শান্তিপ্রিয়

শান্তিপ্রিয়

লোকটা পাদানির ওপরে, দরজা আগলে রড ধরে দাঁড়িয়েছিল। বিরক্তিকর। অপেক্ষমাণ বাস, দাঁড়িয়ে আছে, কত লোক উঠবে। এভাবে দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকলে হয় না। আমি শান্তিপ্রিয় লোক, পিসলাভিং যাকে বলে। অকারণ ঝগড়া বিবাদ করার ইচ্ছা আমার নেই। তা ছাড়া রাত্রি নটা বাজে। বাস যে পাওয়া গিয়েছে, এটাই যথেষ্ট। অনেক দিন তো এসে দেখি, বাসের কোনও পাত্তাই নেই। বাস অ্যাট অল যাবে কি না, কেউ বলতে পারে না। বিশেষ করে, আমাদের এই রুটে। উত্তর কলকাতা থেকে ছেড়ে, প্রায় শহরতলির সীমানায় বাসের গন্তব্য।

এ সময়ে যতটা ভিড় আশঙ্কা করা গিয়েছিল, সেই পরিমাণে যাত্রীর সংখ্যা কমই বলতে হবে। জানি না, এখানে কোনও খুন-টুন হয়েছে কি না, অথবা কোনওরকম বোমাবাজি ঘটেছে কি না। তা ঘটলে বোধহয়, বাসটা থাকতই না। একে প্রাইভেট বাস সার্ভিস আগেই গুটিয়ে নিত। তবে আজকালকার দিনে, রাত্রি নটা নাগাদ বাসে, যাত্রীর সংখ্যা নগণ্য। সেই হিসাবে, লোক একেবারে কম নেই। বসবার জায়গা একটিও খালি নেই। সেটা বাইরে থেকেই দেখতে পাচ্ছি। তবে ভিতরে দাঁড়াবার জায়গা অনেক। সেই হিসাবে বাসটাকে খালিই বলতে হবে। কলকাতার অবস্থা আগের মতো হলে, এখন তিল ধারণের জায়গা থাকত না। আজ দেখছি, কিছু মহিলা যাত্রীও আছে। আজকাল এ সময়ে, এক আধজন মহিলা যাত্রী দেখা যায়। সেই তুলনায়, একটা গোটা লম্বা সীট ভরতি মহিলা। হয়তো দল বেঁধে একসঙ্গে উঠেছে। আবার তা নাও হতে পারে।

কিন্তু এ সব ভেবে আমার লাভ নেই। লোকটা এক রকম দরজা আগলে রড ধরে দাঁড়িয়ে আছে কেন। লোকটা বললে ভুল বলা হয়। রোগা মত মাঝারি লম্বা পঁচিশ ছাব্বিশ বছরের একটা ছেলে। পোশাকের কোনও নতুনত্ব নেই। যেটা আজকাল সকলের গায়েই দেখা যায়, তিন ফুট প্যান্ট, দেড় ফুট জামা, সেইরকমই। বুকের বোতামগুলো খোলা। ভিতর থেকে গেঞ্জি দেখা যাচ্ছে। বাসের কনডাক্টর ভিতর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজা আগলে দাঁড়ানো ছেলেটাকে–ওকে অবিশ্যি আমার ছেলেও বলতে ইচ্ছা করছে না, কী বলব, কিছু বুঝতে পারছি না। তোক না, ছেলেও নয়, এদের কী বলতে হয়, আমি জানি না। হাতে একটা বাঁধানো খাতা থাকলে, ছাত্র মনে করা যেত। একে তাও মনে হচ্ছে না। ছোট ছোট চুল, রুক্ষু, কপালের ওপর এসে পড়েছে। একজোড়া সরু গোঁফ আছে। ভুরু কোঁচকানো। ঠিক অসুখী বলা যাবে না, যেন কোনও কারণে, তার মুখ শক্ত হয়ে আছে। শক্ত চোয়াল দেখে, তাকে রাগি আর অসন্তুষ্ট মনে হচ্ছে।

হতে পারে, কিন্তু সকলের অসুবিধা করে, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবার মানে কী। দরজার কাছে। গিয়ে দাঁড়াতেও, সে যেন আমাকে দেখতেই পেল না। কনডাক্টরও তাকে সরে যেতে বলল না, কেবল আমার দিকে একবার উদাসভাবে তাকাল। সাধারণত এরকম হবার কথা না। আমি বললাম, একটু সরুন তো, ভেতরে যাই।

সে দরজা থেকে নড়ল না, একটু সরে গেল। সেই ফাঁক দিয়ে আমি ঢুকলাম, এবং ঢোকার সময় মনে হল, আমি যেন হালকা একটা গন্ধ পেলাম। মদের গন্ধ। মাতাল নাকি! অতিরিক্ত নেশায়, একেবারে শিব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বোধহয়। যাই হোক গিয়ে, আমার কিছু বলবার দরকার নেই। আমি পিসলাভিং ম্যান। সারাদিন অনেক খাটুনি গিয়েছে। একনাগাড়ে প্রায় দেড় ডজন স্কেচ আঁকতে হয়েছে। কমার্শিয়াল শিল্পের কাজ। মেরুদণ্ডটা টনটন করছে। চোখে জ্বালা, সারা শরীরে একটা অবসন্নতা। তারপরে মীনাক্ষী এসেছিল। মীনাক্ষী আসাতেও সন্ধেটা যে ভাল কেটেছে, তা মোটেই বলতে পারি না। অথচ আশা ছিল, তাতেই সন্ধেটা ভাল কাটবে। মীনাক্ষী আজকাল আমাকে একটু সন্দেহের চোখে দেখছে। কিছুকাল ধরেই একটা সন্দেহ ওকে পেয়ে বসেছে, আমি বোধ হয় শেষ পর্যন্ত কথা রক্ষা করব না। অর্থাৎ ওকে বিয়ে করব না। আজকাল আমার কাজের ব্যস্ততাকে ও ওর প্রতি অবহেলা বলে মনে করে। সে কথা স্পষ্ট করে বলতে পারে না। গুম খেয়ে থাকে। হাসে না, ভাল করে কথা বলে না। যাক। গিয়ে, এখন কী হবে এ সব কথা ভেবে। মীনাক্ষীটা ঠিক থাকলে মন মেজাজ আর একটু ভাল থাকত।

কাঁধের ব্যাগটা ঠিক করে, আমি একবার বাসটার এদিক ওদিক দেখলাম। না, বসবার জায়গা একটিও নেই। বাসের সামনের দরজাতেও কনডাকটর চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। আমার মতো আরও দু-তিন জন দাঁড়িয়ে। এতেই বোঝা যায় যাত্রী সংখ্যা কত কমে গিয়েছে। রাত্রি মাত্র নটা বাজে। এখন ঠাসাঠাসি ভিড় থাকার কথা। এ সময়ে কনডাক্টরদের চিৎকার করার কথা। যাত্রীরাও কেউ তেমন কথাবার্তা বলছে না। আজকাল এই রকমই হয়েছে। কেউ বিশেষ কথা বলতে চায় না। যেন মুখ খুললেই এমন বেফাঁস কিছু বেরিয়ে পড়বে, তাইতে বিপদে পড়ে যাবে। অথচ, আগে বাসে উঠলে কান পাতা দায় ছিল। সেটাও বিরক্তিকর। কিন্তু এরকম চুপচাপ থাকাও অস্বস্তিকর। এ রুটের, বিশেষ করে এ সময়ের অনেক যাত্রীই মুখ চেনা। কারোর সঙ্গেই বাক্যালাপ করবার মতো পরিচয় নেই। তবে মোটামুটি অনেকেই অনেকের চেনা।

কারা যেন গলা নামিয়ে কী সব কথা বলছিল। ড্রাইভার তার জায়গায় বসে। কনডাক্টররাও যে যার দরজায়। একজনই শুধু বকর বকর করছিল, একজন আধবুড়ো মানুষ, কোথাও শান্তি নেই। বাজারে যাবেন, বেগুনের দাম শুনলে…।আমার শোনবার কোনও উৎসাহ নেই।

ছাড়বার তো সময় হল, কখন ছাড়বে?

একজন যাত্রী গলা তুলে জিজ্ঞেস করল। কনডাক্টররা কেউ কোনও জবাব দিল না। যেন কথাটা তারা শুনতেই পায়নি। দরজা আগলে দাঁড়ানো সেই লোকটা বা ছেলেটা, যাই হোক, কনডাক্টরের দিকে একবার ফিরে তাকাল। তার চোখের পাতা কোঁচকানো, চোখ দুটি যেন ধারালো ছুরির মতো চকচকে। কী ব্যাপার কিছু বুঝতে পারছি না। আর যে প্যাসেঞ্জার হবে না, সে তো পরিষ্কার। বাসটা ছাড়ছে না কেন। অবিশ্যি আমার কিছু বলার নেই, আমি পিসলাভিং ম্যান। একজন শান্তিপ্রিয় আর্টিস্ট। আমি কোনও কথা বলতে চাই না।

হঠাৎ ধমক বেজে উঠল, দরজায় দাঁড়িয়ে কেন, ভেতরে যাওয়া যায় না? ভেতরে তো অনেক জায়গা। উঠুন, না হয় নেমে যান।

তাকিয়ে দেখলাম, প্রায় বছর পঞ্চাশ বয়সের একটি লোক। দরজায় দাঁড়ানো ছেলেটাকে বা লোকটাকে, বেশ ঝাঁজের সঙ্গেই কথাগুলো বললেন। কথার শেষ দিকে, ভদ্রলোকের গলাটা শোনাল প্রায় আদেশের মতো। খুবই স্বাভাবিক। এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী। তথাপি সেই লোকটা বা ছেলেটা নড়ল না। ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি তার মুখ দেখতে পাচ্ছিলাম না।

ভদ্রলোক আবার হাঁকলেন, কী হল, আমাকে উঠতে দিতে হবে তো। বলে ভদ্রলোক পা বাড়ালেন। আর সেই তিন ফুট প্যান্ট, দেড় ফুট জামা নেমে দাঁড়াল। ভদ্রলোক উঠলেন, মহিলাদের সিট ঘেঁষে, রড ধরে দাঁড়ালেন, বলতে লাগলেন, যত সব বেয়াড়া ব্যাপার, দরজা আগলে দাঁড়িয়ে থাকবে, যেন আর কারোর ওঠার দরকার নেই..।

ভদ্রলোককে মনে মনে সায় দিলেও, আমার মতোই সবাই শান্তিপ্রিয়। কেউ কোনও কথা বলল না। তবে ভদ্রলোকের সাবেকি চাল দেখে সাবেকি-ই বলতে হবে, আজকাল কেউ এরকম করে বলে না, সবাই বেশ খুশি হয়েছে বোঝা যায়। গাড়িটার কিন্তু ছাড়বার নাম নেই। আবার একজন আওয়াজ দিল, কী হল, বাস ছাড়ছে না কেন?

সে আবার বাসের পা-দানিতে উঠে দাঁড়াল, ছেলেটা বা লোকটা প্রায় মিনিট খানেক পরে, সে বলে উঠল, নাঃ, শালা আসবে না, ছেড়ে দাও।

বলা মাত্রই কনডাক্টর ঘন্টি বাজিয়ে দিল। ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট করল। কনডাক্টর টিকেট বিক্রি শুরু করল। বোঝা গেল, ছেলেটা-ছেলেটা বলাই ভাল, তার হুকুমের জন্যই বাসটা ছাড়ছিল না। কেন? ও কে? আমার অবিশ্যি জানবার দরকার নেই। কোনওরকমে গন্তব্যে পৌঁছুতে পারলেই হল। মনে হল ছেলেটার কেউ আসবার কথা ছিল, এল না তাই বাস ছেড়ে দিতে বলল। ওর কথাতেই কি বাস চলে? ও কে? কথাটা আবার আমার মনে হল। মনে হয় কোনও লাভ নেই। যে-ই হোক, আমার জানবার দরকার নেই। তবু মনটা একটু খচখচ করতে লাগল। কোনও দিন দেখেছি বলে মনে পড়ে না, কিংবা হয়তো দেখেছি, মনে করতে পারছি না।

ছেলেটা এবার পাদানি ছেড়ে বাসের মধ্যে উঠে এল। এসে, সেই ভদ্রলোকের মুখোমুখি দাঁড়াল। তার মুখটা আরও শক্ত দেখাচ্ছে, চোখ দুটো চিতার মতো জ্বলছে। কোনও কিছু বুঝে ওঠবার আগেই শুনতে পেলাম, খুব যে চোখ গরম করে কথা হচ্ছিল, অ্যাঁ?

ভদ্রলোক এবার যেন একটু অবাক, বললেন, মানে?

এখন আর ছেলেটা নয়, লোকটা ঠাস করে ভদ্রলোকের গালে একটা চড় কষিয়ে দিল, শালা কার সঙ্গে কথা বলছ জান না? আমাকে রোয়াব দেখানো হচ্ছে। তোমার গর্দান নিয়ে নেব আজ।

বলেই ভদ্রলোকের বুকের কাছে জামা মুচড়ে চেপে ধরল। বাসের সবাই চকিত হল। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলল না। আমি কাছেই ছিলাম। একটু সরে দাঁড়ালাম। ভদ্রলোক গালে হাত রেখে বললেন, এ সবের মানে কী? আমি কী করেছি?

কী করেছ জান না?

লোকটা ভদ্রলোকের মুখে আবার হাতের পিছন দিয়ে আঘাত করল। জামাটা আরও জোরে মুচড়ে ধরে বলল, মদ মেরে এসে রমজানি হচ্ছে, এখন আবার মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে মজাকি করছ?

হঠাৎ হাঁটু তুলে, ভদ্রলোকের পেটে গুঁতিয়ে দিল। ভদ্রলোক একটা আর্তনাদ করে উঠলেন। লোকটাকে এখন ভয়ংকর দেখাচ্ছে, যেন চিতার মুখের গরাসে ছটফটে শিকার। কেউ কোনও কথা বলল না, কেন না, সকলেই শান্তিপ্রিয়, আমার মতোই। এ সব বিষয়ে কেউ মাথা গলাতে চায় না, যা হচ্ছে তোক। কিন্তু আমার মনে হল, ভদ্রলোকের প্রতি আঘাতগুলো যেন আমার গায়েই পড়ছে। আমার ভিতরটা কুঁকড়ে যাচ্ছে। দেড় ডজন স্কেচ বা মীনাক্ষী, কোনও কথাই আমার মনে পড়ছে না। আমি শুধু আমার অস্তিত্বটাকে নিয়ে একটা ভয়ংকর ভয়ে যেন কাঁপছি। সকলের, মেয়ে-পুরুষদের চোখে ত্রাস।

ভদ্রলোক আর্তস্বরে বললেন, মা বোনের ইজ্জত নিয়ে কী করেছি? লোকটা ভদ্রলোকের মুখে একটা ঘুষি কষাল, গর্জে বলল, মনে করেছ আমি দেখিনি, হাঁটু দিয়ে মেয়েদের গায়ে ঘষছিলে। ওই জন্য শালা এখানে এসে দাঁড়িয়েছ। আমাকে রোয়াব?

ভদ্রলোকের ঠোঁটের কষ ফেটে রক্ত পড়ছে। বললেন, মিথ্যে কথা।

চোপ।

আবার একটা ঘুষি মারল কানের পাশে। এ সময়ে কনডাক্টর বাস থামাবার ঘন্টি বাজাল। লোকটা চিৎকার করে বলল, গাড়ি এখানে দাঁড়াবে না। স্টপেজ ছাড়িয়ে দাঁড়াবে। প্যাসেঞ্জার নামবে, তুলবে না। তা না হলে গাড়ি জ্বলে যাবে বলে দিলাম।

গাড়ি স্টপেজে দাঁড়াল না। কেউ কোনও কথা বলল না। আমার মতো শান্তিপ্রিয় যাত্রীরা সবাই সন্ত্রস্ত চোখে ঘটনাটা দেখছিল।

ভদ্রলোক রড ধরে ঝুঁকে পড়েছেন, এবার পড়ে যাবেন মনে হচ্ছে। কিন্তু তাতে মার থামছে না। ভয়ংকর রাগে আর ঘৃণায়, লোকটা যেন ফুসছিল আর এলোপাথাড়ি মেরে যাচ্ছিল। ভদ্রলোকের হাত রড থেকে খসে পড়ল, কিন্তু বললেন, আমি মদ খাইনি, মেয়েদের বেইজ্জত করিনি। কেন শুধু শুধু মারছ আমাকে?

ফের মিথ্যে কথা? আমি নিজের চোখে দেখেছি। ওই জন্যই শালা আমাকে রোয়াব দেখিয়ে ভেতরে ঢুকতে চেয়েছিলে।

এবার একটা ঘুষি লাগাল গলার কাছে। ভদ্রলোক আর্তনাদ করে উঠলেন, বললেন, আমাকে বাঁচান, আমাকে মেরে ফেলছে।

গাড়িটা স্টপেজ ছেড়ে দাঁড়াল। দুজন মহিলা সমেত, কয়েকজন প্যাসেঞ্জার নেমে গেল। আবার সঙ্গে সঙ্গে ছেড়ে দিল। প্রাইভেট বাসের কনডাক্টর টিকিট বিক্রি করে যাচ্ছে। সবাই টিকিট কিনছে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছে না। সকলেই উদ্বিগ্ন মুখে চুপচাপ বসে আছে। দেখলেই বোঝা যায়, সকলেই গন্তব্যের জন্য অধীর ভাবে অপেক্ষা করছে। সকলেই আমার মতোই উৎকণ্ঠিত ভয়ে আর অস্বস্তিতে অস্থির। শান্তিপ্রিয় লোকেরা কে-ই বা এ সবের মধ্যে থাকতে চায়। কিন্তু আমি যেন আর বাসের মধ্যে থাকতে পারছি না। অজ্ঞান হয়ে যাব বা আর কিছু কিছুই বুঝতে পারছি না। আমি যেন নিজেকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। আমার ভিতরে যেরকম কাঁপছে, তাতে বুঝতে পারছি, অবস্থা খুবই খারাপ। আমি হয়তো ভদ্রলোকের মতোই আর্তনাদ করে উঠব।

বাঁচান, আমাকে বাঁচান, আমাকে মেরে ফেলছে। ভদ্রলোক এখন আর নিজের শরীরের ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে নেই। লোকটাই তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে, আর সমানে মেরে চলেছে। ভদ্রলোকের মুখটা রক্তে ভাসছে। চোয়াল চিবুক ভুরুর পাশে ফুলে উঠেছে।

এ সময়ই, হঠাৎ সবাইকে চমকে দিয়ে, একটি মেয়ের গলা শোনা গেল, উনি তো আমাদের কাউকে অসম্মান করেননি। ও কথা বলছেন কেন?

লোকটার সঙ্গে সবাই মেয়েটার দিকে ফিরে তাকাল। চব্বিশ-পঁচিশ বছর বয়স হবে, মাজা মাজা রং, স্বাস্থ্যবতী একটি মেয়ে, হাতে একটা ব্যাগ। লোকটা ঘুরে বলল, আপনি চুপ করে থাকুন, আপনার সঙ্গে কোনও কথা হচ্ছে না।

মেয়েটিকে রীতিমতো বীরাঙ্গনা বলে মনে হচ্ছে। অনেকটা যেন মীনাক্ষীর মতো দেখাচ্ছে। এত সাহস পেল কোথা থেকে। বলল, কেন চুপ করে থাকব। আপনি বলছেন, উনি মেয়েদের বেইজ্জত করেছেন। আমরা তো বসে আছি, উনি তো কিছু করেননি।

লোকটা আরও জোরে গর্জে উঠল, লাইনের বুঝি? চুপ করে থাকতে বলছি, চুপ করে থাকুন।

মেয়েটিও গলা তুলল, লাইনের মানে? কী বলতে চান?

লোকটা মেয়েটার দিক থেকে আবার ভদ্রলোকের দিকে ফিরল। আবার হাত তুলল মারবার জন্য, আর ঠিক সে সময়েই আমি আমার গলা শুনতে পেলাম।কেন, মিছিমিছি মারছেন ভদ্রলোককে? উনি তো আপনাকে কিছু বলেননি।

লোকটা আমার দিকে ফিরে তাকাল। ঠিক যেন শিং বাঁকানো খ্যাপা ষাঁড়ের মতো। কেন যে এরকম বলতে গেলাম নিজেই জানি না। এই কারণেই আমি নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। আসলে ভদ্রলোকের মতো আর্তনাদ করে ওঠা নয়, এ কথাটাই আমার ঠোঁটের ডগায় এসে আটকেছিল। অথচ আমার বিশ্বাস ছিল, আমি শান্তিপ্রিয় মানুষ, কোনও কথা বলব না। মেয়েটাই গোলমাল করল। বেশ ভালভাবেই সব মিটে যাচ্ছিল, ভদ্রলোক মরছিলেন। এখন লোকটার দিকে তাকিয়ে, আমার বুকের মধ্যে যেন কাঁপতে লাগল।

লোকটা আমার দিকে চেয়ে ধমকের সুরে জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

এখনও সময় আছে, কথা না বলাই উচিত। কিন্তু নিজের প্রতি আর আমার আস্থা রইল না। আমি শান্তভাবেই বলবার চেষ্টা করলাম, কেন শুধু শুধু মারছেন ভদ্রলোককে। উনি তো কিছু করেননি।

যেন আমি বললাম না। আর কেউ আমার ভিতর থেকে কথাগুলো বলে উঠল। আমি কোনও দিকে তাকিয়ে দেখলাম না। কেবল একটা গর্জন শুনতে পেলাম, এই গাড়ি রোখো।

বাসটা দাঁড়িয়ে পড়ল। লোকটা ভদ্রলোককে ছেড়ে দিল। ভদ্রলোক মুখ থুবড়ে পড়ে গেলেন। লোকটা আমার দিকে এগিয়ে এল। থাবা বাড়িয়ে সে আমার গলার কাছে জামা চেপে ধরল, বলল, এস বুঝিয়ে দিচ্ছি।

লোকটা আমাকে হ্যাঁচকা টান দিল। আমি আটকাবার চেষ্টা করলাম। সে আমাকে দরজার দিকে টেনে নিয়ে চলল। আমি চিৎকার করে বললাম, কোথায় নিয়ে যাচ্ছ। ছেড়ে দাও আমাকে।

লোকটার গলায় চিৎকার নেই। আমাকে জোরে টানতে টানতে বলল, ছেড়ে তোমাকে দেব। কেউ তোমাকে ধরে রাখতে পারবে না। কার পেছনে লাগতে এসেছ তুমি জান না।

আমি চেষ্টা করেও নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। সেই মেয়েটার দিকে আবার একবার ফিরে তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা করল। পারলাম না। আর কারোর দিকে তাকিয়ে দেখবার ইচ্ছা হল না। লোকটা আমাকে গাড়ি থেকে টেনে নীচে নামাল। চিৎকার করে হুকুম দিল, গাড়ি ছেড়ে দাও।

বাসটা ইঞ্জিন বন্ধ করেনি। হুকুম পাওয়া মাত্র গোঁ গোঁ শব্দ তুলে তাড়াতাড়ি চলে গেল। লোকটা আমাকে একইভাবে টেনে নিয়ে চলেছে। আমি বাধা দেবার চেষ্টা করছি। জায়গাটা আমি চিনতে পারছি না। অথচ চেনার কথা। কোনও দিকে তাকিয়ে দেখবার সুযোগ নেই। মনে হল, একটা রাস্তা, টিমটিম করে আলো জ্বলছে।

হঠাৎ আমার মুখের ওপর একটা ঘুষি পড়ল, শালা, তোমার জান খেয়ে নেব আজ।

আমি তখনও লোকটার হাত থেকে নিজেকে ছাড়াবার চেষ্টা করছি। আমার ঠোঁটের কষ ভিজে উঠেছে। লোকটা আমার জামা ছেড়ে দিয়ে এলোপাথাড়ি ঘুষি মারতে আরম্ভ করল। আমি চোখে অন্ধকার দেখলাম। ঠোঁট, নাক, চোখ, কোথাও ঘুষি পড়তে বাকি থাকল না। লোকটা শুধু হাতে মারছে কি না বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে, আমার সমস্ত মুখটা ফেটে যাচ্ছে, রক্ত পড়ছে। সেই অবস্থাতেই সে আমাকে ঠেলে ঠেলে একদিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমার কাঁধ থেকে ব্যাগটা পড়ে গেল।

সেই ভদ্রলোকের কথা আমার মনে হল, আর মনে হল, এরকম কিছুক্ষণ চললে, আমি মারা যাব। আমাকে খুন করার জন্যই মারা হচ্ছে। লোকটাকে বলে বোঝাবার কিছু নেই। আমি ওর কিছুই বুঝি না। কিন্তু যে মুহূর্তে মনে হল, লোকটা আমাকে খুন করতে চাইছে, সেই মুহূর্তে আমি সোজা হলাম। মার আটকাবার চেষ্টা করলাম, আর জীবনে এই প্রথম, জ্ঞান হওয়ার পরে একটা লোকের মুখের ওপরে আমি ঘুষি ছুঁড়ে মারলাম।

আমার গায়ে হাত?

এই কথাটা আমি শুনতে পেলাম। লোকটা আমার ঘাড়ের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। এ সময়েই কাদের গলার স্বর যেন আমি শুনতে পেলাম। লোকটা তখন আমাকে মাটিতে ফেলে, গলাটা চেপে ধরবার চেষ্টা করছে। আমি যেন একটি মেয়ের গলাও শুনতে পেলাম, ওই তো ওখানে।

আমি লোকটাকে দুহাতে ঠেলে রাখবার চেষ্টা করছি। সে আমাকে হাঁটু দিয়ে শরীরের সবখানে মারছিল। কতগুলো পায়ের শব্দ এদিকে ছুটে আসছে মনে হল। একটা পাথরের মতো কিছু আমার মুখের ওপর আছড়ে পড়ল। তারপরে আর কিছু মনে করতে পারছি না।…

এখন আমি হাসপাতালের বিছানায় শোয়া। মুখে মাথায় ব্যান্ডেজ। শরীরের অন্যান্য অংশও ব্যথা, ওষুধ লাগানো আছে। এখনও পর্যন্ত আমাকে কেউ দেখতে আসেনি। লোকটার মুখটাই আমার চোখে ভাসছে। ওর একটা স্কেচ আমি এঁকে ফেলতে পারব। কী জন্য খুন হইনি, এখনও জানি না। লোকটা কে, কেন তার এত রাগ আর ঘৃণা, কেন সে খুনে হয়ে উঠেছে, আমি কিছুই জানি না। আমি শান্তিপ্রিয় থাকতে চেয়েছিলাম, ওটাকে শান্তিপ্রিয়তা বলে, না আর কিছু বুঝি না। কিন্তু তা আমি থাকতে পারলুম না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *