অধ্যায় ১৫ – হোটেলের সামনে
জ্যাক কিছুদিন আগে স্টোররুমে একটা বিশালাকৃতির সাদা রঙের বেতের চেয়ার খুঁজে পায়। তারপর ওয়েন্ডির প্রবল প্রতিবাদ উপেক্ষা করে ও চেয়ারটাকে হোটেলের সামনের পোর্চে এনে রাখে। এখন জ্যাক চেয়ারটায় বসে বসে একটা উপন্যাস পড়ছিল, যখন ওয়েন্ডিদের নিয়ে হোটেলের ট্রাকটা আবিভূর্ত হল।
ওয়েন্ডি ট্রাকটা পোর্চের একটু দূরে এনে ইঞ্জিন বন্ধ করল। জ্যাক হাসিমুখে এগিয়ে গেল ওদের দিকে।
“বাবা!” ড্যানি ছুটে এল ওর দিকে। ওর হাতে একটা বক্স। “দেখো আম্মু আমাকে কি কিনে দিয়েছে!” জ্যাক ওকে কোলে নিয়ে ওর গালে চুমু খেল।
ওর পিছে পিছে ওয়েন্ডিও গাড়ি থেকে বের হল। “আরে, বিশ্ববিখ্যাত, নোবেল বিজয়ী লেখক জ্যাক টরেল! আপনাকে এই পাহাড়ের ওপর দেখব ভাবতেই পারি নি।”
“শহরের কোলাহল আর কয়দিন ভালো লাগে বলুন?” জ্যাক এসে ওকেও চুমু দিল। “তোমাদের সফর কেমন গেল?”
“চমৎকার। যদিও ড্যানি অভিযোগ করেছে যে আমি অনেক আস্তে গাড়ি চালাচ্ছিলাম, কিন্তু এরকম রাস্তায় সাবধান থাকাই ভালো…বাহ্ জ্যাক, তুমি তাহলে কাজটা শেষ করেছ!”
ওয়েন্ডির দৃষ্টি অনুসরণ করে ড্যানিও ছাদের দিকে তাকাল। নতুন টালিগুলো দেখে ওর এক সেকেন্ডের জন্যে টনির দেখানো স্বপ্নটার কথা মনে পড়ে গেল। কিন্তু এখন, দিনের আলোয়, ওর আর ভয় লাগল না। ওর হাতের বক্সটার দিকে তাকিয়ে জাবার মুখে হাসি ফুটে উঠল।
“দেখো, বাবা, দেখো!”
জ্যাক ছেলের হাত থেকে বক্সটা নিল। ভেতরে ছিল একটা খেলনা, প্লাস্টিকের বিভিন্ন অংশ যেগুলো জুড়লে একটা গাড়ি তৈরি হয়। বক্সটার গায়ে নানারকম রঙচঙ্গে ছবি আঁকা, যেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড়টা হচ্ছে একটা কার্টুন ভূত, যেটার লম্বা নখগুলো গাড়ির দুই জানালা দিয়ে বেরিয়ে আছে।
ওয়েন্ডি ওদের দিকে তাকিয়ে হাসছিল। জ্যাক ওর দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল।
“এজন্যেই আমি তোকে এত ভালোবাসি, ডক। তুই সুক্ষ, শৈল্পিক আর সুরুচিপূর্ণ জিনিস পছন্দ করিস, ঠিক আমার মত।”
“আম্মু বলেছে যে আমার নতুন পড়ার বইটা শেষ করলে তুমি আমাকে গাড়িটা বানাতে সাহায্য করবে।”
“ঠিক আছে, কোন অসুবিধা নেই।” বলে জ্যাক ওয়েন্ডির দিকে ফিরল। “আমার জন্যে কিছু আনেন নি, ম্যাডাম?”
ওয়েন্ডি চোখে কৃত্রিম রাগ নিয়ে জ্যাকে দিকে তাকাল। “এই, ওগুলো দেখবার কথা চিন্তাও করবে না। এখন তোমার কাজ হচ্ছে দুধের গ্যালনগুলো ভেতরে নিয়ে যাওয়া। ওগুলো ট্রাকের পেছনে রাখা আছে।”
“আমাকে তো তোমরা কুলি ছাড়া কিছুই মনে কর না!” জ্যাক কাঁদো কাঁদো গলায় নিজের কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বলল। “শুধু এটা নিয়ে যাও, ওটা নিয়ে যাও, হুকুম আর হুকুম!”
“বেশী কথা না বলে ভেতরে যাও বলছি!”
“এত কষ্ট আমার আর সহ্য হয় না!” বলে জ্যাক মাটিতে শুয়ে পড়ল। ড্যানি খিলখিল করে হেসে উঠল।
ওয়েন্ডি পা দিয়ে ওকে খোঁচা দিল। “হয়েছে, আর নাটক করতে হবে না, ভাঁড় কোথাকার!”
“দেখেছিস? আমাকে ভাঁড় বলে গালি দিল! তুই সাক্ষী, ডক!”
“সাক্ষী, সাক্ষী!” ড্যানি উচ্চস্বরে বাবার সাথে একমত হয়ে লাফিয়ে জ্যাকের পিঠে উঠে পড়ল।
“ও, ভুলেই গিয়েছিলাম,” জ্যাক বলল। “আমিও তোর জন্যে একটা জিনিস এনেছি, ডক।”
“কি, বাবা?”
“বলব না। টেবিলে রাখা আছে, যেয়ে দেখ।”
ড্যানি ওর পিঠ থেকে নেমে ছুটে ভেতরে চলে গেল।
জ্যাক উঠে ওয়েন্ডির পাশে দাঁড়িয়ে এক হাতে ওর কোমড় জড়িয়ে ধরল। “তুমি কি খুশি, জান?”
ওয়েন্ডি গম্ভীরমুখে জবাব দিল, “আমরা বিয়ে করবার পর আর এত খুশি আমি কখনও হইনি।”
“সত্যি?”
“কসম।”
জ্যাক ওকে জড়িয়ে ধরল। “আই লাভ ইউ।”
ওয়েন্ডিও ওকে জড়িয়ে ধরল। ও জানে যে এই শব্দগুলো কখনও জ্যাক হেলাফেলা করে বলে না। ওদের বিয়ের পর জ্যাক ওকে কতবার আই লাভ ইউ বলেছে সেটা হাতে গোনা যাবে।
“আই লাভ ইউ টু।”
“আম্মু! আম্মু!” ভেতর থেকে ড্যানির উত্তেজিত গলা শোনা গেল। “এসে দেখে যাও! জিনিসটা দারুণ!”
“কি দিয়েছ?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল।
“বলব না।”
“তোমাকে মজা দেখাব, শয়তান।”
“আজকে রাতেই তোমাকে মজা দেখাবার সুযোগ দেব।” জ্যাকের কথা শুনে ওয়েন্ডি হেসে ফেলল।
জ্যাক ওকে জিজ্ঞেস করল, “ড্যানি কি খুশি? তোমার কি মনে হয়?”
“সেটা তো তোমার ভালো জানার কথা। প্রতিদিন রাতে ও ঘুমাবার আগে ওর সাথে আধাঘণ্টা করে গল্প কর তুমি।”
“আমাদের বেশীরভাগ সময় কথা হয় ও বড় হয়ে কি হতে চায় সেটা নিয়ে অথবা সান্টা ক্লজ কি আসলেই আছে কিনা এসব ব্যাপারে। ওভারলুক নিয়ে ও কিছু বলে নি।”
“আমাকেও না,” ওয়েন্ডি পোর্চের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে উঠতে বলল। “ও কিন্তু এখন আগের চেয়েও বেশী চুপচাপ হয়ে গেছে তাই না? ওর ওজনও মনে হল একটু কমেছে।”
“ও কিছু না। আগের চেয়ে লম্বা হয়েছে বলে এখন ওকে শুকনো দেখায়।”
ওয়েন্ডি দেখতে পেল যে ড্যানি জ্যাকের চেয়ারের পাশে রাখা টেবিলটায় মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছে। ড্যানি সামনে থাকায় জিনিসটা কি ও বুঝতে পারছিল না।
“জ্যাক, ও কিন্তু এখন খাওয়াও কমিয়ে দিয়েছে। আগে ওকে প্লেট ভরে খাবার দিতে হত, এখন প্রায় তার অর্ধেক খায়।”
“ছোটবেলায় বাচ্চারা এমনিতেই একটু বেশী খায়,” জ্যাক অন্যমনস্কভাবে জবাব দিল। “আমার মনে হয় না চিন্তার কিছু আছে।”
“তাছাড়া ও এখন পড়ার বইগুলো নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকে। ও খুব কষ্ট করছে আমাদের খুশি করবার…” ওয়েল্ডি অনিচ্ছাস্বত্বেও যোগ করল, “তোমাকে খুশি করবার জন্যে।”
“আমি কিন্তু ওকে কোনরকম চাপ দেই নি। সত্যি কথা বলতে, আমার এটা পছন্দ নয় যে ও এত সময় ধরে বই নিয়ে বসে থাকে।”
“আমি যদি ওকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই তুমি কি রাগ করবে? আজকে শহরে দেখলাম একজন বেশ ভালো ডাক্তার আছে…”
“তুমি এই শীতের সময়টা নিয়ে বেশ চিন্তিত, তাই না?”
ওয়েন্ডি কাঁধ ঝাঁকাল, “যদি তোমার মনে হয় আমি অকারণে দুশ্চিন্তা করছি…”
“না, আমি তা মনে করি না। এক কাজ কর, চল আমরা তিনজনই একবার ডাক্তারের সাথে দেখা করে আসি। শীত শুরু হবার আগে নিশ্চিত করা ভালো যে আমরা সবাই সুস্থ আছি।”
“বেশ, আমি আজকে বিকালে ডাক্তারকে ফোন দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে নেব।”
“আম্মু, দেখো!”
ড্যানি হাতে একটা ধূসর বস্তু নিয়ে ওয়েন্ডির দিকে ছুটে এল। এক সেকেন্ডের জন্যে ওয়েন্ডির মনে হল ওটা একটা মগজ, তারপর জিনিসটা কি বুঝতে পেরে ও সিঁটিয়ে গেল।
“জ্যাক, তুমি কি শিওর যে ওটা নিরাপদ?”
“কোন সন্দেহ নেই,” জ্যাক জবাব দিল। “আমি বাগ বম্ব দিয়ে সব বোলতা মেরে ফেলেছি। তারপর ঝাঁকিয়ে চাকটাকে খালি করেছি।”
“কিন্তু পোকা মারার ওষুধের কারণে যদি ড্যানির কোন ক্ষতি হয়…?”
“কিছু হবে না। ছোটবেলায় এরকম একটা আমার নিজের কাছেই ছিল। ড্যানি,তুই কি নিজের রুমে চাকটা ঝুলিয়ে রাখতে চাস?”
“হ্যা বাবা, এক্ষণি!”
বলে ও দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় নিজের ঘরে চলে গেল।
ওর পায়ের আওয়াজ মিলিয়ে যাবার পর ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল, “তুমি কি বোলতার কামড় খেয়েছ?”
জ্যাক নিজের ফোলা আঙুলটা ওর চোখের সামনে তুলে ধরল। “আমাকে বীরত্বের পদক দেয়া উচিত, তাই না?”
ওয়েন্ডি আঙুলটায় একটা ছোট্ট চুমু খেয়ে আদর করে দিল।
“জ্যাক, ড্যানির কোন ক্ষতি হবে না তো?”
“আমি বাগ বম্বের গায়ে লেখা ব্যাবহারের নিয়মগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। ওদের দাবী হচ্ছে যে ওষুধটা সব পোকাকে মেরে দু’ঘণ্টার মধ্যে মিলিয়ে যায়।”
“আমি এসব জিনিসকে খুব ভয় পাই।” বলে ওয়েন্ডি নিজের কনুইদু’টো জড়িয়ে ধরল।
“কি, বোলতা?”
“হুল ফোটায় এমন যেকোন কিছু।”
একটা হাত দিয়ে জ্যাক ওকে পেঁচিয়ে ধরল। “আমিও।”
অধ্যায় ১৬ – ড্যানি
ওয়েন্ডি জ্যাকের টাইপরাইটারের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছিল। ত্রিশ সেকেন্ডের জন্যে মেশিনগানের গুলির মত দ্রুত টাইপিং এর শব্দ, তারপর এক-দুই মিনিটের বিরতি, তারপর আবার গুলি শুরু। ওয়েন্ডির কানে এই শব্দটা মধুবর্ষণ করে। জ্যাক ওকে বলেছে যে নাটকটা জনপ্রিয় হোক বা না হোক তা নিয়ে ওর বিশেষ মাথাব্যাথা নেই, শেষ করা দিয়ে কথা। ওয়েন্ডি এ কথাটার তাৎপর্য বুঝতে পেরেছিল। জ্যাক অনেকদিন ধরে কিছু সমস্যার সাথে লড়াই করছে। এসব ঝামেলার কারণে ওর অনেকদিন যাবত কিছু লেখা হয় না। দ্যা লিটল স্কুল শেষ করবার মাধ্যমে জ্যাক নিজের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে চায়।
আর এখন জ্যাক প্রত্যেকটা পাতা শেষ করবার সাথে সাথে ওয়েন্ডির মন খুশিতে ভরে ওঠে।
এদিকে ড্যানি নিজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত। জ্যাক ওর জন্যে কয়েকটা বই নিয়ে এসেছে, যেগুলো শেষ করতে পারলে ড্যানির শিক্ষা ক্লাস টুয়ে পড়া একটা বাচ্চার সমান হয়ে যাবে। ওয়েন্ডির এ ব্যাপারটা প্রথমে তেমন পছন্দ হয় নি, ওর মনে হয়েছিল যে ড্যানির মত ছোট্ট ছেলের জন্যে এটা অনেক বেশী হয়ে যায়। জ্যাক ওর সাথে একমত হয় এ ব্যাপারটায়, আর বলে যে ওরা ড্যানিকে ঠেলবে না, কিন্তু ও যদি নিজে থেকে শিখতে চায়, তাহলে সমস্যা কোথায়?
আর ড্যানির শেখার আগ্রহ আছে বটে। ও আগেই টিভিতে শিশু শিক্ষা অনুষ্ঠানগুলোর ভক্ত ছিল, যেটা ওর এখন কাজে লাগছে। ও দুরন্ত গতিতে একটার পর একটা বই শেষ করে চলেছে।
ওয়েন্ডির এটা নিয়েও দুশ্চিন্তা হয়। ড্যানি এমনভাবে পড়ে যেন ওর জীবনমরণ এটার ওপর নির্ভর করছে। এখন ওয়েন্ডি দেখতে পাচ্ছিল যে ওর ছেলের মুখ টেবিলল্যাম্পের আলোতে গম্ভীর আর ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে। ও গভীর মনোযোগ দিয়ে জ্যাক ওর জন্যে যে প্রশ্নগুলো তৈরি করে দিয়েছে সেগুলোর উত্তর দেবার চেষ্টা করছে।
প্রশ্নগুলোতে একপাশে থাকে সারিবদ্ধভাবে বেশ কিছু জিনিসের ছবি, আর অন্যপাশে এলোমেলো করে ছড়ানো অবস্থায় জিনিসগুলোর নাম। নামের সাথে ছবি মেলানো হচ্ছে ড্যানির কাজ। ড্যানি সেটা ভালোই পারে। ও এই প্রশ্নগুলোর সমাধান করতে করতে প্রায় তিন ডজন শব্দ পড়তে শিখে ফেলেছে। এখন ও এক হাতে পেন্সিল আঁকড়ে ভ্রু কুঁচকিয়ে নতুন একটা শব্দ পড়বার চেষ্টা করছিল।
ও নিজের মুখ লেখাটার একেবারে কাছে নিয়ে গেল। ওর বোধহয় লেখাটা পড়তে কষ্ট হচ্ছিল।
“এত কাছ থেকে পড়তে হয় না ড,” ওয়েন্ডি আস্তে করে বলল। “তোমার চোখ খারাপ হয়ে যাবে। দেখি, কি পড়তে পারছো না…”
“না না, আমাকে বলে দিও না!” ড্যানি চেঁচিয়ে উঠল। “বলে দিও না আম্মু, আমি নিজেই পারব।”
“ঠিক আছে সোনা,” ওয়েন্ডি বলল। “কিন্তু বেশী মাথা গরম কোর না। না পারলে কোন অসুবিধা নেই।”
ও খেয়াল করল যে ড্যানির চেহারায় যে চিন্তার ছাপ পড়েছে সেটা খুব কঠিন কোন পরীক্ষা দিতে গেলে বড়দের মুখে পড়ে। ওর জিনিসটা মোটেও ভালো লাগল না।
“ব…অ…ল, কি…? বল!” ড্যানি বিজয়ী, অহংকারী গলায় চেঁচিয়ে উঠল। ওর গলায় অহংকারের ছোঁয়া শুনে ওয়েন্ডি চমকে উঠল।
“ঠিক,” ওয়েন্ডি বলল। “আজকে রাতের মত এটুকুই, ডক।”
“আর একটু আম্মু? প্লিজ?”
“না ডক,” ওয়েন্ডি এসে বই খাতা সব তুলে রাখতে শুরু করল। “ঘুমনোর সময় হয়ে গিয়েছে।”
“প্লিজ?”
“না ড্যানি, আমার ঘুম ধরে গিয়েছে।”
“আচ্ছা,” ও মুখে বললেও আবার ওর চোখ চলে গেল বইগুলোর দিকে। “যাও, শোবার আগে বাবাকে গুডনাইট বলে আসো। দাঁত ব্রাশ করতে ভুলে যেও না।”
ও হেঁটে বেরিয়ে গেল।
এক মুহূর্ত পরই ওয়েন্ডি শুনতে পেল পাশের রুমে ড্যানি জ্যাককে চুমু দিচ্ছে। “গুডনাইট, বাবা।”
জ্যাকের টাইপিং থেমে গেল। “গুডনাইট ডক। পড়া কেমন হল?”
“ভালো। আম্মু বন্ধ করে দিয়েছে।”
“ভালো করেছে। রাত সাড়ে আটটা বাজে। তোর ঘুমাবার সময় হয়ে গিয়েছে। তুই কি বাথরুমে যাচ্ছিস?”
“হ্যা।”
“ভালো। তোর চুল তো পাখির বাসা হয়ে গেছে। আরে, আমি তো একটা ডিমও দেখতে পাচ্ছি! সবর্নাশ…”
ড্যানির খিলখিল হাসি শোনা গেল, তারপর ক্লিক করে বাথরুমের দরজা লাগাবার শব্দ। ড্যানি চায় না যে ও বাথরুমে থাকবার সময় বাবা মা ওকে দেখুক। এদিক দিয়ে ও হয়েছে জ্যাক আর ওয়েন্ডির উলটো। ওরা বাসা খালি থাকলে প্রায়ই বাথরুমের দরজা লাগাতে ভুলে যায়। ড্যানির এই ছোট ছোট পার্থক্যগুলো দেখলে বোঝা যায় ও ওর বাবা মা’র প্রতিবিম্ব নয়, বা ওদের দু’জনের স্বভাবের সমষ্টিতে ড্যানির স্বভাব সৃষ্টি হয় নি। ওয়েন্ডির ভেবে মন খারাপ হয়ে গেল যে একদিন, ড্যানি বড় হয়ে গেলে, ওর আর ড্যানির মধ্যে দুরত্ব এসে পড়বে। কিন্তু এত দুরত্ব যেন কখনওই না আসে যতটা ওয়েন্ডি আর ওর মায়ের মধ্যে এসেছে। হে ঈশ্বর, এত দূরত্ব যেন ওর আর ড্যানির মাঝে কখনও না আসে।
ওয়েন্ডি ড্যানির রুমে চোখ বুলালো। একটা বাচ্চার রুমে সাধারণত যা যা দেখা যায় তার প্রায় সবই এখানে আছে। রঙ করার খাতা, ছেঁড়া কমিকস্, আর পুরনো খেলনা ঘরের বিভিন্ন জায়গায় স্তূপ করে রাখা। ওয়েন্ডি ওকে যে নতুন গাড়িটা কিনে দিয়েছে সেটা যত্ন করে অন্য খেলনাগুলো থেকে একটু দূরে, শেলফের ওপর তুলে রাখা। এখনও ওটার প্যাকেট খোলা হয় নি। দেয়ালে কয়েকটা কার্টুন চরিত্রের পোস্টার লাগানো। কয়েকদিন পরই এই কার্টুনগুলোর জায়গা নিয়ে নেবে সিনেমার নায়ক আর ব্যান্ডের গায়করা, ওয়েন্ডি ভাবল। ওর এখনই এটা চিন্তা করলে মন খারাপ হয়ে যায় যে ড্যানি যখন স্কুলে ভর্তি হবে তখন ওর ড্যানিকে ড্যানির বন্ধুদের সাথে ভাগাভাগি করতে হবে। ওর স্টভিংটনে থাকতে, যখন ওদের অবস্থা ভালো ছিল, তখন জ্যাক আর ও দু’জনেই চেয়েছিল আর একটা বাচ্চা নিতে। এখন অবশ্য ওয়েন্ডি আবার নিয়মিত পিল খেতে শুরু করেছে। ওদের যে অবস্থা, নয় মাস পর ওরা কোথায় থাকবে কে জানে।
ওয়েন্ডির চোখ বোলতার চাকটার ওপর যেয়ে থামল।
ড্যানির রুমের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গাটা দখল করে আছে জিনিসটা, ওর বিছানার পাশে, একটা টেবিলের ওপর প্লাস্টিকের প্লেটে। এখনও চাকটা দেখে ওয়েন্ডির অস্বস্তি লাগছিল। একদল পোকার লালা আর বিষ্ঠা দিয়ে তৈরি একটা জিনিস ওর ছেলের মাথার কাছে থাকবে সেটা ওর মানতে অসুবিধা হচ্ছে। ও একবার ভাবল যে জ্যাককে জিজ্ঞেস করবে চাকটায় জীবাণু থাকতে পারে কিনা, পরে ও ভাবল যে জ্যাক ওর ওপর হাসবে। তারচেয়ে ও আগামীকাল ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করে দেখবে, যদি জ্যাক রুমে না থাকে।
বাথরুমের ভেতর থেকে তখনও কল থেকে পানি পড়বার শব্দ ভেসে আসছিল। ওয়েন্ডি উঠে বেডরুমে গেল সবকিছু ঠিক আছে কিনা দেখবার জন্যে। জ্যাক নিজের টাইপরাইটার থেকে মুখ তুলল না। ও নিজের জগত নিয়ে ব্যস্ত।
ওয়েন্ডি বাথরুমের দরজায় হালকা করে টোকা দিল, “ডক, সব ঠিক আছে তো?”
কোন উত্তর নেই।
“ড্যানি?”
এবারও কোন উত্তর এল না। ওয়েন্ডি দরজার খুলবার চেষ্টা করল। লক করা।
“ড্যানি?” ওয়েন্ডির এখন দুশ্চিন্তা শুরু হয়ে গিয়েছে। এখনও কল থেকে পানি পড়ার শব্দ ভেসে আসছিল। “ড্যানি, দরজা খোল, সোনা।”
কোন উত্তর নেই।
“উফ্ ওয়েন্ডি,তুমি সারারাত দরজা ধাক্কাতে থাকলে আমি লেখব কিভাবে?”
“ড্যানি কোন কথা বলছে না, বাথরুমের দরজা লক করে রেখেছে!” জ্যাক গোমড়া মুখে ডেস্ক থেকে উঠে এল। ও দরজায় জোরে টোকা দিল। “বেরিয়ে আয়, ডক। এখন এসব খেলার সময় নয়।”
কোন উত্তর নেই।
জ্যাক আরও জোরে দরজা ধাক্কাল। “বেরিয়ে আয় ডক, এসব দুষ্টুমি আমার মোটেও পছন্দ নয়। বেরিয়ে না এলে তোর কপালে মার আছে।”
ওর মেজাজ খারাপ হচ্ছে দেখে ওয়েন্ডি আরও ঘাবড়ে গেল। হাত ভাঙ্গার ঘটনাটার পর থেকে জ্যাক আর একবারও ড্যানির গায়ে হাত তোলেনি, কিন্তু এখন ওকে দেখে মনে হচ্ছিল ও ড্যানিকে আসলেই মারবে।
“ড্যানি, আমার যদি এই দরজাটা ভাঙতে হয় তাহলে তোর চামড়া তুলে ফেলব।”
এখনও সব চুপচাপ।
“ভেঙ্গে ফেলো,” ওয়েন্ডি বলল। ওর কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল। “এখনই।”
জ্যাকের এক প্রচণ্ড লাথিতে পুরনো দরজাটা পাল্লা থেকে ছুটে এল। ভেতরে তাকিয়ে ওয়েন্ডি চেঁচিয়ে উঠল,
“ড্যানি!”
বেসিনের কল থেকে এখনও পানি পড়ছে। ড্যানি বাথটাবের একটা কোণায় বসা, ওর এক হাতে টুথব্রাশ শক্ত করে আঁকড়ানো আর ওর মুখ থেকে এখনও পেস্টের ফেনা গড়িয়ে পড়ছে। ও স্থির দৃষ্টিতে বেসিনের ওপরের আয়নাটার দিকে তাকিয়ে আছে, চেহারায় আতংকিত অভিব্যাক্তি। ওয়েন্ডির মাথায় প্রথম যে চিন্তাটা এল সেটা হচ্ছে ড্যানিকে হয়তো কোন ধরণের মৃগী রোগে ধরেছে, ওর জিভ গলায় আটকে গিয়েছে।
“ড্যানি!”
ড্যানি কোন উত্তর দিল না। ওর গলা থেকে ঘড়ঘড় শব্দ বেরিয়ে এল।
জ্যাক ওয়েন্ডিকে সরাবার জন্যে এত জন্যে এত জোরে ধাক্কা দিল যে ও প্রায় আছড়ে পড়ল দেয়ালের ওপর। জ্যাক যেয়ে ড্যানির পাশে বসল।
“ড্যানি,” ও ডেকে ড্যানির চোখের সামনে আঙুল নিয়ে কয়েকবার তুড়ি বাজাল। কিন্তু শুন্য দৃষ্টিতে কোন পরিবর্তন এল না।
হঠাৎ ও বলে উঠল : “আহ্, আচ্ছা ঠিক আছে। টুর্নামেন্ট, তাই না? আহ্ হ্… রোকে!”
ওর গলা শুনতে অন্যরকম লাগছে, ভারী, বড়দের গলার মত। “টুর্নামেন্ট, স্ট্রোক! হাতুড়ির দু’টো মাথা…”
“হে ঈশ্বর জ্যাক ওর কি হয়েছে?”
জ্যাক ড্যানির দুই কাঁধ ধরে ঝাঁকাল। ওর মাথা পুতুলের মত একবার সামনে তারপর একবার পেছনে দোল খেল।
“রোকে, স্ট্রোক, রেডরাম।”
জ্যাকে ওকে আবার ঝাঁকুনি দিল। হঠাৎ করে ড্যানির চোখে প্রাণ ফিরে এল। ছোট্ট একটা শব্দ করে টুথব্রাশটা পরে গেল ওর হাত থেকে।
“কি হয়েছে?” ও চারপাশে তাকিয়ে বুঝবার চেষ্টা করল ও কোথায়, তারপর মা আর বাবার চেহারা দেখে ভয় পেয়ে গেল। “ক্-ক্-কি ব্-ব্- ব্যাপা—”
“তোতলানো বন্ধ কর!” জ্যাক ওর মুখের সামনে চেঁচিয়ে উঠল। ড্যানি চমকে উঠল, ওর দু’চোখ বেয়ে ঝরঝর করে পানি নেমে এল। ও বাবার কাছ থেকে সরে যেতে চেষ্টা করল।
জ্যাক ওকে কাছে টেনে জড়িয়ে ধরল। “ওহ সোনা, না না না, কাঁদে না। সরি বাবা, আমি তোকে বকা দিতে চাই নি। সব ঠিক আছে, কাঁদে না, সব ঠিক আছে।”
ওয়েন্ডির মনে হল ও কোন দুঃস্বপ্ন দেখছে। ও যেন অতীতে ফিরে গেছে, ওদের অন্ধকার অতীতে, যখন ওর স্বামী ওর ছেলের হাত ভাঙ্গবার পর ঠিক একইভাবে ক্ষমা চাচ্ছিল।
(সরি ডক, আমি তোকে ব্যাথা দিতে চাইনি, প্লিজ ডক, মাফ করে দে, সরি…)
ওয়েন্ডি ছুটে গিয়ে জ্যাকের হাত থেকে ছাড়িয়ে ড্যানিকে নিজের কোলে নিয়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল। জ্যাকও ওদের পিছে পিছে এল।
ওয়েন্ডি বসে ড্যানিকে দোল খাওয়াতে লাগল। ও জ্যাকের দিকে তাকাল। জ্যাকের চোখেও চিন্তা। ও ভ্রু উঁচালো, প্রশ্ন করবার ভঙ্গিতে। ওয়েন্ডি আস্তে করে মাথা নাড়ল।
“ড্যানি,” ও বলল। “সব ঠিক আছে সোনা, সব ঠিক আছে। তুই ঠিক আছিস।”
অবশেষে ড্যানি শান্ত হল। কিন্তু তারপরেও ও যখন মুখ খুলল, তখন প্রথম কথা বলল জ্যাকের উদ্দেশ্যে। ওয়েন্ডির মনে আবার পুরনো অভিমানটা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল।
(জ্যাক আগে, সবসময় জ্যাক আগে…)
জ্যাক ড্যানির ওপর চেঁচাল, আর ওয়েন্ডি ওকে কোলে নিয়ে আদর করল, কিন্তু তাও ড্যানি স্থির হবার সাথে সাথে জ্যাককে বলল, “সরি। আমি কি খারাপ কিছু করেছি?”
জ্যাক ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। “সরি বলার কিছু নেই। ওখানে কি হয়েছিল, ডক?”
ড্যানি আস্তে আস্তে মাথা ঝাঁকাল, যেন ও এখনও ঘোরের মধ্যে আছে। “বাবা, তুমি আমাকে তোতলানো বন্ধ করতে বললে কেন? আমি তো তোতলাই না।”
“না না, সে তো আমি জানি,” জ্যাক মুখে বলল ঠিকই, কিন্তু ওয়েন্ডির কেন যেন মনে হলে জ্যাক কিছু একটা লুকাচ্ছে। এক মুহূর্তের জন্যে যেন ওর কোন খারাপ স্মৃতি মনে পড়ে গেছে।
“আমি একটা ঘণ্টাকে নিয়ে কি যেন দেখলাম…” ড্যানি বিড়বিড় করল। “কি?” জ্যাক ঝুঁকল ওর দিকে। ড্যানি আবার সিঁটিয়ে গেল।
“জ্যাক, তুমি ওকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ।” ওয়েন্ডি অভিযোগের সুরে বলল। কথাটা বলার পর ওর মনে হল ওরা সবাই কি নিয়ে যেন ভয় পাচ্ছে। কিন্তু কিসের ভয়?
“আমার…ভালো করে মনে নেই, বাবা। আমি তখন কি বলছিলাম?”
“কিছু না।” জ্যাক একটা রুমাল বের করে নিজের ঠোঁট মুছল। ওয়েন্ডির আবার মনে হল ও নিজের ভয়ংকর অতীতে ফিরে গেছে। যখন জ্যাক মদ খেত তখন ওর বার বার রুমাল দিয়ে মুখ মুছবার বদভ্যাস ছিল।
“তুমি দরজা বন্ধ করে দিলে কেন সোনা?” ওয়েন্ডি নরমসুরে জানতে চাইল।
“টনি বলেছিল, তাই।”
জ্যাক আর ওয়েন্ডি একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল।
“টনি তোমাকে ঠিক কি বলেছে, ডক?”
“আমি দাঁত ব্রাশ করতে করতে আমার পড়াগুলো মনে করছিলাম, “ ড্যানি বলল। “তখন হঠাৎ করে দেখলাম যে আয়নায় টনি দাঁড়িয়ে আছে। ও বলল ও আমাকে একটা জিনিস দেখাতে চায়।”
“মানে ও তোমার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল? এজন্যে তুমি ওকে আয়নায় দেখেছ?”
“না, ও আয়নার ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিল,” ড্যানি জোর দিয়ে বলল। “অনেক ভেতরে। আমিও আয়নার ভেতরে ঢুকলাম। তারপরই দেখি বাবা আমাকে ধরে ঝাঁকাচ্ছে। আমি ভেবেছিলাম যে আমি খারাপ কিছু করেছি দেখে বাবা আমাকে শাস্তি দিচ্ছে।”
জ্যাকের মুখ কুঁচকে গেল।
“না, ডক,” ও নীচু স্বরে বলল।
“টনি তোমাকে বলেছিল দরজা লক করে দিতে?” ওয়েন্ডি আঙুল দিয়ে ড্যানির চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যা।”
“ও কি দেখাতে চেয়েছিল তোমাকে?”
ড্যানির সমস্ত শরীর তারের মত শক্ত হয়ে গেল। “আমি জানি না…” ও কাঁদো কাঁদো স্বরে বলল, “আমি জানি না, আমি মনে করতে চাই না, আমাকে জিজ্ঞেস কোর না!”
“শ্,” ওয়েন্ডি বলল। “তোমার মনে না থাকলে কোন অসুবিধা নেই। জোর কোর না।”
“আম্মু কি আর একটু থাকব তোমার সাথে?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল। “তোমাকে একটা গল্প শোনাই?”
“না, আম্মু, তোমার থাকতে হবেনা।” বলে ড্যানি জ্যাকের দিকে তাকিয়ে লাজুক স্বরে বলল, “বাবা তুমি কি একটু থাকবে?”
“অবশ্যই, ডক।”
ওয়েন্ডি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “আমি লিভিংরুমে আছি, জ্যাক।”
যাবার আগে ওয়েন্ডি নাইটলাইটটা জ্বালিয়ে দিয়ে গেল। ড্যানি সার আগে কখনও রুমে নাইটলাইট চায়নি, কিন্তু ওভারলুকে আসার পর ও একরকম জোর করেই এই লাইটটা লাগিয়ে নিয়েছে।
ওয়েন্ডি বেরিয়ে যাবার আগে শেষ একবার ড্যানির দিকে তাকাল। বিছানায় ওর শরীরটাকে কি ছোট্ট, অসহায় লাগছে!
“তোর ঘুম ধরেছে?” জ্যাক ড্যানির মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল।
“হ্যা।”
“একটু পানি খাবি?”
“না…”
পাঁচ মিনিটের জন্যে ও আর কিছু বলল না। ও ঘুমিয়ে গেছে ভেবে জ্যাক যেই উঠতে যাবে তখন ও মৃদু স্বরে বলে উঠল, “রোকে।”
জ্যাক ঘুরে দাঁড়াল।
“ড্যানি?”
“বাবা, তুমি তো কখনও আম্মুর ক্ষতি করবে না, তাই না?”
“না।”
“আর আমার?”
“কখনোই নয়।”
“বাবা, টনি আমাকে রোকের ব্যাপারে বলেছে।”
“তাই? কি বলেছে?
“খুব বেশী মনে নেই। খেলাটা নাকি ইনিংস হিসাবে খেলে? বেসবলের মত?”
“হ্যা।” জ্যাকের হৃদস্পন্দন দ্রুত হয়ে গেল। ড্যানি কোথা থেকে এ কথাটা জানল? রোকে আসলেই ইনিংস হিসাবে খেলা হয়, তবে বেসবলের মত নয়, ক্রিকেটের মত।
“বাবা…?” ড্যানির গলা ঘুমে জড়িয়ে এসেছে।
“কি?”
“রেডরাম কি?”
“রেডরাম? শুনে মনে হচ্ছে রেড ইন্ডিয়ানদের কোন কিছু হবে। কেন?”
কিন্তু ড্যানি ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর বুকের ওঠানামার ছন্দ দেখতে দেখতে হঠাৎ করে জ্যাকের বুকে ভালোবাসার প্লাবন বয়ে গেল। এরকম একটা ভালো বাচ্চাকে ও কিভাবে বকা দিল? ওর তোতলানোটা তো অস্বাভাবিক কিছু ছিল না, বেচারা মাত্র একটা অদ্ভুত ঘোর কাটিয়ে উঠেছিল। এখন মনেও হচ্ছে না যে ও তখন ঘণ্টা নিয়ে কিছু বলেছে। নিশ্চয়ই জ্যাকের শুনতে ভুল হয়েছে।
রোকের ব্যাপারটা ওকে কি কেউ বলেছে? হ্যালোরান? আলম্যান? (ঈশ্বর আমার এক গ্লাস মদ দরকার)
“আমি তোকে ভালোবাসি, ড্যানি,” জ্যাক বলল। “ঈশ্বরের নামে শপথ করে বলতে পারি আমি কথাটা।”
কিন্তু ড্যানি ঘণ্টার কথাই বলেছে। কোন সন্দেহ নেই তাতে। শব্দগুলো
এখনও ওর কানে বাজছে।
জ্যাক রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে একবার থামল। ঘুরে ড্যানির দিকে তাকিয়ে ও রুমাল বের করে মুখ মুছল।
গভীর রাতে ওরা দু’জন আবার ড্যানির রুমে ফিরে এল। ওয়েন্ডি, যে একটা প্যান্টি ছাড়া আর কিছু নেই, এসে ড্যানির কপালে হাত দিয়ে দেখল যে ওর জ্বর এসেছে কিনা।
“কি মনে হয়? ওর গা কি গরম?” জ্যাক প্রশ্ন করল।
“না।” ওয়েন্ডি ঘুমন্ত ড্যানির কপালে চুমু দিতে দিতে উত্তর দিল।
“ভাগ্য ভালো তুমি ডাক্তারের সাথে দেখা করার ব্যবস্থা নিয়েছিলে।” জ্যাক বলল। একটু থেমে ও যোগ করল, “ওয়েন্ডি, যদি তোমার বা ড্যানির কোন অসুবিধা হয়, তাহলে আমি তোমাদের তোমার মায়ের বাসায় পাঠিয়ে দেব।”
“না।”
“আমি জানি ওনার সাথে তোমার কিছু সমস্যা আছে…”
“শুধু ‘সমস্যা’ বললে অনেক কমিয়ে বলা হবে।”
“ওয়েন্ডি, তোমাদের পাঠাবার মত অন্য কোন জায়গা আমি চিনি না।”
“যদি তুমি আসো, তাহলে আমি চিন্তা করে দেখতে পারি…”
‘এই চাকরিটা ছেড়ে দিলে আমরা পথে বসে পড়ব।” জ্যাক গম্ভীর গলায় বলল।
অন্ধকারে ওয়েন্ডি মাথা নাড়ল। কথাটা যে সত্যি এটা ও জানে।
“আলম্যান আমাকে ইন্টারভিউয়ের সময় বলেছিল যে তোমাদের এতদুরে একলা থাকতে সমস্যা হতে পারে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করিনি। এখন মনে হচ্ছে এ ঝুঁকিটা না নিলেই পারতাম।”
ওয়েন্ডি জ্যাকের পাশে ঘেসে এল। “জ্যাক, আমি তোমাকে ভালোবাসি। ড্যানিও তোমাকে ভালোবাসে, হয়তো আমার চেয়েও বেশী। তুমি যদি আমাদের ছেড়ে একলা এখানে থাকতে তাহলে আমাদের আরও বেশী কষ্ট হত।”
জ্যাক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক হাত দিয়ে ওয়েন্ডিকে জড়িয়ে ধরল। “আমাদের আজকে বেডরুমের দরজা খুলেই ঘুমানো উচিত, কি বল? যাতে ড্যানির ওপর চোখ রাখতে পারি।”
“ওকে দেখে মনে হল যে ওর আরামেই ঘুমাচ্ছে। মনে হয় না সকালের আগে ওর আর ঘুম ভাঙ্গবে।”
কিন্তু ড্যানির ঘুম অতটা আরামের ছিল না।
বুম, বুম, বুউউউউম…
ও বিভীষিকাময় শব্দটা থেকে দৌড়ে পালাচ্ছে একটা গোলকধাঁধার মত করিডর ধরে। পেছনে যতবার রোকের হাতুড়িটা একটা দেয়ালে আছড়ে পড়ছিল ততবার ওর মুখ থেকে চিৎকার বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে, কিন্তু ও নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে সে ইচ্ছাটা দমন করছে। ওর মুখ থেকে আওয়াজ বের হওয়া মাত্র অনুসরণকারী বুঝে ফেলবে, আর তারপর-
(তারপর রেডরাম)
(বেরিয়ে আয় হারামজাদা, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন!)
ও শুনতে পাচ্ছিল যে অনুসরণকারী ওর পিছে ছুটে আসছে, কোন অচেনা,
অশুভ জঙ্গলের হিংস্র কোন প্রাণীর মত।
বুম বুম শব্দটা ওর একদম কাছে এখন, ক্রুদ্ধ গলাটাও কাছে চলে এসেছে।
ওর কানের পাশে হাতুড়িটা শিস তুলে বাতাস কাটল।
(রোকে…স্ট্রোক…রোকে … স্ট্রোক … রেডরাম)
পর মুহূর্তেই অস্ত্রটা আছড়ে পড়ল দেয়ালে। ড্যানির মুখ শুকিয়ে খটখটে হয়ে গেছে।
ও হঠাৎ করে থমকে দাঁড়াল। ওর সামনে যাবার আর কোন জায়গা নেই। রাস্তা ফুরিয়ে গেছে। বাইরে ঝড়ের তীব্র শোঁ শোঁ আওয়াজ ভেসে এল।
ড্যানির পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেল। ওর বুকে ধ্বকধ্বক করে প্রচণ্ড শব্দ হচ্ছে। ওর হাঁটু দুটো আর শরীরের ভার নিতে পারছিল না। ও ধপ করে মাটিতে বসে পড়ল। ওর কার্পেটটা চেনা চেনা লাগছিল। গাঢ় নীল রঙের একটা কার্পেট। ওর চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসছে।
শব্দটা আরও কাছে এগিয়ে এল। আরও কাছে।
পিশাচটা ওকে ধরে ফেলবে, এখনই ধরে ফেলবে, তারপর ড্যানিকে হাতুড়িটা দিয়ে-
ও চোখ মেলে ধড়মর করে অন্ধকারের মধ্যে উঠে বসল। ওর হাত দু’টো চোখের সামনে নিয়ে গেল।
ওর বাঁ হাতের ওপর কি যেন হাঁটছে।
বোলতা। তিনটে বোলতা।
তিনটাই একসাথে ওর হাতে হুল ফোটাল, আর সাথে সাথে ড্যানির ঘোর কেটে গেল। ও চিৎকার দিয়ে উঠল।
ওর রুমের লাইট জ্বলে উঠল, ও দেখল যে ওর বাবা দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে। তার পেছনে মা, ঘুম জড়ানো চোখে বুঝবার চেষ্টা করছে যে কি হচ্ছে।
“আহ্! ওদের সরাও আমার হাত থেকে!” ড্যানি চেঁচিয়ে উঠল
“হে ঈশ্বর!” জ্যাক বলে উঠল। ও এতক্ষণে পোকাগুলোকে দেখতে পেয়েছে।
“জ্যাক ওর কি হয়েছে?” ওয়েন্ডি ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করল
জ্যাক জবাব না দিয়ে ছুটে গেল ছুটে গেল ড্যানির কাছে। বালিশটা নিয়ে ড্যানির হাতে ও একবার বাড়ি মারল। আবার। আবার।
পোকাগুলোর নিস্তেজ দেহ মাটিতে পড়ে গেল। এখনও ওরা ওড়ার চেষ্টা করছিল।
জ্যাক চেঁচিয়ে উঠল, “যেয়ে একটা পেপার রোল করে নিয়ে আস। মার এগুলোকে, এখনই!”
“বোলতা?” ওয়েন্ডি মাথায় তখনও ঢুকছিল না যে কি হয়েছে। তারপর বিদ্যুচ্চমকের মত ও বুঝতে পারল ব্যাপারটা। “বোলতা! জ্যাক তুমি বলেছিলে কিছু হবে না-”
“চিল্লানো বন্ধ করে আমি যা বলেছি কর!” জ্যাক গর্জন করে উঠল।
ওয়েন্ডি ড্যানির পড়ার টেবিল থেকে একটা বই তুলে আছড়ে ফেলল একটা বোলতার ওপর। একটা বাদামী ছোপ ছাড়া ওটার আর কিছু অবশিষ্ট রইল না।
জ্যাক দৌড়ে ড্যানিকে ওদের বেডরুমে নিয়ে শুইয়ে দিল। “এখানেই থাক, আমি না আসা পর্যন্ত। ঠিক আছে?”
ড্যানি মাথা নাড়ল। কান্নায় ওর চোখ ফুলে গিয়েছে।
“সাবাশ। আমার সাহসী ছেলে।”
জ্যাক দৌড়ে নীচে গেল। কিচেনে ঢুকে ও বড় দেখে একটা স্টিলের বাটি নিয়ে আবার ছুটে বেরিয়ে গেল। বেরোবার সময় ও হাঁটুতে প্রচণ্ড বাড়ি খেল দরজার সাথে, কিন্তু একবার ফিরেও তাকাল না।
ও আবার ড্যানির রুমে এসে দেখে যে ওয়েন্ডি বাইরে দাঁড়িয়ে হাঁপাচ্ছে। ঘামে ওর চুল মাথার সাথে লেপটে গিয়েছে। “সবগুলোকে মেরে ফেলেছি, কিন্তু একটা আমাকে কামড়ে দিয়েছে।” ও কাঁদতে শুরু করল। “জ্যাক, তুমি বলেছিলে আর কোন বোলতা বেঁচে নেই।”
জবাব না দিয়ে জ্যাক ওকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে গেল। টেবিলের কাছে এসে ও বোলতার চাকটার সামনে দাঁড়াল। দেখে মনে হচ্ছে না ভেতরে কিছু আছে। তাও জ্যাক বাটিটা মাথার ওপর তুলে তারপর নামিয়ে আনল চাকটার ওপর।
“শেষ।” ও বলল।
ও বেরিয়ে ওয়েন্ডির পাশে এল। “কোথায় কামড় দিয়েছে তোমাকে?”
“আমার… আমার কব্জিতে,” ওয়েন্ডি হাত বাড়িয়ে জ্যাককে দেখাল। ও যেখানে ঘড়ি পড়ে তার একটু ওপরে একটা জায়গা লাল হয়ে ফুলে উঠেছে।
“তোমার কি বোলতার কামড়ে অ্যালার্জি আছে? ভালো করে চিন্তা করে বল। তোমার যদি থাকে তাহলে ড্যানিরও থাকতে পারে, আর ও অনেকগুলো কামড় খেয়েছে!”
“না…”ওয়েভি আরেকটু শান্ত হয়ে জবাব দিল। “আমি শুধু ওদের ভয় পাই, আমার অ্যালার্জি নেই।”
ড্যানি নিজের বিছানায় উঠে বসেছিল। ও নিজের বাঁ হাতটা অন্য হাতে ধরে আছে। জ্যাক এগিয়ে যেতে ও জ্যাকের দিকে অভিমানে দৃষ্টিতে তাকাল। “বাবা, তুমি বলেছিলে চাকটায় কোন বোলতা নেই! আমার হাত জ্বলছে!”
“দেখি কি অবস্থা, ডক…না না, আমি ধরব না, তাহলে আরও ব্যাথা পাবি, তুই হাতটা বাড়িয়ে ধর।”
ওর হাতের অবস্থা দেখে ওয়েন্ডি ফুঁপিয়ে উঠল 1
পরে ডাক্তার দেখাবার পর ওরা জানতে পারে যে ড্যানির হাতে সেদিন বোলতাগুলো এগারবার হুল ফোটায়। কিন্তু এখন একবার দেখেই ওরা বুঝতে পারছিল যে অবস্থা ভালো নয়। ড্যানির হাত ফুলে দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছে, আর হাতের আঙুল আর তালু ছোট ছোট কালো দাগে ছাওয়া।
“ওয়েন্ডি আমাদের ঘর থেকে পেইনকিলার স্প্রেটা নিয়ে আসো।” জ্যাক বলল।
ওয়েন্ডি বেরিয়ে যাবার পর জ্যাক এসে ড্যানির পাশে বসল। “ডক, তোকে স্প্রেটা দেবার পর আমি তোর হাতের কয়েকটা ছবি তুলব, ঠিক আছে? তুই তারপর আজ রাতে আমাদের সাথে ঘুমাবি।”
“ঠিক আছে,” ড্যানি জবাব দিল। “কিন্তু তুমি ছবি কেন তুলতে চাও?”
“যাতে মামলা করে কিছু লোকের প্যান্ট খুলে দিতে পারি।”
ওয়েন্ডি একটা স্প্রে ক্যান হাতে নিয়ে ফিরে এল।
“এটাতে একটুও ব্যাথা লাগবে না, সোনা।” ও বলল।
ওয়েন্ডি ড্যানির হাতের দু’দিকেই স্প্রে করে দিল। তারপর পাঁচটা অ্যাসপিরিন ট্যাবলেট বের করল। ট্যাবলেটগুলো বাচ্চাদের, অরেঞ্জ ফ্লেভারের। “এবার এগুলো খেয়ে নাও দেখি।”
ড্যানি এক এক করে সবগুলো ওষুধ গিলে ফেলল।
জ্যাক বলে উঠল, “এতগুলো ওষুধ একসাথে খাওয়া কি উচিত হবে?”
“ও অনেকগুলো কামড়ও তো খেয়েছে, তাই না?” ওয়েন্ডি রাগীস্বরে উত্তর দিল। “এখনই যেয়ে ওই বোলতার বাসাটাকে ফেলে দিয়ে আসো, জ্যাক টরেন্স!”
“এক মিনিট।”
বলে জ্যাক উঠে গেল বিছানা থেকে। ও ড্রয়ার থেকে নিজের পোলারয়েড ক্যামেরা আর কয়েকটা ফ্ল্যাশবাল্ব খুঁজে বের করল।
“কি করছ তুমি, জ্যাক?” ওয়েন্ডি অধীর গলায় প্রশ্ন করল।
“বাবা মামলা করে কিছু লোকের প্যান্ট খুলে দেবে।” ড্যানি গম্ভীর গলায় বলল।
“ঠিক,” জ্যাকও একই গলায় উত্তর দিল। “দেখি ড্যানি, হাতটা বাড়িয়ে ধর। প্রত্যেকটা কামড়ের জন্যে কম করে হলেও পাঁচ হাজার টাকা পাবার কথা।”
“কিসের কথা বলছ তোমরা?” ওয়েন্ডি প্রায় চিৎকার করে জানতে চাইল। “আমি ওই বাগ বম্বটার গায়ে লেখা নির্দেশনাগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি। তারপরও যখন বোলতাগুলো মরেনি, তার মানে কোম্পানির কীটনাশকে কোন সমস্যা ছিল। আমি ক্ষতিপূরণ চেয়ে ওদের মামলা করব।” জ্যাক জবাব দিল।
“ও।” ওয়েন্ডি নীচুস্বরে বলল।
ওর হাতের কামড়গুলোর দাম হাজার হাজার টাকা এটা চিন্তা করে ড্যানি বেশ মজা পেল। ও হাত বাড়িয়ে বাবাকে ছবি তুলতে সাহায্য করতে লাগল। ওর ব্যাথা এখন একটু কমেছে।
জ্যাক যখন ছবিগুলো ড্রেসারের ওপর শুকোতে দিল তখন ওয়েন্ডি এসে প্রশ্ন করল, “আজকে রাতেই কি ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো?”
“ওর ব্যাথা খুব বেড়ে না গেলে দরকার নেই,” জ্যাকের উত্তর। “যদি ওর বোলতার কামড়ে অ্যালার্জি থাকত তাহলে এতক্ষণে আমরা বুঝে ফেলতাম।”
“বুঝে ফেলতাম? কিভাবে?”
“ও কোমায় চলে যেত।”
“হে ঈশ্বর!” ওয়েন্ডি নিজের কনুইদু’টো জড়িয়ে ধরল।
“কি অবস্থা তোমার বাবা? ঘুমাতে পারবে?” ও ড্যানিকে জিজ্ঞেস করল। ড্যানি মায়ের দিকে তাকাল। দুঃস্বপ্নটার কথা ওর আর এখন মনে নেই, কিন্তু তখন ও যে ভয়টা পেয়েছিল সেটা এখনও ওর মনে চেপে বসে আছে।
“আমি কি তোমাদের সাথে শুতে পারি?”
“হ্যা সোনা, অবশ্যই।” বলে ওয়েন্ডি আবার কাঁদতে শুরু করল। “সরি তোমার এত কষ্ট পেতে হল, সোনা।”
জ্যাক এসে ওয়েন্ডির কাঁধে একটা হাত রাখল। “ওয়েন্ডি, আমি শপথ
করে বলতে পারি যে আমি নিয়মগুলো অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছি।”
“কথা দাও যে কালকে তুমি চাকটাকে ফেলে দিবে?”
“অবশ্যই।”
ওরা সবাই শুয়ে পড়ল। জ্যাক বিছানার পাশে বাতিটা নেভাতে যাবে তখন ওর হঠাৎ করে কি যেন মনে পড়ল। “চাকটারও একটা ছবি তুলে রাখা দরকার।”
“বেশীক্ষণ লাগিও না।” ওয়েন্ডি বলল।
“না না।”
জ্যাক উঠে ড্রয়ার থেকে আবার ক্যামেরাটা বের করল। আর একটাই ফ্ল্যাশবাল্ব বাকি ছিল। ও বেরিয়ে যাবার আগে ড্যানির দিকে তাকিয়ে হাসল। ড্যানিও হাসল ওর দিকে তাকিয়ে।”
ও ড্যানির রুমে এসে চাকটার দিকে তাকাতেই ওর ঘাড়ের লোম সরসর করে দঁড়িয়ে গেল।
চাকটা এখনও স্টিলের বাটিটার নীচে চাপা পড়ে আছে। কিন্তু বাটিটা ছেয়ে গেছে বোলতায়। কমপক্ষে একশ’টা হবে।
জ্যাকের বুকের ভেতর প্রচণ্ড জোরে আওয়াজ হচ্ছিল। ও খুব সাবধানে দু’টো ছবি তুলল। তারপর নিজের মুখ মুছতে মুছতে ওর মাথার ভেতর একটা কথা বারবার পাক খেতে লাগল-
(আপনার বদমেজাজের কারণে, আপনার বদমেজাজের কারণে, আপনার বদমেজাজের কারণে)
ও বোলতাগুলোকে মেরে ফেলেছিল, কোন সন্দেহ নেই তাতে। কিন্তু তারপরও ওরা ফিরে এসেছে। এর মানে কি হতে পারে?
ও আবার নিজের শুকনো ঠোঁট দু’টো জিভ দিয়ে ভেজাল। ওর কানে বেজে উঠল নিজের হিংগ্র, তীব্র গলা : তোতলানো বন্ধ কর!
ও আশেপাশে তাকিয়ে ড্যানির ডেস্ক থেকে একটা খালি বাক্স খুঁজে বের করল। তারপর ও সাবধানে, খুব সাবধানে, বাটি আর চাকটার ওপর বাক্সটা রাখল। তারপর এক ঝটকায় ভেতরের জিনিস দু’টো সহ পুরো বাক্সটা উলটো করে বাক্সের মুখ বন্ধ করে দিল।
ভেতর থেকে বোলতাগুলো ক্রুদ্ধস্বরে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল।
ও বাক্স হাতে বেরিয়ে এল বাইরে।
“শুতে আসবে না, জ্যাক?” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল।
“শুতে আসো, বাবা!” ড্যানির গলা।
“আমি একটু নীচ থেকে আসছি।” জ্যাক নিজের গলার স্বর হালকা রাখার চেষ্টা করল।
কিভাবে সম্ভব এটা? ও নিজের চোখে দেখেছে বাগ বম্ব থেকে ধোঁয়া বের হয়ে চাকের ভেতর ঢুকতে। তারপর, দু’ঘণ্টা পার হবার পর, ও ঝাঁকিয়ে একগাদা পোকার মৃতদেহ বের করে ভেতর থেকে। তাহলে পোকাগুলো আবার বেঁচে উঠল কিভাবে? এটা কোন অলৌকিক ব্যাপার নয় তো?
পাগলের মত চিন্তা কর বন্ধ কর, জ্যাক মনে মনে নিজেকে শাসাল। কিন্তু এর কোন বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা তো পাওয়া যাচ্ছে না। যদি বোলতাদের এই ক্ষমতা থেকেও থাকে যে ওরা একবেলার মধ্যে বাচ্চা দিয়ে আবার পুরো চাক ভরিয়ে ফেলবে, কিন্তু এখন শীতকাল, ওদের বাচ্চা দেবার সময় নয়।
জ্যাক নীচে নেমে কিচেনে ঢুকল। কিচেনে হোটেলের পেছনদিক দিয়ে বেরোবার একটা রাস্তা আছে। এদিক দিয়ে গোয়ালারা দুধ ডেলিভারি দিয়ে যায়, হোটেল খোলা থাকলে। জ্যাক দরজাটা খুলতেই ঠাণ্ডা বাতাস ওর হাড় কাঁপিয়ে দিল। দরজার পাশে একটা থার্মোমিটার লাগানো ছিল, সেখানে ও দেখল যে তাপমাত্রা মাত্র পঁচিশ ডিগ্রি ফারেনহাইটে নেমে এসেছে। ও বাক্সটাকে আস্তে করে মাটিতে নামিয়ে রাখল। বাইরের ঠাণ্ডায় সকাল হবার আগেই বোলতাগুলো মারা যাবে। ও ভেতরে এসে দরজা লাগিয়ে দিল। এক মুহূর্ত চিন্তা করে দরজায় তালাও মারল।
ও কিচেন থেকে বেরিয়ে এসে সবগুলো লাইট আবার বন্ধ করে দিল। তারপর ও অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মদ খাবার প্রচণ্ড ইচ্ছার সাথে লড়ল। হঠাৎ করে ওর মনে হল যেন হোটেলটা অচেনা শব্দে ভরে গিয়েছে।
জ্যাকের এখন আর ওভারলুক হোটেলকে আগের মত ভালো লাগছে না। যেন ওর ছেলেকে বোলতাগুলো নিজের ইচ্ছায় কামড়ায়নি, হোটেলটা ওদের নীরবে হুকুম দিয়েছে কাজটা করবার জন্যে।
নিজের ছেলে আর বৌয়ের সাথে শুতে যাবার আগে জ্যাক নিজের কাছে একটা কঠিন প্রতিজ্ঞা করল।
(এখন থেকে যা কিছুই হোক, তুমি মেজাজ খারাপ করবে না)
ও শেষ একবার হাত দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছল।
অধ্যায় ১৭ – ডাক্তারের অফিসে
ড্যানির ছোট্ট শরীর, শুধু একটা আন্ডারওয়্যার পড়া, ডাক্তারের এক্সামিনেশান টেবিলে শোয়ানো ছিল। ডক্টর এডমন্ডস (যিনি জোর দিয়ে বলেছেন তাকে শুধু বিল বলে ডাকবার জন্যে) একটা বড়, কালো মেশিন টেবিলটার পাশে নিয়ে এলেন।
“তুমি আবার মেশিনটা দেখে ভয় পেয়ে যেও না,” বিল এডমন্ডস বললেন। “এটা একটা ইলেকট্রোএনসেফালোগ্রাফ, তুমি মোটেও ব্যাথা পাবে না।”
“ইলেক্ট্রো-”
“আমরা সবাই এটাকে সংক্ষেপে ই.ই.জি. বলে ডাকি। আমি তোমার কপালের সাথে টেপ দিয়ে কয়েকটা তার লাগাবো, আর তারপর এই যে পিনটা দেখছ না মেশিনটার সাথে? এটা তোমার মস্তিষ্কের তরঙ্গগুলো রেকর্ড করবে।”
“সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের মত?”
“অনেকটা সেরকমই। তুমি কি সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যানের মত হতে চাও?”
“জীবনেও না, বাবা বলে যে একদিন ওর শর্ট সার্কিট হয়ে এমন শক খাবে যে ওর মাথার সব চুল দাঁড়িয়ে যাবে।”
“তোমার সাথে অবশ্য এখানে তেমন কিছু হবে না,” ডক্টর এডমন্ডস সহাস্যে বললেন। নার্স ড্যানির কপালে তারগুলো লাগাচ্ছিল। “আর ই.ই.জি করলে আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারব।”
“কি বুঝতে পারবেন?”
“যেমন ধর, তোমার মৃগী আছে কিনা। মৃগীরোগ হচ্ছে…”
“আমি জানি।”
“তাই নাকি? কিভাবে?”
“আমি ছোট থাকতে যখন নার্সারি স্কুলে পড়তাম তখন আমাদের সাথে একটা ছেলে ছিল যার ওই রোগটা হত। ওকে স্যার আর ম্যাডামরা ফ্ল্যাশবোর্ড ব্যাবহার করতে মানা করে দিয়েছিলেন।”
“ফ্ল্যাশবোর্ড? সেটা কি, ড্যানি?” ডক্টর মেশিনটা চালু করে দিলেন। “একটা বোর্ড, যেটা চালু করলে নানারকম রঙ আর আলোর ঝলকানি দেখা যেত। ব্রেন্টের ওটা ধরতে মানা ছিল।”
“হুম্ম্, কারণ আলোর ঝলকানি দেখলে মৃগী রোগীদের খিঁচুনী উঠতে পারে। দেখি ড্যানি, একদম স্থির হয়ে শুয়ে থাকো তো কিছুক্ষণ, নড়াচড়া কোর না।”
“ঠিক আছে।”
ড্যানি, তোমার সাথে যখন এই… অদ্ভুত ব্যাপারগুলো হয়, তার আগে কি তুমি কোন উজ্জ্বল আলো দেখো?”
“না…”
“কোন শব্দ শুনতে পাও? ডোরবেল বাজবার মত?”
“না।”
“কোন গন্ধ? কাঠের গুঁড়ো, বা কমলালেবুর গন্ধের মত?”
“জি না।”
“তোমার কি জ্ঞান হারাবার আগে কান্না পায়? যখন মন খারাপ থাকে না তখনও?”
“না, কখনওই নয়।”
“বেশ, সব ঠিক আছে বলেই মনে হচ্ছে।”
“আমার কি মৃগী আছে, ডক্টর বিল?”
“মনে হয় না, ড্যানি। আর একটু শুয়ে থাকো, আমাদের কাজ প্রায় শেষ।”
“বেশ।”
মেশিনটা থেকে লম্বা একটা কাগজ বেরিয়ে এল। এডমন্ডস সেটাকে দেখতে দেখতে পাশের ঘরে চলে গেলেন।
নার্স বলল, “তোমাকে আমার ছোট্ট একটা একটা ইঞ্জেকশান দিতে হবে, তোমার যক্ষা আছে কিনা দেখবার জন্যে, কেমন?”
“ওটা তো আমাকে গত বছর স্কুলেই দিয়েছে।” ড্যানি ভয়ে ভয়ে বলল। “কিন্তু তারপর তো অনেকদিন হয়ে গেছে। আমাদের আরেকবার দেখতে হবে।”
“আচ্ছা।” ড্যানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিজের হাত এগিয়ে দিল।
ইঞ্জেকশান নেবার পর ড্যানি জামা-কাপড় পড়ে পাশের ঘরে গেল, যেখানে ডক্টর এডমন্ডস টেবিলের ওপর বসে কাগজটার দিকে চোখ রেখে পা ঝাঁকাচ্ছিলেন।
“তোমার হাতের এখন কি অবস্থা, ড্যানি?” বলে উনি ড্যানির ব্যান্ডেজ করা হাতের দিকে তাকালেন।
“ভালোই, কোন ব্যাথা নেই।”
“তোমার ই.ই.জি. পড়ে মনে হচ্ছে না তোমার ব্রেনে কোন সমস্যা আছে। কিন্তু তাও আমি এই রিপোর্টটা আমার এক বন্ধুর কাছে পাঠাবো, যার কাজই হচ্ছে এই গ্রাফগুলো অনুবাদ করা। কোন ঝুঁকি না নেয়াওই ভালো।”
“জি।”
“আমাকে টনির ব্যাপারে বল, ড্যানি।”
ড্যানিকে একটু অপ্রতিভ দেখাল। “ও আমার একজন বন্ধু। আমিই ওকে বানিয়েছি, মনে মনে। যাতে আমার একলা না লাগে।”
ডক্টর এডমন্ডস হেসে ফেললেন। উনি ড্যানির মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, “এটা তোমার বাবা-মা মনে করেন, তুমি না। ড্যানি, আমি তোমার ডক্টর। তুমি যদি আমাকে সত্যি কথা বল তাহলে আমি কথা দিচ্ছি যে তোমার অনুমতি না নিয়ে আমি তোমার বাবা-মা’কে এসব কথা বলব না।”
ড্যানি প্রস্তাবটা ভেবে দেখল। তারপর ও একটু মনোযোগ প্রয়োগ করল, যাতে ও বুঝতে পারে যে ডক্টর বিল সত্যি কথা বলছেন কিনা। ও ওনার মাথায় যে ছবিটা দেখতে পেল সেটা ওকে ভরসা দিল। ডক্টরের মাথার ভেতর সারি সারি করে সাজানো অনেকগুলো ফাইলিং ক্যাবিনেট। আর এক-একটার গায়ে লেখা : গোপন তথ্য, ক-গ, গোপন তথ্য, ঘ-ট।
ড্যানি সাবধানে বলল, “টনি কে আমি জানি না।”
“ও কি তোমার বয়সী?”
“না, ও কমপক্ষে এগার বছরের হবে। হয়তো আরও বড়। আমি ওকে কখনও সামনাসামনি দেখি নি।”
“ও সবসময় দূর থেকে দেখা দেয়, তাই না?”
“জি।”
“আর তুমি জ্ঞান হারাবার আগেই ও সবসময় আসে?”
“আমি তো আসলে জ্ঞান হারাই না। আমি ওর সাথে যাই। ও আমাকে অনেককিছু দেখায়।”
“কিরকম?”
“যেমন…” ড্যানি একটু চিন্তা করে বাবার তোরঙ্গের গল্পটা শোনাল, কিভাবে ওটা সিঁড়ির নীচে ও খুঁজে পেয়েছিল।
“আচ্ছা। আর টনি যেখানে বলেছিল সেখানেই কি ট্রাংকটা পাওয়া গেছে?”
“জি, কিন্তু টনি আমাকে বলে নি। দেখিয়েছে।”
“যেদিন তুমি বাথরুমে আটকে গিয়েছিলে, সেদিন টনি তোমাকে কি দেখাচ্ছিল?”
“আমার মনে নেই,” ড্যানি দ্রুত জবাব দিল।
“ঠিক?”
“জি।”
“টনিই তো দরজা লক করে দেয়, তাই?”
“জি না। ও তো সত্যি নয়। ও আমাকে দেখিয়ে দিয়েছিল কিভাবে লাগাতে হয় তারপর আমি নিজেই লক করেছিলাম।”
“আচ্ছা, টনি কি তোমাকে শুধু হারানো জিনিস কোথায় আছে তাই বলে?”
“জি না, ও আমাক মাঝে মাঝে ভবিষ্যতে কি হবে তাও দেখায়।”
“তাই?”
“জি। যেমন ও আমাকে একবার বলেছিল যে বাবা আমাকে একটা পার্কে বেড়াতে নিয়ে যাবে। আমার জন্মদিনে। আমার জন্মদিন আসার পর বাবা ঠিক তাই করে।”
“আর কি কি দেখায় ও তোমাকে?”
ড্যানি ভ্রু কুঁচকাল। “সাইনবোর্ড। ও আমাকে প্রায়ই নানারকম সাইন দেখায়, কিন্তু আমি তো এখনও পড়তে পারি না।”
“তুমি কি টনিকে পছন্দ কর, ড্যানি?”
ড্যানি কোন জবাব না দিয়ে মেঝের দিকে তাকাল।
“ড্যানি?”
“আমি জানি না,” ড্যানি বলল, “আমি চাই যে টনি এসে আমাকে সবসময় ভালো ভালো জিনিস দেখাক, কারণ এখন তো বাবা-মা আর ডিভোর্সের কথা ভাবেন না।” ডক্টর বিলের দৃষ্টি এক মুহূর্তের জন্যে তীক্ষ্ম হল, কিন্তু ড্যানি সেটা দেখতে পেল না। ও তখনও ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে ছিল। “কিন্তু এখন ও আমাকে সবসময় খারাপ, ভয়ের জিনিস দেখায়। যেমন সেদিন ও বাথরুমে যে জিনিসগুলো দেখিয়েছিল। বোলতাগুলো আমাকে কামড়ে দেবার পর আমার যেমন লেগেছিল ও জিনিসগুলো দেখেও একইরকম লাগে। শুধু বোলতাগুলো আমার হাতে হুল ফুটিয়েছিল, আর টনি আমাকে যা দেখিয়েছে সেগুলো হুল ফুটিয়েছে এখানে।” ও একটা আঙুল নিজের মাথার পাশে রাখল, অনেকটা আত্মহত্যার অভিনয়ের মত।
“ও কি দেখিয়েছ, ড্যানি?”
“আমি ভুলে গেছি!” ড্যানি চেঁচিয়ে উঠল। ওর মুখ দেখে মনে হচ্ছিল ও এখনই কেঁদে ফেলবে। “আমার মনে হয় জিনিসগুলো এত খারাপ দেখে আমি মনে রাখতে চাই না। শুধু রেডরাম কথাটা মনে আছে।”
“রেড ড্রাম নাকি রেড রাম?”
“রাম।”
“সেটা কি, ড্যানি?”
“আমি জানি না।”
“ড্যানি, তুমি কি এখন টনিকে ডাকতে পারবে?”
“আমি জানি না। এখন আমার মনে হয় টনি আর কখনও না আসলেই ভালো। আমার ভয় হয় যে ও আমাকে আবার খারাপ জিনিস দেখাবে।”
“চেষ্টা করে দেখ, ড্যানি, তোমার ভয়ের কিছু নেই। আমি এখানেই আছি।”
ড্যানি দ্বিধাজড়িত চোখে ডক্টর বিলের তাকাল। ডক্টর হেসে ওকে ভরসা দিলেন।
“আমি জানি না ও আসবে কিনা। সাধারণত আশেপাশে কেউ থাকলে টনি আসতে চায় না। তাছাড়া আমি ডাকলেই যে ও আসবে সবসময় এমন হয় না।”
“তুমি চেষ্টা করে দেখ। না আসলে নেই।”
ড্যানি একটা নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে প্রস্তুত করল। ও নীচের দিকে তাকিয়ে আস্তে আস্তে মনোযোগ বাড়াতে লাগল। প্রথমে বাবার চিন্তাগুলো পড়বার চেষ্টা করল। বাবা পাশের ঘরে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটাচ্ছিল। ড্যানিকে নিয়ে বাবা চিন্তিত। ওরা একই রুমে না থাকলে ওদের চিন্তা পড়তে ড্যানির বেশ কষ্ট হয়।
ও তারপর মায়ের চিন্তা পড়তে চেষ্টা করল। আম্মুও ওকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছে। কিন্তু আম্মু আরও একটা জিনিস ভাবছে, যে ওর মা, ড্যানির দাদী, একটা ডাইনি হয়ে গেছে আম্মুর বোন এইলিন একটা অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাবার পর থেকেই-
(ওকে একটা গাড়ি এসে ধাক্কা মারে হে ঈশ্বর এরকম কিছু যাতে আমার বাচ্চার সাথে না হয় কিন্তু ওর যদি কোন সিরিয়াস রোগ হয়ে থাকে ক্যান্সার, লিউকেমিয়া যেমন জন গুন্টারের ছেলের ছিল, ও তো ড্যানির চেয়ে বেশী বড় নয় না না ও ঠিক আছে ড্যানির কিছু হয় নি ও ঠিক আছে ও ঠিক আছে এত চিন্তা করা বন্ধ কর )
(ড্যানি-)
(এইলিনকে নিয়ে আর-)
(ড্যানিইইই)
(ড্যানিইইইই…)
কিন্তু টনিকে এখনও দেখা যাচ্ছে না। শুধু ওর গলা শোনা যাচ্ছে, অনেক দূর থেকে। ও গলাটার পিছে পিছে ছুটে গেল, ডক্টর বিলের দুই জুতোর মাঝখানে একটা অন্ধকার গর্তের ভেতর দিয়ে। ও অন্য এক জগতে চলে গেল, রাত্রির জগত। ও একটা বাথটাবকে পাশ কাটিয়ে গেল, যেটার ভেতর বীভৎস কোন জিনিস ডুবে আছে। একটা শব্দ শুনতে পেল ও, ছোট্ট, সুরেলা ঘণ্টার মত, তারপর একটা ঘড়ি দেখতে পেল, একটা কাঁচের গোলকে ঢাকা। এসবকে পেছনে ফেলে ড্যানি এগিয়ে যেতে থাকল।
ও থামল। একটা মৃদু আলো ভেসে আসছিল সামনে থেকে, যেটায় ও দেখতে পাচ্ছিল যে ও একটা পাথুরে মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছে, আর ঘরটার মাকড়সার জালে ভরা। কোন জায়গা থেকে একটা মেশিনের গুঞ্জন ভেসে আসছিল, কিন্তু জোরালো নয়, একঘেয়ে, প্রাচীন।
ওর সামনে টনি দাঁড়িয়ে কি যেন দেখছিল। ওর দৃষ্টি অনুসরণ করে ড্যানি বুঝতে পারল টনি দূরে একজন মানুষের ছায়ার দিকে তাকিয়ে আছ। টনি বলল :
(তোমার বাবা…তোমার বাবাকে দেখতে পাচ্ছ?)
অবশ্যই ড্যানি দেখতে পাচ্ছে, এই আধো অন্ধকারেও ওর নিজের বাবাকে চিনতে কোন ভুল হল না। বাবা একটা টর্চলাইটের আলোতে অনেকগুলো পুরনো কার্ডবোর্ডের বাক্সের মধ্যে কি যেন খুঁজছে। বাবা টর্চটা অন্যদিকে তাক করল। একটা পুরনো বইয়ের দিকে। দেখে মনে হচ্ছিল সাদা চামড়া আর সোনালী সুতো দিয়ে বাঁধাই করা। একটা ক্র্যাপবুক। ড্যানির চেঁচিয়ে বাধা দিতে ইচ্ছে করল বাবাকে, বলতে ইচ্ছে করল যে সব বই খুলে দেখা উচিত নয়। কিন্তু বাবা নিশ্চিত পদক্ষেপে বইটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগল।
ড্যানি যে যান্ত্রিক গুঞ্জনটা শুনতে পাচ্ছিল সেটা আস্তে আস্তে আরও জোরালো হচ্ছে, হৃদস্পন্দনের মত। আর ঘরের স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধটা বদলে একটা তীব্র, কড়া গন্ধের রুপ নিয়েছে। মদের গন্ধ। বাবার শরীরকে গন্ধটা কুয়াশার মত ঘিরে আছে। বাবা এগিয়ে এসে বইটাকে তুলে নিল #
টনি গলা ভেসে এল অন্ধকার থেকে।
(এই অভিশপ্ত জায়গাটা মানুষকে অমানুষ করে দেয়। এই অভিশপ্ত জায়গা)
কথাটা বারবার প্রতিধ্বনিত হতে লাগল।
ড্যানি আঁতকে উঠে অন্ধকার জগতটা থেকে ফিরে এল। ডক্টর বিল ওকে বলছিলেন, “ঠিক আছে ড্যানি, সব ঠিক আছে, তুমি ঠিক আছো…”
ড্যানি আশেপাশে তাকিয়ে ডক্টরের অফিসটা চিনতে পারল। ওর সারা শরীর থরথর করে কাঁপছিল। ডক্টর ওকে জড়িয়ে ধরলেন।
ও একটু শান্ত হলে তারপর এডমন্ডস প্রশ্ন করল, “তুমি মানুষের ব্যাপারে কি যেন বলছিলে?”
“এই অভিশপ্ত জায়গাটা…” ও ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, “মানুষকে অমানুষ করে দেয়…এই অভিশপ্ত জায়গা,” ড্যানি মাথা নাড়ল। “আমার মনে নেই।”
“চেষ্টা কর!”
“পারছি না।”
“টনি কি এসেছিল?”
“হ্যা,”
“ও কি দেখিয়েছে তোমাকে?”
“অন্ধকার। যন্ত্রের শব্দ। মনে নেই।”
“তুমি কোথায় গিয়েছিলে?”
“জানি না! আমি কিচ্ছু জানি না! আমাকে প্রশ্ন করা বন্ধ কর!” ড্যানি ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। ওর স্মৃতিগুলো কুয়াশার মত মিলিয়ে গিয়েছে।
ডক্টর বিল যেয়ে ওয়াটার কুলার থেকে ওর জন্যে এক গ্লাস পানি নিয়ে এলেন। সেটা খাবার পর ও আরেক গ্লাস চাইল। দ্বিতীয় গ্লাসটা খালি হবার পর ড্যানি একটু ধাতস্থ হল।
“ড্যানি, আমি তোমাকে আর কষ্ট দিতে চাই না…” ডক্টর বিল আস্তে আস্তে বললেন, “কিন্তু তোমার কি মনে আছে টনিকে দেখবার আগে তুমি কি ভাবছিলে?”
“হ্যা,” ড্যানি বিড়বিড় করে বলল। “আম্মু আমাকে নিয়ে চিন্তা করছে।”
“আম্মুরা তো সবসময়ই বাচ্চাদের নিয়ে চিন্তা করে, বাবা।”
“না, সেরকম নয়। ছোটবেলায় আম্মুর এইলিন নামে এক বোন ছিল, যে গাড়ির অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। আম্মু তার কথা ভাবছিল। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।”
ডক্টর বিল ওর দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে ছিলেন। “উনি কি এটা কিছুক্ষণ আগে চিন্তা করছিলেন, ওয়েটিং রুমে বসে?”
“জি।”
“ড্যানি, তুমি এটা জানলে কিভাবে?”
“জানি না। হয়তো আমার জ্যোতির কারণে।”
“কি?”
“আমার ভালো লাগছে না। আমি বাবা আর আম্মুর কাছে যেতে চাই।”
“ঠিক আছে ড্যান। তুমি বাইরে যেয়ে ওদের সাথে দেখা করে তারপর
ওদের বল যে আমি ওদের একটু ভেতরে আসতে বলেছি।”
“জি।” ড্যানি দায়িত্বপূর্ণভাবে মাথা নাড়ল।
“গুড বয়।”
ড্যানি একটু হাসল।
“আমি ওর ভেতর কোনধরণের অসুখ খুঁজে পাইনি,” ডক্টর বিল বললেন। “না শারীরিক, না মানসিক। ও অনেক কল্পনাপ্রবণ, এটা ঠিক। অনেক বাচ্চাই কল্পনাপ্রবণ হয়, এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।” উনি একটু থেমে যোগ করলেন, “আর ও প্রচণ্ড বুদ্ধিমান। ওর বয়সী অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় ওর অনেক ভালো বাক্য গঠন ক্ষমতা আছে।”
“অন্য বাবারা বাচ্চাদেরকে নির্বোধ বা অবুঝ মনে করে, কিন্তু আমার তেমন কখনওই মনে হয় নি।” জ্যাকের গলায় চাপা গর্ব
“ড্যানির মত বাচ্চাকে অবুঝ মনে করবার কোন কারণও নেই,” ডক্টর বললেন। “আমার অনুরোধে ড্যানি গতকাল বাথরুমে যা হয়েছিল তার পুনরাবৃত্তি করতে চেষ্টা করে। ও ঠিক সেই অবস্থায় চলে যায় আপনারা যেটার কথা বলেছিলেন। ওর পেশীগুলো ঢিলে হয়ে আসে, চোখ উলটে যায়, আর শরীর ঝুঁকে পড়ে। এই জিনিসটাকে প্রফেশনালরা আত্মসম্মোহন বলে। সত্যি বলতে, জিনিসটা দেখে আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছি।”
টরেন্সরা সোজা হয়ে বসল। “কি হয়েছিল ওর?”
ডক্টর বিল ওদেরকে বললেন সম্মোহিত হবার পর ড্যানি কি কি করেছে, কিভাবে ও নিজের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিল আর কিভাবে ‘অমানুষ’, ‘অন্ধকার’, আর ‘অভিশপ্ত’ এই কথাগুলো বিড়বিড় করেছে।
“টনি, আবার।” জ্যাক মাথা নাড়তে নাড়তে বলল।
“আসলে ব্যাপারটা কি তাকি আপনি বুঝতে পেরেছেন, ডক্টর?” ওয়েন্ডি জানতে চাইল।
“আমি একটা থিওরি দাঁড় করেছি, কিন্তু আপনাদের সেটা পছন্দ নাও হতে পারে।”
“শুনেই দেখি।” জ্যাক বলল।
“ড্যানি আমাকে যা বলল তা শুনে মনে হচ্ছে ওর কাল্পনিক বন্ধু ড্যানি আপনারা বাসা বদলে এখানে আসবার আগ পর্যন্ত ওর উপকারই চাইত। কিন্তু এখানে আসবার পর থেকে টনি বদলে গিয়েছে, ও এখন ড্যানিকে ভয়ংকর, বিভীষিকাময় স্বপ্ন দেখায়। ড্যানির জন্যে ব্যাপারটা আরও কষ্টকর কারণ স্বপ্নে কি দেখেছে তা ওর মনে থাকে না, আর এই অজানা শংকা ওর মনে আরও বেশী করে চেপে বসছে। এটা অবশ্য আমরা প্রায়ই দেখি। মানুষের একটা সহজাত প্রবৃত্তি হচ্ছে ভালো স্বপ্ন মনে রাখা, আর দুঃস্বপ্ন ভুলে যাওয়া। হয়তো আমাদের ব্রেনের অবচেতন আর সচেতন অংশগুলোর মাঝখানে একটা ফিল্টারের মত আছে যেটা মনের গভীরের আতংকগুলো থেকে আমাদের আলাদা রাখতে চায়।”
“তাহলে আপনি বলছেন যে আমরা বাসা বদলেছি দেখে ড্যানির সমস্যা হচ্ছে?” ওয়েন্ডি জিজ্ঞেস করল।
“সম্ভাবনা আছে, বিশেষ করে আপনাদের যদি বাধ্য হয়ে বাসা বদলাতে হয়ে থাকে তাহলে,” ডক্টর জবাব দিলেন। “তাই হয়েছিল কি?”
জ্যাক একটু ইতস্তত করে জবাব দিল, “আমি স্টভিংটনে একটা স্কুলে পড়াতাম, আমার চাকরি চলে গিয়েছিল।”
“বেশ…” ডক্টর চিন্তিত স্বরে বললেন, “আরও একটা কথা। আপনাদের আমি বিব্রত করতে চাই না, কিন্তু ড্যানির ধারণা একসময় আপনারা ডিভোর্স নেবার কথা ভাবছিলেন। যদিও ও এখন আর এটা নিয়ে চিন্তিত নয়, কারণ ওর মনে হয় যে এখন আর আপনাদের মধ্যে কোন সমস্যা নেই।”
জ্যাকের চোয়াল বিস্ময়ে ঝুলে পড়ল, আর ওয়েন্ডি এত জোরে ঝটকা খেল যেন ও শক খেয়েছে। “আমরা কখনও ওটা নিয়ে ওর সামনে কথা বলিনি! ওর সামনে তো দূরে থাক, নিজেদের মধ্যেও না…”
“ডক্টর, আমার মনে হয় আপনাকে সবকিছু খুলে বলাই ভালো,” জ্যাক বলল। “আমার কলেজে থাকতেই মদে আসক্তি ছিল, আর ড্যানির জন্মের পর সেটা হঠাৎ করে বেড়ে যায়। আমি লেখায়ও আমি আর মন দিতে পারছিলাম না। এর মধ্যে একদিন ড্যানি আমার কিছু জরুরি কাগজপত্র নিয়ে খেলতে গিয়ে সেগুলোর ওপর কালি ফেলে দেয়, আর তারপর…” জ্যাকের গলা ধরে এল, যদিও ও নিজের ওপর এতটা নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল যে ওর চোখ থেকে পানি পড়ল না। “হে ঈশ্বর, কথাটা মনে করলেও আমার গা শিউড়ে ওঠে… তখন আমি রাগের মাথায় ওকে মারতে যেয়ে ওর হাত ভেঙ্গে ফেলি। তার তিনমাস পর আমি মদ খাওয়া ছেড়ে দেই, আর এরপর কখনও ড্যানির গায়ে হাত তুলিনি।”
“হম্ম্,” ডক্টর বিল পেছনদিকে হেলান দিলেন। “আমি অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম যে ওর হাতে একটা ফ্র্যাকচার আছে। কিন্তু ওটা নিয়ে ভবিষ্যতে কোন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। আর আসলেই তারপর ওকে কখনও আঘাত করা হয়েছে বলে আমার মনে হয় নি।”
“আমরা জানি সেটা,” ওয়েন্ডি ক্রুদ্ধস্বরে বলল, “জ্যাক তো আর ওকে ইচ্ছা করে ব্যাথা দেয় নি।”
“না ওয়েন্ডি,” জ্যাক আস্তে করে মাথা নাড়ল। “হয়তো আমার মনে গভীরে কোথাও ড্যানিকে ব্যাথা দেয়ার ইচ্ছাটা আসলেই লুকিয়ে ছিল।” জ্যাক ডক্টর বিলের দিকে তাকাল। “জানেন ডক্টর, এই প্রথম আমি আর আমার স্ত্রী ডিভোর্স নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বললাম। ড্যানিকে মারা, অথবা আমার মদের নেশার কথাও আমাদের মধ্যে এই প্রথম হচ্ছে।”
“আর এটাই হচ্ছে প্রধান সমস্যা,” ডক্টর বিল বললেন। “আমি সাইকিয়াট্রিস্ট নই। কিন্তু ড্যানির যদি মানসিক চিকিৎসা লাগে তাহলে আমি এই বোল্ডারেই ভালো একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে চিনি। কিন্তু ওর লাগবে বলে মনে হয়না। ড্যানি একজন বুদ্ধিমান, কল্পনাপ্রবণ আর প্রাণবন্ত ছেলে। আপনাদের দাম্পত্তিক সমস্যা ওর ওপর খুব বেশী প্রভাব ফেলেছে বলে মনে হয় না। ছোট বাচ্চারা অনেক কিছুই সহজে মেনে নিতে পারে, ক্ষমাও করে দিতে পারে।”
জ্যাক নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওয়েন্ডি ওর একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিল।
“কিন্তু ও বুঝতে পেরেছিল যে আপনারা কোন সমস্যার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন। ওর সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা ছিল, নিজের হাত নিয়ে নয়। তাই ও আমাকে ডিভোর্সের কথাটা বলেছে, কিন্তু হাত ভাঙ্গার কথা বলে নি। এমনকি নার্স যখন চেক-আপের সময় ওকে জিজ্ঞেস করেছে ওর হাতে কি হয়েছিল, ড্যানি এমন একটা ভাব দেখায় যেন ওটা কিছুই না।”
“বাচ্চাটা এত ভালো,” জ্যাক বিড়বিড় করল। ওর দুই চোয়াল এত শক্ত হয়ে চেপে বসেছিল যে ওর গালের পেশী ফুলে উঠেছে। “আমরা আগের জন্মে কোন পূণ্য করেছিলাম কে জানে, যে ও আমাদের ঘরে জন্মেছে।”
ডক্টর বিল বললেন, “ও মাঝে মাঝে একটা কাল্পনিক জগতে হারিয়ে যায়। এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, অনেক বাচ্চারই কাল্পনিক বন্ধু থাকে। আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল চাগ-চাগ নামে একটা কথা বলা মোরগ, যে আমার দুই ভাই বাসা ছেড়ে চলে যাবার পর আমার কাছে আসত। বলা বাহুল্য, আমি বাদে আর কেউ ওকে দেখতে পেত না। আর আপনাদের নিশ্চয়ই বলে দিতে হবে না ড্যানির বন্ধুর নাম মাইক অথবা জন না হয়ে টনি হল কেন?”
“না, বুঝেছি,” ওয়েন্ডি বলল।
“ওকে কি কখনও এ কথাটা বলেছেন?”
“না। বলা কি উচিত হবে?” জ্যাক জানতে চাইল।
“দরকার আছে বলে মনে হয়না। ওকে নিজে থেকেই বুঝতে দিন, তাতে ওর উপকার হবে। দেখেন, সাধারণ কাল্পনিক বন্ধুর ক্ষেত্রে যা দেখা যায় তার তুলনায় ড্যানির সাথে টনি সম্পর্কটা আরও গভীর। ড্যানির ওকে দরকার ছিল যাতে ও এসে ড্যানিকে ভালো ভালো জিনিস দেখায়, যাতে ওকে অন্য কোন জাদুর জগতে নিয়ে যায়। একবার জাদুর মত টনি ওকে দেখায় বাবার ট্রাংকটা কোথায় লুকানো আছে, আরেকবার দেখায় বাবা-মা জন্মদিনে ওকে কোথায় নিয়ে যাবে…”
“কিন্তু ও এগুলো জানল কিভাবে?” ওয়েন্ডি বিহ্বল হয়ে প্রশ্ন করল। “ওর তো কিছুতেই এসব জানবার কথায় নয়। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ড্যানির মধ্যে—”
“অলৌকিক ক্ষমতা আছে?” ডক্টর মুখে মৃদু হাসি নিয়ে প্রশ্ন করলেন। “জন্মের সময় ওর মুখ একটা পর্দায় ঢাকা ছিল।” ওয়েন্ডি দুবর্ল স্বরে জবাব দিল।
ডক্টর বিল এবার বেশ জোরে হেসে উঠলেন। জ্যাক আর ওয়েন্ডির মুখেও হাসি দেখা দিল। ওরা একে অপরের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল। ড্যানির এই অদ্ভুত ক্ষমতা হচ্ছে আরও একটা ব্যাপার যেটা নিয়ে ওরা আগে কখনও আলোচনা করে নি।
“এরপর আপনারা বলবেন যে ও আকাশে উড়তেও পারে,” ডক্টর হাসিমুখে বললেন। “না, না, ব্যাপারটা তেমন কিছু নয়। ওর ভেতর যে ক্ষমতা আছে সেটা অলৌকিক নয়, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা। ও জানত আপনার ট্রাংক সিঁড়ির নীচে আছে কারণ বাকি সবগুলো জায়গা তো আপনার খোঁজা হয়ে গিয়েছিল, তাই না, মিস্টার টরেন্স? জিনিসটা খুব সহজ। ভালোভাবে চিন্ত ↑ করলে আপনিও ধরতে পারতেন। আর পার্কে যাবার বুদ্ধিটা প্রথমে কার মাথা থেকে বের হয়? ওর না আপনাদের?”
“ওর, অবশ্যই।” ওয়েন্ডি উত্তর দিল। “টিভিতে সারাক্ষণ ওই পার্কটার বিজ্ঞাপণ দিত, ড্যানি যাবার জন্যে অস্থির হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু আমাদের কাছে ওখানে যাওয়ার মত টাকা ছিল না। আমরা ওকে কথাটা জানিয়েছিলামও।”
জ্যাক যোগ করল, “কিন্তু তার কিছুদিন পর একটা ম্যাগাজিন আমার একটা গল্প পূনঃমুদ্রণ বাবদ আমাকে কিছু টাকা পাঠায়। সেই টাকা দিয়ে আমরা ড্যানিকে পার্কে নিয়ে গিয়েছিলাম।”
ডক্টর কাঁধ ঝাঁকালেন। “ব্যাপারটা আমার কাছে কাকতালীয় বাদে আর কিছু বলে মনে হচ্ছে না।”
“আমার মনে হয় আপনি ঠিকই বলছেন।” জ্যাক বলল।
ডক্টর বিল হেসে বললেন, “ড্যানি নিজেই আমার কাছে স্বীকার করেছে যে টনি ওকে যা দেখায় তা সবসময় সত্যি হয় না। মাঝে মাঝে ড্যানির পর্যবেক্ষণে ভুল হয় আরকি। ড্যানি অবচেতনে তাই করছে যা ভন্ড পীর আর ম্যাজিশিয়ানরা স্বেচ্ছায় করে। ওকে আমার ভালো লেগেছে। যদি ওর এই ক্ষমতা ও ঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারে তাহলে ও ভবিষ্যতে খুব বড় কেউ হতে পারবে।”
ওয়েন্ডি মাথা ঝাঁকাল। অবশ্যই ও একমত যে ড্যানি ভবিষ্যতে বড় কেউ হবে-কিন্তু ডক্টর ওর ক্ষমতার যে ব্যাখা দিলেন সেটা ওর মনঃপূত হয় নি। ডক্টরের এটা জানার কথা নয় যে ড্যানি আরও অনেক সুক্ষ ব্যাপার আগে থেকেই বুঝতে পারে। যেমন লাইব্রেরিতে যেসব বই ফেরত দিতে হবে সেগুলো ও আগে থেকেই গুছিয়ে রাখে, যদিও ও পড়তে পারে না আর ওর জানার কথা নয় কোন বইগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে। তারপর জ্যাক যখন গাড়ি ধোয়ার প্রস্তুতি নেয় তখন ও দেখে ড্যানি আগে থেকেই বালতি নিয়ে ওর জন্যে অপেক্ষা করছে।
ও বলল, “কিন্তু ও এখন দুঃস্বপ্ন দেখছে কেন? টনি ওকে বাথরুমের দরজা লাগাবার নিদের্শই বা কেন দিল?”
“কারণ ড্যানির এখন আর টনিকে দরকার নেই,” ডক্টর বিল বললেন। “টনির জন্ম এমন এক সময়ে যখন আপনার আর আপনার স্বামীর মধ্যে সমস্যা চলছিল। হাত ভাঙ্গার ঘটনাটাও তখন ঘটে। আপনাদের মধ্যে শংকাময় নীরবতা বিরাজ করছিল।”
‘শংকাময় নীরবতা।’ কথাটা ডক্টর ভুল বলেননি, ওয়েন্ডি মনে মনে ভাবল। ওর আর জ্যাকের মধ্যে তখন প্রায় কথা বলাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। জ্যাক রাতভর বাইরে থাকত, আর এদিকে ওয়েন্ডি ড্যানিকে টিভির সামনে বসিয়ে অথবা ঘুম পাড়িয়ে নিজে জেগে সোফায় পড়ে থাকত। রাতের খাবার টেবিলে “লবণটা দিও,” আর “ড্যানি গাজর তোমার স্বাস্থ্যের জন্যে ভালো, খেয়ে নাও,” ছাড়া কোন কথা হত না।
(হে ঈশ্বর, পুরনো ব্যাথা কি কখনও ভোলা যায় না?)
ডক্টর তখনও বলে যাচ্ছিলেন, “এখন অবশ্য দিনকাল পালটে গেছে। মানসিক অসুস্থতা বাচ্চাদের মধ্যে প্রায়ই দেখা দেয়। আমাদের বড়দের সাথে ছোটদের যেন একটা নীরব সমঝোতা হয়েছে। বাচ্চারা একটু পাগলামি করবেই। ওদের অদৃশ্য বন্ধু থাকে, ওদের মন খারাপ থাকলে ওরা ঘরের কোণায় মাথা নীচু করে বসে থাকে, নিজেদের খেলনার সাথে কথা বলে। যদি বড় কেউ এমন করে তাহলে ওকে পাগলাগারদে পাঠাতে আমাদের এক মিনিটও দেরি হয় না, কিন্তু কোন বাচ্চার বেলায় এ ধরণের ব্যবহার একদম স্বাভাবিক। আমরা এসব কিছু একটা কথা বলে উড়িয়ে দেই- “
“যে বড় হলে এসব ঠিক হয়ে যাবে।” জ্যাক ডক্টরের কথাটা শেষ করল। ডক্টর চোখ পিটপিট করলেন। “ঠিক তাই। অস্বীকার করতে পারব না যে ড্যানির সামান্য হলেও মানসিক অসুস্থতা দেখা দেবার আশংকা আছে। পারিবারিক সমস্যা, কাল্পনিক বন্ধু যে শুধু কল্পনায় আটকে থাকতে চায় না, সব মিলিয়ে এই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায় না যে বড় হলে ড্যানি এসব ঠিক না হয়ে আরও খারাপ হয়ে যাবে।”
“ও কি অটিস্টিক হয়ে যেতে পারে?” ওয়েন্ডি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল। অটিস্টিক শব্দটাকে ও যমের মত ভয় পায়। নিজের ছেলেকে ও প্রতিবন্ধী, হুইলচেয়ারবন্দী হিসাবে ভাবতেই পারে না।
“হতে পারে, কিন্তু সম্ভাবনা কম,” ডক্টর বিল বললেন। “একদিন ও হয়তো টনির জগত থেকে আর ফিরে আসবে না।”
“ঈশ্বর।” জ্যাক বলল।
“কিন্তু এত চিন্তার কিছু নেই। আপনারা এখন একসাথে থাকেন, এমন একটা জায়গায় যেখানে একজন আরেকজনের ওপর ভরসা না করে উপায় নেই। ড্যানির এমন পরিবেশই দরকার। তাছাড়া ও যে টনির জগত আর আমাদের জগতের পার্থক্য বুঝতে পারে এতেই বোঝা যায় যে ওর মানসিক অবস্থা খুব একটা সঙ্গীন নয়। ও বলল আপনারা ডিভোর্সের চিন্তা বাদ দিয়ে দিয়েছেন। কথাটা কি সত্যি?”
“জি,” ওয়েন্ডি বলল। জ্যাক ওর হাত নিজের মুঠোয় চেপে ধরল, এত জোরে যে ওয়েন্ডি একটু ব্যাথা পেল। জবাবে ওয়েন্ডিও জ্যাকের হাত চেপে ধরল।
এডমন্ডস মাথা ঝাঁকালেন। “ড্যানির আর টনিকে দরকার হবে না। ও নিজেই টনিকে নিজের মাথা থেকে দূর করে দেবে। টনি হয়তো সহজে যেতে চাইবে না, কিন্তু ড্যানির ওপর আমার ভরসা আছে।”
ডক্টর উঠে দাঁড়ালেন। তার সাথে সাথে টরেন্সরাও উঠে দাঁড়াল।
“আবারও বলছি, আমি সাইকিয়াট্রিস্ট নই, মিস্টার টরেন্স। যদি দেখেন শীতকাল শেষ হবার পরও ড্যানি দুঃস্বপ্ন দেখছে তাহলে আমি জোর দিয়ে বলছি ওকে একজন অভিজ্ঞ সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে নিয়ে যেতে।”
“বেশ।”
“আমি আপনাকে ধন্যবাদ দিতে চাই, ডক্টর,” জ্যাক যন্ত্রণাজড়িত মুখে বলল। “অনেকদিন পর এসব নিয়ে কথা বলতে পেরে আমার উপকার হয়েছে।”
“আমারও।” ওয়েন্ডি বলল।
ওরা বেরিয়ে যাবার সময় ডক্টর এডমন্ডস প্রশ্ন করলেন, “মিসেস টরেন্স, আপনার কি এইলিন নামে কোন বোন ছিল?”
ওয়েন্ডি বিস্মিত চোখে ওনার দিকে তাকাল। “হ্যা, আমার বয়স যখন দশ আর ওর ছয় তখন ও মারা যায়। রাস্তা থেকে একটা বল তুলে আনবার সময় একটা ট্রাক ওকে চাপা দিয়ে দেয়।”
“ড্যানি কি এ কথাটা জানে?”
“আমি জানি না। মনে হয় না।”
“ও বলল যে আপনি ওয়েটিং রুমে এইলিনের কথা চিন্তা করছিলেন।”
“হ্যা, আসলেই করছিলাম…বহুদিন পর ওর কথা মনে পড়ল।” ওয়েন্ডি আস্তে আস্তে বলল।
“রেডরাম কথাটা কি আপনাদের কাছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ?”
ওয়েল্ডি মাথা নাড়ল, কিন্তু জ্যাক বলে উঠল, “ও কালকে এ কথাটা বলছিল, জ্ঞান ফিরবার পরে। রেড ড্রাম।”
“না, রাম,” ডক্টর শুধরে দিলেন। “ও এ কথাটা বেশ জোর দিয়ে বলেছে। রাম।”
“হম্ম্,” জ্যাক রুমাল বের করে নিজের ঠোঁট মুছল।
“জ্যোতি কথাটা কি আপনাদের কাছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ?” এবার ওরা দু’জনই মাথা নাড়ল।
“যাক, জিনিসটা তেমন জরুরি নয়।”
ডক্টর এসে ওয়েটিং রুমের দরজা খুলে দিলেন। “এখানে ড্যানি টরেন্স নামে কেউ আছে যে বাড়ি যেতে চায়?”
ড্যানি একটা বাচ্চাদের পত্রিকা হাতে নিয়ে ছবি দেখছিল। বাবা-মাকে বের হতে দেখে ও লাফিয়ে উঠল।
ও দৌঁড়ে জ্যাকের কাছে এল, যে ওকে কোলে তুলে নিল।
ডক্টর বিল হাসিমুখে বললেন, “যদি বাবা-মাকে ভালো না লাগে তাহলে আমার সাথে থেকে যাও।”
“না, না।” বলতে বলতে ড্যানি এক হাত দিয়ে বাবার আর অন্য হাত দিয়ে মায়ের গলা পেঁচিয়ে ধরল। ওরা তিনজনই হাসছিল।
ডক্টর জ্যাককে বললেন “যদি কোন দরকার হয় তাহলে আমাকে ফোন দেবেন।”
তারপর একবার ওদের তিনজনের দিকে তাকিয়ে আবার বললেন, “কিন্তু দরকার হবে বলে মনে হচ্ছে না।”
অধ্যায় ১৮ – স্ক্র্যাপবুক
জ্যাক স্ক্র্যাপবুকটা প্রথম খুঁজে পায় ১লা নভেম্বরে। ওয়েন্ডি আর ড্যানি সেদিন রোকে কোর্টের পেছনের রাস্তাটা ধরে হাঁটতে গিয়েছিল। রাস্তাটার শেষ মাথায় একটা পুরনো, পরিত্যক্ত কাঠ কাটার মিল আছে, সেটা দেখা ছিল ওদের উদ্দেশ্য। আবহাওয়া, তখনও ভালোই ছিল। শীত পড়া শুরু করে নি।
জ্যাক বেসমেন্টে নেমে এসেছিল বয়লারটা চেক করবার জন্যে। এসে ও কি মনে করে একটা টর্চলাইট হাতে নিয়ে স্তুপ করা কাগজগুলোর ওপর আলো ফেলে দেখতে লাগল। ওর অবশ্য এখানে আসার আরেকটা উদ্দেশ্য ছিল। এখানে ইঁদুরের ফাঁদ দেবার জন্যে কোন জায়গাগুলো সবচেয়ে উপযুক্ত হবে তা খুঁজে বের করা।
ও বেসুরো শিস দিতে দিতে লাইটটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে দেখতে লাগল। পচে যাওয়া কাগজের গন্ধ আর বয়লারের যান্ত্রিক শব্দ এখানকার পরিবেশটাকে রীতিমত অস্বস্তিকর করে তুলেছে।
এখানে পেপার আর হিসাবের খাতা স্তূপ করে রাখা। জ্যাক মাঝে মাঝে এক একটা দলিল হাতে তুলে দেখছিল কোনটা কিসের।
ছাদের দিকে লাইটটা তাক করাতে ও দেখতে পেল যে ছাদের মাঝখান থেকে একটা পুরনো, মাকড়সার জালে ঢাকা বাল্ব ঝুলছে। কিন্তু আলো জ্বালাবার কোন সুইচ বা চেইন নেই। ও পায়ের আঙুলের ওপর ভর করে দাঁড়াতেই লাইটটা ওর নাগালে চলে এল। ও বাল্বটা খুলে আবার শক্ত করে লাগাল। দুর্বল একটা আলো ফুটে উঠল বটে, কিন্তু সেটা ঘরের অন্ধকার দুর করতে কোন সাহায্যই করল না। জ্যাক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার ফ্ল্যাশলাইটের আলোতে ফিরে গেল।
জ্যাক পেপারের স্তুপগুলোর ওপর আলো ফেলে ইঁদুরের বিষ্ঠা খুঁজতে লাগল। কিছু চিহ্ন ও খুঁজে পেল ঠিকই, কিন্তু দেখে মনে হচ্ছিল না এগুলো সাম্প্রতিক। সত্যি বলতে জ্যাকের মনে হচ্ছিল গত কয়েক বছরে এখানে কোন ইঁদুর পা ফেলেনি।
জ্যাক একটা পেপার হাতে তুলে দেখল যে সেটা ছাপা হয়েছিল ১৯৬৩ সালে। প্রেসিডেন্ট কেনেডির ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা হচ্ছে হেডলাইনের বিষয়বস্তু। জ্যাকের মজা লাগল। পুরনো খবরের কাগজ ঘাটলে মনে হয় যে ও ইতিহাস চোখের সামনে ঘটতে দেখছে। কিন্তু ও রেকর্ডগুলোর কয়েকটা জায়গায় ফাঁক দেখতে পেল। যেমন ১৯৩৭-১৯৪৫ সাল পর্যন্ত, ১৯৫৭-১৯৬০, আবার ১৯৬৩-১৯৬৫ সালের কোন রেকর্ড নেই। ওই সময়গুলোতে বোধহয় হোটেল বন্ধ ছিল।
একটা জিনিস জ্যাকের এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। আলম্যান ওকে ওভারলুকের ইতিহাস বলবার সময় বলেছিল যে এই হোটেলটা মাত্র কিছুদিন হল লাভ করা শুরু করেছে। কিন্তু এটা জ্যাকের কাছে এখন অযৌক্তিক মনে হচ্ছে। হোটেলটা যে অদ্ভুত সুন্দর জায়গায় অবস্থিত শুধু সেটা দেখতেই এই হোটেলে বহু মানুষের থাকতে আসার কথা। তাছাড়া আমেরিকায় বহু লোকেরই খরচ করবার মত যথেষ্ট টাকা রয়েছে। হিলটন, ওয়ালডর্ফ- অ্যাস্টরিয়ার মত বড় বড় হোটেলের পাশে আজ ওভারলুকের নামও শুনতে পাবার কথা। নিশ্চয়ই হোটেলের ম্যানেজারদেরই ভুল ছিল।
এই রুমটায় ইতিহাস লুকিয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু শুধু খবরের কাগজের পাতায় নয়। হিসাবের খাতাগুলোও পুরনো দিনের লেনদেন, চাহিদা আর কাজকর্মের সাক্ষী দিচ্ছে। ১৯২২ সালে ওয়ারেন হার্ডিং এক বাক্স বিয়ার আনান হোটেলে। কিন্তু এই বিয়ারটা উনি কার সাথে খাবার জন্যে এনেছিলেন? ওনার কোন বন্ধু? হোটেলের কোন অতিথি?
নিজের ঘড়ির দিকে চোখ পড়াতে জ্যাক বিস্মিত হল। কখন ৪৫ মিনিট কেটে গেছে ও বুঝতেই পারে নি। ও ঠিক করল ওয়েন্ডি আর ড্যানি ফিরে আসবার আগে ও উপরে যেয়ে গোসল করবে। এখানে এতক্ষণ থাকতে থাকতে ওর গায়েও নিশ্চয়ই গন্ধ হয়ে গেছে।
কাগজের পর্বতগুলোর মাঝখান দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জ্যাক নিজের ভেতর একধরণের উত্তেজনা অনুভব করল। ওর মাথায় একটা বই লেখার চিন্তা ঘুরছে। কে জানে, এই ইতিহাস-সমৃদ্ধ ঘরটার মধ্যে ঘুরতে ঘুরতেই হয়তো ও একটা বইয়ের প্লট পেয়ে যাবে।
মাকড়সার জালে ঢাকা বাল্বটার নীচে দাঁড়িয়ে ও একটা রুমাল বের করে ঠোঁট মুছল। ঠিক তখনই ওর চোখে পড়ল বইটা।
ওর হাতের বাঁ দিকে পাঁচটা বাক্সের একটা স্তূপ দাঁড়া করানো ছিল। আর সেটার মাথায়, একটা বাক্সের কোণা থেকে বেরিয়ে ছিল একটা সাদা চামড়ায় বাঁধানো মোটা বইয়ের কভার। বইটা সোনালী সুতো দিয়ে বাঁধা ছিল।
জ্যাক কৌতূহলী হয়ে বইটা নামাল। কভারটা ধুলোয় ঢাকা পড়ে গিয়েছে। ও একটা ফুঁ দিতেই একরাশ ধুলো উড়ল। জ্যাক বইটা খুলল। কভারটা খুলতেই একটা কার্ড পড়ল ভেতর থেকে। মাটিতে পড়ার আগেই জ্যাক খপ করে কার্ডটা ধরে ফেলল। কার্ডটাতে ওভারলুক হোটেলের একটা সুন্দর ছবি খোদাই করা। সবগুলো জানালায় আলো জ্বলছে, সামনে ছড়িয়ে আছে বড় লন আর খেলার কোর্টগুলো। দেখে মনে হচ্ছে পা বাড়ালেই ছবিটার ভেতর ঢুকে যাওয়া যাবে। ওভারলুকের ত্রিশ বছর আগেকার চেহারা। কার্ডে লেখা :
হোরেস ডারওয়েন্ট আপনাকে আমন্ত্রণ করছে
মাস্ক বল ড্যান্স পার্টিতে উপস্থিত
থাকবার জন্যে
ওভারলুক হোটেল
উদ্বোধন উপলক্ষে
খাবার পরিবেশন রাত ৮টায়
মুখোশ উন্মোচন এবং ড্যান্স মধ্যরাতে
অগাস্ট ২৯, ১৯৪৫
পড়তে পড়তে জ্যাকের সামনে পুরো দৃশ্যটা ভেসে উঠল। আমেরিকার সবচেয়ে ধনী আর অভিজাত পুরুষ আর মহিলারা। ছেলেরা সবাই চকচকে কালো টাক্সিডো আর সাদা শার্ট পড়ে আছে আর মেয়েরা পড়ে আছে দামী ইভিনিং গাউন। সবার মুখেই সুক্ষ কারুকাজ করা মুখোশ। গ্লাসের সাথে গ্লাস ঠোকার তীক্ষ্ণ, মিষ্টি শব্দ ভেসে আসছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রায় শেষ। আমেরিকা এখন বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী দেশগুলোর মধ্যে একটা, পার্টি করবার এর চেয়ে ভালো সময় আর হতে পারে না।
আর মধ্যরাতে ডারওয়েন্টের গলা অন্য সবার গলাকে ছাপিয়ে বলে উঠল, “মধ্যরাত! মধ্যরাত! মুখোশ খুলে ফেলবার সময় হয়ে গেছে!”
(লাল মৃত্যু সবার দিকে ধেয়ে আসছে!)
জ্যাক ভ্রু কুঁচকাল। হঠাৎ করে ওর এ কথাটা মনে হল কেন? এটা এডগার অ্যালান পো এর লেখা একটা লাইন, একজন পুরনো আমেরিকান কবি আর ঔপন্যাসিক। কিন্তু তাঁর সব লেখা অত্যন্ত বিষণ্ন, আর রোমাঞ্চকর। জ্যাকের আগের চিন্তাগুলোর সাথে এই লাইনটা একদমই যায় না।
জ্যাক কার্ডটা বইয়ের ভেতরে রেখে প্রথম পাতাটার দিকে তাকাল। ভেতরে একটা খবরের কাগজের কাটা অংশ আঠা দিয়ে লাগানো। খবরটা হচ্ছে ওভারলুক হোটেলের পুণঃউদ্বোধনের ওপর। রহস্যময় কোটিপতি ব্যাবসায়ী হোরেস ডারওয়েন্ট ওভারলুক হোটেলকে বিশ্বের সবচেয়ে ভালো হোটেলগুলোর মধ্যে একটা বানাতে চান। উনি আরও বলেছেন যে উনি চান না ওভারলুকে জুয়া খেলবার ব্যাবস্থা থাকুক, কারণ সেটা হোটেলের ভাবমূর্তির সাথে যায় না। রিপোর্টার হোটেলের উদ্বোধনী পার্টি নিয়েও মন্তব্য করেছেন, যে আমেরিকার নামীদামী সবাই সেখানে থাকবে…
ঠোঁটে মুচকি হাসি নিয়ে জ্যাক পাতা ওলটাল। পরের পৃষ্ঠায় নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ছাপা ওভারলুকের একটা রঙ্গিন বিজ্ঞাপণ। তার পরের পৃষ্ঠায় হচ্ছে ডারওয়েন্টকে নিয়ে একটা লেখা, সেখানে তার একটা ছবিও আছে। মাথার চুল কমে আসা, সরু গোঁফওয়ালা একজন লোক যার চোখ একটা ছবির ভেতর থেকেও মানুষের মনের কথা পড়ে ফেলবার ক্ষমতা রাখে।
জ্যাক লেখাটায় চোখ বুলাল। ডারওয়েন্টের ব্যাপারে ওর আগে থেকেই ধারণা আছে, পত্রিকায় পড়েছে। দরিদ্র পরিবারে জন্ম, স্কুলের পড়ালেখা শেষ করবার আগেই নেভীতে যোগ দেয়। সেখানে তার দ্রুত উন্নতি হয়, কিন্তু নিজের ডিজাইন করা একটা ইঞ্জিন নিয়ে তর্ক করে চাকরি ছেড়ে দিয়ে আসে। ওই ডিজাইনের পেটেন্ট উনি নেভীকে দিতে বাধ্য হলেও পরে নিজে থেকে আরও বেশ কিছু জিনিস আবিষ্কার করে ক্ষতিটা পুষিয়ে নেন।
তার কিছুদিন পর ডারওয়েন্ট নজর দেন এরোপ্লেনের ব্যবসার দিকে। সেখানেও নানা চমকপ্রদ ব্যবসায়িক আইডিয়া আর নতুন নতুন আবিষ্কারের সাহায্য নিয়ে খুব সময়ের মাঝেই সাফল্যের মুখ দেখেন। আর এর পাশাপাশি ডারওয়েন্ট বিভিন্ন ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে থাকেন। অস্ত্র বাণিজ্য, গার্মেন্টস, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, সবকিছুর সাথেই উনি জড়িত ছিলেন।
জ্যাকের মনে পড়ল যে কিছু পক্ষ একসময় বলাবলি করেছে যে ডারওয়েন্টের সব ব্যবসা নাকি সৎ ছিল না। মদের চোরাচালান, বেশ্যাবাণিজ্য আর বেআইনী জুয়ার আড্ডাও নাকি ওনার ব্যবসার তালিকায় ছিল।
ডারওয়েন্টের সবচেয়ে বিখ্যাত ব্যবসায়িক লেনদেন হচ্ছে উনি যখন ঘোষনা দেন যে উনি টপ মার্ক স্টুডিও কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। স্টুডিওটা বেশ কিছুদিন আগে থেকেই বন্ধ হয়ে পড়েছিল, ওদের সবচেয়ে বড় তারকা মারা যাবার পর থেকে।
ডারওয়েন্ট হেনরী ফিংকেল নামে এক ঘাঘু ব্যবসায়ীকে নিয়োগ করেন টপ মার্ক চালাবার জন্যে, আর তার পরের কয়েক বছরের মধ্যেই টপ মার্ক থেকে ষাটটা ছবি বের হয়ে যায়। এদের মধ্যে বেশীরভাগই ছিল অত্যন্ত সফল ছায়াছবি। একটা সিনেমায় নায়িকা একটা নতুন ডিজাইনের গাউন পড়ে যেটাতে তার নিতম্বের ভাঁজের নীচে যে জন্মদাগ সেটা ছাড়া সবই দেখা যাচ্ছিল। বলা বাহুল্য, এটা নিয়ে নিন্দা যেমন হয়েছিল তেমন আলোড়ন ও উঠেছিল। সিনেমা সুপারহিট, আর ডারওয়েন্ট আরও আলোচিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সারা পৃথিবীর জন্যে দুঃখ বয়ে আনলেও ডারওয়েন্টের জন্যে বয়ে আনে সাফল্য। এসময় গুজব ছড়ায় যে উনি বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি।
কিন্তু এমন একজন মানুষও ওভারলুকের জন্যে সাফল্য নিয়ে আসতে পারে নি। জ্যাক চিন্তামগ্ন অবস্থায় নিজের বুকপকেট থেকে একটা নোটবুক আর পেন্সিল বের করল। ও ছোট্ট একটা নোট লিখল নিজেকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে যে ডারওয়েন্টকে নিয়ে ওর ভবিষ্যতে আরও পড়ালেখা করতে হবে। নোটবুক আর পেন্সিল পকেটে ফেরত গেল। জ্যাকের মুখ শুকনো দেখাচ্ছিল, আর ও বারবার রুমাল দিয়ে ঠোঁট মুছছে।
ও স্ক্র্যাপবুকটা আবার খুলে পরের কয়েকটা ছবি আর লেখার ওপর চোখ বুলাল। ও নিজেকে কথা দিল যে পরে ও বইটা মনোযোগ দিয়ে পড়বে।
হঠাৎ একটা কাটিং এ ওর চোখ আটকে গেল।
কাটিংটা একটা খবরের কাগজ থেকে নেয়া। সেখানে সাংবাদিক জানিয়েছে যে কোটিপতি হোরেস ডারওয়েন্ট কলোরাডোতে নিজের যত ব্যবসায়িক সম্পত্তি আছে সব বিক্রি করে দিচ্ছেন ক্যালিফোর্নিয়ার একদল ব্যাবসায়ীর কাছে। তেল, কয়লা আর জমির পাশাপাশি এই সম্পত্তিগুলোর মধ্যে ওভারলুক হোটেলও আছে।
জ্যাকের কেন যেন খবরটা অদ্ভুত লাগল। ডারওয়েন্ট কলোরাডোতে অবস্থিত নিজের সমস্ত সম্পতি বিক্রি করেছেন, শুধু ওভারলুক নয়, কিন্তু তারপরও…তারপরও…
জ্যাক রুমাল দিয়ে নিজের ঠোঁট মুছল। এক গ্লাস মদ হাতে থাকলে এখন জিনিসটা জমে যেত। ও আরও পৃষ্ঠা ওলটাল।
হোটেলটা তারপর আরও কয়েকবার হাত বদল করে। ক্যালিফোর্নিয়া থেকে মালিকানা আবার কলোরাডোর একটা গ্রুপের কাছে আসে, যেটার মালিকের নামে দুর্নীতির অভিযোগ আনে আদালত। সে কোর্টে শুনানির আগের দিন আত্মহত্যা করে।
তারপর হোটেলটা দীর্ঘ দশ বছর বন্ধ থাকে। স্ক্র্যাপবুকটায় এসময়ে তোলা কিছু ছবিও আছে। ছবিগুলো দেখে জ্যাকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠল। হোটেলের জানালাগুলো ভাঙ্গা, দেয়ালের রঙ উঠে গেছে। পোর্চের সিঁড়িগুলোতে ফাঁটল ধরেছে। জ্যাক মনে মনে নিজের কাছে প্রতিজ্ঞা করল যে এখন থেকে ও হোটেলটার আরও ভালো যত্ন নেবে। ও আগে বুঝতে পারে নি যে ওর দায়িত্বটা কত গুরুত্বপূর্ণ। এই হোটেলটাকে সংরক্ষণ করা আর ইতিহাস সংরক্ষণ করা একই কথা।
১৯৬১ এর দিকে চারজন লেখক হোটেলটা কিনে নিয়ে একটা রাইটিং স্কুল হিসাবে চালু করে। কিন্তু একজন মাতাল ছাত্র চারতলার জানালা থেকে পড়ে মারা যাবার পর স্কুলের সমাপ্তি ঘটে।
সব বড় বড় হোটেলের নামেই গুজব, বদনাম শোনা যায়, ওয়াটসন বলেছিল। আর সব হোটেলেই ভূত দেখা যায়। কেন? এখানে সবসময় মানুষের আসা-যাওয়া চলতেই থাকে…
হঠাৎ করা জ্যাকের মনে হল যে পুরো ওভারলুকের ভার ওর পিঠে চেপে বসেছে। ওর ওপর পড়ছে একশত দশটা গেস্ট রুম, রান্নাঘর, লাউঞ্জ, ডাইনিং রুমের ওজন…
(এখানে মানুষের আসা-যাওয়া চলতেই থাকে)
(লাল মৃত্যু সবার দিকে ধেয়ে আসছে!)
জ্যাক ঠোঁট মুছে আবার পাতা ওলটাল। ও এখন বইয়ের শেষের দিকে চলে এসেছে। প্রথমবারের মত ওর মাথায় একটা প্রশ্নের আবির্ভাব হল, এটা আসলে কার বই? কে এটাকে এখানে রেখে গিয়েছে?
একটা নতুন হেডলাইন, ১লা এপ্রিল, ১৯৬৩।
এটাতে লেখা কিভাবে ওভারলুক হোটেলকে লাস ভেগাসের একদল হোটেল মালিক কিনে নিয়ে সেখানে ক্যাসিনো খুলতে চায়। ওভারলুকের নাম বদলে গিয়ে হবে কী ক্লাব। কিন্তু এই মালিকরা আসলে কারা সে ব্যাপারে কেউই মুখ খুলছে না।
পরের পৃষ্ঠার খবরটা রীতিমত চমকপ্রদ। সাংবাদিকের ধারণা যে লাস ভেগাসের এই হোটেল মালিকদের আড়ালে আসলে আছেন ডারওয়েন্ট নিজেই! কিন্তু ডারওয়েন্ট এখন আর কোন সংবাদপত্রের সাথে কথা বলেন না, এমনকি তাকে সাধারণ মানুষ অনেকদিন পর্যন্ত চোখেই দেখে নি। তাই কেউ বুঝতে পারছে না যে ডারওয়েন্টের ওভারলুক আবার কিনে নেবার ব্যাপারটা কি গুজব না সত্যি।
তার পরের খবরটায় সাংবাদিকের জল্পনা কল্পনা আরও বেড়ে গেছে। উনি দাবী করছেন যে ডারওয়েন্ট লাস ভেগাসের যেসব ব্যাবসায়ীর সাথে মিলে ওভারলুক কিনেছেন তারা সবাই কুখ্যাত অপরাধ সংস্থা মাফিয়ার সাথে জড়িত। মাফিয়ার বেশ কিছু উচ্চ পদধারী সদস্যকে ওভারলুকে আনাগোনা করতে দেখা গিয়েছে।
কাটিংটায় আরও অনেক কিছু লেখা ছিল কিন্তু জ্যাক শুধু সেগুলোর ওপর চোখ বুলিয়ে গেল। জ্যাকের চোখ জ্বলজ্বল করছিল। উফ্ কি চমৎকার একটা প্লট! কোটিপতি ব্যাবসায়ী, সিনেমার নায়িকা থেকে শুরু করে গ্যাংস্টার পর্যন্ত সবই আছে। জ্যাক আবার নোটবুক বের করে দ্রুত নতুন একটা নোট লিখে নিল। এই চাকরিটা শেষ হলে ডেনভারের লাইব্রেরিতে গিয়ে এখানে যেসব মানুষের কথা বলা আছে তাদের ব্যাপারে আরও পড়ালেখা করতে হবে। সব হোটেলেই ভূত থাকলেও, ওভারলুকে একটু বেশী আছে বলেই মনে হচ্ছে। প্রথমে আত্মহত্যা, তারপর মাফিয়া, এখানে আরও কি কি হয়েছে কে জানে।
তারপরের পৃষ্ঠার কাটিংটা এত বড় যে সেটা বইয়ে আঁটাবার জন্যে ভাঁজ করতে হয়েছে। ভাঁজটা খুলতেই জ্যাকের মুখ থেকে একটা হালকা শিস বেরিয়ে এল। ছবিটা এত জীবন্ত যে মনে হচ্ছে পাতা থেকে এখনই বেরিয়ে আসবে। প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটের পশ্চিমা জানালার ছবি। কিন্তু সুন্দর রুমটাকে ম্লান করে দিয়েছে ভয়ংকর একটা দৃশ্য। সুইটের বাথরুমের সাথে লাগানো দেয়ালটা ঢেকে আছে রক্ত আর ফ্যাকাশে মগজের টুকরোয়। রুমের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে একজন শুকনো চেহারার পুলিশ অফিসার, আর তার পাশে মেঝেতে শোয়ানো সাদা কাপড়ে ঢাকা একটা লাশ। জ্যাক বিস্ফারিত চোখে কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর হেডলাইনের দিকে ওর চোখ পড়ল।
কলোরাডোর হোটেলে সন্ত্রাসের মরণ ছোবল
কুখ্যাত অপরাধী নেতা সহ আরও দু’জন নিহত
বিস্তারিত রিপোর্টে লেখা যে মৃতেরা হচ্ছে খুনের আসামী এবং কথিত মাফিয়া নেতা ভিতোরিও জিনেলি আর তার দুই বডিগার্ড। হোটলের ম্যানেজার রবার্ট নরম্যান গুলির আওয়াজ শুনতে পেয়ে পুলিশে খবর দেয়, আর হোটেলের একজন দারোয়ান দাবী করে যে সে মুখে মুখোশ পড়া দু’জন লোককে ফায়ার এস্কেপের সিঁড়ি বেয়ে পালাতে দেখেছে। পুলিশ রুমে ঢুকবার পর লাশ আবিষ্কার করে। তারা ধারণা করছে যে এদের তিনজনকে খুব কাছ থেকে শটগান দিয়ে গুলি করা হয়েছে।
কাটিংটার নীচে বলপয়েন্ট কলম দিয়ে একটা কথা লেখা : “ওর অন্ডকোষও কেটে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।” লেখাটার দিকে জ্যাক অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকল। ওর মুখ শুকিয়ে গিয়েছে। কার বই এটা?
জ্যাক একটা ঢোক গিলে পৃষ্ঠা উলটালো। আরেকটা কাটিং, এটার তারিখ হচ্ছে ১৯৬৭ সালের শুরুর দিকে। জ্যাক শুধু হেডলাইনটা পড়ল।
অশুভ হোটেলের মালিকানার পুনরায় হাত বদল
এর পরের পৃষ্ঠাগুলো খালি। জ্যাক আবার বইয়ের সামনের পাতাগুলো উলটে পালটে দেখল। বইটা আসলে কার এটা জানতে না পেরে ওর অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু কোথাও কোন নাম বা ঠিকানা লেখা নেই। ও খুঁজে দেখল বইটার গায়ে কোন রুম নাম্বার লেখা আছে কিনা, কারণ ও এ ব্যাপারে নিশ্চিত ছিল যে এটা যার বই সে কোন না কোন সময়ে ওভারলুকে থেকেছে। কিন্তু ও তাও পেল না।
জ্যাক নিজেকে প্রস্তুত করল বইয়ের সবগুলো কাটিং পড়ে দেখবার জন্যে কিন্তু একটা সুরেলা গলা ওর পরিকল্পনায় বাধা দিল : “জ্যাক? তুমি কি নীচে?”
ওয়েন্ডি।
জ্যাক চমকে উঠল। ওর ভেতর কেন যেন একটু অপরাধবোধ মাথাচাড়া দিল। যেন ও চুরি করে মদ খাচ্ছিল এমন সময় ওয়েন্ডি ওকে দেখে ফেলেছে। হাস্যকর। ও জবাব দিল, “হ্যা জান, ইঁদুরের ফাঁদ দেবার জায়গা খুঁজছি।”
জ্যাক ওয়েন্ডির পায়ের শব্দ শুনতে পেল। ও সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে। দ্রুত, কোন কিছু চিন্তা না করেই জ্যাক নিজের হাতের বইটা এক গোছা পেপারের নীচে লুকিয়ে ফেলল।
রুমের আবছা আলোতে ওয়েন্ডির চেহারা ফুটে উঠল
“এতক্ষণ ধরে এখানে কি করছ? ৩টা বেজে গেছে!”
জ্যাক হাসল। “এত দেরী হয়ে গেছে নাকি? এখানে কাগজপত্রের মাঝে হারিয়ে গিয়েছিলাম। এখানে শত শত রহস্য লুকানো আছে।”
কথাটা ও হাস্যচ্ছলে বলতে চাইলেও ওর গলাটা কেমন যেন অদ্ভুত শোনাল।
ওয়েন্ডি ওর দিকে এক কদম এগিয়ে এল, আর জ্যাকের শরীর নিজে থেকেই এক কদম পিছিয়ে গেল। ও জানত ওয়েন্ডি কি করার চেষ্টা করছে। গন্ধ শুঁকে বুঝবার চেষ্টা করছে জ্যাক মদ খেয়েছে কিনা। হয়তো ওয়েন্ডি নিজেও জিনিসটা চিন্তা করে করে নি। কিন্তু জ্যাকের তাও মেজাজ খারাপ হল। রাগ আর অপরাধবোধ।
“তোমার মুখ থেকে রক্ত পড়ছে।” ওয়েন্ডি ওর দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত, স্থির
গলায় বলল।
“কি?” জ্যাক নিজের ঠোঁটে হাত দিয়ে তীক্ষ্ণ জ্বলুনি অনুভব করল। ওর আঙুলের দিকে তাকিয়ে দেখল যে রক্ত লেগে আছে। ওর অপরাধবোধ আবার বেড়ে গেল।
“তুমি আবার নিজের মুখ ঘষা শুরু করেছ।” ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল। “হ্যা, বোধহয়।” জ্যাকের জবাব।
“তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে, তাই না?”
“না, তেমন একটা নয়।”
“আস্তে আস্তে কি জিনিসটা সয়ে আসছে?”
জ্যাকের পা ওর কথা শুনতে না চাইলেও জ্যাক জোর করে ওয়েন্ডির দিকে এগিয়ে এল। ও নিজের বউয়ের কোমড় জড়িয়ে ধরে ওর গলায় চুমু খেল। “হ্যা,” ও বলল। “ড্যানি কোথায়?”
“আশেপাশেই আছে। বাইরে আকাশে মেঘ করছে। তোমার ক্ষিদে পায়নি?”
জ্যাক সুযোগ বুঝে ওয়েন্ডির টাইট জিন্সে ঢাকা নিতম্বে একটা হাত বুলালো। “অনেক, ম্যাডাম।”
ওয়েন্ডি কপট রাগের সুরে বলল, “খুব বাড় বেড়েছ, তাই না?”
জ্যাক হাত না সরিয়ে নির্লজ্জ একটা হাসি দিল। ওয়েভিও হাসল।
ওরা বেসমেন্ট থেকে বেরিয়ে যাবার সময় জ্যাক ঘাড় ঘুড়িয়ে ওই কাগজের স্তূপটার দিকে তাকাল যেটার ভেতর ও ক্র্যাপবুকটা।
(কার?)
লুকিয়ে রেখেছে।
জ্যাকের আবার ওয়াটসনের কথাটা মনে পড়ল। সব হোটেলেই ভূত দেখা যায়। এসব জায়গায় মানুষের আসা-যাওয়া চলতেই থাকে…
ওয়েন্ডি বেরিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। রুমটা আবার ঢাকা পড়ে গেল অন্ধকারে।
অধ্যায় ১৯ – ২১৭ নং রুমের বাইরে
ড্যানির মাথায়ও আরেকজনের কাছে শোনা কিছু কথা ঘুরছিল :
ও একটা রুমের ভেতর খারাপ কিছু দেখেছে…রুম নং ২১৭…আমাকে কথা দাও তুমি কখনও ওখানে যাবে না, ড্যানি…কথা দাও…
ড্যানি এখন রুমটার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। দরজাটার সাথে এই লবির, এমনকি এই হোটেলের অন্যান্য রুমগুলোর দরজার কোন পার্থক্য নেই। গাঢ় ধুসর রঙের, ধাতব তিনটে নাম্বার লাগানো একটা দরজা। দরজাটায় একটা পিপহোল আছে, যেটা দিয়ে রুমের ভেতর থেকে দেখলে বাইরেটা দেখতে কিম্ভুত, গোলাকার লাগে আর বাইরে থেকে দেখলে কিছুই দেখা যায় না।
(তুমি এখানে কি করছ?)
ওরা হাঁটা শেষে ফিরে আসবার পর আম্মু ওকে ওর পছন্দের লাঞ্চ বানিয়ে দেয়। স্যান্ডউইচ আর সুপ। ওরা ডিকের কিচেনে বসে গল্প করতে করতে খেয়ে নেয়। পুরো হোটেলের মধ্যে কিচেন হচ্ছে ড্যানির সবচেয়ে পছন্দের জায়গা, আর ওর ধারণা বাবা আর আম্মুও কিচেনটাকে অনেক পছন্দ করে। ওরা এখানে আসবার পর একদিন শুধু বড় ডাইনিং হলে খাওয়া হয়েছে, বাকি সবদিন কিচেনে। ওদের ওখানে খেতে কোন অসুবিধা হয় না। কিচেনে সবজি কাটার যে টেবিলটা আছে সেটাই ওদের স্টভিংটনের বাসার খাবার টেবিলের চেয়ে বড়। ওরা সবাই এই টেবিলটায় কাছাকাছি বসতে পারে, কথা বলতে পারে। ডাইনিং রুমের টেবিলটা সে তুলনায় এত বড় যে ওখানে খেতে গেলে মন খারাপ হয়ে যায়। খেতে বসলে শুধু খালি চেয়ারগুলোর দিকে চোখ চলে যায় আর ওদের একাকীত্বের কথা মনে পড়িয়ে দেয়।
আজকে যখন ওরা লাঞ্চ খাচ্ছিল তখন আম্মু বেশী খেতে চায়নি, শুধু শুধু- একটা স্যান্ডউইচের অর্ধেক খেয়েছে। আম্মু বলল যে বাবা কাছেই কোথাও আছে, যেহেতু ওদের গাড়ি আর হোটেলের ট্রাক দু’টোই পার্কিং লটে রাখা। আম্মু এখন একটু শুতে চায়। ড্যানি কি কিছুক্ষণ একা একা খেলতে পারবে?
ড্যানির মুখভর্তি স্যান্ডউইচ থাকায় ও মাথা নেড়ে উত্তর দিল, হ্যা, পারবে।
“তুমি কখনও হোটেলের উঠানের খেলার জায়গাটায় যাও না কেন?” ওয়েন্ডি জিজ্ঞেস করল। “আমি তো ভেবেছিলাম জায়গাটা তোমার পছন্দ হয়েছে।”
ড্যানি জোর করে মুখের খাবারটা গিলে নিল। ওর চেহারা শুকিয়ে গেছে। “যাবো বোধহয়,” ও বলল।
“তাছাড়া ওখানে ওই গাছপালা কেটে বানানো পশুপাখিগুলোও আছে। তোমার বাবার উচিত ওগুলো ছেঁটে সাইজে নিয়ে আসা।”
“ঠিক।” ড্যানি বলল।
জিনিস দেখেছি বাগানে… ওই
(একবার আমি একটা বীভৎস বীভৎস জিনিস পশুপাখিগুলোর মাঝে…)
“তোমার বাবা আমাকে খুঁজলে বোলো যে আমি শুয়ে আছি।”
“আচ্ছা আম্মু।” ড্যানি মাথা নাড়ল।
“ড্যানি, তুমি কি এখানে খুশি?”
ড্যানি সরল চোখে মায়ের দিকে তাকাল। “হ্যা, আম্মু।”
“এখনও কি বাজে স্বপ্ন দেখ?”
টনি আর একবার ওর কাছে এসেছিল। ও ঘুমোবার সময় ড্যানির ক্ষীণ গলার ডাক শুনতে পায়। ও জোরে চোখ বুঝে রাখে, আর কিছুক্ষণ পর শব্দটা মিলিয়ে যায়।
“না।”
“ঠিক তো?”
“ঠিক, আম্মু।”
ওয়েন্ডিকে সন্তুষ্ট দেখাল। “তোমার হাতের কি অবস্থা?”
ড্যানি হাতটা ভাঁজ করে দেখাল। “প্রায় ঠিক হয়ে গেছে।”
ওয়েন্ডি মাথা নাড়ল। জ্যাক পরে বোলতার চাকটাকে আগুনে পুড়িয়ে ফেলে। ও ড্যানির হাতের ছবিগুলো একটা খামে পুরে বোল্ডারের একজন উকিলের কাছে পাঠায়, কীটনাশক কোম্পানীকে এ নিয়ে মামলা করা যাবে কিনা সে ব্যাপারে জানবার জন্যে। উকিল জানায় যে যেহেতু জ্যাক ছাড়া আর কেউ দেখে নি যে ও বাগ বম্ব ব্যাবহার করবার নিয়মগুলো পালন করেছে কিনা, এখানে কেস করাটা বেশ কঠিন হবে। খবরটা শুনে জ্যাকের মেজাজ খিঁচড়ে গেলেও ওয়েন্ডি মনে মনে খুশি হয়। এধরণের মামলা লড়বার মত ক্ষমতা ওদের পরিবারের নেই।
তারপর থেকে ওরা আর কোন বোলতা দেখতে পায়নি।
“যাও, যেয়ে খেলাধুলা কর, ডক। মজা কর।”
ড্যানি অবশ্য মজা করার মত কিছু খুঁজে পেল না। ও উদ্দেশ্যহীনভাবে হোটেলের লবিতে ঘুরতে ঘুরতে মাঝে মাঝে এক একটা রুমের দরজা খুলবার চেষ্টা করছিল। কিন্তু সবগুলো দরজা লক করা। ও সেটা জানত অবশ্য। চাবি নীচের অফিসে রাখা আছে। বাবা ওকে সেটা ধরতে মানা করেছে। ড্যানি তো রুমগুলো খুলতে চায়ও না। তাই না?
(তুমি এখানে কি করছ?)
ব্যাপারটা তাহলে উদ্দেশ্যহীন নয়। ওকে কোন গুপ্ত কৌতূহল ২১৭ নং রুমের বাইরে নিয়ে এসেছে। বাবা একবার মাতাল অবস্থায় ওকে একটা গল্প শোনায়। অনেক আগে হলেও ড্যানির গল্পটা এখনও মনে আছে। একটা রুপকথার কাহিনী, বুবেয়ার্ড নামে এক লোককে নিয়ে। না, আসলে গল্পটা হচ্ছে বুবেয়ার্ডের বৌকে নিয়ে, যার মাথার চুল আম্মুর মত সোনালী। ওরা দু’জন ওভারলুকের মত বিশাল একটা বাড়িতে থাকত, আর প্রতিদিন কাজে যাবার আগে রুবেয়ার্ড ওর বৌকে বলে যেত একটা রুমের ভেতর কখনও না যেতে। রুমের চাবিটা একটা দেয়ালে ঝোলানো থাকত, ঠিক ২১৭ নং রুমের চাবিটার মত। ব্লুবেয়ার্ডের বৌও ড্যানির মত কৌতূহলী হয়ে ওঠে রুমটার ব্যাপারে। ও চাবির ফুটো দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখতে চায় ভেতরে কি আছে, কিন্তু কিছুই দেখতে পায় না। তারপর একদিন ও দরজাটা খোলে…
বইয়ে এত স্পষ্টভাবে দৃশ্যটার বর্ণনা দেয়া ছিল যে এখনও সেটা ড্যানির চোখের সামনে ভেসে ওঠে। রুমটার ভেতরে ছিল বুবেয়ার্ডের আগের সাত বৌয়ের কাটা মাথা। সাতটা বেদীর ওপর মাথাগুলো রাখা ছিল, ওলটানো চোখে শূন্য দৃষ্টি, আর কাটা গলা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে।
প্রচণ্ড ভয় পেয়ে বৌ দৌড় দেয়ে বাড়ি ছেড়ে পালাবার জন্যে, কিন্তু দরজা খুলতেই ও দেখতে পায় ব্লুবেয়ার্ড দাঁড়িয়ে আছে ওর সামনে, চোখে খুনী দৃষ্টি আর হাতে তলোয়ার। বুবেয়ার্ড বলে, “আমি ভেবেছিলাম অন্য সাতজনের মত তোমার এত কৌতূহল থাকবে না, কিন্তু তুমিও শেষপর্যন্ত হার মানলে। এখন আমি চিরকাল তোমাকে ওই ঘরে রাখার ব্যাবস্থা করছি।”
ড্যানির হাত ওর ডান পকেটে ঢুকে চাবিটা বের করে আনল। ও এখানে আসবার আগে চাবিটা নিয়েই এসেছিল।
ড্যানি কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে চাবিটায় আঙুল বুলাল, তারপর লকে ঢুকিয়ে দিল। চাবিটা এত মসৃণভাবে ঢুকল যে ড্যানির মনে হল ওটা যেন অনেকদিন ধরে চাচ্ছিল লকটার ভেতর যেতে।
(ড্যানি, আমাকে কথা দাও যে তুমি ওই ঘরটার ভেতর যাবে না)
(আমি কথা দিচ্ছি)
ড্যানির একটু খারাপ লাগছিল ও ওর কথা রাখছে না দেখে, কিন্তু ঘরটার ভেতর কি আছে তা দেখবার কৌতূহল ওকে পাগল করে তুলছিল।
(আমার মনে হয় না জিনিসগুলো তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে…গল্পের বইয়ের ছবির যেমন ক্ষতি করবার ক্ষমতা নেই)
হঠাৎ করে ড্যানি টান দিয়ে চাবিটা বের করে নিল। তারপর রুদ্ধশ্বাসে ও দ্রুতপায়ে হেঁটে করিডরের অন্যপ্রান্তে চলে গেল।
এখানে ড্যানি কি মনে করে যেন থামল। তারপর ও বুঝতে পারল কেন। এখানে ওই ফায়ার এক্সটিংগুইশারটা আছে। ঘুমন্ত সাপের মত।
একটা লাল, পেঁচিয়ে রাখা হোসপাইপ, আর তারপাশে একটা লাল রঙের ট্যাংক, দেয়ালের সাথে লাগানো। তার একটু ওপরে দেয়ালে আর একটা জিনিস ঝোলানো আছে, একটা কাঁচের বাক্স। বাক্সটায় একটা কুড়াল রাখা, আর কাঁচে বড় বড় সাদা অক্ষরে লেখা : সংকটের মুহূর্তে কাঁচ ভাঙন। ড্যানি ‘সংকট’ কথাটা পড়তে পারল, ও এ কথাটা আগে টিভিতে দেখেছে। এখানে হোসপাইপটার সাথে কথাটা দেখে ওর ভালো লাগল না। ওর জানত যে সংকট মানে খারাপ, বিপজ্জনক কিছু।
ড্যানি ঠিক করল যে ও একদৌড়ে পাইপটাকে পাশ কাটিয়ে যাবে। ও চোখ বন্ধ করে নিজেকে প্রস্তুত করল।
তারপর ও দ্রুত বেগে পা ফেলতে শুরু করল। ও পাইপটার কাছাকাছি আসতে হঠাৎ একটা ভোঁতা শব্দ হল। পাইপের ধাতব মুখটা দেয়াল থেকে পিছলে মাটিতে পড়ে গেছে।
ড্যানি বড় বড় নিশ্বাস নিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করবার চেষ্টা করল। প্রচণ্ড ভয়ে ওর শরীর কাঁপছিল।
পড়ে গেছে তো কি হয়েছে? জিনিসটা একটা সামান্য পাইপ। ওটাকে দেখে ভয় পাবার কিছুই নেই। যদি জিনিসটাকে দেখে ওর বিশাল কোন সাপের কথা মনে হয়ে থাকে তাহলে সেটা ওর মনের ভুল মাত্র। ওটা যে রাবারটা দিয়ে বানানো সেটা সাপের চামড়ার মতই চকরা কাটা, তো কি হয়েছে? ও চাইলেই জিনিসটাকে ডিঙ্গিয়ে সিঁড়ি পর্যন্ত যেতে পারবে। তবে একটু তাড়াতাড়ি যাওয়াই ভালো, তাই না? ও জানে যে পাইপটা হঠাৎ উঠে ওকে পেঁচিয়ে ধরবে না, কিন্তু ঝুঁকি না নেয়াই ভালো।
ড্যানি এক কদম আগাল। পাইপটা ভালোমানুষের মত মাটিতে পড়ে ছিল। ওকে আশ্বাস দিচ্ছে, ও এগিয়ে এলে কিছুই হবে না।
আরেক কদম। ড্যানির হঠাৎ করে বোলতার কথা মনে পড়ল। পাইপটার ধাতব মুখটা যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে, বলছে যে এসো…এসো… আমি কিচ্ছু করব না।
আরেক কদম এগিয়ে আসতে ড্যানি পাইপটার একদম কাছে এসে পড়ল।
পাইপটার ভেতরে কি অনেকগুলো বোলতা লুকিয়ে আছে?
ড্যানির হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেল। ওর মনে হল ওর পা জমে গেছে, ও চাইলেও এখন আগাতে পারবে না। পাইপের মুখটা ওর দিকে অশুভ, ভয়ংকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
ড্যানি মুখ দিয়ে ছোট্ট একটা আওয়াজ করে ছুট দিল। পাইপটা এক লাফে ডিঙ্গিয়ে যাবার পর ও আর পিছে ফিরে তাকাল। না। ওর মনে হচ্ছিল যে পাইপটা সাপের মত সরসর করে ওর দিকে এগিয়ে আসছে, মুখটা ফণার মত উদ্ধত। ও প্রাণপণে ছুটছিল, তাও ওর মনে হল যে সিঁড়িটা কিছুতেই কাছে আসছে না।
ও ‘বাবা!’ বলে চিৎকার দেবার জন্যে মুখ খুলল, কিন্তু কোন আওয়াজ বের হল না। ও শেষপর্যন্ত সিঁড়িটার কাছে এসে থামল। ওর ছোট ফুসফুসে আগুন ধরে গিয়েছে। হাঁপাতে হাঁপাতে ও পেছন ফিরে তাকাল।
কিছুই হয় নি।
পাইপটা যেমন মাটিতে পড়ে ছিল তেমনি পড়ে আছে।
দেখলে, গাধা কোথাকার? ড্যানি মনে মনে নিজেকে গালি দিল। শুধু শুধুই ভয় পাচ্ছিলে। ওটা একটা পাইপ ছাড়া আর কিছু নয়।
নাকি পাইপটা ওকে আসলেই তাড়া করছিল, আর ওকে ধরতে না পেরে আগের জায়গায় ফিরে গেছে?