শাইনিং – ২৫

অধ্যায় ২৫ – ২১৭ এর ভেতরে

আড়াই সপ্তাহ বাদে ওভারলুকের চারদিক প্রায় দুই ফিট তুষারের নীচে ডুবে গিয়েছিল। দুই বার জ্যাক চেষ্টা করেছে একটা কোদাল দিয়ে হোটেলের দরজা থেকে রাস্তা পর্যন্ত জায়গাটা বরফমুক্ত রাখার। শেষে ও হার স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে। লাভের মধ্যে ও শুধু দরজার সামনেটা পরিষ্কার করতে পেরেছে, আর ড্যানি এখন চাইলে ওর স্নোবোর্ড নিয়ে বাইরে খেলতে পারে। ওদের ফোনলাইন গত আটদিন ধরে নষ্ট। বাইরের দুনিয়ার সাথে ওদের একমাত্র সংযোগ হচ্ছে সিবি রেডিওটা।

এখন প্রত্যেকদিন বরফ পড়ে। কখনো ঝিরি ঝিরি বৃষ্টির মত, কখনো পুরোদমে। বাইরে তখন বাতাসের শোঁ শোঁ গর্জনে কান পাতা যায় না। কিন্তু এখনও দুই-এক দিন রোদ ওঠে। সেই দিনগুলোতে ওরা সবাই মিলে বাইরে যায়, অন্য কোন কারণে নয়, শুধু অভ্যাসের বশে।

মাঝে মাঝে ওরা হোটেলের বেড়ার বাইরে ক্যারিবু নামে এক ধরণের হরিণ দেখতে পায়। প্রথম যেদিন ক্যারিবুগুলো এসেছিল সেদিন ওরা সবাই জানালা দিয়ে চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে দেখেছে ওরা কি করে। প্রাণীগুলো কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর চলে যায়।

হোটেলের একুইপমেন্ট শেডে বেশ কয়েকটা স্নো-শু আছে, যেগুলোর মধ্যে থেকে জ্যাক তিনটা বের করে নিয়ে এল। ওয়েন্ডির অবশ্য স্নো-শু জিনিসটা কখনওই তেমন পছন্দ ছিল না। এই চ্যাপ্টা, ব্যাডমিন্টন-ব্যাটের মত দেখতে জিনিসগুলো বুটের নীচে লাগিয়ে নিতে হয় বরফের ওপর হাঁটার আগে। উদ্দেশ্য হচ্ছে যাতে বরফের মধ্যে পা না ডুবে যায়। জ্যাক নিজেও ভুলে গিয়েছিল কিভাবে এগুলো পরে হাঁটতে হয়। কিন্তু দু’-একদিন প্র্যাকটিস করে ও আবার কায়দাটা রপ্ত করে নিল। ওয়েন্ডি প্র্যাকটিস করতে যেয়ে নিজের গোড়ালী ব্যাথা করে ফেলল। ড্যানির অবশ্য কোন অসুবিধা হল না।

সেদিন দুপুর থেকেই বরফ পড়া শুরু হল। রেডিওতে আবহাওয়াবিদ জানাচ্ছিল যে এই এলাকার বাসিন্দারা আরও আট থেকে বার ইঞ্চি পর্যন্ত তুষারপাতের জন্যে যেন প্রস্তুত থাকে।

জ্যাক আবার বেসমেন্টে বয়লার চেক করতে গিয়েছে। এখন এটা ওর জন্যে একটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে-আর শীত আসার পর থেকে তো আরও বেশী-ওর কমপক্ষে দুইবার নীচে গিয়ে বয়লারের তাপমাত্রা আর প্রেশার ঠিক আছে কিনা তা মেপে দেখতে হবে।

আজকে বয়লার চেকিং শেষ হবার পর জ্যাক বেসমেন্টের যে অংশটায় কাগজপত্র জমিয়ে রাখা সেখানে এল। লাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে ও পুরনো কাগজগুলো ঘেঁটে দেখতে লাগল। খোঁজা শেষ হলে ও একগাদা কাগজ কোলে নিয়ে একটা চেয়ারে বসল। শীতের প্রকোপে ওর চামড়া ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তার ওপর এই ধুলোয় ঢাকা বেসমেন্টে কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে ওর চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। ওকে বাল্বের ঘোলা হলুদ আলোতে একটা পাগলের মত দেখাচ্ছিল।

দলিল আর চিঠিপত্রের মাঝে জ্যাক কয়েকটা অদ্ভুত জিনিস খুঁজে পেয়েছে। রক্তের দাগ লাগা এক টুকরো কাপড়। একটা পুরনো, ছেঁড়া টেডি বেয়ার যেটা দেখে মনে হয় ওটাকে ছুরি দিয়ে ফালা ফালা করা হয়েছে। মেয়েদের ডায়রির একটা পাতা, দোমড়ানো আর বেগুনী রঙের। একটা অসমাপ্ত নোট, যেটায় লেখা : “প্রিয় টমি, আমার এখানে কেন যেন চিন্তা করতে অসুবিধা হচ্ছে। এখানে আমি আজব আজব স্বপ্ন দেখি, হা হা, আর রাতে এমন অনেক শব্দ শুনতে পাই যেগুলো শোনার কথা নয়,” এ পর্যন্তই। নোটে একটা তারিখও লেখা, জুন ২৭, ১৯৩৪। আরও আছে একটা পুতুল, দেখতে অনেকটা ডাইনির মত, অনেক পুরনো দেখে ছেলে না মেয়ে বোঝা যাচ্ছে না। ধারালো দাঁত আর একটা চোখা টুপি ছাড়া আর কিছুই বেঁচে নেই। একটা কবিতার অংশও পাওয়া গেল, যেটায় লেখা :

মেডক
তুমি কি আছো?
আমি আবার ঘুমের মাঝে হাঁটছি
আমাকে বাঁচাও
কার্পেটের নীচে গাছপালার খেলা

জিনিসগুলো হয়তো তেমন কিছুই নয়, কিন্তু জ্যাক ওগুলোর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। ওর কাছে মনে হচ্ছিল এগুলো কোন ধাঁধার বিক্ষিপ্ত অংশ, যেগুলো ঠিক জায়গায় বসালে পুরো ছবিটা পরিষ্কার হবে।

ড্যানি আবার রুম নং ২১৭ এর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

চাবিটা ওর পকেটে খোঁচা দিচ্ছে। ও দরজাটার দিকে নেশাগ্রস্থের মত তাকিয়ে আছে।

ওর এখানে আসবার কোন ইচ্ছা ছিল না। ও এখন এখানে আসতে ভয় পায়। কিন্তু ওর কৌতুহলটা কিছুতেই যাচ্ছে না। কানের পাশে মাছির পাখার পিনপিন শব্দের মত

(অথবা বোলতার পাখা)

ওকে কৌতূহলটা বিরক্ত করতেই থাকে। আর মিস্টার হ্যালোরান তো বলেইছিলেন যে হোটেলে ও যা দেখবে সেটা ওর কোন ক্ষতি করতে পারবে না?

(তুমি কথা দিয়েছিলে)

(কিন্তু সব কথা না রাখলেও চলে, তাই না? )

চিন্তাটা মাথায় আসাতে ড্যানি প্রায় লাফিয়ে উঠল। এটা যেন ঠিক ওর চিন্তা ছিল না। যেন অন্য কারো গলা ওর মাথায় কথা বলছে।

(কথা দিয়ে কথা না রাখার মজাই আলাদা, রেডরাম। যা শপথ করেছিলে তা ভেঙ্গে ফেল, গুঁড়িয়ে ফেল, চুরমার করে ফেল!)

চোখ বন্ধ করে রাখো, জোরে চোখ বন্ধ করে রাখো তাহলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ভয়ের জিনিসটা চলে যাবে।

ড্যানি তার প্রমাণও পেয়েছে। তাহলে এখন ২১৭ তে ঢুকে দেখতে দোষ কি? ও চোখ বন্ধ করলেই তো সব চলে যাবে।

এখানে আসার আগে ও করিডরে পড়ে থাকা পাইপটা তুলে জায়গামত রেখেছে। ও ধাতব মুখটায় খোঁচা মেরে বলেছে, “তুই আমার কোন ক্ষতি করতে পারবি না, তাই না? পারবি না, কখনওই পারবি না!” আর ওর নিজেকে প্রচণ্ড সাহসী মনে হয়েছে কারণ পাইপটা কোন জবাব দিতে পারে নি। তাও ড্যানি ওখানে বেশীক্ষণ দাঁড়ায়নি। দ্রুত হেঁটে চলে এসেছে।

ও চাবিটা পকেট থেকে বের করে লকে ঢুকাল।

আস্তে করে ঘুরাতেই ‘ক্লিক’ করে একটা ছোট্ট শব্দ হল।

ও ধাক্কা দিয়ে দরজাটা একপাশে সরিয়ে দিল। দরজাটা নিঃশব্দে সরে গেল।

ভেতরে বেডরুম আর বসার ঘর মিলিয়ে একটা বড় ঘর। ঘরটা অন্ধকারে ঢাকা, কারণ বরফ পড়া শুরু হবার পর বাবা সবগুলো জানালায় বাইরে থেকে শাটার লাগিয়ে দিয়েছে।

ও দেয়ালে হাতড়াতে হাতড়াতে সুইচটা পেয়ে গেল। টেপার পর মাথার ওপর দু’টো বাল্ব জলে উঠল, আর ও ঘরটাকে আরও ভাল ভাবে দেখার সুযোগ পেল। মেঝেতে একটা নরম কার্পেট বেছানো, গাঢ় লাল রঙের। একটা বড় ডাবল বেড়, পরিষ্কার, সাদা রঙের চাদর দিয়ে ঢাকা। লেখার জন্যে একটা ডেস্ক। জানালাটা বেশ চওড়া। খোলা থাকলে এখান থেকে বাইরেটা দেখতে খুব সুন্দর লাগার কথা। কিন্তু এখানে অস্বাভাবিক কিছুই নেই।

কিছুই না। একটা কাপড় রাখবার ক্লজেট, যেটার ভেতর এখন হ্যাঙ্গার ছাড়া আর কিছু নেই। একটা টেবিলে একটা বাইবেল। ওর বাঁ দিকে বাথরুমের দরজা। দরজাটা একটু খোলা, আর দরজার গায়ে একটা লম্বা আয়না লাগানো যেটায় ও নিজের প্রতিবিম্ব দেখতে পাচ্ছে।

ড্যানি মাথা ঝাঁকাল।

হ্যা, ও যা দেখতে এসেছে সেটা বাথরুমের ভেতরেই আছে, কোন সন্দেহ নেই। ও আয়নাটার কাছে হেঁটে এল। মনে হচ্ছিল ওর প্রতিচ্ছবিও ওর দিকে এগিয়ে আসছে। ও আস্তে করে ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে দিল। তারপর মাথা গলিয়ে দিল ভেতরে।

ভেতরে চকচকে টাইল লাগানো মেঝেতে একটা হাই কমোড আর একটা বাথটাব বসানো। দেয়ালে সংযুক্ত বেসিনটার সামনে আরেকটা আয়না লাগানো। বাথটাবটার ওপরের অংশ একটা পর্দা দিয়ে ঢাকা আর পা গুলো কোন শ্বাপদের পায়ের মত ডিজাইন করা।

কোন একটা অজানা আকর্ষন ড্যানিকে বাথটাবটার সামনে নিয়ে গেল। ওর মনে হল পর্দার পেছনে কিছু একটা আছে যেটা হয়তো বাবা বা আম্মু হারিয়ে ফেলেছে, আর ও যদি খুঁজে দিতে পারে তাহলে ওরা খুব খুশি হবে।

তাই ও পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিল।

বাথটাবে শোয়া মহিলাটা মারা গেছে অনেকদিন আগে। তার চামড়া ফ্যাকাশে, নীল হয়ে গিয়েছে। পেটটা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে উঠেছে, কোন লাশ অনেকদিন পানিতে ডুবে থাকলে যেমন হয়। সম্পূর্ণ নগ্ন, তার স্তনগুলো পচা ফলের মত দু’দিকে ঝুলছে। হাতের আঙুলগুলো বাথটাবের দুই সাইড আঁকড়ে ধরে আছে। তার চোখগুলো ঘসা কাঁচের মত সাদা আর ভাবলেশহীন, ড্যানির দিকে তাক করা। তার দাঁতগুলো বেরিয়ে আছে একটা বিকৃত হাসির ভঙ্গিতে।

চিৎকার করতে যেয়ে ড্যানির গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না। ও মহিলার দিক থেকে চোখ না সরিয়ে পেছাতে গিয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেল। ওর নিজের ব্ল্যাডারের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ছরছর করে ও প্যান্ট ভিজিয়ে ফেলল।

মহিলা বাথটাবে আস্তে আস্তে উঠে বসেছে।

এখনও ভয়ংকর হাসিটা ওর মুখ থেকে যায়নি। মহিলা একবারও চোখ সরায়নি ড্যানির ওপর থেকে। সে উঠে বসার সময় বরফ ভাঙ্গার একটা ছোট্ট শব্দ হল। সে একটা লাশ, আর সে বহুদিন আগেই মারা গেছে।

ড্যানি উঠে দৌড় মারল। ওর চোখ দু’টো মনে হচ্ছিল মাথা থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। ও যেয়ে ২১৭ এর দরজায় আছড়ে পড়ল। ও দমাদম কিল মারতে লাগল দরজায়, ওর এখন আর এটা বুঝবার মত অবস্থা নেই যে দরজা লক করা ছিল না, ও নব ঘোরালেই দরজা খুলে যাবে। ও কিল মারতে মারতেই শুনতে পাচ্ছিল মহিলার পায়ের শব্দ, সে এগিয়ে আসছে, আরও এগিয়ে আসছে-

ঠিক তখন ডিক হ্যালোরানের গলা ওর কানে বেজে উঠল, এত আচমকা, যে ড্যানির গলা থেকে একটা ছোট্ট কান্নার শব্দ বেরিয়ে এল।

(আমার মনে হয় না ওরা তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে…ওরা বইয়ে আঁকা ছবির মত… চোখ বন্ধ রাখো তাহলেই দেখবে যে ওরা চলে গেছে)

ড্যানি এত জোরে চোখের পাতা চেপে ধরল যে ও চোখ জ্বলা শুরু করল। ও মাটিতে শুয়ে নিজের হাঁটু জড়িয়ে ধরে নিজে বারবার বলতে লাগল : ওখানে কিছু নেই, ওখানে কিছু নেই ওখানে কিছু নেই, ওখানে কিছু নেই-

কিছুক্ষণ সময় কাটল। ড্যানির মনে হল ওর পিছে আর কিছু নেই। ওর মাত্র মনে পড়েছে যে দরজাটা লক করা নয়, ও চাইলে বেরিয়ে যেতে পারবে। ও উঠে দরজাটা খুলতে যাবে ঠিক তখনই দু’টো বরফ-শীতল, স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধযুক্ত হাত ওর গলার দু’পাশে এসে পড়ল।

অধ্যায় ২৬ – স্বপ্নের দেশে

ড্যানি যখন রুম ২১৭ এর বাসিন্দার সাথে ব্যস্ত, তখন ওয়েন্ডি নীচে একটা সোয়েটার বোনার চেষ্টা করছিল। ঘুমে ওর দুই চোখ ঢুলুঢুলু হয়ে এসেছে। আরও পাঁচ মিনিট জেগে থাকার চেষ্টা করবার পর ও হাল ছেড়ে দিল। চেয়ারে বসে বসেই ওয়েন্ডি তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

জ্যাক টরেন্সও ঘুমিয়েও পড়েছিল, কিন্তু ওর ঘুম অতটা গভীর নয়। স্বপ্ন ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছিল। অদ্ভুত স্বপ্ন, যেগুলো দেখবার সময় বোঝা যায় না যে স্বপ্ন দেখছে।

ও বেসমেন্টেই কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ওর কোলে রাখা প্রায় একশ’ দলিল আর পেপারে ও চোখ বুলিয়েছে, যেন কোন একটা পৃষ্ঠা বাদ দিলেই ওভারলুকের রহস্য ও আর ভেদ করতে পারবে না।

জ্যাক ঠিক করেছে ও অ্যাল শকলির অনুরোধ রাখবে না। ওর প্লেগ্রাউন্ডে যে অভিজ্ঞতা হল তার পর থেকেই ও সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে যে ওভারলুককে নিয়ে ওর বইটা লিখতে হবেই। ওর যে হ্যালুসিনেশান হয়েছে সেটা ওর মস্তি স্কের বিদ্রোহ, ওকে নিজের আত্মসম্মানের সাথে এত বড় সমঝোতা করতে হচ্ছে দেখে। যদি বইটা লিখবার ফলে ওর অ্যাল শকলির সাথে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়, তবে তাই হোক। কিন্তু তাই বলে এমন নয় যে জ্যাক ইচ্ছে করে শুধু হোটেলের খারাপ দিকগুলো নিয়েই কথা বলবে। ওর লেখাটা হবে অনেকটা ওভারলুকের আত্মজীবনীর মত, আর প্রথম অধ্যায়টা হবে জ্যাক যে টপিয়ারির জানোয়ারগুলোকে চলতে দেখেছে সেটা নিয়ে। বইটা কারও ওপর প্রতিশোধ নেবার জন্যে লেখা হবে না, না ওর মাতাল, বদমেজাজী বাবার ওপর আর না আলম্যানের ওপর। বইটা লেখা হবে কারণ ওভারলুক জ্যাককে অভিভূত করেছে। বইটা লেখা হবে সত্য উন্মোচনের জন্যে।

দলিলগুলো দেখতে দেখতে জ্যাকের চোখের পাতা ভারী হয়ে এল। ওর নিজের বাবার কথা মনে পড়ছিল। একজন বিশালদেহী মানুষ, বাবা একটা হাসপাতালের পুরুষ নার্স ছিল। জ্যাকের আরও দু’জন ভাই ছিল, আর একজন বোন, বেকি।

জ্যাকের সাথে ওর বাবার সম্পর্কটা ব্যাখা করা কঠিন। ব্যাপারটা ছিল অনেকটা ফুল ফোটার মত, যে ফুলের ভেতরটা পচে গেছে। ও সাত বছর বয়স পর্যন্ত নিজের বাবাকে অন্ধের মত ভালবাসত, বাবার চড়া মেজাজ আর যখন তখন হাত চালাবার অভ্যাস থাকা সত্বেও!

ওর এখনও বসন্তের সেই রাতগুলো মনে পড়ে। বড় ভাই ব্রেট নিজের কোন বান্ধবীর সাথে বাসার বাইরে, মেজো ভাই মাইক নিজের ঘরে কোন পড়া নিয়ে ব্যস্ত আর বেকি আর মা ড্রয়িং রুমে টিভির সামনে বসে আছে। আর জ্যাক,

নিজের খেলনা ট্রাক নিয়ে খেলতে খেলতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করত কখন দড়াম করে বাসার দরজাটা খুলবে আর বাবার জোরালো গলা শোনা যাবে।

বাবা এসেই জ্যাককে এক ঝটকায় কোলে তুলে নিত। নিয়ে বাবা ওকে বাতাসে ছুঁড়ে দিত, আবার ধরে ফেলত। তারপর আবার ছুঁড়ে দিত। ছোট্ট জ্যাক তখন উৎফুল্ল গলায় চিৎকার করত : ‘লিফট! লিফট! আমি লিফটে চড়েছি!” যদিও দু’-একবার মাতাল অবস্থায় বাবা এটা করতে যেয়ে অঘটন ঘটায়। জ্যাককে ছুঁড়ে দেবার পর ধরতে না পারার কারণে জ্যাক আছাড় খায় মাটিতে। কিন্তু বেশীরভাগ সময়ই বাবার আগমন ছিল সাত-বছর-বয়সী জ্যাকের জীবনে একটা আনন্দের মুহূর্ত।

জ্যাকের হাতে ধরা কাগজগুলো আস্তে আস্তে মাটিতে পড়ে গেল। ওর চোখদু’টো জড়িয়ে গেল ঘুমে।

এটা ছিল ওর সাথে ওর বাবার সম্পর্কের প্রথম দিককার কাহিনী। বয়স বাড়ার সাথে সাথে ও বুঝতে পারছিল যে ওর বড় ভাই-বোনরা সবাই বাবাকে ঘৃণা করে। আর ওদের মা, যে কখনও উঁচু গলায় কথা বলত না, বাবার সাথে ছিল শুধু দায়িত্ববোধের খাতিরে। তখনও পর্যন্ত জ্যাক বাবাকে ভয় পেলেও প্রচণ্ড ভালবাসত। বাবা যে ওর বড় ভাইদের সাথে কোন তর্ক হলেই ঘুষি-লাথি দিয়ে তার নিষ্পত্তি করতেন সেটা জ্যাকের কাছে অস্বাভাবিক মনে হত না। বাবারা তো এমনই হয়, তাই না?

ওর ভালবাসা দমে যেতে শুরু করল নয় বছর বয়স থেকে, যখন বাবা ছড়ি দিয়ে মা’কে এত মারে যে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়। বাবার কালো, মোটা ছড়িটার কথা মনে পড়াতে জ্যাক ঘুমের মধ্যেই নড়ে উঠল।

বাবা সেদিন মা’কে কোন কারণ ছাড়াই মেরেছিল। ওরা সবাই রাতের খাবার সময় টেবিলে বসেছে। বাবা আগেই বাইরে থেকে মদ গিলে এসেছে, এখন চোখ খুলে রাখতে তার কষ্ট হচ্ছে। মা সবাইকে প্লেট দিচ্ছিল। এমন সময় বাবার হঠাৎ করে চোখ খুলে যায়। সে এক এক করে নিজের প্রত্যেক ছেলেমেয়ের ওপর চোখ বুলিয়ে শেষে বৌয়ের ওপর দৃষ্টি স্থির করে। তারপর সে বিড়বিড় করে একটা কথা বলে। জ্যাকের মনে হয়েছিল বাবা কফি চাচ্ছে। মা মুখ খুলেছে জিজ্ঞেস করবে বলে, ঠিক তখন বাবা ছড়ি চালায় মায়ের মুখের ওপর। এক বাড়িতেই মায়ের নাক থেকে রক্ত ছিটকে বেড়িয়ে আসে। কিন্তু ততক্ষণে বাবা দ্বিতীয় আঘাতের জন্যে ছড়ি তুলে ফেলেছে। দ্বিতীয় বাড়িটা পড়বার সাথে সাথে বেকি চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল, আর মা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে। ছড়িটা ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। বাবা উঠে মায়ের অচেতন শরীরে আরও সাতবার মারবার সুযোগ পেল রেট আর মাইক তাকে ঠেকাবার আগে। সে তখনও চিৎকার করছিল : “এখন শুনছিস আমার কথা? এখন শুনছিস? আজ আমি তোকে মজা বুঝিয়ে ছাড়ব, হারামজাদী!”

জ্যাকও তখন বেকির সাথে গলা মিলিয়ে কেঁদে ওঠে। বেট ততক্ষণে বাবার হাত থেকে ছড়িটা ছিনিয়ে নিয়েছে। বাবা তখনও এলোমেলো হাত ছুঁড়ছে রেটের দিকে আর চেঁচাচ্ছে : “ফিরিয়ে দে আমাকে লাঠিটা, শয়তান! ওটা আমার! আমার জিনিস আমাকে ফিরিয়ে দে!” রেটও চেঁচাচ্ছিল। ও বাবাকে বলছিল সামনে না আসতে, না হলে আজ ও বাবাকে মেরেই ফেলবে। ঠিক তখন মা উঠে দাঁড়ায়। মায়ের চুল রক্তে ভিজে গিয়েছিল। মা তখন কি বলেছিল সেটা জ্যাকের আজও অক্ষরে অক্ষরে মনে আছে : “খবরের কাগজটা কার কাছে? তোমাদের বাবা পড়তে চাচ্ছে। বাইরে কি বৃষ্টি পড়ছে নাকি?” বলে মা আবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। মাইক তখন ফোনে ধরা গলায় ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। যত তাড়াতাড়ি পারেন ডক্টর, আমাদের মায়ের অবস্থা ভাল নয়।

যে ডাক্তার আসলেন উনি বাবার হাসপাতালেই কাজ করেন। ততক্ষণে বাবার নেশা একটু কেটেছে। সে ডাক্তারকে মোটামুটি গুছিয়ে একটা গল্প বলে ফেলল। মা সিঁড়ি থেকে নামতে যে পা পিছলে পড়ে যায়, তারপর বাবা তাকে ধরাধরি করে এখানে নিয়ে আসে। ডাইনিং টেবিলের কভারে রক্ত লেগে আছে কারণ বাবা চেষ্টা করেছিল সেই কাপড়টা দিয়ে মায়ের মুখ মুছিয়ে দিতে।

“আর তোমার বৌয়ের চশমা খাবার টেবিলে এসে পড়ল কিভাবে, মার্ক?” ডাক্তার বাঁকা সুরে প্রশ্ন করলেন। “ও কি এত জোরে হোঁচট খেয়েছে যে চশমাজোড়া ওর মুখ থেকে দশ ফিট উড়ে এসে টেবিলের খাবারের বাটির ওপর পড়েছে? ডাক্তারী জীবনে অনেককিছুই দেখেছি, মার্ক, কিন্তু এমন কখনও দেখি নি।”

বাবা শান্ত স্বরে জবাব দিল যে যখন সে মাকে এখানে বয়ে নিয়ে এসেছে তখনই হয়তো চশমাটা খুলে পড়ে গিয়েছিল।

এ কথাটা শুনবার পর তার চার ছেলেমেয়ের কারও গলা দিয়ে শব্দ বের হয় নি।

তার কিছুদিন পর ব্রেট আর্মিতে যোগ দিয়ে বাসা ছেড়ে চলে যায়। জ্যাক এখনও বিশ্বাস করে ব্রেট চলে গিয়েছিল তার কারণ শুধু বাবার মিথ্যাকথা আর অত্যাচার নয়, মা যে পরে ডাক্তারদের সামনে বাবার মিথ্যা কথাটাকে সত্যি বলে স্বীকার করেছে সেটাও। ও পরে ১৯৬৫ সালে ভিয়েতনাম যুদ্ধে মারা যায়।

মাইক বাসা ছেড়ে চলে যায় যখন জ্যাকের বয়স বার বছর। ও একটা ভাল ইউনিভার্সিটিতে বৃত্তি পেয়ে চলে যায়। তার এক বছর পর বাবা একটা স্ট্রোক হয়ে মারা যায়।

বাবার মোটা টাকার ইনশুরেন্স ছিল, আর সে মারা যাবার পর টাকাটা ওদের হাতে সে পড়ে।

জ্যাক আবার ঘুমের মধ্যে নড়ে উঠল।

স্বপ্নে ওর বাবার চেহারা আস্তে আস্তে বদলে ওর নিজের চেহারার মত হয়ে গেল। ছোট্ট জ্যাক হয়ে গেল ড্যানি। পেছন থেকে ওর মায়ের মৃদু গলা ভেসে আসছিল : একটু দাঁড়াও, জ্যাকি, একটু দাঁড়াও, খবরের কাগজ…

তারপর মায়ের গলাটা বদলে বাবার গলা হয়ে গেল। বাবা বলছে : মার শয়তানটাকে জ্যাকি, মেরে মজা বুঝিয়ে দে! বেয়াদব হয়েছে একটা, তোর কোন কথা শোনে না! মার! খুন করে ফেল!

বাবার গলাটা জোরালো হতে হতে এক সময়ে চিৎকারে রুপান্তরিত হল। জ্যাকও তখন পালটা চিৎকার করে বলল : চুপ থাকো! তুমি মরে গেছ! আমার আর তোমার কথা শুনতে হবে না! চুপ!

জ্যাকের চোখ খুলে গেল। ও প্রচণ্ড রাগে ফোঁসফোঁস করে শ্বাস ফেলছিল। ওর সামনে রাখা রেডিওটা তখনও বেজে চলেছে। জ্যাকের মনে হল এতক্ষণ রেডিওটা থেকেই ওর বাবার গলা ভেসে আসছিল। না, জ্যাক নিশ্চিত যে রেডিওটা থেকেই বাবা কথা বলছিল। ও রেডিওটা মাথার ওপর তুলে এক আছাড় মেরে চুরমার করে দিল। তারপর টুকরোগুলোকে পা দিয়ে মাড়াতে লাগল যাতে একদম গুঁড়ো হয়ে যায়। ও তখনও চিৎকার করে বলছিল : তুমি মারা গেছ! তুমি মারা গেছ!

ওর হুঁশ ফিরে এল দরজা ওয়েন্ডির ধাক্কা আর গলা শুনতে পেয়ে : “জ্যাক! জ্যাক! কি হয়েছে?”

জ্যাক বোকার মত মেঝেতে ছড়িয়ে থাকা রেডিওর ধ্বংসাবশেষের দিকে চেয়ে রইল। এখন স্নো-মোবিলটা ছাড়া বাইরের দুনিয়ার সাথে যোগাযোগ করবার ওদের আর কোন উপায় নেই।

অধ্যায় ২৭ – অবশ

ওয়েন্ডি দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নামছিল। ওপরের তলা থেকেও জ্যাকের চিৎকার ওর কানে এসেছে। ও এত ভয় পেয়েছে যে ও ডানেবাঁয়ে কোথাও না তাকিয়েই উর্ধ্বশ্বাসে নীচে নামছিল। যদি ও দোতলা পার করার সময় ডানে তাকাতো তাহলে দেখতে পেত যে ড্যানি ওখানে করিডরে দাঁড়িয়ে আছে, ওর চোখে শূন্য দৃষ্টি। ও বুড়ো আঙুলটা মুখে দিয়ে চুষছে, আর ওর শার্ট ঘামে ভেজা। ওর গলার দুইপাশে নীল হয়ে ফুলে গেছে।

ওয়েন্ডি নীচে নেমে ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। মেঝেতে সিবি রেডিওটা টুকরো টুকরো হয়ে পরে আছে, আর জ্যাক সেটার দিকে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। হে ঈশ্বর তোমাকে অশেষ ধন্যবাদ- ওয়েন্ডি মনে মনে বলল, ও এখানে আসার আগে ভাবছিল ও ড্যানিকে মাটিতে পড়ে থাকতে দেখবে, রেডিওটা নয়।

“ওয়েন্ডি?” জ্যাক শূন্য দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, “ওয়েন্ডি?” তখন ওয়েন্ডি এক মুহূর্তের জন্যে জ্যাকের আসল চেহারাটা দেখতে পেল, যে চেহারাটা জ্যাক অন্য সবার কাছ থেকে খুব সাবধানে লুকিয়ে রাখে। একটা অসহায় পশুর চেহারা, যাকে একদল শিকারী কোণঠাসা করে ফেলেছে।

ও ধীর পায়ে ওয়েন্ডির দিকে এগিয়ে এল। ওর চোখ ছলছল করছে। এমন নয় যে ওয়েন্ডি ওকে আগে কাঁদতে দেখে নি, কিন্তু মদ খাওয়া ছেড়ে দেবার পর এই প্রথম। ও এগিয়ে এসে ওয়েন্ডিকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল। ওয়েন্ডি টের পেল যে ওর নিশ্বাসে কোন মদের গন্ধ নেই। থাকার কথাও নয়, এখানে তো কোন মদ নেই।

“কি হয়েছে?” ওয়েন্ডি জানতে চাইল। “জ্যাক, কি হয়েছে?”

কিন্তু জ্যাক এখনও ফোঁপাচ্ছিল। ও ওয়েন্ডিকে এত জোরে ধরে রেখেছে যে ওয়েন্ডির মনে হল ওর পাঁজর ভেঙ্গে যাবে।

“জ্যাক, বল আমাকে কি হয়েছে!”

অবশেষে ওর ফোঁপানি আস্তে আস্তে শব্দের রুপ নিল : “স্বপ্ন, আমি একটা খুব খারাপ স্বপ্ন দেখেছি-জিনিসটা এত বাস্তব ছিল…আমার মনে হয়েছে যে বাবা আমার ওপর চিৎকার করছে…আমি তার গলা শুনতে পাচ্ছিলাম রেডিওটা থেকে…তাই রেডিও ভেঙ্গে ফেলেছি…ওহ ওয়েন্ডি…এত খারাপ স্বপ্ন আমি কখনও দেখি নি…”

“তুমি অফিসেই ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

“না, এখানে নয়, বেসেমেন্টে,” জ্যাক নাক টেনে সোজা হয়ে দাঁড়াল। “আমি নীচে কয়েকটা পুরনো কাগজপত্র উলটে পালটে দেখছিলাম। তার মাঝেই ঘুমিয়ে পড়ি। তারপর আমি নিশ্চয়ই ঘুমের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে এখানে এসে পড়েছি।” জ্যাক চারপাশে তাকিয়ে দেখল। “আমি তো কখনও ঘুমের মধ্যে হাঁটি না।”

“জ্যাক, ড্যানি কোথায়?”

“আমি জানি না। ও না তোমার সাথে ছিল?”

“আমি ভেবেছিলাম…ও তোমার সাথে আছে।”

ওয়েন্ডির চোখে নীরব সন্দেহ দেখে জ্যাকের চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। “আমাকে কখনওই তুমি ভুলতে দেবে না, তাই না?”

“আমার মরার আগমুহূর্তে তুমি আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলবে যে উচিত

শিক্ষা হয়েছে,মনে আছে তুমি ড্যানির হাত ভেঙ্গে ফেলেছিলে?”

“জ্যাক!”

“জ্যাক কি? অস্বীকার করবে যে তুমি আমার চিৎকার শুনে সেটাই চিন্তা করছিলে?”

“আমি শুধু জানতে চাই ও কোথায় আছে!”

“চেঁচাও! আরও চেঁচাও! তুমি চেঁচালেই তো সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে, তাই না?”

ওয়েন্ডি ঘুরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।

জ্যাক এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল, তারপর ও ছুটে গেল ওয়েন্ডির পিছে পিছে। ও ওয়েন্ডির কাঁধে দুই হাত রেখে ওর মুখে নিজের দিকে ফেরাল।

“সরি, ওয়েন্ডি। স্বপ্নটা আমার মাথা খারাপ করে দিয়েছে। মাফ?”

“হ্যা, কোন অসুবিধা নেই।” ওয়েন্ডির চেহারার অভিব্যাক্তি বদলালো না। ও ঘুরে দাঁড়িয়ে জোরে বলল : “ডক! কোথায় তুমি?”

ও এগিয়ে যেয়ে হোটেলের মেইন দরজা খুলে বাইরে দেখল ড্যানি কোথাও আছে কিনা। নেই।

জ্যাক জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি নিশ্চিত যে ও নিজের রুমে নেই?”

“আমি যখন সোয়েটার বুনছিলাম তখন ও আমার রুমের বাইরে কোথাও খেলছিল। আমি নীচের তলা থেকে ওর গলা শুনতে পেয়েছি।”

“তারপর কি তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে?”

“হ্যা। তো কি হয়েছে? ড্যানি!”

“তুমি যে এখন অফিসে এলে তার আগে কি তুমি ওর রুমে গিয়ে দেখেছ ও সেখানে আছে কিনা?”

“আমি…” ওয়েন্ডি থেমে গেল।

“যা ভেবেছিলাম।” জ্যাক মাথা নাড়ল।

ও একদৌড়ে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল, ওয়েন্ডি ওর পিছে। ওপরে উঠে জ্যাক হঠাৎ করে দাঁড়িয়ে গেল, যেন কেউ ওকে ঘুষি মেরেছে। এত আচমকা দাঁড়ানোর ফলে ওয়েন্ডি ওর পিঠে ধাক্কা খেল।

“কি…?” বলতে বলতে ওয়েন্ডির চোখ পড়ল জ্যাক কি দেখছে সেটার ওপর।

ড্যানি তখনও ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আঙুল চুষছে। ওর গলার দাগগুলো উজ্জ্বল আলোতে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

“ড্যানি!” ওয়েন্ডি চেঁচিয়ে উঠল।

ওরা একসাথে দৌড়ে গেল ড্যানির কাছে। ওয়েন্ডি ওকে জড়িয়ে ধরল, কিন্তু ড্যানির তরফ থেকে কোন সাড়া পাওয়া গেলনা।

“ড্যানি, কি হয়েছে?” জ্যাক জানতে চাইল। “তোর গলায় এমন ব্যাথা কে দিয়েছে?”

জ্যাক হাত বাড়িয়ে ড্যানিকে ছুঁতে গেলে ওয়েন্ডি এক ঝটকায় ওকে কোলে তুলে নিল।

“খবরদার! ওকে ছোঁবে না! খবরদার বলছি!”

“ওয়েল্ডি—”

“শয়তান কোথাকার!”

ওয়েন্ডি ড্যানিকে কোলে নিয়েই এক দৌড়ে নীচে নেমে গেল। জ্যাক শুনতে পেল যে ও ওদের বেডরুমে গিয়ে ঢুকেছে। দরজার ছিটকিনি লাগানোর শব্দ এল।

জ্যাক অনেকক্ষণ একই জায়গায় দাঁড়িয়ে রইল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এত কিছু হয়ে গেছে যে ওর মাথা কাজ করছিল না। ওর স্বপ্নটা এখনও ওর মাথায় চেপে বসে আছে। আসলেই কি ও ড্যানির গলায় ওই দাগগুলো ফেলেছে? ওর বাবার কথা শুনে…না, এমন হতে পারে না। জ্যাক মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা দূর করে দিল।

ওয়েন্ডি ড্যানিকে কোলে নিয়ে চেয়ারে বসে ওকে আদর করছিল। ড্যানির মধ্যে একটুও পরিবর্তন আসে নি। ও এখনও আঙুল মুখে দিয়ে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

এটা যে জ্যাকের কাজ সে ব্যাপারে ওয়েন্ডির কোন সন্দেহ নেই। ও যেভাবে ঘুমের মধ্যে রেডিওটা ভেঙ্গেছে সেভাবে ড্যানিরও গলা টিপেছে। ওর কোন একটা সমস্যা হয়েছে, মানসিক সমস্যা। কিন্তু ওয়েন্ডি এখন কি করবে? সারা শীতকাল তো জ্যাকের কাছ থেকে লুকিয়ে থাকা সম্ভব নয়।

ওয়েন্ডির ভেতর থেকে ঠাণ্ডা গলায় একটা প্রশ্ন আসল, ওর মাতৃত্বের গলায় : জ্যাক ঠিক কতটা বিপজ্জনক?

একটা ভাল জিনিস এই যে জ্যাক ড্যানির গলার আঘাতগুলো দেখে নিজেও অবাক হয়েছে। হয়তো কাজটা ও ঘুমের মধ্যে করেছে বলে ওর মনে নেই। তার মানে কি জ্যাকের একটা অংশের ওপর এখনও ভরসা করা যায়? এই চিন্তাটা ওয়েন্ডিকে একটু আশ্বস্ত করল। হয়তো জ্যাক ওকে আর ড্যানিকে সাইডওয়াইন্ডারের হাসপাতাল পর্যন্ত দিয়ে আসতে পারবে।

ওয়েন্ডি ড্যানির সারা গায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল। ওর নিজের মানসিক অবস্থাও এ মুহূর্তে খুব একটা ভাল নয়, নয়তো ও খেয়াল করত যে ড্যানির গলার দাগগুলো ঠাণ্ডা আর ভেজা ভেজা। কিন্তু জ্যাক যখন ওকে অফিসে জড়িয়ে ধরেছিল তখন জ্যাকের হাত একদম শুকনো ছিল।

এখন ওয়েন্ডির মাথায় একটা চিন্তাই ঘুরছিল। ও কি জ্যাককে বলবে ওদের সাহায্য করবার কথা?

আসলে সিদ্ধান্তটা ওর হাতে নয়। এমনিতেও ও একলা কিছু করতে পারবে না। জ্যাককে ছাড়া স্নো-মোবিলটা চালানো সম্ভব নয়। তাও ওয়েন্ডির কষ্ট হচ্ছিল নিজের মনকে মানাতে।

আর জ্যাক যদি আবার ড্যানির ওপর হামলা চালায় তাহলে ও ঠেকাবে কিভাবে? এখানে কোন বন্দুক নেই। রান্নাঘরে অনেকগুলো ছুরি আছে ঠিকই, কিন্তু ওর আর রান্নাঘরের মাঝে দাঁড়িয়ে আছে জ্যাক।

অবশেষে ওয়েন্ডি ড্যানিকে কোলে নিয়ে উঠে দাঁড়াল। ওর পা কাঁপছে। ও ঠিক করে ফেলেছে ওর কি করতে হবে। এমুহূর্তে ওর এটা বিশ্বাস করা ছাড়া আর কোন উপায় নেই যে জাগ্রত অবস্থায় জ্যাক ওদের ক্ষতি করতে চায় না। ও জ্যাককে যেয়ে বলবে ও যাতে ওয়েন্ডি আর ড্যানিকে ডক্টর বিলের কাছে দিয়ে আসে।

ও দরজা খুলে আস্তে করে ডাকল : “জ্যাক?”

ওয়েন্ডি সাবধানে পা ফেলতে ফেলতে সিঁড়ি পর্যন্ত এল, কিন্তু এখানেও জ্যাকের দেখা নেই। ও সিঁড়িতে বসে চিন্তা করতে লাগল এখন কি করবে। ঠিক তখন জ্যাকের গলা শোনা গেল।

ও গান গাচ্ছে। গুনগুন করে গান গাচ্ছে।

অধ্যায় ২৮ – “ওই মহিলাটা!”

জ্যাক কিছুক্ষণ আগে দোতলার সিঁড়িতে বসে চিন্তা করছিল। আর ও যত ভাবছিল ওর রাগ আস্তে আস্তে ততই বাড়ছিল। কোন লাভ নেই। ওয়েন্ডি ওকে কোনদিনই বিশ্বাস করবে না। ও চাইলে বিশ বছর টানা মদ না ছুঁয়ে থাকতে পারে, কিন্তু কোন লাভ নেই। ওয়েন্ডি ওকে সারাজীবন একটা বদমেজাজী মাতাল হিসাবেই দেখবে। ওদের জীবনে যা কিছু খারাপ হবে সব জ্যাকের দোষ। ওরা যদি প্লেনক্র্যাশ করে মারা যায় তাহলে মাটিতে আছড়ে পড়ার আগ মুহূর্তে ওয়েন্ডি ওকে বলবে প্লেনটা ক্র্যাশ করেছে জ্যাকের দোষে।

ওয়েন্ডির ড্যানিকে ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাবার দৃশ্যটা আবার ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল।

ওর উচিত ছিল এক ঘুষিতে হারামজাদীর নাক ভেঙ্গে দেয়া! ওর কি অধিকার আছে যে ও জ্যাককে নিজের ছেলের থেকে দূরে সরিয়ে রাখবে?

হ্যা, প্রথমে জ্যাক অনেক ভুল করেছে, সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই। কিন্তু তারপরে তো ও ঠিকই শুধরে গিয়েছে। এখন কোন কিছু না করেও যদি ওর গালি খেতে হয়, তাহলে তার চেয়ে খারাপ কাজ করে তারপর গালি খাওয়াই ভাল। ওয়েন্ডির তো ধারণা ও এখনও মদ খায়, তাই না? ও ওয়েন্ডিকে দেখিয়ে দেবে।

জ্যাক পকেট থেকে রুমাল বের করে নিজের ঠোঁট মুছল। ওর মুখে একটা কুৎসিত হাসি দেখা দিল। ওয়েন্ডি কতক্ষণ ভেতরে বসে থাকবে? একসময় না একসময় তো ওকে বের হতে হবেই, তাই না?

ও নীচতলায় নেমে এল। কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক ওদিক ঘুরে তারপর ডাইনিং রুমে যেয়ে ঢুকল।

টেবিলগুলো সুন্দর, ধবধবে সাদা কাপড়ে ঢাকা। এখন এখানে কেউ নেই, কিন্তু

(খাবার দেয়া হবে রাত ৮টায়

মুখোশ উন্মোচন আর ড্যান্স মধ্যরাতে)

জ্যাক টেবিলগুলোর মাঝখানে হাঁটতে হাঁটতে কিছুক্ষণের জন্যে সবকিছু ভুলে গেল। ওয়েন্ডির সাথে ঝগড়া, বাজে স্বপ্ন সব মুছে গেল ওর মাথা থেকে। শুধু থাকল একটাই চিন্তা। সেদিন ডিনার পার্টিটা কেমন ছিল?

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মাত্র শেষ হয়েছে। সামনে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাময়। ডাইনিং হল আলোতে ঝলমল করছে। আর এই উজ্জ্বলতার বন্যায় গা ভাসিয়েছে আজ রাতের সব অতিথিরা। সবাই চোখ ধাঁধানো সাজপোশাক পড়া। এখানে একজন রাজকুমারী তো ওখানে একজন মধ্যযুগীয় সৈনিক।

সবার হাতে মদের গ্লাস, হাস্যোজ্জ্বল মুখ। এমন সময় একজনের গলা ভেসে এল : “মুখোশ খোলার সময় হয়ে গেছে!”

(লাল মৃত্যু সবার দিকে ধেয়ে আসছে!)

জ্যাক এখন কলোরাডো লাউঞ্জের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৫ এর সেই রাতে এখানে ছিল অফুরন্ত মদ, বিনামূল্যে।

জ্যাক কোন অজানা টানে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল। ঢুকতেই একটা অদ্ভুত জিনিস ওর চোখে পড়ল। ও আগেও এখানে এসেছে, সবকিছু ঠিকঠাক আছে কিনা দেখবার জন্যে। তখন বারের ওপর মদের বোতল রাখবার তাকগুলো একদম খালি ছিল। কিন্তু আজ আধো অন্ধকারে মনে হচ্ছে সেখানে থরে থরে বোতল সাজানো। এমনকি ও বাতাসে বিয়ারের গন্ধ পর্যন্ত পাচ্ছে।

জ্যাক দেয়ালে হাতড়ে লাইটের সুইচটা জ্বেলে দিল।

কিছুই নেই। তাকগুলো খালি। ঠিক যেমন জ্যাক আগেরবার দেখে গিয়েছিল।

জ্যাক বোকার মত মাথা ঝাঁকিয়ে বারের অর্ধগোলাকৃতি প্রকান্ড ডেস্কটার দিকে এগিয়ে গেল। আবার কি ওর সাথে তাই হচ্ছে, প্লেগ্রাউন্ডে যেটা হয়েছিল? না, হতে পারে না। এভাবে চিন্তা করাটাও পাগলামি।

কিন্তু ও প্রায় নিশ্চিত যে ও বোতলগুলোকে দেখেছিল। একমাত্র প্রমাণ যেটা এখনও টিকে আছে হচ্ছে বিয়ারের গন্ধটা। বারে বিয়ারের গন্ধ থাকা অস্বাভাবিক কোন ব্যাপার নয় কিন্তু… এই গন্ধটা মনে হচ্ছিল নতুন।

ও ডেস্কের সামনে রাখা টুলগুলোর মধ্যে একটায় এসে বসল। এমনই কপাল, জ্যাক ভাবল, এতদিন পরে একটা বারে আসলাম আর সেটায় একফোঁটা মদ নেই। কিন্তু এখানে বসার পর পুরনো স্মৃতি ওকে বন্যার মত ভাসিয়ে নিয়ে গেল। এক গ্লাস মদ গলা দিয়ে কিভাবে জ্বলতে জ্বলতে পেটে নামে তা ওর মনে পড়ে গেল। ও অসহায়ের মত কিল মারল ডেস্কের ওপর।

“কি অবস্থা, লয়েড,”ও বলল। “আজকে তেমন লোকজন নেই, তাই না?”

লয়েড বলল না নেই। তারপর জিজ্ঞেস করল জ্যাক কি নেবে।

“তোমার প্রশ্নটা শুনে মন ভাল হয়ে গেল, লয়েড, “ জ্যাক বলল। “আমার মানিব্যাগে এ মুহূর্তে ষাট ডলার আছে, যে টাকাটা শীতকাল শেষ হওয়া পর্যন্ত ওখানেই বসে থাকবে। কি বিপদ বল তো?”

লয়েড স্বীকার করল যে আসলেই ব্যাপারটা অমানবিক।

“তাহলে আমার জন্যে একটা কাজ কর। আমার বিশ গ্লাস মার্টিনি লাগবে। আমার সামনে এক এক করে বিশটা গ্লাস সাজিয়ে দেবে। পারবে না?”

লয়েড বলল যে ও পারবে।

জ্যাক টাকা বের করার জন্যে পকেটে হাত দিতে একটা ওষুধের বোতল বেরিয়ে এল। ওর টাকা বেডরুমে রাখা, ওর এখন মনে পড়ল। আর ওয়েল্ডি তো ওকে বেডরুমে ঢুকতে দেবে না। ভালই দেখালি তুই, খানকি।

“লয়েড, আমি টাকা আনতে ভুলে গেছি। আমাকে কি বাকিতে দেয়া সম্ভব?”

লয়েড বলল যে বাকিতে দিতে কোন অসুবিধা নেই।

“চমৎকার। লয়েড, তুমি চমৎকার একজন মানুষ।”

লয়েড ওকে ধন্যবাদ জানাল।

জ্যাক বোতল থেকে দু’টো ট্যাবলেট বের করে মুখে ফেলে দিল। ওর হঠাৎ মনে হল যে ওর দিকে অনেকে তাকিয়ে আছে। বারে যে অন্য টেবিলগুলো ছিল সেগুলো ভরে গেছে সাজপোশাক পড়া মানুষে, আর সবাই তাকিয়ে দেখছে ও কি করে।

ও এক ঝটকায় ঘুরল।

কেউ নেই বারে। সবগুলো টেবিল খালি। জ্যাক আবার ডেস্কের দিকে ফিরল। ওষুধের তেতো স্বাদে ওর মুখ বিকৃত হয়ে গেছে।

“বাহ্, এর মধ্যেই হয়ে গেছে? চমৎকার। লয়েড, তোমার তুলনা হয় না। চিয়ার্স।”

জ্যাক নিজের বিশ গ্লাস কাল্পনিক মদের দিকে তাকিয়ে রইল। বাতাসে যেন মার্টিনির গন্ধ ভাসছে।

“লয়েড, মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে এমন কারও সাথে কি তোমার কথা হয়েছে?”

লয়েড বলল হ্যা, দেখা হয়েছে।

“এমন কাউকে দেখেছ যে মদ খাওয়া ছেড়ে দেবার পর আবার ধরেছে?”

লয়েড বলল ওর মনে পড়ছে না।

জ্যাক একটা কাল্পনিক গ্লাস তুলে মদটা মুখে ঢালল। তারপর গ্লাসটা নিজের কাঁধের ওপর দিয়ে ছুঁড়ে ফেলল পেছন দিকে। বার আবার মানুষে ভরে গেছে, জ্যাক টের পাচ্ছিল। ওরা হাসাহাসি করছে জ্যাককে নিয়ে।

“শুনে রাখো লয়েড, যারা একবার ছেড়ে দেবার পর আবার মদ ধরে, ওদের সবার একটা ভয়ানক গল্প থাকে সেই সিদ্ধান্তটার পেছনে।”

ও আরও দু’টো গ্লাস খালি করে ছুঁড়ে মারল পেছনে। ওর এখন একটু একটু নেশা হচ্ছিল। ওষুধটার কারণে নিশ্চয়ই।

জ্যাক বলল, “যতদিন তুমি না খেয়ে আছ, সবাই তোমাকে বাহবা দেবে। সবাই তোমার বন্ধু। সবাই তোমার ওপর খুশি, তোমার প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি দেখে বিস্মিত। এত ভাল অনুভূতি পৃথিবীতে আর খুব কমই আছে।”

জ্যাক আরও দুই গ্লাস খালি করল। পেছনের লোকজনকে নিয়ে এখন ওর আর কোন মাথাব্যাথা নেই। দেখার এত ইচ্ছা থাকলে দেখুক, শালারা। দু’চোখ ভরে দেখে নে।

“কিন্তু লয়েড, একটু সময় গেলেই তুমি বুঝতে পারবে এই খুশি দীর্ঘস্থায়ী নয়। তোমার আশেপাশে যারা আছে ওরা সবাই তোমার দুর্বল অবস্থার ফায়দা লোটা শুরু করে। যেসব কাজ ওরা আগে করবার কথা চিন্তাও করতে পারত না, এখন সেগুলো করতে এক মিনিটেরও দেরী হয় না। কারণ ওরা জানে, ওরা জানে যে তুমি দুর্বল যে তোমার সমস্ত শক্তি খাটাতে হচ্ছে মদ থেকে দূরে থাকবার জন্যে।”

ও থামল। লয়েড ওর সামনে আর নেই। কখনও ছিলও না। মদের গ্লাসগুলোও জ্যাকের কল্পনামাত্র। এখানে শুধু আছে বারভর্তি মানুষ, যারা জ্যাকের দিকে আঙুল তুলে হিহি করে হাসছে।

জ্যাক আবার ঘুরে তাকাল। “হার্সা বন্ধ ক—”

কেউ নেই। হাসির শব্দটা হঠাৎ করে টিভি অফ করে দেয়ার মত বন্ধ হয়ে গেছে। খালি টেবিলগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জ্যাকের মাথায় একটা ভয়ংকর চিন্তা এল। ও কি আসলেই পাগল হয়ে যাচ্ছে?

ওর একবার ইচ্ছা করল ও যে টুলটায় বসে আছে সেটা হাতে তুলে নেয়, তারপর পুরো বারটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলে। কিন্তু তা না করে ও

গুনগুন করে গান গাওয়া শুরু করল।

ড্যানির চেহারাটা ওর চোখের সামনে ভেসে উঠল। ওর স্বাভাবিক চেহারা নয়, শূন্যদৃষ্টির, মুখে আঙুল দেয়া চেহারা। গলার দুই পাশে নীল দাগ, দেখলে মনে হয় শক্তিশালী দু’টো হাত ওর গলা চেপে ধরেছিল।

(কিন্তু আমি তো ওকে ছুঁই নি!)

“জ্যাক?”

ডাকটা এত আচমকা এল যে আরেকটু হলে জ্যাক চেয়ার থেকে উলটে পড়ে যেত। ও ঘুরে দেখল যে ওয়েন্ডি এসেছে। ওর কোলে ড্যানি, যাকে দেখাচ্ছে একটা মোমের পুতুলের মত।

“আমি ওকে ছুঁই নি।” জ্যাক ধরা গলায় বলল। “যেদিন আমি ওর হাত ভেঙ্গেছিলাম তারপর একদিনও আমি ওর গায়ে তুলি নি।”

“এখন আর ওটা নিয়ে মাথা ঘামানো জরুরি নয়, জ্যাক। তার চেয়ে—”

“জরুরি!” জ্যাক এত জোরে ডেস্কে ঘুষি মারল যে ডেস্কটা কেঁপে উঠল। “অবশ্যই জরুরি!”

“জ্যাক, আমাদের ওকে শহরে নিয়ে যেতে হবে। ওর যে অবস্থা-

হঠাৎ ড্যানি মায়ের কোলে নড়ে উঠল। ওর চেহারায় একটা অভিব্যাক্তি ফুটে উঠল, যেন ঘন কুয়াশার আড়ালে ক্ষীণ আলো। ওর ঠোঁট অদ্ভুতভাবে বেঁকে গেল, আর ওর হাতদুটো উঠে এল মুখের সামনে। তারপর আবার দু’পাশে পড়ে গেল।

ড্যানি একমুহূর্তের জন্যে আবার শক্ত হয়ে গেল। তারপর ওর পিঠটা বেঁকে গেল ধনুকের মত। আর তারপর শুরু হল চিৎকার।

ড্যানির গলা থেকে তীক্ষ্ণ চিৎকার বেরিয়ে এল, একটার পর একটা। সারা ঘরে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ওর গলা। মনে হচ্ছিল একশ’ ড্যানি একসাথে চিৎকার করছে।

“জ্যাক!” ওয়েন্ডি ভয়ার্ত গলায় চেঁচিয়ে উঠল। “কি হয়েছে ওর?”

জ্যাক টুল থেকে নেমে এল। ওর শরীর অবশ লাগছে। এত ভয় ও জীবনে পায়নি। কি হয়েছে ওর ছেলের?

ড্যানি জ্যাককে দেখতে পেল, তারপর ছিটকে বেরিয়ে এল মায়ের কোল থেকে। ও এত জোরে ধাক্কা দিয়ে ওয়েন্ডির হাত সরিয়ে দিল যে ওয়েন্ডি ভারসাম্য হারিয়ে বসে পড়ল পেছনের একটা চেয়ারে।

ও ছুটে গিয়ে জ্যাককে জড়িয়ে ধরল। “বাবা! ওই মহিলাটা বাবা! ওহ বাবা ও জ্যাকের বুকে মুখ গুঁজে চেঁচিয়ে কেঁদে উঠল।

বাবা, ওই মহিলাটা।

“ওয়েল্ডি?” জ্যাকের গলা শান্ত, কিন্তু তার আড়ালে লুকিয়ে আছে বিজয়ের আনন্দ। “কি করেছ তুমি ওকে?”

ওয়েন্ডি ওর দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল। ওর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে।

“জ্যাক, বিশ্বাস কর আমার কথা -”

বাইরে আবার বরফ পড়তে শুরু করল।

অধ্যায় ২৯ – রান্নাঘরে কথা

জ্যাক ড্যানিকে কোলে করে রান্নাঘরে নিয়ে গেল। ছেলেটা এখনও উচ্চস্বরে কাঁদছে জ্যাকের বুকে মাথা রেখে। কিচেনে এসে ও ওয়েন্ডির কোলে ড্যানিকে ফিরিয়ে দিল ওয়েন্ডির মুখ থেকে বিস্মিত ভাবটা এখনও যায়নি।

“জ্যাক, আমি জানি না ও কিসের কথা বলছে। প্লিজ জ্যাক, বিশ্বাস কর…”

“আমি বিশ্বাস করি তোমাকে।” জ্যাক বলল। যদিও এত দ্রুত আসামী আর বিচারকের ভূমিকাগুলো উলটে যেতে দেখে ওর ভালই লেগেছে। ও একটা সন্তুষ্ট হাসি গোপন করল। কিন্তু জ্যাক জানে যে ওয়েন্ডি ঠিকই বলছে। ও ড্যানির কোন ক্ষতি করার আগে দরকার হলে আত্মহত্যা করবে।

কিচেনের একটা চুলোয় একটা গরম পানির কেটলি বসানোই ছিল। জ্যাক এগিয়ে গিয়ে একটা কাপ ধূমায়িত পানিতে ভরে নিল। ও ওয়েন্ডিকে জিজ্ঞেস করল : “এখানে রান্নার কাজে ব্যাবহার করবার শেরি আছে না?”

ওয়েন্ডি মাথা নাড়ল। “ওই কাপবোর্ডটার ভেতরে।”

শেরি হচ্ছে একধরনের অ্যালকোহল। গা গরম করতে সাহায্য করে। জ্যাক কাপবোর্ডের ভেতরে রাখা তিনটে বোতলের মধ্যে থেকে একটা বের করে দুই চামচ পানিটায় ঢালল।

তারপর দুধ আর চিনি মিশিয়ে চা তৈরি করে ও কাপটা ড্যানির হাতে ধরিয়ে দিল। ও এখনও কাঁদছে, কিন্তু ওর শরীরের কাঁপুনি কমে গেছে।

“এটা খেয়ে নে, ডক। জিনিসটা খেতে খুব বিশ্রী লাগবে, কিন্তু খেলে শরীরে শক্তি পাবি।”

ড্যানি মাথা ঝাঁকিয়ে কাপটা হাতে নিল। এক চুমুক খেয়ে ও মুখ বিক্রিত করল, কিন্তু বাবার দিকে তাকিয়ে দ্বিতীয় চুমুক দিল। ওয়েন্ডি নিজের ভেতরে পুরনো হিংসার দংশন অনুভব করল। ও বললে ড্যানি খেত কিনা সন্দেহ আছে।

হিংসার পিছে পিছে ওয়েন্ডির মাথায় আরেকটা ভয়ংকর চিন্তা এসে ঢুকল। ও কি নিজের অন্ধ হিংসার বশে মনে মনে এটা চাইছিল যে জ্যাকই আসল অপরাধী হোক? এজন্যেই কি এক মুহূর্ত চিন্তা না করে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছিল যে জ্যাকই ড্যানিকে ব্যাথা দিয়েছে? না…নিশ্চয়ই না। এভাবে ওর মা চিন্তা করে, ও নয়। কিন্তু একটা সত্যি কথা ও নিজের কাছে কখনওই অস্বীকার করতে পারবে না। যদি পুরো জিনিসটা আবার ঘটে, তাহলেও ওয়েন্ডি কোন দ্বিধা ছাড়াই জ্যাককে প্রথমে দোষী হিসাবে বিবেচনা করবে।

“জ্যাক-” ওয়েন্ডি শুরু করল। যদিও ও বুঝতে পারছে না ওর ক্ষমা চাওয়া উচিত নাকি নিজেকে ঠিক প্রমাণ করা উচিত

“পরে,” জ্যাক বলল।

ড্যানি কাপটা শেষ করল। জ্যাক নরম সুরে জিজ্ঞেস করল, “ড্যানি, তুই কি বলতে পারবি আজকে তোর সাথে কি হয়েছিল? জিনিসটা জানা খুবই জরুরি।”

ড্যানি একবার মা আর বাবার মুখের দিকে চাইল। তারপর মাথা নীচু করে বলল, “আমি তোমাদের সবকিছু বলতে চাই। আমার আগেই বলা উচিত ছিল।”

“তাহলে বলিস নি কেন বাবা?” জ্যাক ওর কপালের চুল সরিয়ে দিল।

“কারণ আঙ্কেল অ্যাল তোমাকে চাকরিটা দিয়েছেন, আর…আমি বুঝতে পারছিলাম না এখানে থাকলে তোমার ভাল হবে না খারাপ হবে।”

ওয়েন্ডি জ্যাকের দিকে তাকাল। “তোমার মনে আছে, যেদিন আমি আর ড্যানি মিলে শহরে গেলাম, যেদিন তুমি টপিয়ারিতে কাজ করছিলে? সেদিন আমি আর ড্যানি হোটেলে থাকবার ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলেছি।”

জ্যাক মাথা নাড়ল। টপিয়ারিতে কাজ করবার দিনটা ও সারাজীবনেও ভুলবে না।

“কিন্তু আমাদের আরও অনেককিছু নিয়ে কথা বলা উচিত ছিল, তাই না ডক?” ওয়েন্ডি নরম গলায় জিজ্ঞেস করল।

ড্যানি ম্লান মুখে মাথা নাড়ল।

“তোমরা কি নিয়ে কথা বলছিলে? আমার বৌ আর ছেলে আমাকে নিয়ে কি কথা বলতে- “

“বলছিলাম আমরা তোমাকে কতটা ভালবাসি সেটা।” ওয়েন্ডি বাধা দিল।

“তাও, পিঠপিছে কথা আমার পছন্দ নয়।” জ্যাক বলল।

“আমাদের সবার এখানে থাকা উচিত হবে কিনা আমরা তাই নিয়ে কথা বলেছি। ড্যানি ঠিকই বলেছে, প্রথম প্রথম মনে হচ্ছিল এই জায়গাটায় এসে তোমার উপকার হয়েছে।এখানে তোমার ওপর হুকুম চালাবার কেউ ছিল না, তুমি নিজেকে কাজে ব্যস্ত রেখেছিলে…কিন্তু তারপর হঠাৎ করেই সবকিছু কেমন যেন বদলে গেল। তুমি সারাক্ষণ বেসমেন্টে বসে থাকা শুরু করলে। ওখানে পুরনো কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগলে… ঘুমের মধ্যে কথা বলা শুরু করলে।”

“আমি ঘুমের মধ্যে কথা বলি?” জ্যাক অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল। “বেশীরভাগ সময়ই বোঝা যায় না তুমি কি বলছ। একবার শুধু বুঝেছি তুমি বলছ, ‘মুখোশ খুলবার সময় হয়ে গেছে!”

“হে ঈশ্বর।” জ্যাক নিজের কপালের দু’পাশে আঙুল ঘসল!

“তাছাড়া মদ খাবার সময় তোমার যে বাজে অভ্যাসগুলো ছিল সবগুলো এখন ফিরে এসেছে। তুমি এখন আর নাটকও লিখতে বসছ না, তাই না?”

“না, গত কয়েকদিন ধরে লেখা হয় নি… আমি নতুন একটা লেখা নিয়ে চিন্তা করছি।” জ্যাক বলল।

“সেই নতুন লেখাটা এই হোটেলকে নিয়ে, তাই না? অ্যাল শকলি তোমাকে মানা করেছে, তাও তুমি থামতে পারছ না।”

“তুমি সেটা জানলে কিভাবে?” জ্যাকের গলা চড়ল। “তুমি কি কান পেতে আমার কথা শুনছিলে? তোমার…”

“না, আমি তোমার কথা শুনি নি। ড্যানি আমাকে বলেছে।”

“সত্যি, ড্যানি?” জ্যাক ওর দিকে তাকাল।

“হ্যা। উনি অনেক রাগ করেছিলেন কারণ তুমি মিস্টার আলম্যানকে ফোন করেছ।”

“হে ঈশ্বর।” জ্যাক আবার বলল। “ড্যানি, তোর গলা টিপে ধরেছিল কে?”

ড্যানির চেহারা অন্ধকার হয়ে গেল। “২১৭ নাম্বার রুমের মহিলাটা,” ও বলল। “মরা মহিলাটা।”

জ্যাক আর ওয়েন্ডি একে অপরের দিকে তাকাল।

“ড্যানি?” জ্যাক ওর কাঁধে একটা হাত রাখল। “সবকিছু খুলে বল, বাবা। আমরা তোর সাথেই আছি।”

“আমি জানতাম এই জায়গাটা ভাল নয়,” ড্যানি বলল। “টনি আমাকে আসার আগে দেখিয়েছে।”

“দেখিয়েছে? কিভাবে?”

“স্বপ্নের মধ্যে। সবকিছু আমার মনে নেই, কিন্তু আমি ওভারলুক হোটেলকে স্বপ্নে দেখি, আর তার সামনে একটা খুলি আর দু’টো হাঁড় আড়াআড়ি করে একটা আরেকটার ওপর রাখা। আর কিছু একটা আমাকে তাড়া করছিল। খুব খারাপ কিছু… রেডরাম।”

“কি সেটা?”

“আমি জানি না,” ড্যানি মাথা নাড়ল। “তারপর মিস্টার হ্যালোরানের সাথে আমার গাড়িতে কথা হল, উনি বললেন যে আমার ভেতরে জ্যোতি আছে। ওনার ভেতরেও একটু একটু আছে, তাই উনি আমার ব্যাপারটা ধরতে পেরেছেন।”

“জ্যোতি? মানে?”

“জ্যোতি হচ্ছে…” ড্যানি হাত দিয়ে একটা অস্পষ্ট ভঙ্গি করল। “কোন কিছু হবার আগেই যদি তুমি দেখতে পাও কি হবে। মিস্টার হ্যালোরান নিজের ভাই মারা যাবার অনেক আগেই দেখতে পেয়েছিলেন যে ও মারা যাবে।”

জ্যাকের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। “তুই এসব বানাচ্ছিস না তো, ড্যানি?”

ড্যানি দ্রুত দু’দিকে মাথা নাড়ল। “না,” তারপর ও উৎফুল্ল গলায় যোগ করল : “আর মিস্টার হ্যালোরান বলেছেন উনি নাকি আমার মত জ্যোতি আর কারও ভেতর দেখেননি। আমরা দু’জন মুখ না খুলেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলতে পারব।”

জ্যাক আর ওয়েন্ডি আবার দৃষ্টি বিনিময় করল। ওরা ভাষা হারিয়ে ফেলেছে।

“মিস্টার হ্যালোরান আমার সাথে একলা কথা বলতে চেয়েছিলেন আমাকে সাবধান করবার জন্যে। যাদের ভেতর জ্যোতি আছে তাদের জন্যে নাকি এই জায়গাটা ভাল নয়। আমি সেটার প্রমাণও পেয়েছি। মিস্টার আলম্যান যখন আমাদের প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট দেখাতে নিয়ে যান, আমি সেটার দেয়ালে রক্ত আর মগজের টুকরো দেখতে পাই।”

ওয়েন্ডির চেহারা সাদা হয়ে গেছে। ও জ্যাকের দিকে তাকাল।

জ্যাক ড্যানির দিক থেকে চোখ না সরিয়েই বলল : “এই জায়গাটার মালিকানা অনেকবার হাত বদল হয়েছে। মাঝখানে মালিকদের মধ্যে মাফিয়ার লোকজনও ছিল।”

“গুন্ডা?” ড্যানি জিজ্ঞেস করল।

“হ্যা, গুন্ডা।” জ্যাক এবার ওয়েন্ডির দিকে তাকাল। “এখানে একবার ভিতো জিনেলি নামে এক মাফিয়া সর্দার খুন হয়। পেপারে তার ছবিও এসেছিল। ড্যানির বর্ণনা সেই ছবির সাথে হুবহু মিলে যাচ্ছে।”

“মিস্টার হ্যালোরানও এখানে কয়েকটা খারাপ জিনিস দেখতে পেয়েছেন,” ড্যানি বলে যাচ্ছিল। “একবার প্লেগ্রাউন্ডে, আর একবার ২১৭ নাম্বার রুমে। উনি আমাকে মানা করেছিলেন রুমটায় যেতে, কিন্তু তাও আমি গিয়েছি। মিস্টার হ্যালোরান বলেছিলেন এখানে আমি যা দেখব ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না।” শেষের কথাটা ড্যানি বলার সময় নিজের গলার দাগ গুলোতে হাত বুলাল।

“প্লেগ্রাউন্ডে উনি কি দেখেছেন?” জ্যাক অদ্ভুত, শান্ত গলায় প্রশ্ন করল।

“জানি না। ওই পশুপাখির ঝোপগুলো নিয়ে কিছু।”

জ্যাক একটু চমকে উঠল।ওয়েন্ডির সেটা চোখ এড়াল না।

“জ্যাক? তুমি কি ওখানে কিছু দেখেছ?”

“না,” ও জবাব দিল। “কিছু না।”

“ড্যানি, তোমাকে কোন মহিলা ব্যাথা দিয়েছে?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল।

ড্যানি ওদের বলল ও ২১৭তে যাবার পর কি কি হয়েছে। মহিলা ওর গলা টিপে ধরবার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। ওর মনে হয় যে বাবা আর আম্মু ওকে নিয়ে ঝগড়া করছে আর বাবা আবার খারাপ জিনিসটা করতে চায়।

“ওর সাথে থাকো।” বলে জ্যাক উঠে দাঁড়াল।

“তুমি কোথায় যাচ্ছ?” ওয়েন্ডি চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল। “ওই রুমটায়। হোটেলে যদি আমরা বাদে অন্য কেউ থেকে থাকে, দেখা দরকার কে সেটা।”

“না! জ্যাক, খবরদার আমাদের একলা ছেড়ে যাবে না!” ওয়েন্ডির মুখ থেকে থুথু ছিটকে এল।

জ্যাক এক মুহূর্তের জন্যে থামল। “ওয়েন্ডি, তুমি তোমার মায়ের মত করছ।”

ওয়েন্ডি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। ড্যানি ওর কোলে বসে আছে দেখে ও হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে পারছিল না।

“সরি,” জ্যাক বলল। “কিন্তু আমার যেতেই হবে। আমি হোটেলের কেয়ারটেকার।”

ওয়েন্ডি কাঁদতেই থাকল। জ্যাক দরজা খুলে কিচেন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। “কেঁদো না, আম্মু,” ড্যানি বলল। “বাবার ভেতর জ্যোতি নেই। এখানকার কোনকিছু বাবার ক্ষতি করতে পারবে না।”

“না, ড্যানি,” ওয়েন্ডি কাঁদতে কাঁদতে বলল। “আমি সেটা বিশ্বাস করি না।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *