শাদা গাড়ি

শাদা গাড়ি

আমি যাদের পছন্দ করি না তাদের সঙ্গেই আমার ঘুরেফিরে দেখা হয়। হয়তো খুব জমিয়ে গল্প করছি–কাজের ছেলেটি এসে বলল, কে জানি আইছে, আপনারে বুলায়। বাইরে উঁকি দিলে এমন একজনকে দেখা যাবে যার সঙ্গে একসময় খাতির ছিল। এখন নেই। তবু হাসির একটা ভাব করে উল্লাসের সঙ্গে বলতে হবে, আরে-আরে কী খবর? তারপর কেমন চলছে? একসময় হয়তো এই লোকটির সঙ্গে তুই-তোকারি করতাম। এখন দূরত্ব রাখার জন্যে ভাববাচ্যে কথা বলতে হয়। বাংলাভাষার ভাববাচ্য খুব উন্নত নয়। দীর্ঘসময় কথা চালানো যায় না।

আজকের ব্যাপারটাই ধরা যাক। আডডা জমে উঠেছে। বাংলা বানান নিয়ে খুব তর্ক বেধে গেছে। এমন সময় কাজের ছেলেটি এসে বলল আমাকে কে নাকি ডাকছে। বেরিয়ে দেখি সাব্বির। আমি হাসিমুখেই বললাম— বাইরে কেন, ভেতরে এসে বসুন। সে অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসল।

আসুন ভেতরে।

না, না ঠিক আছে।

আমার কয়েকজন বন্ধুবান্ধব এসেছে। গল্পগুজব হচ্ছে। আসুন পরিচয় করিয়ে দেই।

অন্য আরেকদিন আসব।

আজ অসুবিধা কিসের? আসুন ভেতরে।

সাব্বির চোখ-মুখ লাল করে ভেতরে ঢুকল। পুরুষমানুষদের লজ্জায় এমন লাল হতে কখনো দেখি নি। নাকের পাতায় বিন্দুবিন্দু ঘাম।

ভেতরে তখন তুমুল উত্তেজনা। আজিজ ফজলুকে জিজ্ঞেস করছে, ধূলি . বানান কর দেখি? হ্রস্বউকার না দীর্ঘউকার? রাগের চোটে ফজলু তোতলাচ্ছে। ক্রমাগত তার মুখ দিয়ে থুতু পড়ছে। বিশ্রী অবস্থা।

সাব্বির নার্ভাস ভঙ্গিতে রুমাল দিয়ে তার মুখ মুছল এবং মৃদুস্বরে বলল, আজ যাই, অন্য আরেক দিন আসব।

বসুন না। তাস হবে। তাস খেলতে পারেন তো?

জি-না। আজ আমি যাই । আজ আমার একটা কাজ আছে।

আমি সাব্বিরকে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে গেলাম। সেখানে শাদা রঙের প্রকাণ্ড একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। মুশকো জোয়ান এক ড্রাইভার সাব্বিরকে দেখে স্পিঙের মতো লাফিয়ে বের হল এবং দ্রুত দরজা খুলে মূর্তির মতো হয়ে গেল। আমাদের বয়সী একটা ছেলের জন্যে এতটা আয়োজন আছে ভাবাই যায় না । আমি তাঁর একটা ঈর্ষা নিয়ে মোড়ের দোকান থেকে সিগারেট কিনলাম। ছুটির সকালে ঈর্ষার মতো জিনিস দীর্ঘস্থায়ী হয় না। কিন্তু এটা অনেকক্ষণ ধরে বুকে খচখচ করতে লাগল।

সাব্বিরের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রটা এরকম– পুরানা পল্টনের এক ওষুধের দোকানে ঢুকেছি প্যারাসিটামল কিনতে। পয়সা দিয়ে বেরুবার সময় দেখলাম ঘটাঘট শব্দে সব দোকানের ঝাপ পড়ে যাচ্ছে। চারদিকে দারুণ ব্যস্ততা। কী হয়েছে কেউ কিছু বলতে পারছে না। সবাই ছুটছে। ট্রাকঅলাদের সঙ্গে বাসঅলাদের কী নাকি একটা ঝামেলা। একদল লোক নাকি রামদী নিয়ে বের হয়েছে। ব্যাপারটা গুজব হবারই কথা। এ যুগে রামদা নিয়ে কেউ বের হয় না। তবে সাবধানের মার নেই। দ্রুত পাশের গলিতে ঢুকে দেখি গলির মাথায় একটা পাঞ্জাবি গায়ে দারুণ ফরসা ছেলে লম্বালম্বি হয়ে পড়ে আছে। তবে চশমা ছিটকে পড়েছে অনেকটা দূরে। আমি গিয়ে তাকে টেনে তুললাম। সে বিড়বিড় করে বলল, চশমা ছাড়া আমি কিছু দেখতে পাই না। আমার মায়ােপিয়া, চোখের পাওয়ার সিক্স ডাইওপটার। চশমার একটা কাচ খুলে পড়ে গিয়েছিল । একি কাচের চশমা পরে সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। তাকে বাড়ি না–পৌঁছানো পর্যন্ত সে আমার বাঁ হাত শক্ত করে ধরে রাখল। সম্ভবত ভয় পাচ্ছিল, আমি তাকে ফেলে রেখে চলে যাব।

কোনো পুরুষমানুষের এমন মেয়েদের মতো চেহারা হয় আমার জানা ছিল না। পাতলা ঠোঁট। কাচবিহীন চোখের দিকে তাকালে মনে হয় কাজল পরানো । কিশোরীদের মতো ছোট্ট চিবুক । আমি বললাম, আপনি কী করেন?

ইংরেজিতে এম.এ. পরীক্ষা দেব।

তাই নাকি? ভালো।

গত বৎসর পরীক্ষা দেবার কথা ছিল। দেই নি। আমার হার্টের অসুখ, হার্টবিটের রিদমে গণ্ডগোল আছে।

চিকিৎসা করছেন তো?

এর কোনো চিকিৎসা নেই।

এই বলেই সে ফ্যাকাশে ভাবে হাসতে লাগল। আমি সিগারেট বের করলাম, নেন, সিগারেট নেন।

আমি সিগারেট খাই না। নিকোটিন হার্টের মাসলে ক্ষতি করে। ফাইবার গুলি শক্ত করে দেয়।

এতসব জানলেন কীভাবে?

আমার মা ডাক্তার।

নিউ ইস্কাটনের যে বাড়ির সামনে রিকশা থামল সেটকে বাড়ি বলা ঠিক না। সেটা একটা হুলস্থুল ব্যাপার। আমরা রিকশা থেকে নামতেই চারদিকে ছোটাছুটি পড়ে গেল। সাব্বিরের মতো দেখতে একজন মহিলা তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলতে লাগলেন, কেন তুমি কাউকে কিছু না বলে বেরুলে? আর বেরুলেই যখন কেন গাড়ি নিলে না?

সাব্বির অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে হাসতে লাগল। ভদ্রমহিলা অভিমানী স্বরে বললেন, কেন তুমি আমাদের কষ্ট দাও?

আর যাব না মা।

তোমার দুর্বল হার্ট। যে-কোনো সময় কিছু-একটা যদি হয়ে যেত। তখন?

মা আর যাব না।

এ ছেলেটাই সাব্বির।

রাত ৮ টার আগে আমি এদের বাড়ি থেকে বেরুতে পারলাম না। সাব্বিরের বাবা এবং মা এমন একটা ভাব করতে লাগলেন যেন আমি সাব্বিরকে মৃত্যুর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে এসেছি। এরকম বড় একটা কাজের যোগ্য পুরস্কার দিতে না পেরে তারা দুজনেই অস্থির।

আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে এবং বাড়ি চিনে আসবার জন্যে একজন লোক চলল আমার সঙ্গে ছোট গলিতে বড় গাড়ি টুকবে না— এইজন্য টেলিফোন করে একটা ছোট গাড়ি আনানো হল।

সাব্বির মা-বাবার নিষেধ অগ্রাহ্য করে আমাকে এগিয়ে দিতে এল গেট পর্যন্ত। নিচু স্বরে বলল, বাবা-মা আমার জনো খুব ব্যস্ত। একটামাত্র ছেলে তো।

আপনি একাই নাকি?

জি। আঁচ ভাইবোন ছিলাম আমরা। এখন আমি একা আছি।

বাকিরা কোথায়?

সবাই মারা গেছে। আমাদের ফ্যামিলিতে কেউ বেশিদিন বাঁচে না আমার এক চাচা ছিলেন। তাঁরও চার ছেলেমেয়ে ছিল। সবাই ত্রিশ হবার আগেই মারা গেছে।

বলেন কী!

জি। আমিও বাঁচব না।

আরে, এসব কী বলছেন?

জি, সত্যি কথাই বলছি। দেখেন না হার্টের অসুখ হয়ে গেল।

আমার বন্ধুবান্ধবরা সব আমার মতো। পাস করবার পর সবাই কিছু-একটাতে ঢুকে পড়েছে। ব্যাংক, ট্রাভেল এজেন্সি, নাইট কলেজের পার্ট টাইম টিচার। একমাত্র আজিজ কোথাও কিছু না পেয়ে ল’তে ভর্তি হয়েছে। ছুটিছাটায় দিনে তাসটাস খেলি। মাঝে-মধ্যে পরিমলদের মামার বাড়িতে ভিসিআর দেখি এবং প্রায় সবদিনই আড্ডাটা শেষ হয় একটা ঝগড়ার মধ্যে। কোনো কোনো সময় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। তাতে অসুবিধা হয় না কিছু। অবিার যখন দেখা হয় পুরনো কথা আর মনে থাকে না। বিয়ে করার আগপর্যন্ত এই সময়টা বেশ ভালো। চায়ের দোকানে বসে বিস্বাদ চায়ে চুমুক দেয়ামাত্র মনে হয় জীবনটা বড়ই সুখের। ফজলুদের ভাড়াটেদের ছোটমেয়ের হৃদয়হীনতা আমাদের ফজলুর চেয়েও বেশি আহত করে।

এরকম সুখের সময় উপদ্রবের মতো মাঝে-মাঝে উপস্থিত হয় সাব্বির। তাদের গাড়ির মুশকো ড্রাইভার চায়ের দোকান থেকে আমাকে ডেকে নিয়ে যায় । সাব্বির লজ্জায় লাল হয়ে বলে, চা খাচ্ছিলেন সবাই মিলে?

হুঁ আড্ডা দিচ্ছি, আসুন না।

জি-না, আমি চা খাই না।

চা না-খেলে না খাবেন, বসে গল্প করুন।

আরেকদিন আসব। আজ একটু কাজ আছে।

কাজ থাকলে চলে গেলেই হয়। তা না। অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। বিরক্তিতে আমার গা জ্বলে যায়, তবু ভদ্রতা করে দাড়িয়ে থাকতে হয়।

কী নিয়ে এত গল্প করেন?

গল্প করার টপিকের অভাব আছে নাকি? রাজনীতি, মেয়েমানুষ, সিনেমা, প্রেম। এসে শুনুন না। শুনতে না চাইলে বলুন।

কী বলব?

প্রেমের অভিজ্ঞতার কথা বলবেন।

সাব্বির টমেটোর মতো লাল হয়ে বলল, মেয়েদের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা নেই। আমি কোনো মেয়ের সঙ্গে সামনাসামনি বসে কথা বলি নি।

বলেন কী!

জি সত্যি। আমি একাই থাকি। মেয়েদের সঙ্গে মেশা আমার মা পছন্দ করেন। আমার হার্টে অসুখ।

তাতে কী?

মানে ইয়ে–সামান্যতম একসাইটমেন্টে রিদমে গণ্ডগোল হয়। মেজর প্রবলেম হতে পারে।

আমি ঝামেলামুক্ত হবার জন্য বলি, আজ তাহলে যান। রোদ লাগছে। সাব্বির তবু যায় না। দাঁড়িয়ে থাকে। তার একটু দূরে অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মুশকো ড্রাইভার। কুৎসিত ব্যাপার।

মেয়েলি চেহারার এই যুবকের সুখ-দুঃখের সাথে আমার সুখ-দুঃখের কোনো মিল নেই। এর সঙ্গে নরম স্বরে মিষ্টি কথা বলতে আমার ভালো লাগে না। আমি সাব্বিরকে এড়িয়ে চলবার জন্য নানারকম কৌশল করি। ঘরে বসে থেকে কাজের ছেলেটিকে বলে পাঠাই— বাসায় নেই। কখন ফিরবে তারো ঠিক নেই। কোনো কোনো দিন নিজেই গিয়ে বলি, আমি এক্ষুনি বেরুব। হাসপাতালে এক বন্ধুকে দেখতে যাবার কথা। আজ তো কথা বলতে পারছি না।

আসুন, হাসপাতালে পৌঁছে দেই। কোন্ হাসপাতাল?

না, তার কোনো দরকার নেই।

আমার কোনো অসুবিধা হবে না, আসুন না।

মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। রাস্তায় কোনো শাদা রঙের গাড়ি দেখলেই মনে হয়— এই বুঝি গাড়ি থামিয়ে ফরসা পাঞ্জাবি-পরা সাব্বির বেরিয়ে আসবে। মোটা কাচের আড়ালে যার চোখ ঢাকা বলে মনের ভাব বোঝা যাবে না। কথা বলবে এমন ভালোমানুষের মতো যে রাগ করা যাবে না আবার সহ্যও করা যাবে না।

রাস্তায় বেরুলেই একটা অস্পষ্ট অস্বস্তি লেগে থাকে। এই বুঝি দেখা হল। অস্বস্তিটা সবচে বেশি হয় নীলু সঙ্গে থাকলে। নীলু তার কারণ বুঝতে পারে না। সে বিরক্ত হয়ে বলে, এরকম কর কেন? দেখা হলে কী হবে? আমার তো ভদ্রলোককে দেখতেই ইচ্ছা করছে।

একদিন অবিশ্যি দেখা হলো। গ্রিন রোড দিয়ে হেঁটে-হেঁটে আসছি। হঠাৎ রাস্তার পাশে শাদা গাড়িটি দাঁড়িয়ে গেল। গাড়ির ভিতর থেকে সাব্বির অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমি না-দেখার ভান করলাম। এবং অতি দ্রুত একটা রিকশী ঠিক করে নীলুকে নিয়ে উঠে পড়লাম। সারাক্ষণই ভয় করতে লাগল এক্ষুনি হয়তো সে পাড়ি নিয়ে সামনে এসে থামবে। লাজুক গলায় বলবে–কোথায় যাবেন বলুন, নামিয়ে দি। সেরকম কিছু ঘটল না। নীলু বিরক্ত হয়ে বলল, হুট করে রিকশা নিলে কেন? আমি কতবার বলেছি পাশাপাশি রিকশায় চড়তে আমার ভালো লাগে না।

ভালো লাগে না কেন?

হুড তুলতে হয়। হুড তুললেই আমার কেন জানি দম বন্ধ হয়ে আসে।

হুড না তুললেই হয়।

পাগল, হুড না তুলে অবিবাহিত একটা ছেলের সঙ্গে আমি রিকশায় চড়ব।

বিকালটা আমার চমক্কার কাটল। দুজনে খুব ঘুরলাম। সন্ধ্যাবেলা ঢুকে পড়লাম একটা চাইনিজ রেস্টুরেন্টে। নীলু সারাক্ষণই বলল—ইশ, বাসার সবাই দুশ্চিন্তা করছে। তবু উঠবার কোনো ভাড়া দেখাল না।

নীলুকে শ্যামলীতে রেখে বাসায় ফিরে দেখি সাব্বির আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী ব্যাপার?

কোনো ব্যাপার নয়, এমনি এলাম। দিনে এলে তো আপনাকে পাওয়া যায় না।

কোনো বিশেষ কাজে এসেছেন, না শুধু গল্প করবার জন্য?

না কোনো কাজে না, এমনি। সাব্বির রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে লাগল। আমি বললাম, চা খান। চা দিতে বলি?

জি না, চা-টা না। আমি এখন যাব। মা চিন্তা করছেন, এত রাত পর্যন্ত বাইরে কখনো থাকি না।

আজই বা থাকলেন কেন?

আপনাদের দুজনকে আজ দেখলাম। বড় ভালো লাগল। সেইটা বলবার জন্যে।

সাব্বির লজ্জায় বেগুনি হয়ে গেল।

আমাকে আর নীলুকে দেখেছেন বুঝি?

জি। বড় ভালো লাগল। আমি একবার ভাবলাম এগিয়ে গিয়ে বলি— কোথায় যাবেন চলুন পৌঁছে দেই। আপনারা কী মনে করেন এই ভেবে গেলাম না।

আমি নিঃশব্দে একটা সিগারেট ধরালাম। সাব্বির মৃদুস্বরে বলল, আমি অবিশ্যি আপনাদের পেছনে-পেছনে গিয়েছি।

তাই নাকি?

জি, ড্রাইভারকে বললাম দূর থেকে ঐ রিকশাটাকে ফলো করো।

তারপর ফলো করলেন?

জি। শাহাবাগ পর্যন্ত। তারপর ড্রাইভার আর রিকশাটা লোকেট করতে পারল না। আপনি কি রাগ করছেন?

না।

আমি একবার ভেবেছিলাম আপনাকে বলব না। কিন্তু আপনাদের দুজনকে এত সুন্দর লাগছিল। কী সুখী-সুখী লাগছিল। আমার মনে হল এটা বলা উচিত । আপনি রাগ করেন নি তো?

আমি ঠাণ্ডা স্বরে বললাম, না রাগ করি নি। রাত অনেক হয়ে গেছে এখন বাসায় যান । নয়তো আপনার মা আবার রাগ করবেন।

জি তা ঠিক।

সাব্বির চলে গেল কিন্তু আমার বিরক্তির সীমা রইল না। লোকটি কী নির্বোধ না অন্যকিছু? আমার মনে একটা ক্ষীণ সন্দেহ হল । এরকম ঘটনা আবার ঘটবে, ও যদি আমাকে এবং নীলুকে আবার কখনো দেখে তাহলে আবারো তার শাদা গাড়ি আসবে পেছনে পেছনে। কী অসহ্য অবস্থা।

ঘটলও তাই। দিন সাতেক পর সাব্বির এসে হাসিমুখে বলল, আপনারা কি বুধবার বিকালে শিশু পার্কের সামনে ফুচকা খাচ্ছিলেন?

মনে নেই।

আপনার পরনে ছিল একটা চেকচেক শার্ট আর আপনার বান্ধবীর গায়ে লাল রঙের চাদর। হাতে একটা চটের ব্যাগ, মনে পড়েছে?

হ্যাঁ, পড়েছে।

আমি কিন্তু ফুচকা খাবার পর থেকে ঠিক কাঁটায়-কাঁটায় এক ঘণ্টা আপনাদের ফলো করেছি।

তাই নাকি?

জি।

এত ভালো লাগছিল আমার। ড্রাইভারকে বললাম তারা দেখতে পায় না এমনভাবে তাদের ফলো করো । আপনি অবিশ্যি একবার পেছনে তাকিয়েছেন । কিন্তু কিছু বুঝতে পারেন নি।

আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললাম, নীলুর সঙ্গে থাকলে আমি একটু অন্যমনস্ক থাকি।

সাব্বির গভীর আগ্রহে বলল, আচ্ছা এলিফেন্ট রোডের ঐ দোকানটা থেকে কী কিনলেন আপনারা?

আমি তার জবাব না দিয়ে গম্ভীর হয়ে বললাম, আসুন, আপনার সঙ্গে নীলুর পরিচয় করিয়ে দেই।

না না, তার কোনো দরকার নেই। আপনাদের দুজনকে একসঙ্গে দেখতেই আমার ভালো লাগে। কীরকম অদ্ভুত সুখী-সুখী চেহারা। জানেন আমি মাকে আপনাদের কথা বলেছি?

ভালো করেছেন ।

আমি যে মাঝে-মাঝে আপনাদের পেছনে-পেছনে যাই আপনি রাগ করেন না তা?

আমি উত্তর না দিয়ে সিগারেট ধরালাম। একটা শাদা গাড়ি সর্বত্র আমাদের অনুসরণ করছে এটা ভাবতেই মন শক্ত হয়ে যায় ।

সাব্বির বসে আছে আমার সামনে। তার ফরসা কিশোরীদের মতো মুখে উত্তেজনার ছাপ। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। চোখ চকচক করছে। বোধহয় কেঁদেই ফেলবে। সে অনেকখানি ঝুঁকে এসে বলল, পৃথিবীর মানুষ এত সুখী কেন বলুন তো?

সাব্বিরের সঙ্গে এটাই আমার শেষ দেখা। আর কখনো সে আমার কাছে লাসে নি। হয়তো শরীর খুব বেশি খারাপ। ঘর থেকে বেরোতে পারছে না। কিংবা গিয়েছে বাইরে। কিংবা অন্যকিছু। গিয়ে খোঁজ নেবার মতো ইচ্ছা কখনো হয় নি।

সাব্বির আর কখনো আসে নি কিন্তু তার শাদা গাড়িটি ঠিকই অনুসরণ করেছে আমাদের । যখনই নীলু মজার একটা-কিছু বলছে কিংবা যখনই আমার নীলুর হাত ধরতে ইচ্ছা হয়েছে তখনই বুঝতে পেরেছি বিশাল শাদা গাড়িটা আশেপাশে কোথাও আছে। এর হাত থেকে আমাদের মুক্তি নেই।।

নীলুর সঙ্গে শেষপর্যন্ত আমার বিয়ে হয় নি। যে মেয়েটিকে বিয়ে করেছি সে নীলুর মতো নয়। কিন্তু তার জন্যেও আমি প্রচণ্ড ভালোবাসা অনুভব করি। বৃষ্টির রাতে যখন হঠাৎ বাতি চলে যায়, বাইরে হাওয়ার মাতামাতি শুরু হয় আমি গভীর আবেগে হাত রাখি তার গায়ে । তখনি মনে হয় কাছেই কোথাও শাদা গাড়িটি বৃষ্টিতে ভিজছে। চশমা-পরা অসুস্থ যুবক ভুরু কুঁচকে ভাবছে, মানুষ এত সুখী কেন?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *