শান্তির দ্বীপে সংঘাত – ৪

রাত ৮টা।

ডিনার সেরে ইভা হেরাল্ড তার স্টাডি রুমের সোফায় এসে বসল।

পড়ার টেবিলে একটা বই খোলা। পড়তে পড়তে উঠেই সে ডিনারে গিয়েছিল।

এখন ক’মিনিট সে রেস্ট নিতে চায়। তারপর পড়ার টেবিলে যাওয়ার তার ইচ্ছা।

ইভা হেরাল্ডের স্টাডির দরজায় এসে দাঁড়াল হ্যানস ফেয়ার হেয়ার হেরাল্ড। ইভা হেরাল্ডের বড় ভাই।

‘ভেতরে আসতে পারি ইভা?’ হ্যানস হেরাল্ড বলল।

উঠে দাঁড়াল ইভা হেরাল্ড। বলল, ‘এসো ভাইয়া।

হ্যানস হেরাল্ড ঘরে ঢুকল। বলল, ‘গুড ইভনিং ইভা।’

হ্যানস হেরাল্ড গিয়ে বসল পাশের সোফায়।

‘গুড ইভনিং ভাইয়া।’ বলে ইভা হেরাল্ড তার সোফায় বসে পড়ল।

‘ইভা কেমন আছিস তুই? কপালের ক্ষত দেখছি একদম ভালো হয়ে গেছে।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘ভালো আছি ভাইয়া। কপালটা কবে ঠিক হয়ে গেছে, তুমি আজ দেখছ?’ ইভা হেরাল্ড বলল।

‘প্রতিদিনই দেখছি। শুধু দেখছি নয়, এটা নিয়ে ভেবেছি। এখনও ভাবছি। আজ এটা নিয়েই তোকে কয়েকটা প্রশ্ন করব। বলত যে ঘটনার একটা ফল হিসেবে তোর কপাল আহত হয়েছিল, সেই ঘটনা তুই গোপন করলি কেন?’

ইভা হেরাল্ড তাকাল ভাইয়া হ্যানস হেরাল্ডের দিকে।

সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্নের উত্তর দিল না। ভাবছে, ব্যাপারটা ভাইয়া জানতে পেরেছে। আর কে কে জানতে পেরেছে? বাবা-মারা কি জানতে পেরেছে? কতটা জানতে পেরেছে?

উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় হ্যানস হেরাল্ডই আবার বলল, ‘কিরে ইভা কথা বলছিস না কেন?’

‘ভাইয়া, আমি ভেবেছিলাম ব্যাপারটা বাবা জানতে পারলে একটা মহা হৈচৈ হবে। এই হৈচৈ-এ আমি জড়িয়ে পড়ব। এটা আমি চাইনি। তাই আমি ব্যাপারটা গোপন করেছি।’ বলল ইভা হেরাল্ড।

‘ঠিক করিসনি। ওদের মতো অপরাধীরা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নয়। ওরা স্কিনহেডেড হওয়া, বর্ণবাদী হওয়ার অপরাধ আড়াল করার ওদের একটা কৌশল। তাছাড়া যারা ঘটনার সাথে জড়িত, তারা ভিক্টর আইল্যান্ডের নয়। ওরা আমাদের সাগর এরিয়ার বাইরে নোঙর করা এক জাহাজের ক্রিমিনাল। ওরা বিভিন্ন দ্বীপে লুটতরাজ, নারী অপহরণ ইত্যাদি জঘন্য কাজের সাথে জড়িত। লুটের মাল যেমন, তেমনি যে নারীদের ওরা আপহরণ করে নিয়ে যায়, তাদের আর পাওয়া যায় না। ওরা জঘন্য নারী ব্যবসায়ীও। থামল হ্যানস হেরাল্ড।

শিউরে উঠল ইভা হেরাল্ড তার ভাই হ্যানস হেরাল্ডের কথা শুনে। বুকটা তার কাঁপতে লাগল। সেদিন যদি তাকে ওদের হাত থেকে উদ্ধার করা না হতো, তাহলে কি হতো তার পরিণতি!

কোনো কথা বলতে পারল না ইভা হেরাল্ড।

হ্যানস হেরাল্ডই আবার বলল, ‘তোর উচিত ছিল ওদের হাত থেকে উদ্ধার পাওয়ার পর সঙ্গে সঙ্গেই পুলিশকে টেলিফোন করা, তাহলে ওদের অবশিষ্টদের পুলিশ ধরতে পারত।’

‘ভাইয়া, স্কিনহেডেডদের আমি আমাদের লোক মনে করেছিলাম। আর ওরা যদি এই দ্বীপের লোক নাও হয়ে থাকে, তাহলেও স্কিনহেডেডদেরই অংশ তারা। ওদের সাথে সরকারের বড় ধরনের কোনো গণ্ডগোল হোক, আমি তা চাইনি।’ ইভা হেরাল্ড বলল।

‘তোর কথায় যুক্তি আছে। কিন্তু ওরা সরকারের চেয়ে বড় নয়। ওদের সরকার ব্যবহার করছে, সরকারকে ওরা ব্যবহার করতে পারে না। ঘটনাটা সঙ্গে সঙ্গে প্রকাশ না হওয়ায় ঐ বাহিরাগত স্কিনহেডেডরা আমাদের দ্বীপের স্কিনহেডেডদের ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছে। ওরা তোর ফটো এবং তোকে যে উদ্ধার করেছে তার ফটো এখানকার স্কিনহেডেড নেতার কাছে জমা দিয়ে বলেছে, এই দু’জন যোগসাজস করে একটা ঘটনা ঘটিয়ে তাদের চারজন লোককে হত্যা করেছে। এর প্রতিকার তারা চায়।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘কেন ভাইয়া, জান্নাতুল আরদ রেস্টুরেন্টের সিসিটিভি’তে তো সব দৃশ্যই পাওয়া যাবে।’ ইভা হেরাল্ড বলল।

‘স্কিনহেডেডদের সাথীরা পরে এসে রেস্টুরেন্ট ভাঙচুর করেছে এবং সেদিনের সিসিটিভির ফিল্ম নিয়ে গেছে। যার ফলে তোকে যে ওরা অপহরণ করেছিল তার কোনো প্রমাণ নেই।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘কেন কোনো গোয়েন্দা রিপোর্ট আসেনি? ইভা হেরাল্ডের জিজ্ঞাসা।

‘গোয়েন্দা রিপোর্টে সেখানে একটা ঘটনা ঘটার কথা আছে। তোর এবং তাদের কোনো কথা সে রিপোর্টে নেই। কিন্তু চারজন স্কিনহেডেডের লোক নিহত হবার ঘটনা সচিত্র রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েেিছ। এর ফলে ক্রিমিনালরা বেঁচে গেল, কিন্তু ধরা পড়ে গেল তোকে যে বাঁচিয়েছে, সেই বেচারা। তার আরও বিপদ হলো তার পরিচয়ও প্রকাশ হয়ে পড়েছে। সে প্রাক্তন সেনা অফিসার এবং এ দ্বীপের সবচেয়ে বড় আসামি দরবেশ বংশের এক লোক। সবচেয়ে বড় খবর হলো, সে সাগর সাইমুমের নেতা। এর ফলে ক্রিমিনাল স্কিনহেডেডরা একদম ক্লিন হয়ে গেল। আর আসামি হয়ে গেল তোকে উদ্ধারকারী ওসামা ওবায়দুল্লাহ। শুরুতেই যদি শয়তানদের ফাঁদে ফেলা যেত, তারা এই ষড়যন্ত্র করতে পারতো না।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

আতঙ্ক-উদ্বেগে চুপসে গেছে ইভা হেরাল্ড। তার ভেতরটা যেন কাঁপছে। ওর এই বিপদটা তার কারণেই ঘটল।

সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বলতে পারল না ইভা হেরাল্ড। তার ভাইয়াকে তাঁর প্রতি সহানুভূতিশীল মনে হচ্ছে। কিন্তু ভাইয়া কি করবে?

ইভা হেরাল্ড মুখ নিচু করে বসেছিল। মুখ তুলে সে তার ভাইয়ার দিকে তাকাল। বলল, ‘এখন কি হবে ভাইয়া?’

‘সেটাই ভাবনার বিষয়। সরকার ও স্কিনহেডেডরা এক হয়ে গেছে। সরকারের লক্ষ্য হলো, সরকার শত্রুপক্ষের একজন নেতার সন্ধান পেয়েছে, তাকে তারা শেষ করতে চায়। আর স্কিনহেডেডদের টার্গেট হলো তাদের চারজন স্কিনহেডেড হত্যাকারীর তারা প্রতিশোধ নিতে চায়। একই লক্ষ্য দুই পক্ষের। এই অবস্থায় আমি করার দেখছি না। তাকে নির্দোষ প্রমাণের এখন কোনো উপায় নেই।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘ভাইয়া বলত, একজন উপকারী ও নির্দোষ মানুষের বিরুদ্ধে এই শত্রুতা অন্যায় কিনা? সে সাগর সাইমুমের নেতা, এটা বানানো অভিযোগ হতে পারে। আর সে দরবেশ বংশের ছেলে এটা কোনো দোষের ব্যাপার নয়, যতক্ষণ না সে অপরাধ করে। আর চারজন স্কিনহেডেড সেদিন নিহত হয়েছে তাদেরই অপরাধের কারণে। এতে কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর কোনো দোষ নেই, বরং সে যে কাজ করেছে তার জন্যে তার রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পাওয়া উচিত।’ থামল ইভা হেরাল্ড।

‘তোর প্রত্যেক কথা সত্য, কিন্তু এই সত্যটা শোনার এবং মানার কেউ নেই। বাবা মানে সরকারের প্রধান লক্ষ্যই হলো, এই ভিক্টর আইল্যান্ডে হেরাল্ড রাজবংশের রাজত্ব যে কোনো মূল্যে নিরাপদ রাখা। এ জন্যে বাবার সরকার দুটি ‘বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে। একটি হলো, দরবেশ বংশ ও তাদের সমর্থকদের নিমূর্ল করা। আর দ্বিতীয়টা, বর্ণবাদী, সন্ত্রাসী হোয়াইট এবং স্কিনহেডেডদের বিশ্বব্যাপী সিন্ডিকেটকে দ্বীপের জন্যে সাহায্য লাভ ও দ্বীপের নিরাপত্তা বিধানের কাজে ব্যবহার করা। সুতরাং বাবার সরকার এর বাইরে আর কোনো কিছুই চিন্তা করতে রাজি নয়।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

চোখ-মুখ ছলছল করছে ইভা হেরাল্ডের। প্রায় কান্নার সুরে বলল, ‘ভাইয়া, লোকটি আমাকে সাহায্য করতে গিয়েই এই বিপদে পড়ল। সেদিন সে রেস্টুরেন্টে অনেক লোক ছিল, আশেপাশের রেস্টুরেন্টেও ছিল। আমি চিৎকার করেছি সাহায্যের জন্যে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। কেউ মৌখিক প্রতিবাদও করেনি। কিন্তু ওসামা ওবায়দুল্লাহ একটা মেয়েকে অপহরণ করা হচ্ছে দেখেই ছুটে এসেছে। নিজের নিরাপত্তার চাইতে তিনি অনেক বড় করে দেখেছেন একটা মেয়ের নিরাপত্তাকে। এই মানুষটিই আজ কঠিন বিপদে। আমি এক অসহায় মেয়ে মানুষ কি করতে পারি তার জন্যে। কান্নায় ডুবে গেল শেষের কথাগুলো তার। তার দু’গণ্ড বেয়ে নামল অশ্রুর ধারা।

দু’হাতে মুখ ঢাকল ইভা হেরাল্ড।

হ্যানস হেরাল্ড উঠে দাঁড়িয়ে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, কাঁদিস না বোন। ওরা যেমন ভালো লোক, তেমনি আল্লাহতে গভীরভাবে বিশ্বাসী। আশা রাখ আল্লাহ ওকে সাহায্য করবেন। আমিও দেখব, কি করতে পারি তার জন্যে

একটু থামল। একটু ভাবল। বলল, ‘আচ্ছা বোন ওকে সতর্ক করে দেয়ার কোনো পথ আছে কিনা। টেলিফোন নাম্বার থাকলে সবচেয়ে ভালো হতো।’

‘ভাইয়া, আমি ওর নাম ছাড়া কিছুই জানি না।’ বলল ইভা হেরাল্ড।

এ সময় মোবাইল বেজে উঠল হ্যানস হেরাল্ডের।

হ্যানস হেরাল্ড মোবাইল তুলে নিল।

‘হ্যালো’ বলে ওপারের সাড়া পেয়েই বলল, ‘হ্যাঁ স্কার্ল, কি খবর?’ ওপারের কথা শুনল। মাঝে একবার প্রশ্ন করল, ‘এখন কোথায় সে? তার অবস্থা কি?’

ওপারের কথা আরও কিছু শুনল। বলল, ‘একটু খোঁজ নাও কোথায় রেখেছে তাকে

কল অফ করে তাকাল ইভা হেরাল্ডের দিকে। তার চোখে-মুখে বিমৰ্ষতা নেমে এসেছে।

আর ইভা হেরাল্ড উৎকণ্ঠিত। অস্থির তার চোখ-মুখ।

হ্যানস হেরাল্ড নরম কণ্ঠে বিষণ্ণ সুরে বলল, ‘বোন খুব খারাপ খবর। ওসামা ওবায়দুল্লাহকে ধরা হয়েছে। তার ছবি সব জায়গায় ছড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। গোয়েন্দাদের খবরের ভিত্তিতে আমাদের রাজধানীর বাইরে এক জায়গায় তাকে ঘিরে ফেলা হয়। মারাত্মক সংঘর্ষ হয়। সেনা, পুলিশ ও স্কিনহেডেডদের মোট পনের জন লোক তার হাতে মারা গেছে। আহত হয়েছে তার চেয়ে বেশি। শেষে তাকে আহত অবস্থায় বন্দী করা হয়েছে।’

ইভা হেরাল্ড দু’হাতে মুখ ঢেকে সোফায় এলিয়ে পড়েছিল।

বোনের এই অবস্থা হ্যানস হেরাল্ডকেও স্পর্শ করেছে। তারা দুই ভাই-বোন পিঠাপিঠি। ছোটবেলা থেকে তারা এক সাথে বেড়ে উঠেছে। তাদের একজন আরেকজনকে না হলে চলে না। গভীর স্নেহের সম্পর্ক ওদের মধ্যে। বোনের দুঃখ তার মনেও গভীর দুঃখের সৃষ্টি করেছে। কিন্তু হ্যানস নিজের মনকে শাসানী দিয়ে বলল, ‘বোনের মতো তাকেও নরম হলে চলবে না। তাতে বোন আরও ভেঙে পড়বে। শক্ত হতে হবে তাদের। বাস্তবতার মুখোমুখি তাদের হতে হবে।’

হ্যানস হেরাল্ড বোনের কাছে একটু সরে গিয়ে তার মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, ‘ইভা ভেঙে পড়ে লাভ নেই। দুর্বলের কান্নার কোনো মূল্য হয় না সবলের কাছে। সবলের কাছে কিছু পেতে হলে সবলের সমকক্ষ হতে হবে। দেখ, তোকে বাঁচিয়েছে যে ছেলেটা, সে একা হয়েও বড় একটা সশস্ত্র, প্রশিক্ষিত দলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। একা হয়েও সে তিরিশ-পঁয়ত্রিশজন প্রতিপক্ষকে আহত নিহত করেছে। আহত না হওয়া পর্যন্ত তাকে ধরা যায়নি, নিষ্ক্রিয় করা যায়নি। তার পরাজয় হয়নি ইভা। সে বন্দী হয়েছে বীরের মতো। তার জন্যে কাঁদলে তার অসম্মান হয়। বীরের জন্যে বীরের মতই চিন্তা করা দরকার।’

ইভা উঠে সোজা হয়ে বসল। চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে তার মুখ।

বলল ইভা হেরাল্ড, ‘তার জন্যে কি করব ভাইয়া। আমি তো বীর নই।

‘বীর নস তুই। কিন্তু বীরের মেয়ে, বীরের নাতনী, একজন মহান বীরের প্রপৌত্রী এবং তোর ভাই হিসাবে সোনাবাহিনীতে আমার রেকর্ডও খারাপ নয়।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

চোখ মুছল ইভা হেরাল্ড। বলল, ‘ওসামা কেমন আহত ভাইয়া?’

‘তার বাম বাহুতে গুলি লেগেছে।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘ওসামাকে একটা হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন হাসপাতালে তা জানতে পারিনি। খোঁজ নেবার জন্যে বলেছি। খোঁজ পেলে তার চিকিৎসার বিষয়টা এবং কেমন আছে তা জানা যাবে।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘ভাইয়া, প্রথমেই দরকার তার প্রতি যেন সুব্যবহার হয় তা নিশ্চিত করা। তারপর আরও কিছু করা যায় কিনা দেখতে হবে।’ ইভা হেরাল্ড বলল।

‘ঠিক বলেছিস ইভা। বাবাকে আমি এ বিষয়ে বলব। বাবা সব ব্যাপার জানেন না। বিশেষ করে তোকে তার উদ্ধারের ঘটনা।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আমিও বাবাকে কি কিছু বলব?’ ইভা হেরাল্ড বলল।

‘না ইভা, তুই এর সাথে জড়াস না। বাবা অন্য কিছু মনে করে ফেলতে পারেন। তাহলে ব্যাপারটা আরও খারাপ হয়ে যাবে। ওসামার উপর বিপদ বাড়তে পারে।’ বলল হ্যানস দ্রুত কণ্ঠে 1

‘অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া। তুমি ঠিক বলেছ। আমার নীরব থাকাই ভালো। যদি কিছু পারি নীরবেই করব। তাহলে তুমি ভাইয়া বাবাকে তাড়াতাড়ি বলো।’ ইভা হেরাল্ড বলল।

‘অবশ্যই, কাল ব্রেকফাস্টের পর বাবার সাথে আমার কথা হবে। তিনি ডেকেছেন। সেখানেই সুযোগ বুঝে তোর উদ্ধারের কাহিনী বাবাকে বলব। তারপরেই বাবাকে বলব জীবন বাজী রেখে এ দেশের প্রেসিডেন্টের মেয়েকে উদ্ধারকারী ওসামার সুব্যবহার পাওয়া উচিত।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

হ্যানস হেরাল্ডের কথা শুনে ইভা হেরাল্ডের মুখ অনেকখানি সহজ হয়ে উঠল। বলল, ‘ভাইয়া, বাবার কাছ থেকে কি ফল আশা করছ?’

‘তুই বাবার হৃদয়ের একটা টুকরো, তুই জানিস না? তুই বাড়ির সবার আদরের, কিন্তু তুই বাবার মাথার মণি। আমি…।’

হ্যানসের কথার মাঝখানে ইভা হেরাল্ড বলে উঠল, ‘যেমন তুমি মায়ের নয়নের মণি।

‘হিংসা করবি না। মা কিন্তু কিছু দেবার সময়, তোকেই বেশি দেয়, ভালোটা দেয়।’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘সে আমি জেদ করি বলে। তুমি তো জেদ করো না।’ ইভা হেরাল্ড বলল। তার মুখে হাসি।

‘জেদ করব কেন? আমার ভাগ থেকেও তোকে আমি দিই না?’ বলল হ্যানস হেরাল্ড।

‘দাও ভাইয়া। তুমি এত আদর কর, অপরাধ করলেও বলবে না কিছু, তাইতো তোমাকে আমি আমার সব কথা বলতে পারি।’ ইভা হেরাল্ড বলল। তার কণ্ঠ আবেগে আপ্লুত।

হ্যানস হেরাল্ড উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘এখন চলি। জরুরি কিছু কাজ পড়ে আছে। ওসামার খোঁজ-খবর কতটা হলো, সেটা দেখতে হবে।’

একটু থেমে বোনের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, ‘কোনো চিন্তা করবি না, কাঁদা-কাটা করবি না। মনে রাখবি, তুই নরওয়ের হেরাল্ড রাজবংশের মেয়ে। আমাদের গ্র্যান্ড দাদু দেশ ছেড়েছেন, কিন্তু তিনি যাকে ন্যায়, সত্য মনে করেছেন, তার উপর অটল থেকেছেন। সব হারিয়েও তিনি বাঁচার জন্যে সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। তাই মনে রাখিস, দুঃখ আমাদের জয় করবে না, দুঃখকেই আমরা জয় করব।’ হ্যানস যাবার জন্যে পা বাড়াল।

ইভা হেরাল্ডও উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘তাই যেন আমরা পারি ভাইয়া। ধন্যবাদ।’ হ্যানস হেরাল্ড চলে গেল।

‘তোমার নাম কি?’

প্রশ্নটি যার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো সে বিরাট বপু স্কিনহেডেড একজন শ্বেতাংগ।

‘তোমরা জানতে চেয়েছ আমার নাম। আমি ওসামা ওবায়দুল্লাহ।’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ। তার চুল উষ্কখুষ্ক। চেহারা বিপর্যস্ত, গায়ের জামা-কাপড় ধুলিধূসরিত। বিরাট একটা তক্তপোষের উপর সে শুয়ে। তার বাম বাহুতে ব্যান্ডেজ বাঁধা। ডান হাত একটা লোহার ক্লিপ দিয়ে তক্তপোষের সাথে আটকানো। পা দুটি শিকল দিয়ে বাঁধা।

‘বহু কষ্ট করে জেনেছি তোমার আসল নাম। তবু জিজ্ঞাসা এই কারণে করলাম যে, তোমার স্বীকারোক্তির রেকর্ডটা আমাদের কাজে লাগবে। তুমি তো বাঁচবে না। তখন এই রেকর্ডটা তোমার লোকদের শোনাতে হবে।’ বলল বিরাট বপু স্কিনহেডেড শ্বেতাংগ লোকটি।

স্কিনহেডেড শ্বেতাংগ লোকটির সাথে বসে আছে আরও তিনজন। দু’জন পুলিশ। তাদের পোশাক ও ইনসিগনিয়া দেখে মনে হয় বড় পুলিশ অফিসার হবে। তৃতীয়জন স্কিনহেডেড শ্বেতাংগ লোকটি।

একটু থেমে বিরাট বপু স্কিনহেডেড সেই শ্বেতাংগ লোকটি আবার প্রশ্ন করল, ‘তুমি আমাদের সাথী চারজন লোককে হত্যা করেছ। এই অপরাধের শাস্তি কি জান?’

‘আমি সবজান্তা নই। একমাত্র মহান আল্লাহই সব জানেন, সর্বজ্ঞ তিনি।’

বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।

প্রশ্নকর্তা স্কিনহেডেড লোকটি ক্রোধে চিৎকার করে বলল, ‘চুপ করো হারামজাদা।’

আর সাথে সাথে পাঁজরে একটা লাথি চালিয়ে বলল, ‘তোমার আল্লাহ সর্বজ্ঞ হলে আমরা তোমাকে খাঁচায় পুরতে যাচ্ছি, সেটা তোমার আল্লাহ জানতে পারেনি কেন?’

লাথির আঘাত সামলে নিয়ে বলল, ‘অবশ্যই জানতে পেরেছেন। আপনাদের পরিকল্পনা আগেই তিনি জানেন। আপনারা কি করবেন ভাও তিনি জানেন।

‘তাহলে তোমাকে রক্ষা করেনি কেন?’ স্কিনহেডেড প্রশ্নকর্তা বলল।

‘আপনাদের একটা পরিকল্পনা আছে, আমার আল্লাহরও একটা পরিকল্পনা আছে।’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।

হো হো করে হাসল স্কিনহেডেড লোকটি। বলল, ‘থাকো এ বিশ্বাস নিয়ে। তোমাকে জানাচ্ছি, চারজনকে হত্যার জন্য তোমাকে মৃত্যু দণ্ডাদেশ আমরা দিয়ে রেখেছি। তবে যেহেতু তোমার আরও অপরাধ আছে, তোমার পেট থেকে আরো অনেক কথা জানার আছে, তাই দণ্ডাদেশ কার্যকরী করতে একটু বিলম্ব হবে।’

একটু থামলো স্কিনহেডেড লোকটি। একটু পরামর্শ করল পাশের পুলিশ অফিসারের সাথে। দৃষ্টি ঘোরালো ওসামা ওবায়দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘তোমাদের ‘সাগর সাইমুম’ কতদিন ধরে কাজ করছে?’

‘সাগর সাইমুম আমি প্রতিষ্ঠা করিনি। অতএব এ প্রশ্নের জবার আমি দিতে পারব না।’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।

‘সাগর সাইমুম কোন লক্ষ্যে কাজ করছে, সেটা তো জানো অবশ্যই?’ সেই স্কিনহেডেড লোকটি বলল।

‘এটা তো তোমরাও জানো এবং এ দেশবাসীর সকলেই জানে। এ দেশের মুসলিম এবং আদিবাসীদের উপর যে জুলুম, অত্যাচার, হত্যা, গুমের মতো অবিচার চলছে এসবের প্রতিবাদ করা, প্রতিকার চাওয়া।’ বলল কর্নেল ওসামা।

‘কে জুলুম অত্যাচার করছে?’ বলল প্রশ্নকর্তা স্কিনহেডেড লোকটি।

‘এই দেশের দখলদার সরকার। কর্নেল ওসামা বলল।

কথাটি কর্নেল ওসামার মুখ থেকে বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্কিনহেডেড লোকটি লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তার বুট পরা পায়ের একটা লাথি ছুটে গেল কর্নেল ওসামার মুখ লক্ষ্যে।

‘এত বড় স্পর্ধা একজন বন্দীর!’ বলল স্কিনহেডেড লোকটি অনেকটা স্বগোতোক্তির মত।

লাথির আঘাতে ঠোঁট ও নাক থেঁতলে গিয়ে গল গল করে রক্ত বেরিয়ে এলো। চোখ বুজে সহ্য করল এই নির্যাতন। মুখ থেকে কোনো শব্দ বেরোল না তার।

কর্নেল ওসামা, আপনার হিতাহিত জ্ঞান কি কিছুই নেই? মৃত্যু আপনার মাথার উপর। আপনার কি ভয় নেই?’ একজন পুলিশ অফিসার বলল।

‘মৃত্যু যখন আসবার তখন আসবেই। ভয় করে লাভ কি?’ বলল কর্নেল ওসামা।

‘তাহলে মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত তুমি?’ স্কিনহেডেড লোকটি বলল।

‘না আমি মুক্তির জন্য প্রস্তুত।’ বলল কর্নেল ওসামা।

হো হো করে সেই হাসি হেসে উঠল স্কিনহেডেড লোকটিসহ সকলেই।

‘আপনার শরীরের যে হাল হয়েছে, তাতে সম্ভবত আপনার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। একজন ভালো লোক কি এমন আকাশকুসুম কল্পনা করতে পারে?’ বলল একজন পুলিশ অফিসার।

‘ঠিক আছে মুক্তির জন্য দিন গুনতে থাক। এখন আমার প্রশ্নের জবাব দাও। সাগর সাইমুমের ঘাঁটিগুলো কোথায় বল?’ স্কিনহেডেড লোকটিই প্রশ্ন করল।

‘সুবর্ণ দ্বীপের প্রতিটি বাড়িই সাগর সাইমুমের ঘাঁটি। সুতরাং সাগর সাইমুমের ঘাঁটি কোথায়, কতটি, এসব প্রশ্ন অবান্তর।’

একজন পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে স্কিনহেডেড লোকটি বলল, ‘এ সাংঘাতিক ঘোড়েল মি. সিমসন। এভাবে তাকে কথা বলানো যাবে না। বৈদ্যুতিক আসনের ব্যবস্থা করতে হবে। সাগর সাইমুমের ঘাঁটিগুলো এবং তাদের কিছু পরিচয় আমাদের উদ্ধার করতেই হবে। এই শয়তানকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে, সাগর সাইমুম ভবিষ্যতে আমাদের জন্য বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। আমাদের এই ভিক্টর দ্বীপ শুধু একটা দ্বীপ রাষ্ট্রই নয়, এটা আমাদের আশা ভরসার স্থল ‘নিউ নাজী’দের শক্তিকেন্দ্র বা রাজধানীর মতো হয়ে উঠেছে। একে যেকোনো মূল্যে রক্ষা করতে হবে।’

পুলিশ অফিসার সিমসন স্কিনহেডেড লোকটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছেন, এইভাবে তাকে কথা বলানো যাবে না। কিন্তু কি করা যায় বলুন। তাকে জেলখানা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। যা করার আমাদের দ্রুত করতে হবে।’

‘দেখুন, ওসব আইন আমরা মানি না। আমাদের চারজন লোককে সে খুন করেছে। এতটা সময় তার বেঁচে থাকার কথা নয়। আপনারা তার রাষ্ট্রদ্রোহের বিচার করতে চান, তার কাছ থেকে কথা আদায় করতে চান, সেজন্যই আমরা কিছু করতে পারিনি।’ বলল স্কিনহেডেড লোকটি।

পুলিশ অফিসার সিমসন একটু হাসল। বলল, ‘আমরাও এসবের ধার খুব একটা ধারি না। কিন্তু কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ হঠাৎ করেই আমাদের হাতে পড়েছে। তার কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু আমাদের জানা নেই। তার উপর সাগর সাইমুম আমাদের জন্য একটা বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। আর এই কর্নেল ওসামা যদি সাগর সাইমুমের একজন নেতা হয়ে থাকে তাহলে এটা হবে আমাদের জন্য একটা বড় বিষয়। তাকে হত্যার চেয়ে এখন তার কাছ থেকে আমরা যা জানতে চাই তা জানা এবং তাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করে সাগর সাইমুমের কাছে পৌঁছতে পারা আমাদের জন্য এখন বড় বিষয়।

‘আমরা আপনাদের সাথে একমত। আমরা তো চাচ্ছি কথা আদায় করতে। এখন আমাদের কাছে তাকে কথা বলানোর জন্য সবচেয়ে সহজ পন্থা সেটা হল তাকে ইলেকট্রিক আসনে বসানো। এতে তার বহিরাঙ্গের কোনো ক্ষতি হবে না, কিন্তু এতে আমরা বড় সাফল্য পাবো। তার প্রতিরোধ ক্ষমতা ধসে পড়লে তার মুখ থেকে কথা গড়গড় করে বেরিয়ে আসবে দেখবেন। বলল স্কিনহেডেড লোকটি।

‘আমিও তাই মনে করি।’ বলল পুলিশ অফিসার সিমসন।

‘তাহলে আর দেরি কেন, ব্যবস্থা করতে বলি?’ স্কিনহেডেড লোকটি বলল।

‘ঠিক আছে, ব্যবস্থা করুন।

কথাটা বলেই পুলিশ অফিসার সিমসন তাকাল কর্নেল ওসামার দিকে। বলল, ‘শুনলেন তো, আপনাকে নাচানোর ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আমরা পুলিশরা অন্তত আপনার সাথে খুবই ভালো ব্যবহার করেছি। এক সময় আপনি আমাদের দেশপ্রেমিক এলিট বাহিনীর একজন খুব ব্রাইট অফিসার ছিলেন। এ বিবেচনা থেকেই আমরা আন্তরিকভাবে আপনার সহযোগিতা চেয়েছি। আপনি সহযোগিতা করেননি। কিন্তু এটা করে আপনি শুভবুদ্ধির পরিচয় দেননি। এখনো সময় আছে, আপনি আমাদের সহযোগিতা করুন। কথা না বলে কি আপনি নিজেকে এবং সাগর সাইমুমকে রক্ষা করতে পারবেন? পারবেন না। আপনাদের সবাইকেই মরতে হবে, নয়তো দ্বীপ ছেড়ে পালাতে হবে।’

‘আমরা মরতেও চাই না, দ্বীপ ছেড়ে পালাবোও না। ইনশাল্লাহ সত্যের জয় হবেই।’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।

‘বড় বড় কথা বলবেন না। অনেকেই এমন বড় বড় কথা বলে, কিন্তু নাচন শুরু হলে শরীরটা যখন ধসে পড়ে, ভেতরের মনটা তখন সড়সড় করে কথা বলে ওঠে। বাহাদুরী না করে বাস্তববাদী হোন। পুলিশ অফিসার সিমসন বলল।

‘বাহাদুরী আমি করছি না। আমি সত্য ও ন্যায়ের উপর আছি। অত্যাচার করার শক্তি আপনাদের আছে। অত্যাচার সহ্য করার শক্তি আমি আল্লার কাছে চাইব। তিনিই আমার ভরসা।’ বলল কর্নেল ওসামা।

বিরক্তিতে মুখ বাঁকিয়ে স্কিনহেডেড লোকটির দিকে তাকিয়ে পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘মি. রুডিগার কাজ শুরু করুন।’

কর্নেল ওসামার শুয়ে থাকা তক্তপোষটিকেই বৈদ্যুতিক আসনে পরিণত করা হয়েছে। বৈদ্যুতিক কানেকশন, দেহের সাথে বৈদ্যুতিক তারের সংযোগ, কর্নেল ওসামার দেহটিকে তক্তাপোষের সাথে বেঁধে ফেলা- সব কাজই সম্পন্ন হয়েছে। লাল ও সাদা বাটনওয়ালা ক্ষুদ্র সুইচবোর্ড হাতে নিয়ে স্কিনহেডেড রুডিগার প্রস্তুত। তার চোখে-মুখে বন্য তৃপ্তির কুৎসিত প্রকাশ।

রুডিগারের তর্জনী সেট হলো সুইচ বোর্ডের লাল বোতামে। তর্জনী চেপে বসতে যাচ্ছিল লাল বোতামে।

এমন সময় ওয়ারলেস বেজে উঠল পুলিশ অফিসার সিমসনের। শব্দের দিকে চোখ বুলাল স্কিনহেডেড রুডিগার।

তার তর্জনীটা আপনাতেই সরে এলো লাল বোতামের উপর থেকে।

পুলিশ অফিসার ওয়ারলেস তুলে নিয়ে ‘হ্যালো’ বলেই নড়েচড়ে শটান হয়ে বসল এবং ওপারের কথা শুনতে থাকল এবং অবিরাম ‘স্যার’, ‘ইয়েস স্যার’ করতে লাগল। মাঝে সে একবার তাকাল রুডিগারের দিকে।

একনাগাড়ে মিনিট খানেকের মতো কথা শোনার পর পুলিশ সিমসন বলে উঠল খুব বিনয়ের সাথে, আপনি ঠিক বলেছেন স্যার। যা করতে হবে তা সব দিক ঠিক রেখেই করতে হবে। আপনার নির্দেশে সব ব্যবস্থা আমি করছি স্যার।

‘ধন্যবাদ, অনেক ধন্যবাদ স্যার।’ বলে ওয়ারলেস থেকে মুখ সরিয়ে তা পাশে রেখে দিয়েই পুলিশ অফিসার সিমসন তাকাল রুডিগারের দিকে। বলল, ‘হলো না মি. রুডিগার, ওকে কথা বলানো এখন আর গেল না। উপরের হুকুম এসেছে।

রুডিগার উৎসুক্য নিয়ে তাকিয়ে ছিল পুলিশ অফিসার সিমসনের দিকে। কোনো ভালো খবর শোনার জন্য তার মন উন্মুখ ছিল। কিন্তু পুলিশ অফিসার সিমসনের কথা শুনে মুখে একরাশ বিস্বাদ নিয়ে বলল, ‘কে ওয়ারলেস করেছিল? কি হুকুম উপরের?

‘পুলিশের অপারেশন চীফ মি. ক্যাসপারের কাছ থেকে হুকুম এসেছে। এখনই মি. ওসামাকে রাজধানীতে পুলিশের কেন্দ্রীয় জুডিশিয়াল ব্রাঞ্চের কাস্টডিতে পাঠাতে হবে। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থার লোকজন বর্তমানে আমাদের ভিক্টর আইল্যান্ড সফর করছে মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্যে। সরকার মনে করছে বিশেষ কোনো অভিযোগের ভিত্তিতেই তারা হঠাৎ করে ভিক্টর আইল্যান্ডে এসেছে। ধারণা করা হচ্ছে তারা জেলখানাগুলোসহ পুলিশ ও সেনা কাস্টডি দেখতে চাইতে পারে।’ বলল পুলিশ অফিসার সিমসন।

‘তার মানে এখন আমাদেরকে হ্যান্ডস আপ করে বসে থাকতে হবে। আচ্ছা মি. সিমসন কবে, কখন আমরা মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে এক পয়সার মূল্য দিয়েছি।’ বলল ক্রোধের সাথে রুডিগার।

‘তা দিলে আমাদের এই দ্বীপ রাষ্ট্র হতোও না, টিকেও থাকতে পারতো না, এটা আমরা জানি মি. রুডিগার। কিন্তু পরিস্থিতি মোকাবিলার ক্ষেত্রে কৌশল হিসেবে অনেক কিছুই করতে হয়।’ পুলিশ অফিসার মি. সিমসন বলল।

‘সেটা আপনাদের সরকারের ব্যাপার। কিন্তু আমরা এসব মানি না। আমরা এটা জানি, অব্যাহত আক্রমণই টিকে থাকা এবং বিজয়ের একমাত্র হাতিয়ার। আমি এখন বুঝতে পারছি ওসামা ওবায়দুল্লাহকে আপনাদের সরকারের হাতে তুলে দেয়াই আমাদের ভুল হয়েছে।’ বলল রুডিগার। কঠোর তার কণ্ঠ।

‘আমি আপনার সাথে একমত রুডিগার। কিন্তু কিছু করার নেই।’ বলে পুলিশ অফিসার সিমসন তাকালো তার সহকারী পুলিশ অফিসারের দিকে। এরপর বলল, ‘মি. ওভাল আপনি যান, আমাদের টিমকে প্রস্তুত করুন। আমরা আল-কবির উপত্যকা থেকে হাইওয়েটা এভোয়েড করে হেরাল্ড রোড ধরে রাজধানীতে পৌঁছব। আগে পিছে দুটি পুলিশ লরি থাকবে। মাঝখানের জিপে আমি ও আপনি মি. ওসামাকে নিয়ে উঠব।

একটু থামলো পুলিশ অফিসার সিমসন। সঙ্গে সঙ্গে আবার বলে উঠলো, ‘তবে মি. গুস্তাভ আজ নয় কাল সকালে যাত্রা করাই সঠিক হবে। আপনি হেড কোয়ার্টারে এ সংবাদ জানিয়ে দিন, সকাল দশটার মধ্যে আমরা রাজধানীতে পৌঁছে যাব।’

পুলিশ অফিসার উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘সেটাই ভালো হবে স্যার। তবে স্যার, হেরাল্ড রোড অনেকটাই দুর্গম। চড়াই-উৎরাইগুলোও খুব শার্প। সাধারণ গাড়ি-ঘোড়া চলে না ওই রোডে। শুধু সেনাবাহিনীর গাড়ি চলে।

‘তা হোক মি. গুস্তাভ। হাইওয়ের চেয়ে অর্ধেক সময়ে রাজধানীতে পৌঁছে যাব। সে সুযোগই সেনাবাহিনী নেয়।

‘ইয়েস স্যার’, বলে পুলিশ অফিসার যাত্রায় প্রস্তুতির জন্য চলে গেল।

কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ তখনো তক্তাপোষে শুয়ে। তার হাত-পা বাঁধা।

কর্নেল ওসামা চোখ বুজে শুয়ে ছিল।

কিন্তু সব কথাই তার কানে প্রবেশ করছিল।

মানবাধিকার সংস্থার ভিজিটের কারণে ওরা একজন বন্দীর শাস্তি বন্ধ রাখল শুনে মনে মনে হাসল কর্নেল ওসামা। রাজধানী সুবর্ণ নগরীতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দক্ষিণ-পূর্ব প্যাসিফিক অঞ্চলের বৈঠক চলাকালে তার মতো দশজন স্বাধীনতাকামীকে ওরা ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করেছিল। সেটা মাত্র ছয় মাস আগের ঘটনা। ওরাই মাত্র আজ ছয় মাস পরে মানবাধিকার সংস্থার ভিজিটকে ভয় পাচ্ছে। এই ভিজিটের বাস্তব কোনো মূল্য নেই। তাহলে এই ভিজিটকে ওরা অজুহাত বানাচ্ছে কেন?

কর্নেল ওসামার মনে অনাহুতভাবেই ইভা হেরাল্ডের মুখ ভেসে উঠল। ও নিশ্চয়ই এ খবর জেনেছে। কি করছে সে?

কর্নেল ওসামা হঠাৎ করেই ওদের হাতে পড়েছে। সেদিন কর্নেল সুবর্ণ দ্বীপের উত্তর উপকূলের একটা প্রাইভেট কমার্শিয়াল পোর্টে গিয়েছিল একটা নির্দিষ্ট বোট নিয়ে সাগরে বের হতে। বোটটি কমার্শিয়াল পোর্টের বোট বহরে রেজিস্ট্রিকৃত। এই বোটটি চালায় সাগর সাইমুমের একজন কর্মী।

এ ধরনের রেজিস্টার্ড বোট নিয়ে সাগরে বেরুবার সুবিধা হলো পুলিশের ঝামেলায় পড়তে হয় না। বোটের নাম ও বোটের নাম্বার দেখলেই তারা বুঝে যায় এটা অবৈধ বোট নয়।

সাইমুম কর্মীর বোটের নাম্বার কর্নেল ওসামার কাছে ছিল। সে নাম্বার দেখেই কর্নেল ওসামা বোটের কাছে যায়। বোটম্যান তার দিকে এগিয়ে আসে। তার চোখের দিকে তাকিয়েই কর্নেল ওসামা নিশ্চিত হয় এ বোটম্যান সাগর সাইমুমের কর্মী নয়। বোট ঠিক আছে, কিন্তু বোটম্যান বদল হয়েছে বা বদলানো হয়েছে। কর্নেল ওসামার চিন্তা আর সামনে এগোতে পারেনি। পোর্টে এবং পোর্টের বিভিন্ন বোটে যারা ছিল, তারা একযোগে এসে তাকে ঘিরে ধরে। তাদের সবার হাতে রিভলভার আর তা তার দিকে তাক করা।

কর্নেল ওসামা বুঝল এরা সবাই ছদ্মবেশী পুলিশ।

আরও বুঝল সাগর সাইমুমের কর্মী বোট চালকের পরিচয় নিশ্চয়ই কোনভাবে পুলিশের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছিল। তার মোবাইল ট্যাপ করে বা অন্য কোনোভাবে পুলিশ জানতে পেরেছিল যে, সাগর সাইমুমের একজন কর্মীর বোট নিয়ে আমি সাগরে বেরুবার জন্য পোর্টে আসছি। তারা পাকাপোক্ত আয়োজন করে রেখেছিল আমাকে ধরার জন্য।

.

সকাল তখন ৯টা।

আল-কবির উপত্যকা থেকে হেরাল্ড রোড ধরে তিনটি গাড়ির একটি বহর চলছে।

আল-কবির সুবর্ণ দ্বীপের রাজধানী শহর সুবর্ণ নগরী বা ভিক্টর সিটি থেকে পঞ্চাশ মাইল পুবে দ্বীপের সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের একটা উপত্যকা। এ উপত্যকার মধ্যে দিয়ে হেরাল্ড রোডটি পাহাড়ের আরও উঁচুতে সামরিক বাহিনীর ট্রেনিং কলেজ পর্যন্ত উঠে গেছে। হেরাল্ড রোডটি আল-কবির উপত্যকা থেকে পাহাড়-উপত্যকা ডিঙিয়ে সোজা চলে গেছে রাজধানী সুবর্ণ নগরীতে। দখলদারদের আমলে রাজধানী সুবর্ণ নগরীর নতুন নাম হয়েছে ভিক্টর সিটি, যেমন সুবর্ণ দ্বীপের নাম হয়েছে ভিক্টর আইল্যান্ড।

আল-কবির উপত্যকা থেকে বের হওয়া পুলিশের তিন গাড়ির বহরটি তখন আল কাররার নদীর শাখা ‘তালিয়া’র ব্রীজের উপর।

তালিয়া শাখা নদীটি এখানে তালিয়া উপত্যকা দিয়ে প্রবাহিত আরও উত্তরে চলে গেছে। তালিয়া উপত্যকাটি খুব প্রশস্ত নয়। তালিয়া শাখা নদীটি সংকীর্ণ পরিসরের বলে খুবই খরস্রোতা। তালিয়া উপত্যকার কিছু কিছু অঞ্চলে ফসলের চাষ হয়, কিন্তু তালিয়ার ব্রীজ অঞ্চলের গোটাটাই বন-বাদাড়ে ভরা।

পুলিশের তিনটি গাড়ির বহর যখন তালিয়া ব্রীজে উঠল, তখন তালিয়া ব্রীজের চারদিকে আরেকটা ভয়াবহ দৃশ্য।

গোটা শরীর কালো কাপড়ে আবৃত মুখোশধারী পঞ্চাশজনের একটা দল ব্রীজের দু’দিক থেকে ঘিরে ফেলেছে পুলিশের তিনটি গাড়িবহরকে।

ব্রীজের সামনে-পেছনে সড়কের পাশের ঝোঁপঝাড়ে ওরা লুকিয়ে ছিল। পুলিশের তিন গাড়ির বহর যখন ব্রীজে উঠল, তখন ওরা ঝোঁপঝাড় থেকে বেরিয়ে ব্রীজের দুই পাশের সড়কে উঠে এলো।

সবার হাতে মেশিনগান।

ব্রীজের সামনে-পিছনে দু’দিক থেকে তারা গুলিবৃষ্টি করতে করতে ছুটল পুলিশের গাড়িগুলোর দিকে।

পুলিশের গাড়ি তিনটি তখন ব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে পড়েছে। তিনটি গাড়িই লাগালাগি করে পরপর দাঁড়ানো।

দু’দিক থেকে আসা গুলির ঝাঁক এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছে পুলিশের তিনটি গাড়ির উপর। গুলিবৃষ্টির একটা অংশ পুলিশের গাড়িগুলোর ডান ও বাম পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। আর কিছু গুলি সামনে ও পেছনের দুইটি পুলিশ লরীকে সরাসরি আঘাত করছে। লরীর পুলিশরা পাল্টা আক্রমণের কোনো সুযোগ পায়নি। তারা লরীর মেঝেতে শুয়ে পড়েছে। দুই লরীরই ফ্রন্ট কেবিন গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে। সামনে লরীর ড্রাইভার-পুলিশ ও একজন পুলিশ অফিসার নিহত হয়েছে।

মাঝের পুলিশ জীপটি এখনও নিরাপদ আছে।

আক্রমণকারীদের সংখ্যা ও আক্রমণের গ্রাভিটি আঁচ করতে পেরে চারদিকে ওয়ারলেস করাসহ বিপদ সাইরেন বাজিয়ে দিয়েছে পুলিশ অফিসার সিমসন।

পুলিশ কর্মকর্তা সিমসন ও পুলিশ অফিসার গুস্তাভ তাদের কারবাইন থেকে দুপাশ দিয়ে দুজন সুযোগমতো গুলি করে যাচ্ছে।

তালিয়া ব্রীজের কয়েক গজ সামনে থেকেই উপত্যকার চড়াই শুরু হয়েছে। চড়াইটা শুরুতেই তিরিশ ডিগ্রি খাড়া উঠে গেছে। চড়াই-এর শীর্ষটা খুব দূরে নয়।

পুলিশ বহরের বিপদ সাইরেন বেজে চলেছে।

চড়াই-এর শীর্ষে সেনাবাহিনীর দুটি ভারি গাড়ি দ্রুত উঠে এসেছে।

গাড়ি দুটি থমকে দাঁড়াল চড়াই শীর্ষে।

সেনাবাহিনীর দুটি গাড়ির সামনেরটি একটি আর্মড কার। পেছনেরটা কাভারড ট্রুপস ক্যারিয়ার

আর্মড কারে বসা একজন কর্নেলের চোখে দূরবীন। দূরবীন চোখে রেখেই সে বলল, ‘তিনটি পুলিশের গাড়ি অ্যামবুশের শিকার। ব্রীজের দুপাশের সন্ত্রাসীরা এখনও ব্রীজে উঠতে পারেনি।’

আর্মড কারের ড্রাইভিং সিটে বসা সেনা অফিসারটির কাঁধে ক্যাপ্টেনের ইনসিগনিয়া। পেছনের সিটগুলোতে আরও তিনজন সেনা অফিসার। তাদের তিনজনের কাঁধের ইনসিগনিয়া বলছে, তারা তিনজনই মেজর র‍্যাঙ্কের অফিসার।

কর্নেল অফিসারের কথা শুনে পেছনের তিনজন অফিসার অ্যাটেনশন হয়ে বসল এবং সঙ্গে সঙ্গেই দুপাশের দুই মেজরের চেয়ার পাশের দিকে ঘুরে গেল। তাদের দুজনের সামনে আর্মড কারের দেয়ালে ভেসে উঠল নয় ইঞ্চি বর্গের স্ক্রিন এবং কী বোর্ড। অনুরূপ স্ক্রিন তৃতীয় মেজর এবং কর্নেলের সামনেও এসে সেট হয়েছে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে তালিয়া ব্রীজের সামনে ও পেছনের দুই নিখুঁত লাইভ দৃশ্য

কর্নেল স্ক্রিনের দৃশ্যে চোখ রেখে নির্দেশ দিল, ‘মেজর কমান্ডার, টোটাল অ্যাকশন।

নির্দেশের সাথে সাথে পেছনে বসা তৃতীয় মেজরের ডান হাত অ্যাটেনশন অবস্থায় কাঁধ পর্যন্ত উপরে উঠল এবং মুখে ধ্বনিত হলো: ‘ফায়ার অ্যান্ড ব্লক এন্ট্রি ইন টু ব্রীজ ফ্রম ফ্রন্ট অ্যান্ড রিয়ার, মেজর ওয়ান অ্যান্ড মেজর টু।’

নির্দেশের সাথে সাথে দুই মেজরের, ওয়ান অ্যান্ড টু, দুই হাতের দুই তর্জনি ফায়ার পয়েন্ট অ্যাডজাস্ট করে নিয়ে দুটি লাল বোতামের উপর চেপে বসল মুহূর্তেই। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির ছাদে সেট করা দুই ফায়ার টিউবের চার মুখের দুই অ্যাডজাস্ট হওয়া মুখ থেকে বিশ সেকেন্ড ধরে কয়েক শত গুলির ঝাঁক গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল একদম অরক্ষিত মুখোশধারী সন্ত্রাসীদের উপর।

ব্রীজের দুপাশে সন্ত্রাসীরা যারা উবু হয়ে বা দাঁড়িয়ে যে যে অবস্থায় গুলি করতে করতে ছুটছিল পুলিশের গাড়ির দিকে, তারা সেখানেই মুখ থুবড়ে পড়ল। শুধু একজন ব্রীজের ওপাশের প্রান্ত থেকে আহত হয়েও ছুটে পালাচ্ছিল।

চারমুখো ব্যারেলে একটা মুখ নড়ে উঠে টার্গেট অ্যাডজাস্ট করেই গুলি ছুঁড়ল এক পশলা।

পলায়নপর লোকটি সড়কের ধার বরাবর চলে গিয়েছিল। সে গুলি খেয়ে পড়ে গেল নিচে।

সেনাবাহিনীর দুইটি গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নেমে আসতে লাগল ব্রীজের দিকে।

পুলিশের অফিসার ও সেপাইরা গাড়ি থেকে নেমে অস্ত্র বাগিয়ে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল ব্রীজের দুই প্রান্তের দিকে। তারা সেনাবাহিনীর দুই গাড়ি দেখতে পেয়েছে। তারাই যে পুলিশের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে তাও বুঝতে পেরেছে সবাই।

পুলিশরা এগিয়ে গিয়ে দেখল, সেনাবাহিনীর ভারি মেশিনগানের ‘গুলি সন্ত্রাসীদের কাউকেই বাঁচতে দেয়নি। তারা পালাবারও সুযোগ পায়নি।

পুলিশ সন্ত্রাসীদের মুখোশ খুলে ফেলল। তাদের কালো ইউনিফরমও পরীক্ষা করল।

সেনাবাহিনীর গাড়ি দুটি প্রায় ব্রীজের কাছে এসে গেছে।

পুলিশ অফিসার সিমসন ও গুস্তাভ কয়েক পা এগিয়ে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়াল।

সুবর্ণ দ্বীপ অর্থাৎ ভিক্টর আইল্যান্ডের নতুন বিধান অনুসারে পুলিশ সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রিত অধঃস্তন একটা বাহিনী। এ বাহিনীর কাজ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা দেখা।

সেনাবাহিনীর আর্মড কার পুলিশ অফিসার দুজনের পাশে এসে দাঁড়াল।

পুলিশ অফিসার সিমসন অ্যাটেনশন অবস্থা থেকে দুধাপ এগিয়ে আর্মড কারের সামনের দরজা খুলে দিয়ে দুধাপ পিছনে হটে অ্যাটেনশন লাইনে এসে গুস্তাভের পাশে এসে দাঁড়াল।

গাড়ি থেকে নামল কর্নেল। তার বুকের নেমপ্লেটের সবুজ পটভূমির উপর লাল অক্ষরে লেখা কর্নেল আড্রিয়ান।

গাড়ি থেকে নেমে কর্নেল তাদের মুখোমুখি হতেই পুলিশ অফিসার সিমসন এবং গুস্তাভ পা ঠুকে স্যালুট জানাল কর্নেলকে।

স্যালুট নিয়ে কর্নেল বলল, ‘স্ট্যান্ড ইজি মি. সিমসন এবং মি. গুস্তাভ।

পুলিশ অফিসার দুজনের বুকের নেমপ্লেটে তাদের নাম লিখা ছিল।

‘ধন্যবাদ স্যার।’ সহজভাবে দাঁড়িয়ে বলল পুলিশ অফিসার সিমসন।

‘সন্ত্রাসীরা কারা?’ কি উদ্দেশ্য ছিল ওদের? কি ভাবছেন ‘আপনারা?’ বলল কর্নেল আড্রিয়ান।

‘স্যার কর্নেল ওসামাকে আমরা নিয়ে যাচ্ছি রাজধানীতে। তাকে ছিনিয়ে নেবার জন্যেই ছিল ওদের এই অভিযান। যারা মারা পড়েছে তাদের সবার পোশাকে সাগর সাইমুমের ইনসিগানিয়া এবং সবাই আদিবাসী ও আরব বংশোদ্ভুত।’ পুলিশ অফিসার সিমসন বলল।

‘ও গড! কর্নেল ওসামাকে ছিনিয়ে নেয়ার অভিযান ছিল এটা! কর্নেল ওসামা কি মাঝের গাড়িতে? সে নিরাপদ আছে?’ বলল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে কর্নেল আড্রিয়ান।

‘জি স্যার, উনি মাঝের গাড়িতে। ভালো আছেন। শুরু থেকেই উনি খুব শান্ত আছেন।’ পুলিশ অফিসার সিমসন বলল।

‘উনার কথা মনে পড়লে আমার খুব কষ্ট হয়। এ বয়সী চৌকশ ব্রিলিয়ান্ট অফিসার আমাদের সেনাবাহিনী এর আগে পায়নি। এত অল্প বয়সে এত প্রফেশনাল অ্যাওয়ার্ড জেতার রেকর্ডও আমাদের সেনাবাহি- নীতে নেই। বলল কর্নেল আড্রিয়ান।

‘স্যার চলুন, ওর সাথে কথা বলবেন।’ পুলিশ অফিসার সিমসন বলল।

‘না থাক। মনটা আর বেশি খারাপ করতে চাই না। শৃঙ্খলিত বন্দীর বেশে তাকে দেখার কথা আমরা কেউ ভাবিনি। ঈশ্বর তার ভালো করুন, তিনি তাকে সুবুদ্ধি দান করুন।’ বলল কর্নেল আড্রিয়ান।

উপরের অনুমতি নিয়ে একজন পুলিশ অফিসার বন্দী কর্নেল ওসামার পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে কর্নেল ওসামাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘সাগর সাইমুমের যে লোকরা তাকে ছিনিয়ে নিতে এসেছিল তারা সবাই মারা পড়েছে।’

শুনে কর্নেল ওসামা বললেন, ‘এটা ঠিক নয়। সাগর সাইমুমের লোকরা এভাবে এ ধরনের অভিযান পরিচালনা করে না।’

‘তা উনি বলতেই পারেন। সাগর সাইমুমকে উনি একটা রেম থেকে অবশ্যই বাঁচাতে চাইবেন। কিন্তু মানুষগুলো আদিবাসী ও আরব বংশোদ্ভূত হওয়া এবং সাইমুমের ইউনিফরম পরিহিত- এই দুই সত্যকে উনি ঢাকবেন কী করে?’ বলল পুলিশ অফিসার সিমসন।

আগের সেই পুলিশ অফিসার বলল, ‘স্যার ইউনিফরমের ব্যাপারে আমি তাকে বলেছিলাম। তিনি জবাবে বলেন যে, সাগর সাইমুমের কোনো ইউনিফরম নেই। সাগর সাইমুম জনগণের অংশ। অতএব জনগণের পোশাকই তাদের পোশাক।’

ভাবছিল কর্নেল আড্রিয়ান। বলল, ‘হ্যাঁ, সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সন্ত্রাসীরা আদিবাসী ও আরব বংশোদ্ভুত। কিন্তু তবু আমি মনে করি, তিনি আমাদেরকে ভাবনার একটা খোরাক দিয়েছেন।’

‘তা ঠিক স্যার।’

বলেই পুলিশ অফিসার তাকাল সেই পুলিশ অফিসারের দিকে। বলল, ‘সন্ত্রাসীরা কতজন, গোণা হয়েছে?’

‘হয়েছে স্যার। ওরা উনপঞ্চাশ জন।’ বলল পুলিশ অফিসারটি।

‘আহত একজন ছুটে পালাচ্ছিল। তাকে গুলি করা হয়। গুলি খেয়ে সে রাস্তার দক্ষিণ পাশে গড়িয়ে নিচে পড়ে গেছে। তাকে কি গোণা হয়েছে?’

পুলিশ অফিসার সিমসন তাকাল সেই পুলিশ অফিসারটির দিকে।

পুলিশ অফিসারটি বলল, ‘রাস্তার পাশে গড়িয়ে পড়া এমন কোনো লাশ আমরা তুলিনি। আমরা বিষয়টা জানতাম না। নিশ্চয় সে গণনার মধ্যে নেই।’

‘আমি দেখছি স্যার।’ বলেই সে ছুটল রাস্তার পুলিশদের কাছে। তারপর কয়েকজন পুলিশকে নিয়ে ছুটল সে রাস্তার দক্ষিণ পাশে।

মাত্র পাঁচ মিনিট।

একটা লাশকে ধরাধরি করে কয়েকজন পুলিশ উঠে এলো রাস্তার দক্ষিণ পাশ থেকে। অন্য লাশদের সারিতে নিয়ে গিয়ে লাশটিকে রাখল।

অন্যান্য লাশের চেয়ে এ লাশটিকে কিছুটা লম্বা এবং মোটা তাজা দেখা যাচ্ছে।

‘এই-ই বোধ হয় দলের সরদার। বলে পুলিশদের সাথে থাকা সেই পুলিশ অফিসার, মি. হেড্ডা, এগিয়ে এসে টান দিয়ে লাশটির মুখোশ খুলে ফেলল। মুখ ও মাথা লাশটির উন্মুক্ত হয়ে গেল। তার মুখোশ মুখ ও মাথা দুটোকেই কভার করেছিল।

লাশটির মুখের উপর নজর পড়তেই চমকে উঠল পুলিশ অফিসার হেড্ডা। একদম নিরেট শেতাংগ, স্কিনহেডেড লাশটি। অন্য উনপঞ্চাশটি লাশের সাথে এর মিল নেই।

পুলিশ অফিসার হেড্ডা দ্রুত নজর ফেরাল ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসার ও সেনা কর্মকর্তাদের দিকে। কণ্ঠ একটু উঁচু করেই বলল পুলিশ অফিসার সিমসনকে উদ্দেশ্য করে, ‘স্যার, যে লাশটি নিচ থেকে তুলে আনলাম সে শ্বেতাংগ এবং স্কিনহেডেড।’

পুলিশ অফিসার হেড্ডার কথা শুনেই কর্নেল আড্রিয়ান এবং পুলিশ অফিসার সিমসনরা ছুটে এলো লাশটির কাছে।

পুলিশ অফিসার সিমসনের নজর লাশের চেহারার উপর পড়তেই বলে উঠল, ‘ও গড! ভয়ংকর ব্যাপার।’

কর্নেল আড্রিয়ান লাশের দিক থেকে নজর সরিয়ে সিমসনের দিকে চেয়ে বলল, ‘কি ব্যাপার মি. সিমসন? আপনি কি এই স্কিনহেডেড শ্বেতাংগকে চেনেন? আদিবাসী ও আরবদের সাথে এ কেন?’

পুলিশ অফিসার সিমসনের চোখে-মুখে তখনও অপার বিস্ময়। বলল, ‘স্যার, সোর্ন (SWORN. Super White Organisation of Royal Nation)-এর ভিক্টর আইল্যান্ড শাখার উনি সেকেন্ড ইন কমান্ড। নাম হের রুডিগার। সপ্তাহখানেক আগে তিনি ইউক্রেন থেকে জার্মানি হয়ে এখানে এসেছেন।

‘এটা কিভাবে সম্ভব মি. সিমসন! সাগর সাইমুম তো সোর্ন-এর নাম্বার ওয়ান এনিমি! তাহলে সোর্ন-এর ভিক্টর আইল্যান্ডের সেকেন্ড ইন কমান্ড হের রুডিগারের পরনে সাগর সাইমুমের ইউনিফর্ম কেন?’ বলল কর্নেল আড্রিয়ান।

‘জানি না স্যার, এ অবাক করা ব্যাপার নিয়ে আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং সরকার কি ভাববেন। তবে আমার যা মনে হচ্ছে তা বলতে পারি। বিষয়টা হচ্ছে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার ব্যাপার। স্যার সোর্ন-এর হের রুডিগারই কর্নেল ওসামাকে পুলিশ হাসপাতাল থেকে কিডন্যাপ করে আল-কবির উপত্যকায় সোর্ন-এর ঘাঁটিতে নিয়ে আসে। তাদের টার্গেট ছিল কর্নেল ওসামার কাছ থেকে কিছু কথা আদায় করার পরে তাকে হত্যা করা। পুলিশ এটা জানতে পেরে দ্রুত আল-কবিরে এসে কর্নেল ওসামার দায়িত্ব নিয়ে নেয়। সরকারের পরবর্তী নির্দেশে তাকে রাজধানীতে পুলিশের জুডিশিয়াল ব্রাঞ্চের কাস্টডিতে পৌঁছে দেয়ার সিদ্ধান্ত আসে। এই সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিল হের রুডিগার। এ অবস্থা সোর্ন-এর অনুগত বা কেনা অথবা কোনভাবে বাধ্য করা কিছু আদিবাসী ও আরব বংশোদ্ভূতদের গায়ে সাগর সাইমুমের ইউনিফর্ম পরিয়ে এখানে নিয়ে এসেছিল কর্নেল ওসামাকে ছিনিয়ে নিয়ে ক্রসফায়ারের নামে তাকে হত্যা করা এবং এর দায় সাগর সাইমুমের কাঁধে চাপানো। এতে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলাও হলো এবং নিজেদের উপর দায় না নিয়ে হত্যাও করা হলো কর্নেল ওসামাকে।’ বলল পুলিশ অফিসার সিমসন

‘ধন্যবাদ মি. সিমসন। ঘটনা এটাই। কিন্তু ঈশ্বর ওদের সাজানো ছক একেবারে উল্টে দিয়েছেন। কর্নেল আড্রিয়ান বলল।

‘শুধু ষড়যন্ত্রের ছক উল্টে দেয়া নয়। সোর্ন-এর ষড়যন্ত্র ঈশ্বর একেবারে নগ্ন করে দিয়েছেন। আমি মনে করি এতে বিরাট উপকার হলো ভিক্টর আইল্যান্ড সরকারের।’ বলল পুলিশ অফিসার সিমসন।

ভাবছিল কর্নেল আড্রিয়ান। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘আমি বিষয়টার মধ্যে আমাদের জন্য বিরাট সমস্যা দেখছি। সোর্ন যদি ভিক্টর আইল্যান্ড ভিত্তিক হতো এবং আমাদের সীমানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতো তাহলে বলার কিছু ছিল না। কিন্তু সোর্ন বিশ্বের নাজীবাদী (শেতাঙ্গ বিশ্ব রাষ্ট্র গঠনের অভিলাষী) সংগঠনগুলোর একটা সিন্ডিকেট। এরা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে কাজ করে। যেমন ইউক্রেনে এরা ‘আজভ ব্যাটেলিয়ান’ নাম নিয়ে কাজ করেছে। আমাদের আইল্যান্ডে এরা যেমন আমাদের সাহায্য করা ও নিরাপত্তা দেয়ার নাম করে ঢুকেছে তেমনিভাবে এরা ইউক্রেনেও ঢুকেছিল। কিন্তু শীঘ্রই এরা কৌশলে জনমতকে ব্যবহার করে ইউক্রেনে নিজেদের সরকার গঠন করে নিয়েছিল। তারা ইসরাইল ও পশ্চিম থেকে অঢেল সাহায্য পেয়েছিল। কিন্তু রাশিয়াকে তারা ম্যানেজ করতে পারেনি। তাই ইউক্রেন থেকে তাদের সরতে হয়েছে। আমাদের ভিক্টর আইল্যান্ডে সোর্ন-এর যারা এসেছে, তাদের অধিকাংশই ইউক্রেন থেকে পালিয়ে আসা। একটু থামল কর্নেল আড্রিয়ান।

এই সুযোগে পুলিশ অফিসার সিমসন বলে উঠল, ‘মারাত্মক ব্যাপার! ইউক্রেনের পুনরাবৃত্তি তারা ঘটাবে বলে আশঙ্কা করেন? আপনি বললেন, পশ্চিমের বিভিন্ন দেশে তারা বিভিন্ন নামে কাজ করে। সেসব দেশেও কি এমনটা ঘটেছে?’

ইউক্রেনের পুনরাবৃত্তি তারা আমাদের ভিক্টর আইল্যান্ডে ঘটাবে কথাটা এভাবে বলা যাবে না। তবে একটা আশঙ্কার ব্যাপার তো আছেই। ইউরোপ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে তারা কাজ করছে। কোথাও ‘দ্য বেইস’ নামে, কোথাও ‘প্যাট্রিয়েট মুভমেন্ট’ নামে, কোথাও মিলিশিয়া মুভমেন্ট, অ্যারিয়ান রিপাবলিকান, অলট রাইট, আইডেন্টিটারিয়ান নামে। কিন্তু সবার লক্ষ্য এক। কিন্তু সব দেশে তারা ক্ষমতা দখল করেছে, এটা নয়। ইউরোপ, আমেরিকার গণতান্ত্রিক দেশে প্রকাশ্যে তাদের পক্ষে এটা সম্ভবও নয়। তবে কিছু দেশে ক্ষমতার শেয়ার পেতে শুরু করেছে। আমাদের দেশের পরিস্থিতি ইউরোপ আমেরিকা থেকে ভিন্ন। আমাদের দেশে সরকার ও জনতার মধ্যে বিভেদের যে দেয়াল, তা সেখানে নেই। এই সুযোগের সুবিধা যে কেউ নিতে পারে। আজকের ঘটনা তার খুব ছোট একটা প্রতিচ্ছবি।’

পুলিশ অফিসার সিমসনের মুখটা ম্লান হয়ে গেছে। কর্নেল আড্রিয়ানের কথা শেষ হতেই পুলিশ অফিসার সিমসন দ্রুত বলে উঠল, ‘আমাদের পুলিশ হেডকোয়ার্টারে এখানকার এই ঘটনা দ্রুত জানাতে চাই।’

‘হ্যাঁ মি. সিমসন এখনি জানিয়ে দেন। আমিও জানাচ্ছি আমাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে।’ বলল কর্নেল আড্রিয়ান।

‘ইয়েস স্যার।’

বলে পুলিশ অফিসার সিমসন তার বেল্টের খাপ থেকে অয়্যারলেস বের করে নিয়ে কয়েক ধাপ সরে গেল।

কর্নেল আড্রিয়ানও তার ওয়ারলেস নিয়ে তার গাড়ির দিকে এগোলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *