শান্তির দ্বীপে সংঘাত – ৫

ভিক্টর আইল্যান্ডে দখলদার সরকারের মন্ত্রীসভার বৈঠক।

মন্ত্রীসভার বৈঠকে সাধারণত প্রধানমন্ত্রী নেতৃত্ব দেন।

কিন্তু আজকের মন্ত্রীসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নয়, খোদ প্রেসিডেন্ট অর্থাৎ রাজা চতুর্থ হেরাল্ডের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

ভিক্টর আইল্যান্ডে দখলদার সরকারের সত্তর সদস্যের একটা পার্লামেন্ট আছে। দখলদারীর পূর্বে সুবর্ণদ্বীপে পার্লামেন্ট ছিল একশ চল্লিশ সদস্যের। পূর্বে প্রতি পাঁচ হাজার লোক দ্বারা নির্বাচিত একজন পার্লামেন্ট সদস্য ছিল। এখন দেড় হাজারে একজন। পার্লামেন্টের সব সদস্যই শ্বেতাংগ এবং তারা প্রকৃত পক্ষে নির্বাচিত নয়, মনোনীত। ভিক্টর পরিবার এবং এই পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্টরাই এই মনোনয়ন দেয়। মন্ত্রীসভার ২১ জন সদস্যের সবাই শাসক সিন্ডিকেটের সদস্য। এই সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে ভিক্টর পরিবার এবং এই পরিবারের সাথে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে। ভিক্টর আইল্যান্ডে বসতির অধিকার কে পাবে আর কে পাবে না তা নির্ধারণ করে এই সিন্ডিকেটই। তবে ‘সোর্ন’-এর লোক যারা ভিক্টর আইল্যান্ডে বসতি গাড়ছে, তাদের কথা আলাদা। তাদের বসতির বিষয়টা দেখে ‘সোর্ন’-এর কেন্দ্রীয় কর্তৃপক্ষ। আইল্যান্ডের ভিক্টর সরকার তাদের সিদ্ধান্তের প্রতি একটা আনুষ্ঠানিক অনুমোদন দান করে মাত্র।

মন্ত্রীসভার বৈঠকে ২১ জন সদস্যের সবাই উপস্থিত।

প্রধানমন্ত্রী যে আসনে বসে মন্ত্রীসভায় সভাপতিত্ব করেন, সেই আসনেই তিনি বসে। তার আসনটি মন্ত্রীসভার সদস্যদের ফ্লোর থেকে ৬ ইঞ্চি উঁচু একটা মঞ্চে।

প্রধানমন্ত্রীর আসন থেকে ছয় ফুট পেছনে এবং তিন ফুট উঁচুতে আরেকটা প্রশস্ত মঞ্চ। এখানেই রাজাসন বা প্রেসিডেন্টের বসার সিংহাসন। মন্ত্রীসভার বৈঠকে এই আসনটি খালি থাকে। আজ কিন্তু খালি নেই। রাজা চতুর্থ হেরাল্ড সিংহাসনে সমাসীন। তিনিই আজ মন্ত্রীসভায় সভাপতিত্ব করছেন।

রাজা হেরাল্ড বিশেষ পার্সোনাল সিকিউরিটি দ্বারা পরিবেষ্ঠিত হয়ে বিশেষ দরজা দিয়ে পার্লামেন্ট হলে প্রবেশ করলে প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীপরিষদের সব সদস্য উঠে দাঁড়ায়। ধ্বনি ওঠে, যিশু ঈশ্বর সব সময় সদয় থাকুন আমাদের মহান রাজার প্রতি

রাজা চতুর্থ হেরাল্ড সিংহাসনে বসে তার সামনে রাখা ফাইলে নজর বুলাল। মাথা তুলে সোজা হয়ে বসে সামনে তাকালো। তার গুরুগম্ভীর কন্ঠে ধ্বনিত হলো, ‘প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রীসভার সকল সদস্যকে সুস্বাগতম। জরুরি আহ্বানে সাড়া দিয়ে আপনারা যথাসময়ে হাজির হয়েছেন, সেজন্য সকলকে ধন্যবাদ।’

একটু থেমেই রাজা হেরাল্ড তাকাল প্রধানমন্ত্রীর দিকে। বলল, ‘মি. প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভায় আজকের আলোচনা এজেন্ডা পেশ করুন। প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডারিক ফারল্যান্ড একটু নড়েচড়ে উঠে দাঁড়াল। একটু পিছনে ফিরে রাজার উদ্দেশ্যে একটা লম্বা বাউ করে কথা শুরু করল, ‘মহান রাজাধিরাজ প্রেসিডেন্ট রাজা চতুর্থ হেরাল্ড-এর ‘প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা এবং তাঁর দীর্ঘ, সুস্থ ও সফল জীবনের জন্য আমাদের প্রার্থনা।’

কথা শেষে আরেকটি বাউ করে চেয়ারে বসল প্রধানমন্ত্রী। বলল মন্ত্রীসভার সদস্যদের দিকে চোখ তুলে, ‘মন্ত্রীসভার সম্মানিত সদস্যবৃন্দ, আমাদের মহান রাজাধিরাজ প্রেসিডেন্ট জরুরি প্রয়োজনে অত্যন্ত শর্ট নোটিশে মন্ত্রীসভার এই বৈঠক আহ্বান করেছেন। বিশেষ নিরাপত্তাজনিত কারণেই বৈঠকের এজেন্ডা, আগাম জানানো হয়নি। এজেন্ডা পেশের মাধ্যমেই মন্ত্রীসভার বৈঠকের কাজ শুরু হবে। আমি এজেন্ডা পেশ করছি।

আজকের মন্ত্রীসভার জন্য একটাই মাত্র জরুরি এজেন্ডা সেটা হলো তালিয়া নদীর ব্রিজে আমাদের পুলিশ স্কোয়ার্ড-এর উপর সন্ত্রাসী হামলাজনিত উদ্ভূত পরিস্থিতি। পরিস্থিতিটা আমাদের জন্য খুবই বিব্রতকর এবং ভিক্টর আইল্যান্ডের জন্য একটা হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। আপনারা জানেন, ঠিক সময়ে সেনাবাহিনীর একটি দল সেখানে এসে না পড়লে আমাদের পুলিশ স্কোয়ার্ড-এর কেউই বাঁচত না এবং আমাদের মূল্যবান বন্দী অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ ওরফে ভিক্টর ম্যাথিয়ানকে সন্ত্রাসীরা ছিনিয়ে নিয়ে যেত। সংবাদপত্রসহ সব মিডিয়ায় প্রচার করা হয়েছে কর্নেল ওসামার দল সাগর সাইমুম’ এই সন্ত্রাসী আক্রমণ পরিচালনা করে এবং ছোট্ট একটি পুলিশ স্কোয়ার্ড সন্ত্রাসীদের পরাভূত করতে সমর্থ হয়। সেনাবাহিনীর একটা ইউনিট এসে পড়লে সন্ত্রাসীরা পাল্টা আক্রমণের শিকার হয় এবং উনপঞ্চাশজন সন্ত্রাসী নিহত হয়। কিন্তু যে কথাটা প্রচার করা হয়নি সেটা হল ভিক্টর আইল্যান্ডে সোর্ন-এর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড ডেপুটি কমান্ডার হের রুডিগারের নেতৃত্বে এই সন্ত্রাসী হামলা পরিচালিত হয় এবং তিনিও আমাদের সেনা ইউনিটের পাল্টা হামলায় নিহত হন। সন্ত্রাসীদের সংখ্যা ছিল পঞ্চাশজন। আসলে সব মিডিয়া হের রুডিগারকে বাদ দিয়ে সন্ত্রাসীদের সংখ্যা ঊনপঞ্চাশজন দেখিয়েছি।’

প্রধানমন্ত্রীকে একটু থামতে হলো। প্রধানমন্ত্রীর কথায় সোর্ন ও হের রুডিগার সন্ত্রাসী হামলার সাথে যুক্ত থাকার কথা প্রকাশ হবার সাথে সাথে গোটা মন্ত্রীসভায় বিরাট গুঞ্জন উঠল। অনেকের কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, কি সর্বনাশ এটা কি সত্য?’

প্রধানমন্ত্রী সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বলল, ‘হ্যাঁ, এটা সত্য। অবিশ্বাস্য হলেও এটাই ঘটেছে। ঊনপঞ্চাশটি লাশের সাথে সাগর সাইমুমের ইউনিফর্ম পরা হের রুডিগারের লাশও সংরক্ষিত আছে।

একজন তরুণ মন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে একটা দীর্ঘ বাউ করে বলল, ‘এটা কেন, কিভাবে ঘটতে পারে! সোর্ন শুধু আমাদের মিত্র, আমাদের শক্তিই নয়, গোটা দুনিয়ায় ওরা শ্বেতাঙ্গ অর্থাৎ পশ্চিমী স্বার্থের পক্ষের একটা বড় শক্তি।

‘আমাদের তরুণ মন্ত্রীকে ধন্যবাদ। আপনি যে প্রশ্ন তুলেছেন সেটাই আমাদের আজকের আলোচনার বিষয়।’

বলে একটু থেমেই আবার শুরু করলো প্রধানমন্ত্রী, ‘আমরা মনে করছি, তারা তাদের একটা বাড়াবাড়ি দিয়েই এই ঘটনার সূত্রপাত ঘটিয়েছে। আপনারা অবগত আছেন সাগর সাইমুমের শীর্ষকর্তা ‘ডাবল জিরো’ ছদ্মনামে পরিচিত কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহকে আমরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করেছি। পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ টিমের পাহারায় সামরিক হাসপাতালে সে চিকিৎসাধীন ছিল। ভিক্টর আইল্যান্ডে সোর্ন-এর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড হের রুডিগারের নেতৃত্বে সোর্ন- এর বিশ-পঁচিশজন সদস্যের একটা দল জোর করে হাসপাতালে ঢুকে হাসপাতাল থেকে কর্নেল ওসামাকে তুলে নিয়ে যায় আল-কবির ‘উপত্যকায় তাদের ঘাঁটিতে। বাধা দিলে সংঘর্ষ হতো, হাসপাতালে আহত-নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটতো। এই কারণে আমাদের পুলিশ ও সেনা সদস্যরা ধৈর্য ধারণ করে। বিষয়টা সরকারের অবগতিতে আনা হলে পুলিশকে নির্দেশ দেওয়া হয় আপোসে তাদেরকে বুঝিয়ে, সরকারের সিদ্ধান্তের কথা বলে কর্নেল ওসামাকে কেন্দ্ৰীয় জুডিশিয়াল কাস্টডিতে নিয়ে আসার জন্যে। হের রুডিগার প্রথমে বিরোধিতা করলেও শেষে সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। এরপরেই পুলিশের একটি স্কোয়াড হেরাল্ড রোড ধরে কর্নেল ওসামাকে নিয়ে রাজধানীতে আসছিল। পথে তালিয়া উপত্যকার তালিয়া নদীর ব্রিজে আমাদের পুলিশের স্কোয়াড় সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়। ভাগ্যক্রমে সেনাবাহিনীর একটা টিম এ পথে আসছিল। তারা সন্ত্রাসীদের উপর পাল্টা হামলা চালিয়ে পুলিশ স্কোয়ার্ড ও বন্দীকে রক্ষা করে। সাইমুমের ইউনিফর্মে নিহত সন্ত্রাসীদের দেখে সেখানে উপস্থিত পুলিশ ও সেনা সদস্যরা মনে করেছিল সাইমুম সন্ত্রাসীরাই তাদের নেতা কর্নেল ওসামাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্যই এই অভিযান চালায়। কিন্তু পরে সব সন্ত্রাসীদের বডি চেক করতে গিয়ে সাইমুমের ইউনিফর্ম পরা নিহত হের রুডিগারের লাশ পাওয়া যায়। ৫০জনের মধ্যে সেই ছিল একমাত্র শ্বেতাঙ্গ। অন্যরা সবাই ছিল আদিবাসী ও আরব বংশোদ্ভূত। সঙ্গে সঙ্গেই ঘটনাস্থল থেকে বিষয়টি সরকারকে জানানো হলে তাদেরকে সিদ্ধান্ত দেওয়া হয় যে হের রুডিগারের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টা গোপন করতে হবে এবং সন্ত্রাসীদের সংখ্যা দেখাতে হবে ৪৯জন। প্রচার হবে যে সাগর সাইমুমের ৪৯জন সন্ত্রাসী তাদের নেতা কর্নেল ওসামাকে ছিনিয়ে নিতে এসে সবাই মারা পড়েছে। থামল প্রধানমন্ত্রী।

সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়ালো সেই তরুণ মন্ত্রী। উঠে দাঁড়িয়ে রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে একটা বাউ করে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আমরা যে তাৎক্ষণিকভাবে যৌক্তিক ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি এজন্য মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। সেই সাথে প্রশ্ন রাখছি, সোর্ন ও হের রুডিগারের সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আপাতত গোপন রাখতে পারলেও অবশেষে গোপন রাখা যাবে না। কারণ ভিক্টর আইল্যান্ডের সোর্ন কর্তৃপক্ষের নিশ্চয়ই জানা আছে হের রুডিগারের কথা এবং তারা অবশ্যই বসে থাকবে না। এই অবস্থায় আমাদেরকে একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেটা হলো, আমরা অফেন্সিভে যাবো না, আমরা ডিফেন্সিভ অবস্থানে থাকব এবং এই ক্ষেত্রে আমরা প্রথম হব না, আমরা ওদের অ্যাকশনকে ফলো করব।’

তরুণ মন্ত্রীর কথা শেষ হলে উঠে দাঁড়াল মন্ত্রীসভার সিনিয়র সদস্য অর্থমন্ত্রী। রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে একটা বাউ করে বলল, ‘তরুণ মন্ত্রী মি. কার্লকে ধন্যবাদ। তিনি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় সামনে এনেছেন, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত এখনই হওয়া দরকার। কিন্তু তার আগে একটা বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার, সাগর সাইমুমের সাথে হের রুডিগার বা সোর্ন-এর সম্পর্ক সংযোগ হলো কি করে?

‘ধন্যবাদ অর্থমন্ত্রী মহোদয়। আমাদের তরুণ মন্ত্রী কার্ল-এর মতোই আপনার প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই আমরা কিন্তু চিন্তা করছি। ঊনপঞ্চাশজন আদিবাসী ও আরব বংশোদ্ভুত সন্ত্রাসীদের পরিচয়, উদ্ধারে আমাদের গোয়েন্দা বিভাগকে কাজে নামানো হয়। আজ সকালেই পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট পেয়েছি। ঊনপঞ্চাশজন সন্ত্রাসীর মধ্যে পঁয়ত্রিশজনের পরিচয় উদ্ধার করা গেছে। এরা সকলেই বোট নির্মাণ, হোটেল-রেস্টুরেন্টে প্রজেক্টের শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। অবশিষ্ট চৌদ্দজনও ডে লেবার শ্রেণির লোক। তাদের কারও সাথেই সাগর সাইমুমের কানেকশন পাওয়া যায়নি। মনে করা হচ্ছে, এই গরীব লোকদের অর্থের লোভ এবং চাকরি হারাবার ভয় দেখিয়ে ব্যবহার করা হয়েছে বা ব্যবহার করে আসা হচ্ছে। কর্নেল ওসামার বক্তব্য এই মতকেই সমর্থন করছে। জিজ্ঞাসাবাদের জবাবে কর্নেল ওসামা বলেছেন, ‘সাগর সাইমুমের দলীয় পরিচয় জ্ঞাপক কোনো ইউনিফর্ম নেই।’ আরেকটি কথা তিনি বলেছেন, সেটা হলো এত বড় দল নিয়ে হামলা করা, বা অভিযান পরিচালনার সিদ্ধান্ত সাগর সাইমুমের নেই। সব মিলিয়ে এটাই এখন পরিষ্কার যে, সোর্ন-ই কর্নেল ওসামাকে ছিনতাই করতে চেয়েছিল এবং এর দায় চাপাতে চেয়েছিল সাগর সাইমুমের ঘাড়ে। থামলো একটু প্রধানমন্ত্রী।

নোট শিটের ওপর নজর বুলাল। হাতে তুলে নিল কলম।

এ সময় অতিরিক্ত ক্যাবিনেট সচিব অনুমতি নিয়ে সভাকক্ষে প্রবেশ করল। তার হাতে একটা ইনভেলাপ। ইনভেলাপটির রং লাল।

সে এসে ইনভেলাপটি দিল ক্যাবিনেট সচিবের হাতে।

ক্যাবিনেট সচিব ইনভেলাপটি খুলল।

পড়ল ভেতরের কাগজ। কুঞ্চিত হলো তার কপাল।

দ্রুত উঠে এসে ইনভেলাপসহ কাগজটি দিল প্রধানমন্ত্রীর হাতে।

প্রধানমন্ত্রী চিঠিটি পড়ল। পড়ার সাথে সাথে তার চোখে মুখে প্রবল অস্বস্তির ছায়া নেমে এলো। সে দ্রুত ইনভেলাপের সাথে চিঠিটাকে গেঁথে একটা ফাইলে ঢুকাল। ফাইল হাতে উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত পদক্ষেপে গিয়ে দাঁড়াল প্রেসিডেন্সিয়াল ডেস্কের সামনে। একটা বাউ করে সেটা এগিয়ে দিল রাজার সামনে।

‘মি. ফার্ডিন্যান্ড, জরুরি কিছু?’

বলে রাজা চতুর্থ হেরাল্ড বাম হাত দিয়ে আনফোল্ড করল ফাইলটা। তার সামনে এলো ভেতরের চিঠিটি।

পৃথিবীর লেটার হেড এর উপর নজর পড়তেই মুখে অসন্তুষ্টির একটা ছায়া ফুটে উঠে দ্রুত মিলিয়ে গেল।

‘বসুন মি. ফার্ডিন্যান্ড। চিঠির উপর চোখ বুলাতে বুলাতেই বলল রাজা চতুর্থ হেরাল্ড।

প্রধানমন্ত্রী বসল টেবিলের বাম পাশে একটু দূরে রাখা চেয়ারটিতে।

চিঠির উপর চোখ রেখেই রাজা চতুর্থ হেরাল্ড বলল, ‘মি. ফার্ডিন্যান্ড কি ভাবছেন আপনি?’

‘আপনি যা ভাবছেন সেটাই হবে। তবে মন্ত্রীসভার সদস্যদের মত জানার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হবে এক্সেলেন্সি। আমি তাৎক্ষণিকভাবে যেটা ভেবেছি সেটা হলো, ওদের আল্টিমেটাম চব্বিশ ঘণ্টার। সময় ক্ষেপণের কৌশল আমাদের বের করতে হবে এবং সেই সুযোগে সব দিক দিয়ে বেস্ট একটা সিদ্ধান্ত আমাদের নিতে হবে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী ফার্ডিন্যান্ড।

‘ধন্যবাদ মি. ফার্ডিন্যান্ড। আপনি ঠিক ভেবেছেন। দেখা যাক, মন্ত্রীসভার সদস্যরা কি বলেন। ধন্যবাদ।’ রাজা চতুর্থ হেরাল্ড বলল।

‘আমাদের মহান রাজার কল্যাণ ও দীর্ঘ জীবন লাভ হোক। বলে প্রধানমন্ত্রী নিজের আসনে ফিরে এলো।

মন্ত্রীসভার সদস্যরা সবাই উদগ্রীব প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে নতুন কিছু শোনার জন্য।

প্রধানমন্ত্রী তার সামনে বসা মন্ত্রীসভার সদস্যদের সবার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তরুণ মন্ত্রী মি. কার্ল আমরা অফেন্সিভে যাব, না ডিফেন্সিভে থাকব- এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে বলেছিলেন। মন্ত্রীসভার অন্যতম সদস্য সম্মানিত অর্থমন্ত্রী এ ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু সম্মানিত সদস্যবৃন্দ ওরা মানে সোর্ন অফেনসিভে এসে গেছে। এইমাত্র ওদের একটা চিঠি পেলাম। চিঠিতে ওরা চব্বিশ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিয়েছে। এই চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আমাদের গ্রেফতারকৃত কর্নেল ওসামাকে ওদের হাতে নিঃশর্তভাবে তুলে দিতে হবে। যদি যথাসময়ে কর্নেল ওসামাকে ওদের হাতে তুলে না দেওয়া হয় তাহলে সোর্ন-এর সাথে ভিক্টর আইল্যান্ডের যে চুক্তি হয়েছে তা বাতিল হয়ে যাবে, সোর্ন থেকে ভিক্টর আইল্যান্ড বহিষ্কৃত হবে এবং সোর্ন-এর লোকেরা ভিক্টর আইল্যান্ড ত্যাগ করবে।’

প্রধানমন্ত্রী একটু থামল। একটা দম দিল যেন। কথার শেষের দিকে তার কন্ঠ কিছুটা শুকনো হয়ে উঠেছিল। কয়েক মুহূর্ত সময় নিয়ে আবার সে বলে উঠল, ‘চিঠির বিষয়বস্তু এটুকুই। চিঠির আল্টিমেটাম নিয়েই মন্ত্রীসভার আলোচনা শুরু হবে। এ আলোচনায় সবকিছুই এসে যাবে। মন্ত্রীসভার সম্মানিত সদস্যদেরকে আলোচনা শুরু করার আহ্বান জানাচ্ছি।’

‘আমার মনে হয় প্রধানমন্ত্রী মহোদয় বিষয়টার উপর একটা উদ্বোধনী বক্তব্য দিলে ভালো হবে। এতে আলোচনা একটা দিক নির্দেশনা পাবে।’ বলল পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ভিক্টর সিটি স্টেট ইউনিভার্সিটির ফরেন রিলেশনস বিভাগের প্রধান অধ্যাপকও তিনি।

‘ধন্যবাদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়।

বলে একটু থেমেই আবার শুরু করল, ‘সোর্ন-এর এই চিঠি থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল যে, সেদিন তালিয়া উপত্যকায় আমাদের পুলিশ স্কোয়ার্ড-এর উপর যে হামলা হলো তার দায়ভার সোন নিতে চায় না। এই কারণেই হের রুডিগার সম্পর্কে কোনো উচ্চবাচ্য তারা করেনি। এটা তাদের জন্য একটা দুর্বল পয়েন্ট। যা আমরা ইচ্ছা করলে ব্যবহার করতে পারি। দ্বিতীয় বিষয় হলো, তাদের আল্টিমেটাম। তাদের দাবি মেনে নিয়ে যদি কর্নেল ওসামাকে নিঃস্বার্থভাবে তাদের হাতে তুলে দেই, তাহলে তাদের সাথে আমাদের বিরোধ আপাতত মিটে যায়। আর যদি তাদের দাবি না মানা হয় তাহলে সোর্ন-এর বৈরিতার সম্মুখীন হতে হবে। সে অবস্থা আমাদের কোথায় নিয়ে যাবে আমি জানি না। তৃতীয় বিষয় হলো, আমাদের রাষ্ট্রের নীতি ও নিরাপত্তার স্বার্থে আমরা মধ্যবর্তী কোনো অবস্থান সৃষ্টি করতে পারি কিনা। এ বিষয়গুলোর উপর সবার মত এলে আমরা কোনো একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি।’ থামল প্রধানমন্ত্রী।

একজন ইয়ং মন্ত্রীর স্পিকার স্ট্যান্ডে নীল বাতি জ্বলে উঠল

‘বলুন মি. শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।

মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড’ বলতে শুরু করল শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে সমস্যা আমাদের সামনে এনেছেন তাকে আমি খুব জটিল মনে করি না। আমি ধন্যবাদ জানাই সোর্নকে যে, তারা হের রুডিগারের নিহত নিয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করেনি। আমরা যে কারণে গোপন করেছি, সেই একই কারণে তারা হের রুডিগারের সন্ত্রাসী অভিযানে অংশগ্রহণ এবং তার নিহত হওয়াকে হজম করে গেছে। ফলে সোর্ন-এর সাথে আমাদের সম্পর্কের অবনতি ঘটার একটা বড় কারণ দূর হয়ে গেল। এখন যদি আমরা সন্ত্রাসী দল সাগর সাইমুমের নেতা কর্নেল ওসামাকে তাদের হাতে নিঃশর্তভাবে তুলে দেই, তাহলে আমরা সোর্ন-এর সাথে স্বাভাবিক সম্পর্কে ফিরে যেতে পারি। আর এতে আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষতি নেই। কারণ সাগর সাইমুম আমাদের এক নম্বর শত্রু এবং আমাদের শত্রু বলেই তারা সোর্ন-এরও শত্রু। তার উপর সোর্ন-এর চারজন লোককে কর্নেল ওসামা হত্যা করেছে। সুতরাং প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য কর্নেল ওসামাকে হাতে পাওয়া তাদের অধিকার বলে আমি মনে করি।’ থামল শিক্ষা, যুব ক্রীড়া মন্ত্ৰী।

এবার নীল বাতি জ্বলে উঠল তরুণ মন্ত্রী কার্ল-এর স্পিকার স্ট্যান্ডে।

অনুমতি পেলে তার কথা সে শুরু করল, ‘আমাদের প্রিয় মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমাদের সম্মানিত শিক্ষা, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রী জটিল সমস্যার যে সহজ সমাধান দিয়েছেন, তা যদি গ্রহণ করা যেত খুবই ভালো হতো। অনেক ঝামেলা চুকে যেত। কিন্তু সম্মানিত মন্ত্রী কিছু বিষয় এড়িয়ে গিয়ে একটা সহজ সমাধান দাঁড় করিয়েছেন যা গ্রহণ করলে আইন, সংবিধান বলে আমাদের কিছু থাকবে না এবং সোর্ন-এর ঔদ্ধত্যকে আকাশে তোলা হবে। কর্নেল ওসামা এবং সাগর সাইমুম আমাদের এক নম্বর শত্রু, এ ব্যাপারে দ্বিমত করার কোনো কারণ নেই। কিন্তু তাই বলে একটা সত্য ঘটনাকে আমলে নেব না, আমাদের মিত্র বা বন্ধুদের ঘৃণ্য স্বেচ্ছাচারী আচরণ আমাদের মর্যাদা ভুলুণ্ঠিত করবে আর আমরা তা দেখব না। তা হয় না। কর্নেল ওসামা সোর্ন-এর চারজন লোককে হত্যা করেছে কথাটা এভাবে বলা যায় না। বরং সোর্ন-এর চারজন ক্রিমিনাল একজন নারীকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়ার সময় নারীটিকে উদ্ধার করতে আসা কর্নেল ওসামার হাতে নিহত হয়েছে— এটাই সত্য। অতএব সোর্ন-এর চারজন লোক হত্যার প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য সোর্ন-এর হাতে আমাদের বন্দীকে আমরা তুলে দিতে পারি না। আর ঘটনা এটা না হয়ে যদি কর্নেল ওসামা ভিক্টর আইল্যান্ডের শত্রু হিসেবে সোর্ন তাকে তাদের হাতে নিতে চায়, তাহলে সেটাও অযৌক্তিক। ভিক্টর আইল্যান্ডের বিরুদ্ধে কর্নেল ওসামার অপরাধের বিচারের জন্য ভিক্টর আইল্যান্ডের সরকার রয়েছে এবং সে বিচার কাজ শুরু হয়েছে। সুতরাং কর্নেল ওসামাকে সোর্ন-এর হাতে তুলে দেওয়ার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। আর যদি সোর্নকে তুষ্ট করার জন্য কর্নেল ওসামাকে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন সোর্ন-এর হাতে তুলে দেওয়ার কথা ওঠে, তাহলে আমার প্রশ্ন, এই তুষ্ট করার শেষ সীমা কোথায় গিয়ে ঠেকবে? আমার শেষ কথা হলো সরকারের মধ্যে কোনো সরকার আমরা মানবো না, আমরা আরেক ইউক্রেন হতে চাই না।’

তরুণ মন্ত্রী কার্ল থামার সাথে সাথে প্রধানমন্ত্রী বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ, প্রযুক্তিমন্ত্রী মি. কার্ল।’ মন্ত্রীসভার সম্মানিত সদস্যবর্গ, আমাদের মহামান্য রাজার অনুমোদন সাপেক্ষে মি. কার্লের বক্তব্য থেকে ‘আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংগঠন’-এই তিনটি শব্দ এবং তার বক্তব্যের শেষ বাক্য মন্ত্রীসভার প্রসিডিং থেকে বাদ দেওয়া হলো

মন্ত্রীসভার প্রবীণ সদস্য অর্থমন্ত্রী থিয়োডোর উইলিয়ামের স্পিকার স্ট্যান্ডে নীল বাতি জ্বলে উঠলে সে উঠে দাঁড়াল। রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে বাউ করে মহামান্য রাজা ও প্রধানমন্ত্রীকে সম্বোধন করে বলল, ‘ধন্যবাদ প্রযুক্তিমন্ত্রী মি. কার্ল। অনেক সময় কঠিন সত্যকে হজম করা যায় না। আপনার কথা নিরেট কিছু সত্যকে মন্ত্রীসভার প্রসিডিং হজম করতে পারল না। তাতে কিছু এসে যায় না। আপনার কথা শুধু বায়ুমণ্ডলে নয়, আমাদের সকলের মনেও অমর হয়ে থাকবে।’

একটু থামল অর্থমন্ত্রী থিয়োডোর উইলিয়ামস। শুরু করলো আবার, ‘মহামান্য রাজা ও প্রধানমন্ত্রী, কর্নেল ওসামা আমাদের বিচারাধীন আসামি। তার বিচার কাজ শুরুও হয়েছে। কারো চাপ বা অনুরোধে কোনো অবস্থাতেই তাকে অন্যের হাতে তুলে দেয়া যায় না। তার ওপর কর্নেল ওসামার বিষয়টি একটা আন্তর্জাতিক ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। প্রায় ষাটটি মুসলিম দেশ এবং তাদের সংগঠন ওআইসি কর্নেল ওসামাসহ ভিক্টর আইল্যান্ডের লোকাল জনগণের মানবাধিকার ইস্যুটিকে জাতিসংঘের নজরে এনেছে। জাতিসংঘের যে মানবাধিকার টিম ভিক্টর আইল্যান্ড সফর করছে, তাদের প্রধান এজেন্ডা হলো আদিবাসী ও আরব বংশোদ্ভূত লোকরা কেমন আছে তা দেখা ও জানা। আমি শুনেছি, তারা চায় কর্নেল ওসামার বিচার কাজ পর্যবেক্ষণের জন্য লোক এখানে মোতায়েন রাখতে। এ অবস্থায় কর্নেল ওসামাকে আদালতে সোপর্দ করা ছাড়া অন্য কিছু করার সুযোগ আমাদের নেই। এ তো গেল একদিক, অন্যদিকে সোর্ন-এর সাথে বিরোধে জড়ানো আমাদের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার জন্য খুবই ক্ষতিকর হবে। তরুণ মন্ত্রী কার্ল তার বক্তব্যের শেষ বাক্যে যে কথা বলেছেন সে ব্যাপারটা আমরা অনেকেই জানি এবং আমি মনে করি সরকার আরও বেশি জানেন। এ অবস্থায় তাদের মাথায় তুললে আমাদের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব বিপদে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মহোদয় যে কথা বলেছেন, সেই মধ্যবর্তী কোনো অবস্থানই আমাদের সৃষ্টি করতে হবে, যাতে দুই ষড়যন্ত্র থেকে বাঁচার পথ আমরা সৃষ্টি করতে পারি। অব দা রেকর্ড আমি বলতে চাই, সাগর সাইমুমের বিপদ সম্পর্কে আমরা জানি, সোন কি করছে, কি করবে- সে সম্পর্কে সরকারের কিছু জানা থাকলে মন্ত্রীসভাকে অবহিত করা দরকার। আমার আরো কিছু কথা আছে সেটা পরে বলব।’ থামলো অর্থমন্ত্রী।

অর্থমন্ত্রী থামলে,স্বয়ং রাজা চতুর্থ হেরাল্ড কথা বলে উঠল। বলল, ‘অর্থমন্ত্রী অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আমি চাই সোর্ন সম্পর্কে মন্ত্রীসভাকে অবিলম্বে ব্রিফ করা হোক। এজন্য মন্ত্রীসভার বৈঠক মন্ত্রীসভার বিশেষ সভাকক্ষে শিফট করা হলো। সবাই জানেন, বিশেষ স্ক্যানিং ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে সেই সভাকক্ষে প্রবেশ করতে হবে। কারো কাছে কোনো প্রকার ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থাকতে পারবে না। সে মিটিংয়ে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির সদস্য, সেনাবাহিনীর কমান্ডার ইন চীফ, তিন বাহিনীর প্রধান, গোয়েন্দা প্রধান এবং প্রতিরক্ষা উপদেষ্টাও থাকবেন। এখন থেকে তিন ঘণ্টা পর সে বৈঠক শুরু হবে। প্রধানমন্ত্রী মহোদয় ব্যবস্থা করুন। প্রেসিডেন্ট হাউস ‘গোল্ড প্যালেস’- এর রয়্যাল ক্যান্টিনে লাঞ্চের জন্য সবাইকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

বলে রাজা চতুর্থ হেরাল্ড তার আসন থেকে উঠে দাঁড়াল।

উঠে দাঁড়াল মন্ত্রীসভার সবাই।

রাজা চতুর্থ হেরাল্ড সভাকক্ষ থেকে চলে গেলে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রীসভার সদস্যদের লক্ষ্য করে বলল, ‘আপনারা ফ্রেশ হয়ে নিন। তারপর আমরা সবাই রয়্যাল ক্যান্টিনে যাব।’

সবাই বেরিয়ে এলো সভাকক্ষ থেকে।

.

রাজা চতুর্থ হেরাল্ডের সভাপতিত্বে মন্ত্রীসভা এবং জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের বৈঠক ঠিক তিন ঘণ্টা পরেই শুরু হলো। বৈঠকের শুরুতেই রাজার নির্দেশক্রমে গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান সোর্ন ও সাগর সাইমুমের তৎপরতার উপর দীর্ঘ রিপোর্ট পেশ করল। শেষে দীর্ঘ রিপোর্টের একটা সারাংশ উপস্থাপন করল যাতে বলা হলো: ‘এক. সোর্ন যে জনশক্তি বাইরে থেকে ভিক্টর আইল্যান্ডে নিয়ে আসে, তার মধ্যে খুব বেশি হলেও বিশ শতাংশ বৈধ পথে নিয়ে আসে। শুধু এরাই ইমিগ্রান্ট হিসেবে রেজিস্ট্রেশন পায়। অবশিষ্টদের আশি শতাংশকেই নানা কৌশলে জনসাধারণের মধ্যে মিশিয়ে ফেলা হয়।

দুই. এখন বেশি লোক আসছে ইউক্রেন ও পূর্ব ইউরোপ থেকে। এদের প্রায় সকলেরই সামরিক ট্রেনিং আছে।

তিন. ভিক্টর আইল্যান্ডে অবৈধ মানুষের মতো অবৈধ অস্ত্রও ঢুকছে, যার মধ্যে হেভি অস্ত্রও শামিল আছে।

চার. প্রথমে সোর্ন-এর লোকরা সবার সাথে মিলেমিশে বিভিন্ন বাড়িতে বাস শুরু করে। ধীরে ধীরে তারা নিজেদের মধ্যে ঘাঁটি তৈরির দিকে মনোযোগ দেয়। শুরুর দিকে ওরা অনুমতি নিয়ে বা সরকারের জ্ঞাতসারেই এটা করত। কিন্তু এখন তারা অনুমতি নিয়ে একটা ঘাঁটি তৈরি করলে দশটা গোপনে করে থাকে। এখন তাদের বৈধ ঘাঁটির চেয়ে, অবৈধ ঘাঁটির সংখ্যা অনেক বেশি।

পাঁচ. এক সময় ইউক্রেন বিশ্ব শ্বেতাঙ্গ-নাজী জাতীয়তাবাদীদের ট্রেনিং ও আশ্রয় কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল। মনে হচ্ছে ভিক্টর আইল্যান্ড এক নতুন ইউক্রেনে পরিণত হতে যাচ্ছে। গোটা দুনিয়া থেকে শ্বেতাঙ্গ-নাজী জাতীয়তাবাদীদের এখানে এনে জড়ো করা হচ্ছে। তাদের সামরিক ট্রেনিংও দেয়া হচ্ছে। এ কথা বলা অমূলক হবে না যে, আমাদের রাষ্ট্রীয় সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আরেকটা সেনাবাহিনী গড়ে উঠছে। যুক্তি দেয়া হয় যে, এদের তৈরি করা হয় বিভিন্ন দেশের ব্যবহারের প্রয়োজনে। কিন্তু এদের কথায় আস্থা রাখার পক্ষে কোনো যুক্তি নেই। বরং অন্যান্য অনেক দেশে এদের ভূমিকা আমাদের নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কাকেই ঘণীভূত করে।

ছয়, শ্বেতাঙ্গ-নাজী জাতীয়তাবাদ শুধু আদর্শিকভাবে অসহনশীল নয়, এই আদর্শের ধারক লোকরাও অসহনশীল, চরমপন্থী এবং প্রতিষ্ঠিত আইন কানুনের ব্যাপারে বেপরোয়া। সম্প্রতি একজন সম্মানীয়া তরুণীকে অপহরণ প্রচেষ্টার ঘটনা ঘটে। সেটাকে প্রথমে তাৎক্ষণিকভাবে একটা সাধারণ ঘটনা বলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী অনুসন্ধানে দেখা গেছে এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা। বেশ আগে থেকেই তারা মেয়েটির উপর নজর রেখেছিল। সেদিন পরিকল্পিতভাবেই এই অপহরণ প্রচেষ্টার ঘটনার ঘটায়। কেউ যাতে বাধা না দেয়, এ ব্যাপারে সকলকেই আগাম সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল। পুলিশ প্রহরীদেরও সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। মেয়েটিকে নিয়ে তোলার জন্য উপকূলে জাহাজও প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। হঠাৎ কর্নেল ওসামার আগমনে ওদের গোটা পরিকল্পনা ভণ্ডুল হয়ে যায়। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে তাদের যে সীমাহীন ঔদ্ধত্যের প্রকাশ ঘটেছে এবং ভিক্টর আইল্যান্ডের সরকারের মর্যাদার প্রতি তারা যে আঘাত করেছে তা কোনো স্বাধীন দেশ ও স্বাধীন জাতিরই সহ্য করার মতো না।

সাত. ভিক্টর আইল্যান্ডের জন্য সোর্ন অত্যন্ত সেনসেটিভ বিষয় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ওরা যেমন আমাদের সহ্যের সীমা অতিক্রম করছে, তেমনি তাদের সাথে আমাদের কোনো প্রকার বৈরিতা আমাদের জন্য এবং আমাদের ভিক্টর আইল্যান্ডের জন্য লজ্জাজনক হবে।

অন্যদিকে সাগর সাইমুম বিঘোষিতভাবে আমাদের অস্তিত্বের শত্রু। তারা আমাদেরকে ভিক্টর আইল্যান্ড থেকে তাড়াতে চায়। আমাদের ভিক্টর আইল্যান্ডকে তারা চায় আবার তাদের সুবর্ণদ্বীপে পরিণত করতে। আমাদের রাজধানী গোল্ড সিটিকে তারা বানাতে চায় আগের সেই সুবর্ণ নগরী। আমাদের সরকারকে তাড়িয়ে তারা প্রতিষ্ঠিত করতে চায় তাদের সরকার। তবে এই ব্যাপারে তাদের শক্তি ও প্রস্তুতি উভয়ই প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। সাগর সাইমুম কোনো সুগঠিত সুসজ্জিত বাহিনী নয়। সাগর সাইমুমের লোকরা বিভিন্ন কাজে, বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। এতে করে তাদের অস্ত্রের ট্রেনিং এখনো প্রাথমিক পর্যায়ের। কর্নেল ওসামার পিতা সাগর সাইমুমের প্রতিষ্ঠাতা। তবে সাগর সাইমুমকে প্রফেশনাল বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ খুব অল্পই হয়েছে। কর্নেল ওসামার আগে অভিজ্ঞ কোনো নেতৃত্ব সাগর সাইমুম পায়নি। এই অভাব পূরণের জন্য কর্নেল ওসামাকে সেনাবাহি নী থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কর্নেল ওসামা সাগর সাইমুমকে সশস্ত্র বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছিলেন। তবে সাগর সাইমুমের লোকদের লড়াইয়ের প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতার চাইতে তাদের আন্তরিকতা ও আবেগ অনেক বেশি। তাদের বড় সুবিধা হলো তারা জনগণের মধ্যে থেকে কাজ করে এবং তাদের আছে জনসমর্থন। বড় বাহিনী হিসেবে গড়ে ওঠার সুবিধা ও সম্ভাবনা দুই তাদের আছে। তার আগেই আমাদের যা করার তা করতে হবে।

গোয়েন্দা বাহিনীর পক্ষ থেকে ব্রিফিং শেষ হলো।

‘ধন্যবাদ গোয়েন্দা প্রধান ব্রিগেডিয়ার ডেস্টিন।’

বলে একটু থামল রাজা চতুর্থ হেরাল্ড। সবার দিকে চোখ ফিরাল। বলল, ‘আমি মনে করি আলোচনার বিষয় সবার কাছে পরিষ্কার হয়েছে। এরা আগে কখনো আমরা এত বড় সমস্যায় পড়িনি। প্রত্যেক সমস্যার পাশে তার সমাধানও থাকে। সেই সমাধান আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমি থেকে শুরু করে আমাদের সবার এ বিষয়ে নিজস্ব চিন্তা আছে। সেই চিন্তাগুলো সামনে আসলে আমাদের সমস্যার সমাধানও এসে যাবে। এখন ফ্লোর আপনাদের।’ থামল রাজা চতুর্থ হেরাল্ড।

উঠে দাঁড়াল সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল জোহান জোনস। রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে একটা লম্বা বাউ করে বলল, ‘আমাদের সামনে দুই বিপদ। একটা ষড়যন্ত্র, অন্যটা শত্রুতা। ষড়যন্ত্র করছে সোর্ন, শত্রুতার মুখোমুখি আমরা সাগর সাইমুমের। একসাথে আমরা দুই পক্ষের সাথে লড়াই করতে চাই না। আমাদের লড়াই প্রথমে ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নয়, লড়াই আমাদের প্রথমে শত্রুর শত্রুতার বিরুদ্ধে। সোর্নকে আপাতত ঠান্ডা রেখে ডান্ডা মারতে হবে সাগর সাইমুমের উপর। আমি মনে করি সোর্ন-এর আল্টিমেটামের সময়সীমার মধ্যে কর্নেল ভিক্টর ম্যাথিয়ান ওরফে কর্নেল ওবায়দুল্লাহকে সোর্ন-এর হাতে তুলে দেওয়া উচিত। এতে আমাদের দুটি লাভ। এক. সাগর সাইমুম নেতা হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়বে। তখন সেই দুর্বল সাগর সাইমুমকে শেষ করে দেয়া আমাদের জন্য সহজ হবে। দুই. কর্নেল ভিক্টর ম্যাথিয়ান অর্থাৎ কর্নেল ওসামাকে আমাদের নিজ হাতে কিছু করা বা বিচার পরিচালনার ঝামেলা থেকে আমরা বেঁচে যাব। আপাতত আমার সংক্ষিপ্ত কথা এটুকুই। সবাইকে ধন্যবাদ।’

কথা শেষ হলে জেনারেল জোহান জোনাস উঠে দাঁড়িয়ে রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে আবার একটা বাউ করে বসে পড়ল।

অর্থমন্ত্রী থিয়োডোর উইলিয়ামের স্পিকার স্ট্যান্ডের নীল বাতি জ্বলে উঠেছে। অর্থমন্ত্রী দাঁড়িয়ে রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে বাউ করে বসে পড়ল। বসে কথা শুরু করল। বলল, ‘মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীসভা ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সম্মানিত সদস্যবর্গ, আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল জোহান জোনাস তার সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে সমস্যার যে সমাধান দিয়েছেন তা অবশ্যই ভেবে দেখার মতো। তার কথা শুনতে শুনতে আমি আমাদের পুলিশ স্কোয়ার্ডের উপর সন্ত্রাসী হামলার যে খবর প্রকাশ হয়েছিল- তা আবার পড়লাম। তাতে সন্ত্রাসীরা তাদের নেতা কর্নেল ওসামাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল, একথা যেমন নেই, তেমনি ছিনিয়ে নেয়নি, সেকথাও নেই। তবে সন্ত্রাসীরা পুলিশ ফোর্সকে পরাভূত করেছিল, একথা আছে। পুলিশকে পরাভূত করার অর্থ সন্ত্রাসীরা তাদের নেতা কর্নেল ওসামাকে ছিনিয়ে নিয়েছিল। এ কথা যৌক্তিকভাবেই প্রতিপন্ন হয়। এর অর্থ কর্নেল ওসামা এখন আমাদের হাতে নেই। তাই তার কোনো দায়ও আমাদের ঘাড়ে নেই।

একটা কথা উঠতে পারে- সেনা ইউনিটের পাল্টা আক্রমণ তো সন্ত্রাসীদের পরাভূত করেছিল এবং পরাভূত সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে কর্নেল ওসামাকে উদ্ধারও করেছিল। এর জবাব হলো, সন্ত্রাসীদের পরাভূত করার অর্থ কর্নেল ওসামাকে উদ্ধার করা নয়। উনপঞ্চাশজন সন্ত্রাসী নিহত হয়েছিল, কিন্তু এই উনপঞ্চাশজনই যে সন্ত্রাসীদের মোট সংখ্যা-এ কথা নিউজের কোথাও বলা হয়নি। অতএব ঘটনা এটাই হতে পারে যে, উনপঞ্চাশজন সাথীকে প্রতিরোধের জন্যে রেখে অবশিষ্টরা তাদের নেতা কর্নেল ওসামাতে নিয়ে পালিয়েছে। সুতরাং এ কথা আমরা বলতে পারি যে, কর্নেল ওসামা আমাদের হাতে নেই। অতএব কর্নেল ওসামাকে সোর্ন-এর হাতে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা আমি দেখছি না। বরং লাভ আমাদের এই হবে যে, আমরা সোর্ন-এর সাথে আশু সংঘাত থেকে বাঁচব এবং ওদের ষড়যন্ত্র মোকাবিলার জন্য মূল্যবান সময় আমরা হাতে পাব।’ অর্থমন্ত্রীর কথা শেষ হলো।

এবার কথা বলল মন্ত্রীসভার তরুণ সেই সদস্য কার্ল। সে মহামান্য রাজাকে বাউ করে সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল জোহান জোনস এবং অর্থমন্ত্রী থিয়োডোর উইলিয়ামসকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘তারা সমস্যা সমাধানের যে পথ দেখিয়েছেন তা অমানবিক হলেও অযৌক্তিক নয়। আমাদের সামনে যদি সমস্যা সমাধানের আর কোনো পথ খোলা না থাকে, তাহলে এই পথই গ্রহণ করতে হবে। তবে এই পথ গ্রহণ করা হবে কি হবে না, তা নির্ভর করছে কর্নেল ওসামা যে প্রকৃতই আমাদের কাছে সেটা প্রকাশ হয়ে পড়েছে কিনা বা আগামীতে প্রকাশ হয়ে পড়বে কিনা তার উপর। কারণ তিনি যে আমাদের জুডিশিয়াল কাস্টডিতে আছেন সেটা সংশ্লিষ্ট পুলিশরা এবং কাস্টডির সাথে জড়িত ব্যক্তিরা জানেন। সুতরাং বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়ার একটা আশঙ্কা আছে। যদি প্রকাশ হয়ে পড়ে বা প্রকাশ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে কর্নেল ওসামাকে সোর্ন-এর হাতে দেয়া যাবে না। কারণ তাতে আমরা বিপদে পড়ব। মানবাধিকার ও ন্যায় বিচার নিয়ে যে হইচই পড়বে তার মোকাবিলা আমরা করতে পারব না। মুসলিম দেশগুলোর সম্মিলিত শক্তিকে ছোট করে দেখা ঠিক হবে না। সেক্ষেত্রে আমরা বিকল্প তালাশ করতে পারি। একটা বিকল্প হলো, চব্বিশ ঘণ্টার আল্টিমেটাম বিষয়ে আমরা সোর্ন-কে বলতে পারি, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাসমূহ এবং মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া এড়াবার জন্যে বিচারাধীন আসামি কর্নেল ওসামাকে কিভাবে কোন পন্থায় আমরা সোর্ন-এর হাতে তুলে দিতে পারি, এ নিয়ে ভাববার এবং পথ বের করার জন্যে আমাদের সময় প্রয়োজন। সময় পেলে আমরা ভেবে দেখব, সোর্ন-এর হাতে কর্নেল ওসামাকে তুলে দেবার কোনো নিরাপদ পন্থা বের করা যায় কিনা। বের না হলে বিচারকের কাঁধে বন্দুক রেখে কর্নেল ওসামাকে আমরাই ফায়ার করতে পারি।’ কথা শেষ করল মি. কার্ল।

সভাকক্ষে নেমে এলো নীরবতা।

মন্ত্রীসভার সদস্য বা নিরাপত্তা কাউন্সিল সদস্য কারো স্ট্যান্ডে নীল বাতি জ্বলল না। কেউ কথা বলল না।

প্রধানমন্ত্রী তাকাল রাজা চতুর্থ হেরাল্ডের দিকে।

রাজা চতুর্থ হেরাল্ড তার সিংহাসন সদৃশ চেয়ারের একটু সামনে ঝুঁকে বলল, ‘মন্ত্রীসভা ও নিরাপত্তা পরিষদের সদস্যবর্গ, আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি জেনারেল জোহান জোনাস এবং অর্থমন্ত্রী থিয়োডোর উইলিয়ামসকে একটি সহজ ও সুন্দর সমাধান পেশ করার জন্যে। আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি মন্ত্রীসভার তরুণ সদস্য কার্লকে। তিনি প্রথম প্রস্তাব অমানবিক মনে করলেও শর্ত সাপেক্ষে তা মেনে নিয়েছেন। তারপর তিনি সমস্যার একটা বিকল্প সমাধান পেশ করছেন। আর কারো যদি- নতুন প্রস্তাব না থাকে, তাহলে উপস্থাপিত দুটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে পারি।’ রাজা চতুর্থ হেরাল্ড থামলেন।

সভাকক্ষে নীরবতা নামল আবার।

প্রধানমন্ত্রী উঠে দাঁড়িয়ে রাজা চতুর্থ হৈরাল্ডকে বাউ করে বলল, ‘মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড, আমার মনে হয় নতুন প্রস্তাব কারো কাছে নেই। আমরা উপস্থাপিত দুটি প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা শুরু করতে পারি।’

রাজা চতুর্থ হেরাল্ড প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘মন্ত্রীসভা ও নিরাপত্তা কাউন্সিলের প্রিয় সদস্যবৃন্দ, প্রথম প্রস্তাব ও দ্বিতীয় প্রস্তাব এক সাথে হতে পারে। দুটির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। তার আগে আমি বলব, মন্ত্রীসভার সদস্য মি. কার্ল বলেছেন, কর্নেল ওসামা আমাদের কাছে আছে একথা সংশ্লিষ্ট পুলিশ বা জুডিশিয়াল কাস্টডির সাথে সংশ্লিষ্টদের মাধ্যমে বাইরে গেছে বা যেতে পারে, এ বিষয়ে কিছু বলার থাকলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলুন। বিষয়টি খুবই সেনসেটিভ। কর্নেল ওসামা আমাদের হাতে আছে, এই খবরটা বাইরে গেলে সিদ্ধান্ত এক রকম হবে, না গেলে সিদ্ধান্ত আরেক রকম হতে পারে। বলুন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মি. সেবাস্টিন।’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সেবাস্টিন রালফ উঠে দাঁড়াল। রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে বাউ করে বলল, ‘মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড ও প্রধানমন্ত্রী মহোদয় মন্ত্রীসভা ও নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যবর্গ, তালিয়া উপত্যকার তালিয়া নদীর তালিয়া ব্রীজে কর্নেল ওসামাকে বহনকারী আমাদের স্কোয়ার্ড আক্রান্ত হওয়া এবং সেনা ইউনিটের সাহায্যে রেসক্যু হওয়ার পর তারা চলে না এসে পুলিশ স্কোয়ার্ড ও সেনা ইউনিটের সাথে পরামর্শ করে স্ব স্ব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে করণীয় সম্পর্কে ব্রিফিং চেয়ে পাঠায়। কর্তৃপক্ষ ৪৯জন সাগর সাইমুমের সন্ত্রাসী নিহত হওয়া এবং নিহতদের মধ্যে সোর্ন-এর হের রুডিগার থাকার ঘটনা জানতে পেরে উভয় পক্ষ মতবিনিময় করেই সরকারকে বিষয়টি অবহিত করে। সরকার থেকে তিনটি বিষয় জানিয়ে দেয়া হয়: এক. হের রুডিগার সম্পর্কে কোনো কিছুই প্রকাশ করা যাবে না। দুই. পুলিশ স্কোয়ার্ডই কর্নেল ওসামাকে রাজধানীতে নিয়ে আসছে, এ বিষয়টি হের রুডিগার এবং সোর্ন-এর সবাই আগেই জানত, এ কথাও প্রকাশ হয়ে গিয়েছে। তাই এ বিষয়টি প্রকাশ করা যাবে। এ ছাড়া তার সম্পর্কে আর কোনো কথাই বলা যাবে না। পুলিশ কিংবা সেনা সদস্যের কেউ-ই তালিয়া উপত্যকার ঘটনা সম্পর্কে সাংবাদিক কিংবা কারো কাছেই কোনো কথা বলতে পারবে না। জুডিশিয়াল কাস্টডির সবাইকে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে, কর্নেল ওসামা সম্পর্কে কোনো কথাই বাইরে বলা যাবে না। সুতরাং আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারি যে, কর্নেল ওসামার বিষয়টি বাইরে প্রচারিত হয়নি এবং হবেও না।’ থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

এবার উঠে দাঁড়াল পররাষ্ট্রমন্ত্রী। বলল, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। তারা তাৎক্ষণিকভাবে যে দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, সেজন্যেও তাদের ধন্যবাদ। আমরা প্রথম প্রস্তাবটা তাহলে দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করতে পারি। তবে আমার একটা প্রশ্ন, কর্নেল ওসামা যে আমাদের কাছে আছে, একথা সোর্ন জানতে পারল কি করে?’

‘কর্নেল ওসামাকে যখন জুডিশিয়াল কাস্টডিতে নেয়া হয়, তখন সেখানে সোর্ন-এর দায়িত্বশীল হাজির ছিল আগে থেকেই। তিনি সেখানে ইচ্ছা করেই এসেছিলেন, না ব্যাপারটা কাকতালীয় ছিল তা আমরা জানি না। তবে হের রুডিগারের নেতৃত্বে কর্নেল ওসামাকে ছিনিয়ে নেয়ার জন্য সন্ত্রাসীদের যে অভিযান তা সোর্ন-এর সিদ্ধান্তেই হয়েছিল। তাই জুডিশিয়াল কাস্টডিতে সোর্ন-এর দায়িত্বশীলের উপস্থিতিও উদ্দেশ্যমূলক হতে পারে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘সে উদ্দেশ্য কি হতে পারে?’ প্রশ্ন মন্ত্রীসভার একজন সদস্যের। বলল, ‘একটা বিষয় আমি বুঝতে পারছি না। সোর্ন-এর দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হের রুডিগারের ব্যাপারটা তারা চেপে গেল কেন?’

প্রশ্নটির উত্তর দিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বলল, ‘কারণ এক হতে পারে যে, বিষয়টি জানাজানি হলে কিংবা এ নিয়ে হৈ চৈ হলে তারা ঘরে বাইরে সবখানে বেকায়দায় পড়তে পারে। দ্বিতীয় কারণ এই হতে পারে যে, তারা মনে করতে পারে আমরা হের রুডিগারের লাশ পাইনি, খরস্রোতা নদী তালিয়ার পানি লাশটিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। কারণ যাই হোক তারা বিষয়টি না তোলায় আমরা বড় একটা ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছি। অন্যদিকে রুডিগারের লাশ না পাওয়ায় সোর্ন কি করতে পারে, কতদূর যেতে পারে সেটা আমাদের কাছে হাতে-নাতে ধরা পড়েছে। থামল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘প্রধানমন্ত্রী মি. ফ্রেডারিক ফার্ডিন্যান্ড আপনি আলোচনাকে উপসংহার করে একটা সিদ্ধান্তে নিয়ে আসুন।’ বলল রাজা চতুর্থ হেরাল্ড।

‘মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড এবং মন্ত্রীসভা ও নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যবর্গ, গুরুত্বপূর্ণ আজকের আলোচনায় দুটি প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। গোটা হাউজের মত এই দুই প্রস্তাবের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এর মধ্যে প্রথম প্রস্তাবের পক্ষেই যুক্তি বেশি এসেছে। এমনকি প্রথম প্রস্তাবের ক্ষেত্রে একটা প্রশ্ন তুলে বিকল্প হিসেবে দ্বিতীয় প্রস্তাব উত্থাপিত হয়েছে। প্রশ্নের উত্তর ইতিবাচক হলে প্রথম প্রস্তাব মেনে নিতে দ্বিতীয় প্রস্তাব উত্থাপনকারীর আপত্তি নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রশ্নটির যে উত্তর দিয়েছেন তা প্রথম প্রস্তাবের পক্ষে ইতিবাচক। এই দিক থেকে প্রথম প্রস্তাবটি হাউজের সিদ্ধান্ত হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তবে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের সরকারের মর্যাদা, বাস্তবতা এবং সার্বিক বিবেচনাকে সামনে রেখে আমি মনে করি প্রথম প্রস্তাবের সাথে দ্বিতীয় প্রস্তাব মিলিয়ে অধিকতর যুক্তিসংগত সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারি। প্রথম প্রস্তাবের গোটাটাই গ্রহণ করা হবে আল্টিমেটামের সময়সীমার মধ্যে কর্নেল ওসামাকে সোর্ন-এর হাতে তুলে দেয়ার বিষয়টি ছাড়া। দ্বিতীয় প্রস্তাবে সময় নেয়ার যে কথা বলা হয়েছে, সেটা গ্রহণ করা যুক্তিসংগত এবং আমাদের জন্যে মর্যাদার হবে। একটা রাষ্ট্রের একজন বিচারাধীন আসামিকে আইন ও বিচারকে পদদলিত করে অন্য কারো হাতে তুলে দেয়া আমাদের জন্যে সম্মানজনক হবে না। আমরা সোর্নকে বলতে পারি, আমরা কর্নেল ওসামাকে তাদের হাতে দেব, কিন্তু সেটা কিছুটা অন্যভাবে। বিচারাধীন আসামিকে কি অন্যের হাতে তুলে দেয়ার কোনো বিধান আছে? শীঘ্রই আমরা আদালতের মাধ্যমে তাকে বেল দিয়ে দিব। বিচারালয়ের গেট থেকে সোর্ন তাকে তুলে নিয়ে যাবে। গেটে পৌঁছার আগে সে যাতে কোনোভাবে পালিয়ে যেতে না পারে, সেটা আমরা নিশ্চিত করব।’ থামল প্রধানমন্ত্রী ফ্রেডারিক ফার্ডিনান্ড।

থেমেই আবার সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘আমাদের সকলের প্রিয় মহামান্য রাজা চতুর্থ হেরাল্ড, সবার কথা শুনে আমার যা মনে হয়েছে, আমি যা চিন্তা করেছি সেটা আমি পেশ করলাম। রাজা চতুর্থ হেরাল্ডকে একটা লম্বা বাউ করে বসে পড়ল প্রধানমন্ত্রী ফার্ডিনান্ড।

রাজা চতুর্থ হেরাল্ড পুরো হাউজের উপর একবার চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী মহোদয়কে ধন্যবাদ। আমিও এ রকমটাই চিন্তা করেছিলাম। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে আমাদের সকলের মধ্যে তিনি চিন্তার ঐক্য এনে দিয়েছেন। এখন মন্ত্রীসভা ও জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্যবর্গ বলুন, আর কিছু কি বলার আছে কারো?’

গোটা হাউসের সবাই একসাথে হাততালি দিয়ে রাজা চতুর্থ হেরাল্ড ও প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাল।

রাজা চতুর্থ হেরাল্ড হাউজের সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে বলল, ‘প্রধানমন্ত্রী মি. ফার্ডিনান্ড যে সমন্বয়মূলক উপস্থাপন করেছেন, সেটা আমাদের সিদ্ধান্ত, রাষ্ট্রেরও সিদ্ধান্ত। যার সারাংশ হলো:

এক. রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে আমরা কর্নেল ওসামাকে সোর্ন-এর হাতে তুলে দেব।

দুই. সোর্ন-এর আল্টিমেটামের সময়সীমার মধ্যে কর্নেল ওসামাকে তাদের হাতে তুলে দিব না।

তিন. কর্নেল ওসামাকে আদালত থেকে বেল করিয়ে আমরা তাকে ছেড়ে দেব এবং সোর্ন তাকে নিয়ে যাবে।’ রাজা চতুর্থ হেরাল্ড কথা শেষ করল।

সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে রাজা চতুর্থ হেরাল্ডের অনুমতি নিয়ে সভা শেষ করল প্রধানমন্ত্রী।

সবার শুভ কামনা করে রাজা চতুর্থ হেরাল্ড বিশেষ দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল সভাকক্ষ থেকে।

সবাই উঠে দাঁড়িয়েছিল।

সবার চোখে-মুখে স্বস্তি।

সভাকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল সবাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *