শাইনিং – ২০

অধ্যায় ২০ – মি: আলম্যানের সাথে কথা

জ্যাক সাইডওয়াইন্ডার শহরের পাবলিক লাইব্রেরির বেসমেন্টে পুরনো খবরের কাগজ রাখবার সেকশনে এসেছে। ও দেখে হতাশ হল যে এখানে কয়েকটা লোকাল পেপার ছাড়া আর কিছুই সংগ্রহ করা হয় নি। তাও মাত্র ১৯৬৩ সাল থেকে।

তবে এখানে খবরের কাগজের পাশাপাশি বেশ কিছু পুরনো ফিল্ম ও আছে। কিন্তু ফিল্ম দেখবার জন্যে মেশিনটা আছে সেটার লেন্স মান্ধাতার আমলের, আর জ্যাকের সেটা ব্যাবহার করতে অসুবিধা হচ্ছিল। ৪৫ মিনিট পর ওয়েন্ডি যখন এসে ওর কাঁধে হাত রাখল তখন ব্যাথায় ওর মাথা দপদপ করা শুরু করেছে।

“ড্যানি পার্কে খেলছে,” ওয়েন্ডি বলল। “কিন্তু আমি চাই না ও বেশীক্ষণ বাইরে থাকুক। তোমার এখানে আর কতক্ষণ লাগবে?”

“আর দশ মিনিট।” জ্যাক জবাব দিল। আসলে জ্যাকের কাজ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে। মাফিয়াদের খুন আর আলম্যানের কোম্পানীর ওভারলুক কেনা পর্যন্ত যেটুকু ইতিহাস ওর অজানা ছিল সেটা ও বের করে ফেলেছে। কিন্তু ওয়েন্ডিকে সেটা বলতে গিয়েও ও কেন যেন বলল না।

“তুমি এখানে করছটা কি?” ওয়েন্ডি হাসিমুখে জানতে চাইল।

“ওভারলুকের ইতিহাস পড়ছি।”

“কেন?”

“এমনি।”

(আর এটা নিয়ে তোমার এত মাথাব্যাথা কিসের?)

“ইন্টারেস্টিং কিছু খুঁজে পেলে?”

“তেমন কিছু নয়,” জ্যাক কষ্ট করে নিজের গলা স্বাভাবিক রাখল। ওয়েন্ডির এই গায়ে পড়া স্বভাবটা ওর একদম পছন্দ নয়। আগেও ও এমন করত। জ্যাক, কোথায় যাচ্ছ? জ্যাক ড্যানিকে কি গল্প পড়ে শোনালে? এসব শুনতে শুনতে অতিষ্ট হয়ে জ্যাক মদ খাওয়া শুরু করে। এটা হয়তো ওর মদ খাবার একমাত্র কারণ নয়, কিন্তু অস্বীকার করবার উপায় নেই যে এটা একটা বড় কারণ। মাঝে মাঝে মনে হয় ওর মুখে চড় বসিয়ে দেই…

(কোথায়? কেন? কখন? কে?)

প্রশ্নের পর প্রশ্ন। শুনতে শুনতে জ্যাকের মাথা ধরে যায়।

মাথা? ওর আসলেই মাথাব্যাথা করছে। ওই নষ্ট মেশিনটায় ফিল্ম পড়ছিল দেখে।

ওয়েন্ডি উদ্বিগ্ন মুখ জ্যাকের কপাল ছোঁবার জন্যে হাত বাড়িয়ে দিল। “জ্যাক? তুমি ঠিক আছ তো? তোমাকে ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে।”

জ্যাক এক ঝটকায় নিজের মাথা সরিয়ে নিল। “আমি ঠিকই আছি।”

ওয়েন্ডির মুখের হাসি মিলিয়ে গেল। ও আহত স্বরে বলল, “আচ্ছা, ঠিক আছে তাহলে…তোমার কাজ শেষ হলে বেরিয়ে এস, কেমন?”

বলে ওয়েন্ডি বেরিয়ে যাচ্ছিল, এমন সময় জ্যাক ওকে পেছন থেকে ডাকল, “ওয়েন্ডি?”

“কি?”

“আমি আসলে পুরোপুরি ঠিক নেই…ওই মেশিনটার ভেতর এতক্ষণ তাকিয়ে ছিলাম দেখে মাথাব্যাথা করছে।”

ওয়েন্ডি আবার এগিয়ে এল। নিজের ব্যাগ খুঁজে ও একটা ওষুধ বের করে দিল। “এটা খেয়ে নাও, ঠিক হয়ে যাবে।”

“বেশ।” জ্যাক বলে হাসল।

“তোমার কি পানি লাগবে?” ওয়েন্ডি জানতে চাইল।

প্রশ্নটা শুনতেই জ্যাকের মাথায় আবার রাগ ছোবল দিল।

(না, আমি চাই তুই এখান থেকে চলে যা, হারামজাদী)

“না, আমি উপরে যাবার সময় নিজেই নিয়ে নেব।” জ্যাক হাসিমুখে জবাব দিল।

“বেশ,” ওয়েন্ডি আবার দরজা খুলল। ও একটা ছোট স্কার্ট পড়ে আছে। ওর পেছনটা দেখতে সুন্দর লাগছিল। “আমরা পার্কে আছি।”

“ঠিক আছে।” বলে জ্যাক অপেক্ষা করল ওয়েন্ডির ওপরে যাওয়া পর্যন্ত। তারপর ও ফিল্ম পড়ার মেশিনটা বন্ধ করে নিজেও উঠে এল। ওর মাথার ব্যাথা বেড়েই চলেছে। এখন ও যদি মাথাব্যাথা কমাবার জন্যে যদি এল গ্লাস মদ খায় তাহলে সেটা কি খুব দোষের কিছু হবে?

জ্যাক কষ্ট করে চিন্তাটা মাথা থেকে হটাল। ওর মেজাজ আস্তে আস্তে আরও খারাপ হচ্ছে।

ও রিসেপশন ডেস্কে বসা মহিলাকে জিজ্ঞেস করল ও একটা ফোন করতে পারবে কিনা। মহিলা জানাল যে এখান থেকে শুধু লোকাল কল করা যায়, লং- ডিসট্যান্স নয়। জ্যাকের লং ডিসট্যান্সই দরকার ছিল। ও মাথা নেড়ে সরে এল।

জ্যাক লাইব্রেরির বাইরে বেরিয়ে এল একটা ফোনবুথ খুঁজবার জন্যে। আজকে নভেম্বরের ৭ তারিখ, আর বাইরের আকাশ দেখে তা বোঝা যাচ্ছিল। আকাশে গম্ভীর কালো মেঘগুলো তুষারপাতের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

বিল্ডিং এর পেছনদিকে ও একটা ফোনবুথ খুঁজে পেল। ও ঢুকে ফোনটায় একটা পয়সা পুরে অপারেটরকে চাইল।

“কার সাথে কথা বলতে চাচ্ছেন, স্যার?”

“ফ্লোরিডায়, ফোর্ট লডারডেলে, অপারেটর।” বলে ও নাম্বারটা জানাল। অপারেটর ওকে বলল কত টাকা লাগবে, আর জ্যাক সুবোধ বালকের মত ততগুলো পয়সা ঢুকাল ফোনের স্লটে। তারপর লাইনটা কানেক্ট হবার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে ও হাতের ওষুধটা গিলে নিল।

অপরপ্রান্ত থেকে প্রথম রিং বাজবার সাথে সাথে জবাব এল :

“সার্ফ-স্যান্ড রিসর্ট, আপনার জন্যে কি করতে পারি?”

“আমি আপনাদের ম্যানেজার মি: আলম্যানের সাথে কথা বলতে চাই।”

“উনি এখন খুবই ব্যস্ত। আপনার কি আমাদের দ্বিতীয় ম্যানেজার, মি: ট্রেন্টের সাথে কথা বললে চলবে?”

“আলম্যানকে বলুন যে জ্যাক টরেন্স ফোন করেছে, কলোরাডো থেকে।”

“একটু ধরুন, স্যার।”

কিছুক্ষণ পর জ্যাক ফোনে আলম্যানের গলা শুনতে পেল। আর শুনতেই ওর মনে পড়ে গেল ও আলম্যানকে কতটা অপছন্দ করে।

“টরেন্স? কোন সমস্যা হয়েছে নাকি?”

“জি না,” জ্যাক জবাব দিল। “বয়লার ঠিকভাবেই চলছে, আর আমি এখনও আমার বৌ আর বাচ্চাকে খুন করিনি। সময়ই পাচ্ছি না। দেখি, ক্রিসমাসের দিকে ওই কাজটা শেষ করে ফেলব।”

“তোমার রসিকতা শুনবার আমার সময় নেই, টরেন্স,” আলম্যান যে আপনি থেকে তুমিতে চলে গেছে সেটা জ্যাকের কান এড়াল না। “আমি ব্যস্ত—”

“ব্যস্ত মানুষ। জানি। আমি ফোন করলাম ওভারলুকের ইতিহাসের যে অংশগুলো আপনি আমাকে বলার প্রয়োজন মনে করেননি সেগুলোর ব্যাপারে জানবার জন্যে। যেমন ডারওয়েন্ট কিভাবে হোটেলটা লাস ভেগাসের একদল গুন্ডার কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল, বা প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের চমৎকার পলিশ করা দেয়ালগুলোতে কিভাবে এক মাফিয়া সদস্যের মগজ ছড়িয়ে ছিল।”

একমুহূর্তের জন্যে অপরপ্রান্ত থেকে কোন উত্তর এল না। তারপর আলম্যান নীচু গলায় বলল : “এসবের সাথে আপনার চাকরির কোন সম্পর্ক আমি দেখি নি, মি: টরেন্স – “

“কিন্তু সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা জানতে পারলাম আমি আজকে। লাস ভেগাসের মালিকদের কাছ থেকে আরও দু’বার হাত বদলের পর হোটেলের মালিকানা এসে পড়ে সিলভিয়া হান্টার নামে এক মহিলার কাছে…আর কাকতালীয়ভাবেই বোধহয়, মহিলা আগে ছিলেন সিলভিয়া হান্টার ডারওয়েন্ট, ১৯৪২ থেকে ১৯৪৮ সাল পর্যন্ত!”

“আপনার তিন মিনিটের মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছে।” অপারেটরের গলা শোনা গেল।

“মি: টরেন্স, এসব তো কোন গোপন খবর নয়। পেপারে লেখালেখি হয়েছে, টিভিতে এসেছে।”

“আমার কাছে তো খবরটা গোপন করা হয়েছে, তাই না?” জ্যাক বলল। “আমি খেয়াল করেছি যে ১৯৪৫ এর পর থেকে হোটেলটার মালিকানা হয় ডারওয়েন্ট অথবা ডারওয়েন্টের সাথে সম্পর্কিত কারও কাছে ছিল। সিলভিয়া হান্টার যখন হোটেলটা চালাচ্ছিল তখন এখানে কি ধরনের ব্যবসা হয় তাও বুঝতে পেরেছি। তখন হোটেলটা ছিল একটা বেশ্যাবাড়ি।”

“টরেন্স!” আলম্যানের গলায় একসাথে বিস্ময় আর ঘৃণা ঝরে পড়ল। জ্যাক সন্তুষ্টমুখে আর একটা ওষুধ জিভে ফেলল।

“সিলভিয়া হোটেলটা বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় যখন একটা রুমের মধ্যে একজন মন্ত্রীর লাশ পাওয়া যায়। খবরে দেখলাম যে মৃত্যুর সময় ওনার শরীরে মেয়েদের মোজা, হাই হিল আর একটা কনডম ছাড়া পড়া ছিল না।”

“এটা একটা নোংরা মিথ্যা রটনা!”

“আসলেই?” জ্যাক বলল। ওর রাগ কমে গিয়েছে। ও এখন মজা পাচ্ছিল। আর ওষুধ খাবার কারণেই হয়তো, ওর মাথাব্যাথা কমে গিয়েছে।

“টরেন্স, যদি তোমার প্ল্যান এটা হয়ে থাকে যে তুমি এসব বলে হোটেলের মালিকদের ব্ল্যাকমেইল করবে, বা পত্রিকায় লেখালেখি করবে তাহলে আগেই বলে রাখি যে এসব করে কোন লাভ নেই – “

“না, না, তেমন কিছু নয়। আমার শুধু খারাপ লেগেছে যে আপনি আমাকে পুরো সত্যিটা বলেননি—”  

“পুরো সত্যি?” আলম্যান প্রায় চেঁচিয়ে উঠল। “তোমার যদি মনে হয়ে থাকে যে আমি হোটেলের নামে রটানো কিছু কুৎসিত গুজব একজন কেয়ারটেকারের সাথে আলোচনা করব, তাহলে এটা তোমার ভুল ধারণা। আর এসব গল্প নিয়ে তোমার হঠাৎ এত মাথাব্যাথা কেন? তোমার কি ভয় হচ্ছে যে যারা হোটেলে মারা গেছে ওদের ভূত এসে তোমাকে ধরবে?”

“না, আমার চিন্তা ভূত নিয়ে নয়। কিন্তু যতদুর আমার মনে পড়ে, আমার ইন্টারভিউ নেবার সময় আপনি আমার ব্যক্তিগত ইতিহাস টেনে আনেন, যেটার সাথে আমার কাজের কোন সম্পর্ক নেই। আপনি আমার পুরনো ভুলগুলোর কথা বলে আমাকে অপমান করেন।”

“তোমার এসব কথা বলার সাহস হচ্ছে কিভাবে?” রাগে আলম্যানের কথা আটকে যাচ্ছিল। “আমি তোমার চাকরি খাবার ব্যাবস্থা করছি।”

“আমার ধারণা অ্যাল শকলি বোধহয় সে ব্যাপারে আপত্তি জানাবে।”

“আর আমার ধারণা অ্যাল শকলির বন্ধুত্বের ওপর তুমি খুব বেশী ভরসা করছ।”

এক মুহূর্তের জন্যে জ্যাকের মাথাব্যাথা আবার পুরোদমে ফিরে এল। ও চোখ কুঁচকে প্রশ্ন করল, “এখন ওভারলুকের মালিক কারা? নাকি আপনার সেটা জানার মত উঁচু পদ নেই?”

“তুমি এখন বাড়াবাড়ি করছ, টরেন্স। ভুলে যেও না আমি তোমার বস। আমার সাথে এভাবে কথা বলার তোমার কোন অধিকার নেই…”

“ঠিক আছে, তাহলে আমি অ্যালকে একটা চিঠি লিখে প্রশ্নটা করব। সে সাথে আপনার ব্যাপারে আমার কিছু মতামত জানাবার অধিকার তোয়ামার আছে, নাকি?”

“ডারওয়েন্ট এখন আর হোটেলের মালিক নয়। যারা মালিক তারা সবাই নিউ ইয়র্কে থাকে। তোমার বন্ধু শকলি একটা বড় অংশের মালিক। প্রায় ৩৫% এর মত।”

“আর কে?”

“অন্য শেয়ারহোল্ডারদের নাম আমার তোমাকে জানাবার কোন ইচ্ছা নেই, টরেন্স। তোমার এই ব্যাবহারের ব্যাপারে আমি মালিকদের সাথে কথা বলব- “

“আর একটা প্রশ্ন।”

“আমার কোন ঠেকা নেই তোমার সব প্রশ্নের উত্তর দেবার।”

“ওভারলুকের ইতিহাসের ব্যাপারে আমি এখন যা জানি তার বেশীরভাগই আমি পেয়েছি বেসমেন্টের একটা পুরনো স্ক্র্যাপবুক থেকে। এই বইটা কার সেটা কি আপনি জানেন?”

“না।”

“বইটা কি গ্রেডির হতে পারে? হোটেলের আগের কেয়ারটেকার?”

“শোনো, টরেন্স,” আলম্যান বরফের মত ঠাণ্ডা গলায় বলল, “গ্রেডি পড়ালেখা জানত নাকি সে ব্যাপারেই আমার গভীর সন্দেহ আছে, ওর হোটেলের পুরনো খবর নিয়ে মাথা ঘামাবার কথা নয়।”

“আমি ওভারলুক হোটেলের ব্যাপারে একটা বই লিখবার কথা চিন্তা করছি। ওই স্ক্র্যাপবুকের মালিককে আমি বইয়ের শুরুতে ধন্যবাদ জানাতে চাই।”

“ওভারলুককে নিয়ে বই লেখা খুবই খারাপ একটা আইডিয়া, টরেন্স। বিশেষ করে তোমার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যদি লেখা হয় তাহলে।”

“আপনার তো তা মনে হবেই।” জ্যাক বলল। ওর মাথাব্যাথা আবার ঠিক হয়ে গিয়েছে। ওর মাথা এখন ঝকঝকে পরিষ্কার, ও গভীর মনোযোগ দিয়ে লেখবার সময় যেমন থাকে। ওষুধগুলো ভালো কাজের তো! অন্যদের এমন হয় কিনা কে জানে, জ্যাক মনে মনে বলল, কিন্তু আমার ওষুধগুলো খাবার সাথে সাথে মাথা খুলে গেছে, ফুরফুরে লাগছে।

ও আলম্যানকে বলল, “আপনারা চান মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভরা গাইডবুক মার্কা একটা বই যেটা আশেপাশের পাহাড়ের ছবি আর হোটেলে হোমড়া- চোমড়া কারা এসেছে তাদের কথায় ভরা থাকবে!”

“যদি আমি ১০০% শিওর হতাম যে তোমার চাকরি গেলে আমার নিজের চাকরির কোন সমস্যা হবে না, তাহলে এই মুহূর্তে তোমাকে বের করে দিতাম।” আলম্যান কাটা কাটা সুরে জবাব দিল।

জ্যাক বলল, “আমার বইয়ে মিথ্যা বা সাজানো কোন কথা থাকবে না। যেটা সত্যি শুধু সেটাই লিখব।”

(তুমি ওকে খেপাচ্ছ কেন? তুমি কি চাও যে ও তোমাকে বের করে দিক?)

“তোমার বইয়ে তুমি যা ইচ্ছা তাই লেখো!” আলম্যান চিৎকার করে বলল। “কিন্তু তার আগে আমার হোটেল থেকে দূর হও!”

“ওভারলুক তোমার হোটেল নয়!” জ্যাকও পালটা চেঁচিয়ে উঠল, তারপর দড়াম করে রিসিভারটা আছড়ে রাখল।

ও বুথের ভেতরে রাখা টুলটায় বসে জোরে জোরে দম নিতে লাগল। ওর এখন একটু ভয় হচ্ছিল।

(একটু? নাকি অনেক? )

ও এখন ভেবে পাচ্ছিল না ও আলম্যানকে কেন ফোন করতে গেল।

(তুমি আবার মেজাজ খারাপ করেছ, জ্যাক)

হ্যা,হ্যা ও আসলেই করেছে। এখন আলম্যান যদি অ্যালকে ফোন করে দাবী করে ওকে চাকরি থেকে বের করে দেবার জন্যে? ও ওয়েন্ডিকে কি বলবে? হ্যা, সোনা, আমি আরও একটা চাকরি হারিয়েছি। আমার বস ২০০০ মাইল দূরে বসে ছিল, কিন্তু তাও তাকে এমন রাগিয়েছি যে সে আমাকে বের করে দিয়েছে।

জ্যাক নিজের ঠোঁট মুছল। ওর এক গ্লাস মদ দরকার। এক্ষণি, এক্ষণি। রাস্তার ওপাশে একটা ক্যাফে আছে, ওখান থেকে এক ক্যান বিয়ার নিয়ে নিলেই হবে…

ও অসহায়ের মত নিজের দুই হাত মুঠ করল।

ও আলম্যানকে ফোন করল কেন? যখন ওর মদের নেশা ছিল, তখন ওয়েন্ডি একবার বলেছিল যে জ্যাকের ভেতর একটা কিছু আছে যেটা নিজের ধ্বংস চায়। সেই প্রবৃত্তিটাই কি ওকে এখন বাধ্য করেছে ফোন করতে? ও কি আসলেই ভেতরে ভেতরে নিজের ক্ষতি করতে চায়?

ও চোখ বন্ধ করতে একটা পুরনো ঘটনা ওর সামনে ভেসে উঠল।

ও অনেক রাতে বাসায় ফিরেছে, বদ্ধ মাতাল, গায়ে রাস্তার ময়লা আর রক্ত লেগে আছে। ও বারের সামনের পার্কিং লটে একজনের সাথে মারামারি করেছে, তার ফল। বাসায় ঢুকেই ও প্রচণ্ড শব্দ করে একটা টেবিলের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে। ওয়েন্ডি এসে ওকে তীব্র স্বরে বকা দেয় : “মাতাল কোথাকার, নিজের খেয়াল থাকে না নিজের বাচ্চার খেয়াল তো রাখতে পারিস! ড্যানি মাত্র ঘুমিয়েছে, এখন তোর মাতলামির আওয়াজে ও উঠে যাবে!”

আচমকা টেলিফোন বেজে ওঠায় জ্যাক প্রায় লাফিয়ে উঠল। “কি?” ফোন ধরে ও জিজ্ঞেস করল।

“আপনার কলের জন্যে আরও সাড়ে তিন ডলার লাগবে, স্যার।” অপারেটরের গলা।

“বেশ, একটু ধর, দিচ্ছি।” জ্যাক নিজের পকেট থেকে কয়েনগুলো বের করে টেলিফোনের স্লটে ঢালল। তারপর বুথ থেকে বেরিয়ে গেল।

ওর মাথায় তখনো আলম্যানের সাথে বলা কথাগুলো ঘুরছিল। ও বইয়ের ব্যাপারটা আলম্যানকে বলতে গেল কেন? গাধা কোথাকার। আলম্যান হয়তো এখন নিজের ক্ষমতা খাটিয়ে ওকে বইটা লিখতে বাধা দেবে। জ্যাকের উচিত ছিল রিসার্চ শেষ না করা পর্যন্ত বইয়ের ব্যাপারে মুখ বন্ধ রাখা। ও আরামসে লেখা শেষ করে বই ছাপা হলে তারপর আলম্যানের মুখের সামনে আঙুল নাচাতে পারত। তা না করে ও আলম্যানের সাথে এখন ঝগড়া করল, আর নিজের বসকে শত্রু বানাল। কেন? এটা যদি নিজেকে ধ্বংস করার ইচ্ছা থেকে ও না করে থাকে তাহলে কেন করেছে?

ও হাঁটতে হাঁটতে আরেকটা ওষুধ ফেলল নিজের মুখে। তেতো স্বাদটা এখন ওর ভালো লাগা শুরু হয়েছে।

ওর ওয়েন্ডি আর ড্যানির সাথে দেখা হল।

“আরে, আমরা তোমাকেই খুঁজছিলাম,” ওয়েন্ডি হাসিমুখে বলল। “দেখেছ, বরফ পড়া শুরু হয়েছে?”

জ্যাক মাথা তুলে আকাশের দিকে তাকাল। “তাই তো।” ড্যানিও আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ছিল। ও জিভ বের করে রেখেছে যাতে তুষার ধরতে পারে।

“তোমার মাথাব্যাথার কি অবস্থা?” ওয়েন্ডি জানতে চাইল।

জ্যাক হাত বাড়িয়ে ওর কাঁধ জড়িয়ে ধরল। “আগের চেয়ে ভালো। চল, বাসায় যাই।”

কথাটা বলে জ্যাকের খেয়াল হল এই প্রথম ও ওভারলুক হোটেলকে ‘বাসা’ বলে সম্বোধন করেছে। তারপর ওর মাথায় আর একটা চিন্তা খেলে গেল।

ওভারলুকের ব্যাপারে ওর যতই আগ্রহ থাকুক, ও এখনও হোটেলটাকে পছন্দ করে না, ওখানে থাকলে একটা চাপা অস্বস্তি বোধ করে। এজন্যেই কি ও আলম্যানকে ফোন করেছিল?

যাতে ওখানে কিছু ঘটার আগেই আলম্যান ওকে বের করে দেয়?

অধ্যায় ২১ – রাতের ভাবনা

রাত দশটা। ওরা সবাই নিজ নিজ বিছানায় ঘুমাবার চেষ্টা করছিল।

জ্যাক শুয়ে শুয়ে ওয়েন্ডির নিশ্বাসের শব্দ শুনছিল। ওর জিভ থেকে এখনও ওষুধের তেতো স্বাদ যায়নি। ওর মাথায় ঘুরছিল সন্ধ্যাবেলার কথা, যখন ওরা হোটেলে ফিরে আসার পর অ্যাল শকলি ওকে ফোন করেছিল।

অপারেটর ওকে যান্ত্রিক স্বরে জিজ্ঞেস করে ও মি: অ্যাল শকলির ফোন ধরতে রাজি আছে কিনা। জ্যাক সম্মতি জানাবার সাথে সাথে অ্যালের গলা ভেসে এল।

“জ্যাকি! তুই এসব কি করছিস বল তো?”

“হ্যালো, অ্যাল।” জ্যাকের হাত আবার ওষুধের বোতলটা খুঁজতে আরম্ভ করল।

“আলম্যান আমাকে হঠাৎ করে ফোন করে তোর ব্যাপারে অদ্ভুত সব কথা বলতে শুরু করল। আর আলম্যান যখন নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে লং ডিসট্যান্স ফোন করেছে, তার মানে ব্যাপারটা আসলেই সিরিয়াস।”

“তোর চিন্তা করবার মত কিছু হয় নি, অ্যাল!”

“ব্যাপারটা কি খুলেই বল না। আলম্যান একবার বলে তুই নাকি আমাদের ব্ল্যাকমেইল করতে চাস, আবার বলে যে পত্রিকায় নাকি তুই ওভারলুক নিয়ে লেখালেখি করবি….”

“তেমন কিছুই না,” জ্যাক বলল। “আমি শুধু আলম্যানকে একটু খোঁচা দিতে চাচ্ছিলাম। আমার ইন্টারভিউর সময় ও আমার অতীত টেনে এনে আমাকে অপমান করার চেষ্টা করেছিল। তারই একটু প্রতিশোধ আরকি। যেটায় আমার সবচেয়ে মেজাজ খারাপ হয়েছিল সেটা হচ্ছে ওর ধারণা আমি ওভারলুক হোটেলে কাজ করবার যোগ্য নই। ওর প্রাণপ্রিয়, নিখুঁত ওভারলুক হোটেল। ওর মুখের ওপর দেবার মত জবাব আমি এখন পেয়ে গিয়েছি। বেসমেন্টে একটা স্ক্র্যাপবুক পেয়েছি। ওখানে ওভারলুকের সব গোপন কথা কে বা কারা ফাঁস করে দিয়ে গেছে। দেখে মনে হয় হোটেলের বিরুদ্ধে ভালোই ষড়যন্ত্র চলছে।”

“ষড়যন্ত্র? আশা করি তুই সিরিয়াস না, জ্যাক।” অ্যালের গলা ঠাণ্ডা শোনাল।

“না না। কিন্তু আমি দেখলাম আগে এখানে-”

“হোটেলের ইতিহাস আমার জানা আছে। আলম্যান বলল যে তুই নাকি হোটেলের নাম খারাপ করবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিস?”

“আলম্যান একটা মিথ্যুক!” জ্যাক চড়া গলায় বলল। “এটা ঠিক যে আমি ওভারলুক হোটেলকে নিয়ে একটা কিছু লিখতে চাই, এই হোটেলটায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমলের সব নামকরা ব্যক্তিত্বরা এসে থেকেছে। এটা নিয়ে একটা মজার প্লট দাঁড়া করানো যায়। তার মানে এই নয় যে আমি হোটেলের বদনাম করতে চাই। এখন আমার এসব করবার সময়ও নেই!”

“জ্যাক, আমি তোর কথায় ভরসা রাখব কিভাবে?

জ্যাক বাকরুদ্ধ হয়ে গেল, ওর বিশ্বাস হচ্ছিল না অ্যাল ওকে একথাটা বলেছে। “অ্যাল? কি বললি তুই-”

“ঠিকই বলেছি। জ্যাক, তুই তো এই হোটেলে কিছুদিন কাজ করেই খালাস, কিন্তু আমার ওভারলুকের সাথে আরও বিশ-ত্রিশ বছর থাকতে হবে। আমি তোকে যা ইচ্ছে তাই লিখতে দিতে পারব না।”

জ্যাকের গলা থেকে এখনও শব্দ বের হচ্ছিল না।

“আমি তোর উপকার করতে চেয়েছিলাম,” অ্যাল তখনও বলে যাচ্ছিল, “কারণ আমরা দু’জন একসাথে অনেক খারাপ একটা সময় পার করে এসেছি। মনে আছে সেই সময়ের কথা জ্যাক?”

“মনে আছে,” জ্যাক বিড়বিড় করল। ওর ভেতর এখন চাপা রাগটা আবার মাথাচাড়া দিচ্ছিল। ব্যাপার কি? সবাই মিলে কি ঠিক করেছে ওরা জ্যাকের সাথে যা-তা ব্যাবহার করবে? প্রথমে আলম্যান, তারপর ওয়েন্ডি আর এখন অ্যাল।

“হ্যাফিল্ড ছোকড়াটাকে মারবার পর আমি তোকে বাঁচাবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু বোর্ড আমার কথা শুনল না।” অ্যাল বলল। “তাই আমি তোকে হোটেলের এই চাকরিটা জুটিয়ে দেই, যাতে তুই কিছুদিন সময় পাস নিজের পায়ে দাঁড়াবার জন্যে। আর এখন তুই আমার পিঠেই ছোরা মারতে চাচ্ছিস? বন্ধুরা কি এমন করে, জ্যাক?”

“না,” জ্যাক নীচু স্বরে বলল।

জ্যাক বারবার ওয়েন্ডি আর ড্যানির কথা মনে করে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। ও যদি এখন বেফাঁস কিছু বলে ফেলে তাহলে ওর পুরো পরিবারকে পস্তাতে হবে।

“কি?” অ্যাল কড়া গলায় প্রশ্ন করল।

“না, বন্ধুরা এমন করে না। কিন্তু তুই আমার অবস্থাটা বুঝতে পারছিস না, অ্যাল। তোর কোন বড়লোক বন্ধুর দয়ার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে না। তুই ভুলে গেছিস মদের নেশায় তোর কি অবস্থা হয়েছিল? আমি সেখানে না থাকলে তোর কি হত?”

অ্যাল কিছু বলল না।

“আমাকে কি চাকরি থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে? তাহলে এখনই পরিষ্কার বলে দে।”

অ্যালের গলা ক্লান্ত শোনাল। “না, যদি তুই আমার জন্যে দু’টো জিনিস করতে রাজী থাকিস তাহলে।”

“ঠিক আছে।”

“তোর হ্যা বলার আগে আমি কি চাই সেটা শোনা উচিত না?”

“না। আমার ওয়েন্ডি আর ড্যানির কথা চিন্তা করতে হবে। তুই যা বলিস আমি সেটাই মেনে নেব।”

অ্যাল একমুহূর্ত অপেক্ষা করে তারপর বলল, “এক, আলম্যানকে তুই আর ফোন করতে পারবি না। কোন কারণেই নয়।”

“বেশ।”

“আর দুই-তোর কোন বই যেন কলোরাডোর কোন হোটেলকে নিয়ে না হয়।”

একমুহূর্তের জন্যে জ্যাকের তীব্র রাগ ওকে জবাব দিতে দিল না। আমি তোকে চাকরি দিয়েছি জ্যাক, আমার হুকুম অনুযায়ী তোর চলতে হবে।

“হ্যালো জ্যাক? শুনতে পাচ্ছিস?”

জ্যাক ‘হ্যা’ বলতে চেষ্টা করল, কিন্তু ওর গলা থেকে গোঙ্গানী ছাড়া আর কিছু বের হল না।

“ভাবিস না যে আমি মনে করি তুই কি লিখবি না লিখবি তা নিয়ে কিছু বলার অধিকার আমার আছে। কিন্তু এই ব্যাপারটায়…”

“ডারওয়েন্ট কি এখনও কোনভাবে হোটেলটার সাথে জড়িত?”

“তোর এটা নিয়ে মাথা ঘামাবার কোন কারণ আছে বলে আমার মনে হয় না, জ্যাক।”

“ঠিক বলেছিস,” জ্যাকের গলা মনে হল অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে। “আমি যাই অ্যাল, ওয়েভি বোধহয় আমাকে ডাকছে।”

“আচ্ছা ঠিক আছে”

ফোন রাখবার সাথে সাথে ব্যাথাটা শুরু হল। জ্যাক পেটের ওপর দু’হাত রেখে কুঁজো হয়ে গেল। ওর মাথা দপদপ করছিল।

ওয়েন্ডি একটু পরে যখন জ্যাককে খুঁজে পেল তখন ওর অবস্থা আগের চেয়ে একটু ভাল হয়েছে। তাও ওয়েন্ডি এসে বলল, “জ্যাক, তোমাকে একদম ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। তুমি ঠিক আছ তো?”

“মাথাব্যাথাটা ফিরে এসেছে। আমি আজকে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়তে চাই। আজরাতে আমি আর লিখতে পারব না।”

রাতে ওরা দু’জন বিছানায় শুয়ে ছিল, ওয়েন্ডির উষ্ণ, নরম পা জ্যাকের পায়ের ওপর রাখা। জ্যাক শুয়ে শুয়ে ভাবছিল কিভাবে আজকে ওর অ্যালের সামনে ভিক্ষা চাইতে হয়েছে নিজের চাকরির জন্যে। ও মনে মনে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা করল নিজের কাছে। আজ হোক, কাল হোক, ওভারলুককে নিয়ে একটা বই ও লিখবেই। হোটেলের সব রহস্যকে ও মানুষের চোখের সামনে উলঙ্গ করে ছাড়বে। সেদিন দেখা যাবে কে কার সামনে ভিক্ষা চাইছে।

জ্যাক পাশ ফিরে শুল। ও বুঝতে পারছিল যে ওর আজকে রাতে সহজে ঘুম আসবে না।

ওয়েন্ডি টরেন্স শুয়ে শুয়ে নিজের ঘুমন্ত স্বামির নিশ্বাসের শব্দ শুনছিল। জ্যাক কি নিয়ে স্বপ্ন দেখে? কোন বার, যেখানে কখনও মদ শেষ হয় না? যেখানে ওর বন্ধুরা সারারাত জেগে থাকে হই-হুল্লোড় করবার জন্যে। যেখানে ওয়েন্ডি টরেন্সের প্রবেশ নিষেধ।

কিছুদিন ধরে ওয়েন্ডির জ্যাককে নিয়ে ভয় হচ্ছে। সেই পুরনো, অসহায় ভয়টা, যেটা ওয়েন্ডিকে রাতের পর রাত জাগিয়ে রাখত যখন জ্যাক কোন বারে বা বন্ধুর বাসায় বসে মদ গিলছে।

জ্যাকের মধ্যে এক এক করে মদের নেশার সব লক্ষণ ফিরে এসেছে, শুধু মদ খাওয়া বাদে। ও ঘন ঘন ঠোঁট মুছতে থাকে, লেখায় মন দিতে পারে না। আজ অ্যাল শকলি যখন ফোন করেছিল, তখন ওয়েন্ডি খেয়াল করেছে যে ওখানে একটা খালি ওষুধের বোতল রাখা ছিল। কিন্তু কোন পানির গ্লাস ছিল না। তার মানে জ্যাক আবার ওষুধ চিবিয়ে খাওয়া শুরু করেছে। ও এখন ছোট ছোট জিনিস নিয়ে বিরক্ত হয়ে যায়। বেশীক্ষণ চুপ থাকলে অস্থিরভাবে তুড়ি বাজাতে শুরু করে। তাছাড়া ও প্রতিদিন সকালে বেসমেন্টে যায় বয়লার চেক করবার জন্যে, আর সেখানে অনেকক্ষণ বসে থাকে।

সবচেয়ে দুশ্চিন্তার ব্যাপার হচ্ছে যে জ্যাক এখন রাগারাগি একদম বন্ধ করে দিয়েছে। ও যদি মাঝে মাঝে চেঁচামেচি করে, বা লাথি দিয়ে চেয়ার উলটে ফেলে তাহলে ওয়েন্ডি নিশ্চিন্ত থাকে, যে ওর রাগ বের হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গত কয়েকদিন ধরে জ্যাক একবারও গলা উঁচু করছে না, আর ওয়েন্ডির মনে হচ্ছে এভাবে রাগ চেপে রাখলে ও একদিন আগ্নেয়গিরির মত ফেটে পড়বে।

তাছাড়া ড্যানিকেও কয়েকদিন ধরে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে। যখন অ্যাল ফোন করেছে, তখন ড্যানির দু’চোখে দুশ্চিন্তার ছায়া দেখা যাচ্ছিল। আর অ্যাল শকলি কখনও কারও সাথে আড্ডা মারবার জন্যে ফোন করে না। নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে।

পরে অবশ্য ড্যানি আবার স্বাভাবিক হয়ে যায়। ও যখন বই পড়ছিল তখন ওয়েন্ডি ওর পাশে এসে বসে। ড্যানির চোখের দিকে তাকিয়ে ওর আবার মনে হল যে ওর ছেলের ভেতর কিছু একটা আছে, যেটা ডক্টর এডমন্ডস ধরতে পারেননি।

“ঘুমোবার সময় হয়েছে, ডক।”

“আচ্ছা।” ড্যানির বইয়ের যে পাতা পর্যন্ত পড়া হয়েছে সেখানে একটা ভাঁজ দিয়ে উঠে পড়ল।

“তোমার অ্যাল আংকেল ফোন করেছিল।” ওয়েন্ডি বলল।

“তাই?” ড্যানির গলায় একটুও বিস্ময়ের ছোঁয়া নেই।

“ওদের মধ্যে ঝগড়া-টগড়া হয়েছে কিনা কে জানে।”

“হ্যা, হয়েছে। অ্যাল আংকেল চায় না যে বাবা বইটা লিখুক।”

“কিসের বই, ড্যানি?”

“ওভারলুক হোটেলকে নিয়ে।”

ওয়েন্ডি ড্যানিকে জিজ্ঞেস করতে গিয়েছিল যে ও কিভাবে এসব কথা জানল, কিন্তু শেষ মুহূর্তে নিজেকে থামিয়ে দিল। ঘুমোতে যাবার আগে ড্যানিকে এভাবে জেরা করা উচিত হবে না। তাছাড়া ওয়েন্ডি জানে ড্যানি কিভাবে সব কথা বুঝতে পারে। ডক্টর বিল স্বীকার না করলেও ওয়েন্ডি জানে যে ড্যানির ভেতর আলৌকিক ক্ষমতা আছে।

ও ঠিক করল যে ড্যানির সাথে ওর ওভারলুক হোটেল নিয়ে কথা বলবার সময় হয়েছে। আগামীকালই ও ড্যানিকে জিজ্ঞেস করবে। এ চিন্তাটা মাথায় আসবার পর ওয়েন্ডি একটু স্বস্তি পেল। ও চোখ বন্ধ করে আস্তে আস্তে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে গেল।

ড্যানিও নিজের বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছিল, ওর ঘুম আসছে না। ও ঘরের আশে-পাশে চোখ বুলাল। সবকিছুই সুন্দর করে গুছিয়ে রাখা, ওর খেলনা, ওর বই। তারপরেও ওর কেন যেন মনে হচ্ছিল কোথায় কি যেন একটা মিলছে না। যেমন ওর দেয়ালে একটা ছবি আছে, একটা ধাঁধার মত যেখানে কয়েকশ’ মানুষ যুদ্ধরত আর তাদের মধ্যে থেকে রেড ইন্ডিয়ানদের খুঁজে বের করতে হবে। কয়েকজনকে ড্যানি বের করতে পেরেছে, ভয়ংকর রঙ করা চেহারা আর হাতে কুড়াল। কিন্তু যাদের বের করতে পারে নি তাদের নিয়েই ওর ভয়। ওরা লুকিয়ে আছে এখনও শত শত চেহারার আড়লে, আর যেকোন সময়, ড্যানি যখন ঘুমিয়ে আছে, তখন কুড়াল হাতে ওরা ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে ওর অসহায়, অচেতন শরীরের ওপর।

এখানে আসবার পর থেকেই সবকিছু কেমন যেন ওলট-পালট হয়ে গেছে। বাবা এখন সবসময় মদ খাবার কথা চিন্তা করে, আগের চেয়েও বেশী। কোন কারণ ছাড়াই আম্মুর ওপর রেগে যায়। সারাদিন রুমাল দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছতে থাকে। আম্মুও বাবাকে নিয়ে চিন্তায় আছে। এটা বুঝতে কোন বিশেষ ক্ষমতার দরকার হয় না। মি: হ্যালোরান বলেছিলেন যে সব মায়ের ভেতরই একটু জ্যোতি থাকে। আর সেই জ্যোতি দিয়েই আম্মু বুঝতে পারছে যে কিছু একটা হবে। কিন্তু কি হবে সেটা বুঝতে পারছে না।

আর ড্যানিও এটা নিয়ে আম্মুর সাথে কথা বলতে ভয় পাচ্ছিল। ডক্টর বিল বলেছেন যে ওর টনির সাথে যেসব কথাবার্তা হয় সেসব আসলে ওর কল্পনা। এখন মাকে এগুলো নিয়ে কিছু বলতে গেলে মা যদি মনে করে যে ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে?

‘মাথা খারাপ হওয়া’ যে কি সে ব্যাপারে ড্যানি এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নয়। কিন্তু জিনিসটা যে ভাল নয় তা ও জানত। একবার ও যখন স্কুলের প্লেগ্রাউন্ডে খেলা করছিল তখন ওর বন্ধু স্কটি আঙুল দিয়ে একটা ছেলেকে দেখায়। ছেলেটা বিষণ্ন চেহারা নিয়ে দোলনায় ঝুলছিল। স্কটি বলল যে ওর বাবা ছেলেটার বাবাটাকে চেনে, আর তার ‘মাথা খারাপ’ হয়ে গিয়েছে।

“তারপর ওর বাবাকে কয়েকটা লোক এসে ধরে নিয়ে গেছে।” স্কটি বলল।

“সত্যি? ওনার মাথায় কি হয়েছে?” ড্যানি জানতে চাইল।

“উনি পাগল হয়ে গিয়েছেন, লোকগুলো ওনাকে ‘পাগলা গারদে’ নিয়ে গেছে।” স্কটি চোখ বড় বড় করে একটা আঙুল কপালের একপাশে তাক করে দেখাল।

“উনি কবে ফেরত আসবেন?”

“কক্ষনো-কক্ষনো-কক্ষনো নয়।” স্কটি গম্ভীর মুখে জবাব দিল।

সেদিন ড্যানি ওই ছেলেটার বাবা, মিস্টার স্টেঙ্গারের ব্যাপারে আরও চারটা খবর পেল :

১) মিস্টার স্টেঙ্গার একটা পুরনো পিস্তল দিয়ে বাসার সবাইকে খুন করবার চেষ্টা করছিলেন

২) মিস্টার স্টেঙ্গার বাসার অনেককিছু ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে ফেলেছেন

৩) উনি এক বাটি ভর্তি ঘাস আর পোকা-মাকড় খেয়েছেন

৪) ওনার পছন্দের বেসবল টিম একটা খেলায় হেরে যাবার পর উনি ওনার বৌকে গলা টিপে মেরে ফেলার চেষ্টা করেন।

আর থাকতে না পেরে শেষে ড্যানি বাবাকে মিস্টার স্টেঙ্গারের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করে। বাবা ওকে কোলে বসিয়ে বোঝায় উনি আসলে পাগল হয়ে যাননি, উনি ‘মানসিক ভারসাম্য’ হারিয়ে ফেলেছেন। ওকে পাগলা গারদে নিয়ে যাওয়া হয় নি, নিয়ে যাওয়া হয়েছে হাসপাতালে। উনি কয়েকদিন ধরে খুব চাপের মধ্যে ছিলেন, তাই এমন হয়েছে। কিন্তু বোঝাবার সময় বাবা নিজের অজান্তেই একটা কথা বলেন, যেটা স্কটিও বলেছিল। মিস্টার স্টেঙ্গার যেখানে আছেন সেখানে ‘সাদা কোট পরা মানুষরা’ ওনার খেয়াল রাখেন। ওকে এখন অন্য সবার থেকে দূরে রাখা হবে, সারাদিন ওষুধ খেতে হবে আর অন্যরা যা বলবে তাই করতে হবে। ড্যানি এ জিনিসটা শুনে ভয় পেয়েছিল।

“উনি কবে ফেরত আসবেন, বাবা?”

“যখন উনি ভাল হয়ে যাবেন, ড্যানি।”

“মানে কবে?” ড্যানি তাও জানতে চাইল।

“সেটা তো এখন বলা সম্ভব নয়, ড্যানি।” জ্যাক বলল।

যার মানে হচ্ছে আসলে কক্ষনো-কক্ষনো-কক্ষনো নয়। তার কিছুদিন পর মিস্টার স্টেঙ্গারের ছেলে আর বৌ বাসা বদলে অন্য একটা জায়গায় চলে যান।

এই ভয়েই ড্যানি ওর মাকে কিছু বলতে চাচ্ছে না। যদি ওকে এরকম কোন জায়গায় নিয়ে বন্দি করে ফেলা হয়, যেখান থেকে ও আর ফিরতে পারবে না? এজন্যেই ও কখনো প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটে কি দেখেছে সেটা কাউকে বলবে না, বা হোসপাইপটা কিভাবে ওকে তাড়া করেছিল।

ড্যানির কিছু না বলার আর একটা কারণ আছে। ও জানে যে বাবার জন্যে এটা শুধু একটা চাকরি নয়। এটা হচ্ছে শেষ সুযোগ নিজের অতীতকে পিছে ফেলার। ওয়েন্ডি-আম্মুকে আবার ভালোবাসার। নিজের লেখা শেষ করার। আর ড্যানি যদি বলে যে ওর অসুবিধা হচ্ছে তাহলে বাবার এই চাকরি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

যখন ওরা প্রথম এসেছিল তখন বাবা এই সবগুলো জিনিসই করতে পারছিল। সমস্যাগুলো তো মাথাচাড়া দিয়েছে মাত্র কিছুদিন আগে।

এই অভিশপ্ত জায়গাটা মানুষকে অমানুষ করে দেয়)

কিন্তু ড্যানি নিজেকে যতই বোঝাক, ওর অস্বস্তি কমল না। ওভারলুক হোটেলের পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে।

আর যখন বরফ পড়া শুরু হবে তখন কি হবে? তখন তো ওরা চাইলেও বের হতে পারবে না।

ড্যানি শিউড়ে উঠে পাশ ফিরল। ও ঠিক করল যে ও আগামীকাল টনিকে ডাকবে। ও এখন আরও অনেকগুলো শব্দ পড়তে পারে। ও টনিকে দেখাতে বলবে রেডরাম মানে কি।

ওর বাবা-মা ঘুমিয়ে যাবার পরও ড্যানি অনেকক্ষণ জেগে থাকল। কিন্তু একসময় ওকেও ক্লান্তির কাছে হার মানতে হল। ওর দু’চোখ বুজে এল বাইরে বাতাসের গর্জন শুনতে শুনতে।

অধ্যায় ২২ – ট্রাকের ভেতর

ওয়েন্ডি আর ড্যানি ট্রাকে করে সাইডওয়াইন্ডারে যাচ্ছে। দিনটা উজ্জ্বল আর পরিষ্কার। কিন্তু ওয়েন্ডির তাও একটু চিন্তা হচ্ছিল। ড্যানি মাথা নীচু করে বাবার লাইব্রেরি কার্ডটা হাতে উলটেপালটে দেখছে। ওয়েন্ডির মনে হল ওকে যেন ক্লান্ত দেখাচ্ছে, যেন রাতে ওর ঘুম হয় না ঠিকমত।

গাড়ির রেডিওটায় গান বন্ধ হয়ে একজন খবর পাঠকের গম্ভীর, মাপা গলা শোনা গেল। সে বলছে যে আজ রাত থেকে বরফ পড়া শুরু করবে। কেউ যদি রাস্তায় থাকে তাহলে সন্ধ্যা হবার আগেই বাড়ি ফিরবার অনুরোধ করা হচ্ছে।

ওয়েন্ডি হাত বাড়িয়ে রেডিওটা বন্ধ করে দিল।

ড্যানি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, “যাক, এখনও আকাশ একদম নীল হয়ে আছে। ভাগ্য ভাল বাবা আজকে বাগানের গাছ ছাঁটা শুরু করেছে, তাই না? কালকে থেকে বরফ পড়া শুরু করলে আর পারবে না।”

“হমম্,” ওয়েন্ডি বলল।

“তুমি কি ভয় পাচ্ছ বরফ পড়লে কি হবে সেটা নিয়ে?” ও ড্যানিকে জিজ্ঞেস করল।

“না।”

ওয়েন্ডি একটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করল। ড্যানির সাথে ওভারলুক নিয়ে কথা বলবার এর চেয়ে ভাল সুযোগ আর আসবে না।

“ড্যানি, আমরা যদি হোটেল ছেড়ে চলে যাই তাহলে কি তুমি খুশি হবে?” ড্যানি মাথা নীচু করে নিজের হাতের দিকে তাকাল। “মনে হয়,” ও বলল। “কিন্তু এটা তো বাবার চাকরি, তাই না?”

“মাঝে মাঝে আমার মনে হয়,” ওয়েন্ডি সতর্ক গলায় বলল, “তোমার বাবাও ওভারলুক ছেড়ে যেতে পারলে খুশি হবে।” কথাটা শেষ করে ও কিছুক্ষণ নীরবে গাড়ি চালাল। সামনে একটা সংকীর্ণ মোড় আছে, সেটাকে সাবধানে পার করল।

ড্যানি কিছুক্ষণ মায়ের কথাটা চিন্তা করে দেখল। তারপর বলল, “না, আমার মনে হয় না।”

“কেন?”

“কারণ বাবা আমদের নিয়ে চিন্তা করে।” ড্যানি এখন সাবধানে, চিন্তা করে করে জবাব দিচ্ছিল। বাবার সবগুলো অনুভূতি বা চিন্তা বুঝবার ক্ষমতা ওর এখনও হয় নি, ও এখনও অনেক বাচ্চা।

“বাবা মনে করে…” ড্যানি আবার শুরু করে একটু থামল, আর মায়ের দিকে তাকাল। ওয়েন্ডি মনোযোগ দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল, ড্যানির দিকে নয়। ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে আবার শুরু করল।

“বাবা মনে করে এখানে থাকলে আমাদের সবার উপকার হবে। আমাদের যদি এখানে একটু একলা একলা লাগেও, তারপরও আমরা সবাই একসাথে থাকলে সবাই সবাইকে বেশী ভালবাসব। তাছাড়া বাবা মনে করে যে এই চাকরিটা চলে গেলে ও আর কোন চাকরি পাবে না, আমাদের না খেয়ে থাকতে হবে।”

“হম্। বাবা কি আর কিছু মনে করে?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল।

“হ্যা, আরও অনেক কিছু মনে করে, কিন্তু সেগুলো তো আমি বুঝতে পারি না। কারণ বাবা এখন বদলে গেছে।”

“জানি,” ওয়েন্ডি একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করল। “তুমি এসব জানলে কিভাবে, ড্যানি? টনি বলেছে?”

“না টনি না, আমি নিজেই বুঝতে পেরেছি,” ড্যানি বলল। “ডক্টর বিল বিশ্বাস করেন না যে টনি আছে, তাই না?”

“আমি বিশ্বাস করি,” ওয়েন্ডি বলল। “আমি জানি না ও তোমার ভেতরে থাকে নাকি অন্য কোন জায়গা থেকে আসে, কিন্তু আমি জানি ও আছে। আর ও… অথবা তুমি যদি মনে কর আমাদের এখান থেকে চলে যাওয়া উচিত, তাহলে আমাদের আসলেই চলে যাওয়া উচিত। তোমাদের বাবা দরকার হলে কাজ শেষ করে গ্রীষ্মের সময় আমাদের সাথে দেখা করবে।”

“আমরা কোথায় থাকব? অন্য কোন হোটেলে?” ড্যানি চোখে আশা নিয়ে তাকাল।

“সোনা, আমাদের এতদিন হোটেলে থাকার টাকা নেই। আমাদের মায়ের বাসায় থাকতে হবে।”

ড্যানির চেহারা আবার নিষ্প্রভ হয়ে গেল। “আমি জানি, কিন্তু…”

“কি?”

“কিছু না।” ও বিড়বিড় করে বলল।

“না ডক, কোন কিছু লুকিয়ে রেখ না,” ওয়েন্ডি আরেকটা মোড়কে পার করতে করতে বলল। “তোমার কি মনে হয় আমাকে সবকিছু বলতে পার। আমি কথা দিচ্ছি যে আমি রাগ করব না।”

“আমি জানি তুমি ওনাকে পছন্দ কর না।” বলে জ্যাক দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “কাকে?”

“নানুকে,” ড্যানি বলল। “ওনার কথা ভাবলে তোমার রাগ হয়, আর দুঃখ হয়। আর ভয় হয়। যেন উনি আসলে তোমার মা নন। উনি তোমার ক্ষতি চান।” ড্যানি মায়ের দিকে ভয়ার্ত চোখ তুলে তাকাল। “আর আমিও ওখানে যেতে পছন্দ করি না, আম্মু। নানু সবসময় চিন্তা করে যে আমি তোমার সাথে থাকার চেয়ে ওনার সাথে থাকলে ভাল থাকব। উনি চান তোমার কাছ থেকে আমাকে সরিয়ে নিতে। আমি ওখানে যেতে চাই না আম্মু, তার চেয়ে ওভারলুকে থাকা ভাল।”

ওয়েন্ডির প্রচণ্ড খারাপ লাগল। ওর আর ওর মায়ের মধ্যে সম্পর্ক কি আসলেই এত খারাপ? আর ড্যানি যদি আসলেই ওদের মনের কথা পড়তে পারে তাহলে ছোট্ট ছেলেটার না জানি কত কষ্ট হয়। ওয়েন্ডির হঠাৎ নিজেকে নগ্ন মনে হল, শারীরিক নগ্নতার চেয়েও বেশী নগ্ন, যেন ও চাইলেও কিছু লুকাবার ক্ষমতা ওর নেই।

“তুমি আমার ওপর রাগ করেছ,” ড্যানি মৃদু, প্রায় ধরা গলায় বলল।

“না ড্যানি, সত্যি না। আমি একটু চমকে গেছি, এই যা।” শেষ একটা মোড় পার করে ওয়েন্ডি একটু স্বস্তি পেল। এখান থেকে রাস্তা মোটামুটি সোজা।

“ড্যানি, আমি তোমার কাছ থেকে আর একটা মাত্র জিনিস জানতে চাই। তুমি কি সত্যি সত্যি জবাব দেবে?”

“হ্যা, আম্মু।”

“তোমার বাবা কি আবার মদ খাওয়া শুরু করেছে?”

“না,” ড্যানি বলল। ওর মুখ থেকে আরও দু’টো শব্দ প্রায় বেরিয়ে আসছিল, কিন্তু ও নিজেকে সংবরন করল। শব্দগুলো হচ্ছে : এখনও নয়।

ওয়েন্ডি গাড়ি চালাতে চালাতে ড্যানির পায়ের ওপর একটা হাত রাখল। “তোমার বাবার মধ্যে অনেক খুঁত হয়তো আছে, কিন্তু ও আমাদের অনেক ভালবাসে। শুধু আমাদের জন্যেই ও মদ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। আমি জানি এর জন্যে ওর অনেক কষ্ট হয়, কিন্তু ও আমাদের ভালবাসে দেখে খুব জোর দিয়ে চেষ্টা করছে যাতে ওর আবার মদ না খেতে হয়। আর আমাদের উচিত তোমার বাবার পাশে দাঁড়ানো। তাই আমি বুঝতে পারছি না যে আমাদের হোটেল ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত হবে কিনা।”

“আমি জানি।” ড্যানি বলল।

“তুমি কি আমার জন্যে একটা কাজ করতে পারবে, ডক?”

“কি?”

“টনিকে ডেকে জিজ্ঞেস কর আমাদের ওভারলুকে থাকলে কোন ক্ষতি হবে কিনা।”

“আমি চেষ্টা করেছি,” ড্যানি ম্লান গলায় বলল। “আজকে সকালেই।”

“তারপর?”

“ও আসেনি,” বলতে বলতে ড্যানি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল। “টনি আসেনি…’

“ড্যানি-না সোনা, কাঁদে না,” ওয়েন্ডি হঠাৎ ওর এ অবস্থা দেখে কি করে বুঝতে পারছিল না।

“আম্মু, আমাকে নানুর বাসায় নিয়ে যেও না, আমি ওখানে থাকতে চাই না, আমি তোমাদের সাথে থাকতে চাই!”

“আচ্ছা বাবা, ঠিক আছে।” ওয়েন্ডি পকেট থেকে একটা টিসু বের করে ড্যানির চোখ মুছিয়ে দিল।

“আমরা ওভারলুকেই থাকব।”

অধ্যায় ২৩ – হোটেলের প্লেগ্রাউন্ডে

জ্যাক পোর্চে বেরিয়ে রোদে চোখ পিটপিট করল। ওর হাতে একটা ঝোপ ছাঁটার যন্ত্র, একটা হেজ ক্লিপার। ওর বাইরের অবস্থা দেখে বিশ্বাস হচ্ছিল না যে আজকে রাতে বরফ পড়বে।

ও টপিয়ারিতে এসে দেখল যে খুব বেশী কাজ নেই। শুধু কয়েকটা পশুপাখি সাইজে একটু বড় হয়ে গেছে, ওগুলোকে ছেঁটে ঠিক করলেই হবে।

ও খরগোশটার কাছে যেয়ে ক্লিপারের বোতাম টিপল। একটা মৃদু গুঞ্জন করে যন্ত্রটা চালু হয়ে গেল।

জ্যাকের এই টপিয়ারি জিনিসটা কখনওই তেমন পছন্দ ছিল না। একটা ঝোপকে এভাবে বিকৃত করা ওর কাছে প্রকৃতিবিরুদ্ধ কাজ বলে মনে হয়।

ও মাথা ঝাঁকিয়ে চিন্তাটা দূর করে দিল। এসব নিয়ে এত মাথা না ঘামানোই ভালো।

ও আবার আকাশের দিকে তাকাল। রোদ থাকলেও আবহাওয়া একদমই গরম নয়। এখন বোঝা যাচ্ছে যে রাতে বরফ পড়তে পারে।

ক্লিপারটা হাতে নিয়ে ও কাজ শুরু করল। এধরনের কাজ দ্রুত করতে হয়, যত আস্তে করবে ততই ভুল হবার সম্ভাবনা থাকে। ও প্রথমে খরগোশের পেটটা একটু কমালো, তারপর ক্লিপার চালাল ওটার মুখে। যদিও জিনিসটা ঠিক মুখ নয়, কিন্তু দূর থেকে দেখলে আলো-ছায়ার খেলা আর দর্শকের কল্পনা মিলিয়ে একটা চেহারার রুপ ধারণ করে।

কাজ শেষ করে ও একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখল সব ঠিক আছে কিনা। ঠিকই আছে।

“হোটেলটা আমার হলে তোদের সবগুলোকেই কেটে সাফ করে দিতাম।” জ্যাক বলল।

হোটেলটা ওর হলে জ্যাক পুরো টপিয়ারি সাফ করে এখানে কয়েকটা টেবিল বসিয়ে দিত, যাতে বিকালে এখানে বসে হোটেলের অতিথিরা চা খেতে খেতে গল্প করতে পারে।

ও আবার শুরু করতে যাচ্ছিল, কিন্তু কি মনে করে যেন ও টপিয়ারিতে না গিয়ে প্লেগ্রাউন্ডে এল। বাচ্চাদের মন আসলে কখনওই বোঝা যায় না, জ্যাক মনে মনে বলল। ও আর ওয়েন্ডি ভেবেছিল এই খেলার জায়গাটা ড্যানির খুব পছন্দ হবে, কিন্তু ড্যানি এখানে একবারও এসেছে কিনা সন্দেহ

ও হাঁটতে হাঁটতে ওভারলুকের মডেলটার কাছে এল। সামনের দিকটা ধরে টান দিতেই পুরো মডেলটা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। ভেতরটা তেমন সুন্দর নয়। রঙ করা, কিন্তু কোন ডিজাইন নেই। একদম ফাঁপা। ও আবার সামনের অংশটা জোড়া লাগিয়ে দিল।

ও প্লেগ্রাউন্ডের অন্য জিনিসগুলোও ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগল। ওর নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল, যখন ওর বাবা ওকে নিয়ে পার্কে যেত। বাবা ওর ভাইদের চেয়ে ওকেই বেশী পছন্দ করত, কিন্তু তার মানে এই নয় যে সে মাতাল হবার পর জ্যাকের তার হাতে মার খেতে হয় নি।

জ্যাক যখন স্লিপারটা ঘুরে ঘুরে দেখছিল তখন শব্দটা প্রথম ওর কানে এল।

ও ঝট করে পেছন ফিরে তাকাল, কিন্তু কোন কিছু দেখে অস্বাভাবিক মনে হল না। প্লেগ্রাউন্ড থেকে শুরু করে রোকে কোর্ট পর্যন্ত সবই ও আগে যেমন দেখেছিল তেমনই আছে। কিন্তু তাহলে ওর ঘাড়ের পেছন দিকটা শিরশির করছে কেন?

ও চোখ তুলে হোটেলের দিকে তাকাল, কিন্তু হোটেলের তরফ থেকে কোন উত্তর এল না।

এসব নিয়ে এত মাথা না ঘামানোই ভাল।

জ্যাক ঠিক করল ও কাজ শেষ করবে। ও আবার টপিয়ারির দিকে হাঁটতে শুরু করল। ওর অস্বস্তিটা এখনও যাচ্ছে না।

টপিয়ারিতে এসে ও আবার থমকে দাঁড়াল। এখানেই কিছু একটা ভুল মনে হচ্ছে। কি-কি-কি…

(ওই যে)

খরগোশটা চার পায়ের ওপর ভর দিয়ে মাটিতে বসে আছে। পেটটা ঘসা খাচ্ছে মাটির সাথে। কিন্তু জ্যাক না একটু আগেই ওটার পেট ছেঁটে ছোট করে দিল?

ও কুকুরটার দিকে তাকাল। আসবার সময় কুকুরটা দুই পা বাতাসে তুলে খাবার চাবার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল, কিন্তু এখন ওটাও চার পায়ের ওপর ভর দিয়ে বসে আছে, ঠোঁটের কাছটা যেন গজর্নের ভঙ্গিতে একটু বাঁকানো।

আর সিংহগুলো? সিংহগুলো রাস্তার আরও কাছে চলে এসেছে। ওরা এখন আর রাস্তার দু’পাশে দাঁড়িয়ে নেই, ওরা রাস্তার প্রায় মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে।

জ্যাক নিজের চোখের ওপর একটা হাত রেখে আবার হঠাৎ করে সরিয়ে নিল। কাজ হল না। পশুগুলো এখনও তেমনি আছে। ওর মুখ থেকে একটা ছোট্ট শব্দ বেরিয়ে এল, গোঙ্গানীর মত।

মাতাল অবস্থায় এমন জিনিস জ্যাক অনেক দেখেছে, কিন্তু স্বাভাবিক অবস্থায় এই প্রথম।

জ্যাক লক্ষ্য করল যে ও যখন চোখের ওপর হাত রেখেছিল তার মধ্যে কিছু সুক্ষ্য পরিবর্তন ঘটেছে। কুকুরটা আরও এগিয়ে এসেছে মনে হচ্ছে, ওটাঁর হাঁ আরেকটু চওড়া হয়েছে। কুকুরটার মুখের ভেতরের তীক্ষ্ণ ডালপালাগুলো প্রথম দেখায় দাঁত বলে ভুল হয়। ওটার মাথা আরও নীচু হয়ে গেছে। ঝাঁপ দেবার আগের ভঙ্গি।

আরেকটা শব্দ।

জ্যাক এক ঝটকায় ঘুরে দেখতে পেল যে একটা সিংহ আরেক কদম এগিয়ে এসেছে। এটার মাথাও নীচু, প্রায় মাটির সাথে লেগে আছে।

আবার পেছনে শব্দ।

কোন সন্দেহ নেই, কুকুরটা আরও এক কদম এগিয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ আগেও যেটা একটা ঝোপ ছাড়া আর কিছু ছিল না, দশ ফিট দূর থেকে না দেখলে বোঝাও যেত না যে এটা একটা কুকুরের আকৃতিতে কাটা, এখন পরিষ্কার কুকুরের রূপ ধারণ করেছে। কোন জাতির কুকুর জ্যাক সেটাও আন্দাজ করতে পারছে : জার্মান শেফার্ড। ভয়ংকর, শিকারী কুকুর।

পেছনে আরও কয়েকটা শব্দ শুনে জ্যাক আস্তে আস্তে ঘাড় ঘোরাল। ষাঁড়টাও নিজের জায়গা থেকে নেমে এসেছে। মাথা নীচু, ধারালো শিংগুলো ওর দিকে তাক করা। সিংহটা আরও এক পা এগিয়ে এসেছে।

(না, না, না, না-এটা হতে পারে না, অসম্ভব, অসম্ভব )

জ্যাক দুই হাত দিয়ে নিজের চোখ ঢেকে মাটিতে বসে পড়ল। ওর মাথা দপদপ করছিল। কান দু’টো এত গরম হয়ে গিয়েছে যে মনে হচ্ছে ধোঁয়া বের হবে। ওর কাঁদতে ইচ্ছা করছিল।

ও চোখ থেকে হাত সরাল।

কুকুরটা বেশ দূরে, সামনের দুই পা বাতাসে তোলা, যেন খাবার চাচ্ছে। ষাঁড়টা মাথা নীচু করে ঘাস খাবার ভঙ্গিতে দাঁড়ানো। সিংহগুলো রাস্তার দুইপাশে দাঁড়িয়ে রাস্তাটাকে পাহারা দিচ্ছে। আর খরগোশটার পেট আবার দেখা যাচ্ছে, সুন্দর করে ছাঁটা।

জ্যাক অনেকক্ষণ নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। যখন ও পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা বের করতে গেল তখন এর হাত থেকে পড়ে মাটিতে সিগারেট ছড়িয়ে গেল। ও বসে যখন হাতড়ে সিগারেটগুলো প্যাকেটে ভরছিল তখনও ও পশুগুলো থেকে চোখ সরাবার সাহস পাচ্ছিল না। অবশেষে ও কোনমতে সিগারেটগুলো প্যাকেটে ভরে একটা কাঁপা কাঁপা হাতে নিজের ঠোঁটে ছোঁয়াল!

ও হেজ ক্লিপারটা হাতে নিয়ে জোরে জোরে বলল, “আমি নিশ্চয়ই অনেক ক্লান্ত।” নিজের গলা শুনে ওর একটু ভাল লাগল, যেন ও আস্তে আস্তে বাস্তবে ফিরে আসছে। “এতদিনের দৌড়াদৌড়ি আর টেনশন… বোলতা… সবকিছু মিলিয়ে আমার মাথার ওপর চাপ ফেলছে।”

ও আস্তে আস্তে হেঁটে হোটেলে ফিরে গেল। যাবার সময় ও কমপক্ষে পাঁচবার পেছন ফিরে দেখল সবকিছু ঠিক আছে কিনা। হোটেলে ঢুকে ও নিজের রুমে গিয়ে একমুঠো মাথাব্যাথার ওষুধ মুখে ফেলল। তারপর বসে বসে নিজেকে বোঝাতে লাগল যে ও এতক্ষণ যা দেখেছে সেসব একটা ক্লান্ত মস্তিষ্কের কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।

অনেকক্ষণ পর ও হোটেলের উঠানে ট্রাক ঢোকার আওয়াজ শুনতে পেল। ও উঠে নিজের বৌ আর ছেলের সাথে দেখা করতে গেল। এখন ও সুস্থ বোধ করছে। ড্যানি আর ওয়েন্ডিকে আজকের ঘটনাটা বলে শুধু শুধু ভয় দেখাবার কোন মানে হয় না।

অধ্যায় ২৪ – তুষার

সন্ধ্যাবেলা।

জ্যাক ওয়েন্ডির কোমড়ে একটা হাত জড়িয়ে পোর্চে দাঁড়িয়ে আছে। ওর আরেকটা হাত ড্যানির কাঁধে রাখা। ওরা সবাই মিলে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

আকাশজুড়ে গম্ভীর, কাল মেঘ সন্দেহের আর কোন অবকাশ রাখেনি। রেডিওর ভবিষ্যদ্বাণী ঠিক হতে চলেছে।

আজ থেকে তুষারপাত শুরু। আর এটা কোন হ.কা, মৌসুমি তুষারপাত নয়। আজকে থেকে প্রায় প্রতি রাতে বরফ পড়বে, মাঝে মাঝে দিনেও। এক থেকে দুই দিনের মধ্যে পাহাড় থেকে নামার সব রাস্তা ডুবে যাবে বরফে। সমস্ত গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যাবে।

আকাশে ঝড়ের আগমন দেখে ওরা তিনজন একই জিনিস অনুভব করল : স্বস্তি।

হোটেলে থাকবে না চলে যাবে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা এখন ওদের আর নিতে হবে না।

ওয়েন্ডি জিজ্ঞেস করল: “আর কখনও কি গ্রীষ্ম আসবে?”

জ্যাক ওকে আরেকটু কাছে টেনে আনল। “দেখতে দেখতেই এসে পড়বে। চল ভেতরে যেয়ে খেয়ে নেই, এখানে ঠাণ্ডা লাগছে।”

ওয়েন্ডি ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। ওরা ফিরে আসার পর থেকে জ্যাককে কেমন যেন অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল। এখন ও আবার স্বাভাবিক হয়েছে।

ওরা তিনজন ভেতরে চলে গেল। বাইরে থেকে দেখে মনে হচ্ছিল না হোটেলটার ঠাণ্ডায় কোন অসুবিধা হচ্ছে। নীরব, অন্ধকার একটা আকৃতির মত ওভারলুক দাঁড়িয়ে রইল মেঘে ঢাকা আকাশের নীচে। আর ভেতরে টরেন্স পরিবারের নড়াচড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছিল, যেভাবে একটা প্রকান্ড সাপ শিকার গিলে ফেলার পরও কিছুক্ষণ তার ভেতর নড়াচড়া দেখা যায়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *