শাদা পৃথিবী
৬ আগস্ট ১৯৪৬
বিগ্ বেন্ ঘড়িতে মন্দ্র-মন্থর শব্দে তিনবার ঘণ্টা বাজিল। রাত্রি তিনটা। নৈশ লন্ডনের হিমাচ্ছন্ন বাতাসে এই গম্ভীর নির্ঘোষ তরঙ্গ তুলিয়া বহুদূর পর্যন্ত ছড়াইয়া পড়িল।
স্যর জন্ হোয়াইট তাঁহার লাইব্রেরি কক্ষে একটি চামড়া-মোড়া চেয়ারে বসিয়া গভীর চিন্তায় মগ্ন হইয়া ছিলেন। মাথার উপর একটিমাত্র বৈদ্যুতিক দীপ শাদা বিম্বাবরণের ভিতরে থাকিয়া স্যর জনের কেশহীন ডিম্বাকৃতি মস্তকের উপর আলোক প্রতিফলিত করিতেছিল। অশীতি বৎসর বয়স্ক বৃদ্ধ স্যর জন্ হোয়াইটের নাম জানে না এমন লোক পৃথিবীতে কমই আছে। একাধারে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক, কর্মী ও ভাবুক! পাশ্চাত্য জগতে তিনি একজন ঋষি বলিয়া পরিচিত। তাঁহার প্রাণের উদারতা ও জ্ঞানের গভীরতার সহিত যাঁহাদের পরিচয় আছে তাঁহারা একবাক্যে তাঁহাকে আধুনিক যুগের সক্রেটিস্ বলিয়া স্বীকার করেন। এত বয়সেও তাঁহার দৈহিক স্বাস্থ্য ও মানসিক সজীবতা অক্ষুন্ন আছে।
বিগ্ বেনের শব্দতরঙ্গ কানে আসিয়া আঘাত করিতেই স্যর জনের ধ্যানস্থির দেহ একটু নড়িয়া চড়িয়া উঠিল, তিনি দেয়ালের ঘড়ির দিকে চক্ষু তুলিলেন। রাত্রি তিনটা! পুরা ছয় ঘন্টা তিনি এইভাবে বসিয়া আছেন! কি ভাবিতেছিলেন? সহসা তাঁহার মস্তিষ্কের মধ্যে সহস্র আণবিক বোমার অসহ্য আলোকের মতো একটা গগন-বিদারী দীপ্তি জ্বলিয়া উঠিল। যে-প্রশ্ন গত ছয় ঘণ্টা ধরিয়া তাঁহার মস্তিষ্ক আলোড়িত করিতেছিল—যে-প্রশ্ন তাঁহার দীর্ঘ জীবনের অধিকাংশ সময় জুড়িয়া বসিয়া আছে—সেই প্রশ্নের পরিপূর্ণ উত্তর মন্ত্রদ্রষ্টা কবির মতো তিনি চোখের সম্মুখে দেখিতে পাইলেন।
স্নায়ুপেশী শক্ত করিয়া স্যর জন্ ঘড়ির দিকে তাকাইয়া রহিলেন। তাঁহার চিন্তার গগনলেহী স্পর্ধা যেন তাঁহার মনকে ক্ষণকালের জন্য অসাড় ও স্তম্ভিত করিয়া দিল। তারপর তিনি ধড়মড় করিয়া উঠিয়া দাঁড়াইলেন। ঘরে কেহ থাকিলে লক্ষ্য করিত তাঁহার দুই হাত ও হাঁটু থরথর করিয়া কাঁপিতেছে।
স্খলিতপদে স্যর জন্ কয়েকবার ঘরের কার্পেট-ঢাকা মেঝের উপর পায়চারি করিলেন, তারপর হঠাৎ ফিরিয়া ঘরের কোণের দিকে গেলেন। ঘরের কোণে একটি ছোট টেবিলের উপর টেলিফোন ছিল, স্যর জন্ কম্পিত হস্তে তাহা তুলিয়া লইলেন।
পালামেন্টে তখন গণসভার অধিবেশন চলিতেছিল। স্যর জন্ প্রায় পনেরো মিনিট অপেক্ষা করিবার পর টেলিফোনের অপর প্রান্তে গলার আওয়াজ শোনা গেল। বিব্রত অধীর কণ্ঠস্বর বলিল, ‘হ্যালো স্যর জন্? এত রাত্রে কি হল আপনার?’
স্যর জন্ ব্যগ্রকণ্ঠে বলিলেন, ‘কে, উনি? শোনো, তোমার সঙ্গে ভয়ানক জরুরী কথা আছে—’
বিব্রত কণ্ঠস্বর বলিল, ‘কিন্তু এখন যে আমি ভারি ব্যস্ত, দশমিনিট পরে বক্তৃতা দিতে হবে। নতুন গভর্মেন্ট ভারতবর্ষের কালা আদমিগুলোকে নাই দিয়ে মাথায় তুলেছে—তার বিরুদ্ধে বক্তৃতা—’
স্যর জন্ বলিলেন, ‘চুলোয় যাক তোমার বক্তৃতা—যেমন আছ তেমনি চলে এস। খবর আছে—বিরাট বিপুল খবর। এত বড় খবর পৃথিবীতে কেউ কখনও শোনেনি—’
ওদিকে কণ্ঠস্বর এবার আগ্রহান্বিত হইয়া উঠিল, ‘কী খবর? কিসের খবর?’
একটু নীরব থাকিয়া স্যর জন্ বলিলেন, ‘আমি মানুষের মুক্তিপথ খুঁজে পেয়েছি—শাদা মানুষের মুক্তিপথ—’
তাঁহার গলা কাঁপিয়া গেল।
৫ জানুয়ারী ১৯৪৭
ইংলন্ডে একটি সংবাদপত্রের রবিবাসরীয় সংখ্যায় একটি প্রবন্ধ বাহির হইয়াছে। সংবাদপত্রটি মধ্যমশ্রেণীর একটি টোরী পত্রিকা। প্রবন্ধ লেখক একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক; অবসরকালে রাজনীতি সম্বন্ধে খেয়ালী জল্পনামূলক অপিচ বিজ্ঞানগন্ধী নিবন্ধ লিখিয়া প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছেন।
তাঁহার বর্তমান রচনাটি সংক্ষেপে এইরূপ—
‘মানুষের বিজ্ঞানবুদ্ধি তাহার বিবেকবুদ্ধিকে ছাড়াইয়া গিয়াছে। ফলে সে আরাম বিলাস ও ভোগের বহু নূতন উপাদান পাইয়াছে, শত্রু ধ্বংস করিবার বহু ভয়ঙ্কর অস্ত্রলাভ করিয়াছে; তাহার জীবন উপভোগ করিবার লালসা শতগুণ বাড়িয়া গিয়াছে। কিন্তু তদনুপাতে পরস্পর মিলিয়া মিশিয়া ভ্ৰাতৃভাবে বাস করিবার কোনও উদ্যমই দেখা যায় না। খ্রীস্টের অনুশাসন মানুষের জীবনে ব্যর্থ হইয়াছে।
‘ইহা রূঢ় সত্য; ইহাকে এড়াইবার উপায় নাই। সুতরাং সত্যকে সহজভাবে স্বীকার করিয়া সতর্কতার সহিত তাহার সম্মুখীন হওয়াই সমীচীন। মানুষের পশুমূলক জৈবপ্রবৃত্তি দেড় লক্ষ বৎসরের কর্ষণের ফলেও যখন উন্মূলিত হয় নাই তখন আগামী দু’চার বছরে যে নির্মূল হইবে এমন সম্ভাবনা সুদূর পরাহত বলিয়াই মনে হয়। কোনও কোনও দিব্যদর্শী মননশীল ব্যক্তি মনে করেন মনুষ্যজাতি সমষ্টিগতভাবে অচিরাৎ ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবে।
‘মনুষ্য সম্প্রদায় কয়েকটি বিভিন্ন জাতিতে বিভক্ত হইয়া পৃথিবীপৃষ্ঠের ভিন্ন ভিন্ন ভূভাগ দখল করিয়া আছে। ইহাদের মধ্যে ক্রমাগত সংঘর্ষ চলিতেছে; যে জাতি ছোট সে বড় হইতে চায়, যে বড় সে আরও বড় হইতে চায়, ভূমির ক্ষুধা ইহাদের কিছুতেই মিটিতেছে না।
‘ইহার অর্থ কি? কোন্ নিগূঢ় প্রবৃত্তি জাতিকে জাতির বিরুদ্ধে, এমন মারাত্মকভাবে হিংস্র করিয়া তুলিয়াছে? সকলেই জানে এই বিস্তীর্ণা পৃথিবীতে সকলের জন্যই পর্যাপ্ত স্থান আছে—যৌথভাবে কাজ করিলে সকলের জন্যই প্রভূত খাদ্য উৎপন্ন করা যায়—তবু কেন এই মারামারি হানাহানি?
‘বর্তমান যুগের বুদ্ধিজীবী মানুষ বোধ হয় বুঝিতে পারিয়াছে যে পৃথিবী বিস্তীর্ণা হইলেও সীমাহীন নয়; মানুষের জনসংখ্যা যে-হারে বাড়িয়া চলিয়াছে তাহাতে অদূর ভবিষ্যতে পৃথিবীতে সুখে স্বচ্ছন্দে বাস করিবার স্থানাভাব ঘটিবে। মানুষের নিশ্বাস পৃথিবীর সমস্ত বাতাস শুষিয়া লইবে।…
‘অন্যকে নিহত করিয়াও নিজেকে বাঁচাইয়া রাখিবার প্রবৃত্তি জীবের সহজাত। এমন কি, আত্মরক্ষার জন্য হত্যা করার অধিকার প্রত্যেক সভ্য-জাতির আইনে স্বীকার করা হইয়াছে। ইহা মানুষের অবিসম্বাদী অধিকার। ….
‘প্রত্যেক জাতি এই মৌলিক অধিকার রক্ষা করিবার জন্য অপর সকল জাতিকে বিদ্বেষ করিতেছে, তাহাদের বিনাশ করিবার চেষ্টা করিতেছে। আণবিক বোমা আবিষ্কৃত হইয়াছে; আরও ভয়ঙ্কর অস্ত্র ক্রমে আবিষ্কৃত হইবে। হয়তো ইতিমধ্যে গোপনে গোপনে আবিষ্কৃত হইয়াছে। সুতরাং অন্ধ হানাহানির ফলে সমগ্র মানবজাতি যে সমূলে বিনষ্ট হইবে তাহাতে সন্দেহ নাই। দিব্যদর্শী পণ্ডিতের ভবিষ্যদ্বাণীই ফলিবে।
‘ইহার কি প্রতিকার নাই? পৃথিবী হইতে মানুষের বিলোপ কি অনিবার্য? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিতে হইবে। বুদ্ধ যীশু গান্ধীর পথে চলিবার আর সময় নাই। ভাবালুতার বাষ্পোচ্ছ্বাসে এই সমস্যাকে ঘোলা করিয়া তোলাও নিরাপদ নয়; বিজ্ঞান যে-সমস্যার সৃষ্টি করিয়াছে বিজ্ঞানের নির্মোহ দৃষ্টি দিয়াই তাহাকে পরীক্ষা করিতে হইবে!
‘ইহা কূট-বাক্য (paradox) বলিয়া মনে হইতে পারে, কিন্তু পৃথিবীর জনসংখ্যা কমানোই মানুষকে বাঁচাইয়া রাখিবার একমাত্র উপায়। …জন্ম নিয়ন্ত্রণের দ্বারা এই উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারিত, কিন্তু কোনও জাতি সজ্ঞানে নিজ জনসংখ্যা কমাইতে সম্মত হইবে না। পৃথিবী জুড়িয়া সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করিবার জন্য রেষারেষি চলিতেছে।
‘জনসংখ্যা কমাইবার দ্বিতীয় উপায়—কোনও কোনও বিশেষ জাতিকে তাহাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সমূলে উচ্ছেদ করিয়া ফেলা। সমগ্রের কল্যাণে অংশকে বিনাশ করা নৈতিক অপরাধ বলিয়া বিবেচিত হয় না; মানুষের জীবন রক্ষার জন্য অনেক সময় অস্ত্রোপচার করিয়া তাহার হাত-পা কাটিয়া ফেলিতে হয়।…
‘এখন প্রশ্ন এই : কাহাকে রাখিয়া কাহাকে নিঃশেষ করিয়া ফেলা যাইতে পারে?
‘আধুনিক বিজ্ঞান পাশ্চাত্য শ্বেতজাতির সৃষ্টি; এই বিজ্ঞান মানুষকে যে-শক্তি দিয়াছে বর্তমানে একমাত্র শ্বেতজাতিই তাহার অধিকারী। অতএব জীবনযুদ্ধে বাঁচিয়া থাকিবার নিঃসংশয় দাবি যদি কাহারও থাকে তো সে শ্বেতজাতির। বসুন্ধরা বীরভোগ্যা।
‘পৃথিবী হইতে বর্ণযুক্ত জাতি—কৃষ্ণ পীত বাদামী মিশ্র—যদি বিলুপ্ত করিয়া দেওয়া যায়, তবে পৃথিবীর দুই-তৃতীয়াংশ ভূমি শূন্য হইয়া যাইবে। অসুবিধা হয়তো কিছু ঘটিবে, কিন্তু সুবিধার তুলনায় তাহা অকিঞ্চিৎকর। প্রধান কথা, মনুষ্য জাতি—অন্তত তাহার একটা অংশ—রক্ষা পাইবে। জৈব আইনের ধারা survival of the fittest—অব্যাহত থাকিবে। মানুষে মানুষে ভূমি লইয়া কাড়াকাড়ির আর প্রয়োজন থাকিবে না। বর্ণ-সমস্যা থাকিবে না। অত্যন্ত দুই হাজার বৎসরের মধ্যে মানুষের নির্বাণ প্রাপ্তির ভয় থাকিবে না।
‘এই দুই হাজার বৎসরে মানুষ কি নিজেকে নূতন করিয়া গড়িয়া তুলিতে পারিবে না?’
—প্রবন্ধটি পাঠক মহলে কিছু আলোচনার সৃষ্টি করিল বটে কিন্তু অধিকাংশ পাঠকই উহা খেয়ালী কল্পনার উদ্ভট বিলাস মনে করিয়া হাসিয়া উড়াইয়া দিল।
ইহার পর প্রায় দেড় বৎসর কাটিয়া গেল। সংবাদপত্র পাঠকের স্মৃতি স্বভাবতই হ্রস্ব হইয়া থাকে, প্রবন্ধটির কথা আর কাহারও মনে রহিল না।
অতঃপর পৃথিবীর নানা দেশে যে-সব ঘটনা ঘটিতে আরম্ভ করিল তাহাই সংক্ষেপে বিভিন্ন তারিখের শিরোনামায় বর্ণিত হইল।
২৫ জুন ১৯৪৮
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র হইতে তারযোগে রয়টারের ভয়াবহ সংবাদ আসিয়াছে। সমস্ত ভারতবর্ষ ভয়ে বিস্ময়ে হতবাক হইয়া গিয়াছে।
সকলেই জানেন, আমেরিকার নিগ্রোরা গত দুই বৎসরের অক্লান্ত আন্দোলনের ফলে নিজেদের জন্য একটি স্বতন্ত্র স্টেট বা রাষ্ট্র স্থাপন করিতে সমর্থ হইয়াছে; এই স্টেট আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের ঊনপঞ্চাশ সংখ্যক রাষ্ট্র বলিয়া পরিচিত। আরিজোনা ও মেক্সিকোর সীমান্তে এই ক্ষুদ্র রাষ্ট্রটি স্থাপিত হইয়াছে।
গত ছয় মাস ধরিয়া আমেরিকার সমস্ত নিগ্রো তাহাদের এই নূতন রাষ্ট্রে গিয়া সমবেত হইয়াছে; নিগ্রোজাতির আনন্দের সীমা নাই। গতকল্য তাহাদের নবগঠিত রাজধানীতে প্রথম রাষ্ট্র-পরিষদের অধিবেশন ছিল। রাজধানীর জনসংখ্যা হইয়াছিল প্রায় দশলক্ষ।
অতঃপর রয়টারের যে সংবাদ আসিয়াছে তাহাই বিবৃত হইল—
সান্ফ্রানসিস্কো, জুন ২৪। নবনির্মিত নিগ্রো স্টেট মেক্সারিজ (Mexariz)-এর রাজধানী হইতে একটি শোচনীয় দৈব দুর্ঘটনার সংবাদ পাওয়া গিয়াছে। দ্বিপ্রহরে যে-সময় রাষ্ট্র-সভার বৈঠক বসিয়াছিল, সেই সময় রাজধানীর উপর দিয়া একটি Fortress শ্রেণীর এরোপ্লেন উড়িয়া যাইতেছিল। এরোপ্লেনে কয়েকটি আণবিক বোমা ছিল; এই নবাবিষ্কৃত ভীষণ শক্তিশালী বোমাগুলি পরীক্ষার জন্য প্রশান্ত মহাসাগরের কোনও দ্বীপে লইয়া যাওয়া হইতেছিল। এরোপ্লেনে মানুষ কেহ ছিল না; উহা রেডিও দ্বারা পরিচালিত হইতেছিল। দৈবাৎ এরোপ্লেনের যন্ত্র বিগড়াইয়া যায় এবং কোনও অজ্ঞাত কারণে আণবিক বোমাগুলি ফাটিয়া পড়ে।
অনুমান হয়, এই বিষম বিস্ফোরণের ফলে রাজধানীতে কেহই জীবিত নাই। নানা জাতীয় প্রাণঘাতী রশ্মি-বিকিরণের জন্য ঐ স্থান এখন মানুষের পক্ষে সুগম নয়। দূর হইতে এরোপ্লেন যোগে পরিদর্শনের ফলে জানা গিয়াছে যে নবরচিত রাজধানী একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া মুছিয়া গিয়াছে।
৩০ জুন ১৯৪৮
গত কয়েকদিন আমেরিকা হইতে আণবিক বোমা বিস্ফোরণ সম্বন্ধে আর কোনও নূতন সংবাদ পাওয়া যায় নাই। মনে হয় আমেরিকায় সংবাদের উপর কড়া censorship বসিয়াছে। রাশিয়ার টাস এজেন্সি কিন্তু নিম্নরূপ খবর দিয়াছে—
“আমেরিকায় সম্প্রতি যে দারুণ দুর্ঘটনা হইয়াছে তাহার ফলে আন্দাজ দশলক্ষ নিগ্রো মরিয়াছে। কিন্তু এ ব্যাপার সম্বন্ধে আরও একটি সংবাদ পাওয়া গিয়াছে তাহা আরও চাঞ্চল্যকর। যে নূতন আবিষ্কৃত আণবিক বোমাগুলি ফাটিয়া এই বিপত্তি ঘটে, জানা গিয়াছে সেই বোমায় নাকি এক প্রকারের নূতন রশ্মি বিকিরণের উপাদান ছিল; বোমা বিস্ফোরণের দেড়শত মাইলের মধ্যে সকল মানুষকে এই রশ্মি প্রভাবিত করিবে। জীবদেহে এই রশ্মির ফল—যাহারা আক্রান্ত হইয়াছে তাহারা আর বংশবৃদ্ধি করিতে পারিবে না।
“মেক্সিকোর অধিকাংশ অধিবাসীও এই অভিনব রশ্মি দ্বারা প্রভাবিত হইবে।”
পূর্বোক্ত সংবাদ যুক্তরাষ্ট্রের গভর্মেন্ট অস্বীকার করিয়াছেন।
১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪৮
দক্ষিণ আফ্রিকার শাদা কালো বিরোধ এতদিনে সুষ্ঠুভাবে নিষ্পন্ন হইল; এজন্য প্রধানত ইংলণ্ডের গণতান্ত্রিক মন্ত্রীমণ্ডলই প্রশংসাৰ্হ। ব্রিটিশ কমন্ওয়েল্থকে দীর্ঘায়ু করিবার ন্যায়নিষ্ঠ পন্থা এতদিনে অবলম্বিত হইল।
ইংলন্ডের অক্লান্ত চেষ্টা ও উদ্যমের ফলে অস্ট্রেলিয়া কানাডা প্রভৃতি কমন্ওয়েল্থের অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্রসমূহের একটি বৈঠক হইয়া গিয়াছে। তাহাতে স্থির হইয়াছে : দক্ষিণ আফ্রিকাবাসী সমস্ত শ্বেতাঙ্গ জাতির লোক অস্ট্রেলিয়ায় গিয়া বসতি স্থাপন করিবে। দক্ষিণ আফ্রিকা অতঃপর স্থানীয় জাতি ও উপনিবেশী হিন্দুস্থানিগণ কর্তৃক শাসিত হইবে। আগামী দশ বৎসর ধরিয়া শ্বেতাঙ্গগণ ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পাঁচ লক্ষ তোলা সোনা পাইবে।
এই সকল শর্ত আফ্রিকার আদিম অধিবাসীরা এবং ভারতীয় উপনিবেশীরা আনন্দের সহিত স্বীকার করিয়াছে।
সাউথ আফ্রিকা হইতে শ্বেতাঙ্গ দলের রপ্তানি আরম্ভ হইয়া গিয়াছে। আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গের জনসংখ্যা মুষ্টিমেয়; আশা করা যায় মাসখানেকের মধ্যে আফ্রিকায় আর শ্বেতাঙ্গ থাকিবে না।
দেখা যাইতেছে, পাশ্চাত্য দেশের রাজনৈতিক চিন্তাধারা এখন ভিন্নমুখী হইয়াছে; এসিয়াখণ্ডে—অস্ট্রেলিয়া ছাড়া—অন্য কোনও দেশে তাহারা উপনিবেশ বা অধিকার রাখিতে চাহে তাহাদের এই নূতন মনোবৃত্তি অতীব প্রশংসনীয়।
২৫ ডিসেম্বর ১৯৪৮
গত কয়েকমাসে পাশ্চাত্য দেশ হইতে প্রাচ্যদেশে সংবাদ সরবরাহ অনেক কমিয়া গিয়াছে। বোধ হয় সকল পাশ্চাত্য দেশেই সংবাদের উপর censorship বসিয়াছে। দেড় বৎসর আগে নিগ্রোদের নূতন রাষ্ট্রে বোমা বিস্ফোরণের পর যে বিপুল হৈ চৈ হইয়াছিল, তাহারই ফলে বোধ হয় পাশ্চাত্য দেশের শাসক সম্প্রদায় সাবধান হইয়াছেন।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, সাউথ আফ্রিকা হইতেও সমস্ত খবর আসা বন্ধ হইয়া গিয়াছে। একমাস হইতে রেডিও কেন্দ্রগুলি পর্যন্ত বন্ধ। সেখানে কী হইতেছে কেহ জানে না।
তবু, অতর্কিতে দু’ একটি খবর বাহির হইয়া পড়ে। সম্প্রতি ভারতবর্ষে একটি উদ্বেগজনক সংবাদ পৌঁছিয়াছে। দক্ষিণ আমেরিকায় নাকি এক প্রকার অদ্ভুত মারীভয় দেখা দিয়াছে। সহজ স্বাস্থ্যবান মানুষ রাস্তায় চলিতে চলিতে হঠাৎ পড়িয়া মরিয়া যাইতেছে! রোগের কোনও লক্ষণই এপর্যন্ত ধরিতে পারা যায় নাই। উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র কোনক্রমে বৈজ্ঞানিক উপায়ে এই মহামারীকে পানামা কান্যালের পরপারে ঠেকাইয়া রাখিয়াছে।
মহামারী কিন্তু অন্যদিকে প্রসার লাভ করিয়াছে, প্রশান্ত মহাসাগর ডিঙাইয়া ফিলিপিন দ্বীপপুঞ্জে দেখা দিয়াছে। আন্তর্জাতিক সমিতি সমুদ্রের ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে কোয়ারান্টাইন্ বসাইয়া এই মারীর প্রসার রোধ করিবার চেষ্টা করিতেছেন।
১ জানুয়ারী ১৯৪৯
ইংলন্ডেশ্বর ভারতবাসীকে তাহাদের স্বাধীনতা লাভের প্রথম বৎসর পূর্ণ হওয়ায় অভিনন্দন জানাইয়াছেন।
আর একটি সুখবর আছে। এতদিন, ভারতবর্ষ স্বাধীন হওয়া সত্ত্বেও অনেক ইংরেজ এদেশে বাস করিয়া ব্যবসা-বাণিজ্য চালাইতেছিলেন। আজ ইংলন্ডের মন্ত্রীসভা ভারতপ্রবাসী ইংরেজের উপর এক হুকুম জারি করিয়াছেন: আগামী একমাসের মধ্যে সমস্ত ইংরেজকে ভারতবর্ষ ত্যাগ করিয়া ইংলণ্ডে ফিরিয়া যাইতে হইবে, অন্যথায় ব্রিটিশ জাতিত্ব হইতে তাহারা খারিজ হইয়া যাইবে। ভারতবর্ষের সহিত ইংলন্ডের সম্প্রীতি রক্ষার উদ্দেশ্যেই এই আদেশ প্রচারিত হইয়াছে।
৩১ জানুয়ারী ১৯৪৯
করাচি বোম্বাই ও কলিকাতা বন্দর হইতে আজ য়ুরোপগামী শেষ জাহাজ ছাড়িল; ভারতবর্ষে যে-কয়জন ইংরেজ অবশিষ্ট ছিল তাহারা স্বদেশে ফিরিয়া গেল। ফরাসী ও পোর্তুগীজরা ইতিপূর্বেই ভারত ত্যাগ করিয়াছে।
এতদিনে ভারতবর্ষ কার্যত স্বপ্রতিষ্ঠ স্বয়ংপ্রভু হইল। ইংরেজ শেষের দিকে সত্যই আমাদের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করিয়াছে।
৭ মার্চ ১৯৪৯
স্যর জন্ হোয়াইট তিরাশী বৎসর বয়সে নোবেল প্রাইজ লাভ করিয়াছেন।
স্যর জন্ সাংবাদিকমণ্ডলীকে বিবৃতি দিয়াছেন—জীবনের শেষ পঞ্চাশ বৎসর আমি মানবজাতির সেবায় অতিবাহিত করিয়াছি—এই পুরস্কারের টাকাও আমি সেই উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করিলাম… আমার দিন ফুরাইয়া আসিতেছে তথাপি আমি আশা করি মৃত্যুর পূর্বে মানুষের পরম পরিত্রাণ দেখিয়া যাইতে পারিব।
১৫ মে ১৯৪৯
মহামারীকে আটকাইয়া রাখা গেল না। চীন ও বর্মায় মহামৃত্যুর ডঙ্কা বাজিয়া উঠিয়াছে। পথে ঘাটে মানুষ মরিতেছে। বসিয়া বসিয়া মানুষ মরিয়া যাইতেছে। রেঙ্গুনে,একদিনে সাত হাজার লোক মরিয়াছে!
ভারতবর্ষের জাতীয় গভর্মেন্ট চেষ্টা করিতেছেন যাহাতে এই নামহীন মৃত্যু এদেশে প্রবেশ করিতে না পারে।
৭ জুন ১৯৪৯
আজ কলিকাতা শহরে একটি ঘটনা ঘটিয়াছে। প্রাতঃকালে আন্দাজ দশটার সময় একটি ট্যাক্সি দেশবন্ধু অ্যাভেন্যু দিয়া যাইতেছিল; পথের মাঝখান দিয়া যাইতে যাইতে হঠাৎ ট্যাক্সি পাশের দিকে ফুটপাথের উপর উঠিয়া একটি বালককে চাপা দিয়া দেয়ালে আঘাত করে। বালকের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়; কিন্তু ট্যাক্সির বেগ তাহাতেও শান্ত হইল না; দেয়ালে প্রতিহত হইয়া পিছন দিকে কিছুদুর ফিরিয়া আসিয়া ট্যাক্সি আবার দেয়াল আক্রমণ করিল। এবার আর ট্যাক্সি ফিরিয়া আসিল না, ইঞ্জিন বন্ধ হইয়া যাওয়ায় সেইখানেই দাঁড়াইয়া পড়িল।
পথচারীরা এতক্ষণ সবিস্ময়ে দাঁড়াইয়া এই দৃশ্য দেখিতেছিল, এবার ক্রোধান্ধভাবে ছুটিয়া গিয়া ট্যাক্সি চালককে টানিয়া গাড়ি হইতে বাহির করিল। দেখা গেল, দেহ সম্পূর্ণ অক্ষত হইলেও তাহার দেহে প্রাণ নাই…
৯ জুন ১৯৪৯
কলিকাতার লোক পালাইতে আরম্ভ করিয়াছে; মৃত্যুভয়ে উন্মত্ত হইয়া যে যেদিকে পারিতেছে পালাইতেছে। কিন্তু পালাইয়া যাইবে কোথায়? করাল মৃত্যুর বিষ দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়িয়াছে..বোম্বাই মাদ্রাজ লাহোর সর্বত্র এক অবস্থা…হাহাকার করিয়া মানুষ চারিদিকে ছুটাছুটি করিতেছে; কখন কাহার ললাটে মরণ-কাঠির স্পর্শ লাগিবে কেহ জানে না…।
মাছির মতো মানুষ মরিতেছে; সৎকার করিবার কেহ নাই। শীঘ্রই এই বিশাল ভারতভূমি শ্মশানের মতো হইয়া যাইবে। কেবল যাহা নির্জীব, যাহা ইট-কাঠ-পাথরে তৈরি তাহাই থাকিয়া যাইবে।
৬ আগস্ট ১৯৫০
পৃথিবীর সবর্ণ জাতির আর একটি মানুষও বাঁচিয়া নাই। তাহাদের অস্থি-কঙ্কালে সমস্ত পৃথিবী শাদা হইয়া গিয়াছে।
লন্ডনে একটি মহতী সভা আহ্বান করিয়া স্যর জন্ হোয়াইটকে সম্বর্ধনা করা হইয়াছে।
সভাস্থলে বিপুল আনন্দধ্বনির মধ্যে ঋষিকল্প বৃদ্ধ স্যর জন্ উঠিয়া বলেন—‘বিজ্ঞান বিশ্বপ্রকৃতির দর্পণ, এই দর্পণে আমরা প্রকৃতির স্বরূপ দেখিতে পাই। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে দয়া মায়ার স্থান নাই; যে যোগ্য সেই বাঁচিয়া থাকে, যে অনধিকারী তাহার বাঁচিবার দাবি নাই। প্রকৃতির দরবারে আমাদের শ্বেতজাতির বাঁচিয়া থাকিবার দাবি মঞ্জুর হইয়াছে—’
এই পর্যন্ত বলিয়া স্যর জন্ থামিয়া গেলেন; তারপর সহসা ধরাশায়ী হইলেন। দেখা গেল তাঁহার দেহে প্রাণ নাই।
বিরাট সভা কয়েক মুহুর্তের জন্য নিস্তব্ধ হইয়া রহিল। এই স্তম্ভিত নীরবতার মধ্যে বিগ বেন ঘড়িতে মন্ত্র-মন্থর শব্দে তিনটা বাজিল।
৩২ শ্রাবণ ১৩৫৩