শাপে বর

শাপে বর

সস্তায় বাড়ি ভাড়া লইয়া বড় প্যাঁচে পড়িয়াছিলাম।

কয়েক বছর আগেকার কথা। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ তখনও এমন মৌরসী পাট্টা লইয়া বসে নাই; এই পোড়া কলিকাতা শহরেই চেষ্টা করিলে ভদ্রলোকের বাসোপযোগী বাড়ি কম ভাড়ায় পাওয়া যাইত।

পাড়াটা তেমন ধোপদুরস্ত নয়; বাড়িখানাও পুরানো, কিন্তু বেশ ঝরঝরে; এঁদোপড়া নোনাধরা নয়। তাহার উপর ভাড়া মাত্র কুড়ি টাকা শুনিয়া দাঁও মারিবার মতলবে একেবারে এক বছরের লেখাপড়া করিয়া লইয়াছিলাম। মনে মনে এই ভাবিয়া উৎফুল্ল হইয়াছিলাম যে, বাড়িওয়ালার খুব মাথা মুড়াইয়াছি। এই কলিকালে বাড়িওয়ালার মাথা তাহার পিতৃশ্রাদ্ধেও কেহ মুড়াইতে পারে না, এ জ্ঞান তখনও হয় নাই।

জ্ঞান হইল যেদিন গৃহপ্রবেশ করিলাম সেইদিন সন্ধ্যাবেলা। দিনের আলো একটু ঘোলাটে হইতে না হইতে ঘরের মধ্যে ফর্‌-ফর্‌ ফর্‌-ফর্‌ শব্দ শুনিয়া দেখি, আরশোলা উড়িতেছে। তারপর যতই রাত্রি হইতে লাগিল ততই আরশোলা বাড়িতে লাগিল; পুরানো বাড়ির অসংখ্য ফাঁক-ফোকর-ফাটল হইতে বাহির হইয়া ঘরে ঘরে উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল। তাহাদের অগণ্য বলিলেও যথেষ্ট হয় না, পঙ্গপালের মতো সীমা-সংখ্যাহীন আরশোলা! মানুষ সম্বন্ধে তাহাদের মনে লেশমাত্র সম্ভ্রম নাই, জামাকাপড় ভেদ করিয়া শরীরের এমন দুর্গম স্থানে প্রবেশ করিতে লাগিল যে, মৃতদেহেরও বিপন্ন হইয়া পড়িবার কথা। রাত্রে মশারির মধ্যে শয়ন করিয়াও নিষ্কৃতি নাই, কোন্‌ অদৃশ্য ছিদ্রপথে প্রবেশ করিয়া ইহারা আমাদের দাম্পত্য নিদ্রাকে নিরতিশয় বিঘ্নসংকুল করিয়া তুলিল। আমাকে যৎপরোনাস্তি উস্তম-খুস্তম তো করিলই, ওদিকে গৃহিণীর অবস্থা সত্য সত্যই সঙ্গীন করিয়া তুলিল।

তারপর যতপ্রকার বৈজ্ঞানিক উপায় আছে, সমস্ত প্রয়োগ করিয়া এই নিশাচর পতঙ্গগুলাকে নিপাত করিবার চেষ্টা করিলাম, কিন্তু তাহারা এতই সংখ্যাগরিষ্ঠ যে কোনও ফল হইল না। দিনের বেলায় ইহারা কোথায় অদৃশ্য হইয়া যায়, কিন্তু সন্ধ্যা হইতে না হইতে আবার দলে দলে ঝাঁকে ঝাঁকে ফিরিয়া আসে। কয়েক দিনের মধ্যেই ইহাদের উৎপাতে পাগল হইয়া যাইবার উপক্রম হইল।

রবিবার সকালে অত্যন্ত বিমর্ষভাবে বাহিরের বারান্দায় বসিয়া ভাবিতেছিলাম। বাড়ি ছাড়িয়া যাইতে পারি, কিন্তু বাড়িওয়ালা কোনও ছুতানাতাই শুনিবে না, কান ধরিয়া এক বৎসরের ভাড়া আদায় করিয়া লইবে। অথচ এ বাড়িতে আর কিছুদিন থাকিলেই হঠাৎ একদিন প্রাতঃকালে পরিধেয় বস্ত্রখানি ফেলিয়া দিয়া নাচিতে নাচিতে বাহির হইয়া যাইতে হইবে, ইহাও একপ্রকার সুনিশ্চিত। বাড়িওয়ালার উদ্দেশ্যে গালি দিয়া দিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছি, কোনও ফল নাই। এখন উপায় কি?

চোখ তুলিয়া দেখি, ফেলু সম্মুখের রাস্তা দিয়া যাইতেছে। আমাকে দেখিয়া ফেলু সবিস্ময়ে দন্তবিকাশ করিল; আমি হাতছানি দিয়া তাহাকে ডাকিলাম।

ফ্যালারামের সহিত আমার অনেক দিনের পরিচয়—প্রায় পাঁচ বছর পাশাপাশি বাড়িতে বাস করিয়াছি; ইদানীং কিছুকাল যাবৎ সে শহরের এক প্রান্তে এবং আমি অন্য প্রান্তে ছিটকাইয়া পড়িয়াছিলাম। তবু মাঝে মাঝে ট্রামে বাসে দেখা হইত। ফেলু বয়সে আমার কনিষ্ঠ, নেহাত সরল ভালমানুষ গোছের লোক। নিয়মিত কোনও কাজকর্ম করিত বলিয়া আমার জানা নাই, অথচ বেশ স্বচ্ছলভাবেই সংসার চালাইত দেখিতাম। অন্তত আমার নিকট হইতে কখনও টাকা ধার চাহে নাই। টাকা উপার্জনের নানা ফন্দি তাহার মাথায় ঘুরিত এবং আপাতদৃষ্টিতে ফন্দিগুলা হাস্যকর মনে হইলেও সে তাহা হইতেই কিছু না কিছু রোজগার করিয়া লইত।

সে আসিয়া বলিল, ‘এ কি দাদা! আপনি এখানে?’

বলিলাম, ‘কয়েকদিন হল এ বাড়িতে উঠে এসেছি। তুমি এদিকে কি মনে করে?’

ফেলু আমার পাশে বসিয়া বলিল, ‘বাড়ি খুঁজে বেড়াচ্ছি, দাদা। বাড়িওলা নোটিশ দিয়েছে, তার নাকি মেয়ের বিয়ে।’

মাথার মধ্যে বিদ্যুৎ শিহরিয়া গেল। ভগবান কি সত্যই মুখ তুলিয়া চাহিলেন। যথাসাধ্য তাচ্ছিল্যভরে বলিলাম, ‘বাড়ি খুঁজছ! তা আমি এ বাড়িটা ছেড়ে দেব ভাবছি, আপিস থেকে বড় দূর হয়। তোমার যদি পছন্দ হয় নিতে পারো।’

বাড়িখানা একবার ঘুরিয়া দেখিয়াই ফেলু পছন্দ করিয়া ফেলিল, বস্তুতঃ দিনের বেলা বাড়ি কাহারও অপছন্দ হইবার কথা নয়। ভাড়া কুড়ি টাকা শুনিয়া ফেলু আরও মুগ্ধ হইল। আমি তখন বলিলাম, ‘সারা বছরের ভাড়াটা কিন্তু আগাম দিয়ে দিতে হবে ভাই। জানো তো বাড়িওয়ালাদের ব্যাপার—চুষুণ্ডি ব্যাটারা—’

ফেলু ক্ষণেক চিন্তা করিয়া ঈষৎ বিহ্বলভাবে বলিল, ‘কিন্তু দুশ’ চল্লিশ টাকা তো এখন বার করতে পারবো না দাদা, একটু টানাটানি যাচ্ছে, মেরেকেটে দুশ’ টাকা দিতে পারি। তা বাকি টাকাটা যদি পরে নেন্—’

আমিও ক্ষণেক চিন্তা করিলাম। এই সুযোগ—অগ্রিম যাহা পাওয়া যায় তাহাই লাভ, পরে আরশোলার খবর পাইলে ফেলুর মতো ভালমানুষও আর টাকা দিবে না।

সুতরাং উদার কণ্ঠে বলিলাম, ‘বেশ, দুশ’ টাকাই নেব। তুমি তো আর পর নও। বাকি টাকা আর তোমাকে দিতে হবে না।’

আহ্লাদে ও কৃতজ্ঞতায় ফেলু গদ্‌গদ হইয়া উঠিল। স্থির হইল আগামী রবিবার সে এ বাড়িতে উঠিয়া আসিবে, আমি ইতিমধ্যে অন্য বাড়ি খুঁজিয়া লইব।

অতঃপর নির্দিষ্ট দিনে ফেলু সপরিবারে আসিয়া বাড়ি দখল করিল; আমি দুইশত টাকা পকেটে পুরিয়া বাড়িটিকে মনে মনে দণ্ডবৎ করিয়া বিদায় লইলাম। স্থির করিলাম, ভবিষ্যতে ফেলারামকে যথাসাধ্য এড়াইয়া চলিব। তার স্বভাবটা খুবই শান্ত, কিন্তু বলা তো যায় না।

মাস দুয়েক নির্বিঘ্নে কাটিয়া গেল। তারপর হঠাৎ একদিন এক সিনেমা বাড়ির দরদালানে ফেলুর সহিত দেখা। দূর হইতে তাহাকে দেখিয়া কাটিয়া পড়িবার চেষ্টায় ছিলাম, কিন্তু সে ‘দাদা দাদা’ বলিয়া ডাক ছাড়িতে ছাড়িতে আসিয়া ধরিয়া ফেলিল। এই অল্প সময়ের মধ্যে আরশোলা সম্বন্ধে যত প্রকার কৈফিয়ত ভাবিয়া লওয়া সম্ভব তাহা ভাবিয়া লইলাম।

ফেলুর মুখে কিন্তু জিঘাংসার ভাব না দেখিয়া একটু খটকা লাগিল। সে যেন আমাকে দেখিয়া হৃষ্ট হইয়াছে। তবু মুখে সংশয়কুণ্ঠিত একটু হাসি আনিয়া বলিলাম, ‘আরে ফেলু যে! তারপর, কেমন আছ?’

ফেলু একগাল হাসিয়া একগঙ্গা কথা বলিয়া গেল, ‘ভালই আছি দাদা। ভাগ্যে বাড়িখানা আপনি দিয়েছিলেন, বলতে নেই তারই কল্যাণে করে খাচ্ছি। আপনি লক্ষ্য করেছিলেন কিনা জানি না, বাড়িটিতে আরশোলা ছিল দাদা—এন্‌তার আরশোলা ছিল। তাই দেখে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল, দিলুম এক সাইনবোর্ড টাঙিয়ে—‘হাঁপানির পাঁচন’। বললে বিশ্বাস করবেন না দাদা, কাতারে কাতারে লোক; সকাল-বিকেল নিশ্বেস ফেলবার সময় নেই। বৌ রান্নাঘরে উনুন জ্বেলে আরশোলার ক্কাথ তৈরি করে, আর আমি তাই আট আনা শিশি বিক্রি করি। কলকাতা শহরে এত হেঁপো রুগী আছে, কে জানত? রোজ নিদেন পক্ষে দশ টাকার ওষুধ বিক্রি করি; হাঁপানির ধন্বন্তরী নাম বেরিয়ে গেছে। কিন্তু—’

যেন একটু বিমনা হইয়া চিন্তা করিল, ‘একটু ভাবনার কথা হয়েছে দাদা, আরশোলা ক্রমে ফুরিয়ে আসছে। আচ্ছা, আপনি তো অনেক জানেন শোনেন, কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে আরশোলার টেন্ডার কল্ করলে কেমন হয়। এমন ব্যবসাটা শেষে আরশোলার অভাবে ফেঁসে যাবে?’

ইহাকেই বলে পুরুষস্য ভাগ্যং—!

৯ পৌষ ১৩৫১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *