শান্তির দ্বীপে সংঘাত – ১

বুরুন্ডির প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন ইউভান অফিসের জন্যে তৈরি হয়ে এসে বসল তার স্টাডি কাম কম্যুনিকেশন কক্ষে।

সোফায় একটু গা এলিয়ে দিল। চোখ দুটিও তার বুজে এলো। তার গম্ভীর মুখে কিছুটা দুশ্চিন্তার ছাপ।

তার চিন্তা বুরুন্ডির ঘটনা প্রবাহ নিয়ে। রাজধানী বুজুমবুরায় কি ঘটছে, সেটা তার কাছে আর খুব অস্পষ্ট নয়। কিন্তু সব সংবাদ আন্তর্জাতিক প্রেসে গেল কি করে?

বাতিস্তা সান্ড্রি, স্টিফেন ফোবিয়ান, কলিন ক্রিস্টোফাররা এত পারে, তাহলে আন্তর্জাতিক এই প্রেসগুলোর মুখ তারা বন্ধ করতে পারল না কেন?

ভাবনায় ডুবে গেছে প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন।

ধীর পায়ে ঘরে প্রবেশ করল তার মেয়ে সারা সোনিয়া। বাবার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল, ‘বাবা, তুমি নিশ্চয় ঘুমাওনি?’

তার বাবা প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন ধীরে ধীরে চোখ খুলল। বলল, ‘না মা ঘুমাইনি।’ বলে প্রেসিডেন্ট সোফায় সোজা হয়ে বসল।

‘বসবো বাবা? নাকি তুমি রেস্ট নিচ্ছ?’ বলল মেয়ে সারা সোনিয়া।

সারা সোনিয়া প্রেসিডেন্টের একমাত্র মেয়ে। তিন ছেলের পর প্রেসিডেন্ট দম্পতি পেয়েছে সারা সোনিয়াকে। বাবা, মা ও ভাইদের চোখের মণি সে। চোখের মণি হলেও চোখের মণির মতো সে কালো নয়। সে তার মায়ের চেহারা পেয়েছে। তার মা জার্মান। জার্মানিতে পড়ার সময় তার বাবার সাথে তার মায়ের বিয়ে হয়। সারা সোনিয়া বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রি নেবার পর এখন পিএইচডি করছেন জার্মানিতে।

‘না মা, আমি রেস্ট নিচ্ছি না। আমি প্রোটোকলের অপেক্ষা করছি। বসো মা।’ বললো প্রেসিডেন্ট

বসলো সারা সোনিয়া সামনের এক সোফায়। বলল, ‘বাবা, সকাল থেকে তুমি খুব টেনশনে আছো বলে মনে হচ্ছে। বুরুন্ডি সম্পর্কে যে খবর বেরিয়েছে, যে খবর ব্রডকাস্ট হয়েছে, সেটাই কি কারণ বাবা?’

‘হ্যাঁ মা। নিউজের ব্লেমটা সরাসরি সরকারের ঘাড়েই এসে পড়ে।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘না বাবা, ব্লেমটা সরাসরি খ্রিস্টান সংগঠনগুলোর উপর পড়ে। পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা তাদেরই হাতে।’ সারা সোনিয়া বলল।

‘তা ঠিক মা। কিন্তু এসব দেখা, প্রতিবিধানের দায়িত্ব তো সরকারের। বলল প্রেসিডেন্ট।

‘সরকার এর প্রতিবিধান করেনি কেন? তোমরা কি জানতে না বাবা?’ সারা সোনিয়া বলল।

‘আসলেই এ ব্যাপারে আমরা একদম অন্ধকারে ছিলাম। মাত্র এক দিন আগে আমরা কিছুটা জানতে পারি। আজ মিডিয়ার মাধ্যমে সবটাই জানলাম।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘মাত্র একদিন আগে কী করে জানতে পারলে? আরো আগে জানতে পারলে না কেন? আর প্রেসই বা সব কথা কিভাবে জানতে পারল?’ সারা সোনিয়া বলল।

‘সে আর এক কাহিনী মা। আমাদের বুজুমবুরায় একজন লোক এসেছে। সে আসার পরই খ্রিস্টান সন্ত্রাসী সংগঠনের অর্জনের সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। পঞ্চাশেরও বেশি সন্ত্রাসী এ পর্যন্ত লোকটির হাতে মারা গেছে। মারা যাওয়া লোকেরা যে সন্ত্রাসী এবং তারা যে গোপন একটি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী দলের সদস্য সেটা আমরা লোকটির মাধ্যমে জানতে পারি।

বলে প্রেসিডেন্ট এ পর্যন্ত যা ঘটে গেছে তার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিল মেয়েকে।

‘লোকটির নাম কি বাবা? নিশ্চয় অসাধারণ কেউ সে হবে।’ সারা সোনিয়া বলল।

‘তার নাম সে প্রকাশ করতে চায় না। তার নাম শুধু আমিই জানি। দ্বিতীয় লোক হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছি। আমি জেনেছিলাম আমেরিকা ও চীনের প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে। তারা লোকটিকে সহযোগিতা করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেছিল। এখন দেখছি, সন্ত্রাসীরাও তাকে চেনে এবং নাম জানে। বলল প্রেসিডেন্ট।

‘আমেরিকা ও চীনের প্রেসিডেন্ট তোমাকে অনুরোধ করেছিল লোকটিকে সহযোগিতা করার জন্য। সাংঘাতিক ব্যাপার! লোকটি কে? বলো বাবা। বলতেই হবে?’

‘লোকটি তার নাম বলেছিল ‘আবু আব্দুল্লাহ’। তার পাসপোর্টেও এটাই লিখা। কিন্তু তার আসল নাম ‘আহমদ মুসা। বলল প্রেসিডেন্ট।

‘আহমদ মুসা’ চাপা উচ্চস্বরে নামটার দ্বিরুক্তি করল সারা সোনিয়া। বলেই দুহাতে মুখ ঢাকল সারা সোনিয়া তার উচ্ছ্বাস আড়াল করার জন্যে।

কয়েক মুহূর্ত। মুখ খুলল সারা সোনিয়া দু’হাতের আড়াল থেকে।

বিস্ময়, আনন্দ উপচে পড়ছে যেন তার মুখ থেকে।

‘বাবা আমি বিস্মিত হচ্ছি আহমদ মুসা আমাদের বুরুন্ডিতে, আমাদের বুজুমবুরায়! ব্যাপারটা অনেকটা আকাশের চাঁদ মাটিতে নেমে আসার মতো! বাবা, সেই সাথে আমার বিরাট আনন্দ লাগছে, তাকে চাক্ষুষ দেখার আমার বহুদিনের ইচ্ছা এবার পূরণ হতে পারে।’ সারা সোনিয়া বলল।

‘মা, তুমি কিভাবে চেনো তাকে?’ জিজ্ঞাসা প্রেসিডেন্টের।

‘বাবা, তাকে চেনার মতো ভাগ্য আমাদের নয়। পত্র-পত্রিকা ম্যাগাজিন ও ইন্টারনেট ঘেঁটে আমি তাকে জানি মাত্র। জানা থেকেই দেখার আগ্রহ। যিনি পরোপকারে হাতেম তাই, বীরত্বে রবিন হুড, তীক্ষ্ণবুদ্ধিতে শার্লকদের বহু যোজন পেছনে ফেলেছেন, সেই কিংবদন্তীকে দেখার ইচ্ছা কার হবে না, বাবা?’ বলল সারা সোনিয়া।

‘ঠিক বলেছ মা। আমরাও এমনটাই শুনেছি। গত কয়েকদিনে বুজুমবুরায় তিনি যা ঘটিয়েছেন, তার কোনো তুলনা নেই। কিন্তু তার দেখা পাওয়া ভাগ্যের উপর নির্ভরশীল। তিনি কোথায় থাকেন, আমাদের কেউ তা জানে না। তিনি টেলিফোনে যোগাযোগ করেন, প্রয়োজন হলে দেখাও করেন। কিন্তু আমরা চাইলে দেখাও করতে পারি না, যোগাযোগও করতে পারি না।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘কেন, টেলিফোনের সূত্র ধরে তার লোকেশন তো সরকার বের করতে পারে।’ বলল সোনিয়া

‘তার টেলিফোনের কোনো নাম্বার নেই মা।’ প্রেসিডেন্ট বলল। ‘এটাই হবার কথা বাবা। তার সবই অসাধারণ। তবে বুরুন্ডিকে নিয়ে যে নিউজ আইটেম ব্রডকাস্ট হলো, রিপোর্ট প্রকাশ পেল, সে বিষয় নিয়ে তার সাথে তোমার সরকারের অবশ্যই কথা হবে, দেখা হবে। তোমার সাথেও দেখা হতে পারে। এরই মধ্যে কোনোভাবে তার সাক্ষাৎ আমি পাই কিনা, সেটা তোমাকে দেখতে হবে বাবা। তাকে মাত্র তিনটি প্রশ্ন করার এবং উত্তর পাবার সময়টুকু আমি তার কাছ থেকে নিতে চাই।’ বলল সারা সোনিয়া।

‘ঠিক আছে। দেখব মা।’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘আরেকটা কথা বাবা, এই একটা খ্রিস্টান গ্রুপের অপকর্ম নিয়ে তোমরা কী ভাবছ? কী করতে চাচ্ছো তোমরা?’ সারা সোনিয়া বলল।

‘মা, ব্ল্যাক ক্রস নামের গোপন সংগঠনটি খ্রিস্টান নাম ভাঙিয়ে গোটা দুনিয়ায় কাজ করছে নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্যে। ওদের শেকড় খুব গভীরে। পশ্চিমা অনেক প্রভাবশালী সরকারের সাথে তাদের গোপন সম্পর্ক রয়েছে। সরকারগুলো তাদের পক্ষে এমনকি অর্থনৈতিক, সামরিক চাপ প্রয়োগ করতে পারে। তাদের বিরুদ্ধে আমাদের করার তেমন কিছু নেই। দুনিয়ার মানবাধিকার সংস্থাগুলো সোচ্চার হয়েছে। দেখা যাক কি হয়। আমাদের দেশের যারা, তাদের বিরুদ্ধে কিছু আমরা করতে পারি।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘বাবা, তোমরা একটা সুযোগ পেয়েছ, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে তুমি অনেক কিছুই করতে পার। এ ধরনের সুযোগ বার বার আসে না।’ সারা সোনিয়া বলল।

‘তা ঠিক মা। দেখি মন্ত্রীসভার বৈঠক ডেকেছি দুপুর দুটায়। তার আগে আমি প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে বসব। যাই করি, সবার সাথে পরামর্শ করেই করতে হবে মা।’

বলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন

উঠে দাঁড়াল সারা সোনিয়াও। বলল, ‘বাবা, চিন্তা করো না।’

‘এ পর্যন্ত আহমদ মুসা কোথাও হারেনি। যে দেশে পা দিয়েছে, সেখানেই পরিবর্তন এসেছে। আমি আশা করি বাবা আমাদের বুরুন্ডিতেও সে জয়ী হবে। সে জয়ী হওয়া মানে বুরুন্ডি জয়ী হওয়া।’

প্রেসিডেন্ট হাসল। বলল, ‘বাবাকে সাহস দেবার জন্যে যা বলছ তা যদি সত্য হয়, তাহলে আমাদের ধর্মের বিস্তার যে বন্ধ হবে মা। সেটা ভেবেছ?’

‘ষড়যন্ত্র করে, সন্ত্রাস করে ধর্মের বিস্তার ঘটাতে হবে! যে ধর্ম এতটা অসহায়, বলতে হবে তার গ্রহণযোগ্যতার দিন শেষ বাবা।’ বলল সারা সোনিয়া।

‘ধর্ম সম্পর্কে এভাবে কথা বলে না মা। এ ধর্ম তো তোমারও।’ প্রেসিডেন্ট বলল। তার কণ্ঠ গম্ভীর।

‘স্যরি বাবা। অন্য ধর্ম সম্পর্কে এমন কথা বলি না। নিজের ধর্মকে জানি বলেই এই কথা বলতে পারলাম।’ বলল সারা সোনিয়া।

প্রেসিডেন্ট আবার হাসল। বলল, ‘ওরা এসেছে, চলি মা।’

‘বাই বাবা।’ বলে সারা সোনিয়া চলল নিজের ঘরের দিকে।

.

‘টিভি ব্রডকাস্ট ও পত্রিকার রিপোর্ট মিলিয়ে একটা বিস্তারিত সামারি দাঁড় করাবার কথা ছিল, সেটা তৈরি হয়েছে?’

বলল প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে। প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুলেস হাকিজিসানা একবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল প্রেসিডেন্টকে, ‘ইয়েস এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, তৈরি হয়েছে। আমি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দু’জনেই সামারির উপর নজর বুলিয়েছি।’

‘জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনসহ দুনিয়ার মানবাধিকার সংস্থাগুলো, ওআইসি, আরবলীগ, আফ্রিকান ইউনিয়ন এবং ভ্যাটিক্যান যে বিবৃতি দিয়েছে, সেগুলো কি কম্পাইল করা হয়েছে?’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, সেগুলোরও একটা সামারি দাঁড় করানো হয়েছে।’ প্রধানমন্ত্রী বলল।

‘জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন, কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা, ওআইসি-সহ যারা বুরুন্ডিতে আসতে চাচ্ছে, তাদের সফরসূচি পাওয়া গেছে?’ জিজ্ঞাসা প্রেসিডেন্টের।

‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, সবাই যোগাযোগ করেছে, কিন্তু সফরসূচি কারোরই পাওয়া যায়নি।’ প্রধানমন্ত্রী জোসেফ হাকিজিসানা বলল।

‘তাদের আসার আগে আমাদের বেশ কিছু কাজ আছে। যাক। মি. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বারনাবি মোনিসপা, ‘ব্রডকাস্ট ও রিপোর্টের’ সামারিটা পড়ুন।

‘ধন্যবাদ এক্সিলেন্সি!’ বলে পড়া শুরু করল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, ‘পশ্চিম আফ্রিকায় খ্রিস্টান নামের সন্ত্রাসী সংস্থাগুলো ক্যামেরুনসহ কয়েকটি দেশে যে নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল, হাজার হাজার একর জমি দখল করেছিল এবং বাস্তুচ্যুত করেছিল হাজার হাজার মানুষকে, খ্রিস্টান নামের ঐ ধরনের সংগঠন মধ্য ও পূর্ব আফ্রিকা অঞ্চলে শিক্ষা ও সেবাকর্মের জাল পেতে নানা ষড়যন্ত্র, কৌশল ও চাপ প্রয়োগ করে ধর্মান্তরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কৌশল, ষড়যন্ত্র ও চাপে কাজ না হলে হত্যা ও কিডন্যাপের আশ্রয় নিচ্ছে। সাম্প্রতিককালে মুসলিমরা, বিশেষ করে প্রতিভাবান মুসলিম ছাত্র এবং প্রভাবশালী মুসলিমরা তাদের হত্যা, গুমের শিকার হচ্ছে। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরা হলো :

‘হেনরি বুফোর্ট-এর মুসলিম নাম হোসেইন মুইজি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় তাকে খ্রিস্টান নাম নিতে বাধ্য করা হয়। সে খুব ভালো ছাত্র ছিল। আর খেলাধুলায়ও ছিল অতুলনীয়। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গেমসে সাত ইভেন্টে সে প্রথম হয়ে চ্যাম্পিয়নশীপ অর্জন করে। মেডেল, ক্রেস্টসহ এক লাখ ডলার পুরস্কার পায়। চার্চ কাউন্সিলও তাকে এক লাখ বুরুন্ডিয়ান ফ্রাংক পুরস্কার দেয়। পরের দিনই সে বিকেলে তাঁর বাড়ির পাশে পার্কে তার আবাল্য বান্ধবী ও সহপাঠী সারা সুসান রোজসহ বসা অবস্থায় দুজনেই খুন হয়। সারা সুসানের মুসলিম নাম সাবিনে কেল্লাহ। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময় তাকেও নাম পাল্টাতে হয়। তাদের লাশের উপর ‘M23’ নামের একটি চিরকুট খুঁজে পাওয়া যায়। ঘটনাস্থলে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি যান। পুলিশ প্রধানও আসেন। ভিসি তার নানা কথার মাধ্যমে পুলিশকে একথা গেলাতে চেষ্টা করেন যে, কঙ্গোর সন্ত্রাসী সংস্থা ‘M23’ তাদেরকে খুন করেছে, তবে এ কথা গোপন রাখার জন্য পুলিশকে তিনি চাপ দেন। পুলিশ প্রধান মেধাবী ছাত্র হেনরি বুফোর্ট সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে চাইলে তিনি বলেন যে, পুলিশ প্রধান যেন ভিসির অফিসে যান। তার অফিসই ঠিক করে দেবে কাদের সাথে কথা বলতে হবে। হেনরি বুফোর্ট ও সারা সুসান হত্যার ঘটনার আগের কিছু ঘটনাকে চাপা দেয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে আসল অপরাধী বা অপরাধীদের আড়াল করার জন্যে। হত্যার আগের দিন সন্ধ্যায় সারা সুসান ভিসির অফিস থেকে ফেরার সময় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হেনরি বুফোর্টকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় পান। সারা সুসান লেখাপড়া ছাড়াও ভিসির অফিসে বিকেল পাঁচটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খণ্ডকালীন কাজ করেন। হেনরি বুফোর্টকে কিভাবে হাসপাতালে নেবেন- এ নিয়ে ব্যতিব্যস্ত সারা সুসান পাশের রাস্তায় ট্যাক্সি দেখে সেখানে ছুটে যান। এ সময় ওদিক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর যাচ্ছিলেন। প্রক্টর সারা সুসানের কাছে সব শুনেন। পরে ট্যাক্সিওয়ালা, প্রক্টরসহ তিনজন ধরাধরি করে হেনরি বুফোর্টকে ট্যাক্সিতে তোলেন। প্রক্টর ভাড়া ও অন্যান্য খরচের জন্য সারা সুসানকে পাঁচশ ফ্রাংক দেন। বুজুমবুরা ইভানজেনিক্যাল হাসপাতালে হেনরি বুফোর্টকে ভর্তি করা হয়। পরদিন বিকেলে হেনরি বুফোর্ট হাসপাতাল থেকে তার বাসায় যান।

হেনরি বুফোর্ট হাসপাতালের ইমারজেন্সিতে ছিলেন। ওয়ার্ডে ছিলেন- এই ঘটনার কোনো হদিস হাসপাতালে নেই। হাসপাতালের ইমারজেন্সি ও ওয়ার্ডের দুটি রেজিস্টারই গায়েব করা হয়েছে। হেনরি বুফোর্ট ভিসি সাহেবের অফিসের অদূরে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েছিলেন, সে ঘটনাও চাপা দেয়া হয়েছে। তবে ওই দিন সন্ধ্যার পর ভিসি সাহেব হেনরি বুফোর্টকে ডেকেছিলেন, কথা বলেছিলেন, কিছু দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সে বিষয়টা এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মুখে মুখে। ভিসি সাহেব যে দায়িত্ব হেনরি বুফোর্টকে দিয়েছিলেন, সে দায়িত্ব পালন না করে ভিসিকে হেনরি বুফোর্ট অপমান করেছে, তাও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বহুল আলোচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হেনরি বুফোর্টকে কি দায়িত্ব দিয়েছিলেন, সেটাও জানা গেছে। ওই সন্ধ্যার পরদিন রোম থেকে কার্ডিনাল লিও ম্যালানাস আসবেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন চার্চের উদ্বোধন ও প্রথম প্রার্থনা পরিচালনা করবেন। কার্ডিনাল লিও রোম থেকে যীশুর একটা মূর্তি নিয়ে আসবেন। ভিসির পক্ষ থেকে দায়িত্ব দেয়া হয় যীশুর মূর্তিকে বিশ্ববিদ্যালয় চার্চের যথাস্থানে নিয়ে বসাতে হবে হেনরি বুফোর্টকে। তাকে আরও দায়িত্ব দেয়া হয় কার্ডিনাল পরিচালিত বিশ্ববিদ্যালয় চার্চের প্রথম প্রার্থনাসভায় প্রার্থনার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র হিসেবে হেনরি বুফোর্টকে কিছু বলতে হবে। হেনরি বুফোর্ট এই দুই দায়িত্বের কোনোটাই পালন করতে রাজি হয়নি বা পালন করেনি। কিভাবে করবে? সে তো মুসলিম। এক নাম পরিবর্তনে বাধ্য হওয়া ছাড়া তার অন্য সব মুসলিম পরিচয় ঠিক আছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চেয়েছিল, ঐ দুই দায়িত্ব পালন করিয়ে হেনরি বুফোর্ট যে খ্রিস্টান, একথা জনসম্মুখে প্রকাশ ও প্রচার করতে। হেনরি বুফোর্ট তা হতে দেয়নি। এই পরিস্থিতিতেই হেনরি বুফোর্ট খুন হন। কঙ্গোর ‘M23’ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গ্রুপটির নেতা একটি বড় ঘটনায় ধরা পড়ে এখন আন্তর্জাতিক আদালতে বিচারের সম্মুখীন হবার পর গ্রুপটির সকল কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া গ্রুপটি বুরুন্ডির অভ্যন্তরীণ ঘটনা প্রবাহের সাথে কোনো সময় যুক্ত হয়নি। তাদের বর্তমান অবস্থায় যুক্ত হবার কোনো প্রশ্নই উঠে না। এই অবস্থায় মনে করা হচ্ছে, খ্রিস্টান নামের সন্ত্রাসীরা তাদের অপরাধ আড়াল করা এবং পুলিশের চোখ অন্যদিকে সরিয়ে নেয়ার জন্যই ‘M23’-এর ঘটনা সাজিয়েছে।’

দ্বিতীয় বিষয় হলো, ‘প্রতিভাবান ছাত্র আবিউলা আমাদী মাকা হত্যার ঘটনা। আবিউলা আমাদী মাকা মাকাম্বা কবিলার একজন মুসলিম ছাত্র। ‘আবিউলা’

‘আব্দুল্লাহ’ শব্দের একটি আফ্রিকী অপভ্রংশ। সে গতবারের সেকেন্ডারি অ্যাডভান্সড লেভেল পরীক্ষায় স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সকল রেকর্ড ভেঙে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অফার ও প্রলোভন উপেক্ষা করে বুজুমবুরা সরকারি স্টেট কলেজে সে ভর্তি হয়। স্টেট কলেজ প্রিন্সিপালের লিখিত অনুরোধে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আবিউলা আমাদীকে প্রতিদিন তিন ঘণ্টা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ব্যবহারের লিখিত অনুমতি দেন। আবিউলা আমাদী একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ব্যবহারকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের চার পাঁচজন ব্যাটনধারী ছাত্র আবিউলাকে টেনে-হিঁচড়ে বের করে নিয়ে যায়। তারা চিৎকার করে বলে, ‘প্রভু যীশুর শত্রু, মা মেরির শত্রু এই শয়তান আমাদের লাইব্রেরি ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে আমাদের তথ্য পাচার করে, আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে। এই শয়তানকে আর কোনো অপকর্ম করতে আমরা দেব না। শেষ পর্যন্ত ছেলেটি নিহত হয়। এই হত্যার ষড়যন্ত্র ও হত্যার দায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের উপর বর্তায়।

তৃতীয় বহুল আলোচিত ঘটনা হলো, ‘বুজুমবুরার সবচেয়ে প্রাচীন ও সম্মানিত আসুমানি পরিবারের দুই মেয়ে সাফিয়া সাঈদা ও সাফা সাবিয়া তাদের বাড়ির গেটের সামনে ট্রাক চাপায় নৃশংসভাবে নিহত হওয়া। এই দুই যমজ বোন সাফিয়া সাঈদা ও সাফা সাবিয়া এবারের সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাডভান্সড পরীক্ষায় যথাক্রমে প্রথম ও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিল। আবিউলার ক্ষেত্রে যা হয়েছিল, এ ক্ষেত্রেও তাই হয়, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় দুই বোনকে ছাত্রী হিসেবে পাবার জন্য নানা রকম অফার ও প্রলোভন দেখায়। কিন্তু তারা সবকিছু উপেক্ষা করে বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। ভর্তি হবার পর নিহত হবার আগের রাতে পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো প্রশাসন ভবন এলাকা থেকে করা একটা টেলিফোনে তাদের পরিবারকে থ্রেট করা হয়। বলা হয়, এর ফল ভালো হবে না। পরে জানা গেছে, ওই পুরনো প্রশাসনিক ভবনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের আশ্রয়ে খ্রিস্টান পরিচয়ের আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী সংস্থা ব্ল্যাক ক্রসের একটা গ্রুপ আড্ডা গেড়ে বসেছিল। মনে করা হচ্ছে আসুমানি পরিবারের দুই মেয়ের হত্যাকাণ্ড এই গ্রুপেরই কাজ। আসুমানি পরিবারের বড় মেয়েকেও দুইবার কিডন্যাপের চেষ্টা করা হয়। দুই ঘটনায় সন্ত্রাসীরা সবাই মারা যায়। চাওসিকোর ও আনা আরিয়ার দুই ঘটনায় যে সন্ত্রাসীরা মারা যায়, তারা এবং এরা সবাই ব্ল্যাক ক্রস গ্রুপের সদস্য। তবে এই গ্রুপ বুরুন্ডিতে SCA ( Saviour of Central Africa) নামে কাজ করছে। যেসব সন্ত্রাসী মারা গেছে তাদের কলার ব্যান্ডে মেড ইন স্টিকারে SCA বর্ণ তিনটি লিখিত আছে।

চতুর্থ ঘটনা হিসেবে চাওসিকো ও আনা আরিয়ার বিষয়টা উল্লেখ করা হয়েছে। চাওসিকো ও আনা আরিয়া ব্ল্যাক ক্রস-এর মৃত্যু ফাঁদ থেকে…..’

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে থামিয়ে প্রেসিডেন্ট ডিওডোন ডেভিন বলে উঠলো, ‘চাওসিকো ও আনা-আরিয়ার ঘটনাটা থাক। তাদের ঘটনার সবকিছুই আমরা ইতিমধ্যে জানতে পেরেছি এবং ওরা তা স্বীকার করেও নিয়েছে। এখন পড় ওদের পরবর্তী কথার সামারিটা।

‘ইয়েস এক্সিলেন্সি, পড়ছি।’ বলে আবার পড়া শুরু করলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ‘পোপ ভিক্টর ইউনিভার্সিটি অফ সেন্ট্রাল আফ্রিকা তার শিক্ষা কার্যক্রম চালাবার সাথে সাথে ছাত্রদের খ্রিস্টান দেখাবার এবং খ্রিস্টান বানাবার ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে, কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে তা প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছে। বলা হয়েছে, সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মুসলিম, খ্রিস্টান ও নানা আদিবাসী গোত্রীয় ধর্মাবলম্বী ছাত্ররা ভর্তি হয়। কিন্তু খ্রিস্টান বিশ্ববিদ্যালয় উদ্দেশ্যমূলকভাবে মুসলিম ও আদিবাসী গোত্রীয় ধর্মের ছাত্রদের বেশি বেশি ভর্তি করার চেষ্টা করে। মুসলিম ও আদিবাসী গোত্রীয় ধর্মের ছাত্রদের ভর্তির সময় নাম পাল্টাতে বাধ্য করার মাধ্যমে খ্রিস্টিয়করণের প্রথম কাজ শুরু হয়। নিজে ঠিক থাকলে নাম পাল্টালে কি আর হবে, এই চিন্তা করে অধিকাংশই সুযোগ-সুবিধার লোভে নাম পাল্টাতে রাজি হয়ে যায়। মুসলিম বা আদিবাসী যারা নাম পাল্টাতে রাজি হবে না মনে করা হয়, তাদেরকে ষড়যন্ত্রের জালে আটকে নাম পাল্টাতে বাধ্য করা হয়। চাওসিকো বিজ্ঞানের ছাত্র হিসেবে এক্সট্রা অর্ডিনারি ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র। তার রেকর্ডে মুগ্ধ হয়ে বেলজিয়ামের একটি বিশ্ববিদ্যালয় তাকে অফার দেয়। তার ভর্তির সব ফর্মালিটি কমপ্লিট হয়ে যায়। তার এয়ারলাইন্স টিকেটও হয়ে যায়। ঠিক তার ফ্লাই করার আগের রাতে তার ঘরে ডাকাতি হয়। তার শিক্ষাসংক্রান্ত সব কাগজপত্র, টিকিট ও টাকা ডাকাতরা নিয়ে যায়। তাদের বাড়ির গেটম্যান খুন হয় এবং চাওসিকো আহত হয়। চাওসিকো সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরার পর বেলজিয়ামের বিশ্ববিদ্যালয়টির সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের তরফ থেকে কোনো সাড়া পায় না। হতাশ চাওসিকো ইউরোপের যেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে তার সাবজেক্ট আছে, সেসবের সাথে যোগাযোগ করে। কিন্তু তারাও তার আবেদনে কোনো সাড়া দেয় না। আফ্রিকার দুটি বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে চেষ্টা করেও সে একই ফল পায়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, একটি শক্তিশালী পক্ষের চেষ্টাতেই ইউরোপের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও আফ্রিকার দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার ভর্তির সব দরজা বন্ধ হয়ে যায়। বিমূঢ়, বিপর্যস্ত চাওসিকো তার শিক্ষাজীবন অব্যাহত রাখার স্বার্থে বুজুমবুরার পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরনো ডাকে সাড়া দিয়ে সেখানেই ভর্তির জন্য যায়। ভর্তির সময় তার নাম পরিবর্তনে তাকে বাধ্য হতে হয়। তার বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির শুরু থেকে তাকে খ্রিস্টান বানাবার কাজ শুরু হয়ে যায়। চাওসিকোর মতো ছেলেকে যদি নাম পরিবর্তনে বাধ্য করা হয়, তাহলে সাধারণ ছেলে মেয়েদের ক্ষেত্রে কি হয় তা বলা বাহুল্য।

খোঁজ নিতে গিয়ে এই বিষয়ে এক এলার্মিং চিত্র পাওয়া গেছে। বুজুমবুরায় খ্রিস্টান কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় সেখানকার সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ে বুরুন্ডিয়ান ছাত্রছাত্রীদের খ্রিস্টান নাম অনেক অনেক কম। পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ে শতকরা আশি ভাগ বুরুন্ডিয়ান ছাত্রের আংশিক বা পূর্ণ খ্রিস্টান নাম। অথচ বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র ২০ ভাগ বুরুন্ডিয়ান ছাত্রের নাম খ্রিস্টান। বুরুন্ডিয়ান মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীর নাম পরিবর্তনের তথ্য নিয়ে দেখা গেছে তাদের অবস্থা আরো খারাপ। পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ে বুরুন্ডিয়ান মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের শতভাগ নামের মধ্যে নব্বই ভাগের নামই খ্রিস্টান। অথচ এর পাশেই দেখা যাচ্ছে বুজুমবুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাত্র দশ ভাগ বুরুন্ডিয়ান মুসলিম ছাত্র- ছাত্রীর খ্রিস্টান নাম। এই পরিসংখ্যান প্রমাণ করে খ্রিস্টান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে আংশিক বা পূর্ণ খ্রিস্টান নাম গ্রহণে বাধ্য করা হয়।

‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, রিপোর্টের সর্বশেষ অংশ পড়ছি, ‘বুরুন্ডিতে কার্যরত সন্ত্রাসীরা হত্যা, গুম ইত্যাদি ঘটনার সরকারি তদন্তে হস্তক্ষেপ করে। হত্যা, গুম ইত্যাদি বেড়ে গেলে বুরুন্ডি সরকার চেয়েছিল সিআইডি দিয়ে আগের ঘটনাসহ সব হত্যা, গুমের ঘটনার পুনঃতদন্ত করতে। কিন্তু হত্যা, গুমের সব ঘটনার সিআইডি দিয়ে পুনঃতদন্তের উদ্যোগ থেকে বিরত থাকতে সরকারকে চাপ দেয় খ্রিস্টান সংগঠনগুলো। খ্রিস্টান নামের সন্ত্রাসীরা সিআইডির বিস্তারিত তদন্তে তাদের নাম বেরিয়ে পড়বে এই ভয়েই পুনঃতদন্তের সরকারি উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত করে। খ্রিস্টান সংগঠনগুলো চাইলে দেশে বিভেদ বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে, সরকারের পতন ঘটানো তাদের পক্ষে সম্ভব, এই আশঙ্কাতেই সরকার তার সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে বাধ্য হয়।’ দীর্ঘ রিপোর্টের সামারি পড়া শেষ হলো স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর।

সবাই চুপচাপ। বিস্ময় প্রেসিডেন্টের চোখে। বলল, ‘একমাত্র চাওসিকোর কিছু ঘটনা ছাড়া অন্যান্য ঘটনার যে বিবরণ প্রকাশ পেয়েছে তার তো কিছুই আমরা জানি না। আমাদের পুলিশ জানতে পারল না, অথচ অন্যরা এতটা বিস্তারিত জানলো কি করে? কে অনুসন্ধান করল? আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় কে প্রকাশ করল? আর আন্তর্জাতিক মিডিয়াই বা এমন বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করল কেন?’

‘ঘটনার চেয়ে এটাই আমার কাছে বড় বিস্ময়, এক্সিলেন্সি। কিছু খ্রিস্টান সংগঠনের এমন ষড়যন্ত্রমূলক ঘটনা আমাদের বুরুন্ডিতে ঘটেছে তা শুধু নয়, এমন ঘটনা আফ্রিকার অনেক দেশেই ঘটছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মিডিয়া বিষয়টাকে এইভাবে ফাঁস করে দেয়ার ঘটনা একেবারেই নতুন। নিশ্চয়ই…।’

প্রধানমন্ত্রীর কথার মাঝখানে প্রেসিডেন্ট বলে উঠলো, ‘মি. জোসেফ জুলেস, পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুন অঞ্চলের ঘটনা একশ্রেণির খ্রিস্টান সংগঠনের ষড়যন্ত্র আন্তর্জাতিক মিডিয়া ফাঁস করে দিয়েছিল।’

‘ধন্যবাদ মি. প্রেসিডেন্ট, সেই ঘটনা ছিল ভূমি দখল ও স্থানীয়দের উচ্ছেদ সংক্রান্ত অন্যদিকে আমাদের এখানকার ঘটনা কৌশলে ও বাধ্য করে ধর্মান্তরকরণ এবং এতদসংশ্লিষ্ট গুম-খুন সংক্রান্ত। তবুও আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় যাওয়ার ক্ষেত্রে দুই ঘটনার মধ্যে মিল আছে।’ বলল প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুলেস।

‘দুই ঘটনার মধ্যে আরেকটা মিল আছে স্যার। পশ্চিম আফ্রিকার ক্যামেরুন অঞ্চলে ওই ঘটনার সময় আহমদ মুসা সেখানে হাজির ছিলেন, আমাদের এখানেও বর্তমানে আহমদ মুসা হাজির আছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘ধন্যবাদ মি. বারনাবী। একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন আপনি। আহমদ মুসা দুনিয়ার বড় বড় রাজধানীতে গ্রহণযোগ্য একজন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব। আন্তর্জাতিক অনেক মিডিয়ার উপর তাঁর প্রভাব থাকা স্বাভাবিক। আমার এখন নিশ্চিত মনে হচ্ছে, আমাদের সরকার তাকে সহযোগিতা করার ব্যাপারে অপারগতা জানানোর পর তিনি সহযোগিতা পাওয়ার বিকল্প পথ বেছে নিয়েছেন। ষড়যন্ত্রমূলক ও মানবাধিকার বিরোধী এই ঘটনা বিশ্ব মিডিয়ায় আসার পর দুনিয়ার মানবাধিকার সংগঠনগুলো ও অনেক প্রভাবশালী সরকার এখানে ছুটে আসবে প্রতিকারের জন্য।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, দৃশ্যত আহমদ মুসার এ. কাজ আমাদের বুরুন্ডির জন্যে বিব্রতকর হলেও তিনি বুরুন্ডি সরকারকে বাঁচিয়ে দিয়েছেন এক্সিলেন্সি। তার এই রিপোর্ট থেকে পরিষ্কার, কিছু খ্রিস্টান সংগঠনের ষড়যন্ত্র ও তার ফলাফল সম্পর্কে বুরুন্ডি সরকার কিছুই জানতো না। জানার জন্য বিস্তারিত গোয়েন্দা তদন্তের যে উদ্যোগ সরকার নেয়, তাকেও ওই খ্রিস্টান সংগঠনগুলো বাধাগ্রস্ত করে। সরকার পতনের হুমকির কারণে বুরুন্ডি সরকার তাদের বাধা মেনে নেয়, সেটাও রিপোর্টে বলে দেয়া হয়েছে।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘আসলেই আহমদ মুসা খুব ভালো মানুষ। সন্ত্রাসীদের চাপে পড়ে আমরা আহমদ মুসাকে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেছিলাম। কিন্তু সে সন্ত্রাসীদের সাথে আমাদের ব্রাকেটেড করেনি, বরং আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছে। বলল প্রধানমন্ত্রী।

‘এই সত্যনিষ্ঠ রিপোর্টের জন্যে তার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত। আমরা যা পারিনি, তাই তিনি করেছেন। কিন্তু আমি ভাবছি, এত ডিটেইল ঘটনা তিনি জানলেন কি করে? বিশেষ করে আমাদের সরকারের উপর সন্ত্রাসীরা যে চাপ দিয়েছে, সেটা তিনি জানলেন কি করে?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমাদের কথাবার্তা এবং অসহায়ত্ব দেখে তিনি সেটা আঁচ করেছেন। আর বুরুন্ডির রাজনীতির উপর নিশ্চয়ই তার ভালো স্টাডি আছে। তিনি সত্যি জানার জন্য নিশ্চয়ই অনেক পরিশ্রম করেছেন। ভিকটিমদের পরিবারের সাথে তিনি যোগাযোগ করেছেন। আর এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট, চাওসিকো ও আনা আরিয়ার কাছ থেকে নিশ্চয়ই অনেক সাহায্য পেয়েছেন। আনা আরিয়া তার পিতার সূত্রে নিশ্চয়ই অনেক কিছুই জানতেন। প্রধানমন্ত্রী বলল।

ঠিক মি. জোসেফ জুলেস, আনা আরিয়াকে হাত করতে পারা আহমদ মুসার জন্য একটা বড় পাওয়া।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘এক্সিলেন্সি, আমাদের গোয়েন্দা রিপোর্ট হলো, আনা আরিয়া অনেক আগে থেকেই চাওসিকোর প্রতি দুর্বল।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘সেক্ষেত্রে আনা আরিয়া তার পরিচয় ও স্ট্যাটাস অনুসারে নিজের ধর্মের দিকেই চাওসিকোকে টানতে পারতো। কিন্তু তা হয়নি। সেই গেছে চাওসিকোর ধর্মে।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘ইসলামের এই শক্তি আছে এক্সিলেন্সি। এর প্রমাণ অসংখ্য এক্সিলেন্সি। প্রধানমন্ত্রী বলল।

‘থাক এসব কথা প্রধানমন্ত্রী মি. জোসেফ জুলেস। আমাদের সরকারের একটা প্রতিক্রিয়া এখনই দিতে হবে। সেটা কি হবে, আসুন সেটা আলোচনা করি। আচ্ছা, যতগুলো আন্তর্জাতিক বক্তব্য ও প্রতিক্রিয়া এসেছে, তার মূল কথাটা কি?’ বলল প্রেসিডেন্ট।

সন্ত্রাস ও একটা সম্প্রদায় কর্তৃক তাদের অনুসারী বৃদ্ধির জন্য হিংসাত্মক ও মানবতাবিরোধী ষড়যন্ত্রের কঠোর নিন্দা ও ত্বরিৎ প্রতিকার দাবি করা হয়েছে। বুরুন্ডি সরকারের দুর্বলতা ও নিষ্ক্রিয়তায় দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে এবং দ্রুত সরকারের আইনানুগ পদক্ষেপ দাবি করেছে সবাই।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।

‘শীঘ্রই কি তাদের কারো বুরুন্ডিতে আসার সম্ভাবনা আছে? জিজ্ঞাসা প্রেসিডেন্টের।

‘বেশ কয়েকটি সংগঠন শীঘ্রই বুরুন্ডিতে আসার জন্য আমাদের দূতাবাসে ভিসার আবেদন করেছে। তাদের মধ্যে রয়েছে ওআইসি (OIC), হিউম্যান রাইটস ফর অল (HRA), জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস কমিশন, অর্গানাইজেশন অফ আফ্রিকান ইউনিটি (OAU) এবং ক্রিশ্চিয়ান্স ফর অল।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।

‘এখন প্রথম করণীয়টা হলো, দ্রুত বিশ্বের সকলের জন্য আমাদের একটা প্রতিক্রিয়া দেয়া। এরপর পুরো ঘটনা প্রবাহের উপর আমাদের একটা ওয়ার্কিং পেপার তৈরি করা।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘শুধু ওয়ার্কিং পেপার তৈরি নয় এক্সিলেন্সি। আমাদের কিছু পদক্ষেপও গ্রহণ করতে হবে। আমার মতে, আমাদের প্রাথমিক বক্তব্যে সন্ত্রাসী ও মানবাধিকার বিরোধী সকল ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্তের ঘোষণা থাকতে হবে।’ প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুলেস বলল।

‘তদন্তের ঘোষণা দেয়ার ব্যাপারে আমি একমত। কিন্তু কি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, সে বিষয়টা আমাদের সামনে আসা দরকার।’ বলল প্রেসিডেন্ট।

‘এক্সিলেন্সি, আমি মনে করি পদক্ষেপের বিষয়টা স্থির করার আগে আহমদ মুসার সাথে যেকোনো পর্যায়ে আমাদের বসা দরকার। রিপোর্টে যা প্রকাশ পেয়েছে, আহমদ মুসা তার চেয়ে অনেক বেশি জানেন। তাছাড়া সন্ত্রাসীদের সে চেনে। সুতরাং আমরা প্রত্যেকের ব্যাপারে আহমদ মুসার গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য পেতে পারি।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলল।

‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথার সাথে আমি একমত এক্সিলেন্সি। বলল প্রধানমন্ত্রী।

‘হ্যাঁ, এটা একটা ভালো প্রস্তাব। কিন্তু আহমদ মুসাকে পাওয়া যাবে কোথায়? তার নিজের কোনো টেলিফোন নাম্বার তো আমাদের কাছে নেই। প্রেসিডেন্ট বলল।

‘একটা কন্টাক্ট পয়েন্ট আছে আমাদের কাছে। দূতাবাস ক্লাবে আমরা মেসেজ দিলে তিনি পেয়ে যাবেন এবং নিশ্চয়ই তিনি তখন যোগাযোগ করবেন আমাদের সাথে।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

‘ধন্যবাদ। এই চেষ্টা তাহলে করুন। তাকে যত তাড়াতাড়ি পাওয়া যায় ততই ভালো। ইতিমধ্যে আমাদের প্রতিক্রিয়া প্রেসে দেবার ব্যবস্থা আপনারা করুন। প্রেসিডেন্ট বলল।

‘ইয়েস এক্সিলেন্সি। অল্পক্ষণের মধ্যেই স্টেটমেন্টটা আপনাকে দেখিয়ে আমরা প্রেসে দিয়ে দিব। বলল প্রধানমন্ত্রী।

‘আচ্ছা মি. জোসেফ জুলেস, মি. বতুমবুরা, সন্ত্রাসী কিংবা ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয় অথবা মি. বাতিস্তা সান্ড্রির খ্রিস্টান সংগঠনের কোনো প্রতিক্রিয়া কি জানা গেছে?’ প্রেসিডেন্ট বলল।

‘মিডিয়া কিংবা মৌখিক কারো কোনো প্রতিক্রিয়ার খবর আমরা পাইনি। তবে এক্সিলেন্সি, একটা বড় খবর পাওয়া গেছে, বলতে ভুলে গেছি। পোপ ভিক্টর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ান অপরাধের সমস্ত দায় মাথায় নিয়ে সকালে পদত্যাগ করেছেন। তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো দোষ নেই। বিশ্ববিদ্যালয় সকল সাম্প্রদায়িক অপরাধ থেকে মুক্ত হোক আমি সেটা চাই। সেই সাথে আমি চাই আমাদের ক্রিশ্চিয়ানিটি কর্তৃক কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংঘটিত মানবাধিকার হরণের অপরাধ থেকে মুক্ত হোক।’ বলল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।

সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট কোনো কথা বলল না। গম্ভীর হয়ে উঠেছে সে। প্রধানমন্ত্রী ও প্রেসিডেন্টের দিকে একবার তাকিয়ে চুপ করে রইল। প্রেসিডেন্টই নীরবতা ভাঙলো। বলল গম্ভীর কণ্ঠে, ‘ফাদার স্টিফেন ফোবিয়ানকে ধন্যবাদ। আমিও যদি চিৎকার করে তার কথাটা বলতে পারতাম, তাহলে খুশি হতাম! শুধু তিনি, আমি এবং আমরা কয়েকজন চাইলেই কি ব্ল্যাক ক্রসের ষড়যন্ত্র বন্ধ করতে পারবো?’

‘এক্সিলেন্সি, আগে হলে বলতাম পারবো না। কিন্তু আহমদ মুসাকে দেখার পর, তার কথা শোনার পর এখন আমার মনে হচ্ছে, তাদের ষড়যন্ত্র-বন্ধ হবে। পশ্চিম আফ্রিকায় হয়েছে, আমাদের পূর্ব আফ্রিকাতেও আহমদ মুসা তা পারবেন প্রভু যীশুর ইচ্ছায়।’ বলল প্রধানমন্ত্রী।

হাসল প্রেসিডেন্ট। বলল, ‘মি. প্রধানমন্ত্রী, আহমদ মুসা তো করবেন তার আল্লাহর ইচ্ছায়, কিন্তু আপনি যে বললেন প্রভু যীশুর ইচ্ছায়?’

প্রধানমন্ত্রীও হাসল। বলল, ‘এক্সিলেন্সি, স্রষ্টা এবং সকল কাজের কারক তো একজনই। আমি তাকেই বুঝিয়েছি। আর আমরা, মুসলমানরা এবং ইহুদিরা সকলেই তো একত্ববাদী।’

‘একটিকে আমরা অনেক সময় ‘বহু’ করে ফেলি, সেটাই সমস্যা মি. প্রধানমন্ত্রী। থাক এসব জটিল কথা-বার্তা। আসুন আমরা উঠি। মন্ত্রীসভার বৈঠকের আর দেরি নেই। বলে প্রেসিডেন্ট উঠে দাঁড়াল।

সবাই উঠল।

.

আহমদ মুসার মোবাইল বেজে উঠলো।

বাম হাত দিয়ে মোবাইল তুলে নিয়ে আহমদ মুসা স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখল আনা আরিয়ার নাম্বার।

চাওসিকো ও আনা আরিয়া এখন আসমানি পরিবারের সাথে থাকছে।

চাওসিকো ও আনা আরিয়ারা খুশি।

আসুমানি পরিবার আরো খুশি। চাওসিকো ও আনা আরিয়ার থাকার জন্য আহমদ মুসা যে আসমানি পরিবারকে চয়েস করেছে এতে পরিবারটি নিজেদের ভাগ্যবান মনে করছে। আনা আরিয়াকে সাথী হিসেবে পেয়ে সামিরা সাদিয়া খুবই খুশি হয়েছে। বিশেষ করে আহমদ মুসার সাথে আনা আরিয়ার ছোট ছোট ঝগড়া সাদিয়ার খুব ভালো লাগে। আবার তাকে অবাকও করে। সামিরা সাদিয়া আনা আরিয়াকে বলে, ‘স্যারের সাথে অমন শাসন, অভিযোগের সুরে কথা বল, তোমার ভয় করে না, সংকোচবোধ হয় না?’ আনা আরিয়া কৃত্রিম চোখ পাকিয়ে বলে, ‘বড় বোন হলে তো আরো কত কিছু করতাম, ছোট বলে তাঁর রক্ষা।’ সামিরা সাদিয়া মনে মনে বলে, ‘আমাকেও তো বোন ডাকেন? কিন্তু আমি ওইভাবে বোন হতে পারি না কেন?’

আহমদ মুসা মোবাইলের কল অন করে বাম হাতে কানের কাছে নিল মোবাইল। বলল, ‘আসসালামু আলাইকুম, আনা আরিয়া।

‘ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাইয়া। আপনি কি গাড়িতে, ড্রাইভে?’ জিজ্ঞাসা আনা আরিয়ার।

‘হ্যাঁ আনা আরিয়া, আমি ড্রাইভ করছি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমি কি কথা বলতে পারি?’ আনা আরিয়া বলল।

‘হ্যাঁ পারো। রাস্তায় তেমন ভিড় নেই।’ বলল আহমদ মুসা।

‘একটা খারাপ খবর পেয়েছি ভাইয়া।’ আনা আরিয়া বলল।

‘বল।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আম্মা অল্পক্ষণ আগে টেলিফোন করেছিলেন ভিন্ন একটা টেলিফোন থেকে। তিনি জানিয়েছেন, ওরা বাবাকে পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহারের জন্য চাপ দিয়ে বলেছে, আজ আহমদ মুসার জীবনের শেষ দিন। আজ বিকেল তিনটায় সে যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এবং চারদিকে আমরা ফাঁদ পেতে রেখেছি। এই কাজে আমরা সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি। তাকে যদি আমরা দুনিয়া থেকে সরাতে পারি, তাহলে চিন্তার আর কিছু থাকবে না। সরকার এবং সবাইকে আমরা ম্যানেজ করতে পারবো।’ আনা আরিয়া বলল। কথা বলার সময় উদ্বেগে তার কণ্ঠ কাঁপছিল।

‘ধন্যবাদ বোন। তোমার বাবা-মাকেও ধন্যবাদ। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ খবর তারা দিয়েছেন। সুযোগ মতো আমি তাদেরকে কৃতজ্ঞতা জানাবো। চিন্তা…।’

আহমদ মুসার কথার মাঝখানে আনা আরিয়া বলে উঠলো, ‘কৃতজ্ঞতা জানাবার দরকার নেই। তারাই আপনার কাছে সীমাহীন কৃতজ্ঞ ভাইয়া। তাদের সন্তানকে আপনি পিতা-মাতার চেয়েও ভালভাবে আগলে রেখেছেন। তারা আপনাকে ঈশ্বরের দূত মনে করেন। আমি জানতাম না ভাইয়া, বিশেষ করে আমার বাবা আমাকে এত ভালোবাসেন। মা বলেন, আমি চলে আসার পর বাবা একদম বদলে গেছেন। সময় পেলেই আমার ঘরে গিয়ে বসে থাকেন এবং কাঁদেন। তিনি পদত্যাগও করেছেন এই কারণে। তিনি মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি তাকে অমানুষ বানিয়েছে, মেয়ের প্রতি সীমাহীন অবিচার করিয়েছে। তিনি আম্মাকে বলেছেন, সবকিছুর বিনিময়ে আমি আমার মেয়েকে চাই।’

‘আলহামদুলিল্লাহ। তিনি মূলতই ভালো মানুষ। অবস্থা তাকে ভিন্ন তিনি দিকে নিয়ে গিয়েছিল। একটা আঘাত তাকে ফিরিয়ে এনেছে। পদত্যাগ করে ভালো করেছেন। তার সব দায় স্বীকারই তাকে দায়মুক্ত করবে ইনশাআল্লাহ।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ধন্যবাদ ভাইয়া। আপনি খুব সাবধান থাকবেন। আনা আরিয়া বলল।

‘চিন্তা করো না। আল্লাহ আছেন।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আলহামদুলিল্লাহ। আরেকটা কথা ভাইয়া, আপনি আপাকে মানে সাদিয়া আপাকে ধন্যবাদ দিয়েছেন নিউজটার জন্য?’ আনা আরিয়া বলল।

‘গোটা দুনিয়া তো সাদিয়াকে ধন্যবাদ দিচ্ছে? আর নিউজটার পর সাদিয়ার সাথে আমার কোনো কথা হয়নি।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আপনি তো কথা বলেননি।’ আনা আরিয়া বলল।

‘দরকার হয়নি আনা আরিয়া।’ বলল আহমদ মুসা।

‘এত বড় ঘটনাটা কি ‘দরকার’-এর মধ্যে পড়ে না? যে ঘটনা বুরুন্ডিকে আলোড়িত করেছে, আফ্রিকাকে আলোড়িত করেছে এবং গোটা দুনিয়াকে আলোড়িত করার মতো, সে ঘটনা সৃষ্টি করার কাজ কি ‘দরকার’-এর মধ্যে পড়ে না ভাইয়া?’ আনা আরিয়া বলল। তার কণ্ঠে অনেকটাই ঝগড়াটে সুর।

‘তার কাজে আমি দারুণ খুশি আনা আরিয়া। কিন্তু সে কাজটি করেছে আল্লাহর জন্যে, কোনো প্রশংসা লাভের জন্যে নয়। তোমার আমার সবার মধ্যে এই মনোভাব থাকা দরকার।’ বলল আহমদ মুসা।

‘আমি আপাকে এ কথাটা বলবো ভাইয়া। কিন্তু ধন্যবাদ শুধু প্রশংসার জন্যে নয়, উৎসাহ দেয়ার জন্যেও হয়। নিউজটি প্রকাশ হওয়ার পর আপা অনেক কেঁদেছে। আনন্দের কান্না। এই সাথে এর সব কৃতিত্ব সে আপনাকে দিয়েছে। বলেছে, আপনার দেয়া নিউজটি সে মাত্র কপি করেছে। আপনি কি তাকে উৎসাহ দিয়ে বলতে পারতেন না যে, তোমার নিউজ রিমেকিংটি সুন্দর হয়েছে।’ আনা আরিয়া বলল। তার কণ্ঠটি ভারি হয়ে উঠেছিল।

আহমদ মুসা হাসল। বলল, ‘এখন আমার মনে হচ্ছে, তুমি ঠিকই বলেছ আনা আরিয়া। কিন্তু জানো তো, বড় প্রয়োজনগুলোই আমাকে বেশি ব্যস্ত রাখে।’

‘এটাই কারণ হলে আলহামদুলিল্লাহ। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে যে, অনেকের সাথে দূরত্বকে অতি নিরাপদ করতে গিয়ে আপনি অনেকের মনে কষ্ট দেন ভাইয়া।

‘অতি নিরাপদ বলে কোনো কথা নেই আনা আরিয়া। যা অতি নিরাপদ সেটাই ‘নিরাপদ। আল্লাহ যে নিরাপত্তার সীমা বেঁধে দিয়েছেন, আমি তা রক্ষার চেষ্টা করি। কষ্ট লাগলেও এটাই ঠিক।’ বলল আহমদ মুসা।

‘ধন্যবাদ ভাইয়া, আমাদের অনেক কিছু বুঝার বাকি আছে। থাক এসব কথা। ভাইয়া, আপনি খুব সাবধান থাকবেন। নতুন যে খবরটি আপনাকে দিলাম, সেটা আমাদেরকে খুব উদ্বিগ্ন করেছে। চাওসিকো, আপাসহ বাড়ির সবাই অস্থির হয়ে উঠেছে। আল্লাহ আপনাকে নিরাপদ রাখুন। বলল আনা আরিয়া।

‘আমিন।’ বলল আহমদ মুসা।

সালাম বিনিময়ের মাধ্যমে কথা তাদের শেষ হয়ে গেল।

আহমদ মুসার গাড়ি তখন পার্ক স্ট্রিট দিয়ে পশ্চিম দিকে এগোচ্ছে।

এ রাস্তা হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আসার কথা নয় তার। লেক এভিনিউ-এর বাসা থেকে সেন্ট্রাল এভিনিউ হয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আসার সোজা ও সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত পথ। কিন্তু এ পথে না এসে সার্কুলার রোডের ঘোরা পথে অফিস পাড়ার খুব পাশ দিয়ে পার্ক স্ট্রিটে প্রবেশ করেছে।

সেন্ট্রাল এভিনিউ এবং পার্ক স্ট্রিট সমান্তরাল। এই দুই রাস্তার মাঝেই গোটা অফিস পাড়া এবং সরকারি ভবনগুলো। প্রেসিডেন্টের বাসা, প্রধানমন্ত্রীর বাসা, পার্লামেন্ট সব এখানেই। পার্ক স্ট্রিট অনেকটাই ব্যাকডোর রোডের মতো। পার্লামেন্ট ভবন; প্রেসিডেন্ট ভবন, প্রধানমন্ত্রীর ভবনসহ প্রধান সরকারি স্থাপনাগুলোর মুখ সেন্ট্রাল এভিনিউ-এর দিকে। বলা যায় পার্ক স্ট্রিট ব্যাকডোর এক্সিটের ভূমিকা পালন করে।

সাবধানতার দিক বিবেচনা করে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে আসার জন্য আহমদ মুসা এই পথটাই বেছে নিয়েছিল। আনা আরিয়ার টেলিফোন পাওয়ার পর বুঝলো আল্লাহ তাকে পথ বাছাইয়ে সাহায্য করেছেন।

একটা বিষয় আহমদ মুসার খুবই অবাক লাগছে। প্রধানমন্ত্রী আমাকে টেলিফোন করেছেন ঘণ্টা তিনেক আগে মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে। আমি প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যাব এ সিদ্ধান্ত নিশ্চয় তখনই হয়েছে। এই অল্প সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বা মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে সব তথ্য লিক হলো কি করে! এটা প্রমাণ করে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এবং মন্ত্রীসভায় বড় ধরনের ফুটো আছে। যদি তা থাকে, তাহলে সেটা আরো অনেক ধরনের বিপদ ঘটাতে পারে।

প্রধানমন্ত্রীর অফিসে এবং মন্ত্রীসভায় সন্ত্রাসীদের বড় ধরনের অ্যাক্সেস আছে অবশ্যই।

চলছিল আহমদ মুসার গাড়ি।

প্রধানমন্ত্রীর অফিসের এ পাশের পার্ক স্ট্রিটের গেটটা তখন দেখা যাচ্ছে।

পাশে রাখা এম-১৬ মেশিন রিভলবারের ওপর একবার হাত রাখল আহমদ মুসা। আহমদ মুসার ধারণা, সন্ত্রাসীরা পার্ক স্ট্রিটের গেটের দিকে জাল পাতলেও সে জাল খুব বড় নাও হতে পারে। সন্ত্রাসীদের প্রধান টার্গেট হবে সেন্ট্রাল এভিনিউ। তারা নিশ্চিত করে ধরে নেবার কথা, আহমদ মুসা সেন্ট্রাল রোড় হয়েই প্রধানমন্ত্রীর অফিসে যাবে।

গেটটা এসে গেছে। গেট বন্ধ।

গেটের বাইরে দুজন প্রহরী দাঁড়িয়ে। বেশ লম্বা চওড়া।

আহমদ মুসার গাড়ি গেটের সামনে দাঁড়াতে যাচ্ছে।

দুজন প্রহরী এগিয়ে আসছে।

তাদের উপর চোখ পড়েছে আহমদ মুসার। চোখ পড়তেই বড় একটা ধাক্কা লাগলো আহমদ মুসার মনে। তাদের গাঁয়ের ইউনিফর্ম একেবারেই মিসফিট। দোহারা শরীরের ইউনিফর্ম একহারা শরীরে উঠলে যেমনটা দেখায়, ঠিক সেরকম।

প্রহরী দুজন এগিয়ে এসে আহমদ মুসার দিকে একবার তাকিয়েই পেছন ফিরে গেট বক্সের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘বিদেশী লোক এশিয়ান হবে।’

আহমদ মুসার কিছু বুঝার বাকি রইল না।

দ্রুত আহমদ মুসা পাশে রাখা এম-১৬ জ্যাকেটের নিচের পকেটে তুলে নিল।

গেট বক্সের দিক থেকে ছুটে এলো চারজন প্রহরী। তাদের কারো হাতে উদ্যত রিভলবার। কারো হাতে ব্যারেল উঁচু করে রাখা স্টেনগান। তারা ছুটে আসছে গাড়ির দিকে।

গিয়ার চেঞ্জ করে হঠাৎ গাড়ি স্টার্ট দিল আহমদ মুসা। গাড়ি একটা লাফ দিয়ে সামনে এগোলো।

ছুটে আসা প্রহরীরা গাড়ির সামনে এসে পড়েছিল। তারা দু’পাশে লাফ দিয়ে সরার চেষ্টা করল। তারা সবাই দু’পাশে আছড়ে পড়েছে। কিন্তু দূরে সরতে পারেনি। অনেকেরই হাত, পা দেহাংশ গাড়ির তলায় পিষ্ট হবার মতো ছিল। কিন্তু আহমদ মুসার গাড়ি স্টার্ট নেয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ডেড স্টপ হয়ে যায় এবং তার সাথে সাথেই আহমদ মুসা গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।

গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়লে আকস্মিকতার ধাক্কা কাটিয়ে কেউ কেউ উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করছিল এবং কেউ কেউ উঠে বসছিল।

আহমদ মুসা তাদের দিকে এম-১৬ তাক করে বলল, ‘তোমরা যে যেমন আছো, তেমনি থাক। নড়বে না। অন্যথায়…’

আহমদ মুসা কথা শেষ করতে পারল না। প্রহরীরা অদ্ভুত ক্ষীপ্রতার সাথে তাদের রিভলভার, স্টেনগান কুড়িয়ে নিয়ে আহমদ মুসাকে তাক করছিল।

আহমদ মুসার তর্জনী এম-১৬-এর ট্রিগারেই বসেছিল। আঙ্গুলটা ট্রিগারে রেখে চেপে ধরল মাত্র। বেরিয়ে গেল গুলির ঝাঁক।

আহমদ মুসার গাড়ির পেছনে আরো দুটি গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছিল। একটি প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সিকিউরিটি চীফ নিও আসকানোর জীপ, অন্যটি জাতীয় পরিষদের নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান মার্টিন ভিনসেন্টের।

নিও আসকানো ও মার্টিন ভিনসেন্ট দুজনই ছুটে এসে আহমদ মুসার পাশে দাঁড়াল। আহমদ মুসাকে একটা স্যালুট দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অফিসের সিকিউরিটি চীফ বলল, ‘স্যার কি ব্যাপার? আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। প্রহরীরা আপনাকে গুলি করতে যাচ্ছিল কেন, আপনিই বা তাদের উপর গুলি করলেন কেন?’ তার কণ্ঠে বিস্ময় ও উত্তেজনা।

‘ভালো করে দেখুন, ওরা আপনাদের প্রহরী নয়।’ বলল আহমদ মুসা শান্ত কন্ঠে।

‘স্যার, কি বলছেন আপনি? আমাদের প্রহরী হবে না কেন?’ নিও আসকানো বলল। তার কণ্ঠে রাজ্যের বিস্ময়।

কথাটা বলেই এগোলো সে গাড়ির সামনে দুর্পাশে পড়ে থাকা প্রহরীদের লাশের দিকে। চোখ বুলালো প্রহরীদের ওপর। আশ্চর্যের বিষয় কাউকে সে চিনতে পারছে না। প্রধানমন্ত্রীর অফিসে শ্বেতাঙ্গ প্রহরী প্রচুর, কিন্তু সবাই তার চেনা।

নিও আসকানো তাকালো আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘অবাক ব্যাপার, প্রহরীরা কেউ আমার চেনা নয়! অথচ আমি নিজে আজ নিরাপত্তা প্রহরীদের দায়িত্ব বন্টন করেছি। এই বিটে এই গেটে যারা দায়িত্বে থাকার কথা ছিল, তারা সকলেই আমার চেনা। কিন্তু তারা কোথায়, এরা কা…।’

নিও আসকানো কথা শেষ না করেই রাস্তার দিকে ঘুরে যাওয়া বিস্ফোরিত চোখে আহমদ মুসার দিকে ঝুঁকে ডান হাত দিয়ে প্রচন্ড একটা ধাক্কা দিল আহমদ মুসাকে।

আকস্মিক ধাক্কায় আহমদ মুসা পড়ে গেল। সেই সাথে পার্ক স্ট্রিটের ওপাশ থেকে একসাথে কয়েকটি স্টেনগানের ব্রাশফায়ারের শব্দ হলো।

আহমদ মুসাকে ধাক্কা দেয়ার পর নিও আসকানো নিজের আত্মরক্ষার জন্য সময় পায়নি। সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মাটিতে পড়ে গেল। গুলিবৃষ্টিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল তার দেহ।

অফিসের ভেতর থেকে কয়েকজন প্রহরী এবং আরো লোকজন ছুটে আসছে গেটের দিকে।

আহমদ মুসা পড়ে গিয়েই তার এম-১৬ বের করে নিয়েছিল। শুয়ে থেকেই সে রাস্তায় ওপাশে সন্ত্রাসীদের লক্ষ্যে গুলি বৃষ্টি শুরু করল।

রাস্তার ওপাশে সন্ত্রাসীরা গুলি করতে করতে রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিল গাছপালার আড়াল থেকে। তারা আহমদ মুসার এম-১৬-এর সহজ শিকারে পরিণত হয়ে গেল। এক ঝাঁক গুলি পাঁচজনের ক্ষুদ্র সন্ত্রাসী দলকে গ্রাস করল।

অফিসের ভেতর থেকে প্রহরী ও লোকজন যারা ছুটে আসছিল আহমদ মুসাদের দক্ষিণ গেটের দিকে, তারাও ‘গুলি’, ‘গুলি’ বলে চিৎকার করে উঠল। তারা দেখতে পেয়েছিল অফিস কম্পাউন্ডে পশ্চিম দিকের বাগান ও উত্তর পাশের রাস্তার দিক থেকে চৌদ্দ-পনেরোজন লোক ছুটে আসছিল। তাদের হাতে উদ্যত স্টেনগান, কারো ট্রিগারে আঙুল, কারো কারো স্টেনগান থেকে গুলি শুরু হয়ে গিয়েছিল।

গুলির শব্দ আহমদ মুসারও কানে গিয়েছিল। চট করেই তার মনে হলো, প্রহরীদের গুলি এটা হতে পারে না। এদিক লক্ষ্যে প্রহরীদের ব্রাশ ফায়ারের এখন প্রয়োজন নেই। তাহলে কি ওদিকের সন্ত্রাসীরা এদিকে আসছে?

চিন্তার সঙ্গে সঙ্গেই আহমদ মুসার দেহ বোঁ করে ঘুরে গেল। এবার আহমদ মুসার নজরে এলো গেট এবং ভেতরের কম্পাউন্ড। দেখল সে, একদল স্টেনগানধারী গুলি করতে করতে ছুটে আসছে। দক্ষিণের এই গেট তাদের লক্ষ্য। তাদের কয়েকজন প্রহরীর পোশাক পরা, অবশিষ্টদের পরনে সৈনিকের পোশাক। তবে তাদের কারো বুকে নেমপ্লেট নেই। আহমদ মুসার ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠল।

আহমদ মুসা দ্রুত গড়িয়ে কয়েকটা লাশ ডিঙিয়ে একদম গেট ঘেঁষে অবস্থান নিল। গ্রিল গেটের বটমের পুরু ও প্রশস্ত প্যানেল এবং এর সমান্তরাল স্টিল শিটের আড়াল পাওয়ায় আহমদ মুসা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করল।

ওদিক থেকে তখন গুলিবৃষ্টির আড়ালে সন্ত্রাসীরা ছুটে আসছিল। অফিসের ভেতর থেকে প্রহরী ও লোকজন যারা গেটের দিকে ছুটে আসছিল, তাদের যারা ঠিক সময়ে শুয়ে পড়তে পারেনি তারা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেছে।

গেট তখন সন্ত্রাসীদের গুলিবৃষ্টির কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। অধিকাংশ গুলি মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে।

সন্ত্রাসীরা গুলিবৃষ্টির আড়াল নিয়ে গেটের দিকে ছুটে আসছে।

গেট তখনো বন্ধ।

আহমদ মুসাও মাটিতে গা লাগিয়ে ক্রল করে দ্রুত গেটের দিকে এগোচ্ছিল। ওদেরকে কিছুতেই গেট দখল করতে দেয়া যাবে না। গেট দখলে পেলে সন্ত্রাসীদের সুবিধা বন্ধ করা ছাড়াও পাল্টা আক্রমণের সুবিধা পাবে আহমদ মুসা।

গেট আহমদ মুসার কাছেই ছিল।

আহমদ মুসা গেটে পৌঁছেই তার এম-১৬-কে আক্রমণে নিয়ে এলো।

গেটের গ্রিল দরজার বটম বরাবর জায়গা ছয় ইঞ্চি প্রস্থের ইস্পাত শীটে ঢাকা। এটাই আহমদ মুসার জন্য ঢালের কাজ করল।

আহমদ মুসা তার এম-১৬-এর ব্যারেল ইস্পাতের শীটের উপর তুলে গুলিবৃষ্টি শুরু করল যতটা পারা যায় সামনের গেটটা কভার করে। আহমদ মুসার গুলিবৃষ্টি ছিল ওদের কাছে আকস্মিক। ওদের অনেকগুলো স্টেনগানের অব্যাহত গুলিবৃষ্টির পাল্টা কোনো জবাব না পেয়ে, ওরা ধরে নিয়েছিল এদিকে গুলি করার কেউ থাকলেও গুলি করার মতো অবস্থানে নেই। সুতরাং তারা নিশ্চিন্ত মনে শরীরটা সামনের দিকে একটু বাঁকিয়ে গুলিবর্ষণ করতে করতে ছুটে আসছিল। ফলে তারা অধিকাংশই আহমদ মুসার আকস্মিক গুলিবৃষ্টির শিকারে পরিণত হলো। যারা বেঁচে গিয়েছিল, তারা শুয়ে পড়ে গুলিবৃষ্টি অব্যাহত রাখল। আহমদ মুসাও তার গুলিবৃষ্টি বন্ধ করল না।

উত্তরের গেটের দিক থেকে হুইসেলের শব্দ পাওয়া গেল।

আহমদ মুসা আরো কিছু ভাবার আগেই গেট দিয়ে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করল কয়েক প্লাটুন সৈনিক।

সন্ত্রাসীরা পেছন থেকে তাদের আক্রমণের শিকার হলো।

মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

অবশিষ্ট সন্ত্রাসীরা কয়েক ডজন সাব মেশিনগানের গুলিতে ছাতু হয়ে গেল। সৈনিকরা দ্রুত গোটা কম্পাউন্ড ঘিরে ফেলে গেটের দিকে ছুটে এলো।

ওদিকে প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বেরিয়ে এলো একঝাঁক মানুষ। তাদের মধ্যে গার্ড পরিবেষ্টিত প্রধানমন্ত্রীকে দেখা গেল।

প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুলেস একজন সেনা অফিসারকে চিৎকার করে বলল, ‘গেটে দেখুন আমাদের জাতীয় পরিষদের নিরাপত্তা কমিটির চেয়ারম্যান মার্টিন ভিনসেন্ট এবং আমাদের অফিসের সিকিউরিটি চীফ নিও আসকানো গুলিবিদ্ধ।

সেনা অফিসার ছুটল দক্ষিণ গেটের দিকে।

প্রধানমন্ত্রীও এগোলো সেদিকে।

আহমদ মুসা তখন উঠে দাঁড়িয়ে তার গাড়ির আশেপাশে পড়ে থাকা চারজন দারোয়ানের লাশ পরীক্ষা করছিল।

একজন সিকিউরিটির লোক গেট খুলে দিয়েছিল।

সেনারা ছুটে এসে দক্ষিণ গেট এবং দক্ষিণ পাশের পার্ক স্ট্রিট ঘিরে ফেলল।

প্রধানমন্ত্রী আহমদ মুসার কাছে ছুটে এলো। বলল, ‘মি. মার্টিন ভিনসেন্ট, মি. নিও আসকানো কেমন আছেন? মি. আবু আব্দুল্লাহ আপনি কেমন আছেন?’

‘দুঃখিত মি. প্রধানমন্ত্রী, মি. মার্টিন ভিনসেন্ট আর নেই। বেশ কয়েকটি গুলি তাকে বিদ্ধ করেছে। সঙ্গে সঙ্গেই তিনি মারা গেছেন। আপনার অফিসের সিকিউরিটি চীফ গুলির মুখ থেকে আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরাতে গিয়ে নিজে সাবধান হবার সময় পাননি। গুলিবিদ্ধ হয়েছেন তিনি। তাকে এখনই হাসপাতালে নেয়া দরকার।

নিও আসকানো ক্ষীণ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে বলল, ‘স্যার, মি. আবু আব্দুল্লাহ স্যার, ছদ্মবেশী গেট সিকিউরিটির লোকদের যথাসময়ে চিনতে না পারলে আমরা কেউ বাঁচতাম না। গেট সিকিউরিটির সবাই মি. আবু আব্দুল্লাহ স্যারের হাতে মারা যায়। কিন্তু রাস্তার ওপাশ থেকে আসা ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি এসে আমাদের ঘিরে ধরে। আমি মি. আবু আব্দুল্লাহ স্যারকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে না পারলে তিনি মার্টিন ভিনসেন্টের মতো গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যেতেন।

‘থ্যাংকস মি. নিও আসকানো। আপনি একটা বড় কাজ করেছেন। আপনার জন্য আমরা গর্বিত।’ বলল প্রধানমন্ত্রী নিও আসকানোর মাথার কাছে বসে।

অ্যাম্বুলেন্স এসে দাঁড়ালো। দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো নিও আসকানোকে।

‘আমরা মি. নিও আসকানো এবং মার্টিন ভিনসেন্টকে সামরিক হাসপাতালে নিচ্ছি। মার্টিন ভিনসেন্ট সম্পর্কে আমাদের একটা শেষ আশা আছে। বলল একজন সেনা অফিসার।

‘গড সেভ দেম। যাও মি. অফিসার কুইক।’ বলল প্রধানমন্ত্রী। একজন সেনা অফিসার ও একজন পুলিশ অফিসারের গাড়ি অ্যাম্বুলেন্সের সাথে ছুটলো দ্রুত।

‘মি. প্রধানমন্ত্রী, সন্ত্রাসীদের বডি দ্রুত চেক করার পর তাদের কেউ আহত থাকলে, তাদেরকেও হাসপাতালে নেয়া দরকার। বলল আহমদ মুসা প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে।

প্রধানমন্ত্রী তাকাল আহমদ মুসার দিকে। বলল, ‘ধন্যবাদ আহমদ মুসা। ভিন্ন ভিন্ন পরিচয় ও অবস্থান সত্ত্বেও আমরা তো সবাই মানুষ মানুষকে তার মানবিক অধিকার দেয়া প্রয়োজন।

বলেই প্রধানমন্ত্রী সামনের পুলিশ অফিসারকে লক্ষ্য করে বলে উঠলো, ‘আপনারা দ্রুত সন্ত্রাসীদের দেহ প্রাথমিকভাবে চেক করার কাজটা সারুন এবং আহতদের দ্রুত হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করুন। হাসপাতালে উপযুক্ত প্রহরার ব্যবস্থা থাকতে হবে।’

নির্দেশটা দিয়েই আহমদ মুসার দিকে ফিরে প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘সন্ত্রাসীদের এই চারটা লাশ তো আপনি চেক করেছেন, কি দেখলেন মি. আবু আব্দুল্লাহ? সেই আগের ওরাই নিশ্চয়?’

‘হ্যাঁ, মি. প্রধানমন্ত্রী। এরা সবাই কলিন ক্রিস্টোফারের ব্ল্যাক ক্রসের লোক। আমার নিশ্চিত বিশ্বাস অবশিষ্টরাও এরাই হবে।’ আহমদ মুসা বলল –

‘আমি বুঝতে পারছি না আবু আব্দুল্লাহ, আপনি এখানে এই সময়ে আসছেন, সেটা ওরা জানতে পারলো কি করে? আর যুদ্ধের আয়োজনের মতো এত বড় প্রস্তুতি গ্রহণ করল কখন?’ বলল প্রধানমন্ত্রী। তার চোখে মুখে বিস্ময়।

‘মাফ করবেন মি. প্রধানমন্ত্রী, আপনার মন্ত্রীসভার সব সদস্যের প্রতি কি আপনি সমান আস্থা পোষণ করেন?’ আহমদ মুসা বলল।

গম্ভীর হলো প্রধানমন্ত্রী। বলল, ‘আপনার প্রশ্নের উত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলতে পারলে খুশি হতাম মি. আবু আব্দুল্লাহ। কিন্তু আমি পারছি না। মন্ত্রীসভায় চারজন মন্ত্রী আছেন যারা খ্রিস্টান সংগঠনগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে। কিন্তু মি. আবু আব্দুল্লাহ এদের এবং এদের বাড়ির সব মোবাইল, টেলিফোন আমরা ট্রাকিং-এ রেখেছি। মন্ত্রীসভার বৈঠক থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক ঘণ্টায় তাদের মোবাইল ও টেলিফোন থেকে সন্দেহমূলক কোনো কল হয়নি।

‘ধন্যবাদ মি. প্রধানমন্ত্রী। আরেকটা বিষয়, আপনার মন্ত্রীসভার বৈঠকের প্রসিডিং রেকর্ড করার একটা অফিসিয়াল ব্যবস্থা তো অবশ্যই আছে। এর বাইরে মন্ত্রীসভার বৈঠক বা আশপাশ থেকে আর কোনো রেকর্ডিং হয়েছে কিনা, সেটা নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন মি. প্রধানমন্ত্রী। আহমদ মুসা বলল।

প্রধানমন্ত্রী জোসেফ জুলেসের চোখে মুখে বিস্ময় ফুটে উঠল। বলল প্রধানমন্ত্রী বিস্ময় বিজড়িত কণ্ঠে, ‘ঘটনা এতদূর যেতে পারে মি. আবু আব্দুল্লাহ!’

কথা শেষ করে মুহূর্তকাল দম নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘রেকর্ড ট্রাকিং-এর ব্যবস্থা আছে মি. আব্দুল্লাহ। খোঁজ না নিয়ে আমি বলতে পারছি না কি ঘটেছে।’

‘অসুবিধা নেই মি. প্রধানমন্ত্রী। কিভাবে লিক হয়েছে এটা জানা ছাড়া এর কোনো কার্যকারিতা এখন নেই।’ আহমদ মুসা বলল।

প্রধানমন্ত্রী কিছু বলতে যাচ্ছিল। তখন তার হাতের ক্ষুদ্রাকার ওয়ারলেসটি বেজে উঠল।

ওয়ারলেসের দিকে একবার তাকিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলল, ‘এক্সিলেন্সি মি. প্রেসিডেন্ট।’

প্রধানমন্ত্রী মিনি ওয়ারলেসটি তুলে নিল কানের পাশে।

প্রধানমন্ত্রী এখানকার পরিস্থিতির আপডেট দিলেন। তারপর মাঝে মাঝে দুই একটা কথা বললেন এবং শুনলেন প্রেসিডেন্টের দীর্ঘ কথা।

কথা শেষ করে তার দিকে একবার তাকিয়ে আহমদ মুসাকে বলল, ‘চলুন মি. আবু আব্দুল্লাহ আমার অফিসে। আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা আছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও গোয়েন্দা প্রধান আসছেন।’

প্রধানমন্ত্রী ঘুরে দাঁড়িয়ে পা বাড়ালেন অফিসের দিকে।

আহমদ মুসাও হাঁটা শুরু করল প্রধানমন্ত্রীর সাথে।

পথে দেখা হলো পুলিশ প্রধানের সাথে।

পুলিশ প্রধানকে স্বাগত জানিয়ে কিছু নির্দেশ দিলেন প্রধানমন্ত্রী।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মুখের সামনে ওয়ারলেস। তার চোখে মুখে উত্তেজনা।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *