শাইনিং – ৫

অধ্যায় ৫ – ফোনবুথ

জ্যাক টেবল মেসা শপিং সেন্টারের সামনে এসে গাড়ি থামাল। ও আবার ভাবল যে গাড়ির ফুয়েল ট্যাংকটা বদলানো দরকার, তারপর ওর আবার মনে পড়ল যে নতুন ফুয়েল পাম্প কিনবার টাকা নেই ওর কাছে। নভেম্বর মাস আসতে আসতে গাড়িটা আর কাজেও লাগবে না, জ্যাক চিন্তা করল। অতদিনে রাস্তায় এত বরফ জমে যাবে যে গাড়ির বাপেরও সাধ্য নেই তা ঠেলে যাবার।

“গাড়িতেই থাক, ডক। আমি তোর জন্যে চকলেট নিয়ে আসব।”

“কেন? আমি আসলে কি হয়?”

“আমার একটা ফোন করতে হবে। বড়দের ব্যাপার।”

“এজন্যেই কি তুমি বাসা থেকে ফোনটা করনি?”

“ঠিক তাই।”

ওয়েন্ডি একরকম জোর করেই বাসার ফোনটা কিনেছিল। ওর দাবী ছিল যে বাসায় একটা বাচ্চা ছেলে থাকে, বিশেষ করে ড্যানির মত ছেলে যার মাঝে মাঝে জ্ঞান হারাবার রোগ আছে সে বাসায় একটা টেলিফোন থাকা খুবই জরুরি। তাই জ্যাকের বাধ্য হয়ে ফোনটা লাগাবার জন্যে তিরিশ ডলার দিতে হয়। শুধু তাই নয়, সেফটি-ডিপোজিট হিসাবে আরও নব্বই ডলার দিতে হয়েছে। ওদের জন্য এটা কম টাকা নয়। আর এখনও দু’টো রঙ নাম্বার ছাড়া একবারও কোন ফোন আসেনি ওদের বাসায়।

“বাবা আমার জন্যে কি তুমি বেবি রুথের একটা চকলেট আনতে পারবে?”

“অবশ্যই। তুই চুপচাপ বসে থাক আর গাড়ির গিয়ার নিয়ে নাড়াচাড়া করিস না, ঠিক আছে?”

“আচ্ছা। আমি এখন ম্যাপগুলো দেখব।”

“বেশ তো।”

জ্যাক গাড়ি থেকে বের হতে হতে দেখল যে ড্যানি হাত বাড়িয়ে ড্যাশবোর্ড থেকে পুরনো ম্যাপগুলো বের করল। ড্যানির একটা পছন্দের খেলা হচ্ছে আঙুল দিয়ে ম্যাপে আঁকা রাস্তাগুলো কোথা থেকে কোথায় যায় তা খুঁজে বের করা। ওর জন্যে নতুন জায়গায় যাওয়ার সবচেয়ে খুশির ব্যাপার হচ্ছে নতুন নতুন ম্যাপ নিয়ে খেলা করার সুযোগ পাওয়া।

জ্যাক দোকানের ভেতর যেয়ে ড্যানির চকলেট, একটা ম্যাগাজিন আর একটা খবরের কাগজ নিয়ে দোকানের মেয়েটাকে পাঁচ ডলারের একটা নোট দিয়ে বলল খুচরাগুলো যেন ওকে পয়সায় ফেরত দেয়। ও জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখল যে ড্যানি গভীর মনোযোগ দিয়ে ম্যাপ দেখছে। ও নিজের ছেলের জন্য একটা অসহায় ভালোবাসা বোধ করল। অনুভূতিটা ওর চেহারায় কঠিনতা হিসাবে প্রকাশ পেল।

সত্যি কথা বলতে অ্যালকে ধন্যবাদ জানাবার জন্যে বাসা থেকে ফোন করলেও তেমন কোন অসুবিধা ছিল না। ও এমন কিছু বলবে না যেটা ওয়েল্ডি শুনলে রাগ করতে পারে। কিন্তু জ্যাকের আত্মসম্মানবোধ তা ওকে করতে দেয় নি। আজকাল আত্মসম্মানবোধ জ্যাকের কাছে খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৌ, ছেলে আর একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ছয়শ’ ডলার ছাড়া একটা জিনিসই বাকি আছে এখন জ্যাকের কাছে, সেটা হচ্ছে ওর আত্মসম্মান। শুধু এই জিনিসটাই ওর নিজের। ব্যাংক অ্যাকাউন্টটা পর্যন্ত স্বামী-স্ত্রী দু’জনের নামে। একবছর আগেও ও যখন নিউ ইংল্যান্ডের সবচেয়ে ভালো স্কুলগুলোর মধ্যে একটায় ইংরেজী পড়াত তখন ওর বন্ধুবান্ধবের অভাব ছিল না। ওর কলিগরা ওর পড়ানোর ধরণকে তারিফ করত, আর মনে মনে ওকে পছন্দ করত ও লেখক হতে চাইত বলে। তখন ওর হাতে টাকাও আসা শুরু হয়েছিল। জীবনে প্রথমবারের মত জ্যাকের ব্যাংকে জমাবার মত কিছু টাকা এসেছিল। ও যখন নিয়মিত মদ খেত তখন একটা পয়সাও বাঁচত না, যদিও অ্যালই বেশিরভাগ সময় দাম দিত। ও আর ওয়েন্ডি একটা বাসা কিনবার স্বপ্ন দেখা শুরু করেছিল। শহর থেকে বাইরে একটা ছিমছাম বাড়ি, হয়তো সবকিছু ঠিকঠাক করতে আরও আট-নয় বছর লাগবে, তো কি হয়েছে, ওদের তো আর বয়স বেশি নয়।

কিন্তু জ্যাকের বদমেজাজ বাধা দেয়।

জর্জ হ্যাফিল্ড।

আশার রঙ্গিন দুনিয়া ছেড়ে জ্যাককে ফিরে আসতে হয় স্টভিংটন স্কুলের প্রিন্সিপাল ক্রোমার্টের অফিসের ভেতর। ওর মনে হচ্ছিল এটা ওর লেখা নাটকেরই কোন দৃশ্য : অফিসটার দেয়ালজুড়ে স্কুলের পুরনো প্রিন্সিপালদের ছবি, যারা যারা স্কুলের উন্নয়নের জন্যে দান করেছেন তাদের ছবি আর নানা রকমের সার্টিফিকেট ঝোলানো ছিল। কিন্তু ওটা কোন নাটকের সেট ছিল না, জ্যাক ভাবল। ওটা ছিল বাস্তবতা, ওর নিজের জীবন। ও কিভাবে এত বড় ভুলটা করল?

“এটা একটা সিরিয়াস ব্যাপার জ্যাক। খুবই সিরিয়াস। বোর্ড আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে ওদের সিদ্ধান্ত তোমাকে জানাবার।”

বোর্ড জ্যাকের পদত্যাগ চেয়েছিল, আর জ্যাক বিনাবাক্যব্যয়ে ওদের কথা পালন করে। পরিস্থিতি অন্যরকম হলে তার পরের জুন মাসে জ্যাকের চাকরি পারমানেন্ট হয়ে যেত।

ক্রোমার্টের সাথে ইন্টারভিউ দেবার পরের রাতটা ছিল জ্যাকের জীবনের সবচেয়ে বীভৎস, বিশ্রী রাত। মদ খাবার এত প্রবল ইচ্ছা ওর কখনও হয় নি। ওর হাত কাঁপছিল। ও হাঁটতে যেয়ে জিনিসপত্র ফেলে দিচ্ছিল। আর ওর বারবার ইচ্ছা হচ্ছিল ওয়েন্ডি আর ড্যানির ওপর রাগটা ঝাড়তে। জ্যাকের মেজাজ সেদিন একটা হিংস্র পশু হয়ে গিয়েছিল। ও নিজের বৌ-ছেলেকে মেরে বসবে এই ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ও গিয়ে থামে একটা বারের সামনে। শুধু একটা জিনিস ভেবেই জ্যাক সেদিন বারটার ভেতরে ঢোকেনি : আরেকবার মাতাল হলে ওয়েন্ডি আসলেই ড্যানিকে নিয়ে ওকে ছেড়ে চলে যাবে। তাই জ্যাক অনিচ্ছাস্বত্বেও বারটার সামনে থেকে সরে আসে। ও সেখান থেকে যায় অ্যাল শকলির বাসায়। বোর্ডে ছয়জন ওর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিল। শুধু একজন ছিল ওর পক্ষে। অ্যাল ছিল সেই একজন।

এখন ও টেলিফোন অপারেটরকে ডায়াল করবার পর অপারেটর ওকে বলল ১.৮৫ ডলারের বিনিময়ে দু’হাজার মাইল দূরে বসে থাকা অ্যাল শকলির সাথে ওর তিন মিনিটের মধ্যে যোগাযোগ করানো সম্ভব। সময় আসলেই আপেক্ষিক, জ্যাক মনে মনে বলে ফোনের ভেতর পয়সা ভরলো।

অ্যালের বাবা হচ্ছে আর্থার লংলি শকলি, বিখ্যাত স্টিল ব্যবসায়ী। তিনি ছেলের জন্যে বিশাল সম্পত্তি আর দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বোর্ডে ডাইরেক্টরের পদ রেখে গিয়েছেন। এগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে স্টভিংটন প্রিপেরটরি স্কুলের। অ্যাল আর তার বাবা দু’জনেই এই স্কুলে পড়ালেখা করেছে, আর ওরা স্কুলের কাছাকাছি একটা জায়গায়ই থাকে। তাই অ্যালের স্কুলের কাজকর্মে ভালোই উৎসাহ ছিল। ও স্কুলের টেনিস কোচের পদে ছিল।

জ্যাক আর অ্যালের মাঝে বন্ধুত্ব হওয়াটা তেমন আশ্চর্যের কিছু নয়। স্কুলের যেকোন পার্টিতে ওরা দু’জন সবচেয়ে বেশি মদ খেত। অ্যালের বৌ ওকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, আর জ্যাকের নিজের পারিবারিক অবস্থাও খুব একটা ভালো ছিল না, যদিও ও ওয়েন্ডিকে এখনও ভালোবাসত আর বেশ কয়েকবার কথা দিয়েছে যে ও মদ খাওয়া ছেড়ে দেবে।

ওরা দু’জন সাধারণত পার্টি শেষ হবার পর কোন বারে যেয়ে আড্ডা জমাত গভীর রাত পর্যন্ত। তারপর বার বন্ধ হলে কোন দোকান থেকে এক কেস বিয়ার কিনে কোন খালি রাস্তায় বসে কেসটা শেষ করত। কিছু সকালে জ্যাক টলতে টলতে বাসায় ফিরে দেখত যে ওয়েন্ডি আর ড্যানি ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে সোফায় ঘুমিয়ে পড়েছে। সেসব দিনগুলিতে জ্যাকের মধ্যে প্রচণ্ড অপরাধবোধ কাজ করত। নিজের প্রতি ঘৃণায় ওর মুখ তেতো হয়ে যেত, এত মদ খেয়ে ওর মুখ যতটা তেতো হত তার চেয়েও বেশি। এরকম সময়ে জ্যাক ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করত কোনটা ব্যবহার করা সবচেয়ে সোজা হবে, পিস্তল, দড়ি না ব্লেড।

যদি সপ্তাহের মাঝখানে কোন রাতে এসব পার্টি হত তাহলে জ্যাক তার পরদিন সকালে উঠে চারটা অ্যাসপিরিন চিবিয়ে তারপর সকাল ন’টায় স্কুলে ইংলিশ পোয়েট্রি পড়াতে যেত। গুড মর্নিং ক্লাস। আজকে তোমাদের রক্তচক্ষুওয়ালা টিচার পড়াবেন কিভাবে কবি লংফেলোর স্ত্রী আগুনে পুড়ে মারা যান।

অ্যালের ফোনের রিং শুনতে শুনতে জ্যাকের মনে পড়ল, ও নিজে তখনও বিশ্বাস করত না যে ও একজন অ্যালকোহলিক। যে মদ ওর জন্যে আসক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে ক্লাসগুলোতে ও শেভ না করে পড়াতে গিয়েছিল, বা যেগুলোতে ওর গা থেকে তখনও মদের গন্ধ বের হচ্ছিল। যে রাতগুলোতে ওয়েন্ডি আর ও আলাদা বিছানায় শুত কারণ ও মদ খেয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিল। শোনো, আমি ভালোই আছি। ভাঙ্গা হেডলাইট। না, না, আমার গাড়ি চালাতে কোন অসুবিধা হয় না। পার্টিতে অন্যরা আড়চোখে তাকাতো, এমনকি যখন ও শুধু খাবারের সাথে ওয়াইন খেত তখনও। ও আস্তে আস্তে বুঝতে পারছিল যে ও আর ঠিকমত কাজে মনোযোগ দিতে পারছে না। স্টভিংটন স্কুল ওকে আগে একজন গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষক মনে করত। হয়তো একজন সফল লেখকও। জ্যাকের লেখা দু’ডজনেরও বেশি ছোটগল্প প্রকাশিত হয়েছে। ও একটা নাটকও লেখা শুরু করেছিল। কিন্তু বেশ কয়েক মাস ধরে ওর হাত থেকে কোন লেখা বের হচ্ছিল না।

কিন্তু সবকিছু শেষ হয়ে যায় জ্যাক ড্যানির হাত ভাঙবার কিছুদিন পর। জ্যাকের তখন মনে হয়েছিল যে ওর বিয়ে এখনই ভেঙ্গে যাবে। ও জানতো যে ওয়েন্ডি যদি নিজের মাকে ঘৃণা না করত তাহলে ও তখনই ড্যানিকে নিয়ে একটা বাস ধরে সোজা মায়ের বাসায় রওনা হত।

জ্যাক আর অ্যাল একদিন গভীর রাতে একটা হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়ে আসছিল। অ্যাল চালাচ্ছিল গাড়িটা আর মাঝে মাঝেই ওর ড্রাইভিং উল্টোপাল্টা হয়ে যাচ্ছিল। ওরা দু’জনই এত মাতাল ছিল যে আক্ষরিক অর্থেই ওরা চোখে সবকিছু জোড়া জোড়া দেখতে পাচ্ছিল। ব্রিজটার কাছে ওরা সত্তরে গাড়ি চালাচ্ছিল, তখনই ওদের সামনে একটা বাচ্চাদের বাইসাইকেল এসে পড়ে। জ্যাকের কানে আসে গাড়ির টায়ার ফাটার তীক্ষ্ণ আওয়াজ। ও দেখতে পায় যে অ্যালের চেহারা কাগজের মত সাদা হয়ে গেছে। গাড়ির ধাক্কায় সাইকেলটা একটা ছোট্ট পাখির মত উড়ে যায়। একবার ওটা এসে গাড়ির উইন্ডশিল্ডে লাগে, তারপর আবার ছিটকে যেয়ে ওদের পেছনে পড়ে। অ্যাল তখনও চেষ্টা করছিল গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার। জ্যাকের মনে হল নিজের গলা অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে : “হে ঈশ্বর, অ্যাল। আমরা ওকে চাপা দিয়ে দিয়েছি। আমি পুরো বুঝতে পেরেছি যে গাড়িটা ওর উপর দিয়ে চলে গেছে।”

গাড়িটা আরও কিছুদুর যাবার পর অ্যাল ক্যাঁচ করে ব্রেক করে। ওদের পেছনে রাস্তায় চাকার রাবার পুড়ে দাগ হয়ে গিয়েছিল। গাড়ির দু’টো চাকা ফেটে গিয়েছিল। ওরা এক সেকেন্ডের জন্যে দৃষ্টি বিনিময় করে লাফ দিয়ে নেমে ব্রিজের দিকে দৌড় দেয়।

সাইকেলটা পুরো ধ্বংস হয়ে গিয়েছে। একটা চাকা খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না আর স্পোকগুলো ভেঙ্গে পিয়ানোর তারের মত পেঁচিয়ে গিয়েছিল। অ্যাল সাবধানে বলল : “আমরা বোধহয় এটাকেই চাপা দিয়েছি, জ্যাকি।”

“তাহলে বাচ্চাটা কোথায়?”

“তুই কোন বাচ্চাকে দেখেছিস?”

জ্যাক ভ্রু কুঁচকালো। সবকিছু এত দ্রুত ঘটেছে যে নিশ্চিত করে কিছু বলা মুশকিল।

ওরা সাইকেলটাকে সরিয়ে রাস্তার একপাশে নিয়ে এল। অ্যাল গাড়িতে ফিরে গিয়ে দু’টো ফ্ল্যাশলাইট নিয়ে এল। পরের দু’ঘণ্টা ওরা রাস্তার দু’পাশে আলো ফেলে খুঁজে বেড়ালো। কিন্তু কিছুই পাওয়া গেল না। এই গভীর রাতেও বেশ কয়েকটা গাড়ি ওদের পাশ কাটিয়ে গেল কিন্তু কেউ দাঁড়াল না। জ্যাকের পরে মনে হচ্ছিল যে ওদের কপাল ভালো যে কেউ দাঁড়িয়ে দেখতে চায়নি যে ওরা আলো জ্বালিয়ে রাস্তায় চক্কর কাটছিল কেন।

রাত সোয়া দু’টোর দিকে ওরা নিজেদের গাড়ির কাছে ফিরে এল। ততক্ষণে দু’জনেরই নেশা কেটে গিয়েছে, কিন্তু চাপা অস্বস্তিটা যায় নি। “যদি কেউ নাই চালাচ্ছিল সাইকেলটা তাহলে ওটা রাস্তার মাঝখানে এল কিভাবে?” অ্যাল প্রশ্ন করল, “ওটা তো রাস্তার পাশে দাঁড় করানো ছিল না, ছিল একদম মাঝখানে!”

জ্যাক উত্তর না দিয়ে শুধু মাথা ঝাঁকালো।

“স্যার, আপনি যাকে ফোন করছেন সে কোন উত্তর দিচ্ছে না।” অপারেটর বলল। “আমি কি চেষ্টা করতে থাকবো?”

“আর কয়েকটা রিং, অপারেটর, যদি তুমি কিছু মনে না কর।”

“না, স্যার।” অপারেটর দায়িত্বপূর্ণভাবে জানালো।

কোথায় তুই, অ্যাল?

অ্যাল হেঁটে হেঁটে একটা ফোনবুথ খুঁজে বের করে ওর এক বন্ধুকে ফোন দিল। সেই বন্ধুকে বলা হল যে ও যদি অ্যালের গ্যারেজ থেকে গাড়ির বরফে চলার চাকাগুলো নিয়ে এই ব্রিজের কাছে আসে তাহলে ওকে পঞ্চাশ ডলার দেয়া হবে। অ্যালের বন্ধু বিশ মিনিট পর এসে হাজির হল, জিন্স আর পাজামা পরা অবস্থায়। ও আশেপাশে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল :

“কাউকে মেরেটেরে ফেলেছিস নাকি?”

অ্যাল ততক্ষণে গাড়িতে জ্যাক লাগিয়ে পেছনদিকটা উঁচু করে ফেলেছে। জ্যাক চাকার নাটগুলো খুলছিল যাতে বরফে চলার চাকাগুলো লাগানো যায়।

“মনে তো হয় না।” অ্যাল জবাব দিল।

“তাও আমি ফুটি, বাবা। আমাকে সকালে টাকা দিয়ে দিস, তাহলেই হবে।”

“বেশ।” অ্যাল মাথা না তুলেই জবাব দিল।

ওরা দু’জন চাকা বদলে নিঃশব্দে অ্যাল শকলিন বাসায় ফিরে আসে। অ্যাল গাড়িটা গ্যারেজে ঢুকিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল।

নিশ্চুপ অন্ধকারের ভেতর থেকে ও বলল : “আমি আর জীবনেও মদ ছোঁব না, জ্যাক।”

এখন ফোনবুথের ভেতর দাঁড়িয়ে ঘামতে ঘামতে জ্যাকের মনে হল, ওর কখনই সন্দেহ হয় নি যে অ্যাল ওর কথা রাখতে পারবে না। ও নিজের গাড়ি নিয়ে বাসায় ফিরে আসে, প্রচণ্ড জোরে রেডিও ছেড়ে। কিন্তু ও কিছুতেই সাইকেলের সাথে ধাক্কা লাগবার শব্দটা মাথা থেকে সরাতে পারছিল না। চোখ বন্ধ করলেই পুরো দৃশ্যটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠছিল।

ও বাসায় ফিরে দেখল যে ওয়েন্ডি সোফায় ঘুমিয়ে আছে। ড্যানির রুমে উঁকি দিয়ে দেখল যে ড্যানি গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে নিজের বিছানায়, একটা হাত তখনও ব্যান্ডেজ করা।

ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। ড্যানি সিঁড়ি থেকে পড়ে যায়।

(শালা মিথ্যাবাদী )

ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল। আমার বদমেজাজের কারণে-

(হারামজাদা শয়তান মাতালের বাচ্চা শুওর)

প্লিজ, ওটা একটা অ্যাক্সিডেন্ট ছিল, আমার কথা বিশ্বাস কর-

কিন্তু ওর অনুরোধ চাপা পড়ে গেল গাড়ির সাথে সাইকেলের ধাক্কা লাগার কর্কশ শব্দে। ওদের এখনও ওখানে দাঁড়িয়ে পুলিশের জন্যে অপেক্ষা করা উচিত ছিল। আজকে অ্যাল গাড়ি চালাচ্ছিল তো কি হয়েছে? এমন অনেক দিন গেছে যখন জ্যাকও মদ খেয়ে গাড়ি চালিয়েছে।

ও ড্যানির গায়ের ওপর চাদর টেনে দিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে লামা .৩৮টা ক্লজেট থেকে নামালো। পিস্তলটা একটা জুতোর বাক্সের ভেতর ছিল। ও বাক্সটা কোলে নিয়ে প্রায় একঘণ্টা বসে রইল। অস্ত্রটার চকচকে শরীর থেকে ও চোখ সরাতে পারছিল না।

ও যখন আবার পিস্তলটা ক্লজেেটর ভেতর রেখে দিল তখন প্রায় ভোর হয়ে গিয়েছে।

সেদিন সকালে ও ব্রাকনারকে ফোন করে বলে ওর ক্লাস ক্যানসেল করে দিতে। জ্যাক যে ডিপার্টমেন্টে পড়ায় ব্রাকনার সে ডিপার্টমেন্টের হেড। জ্যাক বলল যে ওর সর্দি লেগেছে। ব্রাকনার খুশি হয় নি তা বোঝাই যাচ্ছিল। জ্যাকের কিছুদিন পরপরই এমন সর্দি লাগে।

ওয়েন্ডি নাস্তায় ডিম আর কফি এনে দিল। ওরা দু’জনেই খাবার সময় কোন কথা বলল না। বাইরে থেকে ড্যানির আনন্দিত গলা ভেসে আসছিল। ও নিজের ভালো হাতটা দিয়ে উঠানে একটা খেলনা গাড়ি চালাচ্ছে।

ওয়েন্ডি উঠে প্লেট ধুতে গেল। ও জ্যাকের দিকে পিঠ রেখে বলল : “জ্যাক, আমি কয়েকটা জিনিস ভেবে দেখেছি।”

“তাই নাকি?” জ্যাক কাঁপা হাতে একটা সিগারেট ধরালো! আজকে সকালে ওর কোন মাথাব্যাথা নেই। শুধু সারা শরীর কাঁপছে ওর। ও চোখ বন্ধ করতে আবার অ্যাক্সিডেন্টটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

“কি করলে আমার আর ড্যানির জন্যে সবচেয়ে ভালো হবে তা নিয়ে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। হয়তো এতে তোমারও ভালো হবে। জানি না…আমাদের হয়তো এসব নিয়ে আগেই কথা বলা উচিত ছিল।”

“তুমি আমার জন্যে একটা কাজ করতে পারবে?” জ্যাক সিগারেটের আগুনের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। “আমার একটা কথা রাখবে?”

“কি?”ওয়েন্ডি সমান, নিরপেক্ষ গলায় জানতে চাইল। জ্যাক চোখ তুলে তাকালো ওর দিকে।

“আজ থেকে এক সপ্তাহ পর আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলি? যদি তুমি চাও তাহলে…”

এবার ওয়েন্ডি ঘুরে তাকাল জ্যাকের দিকে। ও সুন্দর চেহারায় স্পষ্ট হতাশার ছাপ। “জ্যাক, তুমি কখনও কথা দিয়ে কথা রাখো না। তুমি যেমন ছিলে তেমনই থাকো -”

ও আচমকা থামল। জ্যাকের চোখের দিকে ও বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল। ওয়েন্ডি আর আগের মত নিশ্চিত বোধ করছিল না।

“এক সপ্তাহ,” জ্যাক বলল। ওর গলার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। “প্লিজ। আমি কোন কথা দিচ্ছি না। তারপরেও যদি তোমার কিছু বলার থাকে তাহলে বলবে। আমি সবকিছুই মেনে নেব।”

ওরা অনেকক্ষণ একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর ওয়েন্ডি কিছু না বলে আবার ঘুরে সিংকের দিকে মুখ করে দাঁড়ালো। একটু মদের জন্যে জ্যাকের সারা শরীর কাঁপছিল। প্লিজ, মাত্র এক গ্লাস, যাতে এত অসহায় না লাগে-

“ড্যানি বলল যে ও স্বপ্নে দেখেছে তোমার গাড়ি অ্যাক্সিডেন্ট করেছে, ‘ ওয়েন্ডি হঠাৎ করে বলল। “এটা কি সত্যি, জ্যাক? তুমি আসলেই অ্যাক্সিডেন্ট করেছ?”

“না।”

দুপুর হতে হতে মদ খাবার প্রচণ্ড নেশায় জ্যাকের মনে হচ্ছিল ওর জ্বর উঠে গেছে। ও অ্যালের বাসায় গেল।

“তুই এখনও খাসনি তো?” ও ঢুকবার সময় অ্যাল জিজ্ঞেস করল। অ্যালের চেহারাও মদের অভাবে রুক্ষ হয়ে গিয়েছিল।

“এক ফোঁটাও না। তোর চেহারা তো ভূতের মত হয়ে গিয়েছে।”

সারা বিকাল ওরা দু’জন তাস পেটাল। এক ফোঁটা মদও কেউ স্পর্শ করল না।

এক সপ্তাহ চলে গেল। ওয়েন্ডি কিছু বলল না ওকে, শুধু অবিশ্বাস ভরা দৃষ্টি নিয়ে দেখল। জ্যাক কড়া কফি খাওয়া শুরু করেছিল, আর ও সারাদিন ক্যানের পর ক্যান কোকা-কোলা শেষ করত। একবার ও ছয় ক্যান কোক এক বসায় খেয়ে ফেলে। তার পাঁচ মিনিট পরই ও দৌড়ে বাথরুমে যেতে হয়। বাসায় মদের বোতলগুলো আস্তে আস্তে খালি হয়ে গেল না। জ্যাকের ক্লাস শেষ হলে ও অ্যাল শকলির বাসায় যেত-ওয়েন্ডি অ্যাল শকলিকে দু’চোখে দেখতে পারত না আর জ্যাক ফিরে আসার পর ওয়েন্ডির পরিষ্কার মনে হত যে ওর গা থেকে স্কচের গন্ধ আসছে। কিন্তু জ্যাক ওর সাথে সম্পূর্ণ ঠিকঠাকভাবে কথা বলত ডিনারের সময়, আর তারপর এক কাপ কফি খেয়ে ড্যানিকে ঘুম পাড়াবার আগে গল্প শোনাতো। এসব দেখে ওয়েন্ডি নিজের কাছে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে না, ও আসলে মদ খায় নি।

আরও বেশ কিছু সপ্তাহ গেল, আর যে না বলা শব্দটা ওয়েন্ডির ঠোঁটে চলে এসেছিল সেটা আবার দূর হয়ে গেল। কিন্তু জ্যাক বুঝতে পেরেছিল যে ওয়েন্ডির মন থেকে সন্দেহ এখনও পুরোপুরিভাবে যায়নি, আর কখনও হয়তো যাবেও না। তারপর একদিন জর্জ হ্যাফিন্ডের ঘটনাটা ঘটল। আবার জ্যাকের বদমেজাজের কারণে। আর এবার ও মাতালও ছিল না।

“স্যার, আপনার কলের এখনও জবাব পাওয়া যাচ্ছে না-”

“হ্যালো?” অ্যালের গলা, হাঁপাচ্ছে ও। “কথা বলুন।” অপারেটর নীরস গলায় জানালো।

“অ্যাল, আমি জ্যাক টরেন্স।”

“জ্যাকি!” নির্ভেজাল আনন্দ ফুটে উঠল অ্যালের গলায়। “কেমন আছিস?”

“ভালো। আমি ফোন দিয়েছি তোকে ধন্যবাদ দেবার জন্যে। এই লম্বা শীতেও যদি নাটকটা শেষ করতে না পারি তাহলে জীবনেও পারবো না।”

“আরে পারবি, পারবি।”

“তোর কি অবস্থা?” জ্যাক একটু সংকোচের সাথে জিজ্ঞেস করল। “এখনও খাই না।” অ্যালের জবাব। “তুই?”

“আমিও না।”

“খেতে ইচ্ছে করে?”

“প্রত্যেকদিন।”

অ্যাল হাসল। “আমারও একই অবস্থা। আমি জানি না হ্যাফিল্ডের ওই গ্যাঞ্জামের পর তুই না খেয়ে ছিলি কিভাবে। আমি বোধহয় পারতাম না।”

“আমি সবকিছুতে একেবারে প্যাঁচ লাগিয়ে দিয়েছিরে।” জ্যাক সমান স্বরে বলল।

“আরে ধুর, গ্রীষ্ম আসতে আসতে পুরো বোর্ডের আমি মত ঘুরিয়ে দেব। অ্যাফিংগার তো এখনই বলাবলি করছে যে আমরা বেশি তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছি। আর নাটকটা যদি কিছু করতে পারিস”

“ঠিক আছে, অ্যাল। শোন, আমার ছেলে গাড়িতে অপেক্ষা করছে-”

“অবশ্যই। আমি বুঝি। ভালো থাকিস শীতের সময় জ্যাক। তোর উপকার করতে পেরে আমি খুশিই হয়েছি।”

“আবারও ধন্যবাদ, অ্যাল।” জ্যাক ফোন রেখে চোখ বন্ধ করল, আর ওর চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল বাইসাইকেলটার ছবি। পরের দিন সকালে ছোট্ট করে পেপারে খবরটা আসে। কিন্তু ওখানেও মালিকের নাম জানা যায়নি। এত রাতে সাইকেলটা ওখানে কি করছিল এটা সাংবাদিকদের কাছেও একটা রহস্য ছিল, আর ব্যাপারটা রহস্য থাকাই হয়তো ভালো।

জ্যাক গাড়িতে ফিরে ড্যানিকে ওর আধগলা চকলেটটা দিল। “বাবা?”

“কি, ডক?”

ড্যানি একটু ইতস্তত করল, বাবার গম্ভীর চেহারা দেখে।

“তুমি যখন হোটেল থেকে ফিরে এসেছিলে তখন আমি তোমাকে বলেছিলাম যে আমি একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি, মনে আছে?”

“ম্‌ম্ হম্।”

কিন্তু কোন লাভ হল না। বাবার মন অন্য কোথাও পড়ে আছে, ওর সাথে নয়। বাবা আবার খারাপ জিনিসটার কথা চিন্তা করছে।

(স্বপ্নটায় তুমি আমাকে মারার চেষ্টা করছিলে, বাবা)

“স্বপ্নে কি দেখেছিস, ড্যানি?”

“কিছু না।” বলে ড্যানি ম্যাপগুলো গাড়ির গ্লাভ কম্পার্টমেন্টে রেখে দিল।

“তুই শিওর?”

“হ্যা।”

জ্যাক চিন্তিত দৃষ্টিতে একবার ছেলের দিকে তাকালো, তারপর ওর মনকে দখল করে নিল ওর নাটকের চিন্তা।

অধ্যায় ৬ – নৈশচিন্তা

ভালোবাসা শেষ, আর ওর প্রেমিক ওর পাশে শুয়ে আছে।

ওর প্রেমিক।

ও অন্ধকারে একটু হাসলো। ওর প্রেমিকের আদরের ছোঁয়া এখনও ওর শরীরে লেগে আছে। ওর হাসিটা একইসাথে দুষ্টু আর শান্তিপূর্ণ, কারণ ‘ওর প্রেমিক’ শব্দগুলো ওর মনের শত শত অনুভূতিকে একসাথে প্রকাশ করে। সবগুলো অনুভূতিকে ও প্রথমে আলাদা আলাদা করে পরখ করে দেখল, তারপর সবগুলো একসাথে। এখন, এই অন্ধকারে ভাসতে ভাসতে ওর মনে হল, ওদের দু’জনের সম্পর্কটা পুরনো আমলের একটা গানের মত, মন খারাপ করা কিন্তু সুন্দর।

ও শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিল যে ও কতগুলো বিছানাতে এভাবে শুয়েছে এই মানুষটার সাথে। ওরা প্রথম একজন আরেকজনের দেখা পায় কলেজে থাকতে। ওরা প্রথম একজন আরেকজনকে ভালোবাসে ছেলেটার অ্যাপার্টমেন্টে। তার কিছুদিন আগেই মেয়েটার মা মেয়েটাকে বাসা থেকে বের করে দেয়, বলে আর কখনও ফিরে না আসতে। ও কারও সাথে থাকতে চাইলে নিজের বাবার সাথে যেয়ে থাকুক, যার দোষে আসলে ডিভোর্সটা হয়েছে। সেটা ছিল ১৯৭০ সালে। এতদিন হয়ে গেছে? এক সেমেস্টার পরে ওরা একসাথে থাকা শুরু করে। ওরা ছোটখাটো কাজ করত আর ছেলেটার অ্যাপার্টমেন্টে থাকত। ওর সেখানকার বিছানাটা খুব ভালো করে মনে আছে। বিছানাটার মাঝকানের দিকে দেবে গিয়েছিল। ওরা যখন রাতে ঘনিষ্ঠ হত তখন বিছানাটা ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করত। ওই বছর ও প্রথম নিজের মায়ের ছায়া থেকে নিজেকে মুক্ত করে। জ্যাক ওকে এটা করতে অনেক সাহায্য করেছিল। উনি সবসময় তোমাকে বশে রাখতে চান, জ্যাক বলেছিল। তুমি যতবার ওনাকে ফোন করবে, যতবার ক্ষমা চাবে, উনি ততবার তোমাকে তোমার বাবার কথা বলে খোঁটা দেবেন : এতে উনি মজা পান ওয়েন্ডি, এসব করে উনি নিজেকে বোঝান যে যা হয়েছিল তা আসলে তোমার দোষ। কিন্তু এতে তোমার ক্ষতি হচ্ছে। ও আর জ্যাক এটা নিয়ে রাতের পর রাত জেগে কথা বলত।

(নিজের শরীর চাদর দিয়ে অর্ধেক ঢেকে জ্যাক উঠে বসে ওর দিকে তাকাত। ওর দৃষ্টিতে সবসময় হাসি আর চিন্তা মিলেমিশে থাকত। ও ওয়েন্ডিকে বলত : উনি নিজেই তো তোমাকে বলেছেন কখনও ফিরে না আসতে, তাই না? তাহলে তুমি যখন ফোন কর উনি কখনও ফোন রেখে দেন না কেন? সবসময় তোমাকে কেন বলেন যে আমার সাথে থাকলে উনি আর কখনও তোমার চেহারা দেখবেন না? কারণ উনি ভয় পান যে আমি ওনার এই নিষ্ঠুর খেলাটা পন্ড করে দেব। উনি তোমাকে সুতোয় বেঁধে নাচাতে চান, সোনা। তোমার এটা করতে দেয়াটা বোকামী হবে। উনি যখন বলেছেনই ওনার কাছে আর ফিরে না যেতে, তাহলে তুমি ওনার কথা শুনলেই তো পারো। এভাবে অনেক বোঝাবার পর ওয়েন্ডি শেষে রাজী হয়ে যায়। )

কিছুদিনের জন্যে একে অপরের থেকে আলাদা থাকাটা জ্যাকেরই বুদ্ধি ছিল। যাতে আমাদের সম্পর্কটা আমরা আরও ভালো করে বুঝতে পারি, ও বলেছিল। ওয়েন্ডি ভয়ে ভয়ে ছিল যে জ্যাক হয়তো অন্য কারও প্রেমে পড়েছে। পরে ও জানতে পারে যে ব্যাপারটা আসলে তা ছিল না। পরের বসন্তেই ওরা আবার একসাথে থাকা শুরু করে। জ্যাক তখন ওকে জিজ্ঞেস করে যে ও ওর বাবা সাথে দেখা করেছে কিনা। ওয়েন্ডি প্রশ্নটা শুনে আঁতকে উঠেছিল।

“তুমি জানলে কিভাবে? তুমি আমার পেছনে চর লাগিয়েছ নাকি?”

জ্যাক ওর বিজ্ঞ হাসিটা হাসলো। এই হাসিটার সামনে ওয়েন্ডির নিজেকে সবসময় একটা বাচ্চা মেয়ে মনে হয়। যেন জ্যাক ওর মনে কি আছে তা ওর নিজের চেয়ে ভালো বুঝতে পারে।

“তোমার একটু সময় দরকার ছিল, ওয়েন্ডি।”

“কিসের জন্যে?”

“হয়তো…এটা দেখার জন্যে যে আমার আর তোমার মায়ের মধ্যে কার সাথে তুমি সারাজীবন কাটাতে চাও।”

“এসব কি বলছো, জ্যাক?”

“বলছি যে আমি তোমাকে বিয়ে করতে চাই, ওয়েন্ডি।”

বিয়ে। ওয়েন্ডির বাবা এসেছিল, কিন্তু মা আসেনি। ওয়েন্ডি সিদ্ধান্ত নেয় যে তাতে ওর অসুবিধা নেই, যদি জ্যাক ওর সাথে থাকে তাহলে। তারপর ড্যানি আসে, ওর জানের টুকরো বাচ্চা।

ওই বছরটা ছিল ওদের জন্যে সবচেয়ে আনন্দের, রাতের সময়গুলো সবথেকে মধুময়। ড্যানি জন্ম হবার পর জ্যাক ওয়েন্ডির জন্যে একটা চাকরির ব্যবস্থা করে দেয়। ও কলেজের ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রফেসরদের জন্যে টাইপিস্ট হিসাবে কাজ শুরু করে। ও একজনের জন্যে একটা উপন্যাসও টাইপ করে দিয়েছিল, যদিও সেটা পরে প্রকাশ পায়নি। জ্যাক অবশ্য তাতে মনে মনে বেশ খুশিই হয়েছিল। ওর ওই প্রফেসরকে নিয়ে একটু হিংসা ছিল। ওয়েন্ডি এই চাকরিটা করে প্রতি সপ্তাহে চল্লিশ ডলার করে পেত, যেটা উপন্যাস টাইপ করবার সময় বাড়তে বাড়তে ষাট ডলারে যেয়ে ঠেকেছিল। ওরা ওদের জীবনের প্রথম গাড়িটা কেনে তখনই, বেবি-সিট লাগানো একটা পাঁচ বছর পুরনো বুইক। ওদের ছোট্ট পরিবার ধীরে ধীরে সচ্ছলতার দিকে আগাচ্ছিল। ড্যানির জন্মের পর ওয়েন্ডি আর ওর মায়ের মাঝে একটা নিঃশব্দ আপোস হয়। ওদের মধ্যে তখনও আগের আক্রোশ আর অস্বস্তি লুকিয়ে ছিল, কিন্তু তারপরেও দু’জন ড্যানির খাতিরে কিছুক্ষণের জন্যে এগুলো ভুলে থাকতে রাজী হয়। ওয়েন্ডি ওর মায়ের বাসায় কখনও জ্যাককে নিয়ে যেত না। ও ফিরে এসে জ্যাককে কখনও বলত না যে ওখানে ওর মাই সবসময় ড্যানির ডাইপার বদলে দিত। মা সবকিছুতেই ভুল ধরতো। কখনও অভিযোগ থাকত বাচ্চার দুধ বানাবার ফর্মুলা নিয়ে তো কখনও ওর কোন অ্যালার্জি নিয়ে। মা কখনওই মুখে কিছু বলত না, তবে তার ব্যবহারে তার মনোভাব পরিষ্কার বোঝা যেত। মায়ের সাথে আপোসের ফল হল এই যে ওয়েন্ডির মনে ভয় ঢুকে গেল যে ও হয়তো যথেষ্ট ভালো মা নয়। ওয়েন্ডির মা আবার ওকে সূতোয় বেঁধে ফেলেছিল।

ওয়েন্ডি তখন দিনেরবেলা ভালো বৌয়ের মত কিচেনে বসে রেকর্ড প্লেয়ারে একটা পুরনো গান ছেড়ে ড্যানিকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতো। জ্যাকের ফিরতে ফিরতে দু’টো-তিনটে বেজে যেত। এসে ও যদি দেখতো যে ড্যানি ঘুমিয়ে আছে তাহলে ও আস্তে করে ওয়েন্ডিকে বেডরুমে নিয়ে যেত আর ভুলিয়ে দিত সব দুশ্চিন্তা।

রাতে ওয়েন্ডি টাইপ করত আর জ্যাক তখন ব্যস্ত থাকত নিজের নাটক আর কলেজের খাতা দেখা নিয়ে। সে দিনগুলোতে ওয়েন্ডি মাঝে মাঝে রাতে স্টাডিরুমে এসে দেখত যে জ্যাক আর ড্যানি দু’জনই সোফায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। জ্যাক শুধু একটা ছোট হাফপ্যান্ট পড়া, আর ড্যানি গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে বাবার বুকের ওপর। ওয়েন্ডি ড্যানিকে কোলে করে নিয়ে এসে ওর বিছানায় শুইয়ে দিত, তারপর এসে দেখত জ্যাক কতদুর লেখা শেষ করেছে। তারপর আস্তে করে জ্যাককে ডেকে উঠিয়ে দিত যাতে ও বিছানায় শুতে আসে।

সবচেয়ে আনন্দের বছর, সবথেকে মধুময় রাত।

সেই দিনগুলোতেও জ্যাকের মদের নেশা বহাল তবিয়তে ছিল। প্ৰতি শনিবার রাতে একদল ছাত্র এক কেস বিয়ার নিয়ে হাজির হত আর ওদের মধ্যে নানা বিষয় উত্তেজিত আলোচনা চলত, যেগুলোর বেশীরভাগ ওয়েল্ডি বুঝতে পারতো না। ওরা ইংরেজী সাহিত্য নিয়ে কথা বলত, আর ও ছিল সামাজিক বিজ্ঞানের ছাত্রী। ওরা একদিন তর্ক করত পেপিসের ডায়েরির সাহিত্যিক মূল্য নিয়ে তো আরেকদিন করত চার্লস ওলসনের কবিতা নিয়ে। কিছু কিছু দিন আবার আবৃত্তিও শুরু হয়ে যেত। এরকম আরও শত শত জিনিস নিয়ে ওরা গল্প করত। ওয়েন্ডির কখনও এসব আড্ডায় অংশ নিতে বেশী ইচ্ছা করে নি। ও জ্যাকের পাশে একটা ইজি চেয়ারে বসে বসে শুনত। জ্যাক বসত এক পায়ের ওপর আরেক পা চড়িয়ে আর ওর এক হাতে থাকত একটা বিয়ারের ক্যান। আরেক হাত থাকত ওয়েন্ডির পায়ের ওপর।

জ্যাক সারা সপ্তাহ নিজের লেখা নিয়ে গাধার মত খাটত, প্রতি রাতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা করে। তাই শনিবার রাতের এই আড্ডাগুলো ওর দরকার ছিল। যদি ও মাঝে মাঝে একটু ফূর্তি না করে তাহলে ওর ক্লান্তি বাড়তে বাড়তে হয়তো ক্ষোভে পরিণত হবে।

ইউনিভার্সিটি পাশ করতে করতে নিজের প্রকাশিত গল্পের জোরে জ্যাকের স্টভিংটনে চাকরি হয়ে যায়। ততদিনে জ্যাকের লেখা চারটা গল্প বের হয়ে গিয়েছিল, তার মধ্যে একটা আবার এস্কোয়ার নামে একটা জনপ্রিয় পত্রিকায়। ওয়েন্ডির ওই দিনটা এখনও মনে আছে, হয়তো সারাজীবনই মনে থাকবে। ও খামটা আরেকটু হলে ময়লার ঝুড়িতে ফেলেই দিয়েছিল। ও ভেবেছিল এটা কোন পত্রিকার বিজ্ঞাপণ হবে। খোলার পর ও দেখতে পায় যে চিঠিটা এস্কোয়ার পত্রিকা থেকে এসেছে, আর ওরা জ্যাকের ছোটগল্প ‘কনসার্নিং দ্য ব্ল্যাক হোল্স’ আগামী বছরের শুরুতে ছাপাতে চায়। ওরা ৯০০ ডলার দিতে রাজী আছে। পড়ে ওয়েন্ডির চোখ বড়বড় হয়ে যায়। ও ছয় মাস ধরে টানা টাইপিং করলেও এত টাকা আসবে না। ওয়েন্ডি ছুটে যায় ফোনের কাছে, আর ছোট্ট ড্যানি অবাক চোখে মায়ের পাগলামি দেখতে থাকে।

জ্যাক পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরে আসে। ওর বুইকে বসে ছিল সাতজন বন্ধু আর বিয়ার ভর্তি একটা ছোট ড্রাম। সবাই একসাথে এক গ্লাস খাবার পর (ওয়েন্ডিও সেদিন বিয়ার খেয়েছিল, যদিও এমনিতে ওর স্বাদটা অসহ্য লাগে), জ্যাক চিঠিটার সাথে পাঠানো স্বীকৃতিপত্রে সাইন করে একই খামে ভরে লেটারবক্সে ফেলে দিয়ে আসে। ও ফিরে আসার সময় দরজায় দাঁড়িয়ে গম্ভীর গলায় ঘোষণা করে, “আজ আমার জয়ের দিন।” সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দন জানায় ওকে। রাত দু’টোর সময় যখন ড্রামটা শেষের দিকে, জ্যাক আর দু’জন বন্ধু যারা তখনও সচল ছিল বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নেয় কোন বার খোলা আছে কিনা দেখতে।

ওয়েন্ডি জ্যাককে সরিয়ে নিয়ে যায় সিঁড়ির পাশে। ওর দুই বন্ধু ততক্ষণে গাড়িতে উঠে গলা ছেড়ে গান গাওয়া শুরু করেছে। জ্যাক নিচু হয়ে ওর জুতোর ফিতা বাঁধবার চেষ্টা করছিল।

“জ্যাক,” ওয়েন্ডি বলল, “যেয়ো না। তুমি নিজের জুতোর ফিতেই বাঁধতে পারছো না, গাড়ি চালাবে কিভাবে?”

জ্যাক দাঁড়িয়ে শান্তভাবে দু’হাত ওর দুই কাঁধে রাখে। “আমি আজকে রাতে চাইলে আকাশে উড়তেও পারবো।”

“না,” ওয়েন্ডি বলল, “তোমার অবস্থা একদম ভালো নয় আজকে।”

“আমি তাড়াতাড়ি বাসায় চলে আসবো।”

কিন্তু জ্যাকের সেদিন বাড়ি ফিরতে ফিরতে ৪টা বেজে যায়। ও বাসায় ঢুকে টলতে টলতে আসবাবপত্রের সাথে ধাক্কা খাচ্ছিল। সেই শব্দে ড্যানির ঘুম ভেঙ্গে যায়। জ্যাক তখন ড্যানিকে কোলে নিয়ে শান্ত করবার চেষ্টা করে, কিন্তু ফেলে দেয় ওকে নিজের হাত থেকে। ড্যানির কান্নার শব্দে ওয়েন্ডি ছুটে আসে, আর ড্যানিকে পড়ে থাকতে দেখে ওর প্রথম যে কথাটা মাথায় আসে তা হচ্ছে : মা ওর মাথায় আঘাত দেখলে কি ভাববে! ও তারপর ড্যানিকে কোলে নিয়ে ইজি চেয়ারে বসে দোল দিয়ে দিয়ে শান্ত করে। জ্যাক যে পাঁচ ঘণ্টা ছিল না তখন ওয়েন্ডি বসে বসে ওর মায়ের কথা চিন্তা করছিল। ওর মায়ের ভবিষ্যদ্বাণী যে জ্যাককে দিয়ে কখনও কিছু হবে না। বড় বড় স্বপ্ন, ওর মা বলেছিল। রাস্ত ার ভিখিরিদেরকে জিজ্ঞেস করে দেখো, ওরাও সবাই বড় বড় স্বপ্ন নিয়েই শুরু করেছিল। এস্কোয়ারের গল্পটা কি ওর মাকে ভুল প্রমাণ করল নাকি ঠিক? ওর কানে নিজের মায়ের গলা বেজে উঠল : উইনিফ্রেড, তুমি বাচ্চাটাকে সামলাতে পারো না, দেখি আমাকে দাও। ও কি নিজের স্বামীকে সামলাতে পারছিলো না? নিশ্চয়ই তাই, নাহলে ও আনন্দ করতে বাসার বাইরে ছুটবে কেন? ওর ভেতরে একটা অসহায় আতংক মাথাচাড়া দিয়ে উঠল I

“চমৎকার,” ওয়েন্ডি ড্যানিকে কোলে নিয়ে দুলতে দুলতে বলল। “তুমি বোধহয় ওর মাথা ফাটিয়ে ফেলেছো।”

“একটু ব্যাথা পেয়েছে, তার বেশী কিছু নয়।” জ্যাক অপরাধী গলায় বলল, ছোট বাচ্চারা দুষ্টুমি করে ধরা পড়লে যে গলায় কথা বলে তার মত। এক মুহূর্তের জন্য ওয়েন্ডির প্রচণ্ড রাগ উঠলো ওর ওপর।

“হয়তো,” ও শক্ত গলায় বলল। “হয়তো না।” ওর মা ওর বাবার সাথে ঠিক এভাবে কথা বলত, জিনিসটা মাথায় আসতেই ওয়েন্ডির নিজেকে অসুস্থ মনে হল।

“যেমন মা, তেমনই মেয়ে।” জ্যাক বিড়বিড় করল।

“শুতে যাও!” ওয়েন্ডি চিৎকার করে উঠলো, ওর ভেতরের আতংক এখন

রাগের রুপ ধারণ করেছে। “শুতে যাও, তুমি মাতাল!”

“আমাকে হুকুম করবে না।”

“জ্যাক, প্লিজ…আমাদের এখন…এটা…” ও আর কোন শব্দ খুঁজে পাচ্ছিল না।

“আমাকে হুকুম করবে না।” জ্যাক গম্ভীরমুখে আবার বলল, তারপর বেডরুমে চলে গেল। ওয়েন্ডি একলা হয়ে গেল রুমটায়, ড্যানি ওর কোলে শুয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। পাঁচ মিনিট পর বেডরুম থেকে জ্যাকের নাক ডাকার আওয়াজ ভেসে এল। ওটা ছিল ওয়েন্ডির সোফায় ঘুমনোর প্রথম রাত।

এখন ওয়েন্ডি বিছানায় পাশ ফিরল, ও প্রায় ঘুমিয়ে গিয়েছে। ওর চিন্তা এখন ধারাবাহিকতা থেকে মুক্ত হয়ে এক লাফে পার হয়ে গেল স্টভিংটনের প্রথম বছর, তারপর ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল ওদের জীবনের খারাপ সময়গুলো যখন ওর স্বামী ওর ছেলের হাত ভেঙ্গে ফেলেছিল, আর চলে এল সেদিন সকালে, নাস্তার টেবিলে।

ড্যানি বাইরে ট্রাক নিয়ে খেলা করছিল, ওর হাত তখনও ব্যান্ডেজ করা। জ্যাক টেবিলে বসা, মুখ ফ্যাকাসে আর কাঁপা আঙুলের ফাঁকে একটা সিগারেট ধরা। ওয়েন্ডি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিল যে আজকেই ডিভোর্সের কথা বলবে। ও ব্যাপারটা সবদিক থেকেই ভেবে দেখেছে, সত্যি বলতে ও গত ছয় মাস ধরেই ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছে। ও নিজেকে বুঝিয়েছে যে ড্যানি না থাকলে ও বহু আগেই নিজের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিত, কিন্তু আসলে তাও নয়। জ্যাক যে রাতগুলোতে বাইরে থাকত সেসব রাতে ওয়েন্ডি স্বপ্ন দেখত, আর সেই স্বপ্নগুলো সবসময় হত ওর নিজের বিয়ে আর ওর মাকে নিয়ে।

(কে কন্যাদান করবে? ওর বাবা নিজের সবচেয়ে ভালো সুটটা পরা, যদিও সেটা তেমন দামী নয়-তিনি জায়গায় জায়গায় ঘুরে পণ্য বিক্রি করতেন, যে ব্যবসাটার তখনই দেউলিয়া হবার মত অবস্থা ছিল ওনার চেহারা ক্লান্ত মুখে বার্ধক্যের ছাপ-বললেন : আমি করব)

দুর্ঘটনাটার পরেও যদি ড্যানির হাত ভাঙ্গাটাকে দুর্ঘটনা বলা যায়—ওয়েন্ডি ব্যাপারটা পুরোপুরি স্বীকার করতে পারছিল না, মানতে পারছিল না যে ওর বিয়ে একটা ব্যার্থতায় পরিণত হয়েছে। ও বোকার মত অপেক্ষা করছিল কোন অলৌকিক ঘটনার জন্যে, যখন জ্যাক বুঝবে যে ও কি অত্যাচার করছে, শুধু নিজের ওপর নয়, ওয়েন্ডির ওপরও। কিন্তু ওর মধ্যে থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। ক্লাসে যাবার আগে একগ্লাস। স্টভিংটনে লাঞ্চ করবার সময় দু’- তিনটে বিয়ার। রাতে খাবার সময় আবার দু’-তিন গ্লাস। খাতা দেখবার সময় আরও চার-পাঁচ গ্লাস। ছুটির দিনগুলো এর থেকে বেশী খাওয়া হত। আরও বেশী হত অ্যাক শকলির সাথে যে রাতগুলোতে ও বাইরে যেত। ওয়েন্ডি কখনও ভাবে নি যে ওর এত কষ্ট পেতে হবে। এর মধ্যে কতখানি ওর নিজের দোষে হয়েছে? এই প্রশ্নটা ওকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রাখত। ওর মনে হত যে ও ওর মায়ের মত হয়ে যাচ্ছে, অথবা বাবার মত। ও চিন্তা করত ডিভোর্সের পর ও কোথায় যাবে তা নিয়ে। ওর মা ওদের নিজের বাসায় থাকতে দিবে, কোন সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু বারবার মাকে ড্যানির ডাইপার বদলাতে দেখলে, ওর জন্যে ওয়েন্ডির রান্না করা খাবার ফেলে দিয়ে নতুন করে রান্না করতে দেখলে, আর মায়ের পছন্দমত চুল কাটা হয় নি দেখে ড্যানিকে আবার চুল কাটাতে নিয়ে যাওয়া দেখতে হলে ওয়েন্ডি পাগল হয়ে যাবে। তারপর ওর মা আলতো করে ওর হাত ধরে বলবে, এটা তোমার দোষ নয়, কিন্তু আসলে এসব তোমারই দোষ ছিল। তুমি কখনওই প্রস্তুত ছিলে না। যখন তুমি তোমার বাবা আর আমার মাঝখানে এসেছিলে তখনই তোমার আসল চেহারা আমি চিনে গিয়েছি।

আমার বাবা, ড্যানির বাবা। আমার। ওর।

(কে কন্যাদান করবে? আমি। হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু ছয় মাস পরে।)

সেদিন প্রায় সারারাত ওয়েন্ডি জেগে ছিল, চেষ্টা করছিল একটা কঠোর সিদ্ধান্ত নেবার।

এই ডিভোর্সটা নেয়া জরুরি, ও নিজেকে বোঝাচ্ছিল। ওর মা আর বাবার ওপর ভিত্তি করে ও এই সিদ্ধান্তটা নিচ্ছে না। এটা ওর ছেলে আর ওর নিজের জন্যে দরকার, যদি ও নিজের যৌবন সম্পূর্ণ নষ্ট না করতে চায়। সত্য কঠিন হলেও মানতেই হবে। ওর স্বামী একজন বিপজ্জনক মানুষ। তার মেজাজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ নেই, তার ওপর মদের নেশা ওকে পুরোপুরি কাবু করে ফেলেছে। মদের প্রভাবে ওর লেখার হাতও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ব্যাপারটা দুর্ঘটনা হোক আর না হোক, এটা তো অস্বীকার করা যাবে না যে ও ড্যানির হাত ভেঙ্গে ফেলেছে। ও নিজের চাকরিও হারাবে, এই বছরে না হলে আগামী বছর। ওয়েন্ডির এর মধ্যেই চোখে পড়েছে যে অন্যান্য শিক্ষকদের স্ত্রীরা ওর দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকানো শুরু করেছে। ও নিজেকে বোঝালো যে এই অসফল বিয়েটা ঠিক করার জন্যে ও অনেক চেষ্টা করেছে, কিন্তু আর নয়। ব্যাপারটা যত কম ঝামেলার মাঝে দিয়ে শেষ হয় ততই ভালো, কিন্তু ও আর অপেক্ষা করতে পারবে না।

এসব অস্বস্তিকর চিন্তা মাথায় আসাতে ওয়েন্ডি তন্দ্রার মধ্যে নড়ে উঠল ওর স্বপ্নে হানা দিচ্ছিল ওর মা আর বাবার চেহারা। তুমি পারো শুধু মানুষের সংসার ধ্বংস করতে, ওর মা বলেছিল। কে কন্যাদান করবে? পাদ্রী জানতে চেয়েছিল। আমি করব, ওর বাবা বলে ওঠে। আবার ওই দিনটা ওর সামনে ভেসে উঠল, ও প্লেট ধুচ্ছে আর জ্যাক একটা সিগারেট হাতে বসে আছে টেবিলে। ও সেদিন প্রস্তুত ছিল জ্যাককে কঠোর কথাগুলো বলবার জন্যে।

“কি করলে আমার আর ড্যানির জন্যে সবচেয়ে ভালো হবে তা নিয়ে তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। হয়তো এতে তোমারও ভালো হবে। আমাদের হয়তো এসব নিয়ে আগেই কথা বলা উচিত ছিল।”

তারপর জ্যাক একটা অদ্ভুত কথা বলে। ওয়েন্ডি ভেবেছিল যে ও জ্যাকের মাঝে তিক্ততা দেখতে পাবে, দেখতে পাবে রাগ আর অপরাধবোধ। ও ভেবেছিল যে জ্যাক ছুটে যাবে মদের ক্যাবিনেটের দিকে। কিন্তু ও এরকম নীচু, ভাবলেশহীন স্বরে উত্তর আশা করে নি। ওর মনে হচ্ছিল যে জ্যাকের সাথে ও ছয় বছর কাটিয়েছে সে গতকাল রাতে ফেরত আসেনি, তার বদলে অন্য কেউ জ্যাকের চেহারা নিয়ে বসে আছে ওর সামনে।

“তুমি আমার জন্যে একটা কাজ করতে পারবে? আমার একটা কথা রাখতে পারবে?”

“কি?” ওয়েন্ডির নিজের গলা স্বাভাবিক রাখতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছিল। “আজ থেকে এক সপ্তাহ পর আমরা এগুলো নিয়ে কথা বলি? যদি তুমি চাও তাহলে…”

ও রাজী হয়ে গেল। ওদের ভেতর একটা নীরব চুক্তি হয়ে গেল সেদিনই। ওই সপ্তাহে জ্যাক অনেকবার অ্যাল শকলির বাড়ি গিয়েছিল, কিন্তু ও রাত হবার আগেই বাসায় ফিরে আসে, আর নিঃশ্বাসে মদের গন্ধ ছিল না একবারও। ওয়েন্ডির কয়েকবার মনে হয়েছে যে ও গন্ধ পাচ্ছে, কিন্তু ও জানত যে জ্যাক আসলে মদ খায়নি। আরেক সপ্তাহ গেল, তারপর আরও এক সপ্তাহ।

ডিভোর্স ওয়েন্ডির অন্যান্য চিন্তার নীচে চাপা পড়ে গেল।

কি হয়েছিল সেদিন আসলে? ও তখনও ভেবে কূলকিনারা করতে পারছিল না। এ ব্যাপারটা নিয়ে ওদের দু’জনের মধ্যে কখনও কথা হত না। জ্যাক যেন বুঝতে পেরেছিল যে ও কোন দানবের দিকে ছুটে চলেছে, আর ও গতি না কমালে দানবটা ওকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে। মদের বোতলগুলো ক্যাবিনেটেই পড়ে রইল। ওয়েন্ডির অনেকবার মনে হয়েছিল যে বোতলগুলো ফেলে দেয়া উচিত, কিন্তু ও ‘বর্তমান পরিস্থিতি যেমন আছে তেমনই ভালো’ এই ভেবে সেগুলোতে হাত দিত না।

এছাড়া ড্যানির ব্যাপারটাও ভেবে দেখার মত।

যদি ওর স্বামীকে বোঝা কঠিন হয়ে থাকে, তাহলে ড্যানিকে বোঝা প্ৰায় অসম্ভব। ড্যানির জন্যে ওর মনে যেটা ছিল সেটা হচ্ছে একধরণের অবুঝ ভালোবাসা মিশ্রিত ভয়।

এখন আধোঘুমের মধ্যে ওর চোখের সামনে আবার ড্যানির জন্মের স্মৃতি ভেসে উঠল। ও আবার ডেলিভারি টেবিলে শুয়ে ছিল, ঘামে ভেজা, চুল এলোমেলো।

ওর দু’পায়ের মাঝে ডাক্তার, একপাশে নার্স, যন্ত্রপাতি গোছাতে গোছাতে গুণগুণ করছিল। ওর ভেতরের তীক্ষ্ণ, ভাঙ্গা কাঁচের খোঁচার মত ব্যাথাটা কিছুক্ষণ পরপর আসা যাওয়া করছিল।

তারপর ডাক্তারটা ওকে শক্ত গলায় বলে যে আপনার এখন পুশ করতে হবে, আর ওয়েন্ডি তাই করার চেষ্টা করে। তারপর ও বুঝতে পারে যে ওর ভেতর থেকে কিছু একটা বের করে নেয়া হয়েছে। অনুভূতিটা পরিষ্কার আর স্বতন্ত্র, এমন একটা অনুভূতি যেটা ও কখনওই ভুলতে পারবে না ওর ভেতর থেকে কি যেন নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তারপর ডাক্তার ওর ছেলেকে দুই পা ধরে উপরে তুলল-তখন ওয়েন্ডি এত ভয়ংকর একটা জিনিস দেখতে পায় যে ওর দম বন্ধ হয়ে আসে। তারপর ওর গলা থেকে বেরিয়ে আসে একটা চিৎকার।

ওর বাচ্চার কোন চেহারা নেই!

কিন্তু আসলে অবশ্যই ওর চেহারা ছিল, ড্যানির নিজের চেহারা, যেটা জন্মের সময় একটা পাতলা পর্দা দিয়ে ঢাকা ছিল। ওর মা প্রায়ই বলত যে জন্মের সময় যেসব বাচ্চার মুখের ওপর পর্দা থাকে ওদের মধ্যে নাকি ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা থাকে। ওয়েন্ডি এখনও সেই পর্দাটাকে একটা জারে রেখে দিয়েছে। ও কুসংস্কারে বিশ্বাসী নয়, কিন্তু তাও-ছেলেটা প্রথম থেকেই বাকি সবারচেয়ে একটু আলাদা ছিল। ওয়েন্ডি দিব্যদৃষ্টিতেও বিশ্বাস করে না, কিন্তু

বাবার কি কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? আমি স্বপ্নে দেখেছি যে বাবার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে।

জ্যাক কোন কারণে বদলে গিয়েছে। ওয়েন্ডির মনে হয় নি যে ডিভোর্সের কথা তোলাতে ওর মাঝে এই পরিবর্তনটা এসেছে। সেদিন সকালের আগেই ওর সাথে কিছু একটা হয়েছে। অ্যাল অবশ্য জোর দিয়ে বলেছে যে আসলে কিছুই হয় নি, কিন্তু ও ওয়েন্ডির চোখ থেকে নিজের চোখ সরিয়ে ফেলেছিল তখন। আর অন্যান্য টিচারদের গল্প অনুযায়ী, অ্যালও নাকি মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে।

বাবার কি কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে?

হয়তো ও হঠাৎ করে কোন কিছুর সাথে ধাক্কা লাগিয়ে দিয়েছিল, কোন বাড়ি-টাড়ির সাথে। ওয়েন্ডি সেদিন আর তার পরের দিনের পেপার মনোযোগ দিয়ে পড়েছিল, কিন্তু জ্যাকের সাথে সম্পর্ক আছে এমন কিছু খুঁজে পায়নি। ও পেপারের সবগুলো পৃষ্ঠায় তন্নতন্ন করে খুঁজেছে কোন রোড অ্যাক্সিডেন্টে মৃত্যু

অথবা কোন বারে হাতাহাতির খবর আছে কিনা, কিন্তু কিছুই পায়নি। কিছুই না। শুধু ওর স্বামীর আপাদমস্তক পরিবর্তন আর ওর ছেলের ঘুমজড়ানো গলায় প্রশ্ন :

বাবার কি কোন অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে? আমি স্বপ্নে দেখেছি যে…

ওয়েন্ডির জ্যাকের সাথে এতদিন টিকে থাকার একটা বড় কারণ হচ্ছে ড্যানি, যদিও ও সজ্ঞানে এটা কখনও স্বীকার করবে না। কিন্তু এখন, ঘুমের ঘোরে, ওর মনে পড়ল যে ড্যানি সবসময়ই জ্যাকের বেশী ন্যাওটা ছিল। ঠিক যেমন ওয়েন্ডি নিজে ওর বাবার ন্যাওটা ছিল। ড্যানি কখনও বাবার গায়ে খাবার ছুঁড়ে মারেনি, আর জ্যাক যখনই ওকে খেতে বলত তখনই ও বাধ্য ছেলের মত খেয়ে নিত। এমনকি ড্যানির শিশু অবস্থায়ও জ্যাকের ওকে খাওয়াতে কোন অসুবিধা হত না। ড্যানির পেটে ব্যাথা হলে ওয়েন্ডির ওকে কোলে নিয়ে এক ঘণ্টা দোলাতে হত, যেখানে জ্যাক ওকে কোলে নিয়ে দু’বার ঘরের এপাশ-ওপাশ করলেই ছেলেটা বাবার ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেত।

ডাইপার বদলাতে যেয়ে জ্যাক কখনই অভিযোগ করত না। ও ড্যানিকে কোলে নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকত, আঙুল নিয়ে খেলা করত ওর সাথে, আর ড্যানি বাবার নাকে একটা খোঁচা মারতে পেরে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ত। ও বোতলে পর বোতল দুধ বানিয়ে রাখত ড্যানির জন্য, আর খাওয়া শেষ হলে ড্যানির ঢেকুর না আসা পর্যন্ত ওকে কোলে উঠিয়ে রাখত। ড্যানির বয়স যখন মাত্র ছয় মাস তখনই জ্যাক ওকে নিয়ে একটা ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়েছিল। আর আশ্চর্য্য ব্যাপার হচ্ছে, ড্যানি একটুও বিরক্ত না করে বাবার কোলে চুপচাপ শুয়ে খেলা দেখেছে।

ও নিজের মাকে ভালোবাসলেও ও আসলে বাবার ছেলে, কোন সন্দেহ নেই তাতে।

আর ওয়েন্ডি কি ডিভোর্সের ব্যাপারে বারবার নিজের ছেলের নীরব প্রতিবাদ অনুভব করে নি? হয়তো ওয়েন্ডি রান্নাঘরে আলুর ছাল ছিলতে ছিলতে ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করছে, এমন সময় ও পেছন ফিরলেই দেখতে পেত, ড্যানি ওর দিকে তাকিয়ে আছে চোখে ভয় আর অভিযোগ নিয়ে। পার্কে হাঁটবার সময় ড্যানি কখনও কখনও জোরে ওর হাত চেপে ধরত, তারপর দাবী করার সুরে জানতে চাইত : “তুমি কি আমাকে ভালোবাসো? বাবাকে ভালোবাসো?” ওয়েন্ডি হতভম্ব হয়ে জবাব দিত : “হ্যা, অবশ্যই সোনা।”

মাঝে মাঝে ওয়েন্ডির এমনও মনে হয়েছে যে ডিভোর্স নিয়ে জ্যাকের সাথে কথা বলা হচ্ছে না তার কারণ ওর নিজের গাফিলতি নয়, বরং ওর ছেলের ইচ্ছাশক্তির প্রভাবে।

আমি এসব কুসংস্কার বিশ্বাস করি না।

কিন্তু এখন, আধোঘুমের ঘোরে, ওর এসবকিছুই সত্যি মনে হচ্ছে। ওর মনে হচ্ছিল যে ওদের তিনজনকে কেউ একই সুতোয় বেঁধে দিয়েছে-যে ওদের বন্ধন যদি কখনও ধ্বংস হয়ে যায়, তাহলে সেটা বাইরের কোন ক্ষমতার প্রভাবে হবে, ওদের নিজেদের কারণে নয়।

ও যা বিশ্বাস করত তার বেশীরভাগই গড়ে উঠেছে জ্যাকের জন্যে ওর ভালোবাসাকে ঘিরে। ও কখনই জ্যাককে ভালোবাসা বন্ধ করতে পারে নি, শুধু ড্যানির “দুর্ঘটনা”র সময়টুকু বাদে। আর ও নিজের ছেলেকেও ভালোবাসে। কিন্তু ও সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে ওদের দু’জনকে একসাথে দেখতে। ও ভালোবাসে ওদের দু’জনকে আপন মনে করতে, আর ও নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে প্রার্থনা করছে যে জ্যাকের এই কেয়ারটেকিং চাকরিটা যেন ওদের ভালো সময়গুলো ফিরিয়ে নিয়ে আসে।

অধ্যায় ৭ – অন্য এক বেডরুম

ড্যানি যখন জেগে উঠল বুম বুম শব্দটা তখনও ওর কানে বাজছিল। ও তখনও মাতাল, হিংস্র গলাটা শুনতে পাচ্ছিল : বেরিয়ে আয়! আমি তোকে খুঁজে বের করবই!

আস্তে আস্তে বুম বুম শব্দটা বদলে ওর হৃদস্পন্দনের রূপ নিল, আর গলাটা বদলে গিয়ে হয়ে গেল দুরের একটা পুলিশ সাইরেন।

ও অস্থিরভাবে নিজের বিছানায় উঠে বসল। ও জানালায় পাতার ছায়ার খেলা দেখতে পাচ্ছিল। ছায়াগুলো জালের মত একটা আরেকটার সাথে জড়িয়ে আছে, জঙ্গলের লতাগুল্মের মত বা ওর স্বপ্নে দেখা কার্পেটের নকশার মত। ও অনুভব করল যে ওর পরনের পাজামা আর ওর শরীরের মাঝে ঘামের একটা পাতলা আবরণ তৈরি হয়েছে।

“টনি?” ও ফিসফিস করে ডাকল। “তুমি আছো এখানে?”

কোন উত্তর নেই।

ও আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে জানালা দিয়ে বাইরের রাস্তার দিকে তাকাল। সবকিছু শান্ত আর চুপচাপ। রাত দু’টো বাজে। বাইরে পাতা-পড়া ফুটপাথ, পার্ক করে রাখা গাড়ির সারি আর লম্বা গলা-ওয়ালা রাস্তার বাতি ছাড়া আর কিছুই নেই। তবে এই গা ছমছমে অন্ধকারে বাতিগুলোকে দেখতেও ভৌতিক লাগছিল।

ড্যানি রাস্তার দু’পাশে যতদূর দেখা যায় ভালো করে লক্ষ্য করল, কিন্তু টনির ঝাপসা, ছায়াময় আকৃতিটা কোথাও দেখতে পেল না।

গাছের ডালের ফাঁকে বাতাসের দীর্ঘশ্বাস শোনা যাচ্ছিল। বাতাস গাড়ির ছাদে আর রাস্তার পাশে ছোট ছোট পাতার ঘূর্ণি তৈরি করছে। শব্দটা আবছা আর মন খারাপ করা। ড্যানির সন্দেহ হল যে ও ছাড়া পুরো বোল্ডার শহরে হয়তো কেউ জেগে নেই শব্দটা শুনবার জন্যে। কোন মানুষ, অন্তত। কে জানে রাতের অন্ধকারে আরও কি কি ঘুরে বেড়াচ্ছে, ছুটে লুকিয়ে পড়ছে এক ছায়া থেকে আরেক ছায়ায়, বাতাসে গন্ধ শুঁকছে শিকারের খোঁজে।

আমি তোকে খুঁজে বের করবই!

“টনি?” ও আবার ডাকল, তবে ও আশা ছেড়ে দিয়েছে।

শুধু বাতাস এগিয়ে এল জবাব দিতে, আরও জোরে গুঙ্গিয়ে উঠল এবার। ওর জানালার নীচে কিছু পাতা ছড়িয়ে গেল বাতাসে, তারপর ক্লান্ত হয়ে পাতাগুলো যেয়ে শুয়ে পড়ল ড্রেনের পাশে।

ড্যানিইইই…ড্যানিইইই…

ও পরিচিত গলার আওয়াজ পেয়ে চমকে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। টনির গলার শব্দের সাথে সাথে পুরো রাত যেন জেগে উঠল। বাতাস থেমে যাবার পরও চারদিক থেকে ফিসফিস আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। ওর মনে হল যে ও দূরে বাসস্টপের ছায়াগুলোর মধ্যে আরও গাঢ় একটা ছায়া দেখতে পাচ্ছে, কিন্তু ওটা সত্যি নাকি মনের ভুল তা এত দূর থেকে বোঝা সম্ভব নয়।

যেয়ো না, ড্যানি…

তারপর বাতাসের বেগ আবার বেড়ে গেল। বাতাসের জোরে ড্যানির চোখ কুঁচকে গেল। ও চোখ খুলে দেখতে পেল যে বাসস্টপের কাছের ছায়াটা চলে গিয়েছে..যদি ওটা আগে ওখানে থেকে থাকে তাহলে। তাও ও নিজের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল-

(কতক্ষণ? এক মিনিট? এক ঘণ্টা?)

হয়তো আরও বেশী, কিন্তু আর কিছু হল না। ও আবার নিজের বিছানায় ফিরে গেল। শুয়ে শুয়ে দেখতে লাগল কিভাবে ওর ছাদে একটা ভৌতিক রাস্ত ার বাতি কিভাবে ছায়ার জাল সৃষ্টি করছে। ছায়াগুলো ওকে ঘিরে ফেলতে চায়, ওকে টেনে নিয়ে যেতে চায় এক অন্ধকার জগতে যেখানে লাল রঙ এ লেখা একটা শব্দ দপদপ করছে :

রেডরাম।

অধ্যায় ৮ – দৃষ্টিনন্দন ওভারলুক

আম্মু চিন্তায় পড়ে গেছে।

আম্মু চিন্তা করছিল যে ওদের পুরনো গাড়িটার পাহাড়ে ওঠার মত আর শক্তি নেই, আর ওরা যখন আস্তে আস্তে উঠবে তখন পেছন থেকে ছুটে আসা কোন গাড়ি ওদের ধাক্কা মেরে দিতে পারে। ড্যানি অবশ্য নিশ্চিন্ত আছে। ওর বাবা যদি বলে যে গাড়িটা ওদের নিয়ে যেতে পারবে, তাহলে গাড়িটা আসলেই ওদের নিয়ে যেতে পারবে।

“আমরা প্রায় এসে পড়েছি।” জাক বলল।

ওয়েন্ডি কপাল থেকে চুল সরিয়ে জবাব দিল : “যাক, বাবা।”

ও ডানদিকের সীটে বসা, ওর কোলের ওপর একটা উপন্যাস খোলা অবস্থায় পড়ে আছে। ও নীল জামাটা পড়ে আছে, যেটাকে ড্যানি বলে ওর সবথেকে সুন্দর জামা। জামাটার কলার বেশ উঁচু, আর এ জামাটা পড়লে ওকে মাত্র হাইস্কুল পাশ করা কোন কিশোরীর মত দেখায়। বাবা বারবার মায়ের উরুতে হাত রাখছিল আর মা হাসতে হাসতে বারবার সরিয়ে দিচ্ছিল, বলছিল : দূর হ, শয়তান।

ড্যানি পাহাড়গুলো দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল। বাবা ওকে একবার বোল্ডারের কাছে যে পাহাড়গুলো আছে সেগুলো দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এই পাহাড়গুলোর তুলনায় তা কিছুই না। ও কয়েকটা পাহাড়ের চূড়ায় সাদা রঙ দেখতে পাচ্ছিল। বাবা ওকে বলল যে ওগুলো বরফ, আর এসব পাহাড়ের চূড়ায় সারাবছরই বরফ জমে থাকে।

আর ওরা আসলেই পাহাড়ের দেশে এসেছে, কোন সন্দেহ নেই সে ব্যাপারে। কিছু কিছু জায়গায় এত বড় বড় পাথর আছে যেগুলোর ওপাশে কি আছে তা জানালা দিয়ে গলা বের করলেও দেখা যায় না। ওরা যখন বোল্ডার ছেড়ে বের হয় তখন ভালোই গরম পড়েছিল, কিন্তু এখানে দুপুরেই পরিষ্কার আর কনকনে বাতাস বইছে, ভারমন্টে শীতের সময় যেমন দেখা যেত। বাবা গাড়ির হিটারটা ছেড়ে দিয়েছে, যদিও সেটা তেমন ভালো কাজ করে না। ওরা বেশ কয়েকটা সাইন দেখতে পায় রাস্তায় যেগুলোতে লেখা ছিল : ‘সাবধান, পাথর খসে পড়তে পারে’ (মা ওকে সবগুলো পড়ে শুনিয়েছে), আর যদিও ড্যানি অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল পাথর খসে পড়া দেখবার জন্যে, একবারও তা হয় নি। এখনও নয়, অন্তত।

প্রায় আধাঘণ্টা আগে ওরা একটা সাইনকে পাশ কাটিয়ে আসে, যেটা বাবার মতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সাইনটায় লেখা ছিল : ‘সাইডওয়াইন্ডার পাসে প্রবেশ’। বাবা বলল যে শীতের সময় স্নোপ্নাও এর শেষ গন্তব্যসীমা হচ্ছে এখানে। এরপরের রাস্তাগুলো অনেক খাড়া খাড়া, তাই বরফ ঠেলার গাড়িগুলো এখানে উঠতে পারে না।

এখন ওরা আরেকটা সাইনের পাশ দিয়ে যাচ্ছে।

“এটায় কি লেখা, আম্মু?”

“এটায় লেখা ‘ধীরগতির যানবাহন ডানদিকে’ তারমানে আমাদের কথা বলেছে।”

“গাড়িটা আমাদের ঠিকই নিয়ে যেতে পারবে।” ড্যানি বলল।

“প্লীজ, ঈশ্বর,” বলে মা নিজের তর্জনী আর মাঝের আঙুল দিয়ে ক্রসের সাইন বানাল। ড্যানি মায়ের স্যান্ডেল পরা পায়ের দিকে উঁকি দিয়ে দেখল যে মা পায়ের আঙুল দিয়েও ক্রস বানিয়েছে। দেখে ওর মজা লাগল। মাও হাসল ওর দিকে তাকিয়ে, কিন্তু ড্যানি জানত যে মায়ের দুশ্চিন্তা যায়নি।

রাস্তা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে পাহাড়ের ওপর উঠেছে। জ্যাক গাড়ির গিয়ার বদলে প্রথমে থার্ড, তারপর সেকেন্ড গিয়ারে নিয়ে এল। গাড়ির ইঞ্জিন ক্যাঁচক্যাঁচ করে প্রতিবাদ জানাল। ওয়েন্ডি শংকিত চোখে মিটারের দিকে তাকাল। গাড়ির স্পীড চল্লিশ থেকে প্রথমে ত্রিশ, তারপর বিশে এসে থামল।

“ফুয়েল পাম্প…”ও নীচু স্বরে শুরু করল।

“ফুয়েল পাম্প এখনও তিন মাইল টানতে পারবে।” জ্যাকের তরফ থেকে দ্রুত জবাব এল।

ওদের পাশ থেকে উঁচু পাথরের সারি সরে গেল, আর তার জায়গা নিয়ে নিল একটা খাড়া, গভীর উপত্যকা। উপত্যকার কিনারে লাইন দিয়ে পাইন গাছ নেমে গেছে, প্রায় একশ’-দেড়শ’ ফিট নিচে। ওখানে ওয়েন্ডি একটা ছোট্ট ঝর্ণাও দেখতে পাচ্ছিল। পাহাড়গুলো অদ্ভুত সুন্দর, কিন্তু কঠোর। যেন ওদের সতর্ক করছে, এখানে কোন ভুল হলে নিস্তার নেই। ও নিজের ভেতর চাপা একধরণের শংকা অনুভব করল। সিয়েরা নেভাডার ওদিকে একদল অভিযাত্রী একবার পাহাড়ে আটকা পড়ে যায়। শেষে ওদের একজন আরেকজনকে খেয়ে বেঁচে থাকতে হয়েছে। পাহাড়ে খুব বেশী ভুল করবার সুযোগ পাওয়া যায়না।

জ্যাক আবার গিয়ার বদলানোর সাথে সাথে গাড়িটা একটা ঝাঁকুনি খেয়ে উপরদিকে উঠতে লাগল। গাড়িটার ইঞ্জিন এখনও বেশ জোরে শব্দ করছিল।

“জানো,” ওয়েন্ডি বলল, “আমি সাইডওয়ান্ডার পার করবার পর রাস্তায় বোধহয় সব মিলিয়ে পাঁচটা গাড়ি দেখেছি। তারমধ্যে একটা আবার ছিল হোটেলের লিমোসিন।”

জ্যাক মাথা নাড়ল। “ওটা ডেনভারের এয়ারপোর্টে যায়। এখনই হোটেলের পেছনে কয়েকটা জায়গা জমে গিয়েছে, ওয়াটসন বলল। কালকে নাকি আরও বেশী বরফ পড়বে। পাহাড় থেকে যারা নামতে চায় ওরা মেইন রোডটা ব্যাবহার করছে। ওই হারামজাদা আলম্যান হোটেলে থাকলেই হয়। আছে, নিশ্চয়ই।”

“তুমি কি শিওর যে আমাদের খাবারের কোন অভাব হবে না?” ওয়েন্ডির মাথায় তখনও সিয়েরা নেভাডার কথা ঘুরছে।

“ও তো তাই বলল। ও বলল যে হ্যালোরান তোমাকে খাবারের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবে। হ্যালোরান হচ্ছে হোটেলের বাবুর্চি।”

“ও।” ও আস্তে করে বলল, স্পীডোমিটারের দিকে চোখ রেখে। এখন গাড়ির স্পীড পনেরো মাইল থেকে দশ মাইলে এসে ঠেকেছে।

“ওই যে চূড়া।” জ্যাক বলল। ও হাত দিয়ে প্রায় তিনশ’ গজ দুরের একটা জিনিসের দিকে ইশারা করছিল। “ওখানে একটা সুন্দর জায়গা আছে যেখান থেকে ওভারলুক হোটেল দেখা যায়। আমি রাস্তা থেকে সরে গাড়িটাকে একটু রেস্ট দিতে চাই।” ও ঘাড় বাঁকিয়ে ড্যানির দিকে তাকাল : “তুই কি বলিস, ডক? আমরা হয়তো হরিণও দেখতে পাবো।”

“দারুণ, বাবা!”

গাড়িটা কষ্ট করে উপরে উঠতে লাগল। স্পীডোমিটার এখন পাঁচ কিলোমিটারের ঘরের আশেপাশে ঘোরাঘুরি করছিল।

(ওই সাইনটায় কি লেখা আম্মু? “সামনে সুন্দর দৃশ্য,” মা কর্তব্যপূর্ণভাবে জবাব দিল)

জ্যাক ব্রেকে চাপ দিয়ে গিয়ার বদলে গাড়িকে নিউট্রালে নিয়ে এল।

“চল,” ও বলে গাড়ি থেকে নেমে গেল।

ওরা সবাই মিলে রেলিং এর কাছে গেল।

“এটার কথাই বলছিলাম,” বলে জ্যাক হাত দিয়ে সামনে দেখাল।

ওয়েন্ডির মনে হল এতদিন যে বইয়ে পড়েছে প্রচণ্ড সুন্দর কিছু সামনে পড়লে মানুষের দম আটকে আসে এ কথাটা আসলে ভুল নয়। এক মুহূর্তের জন্যে ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে গেল সামনের দৃশ্যটা দেখে। ওরা একটা চূড়ার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। ওদের উল্টোদিকে-কতদুরে তা বলা অসম্ভব- আরেকটা বিশাল পাহাড় জেগে উঠেছে। সামনের পাহাড়টার চূড়া মেঘে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। নীচে ও প্যাঁচানো রাস্তা দিয়ে ঘেরা উপত্যকাটা দেখতে পাচ্ছিল, যেটা দিয়ে ওদের গাড়ি উঠে এসেছে এতক্ষণ। ও ভয়ে বেশীক্ষণ নীচের দিকে তাকাল না, ওর মনে হল যে ওদিকে তাকিয়ে থাকলে ওর মাথা ঘুরিয়ে বমি এসে যাবে। ওর কল্পনা এই পরিবেশে যেন লাগামহীন হয়ে গেল। ও চিন্তা করতে লাগল যে ও পড়ে যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়া থেকে, প্রচণ্ড বাতাসে উড়ছে ওর চুল আর জামা, ওর শরীরের ঘূর্ণনের কারণে ওর চোখের সামনে ভাসছে একবার আকাশ, আর একবার পাথর। ওর চিৎকার ওর মুখ থেকে বের হওয়া মাত্র হারিয়ে যাচ্ছে প্রচণ্ড বাতাসের জোরে…

ওয়েন্ডি জোর করে খাদের দিক থেকে চোখ সরিয়ে জ্যাক যেদিকে ইশারা করছে সেদিকে তাকাল। ও দেখতে পেল যে ওদিকে হাইওয়েটা পাহাড়কে পেঁচিয়ে উঠে গিয়েছে ওপর দিকে। প্রায় চূড়ার কাছাকাছি পাইন গাছের একটা ছোট্ট ঝাড় পাহাড়ের ধার বেয়ে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। তার একটু সামনে দেখা যাচ্ছে একটা সবুজ লন, আর তারপর দাঁড়িয়ে আছে এসব কিছুর কেন্দ্রবিন্দু, ওভারলুক হোটেল। হোটেলটাকে দেখে ওয়েন্ডি আবার নিজের দম ফিরে পেল।

“ওহ জ্যাক, হোটেলটা কি সুন্দর!”

“হম্‌ম্‌, তা বটে,” ও বলল। “আলম্যানের ধারণা যে এটা পুরো আমেরিকায় সবচেয়ে সুন্দর জায়গা। আমি ওকে খুব একটা পছন্দ করি না, কিন্তু এ ব্যাপারটায়…ড্যানি? ড্যানি, তোর কিছু হয় নি তো?”

ওয়েন্ডি দ্রুত মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল ড্যানি কোথায় তা দেখবার জন্যে। নিজের ছেলের ক্ষতির ভয় ওকে অন্য সবকিছু ভুলিয়ে দিয়েছে। ও ড্যানিকে দেখতে পেয়ে ওর দিকে ছুটে গেল। ড্যানি শক্ত করে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, ওর মুখ কাগজের মত সাদা, আর চোখ হোটেলের দিকে। ওর চোখে শূন্য দৃষ্টি, জ্ঞান হারাবার আগে মানুষের চোখ যেমন হয়ে যায়।

ওয়েন্ডি ড্যানির পাশে বসে ওর দু’কাঁধে হাত রাখল। “ড্যানি, কি” জ্যাক ওর পাশে এসে দাঁড়াল। “তুই ঠিক আছিস, ডক?” ও ড্যানিকে ছোট্ট একটা ঝাঁকুনি দিতেই ড্যানির দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে এল।

“আমি ঠিক আছি বাবা। কোন অসুবিধা নেই।”

“কি হয়েছিল, ড্যানি?” ওয়েন্ডি জানতে চাইল। “তোমার কি মাথা ঘুরাচ্ছিল, সোনা?”

“না, আমি একটা জিনিস নিয়ে… চিন্তা করছিলাম। আমি তোমাদের ভয় পাইয়ে দিতে চাইনি।” ও ওর সামনে হাঁটু গেড়ে বসা বাবা আর মার দিকে তাকিয়ে ছোট্ট একটা হাসি দিল। “হয়তো চোখে রোদ লেগেছে দেখেই এমন লাগছিল।”

“চল তোকে হোটেলে নিয়ে যাই। তোর একগ্লাস পানি খাওয়া দরকার।” গাড়িটা চলতে শুরু করলে ড্যানি জানালা দিয়ে পাহাড়ী রাস্তাটার দিকে তাকাল। গাছের ফাঁকে ফাঁকে ওভারলুক হোটেলও দেখা যাচ্ছিল। এই হোটেলটাকেই ও স্বপ্নে দেখেছে, বুম বুম শব্দে আর অন্ধকারে ঢাকা একটা জায়গা, যেখানে খুব চেনা একজন মানুষ ওকে অন্ধকারে ঢাকা একটা করিডোরে ভাড়া করে বেড়াচ্ছিল। রেডরাম যাই হোক, সেটা এই হোটেলটার ভেতরেই আছে।

অধ্যায় ৯ – ঘুরেফিরে দেখা

চওড়া, পুরনো দরজাগুলো দিয়ে ঢুকতেই ওরা দেখতে পেল যে আলম্যান ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে। ও জ্যাকের সাথে হাত মেলাল আর ঠাণ্ডা চোখে ওয়েন্ডির দিকে তাকিয়ে একটু মাথা ঝোঁকাল। হয়তো ও খেয়াল করেছে যে ওয়েন্ডি ঢোকামাত্র সবার চোখ ঘুরে গিয়েছে ওর লম্বা সোনালী চুল আর নীল রং এর নেভী ড্রেসের দিকে। জামাটা ভদ্রতা বজায় রেখে হাটুর দু’ ইঞ্চি ওপরেই থেমে গিয়েছে, কিন্তু ওটুকু দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে ওর পা দু’টো সুন্দর।

শুধু ড্যানিকে দেখে মনে হল যে আলম্যান সত্যিই খুশি হয়েছে। ওয়েন্ডি এই ব্যাপারটা আগেও লক্ষ্য করেছে। যারা বাচ্চাদের সহ্য করতে পারে না তারাও ড্যানিকে দেখলে গলে যায়। আলম্যান একটু কোমড় ঝুঁকিয়ে ড্যানির দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল। ড্যানি ভদ্রভাবে হাতটা ধরে ঝাঁকাল, ওর মুখে কোন হাসি দেখা দিল না।

“ড্যানি, আমার ছেলে,” জ্যাক বলল। “আর আমার স্ত্রী, উইনিফ্রেড।”

“আপনাদের দু’জনকে দেখেই খুশি হলাম,” আলম্যান বলল। “তোমার বয়স কত, ড্যানি?”

“পাঁচ বছর, স্যার।”

“স্যার, হম্?” আলম্যান একটা সন্তুষ্ট হাসি দিয়ে জ্যাকের দিকে তাকাল। “ও তো খুব ভদ্র ছেলে

“অবশ্যই,” জ্যাক বলল।

“আর মিসেস টরেন্স,” আলম্যান ওয়েন্ডির দিকেও একটু ঝুঁকল। এক মুহূর্তের জন্যে ওয়েন্ডি ব্যাজার হয়ে ভাবল যে আলম্যান ওর হাতে চুমু খেতে চায়। ও নিজের হাত একটু বাড়িয়ে দিল। আলম্যান হাতটা ধরল ঠিকই, কিন্তু তার বেশী আর কিছু করল না। আলম্যানের হাত ছোট, শুকনো আর মসৃণ। ওয়েন্ডির মনে হল যে ও হাতে পাউডার দিয়ে রাখে।

লবিতে প্রচুর ব্যস্ততা দেখা যাচ্ছিল। পুরনো আমলের উঁচু পিঠওয়ালা প্রায় সবগুলো চেয়ারই সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বেলবয়রা হাতে সুটকেস নিয়ে করিডরে আসা যাওয়া করছিল, আর ডেস্কে একটা লম্বা লাইন দেখা যাচ্ছিল। ডেস্কে একটা বিরাট সাইজের পুরনো আমলের ক্যাশ রেজিস্টার রাখা। তার পেছনের দেয়ালে লাগানো আধুনিক ক্রেডিট কার্ডের পোস্টারগুলোকে বেমানান লাগছে।

ওদের ডানদিকে একটা একটা লম্বা, বন্ধ দরজার পাশে ছিল একটা ফায়ারপ্লেস, যেটাতে এখন আগুন জ্বলছে। তিনজন নান একটা সোফা নিয়ে ফায়ারপ্লেসটার এত কাছে বসে আছে যে দেখে মনে হচ্ছিল এখনই ওদের গায়ে আগুন লেগে যাবে। ওরা নিজেদের মধ্যে গল্প আর হাসাহাসি করতে করতে অপক্ষা করছে ডেস্কের লাইনটা একটু কমবার জন্যে। ওদের ব্যাগগুলো সোফার পাশে রাখা ছিল। ওদের দেখতে দেখতে ওয়েন্ডির নিজের ঠোঁটেও হাসি ফুটে উঠল। ওদের কারো বয়সই ষাটের কম হবে না।

চারপাশে মানুষের কথা বলার গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। ডেস্কের বেলটা ‘ডিং’ করে বেজে উঠছে একটু পর পর। হোটেল ক্লার্কদের দ্রুত ডাক : “এর পরে কে আছেন?” এসব দেখে ওয়েন্ডির নিউ ইয়র্কে ওদের হানিমুনের কথা মনে পড়ে গেল। প্রথমবারের মত ওয়েন্ডির মনে হল যে ওদের হয়তো এটাই দরকার ছিল। শুধু ওরা তিনজন সারা দুনিয়া থেকে আলাদা তিন মাসের জন্যে। পারিবারিক হানিমুন। ও ড্যানির দিকে তাকিয়ে হাসল। ড্যানি চোখ বড় বড় করে সবকিছু দেখছিল। বাইরে আরেকটা লিমোসিন এসে দাঁড়াল, ধুসর রঙের।

“মৌসুমের শেষ দিন,” আলম্যান বলছিল, “হোটেল বন্ধ করবার দিন। সবসময়ই এ দিনগুলো অনেক ব্যস্ত থাকে। আমি ভেবেছিলাম আপনারা তিনটার দিকে আসবেন, মি টরেন্স।”

“গাড়িটা রাস্তায় নষ্ট হয়ে যেতে পারে ভেবে আমি একটু আগেই রওনা দিয়েছিলাম। পরে দেখলাম যে কিছু হয় নি।”

“খুব ভালো।” আলম্যান বলল। “আমি চাই একটু পরে আপনাদের এ জায়গাটা ঘুরিয়ে দেখাতে, আর হ্যালোরানও চায় খাবারের ব্যাপারটা নিয়ে মিসেস টরেন্সের সাথে কথা বলতে, কিন্তু সমস্যা হচ্ছে-”

একজন ক্লার্ক তাড়াহুড়ো করে আসতে যেয়ে প্রায় আলম্যানের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল।

ও নিজেকে সামলে নিয়ে বলল :

“মি: আলম্যান- “

“কি ব্যাপার?”

“মিসেস ব্র্যান্ট,” ক্লার্ক একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেছে মনে হল, “উনি আমেরিকান এক্সপ্রেসের ক্রেডিট কার্ড ছাড়া আর কিছু দিয়ে বিল দিতে রাজী হচ্ছেন না। আমি ওনাকে বলেছি যে আমরা গত বছর থেকে আমেরিকান এক্সপ্রেস নেয়া বন্ধ করে দিয়েছি, কিন্তু উনি…” ও থেমে টরেন্স পরিবারের দিকে চোখ বুলাল, তারপর আলম্যানের দিকে তাকাল। ও নিজের কাঁধ ঝাঁকাল।

“আমি দেখছি ব্যাপারটা।”

“ধন্যবাদ, মি: আলম্যান।” বলে ক্লার্ক নিজের ডেস্কে ফেরত গেল। ডেস্কটার সামনে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে ছিল। তার পরনে একটা ফার কোট আর পালকের চাদর। মহিলাকে অত্যন্ত বিরক্ত মনে হচ্ছিল।

“আমি ১৯৫৫ সাল থেকে ওভারলুক হোটেলে আসছি।” সে উঁচু গলায় তার সামনে বসা হাসিমুখের ক্লার্ককে বলল। “আমার দ্বিতীয় স্বামীর ওই জঘন্য রোকে কোর্টটায় স্ট্রোক হবার পরও আমি আসা বন্ধ করিনি। আর আমাকে কখনও…কখনও আমেরিকান এক্সপ্রেস বাদে অন্যকিছু ব্যাবহার করতে হয় নি। দরকার হলে তোমরা পুলিশ ডাকো! ওরা আমাকে টেনে নিয়ে যাক! তাও আমি আমেরিকান এক্সপ্রেস ছাড়া অন্যকিছু দিতে রাজী হব না…”

“একটু শুনবেন?” মি: আলম্যান বলল।

ওরা দেখল যে আলম্যান যেয়ে শ্রদ্ধাশীল ভঙ্গিতে মহিলার কনুই ছুঁয়ে তাকে জিজ্ঞেস করল সমস্যাটা কোথায় হয়েছে। মহিলা তার সমস্ত রাগ এবার আলম্যানের ওপর ঝাড়তে শুরু করল। আলম্যান সহানুভূতিভরে তার কথা শুনল, তারপর মাথা নেড়ে মিসেস ব্র্যান্টকে কি যেন একটা বলল। মিসেস ব্র্যান্ট বিজয়ী হাসি দিয়ে ক্লার্কের ব্যাজার চেহারার দিকে তাকিয়ে বললেন : “যাক, এ হোটেলে অন্তত একজনকে পেলাম যে একটা অসভ্য নয়।”

মহিলা আলম্যানের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল, আর আলম্যান তার কনুইয়ের ফাঁকে হাত গলিয়ে তাকে অফিসের দিকে নিয়ে গেল। আলম্যান লম্বায় খুব বেশী হলে মহিলার ফার কোট পড়া কাঁধে পড়বে।

“বাব্বাহ্!” ওয়েন্ডি হাসতে হাসতে বলল। “লোকটা নিজের কাজ ভালোই জানে।”

“কিন্তু উনি তো আসলে মহিলাটাকে পছন্দ করেন না,” ড্যানি সাথে সাথে জবাব দিল। “উনি শুধু পছন্দ করবার ভান করছিলেন।”

জ্যাক ওর দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসি দিল। “আমি জানি, ডক। কিন্তু দুনিয়ায় কিছু কিছু জায়গায় তোষামোদ না করলে চলে না।”

“তোষামোদ মানে?”

“তোষামোদ হচ্ছে,” ওয়েন্ডি ওকে বলল, “যখন তোমার বাবা আমাকে বলে যে আমার নতুন হলুদ জামাটা ওর খুব পছন্দ হয়েছে, যদিও ওর আসলে জামাটা ভালো লাগেনি অথবা যখন ও বলে যে আমার ওজন কমাবার দরকার নেই তখন।”

“ওহ। মানে মজার জন্যে মিথ্যা কথা বলা?”

“অনেকটা।”

ও অনেকক্ষণ মাকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ করছিল। এখন ও বলল : “আম্মু, তুমি খুব সুন্দর।” মা আর বাবা যখন একজন আরেকজনের দিকে তাকিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল তখন ড্যানি ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে ভু কুঁচকাল।

“আলম্যান অবশ্য আমাকে কোনরকম তোষামোদ করে নি,” জ্যাক বলল। “চল আমরা জানালার ওদিকে যাই। লবির মাঝখানে জিনসের জ্যাকেট পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে আমার অস্বস্তি লাগছে। বিশ্বাস কর, আমি ভেবেছিলাম হোটেল বন্ধের দিনে এত মানুষ থাকবে না।”

“তোমাকে দেখতে ভালো লাগছে,” ওয়েন্ডি বলল, তারপর ওরা আবার হাসিতে ফেটে পড়ল। ওয়েন্ডি নিজের মুখে হাত চাপা দিল যাতে বেশী জোরে শব্দ না হয়। ড্যানি এখনও বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে, কিন্তু ওর ভালো লাগছিল এটা দেখে যে বাবা আর মা আবার একজন আরেকজনকে ভালোবাসছে। ড্যানির মনে হল যে এই হোটেলটা মাকে অন্য কোন জায়গার কথা মনে পড়িয়ে দিচ্ছে, যেখানে ওরা দু’জন খুশি ছিল। ও আশা করল যে মার হোটেলটাকে যতটা ভালো লেগেছে ওরও যাতে ততটাই ভালো লেগে যায়। ও বারবার মনে মনে নিজেকে বলছিল যে টনি ওকে যা দেখায় তা সবসময় সত্যি হয় না। ও সাবধানে থাকবে। রেডরাম শব্দটা আবার কোথায় দেখা দেয় তার ব্যাপারে সতর্ক থাকবে। কিন্তু ও বাবা মাকে কিচ্ছু বলবে না। কারণ অনেকদিন পর ওদের সত্যি সত্যি খুশি দেখাচ্ছিল, আর ওদের ভেতর কোন খারাপ চিন্তা ছিল না।

“এখানে দেখো।” জ্যাক বলল।

“ওহ্ কি সুন্দর ড্যানি এসে দেখে যাও!”

ড্যানির দেখে খুব একটা সুন্দর লাগল না। ও উঁচু জায়গা পছন্দ করে না, ওর মাথা ঘোরায়। বাইরে একটা পরিপাটি লন। লনটার একপাশে একটা ছোট্ট গলফ কোর্স দেখা যাচ্ছে, আর লনটা একদিকে ঢালু হয়ে একটা সুইমিং পুলের সাথে মিশেছে। “বন্ধ” লেখা একটা সাইন পুলটার পাশে দাঁড় করানো ছিল। “বন্ধ” সাইনটা ড্যানি নিজেই পড়তে পারে। “বন্ধ”,”পিজা”, “প্রবেশ”, “বাহির” এসব সাইন ও নিজের আয়ত্তে এনে ফেলেছে।

পুলের পরে একটা খোলামকুঁচি বেছানো রাস্তা দেখা যাচ্ছিল। সে রাস্তার শেষে একটা সাইন লাগানো যেটা ড্যানি পড়তে পারছিল না।

“বাবা, ‘রো-কে’ মানে কি?”

“এক ধরণের খেলা,” জ্যাক বলল। “অনেকটা ক্রোকে খেলার মত, শুধু অন্যরকম একটা মাঠে খেলতে হয় আর কয়রকটা নিয়ম আলাদা। রোকে অনেক পুরনো খেলা। মাঝে মাঝে এখানে টুর্নামেন্ট হয়।”

“ক্রোকেতে যেভাবে একটা হাতুড়ি দিয়ে মেরে মেরে বল এগিয়ে নিয়ে যেতে হয় এখানেও কি তাই?”

“হ্যা, তাই।” জ্যাক মাথা নাড়ল। “শুধু হাতুড়িটার হাতলটা একটু খাটো আর মাথাটার একদিক রাবারের আরেকদিক কাঠের।”

(বেরিয়ে আয়, হারামজাদা!)

জ্যাক তখনও কথা বলছিল : “তুই চাইলে আমি খেলাটা তোকে শেখাতে পারি।”

“হয়তো।” ড্যানির নিস্পৃহ উত্তরে ওর বাবা-মা একজন আরেকজনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল। “মনে হয়না আমার খেলাটা বেশী ভালো লাগবে।”

“ডক, তোর যদি ভালো না লাগে তাহলে তোকে কেউ জোর করবে না, ঠিক আছে?”

“আচ্ছা।”

“জন্তু-জানোযারগুলোকে তোমার ভালো লাগছে না?” ওয়েন্ডি জানতে চাইল। “এটাকে বলে টপিয়ারি।” ওদের সামনে একটা বাগানও ছিল, যেটার ঝোপগুলোকে হেঁটে পশুদের রুপ দেয়া হয়েছে। ড্যানি লক্ষ্য করল যে ওখানে একটা খরগোশ, কুকুর, গরু আর বড় বড় সিংহের আকৃতি দেখা যাচ্ছে।

“ওই জন্তুগুলোকে দেখেই আঙ্কেল অ্যালের মাথায় আসে আমাকে এখানে চাকরি দেবার কথা,” জ্যাক জানাল। “আমি কলেজে থাকতে একটা ল্যান্ডস্কেপিং কোম্পানির জন্যে কাজ করতাম। আমাদের কাজ ছিল মানুষের লন সুন্দর করে দেয়া আর টপিয়ারি বানানো। আমি একটা মহিলার জন্যে টপিয়ারি বানিয়ে দিয়েছিলাম।”

“ওনার বাগান কেমন ছিল বাবা? সুন্দর?”

“হ্যা, কিন্তু ওখানে পশুপাখির ডিজাইন ছিল না।” জ্যাক বলল। “ওনার বাগানে আমরা তাসের চিহ্নের মত ডিজাইন করে দিয়েছিলাম। একটা ঝোপ ইস্কাবনের মত, একটা রুহিতন, এরকম। কিন্তু ঝোপগুলো আস্তে আস্তে বাড়তেই থাকে, বুঝলি -”

(ব্যাটা বাড়তেই থাকে, ওয়াটসন বলেছিল। না, ঝোপ নয়, বয়লার। আপনি যদি লক্ষ্য না রাখেন তাহলে ওটা ফেটে আপনাকে আর আপনার পরিবারকে চাঁদে পাঠিয়ে দেবে।)

ওরা দু’জন জ্যাকের দিকে অবাক হয়ে তাকাল।

“বাবা?” ড্যানি প্রশ্ন করল।

ও চোখ পিটপিট করল ওদের দিকে তাকিয়ে, যেন অনেক দূর থেকে ও মাত্র ফিরে এসেছে। “ঝোপগুলো বাড়তেই থাকে ড্যানি, তাই মাঝে মাঝে আমার এসে ওদের ছাঁটতে হত। শীত আসার আগ পর্যন্ত এমন করতে হয়, কারণ শীতের সময় ঝোপগুলোর পাতা ঝরে যায়, তখন আর ছাঁটাহাঁটির কোন ব্যাপার নেই।”

“আরে, একটা খেলার জায়গাও আছে।” ওয়েন্ডি বলল। “আমার ছেলের কপাল ভালো।”

প্লেগ্রাউন্ডটা টপিয়ারির ঠিক পেছনেই। দু’টো দোলনার সেট, যেখানে নানা দৈর্ঘ্যের দোলনা ঝোলানো আছে, একটা ছোট কৃত্রিম জঙ্গল, জাঙ্গল জিম বলে ওটাকে, দু’টো স্লিপার আর ওভারলুক হোটেলের একটা ছোট মডেল খেলবার জায়গাটা দখল করে আছে।

“তোমার পছন্দ হয়েছে, ড্যানি?” ওয়েন্ডি জানতে চাইল।

“খুব।” ও বলল। ড্যানি মনে মনে চাচ্ছিল যে ওর গলায় যাতে একটু আনন্দ প্রকাশ পায়। “জায়গাটা দারুণ।”

খেলার জায়গার পরে হচ্ছে সাধারণ দেখতে একটা তারের বেড়া, তারপর ওরা যে লম্বা রাস্তাটা ধরে গাড়ি চালিয়ে এসেছে সেটা, আর তারও পরে হচ্ছে গভীর উপত্যকা। ড্যানি ‘একাকীত্ব’ কথাটার মানে জানত না, কিন্তু এই মুহূর্তে কেউ যদি ওকে শব্দটার অর্থ বলত তাহলে ও মেনে নিত যে এ জায়গাটার জন্যে এর চেয়ে মানানসই শব্দ আর নেই। আরও অনেক নীচে, কালো, লম্বা একটা ঘুমন্ত সাপের মত সাইডওয়ান্ডারে যাবার রাস্তাটা শুয়ে আছে। এই রাস্ত াটা সারা শীতকাল বন্ধ থাকবে। কথাটা মনে হতেই ড্যানির একটু অস্বস্তি হল। বাবা যখন ওর ঘাড়ে হাত রাখল তখন ও প্রায় চমকে উঠল 1

“আমি যত তাড়াতাড়ি পারি তোর জন্য পানি নিয়ে আসব, ডক। ওরা সবাই এখন একটু ব্যস্ত।”

“কোন অসুবিধা নেই, বাবা।”

মিসেস ব্র্যান্ট উজ্জ্বল চেহারা নিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে এলেন। তার কিছুক্ষণ পর দু’জন বেলবয় আটটা সুটকেস কোনমতে টানতে টানতে তার পিছে বেরিয়ে এল। ড্যানি জানালা দিয়ে দেখল যে ওরা বের হবার সময় মিলিটারির পোশাকের মত ধূসর উর্দি আর টুপি পরা একজন মানুষ ওনার গাড়িটা গেটের সামনে নিয়ে এল। ছেলেটা নেমে মহিলার দিকে একটু মাথা নত করল, তারপর গাড়ির ট্রাংক খুলে ছুটে গেল সুটকেস তুলতে সাহায্য করবার জন্যে।

ঠিক তখন মিসেস ব্র্যান্টের একটা চিন্তা ড্যানির কানে বেজে উঠল সাধারণত ড্যানি মানুষের ভীড় আছে এমন জায়গায় শুধু শোরগোল ছাড়া কিছু শুনতে পায় না, কিন্তু এখন ও পরিষ্কার শুনতে পেল মিসেস ব্র্যান্ট ভাবছেন :

(এই ছেলেটার সাথে শুতে পারলে মন্দ হত না)

বেলবয়দের মালামাল গাড়িতে তোলা দেখতে দেখতে ড্যানির ভ্রু কুঁচকে গেল। মহিলা উর্দি পরা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ছিল, যে সুটকেস ওঠাতে সাহায্য করছিল। মিসেস ব্র্যান্ট কেন ছেলেটার সাথে শুতে চান? একলা শুতে কি ওনার ভয় লাগে? ড্যানি এত ছোট, কিন্তু ও তো এখনই একলা শুতে পারে।

ছেলেটা কাজ শেষ করে গাড়ির সামনের দিকে এগিয়ে এল যাতে ও মহিলাকে গাড়িতে উঠতে সাহায্য করতে পারে। ড্যানি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল মিসেস ব্র্যান্ট শোবার ব্যাপারে আর কোন কথা চিন্তা করেন কিনা বুঝবার জন্যে। কিন্তু উনি শুধু হেসে ছেলেটার হাতে এক ডলারের একটা নোট দিলেন টিপ হিসাবে। তার এক মুহূর্ত পরেই উনি গাড়িটাতে উঠে চলে গেলেন নিজের রাস্তায়।

ও একবার ভাবল যে মাকে জিজ্ঞেস করবে মিসেস ব্র্যান্ট ওই ছেলেটার সাথে শুতে চান কেন, তারপর সিদ্ধান্ত নিল যে না করাই ভালো। মাঝে মাঝে উল্টোপাল্টা প্রশ্নের জন্যে ওকে বিপদে পড়তে হয়েছে।

তাই ও সোফায় যেয়ে বসে পড়ল। ওর এটা দেখতে ভালো লাগছিল যে এখানে এসে বাবা আর মা বেশ খুশি হয়েছে, কিন্তু মাথা থেকে ও দুশ্চিন্তার মেঘটা সরাতে পারছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *