‘ওঃ৷ ওই বর!’

‘হ্যাঁ রে৷ ওই বর৷’

‘তা কী কী বর চাইবি?’

‘সবচেয়ে প্রথমে যে বরটা চাইব, তা হল আমি যেন সোনামুখ করে মিথ্যে কথা বলতে পারি৷’

‘মিথ্যে কথা?’

‘হ্যাঁ রে৷ মিথ্যে বলতে পারি না, মানুষের মন রাখতে পারি না, পাজিকে পাজি বলি, বদমাশকে বদমাশ, ধূর্তকে ধূর্ত; তাইই তো আমার এত কষ্ট এত হেনস্থা৷’

‘তাইই?’

‘না তো কী?’

‘আর?’

‘তাপ্পর বর চাইব, আমি যেন ঘনঘন সেলাম করতে পারি৷ কাঠের পুতুলেরই মতো আমার হাত যেন কেবলই কপালে ওঠে আর নামে৷ প্রশ্বাস না দিয়েই বলতে পারি, জি হুজুর৷ পায়ে হাত দিতে পারি যার-তার, এক থালা ভাতের জন্যে, ঘৃণাভরে ছুড়ে দেওয়া দুটি পয়সার জন্য যেন হামলে পড়তে পারি পায়ে৷ বর চাইব মায়ের কাছে, মা যেন আমার মান-অপমান-জ্ঞান এবার বিসর্জনের দিন ধুয়ে মুছে দেন একেবারে৷ নিজেকে আমি যেন মানুষ বলেই আর কখনও মনে না করি!’

‘সে কী রে বুলবুলি? কী বলছিস তুই?’

‘ঠিকই বলছি রে৷ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা বড়ো কষ্টের রে ঋভু৷’

‘সাধে কি আর লোকে তোকে পাগলি বলে৷ মানুষ না তো আমরা কী? তুই মানুষ নোস? আমি মানুষ নই?’

‘তুই হাসালি রিভে৷ এই নইলে বলি তুই বড়োলোকের পুঃ তোর মুক্কে মারি ঝুঃ?’

‘বাজে কথা বলিস না৷ বল না৷ আমার কথার উত্তর দে তুই৷ ফালতু কথা বললেই মানব কেন?’

বুলবুলি ঝরে যাওয়া শিউলি ফুলের মতো নিঃশব্দে হাসল একবার৷ বলল, ‘গাধারে, মানুষের চেহারা নিয়ে জন্মালেই কি আর মানুষ হওয়া যায়! চারধারে যে কত-শত বেঁটে-লম্বা, রোগা-মোটা মানুষের চেহারার প্রাণী দেখিস অহরহ, তোর কি ধারণা এরা সকলেই মানুষ? মানুষের মতো মানুষ ক-টা আছে হাতের কড় গুনে বলা যায়৷ যাদের দেখিস তারা ভিড় বাড়াবার জন্যই এখানে আসে৷ সাইলেন্ট পিকচারের মিছিলে ভাড়া করা অ্যাকটরদের মতো৷ মা জগদ্ধাত্রী পিকচারের শুটিং হল না চাঁপার মাঠে সেদিন? দেখিসনি তুই? সেইরকম অ্যাকটর৷ মানুষ আসলে আর ক-জন?’

‘তুই নিজে যদি মানুষের মতো মানুষই হোস, তা হলে আবার ইচ্ছে করে অমানুষ হতেই বা চাস কেন?’

‘আরামে থাকব বলে৷ বললাম না তোকে৷ মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা বড়ো কষ্টের৷ কোনও মানে হয় না৷ অমানুষদের দলেই ভিড়িয়ে দেন যেন মা, এই বরই চাইব এবারে৷ তাপ্পর শহরে যাব৷ তোদের কলকাত্তা, ফেলাট কিনব, গাড়ি চড়ব৷ হিঃ হিঃ৷’

‘আর কী বর চাইবি?’

‘আর? আর বর চাইব, মা যেন আমাকে একটা অসুখ দেন৷’

‘অসুখ চাইবি কী রে!’

‘হ্যাঁ রে রিভে,’ বুলবুলি বলল৷

ওর গলার স্বর ভারী হয়ে এল৷ ঝুপ করে গাছ থেকে নেমে পড়ে আঁচলটা গাছকোমর করে বেঁধে নিয়েই ও বলল, ‘চলি রে, ঠাকমার জন্য শাক আর কচু তুলে নিয়ে যেতে হবে৷ ঠান্ডা পড়তে আরম্ভ করল৷ সাপ ধরে যে ঠাকমাকে রেঁধে খাওয়াব, সেই সাপেরও আকাল হবে শীত পড়লে৷ কারও পৌষ মাস, কারও সব্বোনাশ৷ কোন গর্তের কোন গভীরে গিয়ে পাকিয়ে থাকবে তারা তখন, কে জানে? বড়োই দুদ্দিন এল৷ তোদের পুজো, আমাদের হুজো৷ যাই রে৷’ বলেই বুলবুলি পা বাড়াল ঝুমকি বিলের দিকে৷

ঋভুও বাড়ির দিকে এগোল৷

বুলবুলি মা-দুগ্গার কাছে যে অসুখ চাইবে, একথা শোনার পর থেকে ওর কিছুই ভালো লাগছিল না৷

বড়ো সুন্দর হয়ে উঠেছে প্রকৃতি৷ ঝুমকির বিলে শাপলা ফুটেছে৷ পদ্ম৷ কত ভ্রমর৷ কত-রঙা প্রজাপতি৷ আকাশ-বাতাসে এখন সবসময় স্নো-পাউডার আর কোরা তাঁতের শাড়ির গন্ধ ভাসে৷ সমস্ত পৃথিবীটাই যেন মায়ের কোল হয়ে গেছে৷ মিষ্টি-মিষ্টি স্নিগ্ধ গন্ধে নাক ভরে যায়৷

হাঁসেরা ঝুমকি বিলের পাশে গোল হয়ে জটলা করছে৷ অনেক দূরের উঁচু ডাঙার বাড়িতে এক কিশোরী৷ তার কমলা-রঙা আদুড় পা দেখা যাচ্ছে লটকা গাছের ছায়ায়৷ কুলোতে ধান নিয়ে সে দু-হাতে কুলো ধরে হাত উঁচু করে অবেলায় ডাকছে হাঁসেদের, চই-চই-চই…৷ তার স্বর বাঁশবনের মধ্যে চরকি খেয়ে ভেসে যাচ্ছে ঝুমকি বিলে৷ হাঁসেরা যাবে কি যাবে না, ঠিক করতে পারছে না৷ এখন অনেক গুগলি, ঘাস, ফাঙ্গি, জলের নীচে৷ শরতের রোদ পড়ে জলের নীচে সবুজ অন্ধকার ফিকে বোতল-সবুজ আর হলুদের ডোরাকাটা শতরঞ্চি হয়ে গেছে৷ এই জলের তলার আলো-ছায়ায় ডুব সাঁতার দিয়ে মজা করতে হাঁসেরা খুব ভালোবাসে৷

ওই হাঁসেদের মতো খুবই ভালো লাগছিল ঋভুর৷ বাবা কলকাতা থেকে আসবেন পঞ্চমীর দিন৷ অনেক জামা-প্যান্ট, নতুন নটিবয় জুতো নিয়ে৷ বড়োকাকা, মেজোকাকা, সেজোকাকারাও অনেক প্রেজেন্টেশন দিয়েছেন৷ ছোটোকাকা আর জ্যাঠাবাবুও৷ খুব মজা হবে ঋভুর এবার পুজোয়৷

ঝুমকি বিলের বাঁকটা ঘুরেই হঠাৎ ওর খুশি মনটা খারাপ হয়ে গেল বুলবুলির জন্যে৷ শুধু গায়ে জড়ানো ওর ওই ছেঁড়া শাড়িটা ছাড়া আর একটি মাত্রই শাড়ি আছে বুলবুলির৷ সেটিও ওই রকম ছেঁড়া৷ ঋভুদের অত আছে অথচ বুলবুলিদের প্রায় কিছুই নেই৷ কারা এইসব থাকাথাকি ঠিক করে দেয়? কারও খুব বেশি না থাকে, আর কারোরই খুব কম নয়, এমনটি কি ঠিক করে দিতে পারে না কেউ? মা দুর্গা বা অন্য কেউই?

বুলবুলি কোন অসুখের বর চাইবে এবারে পুজোয় মায়ের কাছ থেকে তা জানে না ঋভু৷ তবে একদিন বুলবুলি চাঁপার মাঠে মূল খুঁড়তে খুঁড়তে ফিসফিস করে ঋভুকে বলেছিল কথাটা৷ আকাশ ঘন মেঘে ঢাকা ছিল৷ ঘনঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল৷ মাদল বাজছিল শ্রাবণের মেঘে-মেঘে৷ বুলবুলি বলেছিল, ‘জানিস রিভে, ওই খিদেটা যদি না থাকত আমার, আমার ঠাকমাবুড়ির; তাহলে পিথিবীটা কী ফাস্টো কেলাস জায়গা হত বল তো? শুনেছি তোদের মতো বড়োলোকদের নাকি একটা অসুখ হয়, সেই অসুখের নাম খিদে না পাওয়ার অসুখ৷ কত হাজার টাকা খরচ করে বড়োলোকেরা সব খিদে হওয়ার জন্য চেঞ্জে যায় পশ্চিমে৷ আর এই খিদেয় আমাদের কুটুরে ব্যাঙের মতো কাটে সর্বক্ষণ৷ কুটুরকুটুর৷ খালি পেটে থেকে থেকে চোঁয়া ঢেকুর ওঠে সবসময়৷ তোদের বড়োলোকদের অসুখটা যদি আমরা পেতাম না, তা হলে কী মজাই যে না হত; কী বলব রে তোকে রিভে৷’

বাড়ির দিকে হাঁটতে হাঁটতে ঋভু দেখতে পেল ঝুমকি বিলের অন্যপাশে শাড়িটাকে হাঁটু অবধি তুলে পাঁকে-জলে উবু হয়ে শাক তুলছে বুলবুলি, গুগলি খুঁজছে৷

থমকে দাঁড়িয়ে গেল ঋভু৷ হঠাৎ বড়ো মন খারাপ হয়ে গেল ওর৷ এবার পুজোতে ও কোনও আনন্দই করবে না ঠিক করল৷ মা-কে বলে বুলবুলি আর ঠাকুমার জন্যে অনেক কিছু কিনে দেবে ঋভু৷ পুজোর মধ্যে লুচি, মাংস, পাকা রুই, ক্ষীর—এইসব খাওয়াবে৷ যে আনন্দ, যে সুখ সকলের সঙ্গে সমানভাবে ভাগ করে না নেওয়া যায়, তা সুখই নয়৷ আনন্দই নয় তা৷ এই কথাটা মনে হতেই খুব ভালো লাগল৷ দু-হাতের পাতা মুখের কাছে এনে মুখ আকাশের দিকে তুলে চেঁচিয়ে ডাকল, ‘ও-বু-ল-বু-ল-ই-ই-ই-ই…’

বুলবুলি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ঋভুকে দেখতে পেয়ে বলল, ‘কী-ই-ই-ই-ই?’

ঝুমকি বিলের ওপর দিয়ে শাপলা আর পদ্মর গা পিছলে প্রশ্নটা দৌড়ে এল ছিলিক ছিলিক দাঁড়াশ সাপেরই মতো ঋভুর দিকে৷

ঋভু বলল, ‘বুলবুলি তোর খিদে আমি নিলাম৷ আমি-ই-ই-ই৷’ ‘আমি’ কথাটা বিশ্বচরাচর ভরে দিল৷ সামান্য ঋভুর আমিত্বটা যে এতো বড়ো, তা জেনে অবাক হল ও৷

ঋভু আবারও বলল, ‘আমাতে, আমাতে-তোতে আর…৷ আমরা সব্বাই মিলে শিউলি ফুলের মতো সুখকে ভাগ করে নেব৷ বুলবুলি-ই-ই-ই-ই৷’

কথাগুলি বোধহয় পৌঁছোল না দূরে৷ শহরের ছেলে, হাওয়ার মধ্যে, মাঠের মধ্যে কথা কইতে জানে না৷ তবু শরতের আলোয় শেষ-সকালের পদ্মবন হাসতে লাগল৷ জলছড়া দিয়ে ব্যাঙাচি দৌড়ে গেল পদ্মপাতার গভীরে৷ মাদারগাছে-বসা বুড়ো তক্ষক সব শুনে-টুনে বলে উঠল, ‘ঠিক, ঠিক, ঠিক৷’

বুলবুলি বড়োলোকের পুঃ’র কথা অতদূর থেকে বুঝতে পারল না৷ আবারও উবু হয়ে গুগলি খুঁজতে লাগল৷ তার পেট আর পিঠের মধ্যিখানে নাভিটা জ্বলতে লাগল খিদেয়৷ ঝপাঝপ পদ্ম তুলল ক-টা৷ পদ্মের পরাগ আর বীজ খেতে খুব ভালো৷ রক্তের মতো লাল পদ্মগুলি, রোদে দাঁড়ানো তার উত্তপ্ত মাথাময় যেন লাল রং ছড়িয়ে দিল৷ রক্তের মতো লাল রং৷

‘রক্তই জীবন৷ এবং রক্তই মরণ৷’ মনে মনে বলল বুলবুলি৷

দূরে মিলিয়ে যেতে থাকা ঋভুর দিকে একবার আড়চোখে চেয়ে মনে মনে বলল, ‘ছেলে তুই খুবই ভালো রে রিভে, কিন্তু বাঁচার মানেই জানলি না জীবনে৷ যার পেটে খিদে নেই, জীবন যার কাছে ঝুমকির বিলে ভেসে বেড়ানো হাঁসা-হাঁসিরই মতো সহজ সুখের; বাঁচা অথবা মরার তফাত তারা কী জানে রে! ছেলেটা ভালো৷ কিন্তু একেবারেই ভ্যাবা গঙ্গারাম৷ খিদে আর পিপাসাই যে জীবন, তা কি ওই ছেলেটা জানবে কোনোদিনও? কত্তরকমের খিদে, কত্তরকমের পিপাসা…ওই ছেলেটা ভেলভেলেটা?’

বুলবুলি পাগলি গলা ছেড়ে গান ধরল৷ ‘লালন ফকির’ যাত্রাতে শুনেছিল চৈত্র মাসে৷ লালন ফকিরের গান :

ও তোপ ঠিকরে ঘরে ভুল পড়েচে মন৷
কিসে চিনবি রে মানুষ রতন লল
আপনি খবর নাই আপনারে
বেড়াও পরের খবর করে
মন রে, আপনারে চিনিলে পরে
পরকে চেনা যায় তখন লল

বুলবুলির খোলা গলার গান ঝুমকির বিল সাঁতরে বাড়ির-পথ-ধরা ঋভুর কানে গিয়ে ভেসে উঠল৷

ঋভু ভাবল, সুখে যদি সকলেরই ভাগ না থাকে, তবে সেই সুখ সুখই নয়, তার দামই নেই৷ সেই সুখে মজা নেই কোনও৷ আনন্দের প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পেরে খুশিতে ডগমগ হয়ে উড়ে চলল ঋভু বাড়ির দিকে৷



Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *