২
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়্যারলেসটা মুখের সামনে থেকে একটু সরিয়ে নিয়ে দ্রুত চোখ ফিরাল প্রধানমন্ত্রীর দিকে।
প্রধানমন্ত্রীর অফিসকক্ষে তার জন্যে নির্ধারিত চেয়ারে বসেছিল। সে উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বসেছিল প্রধানমন্ত্রীর টেবিলের একপাশে। টেবিলটির সামনে বসেছিল আহমদ মুসা। আইনমন্ত্রীর’ আসন ছিল টেবিলের অন্যপাশে। আর গোয়েন্দা প্রধান বসে ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পেছনে।
‘মি. প্রধানমন্ত্রী স্যার, কলিন ক্রিস্টোফার বোর্ডিং কার্ড নিয়ে প্লেনে ওঠার জন্যে গ্যাংওয়ের মুখে অপেক্ষা করছে। আমাদের পুলিশ ফোর্স সেখানে পৌঁছে গেছে। আমরা এখনই তাকে গ্রেফতার করতে পারি।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘গ্রেফতারের নির্দেশ দাও।’ দ্রুত কণ্ঠে বলল প্রধানমন্ত্রী।
আহমদ মুসা শান্তভাবে বসে শুনছিল সব কথা।
প্রধানমন্ত্রীর মুখে গ্রেফতারের আদেশ উচ্চারিত হবার সাথে সাথে আহমদ মুসা ‘না’ সূচক হাত তুলল।
‘স্টপ মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে কথাটা বলেই প্রধানমন্ত্রী তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘বলুন মি. আবু আব্দুল্লাহ।’
‘মি. প্রধানমন্ত্রী আমার পরামর্শ হলো, চারদিক থেকে চারটি ছবি নিয়ে তাকে চলে যেতে দিন।’
প্রধানমন্ত্রীসহ সকলের চোখে মুখে বিস্ময়ের বিদ্যুৎ খেলে গেল। প্রধানমন্ত্রী একবার গভীর দৃষ্টিতে তাকালো আহমদ মুসার দিকে। তারপর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে চোখ ফিরিয়ে বলল, ‘মি. আবু আব্দুল্লাহ যা বলেছেন, সেটা করতেই নির্দেশ দিন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একটু দ্বিধা করল, কিন্তু নির্দেশ পালন করল। বলল, প্রেসিডেন্টকে একবার জানালে বোধ হয় ভালো হতো।
‘ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফার ও তার সহযোগী সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে আটক করাসহ ব্ল্যাক ক্রসের সাথে যে সংগঠন বা যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এসব ব্যাপারে তিনি মি. আবু আব্দুল্লার পরামর্শ নিতে বলেছেন। আমরা সেটাই করেছি। সুতরাং প্রেসিডেন্টকে বিরক্ত করার দরকার নেই। বলল প্রধানমন্ত্রী।
‘মি. প্রধানমন্ত্রী স্যার, আমরা কিন্তু মধ্য আফ্রিকা চার্চ আন্দোলনের নেতা ও মধ্য আফ্রিকা কাউন্সিল অফ ক্যাথলিক চার্চের সভাপতি বাতিস্তা সান্ড্রিকে গ্রেপ্তার এবং পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানকে নজরবন্দী করেছি। বিমানবন্দর থেকে ওয়ারলেস পাওয়ার আগের মুহূর্তে এটা জানতে পেরেছি। এ নিয়ে আলোচনার কোনো সুযোগ হয়নি।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
‘তাদের যে অপরাধ তাতে তাদের গ্রেপ্তার এই মুহূর্তের মিনিমাম দাবি। তাই কিনা মি. আবু আব্দুল্লাহ?’ প্রধানমন্ত্রী বলল।
‘আমি মনে করি প্রেসিডেন্টের আদেশ ঠিক আছে। তাদের ভীত- সন্ত্রস্ত করতে না পারলে তারাই আপনাদের ভীত করার চেষ্টা করবে। সেক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে কোনো বড় পদক্ষেপ নেয়া যাবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু মি. আবু আব্দুল্লাহ, কলিন ক্রিস্টোফারকে ছেড়ে দিতে বললেন কেন? সে তো মূল কালপ্রিট। প্রধানমন্ত্রী বলল।
‘ব্ল্যাক ক্রস প্রধান কলিন ক্রিস্টোফারকে আমি ছেড়ে দিতে বলেছি বুরুন্ডিকে বড় ঝামেলা থেকে নিরাপদ রাখার জন্যে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বড় ঝামেলাটা কি?’ জিজ্ঞাসা প্রধানমন্ত্রীর।
‘তাকে সহজে গ্রেফতার করা যাচ্ছিল। কিন্তু সমস্যা দাঁড়াত পরবর্তী সময়ে। আইন অনুসারে তার বিচার এবং তাকে শাস্তি দিতে হতো, কিন্তু তা সম্ভব হতো না। তাকে অনির্দিষ্টকাল আটকে রাখাও যেত না। কারণ তার পক্ষে বুরুন্ডিকে চাপ দেবার মতো বহু দেশ আছে, বড় বড় দেশ আছে। তাদের চাপে পড়ে কলিন ক্রিস্টোফারকে ছেড়ে দিতে হতো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সন্ত্রাসী হিসেবে, হত্যাকারী হিসেবে কলিন ক্রিস্টোফারকে হাতেনাতে ধরে ফেলার পর আইন ও যুক্তি আমাদের পক্ষে থাকতো। আমরা তাদের চাপ অস্বীকার করতে পারতাম না?’ প্রধানমন্ত্রী বলল।
‘কথার চাপ যুক্তি দিয়ে অস্বীকার করা যেত কিন্তু তাদের অন্তর্ঘাতি চাপ মোকাবেলা করা বুরুন্ডির জন্য খুবই কঠিন হতো। এ ব্যাপারে জাতীয় ঐক্যমতও সৃষ্টি করা যেত না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অন্তর্ঘাতটা কেমন?’ প্রধানমন্ত্রী বলল। তার চোখে মুখে বিস্ময়।
‘বুরুন্ডি ব্ল্যাক ক্রসসহ এই ধরনের খ্রিস্টান সন্ত্রাসীদের শত্রু হয়ে দাঁড়াত। বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত এই সন্ত্রাসীরা এই অঞ্চলের সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে বুরুন্ডিতে নানা অন্তর্ঘাত ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি করত। যাদের সহযোগিতা করার মতো প্রচুর লোক বুরুন্ডিতে আছে।’ বলল আহমদ মুসা। আহমদ মুসা থামল।
কোনো কথা এলো না প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে।
ঘরের অন্য সবাই নীরব। প্রধানমন্ত্রীসহ সবার বিস্ময় দৃষ্টি আহমদ মুসার দিকে।
নীরবতা ভাঙলো প্রধানমন্ত্রীই। বলল ধীর কণ্ঠে, ‘অনেক ধন্যবাদ আহমদ মুসা। আপনি অনেক দূর দিয়ে চিন্তা করেছেন এবং আপনার প্রতিটি কথা সত্য। আমরা যদি কলিন ক্রিস্টোফারকে ধরে রাখতাম বা শাস্তি দিতাম, তাহলে আমরা প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে আমাদের ভেতর থেকেও প্রবল বিরোধিতার সম্মুখীন হতাম। আপনি ঠিক চিন্তা করেছেন। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি এক সংকট থেকে আমাদের বুরুন্ডিকে বাঁচিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রী থামতেই তার ওয়ারলেস ইনকামিং কলের সংকেত দিতে শুরু করল।
কল রিসিভ করে সোফায় সোজা হয়ে বসে বলল, ‘ইয়েস এক্সিলেন্সি, আমরা সবাই আমার অফিসে। আহমদ মুসাও। তিনি ভালো আছেন।’
প্রেসিডেন্ট ও প্রান্ত থেকে কথা বলল। উত্তরে প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘এক্সিলেন্সি, আপনার নির্দেশ অনুসারে বড় কালপিটদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেয়া হয়েছে। শুধু বাকি ছিল কলিন ক্রিস্টোফারকে পাকড়াও করা। তাকেও জালে আটকানো হয়েছিল, কিন্তু আহমদ মুসার পরামর্শে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী ও প্রান্ত থেকে প্রেসিডেন্টের কথা শোনার পর আহমদ মুসা কেন কলিন ক্রিস্টোফারকে ছেড়ে দিতে বললেন তা সংক্ষেপে প্রেসিডেন্টকে জানাল।
প্রেসিডেন্টের সাথে কথা শেষ করে প্রধানমন্ত্রী আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা, প্রেসিডেন্ট মহোদয় তাঁর গাড়িসহ প্রটোকল পাঠাচ্ছেন। তার সাথে লাঞ্চের জন্য তিনি আপনাকে অনুরোধ করেছেন। এই সুযোগে আপনার সাথে তার কথাও হবে।’
আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘আমি তো ধূলি ধূসরিত। এই অবস্থায় প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ কি শোভন হবে?’
হাসল প্রধানমন্ত্রীও। বলল, ‘ওয়াশরুমের হ্যাঙ্গারে আপনার জন্য সিমিলার একসেট পোশাক রাখা আছে। একটা ব্যাগও আছে। আপনার ময়লা পোশাক খুলে তাতে রাখবেন। আপনার গাড়িতে ব্যাগটা পৌঁছে দেয়া হবে।’ বলে প্রধানমন্ত্রী উঠে দাঁড়াল।
দাঁড়াল আহমদ মুসা এবং অন্য সকলেই।
নতুন পোশাক পরে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো আহমদ মুসা। তার হাতে ব্যাগ, তাতে তার খুলে রাখা কাপড়।
বাইরে দাঁড়িয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর পিএ। আহমদ মুসার হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনাকে গাড়িতে পৌঁছে দেব?’
‘আমার আবার গাড়ি কোথায়, ওটা তো ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘প্রধানমন্ত্রী স্যার তার একটা গাড়ি আপনাকে দিয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পিএ বলল।
‘তোমার স্যারকে ধন্যবাদ।’ বলে আহমদ মুসা সামনে পা বাড়াল।
প্রেসিডেন্টের প্রোটোকল এসে গেছে।
প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং অন্যান্যরা আহমদ মুসাকে নিয়ে অফিস থেকে গাড়ি বারান্দায় বেরিয়ে এসেছে।
এই সময় প্রধানমন্ত্রীর অফিস লনের শেষ প্রান্তের গার্ড রুম থেকে পুলিশ ও সৈনিকরা কয়েকজনকে টেনে-হিচড়ে গাড়িতে তুলে গেট দিয়ে বেরিয়ে যাবার জন্য আসছিল। আর ভেতর থেকে কয়েকজন চিৎকার করছিল, ‘আমরা নির্দোষ। আমরা জাঞ্জিবার থেকে বুজুমবুরা এসেছি এক পরিচিতজনের সাথে দেখা করতে। তার সন্ধানে যাওয়ার পথে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের গেটে পৌঁছে আমরা এই অবস্থার মধ্যে পড়ি।’
তাদের চিৎকার আহমদ মুসার কানে পৌঁছেছিল। আহমদ মুসা প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে এই লোকেরা কারা?’
প্রধানমন্ত্রী তাকাল পুলিশ প্রধানের দিকে। পুলিশ প্রধানও আহমদ মুসার প্রশ্ন শুনতে পেয়েছিল। বলল পুলিশ প্রধান, ‘সন্ত্রাসী ঘটনার সময় ওরা চারজন এই সম্মুখ গেটে সন্দেহজনকভাবে দাঁড়িয়েছিল। অভিযানে আসা সেনারা তাদের ধরে দিয়ে গেছে। এখন তাদের পুলিশ কাস্টডিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’
‘মি. প্রধানমন্ত্রী, জাঞ্জিবারে আমার প্রচুর পরিচিত লোক আছে। আমি কি একবার ওদের সাথে দেখা করতে পারি? কথা বলতে পারি?’ বলল আহমদ মুসা।
‘অবশ্যই জনাব।’ বলে প্রধানমন্ত্রী তাকাল পুলিশ প্রধানের দিকে।
পুলিশ প্রধান সঙ্গে সঙ্গে একজন অফিসারকে বলল, ‘বস্কো, তুমি পুলিশ ভ্যানকে ভেতরে ব্যাক করতে বল। ছুটলো অফিসারটি।
পুলিশ ভ্যানটি ব্যাক করে এসে অফিস লনে প্রবেশ করল।
পুলিশ প্রধান আসামিদের নিচে নামিয়ে আনতে বলল।
পুলিশ ও সৈনিকদের ঘেরাওয়ের মধ্যে আসামিদের নামানো হলো।
আসামিরা চারজন। তাদের মধ্যে একজন তরুণী। আরেকজন তরুণ। অবশিষ্ট দুজনের একজন মাঝবয়সী, অন্যজন যুবক।
ওরা পুলিশ ভ্যান থেকে নেমে সুস্থির হওয়ার আগেই আহমদ মুসার নজর গিয়ে পড়েছিল তরুণ-তরুণী দুজনের উপর।
নজর পড়তেই বিস্মিত আহমদ মুসা তরুণ তরুণীদের উদ্দেশ্য করে বলল, ‘কি ব্যাপার সিতি, মুইজি তোমরা এখানে? এভাবে?’
আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে দু’হাত উপরে তুলে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, ‘হে আল্লাহ, আপনি আমাদের রক্ষা করেছেন, আপনার হাজার শোকর।
হাত নামিয়ে তাকালো সে আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, জরুরি প্রয়োজনে আপনার সন্ধানেই আমরা এসেছি।’
‘আমার সন্ধানে? তোমরা জানলে কি করে যে আমি বুজুমবুরায়?’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমাদের জাঞ্জিবারের সৌদি কনস্যুলেটের একজন অফিসারের কাছ থেকে আমার বাবা এটা জানতে পারে।’ সিতি সাবেরা বলল।
‘তোমার বাবা তো একজন বড় রাজনীতিক।
একটু থেমেই মাঝবয়সী রাশভারী লোকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘ইনি কি তোমার বাবা?’
‘জি স্যার।’
কথাটা শেষ করেই সুঠামদেহী গৌরবর্ণের যুবকটিকে দেখিয়ে বলল, ‘স্যার, ইনি আমাদের জাঞ্জিবারের মেরিন সেনাদলের একজন কমান্ডার। তিনি কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী আব্দুর রহমান। তার প্রয়োজনেই আপনার সন্ধানে আমাদের এখানে আসা।
আহমদ মুসা সিতির বাবা এবং কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী আব্দুর রহমানকে সালাম দিল।
আহমদ মুসা তাকাল প্রধানমন্ত্রীর দিকে। বলল, ‘মি. প্রধানমন্ত্রী, দুজনের পরিচয় তো পেলেন। একজন জাঞ্জিবারের বড় একজন রাজনীতিক। আর দ্বিতীয়জন জাঞ্জিবার নৌবাহিনীর একজন কমান্ডার। আর মেয়েটার নাম সিতি সাবেরা। ছেলেটা হাসান আলী মুইজি। তারা দুজনেই দুদুমা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। মুইজির বাবা তানজানিয়া আইন পরিষদের সদস্য।’
প্রধানমন্ত্রী কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে হ্যান্ডশেক করল সিতি সাবেরার বাবা এবং কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী আব্দুর রহমানের সাথে এবং পিঠ চাপড়ে দিল সিতি সাবেরা এবং হাসান আলী মুইজির। বলল সিতির বাবা ও কমান্ডারকে লক্ষ্য করে, ‘যা ঘটেছে, তা ঘটাই স্বাভাবিক ছিল সেই অবস্থায়। আমাদের সৌভাগ্য যে, জনাব আহমদ মুসাকে আপনারা চেনেন। এক অনাকাঙ্ক্ষিত অবস্থা থেকে তিনি আমাদের বাঁচিয়েছেন।
একটু থেমে প্রধানমন্ত্রী আবার বলল, ‘মনে হচ্ছে শহরে পরিচিত কেউ নেই আপনাদের, আর এই শহরেও আপনারা নতুন। আপনারা আমাদের অতিথি হতে পারেন। আমরা খুশি হবো।’
‘মি. প্রধানমন্ত্রী ধন্যবাদ আপনাকে। এরা আমার অতিথি হলেই ভালো হবে, তাদের প্রয়োজন যখন আমার সাথে।’
মুহূর্তের জন্যে থামল আহমদ মুসা। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, ‘আমি প্রেসিডেন্ট মহোদয়ের সাথে কথা বলে না ফেরা পর্যন্ত এদের একটা ব্যবস্থা করলে আমি খুশি হবো।’
‘সেটা আমি করছি মি. আবু আব্দুল্লাহ।’
বলেই প্রধানমন্ত্রী ডাইরেক্টর জেনারেলের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সম্মানিত অতিথিদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করুন।
আহমদ মুসা সিতি সাবেরার দিকে কিছুটা এগিয়ে সিতির বাবাকে লক্ষ্য করে বলল, ‘প্রেসিডেন্ট মহোদয় ডেকেছেন। তার সাথে দেখা করে এসে আমি আপনাদের নিয়ে যাব। কতটা দেরি হবে আমি জানি না। এখানে আপনাদের নিশ্চয়ই কোনো অসুবিধা হবে না।’
‘আল্লাহ আপনাকে পাইয়ে দিয়েছেন। তাঁর হাজার শোকর। আমাদের কোনো চিন্তা নেই।’ বলল সিতির বাবা আহমদ মুসাকে লক্ষ্য করে।
‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে আহমদ মুসা সবাইকে সালাম দিয়ে তার জন্য প্রস্তুত গাড়িতে গিয়ে বসল।
প্রধানমন্ত্রীও অগ্রসর হয়েছেন তার গাড়ির দিকে।
.
প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন আহমদ মুসাকে সাথে নিয়ে লাঞ্চ সেরে প্রেসিডেন্ট ভবনের ফ্যামিলি অংশে তার প্রাইভেট ড্রয়িং রুমে বসেছিল। বুরুন্ডির সাম্প্রতিক সমস্যা নিয়েই কথা হচ্ছিল আহমদ মুসার সাথে প্রেসিডেন্টের। বলা যায় বুরুন্ডির এ সমস্যা বিষয়ে এবং এর আন্তর্জাতিক নানা রকম প্রতিক্রিয়া নিয়ে একটা কমপ্লিট ব্রিফিং নিচ্ছিলেন প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসার কাছ থেকে।
কথাবার্তার এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা আমার একমাত্র মেয়ে সারা সোনিয়া আপনার সাথে দুই একটা কথা বলতে চায়। সে আপনাকে দেখেনি, কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক বেশি জানে। তার বহুদিনের আকাঙ্ক্ষা আপনাকে চাক্ষুষ দেখা।’
‘মি. প্রেসিডেন্ট, একজন বোন কথা বলতে চাইলে তাকে সে অধিকার দিতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা
‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা।’
বলে প্রেসিডেন্ট সঙ্গে সঙ্গেই ইন্টারকমে তার মেয়েকে আসার জন্য বলল।
মিনিট খানেকের মধ্যে বাইশ-তেইশ বছরের একটা মেয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল এবং সালাম দিল। কালো গোলাপের রাজ্যে মেয়েটি সুন্দর, সুশ্রী একটা সাদা গোলাপ। তার পরনে সবুজ সালোয়ার, সবুজ কামিজ। মাথা ও গলায় পেঁচানো একটা সবুজ ওড়না।
আহমদ মুসা তাকে একবার দেখার পর চোখ নামিয়ে নিয়েছিল। প্রেসিডেন্ট মেয়েটিকে কাছে ডেকে তার পাশের সোফা দেখিয়ে দিল বসার জন্যে।
মেয়েটি বসল কিছুটা জড়োসড়ো হয়ে।
‘মি. আহমদ মুসা এই আমাদের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান, আমার মেয়ে, সারা সোনিয়া।
‘স্বাগত বোন। আল্লাহ তোমাকে দীর্ঘ নেক জীবন, অনেক হালাল সম্পদ এবং প্রচুর বিদ্যা ও কল্যাণকর জ্ঞানের অধিকারী করুন।’ বলল আহমদ মুসা সারা সোনিয়াকে উদ্দেশ্য করে।
সারা সোনিয়া কিছুটা নতমুখী ছিল। এবার মুখ তুলল এবং আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনার সাথে সাক্ষাতের সুযোগ পাওয়ায় আমি খুবই খুশি হয়েছি। এটা আমার অনেকদিনের স্বপ্ন ছিল।
‘একজন মানুষের সাথে সাক্ষাৎ বড় কথা নয় বোন। তার কাজের মধ্যে তার যে সাক্ষাৎ মিলে, সেটাই আসল। মানুষ হিসাবে তোমার, আমার, আমাদের সকলের মানুষের কর্ম ও আদর্শের দিকেই বেশি তাকানো উচিত।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক স্যার, কিন্তু ব্যক্তির সাক্ষাৎ, সাহচর্য বড় বড় কাজ করেছে দুনিয়ায়।’ সারা সোনিয়া বলল।
‘ওটা বিশেষ ক্ষেত্রে সোনিয়া, আমি বলেছি সাধারণ নীতির কথা। ব্যক্তি মানুষের সীমাবদ্ধতার কথা, মানব সমাজের আবশ্যিক প্রয়োজনের কথা। আর একটা বিষয়, ব্যক্তির সাক্ষাৎ সাহচর্যের গুরুত্ব প্রাগ- আধুনিককালে যেমন ছিল, এই কমিউনিকেশন যুগে তেমন নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার, আমি বুঝেছি। এই বুঝা আমার মধ্যে একটা বড় প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে, আপনি বাস্তববাদী একজন সমাজ বিশ্লেষক। জীবন দেয়া-নেয়ার সংগ্রামে না গিয়ে মানুষের জীবন গড়ার কাজে আপনার আসা উচিত ছিল।’ বলল সোনিয়া।
‘জীবন গড়ার জন্যে জীবন বাঁচানো প্রয়োজন সোনিয়া।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা সোনিয়া একটুক্ষণ চুপ থেকে বলল, ‘ঠিক স্যার, না বাঁচানো গেলে জীবন গড়া হবে কি করে? একটা প্রশ্ন স্যার, বারুদের গন্ধ, রক্তের লাল আতঙ্কের মধ্যে মানুষকে নিয়ে এইভাবে ভাবেন কি করে?’
‘সোনিয়া, বারুদের গন্ধ, রক্তপাতের লাল আতঙ্ক এই উৎসাহ অনুপ্রেরণা দেয় যে, মানুষকে দুঃখ-কষ্ট, সংঘাত-সমস্যা থেকে বাঁচানোই প্রথম কাজ। স্রষ্টা আল্লাহ মানুষের কাছে এটাই চায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। একটা প্রশ্ন স্যার, আপনি মুসলিম এবং সব ব্যাপারে আপনি আল্লাহর অনুগত। কিন্তু আপনার হওয়া উচিত ছিল সকলের এবং সব মানুষের জন্য। দুনিয়াতে কেবল এক ধর্মই নেই, অনেক ধর্ম আছে। ধর্মের বাইরেও মানুষ আছে। সারা সোনিয়া বলল।
আহমদ মুসা একটু হাসল। বলল, ‘প্রতিটি মানুষেরই একটা ধর্ম আছে, থাকে। যারা ধর্মের বাইরে বা ধর্ম মানে না, তাদেরও নিরেশ্বরবাদীতা বা ধর্মহীনতা একটা ধর্ম, এক ধরনের বিশ্বাস। তাদের হয়তো গড বা আল্লাহ নেই, কিন্তু সেই স্থানে তারা হয়তো বসিয়েছে কোনো অনুসরণীয় আইডলকে। যেমন কমিউনিস্ট সোভিয়েত ইউনিয়নে মসজিদ ও গির্জার দরজা বন্ধ হয়ে গেলে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রবল জনস্রোত লেলিনের সমাধিমুখী হয়েছিল তাদের পূজারী মন নিয়ে। মানুষ তার অবচেতন মনে তার স্রষ্টাকে, বৃহত্তর উচ্চতর কোনো অলৌকিক সত্তাকে ইবাদতের বা পূজার আসনে বসিয়ে রেখেছে, লেলিনের মাজারে আছড়ে পড়া মানুষের ঢল তারই একটা প্রকাশ। থাক এদিকটা। আমি অবশ্যই মুসলিম। আর মুসলিম মানেই হলো আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশ-নিষেধের প্রতি আত্মসমর্পিত মানুষ। মুসলিম হিসেবে মুসলিমদের কথা তো আমি ভাববোই, তাদের খেদমত তো আমি করবোই। কিন্তু তাই বলে আমার অন্য ধর্মের মানুষের সাথে বিদ্বেষের সম্পর্ক নেই, কোনো মুসলমানেরই তা থাকতে পারে না। কারণ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষই আল্লাহর বান্দা। আল্লাহই তাদের আহার দেন, আলো-বাতাস এবং অসংখ্য নিয়ামত দিয়ে তাদের বাঁচিয়ে রাখেন। তাহলে আমি আহমদ মুসা আল্লাহর অনুগত হলে ওই সব মানুষের পাশে দাঁড়াবো না কেন? আমি তাদেরও হবো না কেন?’ থামলো আহমদ মুসা।
সঙ্গে সঙ্গেই সারা সোনিয়া ধীর কণ্ঠে বলে উঠল, ‘ধন্যবাদ স্যার, একটা সুন্দর দিক সামনে আনার জন্য। স্যার, আপনি যা বললেন আমি তা বুঝেছি। কিন্তু আপনাকে শুধুই মুসলিমদের সাথে ব্রাকেটেড করা হয় কেন?’
‘এর কারণ বিশ্বের মুসলমানদের পাশে আমাকে বেশি দেখা যায়। বেশি দেখা যাবার কারণ গোটা দুনিয়ায় মুসলমানরাই আজ বেশি নির্যাতিত। মুসলমানরা আজ দুনিয়ায় শতরকম নির্যাতনের শিকার। এমনকি জাতিসংঘ তাদের সাথে বিমাতাসুলভ আচরণ করে। পূর্ব তিমুর ও দক্ষিণ সুদানের সশস্ত্র খ্রিস্টান মুক্তিকামীদের বলা হয় স্বাধীনতা যোদ্ধা, কিন্তু ফিলিস্তিন ও কাশ্মীরের মুক্তিকামীরা সন্ত্রাসী। বিশ্বে আজ মুসলমানরা অসহায় মজলুম। তাই তাদের পাশে আমাকে বেশি দেখা যাবারই কথা। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যাবে আমার সাধ্য ও সুযোগ অনুসারে আমি অমুসলিমদের জন্যে যা করেছি এবং মুসলিমদের জন্যে যা করেছি তার একটার চেয়ে অন্যটা খুব কম কিছু নয়। আসল কথা হলো, আমি মানুষের পরিচয়ের চেয়ে কে জালেম আর কে মজলুম- এটাই বড় করে দেখেছি। আমার ধর্মের এটাই শিক্ষা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ স্যার। স্যার, আমি আপনার ব্যক্তি ও পরিবারিক জীবন সম্পর্কে কিছু জানতে চাই।’ সারা সোনিয়া বলল।
‘ওগুলো একান্তই আমার নিজস্ব। এ ব্যাপারটা থাক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আপনার মতো বিশেষ মানুষদের নিজস্ব বলে কিছু থাকে না। আপনি বিয়ে করেছেন ফরাসি বুরবন রাজকুমারীকে, দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাতঃস্মরণীয় প্রেসিডেন্ট টমাস জেফারসনের একমাত্র উত্তরাধিকারীকে। এসব আমরা জানি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম, কোন দেশে আপনার জন্ম, কিভাবে আপনি আহমদ মুসা হলেন, ইত্যাদি?’ সারা সোনিয়া বলল।
‘চীনের কানসু প্রদেশে আমার জন্ম। আর আমি কিভাবে আহমদ মুসা হলাম, এটা আল্লাহ জানেন যিনি আমাকে আহমদ মুসা বানিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সুন্দর জবাব। ধন্যবাদ স্যার। স্যার, আপনি কি আপনার এ জীবন নিয়ে সন্তুষ্ট?’ সারা সোনিয়া বলল।
‘আমি সন্তুষ্ট। সন্তুষ্ট কারণ, এ জীবন আমার বাছাই করা নয়। আমার আল্লাহ আমার জন্যে যা বাছাই করেছেন, তাতে আমি শতভাগ সন্তুষ্ট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আমি পড়েছি, আপনার সব ভরসা আল্লাহর উপর, আপনার সব ভালোবাসা আল্লাহর জন্যে, আপনার সব কাজ আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশ অনুসারে, আপনার সব পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা, মন্দ লাগা নির্ভর করে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উপর। তাহলে তো আপনার নিজস্ব বলে কিছু থাকে না, আপনার নিজস্ব স্বাধীনতা, ইচ্ছার তো কোনো ভূমিকা কোথাও থাকার কথা অবশ্যই নয়।’ সারা সোনিয়া বলল।
‘কি বল সোনিয়া, আমার সব কাজ, সব ইচ্ছাতেই তো আমার স্বাধীন ভূমিকা। এই যে আমি বুজুমবুরায় একটা কাজ নিয়ে এসেছি, এটা আমার নিজস্ব ইচ্ছার ফল। কেউ আমাকে ডিকটেট করেনি যে, তুমি বুজুমবুরায় যাও। আল্লাহ এভাবে কাউকে ডিকটেট করেন না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন স্যার, আপনি বুজুমবুরায় এই কাজকে আল্লাহর কাজ মনে করেন না, এই কাজকে আল্লাহর তরফ থেকে আসা আপনার জন্যে দায়িত্ব মনে করেন না?’
‘হ্যাঁ, করি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে এটা তো আপনার নিজস্ব ইচ্ছা নয়, আল্লাহর ইচ্ছা ও আদেশে আপনার এখানে আসা বুঝায়। সারা সোনিয়া বলল।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘সোনিয়া বিষয়টা আরও গভীরে গিয়ে চিন্তা করতে হবে। দেখ, বুজুমবুরায় মুসলমানরা মজলুম এবং ষড়যন্ত্রের শিকার, তাদের সাহায্য প্রয়োজন- এই বোধটা আমার অন্তরে আল্লাহর ইচ্ছা ও.একটা তাকিদ আকারে প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু এটা আমার জন্যে নির্দেশ বা ডিকটেশন ছিল না। আমি আমার ইচ্ছায় এটা এড়িয়ে যেতে পারতাম, পাশ কাটাতে পারতাম, যেমন হাজারো লোক করছে, এমনকি তুমিও করছ। আমিও তা করতে পারতাম। কিন্তু আমি, আমার বিবেক, আল্লাহর ইচ্ছা, আল্লাহর তাকিদ ও নীতিবোধকে প্রাধান্য দিয়ে আমি বুজুমবুরায় এসেছি। এটা কি আমার নিজস্ব সিদ্ধান্ত হলো না?’
‘বুঝলাম স্যার। কিন্তু বিষয়টা জটিল। এ বিষয়টাও পরিষ্কার হলো যে, আল্লাহর আদেশ মানবার, না মানবার উভয় সুযোগ মানুষের আছে। এটা তার স্বাধীনতা।’ সারা সোনিয়া বলল।
‘এই সুযোগ ও স্বাধীনতা আল্লাহ মানুষকে দিয়েছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন দিয়েছেন? না দিলে তো আল্লাহর আদেশ-নিষেধ লংঘন হতো না। সারা সোনিয়া বলল।
‘আল্লাহ তাঁর শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি মানুষকে গাছপালা, পশু-পাখির মতো করতে চাননি। তিনি মানুষকে বুদ্ধি-জ্ঞানসম্পন্ন ও স্বাধীন সিদ্ধান্তের ক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন একটা বিশেষ উদ্দেশ্যে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘সে বিশেষ উদ্দেশ্যটা কি?’ সারা সোনিয়া বলল।
‘সে উদ্দেশ্যটা হলো মানুষকে পরীক্ষা করা। পরীক্ষাটা হলো মানুষের মধ্যে যারা সৎ পথে চলবে এবং যারা অসৎ পথে চলবে তাদের বাছাই করা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এ বাছাই করা কেন?’ সারা সোনিয়া বলল।
‘সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ করা। আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন এবং দুনিয়ায় বেঁচে থাকার জন্যে হাজারো উপকরণ দিয়েছেন, চন্দ্র-সূর্য, গ্রহ- তারা, গাছপালা, তৃণলতা, পশুপাখির মতো হাজার রকমের সেবা মানুষকে দিয়েছেন, সেটা মানুষের মৃত্যুর মাধ্যমে শেষ হয়ে যাবার জন্যে নয়। এই দুনিয়ার পর আর একটা প্রতিফলের জগৎ আল্লাহ সৃষ্টি করে রেখেছেন বা সৃষ্টি করবেন, সেখানে মানুষ ঐ বাছাই অনুসারে কর্মফল লাভ করবে, সেটা হবে অনন্ত সুখের জান্নাত, নয়তো চিরন্তন কষ্টের জাহান্নাম। মানুষকে তার কর্মের এই প্রতিফল দেয়ার মাধ্যমেই মানব সৃষ্টির উদ্দেশ্য সম্পূর্ণ হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা সোনিয়ার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠেছিল। আহমদ মুসা থামলেও সারা সোনিয়া তৎক্ষণাত কোনো কথা বলল না। একটু সময় নিয়ে বলল, ‘স্যার, মানুষের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে যে ভয়াবহ কথা আপনি বললেন, তা মানুষের মুখের হাসি মিটিয়ে দেবার মতো। বিষয়টা নিয়ে আরও ভাববো স্যার। মনে হচ্ছে আমাকে, আমার বাবা-মাকে রক্ষার জন্যেও এটা প্রয়োজন। থাক এ ভারি বিষয়টা স্যার। আপনার কাছে আমার একটা জিজ্ঞাসা ছিল, সেটা হলো, আপনার সবচেয়ে আনন্দের এবং সবচেয়ে দুঃখের দিন কোনটি?’
‘স্যরি সোনিয়া। এমন হিসেব-নিকেশ আমি কখনো করিনি আমার দৃষ্টি সব সময় সামনে। এ কারণেই হয়তো পেছনের জীবন নিয়ে এমন হিসেব-নিকেশের সুযোগ হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘জীবনে হতাশ হয়েছিলেন কখনো?’ সোনিয়া বলল।
‘অনেক বছর আগে চীনের কানসু মরুভূমিতে ছোট ভাইয়ের পোড়া লাশ ও মুমূর্ষু পিতা-মাতাকে নিয়ে যখন বসেছিলাম, যখন দেখছিলাম চারদিকে জ্বলতে থাকা তাঁবুর দাউদাউ করা আগুন এবং অগ্নিদগ্ধ মানুষের লাশের সারি, তখন হতাশায় মুষড়ে পড়েছিলাম। কিন্তু মুমূর্ষু বাবা আমাকে সাহস দিয়ে বলেছিলেন, মুসলমানদের কখনো হতাশ হতে নেই। আল্লাহর দয়া থেকে নিরাশ হতে আল্লাহ নিষেধ করেছেন। তারপর আমার জীবনে আর কোনো হতাশা আসেনি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘তাহলে স্যার আমি বলব, ওটাই আপনার জীবনের চরম দুঃখের দিন এবং পরম উত্থান ও আনন্দেরও দিন। সারা সোনিয়া বলল।
‘ধন্যবাদ সারা সোনিয়া। আমার জীবনের এই নতুন হিসেব দাঁড় করাবার জন্যে। হয়তো তোমার কথাই ঠিক, কিন্তু আমি আমার জীবনকে এ হিসেবের দৃষ্টিতে কখনো দেখিনি।’ বলল আহমদ মুসা।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে। প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন হাসিমুখে বসেছিল। বলল আহমদ মুসা তাকে লক্ষ্য করে, ‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, অনুমতি দিলে আমি এখন উঠতে চাই।
‘আমার মন চাচ্ছে, আপনার সাথে এই আলোচনা আরও চলুক। আমি অনেক কিছু শিখেছি এই আলোচনা থেকে। বিশেষ করে মানব পরিণতির কথা আমাকে বিশেষভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। মেয়ের মতো আমিও বলছি, এ বিষয়ে আমি আরও জানতে চাই, বুঝতে চাই।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আল্লাহ আপনাকে তৌফিক দিন। আপনার মেয়ে এ ব্যাপারে অনেক সাহায্য করতে পারবে। খুব বুদ্ধিমান মেয়ে সে।’ আহমদ মুসা বলল।
মি. আহমদ মুসা, আজই প্রথম বুঝলাম আমার মেয়ে এখন আর সেই ছোট্টটি নেই, অনেক বড় হয়েছে। এমন কিছু প্রসঙ্গ সে আলোচনায় এনেছে, যে সম্পর্কে আমার তেমন কিছু জানা নেই। মি. আহমদ মুসা অনেক আশা আমার এ মেয়েকে নিয়ে। আপনি তাকে আশীর্বাদ করুন।’ বলল প্রেসিডেন্ট।
‘আল্লাহ তাকে অনেক বিদ্যা, বুদ্ধি, জ্ঞান দান করুন এবং কল্যাণের পথ যেন সে পায়। একটা কথা মি. প্রেসিডেন্ট, আপনার মেয়ে যে পোশাক পরেছে, সে রকম পোশাক কি আপনাদের পরিবারে পরা হয়?’ আহমদ মুসা হাসল। হাসল প্রেসিডেন্ট। কিছু বলতে যাচ্ছিল প্রেসিডেন্ট।
সারা সোনিয়া তার আগেই মুখ খুলেছে। বলল, ‘জবাবটা আমিই দিচ্ছি স্যার।’
মুহূর্তের জন্যে থেমে বলল, ‘স্যার, এ পোশাক আমাদের বাড়ির নয়। বাড়িতে আমরা হয় জার্মান, নয়তো আমাদের বুরুন্ডিয়ান পোশাক পরি। আমি যে পোশাক পরেছি, সেটা জার্মানির এক মুসলিম বান্ধবী আমাকে গিফট করেছিল। এক ঈদ উৎসবে আমি তাদের বাড়ি গিয়েছিলাম। সেই ঈদে সে আমাকে এই পোশাক গিফট করে। আমি সেদিন এ পোশাকটি পরেছিলাম। মাথায় ওড়নাসহ এ পোশাকটি পরে তখন আমার খুব ভালো লেগেছিল। ছুটির দিনগুলোতে কখনো কখনো আমি এ পোশাক পরে বাইরে যাই। কারো তির্যক দৃষ্টি, কারো কারো চোখের বিস্ময় এবং অনেকের সাদর সম্ভাষণ আমার জন্য তখন খুব উপভোগ্য হয়। সবচেয়ে ভালো লাগে মুসলমানদের কাছ থেকে যখন সালাম পাই। সালামের জবাবও দিয়ে থাকি আমি। আপনার মনে প্রশ্ন সৃষ্টির জন্যই আপনার সাথে সাক্ষাতের পোশাক হিসেবে এই পোশাক আমি বেছে নিয়েছি। আমার সৌভাগ্য যে, সত্যই আপনার মনে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে।
‘শুধু প্রশ্ন সৃষ্টি হওয়া নয়, খুশিও হয়েছি সোনিয়া। তবে তুমি যেটা পরেছ সেটা পাকিস্তানী মেয়েদের পোশাক। সেখান…।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে সারা সোনিয়া বলে উঠল, ‘এটা- মুসলিম পোশাক নয়?’
‘বলতে পারো এটা পাকিস্তানী মুসলমানদের পোশাক। মুসলিম পোশাক বলে বিশেষ ডিজাইনের কোনো পোশাক নেই।’ বলল আহমদ মুসা।
‘মুসলিম বা ইসলামী পোশাক বলে তাহলে কিছু নেই?’ সারা সোনিয়া বলল।
‘না, নেই। তবে ইসলাম মানুষকে একটা শালীন, শোভন ও নিরাপদ পোশাকের একটা ‘ড্রেস কোড’ দিয়েছে, এই ড্রেস কোড অনুসারে যে পোশাক তৈরি হয়, তাকে ইসলামী পোশাক বলা যায়।’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যরি স্যার, বিরক্ত করছি। সেই ‘ড্রেস কোড টা কি?’ বলল সারা সোনিয়া।
‘এর উত্তরে অনেক কথা বলতে হয়। বরং ভালো হয় এটা তুমি তোমার জার্মান বান্ধবীর কাছ থেকে জেনে নিও। এ ব্যাপারে সংক্ষেপ কথা হলো, মেয়েদেরকে তার সৌন্দর্যের স্থানগুলো ঢেকে রাখতে হবে এবং ছেলেদেরকে অশ্লীলতা বা অসৌজন্যের পর্যায়ে পড়ে এমন স্থান ঢেকে রাখতে হবে।’ বলল আহমদ মুসা।
‘পোশাক পার্সোনাল চয়েজের বিষয়। এই বিষয়ে কোন আইনি হস্তক্ষেপ মানুষের অধিকার হরণ করে?’ সারা সোনিয়া বলল।
‘না সোনিয়া, কারো কোনো কাজ যখন অন্যের চোখকে, মনকে প্রভাবিত করে, আহত করে, তখন তা পার্সোনাল বিষয় থাকে না। বলল আহমদ মুসা।
‘এমনটা কি ঘটেছে স্যার?’ প্রশ্ন সারা সোনিয়ার।
‘তুমি বার্লিনের রাস্তায় যখন ঘুরো, কোনো বিচে যাও, তখন অনেক দৃশ্য থেকে তোমার চোখ লজ্জায় সরে আসে কিনা?’ বলল আহমদ মুসা।
সারা সোনিয়ার মুখ লজ্জায় কিছুটা আড়ষ্ট হলো। মুখ নিচু করে বলল, ‘তবু মানুষের স্বাধীনতা আমরা মেনে নেই।’
‘এটা মেনে নেয়া অপরাধ। কারণ এটা অপরাধের বিস্তার ঘটায়।’ বলল আহমদ মুসা।
সারা সোনিয়া কিছুটা চুপ থেকে বলল, ‘আপনি যা বলতে চাচ্ছেন, কিছুটা বুঝেছি স্যার। কিন্তু ভাবছি, আপনাদের ইসলাম এত বাস্তববাদী, এতটা জীবনধর্মী?’
‘ইসলাম তো আমাদের নয়, সব মানুষের। আল্লাহ মানুষকে আহ্বান করেছেন তাঁর ডাকে সাড়া দেয়ার জন্যে। যারা তার ডাকে সাড়া দেয়, তাদেরই নাম দেয়া হয়েছে ‘আত্মসমর্পিত’ বা ‘মুসলিম’।
কথা শেষ করেই আহমদ মুসা তাকাল প্রেসিডেন্টের দিকে। বলল, ‘এক্সিলেন্সি, আমি এখন উঠব অনুমতি পেলে।
প্রেসিডেন্ট জবাব দেয়ার আগেই সারা সোনিয়া বলল তড়িঘড়ি করে, ‘স্যার, জানার আগ্রহ আমার বাড়িয়ে দিলেন। এখন অনেক প্রশ্ন এসে আমার মাথায় ভিড় করেছে।’
‘মা, শুধু তোমার মাথায় নয়, আমার মাথায়ও কিছু জরুরি প্রশ্ন এসে জমেছে। কিন্তু আহমদ মুসাকে তো আটকানো যাবে না। সে কাজের মানুষ। তার প্রতিটা মুহূর্ত মূল্যবান। এসো তাকে আমরা বলি, তিনি যেন আমাদের জানার এই আগ্রহ পূরণের ব্যবস্থা করেন। থামলো প্রেসিডেন্ট।
‘এমন সুযোগ আছে। আমি চেষ্টা করব এক্সিলেন্সি।’ বলল আহমদ মুসা।
প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল। বলল, ‘ধন্যবাদ মি. আহমদ মুসা এই মূল্যবান প্রতিশ্রুতির জন্য। ধন্যবাদ আমাদেরকে এই আতিথ্যের সুযোগ দেয়ার জন্যে।
আহমদ মুসা ও সারা সোনিয়াও উঠে দাঁড়িয়ে ছিল।
আহমদ মুসা বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলো।
লিফট পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আহমদ মুসাকে পৌঁছে দিল। আর সারা সোনিয়া এগোলো আহমদ মুসার গাড়ি পর্যন্ত। গাড়ির দরজা খুলে আহমদ মুসাকে গাড়িতে উঠিয়ে দিল। বলল, ‘হ্যান্ডশেক করতে খুব ইচ্ছা করছে, আমাদের একটা কালচার তো এটা। কিন্তু তাতো এখন হবার নয়।’ হাসতে হাসতে বলল সারা সোনিয়া।
‘এত কথা শোনার পর এমন হ্যান্ডশেকের ইচ্ছে কি এখনো আছে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘স্যার, আপনার ভারি কথাগুলো বুঝতে, হজম করতে আরো সময় লাগবে।’ বলল সারা সোনিয়া।
একটু থেমেই সারা সোনিয়া আবার বলে উঠলো, ‘স্যার, আপনার অন্তহীন স্মৃতির ভিড়ে অন্ধকার আফ্রিকার এই ছোট্ট বুজুমবুরাকে কি আপনার মনে থাকবে?’
‘আমার জীবনে হাজারো বুজুমবুরা রয়েছে, তাদের কাউকেই আমি ভুলিনি। সুজলা সুফলা সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাময় আফ্রিকার ঐতিহ্যবাহী বুজুমবুরাকেও ভুলবো না ইনশাআল্লাহ। আসি সোনিয়া, দোয়া করি তোমার মতো সোনিয়ারা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শোষিত আফ্রিকায় মুক্তির সফেদ আলো প্রজ্জ্বলিত করুক।’
‘ধন্যবাদ, সালাম আলাইকুম।’ বলে সারা সোনিয়া ভারাক্রান্ত মুখে একখণ্ড হাসি টেনে গাড়ির দরজা লাগিয়ে দিল।
গাড়ি চলতে শুরু করল আহমদ মুসার।
.
সময়টা বাদ মাগরিব।
সোফায় বসতে বসতে আহমদ মুসা ইদি আসুমানি মোহাম্মদ এবং আসমানি আব্দুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘আপনাদের অনেক ধন্যবাদ জনাব জাঞ্জিবার থেকে আশা আমার কয়েকজন মেহমানকে স্টপ ওভারের সুযোগ দেয়ার জন্য।’
‘স্টপ ওভার কেন? আমাদের মেহমান ওরা। আপনাকে ধন্যবাদ যে ওদেরকে মেহমানদারীর সুযোগ আপনি আমাদের করে দিয়েছেন।’ বলল আসমানি আব্দুল্লাহ।
‘আমাদের সে মেহমানরা কোথায়?’ আসুমানি আবদুল্লাহকে উদ্দেশ্য করে বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘আমার ঘরে তারা বসেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘দুঃখিত ভাই আহমদ মুসা। সামান্য একটু গড়বড় হয়েছে। আসুমানি আব্দুল্লাহ, আমর আসমানি মোহাম্মদ দুজনেই বাইরে ছিল। আমিও ঘুমিয়ে ছিলাম। আর ভাই আহমদ মুসা, তুমিও সময়টা জানাতে পারনি যে কখন আসছো। তার ফলেই একটু অসুবিধা হয়েছে। যাক, তুমি ওদের ওখানে না বসিয়ে সাথে করে এখানে নিয়ে আসলে ভালো হতো ভাই।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘ব্যস্ত হবেন না জনাব। ওখানে ওদের সাথে আমর মোহাম্মদ রয়েছে। আর ওরা ঠিক সেরকম মেহমান নন। ওরা আমার কাছে একটু সময় চায় কিছু কথা বলার জন্যে। যেহেতু ওদের এখানে নিয়ে এলে নিরিবিলি কথা বলার সুবিধা হয়, সেজন্যই ওদের এখানে নিয়ে এসেছি আমি। কথা বলেই চলে যাবেন ওরা।’ আহমদ মুসা বলল।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ তাকালো ছেলে আসমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘যাও মেহমানদের এখানে নিয়ে এসো। আর নাস্তা যা আছে দিতে বল।’
‘ঠিক আছে বাবা।’ বলে আসুমানি আব্দুল্লাহ উঠে দাঁড়াল। বের হয়ে গেল ড্রয়িং রুম থেকে।
অল্পক্ষণ পর আসুমানি আব্দুল্লাহ সিতি সাবেরা, আলী মুইজি, সাবেরার বাবা এবং কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীকে নিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল।
আহমদ মুসা উঠে দাঁড়ালো। প্রথমে সিতি সাবেরার বাবা ওমার আব্দুর রহমান, কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী এবং সিতি সাবেরা, মুইজিকে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ও আসুমানি আব্দুল্লাহর সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ও আসুমানি আব্দুল্লাহ এবং তাদের পরিবারের পরিচয় দিল আহমদ মুসা।’
আহমদ মুসার কথা শেষ হতেই ওমার আব্দুর রহমান, সিতি সাবেরার বাবা, উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, ‘আল্লাহু আকবার, এই ঐতিহ্যবাহী পরিবারের কথা আমি অনেক শুনেছি। বুজুমবুরার মহান মিশনারি, বুজুর্গ ওস্তাদ এবং বুজুমবুরার প্রথম মসজিদের প্রথম ইমাম ইদি আসুমানির পরিবার এটা। পরে ইউজিজির সালিহ পরিবারের সাথে যুক্ত হয়। এই সালিহ আসুমানি পরিবার বুরুন্ডির মুসলমানদের কাছে ধ্রুবতারার মতো। মহান পরিবারটির সাথে পরিচিত হতে পারায় আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করছি।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ হাত বাড়িয়ে ওমার আব্দুর রহমানের সাথে হ্যান্ডশেক করে বলল, ‘আমাদের পরিবার সম্পর্কে এত কথা আপনি জানলেন কি করে?’
‘জাঞ্জিবার নৌ বাহিনীর কমান্ডার মেজর জনাব শাকির সাঈদ সালিহ আমার প্রতিবেশী ছিলেন এবং উভয় পরিবারের মধ্যে যাতায়াত ও বন্ধুত্ব ছিল। তারা ইউজিজির অধিবাসী ছিলেন। তার কাছ থেকে এসব জানা। বলল ওমার আব্দুর রহমান।
‘তাহলে তো তোমরাও আমাদের আত্মীয় হয়ে গেলে। সালিহ পরিবার এবং আমাদের আসুমানি পরিবার তো একই পরিবার।’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। আসুমানি পরিবারের আত্মীয় হতে পারা অনেক সৌভাগ্যের।’ বলল ওমার আব্দুর রহমান।
আসুমানি আব্দুল্লাহ ড্রয়িং রুম থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। ফিরে এসেই তার বাবা ইদি আসুমানি মোহাম্মদকে লক্ষ্য করে বলল, ‘বাবা টেবিলে মেহমানদের জন্য খাবার দেয়া হয়েছে।’
‘নিয়ে যাও মেহমানদের ওখানে।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘সিতি সাবেরা তুমি অন্দরে যাও। খাওয়ার সময় সবার সাথে পরিচয়ও হয়ে যাবে। এখন এরা তোমাদের আত্মীয় পরিবার হয়ে গেলেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ঠিক তাই মা, তুমি ভেতরে যাও। চলো তোমাকে ভেতরে দিয়ে আসি।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘ধন্যবাদ’ বলে সিতি সাবেরা উঠল। তার সাথে সবাই উঠল। আহমদ মুসাও উঠল। বলল, আমি লাঞ্চ করেছি। আমি আমার
রুম থেকে একটু ঘুরে আসি এই ফাঁকে।’
‘ঠিক আছে ভাই।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
খাওয়া সেরে মেহমানরা এসে বসল ড্রয়িং রুমে।
আহমদ মুসা তখনও আসেনি।
মেহমানরা সবাই বসলে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ জিজ্ঞাসা করল ওমার আব্দুর রহমানকে, ‘প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহ রক্তারক্তির সময় আপনারা ওখানে কিভাবে এলেন?’
‘আহমদ মুসার সন্ধানে আমরা বুরুন্ডি এসেছি। কিন্তু কোথায় তাকে পাওয়া যাবে, তা আমাদের জানা ছিল না। তবে আমরা নিশ্চিত ছিলাম বুরুন্ডির ইসলামী সংগঠন ও ব্যক্তিত্বের কেউ না কেউ আহমদ মুসার সম্পর্কে অবশ্যই জানবে। সেজন্য তাদেরই একজনের খোঁজে আমি যাচ্ছিলাম বুরুন্ডির তানজানিয়া দূতাবাসে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে এসে ঝামেলার মধ্যে পড়ে যাই।’
‘আপনারা যেভাবে এসেছেন, এভাবে কি আহমদ মুসার খোঁজ পাওয়া যায়!’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘তা যায় না। কিন্তু আমাদের আর কোনো বিকল্প পথ ছিল না। বুজুমবুরায় তিনি আছেন, এটুকুই আমাদের জন্য একটা বড় আশার আলো হিসেবে দেখা দেয়।’ বলল ওমার আব্দুর রহমান।
‘তাহলে তো আহমদ মুসার দেখা পাওয়া খুব জরুরি প্রয়োজন আপনাদের?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
এ সময় আহমদ মুসা ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করল। তখন ওমার আব্দুর রহমান কথা বলা শুরু করেছিল। বলল সে, ‘জ্বি হ্যাঁ, খুব জরুরি প্রয়োজন।’
আহমদ মুসা বসতেই ইদি আসুমানি মোহাম্মদ আহমদ মুসাকে বলল, ‘আমি মেহমানদের সাথে কথা বলছিলাম। তারা খুব জরুরি প্রয়োজনে তোমার কাছে এসেছে ভাই আহমদ মুসা।
আহমদ মুসা তাকালো ওমার আব্দুর রহমানের দিকে। বলল, ‘আল্লাহ আমাদের সাহায্য করুন। তিনি মানুষের সব প্রয়োজন পূরণ করেন। সকল বিপদ মুসিবত থেকে তিনি মানুষকে রক্ষা করেন।
একটু থামল আহমদ মুসা। তাকালো ওমার আব্দুর রহমানের দিকে। বলল, ‘জনাব আপনাদের কথা কি এখন এখানে বলা যাবে?’
‘জি, হ্যাঁ বলা যাবে। সবাই জানলে আমাদের জন্য ভালো।’ বলল ওমার আব্দুর রহমান।
‘আলহামদুলিল্লাহ। শুরু করেন।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ওমার আব্দুর রহমানকে।
‘সে এক ভয়াবহ বিপদের কাহিনী!’ বলে কথা শুরু করল ওমার আব্দুর রহমান। ‘কিন্তু বিপদটা আমার নয় এবং বিপদটা আমাদের দেশেরও কারো নয়। বিপদটা কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর পরিবার এবং সুবর্ণ দ্বীপের মুসলমানদের। এ বিষয়ে…’
ওমার আব্দুর রহমানের কথার মাঝখানে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘এই ‘সুবর্ণ দ্বীপ’টা কোথায়? দ্বীপটা কি কোনো রাষ্ট্র?
ওমার আব্দুর রহমান তাকালো কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর দিকে। বলল, ‘এই জবাবসহ পরের কথাগুলো আপনারই বলা উচিত।’
‘ধন্যবাদ জনাব।’ বলে একটু থামলো কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী লোফার উপর একটু সামনে ঝুঁকে বসল সে। বলল, ‘আল্লাহর হাজার শোকর, মহান ভাই আহমদ মুসার সাথে দুর্লভ এই সাক্ষাৎ এবং কথা বলার সুযোগ তিনি দিয়েছেন সেজন্য। ধ্বংসপ্রায় এক জনগোষ্ঠীর হৃদয়ের সীমাহীন আকুতি তুলে ধরার তৌফিক আল্লাহ আমাকে দিন।
আবার একটু থামলো কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী। একটু মাথা নিচু করল। মুহূর্তেই আবার মাথা তুলে শুরু করল, ‘ভারত মহাসাগরের দক্ষিণপ্রান্তে চারদিকের অথৈ পানিতে লুকানো ‘সুবর্ণ দ্বীপে’ আশ্রয় গ্রহণকারী মিশনারি ও রাজনীতিক এবং বিজ্ঞ জ্ঞানসাধক ওস্তাদ আব্দুল্লাহ আল আলী বিন আব্দুর রহমানের একজন উত্তরসূরী আমি। জনাব আব্দুল্লাহ আলী বিন আব্দুর রহমান দ্বীপের সবার কাছে ‘দরবেশ’ নামে পরিচিত। দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী বিন আব্দুর রহমান স্থানীয় অধিবাসীদের সাথে মিলে দ্বীপে ইসলামী খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেন। উনিশ শতকের প্রথম ভাগে দ্বীপটি ইউরোপের উপনিবেশিক শক্তি ষড়যন্ত্র ও গণহত্যার মাধ্যমে দখল করার পূর্ব পর্যন্ত ইসলামী খেলাফত টিকে ছিল। উপনিবেশিকদের অব্যাহত হত্যা নির্যাতনের মধ্যে স্থানীয় মানুষরা এখন পশুর মতো জীবন নিয়ে বেঁচে আছে। সম্প্রতি তাদের অত্যাচার চরমে উঠেছে। স্থানীয় লোকদের নির্মূল করে সেখানে শাসকরা শ্বেতাঙ্গদের এনে বসাতে চায়। স্থানীয় অধিবাসীরা নিজেদের রক্ষার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ হবার চেষ্টা করছে। গঠিত হয়েছে ফিলিস্তিনের অনুকরণে ‘সাগর সাইমুম’। আমারই এক ভাই কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ ‘সাগর সাইমুমকে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। কিন্তু সম্প্রতি তিনি তার কয়েকজন সাথীসহ দ্বীপের শাসক ভিক্টর বাহিনীর হাতে বন্দী হয়েছেন। সেই সাথে শুরু হয়েছে স্থানীয় অধিবাসীদের নির্মূল করার ওদের প্রোগ্রাম। বন্দী আমার ভাই ও অন্যরা ততক্ষণ পর্যন্ত বেঁচে আছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তাদের কাছ থেকে সব তথ্য আদায় করা না যায়। তাদেরকে এবং স্থানীয় অধিবাসীদের রক্ষার জন্য সেখানে জরুরি সাহায্য প্রয়োজন। আমি ওআইসির মাধ্যমে কিছু করা যায় কিনা চেষ্টা করেছি। পরিচিত কয়েকটি সরকারকেও বলেছি। কিন্তু তারা এটা খুব বড় কাজ নয় মনে করে এড়িয়ে গেছে। ওআইনির সেক্রেটারি জেনারেল বলেছেন, ‘জাতিসংঘসহ গোটা পশ্চিমের সমর্থন রয়েছে দ্বীপটির বর্তমান সরকারের প্রতি। এমন কি দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য করার জন্য প্রস্তাব উঠেছে এবং নিশ্চিতই বলা যায় দ্বীপটি সদস্যপদটি পেয়েও যাবে। এই অবস্থায় কার্যকরী কিছু করার সুযোগ নেই বললেই চলে। আমি যখন হতাশ, সেই সময় জনাব ওমার আব্দুর রহমানের কাছে আপনার কথা শুনলাম যে, আপনি বুজুমবুরায় এসেছেন। এই খবর শুনে আমার মনে আশা জাগল, আল্লাহর সাহায্য হয়তো আমাদের জন্যে আসবে। এই সাহায্যের আশায় আপনার খোঁজে আমরা বুজুমবুরায় এসেছি। দীর্ঘ বক্তব্য দিয়ে থামল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী।
আহমদ মুসা গভীর মনোযোগ দিয়ে তার কথা শুনছিল। তার চোখে মুখে বেদনা ভরা গাম্ভীর্য।
কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর কথা শেষ হলে আহমদ মুসা সোফায় হেলান দেয়া অবস্থা থেকে সোজা হয়ে বসল। বলল, ‘ভাই আব্দুল্লাহ আলী, আপনার কথা অনেক প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে। প্রশ্নগুলোর জবাব পেলে ভালো হয়।’
‘প্রশ্নগুলো বলুন জনাব।’ বলল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী।
‘ধন্যবাদ কমান্ডার আলী। আমার প্রথম জানার বিষয় হলো, ভারত মহাসাগর ও কুমেরু সাগর এলাকায় মানব বসতি ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা সম্বলিত ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ নামের কোনো দ্বীপ আছে বলে আমার জানা নেই। আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন, আপনি বললেন দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী বিন আব্দুর রহমান ‘সুবর্ণ দ্বীপে’ আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাহলে জাহাজডুবি কিংবা শত্রুর তাড়া খাওয়া লোক বা লোকদের আশ্রয় নেবার প্রশ্ন ওঠে? ওস্তাদ দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী বিন আব্দুর রহমান দ্বীপটিতে আশ্রয় নিয়েছিলেন কেন? তৃতীয়ত: জানতে চাই দ্বীপটিতে মুসলিম ও আদিবাসীর সংখ্যা কত? দ্বীপ দখলকারী উপনিবেশিক শক্তি কারা? মানে তারা কোন দেশের? আর শেষ জানার বিষয় হলো, ‘সাগর সাইমুম’ নামটা আপনারা কোথায় পেলেন?’ আহমদ মুসা বলল।
আহমদ মুসার প্রশ্ন শেষ হলে কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী বলল, ‘জনাবের প্রশ্নগুলোর জবাব দিতে হলে অনেক কথা বলতে হয়। জনাব চাইলে এবং সবাই অনুমতি দিলে যে স্টোরিটা আমি বংশানুক্রমে পেয়েছি সেটা বলতে পারি। তবে শেষ প্রশ্নের জবাব হিসেবে বলছি, আমি বাবার কাছ থেকে শুনেছি ফিলিস্তিন ও মধ্য এশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামী সংগঠন ‘সাইমুম’-এর নামটাই তিনি সুবর্ণ দ্বীপে আমার ভাই এবং বর্তমানে ঔপনিবেশিকদের হাতে বন্দী কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর বাবা দিয়েছিলেন।
কর্নেল ওবায়দুল্লাহর বাবাই ‘সাইমুম’ নামের আগে ‘সাগর’ যোগ করে সুবর্ণ দ্বীপের গোপন স্বাধীনতা সংগ্রামের সংগঠনটির নাম রাখেন ‘সাগর সাইমুম’। আরেকটা কথা জনাব, সুবর্ণ দ্বীপের নাম এখন আর কেউ জানে না, আপনারাও সেই কারণে শোনেননি। ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ এখন আর তার নামে নয়। নাম বদলে ঔপনিবেশিক দখলদাররা তার নাম রেখেছে ‘ভিক্টর আইল্যান্ড রিপাবলিক’
একটু থামলো কমান্ডার আলী। সেই সুযোগে আহমদ মুসা বলে উঠল, ‘জনাব কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী আপনাদের বংশানুক্রমিকভাবে আশা সেই স্টোরিটাই আমাদের শোনান।
কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী তার সোফায় একটু নড়েচড়ে বসল। বলল, ‘সম্মানিত মহোদয়গণ, আমি যে স্টোরিটা বলব, সেটা আজকের নামহারা সুবর্ণ দ্বীপের পূর্বকথা। সেটা ক্ষুদ্র, অসহায় একটি উদ্বাস্তু মানুষের নামহীন একটা দ্বীপে অধিবাস গ্রহণ এবং সে দ্বীপের বৈরী আদিবাসীদের আপন করে নিয়ে একটি আদর্শ রাষ্ট্র গঠন এবং প্রায় ছয়শ’ বছর ধরে তার শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হবার কাহিনী।’ আবার একটু থামল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী।
সঙ্গে সঙ্গেই ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘তোমার স্টোরির এই ভূমিকা আমার আগ্রহ অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। তোমার কথা আর একটু উঁচু ভয়েজে হলে ভালো হয়। পাশে বৈঠকখানার আরেক অংশে আমাদের মেয়েরা থাকার কথা। তারা যেন তোমার স্টোরি থেকে বঞ্চিত না হয়
‘ধন্যবাদ জনাব।’ কথা শুরু করল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী, ‘আমাদের পঞ্চাশ হাজার বর্গ কিলোমিটার আয়তনের সুবর্ণ দ্বীপ ভারত মহাসাগরের কঠিন এক ঝঞ্ঝাময় এলাকায় অবস্থিত। ভারত মহাসাগরের দক্ষিণাংশে কোকো আইল্যান্ড থেকে চারশ’ মাইল দক্ষিণে কুমেরু সাগরের সেন্ট পল দ্বীপ থেকে তিনশ’ মাইল উত্তরে এবং আফ্রিকার মরিশাস ও অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিম উপকূল থেকে প্রায় সম দূরত্বের সাগরবক্ষে সুবর্ণ দ্বীপটির অবস্থান। ভারত মহাসাগরের তলদেশকে পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্তকারী উত্তর-দক্ষিণে বিলম্বিত শৈলশীরাটি সুবর্ণ দ্বীপের গা ঘেঁষে চলে গেছে। আরো দুটি দ্বিখণ্ডিত সমান্তরাল শৈলশীরা আছে দ্বীপটির কিছুটা দক্ষিণে। মধ্য ভারত মহাসাগরীয় স্রোতটি পূর্ব দিক থেকে পশ্চিমে ঘুরে দক্ষিণ কুমেরু সাগরের ঠান্ডা স্রোত ও দক্ষিণ-পূর্বের গভীর স্রোত শৈলশীরায় ধাক্কা খেয়ে দ্বিখণ্ডিত শৈলশীরাগুলোর উপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে ডিঙিয়ে এসে দুটি সমান্তরাল ধারায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে সুবর্ণ দ্বীপের উপর। ঝড় ও স্রোতের ঘূর্ণি দ্বীপের চারদিকটাকে বিপদজনক করে রেখেছে। ভারত মহাসাগরে যাতায়াতকারী জাহাজগুলো এটা জানে। তাই ভুলেও কোনো জাহাজ এদিকে আসে না।
সাগরের অবিরাম গর্জন আক্রান্ত ঝজ্ঞাপূর্ণ এই দ্বীপটিতে তখন বাস করতো দুই হাজারের মতো মানুষ। বনচারী এই মানুষদের গায়ের রং কারো সবুজাভ কালো, আবার কারো পিতাভ-বাদামী, বর্ণিও অঞ্চল ও অস্ট্রেলীয় আদিবাসীদের সাথে অনেকটাই মিল আছে তাদের।
. ত্রয়োদশ শতাব্দীর কথা। মঙ্গলদের মহাবিপর্যয়কর আগ্রাসনে বাগদাদের পতনের পর কোনো এক সময় রাজনৈতিক কারণে বিতাড়িত বা পালানো তিন হাজার নারী-পুরুষের একটা বিরাট দল নিয়ে ৭টি জাহাজের একটা বহর দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী বিন আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে ইরাকের আবাদান বন্দর থেকে জাঞ্জিবারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। পথে তারা এক প্রবল ঝড়ের কবলে পড়ে। জাহাজগুলো ভাসতে ভাসতে ঝড়-ঝঞাময় এক দ্বীপের বলয়ে গিয়ে আছড়ে পড়ে। দ্বীপ দেশটির ঘূর্ণিস্রোত টেনে নিলো জাহাজগুলোকে খড়-কুটোর মতো। ঘূর্ণিস্রোত ও ঝড়ের বিপরীত গতি সাগরকে ধ্বংসকরী করেছে। ঢেউ ও ঝড়ের কাছে জাহাজগুলো ছিল খেলনার মতো বিপর্যস্ত। ক্ষতিগ্রস্ত জাহাজগুলো ডুবে যাওয়ার উপক্রম হলো। কয়েক হাজার শিশু, নারী, পুরুষের কান্নাও ঝড় আর সাগরের গর্জনের মধ্যে হারিয়ে গেল।
দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী বিন আব্দুর রহমান তার কমান্ডিং জাহাজের একটা ঘরে নামাজে রত ছিলেন। শেষ মুহূর্তে তিনি ছুটে বেরিয়ে এলেন ডেকে। প্রায় ডুবন্ত জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে হাত তুলে অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, ‘হে সকলের মাবুদ, সকলের স্রষ্টা, প্রতিপালক ও রক্ষাকর্তা, আমাদের নৌবহরের নারী-শিশু-যুবক- বৃদ্ধ আপনার আশ্রয় চাচ্ছে। মাবুদ, আপনার ক্রোধের চেয়ে আপনার দয়া অনেক বড়। আপনার সেই দয়ারই আশ্রয় আমরা চাচ্ছি। আপনি আমাদের ধ্বংস করলে তাতে বাঁধা দেয়ার কেউ নেই, আর রক্ষা করলে তাতে বাঁধ সাধবার ক্ষমতাও কারো নেই। আপনি এক এবং একক। শরীক বিহীন। সকল রাজ্যের অধিপতি আপনিই। সকল প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতা শুধুই আপনার জন্য। আপনি সর্বশক্তিমান, সবার উপর ক্ষমতাশালী। আমাদের সব প্রার্থনা, সব চাওয়া আপনার কাছেই।
প্রার্থনা শেষ হওয়ার সাথে সাথে দরবেশ বুকফাটা কান্নায় আছড়ে পড়লেন উথাল পাথাল জাহাজের ডেকে। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললেন দরবেশ।
খালিক, মালিক আল্লাহ। অসীম ক্ষমতা তাঁর। মুহূর্তেই ঝড় থেমে গেল। শান্ত হয়ে গেল ঢেউয়ের ধ্বংসকরী উথাল পাথাল। শুধু নৌবহরের এলাকা নয়, দ্বীপটির চারপাশের গোটা সাগর শান্ত হয়ে গেল, যেন উত্তাল সাগর ঘুমিয়ে পড়লো কত শতাব্দী পর।
ধীরে ধীরে চোখ খুললেন দরবেশ। ঝড় ও সাগরের গর্জন শুনতে পেলেন না। তার জাহাজ স্থির। নৌবহরের অন্যান্য জাহাজও সারবেঁধে শান্তভাবে দাঁড়ানো। সাগরবক্ষ ঘুমন্ত। বদ্ধ জলাশয়ের মতো নিস্তরঙ্গ সাগরের পানি। উঠে বসে আবার সেজদায় চলে গেলেন দরবেশ।
দরবেশকে উঠে বসতে দেখে, বেঁচে আছেন দেখে ‘আল্লাহ আকবর’ ধ্বনি দিয়ে উঠল নৌবহরের নারী-পুরুষ সকলেই। তারাও দরবেশের সাথে সিজদায় পড়ে গেল আল্লাহর প্রতি অসীম প্রশংসা ও কৃতজ্ঞতায়।
দরবেশ দেখলেন তার কমান্ডিং জাহাজের মাথা গিয়ে স্পর্শ করেছে দ্বীপের সমতল একটা পাথুরে তীর-ভূমিতে। স্থানটা যেন একটা সুন্দর প্রাকৃতিক জেটি। সেটা দ্বীপের অভ্যন্তরে ঢোকার একটা দরজাও যেন। এর দুপাশেই উপকূল বরাবর সবুজ পাহাড়ের দেয়াল। ভেতরে তাকিয়ে দেখতে পেল গাছ-গাছালিতে ভরা সবুজ একটা দেশ। লতাপাতা ও গাছে গাছে ঝুলছে আঙ্গুর, আপেলসহ বিভিন্ন ফল। পাকা- কাঁচা পেঁপেতে ভরা পেঁপে গাছ। দূরবীন দিয়ে দেখলেন দ্বীপটা যেন ফলের একটা সাজানো ডালা। তার সাথে কয়েকটা ধান ও গমের গাছ দেখতে পেয়ে বিস্মিত হলেন দরবেশ। ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলেন দরবেশ। বললেন, ‘এটা একটা সুন্দর ‘সুবর্ণ দ্বীপ’। দরবেশের এই ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ কথা থেকেই দ্বীপের নামকরণ হয়ে যায় ‘সুবর্ণ দ্বীপ’। সম্ভবত দ্বীপের এটাই প্রথম নামকরণ।
দরবেশ নৌবহরের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘জাহাজগুলো সব নোঙর করো।’
নোঙর করা হলো সাতটি জাহাজ। সিঁড়িও পাতা হলো। কমান্ডিং জাহাজের সিঁড়িতে পা রাখলেন দরবেশ তীরে নামার জন্যে।
‘জনাব, নিরাপত্তার জন্য কিছু লোককে অস্ত্রসহ আগে নামিয়ে দিলে ভালো হতো না?’ বলল নৌবহরের প্রধান নিরাপত্তা উপদেষ্টা আবু আমর আব্দুল্লাহ। তিনি আব্বাসীয়দের সাবেক একজন সেনাধ্যক্ষ।
‘না, কোনো অস্ত্র নামবে না এই সুন্দর ‘সুবর্ণ দ্বীপে’। এই দ্বীপ আমাদের জন্য আল্লাহর দান। আমরা ইচ্ছা করে এখানে আসিনি। যিনি এনেছেন তিনি আমাদের নেগাহবান।’ বললেন দরবেশ শান্ত কিন্তু দীপ্ত কণ্ঠে।
‘কিন্তু জনাব, এ ধরনের দ্বীপে সাধারণত ভয়ানক সব আদিবাসী- রা বাস করে। সেনা অফিসার বলল।
‘যদি আদিবাসীরা এ দ্বীপে থাকে, তারা আমাদের মারবে? মারুক। আমরা তাদের মারব না। দু’হাত বাড়িয়ে ভাই হিসেবে তাদের বুকে জড়ানোর জন্য আহ্বান জানাতে থাকব। তারা আমাদের কয়জনকে মারবে? আমরা যদি পাল্টা আক্রমণ না করি, তাহলে তাদের অস্ত্র ধরা হাত একসময় নিচে নেমে যাবে। অস্ত্র নয়, ভালোবাসা দিয়ে তাদেরকে আমাদের আপন করে নিতে হবে।’ বললেন দরবেশ স্থির ও শান্ত কণ্ঠে।
আলহামদুলিল্লাহ, আপনি ঠিক বলেছেন জনাব। কিন্তু আমার একটা অনুরোধ, অস্ত্র আমাদের সাথে থাকুক। আক্রান্ত হলেও আমরা পাল্টা অস্ত্র ব্যবহার করব না, একের পর এক লোক মারা গেলেও অস্ত্র আমরা তাদের বিরুদ্ধে তুলবো না, তাতে ফল আরো ভালো হবে। আমাদের সদিচ্ছা এবং আমরা তাদের শত্রু না হবার ব্যাপারে তারা নিশ্চিত হতে পারবে।’ বলল নিরাপত্তা উপদেষ্টা আবু আমর আব্দুল্লাহ।
দরবেশ খুশি হলেন এবং আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে নিরাপত্তা উপদেষ্টাকে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আবু আমর তুমি ভালো পরামর্শ দিয়েছো।’ অস্ত্র সাথে নেবার নির্দেশ দেয়া হলো সকলকে।
দরবেশ জাহাজ থেকে সিঁড়ি দিয়ে নামলেন। পা রাখলেন অজানা, অচেনা দ্বীপের মাটিতে। তার সাথে নামল আরো অনেকে।
দ্বীপে নেমে দরবেশ কয়েক ধাপ হাঁটলেন এবং আল্লাহর প্রশংসা কীর্তন এবং রাসূল (সা.)-এর প্রতি দরুদ ও সালাম প্রেরণ করলেন। তারপর পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘আল্লাহ দয়া করে এক ঝড়ের সাহায্যে উত্তাল এক সাগর এলাকা পাড়ি দিয়ে আমাদেরকে এই দ্বীপে এনেছেন। আমরা সব হারানোর পর আল্লাহ আমাদের একটি দ্বীপ দিয়েছেন। আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের হাজার শোকর। এই দ্বীপে যদি আল্লাহর বান্দা কোনো আদিবাসী থাকেন, তাহলে তারাই এই দ্বীপদেশের আদি মালিক। আমরা ওদের ভাই হবো। ভাইয়ের অংশীদার হিসেবে এই দ্বীপের এবং এর সম্পদের প্রকৃত মালিক আল্লাহ এই দ্বীপে এনে যে অধিকার আমাদের দিয়েছেন, সেই অধিকার বলে আদিবাসীদের সাথে মিলেমিশে ইনসাফের সাথে এর ভোগ-দখল করব। সকলকে সবসময় এই কথা মনে রাখতে হবে। আল্লাহর রাসূল (সা.) মদিনার আনসারদের যে মর্যাদা দিয়েছিলেন সে মর্যাদাই তারা পাবে।
দরবেশ আব্দুল্লাহ আলী প্রসঙ্গক্রমে দ্বীপটিকে ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ নামে অভিহিত করেছিলেন। কালক্রমে সেটাই হয়ে গেল দ্বীপটির নাম। সত্যিই সম্পদের সোনায় ভরা ‘সুবর্ণ দ্বীপ’টি। চারদিকে পাহাড় ঘেরা দ্বীপটি। কর্কটক্রান্তির কিছুটা দক্ষিণে দাঁড়ানো দ্বীপটিতে গ্রীষ্ম প্রধান ও শীত প্রধান দেশের সব ফলই কম-বেশি পাওয়া যায়। আঙুর, পিচ, আপেল, আনার, আম, কাঁঠাল, পেঁপে ইত্যাদি সব ফলই এখানে জন্মে। শস্যের মধ্যে গম, সরিষা, ধান, সয়াবিন, বিভিন্ন ধরনের কলাই জাতীয় শস্য উৎপাদনের জন্য উপযুক্ত দ্বীপটির মাটি। আদিবাসীরা খাদ্যের জন্য ফলমূল ও শিকারের উপর নির্ভরশীল বলে কৃষি কাজের প্রচলন হয়নি। দ্বীপটি উঁচু-নিচু টিলা ও ছোট-বড় উপত্যকায় ভরা। সর্বত্রই গাছে গাছে ফলের সমারোহ। দরবেশের নেতৃত্বে এ অবস্থার পরিবর্তন ঘটল। আরবরা সে সময় ফল ও কৃষি উৎপাদন উভয় ক্ষেত্রেই পারদর্শী ছিল।
সুবর্ণ দ্বীপে গড়ে উঠলো সুশৃংখল এক মানববসতি। আদিবাসীরা প্রথমে মারমুখো ছিল। আট-দশ জন আরব এ সময় আদিবাসীদের হাতে নিহত হয়। কিন্তু আরবরা প্রতিশোধ নিতে এগোয়নি। বরং দুই হাত বাড়িয়ে দরবেশ তাদেরকে বন্ধুত্বের আহ্বান জানিয়েছে। পরবর্তী এক ঘণ্টায় চারজন আরব আদিবাসীদের হাতে নিহত হলে দরবেশ একাই আক্রমণে আসা প্রায় দু’শ আদিবাসীদের দিকে এগিয়ে যায় একটা গাছের ডালে সাদা কাপড় উড়িয়ে। তার সাথে তরবারি ছিল, কিন্তু তা ছিল খাপে আবদ্ধ। আদিবাসীরা তাদের হাতের বর্ষা, তীর তাক করে দাঁড়ায় দরবেশের দিকে। কিন্তু দরবেশ হাসিমুখে তাদের দিকে এগোতেই থাকে। দরবেশ সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো আদিবাসীদের সরদারের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। আদিবাসীরা চারদিক থেকে দরবেশকে ঘিরে ফেলে। দরবেশ আদিবাসীদের সরদারের সামনে দাঁড়িয়ে তরবারি খাপ থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। তারপর দুহাত প্রসারিত করে সর্দারের দিকে। সরদার কিছুক্ষণ নীরবে তাকিয়ে থাকে দরবেশের চোখের দিকে। পরে ডান হাত উপরে তুলে একটা ধ্বনি করে। সঙ্গে সঙ্গে আদিবাসীরা তাদের হাতের অস্ত্র মাটিতে ফেলে দেয়। সর্দার জড়িয়ে ধরে দরবেশকে। এরপর আদিবাসীদের হাতে আর কখনো অস্ত্র ওঠেনি আরবদের বিরুদ্ধে। ধীরে ধীরে দরবেশের পিতৃসুলভ, ভ্রাতৃসুলভ, অভিভাবকসুলভ ব্যবহার জয় করে নিল আদিবাসীদেরকে। আদিবাসীদের পাঁচশ’ পরিবার মিশে গেল আরব মুসলিম পরিবারের সাথে। দরবেশ হয়ে গেল আদিবাসীদের কাছে ‘মাথার তাজ’। উভয় গ্রুপ উভয়ের ভাষা আয়ত্ত করতে লাগল। দরবেশ আদিবাসীদের চিনিয়ে দিল তাদের এবং সব মানুষের স্রষ্টা কে, প্রতিপালক ও শেষ বিচার দিনের মালিক কে। আদিবাসীরা দরবেশের স্রষ্টাকে তাদের স্রষ্টা, প্রতিপালক ও শেষ বিচার দিনের মালিক হিসেবে গ্রহণ করল।
সময় বয়ে চলল। ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ হয়ে উঠল ইসলামী জীবন ব্যবস্থার অনুসরণে একটা আদর্শ ইসলামী রাষ্ট্র। সুবর্ণ দ্বীপের সকলে মিলে দরবেশকেই সিংহাসনে বসায়। পাথর সাজিয়ে তাতে মাটির প্লাস্টার করে তাতেই ফরাস পেতে তার জন্য বানানো হলো সিংহাসন। সিংহাসনের পেছনে কর্মচারী এবং সামনে মন্ত্রীদের বসার জায়গা। আদিবাসীদের সরদার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে দরবেশের পাশেই বসেন। দরবেশের মন্ত্রীসভার সদস্যদের অর্ধেকই আদিবাসীদের মধ্য থেকে নেয়া। আরবদের মতো আদিবাসীদের সংখ্যাও দ্রুত বাড়তে লাগল। আরব ও আদিবাসীদের মধ্যে উভয় পক্ষের ইচ্ছায় বিয়ের ব্যাপক প্রচলন হলো। রাষ্ট্রপ্রধান দরবেশ তার দুই ছেলেকে বিয়ে দেন আদিবাসী মেয়ের সাথে। সুবর্ণ দ্বীপে রাষ্ট্রপ্রধান নির্ধারণের ব্যবস্থা হয় জনসমর্থনের মাধ্যমে। আইনসম্মতভাবে দেশ পরিচালনা করলে, সকল প্রকার পক্ষপাতিত্ব ও অবিচার অন্যায় থেকে দূরে থাকলে এবং জনগণের পক্ষ থেকে অভিযোগ না উঠলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট আমৃত্যু দেশ পরিচালনায় থাকার ব্যবস্থা হয়। তাকে বা তাদের সরে যেতে হলে অথবা ইন্তেকাল করলে নির্বাচনের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট, ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। রাষ্ট্রে সবার সমান অধিকার, সব ক্ষেত্রে সবার সমান সুযোগ নিশ্চিত করা হয়। রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা ছিল খোদায়ী আইন ও জনপ্রতিনিধিদের প্রণীত আইনের উপর ভিত্তিশীল। রাষ্ট্রপ্রধানকেও বিচারকের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। স্বয়ং প্রধান বিচারপতিও যদি অন্যায় করে, তারও সাধারণ মানুষের মতো বিচার হয়। বহিঃদেশীয় সকল দ্বন্দ্ব সংঘাতে নিরপেক্ষ থাকলেও, কোনো যুদ্ধে সুবর্ণ দ্বীপ অংশ না নিলেও রাষ্ট্রে এই ব্যবস্থা সিরিয়াসলি চলে আসছে যে, দেশের সবাই একই সাথে মিশনারী এবং সৈনিক। তাই সকলের জন্যে আত্মরক্ষার ট্রেনিং অপরিহার্য। এর সাথে সাথে সুবর্ণ দ্বীপ হয়ে উঠল বর্ধিষ্ণু অর্থনীতির দেশ। আদিবাসীরা ফলমূল ও শিকারের গোশত খেয়ে জীবনধারণ করত। আরবরা এসে ফসলের চাষ শুরু করল। সেচ ও খাবার পানির ব্যবস্থা করল তারা। আরব দেশগুলো থেকে রাজনৈতিক কারণে বিতাড়িত বা পালানো লোক ছাড়াও ভাগ্যান্বেষী লোকরাও এসে সুবর্ণ দ্বীপে আশ্রয় নিল। অনেকে ব্যবসায় বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে আসতে লাগল। সুবর্ণ দ্বীপের চারদিকের ভয়ংকর সাগর শান্ত হয়ে পড়ায় সবার জন্য আকর্ষণের একটা কেন্দ্র হয়ে দাঁড়াল এই ‘সুবর্ণ দ্বীপ’। কৃষি পণ্য ও ফলমূল বিপুল পরিমাণে রপ্তানি হতে লাগল। আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করল দরবেশের সরকার। দ্বীপ রাষ্ট্রটিকে স্বনির্ভর করা দরবেশ সরকারের অর্থনীতির লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াল।
বয়ে গেল সাতশ বছরের দীর্ঘ সময়। সুবর্ণ দ্বীপ তখন একটা পরিণত রাষ্ট্র। রাজধানী ‘সুবর্ণ নগর’ এখন একটা আন্তর্জাতিক নগরী। সুবর্ণ দ্বীপে বিমান ও বিমানবন্দর না থাকলেও সমুদ্রপথে প্রায় সব দেশের সাথে যোগাযোগ গড়ে উঠেছে, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোর সাথে। সুবর্ণ দ্বীপের নৌবন্দর ‘নিউ জেদ্দা’ ও ‘নিউ আদন’ তখন এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোর কাছে খুবই পরিচিত এবং সমুদ্র পথের নাবিকদের কাছে আকর্ষণের একটা কেন্দ্র হয়ে উঠেছে।
সুবর্ণ দ্বীপ সকলের কাছেই শান্তিবাদী একটি শান্তির দ্বীপ। শান্তিরক্ষার একটা সামান্য ব্যবস্থা ছাড়া বড় ধরনের কোনো মারণাস্ত্র সুবর্ণ দ্বীপে ছিল না। বাইরের কোনো সাতে-পাঁচে না থাকা একটা নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে সব দেশই সুবর্ণ দ্বীপকে ভালো চোখে দেখে। কিন্তু সুবর্ণ দ্বীপের শান্তিবাদিতা এবং তার আত্মরক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকা এবং কাউকেই ক্ষতিকর হিসেবে না দেখার মানসিকতাই একসময় সুবর্ণ দ্বীপের জন্যে কাল হয়ে দাঁড়ালো। সময়টা তখন পশ্চিমা দেশগুলোর বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ স্থাপনের কাল। বাণিজ্য বহরের সাথে জলদস্যুদের নৌবহর ছিল সাগরে তৎপর। সুযোগ পেলে তারা যেমন বাণিজ্যবহর লুট করত, তেমনি বিচ্ছিন্ন দ্বীপ এবং ছোট ও দুর্বল দেশও ছিল তাদের লুটতরাজের শিকার। ‘সাগর সংঘ’ নামে একটা জলদস্যু সিন্ডিকেট অনেকদিন থেকে চোখ রাখছিল সুবর্ণ দ্বীপের দিকে। ‘সাগর সংঘে’র মধ্যমণি ভিক্টর দি গ্রেট। বলা হয় সে ইউরোপের কোনো এক দেশের রাজ্য বঞ্চিত রাজা ছিল। তার ছিল নিজস্ব বিমান, তার সেনাবাহিনী ছিল কামান, বন্দুক ও অন্যান্য অস্ত্রে সজ্জিত। দৃশ্যত এরা ঘুরে বেড়ায় তাদের বাণিজ্যবহর নিয়ে এদেশ থেকে সেদেশে। সুযোগ পেলেই এরা মুখোশ খুলে ফেলে ছোট ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রসহ বড় বড় বাণিজ্যবহরও লুট করে। এই ‘সাগর সংঘে’র ভিক্টর দি গ্রেটের টার্গেট হয়ে দাঁড়ায় সুজলা-সুফলা সমৃদ্ধ এবং চারদিক থেকে বিচ্ছিন্ন ‘সুবর্ণ দ্বীপ’। অনেক ভেবে চিন্তে ভিক্টর দি গ্রেট ঠিক করে স্থায়ী বসতির জন্য সুবর্ণ দ্বীপের মতো’ বিচ্ছিন্ন একটি বড় দ্বীপই তাদের দরকার। যাযাবরের মতো কতদিন আর সাগরে ঘুরে বেড়াবে। সাগরে তো আর রাষ্ট্র গঠন করা যায় না। এই সুবর্ণ দ্বীপই তাদের চাই। বিভিন্ন দেশ ও দ্বীপে ছড়ানো-ছিটানো তাদের সম্পদকে তারা নিয়ে আসবে এই সুবর্ণ দ্বীপে। তখন ‘সুবর্ণ দ্বীপ’-এর (Golden Island) নামটাও সার্থক হবে।
‘সাগর সংঘ’ প্রস্তুতি নিল।
এক অমাবস্যার কালরাতে হাজার হাজার দস্যু সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল দস্যু নেতা ভিক্টর দি গ্রেট। কামানের গুলিবৃষ্টির আড়ালে সাগর সংঘের হাজার হাজার সশস্ত্র দস্যুসৈন্য রাতের অন্ধকারে চড়াও হলো সুবর্ণ দ্বীপের শহর ও জনপদের উপর। সুবর্ণ দ্বীপের শান্তিপ্রিয় মানুষের কাছে এটা ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো। এই বজ্রপাতে শেষ হয়ে গেল ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ রাষ্ট্রটি। ভিক্টর দি গ্রেটের প্রধান টার্গেট ছিল সুবর্ণ দ্বীপের সরকার, সংসদ, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী এবং দরবেশ আব্দুল্লাহ আলীর উত্তরসূরী পরিবারগুলো। এদের কাউকে বাঁচতে দেয়া হয়নি। দরবেশের অষ্টম প্রজন্মের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য আবুবাকার আব্দুল্লাহ আলী ছিলেন প্রেসিডেন্টের দায়িত্বে। তার এক ছেলে ছাড়া আর কেউ বাঁচেনি। তার বেঁচে যাওয়া পুত্র জুবায়ের বিন আব্দুর রহমান নিউ জেদ্দা বন্দর উপকূল রক্ষী বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। তিনি আহত অবস্থায় কয়েকজন সহকর্মী নিয়ে একটা দ্রুতগামী জাহাজে করে হানাদার সাগর সংঘের ব্যারিকেডকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পেরেছিলেন। তার পরিবার রাজধানী সুবর্ণ নগরে থাকায় তাদের সাথে নেয়া সম্ভব হয়নি। আবু জুবায়েররা কয়েকজন ছাড়া সুবর্ণ দ্বীপ থেকে আর কেউ পালাবার সুযোগ পায়নি। দরবেশের উত্তরসূরী পরিবারগুলোর আর একজন শিশু পুত্র মাত্র বেঁচেছিল। সে শিশু এই নৌ কমান্ডার জুবায়ের বিন আব্দুর রহমানেরই তিন বছর বয়সের পুত্র আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের। জুবায়ের বিন আব্দুর রহমানের বাড়ির সিকিউরিটি চীফ আহমদ শরীফ মুমূর্ষ অবস্থায় শিশুটিকে উদ্ধার করে কোনোরকমে পালাতে পারেন। এই শিশু আব্দুল্লাহ বিন জুবায়েরের বংশধর কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ। যিনি এখন দখলদার ভিক্টর সরকারের হাতে বন্দী। স্যরি, কাহিনীর সংক্ষেপিত মূলধারা থেকে একটু সরে গিয়েছিলাম।’
বলে একটু থেমে কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী আবার কথা শুরু করতে যাচ্ছিল। এই সময় ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর পরিচয় পূর্ণ তো হলো, কিন্তু তোমার সাথে তার সম্পর্কটা স্পষ্ট হলো না।’
কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী একটু হেসে বলল, ‘বলছি জনাব। আমি কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহর দাদার ভাইয়ের নাতি। আমার দাদার নাম ছিল হামজা বিন জুবায়ের।
কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী ‘কথা আর বেশি বাকি নেই’ বলে তার মূল কাহিনী আবার শুরু করল।
‘সুবর্ণ দ্বীপ দখল হওয়ার আরও ১০০ বছর পর। সুবর্ণ দ্বীপের নামটাও তারা পাল্টে ফেলেছে। নতুন নাম দ্বীপ দখলকারী ভিক্টর দি গ্রেটের নাম অনুসারে ভিক্টর আইল্যান্ড। ভিক্টর আইল্যান্ড এখন হয়ে উঠেছে বর্ণবাদী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য। ভিক্টর দি গ্রেট নিজে আগ্রাসী ছিলেন, কিন্তু বর্ণবাদী ছিলেন না। বর্ণবাদী মানসিকতা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে তার উত্তরসূরীদের শাসনে। ইউরোপ, আমেরিকা, চীন, রাশিয়া সবদেশ থেকে বর্ণবাদী সন্ত্রাসীদের এবং নতুন রিক্রুটদের এনে এই সুবর্ণ দ্বীপে তাদের ট্রেনিং দেয়া হয় ও মোটিভেশন করা হয়। তারপর তারা পরিকল্পনা অনুসারে বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। এরা নব্য নাজী’তে রূপান্তরিত হয়েছে। বিশ্বের সব ধর্ম, সব শান্তিবাদী রাষ্ট্রের জন্যে এরা বিপদজনক হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বিপদে পড়েছে সুবর্ণ দ্বীপের আরব ও আদিবাসী মুসলিম জনগোষ্ঠী। তারা কোনো বাদ-প্রতিবাদে না থাকলেও, রাজনীতির কোনো পক্ষ-বিপক্ষ না হলেও তারা রেহাই পাচ্ছে না। তাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে উঠেছে। অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই অবশেষে তারা জেগে উঠেছে। সুবর্ণ দ্বীপের আত্মগোপনকারী, নির্যাতিত নেতারা আত্মরক্ষা ও অধিকার আদায় এবং নিজেদের সংঘটিত করার জন্য ফিলিস্তিন ও মধ্য এশিয়ায় ‘সাইমুম’-এর অনুকরণে ‘সাগর সাইমুম’ গঠন করেছে। এই সাগর সাইমুমকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য দরবেশ আব্দুল্লাহ আলীর বংশধর আমার দাদার বাবা সুবর্ণ দ্বীপ থেকে সরে পড়তে পারা- জুবায়ের বিন আব্দুর রহমানের সুবর্ণ দ্বীপে থেকে যাওয়া শিশুপুত্র আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের নাতি সুবর্ণ দ্বীপের ভিক্টর সেনাবাহিনীর কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহকে আহ্বান জানানো হলো। তিনি সেনাবাহিনীর চাকরি ছেড়ে দিয়ে ‘সাগর সাইমুম’-এর কমান্ড গ্রহণ করলেন। এর পরের কাহিনী শুরুতেই বলেছি যে, কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ এখন ভিক্টর সরকারের হাতে বন্দী। তার জীবনসহ ‘সাগর সাইমুম ও সুবর্ণ দ্বীপের’ অবশিষ্ট মুসলিম বসতির অস্তিত্ব আজ বিপন্ন।’
আহমদ মুসা কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘ভাই কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী, তুমি বললে সুবর্ণ দ্বীপে বন্দী কর্নেল ওসামা ওবায়দুল্লাহ তোমার ভাই। তার দিকের পরিচয় জানলাম, কিন্তু তোমার দিকের পরিচয় মানে তোমরা জাঞ্জিবারে আসলে কবে, কিভাবে তা জানা গেল না।’
‘বলছি জনাব। আমার দাদার বাবা জুবায়ের বিন আব্দুর রহমান তিনি দরবেশ আব্দুল্লাহ আলীর বংশধর এবং তিনি ও তার কয়েকজন সাথীই মাত্র বেঁচে পালাতে পেরেছিলেন সুবর্ণ দ্বীপ থেকে। তিনি সুবর্ণ দ্বীপ নৌবাহিনীর একজন কমান্ডার ছিলেন। তিনি প্রথমে আশ্রয় নেন মরিশাসে। সেখান থেকে যান মাদাগাস্কারে। সেখানে গিয়ে তিনি নানা সূত্রে সুবর্ণ দ্বীপের গণহত্যার খবর পান। মুসলিম দেশগুলো তখন ঔপনিবেশিকদের কবলে। সাহায্যের কোনো আশা নেই কোথাও থেকে। তিনি অবশেষে ট্যাঙ্গানিকা (আজকের তানজানিয়া) উপকূলের জাঞ্জিবারে আশ্রয় নেন। আবাস গড়েন তিনি সেখানেই। এর ১০ বছর পর তিনি বিয়ে করেন এক আরব পরিবারে। তিনি এখানে দ্বিতীয় সন্তান ‘হামজা বিন জুবায়ের আব্দুর রহমান’কে পান, প্রথম সন্তান ছিল সুবর্ণ দ্বীপের আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের। হামজা বিন জুবায়ের আমার দাদা।’
কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী একটু থেমেই আবার বলে উঠল, ‘আমার স্টোরি এখানেই শেষ মুহতারামগণ।
আহমদ মুসা কথা বলার জন্য মুখ খুলছিল।
এই সময়ই তার মোবাইলটা বেজে উঠল। মোবাইলের কল ওপেন করল আহমদ মুসা। ওপ্রান্তের কথা শুনেই বলে উঠল, ‘নাদা ডেনিসা কেমন আছ? খুশি হয়েছি তোমার কল পেয়ে।’
‘আমি এবং আমরা সবাই ভালো আছি। নেতাকে কল করতে পারা কর্মীদের জন্য আনন্দের।’ বলল নাদা ডেনিসা ওপ্রান্ত থেকে।
‘নেতা বলো না, ভাই বলো। ভাইয়ের খোঁজ খবর তুমি রাখ, এজন্য ধন্যবাদ।’ আহমদ মুসা বলল।
‘বোনের মর্যাদা দেয়ার পর ধন্যবাদ দেয়া মানায় না। বোনের তো অপরিহার্য দায়িত্ব ভাইয়ের খোঁজ নেয়া ‘
একটু থেমেই আবার বলল নাদা, ‘একটা জরুরি বিষয় নিয়ে টেলিফোন করেছি ভাই। বিষয়টা হলো, আমাদের পূর্ব কঙ্গোর বামপন্থী একটা রেবেল গ্রুপ আজ রাতে আপনাদের বাসায় যাচ্ছে এক অপারেশনে। লক্ষ্য হলো, আপনিসহ বাসার সবাইকে হত্যা করা। ওদের…।’
নাদার কথার মাঝখানেই আহমদ মুসা বলল, ‘ভাড়া করেছে কে তাদের?’
ব্ল্যাক ক্রস তাদের ভাড়া করেছে। ব্ল্যাক ক্রসের ওরা পাগল হয়ে গেছে। আপনাকে হত্যা করা ছাড়া তাদের মাথায় আর কিছু নেই।’ বলল নাদা।
‘কিন্তু দুঃখিত নাদা, আমাকে হত্যার বিষয়টা ওদের হাতে নেই, এটা একেবারেই আল্লাহর হাতে। আমার উপর বা আমার বাসায় তারা আক্রমণ চালাতে পারে।’ আহমদ মুসা বলল।
‘তাও তারা পারবে না। আমরা ওদের পেছনে আছি। আমরা একটু দেরিতে জানতে পেরেছি যে, আপনি এবং আপনার বাসা ওদের টার্গেট। ওরা অপারেশনে যাত্রা করার পর আমরা জানতে পেরেছি। আপনাদের বাসার সামনেই ওদের ধরে ফেলব আমরা আশা করছি।’
মুহূর্তকালের জন্য থেমেই আবার বলে উঠল, ‘স্যার। স্যরি, ভাই, আপনার কোনো চিন্তা করতে হবে না। আমাদের অনুরোধ, সতর্ক হয়ে আপনারা বাড়ির ভেতরে থাকুন। কেউ দয়া করে বের হবেন না। ওরা যতজন গেছে, তাদের থেকে আমরা সংখ্যায় বেশি। আমরা দুই ভাই বোন রাস্তার দুদিক থেকে ওদের ঘিরে ফেলব।’
‘ধন্যবাদ, আমাদের বাড়ির ঠিকানা তোমরা পেলে কি করে?’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিকানা ওদের কাছ থেকে জোগাড় করেছি। ভাই, অনুমতি দিলে আমি মোবাইল রাখতে চাচ্ছি। আমরা এসে গেছি। আল্লাহর কাছে আমাদের জন্য দোয়া করুন। বলল নাদা।
‘ঠিক আছে বোন। আল্লাহ আমাদের তোমাদের সকলকে সাহায্য করুন।
বলে আহমদ মুসা মোবাইলের কল অফ করে দিল। ইদি আসুমানি মোহাম্মদসহ সকলেই আহমদ মুসার দিকে উগ্রীবভাবে তাকিয়ে ছিল। আহমদ মুসার কিছু কথা শুনে তারা বুঝেছিল গুরুতর কোনো বিষয়ে কথা হয়েছে।
আহমদ মুসা মোবাইলের কল অফ করতেই ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল, ‘কিছু ঘটেছে ভাই?’
‘ঘটেনি জনাব, ঘটতে যাচ্ছে। ব্ল্যাক ক্রস এখানে পরাজিত হবার পর পূর্ব কঙ্গোর একটা সন্ত্রাসী গ্রুপকে ভাড়া করেছে আমাদের হত্যার জন্য। ওরা হত্যার মিশন নিয়ে আমাদের এই বাড়িতে আসছে এই……।’
আহমদ মুসার কথার মাঝখানে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘আসছে মানে আজই এই রাতে আসছে?’ তার কণ্ঠে উদ্বেগ।
‘জ্বি জনাব, কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। টেলিফোনের কথায় তাই মনে হলো।’ একটু থামল আহমদ মুসা।
তার একটু থামার সুযোগে আসুমানি আব্দুল্লাহ দ্রুত প্রশ্ন করল, ‘কে টেলিফোন করেছিল জনাব? সন্ত্রাসীদের কেউ?’
‘না সন্ত্রাসীদের কেউ নয়। পূর্ব কঙ্গোর একটা বিদ্রোহী গ্রুপের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে। সেই গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড নাদা ডেনিসা আমাকে টেলিফোন করেছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আপনি কি ভাবছেন? আমাদের এখন করণীয় কি? পুলিশকে কি এখনই জানানো দরকার নয়?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল প্রায় অস্থির কণ্ঠে।
‘পুলিশকে খবর দেয়ার প্রয়োজন নেই। আমাদের কিছু করণীয় নেই। যা করার ইনশাআল্লাহ নাদা ডেনিসারাই করবে। আমাকে মোবাইলে নাদা ডেনিসা এ কথাই জানিয়েছে। তারা সন্ত্রাসী গ্রুপটার পিছু নিয়েছে। সন্ত্রাসীরা আমাদের উপর আক্রমণের আগেই নাদা ডেনিসারা সন্ত্রাসীদের উপর দু’দিক থেকে আক্রমণ চালাবে। তারা আমাদের অনুরোধ করেছে সতর্ক হয়ে আমরা যেন বাড়ির ভেতরেই থাকি, কেউ যেন বের না হই। বলল আহমদ মুসা।
‘তুমি ওদের উপর নির্ভর করতে পার নিশ্চয়ই?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘আল্লাহ ভরসা। আমি মনে করি ওদের কথার উপর নির্ভর করা যায়। ওরা ব্যর্থ হলে আমরা তো আছিই। আল্লাহ আমাদের সাহায্য করবেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কিন্তু জনাব, মাত্র একটি পরিচয়ের কারণে আমাদের সাথে এক রক্তক্ষয়ী সংঘাতে ওরা নিজেদের জড়াবে কেন?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘জাম্বিয়াতে এক ঘটনায় আমি নাদা ডেনিসার জীবন বাঁচিয়েছিলাম। হয়তো সে কারণেই তারা আমাদের সাহায্য করতে চায়।’ বলল আহমদ মুসা গম্ভীর কণ্ঠে।
কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। কিন্তু ব্রাশ ফায়ারের অব্যাহত শব্দের মধ্যে তার কন্ঠ ডুবে গেল। যেন এক সমান্তরাল রেখার দুই প্রান্ত থেকে গর্জে উঠেছে অনেকগুলো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
তুমুল গোলাগুলি শুরু হলো।
আহমদ মুসা বলল, ‘গুলি চলছে দুই পক্ষ থেকেই। তবে প্রথম যারা গুলি করা শুরু করেছে তাদের গুলির শব্দই বেশি ভারী।
আহমদ মুসা ছাড়া সবার চোখে মুখেই দারুণ উৎকণ্ঠা।
উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী বলল, ‘প্রথম কারা গুলি শুরু করেছে বলে আপনি মনে করেন?’
‘আমি নিশ্চিত, নাদা ডেনিসারা মানে আমাদের পক্ষের লোকেরাই প্রথম গুলি শুরু করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
আমাদের পক্ষের লোকদের গুলি-গোলাকে ভারি বলছ কেন আহমদ মুসা?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘তাই অনুমান করছি জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
মিনিট দশেকের মধ্যেই গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল।
‘এতক্ষণে তো পুলিশ আসার কথা।’ বলল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী।
‘সাধারণত পুলিশ এ ধরনের ঘটনার পরেই এসে থাকে। ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
কিছু বলতে যাচ্ছিল আহমদ মুসা। কিন্তু তার মোবাইল বেজে উঠল।
মোবাইল তুলে নিল আহমদ মুসা। দেখলো নাদা ডেনিসার কল।
‘হ্যালো নাদা, ধন্যবাদ তোমাকে এবং তোমাদেরকে। মোবাইল মুখের কাছে নিয়েই বলল আহমদ মুসা।
‘কি জন্য ধন্যবাদ ভাইয়া?। নাদা বলল।
‘তোমাদের মিশন সফল হওয়ার জন্য এবং তোমাদের দ্বারা আল্লাহ আমাদের বিরাট সাহায্য করলেন- এজন্য ধন্যবাদ। কিন্তু কিভাবে এত তাড়াতাড়ি মিশন শেষ করলে? সেটা বল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘না ভাই এখন নয়, পরে বলব। পুলিশ এসে গেছে। আমরা চলে যাচ্ছি।’ নাদা বলল।
‘আমাদের সাথে দেখা না করে চলে যাবে?’ বলল আহমদ মুসা।
‘দেখা না করে চলে যেতে মন চাচ্ছে না। কিন্তু পরিস্থিতি ভালো নয়। অযথা আমরা পুলিশের ঝামেলায় জড়াতে চাই না।’
মুহূর্তের জন্য থেমে আবার বলল, ‘ভাই দোয়া করবেন। আমাদের ওখানে আপনার যাওয়ার দাওয়াত কিন্তু বাতিল হয়নি। আমি রাখছি ভাইয়া। সালাম।’ নাদা কল অফ করে দিয়েছে।
আহমদ মুসা মোবাইল রেখে বলল, ‘শুভ সংবাদ। পুলিশের ঝামেলা এড়িয়ে নাদারা চলে যেতে পারল।’
‘এদিকের খবর কি?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ওরা যুদ্ধ জয় করেছে।’ বলল আহমদ মুসা।
সবাই ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠল।
ঘটনা নিয়ে কথা চলতে লাগল। পাঁচ মিনিটও পার হয়নি। কলিং বেল বেজে উঠল।
‘পুলিশ এসেছে। জনাব আসমানি আব্দুল্লাহ আপনি বাইরের দরজা খুলে দিন। আমরা আসছি।’ বলল আহমদ মুসা।
‘পুলিশ? আপনি কি করে জানলেন?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল। ‘সামনের রাস্তার উত্তর, দক্ষিণ দু’প্রান্ত থেকে পুলিশের বাঁশির শব্দ পাওয়া গেছে। আপনারাও শুনেছেন।’ বলল আহমদ মুসা।
‘বাঁশির শব্দ শুনেছি। কিন্তু ওরা যে আমাদের বাড়ির দরজায় এত তাড়াতাড়ি এসে গেছে তা বুঝিনি। পুলিশকে তো আমাদের এ বাড়ির ঠিকানা জানানো হয়নি।’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
‘জানানো হয়নি। কিন্তু ওরা মানে গোয়েন্দারা আমাদের ফলো করেছে। জেনে গেছে ওরা আমাদের ঠিকানা।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ফলো করেছে কেন?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ বলল।
তার কণ্ঠে কিছুটা উদ্বেগ।
‘চিন্তার কোনো কারণ নেই জনাব আসুমানি আব্দুল্লাহ। আমাদের নিরাপত্তা দেয়া ওদের টার্গেট ছিল। আমাদের দ্বারা সংঘটিত একটা বড় ঘটনার পর এটা স্বাভাবিক ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ’! বলে অসুমানী আবদুল্লাহ বাইরের ঘরের দরজার দিকে চলে গেল।
.
একে একে পুলিশের ঊর্ধ্বতন অফিসারসহ পুলিশ প্রধানও আসুমানি আব্দুল্লাহদের বৈঠাখানায় এসে গেছে।
আসুমানি আব্দুল্লাহদের বাড়ির সামনের রাস্তাসহ আশেপাশের এলাকায় বেশ বড় ঘটনা ঘটে গেছে। বিশ্বজোড়া সংগঠন ব্ল্যাক ক্রসের প্রধান কলিন ক্রিস্টোফারসহ বাইশ জন সশস্ত্র লোক মারা গেছে। পুলিশ প্রধানসহ ঊর্ধ্বতন পুলিশ অফিসারদের সবারই মুখ বিমর্ষ। এত বড় একটা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, কিন্তু তাকে সংঘাত, সংঘর্ষ বলা যাচ্ছে না। কারণ সংঘাত, সংঘর্ষ প্রমাণ করতে হলে তো আরেকটি পক্ষ থাকা দরকার। কিন্তু সেই পক্ষকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না কোথাও। যারা মরেছে, তারা একপক্ষের লোকই মরেছে, অস্ত্র যা পাওয়া গেছে, তা যে কেবল একপক্ষেরই তাও প্রমাণিত হয়েছে। দ্বিতীয় বা আরেকটি পক্ষের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই অবস্থায় দায় এসে পড়ছে পুলিশের উপর। কিন্তু ঘটনায় ব্ল্যাক ক্রস প্রধান নিহত হবার পর একটা পক্ষ হবার দায় সরকার নিতে চাচ্ছে না। বিশেষ করে যখন নিহত লোকদের বা সন্ত্রাসীদের কোনো অ্যাকশন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তারা কাউকে আক্রমণ করেছে, কোনো বাড়ির উপর চড়াও হয়েছে বা কাউকে আহত অথবা হত্যা করেছে, তার কোনো চিহ্ন নেই, সেটা কোনোভাবে প্রমাণ করা যাচ্ছে না।
বিমর্ষ পুলিশ প্রধান আহমদ মুসার দিকে গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘মি. আহমদ মুসা স্যার, আপনিও তো ঘটনাস্থল দেখে এলেন। সেখানে দুই পক্ষের সংঘাতের কোনো চিহ্ন নেই। বলা যেতে পারে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে সেটাকে সংঘাতের ঘটনা হিসেবে সাজানো হয়েছে। ব্ল্যাক ক্রস প্রধান এই ঘটনায় নিহত হবার পর এই হত্যাকাণ্ডের দায় সরকার নিতে চায় না। এখন কি করণীয় আমরা বুঝতে পারছি না। স্যার, আপনি বা আপনার লোকজন কি ঘটনার একটা পক্ষ হতে পারেন?’
হাসল আহমদ মুসা। তারপর গম্ভীর হয়ে উঠল তার মুখ। বলল আহমদ মুসা, ‘সমস্যার সমাধান আমার কাছে আছে। কিন্তু তার আগে বলুন, ঘটনার যে অবস্থান ও প্রকৃতি তাতে আমার মতো একজন কেউ কি এই ঘটনা ঘটাতে পারে? আর আমার এমন লোকজন কি বুজুমবুরায় আছে বলে আপনারা মনে করেন?’
‘স্যার, আমি যা বলেছি সেটা সত্য হলে খুশি হতাম? কারণ, আপনি স্যার এ পর্যন্ত সন্ত্রাসীদের মোকাবিলা করেছেন। আজও যদি সেটাই ঘটতো, তাহলে আমরা সমস্যা থেকে বেঁচে যেতাম। গোটা দুনিয়া একে স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করত। আমরা দুঃখিত স্যার যে তা হয়নি। আমি যেটা বলেছি, সেটা কথার কথা। এখন বলুন স্যার সমস্যার কি সমাধান আপনি দেবেন?’ পুলিশ প্রধান বলল।
‘আমি কিছু বলছি না। আমার মোবাইলের একটা কল রেকর্ড বাজাচ্ছি, আপনারা শুনুন।’ বলে আহমদ মুসা তার মোবাইলের কল রেকর্ড অপশনে গিয়ে একটা কল রেকর্ড বাজিয়ে দিল।
কল রেকর্ডটির প্লে চলতে লাগল।
পুলিশ প্রধানসহ পুলিশের সব অফিসার উৎকীর্ণ।
অল্প কিছুটা শুনেই সবাই তাকালো আহমদ মুসার দিকে। তাকালো পরস্পরের প্রতি।
যতই সামনে এগোতে লাগল কল রেকর্ডের প্লে, পুলিশের সবার চেহারা পাল্টে যেতে লাগল। বিমর্ষতার অন্ধকার কেটে গিয়ে মুখে আনন্দ উজ্জ্বল্য ফিরে এলো।
প্রথমটা শেষ হবার পর দ্বিতীয় আরেকটা কল রেকর্ডের প্রে শুরু হলো।
অন্য একটি কল রেকর্ডিং প্লে।
এ কল রেকর্ডটি আগেরটার চেয়ে ছোট।
কল রেকর্ডটি শেষ হবার সাথে সাথে পুলিশ প্রধান লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। দুই হাত জোড় করার ভঙ্গিতে হাত উপরে তুলে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘স্যার, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আমরা সমস্যার সমাধান পেয়ে গেছি। আপনি আমাদের সরকারকে বাঁচিয়েছেন, আমাদের বুরুন্ডিকে বাঁচিয়েছেন।’ বসে পড়ল পুলিশ প্রধান।
বসেই বলে উঠল, ‘স্যার বুঝলাম, ওরাও কঙ্গোরই একটা দল। কারা ওরা? আপনার এমন ভক্ত হলো কি করে?’
আহমদ মুসা নাদা ডেনিসা মেয়েটাকে বাঁচানোসহ খুব সংক্ষেপে পুলিশ প্রধানের প্রশ্নের উত্তর দিল।
‘স্যার, আপনি বিরাট ভাগ্যবান। আপনি পরশপাথরের মতো। আপনি যেমন গোল্ড, তেমনি যারা আপনার সংস্পর্শে আসে তারাও গোল্ড হয়ে যায়। কঙ্গোর একটা সন্ত্রাসী দলকে আপনি বদলে দিয়েছেন স্যার।’
কথাটা শেষ করে মুহূর্তকাল থেমেই আবার বলে উঠল, ‘স্যার প্লিজ, আপনাদের কথোপকথনের রেকর্ড দুটি আমার মোবাইলে ট্রান্সফার করে দিন। এ ডকুমেন্টটা আমাদের দরকার হবে।’
আহমদ মুসা অল্প হেসে বলল, ‘আপনি আপনার মোবাইলটা চেক করুন।’
পুলিশ প্রধান তার মোবাইল দেখে নিয়ে আহমদ মুসার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ধন্যবাদ স্যার। কল রেকর্ড দুটি ডকুমেন্ট কপি আকারে আমার মোবাইলে এসেছে। অনেক ধন্যবাদ স্যার, যা ভাববার তার সবকিছুই আপনি আগাম ভাবতে পারেন।’
পুলিশ প্রধান তার সহকারী প্রধানের দিকে একপলক তাকিয়ে চোখ ফিরাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘স্যার, আপনি অনুমতি দিলে আমরা উঠতে পারি। লাশ সব উঠিয়ে নেয়া হয়েছে। সব আলামত জব্দ করা হয়েছে। সুরতহাল অবস্থার বর্ণনা ও ছবি দুইই রেকর্ড করা হয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে এলাকাটা ধুয়ে মুছে পরিষ্কার করে ফেলা হবে। আমরা ১১জন পুলিশের একটি দল রেখে যাচ্ছি, আপনাদের বাড়ির চারপাশসহ এলাকাটিতে সার্বক্ষণিক টহল দেবার জন্যে।
পুলিশরা বিদায় নিয়ে চলে গেল।
ড্রয়িং রুমে বসে থাকলো আহমদ মুসা, আসমানি আব্দুল্লাহ, সিতি সাবেরার বাবা আবু ওমার আব্দুল্লাহ ইয়ামানি, কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী এবং আলী মুইজি। সিতি সাবেরা মেয়েদের সাথে পাশের ঘরে রয়েছে। তারাও ড্রয়িং রুমের আলোচনা শুনেছে।
একটু বসেই আসুমানি আব্দুল্লাহ আহমদ মুসাকে বলল, ‘আমি একটু ভেতর থেকে আসছি জনাব।’
আসমানি আব্দুল্লাহ উঠে দাঁড়াচ্ছিল।
আসুমানি আব্দুল্লাহর ছেলে আমর আসুমানি আব্দুল্লাহ এ সময় দৌড় দিয়ে ড্রইং রুমে প্রবেশ করল। বলল তার বাবাকে লক্ষ্য করে, ‘দাদু সবাইকে ভেতরের ড্রইং রুমে যেতে বলেছেন।
‘তাহলে প্লিজ সবাই চলুন ভেতরে। বাবা নিশ্চয়ই খুব উদ্বেগে আছেন। কি ঘটলো তিনি মনে হয় জানতে চান।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘ঠিক আছে সবাই উঠুন। আমি এবং কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী দু’মিনিট পরে আসছি।’ আহমদ মুসা বলল।
‘ঠিক আছে জনাব, আমি অন্য সবাইকে নিয়ে যাচ্ছি।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
আসুমানি আব্দুল্লাহ সিতি সাবেরার বাবা আবু ওমার আব্দুল্লাহ এবং আলী মুইজিকে নিয়ে ভেতরে চলে গেল।
‘তেমন কিছু কথা নয় ভাই কমান্ডার, আমি আপনাদের পরিবার সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিলাম। জাঞ্জিবারে আপনার পরিবারে কে কে আছে?’ আসুমানি আব্দুল্লাহ প্রশ্ন করল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীকে।
বাবা, মা নেই। জাঞ্জিবারে আমার ফুফু ও খালা আছেন। আর আমার বাড়িতে ছোট দুই ভাই-বোন এবং কয়েকজন কাজের লোক আছেন।’ বলল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী।
‘কেন স্ত্রী নেই?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘নেই।’ সলজ্জ কণ্ঠের সংক্ষিপ্ত উত্তর আব্দুল্লাহ আলীর।
‘কেন নেই? বাগদত্তা কিংবা চিন্তার মধ্যে কেউ নেই?’ জিজ্ঞাসা করল আহমদ মুসা।
‘তাও নেই জনাব।’ বলল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী।
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘বোঝা যাচ্ছে, কোনো শক্ত অভিভাবক আপনার নেই। আমি কি অভিভাবকত্ব করতে পারি?’
সলজ্জ হাসি কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর মুখে। বলল, ‘স্যার, সেটা আমার সৌভাগ্য
‘এই আসুমানি পরিবার আপনার কেমন লাগছে?’ জিজ্ঞাসা আহমদ মুসার।
‘ভালো স্যার। আগেও শুনেছিলাম এদের কথা।’ বলল আব্দুল্লাহ আলী।
‘ধন্যবাদ। চলুন যাই।’ আহমদ মুসা বলল।
‘চলুন।’
বলে আহমদ মুসার সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী। হাঁটা শুরু করে বলল, ‘স্যার, এদের পরিবার সম্পর্কে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন কেন?’
হাসল আহমদ মুসা। বলল, ‘দেখি আপনার অভিভাবকত্ব করা যায় কিনা। আপত্তি নেই তো?’
কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর মুখ কিছুটা লাল হয়ে উঠেছে লজ্জায়। বলল, ‘আপনার এই চিন্তাই আমার কাছে বিরাট সৌভাগ্যের ব্যাপার স্যার।’
‘আবারও ধন্যবাদ। এই তো আমরা এসে গেছি।’ বলল আহমদ মুসা।
ড্রয়িং রুমের দরজায় দাঁড়িয়েছিল আসুমানি আব্দুল্লাহ।
আহমদ মুসাদের স্বাগত জানিয়ে ভেতরে নিয়ে বসাল।
আহমদ মুসা বসতেই ইদি আসুমারি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘ভাই আহমদ মুসা, আল্লাহর হাজার শোকর। এবারও তিনি আমাদেরকে রক্ষার নিমিত্ত বানালেন তোমাকে। শুনলাম, ২২ জন যারা মারা গেছে, তাদের মধ্যে নাকি ব্ল্যাক ক্রস-এর প্রধান কলিন ক্রিস্টোফারও রয়েছেন। কি বল তুমি, এবার কি তাহলে আমাদের বুজুমবুরার আকাশ থেকে দুর্যোগের মেঘ কাটল?’
‘আমি আশা করছি জনাব। ওদের আজকের আক্রমণের টার্গেট আমি ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সামনে ওদের সর্বাত্মক আক্রমণের যে ঘটনা ঘটেছে তারও টার্গেট ছিলাম আমি। এরপর আমি মনে করি বুজুমবুরা আর ওদের টার্গেটে থাকবে না।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এতটা আস্থার কথা কেমন করে বলছ ভাই?’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘জনাব, ওদের টার্গেট শিফট হলে ওদের লক্ষ্যও শিফট হবে, সেটাই স্বাভাবিক।’
বিস্ময়ের এক ভাব ফুটে উঠল ইদি আসুমানি মোহাম্মদের চোখে মুখে। সোজা হয়ে বসতে চেষ্টা করে কিছু বলার জন্য মুখ খুলল। ঠিক এ সময় আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠল।
আহমদ মুসার মোবাইলে কল আসার সাথে সাথে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ থেমে গেল। বলল, ‘কল রিসিভ কর ভাই, জরুরি কল হতে পারে।’
‘জি জনাব, প্রধানমন্ত্রীর কল।’ বলেই কল রিসিভ করল আহমদ মুসা।
কুশল বিনিময়ের পর ওপারের কথা শুনলো আহমদ মুসা।
যেভাবে আহমদ মুসা বলল, ‘মি. প্রাইম মিনিস্টার, আজ দুপুরে এবং এই রাতে যে বড় বিজয় এসেছে, তাতে প্রকৃতই আমার কৃতিত্ব নেই। শক্তি সাহস, জ্ঞান, আল্লাহ আমাদের দিয়েছেন এবং তিনিই এই বিজয় এনে দিয়েছেন। আমি আপনার সাথে একমত, আল্লাহ বুজুমবুরা, বুরুন্ডিকেও দুর্যোগ মুক্ত করবেন। তবে আমি দুঃখিত মি. প্রাইম মিনিস্টার, আগামী রাতের প্রেসিডেন্টের ডিনারে আমি যেতে পারছি না। কালকেই কোনো এক সময় আমি বুজুমবুরা ছাড়ছি।’
আবার ওপ্রান্তের কথা শুনতে লাগলো আহমদ মুসা।
এদিকে ঘরে উপস্থিত ইদি আসুমানি মোহাম্মদ, আসুমানি আব্দুল্লাহর মুখ বিস্ময় ও বেদনায় ছেয়ে গেছে। পর্দার ওপারে মেয়েদের মধ্যেও একই অবস্থা।
প্রধানমন্ত্রীর কথা শোনার পর আহমদ মুসা বলল, ‘আমি আমার অপারগতার জন্য আপনাদের কাছে ক্ষমা চাচ্ছি মি. প্রাইম মিনিস্টার। আমার প্রোগ্রাম স্থির হয়ে গেছে। কালকে কোনো এক সময় আমি জাঞ্জিবারে পৌঁছব। সেখান থেকে আমার যাত্রা দক্ষিণ ভারত মহাসাগরের কোনো এক দ্বীপে নতুন অভিজ্ঞতার অন্বেষায়। আল্লাহ চাইলে আবার দেখা হবে আপনাদের সাথে।
আরো কিছু কথা শেষে শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর কল অফ হয়ে গেল। মোবাইল পকেটে পুরে তাকালো আহমদ মুসা ইদি আসুমানি মোহাম্মদের দিকে।
বিস্ময় বেদনায় নির্বাক তখন ইদি আসুমানি মোহাম্মদ এবং আসুমানি আব্দুল্লাহ।
‘জনাব অনুমতি দিলে একটা কথা আমি বলতে চাই।’ বলল আহমদ মুসা ইদি আসুমানি মোহাম্মদকে লক্ষ্য করে।
‘কি বলবে সেটা পরে, কিন্তু তুমি কি বললে? কি শুনলাম আমি!’ ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
‘আমার চলে যাবার কথা বলছেন? আসলে তো যেতেই হবে। সেই যাওয়াটা কালকেই যেতে হচ্ছে জনাব।’ বলল আহমদ মুসা।
‘কেন যেতে হচ্ছে? এইভাবে হঠাৎ? তুমি আহত। তোমার কথা সত্য হলে যুদ্ধ সবে শেষ হতে যাচ্ছে। তুমি আমাদের জন্যে অনেক করেছ। আমাদেরকে কিছুই করতে দেবে না?’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। কান্নারুদ্ধ তার কণ্ঠ।
‘স্যরি জনাব। এইভাবে আমি মানুষকে কষ্ট দিয়ে থাকি। আমিও কষ্ট পাই না, তা নয়। কিন্তু আল্লাহর ইচ্ছা ছাড়া কিছুই ঘটে না। আমি এখানে এসেছিলাম, কেউ আমাকে ডাকেনি। আল্লাহর ইচ্ছাতেই আমি এসেছি। আবার আমি চলেও যাচ্ছি, কেউ আমাকে যেতে বলেনি। আমি মনে করি আল্লাহর ইচ্ছাতেই সর ঘটে থাকে।’ বলল আহমদ মুসা।
চোখ মুছল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। বলল, ‘তুমি যা বললে ভাই তার উপর কোনো কথা নেই? আমরা সকলেই আল্লাহর ইচ্ছার অধীন। কিন্তু তারপরও কি কালকেই চলে যাওয়াটা এড়ানো যায় না?’
‘কিন্তু জনাব, কালকে এবং তারপরের দিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। বরং কালকের পরের দিনের যাওয়াটাই আমাদের জন্য আরও কষ্টদায়ক হতে পারে। অতএব আমার অনুরোধ আমার যাওয়াটাকে স্বাভাবিকভাবে নিলে আমি কষ্ট কম পাবো।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ, আহমদ মুসা ভাই। তুমি যেমন মাঠের রাজা, তেমনি কথার রাজাও। সত্যি আহমদ মুসা, আমি বা আমাদেরই ভুল। তোমাকে আসার জন্য ডাকতে হয় না, আবার চলে যাবার জন্য অনুমতিরও প্রয়োজন নেই। তারপর ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ তোমাকে ডেকেছে। তোমাকে আটকানো ঠিক নয়, বুঝতে পারছি আহমদ মুসা।’
থামল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। তার দুচোখ থেকে নেমে এলো দুফোঁটা অশ্রু।
আবারও চোখ মুছল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ, ‘বলো আহমদ মুসা, তুমি কি যেন বলতে চাচ্ছিলে।’
‘দুঃখিত জনাব, আপনাদের আমি কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু…।’ আহমদ মুসার কথার মাঝখানেই ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলে উঠল, ‘আহমদ মুসা, তোমার কষ্ট পাওয়ার প্রয়োজন নেই। তোমার জন্য যেটা কষ্টের, আমাদের জন্য তা আনন্দের, সৌভাগ্যের। আল্লাহই আমাদের এ সৌভাগ্য দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ, এখন বলো তোমার কথা আহমদ মুসা।’
‘জনাব, আমাকে মাফ করবেন, আমার কথা কিছুটা অনধিকার চর্চার মতো শোনাবে। আমাদের কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর অনেক অভিভাবকের মধ্যে আমিও একজন। সে অবিবাহিত। আমি তার জন্য কনে খুঁজছি। আপনি কি আমাকে সাহায্য করতে পারেন?’ বলল আহমদ মুসা।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদের চোখে মুখে একটা বিস্ময়, একটু ভাবনা। তারপরেই তার মুখে এক টুকরো হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘আহমদ মুসা, আমিও একটা পাত্র খুঁজছি। তবে আমাকে কয়েক মিনিট সময় দাও আহমদ মুসা, তোমার প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য।’
বলেই ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ছেলে আব্দুল্লাহকে বলল, ‘চলো আব্দুল্লাহ একটু ভেতর থেকে আসি।’
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ এবং আসমানি আব্দুল্লাহ ভেতরে চলে গেল।
ওরা চলে যেতেই সিতি সাবেরার বাবা আবু ওমার আব্দুল্লাহ ইয়ামেনি হাসিমুখে আহমদ মুসাকে বলল, ‘কি ব্যাপার জনাব, একদম সরাসরি ঘটকালী।’
‘হ্যাঁ জনাব! আমাদের কমান্ডার ভাইটি ইসলামের আইনের উপর, সামাজিক বিধানের উপর এবং নিজের উপর জুলুম করছেন। বিয়ে না দিয়ে তাকে জাঞ্জিবারে ফিরতে দেব না। জাঞ্জিবার এতদিনও তাকে কনে দেয়নি, বুজুমবুরা নিশ্চয়ই দেবে, ইনশাআল্লাহ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘এই ঘোরতর লড়াই অবস্থার মধ্যেও আপনি এদিকটা লক্ষ্য করেছেন? অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। একটা বড় কাজ আপনি করছেন।’ আবু ওমার আব্দুল্লাহ বলল।
কথা শেষ করেই কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর পিঠ চাপড়ে বলল, ‘কি ভাবছো ইয়াং ম্যান? আর কেউ নয় এবার স্বয়ং আহমদ মুসা তোমাকে ধরেছেন নড়বার কায়দা নেই।’
লজ্জা বিজড়িত ব্ৰিত কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলীর মুখ। বলল, ‘স্যার আমার কথা ভেবেছেন, এটাই আমার সৌভাগ্য। তবে আমার কাছে সবচেয়ে আনন্দের বিষয় হলো, স্যার আমাদের ‘সুবর্ণ দ্বীপে’ যাচ্ছেন। নিজেই এত দ্রুত এত বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, এটা আমার এবং আমাদের সবার কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। এটা আল্লাহর সাহায্য আমাদের জন্যে।’
কথাবার্তা, আলাপ-আলোচনা চলল আরও কিছুক্ষণ। ইদি আসুমানি মোহাম্মদ ও আসুমানি আবদুল্লাহকে আসতে দেখে কথা থেমে গেল।
এবার ইজিচেয়ার নয়, সোফায় গিয়ে বসল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। তার পাশেই বসলো তার ছেলে আসুমানি আব্দুল্লাহ।
বসেই ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, কনে পাওয়া গেছে। এখন করণীয় বলো।’
‘কনের পরিচয় পেলে ভালো হয়। এটা জানা বরের তো হক বলল আহমদ মুসা হাসিমুখে।
কনেকে তুমি জানো। বর এবং অন্য সবার জন্য বলছি, কনে আমার একমাত্র নাতনি সামিরা সাদিয়া, অল্প কিছুদিন হলো বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতায় ঢুকেছে। ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল।
আহমদ মুসাসহ সবাই বলে উঠল ‘আলহামদুলিল্লাহ’।
মুখ নিচু করলো কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী।
‘ভাই আহমদ মুসা, তুমি তো একটা বড় ঘটনার সূচনা করলে, তা তোমাকেই শেষ করতে হবে। কিন্তু তুমি কাল তো চলে যাচ্ছ।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
‘আমি সূচনা করে গেলাম। আপনারা সবাই মিলে এটা সম্পন্ন করবেন। আপনাদেরই এটা দায়িত্ব।’ আহমদ মুসা বলল।
ভাবছিল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ এবং আসুমানি আব্দুল্লাহ দুজনেই।
.
ড্রইংরুমের দরজায় এসে দাঁড়াল সামিরা সাদিয়ার ছোটভাই আমর আসুমানি মোহাম্মদ। বলল সে, ‘দাদাজী, আপাজী বলেছেন, স্যার ‘সুবর্ণ দ্বীপ’ থেকে ফিরে আসা পর্যন্ত বিয়ে স্থগিত থাকবে।’ আমর আসুমানির কথাটা সবার উপরই ক্রিয়া করল। কেউ বিস্মিত, কেউ বিব্রত। সবাই নীরব।
নীরবতা ভেঙে ইদি আসুমানি মোহাম্মদ বলল, ‘বলো আহমদ মুসা, এখন কি করবে? কি করণীয়?’
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, জনাব, আগামীকাল বাদ জুমআ বিয়ে হবে। সবাই প্লিজ প্রস্তুত হোন।
আবার নীরবতা। সবাই বিস্মিত, কেউ কেউ আনন্দিত। জাঞ্জিবার থেকে যারা এসেছে, তাদের জন্যে এটা আনন্দের। তবে কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী অনেকটা বিব্রত। কিন্তু কারও মুখেই কথা নেই। কি বলার আছে আহমদ মুসার এই কথার উপর।’
এবারও নীরবতা ভাঙল ইদি আসুমানি আব্দুল্লাহই। বলল, ‘ভাই আহমদ মুসা, এটা কি তোমার সিদ্ধান্ত? আমাদের উপর আদেশ?’
‘মাফ করবেন জনাব, আমি আদেশ দিতে পারি না। তবে আমার সিদ্ধান্ত জানাতে পারি, যা মানা, না মানা দুই এখতিয়ারই আপনাদের রয়েছে।’ বলল আহমদ মুসা সহজ, শান্ত স্বরে।
আবার নীরবতা। একটা অস্বস্তি সবার চোখে-মুখে।
নীরবতা ভাঙল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। তাকিয়েছিল আসুমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘আব্দুল্লাহ বিয়ের আয়োজন কর। যাদের খবর দেয়া দরকার খবর দাও। রাতের মধ্যেই সবাইকে জানাও। আল্লাহর হাজার শোকর। আল্লাহ আমাদের অপার সৌভাগ্যের মালিক করেছেন। স্বয়ং আহমদ মুসা আমার নাতনীর বিয়ের অভিভাবক হয়েছেন। এর চেয়ে বড় পাওয়া আমাদের আর কিছু নেই।’
‘আমার আর একটা কথা আছে। সিতি সাবেরা এবং আলী মুইজির বিষয়ে কিছু বলার জন্যে মুহতারাম ভাই আবু ওমার আব্দুল্লাহ ইয়ামেনীর অনুমতি চাই।’ বলল আহমদ মুসা।
আহমদ মুসার কথা শুনে আবু ওমার আব্দুল্লাহ প্রথমে বিস্মিত হয়েছিল। তার পরেই তার মুখ প্রসন্ন হয়ে উঠল। বলল, ‘আমাদের মহান ভাই জনাব আহমদ মুসার ইঙ্গিত আমি বুঝতে পেরেছি। আমি খুবই আনন্দ বোধ করছি এবং নিজেদের খুব সৌভাগ্যবান মনে করছি যে, তিনি আমাদের সন্তানদের নিয়ে চিন্তা করেছেন। আল্লাহ তাকে অশেষ জাযাহ দান করুন।’
একটু থামল আবু ওমার আব্দুল্লাহ। সঙ্গে সঙ্গেই আবার বলে উঠল, ‘আমি একটু সময় চাচ্ছি। আমি আলী মুইজির বাবার সাথে একটু কথা বলতে চাই এ নিয়ে।’
‘অবশ্যই জনাব। ওদের সাথে কথা বলুন। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া তাদের হক। আমি প্রস্তাব করেছি মাত্র।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ধন্যবাদ।’ বলে আবু ওমার আব্দুল্লাহ মোবাইল হাতে নিয়ে ঘর থেকে বাইরে গেল।
ফিরে এলো তিন চার মিনিট পরেই।
তার আসনে বসেই বলল, ‘আলহামদুলিল্লাহ, ও পক্ষ ভীষণ খুশি। মুহতারাম ভাই আহমদ মুসার সাথে যাতে দু’একটা কথা বলার সুযোগ পায়, এজন্যে আলী মুইজির আব্বা অনুরোধ করেছে। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছে। চেষ্টা করবেন, যদি পারেন তাহলে সকালের ফ্লাইটেই তিনি বুজুমবুরায় পৌঁছবেন।’
আহমদ মুসাসহ সবাই আলহামদুলিল্লাহ বলল।
‘তাহলে দুই বিয়েই আমরা এক আয়োজনে করে ফেলতে চাই।’ বলল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ।
সবাই বলে উঠল, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’
‘চলুন, সবাই আমরা এখন বিশ্রামে যাই। অবশিষ্ট রাতটুকু যেন আমরা আরামদায়ক ঘুমে কাটাতে পারি, আল্লাহ সে তৌফিক দিন।
ইদি আসুমানি মোহাম্মদ তাকাল ছেলে আসমানি আব্দুল্লাহর দিকে। বলল, ‘প্রয়োজনীয় টেলিফোন সেরে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাও। সকালে উঠেই কাজে লেগে পড়তে হবে। দুই বর, দুই কনে- সবার বাজারই তুমি এক সাথে সেরে ফেলবে। তোমার মা এবং বৌমাকে রাতেই লিস্ট বানাতে বলে দাও।’
উঠে দাঁড়াল ইদি আসুমানি মোহাম্মদ। লাঠিতে ভর দিয়ে সামনে এগোবার জন্যে পা ফেলল। সবাই উঠে দাঁড়াল।
আমর আসুমানি মোহাম্মদ জাঞ্জিবারের মেহমানদের নিয়ে চলল তাদের ঘরের দিকে।
সবার শেষে ড্রাইং রুম থেকে বের হলো আহমদ মুসা ও আসুমানি আব্দুল্লাহ। হাঁটতে হাঁটতে আসুমানি আব্দুল্লাহকে আহমদ মুসা বলল, ‘আমি তো কমান্ডার আব্দুল্লাহ আলী এবং মুইজি সাবেরাদের লোকাল গার্ডিয়ান। ওদের জন্য খরচ করা তো আমার হক।
দাঁড়িয়ে গেল আসুমানি আব্দুল্লাহ। চেপে ধরল আহমদ মুসার দুই হাত। বলল, ‘আল্লাহ আমাদের সুযোগ দিয়েছেন মূল্যবান এই কাজে কিছু খরচ করার, আপনি দয়া করে আমাদের বঞ্চিত করবেন না জীবনে অনেক খরচ করার তৌফিক আল্লাহ দিয়েছেন, কিন্তু এমন ভালো সুযোগ কখনো পাইনি, ভবিষ্যতে পাব কিনা জানি না। প্লিজ, আপনি আমাদের সবার জন্যে দোয়া করুন আল্লাহর দয়া এবং বরকত যেন আমরা অঝোর ধারায় পাই।’
‘জাযাকাল্লাহ। ধন্যবাদ আপনাদের।’ বলল আহমদ মুসা। হাঁটতে লাগল আবার দু’জনেই।
ড্রইংরুম থেকে বের হয়ে কিছুটা এগোতেই আহমদ মুসার সামনে এসে দাঁড়াল আনা আরিয়া। তার শরীর চাদরে জড়ানো। মুখে নেকাব। আহমদ মুসার সামনে এসে নেকাব খুলে ফেলেছে। বলল, ‘ভাইয়া আপনি কালকেই চলে যাবেন।…
কান্নায় গলা আটকে গেল আনা আরিয়ার। কথা বলতে পারল না।
‘কেঁদ না বোন। আমি যেখানে থাকি, সেই মদিনা মুনাওয়ারা তো আফ্রিকার পাশেই। তাছাড়া সামনে বেশ কিছু সময় তো আমি আফ্রিকার আশেপাশেই থাকছি।’ বলল আহমদ মুসা।
আনা আরিয়া নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ মুছে ভারি ও ভাঙা গলায় বলল, ‘ভাইয়া আপনিই তো চাওসিকোকে ইউজিজি পাঠিয়েছেন। সে জানতেই পারল না আপনি যাচ্ছেন। বাবা-মা জরুরি এক কাজে কায়রোতে গেছেন। তারা বলেছেন, তারা আপনার জরুরি সাক্ষাৎ চান।’
‘ঠিক আছে বোন। চাওসিকোকে বলে দাও সকালেই যেন চলে আসে। আর তোমার বাবা-মাকে বলে দাও কাল সকাল বা বিকালের ফ্লাইটে তারাও যাতে আসতে পারেন। কাল রাত ১২টায় আমার ফ্লাইট।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, এটা আপনার কি অবিচার। কালকে ওদের বিয়ে দিচ্ছেন, আর কালকেই রাত ১২টায় আপনি চলে যাচ্ছেন! জাঞ্জিবারের মেহমানরা কি করবেন? ওরা তো আপনাকেই নিয়ে যেতে এসেছেন!’
‘অসুবিধা নেই আনা আরিয়া। আমি কালকে যাব, আমার ওখানে কিছু কাজ আছে। ওরা পরের দিন যাবেন। ওদের যাওয়ার জন্যে কিছু আয়োজন দুই পক্ষেরই দরকার। জাঞ্জিবার ও দুদুমার দুই ঘরে দুই নতুন বউ যাবে, তাই ওদের জন্যে একটা সময় দরকার ছিল।’ বলল আহমদ মুসা।
‘ভাইয়া, বুজুমবুরা ছেড়ে যেতে আপনার মন সায় দিচ্ছে?’ আনা আরিয়া বলল। ভারী ও কাঁপা কণ্ঠ আমা আরিয়ার।
‘পাগলী বোন, এসব মনে করতে নেই। পেছনে তাকালে সামনের গতি আটকে যায়।’ বলল আহমদ মুসা হাসতে হাসতে।
‘তার মানে আমরা যারা পেছনে পড়ে গেলাম, তাদের কোনো মূল্য নেই!’ রুদ্ধপ্রায় কণ্ঠে বলল আনা আরিয়া।
‘পেছনে না তাকানোর অর্থ পেছনকে ভুলে যাওয়া নয়। সামনে চলার পথে যখন একাকিত্ব আসে, সামনে যখন কোনো সীমাহীন প্রান্তর দেখি, যখন তাকাই নীরব-নিঃসীম আকাশের দিকে, তখন আকাশের সীমাহীন চাঁদোয়ায় অতীতের সব স্মৃতি, সব ছবিকেই জীবন্ত আমি দেখি।’ বলল আহমদ মুসা। মনের কোন অতল তল থেকে উঠে আসা গভীর, শান্ত কণ্ঠ আহমদ মুসার।
ওড়না মুখে চেপে ফুপিয়ে কেঁদে উঠল আনা আরিয়া।
একটু দূরেই দাঁড়িয়ে পড়েছিল আসমানি আব্দুল্লাহ।
সে একধাপ এগিয়ে এলো আহমদ মুসার দিকে। পেছন দিকে ইঙ্গিত করে বলল, ‘জনাব, সামিরা সাদিয়া অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছে আপনাকে সালাম দেবে, দোয়া চাইবে বলে।’
পেছনে তাকাল আহমদ মুসা। কালো চাদরে আবৃতা সামিরা সাদিয়া। মাথায় কালো চাদর কপালের উপর দিয়ে মুখের উপর ঝুলে পড়েছে।
আহমদ মুসা সালাম দিতে যাচ্ছিল। তার আগেই সামিরা সাদিয়ার তরফ থেকে সালাম এলো। তার কাঁপা কণ্ঠ।
‘সামিরা সাদিয়া, আমরা সবাই মিলে যে সিদ্ধান্ত নিলাম, তা আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কবুল করুন। তোমাদের দুজনের জন্যে তা মুবারকময় হোক।’ বলল আহমদ মুসা।
‘অন্ধকার আফ্রিকার ক্ষুদ্র বুজুমবুরার অজানা অখ্যাত এক সামিরা সাদিয়ার জন্যে আপনি এতটা ভেবেছেন, তার জন্যে আমরা সবাই কৃতজ্ঞ। আল্লাহ আপনাকে এর পূর্ণ জাযাহ দিন। আর দোয়া করবেন, আপনার দেয়া সাংবাদিকতার দায়িত্ব যেন আমি পালন করতে পারি। আর…।
কথা শেষ করতে পারল না সামিরা সাদিয়া। কান্নায় ডুবে গেল তার কণ্ঠ।
‘সামিরা সাদিয়া তোমার ইচ্ছাকে আল্লাহ কবুল করুন। আজ সাংবাদিকতার পেশা মুসলমানদের জন্যে জীবন-সঞ্জীবনীর মতো গুরুত্বপূর্ণ। প্রয়োজন হলে, প্রয়োজন মনে করলে আমার সাহায্য তুমি পাবে। ভাই আব্দুল্লাহ আলীকেও আমি বলে যাব।’ বলল আহমদ মুসা। ‘অনেক ধন্যবাদ স্যার। সামান্য এক বোনকে আপনার সহযোগিতার যে আশ্বাস, তার জন্যে আল্লাহর শুকরিয়া করছি।
মুহূর্তের জন্যে একটু থেমেই সামিরা সাদিয়া বলল, ‘মাফ করবেন স্যার, একটা কথা বলতে চাই।’
‘যা বলা যায়, তা অবশ্যই বলতে পার।’ বলল আহমদ মুসা।
‘আনা আরিয়া এখনও কাঁদছে। শুনে আমারও কান্না এসেছিল। বলেছেন, আপনি কিছু ভুলে যান না। তাহলে সীমাহীন স্মৃতির দুঃসহ ভার কি আপনার জীবনকে, আপনার সামনে এগিয়ে যাবার গতিকে কষ্টকর করে না?’ সামিরা সাদিয়া বলল। তার ভেজা কণ্ঠস্বর।
আহমদ মুসা গম্ভীর হলো। বলল, ‘আল্লাহ মানুষের জীবনকে অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সমন্বয়ে সৃষ্টি করেছেন। অতীত শুধু ভার নয়, বর্তমানের চালকও। অতীত শুধু কষ্টের নয়, শিক্ষা এবং প্রেরণারও। অতীত বিষণ্নতার নয়, আনন্দেরও। সুতরাং প্রকৃত অর্থেই অতীত বর্তমানের খাজাঞ্চিখানা। অতীত হলো বর্তমান ও ভবিষ্যতের পাথেয়। ভবিষ্যতের ব্লু প্রিন্ট মানুষ অতীত দিয়েই এঁকে থাকে।’ থামল আহমদ মুসা।
‘আলহামদুল্লিাহ। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ স্যার। আপনার এক বোন আপনার কাছ থেকে অবিস্মরণীয় কিছু শিক্ষা পেল। আল্লাহ যেন এতে…।’ কথা শেষ করতে পারল না সামিরা সাদিয়া।
আনা আরিয়া দ্রুত কয়েক ধাপ এগিয়ে এসে বলল, ‘এক বোন কেন? দুই বোন অবিস্মরণীয় এ শিক্ষা পেল।
‘আলহামদুলিল্লাহ। ঠিক আছে দুই বোনই পেল।’ বলল সামিরা সাদিয়া। আনা আরিয়ার দিকে তার প্রসন্ন দৃষ্টি।
‘তা ঠিক আছে। কিন্তু ভাইয়া, সাদিয়া আপাকে বেশি ভালো কথা বলেছেন।’ আনা আরিয়া বলল। তার ঠোঁটে ছোট্ট একটা হাসি।
‘ভাইয়ার চেয়ে ‘স্যার’ই তো তার ছাত্রীকে বেশি শিক্ষণীয় কথা বলেন।’ বলল সামিরা সাদিয়া। তার ঠোঁটে কিছুটা মিষ্টি হাসি ফুটে উঠেছে।
‘কিন্তু স্যারের চেয়ে ভাইয়াই তো বড়।’ আনা আরিয়া বলল।
‘চলো, আমরা ঘরে গিয়ে ঝগড়া করি। স্যারকে যেতে দাও।’
বলে ঘুরে দাঁড়িয়ে সামিরা সাদিয়া শান্ত, গম্ভীর কণ্ঠে একটা পরিপূর্ণ সালাম দিল আহমদ মুসাকে। তারপর আনা আরিয়াকে জড়িয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করল।
আনা আরিয়া মুখ ঘুরিয়ে আহমদ মুসাকে সালাম দিয়ে বলল, ‘কাল দেখা হবে ভাইয়া।’
আহমদ মুসা ও আসুমানি আব্দুল্লাহ দুজনেই হাসল।
‘এরা বড় হয়েছে, কিন্তু মনটা ছোট বেলাতেই রয়ে গেছে।’ বলল আসুমানি আব্দুল্লাহ। স্বগত কণ্ঠস্বর তার।
হাঁটতে শুরু করল দুজনেই।