শান্তিনিকেতন ১৯৩১
১৯৩১ সালে এমএ পাশ করে শান্তিনিকেতনে গেছি মাস্টারনি হয়ে। ওঁরা অবিশ্যি বলতেন অধ্যাপিকা। পঁচাশি টাকা মাইনে পাই; তার থেকে বোর্ডিং-এ থাকা-খাওয়া বাবদ কুড়ি টাকা বাদ যায়। বাকি টাকা দিয়ে কী যে করব ভেবে পাই না, তখন ধারে-কাছে না ছিল দোকানপাট, না ছিল হোটেল-রেস্তোরাঁ। থাকলেও কোনও সুবিধে হত না জানি। কারণ ওখানে সবাই সাদাসিধে কাপড় পরত; বেশির ভাগ খালি পায়ে হাঁটত; চটি ছিল পোশাকি ব্যাপার, কলকাতা থেকে আমরা শিল্পী সত্যেন বিশীকে দিয়ে আনাতাম। দেড় টাকা দিয়ে চমৎকার সব জিনিস পাওয়া যেত।
সে যাই হোক গে, কাজটি ভারী ভাল লাগত। দার্জিলিং-এ যখন কবির সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তখন কিছু খুলে বলেননি। শান্তিনিকেতনে ফিরে গিয়েই নিজের হাতে চিঠি লিখলেন— আশা অধিকারী এক বছরের ছুটি নিয়েছে, তুমি এসে ওই একটা বছর শিশু বিভাগের ভার নাও। সে আর বলতে। গরমের ছুটির পর গিয়ে জুটেছিলাম।
কিন্তু ততদিনে আমার ‘সন্দেশ’-এ প্রকাশিত ছোটদের গল্প পড়া ছাড়াও দেখলাম আমার সম্বন্ধে কিছু খোঁজখবর নিয়েছেন। ফলে শিশুবিভাগে গল্প বলি, একটু বড় ছেলেদের ইংরেজি পড়াই আর বিএ ইংরেজি অনার্সেরও ক্লাস নিই।
প্রথম দিন দশম শ্রেণির ইংরেজি ক্লাস নিতে গেছি। আমবাগানের দক্ষিণে শালবীথি, সেখানে একটা বড় ফটক, তার ওপর মধুমালতী লতা বেয়ে উঠেছে। জায়গাটি আমার ভারী পছন্দ। মন্দ মন্দ বাতাস দেয়, ফুলের গন্ধ ভুরভুর করে। তা হলে হবে কী! পড়ুয়াদের কাছে শুনলাম যে ফটকের তলাটা নাকি জগদানন্দবাবুর অঙ্কের ক্লাসের জন্য নির্দিষ্ট। নির্দিষ্ট মানে তিনি নিজেই ওইরকম নির্দেশ দিয়ে থাকবেন। কী আর করি, অগত্যা মহুয়াগাছের নীচে জায়গা নিলাম। আশ্চর্য মানুষ জগদানন্দ রায়, নানা বিষয়ে পণ্ডিত, লেখক, চমৎকার মানুষ, ছাত্রগতপ্রাণ। তবে রেগে গেলে মাঝে মাঝে যাদব চক্রবর্তীর মোটা অঙ্কের বই ছুড়ে মারতেন। দু’-একবার মারবার পর মলাট আলগা হয়ে যেত। নিজের বই আনতে ভুলতেন, এদিকে কেউ বই দিতেও চাইত না। শেষটা মনিটর রোজ একটা ছেঁড়া বই সঙ্গে আনতে লাগল। কিন্তু কোনও ছাত্রছাত্রীর কোনও কিছুর দরকার হলে, খালি হাতে তাঁর কাছ থেকে ফিরত না।
বসবাস জন্যে একটা নতুন শতরঞ্জির আসন পেয়েছিলাম। সেটি পেতে মহুয়া তলায় প্রথম দিন ভয়ে ভয়ে গিয়ে বসলাম। আমার সামনে অর্ধচন্দ্রাকারে দু’সারি পড়ুয়া বসল। ছেলেরা ডান দিকে, মেয়েরা বাঁ দিকে। নতুন এসেছি, সবে আসনটা পেয়েছি, তখনও বইটই পাইনি। পড়ুয়াদের কাছে একটা বই চাইলাম। ছেলেমেয়েগুলো একটুক্ষণ এ ওর দিকে চেয়ে, দ্বিধাভরে একটা ছেঁড়ামতো বই দিল। তখনও বই-ছোড়ার কাহিনি শুনিনি, তাই ওদের দোমনা ভাব দেখে একটু অবাক হলাম।
বই খুলে সেদিনকার পড়ার জায়গাটা বের করে দেখি সব শক্ত কথাগুলোর তলায় পেনসিলের দাগ, পাশে মানে লেখা। এক জায়গায় দেখি Soot শব্দটির মানে লেখা ‘ঝোল’। বিস্মিত হয়ে বইয়ের মালিকের নামটা দেখে নিয়ে বললাম, ‘আচ্ছা, রাসবিহারী, Soot মানে ঝোল লিখেছ কেন?’ তাই শুনে সকলের কী হাসি!
পোড়োরা বলল, ‘ও বাঙাল দেখুন। রান্নাঘরে “মাছের ঝুল, মাছের ঝুল” করছিল বলে আমরা বুঝিয়ে বললাম, “ঝুল না, ঝোল বল!” তারপর তনয়দা ক্লাসে যেই বলেছেন Soot মানে ঝুল, ও নিশ্চয় ভেবেছে উনিও বাঙাল, তাই লিখে রেখেছে ঝোল।’
আরেকদিন আরেকটু ছোট ছেলেদের ইংরেজি গ্রামার পড়াচ্ছি। শীতকাল; মুখে মাথায় টুপটাপ করে পাকা মহুয়ার ফল পড়ছে। আমারই পড়ানোতে মন যাচ্ছে না, ওদের কথা ছেড়েই দিলাম। তারই মধ্যে আশ্চর্য হয়ে দেখি একটা বারো-তেরো বছরের ছেলে, আমার দিকে পাশ ফিরে, শালগাছে ঠেস দিয়ে বসে, গভীর মনোযোগের সঙ্গে কী একটা বই পড়ছে। পড়তে পড়তে তার চুল খাড়া হয়ে উঠছে, চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছে, থুতনি ঝুলে পড়ছে। ও বই কখনওই ইংরেজি গ্রামার হতে পারে না।
বিরক্ত হয়ে বললাম, ‘কানু, কী পড়ছিস নিয়ে আয়।’ কানু তক্ষুনি বইটা হাঁটুর তলায় লুকিয়ে ফেলে, কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘ইয়ে— মানে— এটা আপনি না পড়লেই ভাল হয়।’ আমারও কেমন জেদ চেপে গেল। কড়া গলায় বললাম, ‘নিয়ে আয় বলছি!’
বই হাতে নিয়ে দেখি মলাটের ওপর অন্ধকার এক গুহার ছবি। গুহার মধ্যে থেকে বিকট একটা ড্রাগনের মতো জানোয়ার মুখ বের করে রয়েছে। তার নাক দিয়ে আগুনের হলকা ছুটছে। ওপরে লাল হরফে লেখা ‘তিব্বতী গুহার ভয়ংকর’ আর নীচে লেখা ‘রোমাঞ্চ সিরিজ, ২২ নং’। আমি বললাম, ‘বইটা আমার কাছে থাক। কাল নিস। ক্লাসে গল্পের বই আনা ভারী খারাপ।’
বিকেলে প্রায় রোজই আমরা কেউ কেউ কবির কাছে যেতাম। সান্ধ্য আসর আরম্ভ হতে তখনও দেরি। কবির জাব্বা-জোব্বা পরা হয়নি। গায়ে একটি ঢিলে হাতার মিহি খদ্দরের পাঞ্জাবি। ঠিক সাদা নয়, সাদা জমির ওপর ছাই রঙের সূক্ষ্ম ডোরা কাটা। হাতা দুটি কনুই অবধি গুটোনো। ফরসা বলিষ্ঠ বাহু দেখে আশ্চর্য হতাম। সাদা ধুতি। পায়ে কটকী চটি, কখনও সাদামতো, কখনও গাঢ় নীল, তাতে ছুঁচের কাজ করা।
আমাকে দেখেই সারাদিনের কাজকর্মের কথা জিজ্ঞাসা করতেন, নানারকম রসের গল্প বলতেন। আমার সঙ্গে থাকত আমার বাল্যবন্ধু পূর্ণিমা ঠাকুর, দীপু ঠাকুরের নাতনি। সেও পড়াত ওখানে। একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আজ ইংরেজি ক্লাসে কী করালে?’ বললাম, ‘গোরুর বিষয়ে রচনা লেখালাম।’ বললেন, ‘তা, তারা কী লিখল?’ বললাম, ‘একজন লিখল, The cow is a domesticated vegetarian!’
শুনেই উনি খাড়া হয়ে বসে বললেন, ‘অ্যাঁ! বল কী! ওটা যে আমার বর্ণনা। আমিও তো domesticated vegetarian!’ এইরকম আমুদে মানুষ ছিলেন। সে সময় উনি নিরামিষ খেতেন, প্রচুর ফল খেতেন। ভোরে উঠতেন; উঠেই ছবি আঁকার সরঞ্জাম নিয়ে বসতেন। উদয়ন বাড়ির দক্ষিণ দিকে একটা রংচং খড়খড়ি দেওয়া বারান্দা দেখা যায়। আজকাল সেটি অষ্টপ্রহর বন্ধ থাকে দেখি। তখন ওদিক দিয়ে যাওয়া-আসা করা যেত। পথ দিয়ে যেতে যেদিন গলাখাঁকারির শব্দ শুনতাম, সেদিন সাহস করে ঢুকে পড়তাম। আর যেদিন দেখতাম সব নিস্তব্ধ নিঝুম, সেদিন বুঝতাম কবি সৃষ্টির কাজে মগ্ন আছেন। সেদিন আর ভিতরে যাবার চেষ্টা করতাম না।
মনে আছে একদিন দেখেছিলাম, কবির আরামকেদারার সামনে, নিচু শ্বেতপাথরের জলচৌকির ওপর সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরা অপূর্ব সুন্দর একজন পুরুষ বসে। আমাকে দেখে কবি ডাকলেন, ‘এসো এসো, এই সুন্দর মানুষটির সঙ্গে আলাপ করো। এর নাম সুধীন্দ্রনাথ দত্ত।’
আমার মনে হল এমন সুন্দর মানুষ বাস্তবিকই আর দেখিনি। কবি একটু হেসে বললেন, ‘কিন্তু মনে রেখো ও বিবাহিত।’