শাইনিং – ৪০

অধ্যায় ৪০ – দিনের আলোয়

ড্যানি আঁতকে জেগে উঠল। ও স্বপ্নে দেখছিল যে হোটেলে আগুন ধরে গেছে, আর ও আর ওর আম্মু পুড়ে মারা যাচ্ছে।

ও শুকনো গলায় একটা ঢোক গিলে আম্মুর দিকে তাকাল। আম্মু এখনও ঘুমাচ্ছে। যাক, ও তাহলে ঘুমের মাঝে চিৎকার করে নি। ওর কেন যেন মনে হল ওরা সবাই একটুর জন্যে একটা অনেক বড় বিপদ থেকে বেঁচে গেছে।

(আগুন? বিস্ফোরণ? )

ড্যানি বাবাকে খুঁজে বের করবার জন্যে নিজের মানসিক ক্ষমতাকে ছড়িয়ে দিল হোটেল জুড়ে। একটু খুঁজবার পরই ও বাবাকে পেয়ে গেল। বাবা নীচে কোথাও আছে। লবিতে। তার মাথায় খারাপ জিনিসটার চিন্তা ঘুরছে।

(এক গ্লাস মাত্র এক গ্লাস অথবা তার চেয়ে একটু বেশীও যদি খাই তাহলেও আমার সমস্যা হবে না হুইস্কি জিন রাম বিয়ার)

(বেরিয়ে যা ওর মাথা থেকে হারামজাদা!)

কেউ প্রচণ্ড জোরে গর্জে উঠল ড্যানির ওপর। ওর ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে গেল। গলাটা ওর বাবার নয়। কেউ বাবার গলা নকল করে কথা বলেছে, কিন্তু কোন মানুষের গলা এত নিষ্ঠুর, বিকৃত আর ভয়ংকর হতে পারে না।

ড্যানি এই গলাটা আগেও শুনেছে। টনি ওকে যে স্বপ্নগুলো দেখিয়েছে সেখানে।

ও বিছানা থেকে নেমে করিডরে বেরিয়ে এল। আর এসেই ওকে থমকে দাঁড়াতে হল।

ওর আর সিঁড়ির মাঝখানে একটা অচেনা লোক দাঁড়িয়ে আছে।

লোকটা বেশী লম্বা হবে না। তার ছোট্ট চোখদু’টো লাল হয়ে জ্বলজ্বল করছে। লোকটা একটা অদ্ভুত সাজপোশাক পড়ে আছে, একটা কুকুরের মত। পেছন থেকে একটা লম্বা লেজ বেরিয়েছে। মুখের ওপর যে মুখোশটা থাকার কথা সেটা লোকটা খুলে রেখেছে, ওর কাঁধের ওপর পড়ে আছে ওটা। একটা নেকড়ে অথবা কুকুরের মুখ।

লোকটার মুখে আর গালে রক্তের ছোপ লেগে আছে।

লোকটা ড্যানির দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে গজরাতে শুরু করল। গর্জনটা অবিকল কোন হিংস্র পশুর মত ওর গলার গভীর থেকে বেরিয়ে আসছে। ড্যানি লক্ষ্য করল যে লোকটার দাঁতেও রক্ত লেগে আছে।

লোকটা এবার কুকুরের মত ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে শুরু করল। ও চার হাত-পায়ে হেঁটে আগাতে লাগল ড্যানির দিকে।

“আমাকে যেতে দাও।” ড্যানি বলল।

“আমি তোকে কাঁচা খেয়ে ফেলব,” কুকুরমানব উত্তর দিল। ওর ঘামে ভেজা কালো চুল মাথার সাথে লেপটে আছে। ওর শরীর থেকে হুইস্কি আর শ্যাম্পেনের গন্ধ ভেসে আসছিল।

ড্যানি ভয় পেলেও নিজের জায়গায় থেকে নড়ল না। “আমাকে যেতে দাও।”

কুকুরমানবের মুখে বিকৃত হাসি ফুটে উঠল। “আমার ক্ষিদে পেয়েছে। তোর শরীরের কোন জিনিসটা দিয়ে শুরু করব ভাবছি। তোর নাক? গাল? নাকি হৃৎপিন্ড?” লোকটা ছোট ছোট লাফ দেবার ভক্তি করে ড্যানির দিকে এগিয়ে আসছে।

ড্যানি আর পারল না। ও ঘুরে দৌড় দিল পেছন দিকে।

“আমি আসছি তোকে ধরতে ডারওয়েন্ট,” লোকটা চেঁচিয়ে উঠল ওর পেছন থেকে। “তুই যতই বড়লোক হোস না কেন, আমি তো জানি তুই কত খারাপ! তুই বিছানায় কি করিস আমি জানি!”

ড্যানি দৌড়াতে দৌড়াতে ওর বেডরুমের দরজা পর্যন্ত এসে পড়েছে। ও দরজাটা খুলে মাথা গলিয়ে দিল। আম্মু এখনও ঘুমাচ্ছে। তার মানে ও ছাড়া আর কেউ লোকটার গলা শুনতে পাচ্ছে না। ও আস্তে করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। হতে পারে পুরো জিনিসটাই ও কল্পনা করেছে। কিন্তু ও আর ঝুঁকি নিতে রাজী নয়।

ড্যানির চোখ থেকে পানি পড়তে লাগলো।

ও আর সহ্য করতে পারছে না। এখানে সবকিছু ওদের ক্ষতি করতে চায়। সবকিছু।

ও গাল থেকে পানি মুছে আবার নিজেকে শক্ত করল।

না, এভাবে ভাবলে হবে না। ওর নিজেকে বাঁচাতে হবে। নিজের বাবা- মাকে বাঁচাতে হবে। ও নিজের চোখ বন্ধ করে আবার মনোযোগ দিল

(!!ডিক তাড়াতাড়ি এসো আমরা খুব বিপদে আছি!!)

এমনসময় হঠাৎ করে ড্যানি অনুভব করল ওর পিছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ও চোখ মেলে পেছনে তাকাল। টনির দেখানো স্বপ্নের দানবটা!

“এখনই তোর এসব শয়তানী বন্ধ করার ব্যবস্থা করছি! তুই আমাকে কি ভেবেছিস? আমি তোর বাবা!”

ড্যানি ভয়ে বিছানার এক কোণায় সিঁটিয়ে গেল। ওর কানের পাশ দিয়ে বাতাস কেটে গেল হাতুড়িটা। দানবটা একবার গর্জে উঠল ওর দিকে তাকিয়ে, তারপর বাতাসের সাথে মিলিয়ে গেল।

ব্যাপারটা বুঝতে ড্যানির অসুবিধা হল না। ওভারলুক ওকে সাবধান করে দিচ্ছে, যাতে ও ডিককে আর ডাকার চেষ্টা না করে।

অধ্যায় ৪১ – মদের নেশা

জ্যাক কলোরাড লাউঞ্জের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ওর মাথা একদিকে কাত করা, আর মুখে মুচকি হাসি।

ও শুনতে পাচ্ছিল যে ওর চারপাশে ওভারলুক হোটেল জেগে উঠেছে

ঠিক কিভাবে ও জিনিসটা বুঝতে পারছে সেটা ও নিজেও জানে না, কিন্তু কোন সন্দেহ নেই, ড্যানি যেভাবে অনেক কিছু দেখতে পায় সেভাবে জ্যাকও এখন দেখা শুরু করেছে। ও অনুভব করছিল যে হোটেলের অতীত আবার জীবন্ত হয়ে উঠছে, আর সেটা টরেন্স পরিবারকে নিজের ভেতর নিয়ে নিতে চায়। কোন অসুবিধা নেই, জ্যাক ভাবল। চমৎকার হয় তাহলে।

লাউঞ্জের ভেতর থেকে মানুষের কথা বলার গুঞ্জন ভেসে আসছে। ভদ্র হাসি। অভিজাত, গভীর উচ্চারণ। এসব শব্দ মিশে যাচ্ছে নীচু স্বরে বাজানো গানের সাথে।

জ্যাক দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল।

“কি অবস্থা তোমাদের? আমি ফিরে এসেছি।” ও বলল।

“আমরা ভাল আছি মিস্টার টরেন্স,” লয়েডের গলায় খুশি ফুটে উঠল। “বসুন, বসুন। কি নিবেন আপনি?”

“একটা মার্টিনি, লয়েড।” জ্যাক সন্তুষ্ট গলায় জবাব দিল। ও একটা টুল টেনে নীল সুট পড়া এক লোক আর ঘোলা চোখওয়ালা এক মহিলার মাঝখানে বসে পড়ল।

লয়েড মার্টিনিটা গ্লাসে ঢালতে ঢালতে জ্যাক ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে তাকাল। সবগুলো বুথ মানুষে ভরে গিয়েছে। আর সবাই সাজপোশাক পড়া। কুকুরের, বেড়ালের, শেয়ালের। কয়েকজনের মুখে মুখোশ পড়া, কয়েকজনের নেই।

“আপনার কোন টাকা দেয়া লাগবে না, মিস্টার টরেন্স, “ লয়েড ওর সামনে গ্লাসটা রাখতে রাখতে বলল। “ম্যানেজার আমাকে বলে দিয়েছে।

“ম্যানেজার?” জ্যাক একটু অবাক হল।

“জি, ম্যানেজার,” লয়েডের হাসি আরও চওড়া হল। ওর শরীরের চামড়া অনেক ফ্যাকাশে, আর চোখ দু’টো কোটরে বসা। অনেকটা পুরনো লাশের মত। “উনি আপনার ছেলের ব্যাপারে খুবই আগ্রহী!”

জ্যাকের মনে হল কোথায় যেন হিসাব মিলছে না। লয়েড ড্যানির ব্যাপারে কথা বলছে কেন? আর ও বারে বসে কি করছে? ও তো অনেকদিন হল মদ খায় না।

ওরা ড্যানিকে চায় কেন? ড্যানির সাথে ওরা কি করতে চায়? ও লয়েডের চোখের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল ও মিথ্যা কথা বলছে কিনা। কিন্তু

অন্ধকারে লয়েডের চোখ দেখা যাচ্ছে না।

তাছাড়া ওরা তো বলেছিল ওরা জ্যাককে চায় তাই না? ড্যানি অথবা ওয়েন্ডিকে নয়।

“কোথায় তোমার ম্যানেজার?” জ্যাক প্রশ্ন করল। ওর গলা শুনে মনে হল ও অনেকক্ষণ ধরে মদ খাচ্ছে।

লয়েড কিছু না বলে হাসল।

“তোমরা আমার ছেলের সাথে কি করতে চাও?” এবার জ্যাকের গলায় নগ্ন অনুনয়।

লয়েডের চেহারায় যেন ঢেউ খেলে গেল। ওর সাদা চামড়া বদলে অসুস্থ রঙ ধারণ করল। সারা মুখে ফুটে উঠল লাল লাল ফোসকা। ওর কপালে ঘামের মত রক্তের লাল ফোটা দেখা দিল।

(মুখোশ খুলে ফেলবার সময় হয়েছে!)

হঠাৎ জ্যাক টের পেল যে ওর পেছনের সব শব্দ থেমে গিয়েছে।

জ্যাকের গলা শুকিয়ে গিয়েছে। ও ঢোক গিলল। ও কথা বলবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ওর গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না। “আ-আমি তোমাদের ম্যানেজারের সাথে কথা বলতে চাই,” ও কোনমতে বলল। “আমার ছেলের সাথে এসবের কোন সম্পর্ক নেই…”

“মিস্টার টরেন্স,” লয়েডের গলা পুরোপুরি স্বাভাবিক, ওর ভয়াবহ চেহারার সাথে একদমই বেমানান। “আপনার এসব নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। সময় হলে আপনার ম্যানেজারের সাথে দেখা হবে। আপনি মার্টিনিটা খেয়ে নিন।”

“খেয়ে নাও, খেয়ে নাও।” লাউঞ্জের সবাই একই সাথে বলে উঠল।

জ্যাক কাঁপা কাঁপা হাতে গ্লাসটা তুলল। আচমকা একজন লোক হাত রাখল ওর কাঁধে। হোরেস ডারওয়েন্ট। ও জ্যাকের দিকে তাকিয়ে বন্ধুবৎসলভাবে হাসল। জ্যাক দেখতে পেল যে লাউঞ্জের সবাই ওর দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ওর পাশের নীল সুট পড়া লোকটা আস্তে আস্তে নিজের হাত তুলে কি যেন তাক করল জ্যাকের দিকে। একটা পিস্তল।

জ্যাক চোখ বন্ধ করে তিন ঢোকে গ্লাসটা খালি করে দিল। মদটা পেটে যাবার পর ওর বেশ ভাল লাগল। যেন ও কোনকিছুর জন্যে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছিল, যেটা মাত্র ঘটে গিয়েছে।

“আরেক গ্লাস দিতে পারো, লয়েড।” ও গ্লাসটা এগিয়ে দিল সামনে।

অধ্যায় ৪২ – পার্টিতে গল্প

কতক্ষণ ধরে জ্যাক লাউঞ্জে আছে ওর নিজেরও মনে নেই।

ও এখন অনেক ভাল মুডে আছে। অন্যদের সাথে ও এখন পার্টিতে যোগ দিয়েছে। প্রথমে কিছুক্ষণ ও সুন্দরী একটা মেয়ের সাথে নাচলো, তারপর কুকুরমানবের সাথে প্রতিযোগিতায় নামল কে বেশী জোরে ঘেউ ঘেউ করতে পারে। সেটা শেষ হলে ও হাসতে হাসতে বারের দিকে ফিরছিল, তখন হঠাৎ ধাক্কা খেল সাদা মেস জ্যাকেট পড়া একটা লোকের সাথে।

“সরি,” জ্যাক জড়ানো গলায় বলল। হঠাৎ করে ওর এই ভিড় আর ভাল লাগছিল না। ও চায় ওভারলুক আবার আগের অবস্থায় ফিরে যাক। যখন জ্যাক টরেন্স হোটেলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিল।

“ব্যাপার না,” মেস জ্যাকেট পড়া লোকটা উত্তর দিল। লোকটার কথা বলার ভঙ্গি খুব ভদ্র, কিন্তু ওর মুখ দেখলে ওকে একটা গুন্ডা ছাড়া আর কিছু মনে হয় না। ও মদের গ্লাস আর বোতলে বোঝাই করা একটা কার্ট ঠেলে নিয়ে যাচ্ছিল। “কিছু নেবেন কি? হুইস্কি, বিয়ার?”

“মার্টিনি।”

লোকটা একটা গ্লাস ধরিয়ে দিল জ্যাকের হাতে। জ্যাক পিপাসার্তের মত পান করল।

“ঠিক আছে তো, স্যার?”

“হ্যা, ঠিক আছে।”

“বেশ। পরে দেখা হবে স্যার।” লোকটা আবার কার্ট ঠেলবার জন্যে উদ্যত হল।

জ্যাক ওকে থামাবার জন্যে ওর কাঁধে একটা হাত রাখল।

“তোমার নামটা কি বল তো?”

লোকটা একটুও অবাক না হয়ে উত্তর দিল : “গ্রেডি, স্যার। ডিলবার্ট গ্রেভি।”

“কিন্তু…তুমি…আগে এখানে…কেয়ারটেকার…” জ্যাকের কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। ওর জিভ জড়িয়ে যাচ্ছে।

“না স্যার, আপনি বোধহয় ভুল করছেন।”

“কিন্তু তোমার বৌ…আর দুই মেয়ে…”

“আমার বৌ এখন কিচেনে স্যার। আর আমার মেয়েরা ঘুমিয়ে পড়েছে। ওরা তো কখনওই এত রাত জাগে না।”

“তুমি যখন কেয়ারটেকার ছিলে তখন তো…” জ্যাক অবশেষে কথাগুলো খুঁজে পেল, “তুমি তো ওদের খুন করেছ।”

গ্রেডির অভিব্যক্তি বদলালো না। “না স্যার, এমন কিছু হয়েছে বলে আমার মনে পড়ে না।” ও জ্যাকের শিথীল আঙুলগুলো থেকে গ্লাসটা ছাড়িয়ে আরও মার্টিনি ঢালল। তারপর জ্যাকের হাতে ফিরিয়ে দিল গ্লাসটা।

“কিন্তু তুমি…”

“স্যার, আপনি এই হোটেলের কেয়ারটেকার।”গ্রেডি বিনীত স্বরে বলল। “আপনি অনেকদিন ধরে এই হোটেলের কেয়ারটেকার। আমি জানি কারণ আমিও অনেকদিন ধরে এখানে আছি। আমাদের দু’জনকে একই ম্যানেজার চাকরি দিয়েছে।”

“আলম্যান?”

“আমি আলম্যান নামে কাউকে চিনি না, স্যার।”

“কিন্তু…”

“ম্যানেজার হচ্ছে-”গ্রেডি একটু থামল, “হোটেলটা স্যার। আপনি নিশ্চয়ই জানেন আপনাকে কে চাকরি দিয়েছে। আর কিছু জানার থাকলে আপনার ছেলেকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

“না,” জ্যাক আবার জড়ানো গলায় বলল। “না, আমি-”

“ও তো সবই জানে। কিন্তু ও আপনাকে কিছু বলে নি, তাই না, স্যার? বেয়াদবি নেবেন না স্যার, কিন্তু আমার মনে হয়েছে ও আপনার কোন কথাই শোনে না। এখনই অবাধ্য হয়ে গিয়েছে, এত কম বয়সেই।”

“হ্যা,” জ্যাক বলল। “ঠিকই বলেছ।”

“ওর একটা উচিত শিক্ষা হওয়া দরকার, বুঝলেন স্যার। আমার নিজের মেয়েরাই আগে এমন করত। একজন তো আমার এক বাক্স ম্যাচ চুরি করে হোটেলে আগুন ধরিয়ে দিতে চেয়েছিল। ওদের অবশ্য আমি শুধরে দিয়েছি। এখন ওরা আর কোন ঝামেলা পাকাবার কথা চিন্তাও করে না। আর আমার বৌ তখন ওদের পক্ষ নিয়েছিল তখন ওকেও আমার একটু শিক্ষা দিতে হয়েছে।” গ্রেডি জ্যাকের দিকে তাকিয়ে নিরানন্দ একটা হাসি দিল। “বাবাদের অনেক কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয়, তাই না স্যার?”

“হ্যা।” জ্যাক বলল।

“ওরা ওভারলুককে সেভাবে ভালবাসেনি যেভাবে আমি ভালবেসেছিলাম। আপনার বৌ আর ছেলেও একই ভুল করছে, স্যার। এই ভুলটা শুধরানোর দায়িত্ব আপনার। বুঝতে পারছেন আমি কি বলছি?”

“হ্যা,” জ্যাক মাথা নাড়ল।

গ্রেডি ঠিকই বলেছে। ও এতদিন ড্যানি আর ওয়েন্ডির সাথে অতিরিক্ত ভাল ব্যাবহার করে ফেলেছে। ওরা জ্যাকের মাথায় চড়ে বসেছে। ওর আসলেই বাবা হিসাবে কিছু দায়িত্ব আছে। স্বামী হিসাবেও। সেই দায়িত্বগুলোর মধ্যে একটা হচ্ছে অপরাধের উচিত শাস্তি দেয়া।

“আপনি জানেন তো স্যার,” গ্রেডি জ্যাকের দিকে ঝুঁকে এল, যেন ও গোপন কোন কথা বলছে, “যে আপনার ছেলের একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে? সেই ক্ষমতাটা দিয়ে ও বাইরের একজনকে ডেকে আনবার চেষ্টা করছে। যে আপনার আর ম্যানেজারের কাজে বাধা দিতে চায়।”

“বাইরের একজন? কে?”

“ওই হারামী বাবুর্চিটা, স্যার।”

“হ্যালোরান?”

“জি।” গ্রেডি একটু থেমে যোগ করল :

“ম্যানেজারসাহেব আপনাকে অনেক পছন্দ করেছেন, স্যার। আপনি যে ওভারলুকের ইতিহাসের ব্যাপারে এত আগ্রহী এটা দেখে উনি খুবই খুশি হয়েছেন। উনিই আপনার জন্যে বেসমেন্টে ক্র্যাপবুকটা রেখে দিয়েছিলেন। আপনি চাইলে এরকম আরও উপহার দেয়া হবে।”

“হ্যা…আমি চাই।” জ্যাকের গলায় অধীর আগ্রহ প্রকাশ পেল।

“ম্যানেজারসাহেব ভাবছেন যে আপনি ওভারলুকের জন্যে অনেক কিছু করতে পারবেন। আপনি যদি আমাদের একজন হয়ে যান, তাহলে আপনার দ্রুত উন্নতি হবে। কে জানে, একসময় হয়তো আপনি নিজেই ম্যানেজার হয়ে যাবেন।”

“সত্যি?”

“জি স্যার। আমাকেই দেখুন না, আমি হাইস্কুলও পাশ করিনি। কিন্তু এখানে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ চাকরি আছে। আর আপনি শিক্ষিত মানুষ, আপনার ভবিষ্যৎ তো উজ্জ্বল। কিন্তু এসবকিছুই আসলে নির্ভর করছে আপনার ছেলের উপর। ও কি রাজী হবে আপনি এখানে থেকে যেতে চাইলে?”

“ড্যানি?” জ্যাক ভ্রু কুঁচকালো। “আমার চাকরির ব্যাপারে কি আমি ওর কাছে উপদেশ চাবো নাকি? না, না, আমি যা বলব তাই হবে।”

“তাহলে আপনি দেখবেন যাতে ড্যানি কোন ঝামেলা না করে?”

“হ্যা, অবশ্যই।” জ্যাকের চোখের গভীরে রাগের একটা স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠল।

“চমৎকার। আসুন আমার সাথে।”

জ্যাক গ্রেডির পিছে হাঁটতে লাগল। ওর হাতের গ্লাসটা আবার কখন মদে ভরে উঠেছে ও খেয়ালই করে নি। দুই ঢোকে ও গ্লাসটা খালি করে দিল। আশেপাশে মানুষের হইহল্লা কমেনি। উচ্চস্বরে নৃত্যসঙ্গীত ভেসে আসছে বলরুমের ভেতর থেকে।

গ্রেডি ওকে একটা ফায়ারপ্লেসের সামনে নিয়ে এল। ফায়ারপ্লেসটার ওপর একটা তাকে একটা ঘড়ি রাখা। ঘড়িটা একটা কাঁচের গম্বুজে ঢাকা। দু’পাশে রুপোর হাতির মূর্তি। জ্যাক বিরক্ত হল। গ্রেডি ওকে একটা ঘড়ি দেখাবার জন্যে নিয়ে এসেছে? ও ঘুরে প্রশ্নটা করতে গেল, কিন্তু গ্রেডি উধাও হয়ে গিয়েছে।

“সময় হয়ে গিয়েছে!” ডারওয়েন্টের গলা ভেসে এল। “মুখোশ খুলবার সময় হয়ে গিয়েছে!”

ঘড়িটায় একটা সুরেলা ঘণ্টা বেজে উঠল। চোখ সেদিকে ফেরাতে জ্যাক দেখতে পেল কাঁচের গম্বুজটার ভেতর দু’টো ছোট্ট পুতুল বেরিয়ে এসেছে। একজনেরর হাতে একটা হাতুড়ি। অন্য পুতুলটা একটা বাচ্চা ছেলে। পুতুলদু’টো একটা আরেকটার দিকে এগিয়ে এল। লোকটার হাতুড়ি দড়াম করে নেমে এল বাচ্চাটার মাথার ওপর। এক ঝলক রক্ত ছিটকে এসে কাঁচে লাগল।

(কিন্তু পুতুলটার ভেতর থেকে রক্ত বের হল কিভাবে)

আরেকবার আছড়ে পড়ল হাতুড়িটা। আরেকবার। আরেকবার। রক্তে এখন পুরো গম্বুজটা ঢেকে গিয়েছে।

(লাল মৃত্যু সবার দিকে ধেয়ে আসছে! )

হঠাৎ জ্যাক অনুভব করল পেছনে সবকিছু নিস্তব্ধ হয়ে গেছে। ও ঘুরল। কোথাও কেউ নেই।

ওর মাথা প্রচণ্ড দপদপ করছে।

অধ্যায় ৪৩ – ওয়েন্ডি

দুপুরবেলা।

ওয়েন্ডি আর ড্যানি সারা সকাল নীচতলা থেকে জ্যাকের গলা শুনতে পেয়েছে। জ্যাক চিৎকার করেছে, নিজের সাথে কথা বলেছে, গান গেয়েছে, এমনকি কুকুরের ডাকও ডেকেছে। ওয়েন্ডির এখন আর কোন সন্দেহ নেই যে ওর স্বামী পাগল হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গত একঘণ্টা যাবত নীচে সবকিছু নিস্ত ব্ধ। ওয়েন্ডি আর থাকতে না পেরে নীচে নামল কি হয়েছে দেখবার জন্যে। তবে নামার আগে ছুরিটা তোয়ালেতে পেঁচিয়ে নিজের গাউনের পকেটে নিতে ভুলল না।

ও সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে কয়েকবার ‘জ্যাক,’ ‘জ্যাক’ বলে ডাকল। কোন জবাব নেই। ও জবাব আশাও করছিল না। জ্যাকের গলা শেষ শোনা গেছে লাউঞ্জের ভেতর থেকে। ওয়েন্ডি সেদিকেই হাঁটা দিল।

লাউঞ্জের দরজা ঠেলে ঢুকতেই মদের কড়া গন্ধ এসে ধাক্কা দিল ওর নাকে। কিন্তু গন্ধটা এল কোত্থেকে? বারের শেলফে তো কোন মদের বোতল নেই।

ও একটু সামনে এগিয়ে দেখতে পেল যে জ্যাক হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে শুয়ে আছে। ওকে দেখে ওয়েন্ডির রাগ পড়ে গেল। কি অসহায় লাগছে জ্যাককে দেখতে! যেন কোন বাচ্চা ছেলে অনেকক্ষণ ছুটোছুটি করে ক্লান্ত হয়ে মাটিতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ও দ্রুত পায়ে নিজের স্বামীর দিকে এগিয়ে গেল।

“জ্যাক! জ্যাক, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?”

“পেয়েছি তোকে!” জ্যাকের একটা হাত খপ করে ওয়েন্ডির পায়ের গোড়ালী ধরে ফেলল। জ্যাক জেগেই ছিল। ওর মুখে একটা কুটিল হাসি দেখা দিল। হাসিটা দেখে ওয়েন্ডির মনে একটা ভয় ফিরে এল, অনেক পুরনো একটা ভয়, যে ওর মাতাল স্বামী ওকে একদিন মেরে ফেলবে।

“জ্যাক? চল তোমাকে উপরে নিয়ে যাই, তোমার অবস্থা বেশী ভাল নয়-”

“তোর আর ড্যানির তো খুব শখ এখানে থেকে ভাগার, তাই না? আজ পেয়েছি তোকে—” জ্যাকের আঙুল আরও শক্ত করে চেপে বসল ওয়েন্ডির গোড়ালীতে। ও আরেকহাতে ভর দিয়ে নিজের হাঁটুর ওপর উঠে বসল।

“জ্যাক, আমি পায়ে ব্যাথা পাচ্ছি!”

“তোর পা তো সবে শুরু, হারামজাদী!”

কথাটা শুনে ওয়েন্ডি স্তম্ভিত হয়ে গেল। ও নড়াচড়া করছে না দেখে জ্যাক ওর পা ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ও এখনও একটু টলছে।

“তুই আমাকে কখনওই ভালবাসতি না। এজন্যেই তুই এখান থেকে চলে যেতে চাস। জানিস না যে এখান থেকে চলে গেলে আমি শেষ হয়ে যাবো? আমার এখানে অনেক দা…দা…দায়িত্ব আছে। সবসময় তুই চাস আমাকে ছোট করতে। তুই নিজের মায়ের মতই হয়েছিস।”

“জ্যাক, থামো। তুমি মাতাল।” ওয়েন্ডি কাঁদতে কাঁদতে বলল। “আমি জানি না তুমি মদ কোথায় পেলে, কিন্তু তুমি মাতাল।”

“আমি জানি তুই আর তোর ছেলে মিলে আমার বিরুদ্ধে গুটি চালছিস। আমি জানি। চালছিস না?”

“না জ্যাক, প্লিজ, তুমি নিজেও জানো না তুমি কি আবোল-তাবোল বকছো—”

“মিথ্যুক!” জ্যাক চেঁচিয়ে উঠল। “আমি তোদের চিনি না মনে করেছিস? তুই আর ড্যানি মিলে আমার জীবন হারাম করে দিয়েছিস।”

ওয়েন্ডির মুখ থেকে আর কোন কথা বের হল না। জ্যাকের চোখে খুনীর দৃষ্টি। ও ওয়েন্ডিকে আসলেই মেরে ফেলতে চায়। তারপর ও ড্যানিকে মারবে। শেষে ওর আত্মহত্যার পর হোটেলটা শান্ত হবে।

“সবচেয়ে খারাপ জিনিস কি জানিস? তুই আমার নিজের ছেলেকে আমার বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়েছিস। তুই আমাদের সবসময় হিংসা করতি, তাই না? ঠিক তোর মায়ের মত।”

ওয়েন্ডি নির্বাক।

“দাঁড়া, তোকে মজা দেখাচ্ছি,” জ্যাক বলল। ও নিজের দুই হাত এগিয়ে দিল ওয়েন্ডির গলার দিকে।

ওয়েন্ডি এক পা পিছিয়ে গেল। ওর মনে পড়ল যে ওর পকেটে ছুরিটা আছে, আর ও সেটা বের করবার জন্যে হাত বাড়াল। কিন্তু পকেট পর্যন্ত পৌঁছাবার আগেই জ্যাক ওর হাত ধরে ফেলল। তারপর মুচড়ে ওর পিঠের দিকে নিয়ে এল। জ্যাকের শরীর থেকে মার্টিনি আর ঘামের গন্ধ ভেসে আসছে।

ওর আরেক হাত ওয়েন্ডির গলায় চেপে বসল।

ওয়েন্ডি পাগলের মত হাত পা ছুঁড়তে শুরু করল। কিন্তু জ্যাকের শক্তির সাথে ও কিছুতেই এঁটে উঠতে পারছিল না।

এমন সময় পেছন থেকে ড্যানির তীক্ষ্ণ গলা ভেসে এল : “বাবা! আম্মুকে ছেড়ে দাও! তুমি আম্মুকে ব্যাথা দিচ্ছ!”

তারপরে কি হল সেটা ওয়েন্ডি ঠিক বুঝতে পারে নি। একটা হুটোপুটি হল, ও দেখল যে ড্যানি বারের ডেস্কটার ওপর থেকে জ্যাকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। জ্যাকের হাত ওয়েন্ডির শরীর থেকে সরে গেল।

কিন্তু ড্যানির দুঃসাহসী প্রচেষ্টা কাজে লাগল না। জ্যাক এক ঝটকায় ড্যানিকে ছিটকে ফেলল। ওর দুই হাতের আঙুল আবার চেপে বসল ওয়েন্ডির গলায়। ওয়েন্ডির চোখের সামনে সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসতে লাগল।

ওয়েন্ডির হাত পাগলের মত মাটিতে কিছু একটা খুঁজে বেড়াচ্ছিল যেটা ওকে এখান থেকে বাঁচতে সাহায্য করবে। আশ্চর্যজনকভাবে ও তেমন একটা জিনিস পেয়েও গেল। একটা খালি ওয়াইনের বোতল, যেটা বারে মোমবাতিদান হিসাবে ব্যাবহার করা হয়। ওর আঙুলগুলো আঁকড়ে ধরল বোতলটাকে,তারপর মাথার ওপর ওঠালো, আর সরাসরি নামিয়ে আনল জ্যাকের মাথায়।

জ্যাক ছেড়ে দিল ওয়েন্ডিকে। ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও বুঝতে পারছে না ও কোথায় আছে। কিছুক্ষণ এলোমেলো পা ফেলে ও আছড়ে পড়ল মাটিতে।

ওয়েন্ডি একটা লম্বা, কান্নাজড়ানো নিশ্বাস নিল। ও কোনমতে ডেস্কের ওপর ভর দিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর চোখ গেল ড্যানির দিকে। ড্যানি চোখে অবিশ্বাস নিয়ে নিজের অজ্ঞান বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

“ড্যানি…শোন…” ওয়েন্ডির কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। ওর গলা এখনও ব্যাথা করছে। “যে আমাকে ব্যাথা দিতে চেয়েছে সে তোমার বাবা নয়। হোটেলটা ওর ভেতরে ঢুকে গিয়েছে ড্যানি…তাই আমি ওকে বাধ্য হয়ে ব্যাথা দিয়েছি।” ও কাশতে ওর মুখ থেকে এক ঝলক রক্ত বেরিয়ে এল।

“হোটেলটা আস্তে আস্তে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে ড্যানি…ওটা এখন তোমার বাবাকে পুরোপুরি বশে এনে ফেলেছে। তুমি কি বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?”

ড্যানির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ও আস্তে করে মাথা নাড়ল।

“আমি জানি তুমি তোমার বাবাকে অনেক ভালবাসো। আমিও। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে যে এই লোকটা আর তোমার বাবা নয়। ওভারলুক ওকে পুরোপুরি বদলে ফেলেছে।”

“আমি চাই বাবা আবার ভাল হয়ে যাক।” অবশেষে ড্যানির চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে এল।

“আমিও সেটা চাই ড্যানি, কিন্তু আমাদের এখন কোন ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না,” ওয়েন্ডি এগিয়ে গিয়ে ড্যানিকে জড়িয়ে ধরল। “আমাদের ওকে এমন একটা জায়গায় রাখতে হবে যেখানে ও আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না। পরে…যদি হ্যালোরান, বা পার্ক রেঞ্জাররা আসে, তাহলে ওরা আমাদের নীচে নিয়ে যেতে পারবে। আমাদের এখন সাহসী হতে হবে, বুঝেছ, বাবা?”

ড্যানি মাথা ঝাঁকাল। “আমারও মনে হয়…বাবাকে এখন আমাদের থেকে একটু দূরে রাখলেই ভাল। কিন্তু কোথায়?”

“প্যান্ট্রিতে! যেটা হ্যালোরান আমাদের প্রথম দিন দেখিয়েছিল। ওখানে অনেক খাবার আছে, তোমার বাবা চাইলে পুরো শীতকালই ওখানে কাটিয়ে দিতে পারবে। আর আমরা কিচেনে আর ফ্রিজে রাখা খাবার খেয়ে থাকব। তবে ড্যানি, আমাদের এখনই যেতে হবে, তোমার বাবার জ্ঞান ফিরবার আগে। আমরা এখন ওকে বয়ে নিয়ে যেতে পারব। কিন্তু জ্ঞান ফিরলে ও সেটা করতে দিবে কিনা সন্দেহ আছে।”

ওরা কাজে লেগে গেল। জ্যাককে ধরাধরি করে প্যান্ট্রি পর্যন্ত নিয়ে আসতে ওয়েন্ডির ঘাম ছুটে গেল। ড্যানি সাহায্য করতে চাইলেও পারছিল না, ও এত ছোট যে ও বাবাকে একদিকে ধরলে উলটো আম্মুর আরও কষ্ট হত। ওয়েন্ডি জ্যাককে প্যান্টির ভেতর শোয়ালো। ওর অজ্ঞান দেহ বয়ে আনতে গিয়ে ওয়েন্ডির এই শীতেও ঘাম ছুটে গেছে।

ও প্যান্টির দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে দেখে আরেক বিপদ। দরজার একটা কব্জা ঠাণ্ডায় জমে গিয়েছে। খুলবার সময় কোন সমস্যা হয় নি, কিন্তু এখন দরজাটা কিছুতেই বন্ধ হচ্ছে না। ও দরজা নিয়ে ধস্তাধস্তি করবার সময় কিছুক্ষণের জন্যে ওর আর ড্যানির দু’জনেরই জ্যাকের দিকে খেয়াল ছিল না।

ঠিক তখনই জ্যাক চোখ মেলল।

“ওয়েন্ডি?”

ডাকটা শুনবার সাথে সাথে ওয়েন্ডি আতংকে জমে গেল। কিন্তু ড্যানি ঘাবড়াল না। ও চেঁচিয়ে উঠল, “আম্মু! দরজাটা বন্ধ কর, এখনই!”

ওয়েন্ডি ওর গলা শুনে সম্বিত ফিরে পেল। ও প্রাণপণে টান দিল দরজার হাতল ধরে।

ওদের পেছনে জ্যাক উঠে দাঁড়িয়েছে। ও এখনও টলছে, আর ওর চোখের দৃষ্টি এখনও ভয়ংকর। “কি করছিস তোরা?” ও খেঁকিয়ে উঠল।

ওয়েন্ডি ড্যানিকে একঝটকায় কোলে নিয়ে নিল। ও দেখতে পাচ্ছিল যে জ্যাক ওদের ওপর ঝাঁপ দেবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। শেষ একটা টান দিতে দড়াম করে দরজাটা বন্ধ। আর জ্যাকও ঠিক সেই মুহূর্তেই ঝাঁপ দিল। দরজাটা বন্ধ হবার এক সেকেন্ড পর জ্যাকের শরীর দরজার ওপাশে আছড়ে পড়ল।

“বের হতে দে আমাকে এখান থেকে! তোদের দু’টোকেই আমি ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলব! দরজা খোল!”

ড্যানি বারবার নিজেকে বলতে লাগল : “ওটা বাবা, নয় হোটেলটা। ওটা বাবা নয়।”

ওর মুখ ভয়ে সাদা হয়ে গেছে।

অধ্যায় ৪৪ – জ্যাক

বেলা ৩টা।

জ্যাক প্যান্ট্রির ভেতর বসে ফুঁসছিল। ওয়েন্ডি আর ড্যানির কোন সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই নিজেদের রুমে বসে আরাম করছে। ওকে এখানে আটকে রেখে। কত বড় সাহস হারামীদের!

ও এখন বুঝতে পারছে ওর বাবা ওদের কেন এত মারতো। দোষ আসলে বাবার ছিল না। ওরা সবাই ছিল অকৃতজ্ঞ। লোকটা সারাদিন খাটতো নিজের পরিবারের জন্যে, আর দিন শেষে বাসায় ফিরে কি হত? সবার একশত বায়নাক্কা, বাবা আমার সাথে খেলো, বাবা আমার স্কুলের পড়ায় সাহায্য কর, মার্ক আমাকে রান্নায় সাহায্য কর। ওরা কখনওই বাবার যেসব কঠিন দায়িত্ব পালন করতে হয় সেগুলোর ব্যাপারে জানত না, আর জানবার চেষ্টাও করে নি। অকৃতজ্ঞের দল। ঠিক যেমন ড্যানি আর ওয়েন্ডি এখন ওর সাথে করছে। জ্যাক শুধু চায় ওদের ভাল করতে, আর ওরা জ্যাককে বন্দী করে রেখেছে এখানে!

“চিন্তা করছেন কেন স্যার, আমরা তো আছি আপনার পাশে।” দরজার ওপাশ থেকে মসৃণ একটা গলা ভেসে এল জ্যাকের কানে।

জ্যাক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

“গ্রেডি? এটা কি তুমি নাকি?”

“জি স্যার, আমিই। আপনি তো এখানে আটকে গেছেন দেখছি।”

“আমাকে বের হতে দাও গ্রেডি, এক্ষণি। ওরা আমাকে এখানে বন্দী করে রেখেছে এখানে।”

“ওরা? একটা মেয়ে আর একটা বাচ্চা ছেলে? ম্যানেজারসাহেব তো এটা শুনলে খুশি হবেন না, স্যার।”

রাগে আর লজ্জায় জ্যাকের কান লাল হয়ে গেল। “আমাকে বের হতে দাও, গ্রেডি। আমি ওদের মজা দেখাচ্ছি।”

“তা কি আপনি পারবেন, স্যার? আমাদের তো আপনার ওপর ভালই ভরসা ছিল, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে হয়তো আমরা ভুল মানুষের সাথে কথা বলেছি। আপনার বৌকে তো আপনার চেয়ে চালাক মনে হচ্ছে। হয়তো আপনার বদলে ওনার সাথে যোগাযোগ করলেই ভাল হত।”

“গ্রেডি, আমাকে একবার বের হতে দিয়ে দেখ আমি ওদের কি অবস্থা করি।”

“আপনার ছেলেকে কি আপনি আমাদের হাতে তুলে দেবেন?”

“হ্যা!”

“আপনার বৌ আপনাকে সেটা সহজে করতে দেবে না, স্যার,” গ্রেডি ঠাণ্ডা গলায় বলল। “আপনার ওনাকে মেরে ফেলতে হবে।”

“যদি তাই করতে তাহলে করব!”

খট করে একটা শব্দ হয়ে দরজাটা খুলে গেল। জ্যাক দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে এল বাইরে। ওর মুখে বিজয়ীর হিংস্র হাসি। ও দেখল যে গ্রেডি যাবার আগে ওর জন্যে একটা উপহার রেখে গেছে।

ওর সামনে, মেঝেতে শোয়ানো একটা রোকে খেলার হাতুড়ি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *