অধ্যায় ৩০ – আবার ২১৭তে
জ্যাক লিফটে চড়ে উপরে এল। ওর কাছে ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগল যে ওরা হোটেলে আসবার পর এই নিয়ে মাত্র দ্বিতীয়বার লিফটটা ব্যাবহৃত হচ্ছে। অবশ্য ও জানে যে ওয়েন্ডির মধ্যে একটু ক্লস্ট্রোফোবিয়া আছে। ও বদ্ধ জায়গা সহ্য করতে পারে না।
করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে জ্যাক আরও কয়েকটা পিল মুখে ফেলল। ২১৭ এসে পড়েছে। রুমটার দরজা সামান্য খোলা, চাবিটা এখনও নব থেকে ঝুলছে।
জ্যাকের ভেতর বিরক্তি আর রাগ মাথাচাড়া দিল। ড্যানিকে ও মানা করেছে একুইপমেন্ট শেড, বেসমেন্ট আর গেস্টদের রুমে না ঢুকতে। ওর ভয় কমলে ওকে শক্ত একটা বকা দিতে হবে।
জ্যাক চাবিটা খুলে নিজের পকেটে পুরল। ঘুরে ঢুকে ও প্রথমেই দেখল বিছানাটা এলোমেলো হয়েছে কিনা। ওটা ঠিক আছে দেখে ও বাথরুমের দিকে হাঁটা ধরল। জ্যাকের মনে একটা জিনিস বেশ কিছুক্ষণ ধরে খোঁচাচ্ছে। ওয়াটসন যদিও রুমটার নাম্বার বলে নি, কিন্তু জ্যাকের মনে হচ্ছে এটাই হচ্ছে সেই রুমটা যেখানে সেই উকিলের বৌ আত্মহত্যা করেছিল।
জ্যাক বাথরুমে ঢুকে আলো জ্বেলে দিল। সাদা টাইলের ফ্লোর, বাথটাব, কমোড… ওভারলুকের অন্য সব রুমের মতই। বাথটাবের পর্দাটা টেনে দেয়া।
জ্যাক আরেক কদম এগিয়ে আসতে পর্দাটা একটু নড়ে উঠল।
ড্যানির গল্পটা জ্যাক বিশ্বাস করে নি। ওর মনে হয়েছে অন্ধকার রুমে ড্যানির নিজের কল্পনা ওকে ধোঁকা দিয়েছে। কিন্তু এখন জ্যাকের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরল। একটা ঠাণ্ডা শিহরণ নেমে গেল ওর মেরুদন্ড বেয়ে।
ও একটানে পর্দাটা সরিয়ে দিল।
বাথটাবটা শুকনো,আর খালি।
জ্যাক নীচু হয়ে বসে টাবের মেঝেতে একটা আঙুল বুলাল। শুকনো খটখটে। ড্যানি হয় ভুল দেখেছে নয়তো পুরো জিনিসটা বানিয়ে বলেছে। ওর আবার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছিল যখন ও মেঝেতে টাওয়েলটা পড়ে থাকতে দেখল।
এখানে টাওয়েল কি করছে? সব টাওয়েল তো নীচতলার লিনেন কাপবোর্ডে থাকার কথা। ড্যানি কি ওটা নিয়ে এসেছে? মেইন চাবি দিয়ে কাপবোর্ডটাও খোলা যায়…কিন্তু ও কেন আনবে? ও টাওয়েলটা ধরে দেখল। এটাও শুকনো।
ও আবার চারদিকে তাকিয়ে সবকিছু মনোযোগ দিয়ে দেখল। টাওয়েলের ব্যাপারটা একটু আজব, কিন্তু হোটেলের কোন কমর্চারীর এটা ভুলে ফেলে যাওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।
হঠাৎ করে জ্যাকের নাকে গন্ধটা এল। সাবান।
তাও যেন-তেন সাবান নয়। মেয়েদের সাবান। পারফিউমের গন্ধযুক্ত।
(এটা তোমার কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়)
(যেমন প্লেগ্রাউন্ডের ব্যাপারটা আমার কল্পনা ছিল?)
জ্যাক উঠে রুমের মেইন দরজাটার দিকে আগাল। আস্তে আস্তে ওর মাথাব্যাথা শুরু হচ্ছে। আজকে এত কিছু একসাথে ঘটছে…ও ২১৭ নিয়ে আর মাথা ঘামাবে না, জ্যাক মনে মনে নিজেকে বলল। একটা সামান্য টাওয়েল আর সাবানের গন্ধ নিয়ে এত মাথা গরম করবার কোন মানে হয় না।
ও দরজাটা খুলবার সাথে সাথে পেছনে একটা ছোট্ট শব্দ হল। কোন কাপড় টানলে সরসর করে যেমন শব্দ হয়। জ্যাক ইলেকট্রিক শক খাবার মত ঘুরে পিছে তাকাল। ও কম্পমান পায়ে আবার বাথরুমে যেয়ে ঢুকল।
ও যে পর্দাটা নিজের হাতে একটু আগে টেনে সরিয়েছে সেটা আবার কেউ টেনে বাথটাব ঢেকে দিয়েছে।
প্রচণ্ড ভয়ে জ্যাকের মনে হল ওর চেহারা অবশ হয়ে গেছে। ও অনুভব করছে যে পর্দার আড়ালে বাথটাবে কেউ শুয়ে আছে। খুব আবছাভাবে। সেটা আলোর কারসাজিও হতে পারে, ওর চোখের ভুলও হতে পারে। আবার কোন মহিলার বিকৃত লাশও হতে পারে।
জ্যাক নিজেকে বলল পর্দাটা টেনে দেখতে আসলেই কেউ বাথটাবে আছে কিনা। কিন্তু ওর শরীর ওর কথা শুনল না। ও ঘুরে দাঁড়াল, তারপর ধীর পায়ে বেডরুমে ফিরে এল।
বাইরে যাবার দরজা বন্ধ।
ভয়ে জ্যাকের মুখ তেতো হয়ে গেছে। ও আস্তে আস্তে হেঁটে দরজাটা পর্যন্ত গেল। তারপর নবটা ধরে ঘোরাল।
(দরজাটা খুলবে না)
কিন্তু খুলে গেল।
জ্যাক লাইটটা বন্ধ করে একবারও পিছে না তাকিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করবার পর ওর মনে হল ও আরেকটা শব্দ শুনতে পেয়েছে। থপ্ করে কোন কিছু মাটিতে পড়ার শব্দ। যেন বাথটাব থেকে ভেজা কিছু নেমে এসেছে।
ও দরজাটা লক করতে যেয়ে আরেকটু হলে চাবিটা হাত থেকে ফেলে দিয়েছিল। অবশেষে দরজাটায় তালা মেরে এক কদম পিছিয়ে জ্যাক সশব্দে একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল।
ও চোখ বন্ধ করেভাবতে লাগল। এসব কি হচ্ছে? প্রথমে প্লেগ্রাউন্ডে, তারপর লাউঞ্জে, এখন এখানে? ওর কি আসলেই মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে?
“না,” ও কাঁদো কাঁদো গলায় ফিসফিস করল। “না, ঈশ্বর, প্লিজ না…”
ও হঠাৎ থেমে গেল। রুমের ভেতর থেকে একটা নতুন শব্দ আসছে। দরজার নব ঘোরানোর শব্দ?
জ্যাক দ্রুত পায়ে হেঁটে কাছে চলে গেল। পথে ওর আরেকটা অদ্ভুত জিনিস চোখে পড়ল। দেয়ালে ঝোলানো হোসপাইপটার মুখ লিফটের দিখে ঘোরানো। আগেও কি মুখটা এ দিকেই তাক করা ছিল?
“এসব আমার মনের ভুল।” জ্যাক জোরে জোরে বলল। ওর চেহারা চেনা যাচ্ছে না। মুখ সম্পূর্ণ সাদা হয়ে গেছে।
ও লিফটে না চড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল।
অধ্যায় ৩১ – রায়
জ্যাক কিচেনে ঢুকল চাবিটা হাতে লোফালুফি করতে করতে। ভেতরে ওয়েল্ডি আর ড্যানির অবস্থা তেমন ভাল নয়। ওয়েন্ডির কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে গিয়েছে। চোখের নীচে কাল দাগ পড়েছে। ড্যানিকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। জ্যাক কেন যেন একটু আশ্বস্ত বোধ করল। যাক, ও তাহলে একলা ভুগছে না।
ওরা দু’জন জ্যাকের দিকে মুখ তুলে তাকাল, কিন্তু কিছু বলল না।
“কিছুই নেই ওখানে,” জ্যাক বলল। “কিচ্ছু না।”
ওদের দিকে তাকিয়ে একটা আত্মবিশ্বাসী হাসি দিতে দিতে জ্যাকের মনে
হল, মদ খাবার এত প্রচণ্ড ইচ্ছা ওর আর কখনও হয় নি।
অধ্যায় ৩২ – বেডরুমে
সেদিন সন্ধ্যায় জ্যাক আর ওয়েন্ডি নিজেদের বেডরুমেই ড্যানিকে ঘুমাতে বলল। জ্যাক স্টোরেজ রুম থেকে একটা ছোট্ট বিছানা বের করে নিয়ে এল ওর জন্যে। ড্যানি শোবার পনের মিনিটের মধ্যে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল। ওয়েন্ডি হাতে একটা উপন্যাস নিয়ে বিছানায় বসে ছিল, আর জ্যাক টাইপরাইটারে এসেছে নিজের নাটক নিয়ে।
“বাল!” জ্যাক বলল।
“কি হয়েছে?” ওয়েভি জিজ্ঞেস করল।
“কিছু না।”
নাটকটা পড়ে জ্যাকের বিশ্বাস হচ্ছিল না যে ও এই জিনিসটা লিখেছে। এটা কি? হাস্যকর একটা পুট, আগেও যেটা একশ’বার একশ’টা নাটকে দেখানো হয়েছে। আর চরিত্রগুলোকেও এখন মেকী মনে হচ্ছে। জ্যাকের সাথে আগে এমন কখনও হয় নি। সাধারণত ও নিজের লেখা চরিত্রদেরকে বেশ পছন্দই করে, সেটা ভাল হোক বা খারাপ হোক। ওর নিজের লেখা সবচেয়ে পছন্দের গল্প হচ্ছে “মাংকি ইজ হিয়ার, পল ডেলং।” গল্পটা হচ্ছে পল ডেলং নামে এক লোককে নিয়ে যে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন করে। শেষে ও আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়। পল ডেলংকে ওর বন্ধুরা মাংকি বলে ডাকত। জ্যাক এই চরিত্রটাকে খুব পছন্দ করে। ও গল্পে দেখিয়েছে যে মাংকির অপরাধগুলোর জন্যে একলা ও দায়ী নয়। দায়ী ছিল ওর ভয়ংকর অতীত। ওর বাবা ওর ওপর অত্যাচার করত। ও স্কুলে থাকতে এক সমকামীর ধর্ষনের শিকার হয়। এসব কারণে মাংকির মধ্যে যৌন বিকৃতি দেখা দেয়। ও একবার ধরা পড়ে যাওয়ার পর ওকে মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। কিন্তু সেই হাসপাতালের অধ্যক্ষ, গ্রিমার নামে একজন লোক, তাকে ছেড়ে দেয় সে ভাল হয়ে গেছে এটা বলে। এই গ্রিমার চরিত্রটাকেও জ্যাকের ভাল লাগে। সে মাংকিকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, কারণ তার হাসপাতালে এমনিতেই অনেক বেশী রোগী হয়ে গেছে,আর তাদের সবার খেয়াল রাখবার মত যতেষ্ট ডাক্তার বা কর্মচারী নেই। তাছাড়া হাসপাতালে অন্যান্য বেশীরভাগ রোগীরই এমন অবস্থা যে তাদের পেছনে চব্বিশ ঘন্টা লোক থাকতে হয়। মাংকি নিজের প্যান্টে মলত্যাগ করে না, অপরিচিত মানুষদেরকে দেখলে হিংস্র হয়ে যায় না আর ঠিকঠাকভাবে কথা বলতে পারে। তাই অন্য, আরও সঙ্গীন অবস্থার কোন রোগীকে ছাড়ার চাইতে গ্রিমার মাংকিকে ছেড়ে দেয়াই উচিত কাজ মনে করে। জ্যাকের ওই বাচ্চাগুলোর জন্যেও কষ্ট হয়েছে, যাদের মাংকি নির্যাতন করে। ও নিজের সব চরিত্রকেই চেনে, তাদের উদ্দেশ্য, তাদের ব্যাবহার, তাদের কাজকর্ম সবই বুঝতে পারে।
ও দ্য লিটল স্কুলও একই মনোভাব নিয়ে লেখা শুরু করেছিল। কিন্তু ইদানিং গল্পটার নানা খুঁত ওর চোখে ধরা পড়ছে। এমনকি নায়ক গ্যারি বেনসনকেও ওর আজকাল অসহ্য লাগা শুরু হয়েছে। জ্যাকের এখন ওকে মনে হয় মুখে মুখে বড় বড় বুলি ফোঁটানো একটা আঁতেল, যে নিজের টাকার জোরে সব কিনে নিতে চায়। যেন বেনসন এতদিন শুধু ভাল সাজার ভান করেছে, ও আসলে ভাল নয়। প্রথমে জ্যাকের নাটকটা লেখার উদ্দেশ্য ছিল ডেংকার চরিত্রটার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহারের একটা চিত্র তুলে ধরা। কিন্তু এখন ডেংকারকেই ওর বেনসনের চেয়ে ভাল লাগা শুরু হয়েছে। ডেংকার একজন নির্দোষ স্কুল শিক্ষক ছাড়া আর কিছু নয়, যে বেনসনের জালে পড়ে নিজেকে হারিয়ে ফেলে।
ও নাটকটা কিভাবে শেষ করবে তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না।
জ্যাক ভ্রু কুঁচকে চিন্তা করছিল কিভাবে নাটকটাকে বাঁচানো সম্ভব এমন সময় ওয়েন্ডির গলা ওর কানে এল।
“ নিয়ে যাব কিভাবে?”
জ্যাক তাকাল ওর দিকে : “হম্?”
“ড্যানির কথা বলছি, জ্যাক। ওকে শহরে নিয়ে যাব কিভাবে?”
একমুহূর্তের জন্যে জ্যাকের মাথায়ই ঢুকল না ওয়েন্ডি কি বলতে চাচ্ছে। বোঝার পর ও হাহা করে হেসে উঠল।
“’এমনভাবে কথাটা বললে যেন শহরে যাওয়া কত সোজা!”
ওয়েন্ডির মুখে ব্যাথার ছাপ পড়ল।
“আমি জানি কাজটা সোজা নয় জ্যাক… কিন্তু তুমি ড্যানির দিকটা একবার ভেবে দেখ! ও কত বড় একটা ঝটকা খেয়েছে।”
“কিন্তু ও তো এখন ঠিক আছে, তাই না?” কথাটা বলতে বলতেই জ্যাকের মনে হল, ড্যানি তখন মুখে আঙুল দেয়া ভাবলেশহীন চেহারাটা ইচ্ছা করে বানায় নি তো? জ্যাকের বকা এড়াবার জন্যে? ও তো জানত যে ও ২১৭ তে ঢুকে জ্যাকের কথা অমান্য করেছে।
“তারপরেও,” ওয়েন্ডি উঠে এসে জ্যাকের ডেস্কের পাশে বসল। “ওর গলার দাগগুলোর কথা ভুলে গেছ? কিছু একটা ওকে ব্যাথা দিয়েছে, জ্যাক। আমি চাই সেই জিনিসটা থেকে ওর দূরে থাকুক।”
“আস্তে কথা বল। আমার মাথাব্যাথা করছে। ওয়েন্ডি, এই জিনিসটা নিয়ে তোমার চেয়ে আমার চিন্তা কম হচ্ছে না। তোমার চিৎকার করার প্রয়োজন নেই।”
“আচ্ছা, আমি চিৎকার করব না,” ওয়েন্ডি গলার স্বর নীচু করে বলল। “কিন্তু জ্যাক, এখানে আমাদের সাথে কিছু একটা আছে, খুব খারাপ কিছু। আমাদের বাঁচতে হলে শহরে যেতে হবে।”
“শহরে যাব কিভাবে? তুমি কি আমাকে সুপারম্যান মনে কর?”
“আমি তোমাকে আমার স্বামী মনে করি।” ওয়েন্ডি আস্তে করে বলল। ও নিজের হাতে দিকে তাকিয়ে আছে।
জ্যাকের মাথা গরম হয়ে গেল। ও ডেস্কে এত জোরে একটা কিল বসাল যে টাইপরাইটারটা কেঁপে উঠল।
“তোমাকে কয়েকটা সত্যি কথা বলি, কেমন, ওয়েন্ডি? যদিও তুমি জিনিসগুলো জান, তোমার কথাবার্তা শুনে মনে হচ্ছে না সেগুলো তোমার মাথায় ঠিকমত ঢুকেছে।”
ড্যানি হঠাৎ ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া শুরু করল। আমরা ঝগড়া করলে ওর সবসময় এমন হয়, ওয়েন্ডি মনে মনে ভাবল।
“ওর ঘুম ভাঙ্গিয়ে দিও না, জ্যাক।”
ড্যানির দিকে তাকিয়ে জ্যাকের মেজাজ একটু ঠাণ্ডা হল। “সরি ওয়েন্ডি। আমি এত চেঁচাচ্ছি কারণ রেডিওটা ভাঙ্গার জন্যে আমিই দায়ী।”
“নিজের ঘাড়ে সব দোষ নিও না,” ওয়েন্ডি জ্যাকের কাঁধে হাত রেখে বলল। “তোমার এখন একটু রাগ হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমি নিজেও তোমার সাথে অনেক অন্যায় আচরণ করেছি। আসলেই আমি আমার মায়ের মত করি মাঝে মাঝে। কিন্তু কয়েকটা জিনিস ভুলে যাওয়া… খুব কঠিন। প্লিজ আমার কথা বোঝার চেষ্টা কর, জ্যাক।”
“যেমন ড্যানির হাত?” জ্যাক শুকনো গলায় প্রশ্ন করল।
“হ্যা,” বলে ওয়েন্ডি দ্রুত যোগ করল, “কিন্তু শুধু তুমি নও, আমি ড্যানিকে নিয়ে এমনিতেই অনেক চিন্তায় থাকি। ও খেলতে গেলে আমার চিন্তা হয়, স্কুলে গেলে চিন্তা হয়, বেশীক্ষণ পড়ালেখা করলে আমার চিন্তা হয়। আমি ওকে নিয়ে চিন্তা করি কারণ ও এত ছোট্ট আর নাজুক… আর এই হোটেলের কিছু একটা ওর ক্ষতি করতে চাচ্ছে। এজন্যেই আমি এখান থেকে চলে যেতে চাই, জ্যাক!”
ওর হাতের আঙুলগুলো জ্যাকের কাঁধে চেপে বসল। কিন্তু জ্যাক সরে গেল না। ও একটা হাত ওয়েন্ডির ডান স্তনে রেখে আদর করল।
“ওয়েন্ডি,” বলে জ্যাক একমুহূর্ত অপেক্ষা করল ওর তরফ থেকে কোন বাধা আসে কিনা দেখবার জন্যে। কিন্তু ওয়েন্ডি কিছু বলল না। জ্যাকের শক্তিশালী হাত ওর স্তনে থাকাতে ওর আরাম লাগছিল। “আমি স্নো-শু পড়ে ওকে নীচে নিয়ে যাবার চেষ্টা করতে পারি। আমাদের হয়তো দুই থেকে ভিদিন লাগবে যদি তাবু, খাবার-দাবার সব ব্যাগে করে নিয়ে যাই। এ এম- এফ এম রেডিওটা তো এখনও কাজ করে, আমরা নামবার আগে আবহাওয়ার খবর জেনে নিতে পারব। কিন্তু আমরা বাইরে থাকবার সময় যদি একদিনও তুষারপাত হয়…আমরা মারা যেতে পারি।”
ওয়েন্ডির মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। জ্যাক এখনও ওর স্তনে আদর করছিল, ওর বুড়ো আঙুলটা ঘোরাফেরা করছিল স্তনবৃত্তের চারপাশে। ওয়েন্ডির মুখ কে একটা অস্পষ্ট গোঙ্গানী বেরিয়ে এল। ওর আদর খেয়ে নাকি ওর কথা শুনে সেটা জ্যাক ঠিক ধরতে পারল না। জ্যাক হাত বাড়িয়ে ওয়েন্ডির টপের একটা বোতাম খুলে দিল। ওয়েন্ডি পা ভাঁজ করে বসল। হঠাৎ করে ওর কাছে নিজের জিন্স অনেক টাইট মনে হচ্ছে।
“তার মানে তোমাকে তিন দিনের জন্যে একলা ছেড়ে যাওয়া। তুমি কি তাই চাও?” জ্যাকের হাত দ্বিতীয় বোতামটাও খুলে দিল।
“না।” ওয়েন্ডি গাঢ় গলায় বলল। ও একবার ড্যানির দিকে তাকাল। নিশ্চিন্তে আঙুল চুষছে। কিন্তু ওর কেন যেন মনে হচ্ছে জ্যাক কিছু একটা চেপে যাচ্ছে…কি সেটা?”
জ্যাক বাকি দু’টো বোতাম খুলে ওয়েন্ডির উর্ধ্বাঙ্গকে নগ্ন করে দিল। একটা স্তনবৃন্তে ও নিজের জিভ ছোঁয়াল।
“আমরা যদি এখানে থেকে যাই,” জ্যাক এক মুহূর্ত থেমে বলল, “তাহলে কিছুদিন পর একজন রেঞ্জার এমনিতেই আমাদের খোঁজ নিতে আসবে। তখন আমরা বললেই হবে যে আমরা নীচে যেতে চাই।” ও আবার চুমু খেল ওয়েন্ডির স্তনে।
ওয়েন্ডির মুখ থেকে অস্ফুট একটা “আহ্হ্” বেরিয়ে এল। (আমি কি কিছু ভুলে যাচ্ছি?)
“সোনা?” ওয়েন্ডি জ্যাকের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে প্রশ্ন করল, “রেঞ্জার আমাদের এখান থেকে নিয়ে যাবে কিভাবে?”
জ্যাক আবার উত্তর দেবার জন্যে মাথা তুলল।
“হয় হেলিকপ্টারে নয়তো স্নো-মোবিলে।”
(তাইতো!!!)
“কিন্তু একটা স্নো-মোবিল না হোটেলেই আছে? আলম্যান তো তাই বলেছিল!”
জ্যাক উঠে বসল। ওয়েন্ডির চেহারা একটু লাল হয়ে গেছে, চোখ বড় বড়, কিন্তু জ্যাকের চেহারা একদম স্বাভাবিক। ওর চোখ দেখে মনে হচ্ছে ও এতক্ষণ কোন নীরস বই পড়ছিল।
“যদি একটা স্নো-মোবিল থেকে থাকে তাহলে তো কোন সমস্যাই নেই! আমরা তিনজনই একসাথে নামতে পারব।” ওয়েন্ডি উৎফুল স্বরে বলল।
“ওয়েন্ডি, আমি জীবনে কখনও স্নো-মোবিল চালাই নি।”
“জিনিসটা শিখতে তো বেশীক্ষণ লাগার কথা নয়, তাই না? আমি ছোট ছোট বাচ্চাদেরও স্নো-মোবিল চালাতে দেখেছি। আর তুমি তো মোটরবাইক চালাতে পার। স্লো-মোবিল তো অনেকটা সেরকমই।”
“ওটা এতদিন গ্যারেজে পড়ে আছে, এঞ্জিনের কি অবস্থা কে জানে? তেলও আছে কিনা দেখতে হবে। ব্যাটারিও হয়তো খুলে রাখা হয়েছে। এত বেশী আশা না করাই ভাল, ওয়েল্ডি।”
ওয়েন্ডি এখন পুরোপুরি উত্তেজিত হয়ে গেছে। ও জ্যাকের দিকে আরও ঝুঁকে এল। জ্যাকের ইচ্ছে হল ওর গলাটা টিপে দিচ্ছে। তাহলে হয়তো ওর মুখ বন্ধ হবে।
“তেল কোন সমস্যাই নয়,” ওয়েভি বলল। “নীচে জেনারেটরের জন্যে তেলের অনেকগুলো ক্যান রাখা আছে। আর ওই ইকুপমেন্ট শেডেও নিশ্চয়ই একটা ক্যান আছে যেটা তুমি সাথে নিয়ে যেতে পারবে।”
“হ্যা।” জ্যাক বলল। আসলে একটা নয়, তিনটে ক্যান আছে।
“ব্যাটারিও নিশ্চয়ই আশেপাশেই কোথাও রাখা আছে। কেউ তো স্পার্কপ্লাগ আর ব্যাটারি খুলে রাখলে গাড়ি থেকে খুব বেশী দূরে রাখে না।”
“হুম্ম্,” জ্যাক ঘুমন্ত ড্যানির পাশে গিয়ে দাঁড়াল। ও ড্যানির কপাল থেকে একগোছা চুল সরিয়ে দিল। ড্যানি নড়ল না।
“তাহলে এর পরে যেদিন আবহাওয়া ভাল থাকবে সেদিন তুমি আমাদের নিয়ে বের হচ্ছ?”
“হ্যা।” জ্যাক ছোট্ট করে বলল।
ওয়েন্ডি বিছানায় শুয়ে জ্যাকের দিকে একটা অর্থপূর্ণ ভঙ্গি করল। ওর শার্টের সবগুলো বোতাম এখনও খোলা।
অনেক পরে, যখন ঘরের সবগুলো বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়েছে, ওয়েল্ডি জ্যাকের হাতের ওপর মাথা রেখে চিন্তা করছিল যে এই হোটেলে কোন খারাপ কিছু লুকিয়ে আছে কথাটা কত অবিশ্বাস্য।
“জ্যাক?”
“কি?”
“ড্যানিকে কে ব্যাথা দিয়েছে তোমার মনে হয়?”
জ্যাক সরাসরি উত্তর দিল না। “ওর ভেতরে এমন কিছু একটা আছে যা আমাদের মধে নেই। আর ওভারলুকের মধ্যেও কিছু একটা আছে।”
“ভূত?”
“জানি না। এমনিতে আমরা ভূত বলতে যা বুঝি তা তো মনে হচ্ছে না। হয়তো এখানে যারা এসে থেকেছে তাদের সবার একটা ছায়া হোটেলের ভেতর রয়ে গেছে। সেভাবে দেখতে গেলে সব হোটেলেই ভূত আছে, বিশেষ করে বড় হোটেলগুলোতে।”
“কিন্তু বাথটাবে মহিলার লাশ… ও পাগল হয়ে যাচ্ছে না তো?”
জ্যাক ওয়েন্ডিকে জড়িয়ে ধরল। “এ বয়সের বাচ্চাদের মধ্যে কিছু সুপ্ত মানসিক অসুখ থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
“কিন্তু তাহলে ওর গলার দাগগুলো কোথা থেকে এল?”
জ্যাক একটু চিন্তা করে বলল, “মধ্যযুগের মানুষের মধ্যে স্টিগমাটা নামে একটা জিনিস দেখা যেত। যারা খ্রিস্টের চিন্তায় নিজেদের সারাদিন মগ্ন থাকত, তাদের হাতে আর পায়ে যীশুর মত ক্ষত দেখা দিত। বিজ্ঞানীরা মনে করে যে ওরা খ্রিস্টের সাথে এতটা একাত্ম হয়ে যেত যে নিজেদের বিশ্বাসের জোরে ওরা ক্ষতগুলো ফুটিয়ে তুলত।”
“তোমার ধারণা ড্যানি চিন্তা করে নিজের ক্ষতগুলো তৈরি করেছে।”
“ও কিন্তু আগেও ঘোরের মধ্যে নিজেকে ব্যাথা দিয়েছে। মনে আছে, বছর দুয়েক আগে যখন আমাদের মধ্যে ঝগড়া চলছিল তখন ও খাবার টেবিলে হঠাৎ করে ঘোরে চলে যায়, আর ওর মাথা টেবিলের সাথে বাড়ি খায়?”
“হ্যা, তা মনে আছে…
“আর ও বাইরে খেলতে গেলেই শরীরে কাটাছড়া নিয়ে ফিরে আসে। ওর হাঁটুতে যে কতগুলো কাটার দাগ আছে তার কোন হিসাব নেই।”
“কিন্তু ড্যানির গলার ওই দাগগুলো কারও আঙুলের দাগ, জ্যাক। আমার কোন সন্দেহ নেই সে ব্যাপারে।”
“এমনও হতে পারে যে,” জ্যাক বলল, “ড্যানি ঘরটায় ঢুকবার পর ঘোরে চলে যায়। তখন ওর মনে হয় ওই ঘরে যা আছে সেটা ওর ক্ষতি করছে, কিন্তু আসলে করছে ও নিজেই।”
“কথাটা শুনতেই আমার গা শিউড়ে উঠছে।”
“আমারও,” জ্যাক বলল। “প্রশ্ন জাগতে পারে যে ড্যানি একটা মহিলারই লাশ দেখল কেন। সেটারও বৈজ্ঞানিক ব্যাখা আছে। মৃত মহিলার ছবিটা ওর অবচেতন মন টেনে বের করেছে। লাশ মানে পুরনো স্মৃতি, লাশ মানে মৃত্যুর প্রতীক। আর যেহেতু ওর অবচেতন মন লাশটার চেহারা ধারণ করেছে, এটাও ধরে নেয়া উচিত যে নিজের অবচেতন মনের হুকুমেই ড্যানি নিজের গলা টিপে ধরেছিল।”
“থামো জ্যাক,” ওয়েন্ডি বলল। “এখন আমার মনে হচ্ছে এর চেয়ে হোটেলে ভূত থাকলেই ভাল হত। ভূতের কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়া যায়। নিজের কাছ থেকে তো আর পালান যায় না। ড্যানির কি স্কিৎজোফ্রেনিয়া হয়েছে তুমি বলতে চাও?”
“খুব বিরল এক প্রকৃতির স্কিৎজোফ্রেনিয়া, “ জ্যাক একটু অস্বস্তির সাথে বলল। “কারণ ও আসলেই মাঝে মাঝে মানুষের মনের কথা পড়তে পারে, আর সত্যি সত্যি ভবিষ্যৎ দেখতে পায়।”
“যদি তোমার কথা ঠিক হয়ে থাকে, তাহলে তো ওকে এই হোটেল থেকে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি।”
“কেন? ও যদি আমার কথা শুনে ওই ঘরটায় না ঢুকত তাহলে ওর কোন সমস্যাই হত না। এভাবে দেখলে দোষটা তো আসলে ওরই, তাই না?”
“কি বলছ, জ্যাক! কেউ ওকে গলা টিপে প্রায় খুন করে ফেলেছে এটা ওর দোষ?”
“না, না, তা বলছি না, কিন্তু…”
“উহুঁ,” ওয়েন্ডি জোরে মাথা দু’দিকে নাড়ল। “আমরা আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ছি। শেষে দেখা যাবে এসব নিয়ে এত চিন্তা করতে করতে আমরা নিজেরাই ভূত দেখা শুরু করেছি।” শেষের কথাটা বলবার সময় ও একটু হাসল।
“ফালতু কথা বোল না,” জ্যাক বলল। অনিচ্ছাস্বত্বেও জ্যাকের চোখ ঘরের একটা অন্ধকার কোণার দিকে চলে গেল, যেখানকার ছায়াটা দেখতে টপিয়ারির একটা সিংহের মত লাগছে।
“তুমি আসলেই ওই ঘরটায় কিছু দেখতে পাওনি?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল। ছায়াটা এবার সিংহ থেকে বদলে একটা বাথটাবের রুপ নিল, যেটার পর্দার আড়ালে কেউ থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে।
“তুমি তো আমাদের যত তাড়াতাড়ি পার নীচে নিয়ে যাচ্ছ, চাই না জ্যাক?”
জ্যাকের হাত দু’টো আপনা-আপনি মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে গেল।
(ঘ্যান-ঘ্যান করা বন্ধ কর!)
“বললামই তো যাব। এখন একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। সারাদিন অনেক ধকল গিয়েছে।”
ওয়েন্ডি জ্যাকের গালে একটা চুমু খেয়ে চোখ বন্ধ করল। “আই লাভ ইউ, জ্যাক।”
“আই লাভ ইউ টু।” জ্যাক বলল বটে, কিন্তু ওর হাত এখনও মুষ্ঠিবদ্ধ। ওয়েন্ডি একবারও ভাবেনি ওরা নীচে নামবার পর কি হবে। সবসাকূল্যে ওদের কাছে আছে ষাট ডলার, ওয়েন্ডির নব্বই ডলারের এনগেজমেন্ট রিং আর একটা এ এম-এফ এম রেডিও। এগুলো দিয়ে ওরা এক মাসও চলতে পারবে কিনা সন্দেহ আছে। আর জ্যাকের নিজের স্বপ্নের কথা তো বাদই দাও-ওর স্বপ্ন যে ও আমেরিকার একজন প্রতিষ্ঠিত লেখক হবে। কথাটা মনে হতে ওর হাতের মুঠো আরও শক্ত হয়ে চেপে বসল। ওর নখগুলো হাতের তালুতে দেবে যাচ্ছে। এখন জন টরেন্স দারে দারে যেয়ে সাহায্য চাইবে, নিজের পরিবারের দোহাই দেবে। প্লিজ, আর দশটা ডলার হলে আমাদের এ মাসের খাওয়াটা হয়ে যাবে। অ্যাল শকলিকে বোঝাতে হবে কেন ওরা আচমকা হোটেলকে শীতের মাঝে ছেড়ে দিয়ে চলে এল। বুঝেছিস, অ্যাল, আমার ছেলে হোটেলের একটা রুমে ভূত দেখেছে। কিন্তু তোর ছেলে রুমে ঢুকল কিভাবে? ওটা আমারই দোষ, আমার নিজের ছেলেই আমার কথা শোনে না।
ওর হাতের তালু থেকে কয়েক ফোঁটা রক্ত গড়িয়ে পড়ল। স্টিগমাটার মত। হ্যা, পুরোই স্টিগমাটার মত। ওর বৌ ওর পাশে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আর কেন ঘুমাবে না? ওর তো কোন চিন্তা নেই। ও আর ওর আদরের ড্যানি তো হোটেল ছেড়ে চলে যাবে কয়েকদিনে মধ্যেই।
(মেরে ফেল ওকে! )
চিন্তাটা এক ঝটকায় ওর মাথায় চেপে বসল। এখনই ও চাইলে ওয়েন্ডিকে মাটিতে ছুঁড়ে ফেলে ওর ওপর চেপে বসতে পারে। ওর কণ্ঠনালীতে দুই হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে চাপ দেয়া শুরু করলে ওর মরতে কতক্ষণ লাগবে? বেশীক্ষণ নয়, জ্যাক বাজি লাগিয়ে বলতে পারে। ওয়েন্ডির মুখ থেকে রক্ত ছিটকে আসবে, আর ওর চোখ থেকে আস্তে আস্তে জীবনের আলো নিভে যাবে।
জ্যাক অন্ধকারেই হাসল। তাহলে ওকে ঠিকমত মজা দেখানো হবে। হারামজাদী।
একটা ছোট্ট শব্দ শুনে ও ঘাড় ঘোরাল। ড্যানি আবার ঘুমের মধ্যে নড়াচড়া করছে। একটা অস্ফুট গোঙ্গানীও বেরিয়ে এল ওর মুখ থেকে।
শব্দটা শুনে জ্যাক স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসল। ওর আসল চিন্তা নিজেকে বা ওয়েন্ডিকে নিয়ে হওয়া উচিত নয়। ওর চিন্তা হবে ড্যানিকে ঘিরে। ছেলেটা যাতে ভাল থাকে। ওর যাতে কেউ ক্ষতি না করতে পারে। ও উঠে এসে ড্যানির কম্বল ঠিক করে দিল। যে করেই হোক, ড্যানিকে এই হোটেলের বাইরে নিয়ে যেতেই হবে।
এখন ও আবার শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। অদ্ভুত।
জ্যাক আবার শুয়ে পড়ল। শুয়ে আরও হাজারও আবোল-তাবোল চিন্তা করতে একসময় ওর চোখ বুজে এল ঘুমে।
ও চোখ মেলে দেখল যে ২১৭ নাম্বার রুমের বাথরুমে দাঁড়িয়ে আছে।
ও কি আবার ঘুমের মধ্যে হাঁটা শুরু করেছে নাকি?
ও আশেপাশে তাকাল। বাথরুমের লাইটটা জ্বলছে, যদিও বেডরুমের লাইটটা নিভিয়ে রাখা হয়েছে। বাথটাবের পর্দাটা টেনে দেয়া। টাওয়েলটা মাটিতে পড়ে আছে, ভেজা আর স্যাঁতস্যাঁতে।
ওর ভেতর একটু একটু করে ভয় ঢুকতে লাগল। কিন্তু ভয়টা আচ্ছন্ন একধরনের ভয়, স্বপ্নের মত। ওর মনে হল না যে ও জেগে আছে। কিন্তু তাও ওর ভয় যাচ্ছিল না।
ও একটানে পর্দাটা সরিয়ে দিল।
বাথটাবের পানিতে জর্জ হ্যাফিল্ডের নগ্ন, মৃত শরীর ভাসছে। একটা ছোরা ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে ওর বুকে। জর্জের চোখদুটো বন্ধ। ওর চারপাশের পানি হালকা গোলাপী রঙ ধারণ করেছে।
“জর্জ…” জ্যাক নিজের গলা শুনতে পেল।
জর্জ চোখ মেলল। চোখগুলো মানুষের চোখের মত নয়। সম্পূর্ণ সাদা, মার্বেল পাথরের মত। জর্জ আস্তে আস্তে বাথটাবে উঠে বসল। জ্যাক খেয়াল
করল যে ওর বুকের ক্ষত থেকে কোন রক্ত বের হচ্ছে না।
“আপনি ইচ্ছা করে আগে ঘণ্টা বাজিয়েছেন।”
“না, জর্জ, আমার কথা শোন-”
“আমি তোতলাই না।”
জর্জের মুখে একটা বিকৃত, বাঁকা হাসি দেখা দিল। ওর একটা পা বাথটাব থেকে বেরিয়ে থপ করে মেঝের ওপর পড়ল। পানিতে ভিজে পায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে।
“প্রথমে তুমি আমার সাইকেলকে গাড়ি চাপা দিয়েছ, তারপর আগে ঘণ্টা বাজিয়েছ, আর এখন আমাকে তুমি ছুরি মেরে খুন করতে চাও?” জর্জ এগিয়ে এল জ্যাকের দিকে। ওর হাতে আঙুলগুলো বাঁকা, নখগুলো পচে গেছে। ওর শরীর থেকে শ্যাওলার গন্ধ ভেসে আসছিল।
“আমি তোমার ভালর জন্যেই আগে ঘণ্টা বাজিয়েছিলাম…” জ্যাক এক পা পিছিয়ে গেল। “আর আমি জানি শেষ ডিবেটটায় তুমি চিটিং করেছ।”
“আমি চিটিং করি না।আমি তোতলাই না।”
জর্জের হাত জ্যাকের গলা চুল।
জ্যাক ঘুরে দৌড় দিল। কিন্তু সর্বশক্তি দিয়ে দৌড়ানোর পরও ওর মনে হল ও খুব আস্তে আস্তে আগাচ্ছে। ও বেডরুমে এসে ঢুকল।
“তুমি চিটিং করেছ!” জ্যাক রাগে, ভয়ে চেঁচিয়ে উঠল। “আমি তোমাকে প্রমাণ দেখাব!”
জর্জের আঙুল আবার ওর গলাকে ঘিরে ধরল। ওর বুক এত জোরে ধ্বকবক করছিল যে ওর মনে হচ্ছিল ওর হৃৎপিন্ড পাঁজর ফেঁটে বেরিয়ে আসবে।
অবশেষে জ্যাকের হাত দরজার নব পর্যন্ত পৌঁছাল। এক টানে দরজাটা খুলে ও বেরিয়ে এল বাইরে। বাইরে করিডর নয়, বেসমেন্ট। বেসমেন্টের মলিন হলুদ আলোটা মাথার ওপরে জ্বলছে। আর চারদিকে, যতদুর চোখ যায়, বাক্সের পর বাক্সভর্তি কাগজ আর কাগজ।
জ্যাক স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। “দাড়াও, আমি এখনই প্রমাণটা খুঁজে বের করছি!” ও হাত দিয়ে একটা বাক্স তুলতে গেল। কিন্তু ছোঁবার সাথে সাথে বাক্সটা ছিড়ে একগাদা কাগজ মাটিতে পড়ল।
জর্জের হাত আবার ওর গলায় এসে পড়ল। এবার জ্যাক আর ভয় পেল না। ও এক ঝটকায় ঘুরে জর্জের মুখোমুখি হল, ওর চোখে হিংস্র দৃষ্টি। ওর হাতে কে যেন একটা ছড়ি ধরিয়ে দিল। দেখতে ঠিক ওর বাবা যে ছড়িটা নিয়ে হাঁটত তেমনি।
জ্যাক ছড়িটা শক্ত করে দু’হাতে ধরে মাথার ওপরে তুলল। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে নামিয়ে আনল জর্জের মুখের ওপর। জর্জের মাথা ফেটে রক্ত বেড়িয়ে এল। ও হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মাটিতে।
“প্লিজ, মিস্টার টরেন্স,” জর্জ কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “মাফ করে দিন আমাকে।”
জ্যাক আবার ছড়িটা তুলল। তারপর আবার নামিয়ে আনল জর্জের মুখে। আবার। আবার। আবার।
জ্যাক থামল। ও জোরে জোরে দম নিচ্ছে। নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে একটা অদ্ভুত জিনিস ওর চোখে পড়ল। ওর হাতের ছড়িটা বদলে একটা রোকে খেলার হাতুড়ির রুপ নিয়েছে।
যাকে ও এতক্ষণ মারছিল সে আস্তে আস্তে মুখ তুলে তাকাল। রক্তে ঢাকা চেহারাটা এখন আর চেনা যাচ্ছে না। কিন্তু ছেলেটা অস্ফুট গলায় একটা কথা বলল : “বাবা—”
ড্যানি?
হে ঈশ্বর, না, না, না-
জ্যাক জেগে উঠল। ও ড্যানির বিছানার সামনে নগ্ন অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে, সারা শরীর ঘামে ভেজা। ও ড্যানির দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বলল :
“না ড্যানি। কক্ষনও নয়। আমি এমন কখনও হতে দেব না।”
ও কাঁপা কাঁপা পায়ে নিজের বিছানায় ফিরে গেল।
অধ্যায় ৩৩ – স্নো-মোবিল
ইকুইপমেন্টের শেডের জানালা দিয়ে বাইরের মৃদু রোদটা জ্যাকের পিঠে এসে পড়ছিল। কাল সারারাত তুষারপাত হবার পর আজকে সকালে আকাশ একটু পরিষ্কার হয়েছে।
ইকুইপমেন্ট শেডটা হচ্ছে একটা ছোট ঘর, যেখানে হোটেলের কিছু সরঞ্জাম আর যন্ত্রপাতি রাখা থাকে। এখানে হেজ-ক্লিপার থেকে শুরু করে বিভিন্ন সাইজের শাবল পর্যন্ত সবই আছে। একপাশে তিনটে টেবিল টেনিস খেলার টেবিলও রাখা ছিল।
জ্যাক হেঁটে টেবিলগুলোর কাছে গেল। টেবিলগুলোর পাশে, মেঝেতে রোকে খেলার সরঞ্জাম স্তূপ করে রাখা হয়েছে। তার দিয়ে একে অপরের সাথে বেঁধে রাখা কয়েকটা উইকেট, কয়েকটা বড়, রঙচঙ্গে কাঠের বল আর দুই সেট হাতুড়ি।
জ্যাক হাতুড়িগুলো দেখে এগিয়ে এল। ও ঝুঁকে একটা হাতে তুলে নিল। হাতুড়িগুলোর হাতল বেশী লম্বা নয়। ও গোলাকার নিজের চোখের সামনে ধরে ভ্রু কুঁচকে দেখতে লাগল।
ওর স্বপ্নটা এখন আর ওর ভাল করে মনে নেই। জর্জ হ্যাফিল্ড আর ওর বাবার ছড়ি নিয়ে কিছু একটা। তাও, জ্যাকের ভেতর কেন যেন রোকের হাতুড়িটা ধরবার পর থেকেই অপরাধবোধ দেখা দিয়েছে। ও অনুভূতিটাকে পাত্তা দিল না।
রোকে একসময় বনেদী খেলা ছিল। শুধু রাজা-জমিদারদেরই রোকে কোর্ট বানাবার মত যথেষ্ট জমি ছিল। এখন অবশ্য রাজা-রাজড়াদের দিন চলে গেছে। তাও, এখন চোখের সামনে সরঞ্জামগুলো দেখে জ্যাকের আপনাআপনিই শ্রদ্ধা হচ্ছে। ওর মনে পড়ল যে ও বেসমেন্টে একটা ছাতা পড়া রোকে খেলার নিয়ম-কানুনের বই দেখেছে। ওখানে লেখা ছিল যে ১৯২০ এর দিকে ওভারলুকে একটা রোকে টুর্নামেন্ট হয়েছে।
জ্যাক হাতুড়িটা দেখতে দেখতে মৃদু হাসল। জিনিসটার একটা মুখ নরম, কিন্তু আরেকটা মুখ প্রচণ্ড শক্ত। রোকে খেলতে একদিকে যেমন সুক্ষ্যতা আর তীক্ষ্ণ চোখ দরকার, তেমনই শক্তিও দরকার।
খেলাই বটে একটা।
ও হাতুড়িটা দিয়ে বাড়ি মারার ভঙ্গি করল। হাতুড়িটা বাতাসে কেটে যাবার সময় যে শীষ তুলল সেটা শুনে জ্যাকের মুখে আবার হাসি ফুটে উঠল।
ও হাতুড়িটা আগের জায়গায় রেখে দিল। অনেক হয়েছে।
ও এবার মনোযোগ দিল এখানে ও যে উদ্দেশ্যে এসেছে, সেটাতে। স্নো- মোবিলটা শেডের একদম মাঝখানে রাখা। বেশ নতুন, এক দেখাতেই বোঝা যায়। গায়ে ক্যাটক্যাটে হলুদ রঙ করা, মাঝামাঝি দু’টো লম্বা কালো দাগ চলে গেছে। নীচ থেকে যে স্কি দু’টো বেরিয়ে এসেছে সেগুলোও কালো রঙের। জ্যাকের রঙটা মোটেও পছন্দ হল না। সকালের ম্লান আলোতে হলুদ-কালো স্নো-মোবিলটাকে দেখতে একটা বিশাল বোলতার মত লাগছে।
ও নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের ঠোঁট মুছল। বাইরে একটা জোরালো বাতাস বয়ে গেল, যেটার ধাক্কায় জরাজীর্ণ ইকুপমেন্ট শেডটা ক্যাঁচক্যাঁচ করে নড়ে উঠল। জ্যাক জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল যে বাতাসটা একগাদা তুষার উড়িয়ে আকাশটাকে প্রায় সাদা করে দিয়েছে।
ও আবার চোখ ফিরিয়ে আনল স্নো-মোবিলটার দিকে। জিনিসটাকে ও যত দেখছে ওর ততই অপছন্দ হচ্ছে। এমনিতেই স্নো-মোবিল ওর খুব প্রিয় কোন বস্তু নয়। শীতের নিস্তব্ধতাকে ভেঙ্গে চুরমার করে দেয় এই অপদার্থ যানবাহনগুলো। ধোঁয়া উড়িয়ে কালো করে দেয় গাছের পাতা।
ওর খবরে পড়া একটা গল্পের কথা মনে পড়ে গেল। একটা ছেলে গভীর রাতে অনেক জোরে স্নো-মোবিল চালাচ্ছিল। ওর হেডলাইট বন্ধ করা ছিল। একটা নির্জন রাস্তা দিয়ে চালাতে চালাতে ওর সামনে একটা তার এসে পড়ে, যেটা ও অন্ধকারে দেখতে পায়নি। ওর শরীর সোজা তার ভেদ করে চলে যায়, মাথাটা পড়ে থাকে রাস্তায়।
(ড্যানির চিন্তা না থাকলে আমি এতক্ষণে একটা হাতুড়ি নিয়ে স্নো- মোবিলটাকে টুকরো টুকরো করে ফেলতাম )
জ্যাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। না। ওয়েন্ডি ঠিকই বলেছে। এই স্নো- মোবিলটা ওদের নীচে যাবার শেষ ভরসা। এটাকে নষ্ট করা আর ড্যানিকে মেরে ফেলা একই কথা।
“কপাল!” জ্যাক জোরে বলে উঠল I
ও স্নো-মোবিলের তেলের ট্যাংকের ক্যাপটা খুলে একটা আঙুল ঢুকিয়ে দিল ভেতরে, কতখানি তেল আছে বুঝবার জন্যে। খুব বেশী নেই, কিন্তু চলবে। দরকার হলে ও হোটেলের ট্রাক অথবা নিজের ভোক্সওয়্যাগন থেকে তেল বের করে নেবে।
ও এবার হুডটা খুলে দেখল এঞ্জিনের কি অবস্থা। না, আসলেই ব্যাটারি আর স্পার্কপ্লাগ খুলে রাখা হয়েছে।
ও ইকুউইপমেন্ট শেডের এদিকে ওদিকে খুঁজে দেখতে দেখতে একটা তাকের ওপর একটা বাক্স দেখতে পেল। বাক্সটা নাড়াতে, ভেতর থেকে ধাতব কিছুর আওয়াজ ভেসে এল। স্পার্ক প্লাগ।
ও একটা টুল টেনে স্নো-মোবিলের পাশে বসল। তারপর একে একে চারটা স্পার্ক প্রাগ বাক্স থেকে বের করে এঞ্জিনে জায়গামত লাগিয়ে দিল।
এবার ব্যাটারি খোঁজার পালা। প্রাগগুলো ও যত সহজে পেয়ে গিয়েছিল ব্যাটারি অত সহজে পাওয়া গেল না। জ্যাকের অবশ্য তাতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। বরং ব্যাটারিটা না পাওয়া গেলেই ভাল। ওর ওপর থেকে একটা কঠিন সিদ্ধান্তের বোঝা নেমে যায় তাহলে।
পুরো ঘরে খুঁজেও কোন ব্যাটারি পাওয়া গেল না। কেউ হয়তো জিনিসটা নিয়ে গেছে। হয়তো ওয়াটসন নিজেই সুযোগ বুঝে হোটেল বন্ধ হবার দিন ব্যাটারিটা লোপাট করেছে।
যাক, এখানেই তাহলে ওদের নীচে নামবার অভিযানে সমাপ্তি। যেয়ে ওয়েন্ডিকে এখন খবরটা জানাতে হবে। বেরোবার আগে জ্যাক স্নো-মোবিলটার গায়ে দড়াম করে একটা লাথি মারল, আর সেই লাথির ঠেলায় ও যে টুলটায় বসে ছিল সেটা উলটে পড়ল।
বাক্সটা টুলটার ঠিক নীচেই রাখা ছিল।
জিনিসটা দেখে জ্যাকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেল।
(আমি যা চাই সেটা কখনও হয় না!)
ঠিক যখন ও ভেবেছিল যে জিনিসটা নিয়ে ওর আর মাথা ঘামাতে হবে না, তখনই ওর কপাল ওকে মনে করিয়ে দিল যে ও কখনও খুশি থাকতে পারবে না।
না, এটা অবিচার। জ্যাক এটা নিজের সাথে হতে দেবে না। এই একবার জ্যাক টরেন্স জিতবে, ওর পোড়া কপাল নয়। জ্যাক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। ও বলবে যে ও ব্যাটারি খুঁজে পায়নি।
কিন্তু দরজাটা খুলবার সাথে সাথে একটা দৃশ্য ওকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করল। ড্যানি হোটেলের পোর্চে দাঁড়িয়ে একটা তুষারমানব বানাবার চেষ্টা করছে। যদিও বরফটা ঠিকমত মানুষের চেহারা নিতে রাজি হচ্ছিল না, তাও ড্যানি বারবার চেষ্টা করছে মাথাটায় একটা নাক বসাবার।
ঝকঝকে সাদা বরফ আর সাদা আকাশের নীচে ছোট্ট একটা ছেলে।
(কিভাবে তুমি ভাবলে যে তুমি ওকে মিথ্যা কথা বলবে?)
জ্যাকের হঠাৎ করে মনে পড়ল যে ও কাল রাতে ওয়েন্ডিকে মেরে ফেলার কথা ভাবছিল। ও নিজের বৌকে গলা টিপে খুন করতে চেয়েছিল।
তখন, ঠিক তখন জ্যাক বুঝতে পারল যে ওভারলুক শুধু ড্যানির সাথেই ছলনা করছে না, ওর সাথেও করছে। ড্যানির মানসিকতাকে এখনও ওভারলুক বিকৃত করতে পারে নি, কিন্তু জ্যাকেরটা ঠিকই করেছে।
ও মুখ তুলে ওভারলুকের দিকে তাকাল। ওর মনে হল হোটেলের দু’পাশের জানালাগুলো দু’টো চোখ, আর চোখ দু’টো সরাসরি জ্যাকের দিকে তাকিয়ে আছে।
জ্যাকের মাথা এখন পরিষ্কার কাজ করছে। ও হোটেলের উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছে। হোটেলটা ড্যানিকে চায়। হয়তো ওদের সবাইকেই, কিন্তু ড্যানিকে সবচেয়ে বেশী। টপিয়ারির জন্তুগুলো আসলেই ওর দিকে এগিয়ে এসেছিল, ২১৭ নাম্বার রুমে আসলেই এক মৃত মহিলার আত্মা থাকে… এমনিতে সেই আত্মার হয়তো কারও ক্ষতি করবার শক্তি নেই, কিন্তু ড্যানির অদ্ভুত ক্ষমতা তাকে জাগিয়ে তুলেছে। আরও কতগুলো আত্মা আছে এই হোটেলে? ওয়াটসন বা আলম্যান কেউ একজন ওকে বলেছিল যে রোকে কোর্টে একজন হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যায়… চারতলায় একজন খুন হয়…আরও কতজন মারা গেছে এই হোটেলে? গ্রেডি কি হোটেলের কোন এক অন্ধকার কোণায় কুড়াল হাতে অপেক্ষা করছে, ড্যানি কখন ওকে জাগিয়ে তুলবে তার জন্যে?
ড্যানির গলায় আঙণলের দাগ
রেডিওতে জ্যাকের বাবার গলা
প্রতি রাতে দুঃস্বপ্ন
বেসমেন্টে খুঁজে পাওয়া স্ক্র্যাপবুক
ধাঁধার সবগুলো অংশ জ্যাকের মাথায় এক এক করে মিলে গেল। ও এক ঝটকায় উঠে দাঁড়িয়ে আবার ইকুইপমেন্ট শেডের ভেতরে গিয়ে বাক্স থেকে ব্যাটারিটা টেনে বের করল। শেডের তাকগুলো থেকে খুঁজে বের করল একটা রেঞ্চ। তারপর দশ মিনিট এঞ্জিনের সাথে জোরাজুরি করে ব্যাটারিটা জায়গামত লাগিয়ে দিল।
ওরা যদি থেকে যায় তাহলে ওভারলুক ওদেরকে নিয়ে এই ইঁদুর-বেড়াল খেলা চালিয়েই যাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত ওরা একজন আরেকজনকে মেরে না ফেলে, আর ওভারলুকের শত শত অপঘাতে মৃত আত্মার সাথে যোগ দেয়। এখানে থাকার কোন প্রশ্নই ওঠে না।
(কিন্তু আমার এখনও যেতে ইচ্ছা করছে না! )
জ্যাক জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলছিল, আর ওর মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে ধোঁয়ার মত কুয়াশা। ও যখন প্রথম এখানে এসেছিল ওর মনে কোন দ্বিধাদ্বন্দ ছিল না। ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল যে পুরো শীতকালটা এখানেই কাটাবে। এমনকি ওয়েন্ডি যখন বারবার নীচে যাবার কথা বলা শুরু করেছিল তখনও জ্যাকের সিদ্ধান্ত বদলায়নি। হোটেল ছেড়ে চলে যাওয়া মানে ওদের পরিবারের পথে বসে যাওয়া। জ্যাক আরেকটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। ওর এখন মনে হচ্ছে হোটেলের আসল রুপটা ও না দেখলেই ভাল হত। ওর নাটকের চরিত্রগুলোর মধ্যে যেমন বোঝা যাচ্ছিল না কে ঠিক আর কে ভুল, তেমনি জ্যাক বুঝতে পারছে না ওর এই পরিস্থিতিতে কে ঠিক, ওয়েন্ডি, যে নীচে যেতে চায় বর্তমানের বিপদ এড়াতে, নাকি জ্যাক, যে হোটেলে থাকতে চায় ভবিষ্যতের বিপদের কথা চিন্তা করে।
ভাবতে ভাবতে জ্যাকের মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল।
সবকিছু আসলে ড্যানিরই দোষ। ওকে বরফে খেলতে দেখার আগে তো জ্যাকের মনে কোন প্রশ্ন ছিল না? ওর ওই অভিশপ্ত ক্ষমতা, জ্যোতি না কি যেন, ওটার জন্যেই এত অসুবিধা হচ্ছে। ও না থাকলে জ্যাক আর ওয়েন্ডির পুরো শীতকাল এখানে কাটাতে কোন সমস্যাই হত না।
(যেতে ইচ্ছা করছে না? নাকি পারবে না?)
ওভারলুক চায় না যে ওরা চলে যাক, আর জ্যাকও চায় না। ড্যানিও হয়তো চায় না। কে জানে, ও হয়তো এখন ওভারলুকেরই একটা অংশ হয়ে গেছে। হোটেলটা তো জানে যে ও একজন লেখক। হয়তো ওভারলুক চায় যে জ্যাক হোটেলের ইতিহাস মানুষের সামনে নিয়ে আসুক। আর ওর ছেলে আর বৌ যদি ওকে এটা করতে বাধা দেয়, তাহলে ওদের খতম করে দেয়া ছাড়া কিছু করার নেই…
জ্যাকের মাথাব্যাথা একটু একটু করে ফিরে আসছে। আসল প্রশ্ন তো একটাই, তাই না? ওরা কি থাকবে, না যাবে?
ওরা হোটেল ছেড়ে চলে গেলে কয়দিন টিকবে? জ্যাকের চোখের সামনে আবার ওই দৃশ্যটা ফুটে উঠল : টরেন্স পরিবারের যাবার কোন জায়গা নেই, মানুষের কাছে চেয়েচিন্তে দিন কাটাতে হচ্ছে।
“যাই করি, আমাকেই হারতে হবে।” জ্যাক মৃদু স্বরে বলল।
হঠাৎ করে জ্যাক স্নো-মোবিলটার দিকে ফিরে তাকাল। তারপর একটানে ইঞ্জিন থেকে ব্যাটারিটা খুলে ফেলল। তারপর সেটা হাতে নিয়ে ও শেডের পেছনের দরজাটা খুলল। এখানে দুই দরজাটা থেকে দুই ফিট দূরে ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাহাড়। জ্যাক পাহাড়ের মুক্ত, তাজা বাতাসে লম্বা একটা শ্বাস নিল। তারপর সর্বশক্তি দিয়ে ব্যাটারিটা ছুঁড়ে মারল পাহাড়ের নীচে।
হোটেলে ফিরে যাবার আগে পোর্চে দাঁড়িয়ে জ্যাক কিছুক্ষণ ড্যানিকে তুষারমানব বানাতে সাহায্য করল।
অধ্যায় ৩৪ – টপিয়ারি
নভেম্বর ২৯, থ্যাংকসগিভিং উৎসবের তিনদিন পর। টরেন্স পরিবারের জন্যে উৎসবটা ভালই কেটেছে। ডিক হ্যালোরান ওদের জন্যে যে তিতিরটা রেখে গিয়েছিল ওয়েন্ডি সেটাকে রোস্ট করেছে। রোস্টটা এত বড় ছিল যে তিনজন মিলেও শেষ করতে পারে নি।
ড্যানির গলার দাগগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গিয়েছে। টরেন্স পরিবারের মনে যে চাপা ভয় বসে গিয়েছিল তাও যেন আস্তে আস্তে কেটে গিয়েছে। থ্যাংকসগিভিং এর দিন বিকালে ওয়েন্ডি ড্যানিকে নিয়ে বাইরে বরফে খেলা করছিল, আর জ্যাক ভেতরে নিজের নাটক নিয়ে বসেছিল। নাটকটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।
“তোমার কি এখনও ভয় হয়, ডক?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল।
“হ্যা,” ড্যানি ছোট করে উত্তর দিল। “কিন্তু এখন আমি ওসব জায়গায় আর যাই না যেখানে আমার ক্ষতি হতে পারে।”
“তোমার বাবা বলেছে যে কিছুদিন পর রেঞ্জাররা আমাদের খোঁজ নিতে আসবে। তখন হয়তো আমি আর তুমি নীচে চলে যাব। তোমার বাবা শীত শেষ করে আসবে। ড্যানি…আমাদের কোন উপায় নেই। আরও কিছুদিন এখানে থাকতেই হবে।”
“আচ্ছা,” ড্যানি ভাবলেশহীন গলায় উত্তর দিয়েছিল।
এখন, থ্যাংকসগিভিং এর তিনদিন পর একটা সুন্দর বিকালে, বাবা আর আম্মু নিজেদের রুমে শুয়ে আছে। ওরা দু’জন এখন আগের মত খুশি আছে, ড্যানি জানে। আম্মু এখনও একটু একটু ভয় পায়, কিন্তু বাবার মনের অবস্থাটা অদ্ভুত। যেন বাবাকে খুব কঠিন কোন কাজ করতে হয়েছে, কিন্তু যা করেছে সেটা নিয়ে বাবা খুশি। জিনিসটা যে কি ড্যানি সেটা এখনও বুঝতে পারছিল না। দুইবার ড্যানি চেষ্টা করেছে গভীর মনোযোগ দিয়ে বাবার মনের কথা পড়তে, আর দুইবারই একটা ছবির চেয়ে বেশী কিছু দেখতে পায়নি। একটা কালো অক্টোপাসের মত প্রাণী, নীল আকাশকে ঢেকে ফেলছে। এরপর ড্যানি চেষ্টা করা বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ দুইবারই ও খেয়াল করেছে যে বাবা ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে, যেন সে জানে ড্যানি কি করতে চায়।
এখন ড্যানি বাইরে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিল। বুট, স্নো-শু, ভারী জ্যাকেট আর স্কী-মাস্ক পড়া ড্যানিকে এখন আর চেনাই যাচ্ছে না।
ও এখন প্রায়ই হোটেলের পেছনের খোলা জায়গাটায় খেলতে যায়। বাইরে থাকলে ওর মনে হয় ওর ওপর থেকে একটা ছায়া সরে গেছে, ওর কাঁধ থেকে একটা বোঝা নেমে গেছে।
আজকেও ওর হোটেলের পেছনেই যাবার কথা ছিল, কিন্তু একটা কথা মনে পড়াতে ড্যানি থেমে গেল। এখন বিকাল হয়ে গেছে। তারমানে হোটেলের পেছনদিকটা হোটেলের ছায়ায় ঢেকে গেছে। একমুহূর্ত চিন্তা করে ড্যানি সিদ্ধান্ত নিল যে ও আজকে হোটেলের সামনেই খেলবে। টপিয়ারির সামনে যে প্লেগ্রাউন্ড আছে সেখানে।
ডিক হ্যালোরান যদিও ওকে টপিয়ারিতে যেতে মানা করেছিল, ড্যানির কখনওই ওই উদ্ভট ঝোপজন্তুগুলোকে দেখে ভয় লাগেনি। তাছাড়া এখন ওগুলো সব তুষারে প্রায় ডুবে গিয়েছে। শুধু কয়েকটা পশুর মাথা বরফ ভেদ করে এখনও দাঁড়িয়ে আছে, অন্যগুলোকে তো দেখাই যায় না।
ড্যানি হোটেলের সামনের দরজা খুলে পোর্চে বেরিয়ে এল। ওর স্নো-শু পড়ে হাঁটতে তেমন অসুবিধা হয় না, কিন্তু ও এখনও ছোট দেখে বেশীক্ষণ হাঁটলে ওর পা ব্যাথা হয়ে যায়। তাই ও কিছুক্ষণ পর পর থেমে থেমে হাঁটে।
প্রেগ্রাউন্ড পর্যন্ত পৌঁছাবার পর ড্যানি দেখতে পেল যে বরফে ঢেকে যাবার পর জায়গাটাকে আরও সুন্দর লাগছে দেখতে। দোলনাগুলো যে শেকল থেকে ঝোলে সেগুলো জমে স্থির হয়ে গেছে। লুকোচুরি খেলার জন্যে যে জাঙ্গল জিমটা আছে সেটাকে মনে হচ্ছে বরফে লুকনো কোন প্রাচীন গুহা, আর ওভারলুকের মডেলটার চিমনিগুলো বাদে বাকি সবকিছু বরফের নীচে ঢাকা পড়ে গিয়েছে। সবমিলিয়ে জায়গাটাকে রুপকথার বইয়ের কোন ছবির মত দেখাচ্ছিল।
প্লেগ্রাউন্ডটার একপাশে দু’টো রঙ্গিন সিমেন্টের সুরঙ্গ আছে, যেখানে বাচ্চারা হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে বা বের হতে পারবে। সুড়ঙ্গে ঢুকবার মুখগুলো এখনও বরফে ডুবে যায়নি। ড্যানি নীচু হয়ে একটা সুড়ঙ্গে ঢুকে গেল। ওর নিজেকে একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী মনে হচ্ছিল, যারা বরফে ঢাকা পর্বতের চূড়ায় কোন গুহার ভেতর মশাল জ্বালিয়ে থাকে।
সুরঙ্গ থেকে বের হবার মুখটা বরফে একদম চাপা পড়ে গেছে। ড্যানি হাত দিয়ে বরফটা খুঁড়ে রাস্তা পরিষ্কার করবার চেষ্টা করল। একবার চেষ্টা করেই ও থেমে গেল। এখানকার বরফ খুঁড়ে বের হবার শক্তি বাবারও আছে কিনা সন্দেহ।
হঠাৎ ড্যানির খেয়াল হল যে ও একটা সরু টানেলের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে বসে আছে, যেটার সামনে দিয়ে বের হবার কোন রাস্তা নেই। কথাটা মনে হবার সাথে সাথে ওর মুখ শুকিয়ে গেল। ও এখানে একদম একলা, বাবা-মা হোটেলের ভেতর ঘুমিয়ে আছে, আর ওভারলুক ড্যানিকে পছন্দ করে না।
ও কোনমতে নিজের শরীরকে মুচড়ে উল্টোদিকে ঘোরাল, ও যেদিক দিয়ে ঢুকেছে সেদিকে। তারপর দ্রুত হামাগুড়ি দিয়ে ও মুখের সামনে চলে এল। ঠিক যখন ও সুড়ঙ্গ থেকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছে, তখন ওপর থেকে একরাশ বরফ পড়ে সুড়ঙ্গের এ মুখটাও বন্ধ করে দিল।
একমুহূর্তের জন্যে ড্যানি এত ভয় পেল যে ওর দম বন্ধ হয়ে গেল।
আমি এখানে আটকে গেছি! এখন এই অন্ধকারেই আমাকে মরতে হবে! এই অন্ধকারে একা একা-
এখানে ও একা নয়। সুড়ঙ্গে অন্য কিছু একটা আছে।
ড্যানির মনে হচ্ছিল ভয়ে ওর বুক ফেটে যাবে। হ্যা, কোন সন্দেহ নেই। কোন ভয়ংকর কিছু যেটা ওভারলুক এতদিন সামনে আনেনি, কিন্তু এখন ড্যানিকে অসহায় দেখে লেলিয়ে দিয়েছে। জিনিসটা কি হতে পারে? একটা বিশাল মাকড়সা? নাকি হিংস্র একদল ইঁদুর যেগুলো ড্যানিকে কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবে? নাকি…কোন বাচ্চার লাশ, যে আগে ওর মতই এখানে আটকা পড়ে মারা গিয়েছিল?
ড্যানি পেছন থেকে একটা শব্দ শুনতে পেল। কোনকিছুর হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে আসার শব্দ।
ওর সামনে একটাই রাস্তা আছে। ও প্রাণপণে দু’হাত দিয়ে সামনের বরফটা খুঁড়তে শুরু করল। এখানে যে বরফটা রাস্তা বন্ধ করে রেখেছে সেটা অন্যপ্রান্তের বরফের মত শক্ত নয়। ও মিনিটখানেক খুঁড়বার পর বরফ ভেদ করে বাইরের আলো দেখা দিল। আলোটা দেখে ড্যানির সাহস বেড়ে গেল। ও দুই হাত মাথার সামনে রেখে সর্বশক্তি দিয়ে ডাইভ দিল সামনে।
এক লাফে ড্যানির শরীর সুড়ঙ্গের বাইরে বেরিয়ে এল। ও রোদে কিছুক্ষণ চোখ পিটপিট করল। ও উঠে খুঁড়িয়ে খুড়িয়ে জাঙ্গল জিমটার কাছে গেল। ওর একটা স্নো-শু ডাইভের কারণে প্রায় খুলে গিয়েছে। ও বসে সেটাকে ঠিক করল। এরমধ্যে একমুহূর্তের জন্যেও ও সুড়ঙ্গের মুখ থেকে চোখ সরায়নি। ভেতরের জিনিসটা কি ওর পিছে পিছে বেরিয়ে আসবে?
অনেকক্ষণ যাবত কিছুই হল না। ড্যানি আস্তে আস্তে শান্ত হল। হয়তো ভেতরের জিনিসটা সূর্যের আলো ভয় পায়।
(যাক আমি ঠিক আছি আর কোন ভয় নেই আমি এখনই হোটেলে ফেরত যাচ্ছি)
ওর পেছনে থপ করে একটা শব্দ হল।
ড্যানি এক ঝটকায় মাথা ফেরাল পেছনে। কিন্তু পিছে তাকাবার আগেই ও বুঝতে পেরেছে এটা কিসের শব্দ। হোটেলের ছাদ থেকে যখন ঝুপ করে মাটিতে একরাশ বরফ পড়ে তখন এরকম শব্দ হয়। টপিয়ারিতে কিছু একটা ঝাড়া দিয়ে নিজের শরীর থেকে বরফ ফেলে দিয়েছে।
কুকুরটা। যখন ড্যানি প্লেগ্রাউন্ডে আসে, তখন বরফের নীচে কুকুরের আকৃতিতে কাটা ওই ঝোপটা পুরোপুরি ঢেকে গিয়েছিল। এখন কুকুরটার গায়ে কোন তুষার নেই, সাদা প্লেগ্রাউন্ডে সবুজ আকৃতিটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।
ড্যানি এবার অতটা ভয় পেল না। ও এখন বাইরে, রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে। কোন অন্ধকার সুড়ঙ্গে নয়। আর ওটা একটা কুকুর ছাড়া কিছু নয়। তাছাড়া আজকে অনেক রোদ উঠেছে। এমনও তো হতে পারে রোদের তাপেই বরফটা ঝরে পড়েছে?
এমন সময় ওর সুড়ঙ্গের মুখটায় আবার চোখ পড়ল। ও যা দেখল তাতে ও আবার স্থির হয়ে গেল। ও সুড়ঙ্গের মুখের বরফে যে গর্তটা খুঁড়ে বেরিয়ে এসেছে সেখানে কিছু একটা নড়ছে। একটা হাত। কোন বাচ্চার হাত…?
ড্যানির এক সেকেন্ডের জন্যে মনে হল ও আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, ২১৭-তে যেমন হয়েছিল। কিন্তু পরমুহূর্তেই ও সোজা হয়ে দাঁড়াল। না, এখন ওর সজাগ থাকতে হবে। যে করেই হোক এখান থেকে পালাতে হবে। সমস্ত মনোযোগ এ চিন্তাটায় দাও, অন্য কিছুতে নয়।
আবার পেছনে ঝুপ করে বরফ ঝরে পড়ার শব্দ হল। ও ঘুরে দেখল যে এবার একটা সিংহের শরীর থেকে ঝরেছে। সিংহটা মনে হল আগের জায়গা থেকে একটু এগিয়েও এসেছে। এখন প্লেগ্রাউন্ডের গেটের একদম কাছাকাছি।
আবার ভয় মাথাচাড়া দেবার আগেই ড্যানি ওটাকে দমন করল। শুর এখান থেকে পালাতে হবে।
ও ঠিক করল ও প্লেগ্রাউন্ডের সামনের দরজা দিয়ে না বেরিয়ে ঘুরে বের হবে। ও মাটির দিকে তাকিয়ে নিজের স্লো-গুগুলোর দিকে মনোযোগ দিল।
আগাও, এক পা সামনে। তারপর আরেক পা। আরেক পা।
হাঁটতে হাঁটতে ও প্লেগ্রাউন্ডের অন্যপ্রান্তের বেড়াটার কাছে এসে পড়েছে। এখানে উঁচু হয়ে বরফ জমেছে। ওর বেড়া টপকাতে অসুবিধা হল না।
ওর ডান দিক থেকে আবার শব্দটা ভেসে এল। বরফ ঝরে পড়ার শব্দ। এবার ও ঘুরে দেখল দ্বিতীয় সিংহটাও এগিয়ে এসেছে। ওদের কোটর চোখগুলো ড্যানির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কুকুরটাও মাথা ফিরিয়েছে ওর দিকে।
(আমি যখন তাকাচ্ছি না শুধু তখনই ওরা নড়তে পারছে-)
(তুমি একজন দুঃসাহসী অভিযাত্রী মনে রেখ ভয়ের কিছু নেই)
ড্যানির মনে হচ্ছিল ভয়ে, ঠাণ্ডায় ওর হাত পা অসাড় হয়ে গেছে। তারপর ওর মনে পড়ল সুড়ঙ্গের ভেতরের জিনিসটার কথা, আর ও আবার তৈরি হল এখান থেকে পালাবার জন্যে।
ও আস্তে আস্তে আবার হাঁটতে শুরু করল, বরফের ওপরে স্নো-শু পরে দৌড়নো সম্ভব নয়। ওর এখন ক্লান্তও লাগছে, আর অনেকক্ষণ স্নো-ও পড়ে থাকলে ওর পায়ে যে ব্যাথাটা দেখা দেয় সেটা শুরু হয়ে গেছে। সামনে ওভারলুক হোটেল যেন ওর জানালা চোখগুলো দিয়ে ড্যানির দিকে তাকিয়ে আছে, ও কি করবে তা দেখার জন্যে।
ড্যানি আরেকবার নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে পেছনে তাকাল। প্রথম সিংহটা আরও এগিয়ে এসেছে। ওটার দাঁড়াবার ভঙ্গিও বদলে গেছে, দেখে মনে হচ্ছে ওটা লাফ দেবার জন্যে প্রস্তুত করছে নিজেকে।
ড্যানি মুখ ঘুরিয়ে সামনে তাকাল। আর পিছে ফেরা যাবে না। কিভাবে পালাবে এখান থেকে শুধু সেটার ওপর মনোযোগ দাও। আরেকটা পা ফেল সামনে। আরেকটা পা।
ড্যানি এখন সর্বশক্তি দিয়ে চেষ্টা করছে সামনে আগাতে, কিন্তু ওর গতি বাড়ছে না। ওর দুই পায়ের গোড়ালীর ওপর চিনচিন করছে।
অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও ও ঘাড় ঘোরাল পেছন দিকে। সিংহটা এখন ওর থেকে মাত্র পাঁচ ফিট দূরে। জন্তুটার মুখ হা হয়ে ভেতরে চোখা চোখা দাঁতের মত ডাল দেখা যাচ্ছে।
এবার ড্যানি সবকিছু ভুলে দৌড় দেবার চেষ্টা করল সামনের দিকে। অন্ধের মত ও হাত ছুঁড়তে ছুড়তে আগাল সামনে, ওর পায়ের ব্যাথা ভুলে গিয়ে। ও পোর্চের একদম কাছে চলে এসেছে এখন।
ও পোর্চের সিঁড়িতে আছড়ে পড়ল, ওর গলা থেকে বেরিয়ে এল একটা নিঃশব্দ চিৎকার। ওর পেছন থেকে ফড়ফড় করে কাপড় ছেড়ার শব্দ ভেসে এল। আরও একটা শব্দ হয়েছে ড্যানির মনে হল, কিন্তু সেটা পেছন থেকে এসেছে না ওর কল্পনা থেকে ড্যানি এখনও বুঝতে পারছিল না।
একটা চাপা গর্জন।
রক্তের গন্ধ ভেসে এল ওর নাকে।
ড্যানি ফোঁপাতে শুরু করল। ওর পিছে তাকাবার আর সাহস নেই।
ও কতক্ষণ ওখানে শুয়ে ছিল ও জানে না! একসময় ওর সামনে হোটেলের দরজাটা এক ঝটকায় খুলে গেল, আর জ্যাক বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। ওর পরনে শুধু একটা জিন্সের প্যান্ট আর স্যান্ডেল। ওর পেছনে ওয়েন্ডি।
“ড্যানি!” ওয়েন্ডি ওকে দেখে চেঁচিয়ে উঠল।
“ডক! ড্যানি, কি হয়েছে তোর?” জ্যাক ছুটে এসে ওকে কোলে তুলে নিল। ড্যানি দেখল যে ওর প্যান্টের পেছনদিকে, হাঁটুর ঠিক নীচে, কিছু একটা থাবা মেরেছে। প্যান্টটা ছিঁড়ে গেছে, আর ওর চামড়ায় ধারালো নখের দাগ। ও পেগ্রাউন্ডের দিকে তাকাল। বরফে সবগুলো পশু ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু কয়েকটার মাথা বেরিয়ে আছে তুষার ভেদ করে।