৩
আহমদ মুসা যেদিন কোমরো ও মাদাগাস্কার দ্বীপ হয়ে ‘সুবর্ণ দ্বীপে’ পৌঁছার জন্য জাঞ্জিবার থেকে বের হলো, তার আগের কথা। ঠিক কথা নয়, একটা ঘটনা। ঘটনার স্থান জান্নাতুল আরদ।
সুবর্ণ দ্বীপের পুব পাশে প্রায় লাগোয়া একটা দ্বীপ ‘জান্নাতুল আরদ’। একটা ওভার ব্রীজের দ্বারা সংযুক্ত জান্নাতুল আরদ মূল দ্বীপের সাথে।
সুবর্ণ দ্বীপের চারদিকের সাগর শান্ত কয়েকশ’ বছর ধরে।
কিন্তু জান্নাতুল আরদ-এর সাগর আরও সুশান্ত।
নীল সাগরের বুকে জান্নাতুল আরদ একটা সবুজ ডট-এর মতো। জান্নাতুল আরদ-এর চারদিক ঘিরে সুন্দর সমতল বালুকাময় বীচ। বীচের সমান্তরালে ছোট দ্বীপটির চারদিক ঘিরে অনুচ্চ সবুজ পাহাড়ের সুন্দর বৃত্ত। আর বৃত্ত জুড়ে রঙ-বেরঙয়ের বাড়ি-ঘরের অপরূপ মেলা। বৃত্তের মাঝখানে উপত্যকা-অধিত্যকা জুড়ে ফল-শস্যের সম্ভার, যেন গোটা দ্বীপটাই একটা বাগান। দ্বীপে আছে মিঠা পানির হ্রদ, দিঘি এবং জলাশয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো দ্বীপটির চারদিকের বীচে একটু খুড়লেই মিঠা পানি পাওয়া যায়। গোটা দ্বীপটাই যেন একটা স্বাস্থ্য নিবাস, ভ্রমণ-পিয়াসীদের জন্যে হতে পারে এক ভূ-স্বর্গ। সুবর্ণ দ্বীপ যিনি আবাদ করেছিলেন, দ্বীপে যিনি সভ্যতা-মানবতার আলো জ্বেলেছিলেন, দ্বীপে শান্তির সমাজ গড়েছিলেন যিনি, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কল্যাণ-রাষ্ট্র, সেই দরবেশ আবদুল্লাহ আলী বিন আব্দুর রহমান সুন্দর এই বীচ, সবুজ পাহাড়ের বৃত্ত এবং ফল ও শস্যভারে শোভিত ক্ষুদ্র দ্বীপটির নাম দিয়েছিলেন ‘জান্নাতুল আরদ-দুনিয়ার জান্নাত’। দুনিয়ার সেই জান্নাতকে অপরাধ এবং অপরাধীরা আজ জাহান্নামে পরিণত করেছে। আগের বাসিন্দাদের মেরে কেটে, উচ্ছেদ করে সেখানে বসানো হয়েছে বাইরে থেকে আসা শ্বেতাংগদের। সেই জান্নাতুল আরদে চলছে এখন জঘন্য ধরনের টুরিস্ট ব্যবসায়। উপকূলীয় সবুজ বৃত্তের মনোরম বাড়িগুলো হয়েছে পর্যটক নিবাস। দুনিয়ার অপরাধীদের বড় আড্ডাখানা এখন এটা। তারা দলে দলে এখানে আসে, যায়। মাঝে মাঝে দ্বীপে দস্যুতার মতো বড় বড় ঘটনাও ঘটে।
এই জান্নাতুল আরদ দ্বীপ থেকে ২০ মাইল পশ্চিমে মূল আইল্যান্ড- সুবর্ণ দ্বীপের একটি কমার্শিয়াল বন্দর বাবেল মানদেব থেকে দুই সিটের একটা কমার্শিয়াল বোট ছুটে চলছে। বোটটির মাথা জান্নাতুল আরদ দ্বীপটির দিকে।
বোটটিতে একজন আরোহী এবং চালক একজন।
আরোহীটির আরবীয় চেহারা। ব্যায়ামপুষ্ট, ঋজু শরীর। আর্মিকাট চুল। পরনে ডিপ অ্যাশ কালারের জ্যাকেট ও টাউজার। মাথায় অ্যাশ কালারেরই আর্মি ক্যাপ।
বোটের আরোহীটি দ্বীপের উপকূলের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে উত্তর-পশ্চিমমুখী হয়ে নামাজে দাঁড়াল।
বোটের চালক তাকাল নামাজরত আরোহীর দিকে। তার চোখে মুখে বিস্ময় ও আনন্দ। মনে মনে বলল, ‘আমার চেনা তাহলে ঠিক, আলহামদুলিল্লাহ। সেনাবাহিনী ছেড়ে দিলে খবরসহ একটি ছবি বেরিয়েছিল স্থানীয় একটি সাপ্তাহিক কাগজে। কাগজের সেই ছবির সাথে এর হুবহু মিল আছে। সে খবরে তার পরিচয়ের কথাও লিখা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, এই পরিচয়ের কারণেই তাকে সেনাবাহিনী ছাড়তে বাধ্য হতে হয়েছে।
নামাজ শেষ হলো আরোহীটির। নামাজ শেষ হলে চেয়ারে এসে বসল সে।
বোটের চালক তাকে সালাম দিল প্রসন্নমুখে।
‘ওয়ালাইকুম সালাম’ বলে সালাম নিয়ে সে বোট চালককে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনি মুসলমান?’
বোট চালক সুবর্ণ দ্বীপের আদিবাসী চেহারার লোক।
গায়ের রং আরবীয়দের মতো মনে হলেও চেহারায় আদিবাসী ভাবই মুখ্য।
‘জি, আমি মুসলমান।’ বলল বোট চালক।
নাম তো বলেছ ইবেকা।’ আরোহীটি বলল।
‘জি বলেছি। কিন্তু আমার নাম আব্দুল্লাহ ইবেকা।’ বলল বোট চালক।
‘আব্দুল্লাহ অংশটা গোপন করেছ কেন?’ জিজ্ঞাসা আরোহীর। ‘স্যার, চারদিকের যে অবস্থা। জীবিকা ও বেঁচে থাকার স্বার্থেই নামের এই অংশটা আমি গোপন রেখে চলি।’
‘আমাকে ‘স্যার’ বলছ কেন? আরোহী সবাইকে তো ‘স্যার’ বল না?’ বলল আরোহী।
‘স্যার, আপনারা আমাদের মাথার মণি। আপনাদের নয়তো কাদের স্যার বলব? দস্যুদের?’ বোট চালক বলল। তার কথায় কিছুটা আবেগের পরশ।
বিস্ময় ফুটে উঠল বোট আরোহীর চোখে-মুখে। বলল, ‘আমি কে, যে এই কথা বলছ? চিন আমাকে?’
‘চিনতে পেরেছি স্যার আপনাকে। আপনি আমাদের দরবেশ হুজুরের বংশধর। আপনি সেনাবাহিনীর একজন কর্নেল ছিলেন। সেনাবাহিনী থেকে আপনি রিটায়ারমেন্ট নিয়েছেন।’ বলল বোট চালক।
‘আমার সম্পর্কে এত কথা জান কি করে?’ জিজ্ঞাসা আরোহীটির।
‘আরবি ‘সাপ্তাহিক সুবর্ণ’তে আপনার ছবি দেখেছি। সেনাবাহিনী থেকে আপনার পদত্যাগ, আপনার পরিচয় সবই সাপ্তাহিক সুবর্ণতে আমি পড়েছি। আপনার আসল নাম লেখা ছিল, কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।’ বলল বোট চালক।
আরোহীটি মানে কর্নেল ওবায়দুল্লাহর চোখে মুখে আবার বিস্ময় নেমে এলো। ভাবল, ‘আরবি সাপ্তাহিক সুবর্ণ’ একটা গোপন পত্রিকা। ছাপা ও বিলি গোপনে হয় এবং যারা পড়ে গোপনেই পড়ে। সাগর সাইমুমের মুখপত্র এটা। কিন্তু বোট চালক আব্দুল্লাহ ইবেকা সাপ্তাহিক সুবর্ণের কথা জানল কি করে? সাগর সাইমুমের সাথে কি তার সম্পর্ক আছে! বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ, ‘আব্দুল্লাহ ইবেকা, সাপ্তাহিক সুবর্ণ তোমরা নিয়মিত পড়? পাও কোথায়?’
আব্দুল্লাহ ইবেকা একটুক্ষণ নীরব থাকল। তাকাল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আমাদের ওখানে নিয়মিত আসে। সেখান থেকে আমরা পড়ি।
‘সাগর সাইমুম সম্বন্ধে তোমরা জান?’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।
‘জি স্যার, জানি।’ আব্দুল্লাহ ইবেকা বলল।
‘কিভাবে জান? তোমাদের কেউ সাগর সাইমুমের সাথে আছে?’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।
‘স্যার, আমাদের নেতা, মানে সাগর সাইমুমের নেতা ডাবল জিরোকে আপনি চেনেন, দেখেছেন স্যার?’ আব্দুল্লাহ ইবেকা বলল।
এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর ঠোঁটে।
ডবল জিরো (OO=Osama Obaidullah) মানে ওসামা ওবায়দুল্লাহ। এই কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ আব্দুল্লাহ বিন যুবায়েরের নাতি এবং আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের জলদস্যুরা সুবর্ণ দ্বীপ দখলকালে বেঁচে যাওয়া নৌকমান্ডার ও দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী ইবনে আব্দুর রহমানের বংশধর যুবায়ের বিন আব্দুর রহমানের প্রপৌত্র।
‘হ্যাঁ, আব্দুল্লাহ ইবেকা। তুমিও কি তাকে জানতে চাও, দেখতে চাও?’ আব্দুল্লাহর ইবেকার প্রশ্নের উত্তরে বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।
‘না স্যার, উনি গোপনে আছেন, গোপনেই থাকুন। জলদস্যুদের সরকার মানুষের সরকার নয়। কিছু করতে হলে গোপনে থেকে সাবধানেই করতে হবে। আল্লাহ তাঁকে সাহায্য করুন। চালক আব্দুল্লাহ ইবেকা বলল।
‘আব্দুল্লাহ ইবেকা অপূরণীয় ক্ষতি তোমাদের হয়েছে। অনেক কষ্ট তোমরা করেছ, অনেক কষ্ট তোমরা এখনও করছ। আমাদের কারণেই তোমাদের কষ্ট আরও বেশি হয়েছে।’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।
‘আমরা আর কি কষ্ট করেছি। আপনাদের জন্যে কি আর হয়েছে আমাদের! তার চেয়ে হাজার গুণ লক্ষ গুণ বেশি পেয়েছি আমরা আপনাদের কাছে। আমরা সুবর্ণ দ্বীপের আদিবাসীরা নতুন জীবন পেয়েছি আপনাদের কাছে। আল্লাহর প্রিয় বান্দাহ মহান দরবেশ আব্দুল আলী বিন আব্দুর রহমান আমাদেরকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। আমাদের ধর্ম ছিল না, আমাদের সমাজ ছিল না, লেখাপড়া ছিল না, উন্নত জীবন ও সভ্যতার সাথে আমাদের কোনো পরিচয় ছিল না। আল্লাহর মহান দরবেশের কাছে আমরা সব পেয়েছি। আমরা কিন্তু তাঁকে কিছুই দেইনি, সব সময় সব কাজে তাঁর সাথে থাকা ছাড়া।’ থামল আব্দুল্লাহ ইবেকা।
‘দীর্ঘ আটশ’ বছর পরেও তোমরা দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী বিন আবদুর রহমানকে এত ভালোবাসো?’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।
‘ভালোবাসবো না স্যার! তিনি এবং তার উত্তরসূরীরা সবাই আমাদের ভালোবেসেছেন। আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়ার মতো সভ্য দেশ তাদের আদিবাসীদের ধ্বংস করেছে। আদিবাসীদের যারা অবশিষ্ট আছে, তাদেরকেও সংরক্ষণের নামে জনগণের মূল স্রোতে মিশতে না দিয়ে ধীরে ধীরে শেষ করে দিচ্ছে। অথচ মহান দরবেশ এবং তার সাথীরা আদিবাসীদেরকে তাদের সমকক্ষ মানুষ হিসেবে বুকে টেনে নেন। ভেদাভেদের দেয়াল ভেঙে দিয়ে সবাইকে নিয়ে এক সমাজ গঠন করেন। রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রেও আদিবাসীদেরকে মহান দরবেশ আরবদের সমান দায়িত্ব ও মর্যাদা দান করেন। আদিবাসীরা এখনও গর্বের সাথে স্মরণ করে যে মহান দরবেশের দুই ছেলে আদিবাসী মেয়েকে বিয়ে করেন। পরবর্তীতে অন্য আরবরাও দরবেশের এই দৃষ্টান্ত অনুসরণ করেন। ধীরে ধীরে আরব ও আদিবাসীদের মধ্যে বিয়ে একটা সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। এইভাবে এই সুবর্ণ দ্বীপে আরব-রক্ত ও আদিবাসীদের রক্ত এক সাথে মিশে এক হয়ে গেছে। এমন অনন্য দৃষ্টান্ত পৃথিবীর অভিবাসী-ইতিহাসের কোথাও নেই। এমন মানুষকে, এমন মানুষদের কি কেউ ভুলতে পারে!’ বলল আব্দুল্লাহ ইবেকা। তার কণ্ঠ আবেগে ভারি। চোখের কোনায় তার অশ্রু জমে উঠেছে।
কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ বলল, ‘ধন্যবাদ আব্দুল্লাহ ইবেকা। মহানকে যারা মহান বলতে পারে, তারাও মহান আব্দুল্লাহ ইবেকা। আমাদের সুবর্ণ দ্বীপের আদিবাসীরাও মহৎ ও মহান মানুষ।’
একটু থেমেই কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ বলল, ‘আব্দুল্লাহ ইবেকা, তোমরা নীতি আদর্শ এবং দেশপ্রেমের উপর এবং জাতির প্রতি ভালোবাসার প্রতি অটল থাকতে গিয়ে অনেক ত্যাগ ও কষ্ট স্বীকার করেছ এবং এখনও করছ এটা আমাকে খুব পীড়া দেয়।’
‘কিন্তু স্যার, বলল আব্দুল্লাহ ইবেকা, এই দস্যু সরকারের হাতে মহান দরবেশের উত্তরসূরী আপনাদেরকে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে দিয়ে আসতে হচ্ছে। আমি আমাদের প্রধানদের কাছে শুনেছি, আপনাদের পরিবারের এক আপনার দাদা আব্দুল্লাহ বিন যুবায়ের ছাড়া আর কেউ বেঁচে ছিলেন না। কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হয়নি। আমরা সকলে সব সময় প্রার্থনা করি, আল্লাহ আপনাদের মহান পরিবারের প্রতি সদয় হোন। আপনাদের নেতৃত্বে আমাদের সকলের মুক্তির প্রচেষ্টা সফল হোক। সুবর্ণ দ্বীপে আবার সোনালি দিন ফিরে আসুক।’ বলল আব্দুল্লাহ ইবেকা।
কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ কিছুটা আনমনা হয়ে পড়েছিল। তার মনে পড়েছিল তার দাদার শিশু জীবন এবং বাল্য-কৈশোরের কথা। সে মানুষ হয়েছিল ড্যান অ্যাডোফো নামের আফ্রো-এশীয় এশিয়ান চেহারার একজন খ্রিস্টান ভালো মানুষের সন্তান হিসাবে। তিনি একজন বড় ফল ব্যবসায়ী এবং দেশের সর্ববৃহৎ ফ্রুট প্রসেসিং কারখানার মালিক ছিলেন। তার বিশাল বাড়িতে সীমাহীন আদরের মধ্যে ননীর পুতুলের মতো তার দাদা মানুষ হয়েছেন। দেশের সর্বোৎকৃষ্ট স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করেছেন তিনি। পিতা ড্যান অ্যাডোফো’র তাকিদেই তিনি সেনাবাহিনীতে ভর্তি হন। যেদিন সেনাবাহিনীর অফিসার পদে কমিশন পেয়ে তিনি বাড়ি এলেন সেদিন পিতা ড্যান অ্যাডোফো তাঁকে নিয়ে তার শোবার ঘরে গেলেন। দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাকে নিয়ে বসলেন। একটা চেয়ারে দাদাকে তিনি বসালেন এবং নিজে বসলেন চেয়ারের নিচে মেঝের কার্পেটের উপর। দাদা আপত্তি করলে তিনি বললেন, আমার স্থান এখানে। একটু থেমেই আবার তিনি বলতে শুরু করলেন, আজ তেইশ বছর যে হৃদয়বিদারক কাহিনী আমি আমার বুকে পুষে রেখেছি, সেটা আজ তোমাকে আমার বলতে হবে। আমি তোমার বাবা নই। আজ থেকে ২৪ বছর আগে তোমার দাদা আব্দুর রহমান বিন আব্দুল্লাহ আলী ছিলেন এই সুবর্ণ দ্বীপের প্রেসিডেন্ট এবং তোমার বাবা যুবায়ের বিন আব্দুর রহমান ছিলেন সুবর্ণ দ্বীপ সেনাবাহিনীর একজন শীর্ষ কমান্ডার। আর এই বাড়ি, এই ব্যবসায় সবকিছুর মালিক ছিলেন তোমার বাবার সিকিউরিটি প্রধান আহমদ শরীফ। আমি ছিলাম তার কর্মচারী। এই দস্যু সরকার দ্বীপ দখলের সময় তোমাদের পরিবারের সবাইকে হত্যা করা হলে গুলিবিদ্ধ মুমূর্ষু আহমদ শরীফ কোনো রকমে তোমার শিশু বাবাকে বাঁচিয়ে এনে আমার কোলে তুলে দেন এবং বাড়ি- ঘর, ব্যবসায়-বাণিজ্য আমাকে দিয়ে বলেন, আমি যেন শিশুটিকে সম্মান ও আদর দিয়ে মানুষ করি। শিশুটি বড় হয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করলে তাকে তার পরিচয় যেন আমি দেই। সেই দায়িত্বই আজ আমি পালন করলাম। কাহিনীটি শুনে আমার দাদু প্রথমে বিস্ময়ে হতবাক হয়েছিলেন, তারপর তিনি অনেক কেঁদেছিলেন, তার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু ঝরেছিল অঝোর ধারায়। সে অশ্রু একশ’ বছরের পথ পাড়ি দিয়ে তাকে যেন স্পর্শ করছে।
আব্দুল্লাহ ইবেকা থামলে অতীতের স্মৃতির ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া মনের ভাব কেটে গেল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো কর্নেল ওসামার বুক থেকে। বলল, ‘হ্যাঁ, আব্দুল্লাহ ইবেকা এই দস্যু সরকার সুবর্ণ দ্বীপের লক্ষ লক্ষ মানুষ খুন করেছে। বিরান করছে হাজার হাজার বাড়ি, পরিবার। তারা চাচ্ছে, এদেশের মালিক জনগণকে নিশ্চিহ্ন করে দস্যুরাজকে এখানে চিরস্থায়ী করতে। আমরা ইনশাল্লাহ তাদের এ আশা পূরণ হতে দিব না।’
‘আলহামদুলিল্লাহ। মানুষ চেয়ে আছে সাগর সাইমুমের দিকে।’ বলল আব্দুল্লাহ ইবেকা।
কিছু বলতে গিয়েও কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ থেমে গেল। সামনের দিকে চোখ রেখে বলল, ‘আব্দুল্লাহ ইবেকা, বোটকে জান্নাতুল আরদ দ্বীপের উত্তর সীমান্ত ঘুরে পুব দিকে নিয়ে চলো।
‘আপনি কোথায় নামবেন স্যার?’ জিজ্ঞাসা আব্দুল্লাহ ইবেকার।
‘সুবর্ণ ট্যুর প্রাইভেট লিমিটেডের জেটিতে বোট ভিড়াবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সুবর্ণ ট্যুর প্রাইভেট লিমিটেড (এস.টি.প্রা.লি) সাগর সাইমুমের গোপন কম্যুনিকেশন সেন্টার। এস.টি. প্রা. লিমিটেড পাঁচটি কেন্দ্র থেকে সাগর সাইমুমের যোগাযোগ ও ইনফরমেশন নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে। ট্যুরিস্টদের বোট ভাড়া দেয়ার আড়ালে তারা এই দায়িত্ব পালন করে। পাঁচটি কেন্দ্রে তাদের ৫০টি বোট আছে। পঞ্চাশটি বোটের জন্যে একশ’ জন বোটম্যান। এরা সবাই সাগর সাইমুমের নিবেদিতপ্রাণ কর্মী। এদের কাজ হলো তথ্য যোগাড় এবং হেডকোয়ার্টারে প্রেরণ করা এবং আক্রমণ বা আত্মরক্ষার প্রয়োজনে মুহূর্তের নোটিশে সংঘবদ্ধ হওয়া। এস.টি.প্রা. লিমিটেড ৫টি কেন্দ্রের ৪টি সুবর্ণদ্বীপের চারদিকে এবং একটি জান্নাতুল আরদ দ্বীপের পূর্ব তীরে। এই কেন্দ্রটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেন্দ্রটি বাইরের সাথে যোগাযোগে ব্যবহার হওয়া ছাড়াও বাইরে থেকে সাগর সাইমুমের কারো সুবর্ণ দ্বীপের প্রবেশের প্রথম প্ল্যাটফরম হিসেবে ব্যবহার হয়। কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ, সাগর সাইমুমের প্রধান, নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে এই কেন্দ্ৰেই আসছে।
আব্দুল্লাহ ইবেকা তার বোট এই কেন্দ্রের জেটিতে নোঙর করল। যদিও আব্দুল্লাহ ইবেকা সাগর সাইমুমের কর্মী, তবু সাগর সাইমুমের এই গোপন কেন্দ্রের কথা সে জানে না।
সাগর সাইমুমের কাজ দায়িত্বের প্রকৃতি অনুসারে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত। একভাগ অন্যভাগের কথা জানে না, অন্য ভাগের কাউকে চিনেও না। সাগর সাইমুমের নেতৃত্বও ভার্টিক্যালি বিন্যস্ত। এক দায়িত্বশীল মাত্র তার উপরের দায়িত্বশীলকে ছাড়া আর কোনো দায়িত্বশীলকে চিনে না।
কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ বোট থেকে নামার আগে আব্দুল্লাহ ইবেকার হাতে আসার ভাড়ার সাথে যাওয়ার ভাড়াটাও গুঁজে দিয়ে বলল, ‘অপেক্ষার দরকার নেই। তুমি চলে যাও।’
আব্দুল্লাহ ইবেকা একবার টাকার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার কাছে আমি ভাড়া নিতে পারবো না, তার উপর আবার যাওয়ার ভাড়া! এ আমি নিতে পারব না স্যার।’ ভারী কণ্ঠ আব্দুল্লাহ ইবেকার। ‘আব্দুল্লাহ ইবেকা, আমি তোমার সাথে আসা-যাওয়ার চুক্তি করেছিলাম। চুক্তি অনুসারেই তোমাকে আমি টাকা দিয়েছি। অতএব…।’
কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর কথার মাঝখানেই আব্দুল্লাহ ইবেকা বলল, ‘স্যার, নিজের সাথে নিজের কোনো চুক্তি হয় না। আমাকে টাকা নিতে বলবেন না স্যার।’
‘দেখ, তুমি আমার ছোট ভাই। আমি বোট চালককে টাকা দেইনি। দিয়েছি আমার ছোট ভাইকে। বড় ভাই ছোট ভাইকে কিছু দিতে পারে কিনা?’
আব্দুল্লাহ ইবেকা কিছু বলল না। আবেগে ভারী তার চোখ মুখ। তার দু’চোখ থেকে নেমে এলো দু’ফোটা অশ্রু। বলল, ‘বড় ভাইয়ের দান আমি নিলাম স্যার। দোয়া করবেন।’
কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ উঠে দাঁড়াল। আব্দুল্লাহ ইবেকার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘আল্লাহ তোমাকে তাঁর রহম ও করমের মধ্যে রাখুন। আল্লাহর বান্দাহদের প্রতি দায়িত্ব পালনে আল্লাহ তোমাকে সব দিক দিয়ে যোগ্য করুন।’
বোট থেকে নেমে গেল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ। হাঁটতে লাগল অফিসের দিকে।
.
কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ এস.টি.প্রা. লিমিটেডের গাড়িতে জান্নাতুল আরদের সেন্ট্রাল ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের দিকে যাচ্ছে।
সন্ধ্যা নামার বেশি দেরি নেই।
রাস্তায় লোকজন কম। এ সময় লোকেরা ক্লাব-রেস্তোরায় বৈধ- অবৈধ খেলায় মত্ত থাকে টুরিস্টদের মতোই।
কর্নেল ওসামার গাড়ি যাচ্ছিল একটা পার্কের পাশ দিয়ে।
রাস্তার আরেক পাশে কয়েকটা ক্লাব-রেস্টুরেন্ট। রাতদিন চব্বিশ ঘণ্টা খোলা থাকে। এসব ক্লাবে নাচ, গান, জুয়া খেলা, খানাপিনা, বিশ্রাম সবই চলে। অতএব ক্লাবে আসে নানা ধরনের লোক। কেউ আসে নিছক খানাপিনার জন্যে, কেউ আসে নাচ-গানের জন্যে, একটা বড় অংশ জুয়া খেলার জন্যে আসে। স্বল্প সময় বিশ্রামের জন্য রুম বা সিট ভাড়া নেয়ার ব্যবস্থা আছে। অতএব ক্লাবগুলো সব সময় জমজমাট থাকে।
চলছিল কর্নেল ওসামার গাড়ি।
কিছু উচ্চকণ্ঠ এবং চিৎকার কান্না-কাটির আওয়াজ শুনল কর্নেল ওসামা আব্দুল্লাহ।
কর্নেল ওসামা সামনে তাকাল। দেখল স্বর্ণকেশী একজন তরুণীকে টেনেহেঁচড়ে মাইক্রোতে তোলা হচ্ছে। যারা তুলছে তারাও শ্বেতাংগ- স্কিনহেডেড।
‘স্কিনহেডেডদের দৌরাত্ম্য সুবর্ণ দ্বীপে ক্রমেই অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে’- ভাবল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ। পাশ্চাত্যের স্কিনহেডেডদের মতোই সুবর্ণদ্বীপের স্কিনহেডেডরা। একটিই পার্থক্য সেটা হলো, এরা বর্ণবাদী ও সন্ত্রাসী হবার সাথে সাথে এরা খুব বেশি স্বেচ্ছাচারী। কোনো আইন-কানুনের তোয়াক্কা করে না এরা। অনেক সময় দ্বীপের শ্বেতাংগ সরকারকেও তারা বিব্রত করে ফেলে। দ্বীপের শ্বেতাংগ সরকারের স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং শ্বেতাংগ দুনিয়ার স্বার্থে সরকার নিও- নাজীদের দৌরাত্ম্য মেনে নেয়।
ঘটনা দেখে কর্নেল ওসামার প্রথমেই মন যেটা বলল, তাহলো ওদের সেম সাইডের ব্যাপার, ওদিকে মনোযোগ না দেয়াই ভালো।
কিন্তু মেয়েটির বাঁচার জন্যে চিৎকার মনের চিন্তাটিকে কোথায় যেন ডুবিয়ে দিল। মেয়েটির মানুষ পরিচয় তার কাছে আকাশস্পর্শী হয়ে উঠল।
অ্যাটেনশন হয়ে বসল কর্নেল ওসামা।
গাড়ির গতি বাড়াতে যাচ্ছিল সে। কিন্তু দেখল সন্ত্রাসীদের গাড়িটা তার দিকেই আসছে। তার মানে সন্ত্রাসীরা সুবর্ণদ্বীপের দিকে যাবার জন্যে ওভারব্রীজের এক্সিট নিচ্ছে না।
ওরা জলপথ ব্যবহার করবে।
কর্নেল ওসামা ঠিক করল, সন্ত্রাসীদের ঠেকানোর জন্যে এই জায়গাটাই সবচেয়ে অনুকূল। কোনো আক্রমণ ঠেকাবার জন্যে সন্ত্রাসীরা মানসিকভাবে অনেকখানিই অপ্রস্তুত। আর কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওদের উপর চড়াও হতে হবে।
গাড়িটা ছুটে আসছে।
রাস্তার মাঝখান বরাবর গাড়ি দাঁড় করিয়ে ফেলেছে, যেন ঘটনা দেখে বিমূঢ় হয়ে গাড়িটা থেমে গেছে। সন্ত্রাসীদের গাড়িও রাস্তার মাঝখান দিয়েই ছুটে আসছে।
কর্নেল ওসামা সিটের আড়াল থেকে লেটেস্ট ভার্সনের ক্ষুদ্র কারবাইন বের করে নিল।
এ কারবাইনের ব্যারেল থেকে সেকেন্ডে চল্লিশটি গুলির ঝাঁক বের হয়। গুলি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র ধরনের, কিন্তু গুলি কোথাও প্রবেশের পর বিস্ফোরিত হয়। সুতরাং ক্ষতি হয় ভয়াবহ ধরনের। আবার এ কারবাইন থেকে সিঙ্গেল গুলি ছুঁড়বারও অপশন আছে।
সন্ত্রাসীদের গাড়ি একশ’ গজের মধ্যে এসে পড়েছে।
কর্নেল ওসামা দ্রুত একটা বোতাম টিপে সামনের উইন্ড স্ক্রিনের মধ্যের অংশটা সরিয়ে দিল এবং কারবাইন তুলে নিয়ে সামনের গাড়িটা তাক করল।
গাড়িটা তখন পঞ্চাশ গজের মধ্যে।
কর্নেল ওসামা সন্ত্রাসীদের গাড়ির টায়ার তাক করে কারবাইনের ট্রিগার চেপে ধরল।
শতখানেক গুলির একটা ঝাঁক বেরিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল গাড়ির মাথা এবং টায়ার এলাকার উপর।
সঙ্গে সঙ্গে অনেক ক্ষুদ্র বিস্ফোরণ এবং টায়ার বিস্ফোরিত হবার শব্দ হলো।
উল্টে গেল গাড়ি। দু’বার ডিগবাজী খেয়ে গাড়িটি কাত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল।
গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে দু’জন বেরিয়ে এসেছিল। তাদের চোখে আগুন। তারা সাথীদের সাহায্য করার বদলে পকেট থেকে রিভলভার বের করছিল।
কর্নেল ওসামা বিভলভার বের করার সুযোগ তাদের দিল না। দু’টি গুলি করল ধীরে সুস্থে। দু’জনেই বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে ছিটকে পড়ল মাটিতে।
কর্নেল ওসামা ছুটে গেল সন্ত্রাসীদের কাত হয়ে থাকা গাড়ির কাছে। উৎসুক কয়েকজন লোক একটু দূরে এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।
কর্নেল ওসামা তাদের কয়েকজনকে ডেকে মাইক্রোটাকে সোজা করে দাঁড় করাল।
দ্রুত গাড়ির ভেতরে উঁকি দিল কর্নেল ওসামা। দেখল, মেয়েটা উঠে বসছে। আর ভেতরে দুজন সন্ত্রাসীর একজন ড্রাইভিং সিটে, মারাত্মকভাবে আহত। অন্যজন সম্ভবত গুলিবিদ্ধ, সংজ্ঞাহীন।
মেয়েটিকে দেখে বিস্মিত হলো কর্নেল ওসামা। কিন্তু বিস্ময়টাকে বাড়তে দিল না।
মেয়েটি উঠে দাঁড়িয়েছে। কপালে রক্ত মেয়েটির।
মাইক্রোর দরজায় লক ছিল না, বন্ধ ছিল মাত্র। কর্নেল ওসামা, টেনে দরজা খুলে ফেলল।
মিস, আপনি ঠিক আছেন? হাঁটতে পারবেন?’ গাড়ির দরজায় দাঁড়িয়ে বলল কর্নেল ওসামা।
মেয়েটি কর্নেল ওসামার দিকে পরিপূর্ণভাবে তাকাল। তার চোখে মুখে একটা চমকে উঠা ভাব ফুটে উঠল, কিন্তু মুহূর্তেই তা আবার মিলিয়ে গেল। বলল, ‘পারব। কপাল ছাড়া বড় কোনো অসুবিধা কোথাও নেই.।’
‘তাহলে প্লিজ বেরিয়ে আসুন।’ বলল কর্নেল ওসামা।
মেয়েটি বেরিয়ে এল। দরজার সামনেই গুলিবিদ্ধ দুই সন্ত্রাসীর লাশ দেখল। বলল কর্নেল ওসামাকে, ‘আপনিই সন্ত্রাসীদের মাইক্রোতে গুলি করেছেন। এ সন্ত্রাসীদের কি আপনিই মেরেছেন?’
‘গাড়িতে গুলি না করে, এদের না মেরে কোনো উপায় ছিল না।’ বলল কর্নেল ওসামা।
‘গাড়ি না থামলে, এরা না মরলে আমি বাঁচতাম না। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। মেয়েটি বলল।
‘আপনি এখন কোথায় যাবেন? আপনার কপালের আহত জায়গায় ফাস্ট এইড এখনি দরকার।’ বলল কর্নেল ওসামা
‘আমি যাব সুবর্ণ নগরীতে। ফাস্ট এইড এখানে নয়, সুবর্ণ নগরীতে যাবার পথে কোনো ক্লিনিকে যাওয়া যাবে।’ মেয়েটি বলল।
‘কিভাবে যাবেন? ট্যাক্সি ডেকে দেব?’ বলল কর্নেল ওসামা।
‘আমার গাড়ি আছে। মেয়েটি বলল।
‘কোথায়?’ বলল কর্নেল ওসামা।
‘জান্নাতুল আরদ রেস্টুরেন্টের পার্কিং-এ। মেয়েটি বলল।
‘এটা আমার গাড়ি। গাড়িতে উঠুন, আপনাকে গাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছি। বলল কর্নেল ওসামা।
মেয়েটি মুখ একটু নিচু করল। বলল, ‘আমি একা এসেছি বটে, কিন্তু আমি এখন একা যেতে পারব না।’
‘জান্নাতুল আরদে আপনার আত্মীয়-স্বজন কিংবা পরিচিতজন অবশ্যই আছেন, যাদের সাহায্য আপনি নিতে পারেন!’ কর্নেল ওসামা বলল।
‘তেমন নেই।’
বলে মেয়েটি আবার বলে উঠল, ‘কারও উপর আমি ভরসা করতে পারছি না। আমার ভেতরটা এখনও কাঁপছে। আমি সুস্থ নই। আর আমার এই অবস্থার কথা আমার আপনজন যারা আছেন, তাদের আমি জানাতেও পারছি না, জানানো যায়ও না। আমি চাচ্ছি যা ঘটেছে, তার ইতি এখানেই ঘটুক। এ ঘটনা নিয়ে আরও বড় ঘটনা ঘটার ভয় আমি করছি। তা যেন না ঘটে সেটাই আমি চাচ্ছি। প্লিজ আমি এই মুহূর্তে এ দ্বীপ ছাড়তে চাই। যারা এই ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের প্রতিক্রিয়া ‘সাংঘাতিক হতে পারে। আপনাকেও এখান থেকে সরে যাওয়া দরকার।’ প্রায় এক নিঃশ্বাসে কথাগুলে বলে থাম্ল সে। তার কণ্ঠ উদ্বেগে ভরা।
কর্নেল ওসামা আবার কিছুটা বিস্মিত হলো। কিন্তু সে ব্যাপারে কোনো প্রশ্ন না তুলে বলল, ‘চলুন আপনার গাড়িতে। আমি বলে দিচ্ছি, আমার গাড়িটা আমার লোকেরা নিয়ে যাবে। কর্নেল ওসামা বলল মেয়েটিকে লক্ষ্য করে।
দু’জনেই হাঁটতে লাগল।
ঘটনাস্থল ক্লাব-রেস্টুরেন্টটির আউটার গেটের কাছাকাছিই পার্ক করা ছিল মেয়েটির গাড়ি।
মেয়েটি কোনো দিকে বা কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা গিয়ে আনলক করলো গাড়িটাকে। ড্রাইভিং সিটের সাথের দরজা খুলে কর্নেল ওসামাকে সেদিকে আমন্ত্রণ করল। কর্নেল ওসামা গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসল।
মেয়েটি দরজা বন্ধ করে গাড়ির সামনের দিকটা ঘুরে, ড্রাইভিং সিটের পাশের সিটে গিয়ে বসল।
গাড়ি চলতে শুরু করল।
ছুটল সুবর্ণদ্বীপের সাথে কানেকটিং ব্রীজের দিকে।
ব্রীজ পার হয়ে সুবর্ণ নগরীগামী রোড ঘুরে ছুটছে গাড়ি।
সুবর্ণ নগরী সুবর্ণদ্বীপের রাজধানী।
এখন এসব নাম সবই পাল্টে গেছে। সুবর্ণ দ্বীপ হয়েছে ভিক্টর আইল্যান্ড, সুবর্ণনগরী হয়েছে গোল্ড সিটি। এমনকি প্রেসিডেন্ট বা রাজার বাড়ি ‘সুবর্ণ হাউজ’ হয়েছে ভিট্রি হাউজ।
সুবর্ণনগরীতে প্রবেশের পর মেয়েটা অনেকখানি স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে। এক সময় প্রসন্ন দৃষ্টিতে কর্নেল ওসামার দিকে চেয়ে বলল, ‘আমি আপনাকে চিনতে পেরেছি।’
কর্নেল ওসামার মুখে এক টুকরো সূক্ষ্ম হাসি ফুটে উঠল। মেয়েটির দিকে না তাকিয়েই বলল, ‘চিনতে পেরেছেন আমাকে?’
‘হ্যাঁ পেরেছি। আমার মতো অনেকেই আপনাকে জানে না, কিন্তু চিনে। আপনি ভিক্টর আইল্যান্ড মানে সুবর্ণদ্বীপের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেটাল ফিজিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং-এ বিস্ময়কর রেজাল্ট করার জন্যে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্পোর্টসেও বরাবর চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন।’ বলল মেয়েটি।
মেয়েটি মুহূর্তের জন্যে একটু থেকেই আবার বলল, ‘কিন্তু আপনার হাতে ভয়ানক অস্ত্র কারবাইন কেন?’
‘কারবাইনটি হাতে না থাকলে তো আপনাকে বাঁচাতে পারতাম না।’ কর্নেল ওসামা বলল।
‘ঘটনাটা আমার ভুলবার নয়। এই ঘটনা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে আতঙ্কের, সবচেয়ে আনন্দের। যখন আমি সন্ত্রাসীদের হাতে পড়েছিলাম, সেটা ছিল আমার কাছে মৃত্যুর চেয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক। আবার যখন বেঁচে গেলাম, তখন মনে হয়েছিল দুনিয়ার সব খুশি যেন দু’হাত ভরে পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমি এ বিষয়ে প্রশ্ন করিনি। আমার বিস্ময় হলো প্রতিভাবান একজন বিজ্ঞান-ইঞ্জিনিয়ারের হাতে কারবাইনের মতো ভয়াবহ অস্ত্র কেন?’ বলল মেয়েটি।
‘আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলাম। অতএব হাতে কারবাইন থাকতেই পারে।’ কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ বলল।
‘যিনি হবেন যন্ত্র বিজ্ঞানের ইঞ্জিনিয়ার, তিনি সেনাবাহিনীতে! অবাক ব্যাপার। যাক, এখনও কি সেনাবাহিনীতে আছেন?’ বলল মেয়েটি।
‘এ প্রশ্ন কেন?’ কর্নেল ওসামা বলল।
‘কারণ আপনার হাতে কারবাইন, কিন্তু গায়ে সেনাবাহিনীর ইউনিফরম নেই।’ বলল মেয়েটি।
‘আপনি ঠিক বলেছেন। কর্নেল র্যাংকে উঠার পর আমি সেনাবাহিনী থেকে রিটায়ারমেন্ট নিয়েছি। আর কারবাইন আল্লাহই আমার হাতে তুলে দিয়েছেন। ভালো কাজে ব্যবহারের জন্যেই, কিছুক্ষণ আগে তা প্রমাণ হলো। কর্নেল ওসামা বলল।
মেয়েটির ঠোঁটে হাসি। বলল, ‘যুক্তি সাজাবার অদ্ভুত ক্ষমতা তো আপনার! আমার কাছে মনে হচ্ছে আপনি কথারও ইঞ্জিনিয়ার।
কর্নেল ওসামাও একটু হাসল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ কোনো কথা বলল না। মেয়েটিও কর্নেল ওসামার দিক থেকে চোখ সামনে ফিরিয়ে নিয়েছিল।
সেও চুপচাপ। দৃষ্টি তার সামনে। তার দৃষ্টিতে নানা কথা, নানা চিন্তা, নানা প্রশ্নের খেলা।
এক সময় চোখ ফিরিয়ে কর্নেল ওসামার দিকে চেয়ে বলল, ‘আপনি আমার পরিচয় জিজ্ঞাসা করলেন না?’
‘আপনার পরিচয় আমি জানি।’ বলল কর্নেল ওসামা।
‘জানেন? কে আমি বলুন তো?’ মেয়েটি বলল।
কর্নেল ওসামা একটু গম্ভীর হলো। তাকাল মেয়েটির দিকে বলল, ‘দস্যু সম্রাট দ্বিতীয় হেরাল্ডের গ্রান্ড গ্রান্ড ডটার ইভা হেরাল্ড আপনি। যার পিতা বর্তমান দস্যু সরকারের প্রধান, চতুর্থ হেরাল্ড।’
ইভা হেরাল্ড তাকাল কর্নেল ওসামার দিকে। তার চোখে-মুখে দারুণ বিব্রতভাব। বিব্রত ভাবটা আবার সঙ্গে সঙ্গেই অসহনীয় এক বেদনায় রূপান্তরিত হলো। ফুটে উঠল চোখে-মুখে গভীর বেদনার ছাপ। বলল, ‘আপনি এভাবে সাধারণের মতো কথা বলেন?’ কণ্ঠটি বেদনাসিক্ত, নরম, অশ্রু ভেজা।
কর্নেল ওসামা তাকাল ইভা হেরাল্ডের দিকে দ্রুত। তার বুকে গিয়ে বেঁধেছে একটা অশ্রুভেজা কণ্ঠের শক্ত তীর। বলল নরম কণ্ঠেই, সত্যের তো সাধারণ, অসাধারণ বলে কোনো আলাদা রূপ নেই মিস ইভা হেরাল্ড।’
‘তা নেই। তবে সত্যের সম্পূর্ণতা, অসম্পূর্ণতা নামের একটা বিভক্তি আছে। সম্পূর্ণ সত্য জানলে, আমি মনে করি, আমার পরিবারকে দস্যু বললেও কিছু সমবেদনা তার সাথে থাকতো। বলল ইভা হেরাল্ড। তার কণ্ঠ ভারি এবং আবেগপূর্ণ
ইভা হেরাল্ডের শান্ত ও আবেগমাখা কণ্ঠ কর্নেল ওসামার হৃদয়কে স্পর্শ করেছে। বলল সে, ‘স্যরি, সম্পূর্ণ সত্য কিছু থাকলে সেটা আমি জানি না মিস ইভা হেরাল্ড। কর্নেল ওসামার কণ্ঠ নরম ও সহানুভূতিপূর্ণ।
‘আমি জানি মি. কর্নেল ওসামা, আমার প্রপিতামহ লুটতরাজ, গণহত্যা ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যম সুবর্ণদ্বীপে তার দখল ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। তার উত্তরসূরীদের শাসনকালেও হত্যাসহ অত্যাচার, অবিচার, সন্ত্রাস অব্যাহত রয়েছে। কিন্তু আমার প্রপিতামহ দ্বিতীয় হেরাল্ড জলদস্যু ছিলেন না এবং অত্যাচারী স্বভাবেরও ছিলেন না। আমার গ্রান্ড দাদু দ্বিতীয় হেরাল্ড, যার পুরো নাম হেরাল্ড ফেয়ার হেয়ার নরওয়ের বিখ্যাত রাজবংশের রাজা ছিলেন। ইউরোপে নেপোলিয়ান যুদ্ধের পর ১৮১৪ সালে আমার গ্রান্ড দাদুর নেতৃত্বে নরওয়ে স্বাধীন হয়। আমার গ্রান্ড দাদু দেশকে একটি সংবিধানও প্রদান করেন। তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক ছিলেন। প্রজাদের তিনি ভালোবাসতেন। কোনো অবিচার- অত্যাচার নরওয়েতে ছিল না। আমাদের নরওয়ের প্রথম রাজার নাম অনুসারে তিনি দ্বিতীয় হেরাল্ড ফেয়ার হেয়ার নাম গ্রহণ করেন। দিন ভালোই চলছিল। দ্রুত সমৃদ্ধ হয়ে উঠছিল নরওয়ে। নরওয়ের এই সোনালি দিনে নরওয়ের মাথায় বাজ পড়ল। বাইরের চাপে এবং সুইডেনের ষড়যন্ত্রে নরওয়ে ও সুইডেনকে একীভূত করা হলো একটা ইউনিয়ন কাঠামোর আড়ালে। একক রাজার অধীনে এক প্রশাসনের নামে যে শাসন ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা হলো, তাতে কার্যত নরওয়ে তার স্বাধীনতা হারাল। আমার গ্রান্ড দাদু জনমতের চাওয়া অনুসারে এই অন্যায় মেনে নেননি। এই কারণে ষড়যন্ত্রকারীরা মিলিতভাবে আমার গ্রান্ড দাদুকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করল। গ্রান্ড দাদু রাজভাণ্ডার এবং কিছু লোকজন সাথে নিয়ে জাহাজে করে সমুদ্র পথে দূরে সরে গেলেন। কিন্তু সমুদ্রে সপ্তম দিনেই তার জাহাজ আক্রান্ত হলো জলদস্যুদের দ্বারা। রাজভাণ্ডারের অনেক কিছু তিনি হারালেন। এরপরেই তিনি আত্মরক্ষার জন্যে বিশাল জাহাজবহর গড়ে তুললেন। এই জাহাজবহর নিয়ে কি করবেন তিনি! কোথাও জাহাজ নোঙর করার বা মাটিতে নামার মতো নিরাপদ বা আপন কোনো জায়গা ছিল না তার। কতদিন তিনি পানিতে ঘুরবেন! অবশেষে কি হবে তাঁর! বাধ্য হয়ে তিনি জলদস্যু সিন্ডিকেটে যোগ দেন। কিন্তু তার লক্ষ্য ছিল দ্বীপ বা নিরাপদ কোনো স্থল এলাকা পেলে সেখানে তিনি বসতি গড়বেন, সুযোগ পেলে তিনি রাজ্য স্থাপনের দিকে এগোবেন। তিনি তার স্বপ্নের দ্বীপ বা দেশের সন্ধানে ঘুরতে লাগলেন। অবশেষে মিলল। তাঁর স্বপ্নের সেই রাজ্যই হলো ‘সুবর্ণ দ্বীপ’। জানি এতে লক্ষ প্রাণের বিনাশ হয়েছে, একটা স্বাধীন ও শান্তিপ্রিয় জাতির শান্তি, স্বাধীনতা লুণ্ঠিত হয়েছে। গ্রান্ড দাদুর এটা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ অবশ্যই। এই অপরাধ তিনি করেছেন আশ্রয়ের জন্যে একখণ্ড মাটি পাবার প্রয়োজনে। তিনি অপরাধী হওয়ার সাথে সাথে তিনি হয়তো কিঞ্চিত সহানুভূতিও পেতে পারেন।’ থামল ইভা হেরাল্ড। অবরুদ্ধ আবেগে কাঁপছিল তার কণ্ঠ 1 ‘ঠিক বলেছেন মিস ইভা হেরাল্ড। আমি দুঃখিত। আমাদের ইসলাম ধর্মও ক্ষুধার তাড়নায় যারা চুরি-ডাকাতি করে, তাদের আলাদাভাবে বিবেচনা করতে বলেছে।’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।
‘ধন্যবাদ আপনাদের ধর্মকে। আপনাদের ধর্মের মতো এমন বাস্তববাদী ধর্ম আর দ্বিতীয়টি নেই।’ ইভা হেরাল্ড বলল।
‘আমাদের ধর্ম সম্পর্কে এমন চমৎকার মন্তব্য আপনি কি আপনাদের লোকদের কাছে করতে পারবেন?’ বলল কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ।
‘অবশ্যই বলতে পারব এবং বলেও থাকি। এমনকি আমার বাবাকেও আমি ছাড় দেই না। রাজ্য রক্ষার নামে তারা যা করেন, করছেন তা অন্যায় এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ।’ ইভা হেরাল্ড বলল।
‘আপনি সত্যিই রাজকুমারী। রাজপুত্র, রাজকুমারীরা মাঝে মাঝে এমন সাহসী হবার ইতিহাস আছে।’ বলল কর্নেল ওসামা।
‘আমি রাজকুমারী নই, প্লিজ। আমি একটা ঐতিহ্যের উত্তরসূরী মাত্র। সে ঐতিহ্য আমার জন্যে বেদনাদায়ক। একটা সাধারণ মেয়ে হলেই ভালো হতো। তাহলে যন্ত্রণাদায়ক বর্তমান এবং দুঃসহ অতীত স্মৃতির ভার বয়ে বেড়াতে হতো না।’ ইভা হেরাল্ড বলল।
‘মানুষের দুঃখ আপনাকে কাঁদায়, একজন রাজকুমারীর জন্যে এটা বড় কথা অবশ্যই।’ বলল কর্নেল ওসামা। গম্ভীর কণ্ঠ তার।
‘কাঁদায় হয়ত না, কিন্তু জ্বলজ্যান্ত অপরাধের দুঃসহ ভার আমি বহন করতে পারি না।’ ইভা হেরাল্ড বলল। তারও গম্ভীর কণ্ঠ।
‘আপনার এই সমস্যার সমাধান কি, তা কখনো কি চিন্তা করেছেন?’ বলল কর্নেল ওসামা। কিছুটা হালকা কণ্ঠ তার।
আমি রাজা নই যে, সমাধান আমি বের করব, আবার আমি মন্ত্রী উপদেষ্টাদের মতো পদাধিকারীও নই যে, সমস্যা সমাধানের পরামর্শ দিতে পারব।’ ইভা হেরাল্ড বলল।
‘রাজা মন্ত্রীরা ছাড়া কি কেউ সমাধান বের করতে পারে না?’ জিজ্ঞাসা কর্নেল ওসামার।
ইভা হেরাল্ড তাকাল কর্নেল ওসামার দিকে। কিন্তু চোখে তার শূন্য দৃষ্টি। বলল, ‘পারার কথা, কিন্তু তার জন্যে যোগ্যতা ও সুযোগ প্রয়োজন।
‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও সুযোগ সৃষ্টি করা যায়, মানে চাইলে আল্লাহ সুযোগ সৃষ্টি করে দেন।’
আবার কর্নেল ওসামার দিকে দৃষ্টি ফেরাল ইভা হেরাল্ড। বলল, ‘আপনার এই মূল্যবান শিক্ষা আমি মনে রাখব।’
ইভা হেরাল্ড দৃষ্টি ফিরিয়ে সামনে তাকাল।
কর্নেল ওসামার দৃষ্টিও সামনে নিবদ্ধ।
‘ম্যাডাম ইভা হেরাল্ড সামনেই সুবর্ণ হাউজ, মানে ভিত্তি হাউজগামী রাস্তার মুখ। রাস্তার মুখে যে গেট তার একটু আগেই আমি নেমে যেতে… ‘
কর্নেল ওসামাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই ইভা হেরাল্ড বলে উঠল, ‘আমি ম্যাডাম, মিস কিছু নই। প্লিজ আমাকে ইভা হেরাল্ড বলবেন। আমি শুধুই ইভা, সাধারণ এক ইভা। আমার পদ, প্রতিপত্তি, অর্থ-সম্পদ কিছুই নেই। এ সবকিছু আসে যে পথ ধরে, সেই যোগ্যতাও আমার নেই। আপনার শিক্ষা সামনে রেখে ভেবে দেখলাম, আপনি যাকে হেরাল্ড পরিবারের রাজকুমারী বলেছেন, সে একেবারেই নিঃস্ব।’ ভারি কণ্ঠ ইভা হেরাল্ডের।
চোখ বন্ধ করল সে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে। বোধ হয় নিজেকে সে সামলে নিল। কিছু বলতে যাচ্ছিল ইভা হেরাল্ড।
কিন্তু তার আগেই কর্নেল ওসামা বলল, ‘রাজকুমারী ইভা, আপনি…’
কর্নেল ওসামার কথায় আবার বাধা দিল ইভা হেরাল্ড। বলল, ‘আবার রাজকুমারী বলছেন? বললাম না, আমি শুধুই ইভা।’
‘ম্যাডাম, মিস বলতে আপনি নিষেধ করেছেন, রাজকুমারী বলতে তো নিষেধ করেননি। সুতরাং রাজকুমারী বলা যায়।’ বলল কর্নেল ওসামা।
‘তাহলে আমিও আপনাকে ‘শাহজাদা’ বলতে পারি। কারণ দরবেশ প্রেসিডেন্ট-এর আপনি উত্তরসূরী এবং সরাসরি তার বংশের আপনি সন্তান।’
হাসল কর্নেল ওসামা। বলল, ‘দরবেশসহ দরবেশ বংশের কেউ বাদশাহ নয়, দরবেশ বংশের কাউকে শাহজাদাও বলা হয় না।’
‘জনাব, ‘সত্য’কে কেউ সত্য না বললেও ‘সত্য’ সত্যই থাকে, মিথ্যা হয়ে যায় না।’ বলল ইভা হেরাল্ড। তার মুখে হাসি।
কথাটা শেষ করেই কর্নেল ওসামাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলে উঠল ইভা হেরাল্ড। বলল, ‘আমাকে বাড়িতে পৌঁছে না দিয়ে এতদূরে নামবেন কেন?’
‘কানেকটিং রাস্তার মুখে যে গেট, এখান থেকেই আপনাদের বাড়ির শুরু। তাই এখানে আপনার কোনো অসুবিধা হবে না। এটুকু পথ আপনি ড্রাইভ করে যাবেন। আমি চাই, আপনি যেমন একা গিয়েছিলেন, তেমনি একাই ফিরছেন, এটা সকলেই জানুক।’ বলল কর্নেল ওসামা।
ইভা হেরাল্ড একটু চিন্তা করল। তার মুখে হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘ধন্যবাদ কর্নেল ওসামা। ঠিক বলেছেন আপনি। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।’
‘আরেকটা বিষয়, ছোট হলেও কপালে আপনার একটা ব্যান্ডেজ আছে। ওটা ঢাকার জন্যে আপনি মাথায় আপনার হ্যাটটা পরে নিন। বলল কর্নেল ওসামা।
এবার মুখ ভরা হাসি হাসল ইভা হেরাল্ড। বলল, ‘ধন্যবাদের পর ধন্যবাদের বিকল্প আর কোনো শব্দ আমার জানা নেই। ধন্যবাদ দু’বার ব্যবহার করছি। আর ব্যবহার ভালো দেখায় না। বলুন তো কি বলি?’
‘বলেছেন তো।’ কর্নেল ওসামা বলল।
‘না বলিনি। কি বলেছি?’ ইভা হেরাল্ড বলল।
কর্নেল ওসামা একটু গম্ভীর হলো। বলল, ‘কেন মুখ ভরা হাসি।’
সঙ্গে সঙ্গে কথা বলল না ইভা হেরাল্ড। তার মুখ কিছুটা রক্তিম হয়ে উঠল। এক টুকরো লজ্জা এসে আচ্ছন্ন করেছে চোখ দুটিকেও।
কিছুটা আত্মস্থ স্বরে বলল, ‘সে তো হাসি।’
‘হাসির ভাষা কথার চেয়ে আরও স্বচ্ছ, আরও স্পষ্ট, আরও গভীর হয়।’ বলল কর্নেল ওসামা।
মুখ একটু নিচু করল ইভা হেরাল্ড।
হঠাৎ তার মুখ জুড়ে নেমে এলো অনুরাগের রক্তিম ছায়া। বলল, ‘আপনি সে ভাষা বুঝেন?’
‘সবাই তা বুঝে, আমি তাদের বাইরে নই বোধ হয়। কর্নেল ওসামা বলল শান্ত কণ্ঠে।
‘ধন্যবাদ।’ নরম অনুচ্চ কণ্ঠ ইভা হেরাল্ডের।
‘পুরনো ‘ধন্যবাদে’র ব্যবহার কিন্তু আবার হলো!’
হেসে উঠল ইভা হেরাল্ড। হাসি মুখেই বলল, ‘বললাম তো, ও শব্দের কোনো বিকল্প আমি জানি না।
ততক্ষণে কর্নেল ওসামা রাস্তা মুখের গেটের একটু দূরে গাড়ি দাঁড় করিয়েছে। গাড়ি দাঁড়াবার সঙ্গে সঙ্গে কর্নেল ওসামা গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির পেছনটা ঘুরে গিয়ে ইভা হেরাল্ডের দরজা খুলে দিল।
ইভা হেরাল্ড নেমে এলো গাড়ি থেকে। তার মুখটা অনেকখানি ভারি হয়ে উঠোছে। মুহূর্ত কয়েক আগের সে হাসি মুখে আর নেই।
দাঁড়াল ইভা হেরাল্ড কর্নেল ওসামার সামনে।
‘আপনি ড্রাইভিং উঠুন। আমি যাচ্ছি। ভাববেন না, একটা গাড়ি ডেকে নিয়ে আমি চলে যাব।’
কথাটা শেষ করেই আবার বলে উঠল, ‘কপালের আঘাতটা তো মা-বাবা, ভাই-বোনদের কাছে ঢাকতে পারবেন না। আমি ভাবছি আপনি বলবেন, ছোট্ট একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। হঠাৎ ব্রেক কষতে গিয়ে কপালটা ড্রাইভিং হুইলের সাথে ঠুকে গেছে।
ইভা হেরাল্ড কোনো কথা বলল না।
বিস্ময়-বেদনার এক দৃষ্টি নিয়ে সে কর্নেল ওসামার দিকে তাকিয়ে। তার মনে নানা কথার আকুলি-বিকুলি, তাকে নিরাপদ করার, তাকে নানা প্রশ্ন ও সন্দেহ থেকে বাঁচাবার জন্য ওর এত চিন্তা! একজন মানুষের চিন্তা এত পরিচ্ছন্ন হয়, চোখের দৃষ্টি এত পবিত্র হয়। এত পথ আমরা এক সাথে এলাম, গাড়ির নিরিবিলি পরিবেশে আমরা পাশাপাশিই ছিলাম। আমার এই দুটি চোখ তাকে বার বার দেখেছে। কিন্তু ও একবারও আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলেনি। প্রায় সময় ওর দৃষ্টি সামনে ছিল। কিন্তু এতটা বয়স পর্যন্ত তার মতো পুরুষদের চোখে সে যা দেখে অভ্যস্ত, সেই লোভ, অপবিত্র পিপাসার বিন্দুমাত্র প্রকাশ তার চোখে-মুখে সে দেখেনি। কি অপরূপ স্বচ্ছ, পবিত্র হিরের টুকরো মানুষ! অনেক মুসলমানকে সে চেনে, জানে। তাদের তো এমন দেখেনি সে! আদর্শনিষ্ঠ মুসলমানরা কি তাহলে এমনই হয়!
এসব চিন্তায় নির্বাক, বাকহারা হয়ে পড়েছিল ইভা হেরাল্ড।
‘তাহলে চলি আমি।’ বলল কর্নেল ওসামা। চমকে উঠে সম্বিত যেন ফিরে পেল ইভা হেরাল্ড।
নিজেকে সামলে নিয়ে আবার চোখ তুলে তাকাল ইভা হেরাল্ড কর্নেল ওসামার দিকে। চোখ-মুখ জুড়ে বেদনার প্রকাশ। বলল, ‘মেহমান বাড়িতে এলে, তাদের যাবার সময় বলতে হয়, আবার আসবেন। আমি আপনাকে আসতে বলতে পারি?’
‘অবশ্যই পারেন। সুযোগ পেলে আসতে পারি।’ বলল কর্নেল ওসামা। মনে মনে ভাবল প্রেসিডেন্টের মেয়ের সাথে জানাশুনা সাগর সাইমুমকে সাহায্য করতে পারে।
‘আর সুযোগ না পেলে?’ ইভা হেরাল্ড বলল।
‘সুযোগ না পেলে তো আপনিও দেখা করতে পারবেন না। অতএব দুজনের অবস্থা সমান সমান।’ বলল কর্নেল ওসামা।
বেদনা বিজড়িত ইভা হেরাল্ডের ঠোঁটে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আপনার কাজ ও বুদ্ধির মতো কথাও অপরূপ। ধন্যবাদ।
‘ধন্যবাদ।’ বলে বিদায় নিয়ে চলতে শুরু করেই কর্নেল ওসামা ঘুরে দাঁড়াল। বলল, ‘একটা সত্য আপনাকে বলে যাই, আমার যে নাম, ভিক্টর ম্যাথিয়াস, আপনি জানতেন, সেটা আমার আসল নাম ছিল না। আমার নাম ওসামা ওবায়দুল্লাহ, যা আপনি কোনোভাবে জেনেছেন। যেহেতু এ নাম নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যেতো না, তাই আমাকে ভিক্টর ম্যাথিয়াস নাম নিতে হয়েছিল। সেনাবাহিনীতে ভর্তির সময়ও এ নাম ব্যবহার করেছি। এ সত্যটা আপনার জানা থাকা উচিত, তাই বললাম।’ বলে যাবার জন্যে আবার ঘুরে দাঁড়াল।
ইভা হেরাল্ডের চোখ-মুখ প্রসন্নতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঘুরে দাঁড়ানো কর্নেল ওসামাকে লক্ষ্য করে একটু উচ্চ কণ্ঠে বলল, ‘শুনুন, ভিক্টর ম্যাথিয়াস এবং ওসামা ওবায়দুল্লাহর মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য করি না।’
ওসামা ওবায়দুল্লাহ মাথাটা একটু পেছন দিকে ঘুরিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ।
হাঁটতে লাগল হাত তুলে দাঁড় করানো একটা ট্যাক্সির দিকে।
ট্যাক্সিটি চলতে শুরু না করা পর্যন্ত ইভা হেরাল্ড দাঁড়িয়ে থাকল ট্যাক্সির দিকে তাকিয়ে। তার চোখ-মুখে বেদনার ছাপ আরও গভীর হয়েছে।
তার বুকের কোথায় যেন এক অপরিচিত কষ্ট।
কষ্টকর এক নাড়িছেঁড়া টান তাতে।