শাইনিং – ৪৫

অধ্যায় ৪৫ – রেডরাম

রাত ৮টা।

ড্যানি ঘুমিয়ে পড়েছে।

ওয়েন্ডিও নিজের বিছানায় কিছুক্ষণ ঘুমাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু সকাল থেকে ঘটে যাওয়া অবিশ্বাস্য ঘটনাগুলো মনে করে ওর ঘুমের বদলে কান্না পাচ্ছিল। আসলেই কি ওর স্বামী পাগল হয়ে গেছে? যদি জ্যাক আর ঠিক না। হয় তাহলে ওরা কি করবে? ওর মায়ের কাছে যাবে থাকতে?

নীচ থেকে একটা অদ্ভুত শব্দ ভেসে আসায় ওয়েন্ডির চিন্তায় বাধা পড়ল। কি ব্যাপার? জ্যাক কি ছুটে গেছে? ও বিছানায় উঠে বসল। নীচে যেয়ে দেখতে হবে।

ও উঠে নিজের গাউনটা গায়ে জড়িয়ে নিল, আর একহাতে নিল ছুরিটা। তারপর সাবধানে চারদিকে চোখ রাখতে রাখতে নীচে নেমে এল। ও সিঁড়ির শেষ ধাপ থেকে নামবার সময় আবার শব্দ হল। ওয়েন্ডির মনে হল শব্দটা বলরুম থেকে ভেসে আসছে।

ওয়েন্ডি বলরুমে এল। এখানে কিছুই নেই। আধো-অন্ধকারে ঢাকা একটা ঘর, অনেকগুলো টেবিল আর ওলটানো চেয়ার রাখা।

হঠাৎ ওয়েন্ডির কানে সুন্দর একটা সুর বেজে উঠল। অনেক পুরনো একটা গানের, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের। আর এক সেকেন্ড ওর চোখের সামনে সেই দৃশ্যটা জীবন্ত হয়ে উঠল, যেটা ও সেদিন লিফটের সামনে দেখেছে।

বলরুমের প্রায় প্রত্যেকটা টেবিল ভরে গিয়েছে মানুষে। সবাই হাসাহাসি করছে, মদ খাচ্ছে। সবাই সাজপোশাক আর মুখোশ পড়া। জন্তু-জানোয়ার থেকে শুরু করে রাজকুমার পর্যন্ত সবই আছে এই পার্টিতে। ভীড়ের মধ্যে থেকে কেউ চেঁচিয়ে উঠল : “মুখোশ খুলে ফেলবার সময় হয়ে গেছে!”

আবার সবকিছু নিশ্চুপ।

কিন্তু ওয়েন্ডি অনুভব করল যে ও একা নয় বলরুমে। ও আস্তে আস্তে পিছে ফিরল।

জ্যাককে দেখে এখন আর ওর স্বামী বলে চেনা যাচ্ছে না। ওর দুই চোখ লাল, রক্তপিপাসু। ওর মুখে একটা বিকৃত, নিষ্ঠুর হাসি ঝুলছে। ও দুই হাতে শক্ত করে একটা রোকে খেলার হাতুড়ি ধরে আছে।

“তুই কি ভেবেছিলি আমাকে আটকে রাখতে পারবি?”

“জ্যাক—”

“চুপ মাগী! আমি জানি তুই কত খারাপ।”

ওয়েন্ডি কিছু বোঝার আগেই জ্যাক এগিয়ে এসে সজোরে হাতুড়িটা ওর পেটে বসিয়ে দিল। ব্যাথায় ওয়েন্ডির দম আটকে আসলো, ওর মনে হল ও এখনই অজ্ঞান হয়ে যাবে। ও দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল। ওর ছুরিটা খসে পড়ল হাত থেকে।

জ্যাকের হাসি আরও চওড়া হল। ও আবার হাতুড়িটা মাথার ওপর তুলল, এবার ও ওয়েন্ডির মাথা গুঁড়িয়ে দিতে চায়। কিন্তু ওয়েন্ডি সময়মত সরে গেল। হাতুড়িটা ওর মাথায় না লেগে লাগল পায়ে।

ওয়েন্ডির মনে হল ওর পা দু টুকরো হয়ে গেছে। কিন্তু ওর মাথা তখনও কাজ করছিল। ও যদি এখন কিছু না করে, তাহলে জ্যাক ওকে মেরেই ফেলবে। ও নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে জ্যাকের হাঁটুর নীচে একটা লাখি ছুঁড়ল।

জ্যাক একটা জান্তব গর্জন করে বসে পড়ল মাটিতে। ওয়েন্ডি মাটি থেকে ছুরিটা তুলে নিল নিজের হাতে, তারপর জ্যাকের পিঠে বসিয়ে দিল।

জ্যাক তীক্ষ্ম স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। ওয়েন্ডির মনে হল ও এত ভয়ংকর কোন শব্দ জীবনেও শোনে নি। যেন হোটেলের সবগুলো দরজা, জানালা আর মেঝে একসাথে চেঁচিয়ে উঠেছে। ওয়েন্ডির মনে হল চিৎকারটা যেন অনন্তকাল ধরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। অবশেষে জ্যাক থামল। তারপর লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

ওয়েন্ডি কিছুক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। জ্যাকের শরীর নিথর। ওয়েন্ডির চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে এল। ও নিজের স্বামীকে মেরে ফেলেছে!

ও ফোঁপাতে ফোঁপাতে হাঁটতে শুরু করল। ড্যানি এই শব্দে জেগে গিয়েছে কিনা কে জানে। ওয়েন্ডির পাও প্রচণ্ড ব্যাথা করছিল। ও বেডরুমে গিয়ে কিছুক্ষণ শুয়ে থাকতে চায়।

ও খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে সিঁড়ি পেরিয়ে প্রায় দোতলায় পৌঁছে গিয়েছিল যখন ও পেছন দেখে ডাকটা শুনতে পেল।

“হারামজাদী, তুই আমাকে খুন করেছিস।”

অন্ধকার প্লাবনের মত ভয় ভাসিয়ে নিয়ে গেল ওয়েন্ডিকে।

জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির নীচে। ও কুঁজো হয়ে আছে, আর ছুরির হাতলটা উঁচিয়ে আছে ওর পিঠ থেকে। ওর চোখে মণির কোন চিহ্ন নেই, দু’চোখই একদম সাদা। ওর বাঁ হাত থেকে হাতুড়িটা শিথীলভাবে ঝুলছে। হাতুড়িটার মাথায় রক্ত লেগে আছে। ওয়েন্ডির রক্ত।

“আজ তোকে মজা দেখাব হারামজাদী।”

ও ধীর পায়ে এগিয়ে এল সিঁড়ির দিকে।

অধ্যায় ৪৬ – জ্যাক আর ওয়েন্ডি

ওয়েন্ডি খোঁড়া পা নিয়েই দৌড়াতে চেষ্টা করল। যে করেই হোক, বেডরুম পর্যন্ত পৌঁছাতে হবে। ওই পিশাচটা যাতে ড্যানি কাছে না যেতে পারে।

নীচে জ্যাক দাঁত বের করে হাসল। ওর ঠোঁটের দু’পাশ দিয়ে ক্ষীণ ধারায় রক্ত গড়িয়ে পড়ল। “আজ তোকে টুকরো টুকরো করে ফেলব।” ও ধীর পায়ে আরেক ধাপ উঠল।

ওয়েন্ডি দু’কদম সামনে গিয়েই আছড়ে পড়ল। পায়ের ব্যাথায় ও এখন চোখে অন্ধকার দেখছে। দৌড়ানো তো দুরের কথা, ওর এখন হাঁটতেই কষ্ট হচ্ছে। এভাবে চিন্তা করে লাভ নেই! ওর ভেতর থেকে চেঁচিয়ে উঠল একটা গলা। শুধু ড্যানির কথা ভাবো!

ও জোর করে উঠে দাঁড়াল। জ্যাক সিঁড়ির মাঝামাঝি চলে এসেছে। ওয়েন্ডি খোঁড়াতে যেয়ে আবার পড়ে গেল। এবার আর উঠবার চেষ্টা না করে ও হামাগুড়ি দিয়েই আগাতে লাগল। আরও এক কদম, ওয়েন্ডি! আরও একটা!

অবশেষে ও দরজা পর্যন্ত পৌঁছে গেল। নবটা এক হাত দিয়ে ঘুরিয়ে ও রুমের ভেতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করতে যাবে এমন সময় দেখতে পেল যে জ্যাক দোতলায় এসে পড়েছে।

“খবরদার! দরজা লাগাবি না!”

ওয়েন্ডি সর্বশক্তি দিয়ে দরজাটা বন্ধ করল। তারপর ছিটকিনিটা আটকে দিল।

ওয়েন্ডি জোরে জোরে শ্বাস ফেলছিল। ওদের বিপদ এখনও কাটেনি। ওর এখন ড্যানিকে নিয়ে ঘরের সাথে জোড়া দেয়া যে বাথরুমটা আছে সেটাতে ঢুকতে হবে। বাথরুমের দরজাতেও তালা মেরে দিতে হবে।

ও ঘুরল ড্যানিকে ডাকবে বলে। কিন্তু ড্যানির বিছানা খালি।

তারমানে ড্যানি কি ওদের গলা শুনতে পেয়েছে? না, না, ড্যানি তো ওদের মনের কথা পড়তে পারে! যখন জ্যাক ওকে মারতে চাচ্ছিল তখন জ্যাক নিশ্চয়ই বুঝতে পেরে কোথাও লুকিয়ে গিয়েছে।

দরজায় একটা হাতুড়ি আছড়ে পড়ল।

ওয়েন্ডির সারা শরীর কেঁপে উঠল শব্দটা শুনে। ও ঝুঁকে বিছানার নীচে দেখল ড্যানি সেখানে আছে কিনা। নেই। ও নীচু গলায় ডাকল : “ড্যানি?”

আবার হাতুড়ির শব্দ।

এবার ও ক্লজেটের দরজা খুলল। হ্যাঙ্গারে ঝুলিয়ে কাপড়গুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল ও মাটিতে। ড্যানি এখানেও নেই।

আরেকটা আঘাত। দরজাটা এবার থরথর করে কেঁপে উঠল। দরজার ঠিক মাঝখানে একটা ফাটল দেখা দিল। ওপাশ থেকে চিৎকার ভেসে এল : “আজ তোদের মজা দেখিয়ে ছাড়ব! হারামজাদী! কি ভেবেছিস, তোরা যা ইচ্ছে তাই করে পার পেয়ে যাবি?” ও যদি আগে থেকে না জানতো যে দরজার ওপাশে জ্যাক দাঁড়িয়ে আছে ওয়েন্ডি কখনওই বিশ্বাস করত না যে এটা জ্যাকের গলা।

আর থাকতে না পেরে ওয়েন্ডি বাথরুমের দরজা খুলল। ড্যানি এখানেও নেই। ও ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

ও শুনতে পেল জ্যাক দরজা ভেঙ্গে রুমে ঢুকেছে। ও এলোপাথাড়ি হাতুড়ি চালাচ্ছে। একটা ক্যাবিনেট উলটে পড়ল হাতুড়ির আঘাতে। দেয়াল ভাঙ্গার আওয়াজ। তারপর ওয়েন্ডির রেকর্ড প্লেয়ারটা দু’টুকরো হয়ে গেল। তারপর হাতুড়িটা আছড়ে পড়ল বাথরুমের দরজায়। দরজাটার ছোট একটা অংশ ফেটে ছিটকে পড়ে গেল নীচে। সেই ফুটোটা দিয়ে জ্যাকের চোখ দেখা দিল।

“তোর পালাবার আর কোন জায়গা নেই! এখন কোথায় যাবি, হারামজাদী?” ও আরেকবার আঘাত করে ফুটোটা আরও চওড়া করল। এবার ও নিজের চেহারা সরিয়ে একটা হাত গলিয়ে দিল দরজার ফুটোটা দিয়ে।

ওয়েন্ডির তখন হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। জ্যাক নিজের দাড়ি কামাবার ব্লেডগুলো এই বাথরুমেই রাখে! ও খোঁড়া পা নিয়ে যত দ্রুত পারে হেঁটে গিয়ে সিংকের ওপরের ক্যাবিনেটটা খুলল। হ্যা, সামনেই তিনটে ব্লেড রাখা। ও একটা তুলে নিয়ে কঠিন মুখে দরজার দিকে আগাল। তারপর একটুও না থেমে জ্যাকের হাতের তিন জায়গায় ব্লেডটা চালিয়ে দিল।

জ্যাক চিৎকার করে উঠল। হাতটা সরে গেল দরজা থেকে।

হঠাৎ করে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেল। ওয়েন্ডি নিশ্বাস নিতেও ভয় পাচ্ছিল। একটু পর বাইরে থেকে পায়ের শব্দ ভেসে এল। জ্যাক রুম ছেড়ে চলে যাচ্ছে!

ওয়েন্ডি আর পারল না। ও জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

অধ্যায় ৪৭ – হ্যালোরানের পূণরাগমন

হোটেলের প্রধান দরজা এক ধাক্কায় খুলে দিয়ে হ্যালোরান ঢুকল ভেতরে। ও চেঁচিয়ে ডাকল : “ড্যানি? ড্যানি?”

ড্যানি প্রথম যেদিন ওকে মানসিকভাবে ডেকেছিল ও সেদিনই শুনতে পেয়েছে। ও ফ্লোরিডার সব কাজকর্ম ফেলে তখনই একটা প্লেনের টিকেট বুক করে সাইডওয়াইন্ডারে ফিরে আসবার জন্যে। এখানে এসে একটা স্নো-মোবিল ভাড়া করে সোজা চলে আসে হোটেল পর্যন্ত। যাত্রাপথে ও আবারও ড্যানির ডাক শুনতে পেয়েছে। ওর এখন ভয় হচ্ছিল যে ও বেশী দেরি করে ফেলেছে। “ড্যানি!” ও আবার ডাকল, এবার আরও জোরে। কোন উত্তর নেই।

আশেপাশে চোখ বুলিয়ে ওর মুখ শুকিয়ে গেল। লবির কার্পেটটায় শুকনো রক্তের দাগ লেগে আছে। রক্তটা সিঁড়ি বেয়ে উঠে দোতলায় শেষ হয়েছে। ওর কি আসলেই বেশী দেরি হয়ে গেছে?

হ্যালোরান সিঁড়ি বেয়ে উঠে এল। ও দোতলায় পা দেবামাত্র জ্যাক ঝাঁপিয়ে পড়ল ওর ওপর। জ্যাক এতক্ষণ লিফটের ভেতর লুকিয়ে ছিল। হ্যালোরান এসেছে টের পেয়েই ও ওয়েন্ডির বেডরুম ছেড়ে এখানে চলে আসে।

“হারামী,” জ্যাক নোংরা স্বরে হ্যালোরানের কানের পাশে ফিসফিস করল। “অন্যদের কাজে নাক গলালে কি হয় সেটা তোকে দেখাচ্ছি আমি।”

ও হাতুড়িটা দিয়ে প্রচণ্ড জোরে আঘাত করল হ্যালোরানের গালে। হাড় ভাঙ্গার একটা বিশ্রী শব্দ হল, আর হ্যালোরান লুটিয়ে পড়ল মাটিতে।

“এবার ড্যানি।” জ্যাকের মুখের বিকৃত হাসিটা একবারও মিলিয়ে যায়নি।

অধ্যায় ৪৮ – টনি

(ড্যানি…)

(ড্যানিইইই…)

ড্যানি অন্ধকার একটা করিডর ধরে হাঁটছে। অনেকটা হোটেলের করিডরগুলোর মত, কিন্তু পুরোপুরি নয়। ওর চোখে অন্ধকারে সয়ে আসার পর ও দেখতে পেল করিডরের একদম শেষপ্রান্তে একটা ছোট্ট আকৃতি দাঁড়িয়ে আছে। টনি।

“আমি কোথায়?”

“তুমি স্বপ্ন দেখছ। তুমি তোমার বাবা আর আম্মুর বেডরুমে শুয়ে আছ।”

“ড্যানি,” টনি যোগ করল, “তোমার মায়ের অনেক বড় বিপদ। উনি মারাও যেতে পারেন। হয়তো মিস্টার হ্যালোরানও।”

“না!” ড্যানি চেঁচিয়ে উঠল। ওর চিৎকার প্রতিধ্বনিত হতে হতে মিলিয়ে গেল করিডরের অন্ধকারে।

“ড্যানি, অস্থির হয়ে যাও না।”

“আমি ওদের মরতে দেব না!”

“তাহলে তোমার ওদের সাহায্য করতে হবে,” টনি অস্পষ্ট গলায় বলে উঠল। “ড্যানি, তুমি তোমার মনের গভীরে একটা জায়গায় আছ। আমি যেখানে থাকি। আমি তোমার একটা অংশ, ড্যানি।”

“না, তুমি টনি। আমি আম্মুর কাছে যেতে চাই—”

“তুমিই আমাকে সৃষ্টি করেছ, ড্যানি, আর মনের গভীরে এই সত্যটা তুমি সবসময়ই জানতে।”

টনি এগিয়ে এল ওর দিকে। জীবনে প্রথমবারের মত, টনি এগিয়ে এল। “শোন, তোমার বাবাকে ওভারলুক নিয়ে নিয়েছে। আর তোমার বাঁচার একটাই পথ আছে। তোমার বাবা যা ভুলে গিয়েছে সেটা তোমার মনে রাখতে হবে।”

কথাটা শেষ হবার সাথে সাথে ড্যানির চারপাশের দৃশ্য বদলে গেল। ও এখন সত্যিকারের ওভারলুকের করিডরে দাঁড়িয়ে আছে। পেছনে বুম বুম শব্দ তুলে ধেয়ে আসছে বাবার রুপধারী পিশাচটা। ও এতদিন স্বপ্নে যা দেখেছে সেটা সত্যি হতে চলেছে! ড্যানি উর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিল।

ড্যানির মাথায় বিদ্যচ্চমকের মত একটা চিন্তা খেলে গেল। হোটেলের ছাদে একটা চিলেকোঠা আছে যেটাতে ওকে কখনও যেতে দেয়া হয়না ইঁদুরের বিষের ভয়ে। কিন্তু ড্যানি জানে যে চিলেকোঠাটায় ঢুকবার একটা গুপ্তদরজা আছে, যেটা চারতলার করিডরের ছাদে। ওই দরজাটা থেকে ঝোলানো একটা দড়ি ধরে টান দিলে একটা মই নেমে আসে। ড্যানি যদি একবার চিলেকোঠায় উঠে মইটা উঠিয়ে নিতে পারে, তাহলে জ্যাক ওকে ধরতে পারবে না।

ও লম্বা একটা দম নিয়ে সিঁড়ির দিকে দৌড় দিল। ওর পেছনে নিরন্তর জ্যাকের চিৎকার আর বুম বুম শব্দ হয়েই চলেছে।

ড্যানি চারতলার করিডরে এসে থামল। ওর দম ফুরিয়ে গিয়েছে। আর মাত্র কয়েক পা, ও বোঝাল নিজেকে। জোরে করে ও এগিয়ে এল করিডরের মাঝখানে। এসে ওর মুখ শুকিয়ে গেল।

ছাদের দরজাটায় তালা দেয়া।

বাবা নিশ্চয়ই কোন একসময় তালা লাগিয়ে দিয়েছিল, যাতে ড্যানি চাইলেও চিলেকোঠায় না যেতে পারে। ব্যাপারটা চিন্তা করে ড্যানির মুখে একটা কাষ্ঠ হাসি ফুটে উঠল।

অধ্যায় ৪৯ – বাবা যা ভুলে গেছে

ওয়েন্ডির একটু একটু করে জ্ঞান ফিরে এল। ওর সারা শরীর ব্যাথা করছে। ওর প্রথম কয়েক মুহূর্ত কিছু মনে পড়ল না। ও কোথায়, ব্যাথা পেল কিভাবে, দরজাটা ভাঙ্গা কেন ওর কিছুই মনে নেই। ও লম্বা একটা নিশ্বাস নিল, আর সাথে সাথে ওর সবকিছু মনে পড়ে গেল।

জ্যাক হঠাৎ করে চলে গেল কেন? ও কি ড্যানিকে দেখতে পেয়েছে? চিন্ত াটা মাথায় আসতেই ওয়েন্ডি উঠে দাঁড়াল। তারপর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বেরিয়ে এল বাইরে’। করিডরে ওর জন্যে আরেকটা চমক অপেক্ষা করছিল। হ্যালোরান।

হ্যালোরানেরও মাত্র জ্ঞান ফিরে এসেছে। ওর মুখ থেকে রক্ত পড়ছে, আর একটা গাল বিশ্রীভাবে ফুলে গেছে। ও ওয়েন্ডিকে দেখে জড়ানো গলায় বলল : “শুয়োরের বাচ্চা আমার চোয়াল ভেঙ্গে দিয়েছে।”

“মিস্টার হ্যালোরান?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল। তারপরই ওর মনে পড়ে গেল যে ড্যানি ওকে বলেছিল যে ও নিজের ক্ষমতা ব্যাবহার করে হ্যালোরানকে ডেকেছে। ও নিশ্চয়ই সেই ডাক শুনেই এসেছে।

“তুমি কি জানো ড্যানি কোথায়?” এবার হ্যালোরান ওকে প্রশ্ন করল। ওয়েন্ডির কানে কিছুক্ষণ ধরেই একটা শব্দ আসছে। ও একটা আঙুল ঠোঁটের ওপর রেখে হ্যালোরানকে কথা বলতে নিষেধ করল।

এক মিনিট পর ও বলল : “হ্যা। ওরা দু’জনই ওপরে।”

.

ড্যানির আর যাবার কোন জায়গা নেই। করিডরের প্রত্যেকটা রুমে তালা দেয়া। ও পিছাতে পিছাতে ওর দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেল।

এমন সময় জ্যাক উঠে এল ওপরে। হাতের হাতুড়িটা বাতাসে বিপজ্জনকভাবে দুলছে, একটা সাপের ফণার মত। ও এগিয়ে আসতে ড্যানি ওর মুখের হাসিটা দেখতে পেল।

“এবার পেয়েছি তোকে হারামী। আজ তোকে মজা দেখাব। নিজের বাবাকে কিভাবে শ্রদ্ধা করতে হয় আজ শিখিয়ে দেব তোকে।”

“তুমি আমার বাবা নও!” ড্যানি তীক্ষ্ম স্বরে চেঁচিয়ে উঠল। ওর ভয় কেন যেন কেটে গিয়েছে। একজন মানুষ বোধহয় চাইলেও এতক্ষণ আতংকিত থাকতে পারে না ড্যানি যতক্ষণ থেকেছে।

“ফালতু কথা বলিস না,” জ্যাক বলল। “অবশ্যই আমি তোর বাবা। আমি দেখতে তোর বাবার মত নই? তবে হোটেলের বাসিন্দারা আমাকে কথা দিয়েছে, আমি যদি তোকে ওদের হাত তুলে দেই তাহলে আমি ওদের একজন হয়ে যাব।”

“ওরা কথা দেয়, কিন্তু কথা রাখে না।”

“চুপ মিথ্যুক!” জ্যাক আবার চেঁচিয়ে উঠল। কিন্তু কথাটা বলবার সাথে সাথে জ্যাকের মধ্যে একটা সুক্ষ পরিবর্তন দেখা দিল। ও চেহারার অভিব্যক্তি পালটে গেল। এক মুহূর্তের জন্যে ড্যানির মনে হল ওর আবার ওর বাবাকে দেখতে পাচ্ছে।

“ডক…তুই কি করছিস? পালিয়ে যা এখান থেকে…”

“না, বাবা,” ড্যানি দৃঢ়স্বরে বলল। “আমার পালাবার আর কোন জায়গা নেই। আমি আর পালাতে চাইও না।”

আবার জ্যাকের মুখ বিকৃত হয়ে গেল। “খুব কথা শিখেছিস, না? তোর জিভ ছিড়ে ফেলব আমি। তোকে এক্ষণি মজা দেখাচ্ছি, দাঁড়া…

ড্যানির মুখে আস্তে আস্তে একটা হাসি ফুটে উঠল। সে হাসিটা দেখেই হয়তো জ্যাকরুপী পিশাচটা একটু দ্বিধায় পড়ে গেল। ও ড্যানিকে মারবার জন্যে হাতুড়িটা মাথার ওপর তুলেছিল, ওর হাত দু’টো সেই ভঙ্গিতেই থেমে গেল।

“আমি এখন বুঝেছি তুমি কি ভুলে গিয়েছ,” ড্যানি বলল। “তুমি তো আজকে সকাল থেকে বয়লার চেক করনি, তাই না? ওটা একটু পরেই ফাটবে!”

“বয়লার!” জ্যাক-পিশাচ চেঁচিয়ে উঠল। “না, না, না, এটা হতে পারে না—”

“এমনই হবে!” ড্যানিও পালটা চিৎকার করল। “এই পুরো হোটেলটাই একটু পরে উড়ে যাবে!”

এক মুহূর্তের জন্যে মনে হল পিশাচটা ড্যানির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। কিন্তু তার বদলে হঠাৎ সেটা ঘুরে পেছনে হাঁটতে শুরু করল। ও হেঁটে লিফটে ঢুকে গেল। লিফটটা নীচে নামবার আগে ভেতর থেকে একটা রক্ত জল করা চিৎকার ভেসে এল। পরাজয়ের চিৎকার।

ড্যানি নিজের সমস্ত মনোযোগ দিল যাতে চিন্তাটা আম্মু আর হ্যালোরানের কাছে পৌঁছে যায় :

(আম্মু ডিক তোমাদের এখনই হোটেল থেকে বেরিয়ে যেতে হবে বয়লারটা ফেটে যাবে)

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *