শাইনিং – ৩৫

অধ্যায় ৩৫ – লবিতে

ড্যানি নিজের বাবা-মাকে সবকিছুই খুলে বলল, শুধু সুড়ঙ্গের ভেতর কি হয়েছিল সেটা বাদে। ওর কেন যেন সুড়ঙ্গের কথাটা আবার মনে করতেই ইচ্ছা হচ্ছিল না। কিন্তু ও বলল কিভাবে সবগুলো জন্তুর শরীর থেকে বরফ ঝরে পড়েছিল, কিভাবে ওরা নেমে এসেছিল নিজেদের জায়গা থেকে।

ওরা তিনজন লবিতে বসে আছে, ফায়ারপ্লেসের পাশের সোফাটায়। জ্যাক ফায়ারপ্লেসে একটা বড় আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। ড্যানি সোফাটায় শুঁটিসুটি হয়ে বসে সুপে চুমুক দিচ্ছে। ওয়েন্ডি বসে আছে ওর পাশে, ওর মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আর জ্যাক বসে আছে মেঝেতে। ড্যানির গল্পটা শুনতে শুনতে শুর মুখ শক্ত হয়ে গেল।

ড্যানির এখনও ঘটনাটা মনে করে শরীর কাঁপছিল। কিন্তু তাও ও নিজের মনকে দৃঢ় রাখল, যাতে ও না কাঁদে। ও যদি গল্পটা বলতে গিয়ে কান্নাকাটি করে, হাত পা ছোঁড়াছুঁড়ি করে, (যেমন এখন করতে ইচ্ছা হচ্ছে), তাহলে বাবা-মা মনে করবে মিস্টার স্টেঙ্গারের মত ওরও মাথা খারাপ হয়ে গেছে।

ও গল্পটা শেষ করবার পর জ্যাক উঠে জানালার কাছে গেল। “ড্যানি, এদিকে আয়।” ও ডাকল ছেলেকে।

ড্যানি খেয়াল করল যে বাবার মুখে কালো মেঘ জমেছে। এই চেহারাটা দেখলে ওর ভয় হয়।

“জ্যাক…”

“আমি চাই ও শুধু একমিনিটের অন্যে এখানে আসুক।” ড্যানি সোফা থেকে নেমে এগিয়ে এল বাবার দিকে।

“গুড। এখন বাইরে তাকা। কি দেখতে পাচ্ছিস?”

ড্যানি তাকাবার আগেই জানত ও কি দেখতে পাবে। সামনে ধুধু সাদা বরফের মধ্যে পায়ের দাগের দু’টো সারি। একটা হোটেল থেকে প্লেগ্রাউন্ডের দিকে গেছে, আরেকটা প্লেগ্রাউন্ড থেকে হোটেলের দিকে ফিরে এসেছে।

“শুধু আমার পায়ের ছাপ, কিন্তু বাবা—”

“আর ওই জন্তুগুলো?”

ড্যানির ঠোঁট কাঁপতে শুরু করল। কিন্তু আমি এখন কাঁদব না, ও আবার মনে করিয়ে দিল নিজেকে।

“সবগুলো বরফে ঢাকা।” ও ফিসফিস করে বলল। “কিন্তু বাবা -”

“জ্যাক, তুমি ওকে জেরা করছ-”

“তুমি চুপ থাকো! কি, ড্যানি?”

“ওরা পায়ে থাবা মেরেছে…

“তুমি যে বরফে পিছলে পা কেটে ফেলনি সেটা আমরা কিভাবে বুঝব?”

ওয়েন্ডি ওদের দু’জনের মাঝখানে এসে দাঁড়াল। “তোমার হয়েছেটা কি, জ্যাক?” ও রাগী স্বরে প্রশ্ন করল। “ড্যানি কোন অপরাধ করে নি যে তুমি ওকে এভাবে জেরা করবে।”

জ্যাকের চোখের ঘোরটা যেন হঠাৎ কেটে গেল। “আমি ওকে বাস্তব আর কল্পনার পার্থক্য বোঝাবার চেষ্টা করছি।”

ও হাঁটু গেড়ে বসে ড্যানিকে জড়িয়ে ধরল। “ড্যানি, আসলে কিছু হয় নি, বুঝলি। তুই বোধহয় তোর একটা ঘোরের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিলি।”

“বাবা?”

“কি, ড্যান?”

“আমি পিছলে পড়ে পা কাটিনি। আমার পায়ে নখের দাগ পড়েছে।” ড্যানি অনুভব করল ওর বাবার শরীর আবার শক্ত হয়ে যাচ্ছে।

“তাহলে হয়তো সিঁড়ির কোণায় লেগেছে।”

হঠাৎ করে ড্যানি বাবার হাত ছুটিয়ে সরে এল। ওর মাথায় বিদ্যুচ্চমকের মত একটা চিন্তা খেলে গেছে।

“তুমি জানো যে আমি সত্যি কথা বলছি!” ও ফিসফিস করে বলল।

“তুমি জানো কারণ তুমি নিজেও দেখেছ-”

জ্যাকের হাত বিদ্যুতের মত ড্যানির গালে আছড়ে পড়ল। এক সেকেন্ডের মধ্যে ওর ফর্সা গালে জ্যাকের পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গেল।

ওয়েন্ডির মুখ থেকে একটা মৃদু গোঙ্গানী বেরিয়ে এল।

এক মুহূর্তের জন্যে ওরা তিনজন একটুও নড়ল না, তারপর জ্যাক সচকিত হয়ে নিজের ছেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল : “সরি ড্যানি, সরি, তুই ঠিক আছিস তো?”

“তুমি ওকে মারলে! শয়তান কোথাকার! তুই কখনওই বদলাবি না!” ওয়েন্ডি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।

ওয়েন্ডি ড্যানিকে একটা বাচ্চাদের অ্যাসপিরিন খাইয়ে দিয়েছে। জ্যাক ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়েছে। এখন ও নিশ্চিন্তে নিজের বুড়ো আঙুল চুষতে চুষতে ঘুমাচ্ছিল।

ওয়েন্ডি ব্যাজার মুখে বলল, “ড্যানি তো মাঝখানে আঙুল চোষা ছেড়ে দিয়েছিল। এই বদভ্যাসটা আমার মোটেও পছন্দ নয়।”

জ্যাক কিছু বলল না।

ওয়েন্ডি ওর দিকে তাকাল। “আমি যেটা বলেছি সেটার জন্যে কি তুমি রাগ করে আছো? বেশ, আমি ক্ষমা চাচ্ছি। কিন্তু তাই বলে তোমার ওকে মারা উচিত হয় নি।”

“আমি জানি,” জ্যাক বিড়বিড় করে বলল। “আমি জানি সেটা। এখন আমি পস্তাচ্ছি। আমার উপর কি ভর করেছিল কে জানে?”

“তুমি কথা দিয়েছিলে যে ওকে আর মারবে না।”

জ্যাক ক্ষিপ্তচোখে ওয়েন্ডির দিকে তাকাল, কিন্তু পরমুহূর্তেই ওর রাগ নেমে গেল। জ্যাকের এই চেহারাটা দেখে ওয়েন্ডির একটু ভয় হল। ওকে কি অসহায়, ভগ্ন লাগছে দেখতে।

“আমি ভেবেছিলাম আমি সবসময় নিজের কথা রাখি।”

ওয়েন্ডি এসে ওর দুই হাত নিজের হাতে তুলে নিল। “যা হবার হয়ে গেছে। এখন ভুলে যাও। রেঞ্জার আসলে তো আমরা সবাই নীচে যাচ্ছি, তাই না?”

জ্যাক মাথা নাড়ল, “হ্যা।” এবার ও সত্যি সত্যি নীচে যেতে চায়। কিন্তু ওর যখন মদের নেশা ছিল, তখন প্রত্যেকদিন সকালে উঠেই ও এমন করে মদ ছেড়ে দেবার কথা ভাবত। এবার সত্যি সত্যি ছেড়ে দেব। আর নয়। কিন্তু সেদিন রাতেই আবার ও বাসায় ফিরত মাতাল হয়ে, মুখে কড়া অ্যালকোহলের গন্ধ।

ও মনে মনে চাচ্ছিল যাতে ওয়েন্ডি ওকে জিজ্ঞেস করে টপিয়ারিতে ওর সাথে কি হয়েছিল-ড্যানিকে মারার আগে ও কি নিয়ে কথা বলছিল। ও একবার জিজ্ঞেস করলেই জ্যাক সবকিছু বলে দেবে। শুধু একবার।

তার বদলে ওয়েন্ডি যে প্রশ্নটা করল সেটা হচ্ছে, “তুমি চা খাবে?

“হ্যা, এক কাপ চা হলে মন্দ হয় না।”

“এমন না যে দোষ তোমার একার,” ওয়েন্ডি বলল। “আমার উচিত ড্যানির ওপর সবসময় চোখ রাখা। আর ওর যখন বিপদ হল তখন আমি কি করছিলাম? নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে ছিলাম হোটেলের ভেতরে।”

“বাদ দাও ওয়েন্ডি, এখন তো বিপদ কেটে গেছে, তাই না?”

“না,” ওয়েন্ডি- জ্যাকের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত করে হাসল। “আমার মনে হয় না বিপদ এখনও গেছে।”

অধ্যায় ৩৬ – লিট

জ্যাক আবার ঘুমের মধ্যে দুঃস্বপ্ন দেখছে। বিশাল বিশাল যন্ত্র ওকে তাড়া করছে, আর ও পালাবার কোন পথ খুঁজে পাচ্ছে না। যন্ত্রগুলোর চলবার সময় ঘটাং ঘটাং করে শব্দ হচ্ছিল। হঠাৎ করে ওয়েন্ডি লাফ দিয়ে ওর পাশে উঠে বসল। আর জ্যাক জেগে ওঠার পর শুনতে পেল কোন জায়গা থেকে আসলেই ঘটাং ঘটাং শব্দ আসছে।

“কিসের আওয়াজ?” ওয়েন্ডি ভয়ার্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। ওর প্রশ্নটা শুনে জ্যাক বিরক্ত হল। কিসের আওয়াজ সেটা ও কিভাবে জানবে? বিছানার পাশে রাখা ঘড়িটায় ও দেখল যে রাত বারোটা বাজতে আর পাঁচ মিনিট বাকি আছে।

আবার শব্দটা ভেসে এল। একটা যান্ত্রিক গুঞ্জনের মত। এবার জ্যাক বুঝতে পারল শব্দটা কোথা থেকে আসছে। লিফট থেকে।

ড্যানি ঘুম থেকে উঠে বসল। “বাবা? বাবা?” ওর গলায় ভয় আর ঘুমে জড়ানো।

“আমরা এখানেই আছি, ডক,” জ্যাক ওকে অভয় দিল। “আমাদের সাথে এসে শুয়ে পড়। তোর মাও জেগে গেছে।”

ড্যানি উঠে এসে ওদের মাঝখানে শুয়ে পড়ল। “শব্দটা লিফট থেকে আসছে।” ও ভয়ে ভয়ে বলল।

“হ্যা ডক। লিফটের শব্দ। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।”

“কি বল তুমি, ভয়ের কিছু নেই মানে? এত রাতে লিফট কে চালাচ্ছে?” ওয়েন্ডি আবার আতংকিত গলায় প্রশ্ন করল।

আবার গুঞ্জন। একবার লিফটটা চলছে, আবার থামছে।

ড্যানি কম্বলের নীচে ফোঁপাতে শুরু করল।

জ্যাক বিছানা থেকে নামবার উদ্যোগ নিল। “কোন শর্ট সার্কিট হয়েছে বোধহয়। যেয়ে দেখে আসি।”

ওয়েন্ডি খপ করে ওর হাত ধরে ফেলল। “তাহলে আমরাও তোমার সাথে যাব।”

“ওয়েন্ডি—”  

কিন্তু ওয়েন্ডি জ্যাকের আপত্তি না শুনে ওর পিছে পিছে এল। ড্যানিকেও নিয়ে এল ওর সাথে।

জ্যাক তাড়াহুড়ো করে এগিয়ে এল ওদের দু’জনকে পেছনে ফেলে। ও করিডরের লাইটগুলো না জ্বালিয়েই আগাচ্ছিল। তাই ওয়েন্ডি আর ড্যানি ওর পিছে আসতে আসতে লাইটগুলো জ্বালিয়ে দিল।

জ্যাক হঠাৎ করে থমকে দাঁড়াল। ওয়েন্ডিরা দেখতে পেল জ্যাক লিফটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছে।

ড্যানির হাত ওয়েন্ডির হাতে শক্ত হয়ে চেপে বসল। ওয়েন্ডি ছেলের দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল যে ওর চেহারায় ভয় আর দুশ্চিন্তা ফুটে উঠেছে।

“আসো আমার সাথে।” ও বলল। ওরা দু’জন হেঁটে জ্যাকের কাছে গেল।

এখনও গুঞ্জন আর ঘটাং ঘটাং শব্দগুলো থামে নি। জ্যাক এখনও একদৃষ্টিতে লিফটের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে।

হঠাৎ করে ওয়েন্ডির চোখের সামনে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল, জাগ্রত অবস্থায় স্বপ্ন দেখার মত। একটা পার্টি। একটা ব্যান্ড গান বাজাচ্ছে…চারদিকে চোখ ধাঁধানো আলো। আর সবাই…দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের পোশাক পড়ে আছে? কি এসব?

ও ড্যানির দিকে তাকাল। ড্যানিকে দেখে মনে হচ্ছে যে ও কিছু একটা শুনতে পাচ্ছে যেটা অন্য কেউ শুনতে পাচ্ছে না। ওর মুখ একদম ফ্যাকাশে।

ঘটাং করে একটা শব্দ। লিফটটা ওদের সামনে এসে থেমেছে।

আস্তে আস্তে, মসৃণভাবে দরজাটা খুলে গেল। লিফটের লাইটের আলো এসে পড়ল ওদের সবার গায়ে। ভেতরে কেউ নেই।

(কিন্তু পার্টির রাতে লিফটটা একদম ভর্তি ছিল, তাই না? কোলাহলে মুখরিত ছিল লিফটের ছোট্ট ঘরটা…সবাই মুখোশ পড়ে আছে কেন?)

আবার ঘটাং। লিফটের দরজা বন্ধ হল। লিফটটা নীচে নেমে গেল।

“ব্যাপার কি?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল। “লিফটটার কি হয়েছে?”

“শর্ট সার্কিট, বললাম তো তোমাকে।” জ্যাক জবাব দিল। ওর মুখটা দেখতে পুতুলের মুখের মত প্রাণহীন লাগছে।

“আমার চোখের সামনে বারবার একটা পুরনো দৃশ্য ভেসে উঠছে!” ওয়েন্ডি চিৎকার করে বলল। “হে ঈশ্বর, জ্যাক, আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছি?”

“কি দৃশ্য?” জ্যাক ভাবলেশহীন গলায় জিজ্ঞেস করল।

ওয়েন্ডি ড্যানির দিকে তাকাল। “ড্যানি, তুমি দেখেছ?”

ড্যানি মাথা নাড়ল। “হ্যা। আমি গানও শুনতে পাচ্ছি।”

“আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। তোমরা দু’জন মিলে পাগলামি করতে চাও, সেটা তোমাদের ব্যাপার। কিন্তু আমি তোমাদের খেলায় সামিল হতে রাজী নই।”

লিফটটা আবার চলছে।

জ্যাক ডান দিকে সরে এল। এখানে দেয়ালের সাথে একটা কাঁচের বাক্স লাগানো আছে। ও এক ঘুষিতে বাক্সটা ভেঙ্গে ভেতর থেকে একটা চাবি বের করল। ওর হাত কেটে রক্ত পড়ছিল, কিন্তু ও পাত্তা দিল না।

“জ্যাক, প্লিজ, আমার কথা শোন…” ওয়েন্ডি জ্যাকের হাত ধরে বলল।

জ্যাক এত জোরে ওকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল যে ও আছড়ে পড়ল মাটিতে। ড্যানি কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পাশে বসল। “আমাকে আমার কাজ করতে দাও।” জ্যাক বলল।

লিফটটা আবার এসে ওদের সামনে থামতেই জ্যাক ওর হাতের চাবিটা লিফটের দরজার গায়ে একটা ফুটোতে ঢুকিয়ে দিল। ক্যাঁচ শব্দ করে লিফটটা দাঁড়িয়ে গেল। জ্যাক ঘুরে ওয়েন্ডি আর ড্যানির দিকে তাকাল। ওয়েন্ডি এখন উঠে বসেছে। ড্যানি একটা হাত রেখেছে মায়ের কাঁধে।

“ওয়েন্ডি, আমার… চাকরিই এটা…”

“জাহান্নামে যাক তোমার চাকরি।” ওয়েন্ডি পরিষ্কার গলায় বলল।

জ্যাক ঘুরে আবার লিফটের দিকে তাকাল। দরজাদু’টোর মাঝখানে যে ছোট্ট ফাঁকটা আছে সেখানে ও আঙুল ঢুকিয়ে জোরে দু’দিকে ঠেলা দিতে দরজাটা খুলে গেল।

“কিছুই নেই ভেতরে,” জ্যাক বলল। “যা ভেবেছিলাম। শর্ট সার্কিটই হয়েছে।”

হঠাৎ করে জ্যাকের কাঁধে একটা হাত এসে পড়ল। ওয়েন্ডি। জ্যাক কিছু বলার আগেই ও টান দিয়ে জ্যাককে সরিয়ে দিল পিছে। আর লিফটটার ভেতরে ঢুকে ছাদের দিকে তাকাল।

“ওয়েন্ডি, কি করছ তুমি-” জ্যাকের গলায় রাগের চেয়ে বেশী বিস্ময়।

ওয়েন্ডি ছাদে হাত দিয়ে কি যেন বের করে আনল। তারপর মুঠো মেলল জ্যাকের সামনে। করিডরের আলোতে ওর হাতে ঝিলিক দিয়ে উঠল একটা মুখোশ।

“এটা কি জ্যাক? এটাও কি শর্ট সার্কিটের জন্যে হয়েছে?” ওয়েল্ডি চিৎকার করে বলল।

জ্যাক বোকার মত তাকিয়ে রইল মুখোশটার দিকে।

অধ্যায় ৩৬ – বলরম

১লা ডিসেম্বর।

ড্যানি মনে মনে একটা তালিকা করে নিয়েছে। হোটেলের কয়েকটা জায়গা খারাপ, বাকিগুলোতে গেলে কোন অসুবিধা নেই। খারাপ জায়গাগুলো হচ্ছে : লিফট, বেসমেন্ট, প্লেগ্রাউন্ড, রুম ২১৭ আর প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট। কিন্তু ও তখনও জানত না যে একতলায় যে বলরুমটা আছে সেটাও ওর খারাপ জায়গার তালিকায় যোগ হতে যাচ্ছে।

ড্যানি বলরুমটা এমনিই দেখতে এসেছিল। হোটেলে এতদিন থাকবার পরও ওর আগে এখানে আসা হয় নি। রুমটা বেশ বড়, আর হোটেলের অন্যান্য বেশীরভাগ রুমের মতই এটার জানালাও ঢাকা থাকার কারণে রুমটা সবসময় অন্ধকার হয়ে থাকে।

এখানে অনেকগুলো গোল গোল, ছোট টেবিল রাখা। টেবিলগুলো দু’জন মানুষ যাতে মুখোমুখি বসতে পারে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে। প্রত্যেকটা টেবিলের দু’পাশে দু’টো করে চেয়ার উল্টিয়ে রাখা। ড্যানির কাছে মনে হল আম্মু গতকাল যে পার্টির কথা বলছিল সেটা নিশ্চয়ই এখানেই হয়েছে। ও এসে একটা চেয়ার সোজা করে তাতে উঠে বসল। এখানকার মেঝেতে যে কার্পেটটা আছে সেটা যে অনেক দামী তা এক নজরেই বোঝা যায়। লাল আর সোনালী রঙের কার্পেটটা নরম আর চকচকে। বাবা একবার ড্যানিকে বলেছিল নাচবার সময় কার্পেটটা গুটিয়ে একপাশে সরিয়ে রাখা হয়।

পুরো বলরুমটায় ড্যানি ছাড়া কেউ নেই।

কিন্তু তাই বলে রুমটা খালি নয়। এখানে, ওভারলুকে, সবকিছুই অনন্ত কাল ধরে পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। ওভারলুকে সবকিছুই জীবন্ত। এখানে নষ্ট হয়ে যাওয়া ভিডিও টেপের মত একই দৃশ্য বারবার দেখা দেয়। আর এই বলরুমে যে দৃশ্য, যে স্মৃতি বন্দী হয়ে আছে সেটা হচ্ছে ১৯৪৫ সালের একটা পার্টি, যেখানে সবাই মুখোশ পড়ে আছে।

আর এই সবকিছু হচ্ছে ড্যানির কারণে।

ড্যানি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। টনি ওকে সতর্ক করেছিল আসার আগে, কিন্তু ড্যানি তাতে কান দেয় নি। এখন ওর কারণে ওভারলুকের সবগুলো বন্দী

স্মৃতিতে নতুন করে জীবন ফিরে এসেছে।

ও ঠিক করল ও টনিকে আবার ডাকবে। ওর এখন সাহায্য দরকার, উপদেশ দরকার। ও একটা লম্বা দম নিয়ে চোখ বন্ধ করল।

(প্লিজ টনি, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?)

কোন উত্তর নেই। (প্লিজ?)

কোন উত্তর এল না।

ড্যানি আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ মেলল। চোখ খুলবার সাথে সাথে ও দেখতে পেল ওর সামনে, বাতাসে, একটা অন্ধকার গর্ত আবির্ভূত হয়েছে। গর্তটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ড্যানির মনে হল ও পড়ে যাচ্ছে অন্ধকারটার ভেতরে… গভীরে…আরও গভীরে…

ও দৌড়াতে দৌড়াতে প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের সামনে এসে থমকে দাঁড়াল। আর যাবার কোন জায়গা নেই। বুম বুম শব্দটা ওকে এখনও তাড়া করছে, রোকের হাতুড়িটা একটু পরে পরে আছড়ে পড়ছে দেয়ালে।

(বেরিয়ে আয়! আজ তোকে মজা দেখাব-)

কিন্তু ড্যানির সাথে এখানে আরও একজন আছে। ওটা কি একটা ভূত…? না, সাদা পোশাক পড়া একজন মানুষ। ড্যানির থেকে একটু দূরে, ঝুঁকে বসে আছে মাথা নীচু করে। ওর ঠোঁটে অলস ভঙ্গিতে একটা সিগারেট ঝুলছে।

(আমি তোকে আজ মেরেই ফেলব হারামজাদা!)

সাদা পোশাক পড়া মানুষটা উঠে দাঁড়াল। এবার ড্যানি ওর চেহারা দেখতে পেল। হ্যালোরান। কিন্তু হ্যালোরান একটা সাদা বাবুর্চির পোশাক পড়ে আছে, ওদের বিদায় দেবার দিন ও যে নীল সুটটা পড়া ছিল সেটা নয়।

ড্যানির মাথায় ডিকের বলা একটা কথা ঘুরতে লাগল।

“যদি তোমার কোন ধরণের সমস্যা হয়… তাহলে আমাকে ডাকবে। জোরে, যেভাবে একটু আগে চিন্তা পাঠালে সেভাবে। যদি আমি শুনতে পাই, তাহলে আমি ফ্লোরিডা থেকে ছুটে চলে আসব।”

(ওহ্ ডিক তোমাকে আমার এখন দরকার আমার সমস্যা হয়েছে প্লিজ আসো)

কিন্তু ডিক ওর ডাকে সাড়া দিল না। তার বদলে ও নিজের সিগারেটটা পায়ের নীচে নেভাল, তারপর ঘুরে দেয়াল ভেদ করে হেঁটে চলে গেল।

আর ঠিক তখনই ওকে যে দানবটা তাড়া করছিল, যে হাতুড়ি দিয়ে ওকে টুকরো টুকরো করে ফেলতে চায়, সে করিডরের মাথায় দেখা দিল। করিডরের ম্লান আলোতে ওকে বিশাল দেখাচ্ছে।

(এইবার তোকে পেয়েছি হারামজাদা তোর আজ কোন নিস্তার নেই

এমন সময় ড্যানির আবার একটা উঁচু জায়গা থেকে পড়ে যাবার অনুভূতি হল। ওর আশেপাশের দৃশ্য বদলে গেল। ও দেখতে পেল যে টনিও ওর সাথে নীচে পড়ছে। ওর ফিসফিস গলা ড্যানির কানে ভেসে এলঃ

(ড্যানি আমি আর তোমার কাছে আসতে পারছি না… ও আমাকে আসতে দিচ্ছে না… হ্যালোরানকে ডাকো… হ্যালোরানকে ডাকো…)

ড্যানি চেঁচিয়ে উঠল “টনি!” আর ওর চারপাশের দৃশ্য আবার বদলে গেল।

ও এখন একটা বিশাল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। কাঁচের গম্বুজে ঢাকা একটা ঘড়ি। ঘড়িটায় কোন সময় দেখাচ্ছে না, শুধু একটা তারিখ লেখা : ডিসেম্বর ২। আস্তে আস্তে ড্যানির মাথার ওপরে একটা ইংরেজীতে একটা লেখা ফুটে উঠল। রেডরাম। ড্যানি বিস্ফারিত দৃষ্টিতে দেখল যে লেখাটার প্রতিবিম্ব ঘড়ির কাঁচে উলটো হয়ে পড়েছে, আর অবশেষে ওর কাছে রেডরাম কথাটার অর্থ পরিষ্কার হল।

Redrum হচ্ছে Murder ।

সবকিছু রক্তের মত লাল রঙ ধারণ করল। ড্যানি চোখ মেলে দেখল ও বলরুমের চেয়ারটা থেকে পড়ে গেছে।

ওর শরীর থরথর করে কাঁপছে। ও নিজের সমস্ত মনোযোগ আর শক্তি দিয়ে একটা মানসিক চিৎকার ছুঁড়ে দিল :

(ডিক!!!)

অধ্যায় ৩৮ – সিঁড়িতে

সোয়া সাতটা বাজে। ওয়েন্ডি লবি থেকে দোতলায় উঠতে যেয়ে দেখল ড্যানি সিঁড়িতে বসে একটা লাল বল হাতে নিয়ে খেলছে। আরও কাছে এসে ও শুনতে পেল যে ড্যানি গুনগুন করে একটা গান গাইছে। ওয়েস্তি গানটা চিনতে পারল। এডি ককরান নামে একজন গায়কের গান, জ্যাক আগে প্রায়ই রেডিওতে এই গানটা শুনত।

ড্যানি মাথা নীচু করে বসে ছিল, তাই একদম কাছে আসার আগে ওয়েল্ডি ওর চেহারা দেখতে পায়নি। এখন ও দেখল যে ড্যানির ঠোঁট ফুলে গেছে, আর থুতনিতে শুকনো রক্তের দাগ। ওয়েন্ডির বুকের রক্ত ছলকে উঠল। জ্যাক ওকে আবার মেরেছে!

“কি হয়েছে তোমার, ডক?”

“আমি টনিকে আবার ডেকেছিলাম,” ড্যানি বিমর্ষ স্বরে জবাব দিল। “বলরুমে। ওখানে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়েছি বোধহয়। এখন আর ব্যাথা করছে না। শুধু মনে হচ্ছে আমার ঠোঁটটা অনেক বড়।”

“সত্যি?”

“হ্যা। বাবা মারেনি আমাকে।”

ওয়েন্ডি চোখে অস্বস্তি নিয়ে তাকিয়ে রইল ওর দিকে। ও এখনও বলটা থেকে চোখ সরায় নি। ও আমার মনের কথা পড়ছে, ওয়েন্ডি মনে মনে বলল। আমার ছেলে আমার মনের কথা পড়ছে।

“টনি তোমাকে কি বলল, ডক?”

“তেমন জরুরি কিছু নয়।” ড্যানি বলল। এতক্ষণ কথা বলবার সময় একবারও ওর চেহারার অভিব্যক্তি বদলায় নি। “টনি আর এখানে আসতে পারবে না। ওকে ওরা আটকে ফেলেছে।”

“কারা?”

“হোটেলে যারা থাকে তারা।” অবশেষে ড্যানি মুখ তুলে তাকাল ওয়েন্ডির দিকে, আর ও দেখতে পেল ড্যানির চোখজুড়ে ভয় আর ক্লান্তি চেপে বসেছে।

“ড্যানি…নিজেকে এভাবে…এভাবে কষ্ট দিও না।”

“হোটেলটা আমাকে সবচেয়ে বেশী চায়। কিন্তু তোমাকে আর বাবাকেও নিতে ওর কোন অসুবিধা নেই। এখন হোটেলটা বাবাকে মিথ্যা কথা বলছে, বলছে যে ও বাবাকেই সবচেয়ে বেশী চায়। যাতে বাবা আমাদের এখান থেকে নিয়ে না যায়।”

“ইস্, স্নো-মোবিলটা যদি নষ্ট না হত-”

“হোটেলটা চায় না যে আমরা চলে যাই। তাই ওটা বাবাকে বলেছে স্নো- মোবিলের একটা অংশ খুলে ফেলে দিতে। আমি এটা স্বপ্নে দেখেছি। বাবা এটাও জানে যে ২১৭ তে মহিলাটা আসলেই আছে।” ও আবার ভয়ার্ত চোখে তাকাল মায়ের দিকে, “তুমি আমাকে বিশ্বাস না করলেও কিছু করার নেই।”

ওয়েন্ডি একটা হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরল। “আমি তোমার কথা বিশ্বাস করি, ড্যানি…” ও বলল। “তোমার বাবা কি আমাদের কোন ক্ষতি করার চেষ্টা করবে?”

“হোটেলটা ওকে করতে বলবে,” ড্যানি বলল। “আমি মিস্টার হ্যালোরানকে ডেকেছি, উনি যাবার আগে বলেছিলেন আমি যদি ওনাকে ডাকি তাহলে উনি চলে আসবেন। কিন্তু আমি এখনও জানি না উনি আমার ডাক শুনতে পেয়েছেন কিনা। আর আগামীকাল -”

“আগামীকাল কি?”

“কিছু না।”

“তোমার বাবা এখন কোথায়?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল।

“নীচে। বেসমেন্টে। আজকে আর বাবা উপরে আসবে বলে মনে হয় না।”

ওয়েন্ডি হঠাৎ উঠে দাঁড়াল। “একটু অপেক্ষা কর। আমি এখনই আসছি। পাঁচ মিনিট।”

ওয়েন্ডি এক দৌড়ে কিচেনে যেয়ে ঢুকল। তারপর সোজা আগালো যে বোর্ডটায় ছুরি ঝোলানো থাকে সেটার দিকে। ও সবচেয়ে বড় ছুরিটা নামিয়ে একবার আঙুল দিয়ে পরখ করল ধার কিরকম। চলবে।

ড্যানি তখনও সিঁড়িতে বসে বলটা হাতে নিয়ে লোফালুফি করছিল। এমন সময় হঠাৎ ওর কানের পাশে একটা গলা বলে উঠল :

(হ্যা, তোমার এখানে ভাল লাগবেই…চেষ্টা করে দেখো একবার, ভালো লাগবে…লাগবেইইইইই…)

যেন হোটেলে বন্দী সবগুলো আত্মা একসাথে হাহাকার করে উঠেছে…যেন ওদের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে নতুন মানুষদের ওদের দলে যোগ করা, যাতে ওদের আর একলা না লাগে…কিন্তু যতই চেষ্টা করুক, ওদের একাকীত্ব কিছুতেই দূর হয় না…

ওয়েন্ডি সিঁড়ি বেয়ে উঠতে যেয়ে থমকে দাঁড়াল। ও ড্যানির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল : “তুমি কি কিছু শুনতে পাচ্ছো?”

ড্যানি মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকাল, কিন্তু কোন উত্তর দিল না।

ওরা দু’জন সেদিন বেডরুমের দরজায় তালা মেরে গুলো, কিন্তু কারওই ভাল ঘুম হল না।

ড্যানি শুয়ে শুয়ে ভাবছিল :

(ও চায় এখানে থেকে যেতে, যাতে ওর কখনও মৃত্যু না হয়, যাতে ও এখানকার আত্মাদের সাথে চিরকাল থাকতে পারে, এটাই ও চায়)

ওয়েন্ডি ভাবছিল :

(দরকার হলে আমি ওকে নিয়ে পাহাড়ের আরও ওপরে উঠে যাব, যদি মরতেই হয় আমি এত সহজে মরতে রাজী নই)

ও ছুরিটা একটা তোয়ালেতে পেঁচিয়ে বালিশের নীচে রেখে দিয়েছে। অস্বস্তিকর চিন্তাগুলো মাথায় ঘুরতে ঘুরতে একসময় ওয়েন্ডির তন্দ্রা এসে গেল।

অধ্যায় ৩৯ – বেসমেন্ট

জ্যাক সারারাত এখানে বসে বসে পুরনো কাগজ ঘেটেছে। ওর ভেতর একটা অস্থিরতা কাজ করছে, যেন আর বেশী সময় নেই, ওকে যা করার এখনই করতে হবে। কিন্তু এখনও ও সেই সূত্রগুলো খুঁজে পাচ্ছে না, যেগুলো পেলে সবকিছু ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে। পুরনো কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে জ্যাকের আঙুল হলুদ হয়ে গিয়েছে।

হঠাৎ ওর মনে পড়ল, সর্বনাশ, বয়লারটা তো চেক করা হয় নি!

যেন ওর সাথে একমত হয়ে বয়লারটা পেছন থেকে গুঙ্গিয়ে উঠল।

জ্যাক ছুটে গেল বয়লারটার কাছে। ওর চেহারা শুকনো লাগছে। গালে তিন-চারদিনের না-কামানো দাড়ি।

মিটারের কাঁটাটা ২১০ পি.এস.আই. ছুঁই ছুঁই করছে। জ্যাকের মনে হল বয়লারের দু’পাশের স্ক্রুগুলো চাপের চোটে এখনই ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এমন সময় একটা ঠাণ্ডা গলা ওর কানের পাশে বলে উঠল :

(ফাটতে দাও। ওপরে যেয়ে ওয়েন্ডি আর ড্যানিকে সাথে নিয়ে ভাগো এখান থেকে)

এক মুহূর্তের জন্যে জ্যাক গম্ভীরমুখে কথাটা চিন্তা করে দেখল। যদি বয়লারটা ফেটে যায়, তাহলে হোটেলটার একটা বড় অংশ উড়ে যাবে বিস্ফোরণে, আর যেহেতু জিনিসটা বেসমেন্টে, বিস্ফোরণের পর পুরো হোটেলটাই ধসে পড়বে। যে অংশগুলো ধসে পড়েনি সেগুলোতে আগুন ধরে যাবে। সব মিলিয়ে ওভারলুক ধ্বংস হতে দশ-বারো ঘণ্টার বেশী লাগবে না।

বয়লারটা আবার গুঙ্গিয়ে উঠল। কয়েকটা জায়গা থেকে ‘হিস্ শব্দ করে ছুটে বেরুল ধোঁয়া।

কিন্তু জ্যাকের ঘোর তখনও কাটেনি। ওর একটা হাত বয়লারের ভাল্ভটার ওপর রাখা, যেটা ঘোরালে প্রেশার কমে যাবে, কিন্তু হাতটা নড়ছে না। জ্যাকের চোখ অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল।

(এই আমার শেষ সুযোগ)

ওর আর ওয়েন্ডির একটা যুক্ত জীবন বীমা করা আছে। যদি ওদের মধ্যে কেউ একজন মারা যায় তাহলে অপরজন চল্লিশ হাজার ডলার পাবে।

(একটা বিস্ফোরণ আর সাথে সাথে আশি হাজার ডলার)

মিটারের কাঁটাটা ২১৫ পি.এস.আই. এর ঘর ছুঁলো। বয়লারের ভেতর থেকে এখন একটা বিশ্ৰী শব্দ আসছে। অনেকগুলো বোলতা একসাথে উড়লে যেমন শব্দ হয় তেমন।

জ্যাক চমকে বাস্তবে ফিরে এল। এসব কি আবোল-তাবোল চিন্তা ঘুরছে ওর মাথায়? ও হোটেলের কেয়ারটেকার। ওভারলুকের যত্ন নেয়া ওর চাকরি।

ভাল্ভটা ঘোরাবার আগে একমুহূর্তের জন্যে জ্যাকের মনে হল ও বেশী দেরি করে ফেলেছে, বয়লারটা এখনই ফাটবে। কিন্তু ও শক্ত হাতে একটা মোচড় দিতেই বয়লারের গোঙ্গানী কমে এল। আরও কয়েকবার ধোঁয়া ছেড়ে বয়লারটা শান্ত হয়ে এল। মিটারের কাঁটাটা নামতে নামতে ৮০ এর ঘরে থামল।

জ্যাক নিজের হাতের দিকে তাকাল। ওর হাতে ফোসকা পড়ে গেছে। বয়লারের সাথে সাথে ভাল্ভটাও উত্তপ্ত হয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্য, ও এতক্ষণ টেরই পায়নি যে ওর হাত পুড়ে যাচ্ছে! কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, জ্যাক ভাবল, আমি ওভারলুককে পুড়িয়ে ফেলার কথা ভাবছিলাম। সেই ওভারলুক, যেটাকে ওর সবসময় আগলে রাখার কথা। ওর ভেতরে অপরাধবোধ জেগে উঠল। ও আর কখনও এমন হতে দেবে না।

ঈশ্বর, ওর এক গ্লাস মদ দরকার।

এমন নয় যে ও মাতাল হতে চায়। নিজের মাথা ঠাণ্ডা করবার জন্যেই ওর একটু মদ খাওয়া প্রয়োজন। কিন্তু সারা হোটেলে রান্না করবার শেরি ছাড়া আর কিছু নেই। ওষুধগুলোও আর কাজ করছে না।

ওর মনে পড়ল ও লাউঞ্জের শেলফে অনেকগুলো বোতল দেখেছে একবার!

ও মাত্র বয়লারটা ঠিক করে হোটেলটাকে রক্ষা করেছে।ওভারলুক কি এর জন্যে ওকে কোন পুরষ্কার দেবে না? ওর পা আপনা থেকেই চলতে শুরু করল। একবার লাউঞ্জে গিয়ে দেখাই যাক।

বাইরে ভোর হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *