এখানে যারা একসঙ্গে এসে মিলেছি, তাদের অনেকেই একদিন পরস্পরের পরিচিত ছিলুম না; কোন্ গৃহ থেকে কে এসেছি, তার ঠিক নেই। যে দিন কেউ এসে পৌঁছল তার আগের দিনেও তার সঙ্গে অসীম অপরিচয়। তার পরে একেবারে সেই না-জানার সমুদ্র থেকে জানা-শোনার তটে মিলন হল। তার পরে এই মিলনের সম্বন্ধ কতদিনের কত না-দেখা-শুনোর মধ্যে দিয়েও টিকে থাকবে। এই জানাটুকু কতই সংকীর্ণ, অথচ তার পূর্বদিনের না-জানা কত বৃহৎ।
মায়ের কোলে যেম্নি ছেলেটি এল, অম্নি মনে হল এদের পরিচয়ের সীমা নেই; যেন তার সঙ্গে অনাদি কালের সম্বন্ধ, অনন্তকাল যেন সেই সম্বন্ধ থাকবে। কেন এমন মনে হয়? কেননা, সত্যের তো সীমা দেখা যায় না। সমস্ত “না’ বিলুপ্ত করেই সত্য দেখা দেয়। সম্বন্ধ যেখানেই সত্য সেখানে ছোটো হয় বড়ো, মুহূর্ত হয় অনন্ত; সেখানে একটি শিশু আপন পরম মূল্যে সমস্ত সৌরজগতের সমান হয়ে দাঁড়ায়, সেখানে কেবল জন্ম এবং মৃত্যুর সীমার মধ্যে তার জীবনের সীমা দেখা যায় না, মনের মধ্যে আকাশের ধ্রুবতারাটির মতো সে দেখা দেয়। যার সঙ্গে সম্বন্ধ গভীর হয় নি, তাকে মৃত্যুর মধ্যে কল্পনা করতে মন বাধা পায় না, কিন্তু পিতামাতাকে, ভাইকে, বন্ধুকে যে জানি, সেই জানার মধ্যে সত্যের ধর্ম আছে– সেই সত্যের ধর্মই নিত্যতাকে দেখিয়ে দেয়। অন্ধকারে আমরা হাতের কাছের একটুখানি জিনিসকে একটুখানি জায়গার মধ্যে দেখতে পারি। একটু আলো পড়বামাত্র জানতে পারি যে, দৃষ্টির সংকীর্ণতা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে যা-কিছু ভয়ভাবনা, সে কেবল অন্ধকার থেকেই হয়েছে। সত্য-সম্বন্ধে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে সেই আলো ফেলে এবং এই আলোতে আমরা নিত্যকে দেখি।
হৃদয়ের আলো হচ্ছে প্রীতির আলো, অপ্রীতি হচ্ছে অন্ধকার। অতএব এই প্রীতির আলোতে আমরা যে-সত্যকে দেখতে পাই, সেইটিকে শ্রদ্ধা করতে হবে; বাহিরের অন্ধকার তাকে যতই প্রতিবাদ করুক, এই শ্রদ্ধাকে যেন বিচলিত না করে। সত্যপ্রীতির কাছে অল্প বলে কিছু নেই, সত্যপ্রীতি ভূমাকেই জানে। সংসার সেই ভূমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয়, মৃত্যু সেই ভূমার বিরুদ্ধে প্রমাণ দিতে থাকে, কিন্তু প্রেমের অন্তরতম অভিজ্ঞতা যেন আপনার সত্যে আপনি বিশ্বাস না হারায়।
আমাদের যে অতি প্রিয়, প্রিয়দর্শন ছাত্রটি এখানে এসেছিল– না-জানার অতলস্পর্শ অন্ধকার থেকে জানার জ্যোতির্ময় লোকে– এল তার জাগ্রত জীবন্ত ঔৎসুকপূর্ণ চিত্ত নিয়ে, আমাদের কাজকর্মে সুখে দুঃখে যোগ দিলে– আজ শুনছি সে নেই। কিন্তু যেই শুনলুম সে নেই, অমনি তার কত ছোটো ছোটো কথা বড়ো হয়ে উঠে আমাদের মনের সামনে দেখা দিলে। ক্লাসে যখন সে পড়ত, তখন সেই পড়ার সময়কার বিশেষ দিনের বিশেষ এক-একটি সামান্য ঘটনা, বিশেষ কথায় তার হাসি, বিশেষ প্রশ্নের উত্তরে তার উৎসাহ, এ-সব কথা এতদিন বিশেষভাবে মনে ছিল না, আজ মনে পড়ে গেল। তার পরে ছেলেদের আনন্দবাজারে যে-সব কৌতুকের উপকরণ সে জড়ো করেছিল, সে সমস্ত আজ বড়ো হয়ে মনে পড়েছে।
বড়োলোকের বড়োকীর্তি আমাদের স্মরণক্ষেত্রে আপনি জেগে উঠে। সেখানে কীর্তিটাই নিজের মূল্যে নিজেকে প্রকাশ করে। কিন্তু এই বালকের যে-সব কথা আমাদের মনে পড়ছে, তাদের তো নিজের কোনো নিরপেক্ষ মূল্য নেই। তারা যে বড়ো হয়ে উঠেছে সে কেবল একটি মূল সত্যের যোগে। সেই সত্যটি হচ্ছে সেই বালকটি স্বয়ং। পূর্বেই বলেছি, সত্য ভূমা। অর্থাৎ বাইরের মাপে, কোনো প্রয়োজনের পরিমাণে, তার মূল্য নয়– তার মূল্য আপনাতেই। সেই মূল্যেই তার ছোটোও ছোটো নয়, তার সামান্য চিহ্নও তুচ্ছ নয়– এই কথা ধরা পড়ে প্রেমের কাছে।
তোমাদের সঙ্গে সে যে হেসেছিল, খেলেছিল, একসঙ্গে পড়েছিল, এ কি কম কথা! তার সেই হাসি খেলা, তোমাদের সঙ্গে তার সেই পড়াশোনা, মানুষের চিরউৎসারিত সৌহার্দ্য-ধারারই অঙ্গ, সৃষ্টির মধ্যে যে অমৃত আছে, সেই অমৃতেরই অংশ। আমাদের এখানে তোমাদের যে প্রাণপ্রবাহ, যে আনন্দপ্রবাহ বয়ে চলেছে, তার মধ্যে সেও তার জীবনের গতি কিছু দিয়ে গেল,এখানকার সৃষ্টির মধ্যে সেও আপনাকে কিছু রেখে গেল। এখানে দিনের সঙ্গে দিন, কাজের সঙ্গে কাজ, ভাবের সঙ্গে ভাব, প্রতিদিন যে গাঁথা পড়ছে, নানা রঙে নানা সুতোয় মিলে এখানে একটি রচনাকার্য চলছে। সেইজন্যে এখানে আমাদের সকলেরই জীবনের ছোটো বড়ো নানা টুকরো ধরা পড়ে যাচ্ছে; সেই বালকেরও জীবনের যে অংশ এখানে পড়েছে, সমস্ত আশ্রমের সেইটুকু রয়ে গেল, এই কথাটি আজ তার শ্রাদ্ধ-দিনে মনে করতে হবে।
তা ছাড়া তার জীবনের কীর্তিও কিছু আছে এখানে। ভুবনডাঙার গরীবদের জন্যে সে এখানে যে নৈশবিদ্যালয় স্থাপন করে গেছে, তার কথা তোমরা সবাই জান। চাঁদা সংগ্রহ করে আমরা অনেক সময় মঙ্গল অনুষ্ঠানের চেষ্টা করে থাকি। কিন্তু তার চেয়ে বড়ো হচ্ছে নিজের সাধ্য দ্বারা, নিজের উপার্জনের অর্থ দ্বারা কাজ করা। নৈশবিদ্যালয় স্থাপন সম্বন্ধে মুলু তাই করেছে। সে পুরোনো কাগজ নিজে বোলপুরে বয়ে নিয়ে বিক্রি করে এই বিদ্যালয়ের ব্যয় নির্বাহ করত। সে নিজে তাদের শেখাত, তাদের আমোদ দিত। এ সম্বন্ধে আশ্রমের কর্তৃপক্ষের কোনো সাহায্য সে নেয় নি। এই অনুষ্ঠানটি কেবল যে তার ইচ্ছা থেকে প্রসূত, তা নয়, তার নিজের ত্যাগের দ্বারা গঠিত। তার এই কাজটি, এবং তার চেয়ে বড়ো, তার এই উৎসাহটি, আশ্রমে রয়ে গেল।
পূর্বে বলেছি, অপরিসীম অজানা থেকে জানার মধ্যে মানুষ আসবামাত্রই সেই না-জানার শূন্যতা এক নিমেষে চলে যায়– সেই না-জানার মহা গহ্বর সত্যের দ্বারা নিমেষে পূর্ণ হয়ে যায়। অন্তরের মধ্যে বুঝতে পারি, আমাদের গোচরতা এবং অগোচরতা, দুইকেই ব্যাপ্ত করে সত্যের লীলা চলছে। অগোচরতা সত্যের বিলোপ নয়। পাবার বেলায় এই যে আমাদের অনুভূতি, ছাড়বার বেলায় একে আমরা ভুলব কেন? ঢেউয়ের চূড়াটি নীচের থেকে উপরে যখন উঠে পড়ল, তখন সত্যের বার্তা পেয়েছি; ঢেউয়ের চূড়াটি যখন উপর থেকে নীচে নেমে পড়ল, তখন সত্যের সেই বার্তাটিকে কেন বিশ্বাস করব না? এক-সময়ে সত্য আমাদের গোচরে এসে “আমি আছি’ এই কথাটি আমাদের মনের মধ্যে লিখে দিল– তার স্বাক্ষর রইল; এখন সে যদি অগোচরে যায়, অন্তরের মধ্যে তার এই দলিল মিথ্যে হবে কেন? ঋষি বলেছেন–
“ভয়াদস্যাগ্নিস্তপতি ভয়াত্তপতি সূর্য্যঃ
ভয়াদিন্দ্রশ্চ বায়ুশ্চ মৃত্যুর্দ্ধাবতি পঞ্চমঃ।”
এই শ্লোকটির অর্থ এই যে, মৃত্যু সৃষ্টির বিরুদ্ধ শক্তি নয়। এই পৃথিবীর সৃষ্টিতে যেগুলি চালকশক্তি, তার মধ্যে অগ্নি হচ্ছে একটি; অণু-পরমাণুর অন্তরে অন্তরে থেকে তাপরূপে অগ্নি যোজন-বিয়োজনের কাজ করছেই। সূর্যও তেমনি পৃথিবীর সমস্ত প্রাণকে এবং ঋতু সম্বৎসরকে চালনা করছে। জল পৃথিবীর নাড়ীতে নাড়ীতে প্রবহমান, বায়ু পৃথিবীর নিশ্বাসে নিশ্বাসে সমীরিত। সৃষ্টির এই ধাবমান শক্তির মধ্যেই মৃত্যুকেও গণ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ মৃত্যু প্রতি মুহূর্তেই প্রাণকে অগ্রসর করে দিচ্ছে– মৃত্যু ও প্রাণ এই দুইয়ে মিলে তবে জীবন। এই মৃত্যুকে প্রাণের থেকে বিচ্ছিন্ন করে বিভক্ত করে দেখলে, মিথ্যার বিভীষিকা আমাদের ভয় দেখাতে থাকে। এই মৃত্যু আর প্রাণের বিশ্বব্যাপী বিরাট ছন্দের মধ্যে আমাদের সকলের অস্তিত্ব বিধৃত হয়ে লীলায়িত হচ্ছে; এই ছন্দের যতিকে ছন্দ থেকে পৃথক করে দেখলেই তাকে শূন্য করে দেখা হয়; দুইকে অভেদ করে দেখলেই তবে ছন্দকে পূর্ণ করে পাওয়া যায়। প্রিয়জনের মৃত্যুতেই এই যতিকে ছন্দের অঙ্গ বলে দেখা সহজ হয়– কেননা, আমাদের প্রীতির ধনের বিনাশ স্বীকার করা আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য। এইজন্যে শ্রাদ্ধের দিন হচ্ছে শ্রদ্ধার দিন, এই কথা বলবার দিন যে, মৃত্যুর মধ্যে আমরা প্রাণকেই শ্রদ্ধা করি।
আমাদের প্রেমের ধন স্নেহের ধন যারা চলে যায়, তারা সেই শ্রদ্ধাকে জাগিয়ে দিক, তারা আমাদের জীবনগৃহের যে দরজা খুলে দিয়ে যায়, তার মধ্য দিয়ে আমরা শূন্যকে যেন না দেখি, অসীম পূর্ণকেই যেন দেখতে পাই। আমাদের সেই যে অসত্যদৃষ্টি, যা জীবন-মৃত্যুকে ভাগ করে ভয়কে জাগিয়ে তোলে, তার হাত থেকে সত্যস্বরূপ আমাদের রক্ষা করুন, মৃত্যুর ভিতর দিয়ে তিনি আমাদের অমৃতে নিয়ে যান।
প্রবাসী, আশ্বিন, ১৩৪২