অধ্যায় ১০ – হ্যালোরান
হোটেলের রাধুনীকে দেখে ওয়েন্ডি একটু হতাশ হল। এরকম অভিজাত হোটেলের রাঁধুনী যেমন হওয়া উচিত একদমই সেরকম নয়। প্রথম কথা হচ্ছে, এরকম হোটেলে রাঁধুনী থাকে না, থাকে শেফ।ওয়েন্ডিকে রাঁধুনী বলা চলে, যখন ও নিজের রান্নাঘরে আগের দিনের বেঁচে যাওয়া খাবার দিয়ে ক্যাসারোল বানায় তখন। কিন্তু ওভারলুক একটা হোটেল যেটার খাবারের প্রশংসা বড় বড় ম্যাগাজিনেও ছাপা হয়েছে। এরকম হোটেলে যে রান্নার জাদুকর কাজ করে তার হওয়া উচিত খাটো, ফর্সা আর গোলগাল। তার ঠোঁটের ওপর সরু গোঁফ থাকবে, চোখ হবে গাঢ় রঙের আর কথায় ফ্রেঞ্চ টান থাকবে। তার ব্যাবহার হবে উগ্র আর বদমেজাজী।
হ্যালোরানের চোখ গাঢ় রঙের ঠিকই, কিন্তু আর কিছুই ওর সাথে মেলে না। ও হচ্ছে লম্বা, কৃষ্ণাঙ্গ একজন লোক যার কোঁকড়ানো চুলে সাদার ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। ওর কথায় আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের একটু টান আছে। লোকটা খুব হাসিখুশি, আর যখন হাসে তখন ওর দাঁত এত ধবধবে সাদা দেখায় যে সন্দেহ হয় আসলে ওগুলো নকল দাঁত কিনা। ওয়েন্ডির বাবার নকল দাঁত ছিল, যা সে প্রায়ই খেলাচ্ছলে ওয়েন্ডির সামনে মুখ থেকে বের করে দেখাত। কিন্তু বাবা এটা শুধু তখনই করত যখন মা বাসায় থাকত না, ওয়েন্ডির মনে পড়ল।
ড্যানি অবাক হয়ে এই বিশালাকৃতির মানুষটাকে দেখছিল। এটা লক্ষ্য করে হ্যালোরান ওকে দু’হাতে তুলে নিজের কনুই এর ফাঁকে বসিয়ে জিজ্ঞেস করল : “তুমি নিশ্চয়ই পুরো শীতকাল এখানে কাটাতে চাও না।”
“হ্যা, আমি চাই।” ড্যানি একটা লাজুক হাসি দিয়ে জবাব দিল।
“না, তুমি আসলে চাও আমার সাথে সেইন্ট পিটার্সে এসে রান্না শিখতে আর সন্ধ্যাবেলা বীচে যেয়ে কাঁকড়া ধরতে, তাই না?”
ড্যানি হিহি করে হেসে মাথা নাড়ল, না, ও চায় না। হ্যালোরান ওকে নীচে নামিয়ে দিল।
“তুমি যদি আমার সাথে আসতে চাও, “ হ্যালোরান গম্ভীরভাবে বলল, “তাহলে তাড়াতাড়ি চল। আধাঘণ্টা পর আমি আমার গাড়িতে চেপে বসব। তার আড়াই ঘণ্টা পর আমি থাকবো ডেনভার, কলোরাডোর এয়ারপোর্টে। তার তিনঘণ্টার মধ্যে আমি গাড়ি ধরে চলে যাবো সেন্ট পিটার্সে, যেখানে পৌঁছেই আমি জামা বদলে বীচে নেমে যাবো আর যারা বরফে জমে যাচ্ছে তাদের ওপর খুব একচোট হাসব। বুঝেছ, খোকা?”
“জি।” ড্যানি হাসতে হাসতে বলল।
হ্যালোরান ঘুরে জ্যাক আর ওয়েন্ডির দিকে তাকাল। “খুব ভালো ছেলে ও।”
“আমাদেরও তাই মনে হয়।” জ্যাক ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। “জ্যাক টরেন্স, আমার স্ত্রী উইনিফ্রেড। ড্যানির সাথে তো আপনার আগেই পরিচয় হয়েছে।”
“আর পরিচয় করে বেশ ভালোই লেগেছে। ম্যা’ম, আপনাকে কি বলে ডাকব, উইনি, না ফ্রেডি?”
“ওয়েন্ডি।” বলে ও মুচকি হাসল।
“বেশ। অন্য দু’টো নামের চেয়ে এটাই ভালো অবশ্য। এদিকে আসুন। আলম্যান বলেছে আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাতে, তাই আপনাদের ঘুরিয়ে দেখাতে নিয়ে যাচ্ছি।” তারপর ও আস্তে করে বলল, “আর তিনমাস ওর চেহারাটা দেখতে হবে না ভাবতেই ভালো লাগছে।”
হ্যালোরান ওদেরকে যে রান্নাঘরটা দেখাতে নিয়ে গেল তত বড় রান্নাঘর ওয়েন্ডি জীবনেও দেখে নি। আর পুরো কিচেনটা ঝকঝকে পরিষ্কার। রুমটা এত বড় যে দেখে ওয়েন্ডির ভয়ই হচ্ছিল। ও হ্যালোরানের পাশে হাঁটতে হাঁটতে চারদিকে তাকিয়ে দেখছিল, আর জ্যাক, কি করবে খুঁজে না পেয়ে ড্যানির সাথে ওদের পেছন পেছন আসছিল। একপাশের একটা ওয়ালবোর্ডে সবধরণের ছুরি ঝোলানো, ফল কাটার ছোট্ট ছুরি থেকে শুরু করে কাঁচা মাংশ সাইজ করবার বিরাট ছুরি পর্যন্ত। রুটি কাটবার জন্যে যে কাঠের বোর্ডটা আছে ওটাই ওয়েন্ডির বাসার খাবারের টেবিলের সমান হবে। একটা দেয়াল পুরো ঢাকা পড়ে গিয়েছিল নানা রকম স্টিলের বাটির আড়ালে।
“এখানে একলা এলে তো আমি হারিয়ে যাব।” ও বলল।
“আরে কোন চিন্তা করবেন না।” হ্যালোরান জবাব দিল। “সাইজে বড় হতে পারে, কিন্তু এটা একটা রান্নাঘর ছাড়া আর কিছু নয়। এখানে বেশীরভাগ জিনিসই আপনার কখনও ব্যবহার করতে হবে না। শুধু সবকিছু পরিষ্কার রাখবার চেষ্টা করবেন, এটুকুই আমার অনুরোধ। আসেন, আপনাকে দেখাই কোন চুলাটা আপনার ব্যবহার করা উচিত। এখানে এটাই সবচেয়ে ছোট চুলা।”
সবচেয়ে ছোট, ওয়েন্ডি মনে মনে বলল। এখান থেকেই দেখা যাচ্ছে যে চুলাটায় বারোটা বার্নার, দু’টো ওভেন আর আরও নানারকম রান্নার ব্যাবস্থা রয়েছে। তার পাশাপাশি আছে নানারকম মিটার আর ডায়াল।
“এখানে সবকিছু গ্যাসে চলে।” হ্যালোরান বলল। “আপনি তো গ্যাস দিয়ে আগেও রান্না করেছেন। তাই না?”
“হ্যা…”
“আমি গ্যাসের অনেক বড় ভক্ত।” হ্যালোরান ঝুঁকে চুলার একটা ডায়াল ঘুরাতেই লাফ দিয়ে একটা নীল রঙের আগুন জ্বলে উঠল। ও ডায়ালটাকে অভিজ্ঞ হাতে ঘুরিয়ে আগুনটাকে আরও ছোট করে আনল। “কি ধরণের আগুন দিয়ে রান্না করছি এটা দেখতে আমার ভালো লাগে। আপনি কি বুঝতে পারছেন কোন কোন ডায়াল দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা যায়?”
“হ্যা।”
“ওভেনের ডায়ালগুলোর গায়ে চিহ্ন দেয়া আছে যাতে সহজে খুঁজে বের করা যায়। আমি সাধারণত মাঝখানের ডায়ালটা ব্যাহার করি, কারণ ওটা দিয়ে তাপ নিয়ন্ত্রণ করা সবচেয়ে সোজা, কিন্তু আপনার যেটাতে সুবিধা হয় আপনি সেটাই ব্যাবহার করতে পারেন।”
হ্যালোরান বলতে লাগল : “এখানে খাবার কি কি আছে তার একটা লিস্ট আমি সিংকের পাশে রেখে দিয়েছি। দেখতে পাচ্ছেন?”
“এইযে পেয়েছি, আম্মু।” ড্যানি দু’টো কাগজ নিয়ে এল সিংকের কাছ থেকে।
“শাবাশ।” হ্যালোরান ওর কাছ থেকে কাগজগুলো নিয়ে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। “তুমি শিওর তুমি আমার সাথে ফ্লোরিডা আসতে চাও না? ওখানে আমি তোমাকে চমৎকার শ্রিম্প ক্রেওল রান্না করা শিখিয়ে দেব।”
ড্যানি মুখে হাত চাপা দিয়ে হিহি করে আবার বাবার পাশে ছুটে গেল।
“এখানে যে পরিমাণে খাবার আছে তাতে আপনাদের তিনজনের প্রায় বছরখানেক চলে যাবার কথা।” হ্যালোরান বলল। “আমাদের এখানে একটা কোল্ড প্যান্ট্রি আছে, একটা শীতলঘর আছে, বাক্সের পর বাক্সে সবজি আছে আর দু’টো রেফ্রিজারেটর আছে। আসুন দেখাই।”
এর পরের দশ মিনিট ধরে হ্যালোরান একটার পর একটা দরজা খুলে খাবারের হিসাব দিতে লাগল। এত খাবার ওয়েন্ডি একসাথে কখনও দেখে নি। ওর আবার বরফে আটকা পড়া যাত্রীদলের কথা মনে পড়ে গেল। এত খাবার দেখে ও এই প্রথম ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পারল। যখন বরফ পড়া শুরু করবে তখন ওরা সত্যি সত্যিই এখানে অনেকদিনের জন্যা আটকা পড়ে যাবে। এই বিশাল, অভিজাত হোটেলে বসে বসে রুপকথার চরিত্রের মত ওরা দামী দামী খাবার খাবে আর বাইরে বাতাসের হা-হুতাশ শুনবে, কিন্তু বের হতে পারবে না।
ভারমন্টে থাকতে, যখন ড্যানির হাত ভেঙ্গে গিয়েছিল, (জ্যাক যখন ড্যানির হাত ভেঙ্গে ফেলেছিল) তখন ওয়েন্ডি হাসপাতালে ফোন করবার দশ মিনিটের মাঝে অ্যাম্বুলেন্স এসে পড়েছিল। একইভাবে ওখানে পুলিশ অথবা দমকলকে ফোন দিলে ওরা পাঁচ মিনিটের মধ্যে এসে হাজির হত। কিন্তু এখানে যদি ড্যানি একবার জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তখন কাকে ডাকা যাবে?
(হে ঈশ্বর কি ভয়ংকর একটা চিন্তা!)
যদি আগুন লেগে যায় তাহলে? যদি জ্যাক সিঁড়িতে পা পিছলে নিজের মাথা ফাটিয়ে-
(যদি সবকিছু ঠিকঠাক থাকে তাহলে কি হবে? দুশ্চিন্তা বন্ধ কর, উইনিফ্রেড)
হ্যালোরান ওদেরকে শীতলঘরে নিয়ে গেল। ঘরটার ভেতর ওদের নিঃশ্বাসের সাথে বের হওয়া বাষ্প দেখে মনে হচ্ছিল কোন কমিক চরিত্রের কথা বলার বেলুন। এ ঘরে যেন শীতকাল এখনই এসে পড়েছে।
প্লাস্টিক ব্যাগে ডজন ডজন হ্যামবার্গার, ৩০ ক্যান হ্যাম, চল্লিশটা হাল ছাড়ানো মুরগী, প্রচুর গরুর মাংশ আর ভেড়ার একটা আস্ত পা পুরো রুমটা দখল করে রেখেছে।
“তুমি ভেড়ার মাংশ পছন্দ কর, ডক?” হ্যালোরান হাসতে হাসতে জিজ্ঞেস করল।
“খুব।” ড্যানি সাথে সাথে জবাব দিল। ও আগে কখনও ভেড়ার মাংশ খায়নি।
“জানতাম তোমার ভেড়ার মাংশ পছন্দ হবে। শীতের রাতে দুই স্লাইস ভেড়ার মাংশ আর মিন্ট জেলীর কোন তুলনা নেই। কিচেনে মিন্ট জেলীও পাবেন। ভেড়ার মাংশ পেট ঠাণ্ডা করে। শুধু খেতেই মজা নয়, আপনার শরীরের জন্যেও ভালো।”
ওদের পেছন থেকে জ্যাক কৌতুহলী স্বরে প্রশ্ন করল, “আপনি জানলেন কিভাবে যে আমরা ওকে ডক বলে ডাকি?”
হ্যালোরান ঘুরে দাঁড়াল। “জি?”
“ড্যানি : আমরা ওকে আদর করে ডক বলে ডাকি। বাগস বানি কার্টুনের মত।”
“ওকে দেখলেই মনে হয় যে ওর নাম ডক হওয়া উচিত, তাই না?” বলে হ্যালোরান নাকী গলায় বাগস বানির মত করে বলল : “ওয়াট্স আপ, ডক?”
ড্যানি আবার হেসে ফেলল আর তারপর হ্যালোরান ওকে বলল
(তুমি আসলেই ফ্লোরিডা যেতে চাও না, ডক? )
পরিষ্কার। ড্যানি প্রত্যেকটা শব্দ শুনতে পেয়েছে। ও মুখ তুলে হ্যালোরানের দিকে তাকাল, একটু ভয়ে ভয়ে। হ্যালোরান ওর দিকে চোখ টিপ মেরে আবার ঘুরে খাবারের দিকে তাকাল।
ওয়েন্ডি হ্যালোরানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে ড্যানির ওপর রাখল। ওর কেন যেন মনে হচ্ছিল যে ওদের দু’জনের মধ্যে গোপনে কোন কথা হয়েছে।
“এখানে আপনি পাবেন বিশ প্যাকেট সসেজ, বিশ প্যাকেট বেকন।” হ্যালোরান বলল। “আর এই ড্রয়ারে পাবেন বিশ পাউন্ড মাখন।”
“খাঁটি মাখন?”
“১০০% খাঁটি।”
“আমি শেষ খাঁটি মাখন খেয়েছি বোধহয় বাচ্চা থাকতে, যখন নিউ হ্যাম্পশায়ারে থাকতাম।”
“এখানে এত আছে যে আপনি তিন মাস টানা খেলেও শেষ করতে পারবেন না।” হ্যালোরান বলে হাহা করে হাসল। “এখানে পাঁউরুটি আছে পঞ্চাশ লোফ, আর যদি এর বেশী প্রয়োজন হয় তাহলে প্রচুর ময়দাও কিচেনে পাবেন। ফ্রিজে রাখা পাঁউরুটির চেয়ে ফ্রেশ জিনিস খাওয়াই ভালো, কি বলেন?”
“এখানে পাবেন মাছ। মাছ খেলে বুদ্ধি বাড়ে, তাই না, ডক?”
“আসলেই, আম্মু?”
“মি: হ্যালোরানের তো মিথ্যা কথা বলবার কথা নয়, সোনা।” ওয়েল্ডি হাসল।
ড্যানি নাক কুঁচকাল। “আমার মাছ খেতে ভালো লাগে না।”
“উহুঁ,” হ্যালোরান বলল। “তারচেয়ে তোমার বলা উচিত এখনও এমন কোন মাছ তুমি খাও নি যেটা তোমার ভালো লেগেছে। এ মাছগুলো তোমার ভালো লাগবেই। পাঁচ পাউন্ড রেইনবো ট্রাউট, দশ পাউন্ড টারবট, পনের ক্যান টুনা মাছ-”
“ও হ্যা, টুনা মাছ খেতে আমি পছন্দ করি।”
“আর চমৎকার পাঁচ পাউন্ড সোলমাছ। খোকা, সামনের গ্রীষ্মকাল আসতে আসতে বুঝবে যে আমি তোমার কত বড় উপকার করেছি। বলবে যে আপনি আসলে ঠিকই বলেছিলেন মি:- “ হ্যালোরান এমনভাবে তুড়ি বাজালো যেন ও কিছু মনে করার চেষ্টা করছে, “আমার নামটা যেন কি? মাত্র মনে পড়ল, এখন আবার ভুলে গেলাম।”
“মি: হ্যালোরান,” ড্যানি হাসতে হাসতে বলল, “আপনার বন্ধুরা আপনাকে ডিক বলে ডাকে।”
“আর তুমি যেহেতু আমার বন্ধু, তুমি আমাকে ডিক বলে ডাকতে পারো। আর বন্ধুরা একজন আরেকজনকে আপনি বলে ডাকে না, তাই এখন থেকে ‘তুমি’, ঠিক আছে?”
হ্যালোরানের পিছে পিছে রুমের কোণার দিকে যাবার সময় জ্যাক আর ওয়েন্ডি একজন আরেকজনের সাথে অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করল। হ্যালোরান কি আগে ওদেরকে নিজের ডাকনাম বলেছিল?
“আর এটা আমার তরফ থেকে একটা উপহার হিসাবে ধরে নিতে পারেন।” হ্যালোরান বলল। “আশা করি আপনাদের ভালো লাগবে।”
“আপনার শুধু শুধু এত কষ্ট করবার কি দরকার ছিল?” ওয়েন্ডি বলল। ওর আসলেই ভালো লেগেছে। হ্যালোরান ওদেরকে একটা বিশ পাউন্ডের ছেলা তিতির পাখি দেখাচ্ছিল, যেটার গায়ে লাল রঙের রিবন দিয়ে একটা প্যাঁচ লাগানো হয়েছে, জন্মদিনের গিফটের মত।
“থ্যাংকসগিভিং এর দিন তিতিরের রোস্ট থাকতেই হবে ওয়েন্ডি।” হ্যালোরান গম্ভীর গলায় বলল। “ এখন চল সবার নিউমোনিয়া হবার আগে এখান থেকে বেরনো যাক, ঠিক না, ডক?”
“ঠিক!”
প্যান্ট্রির খাদ্যভান্ডার অবশ্য এখানেই শেষ নয়। আরও আছে প্রায় একশ’ বক্সের মত গুঁড়ো দুধ (যদিও হ্যালোরান ওদের গম্ভীরভাবে জানাল যে বাচ্চার জন্যে সাইডয়াইন্ডার থেকে ফ্রেশ দুধ নিয়ে আসাই ভালো), চিনি ম্যাকারনি, স্প্যাগেটি, ফলমুল, আরও হাজাররকমের খাদদ্রেব্য।
“বাব্বা,” বেরিয়ে আসতে আসতে ওয়েন্ডি বলল। এক সপ্তাহ চালাবার জন্যে ওর মাত্র তিরিশ ডলারের খাবার কিনলেই হয়। এত খাবার একসাথে দেখে ওর মাথা ঘুরছিল।
“আমার একটু দেরী হয়ে যাচ্ছে,” হ্যালোরান ঘড়ি দেখে বলল। “আপনি নিজের সুবিধামত বাকি ক্যাবিনেটগুলো দেখে নিয়েন, কেমন? আপনাকে এখনও যা যা দেখানো হয় নি তার মধ্যে আছে কন্ডেন্সড মিল্ক, কলা, ঈস্ট, পাই, বেকিং সোডা—”
“হয়েছে,হয়েছে।” ওয়েন্ডি হাসতে হাসতে এক হাত তুলল। “আমার জীবনেও সবকিছু মনে থাকবে না। কিচেনটা চমৎকার, আর আমি কথা দিচ্ছি যে আমি সবকিছু পরিষ্কার রাখব।”
“আমি এর চেয়ে বেশী কিছু চাই না।” বলে হ্যালোরান জ্যাকের দিকে ঘুরল। “মি: আলম্যান কি আপনাকে ইঁদুরের উৎপাতের কথা বলেছে?”
জ্যাক দাঁত বের করে হাসল। “মি: আলম্যান বলেছে যে চিলেকোঠায় ইঁদুর থাকতে পারে, আর মি: ওয়াটসন বলেছে যে বেসমেন্টেও ইঁদুরের বাসা থাকতে পারে। নীচে দেখলাম প্রায় দুই টনের মত কাগজ আছে, কিন্তু দেখে মনে হল না সেগুলোর কোনটাকে ইঁদুর দাঁতে কেটেছে।”
“আহ্ ওয়াটসন,” হ্যালোরান নকল দুঃখ নিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আর কাউকে কখনও এত মুখ খারাপ করতে দেখেছেন?”
“উনি একটা ক্যারেক্টার বটে।” জ্যাক বলল। নিজের বাবার চেয়ে বেশী মুখ খারাপ কারও সাথে এখনও ওর পরিচয় হয় নি।
“ব্যাপারটা ভাবলে খারাপই লাগে,” ওদেরকে ডাইনিং রুমে আবার লম্বা দরজাগুলোর দিকে নিয়ে যেতে যেতে হ্যালোরান বলল। “ওদের পরিবার আগে ভালোই ধনী ছিল। ওয়াটসনের পরদাদা অথবা পরদাদার বাবা-আমার ঠিক মনে নেই কোনজন-এই হোটেলটা বানায়।”
“হ্যা, আমিও তাই শুনলাম।” জ্যাক উত্তর দিল।
“পরে কি হল?” ওয়েন্ডির প্রশ্ন।
“ওরা বেশীদিন সম্পত্তি ধরে রাখতে পারে নি,” হ্যালোরান বলল। “আপনি যদি সুযোগ দেন তাহলে ওয়াটসন দিনে দু’বার করে আপনাকে গল্পটা শোনাবে। এই জায়গাটায় ওয়াটসনের পরিবারের সাথে কিছু দুঃখজনক ঘটনা ঘটে। ওয়াটসনের বাবার দুই ছেলের মধ্যে একজন এখানেই ঘোড়া চালাতে যেয়ে একটা দুর্ঘটনায় মারা যায় যখন হোটেলটা বানানো হচ্ছিল। ১৯০৮-০৯ সালের ঘটনা। তারপর বুড়ো মানুষটার বৌ ফ্লুতে মারা যায়। পরে ও আর ওর ছোট ছেলেকে হোটেলের কেয়ারটেকার হিসাবে নিয়োগ করা হয়। সেই হোটেলেই যেটা ওনার পূর্বপুরুষ বানিয়েছিল।”
“আসলেই ব্যাপারটা দুঃখের।” ওয়েন্ডি বলল।
“পরে ওনার কি হল? ওয়াটসনের বাবার?” জ্যাক জানতে চাইল।
“ভুলে একটা ইলেকট্রিক সকেটে আঙুল ঢুকাবার ফলে শক লেগে মারা যান।”হ্যালোরান জবাব দিল। “এটা ১৯৩০ এর দিকে, যারপরে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হোটেলটা দশ বছরের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়।”
“যাই হোক, জ্যাক… তুমি এবং তোমার স্ত্রী যদি একটু খেয়াল রাখো যে কিচেনেও ইঁদুরের উৎপাত শুরু হয়েছে কিনা তাহলে ভালো হয়।” হ্যালোরান যে কখন আপনি থেকে তুমিতে চলে গেছে ওরা বুঝতেই পারে নি। যদিও ওরা দু’জন কিছু মনে করল না। হ্যালোরান ওদের দু’জনের চেয়ে বয়সে বেশ বড়ই হবে। “যদি ইঁদুর দেখতে পাও তাহলে ওদের ধরার জন্যে ফাঁদ ব্যাবহার করবে, বিষ নয়।”
জ্যাক চোখের পাতা ফেলল। “অবশ্যই। কোন গাধা কিচেনে বিষ দেয়ার কথা চিন্তা করবে?”
হ্যালোরান একটা তিক্ত হাসি দিল। “মি. আলম্যান, আর কে? গত শীতের সময় যখন ওনার মাথায় প্রথম এ বুদ্ধিটা খেলে তখন আমি শোনার সাথে সাথে বলেছিলাম : মি: আলম্যান, ধরুন গ্রীষ্মকালে যখন আবার হোটেল খুলবে, তখন ওপেনিং নাইটে যে ভোজ হয় সেখানে আমি স্যামন মাছের একটা চমৎকার রান্না পরিবেশন করলাম। কিন্তু তার কিছুদিন পর আপনার কাছে ডাক্তার এসে অভিযোগ দিল, আলম্যান তুমি এখানে করছটা কি? আমেরিকার সবচেয়ে ধনী লোকজনকে ডেকে ডেকে এনে ইঁদুরের বিষ খাওয়াচ্ছ? ওদের সবার তো পেট খারাপ করেছে।”
জ্যাক হাসিতে ফেটে পড়ল। “শুনে আলম্যান কি বলে?”
হ্যালোরান এমনভাবে জিভ দিয়ে নিজের গালের ভেতরটা পরখ করল যেন ওখানে খাবার লেগে আছে। “আলম্যান বলে : ফাঁদ কিনে নিয়ে আসো, হ্যালোরান।”
এইবার ওরা সবাই হেসে উঠল, এমনকি ড্যানিও, যদিও ও ঠিক বুঝতে পারে নি যে ওরা কি নিয়ে হাসছে। শুধু এটুকু বোঝা গেছে হাসাহাসি হচ্ছে আলম্যানকে নিয়ে, যে নিজেকে সবজান্তা মনে করলেও আসলে সে একটা বোকা।
ওরা সবাই ডাইনিং রুমের ভেতর দিয়ে হেঁটে এল। এখন ওখানে কেউ নেই। রুমটার একপাশে দেয়ালজোড়া কাঁচের জানালা, যেটা দিয়ে বরফে ঢাকা পর্বতশৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। এখানে গোছানোর কাজ প্রায় শেষ। সব টেবিলগুলোকে স্বচ্ছ প্লাস্টিকে মুড়ে ফেলা হয়েছে, আর লম্বা কার্পেটটাকে গুটিয়ে একপাশের দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে। ওটাকে দেখে মনে হচ্ছিল যে ও রুমটাকে পাহাড়া দিচ্ছে।
চওড়া রুমটার অন্যপ্রান্তে একটা দরজা দেখা যাচ্ছে। পুরনো আমলের ওয়েস্টার্ন সিনেমায় যেমন দরজা দেখা যায়, যেগুলোত্র ছোট দু’টো বাদুড়ের ডানার মত কাঠের পাল্লা থাকে সেরকম। দরজাগুলোর ওপরে একটা ঝলমলে সাইন লাগানো : দ্যা কলোরাডো লাউঞ্জ।
জ্যাকের দৃষ্টি অনুসরণ করে হ্যালোরান বলল, “যদি আপনার মদ খাবার ইচ্ছা থাকে তাহলে আশা করি নিজের স্টক নিয়ে এসেছেন। লাউঞ্জে এখন আর কিছুই নেই। গতকাল রাতে কর্মচারীদের পার্টি ছিল, সবাই মিলে হোটেলের মদ সাফ করে ফেলেছে। আজকে সবাই মাথাব্যাথা নিয়ে ঘুরছে, এমনকি আমিও।”
“আমি মদ খাই না।” জ্যাক ছোট্ট করে বলল। ওরা লবিতে পৌঁছে গিয়েছে।
লবির ভীড় এখন আর নেই বললেই চলে। এখন এ জায়গাটাও থমথমে হয়ে গিয়েছে। আমাদের এ পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া উচিত, জ্যাক ভাবল। এখন থেকে পুরো হোটেলটাই এমন নীরব থাকবে। সোফায় যে নানরা বসা ছিল তাদেরও আর দেখা যাচ্ছে না। ওয়েন্ডি দেখল যে পার্কিং লটে আর মাত্র ডজনখানেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে।
ও মনে মনে বলল আমাদেরও হোটেলের অতিথিদের দলে সামিল হয়ে গাড়িতে চেপে এখান থেকে হাওয়া হয়ে যাওয়া উচিত।
জ্যাক চারদিকে তাকিয়ে আলম্যানকে খুঁজছিল, কিন্তু আলম্যান লবিতে ছিল না।
ছাই রঙের চুলওয়ালা একজন যুবতী মেইড এগিয়ে এল ওদের দিকে। “তোমার মালপত্র বাইরে রাখা আছে, ডিক।”
“ধন্যবাদ স্যালি।” হ্যালোরান ওর কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিল। “আশা করি তোমার ছুটিটা ভালো যাবে। শুনলাম তুমি নাকি বিয়ে করছ।”
হ্যালোরান ঘুরে টরেন্সদের দিকে তাকাল। স্যালি নিতম্ব দুলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেল।
“প্লেন ধরতে চাইলে আমার তাড়াতাড়ি করতে হবে,” হ্যালোরান বলল। “আশা করি তোমাদের কোন অসুবিধা হবেনা।”
“ধন্যবাদ।” জ্যাক বলল।
“আমি আপনার কিচেনের সবকিছু ঠিকঠাক রাখব।” ওয়েন্ডি আবার কথা দিল। “আশা করি ফ্লোরিডায় আপনার ছুটি ভালোই কাটবে।”
“তোমার কথা যেন সত্যি হয়।” হ্যালোরান দাঁত বের করে হাসল। ও হাঁটুর ওপর হাত রেখে ঝুঁকে ড্যানিকে বলল, “এই তোমার লাস্ট চান্স। আসবে আমার সাথে?”
“না মনে হয়।” ড্যানি হাসতে হাসতে বলল।
“ঠিক আছে। তুমি কি আমার ব্যাগগুলো গাড়িতে তুলতে সাহায্য করবে?”
“যদি আম্মু অনুমতি দেয়।”
“ঠিক আছে যাও, কিন্তু এক শর্তে।” ওয়েন্ডি জ্যাকের দিকে এগিয়ে এল। “বাইরে গেলে জ্যাকেটের সবগুলো বোতাম লাগিয়ে রাখবে।”
কিন্তু ও হাত দেবার আগেই হ্যালোরান এসে মসৃণভাবে ড্যানির জ্যাকেটের সবগুলো বোতাম লাগিয়ে দিল।
“ওকে একটু পরেই ভেতরে পাঠিয়ে দিচ্ছি।” হ্যালোরান বলল।
“বেশ।” ওয়েন্ডি বলে হ্যালোরান আর ড্যানির পিছে পিছে দরজা পযন্ত গেল।
জ্যাক এখনও আলম্যানকে খুঁজছিল। ডেস্কে ওভারলুকের শেষ কয়েকজন অতিথি চেক আউট করবার জন্যে দাঁড়িয়ে আছে।
অধ্যায় ১১ – জ্যোতি
দরজার ঠিক সামনেই পোর্চে চারটা ব্যাগ স্তূপ করে রাখা। তাদের মধ্যে তিনটা বিশাল সাইজের নকল কুমীরের চামড়ার সুটকেস। আর একটা মাঝারী সাইজের ব্যাগ।
“তুমি ওই বাগটাকে সামলাতে পারবে না?” বলতে বলতে হ্যালোরান দু’টো সুটকেস দু’হাতে নিয়ে নিল আর তিন নম্বরটা বগলদাবা করল।
“হ্যা,” বলে ড্যানি দু’হাতে ব্যাগটা তুলে হ্যালোরানের পিছে পিছে উঠানের সিঁড়ি দিয়ে নামল। ও চেহারা শক্ত করে রাখল যাতে বোঝা না যায় যে ব্যাগটা তুলতে ওর কষ্ট হচ্ছে।
এখন বাইরে বেশ ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। পাহাড় থেকে নেমে আসা দমকা হাওয়া মুখে লাগতে ড্যানি চোখ কুঁচকে ছোট ছোট করে ফেলল। উঠানে কিছু মরা পাতা ঘুরে বেড়াচ্ছিল। এই দৃশ্যটা দেখে ড্যানির এখানে আসার আগের রাতের কথা মনে পড়ে গেল। যেদিন রাতে ওর,মনে হয়েছিল যে টনি ওকে নিষেধ করছে, যাতে ও এখানে না আসে।
হ্যালোরান সুটকেসগুলো একটা প্লাইমাউথ ফিউরির সামনে এনে রাখল। “এই গাড়িটা তেমন সুবিধের নয়।” ও স্বীকার করল। “আমার আসল গাড়িটা আমার জন্যে ফ্লোরিডায় অপেক্ষা করছে। ১৯৫০ সালের একটা ক্যাডিলাক। দেখেছ কখনও? এত চমৎকার গাড়ি আজকাল আর বানানো হয়না। আমি গাড়িটাকে ফ্লোরিডায় রাখি কারণ ওটা পাহাড়ে চরার গাড়ি নয়। তোমার কি ব্যাগটা সামলাতে কষ্ট হচ্ছে?”
“না, স্যার।” ড্যানি শেষের দশ-বারো কদম কোনরকমে মুখ না বিকৃত করে এসে ব্যাগটা রেখে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
“গুড বয়।” হ্যালোরান বলল। ও নিজের জ্যাকেটের পকেট থেকে একটা চাবি বের করে গাড়ির ট্রাংকটা খুলে ব্যাগ ভেতরে রাখতে লাগল। “তোমার ভেতর জ্যোতি আছে ছেলে। আমি সারা জীবনে আর কাউকে আমি এত উজ্জ্বল হয়ে জ্বলতে দেখি নি, আর আমার বয়স প্রায় ষাট বছর।”
“জি?”
“তোমার মধ্যে একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে।” হ্যালোরান ওর দিকে ঘুরে বলল। “আমি এটাকে বলি জ্যোতি, বা শাইনিং। আমার দাদীও তাই বলতেন, যখন উনি বেঁচে ছিলেন। আমরা কিচেনে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গল্প করতাম, কিন্তু আমাদের মুখ দিয়ে কোন শব্দ বেরুত না।”
“সত্যি?”
হ্যালোরান ড্যানির কৌতূহলী, প্রায় ক্ষুধার্ত দৃষ্টি দেখে হাসল। “এসে আমার গাড়িতে কয়েক মিনিটের জন্যে বস। তোমার সাথে আমার কথা আছে।” বলে ও দড়াম করে ট্রাংকটা বন্ধ করে দিল।
ওদিকে ওভারলুক হোটেলের লবি থেকে ওয়েন্ডি টরেন্স দেখছিল যে ওর ছেলে হ্যালোরানের গাড়িতে উঠছে। ঠাণ্ডা একটা ভয় ওয়েন্ডির মনে চেপে বসল। ওর একবার মনে হল যে ওর যেয়ে জ্যাককে বলা উচিত যে হ্যালোরান আসলেই ড্যানিকে হ্যালোরান ফ্লোরিডা নিয়ে যাচ্ছে। ওদের ছেলেকে কিডন্যাপ করা হচ্ছে! কিন্তু গাড়িটা ওখান থেকে নড়ল না। ও ড্রাইভারের সীটে হ্যালোরানকে দেখতে পেল, আর তার পাশের সীটে ড্যানির মাথার ছায়া দেখা যাচ্ছে। এতদুর থেকেও ওয়েন্ডি বুঝতে পারল যে ড্যানি একটা বিশেষ ভঙ্গিতে হ্যালোরানের দিকে তাকিয়ে আছে। ও এমনভাবে তাকায় যখন ও গভীর মনোযোগ দিয়ে কোন কিছু দেখছে বা শুনছে। জ্যাক, যে এখনও মি.আলম্যানকে খুঁজছে, ব্যাপারটা খেয়াল করে নি। ওয়েন্ডি কোন কথা বলল না। তবে মনে মনে ওর শংকা হচ্ছিল। হ্যালোরান ড্যানিকে কি এমন বলছে যে ওর এত মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে?
গাড়ির ভেতর হ্যালোরান বলছিল : “তুমি কি ভেবেছিলে একা তোমার সাথেই এমন হয়?”
ড্যানি, যে আসলেই তাই ভেবেছিল, মাথা ঝাঁকাল। “শুধু আমার মধ্যেই কি আপনি এমন আলো দেখেছেন?”
হ্যালোরান হেসে মাথা নাড়ল। “না খোকা, কিন্তু তোমার মত উজ্জ্বল আর কাউকে দেখি নি।”
“এমন কি আরও অনেকেই আছে?”
“না, অনেক নেই,” হ্যালোরান বলল। “কিন্তু মাঝে মাঝে এমন মানুষের সাথে দেখা হয়ে যায়। অনেকে নিজেরাও জানে না যে তাদের মাঝে জ্যোতি আছে। কিন্তু ওরা অনেককিছু আগে থেকে বুঝতে পারে। ঠিক যেদিন বউয়ের একটু শরীর খারাপ লাগছে সেদিন ফুল নিয়ে যায়, যেসব পরীক্ষার জন্যে পড়েনি সেসব পরীক্ষাতেও ভালো করে, একটা রুমে পা ফেললেই বুঝতে পারে যে রুমের অন্যান্যদের মনের অবস্থা কিরকম। এরকম প্রায় পঞ্চাশ-ষাট জনকে আমি দেখেছি। কিন্তু আমার দেখা খুব বেশী হলে এক ডজন মানুষ জানতো যে ওদের মাঝে জ্যোতি আছে।”
“ওয়াও।” ড্যানি কিছুক্ষণ চুপ করে চিন্তা করল। তারপর জিজ্ঞেস করল : “আপনি কি মিসেস ব্র্যান্টকে চেনেন?”
“ব্র্যান্ট?” হ্যালোরান ভ্রু কুঁচকাল। “কেন, কি হয়েছে? ওর মধ্যে কোন জ্যোতি নেই। ও শুধু তিন-চারবার নিজের ডিনার ফেরত পাঠায়, রান্না ভালো হয় নি বলে।”
“আমি জানি,” ড্যানি সরলভাবে বলল। “কিন্তু আপনি কি ধূসর জাম্না পরা ওই লোকটাকে চেনেন যে গাড়ি নিয়ে আসে?”
“মাইক? হ্যা আমি ওকে চিনি। কেন, কি হয়েছে?”
“মি: হ্যালোরান, মিসেস ব্র্যান্ট ওর সাথে ঘুমাতে চায় কেন?”
“মানে?”
“উনি যখন মাইককে দেখছিলেন, তখন ভাবছিলেন, এই ছেলেটার সাথে শুতে পারলে মন্দ হত না আর আমি বুঝিনি যে-”
কিন্তু এর চেয়ে বেশী ও আর বলার সুযোগ পেল না। হ্যালোরান তার আগেই হাসিতে ফেটে পড়ল। ওর শরীর দুলতে লাগল হাসির দমকে, আর ওর ভারী গলার হাসি সারা গাড়িতে ঘুরে বেড়াতে লাগল। ড্যানিও হাসল, কিন্তু ও বুঝতে পারছিল না কি হয়েছে। শেষপর্যন্ত হ্যালোরানের হাসি থামল। ও নিজের পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে নিজের চোখ মুছল।
“খোকা,” ও বলল, “আর কিছুদিন পরেই তুমি বুঝে যাবে মানুষ এসব কথা কেন বলে।”
“কিন্তু মিসেস ব্র্যান্ট-–”
“ওকে নিয়ে মাথা না ঘামালেও চলবে। আর তোমার মাকে যেয়ে এ কথাটা জিজ্ঞেস কোর না, তাহলে ও রাগ করবে। বুঝতে পেরেছ?”
“বুঝেছি।” ড্যানি বেশ ভালো করেই বুঝেছে। এমন কথা মাকে জিজ্ঞেস করে ওর আগেও বিপদে পড়তে হয়েছে।
“মিসেস ব্র্যান্ট হচ্ছে একটা নোংরা মহিলা যার মাঝে মাঝে চুলকানি ওঠে, আপাতত তোমার জন্যে এটুকু জানাই যথেষ্ট।” ও ড্যানির দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাল, “তুমি কত জোরে চিন্তা পাঠাতে পারো, ড্যানি?”
“কি?”
“তোমার সমস্ত শক্তি দিয়ে আমার মাথায় একটা চিন্তা পাঠাবার চেষ্টা কর। আমি দেখতে চাই আমি যতটুকু ভাবছি তোমার ক্ষমতা অতদুর পর্যন্ত যায় কিনা।”
“আমার কি ধরণের চিন্তা পাঠানো উচিত?”
“যেকোন কিছু। শুধু মনোযোগ দিয়ে চিন্তা করবে।”
“ঠিক আছে।” ড্যানি বলল। ও এক মিনিট ভাবল, তারপর নিজের মনের সব শক্তি একত্র করে ছুঁড়ে দেবার জন্যে নিজেকে প্রস্তুত করল। ও আগে কখনও এরকম কিছু করে নি, আর শেষ মুহূর্তে ওর সহজাত প্রবৃত্তি ওকে বাধা দিল। ও নিজের পুরো ক্ষমতা ব্যাবহার না করে কিছুটা ঠেকিয়ে রাখল। ও হ্যালোরানকে ব্যাথা দিতে চায় না। তারপরেও চিন্তাটা তীরের মত ছুটে বেরিয়ে গেল ওর ভেতর থেকে, প্রচণ্ড বেগে একটা বেসবল ছুঁড়ে মারবার মত।
চিন্তাটা হচ্ছে :
(!!!কেমন আছো, ডিক!!!)
হ্যালোরানের মুখ কুঁচকে গেল, আর ওর শরীর ঝটকা খেল পেছন দিকে। কটূ করে ওর দাঁতের পাটিগুলো বাড়ি খেল একটা আরেকটার সাথে, আর ওর নীচের ঠোঁট থেকে গড়িয়ে পড়ল রক্তের সরু ধারা। ওর হাত দু’টো আপনাআপনি লাফ দিয়ে বুকের কাছে চলে এল, তারপর আবার ফিরে গেল উরুর ওপর। কিছুক্ষণ ও নিজের চোখের পাতা পিটপিট করল। এসব দেখে ড্যানি ভয় পেয়ে গেল।
“মি: হ্যালোরান? ডিক? আপনি কি ঠিক আছেন?”
“আমি জানি না,” বলে মি: হ্যালোরান দূবলভাবে হাসল। “আমি সত্যি জানি না। আমি যা ভেবেছিলাম তোমার ক্ষমতা তার চেয়েও অনেক বেশী, ড্যানি।”
“সরি,” ড্যানি বলল। ওর এখন আরও বেশী ভয় লাগছে। “আমি কি বাবাকে ডেকে আনব? আমি এখনই দৌড়ে বাবাকে নিয়ে আসছি।”
“না না, আমি এখনই ঠিক হয়ে যাব। তুমি এখানেই থাকো ড্যানি। আমার মাথা একটু এলোমেলো হয়ে গেছে, আর কিছু নয়।”
“আমি কিন্তু আমার পুরো শক্তি দিয়ে চিন্তা করিনি।” ড্যানি স্বীকার করল। “শেষে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
“আমার কপাল ভালো যে করনি…নয়তো আমার মগজ গলে কান দিয়ে বেরিয়ে যেত।” হ্যালোরান ড্যানি মুখে শংকার ছাপ দেখে হাসল। “আরে কিছু হয় নি। তোমার কেমন লেগেছে?”
“মনে হচ্ছিল আমি অনেক জোরে একটা বেসবল ছুঁড়ছি।” ও দ্রুত জবাব দিল।
“তুমি কি বেসবল পছন্দ কর নাকি?” হ্যালোরান নিজের কপালের দু’পাশে আঙুল ঘসতে ঘসতে প্রশ্ন করল।
“আমি আর বাবা দু’জনেই এঞ্জেলস দলটার ভক্ত।” ড্যানি বলল। “আমি ছোটবেলায় বাবার সাথে একটা খেলা দেখতে গিয়েছিলাম। আমি একদম ছোট্ট ছিলাম তখন, আর বাবা…” ড্যানির চেহারা গম্ভীর হয়ে গেল।
“বাবার কি হয়েছিল, ড্যানি?”
“মনে নেই।” ড্যানি নিজের বুড়ো আঙুল মুখ পর্যন্ত নিয়ে এল চুষবার জন্যে, কিন্তু শুধু বাচ্চারা আঙুল চোষে, এটা মনে পড়াতে ও আবার হাত নামিয়ে রাখল।
“তোমার বাবা-মা কি চিন্তা করছে এটা কি তুমি বুঝতে পারো, ড্যানি?” হ্যালোরান ওকে মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করছিল।
“বেশীরভাগ সময়ই পারি, যখন আমি বুঝতে চাই। কিন্তু আমি সাধারণত বুঝবার চেষ্টা করি না।”
“কেন?”
“আহ্…” ড্যানি একটু থামল, ওর মুখে চিন্তার ছাপ। “আমার মনে হয় আমি এমন একটা কাজ করছি যেটা আমার করা উচিত নয়। যেন আমি বেডরুমে উঁকি দিয়ে ওদের ওই জিনিসটা করতে দেখছি যেটা করলে বাচ্চা হয়। আপনি কি ওই জিনিসটার কথা জানেন?”
“মানুষের মুখে ওটার কথা শুনেছি বটে।” হ্যালোরান চিন্তাপূর্ণ মুখে জবাব দিল।
“ওরা জানলে ব্যাপারটা পছন্দ করবে না। আর সেভাবেই ওরা যদি জানে যে আমি ওদের চিন্তা পড়তে পারি তাহলে ওরা রাগ করবে। জিনিসটা আমার কাছে নোংরা লাগে।”
“বুঝেছি।”
“কিন্তু আমি বুঝতে পারি ওদের মনের অবস্থা কেমন। ওরা রাগ করে আছে, না খুশি হয়ে আছে, নাকি কাঁদতে চাচ্ছে এগুলো আমি এমনিতেই বুঝতে পারি, আর এ জিনিসটা আমি চাইলেও বন্ধ করতে পারি না। আপনার কেমন লাগছে তাও আমি বুঝতে পারছি। আমি আপনাকে ব্যাথা দিয়েছি। সরি।”
“ও কিছু নয়। মাথাটা একটু ব্যাথা করছে, ব্যস এই। তুমি কি অন্যদের মনের কথা পড়তে পারো, ড্যানি?”
“আমি তো এখনও পড়তে শিখিনি।” ড্যানি বলল। “আমি শুধু কয়েকটা শব্দ পড়তে পারি। কিন্তু বাবা আমাকে এই শীতের মধ্যে শিখিয়ে দেবে। বাবা আগে একটা বড় স্কুলে পড়ালেখা শেখাত। লেখাতোই বেশী, কিন্তু বাবা পড়তেও জানে।”
“সেটা বলি নি। আমি জানতে চাচ্ছিলাম যে অন্যরা কি ভাবছে সেটা তুমি বুঝতে পারো কিনা।”
ড্যানি চিন্তা করে দেখল।
“যদি কেউ জোরে জোরে চিন্তা করে তাহলে পারি।” ও শেষে বলল। “যেমন মিসেস ব্র্যান্টের শুতে চাবার কথাটা, অথবা একবার আমি আর আম্মু দোকানে শপিং করবার সময় শুনতে পাই রেডিও স্টোরের সামনে দাঁড়িয়ে একটা ছেলে ভাবছে যে ও দাম না দিয়ে একটা রেডিও নিয়ে যাবে। তারপর ও ভাবল যে ও ধরা পড়ে যাবে। তারপর আবার ভাবল যে ওর একটা রেডিওর খুব শখ। তারপর আবার ধরা পড়বার কথা। চিন্তা করতে করতে ওর মাথা ঘুরাচ্ছিল, আর সেজন্যে আমারও মাথা ঘুরতে শুরু করে। আম্মু জুতোর দোকানের ভেতর জুতো দেখছিল, তাই আমি ছেলেটার কাছে গিয়ে বলি, রেডিওটা নিও না। ছেলেটা খুব ভয় পেয়ে সেখান থেকে চলে যায়।”
হ্যালোরান গল্পটা শুনে দাঁত বের করে হাসল। “পালাবারই কথা। তোমার কি আর কোন ক্ষমতা আছে, ড্যানি? শুধু চিত্তা আর অনুভূতি বুঝতে পারা বাদে অন্যকিছু?”
ও সাবধানে জবাব দিল : “আপনার কি অন্য কোন ক্ষমতা আছে?”
“মাঝে মাঝে,” হ্যালোরান বলল, “মাঝে মাঝে…আমি স্বপ্ন দেখি। তুমি কি স্বপ্ন দেখ, ড্যানি?”
“মাঝে মাঝে,” ড্যানি বলল। “আমি জেগে থেকেও স্বপ্ন দেখতে পাই। যখন টনি আসে।” ড্যানির বুড়ো আঙুল আবার ওর মুখের ভেতর যেতে চাচ্ছিল। ও এই প্রথম বাবা-মা বাদে কাউকে টনির কথা বলল। ও জোর করে নিজের হাত কোলের ওপর রাখল।
“টনি কে?”
তখনই হঠাৎ করে ড্যানির মাথার ভেতর বিদ্যুৎ খেলে গেল। ওর সাথে কখনও কখনও এমন হয়, যেন ও একটা বিশাল যন্ত্রের সামনে দাঁড়িয়ে আছে, যেটা ভালোও হতে পারে আবার মারাত্মক ক্ষতিকরও হতে পারে। ও যন্ত্রটাকে চিনতে পারছে না, বুঝতে পারছে না কারণ ও এখনও অনেক ছোট।
“কি হয়েছে?” ও কাঁদো কাঁদো গলায় জানতে চাইল। “আপনি আমাকে এসব জিজ্ঞেস করছেন কারণ আপনি ভয় পাচ্ছেন, তাই না? আপনি আমাদের নিয়ে কেন ভয় পাচ্ছেন? আমাকে নিয়ে কেন ভয় পাচ্ছেন?”
হ্যালোরান নিজের বড় বড় কালো হাতগুলো ড্যানির কাঁধে রাখল। “থামো,” ও বলল। “জিনিসটা হয়তো কিছুই নয়…আবার কিছু হতেও পারে। ড্যানি, তোমার ভেতর একটা ক্ষমতা লুকিয়ে আছে। এই শক্তিটাকে ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণে আনবার বয়স হয়তো তোমার এখনও হয় নি, কিন্তু বড় হবার সাথে সাথে তোমার সেটা চলে আসবে। ভরসা রাখতে শেখো।”
“কিন্তু আমি অনেক কিছু বুঝতে পারি না!” ড্যানি ফেটে পড়ল। “মানে আমি বুঝি, আবার বুঝি না। অন্যরা অনেককিছু ভাবে যেগুলো আমার মাথার মধ্যেও চলে আসে, কিন্তু আমি জানি না সেই চিন্তাগুলো কিসের!” ড্যানি গোমড়ামুখে নিজের কোলের দিকে তাকাল। “মাঝে মাঝে আমার মনে হয় আমি পড়তে পারলে খুব ভালো হত। টনি আমাকে মাঝে মাঝে কিছু সাইনবোর্ড দেখায় যার মানে আমি বুঝতে পারি না।”
“টনি কে?” হ্যালোরান আবার প্রশ্ন করল।
“আম্মু আর বাবা ওকে আমার ‘অদৃশ্য খেলার সাথী’ বলে ডাকে,” ড্যানি আস্তে আস্তে মুখস্ত বলবার শব্দগুলো উচ্চারণ করল। “কিন্তু ও আসলেই আছে। অন্তত আমার তো তাই মনে হয়। মাঝে মাঝে আমি যখন খুব মনোযোগ দিয়ে কোন কিছু বুঝবার চেষ্টা করি তখন ও আসে। এসে বলে, ‘ড্যানি, আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।’ তারপর আমার এমন মনে হয় যেন আমি কিছুক্ষণের জন্যে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু…তখন আমি স্বপ্ন দেখতে পাই, যেমন আপনি বললেন।” ও হ্যালোরানের দিকে তাকিয়ে ঢোক গিলল। “আগে ও ভালো ভালো জিনিস দেখাত। কিন্তু এখন…যেসব স্বপ্ন দেখলে ভয় লাগে আর কান্না পায় তাদের কি বলে আমি ভুলে গেছি।”
“দুঃস্বপ্ন?”
“হ্যা। ঠিক। দুঃস্বপ্ন।”
এই জায়গাকে নিয়ে? ওভারলুকের ব্যাপারে?”
ড্যানি আবার নিজের বুড়ো আঙুলের দিকে তাকাল। “হ্যা” ও নীচু স্বরে জবাব দিল। তারপর ও মাথা তুলে তীষ্মস্বরে বলল : “কিন্তু বাবাকে এটা বলা যাবে না, আপনিও বলতে পারবেন না! বাবার এই চাকরিটা দরকার কারণ এটা ছাড়া অ্যাল আঙ্কেল আর কোন চাকরি দিতে পারবে না আর বাবার নাটক শেষ করতে হবে আর চাকরি না থাকলে বাবা আবার খারাপ জিনিসটা করা শুরু করবে আর আমি জানি খারাপ জিনিসটা কি, সেটা হচ্ছে মদ খাওয়া, আর বাবা তাহলে আগের মত সবসময় নেশায় থাকবে আর নেশায় থাকা খুব খারাপ!” ড্যানি থামল। ওর চোখ ছলছল করছিল।
“শ্শ্শ্…” হ্যালোরান ড্যানিকে নিজের বুকে টেনে নিল। “সবকিছু ঠিক আছে বাবা। আর তোমার বুড়ো আঙুলটা যদি তোমার মুখের ভেতরে ঘুরে আসতে চায়, তাহলে যেতে দাও।”ও বলল। কিন্তু কেন যেন ওকে চিন্তিত দেখাচ্ছিল।
ও বলল, “তোমার যে ক্ষমতাটা আছে, যেটাকে আমি বলি জ্যোতি, বাইবেল ওই একই জিনিসকে বলে দিব্যদৃষ্টি, আর বিজ্ঞানীরা একে বলে প্রিকগনিশন। আমি এটা নিয়ে পড়ালেখা করেছি। এসবগুলো নামের একটাই মানে, সেটা হচ্ছে ভবিষ্যৎ দেখবার ক্ষমতা। বুঝেছ?”
,ড্যানি মাথা ঝাঁকাল
“আমার এখনও মনে আছে সবচেয়ে বেশী জ্যোতি আমার মধ্যে কবে এসেছিল…সারাজীবন মনে থাকবে। সালটা ছিল ১৯৫৫। আমি তখনও আর্মিতে ছিলাম, আমার পোস্টিং ছিল পশ্চিম জার্মানিতে। রাতের খাবারের প্রায় এক ঘণ্টা আগে আমি সিংকের কাছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একটা সিপাইকে বকছিলাম ও আলু ঠিকভাবে ছিলতে পারে না দেখে। আমি ওর হাত থেকে আলুটা নিয়ে দেখাতে গিয়েছি কিভাবে ছিলতে ওমনি দুম করে আমার সামনে থেকে রান্নাঘরটা গায়েব হয়ে গেল। এক সেকেন্ডের মধ্যে। টনি নামে এই ছেলেটা কি সবসময় আসে তুমি… স্বপ্ন দেখার আগে?”
ড্যানি মাথা ঝাঁকাল।
হ্যালোরান একটা হাত দিয়ে ড্যানিকে জড়িয়ে ধরল। “আমার বেলায় আসে কমলালেবুর গন্ধ। সেদিন আমি সারা বিকাল ধরেই কমলালেবুর গন্ধ পাচ্ছিলাম কিন্তু কিছু সন্দেহ করিনি। আমরা জুস বানাবার জন্যে এক বাক্স কমলা এনে রেখেছিলাম। সেদিন কিচেনের সবাই কমলালেবুর গন্ধ পাচ্ছিল!
এক মুহূর্তের জন্যে মনে হয়েছিল যে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছি। তারপর বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেলাম। দেখতে পেলাম আগুন। দূরে কারা যেন চিৎকার করছে, সাইরেনের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। স্টিম ইঞ্জিন যেমন হিস্ করে শব্দ করে তেমন একটা শব্দও শুনতে পেলাম। একটু কাছে গিয়ে দেখি ট্রেনের একটা বগি উলটে পড়ে আছে, একপাশে জর্জিয়া রেলওয়ের নাম লেখা। আমি দৃশ্যটা দেখামাত্র বুঝতে পারলাম যে আমার ভাই কার্ল ওই ট্রেনটায় ছিল, আর অ্যাক্সিডেন্ট করে ও মারা গেছে। তারপর মুহূর্তেই আবার সবকিছু বদলে গেল, দেখি যে আমি আমার কিচেনে দাঁড়িয়ে আছি আর সিপাইটা এক হাতে আলু নিয়ে বোকার মত আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ও জিজ্ঞেস করল, ‘আপনি ঠিক আছেন তো, স্যার?’ আর আমি বললাম, না, আমার ভাই মাত্র মারা গেছে।’ পরে যখন বাড়িতে মাকে ফোন করি তখন মা আমাকে বলে কি হয়েছে, কিন্তু আমি তো আগে থেকেই জানতাম।”
ও জোরে মাথা ঝাঁকাল, যেন স্মৃতিটা ঝেড়ে ফেলবার জন্যে, তারপর ড্যানির দিকে তাকাল। ড্যানি চোখ বড় বড় করে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল।
“কিন্তু মনে রেখো, ড্যানি, যেমন দেখবে সবসময় তেমন হয় না। একবার আমি এয়ারপোর্টে বসে প্লেনের জন্যে অপেক্ষা করছি, তখন হঠাৎ করে কমলালেবুর গন্ধ আসতে লাগল। তার আগে পাঁচ বছরে আমি কোন স্বপ্ন দেখি নি। তো আমি ভাবতে লাগলাম না জানি কি হবে। তাই আমি বাথরুমে যেয়ে দরজা লক করে দিলাম, যাতে হঠাৎ আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে অন্যরা ভয় না পেয়ে যায়। শেষপযন্ত তা হয় নি, কিন্তু আমার মনে হতে লাগল যে আমার যে প্লেনটায় ওঠার কথা সেটা ক্র্যাশ করবে। তারপর আবার সবকিছু ঠিক হয়ে গেল, কমলালেবুর গন্ধটাও মিলিয়ে গেল। আমি যেয়ে এয়ারলাইন্সের লোকদের সাথে কথা বলে প্লেন বদলে তিনঘণ্টা পরের ফ্লাইটটা নিলাম। তারপর কি হল জানো?”
“কি?” ড্যানি রুদ্ধশ্বাসে জানতে চাইল।
“কিছুই না!” হ্যালোরান বলে হাসল। ওর দেখে ভালো লাগল যে ড্যানির মুখেও হাসি ফুটেছে। “কিচ্ছু হয় নি। ওই প্লেনটা নিরাপদেই ল্যান্ড করে, কারও কোন ক্ষতি হয় নি। তো ড্যানি, মনে কোর না তুমি যে দেখতে পাও তা সবসময় সত্যি হবে।”
“ওহ্।” ড্যানি বলল।
ওর মনে পড়ল যে প্রায় এক বছর আগে টনি ওকে দেখিয়েছিল যে ওদের স্টভিংটনের বাসায় একটা বাচ্চা বিছানায় শুয়ে আছে। ড্যানি অধীর আগ্রহে তার জন্যে অপেক্ষা করেছে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোন বাচ্চা আসে নি।
“শোন, বাবা” হ্যালোরান ড্যানির দু’হাত নিজের হাতে নিল। “আমি এখানে প্রায় ছয় মাস ধরে কাজ করছি, আর আমিও কিছু দুঃস্বপ্ন দেখেছি, আমারও কিছু বাজে অনুভূতি হয়েছে। আমি কিছু জিনিস দেখতেও পেয়েছি। কি দেখেছি তা তোমার মত বাচ্চা একটা ছেলেকে না বলাই ভালো। খারাপ জিনিস। একবার আমি নিজে দেখেছি টপিয়ারিতে, আর একবার ডেলরেস ভিকি নামে এক মেইড কিছু একটা দেখতে পায়। ওর ভেতর একটু জ্যোতি আছে, কিন্তু ও সেটার ব্যাপারে জানে না বোধহয়। মি: আলম্যান ওকে বরখাস্ত করে দেয়। তুমি জান বরখাস্ত করে দেয়া মানে কি?”
“জি, স্যার।” ড্যানি সরলভাবে উত্তর দিল। “আমার বাবাকে স্কুল থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে আর এজন্যেই আমরা এখানে এসেছি।”
“আলম্যান ডেলরেসকে বরখাস্ত করে দেয় কারণ ও দাবী করেছিল যে ও একটা রুমে কিছু একটা দেখেছে। ওই রুমটায় আগে একটা খারাপ ঘটনা ঘটেছিল। রুম নং ২১৭। ড্যানি, তোমার আমাকে কথা দিতে হবে যে তুমি ওই রুমটা থেকে দূরে থাকবে। ওখানে ঢোকার চেষ্টা করবে না। একবারও নয়।”
“ঠিক আছে।” ড্যানি বলল। “সেই মহিলা-মেইড-কি আপনাকে যেয়ে দেখতে বলেছিল?”
“হ্যা। আমি গিয়েছিলাম। ওখানে একটা খারাপ জিনিস আছে, কিন্তু… আমার মনে হয় না ওই জিনিসটার কারও ক্ষতি করবার ক্ষমতা আছে। আমিএ কথাটাই বোঝাতে চাচ্ছি, ড্যানি। যাদের ভেতর জ্যোতি আছে তারা মাঝে মাঝে যেমন ভবিষ্যতে কি হবে দেখতে পায়, তেমনি অতীতে কি হয়েছে সেটাও তারা দেখতে পায়। কিন্তু এটা হচ্ছে অনেকটা গল্পের বইয়ের পৃষ্ঠায় ছবি দেখবার মত। তুমি কখনও কোন বইয়ে এমন কোন ছবি দেখেছ যেটা দেখে তোমার ভয় লেগেছে, ডক?”
“হ্যা,” ও রুপকথার বেশ কিছু গল্প মনে পড়ে গেল, যেখানে দৈত্য মানুষদেরকে গিলে খেয়ে ফেলেছে।
“কিন্তু তুমি তো জানতে যে ওই ছবিগুলো কখনও তোমার ক্ষতি করতে পারবে না, তাই না?”
“হ্যা…” ড্যানি বলল, যদিও ওর গলায় একটু সন্দেহের ছোঁয়া।
“এই হোটেলের ব্যাপারটাও ঠিক তেমন। এ জায়গাটায় আগে যত খারাপ কিছু হয়েছে তা সব পুরনো আবর্জনার মত পড়ে এখানে সেখানে। যদিও আমি জানি না এটার কারণ কি। খারাপ ঘটনা সব হোটেলেই ঘটে, আমি বেশ কিছু হোটেলে কাজ করেছি, তাই আমি জানি। কিন্তু সেসব জায়গায় এখানকার মত ঘটনাগুলো জমে থাকে না। কিন্তু ড্যানি, আমার মনে হয়না এই জিনিসগুলোর কারও ক্ষতি করবার ক্ষমতা আছে।” ও শেষের বাক্যের প্রতিটা শব্দ বলবার সময় ড্যানির কাঁধ ধরে ছোট্ট ঝাঁকুনি দিল, যাতে জানি কথাগুলোর গুরুত্ব বুঝতে পারে। “তাই তুমি যদি টপিয়ারিতে বা হোটেলের করিডরে কিছু দেখ তাহলে কিছুক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে তারপর আবার তাকাবে, দেখবে যে জিনিসটা চলে গেছে। বুঝেছ?”
“জি।” ড্যানি বলল। ওর এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো লাগছে। ও স্বস্তিবোধ করছিল। ও নিজের হাঁটুর ওপর দাঁড়িয়ে হ্যালোরানের গালে একটা চুমু দিল, তারপর ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। হ্যালোরানও ওকে জড়িয়ে ধরল।
ড্যানিকে ছেড়ে দেবার পর ও জানতে চাইল, “তোমার বাবা-মা’র ভেতর তো জ্যোতি নেই, তাই না?”
“না বোধহয়।”
“তোমার মাথায় আমি যেমন চিন্তা পাঠিয়েছি তেমন ওদের সাথেও চেষ্টা করেছিলাম। তোমার মা মনে হল একটু চমকে উঠেছে। আমার ধারণা সব মায়ের ভেতরই একটু জ্যোতি থাকে, অন্তত তাদের বাচ্চা বড় হয়ে ওঠার আগ পযন্ত। আর তোমার বাবা…
হ্যালোরান একটু থামল। ড্যানির বাবাকে ও খতিয়ে দেখেও বুঝতে পারে নি যে ওর ভেতর জ্যোতি আছে কি নেই। যেন জ্যাক টরেন্স নিজের ভেতর কিছু একটা লুকিয়ে রেখেছে, যেটার ব্যাপারে আর কেউ জানে না।
“আমার মনে হয় না তোমার বাবার ভেতর জ্যোতি আছে।” হ্যালোরান শেষ করল। “তাই ওদেরকে নিয়ে তোমার চিন্তা করতে হবে না। তুমি শুধু নিজেকে সামলে রাখলেই চলবে। মাথা ঠাণ্ডা রেখো। ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
“ড্যানি! এই, ডক!
হোটেলের সামনে থেকে ওয়েন্ডির গলা ভেসে এল।
ড্যানি ফিরে তাকাল। “আম্মু ডাকছে। আমার যেতে হবে।”
“জানি,” হ্যালোরান বলল। “ভালো থেকো, আর মজা করতে চেষ্টা কর। যতটুকু পারো আরকি।”
“চেষ্টা করব, মি: হ্যালোরান। ধন্যবাদ। এখন আমার আগের চেয়ে অনেক ভালো লাগছে।”
হাসিমাখানো চিন্তাটা ওর মাথার ভেতর ফুটে উঠল :
(আমার বন্ধুরা আমাকে ডিক বলে ডাকে) (ডিক, আচ্ছা, ঠিক আছে)
ওরা দৃষ্টি বিনিময় করল, আর ডিক হ্যালোরান চোখ টিপল ড্যানির দিকে তাকিয়ে।
ড্যানি গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে যাবার সময় ডিক ওকে ডাকল।
“ড্যানি?”
“জি?”
“যদি তোমার কোন সমস্যা হয়… তাহলে আমাকে ডাকবে। জোরে, যেভাবে একটু আগে চিন্তা পাঠালে সেভাবে। যদি আমি শুনতে পাই, তাহলে আমি ফ্লোরিডা থেকে ছুটে চলে আসব।”
“ঠিক আছে।” বলে ড্যানি একটু হাসল।
“ভালো থেকো বাবা।”
“আপনিও।”
ড্যানি নেমে হোটেলের দরজার দিকে ছুটে গেল, যেখানে ওয়েন্ডি অপেক্ষা করছে ওর জন্যে। ওকে দেখতে দেখতে হ্যালোরানের মুখ থেকে হাসি মিলিয়ে গেল।
আমার মনে হয় না এখানের কোন কিছু তোমার ক্ষতি করতে পারবে। আমার মনে হয় না।
কিন্তু যদি ওর ধারণা ভুল হয়ে থাকে? ওর ২১৭ নাম্বার রুমের জিনিসটার কথা মনে পরে গেল। যেকোন বইয়ের ছবির তুলনায় জিনিসটা দেখতে অনেক বাস্তব, আর ড্যানি একটা বাচ্চা ছেলে মাত্র…
আমার মনে হয় না…
হ্যালোরান গাড়ি চালাতে আরম্ভ করল। ও চাচ্ছিল না ফিরে তাকাতে, কিন্তু অনিচ্ছাস্বত্বেও ওর ঘাড় ঘুরে গেল। ছেলেটা আর ওর মা আর বাইরে নেই। যেন হোটেলটা ওদের দু’জনকে গিলে খেয়ে ফেলেছে।
অধ্যায় ১২ – হোটেল সফর
“তোমরা কি নিয়ে কথা বলছিলে, সোনা?” ভেতরে যেতে যেতে ওয়েন্ডি প্রশ্ন করল।
“ওহ, কিছু না।”
“কিছু না বলতে এতক্ষণ লাগল?”
ড্যানি কাঁধ ঝাকাল, আর ভঙ্গিটার মধ্যে ওয়েন্ডি স্পষ্ট জ্যাকের ছাপ দেখতে পেল। ড্যানির ভেতর থেকে ও আর কোন কথা বের করতে পারবে না। ওয়েন্ডি একইসাথে জেদ আর প্রচণ্ড ভালোবাসা অনুভব করল। ভালোবাসাটা ছিল অসহায় এক ধরণের ভালোবাসা, যেটার ওকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেও ওর আপত্তি করবার শক্তি নেই। আর জেদ কারণ ওর মনে হচ্ছিল যে ওর নিজের পরিবারেই ও যেন বাইরের কেউ। জ্যাক আর ড্যানির মাঝে এত প্রচণ্ড মিল যে ওর কখনও কখনও মনে হয় যে ও একজন অতিথি, যে ওদের সাথে কিছুদিন থাকতে এসেছে। কিন্তু এই শীতে তো এটা সম্ভব নয়, ওয়েন্ডি সন্তুষ্ট মনে ভাবল। ওরা তিনজন ছাড়া আর কেউ এখানে থাকবে না। ওকে জ্যাক আর ড্যানির নিজেদের দলে সামিল করতেই হবে। হঠাৎ ওয়েন্ডির মনে পড়ল যে ও নিজের ছেলে আর স্বামীকে হিংসা করছে,আর ও মনে মনে লজ্জা পেল। এমনভাবে ওর মা চিন্তা করে, ও নয়।
লবিতে এখন হোটেলের কয়েকজন কর্মচারী বাদে আর কেউ নেই আলম্যান আর হেড ক্লার্ক ক্যাশ রেজিস্টারের সামনে দাঁড়িয়ে টাকার হিসাব করছে, কয়েকজন মেইড নিজেদের ইউনিফর্ম বদলে সাদা পোশাকে লাগেজ নিয়ে দরজার কাছে অপেক্ষা করছে আর মেইনটেনেন্স ম্যান ওয়াটসন দাঁড়িয়ে আছে। ওয়েন্ডি ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে ওয়াটসন অশ্লীল ভঙ্গিতে চোখ টিপ মারল। ওয়েন্ডি সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিল। জ্যাক বড় জানালাটার কাছে দাঁড়িয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। ওকে দেখে মনে হচ্ছে ও নিজের কল্পনায় হারিয়ে গেছে।
হিসাব শেষ করে আলম্যান ঘটাং শব্দ তুলে ক্যাশ রেজিস্টার বন্ধ করে দিল। হেড ক্লার্কের চেহারায় স্বস্তির ছাপ দেখে ওয়েন্ডি মজা পেল। বোঝাই যাচ্ছিল যে বেচারা হিসাব নিয়ে একটু ভয়ে ছিল। আলম্যান নিশ্চয়ই টাকায় কোন ঘাটতি দেখলে ওর বেতন থেকে কেটে রাখে। আলম্যানকে ওয়েন্ডির তেমন পছন্দ হয় নি। ও হচ্ছে ওয়েন্ডির জীবনে দেখা অন্য প্রত্যেকটা বসের মতই। কাস্টমারদের সাথে মধুর স্বরে কথা বলে, আর কর্মচারীদের পান থেকে চুন খসলে বকে ভূত ভাগিয়ে দেয়। দেখে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিল যে আলম্যানের সাথে ওর পুরো তিনমাস দেখা হবে না এটা ভেবে হেড ক্লার্ক বেশ খুশি। স্কুল ছুটি, সবার জন্যে। ওয়েন্ডি, জ্যাক আর ড্যানি বাদে সবার জন্যে আরকি।
“মি: টরেন্স,” আলম্যান নাটকীয়ভাবে ডাকল। “একটু এদিকে আসবেন কি?”
জ্যাক এগিয়ে গেল, আর যাবার সময় ড্যানি আর ওয়েন্ডিকেও এগিয়ে যাবার জন্যে ইশারা করল।
ক্লার্ক এর মধ্যে ভেতরে গিয়ে জামা বদলে একটা ওভারকোট পরে এসেছে।
“আশা করি আপনার ছুটি ভালো যাবে, মি: আলম্যান।”
“মনে হয় না খুব একটা ভালো যাবে,” আলম্যান অন্যমনস্ক সুরে জবাব দিল। “১২ই মে’তে দেখা হবে, ব্র্যাডক। একদিন আগেও নয়, পরেও নয়।”
“জি স্যার।”
ব্র্যাডক চলে যাবার পর হোটেলের নীরবতাটা ওয়েন্ডি খেয়াল করল। বাইরে বাতাসের নিয়মিত হাহাকার বাদে আর একটা শব্দও কোথাও শোনা যাচ্ছে না। ও যেখানে দাঁড়িয়ে আছে সেখান থেকে অফিসের ভেতরটা দেখা যাচ্ছে, এত পরিচ্ছন্ন যে প্রায় ন্যাড়া ন্যাড়া লাগছিল অফিসটাকে। তার পেছনে ও হ্যালোরানের কিচেনও দেখতে পাচ্ছিল।
“ভাবলাম আরও কয়েক মিনিট থেকে আপনাদের হোটেলটা একটু ঘুরিয়ে দেখাই।”
ওয়েন্ডি খেয়াল করল যে আলম্যান ‘হোটেল’ শব্দটা সবসময় একটু জোর দিয়ে উচ্চারণ করে। “আপনার স্বামী কিছুদিনের মধ্যেই হোটেলের সবকিছু চিনে ফেলবে,
মিসেস টরেন্স, কিন্তু আপনার ও আপনাদের ছেলের হয়তো খুব বেশী ঘুরে দেখা হবে না। আপনারা নিশ্চয়ই বেশীরভাগ সময় লবি লেভেলেই কাটাবেন, যেখানে আপনাদের থাকার কোয়ার্টার।”
“নিশ্চয়ই।” ওয়েন্ডি ব্যাজার সুরে বিড়বিড় করল। জ্যাক চোখের ইশারায় ওকে মানা করল বিরক্তি দেখাতে।
“হোটেলটা খুবই সুন্দর,” আলম্যান বলল। “এই হোটেলের ম্যানেজার হতে পেরেছি বলে আমি খুবই গর্বিত।”
সেটা বোঝাই যায়, ওয়েন্ডি মনে মনে বলল।
“আপনার আবার দেরী হয়ে যাবে না তো…” জ্যাক শুরু করল।
আলম্যান একটা হাত তুলে ওকে থামিয়ে দিল। “না, হোটেল বন্ধ করবার সব কাজ শেষ করে ফেলেছি। এমনিতেও আমার আজকে রাতটা বোল্ডারে কাটানোর কথা, এই এলাকা ছেড়ে চলে যাবার আগে। এদিকে আসুন।”
ওরা সবাই মিলে লিফটে উঠল। ভেতরে তামা আর পেতল দিয়ে সুন্দর ডিজাইন করা। কিন্তু আলম্যান লিভার টানবার পর লিফটটা বেশ ভালোরকমের একটা ঝাঁকুনি খেল। ড্যানি একটু চমকে গেল তাতে। আলম্যান তা লক্ষ্য করে ওর দিকে তাকিয়ে ওকে আশ্বস্ত করবার জন্যে হাসল। ড্যানি চেষ্টা করল হাসিটা ফিরিয়ে দিতে, কিন্তু ও খুব একটা সফল হয়েছে বলে মনে হল না।
“ভয়ের কিছু নেই খোকা,” আলম্যান বলল। “এখানে দুর্ঘটনা ঘটার কোন সম্ভাবনাই নেই।”
“টাইটানিকের মালিকরাও একই কথা বলেছিল।” জ্যাক লিফটের ছাদে লাগানো কাঁচের গ্লোবটার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল। ওয়েন্ডি নিজের গাল কামড়ে হাসি চেপে রাখল।
আলম্যানের চেহারায় অবশ্য হাসির কোন চিহ্ন দেখা গেল না। ও দড়াম করে লিফটের ভেতরের দিকের দড়জাটা লাগিয়ে বলল : “টাইটানিক মাত্র একবারই যাত্রা করেছে, মি: টরেন্স, আর এই লিফটটা কম করে হলেও হাজারখানেক বার ওঠানামা করেছে এই হোটেল বেয়ে।”
“যাক, তাহলে তো কোন ভয় নেই।” জ্যাক ড্যানির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। “সব ঠিক আছে ডক, এই প্লেনটা ক্র্যাশ করবে না।”
আলম্যান লিভার টানবার পর ওরা সবাই একটা ঝাঁকুনি খেল, তারপর মোটরটা গুঙ্গিয়ে উঠে লিফটটাকে চালু হবার নির্দেশ দিল। প্রাচীন এই ঘরটার ভেতর আলোছায়ার খেলা দেখতে দেখতে ওয়েন্ডির মনে হল ওরা আর কখনও বের হতে পারবে না, দিনের আলো দেখার সৌভাগ্য ওদের কারও আর কখনও হবে না, এখানেই দম বন্ধ হয়ে মরতে হবে…
(অনেক হয়েছে! থামো!)
ওরা নামবার সময় লিফটটা আরেকটা ঝাঁকুনি খেল, যেটা ওয়েন্ডির মোটেও সুবিধার মনে হল না। আগে দুর্ঘটনা ঘটুক আর নাই ঘটুক, ও ঠিক করল যে ও এখানে যতদিন আছে লিফটের বদলে সিঁড়িই ব্যাবহার করবে। অন্তত তিনজন একসাথে এই মান্ধাতা আমলের লিফটে কখনওই উঠবে না। ড্যানি নেমে কিছুক্ষণ মেঝের কার্পেটটার দিকে তাকিয়ে রইল।
“কি দেখিস ডক?” জ্যাক কৌতুকপূর্ণ স্বরে জানতে চাইল। “ওখানে খাবারের দাগ লেগে আছে নাকি?”
“অসম্ভব।” আলম্যান বিরক্ত সুরে বলল। “সবগুলো কার্পেট মাত্র দু’দিন আগে শ্যাম্পু করা হয়েছে।”
ওর দেখাদেখি ওয়েন্ডিও করিডরের লম্বা কার্পেটটার দিকে তাকাল। নিঃসন্দেহে সুন্দর, কিন্তু ও নিজের ঘরে কখনও এরকম ডিজাইন বা রঙ ব্যাবহার করবে না। গাঢ় নীল রঙ এর একটা কার্পেট যেটার সারা শরীর জুড়ে লতাপাতার ডিজাইন। দেয়ালে নানারকম পাখির আদল আঁকা, যদিও কোনটাকেই ওয়েন্ডি চিনতে পারছিল না। সব মিলিয়ে করিডরটাকে একটা জঙ্গলের রুপ দেবার চেষ্টা করা হয়েছে।
“তোমার কি কার্পেটটা ভালো লেগেছে?” ও ড্যানিকে জিজ্ঞেস করল।
“হ্যা, আম্মু।” ড্যানির নিষ্প্রাণস্বরে জবাব দিল।
হলটা বেশ চওড়া, তাই ওদের হাঁটতে কোন অসুবিধা হচ্ছিল না। দেয়ালের ওয়ালপেপার কার্পেটের সাথে মানিয়ে আকাশী নীল রঙ এর। কিছুক্ষণ পরপর মাটিতে লাইটপোস্ট বসানো ছিল, যেগুলো ১৮০০ শতাব্দীর লন্ডনের গ্যাস লাইটের আদলে বানানো।
“বাহ্, লাইটগুলো তো চমৎকার।” ওয়েন্ডি বলল।
আলম্যান মাথা ঝাঁকাল, ও কথাটা শুনে খুশি হয়েছে। “দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মি: ডারওয়েন্ট বসিয়েছে ওগুলো। চারতলার অনেকখানি-যদিও সবটা নয়-ওনার ডিজাইন করা। এটা হচ্ছে প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট, ৩০০।”
ও বড় মেহগনির দরজাটায় চাবি লাগিয়ে মোচড় দিল। ভেতরে তাকাবার সাথে সাথে পুরো টরেন্স পরিবারের মুখ একসাথে হাঁ হয়ে গেল। সিটিং রুমের সামনে বিশাল জানালা দিয়ে বাইরের পাহাড়গুলোর অনেকখানি দেখা যাচ্ছে। আলম্যান আবার মনে মনে খুশি হল। ও এই প্রতিক্রিয়াটাই আশা করছিল। “চোখ জুড়িয়ে যায়, তাই না?”
“কোন সন্দেহ নেই তাতে।” জ্যাক উত্তর দিল।
জানালাটা এত বড় যে ওটা সিটিং রুমের দেয়ালের প্রায় সবটুকু নিয়ে নিয়েছে। বাইরে ছবির মত সুন্দর একটা সূর্য দু’টো পাহাড়ের চূড়ার মাঝে অস্ত যাচ্ছে। পাহাড়গুলোর গায়ে বরফ সূর্যের আলোয় মুক্তোর মত ঝকঝক করছে।
জ্যাক আর ওয়েন্ডি এই দৃশ্য দেখে এতই বিমোহিত হয়ে গিয়েছিল যে ওদের ড্যানির দিকে খেয়াল ছিল না। ওর দিকে তাকালে ওরা দেখতে পেত যে ড্যানি জানালার দিকে নয়, বরং বাঁ দিকের লাল-সাদা দেয়ালের দিকে তাকিয়ে আছে। আর ওর মুখ পাহাড়ের সৌন্দর্যের কারণে হাঁ হয় নি।
দেয়ালজুড়ে শুকনো রক্তের ছোপ, আর তার মাঝে মাঝে মানুষের হাঁড়ের টুকরো আর ধুসর মগজের টুকরো ঝুলে আছে। দৃশ্যটা দেখার সাথে সাথে ড্যানির বমি এসে গেল। দেয়ালে রক্ত আর মাংশ মিলে একটা আবছা আকৃতি ধারণ করেছে : একজন মানুষের চেহারা যার মুখ ব্যাথায় বিকৃত, যার মাথার একপাশ থেঁতলে গিয়েছে…
(যদি তুমি কিছু দেখ তাহলে কিছুক্ষণ অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে রেখে তারপর আবার তাকাবে, দেখবে যে জিনিসটা চলে গেছে। বুঝেছ?)
ও জোর করে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, আর মুখ স্বাভাবিক রাখল যাতে কেউ কিছু বুঝতে না পারে। আর মা যখন ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল তখন ও হাতটা ধরল বটে, কিন্তু তাতে চাপ দিল না যাতে ওরা দেখতে না পায় যে ও ভয় পেয়েছে।
আলম্যান বাবাকে শীতের সময় জানালা বন্ধ রাখার ব্যাপারে কিছু একটা বোঝাচ্ছিল। ড্যানি আড়চোখে আবার দেয়ালটার দিকে তাকাল। এখন আর ওখানে কিছু দেখা যাচ্ছে না। রক্ত, চেহারা, কিছুই না।
আলম্যান এখন ওদেরকে আবার রুমের বাইরে নিয়ে গেল। আম্মু জানতে চাইল ড্যানির পাহাড়গুলো কেমন লেগেছে। ড্যানি বলল ভালো, যদিও পাহাড়ের দিকে ও একবারও মনোযোগ দিতে পারে নি। আলম্যান দরজায় তালা দেবার সময় ড্যানি আরেকবার ভেতরে থাকাল। রক্তের ছোপগুলো আবার ফিরে এসেছে, কিন্তু এখন আর শুকনো নয়। তাজা রক্ত দেয়াল থেকে গড়িয়ে মাটিতে পড়ে জমা হচ্ছে। আলম্যান সরাসরি দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে এই রুমটায় কোন কোন বিখ্যাত ব্যাক্তি এসে থেকেছে তার বর্ণনা দিচ্ছিল। ড্যানির তখন খেয়াল হল যে ও নিজের নীচের ঠোঁট কামড়ে রক্ত বের করে ফেলেছে। ও অন্যদের পেছন পেছন হাঁটতে হাঁটতে ঠোঁটের রক্ত হাত দিয়ে মুছে চিন্তা করতে লাগল-
(রক্ত)
(মি: হ্যালোরান কি রক্তই দেখেছিলেন নাকি তারচেয়েও খারাপ কিছু?) (আমার মনে হয় না এই জিনিসগুলো তোমার কোন ক্ষতি করতে পারবে) ওর বুকের ভেতর একটা চাপা চিৎকার জমা হয়ে আছে, কিন্তু ও কখনও সেটা বের হতে দেবে না। ওর বাবা-মা এসব জিনিস দেখতে পায় না, বুঝতেও পারে না। ওর বাবা আর মা একজন আরেকজনকে ভালোবাসছে এখন, আর এটাই সবচেয়ে জরুরি কথা। অন্য সবকিছু রুপকথার বইয়ের ছবির মত। কিছু ছবি দেখলে ভয় লাগে ঠিকই, কিন্তু ওরা কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ওরা…কোন… ক্ষতি….করতে….পারবে…না।
মি: আলম্যান ওদের চারতলার গোলকধাঁধার মত করিডরে হাঁটতে হাঁটতে আরও বেশ কয়েকটা রুমে নিয়ে গেলেন। একটা রুম দেখিয়ে আলম্যান জানালো যে এখানে ম্যারিলিন মনরো নামে এক মহিলা আর্থার মিলার নামে এক লোকের সাথে এসে থেকেছিলেন। তখন ওরা স্বামী-স্ত্রী ছিলেন। পরে ওদের ‘ডিভোর্স’ হয়ে যায়।
“আম্মু?”
“কি, সোনা?”
“যদি ওরা স্বামী-স্ত্রী হয়ে থাকে, তাহলে ওদের দু’জনের নাম দু’রকম ছিল কেন? তোমার আর বাবার দু’জনের নামই তো “টরেন্স’”
“হ্যা, কিন্তু আমরা তো আর বিখ্যাত নই।”জ্যাক বলল। “যেসব মেয়েরা খুব বিখ্যাত তারা নিজেদের পদবী বদলায় না, কারণ ওরা নাম বিক্রি করেই বেঁচে থাকে।”
“নাম বিক্রি করে?” ড্যানি অবাক হয়ে প্রশ্ন করল।
“বাবা যেটা বলল তার মানে হচ্ছে,” ওয়েন্ডি বলল, “লোকজন ম্যারিলিন মনরোর সিনেমা দেখতে যেতে যাবে কিন্তু ম্যারিলিন মিলারের নয়।”
“কিন্তু কেন? ওনার চেহারা তো একই থাকবে তাই না? মানুষ কি আর ওনাকে দেখলে চিনবে না?”
“হ্যা, তা চিনবে, কিন্তু…” ওয়েন্ডি অসহায়ভাবে জ্যাকের দিকে তাকাল। “স্বনামধন্য লেখক ট্রুম্যান ক্যাপোটিও এ রুমে থেকেছিলেন।” আলম্যান অধৈর্য্যস্বরে বাধা দিল। “এটা আমি ম্যানেজার হবার পরের ঘটনা। খুবই ভালো লোক ছিলেন। ভদ্র।”
আর কোন রুমেই তেমন অসাধারণ কিছু দেখা গেল না। শুধু লিফটের কাছের দেয়ালে ঝোলানো একটা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দেখে ড্যানির কেন যেন একটু অস্বস্তি হল।
এক্সটিংগুইশারটা বেশ পুরনো আমলের, একটা চ্যাপটা হোসপাইপ যেটার একদিক গুটিয়ে একটা লাল হুইলের সাথে গিয়ে যুক্ত হয়েছে, আর অন্যদিকে পেতলের নল যেদিক দিয়ে পানি বের হয়। হুইলটার মাঝে একটা লোহার পাইপের মত জিনিস ঢোকানো, যেটা আগুনের সময় একটানে খুলে হুইলটা ঘুরিয়ে পানি ছাড়া যায়। ড্যানি একবার দেখেই বুঝতে পারছিল যন্ত্রটার কোন অংশ কি করে, এসব ব্যাপারে ওর একটা সহজাত ক্ষমতা আছে। ওর যখন মাত্র আড়াই বছর বয়স তখন ওদের স্টভিংটনের বাসার দরজার লক কিভাবে খুলতে হয় তা ও শিখে ফেলে।
এই এক্সটিংগুইশারটা ওর দেখা অন্যান্য এক্সটিংগুইশারের চেয়ে পুরনো। ওর নার্সারি স্কুলেও একটা আগুন নেভানোর যন্ত্র ছিল, কিন্তু ওটা আরও আধুনিক। কিন্তু ওর অস্বস্তির কারণ যন্ত্রটার বয়স নয়। ও কিছুতেই বুঝতে পারছিল না যে ওর এমন কেন লাগছে। এই এক্সটিংগুইশারটাকে দেখে মনে হচ্ছে ওটা একটা পেঁচিয়ে থাকা সাপ, দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে ঘুমাচ্ছে। যখন ওরা হল থেকে লিফটে উঠল তখন ড্যানি মনে মনে খুশি হল, কারণ এখান থেকে এক্সটিংগুইশারটা আর দেখা যাচ্ছে না।
“সবগুলো জানালাতেই শাটার দেয়া জরুরি।” আলম্যান লিফটে উঠতে উঠতে বলল। ওরা সবাই ওঠার পর লিফটটা একটু দেবে গেল। “কিন্তু প্রেসিডেন্সিয়াল সুইটগুলো নিয়েই আমার চিন্তা সবচেয়ে বেশী। ওই বড় জানালাটার সেসময়েই দাম পড়েছে চারশ’ বিশ ডলার, আর এখনকার দিনে তো তা আরও দশগুণ বেশী পড়বে।”
“আমি শাটার লাগিয়ে দেব।” জ্যাক বলল।
ওরা এবার তিনতলায় এল, যেখানে আরও বেশী রুম আর আরও প্যাঁচালো করিডর। সূর্য পাহাড়ের নীচে চলে যাওয়ায় চারদিকে অন্ধকার হয়ে আসছিল। তিনতলায় আলম্যান ওদের দু’-তিনটের বেশী রুমে নিয়ে গেল না। হ্যালোরান যে রুমটার ব্যাপারে ড্যানিকে সাবধান করেছিল, ২১৭ নাম্বার রুম, সেটার সামনে দিয়ে আলম্যান একবারও না থেমে হেঁটে চলে গেল। ড্যানি দরজায় লাগানো নাম্বারপ্লেটটার দিকে কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকাল।
তারপর ওরা দোতলায় নেমে এল। মি: আলম্যান লবিতে যাবার সিঁড়ির কাছে আসবার আগ পর্যন্ত কোন রুমের সামনে দাঁড়াল না। সিঁড়ির কাছে এসে সে বলল : “এই হচ্ছে আপনাদের থাকবার জায়গা।”
ভেতরে কি আছে দেখবার জন্যে ড্যানি নিজেকে মনে মনে প্রস্তুত করল। কিন্তু ও ঢুকে দেখল যে কিছুই নেই।
ওয়েন্ডি রুমটা দেখে ভেতরে ভেতরে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ওপরে প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট দেখে ওর মনে ভয় ঢুকে গিয়েছিল। এসব ঐতিহাসিক জায়গা দেখতেই ভালো লাগে, কিন্তু ওকে আর জ্যাককে যদি ওই বিশাল বিছানায় শুতে হত যেখানে আব্রাহাম লিংকন আর ফ্র্যাংকলিন রুজভেল্ট ঘুমিয়েছেন, তাহলে ওর অস্বস্তিতে ঘুমই আসত না। কিন্তু ওদের থাকবার এই রুমটা সেরকম নয়। এটা ছোট, ঘরোয়া আর ছিমছাম। ওর মনে হল না এখানে তিনমাস থাকতে ওর বিশেষ কষ্ট হবে।
“রুমটা বেশ সুন্দর।” ওয়েন্ডি সন্তুষ্টসুরে বলল।
আলম্যান মাথা ঝাঁকাল। “খুব বেশী কিছু নয়, কিন্তু কাজ চালাবার জন্যে যথেষ্ট। সাধারণত বাবুর্চি আর তার স্ত্রী এখানে থাকে।”
ড্যানি আলম্যানের কথায় বাধা দিল, “মি: হ্যালোরান এখানে থাকেন?” আলম্যান ঘাড় বাঁকিয়ে ড্যানির দিকে তাকাল। “হম্ম্।” বলে ও আবার
জ্যাক আর ওয়েন্ডির দিকে মুখ ফেরাল। “এটা হচ্ছে বসার ঘর।”
বেশ কয়েকটা চেয়ার রাখা রুমটার ভেতর, যেগুলো আরামদায়ক হলেও খুব একটা দামী নয়। একটা কফি টেবিল আছে মাঝখানে, যেটা একসময় দামী ছিল, কিন্তু এখন সেটার মাঝখানে ফাটল ধরেছে। আরও ছিল দু’টো বুককেস, (পুরনো আমলের ডিটেকটিভ উপন্যাস আর রিডার্স ডাইজেস্ট ম্যাগাজিনে ভর্তি, ওয়েন্ডি খেয়াল করল) আর একটা হোটেল প্রদত্ত নামহীন টিভি, যেটাকে অন্যান্য জিনিসগুলোর পাশে বেমানান লাগছিল।
“এখানে অবশ্য রান্না করার কোন জায়গা নেই,” আলম্যান বলল। “কিন্তু এই রুমটা হোটেল কিচেনের ঠিক ওপরে।” ও দেয়ালের একটা চারকোণা প্যানেল সরিয়ে দেখাল যে তার ভেতরে আরেকটা চারকোণা ট্রে লুকিয়ে আছে। ও ট্রেটাকে ঠেলা দিতেই সেটা সরে গেল, আর একটা লম্বা, ঝুলন্ত দড়ি দেখা দিল।
“চোরকুঠুরি!” ড্যানি উত্তেজিত স্বরে বলল। জিনিসটা দেখে ও কিছুক্ষণের জন্যে সব ভয় ভুলে গেল। “ঠিক যেমন আমরা ওই ভূতের সিনেমাটায় দেখেছিলাম!”
মি: আলম্যানের ভ্রু কুঁচকে গেল, কিন্তু ওয়েন্ডি হাসল ড্যানির দিকে তাকিয়ে। ড্যানি দৌড়ে কুঠুরিটার নীচে কি আছে দেখবার জন্যে উঁকি দিল।
“এদিকে আসুন, প্লিজ।”
আলম্যান বসার ঘরের সাথে যুক্ত আরেকটা দরজা খুলল। ভেতরে ওদের শোবার ঘর দেখা যাচ্ছিল। ঘরটা বেশ খোলামেলা। দু’টো সিঙ্গেল বিছানা রুমের দু’পাশে রাখা। ওয়েন্ডি স্বামীর দিকে তাকিয়ে হেসে কাঁধ ঝাকাল।
“কোন অসুবিধা নেই।” জ্যাক বলল। “আমরা জোড়া লাগিয়ে নেব।” মি: আলম্যান ঘাড় ঘুরিয়ে ওদের দিকে তাকাল। ও বুঝতে পারে নি জ্যাক কি বলতে চাচ্ছে। “কি?”
“বিছানাগুলো,” জ্যাক হাসিমুখে বলল। “আমরা বিছানা দু’টো জোড়া লাগিয়ে নেব।”
“বেশ,” আলম্যান তখনও বুঝতে পারে নি ওরা কিসের কথা বলছে। তারপর হঠাৎ করে ব্যাপারটা ওর মাথায় ঢুকল, আর সাথে সাথে ওর গালে লালের ছোপ পড়ল। “আপনাদের যা ভালো মনে হয়।”
ও বসার ঘরে যেয়ে আরেকটা দরজা খুলল। এটা অন্য একটা, আরও ছোট বেডরুম আর এখানে সিঙ্গেল বেডের বদলে একটা দোতলা বাংক বেড রাখা। মেঝের কার্পেটটা ক্যাটক্যাটে সবুজ রঙের, অনেকটা ক্যাকটাসের মত। ওয়েন্ডি খেয়াল করল যে ড্যানির রুমটা বেশ পছন্দ হয়েছে। এই রুমটার দেয়ালগুলোতে আসল পাইন কাঠের প্যানেল লাগানো।
“এখানে তুই থাকতে পারবি না, ডক?”
“হ্যা বাবা, আমি ওপরের বাংকে শোব, ঠিক আছে?”
“আপনি যেটা চান সেটাই হবে, ডক।”
“এই কার্পেটটাও আমার খুব ভালো লেগেছে, মি: আলম্যান। হোটেলের অন্য সব জায়গায় এমন কার্পেট নেই কেন?”
এক মুহূর্তের জন্যে আলম্যানের মুখ কুঁচকে গেল, যেন ও একটা লেবুতে কামড় দিয়েছে। তারপর ও হেসে ড্যানির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। “এখানে রুমটা তোমার একার,” ও বলল, “শুধু বাথরুমটা বাদে, যেটা তোমার বাবা- মা’র বেডরুমের সাথে যুক্ত। জায়গাটা বেশী বড় নয়, কিন্তু আপনারা তো পুরো হোটেলটাই খালি পাচ্ছেন, তাই না?” শেষের কথাটা জ্যাক আর ওয়েন্ডির উদ্দেশ্যে ছিল। “লবির ফায়ারপ্লেসে আগুন জ্বালিয়ে আরাম করতে পারেন, অথবা যদি ইচ্ছে হয় তাহলে ডাইনিং রুমে বসে খেতে পারবেন।” আলম্যানের গলা শুনে মনে হল যে ও টরেন্সদের অনেক বড় উপকার করছে।
“বেশ তো।” জ্যাক জবাব দিল।
“আমরা কি নীচে যেতে পারি?” আলম্যানের প্রশ্ন।
“অবশ্যই।” ওয়েন্ডি বলল।
ওরা লিফটে করে নীচে নেমে এল। এখন লবিতে ওয়াটসন ছাড়া আর কেউ নেই। ও মেইন ডেস্কের সাথে হেলান দিয়ে একটা টুথপিক চিবোচ্ছিল।
“তোমার তো এতক্ষণে চলে যাওয়ার কথা।” আলম্যান ঠাণ্ডা গলায় বলল।
“মি: টরেন্সকে বয়লারের কথাটা মনে করিয়ে দেবার জন্যে থেকে গেলাম,” ওয়াটসন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বলল। “প্রেশারের দিকে খেয়াল রাখবেন। ব্যাটা কিন্তু আস্তে আস্তে বাড়ে।”
“বেশ, রাখব।” জ্যাক বলল।
“আপনার কোন অসুবিধা হবে না,” ওয়াটসন জ্যাকের সাথে হ্যান্ডশেক করল। তারপর ও ঘুরে ওয়েন্ডির দিকে তাকিয়ে একটু মাথা ঝুঁকালো। “ম্যাডাম,” ও বলল।
“খুশি হলাম,” ওয়েন্ডি বলল। বলার পর ওর মনে হল যে কথাটা শুনতে হাস্যকর লেগেছে, কিন্তু কারও মধ্যে কোন অভিব্যাক্তি না দেখে ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
“আর মি: ড্যানি টরেন্স,” ওয়াটসন গম্ভীরমুখে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। ড্যানি, যে দেখে দেখে শিখে নিয়েছে কিভাবে হ্যান্ডশেক করতে হয়, নিজের ছোট্ট হাত বাড়িয়ে ধরল ওয়াটসনের হাতটা। “খেয়াল রেখো যাতে ওদের কিছু না হয়, ড্যান।”
“জি।”
ওয়াটসন ড্যানির হাত ছেড়ে আলম্যানের দিকে তাকাল। “আগামী বছর দেখা হচ্ছে তাহলে,” বলে ও আলম্যানের দিকে হাত বাড়াল।
আলম্যান দায়সারাভাবে হাতটা ধরে ঝাঁকাল।
“১২ই মে, ওয়াটসন। একদিন আগেও নয়, পরেও নয়।”
“জি, স্যার,” জ্যাক ওয়াটসনের চেহারা দেখেই বুঝতে পারল ও মনে মনে কি বলছে : “হারামজাদা শুওর”
“আশা করি আপনার ছুটি ভালো যাবে, মি: আলম্যান।”
“মনে হয় না,” আলম্যান তিক্তসুরে উত্তর দিল।
ওয়াটসন বাইরে যাবার জন্যে মেইন গেটের একটা পাল্লা খুলল। বাইরে তখনও বাতাস গর্জন করছিল। ও ঘুরে দাঁড়িয়ে বলল, “ভালো থাকেন আপনারা।”
ড্যানি সবার হয়ে উত্তর দিল, “জি, আপনিও।”
ওয়াটসন চলে গেল।
এক মুহূর্তের জন্যে ড্যানির নিজেকে প্রচণ্ড একা লাগল।
অধ্যায় ১৩ – পোর্চ
টরেন্স পরিবারকে হোটলের সামনের পোর্চে ঠিক একটা ছবির মত দেখাচ্ছিল। ড্যানি মাঝখানে দাঁড়িয়ে, ওর পরনে একটা জ্যাকেট যেটা ওর শরীরে ছোট হয়, ওয়েন্ডি ওর বাঁ পাশে কাঁধে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আর জ্যাক ওর ডানদিকে, ওর হাত আলতো করে ড্যানির মাথায় রাখা।
মি: আলম্যান ওদের চেয়ে একধাপ নীচে দাঁড়িয়ে ছিল। সে এখন একটা দামী ওভারকোট গায়ে চড়িয়েছে। সূর্য পুরোপুরি পাহাড়ের আড়ালে চলে গিয়েছে এখন, আর উঠানের সবকিছুর ছায়া সে কারণে লম্বা, বেগুনী রুপ নিয়েছে। এখন পার্কিং লটে হোটেলের ট্রাক, আলম্যানের লিংকন কন্টিনেন্টাল আর টরেন্সদের গাড়িটা ছাড়া আর কোন গাড়ি নেই।
“সবগুলো চাবি বুঝে নিয়েছেন তো?” আলম্যান জ্যাককে জিজ্ঞেস করল। “বয়লার অথবা ফার্নেসের বাপারে আর কোন প্রশ্ন আছে?”
জ্যাক আলম্যানের মনের অবস্থা বুঝতে পারল। হোটেল বন্ধ করবার সব কাজ শেষ। কিন্তু নিজের প্রাণপ্রিয় হোটেলকে একজন অচেনা মানুষের হাতে ছেড়ে যেতে আলম্যানের কষ্ট হচ্ছে।
“নাহ্, মনে হয় না আমার কোন অসুবিধা হবে।”
“বেশ। আমি যোগাযোগ রাখব।” এটা বলার পরও আলম্যান কিছুক্ষণ দ্বিধাজড়িত মুখে ওদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলল, “বেশ। আশা করি আপনাদের শীতকাল আনন্দে কাটবে, মি: টরেন্স, মিসেস টরেন্স, ড্যানি, তোমারও।”
“আপনিও ভালো থাকুন, মি: আলম্যান,” ড্যানি বলল।
“মনে হয় না আমার শীতকাল খুব একটা ভালো যাবে,” আলম্যান আবার দীর্ঘশ্বাস ফেলল। “ফ্লোরিডার যে জায়গাটা আমি দেখাশোনা করি সেটা খুবই নিম্নমানের একটা রিসর্ট, সত্যি কথা বলতে। ওভারলুক হচ্ছে আমার আসল চাকরি। জায়গাটার খেয়াল রাখবেন, মি: টরেন্স।”
“চিন্তা করবেন না, মি. আলম্যান, আপনি ফিরে আসা পযন্ত হোটেল ঠিকঠাক থাকবে।” জ্যাক বলল, আর সাথে সাথে ডানির মাথায় বিদ্যুচ্চমকের মত একটা চিন্তা খেলে গেল :
(কিন্তু আমরা ঠিক থাকব তো?)
“অবশ্যই, অবশ্যই।” আলম্যান উত্তর দিল।
তারপর ও পাকা ব্যবসায়ীর মত একবার মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, “গুডবাই, তাহলে।”
ও হেঁটে নিজের গাড়ির কাছে গেল। এত খাটো একজন মানুষের পাশে গাড়িটা বিশাল দেখাচ্ছিল। ও উঠে একটান দিয়ে গাড়িটা বের করে চলে গেল।
“হম্,” জ্যাক বলল।
আলম্যান চলে যাবার পর ওরা তিনজন একজন আরেকজনের সাথে দৃষ্টি বিনিময় করল। উঠানে জমে থাকা পাতার মধ্যে বাতাস খেলা করছে, কিন্তু সেটা দেখার জন্যে আর কেউ নেই। জ্যাকের হঠাৎ করে মনে হল যে বাগানের ছায়াগুলো বিশাল বড় হয়ে গিয়েছে, আর ওরা সে তুলনায় হয়ে গিয়েছে ক্ষুদ্র, অসহায়।
তারপর ওয়েন্ডি বলল : “একি ডক, ঠাণ্ডার চোটে তো তোমার নাক দিয়ে পানি পড়ছে। চল চল, ভেতরে চল।”
ওরা সবাই ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল। পেছনে পড়ে গেল বাতাসের শোঁ শোঁ গর্জন।
অধ্যায় ১৪ – ছাদে
“বাল! শালা শূয়োরের বাচ্চা!”
জ্যাক চড়া গলায় চেঁচিয়ে উঠল। ও নিজের জ্যাকেটে হাত চাপড়ে যে বোলতাটা ওকে হুল ফুটিয়েছে সেটাকে সরাল। তারপর এক দৌড়ে ছাদের ওপরে উঠে গেল যাতে ও মাত্র যে চাকটাকে নাড়া দিয়েছে সেটা থেকে অন্য বোলতাগুলো বেড়িয়ে ওকে নাগালে না পায়। যদি অন্য বোলতাগুলো আসলেই ওর পিছু নিয়ে থাকে তাহলে ওর কপালে ভোগান্তি আছে। ও যেই মই বেয়ে ছাদে উঠেছে চাকটা ঠিক তার সামনে। নীচে নামবার জন্যে ছাদে আরেকটা দরজা আছে ঠিকই, কিন্তু সেটা অন্যদিক থেকে তালা লাগানো। আর ছাদ থেকে যদি ও লাফ দেয় তাহলে ওর জন্যে সত্তর ফিট নীচে নিশ্চিত মৃত্যু অপেক্ষা করছে।
কিন্তু বোলতার চাক থেকে কোনরকম সাড়াশব্দ এল না।
জ্যাক ছাদের ওপর বসে নিজের হাত পরীক্ষা করে তিক্ত সুরে শিস দিল। আঙুলটা এখনই ফুলতে শুরু করেছে। যেভাবেই হোক চাকটাকে এড়িয়ে ওর নীচে নেমে হাতে বরফ লাগাতে হবে।
আজ অক্টোবরের বিশ তারিখ। ওয়েন্ডি আর ড্যানি হোটেলের ট্রাকে করে সাইডওয়াইন্ডারে গিয়েছে তিন গ্যালন দুধ আর ক্রিসমাসের জন্যে কিছু টুকিটাকি জিনিস কিনতে (ট্রাকটা যদিও পুরনো আমলের, কিন্তু ওদের গাড়িটার চেয়ে ভালো অবস্থায় আছে)। যদিও এখনও ক্রিসমাস শপিং এর সময় হয় নি, কিন্তু বলা যায় কখন বরফ পড়ে ওদের শহরে যাবার রাস্তা বন্ধ করে দেবে। এখনই হোটেলের উঁচু কোন যায়গায় দাঁড়ালে দেখা যায় যে বরফ পড়ে রাস্তার কয়েকটা জায়গা পিচ্ছিল হয়ে আছে।
দু’-তিনবার বরফ পড়া বাদে এখন পর্যন্ত ওরা চমৎকার আবহাওয়া পেয়েছে। সোনালী রোদ দিয়ে দিন শুরু হয়, আর সোনালী রোদ দিয়েই শেষ হয়। এটা হচ্ছে ছাদে নতুন টালি লাগাবার জন্যে খুবই ভালো আবহাওয়া।
জ্যাক অবশ্য ওয়েন্ডির কাছে অকপটে স্বীকার করেছে যে ওর উচিত ছিল তিন- চারদিন আগেই এই কাজটা শেষ করে ফেলা।
এখন ছাদের ওপর বসে ওর মনে হল এখান থেকে পাহাড়ের যে ভিউ পাওয়া যায় সেটা প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট থেকেও ভালো। তারচেয়েও বড় কথা, কাজটা অনেক শান্তির। এখানে বসে ওর গত তিন বছরের ঝামেলাগুলো আর মনে পড়ছে না।
পুরনো টালিগুলোর বেশীরভাগই পচে গিয়েছে, আর ছাদের একটা বড় অংশ থেকে গত বছরের ঝড় টালি উড়িয়ে নিয়ে গেছে। বোলতার কামড় খাওয়ার আগ পর্যন্ত ও পুরনো টালিগুলো পরিষ্কার করছিল।
কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে এই যে, এর আগে ও প্রত্যেকবার ছাদে আসার আগে নিজেকে মনে করিয়ে দিয়েছে যে ছাদে বোলতা বা মৌমাছির চাক থাকতে পারে। এ জন্যই ও কীটনাশক ওষুধে ভরা একটা ক্যান কিনে নিয়ে এসেছে যেটা বাগ বম্ব নামে পরিচিত। কিন্তু আজকে ও চারপাশের শান্তি আর সৌন্দর্যে হারিয়ে গিয়েছিল। ওর মন চলে গিয়েছিল ও যে নাটকটা লেখছে তার জগতে।
নাটকটা এখন পর্যন্ত ভালোই আগাচ্ছে। ওয়েন্ডিকে পড়ে শোনাবার পর যদিও ও খুব বেশী কিছু বলে নি, কিন্তু জ্যাক বুঝতে পেরেছিল যে ওর নাটকটা পছন্দ হয়েছে। জ্যাক একটা জরুরি দৃশ্যে এসে আটকে গিয়েছিল, যেখানে গল্পের নায়ক গ্যারি বেনসন আর ডেংকার, তার নিষ্ঠুর হেডমাস্টারের মধ্যে কথা কাটাকাটি হয়। এটুকু লেখার পর ও মদ ছেড়ে দেয়, আর এরপরের তিন মাস ও স্কুলে ঠিকমত ক্লাসও করাতে পারে নি, নাটক নিয়ে বসা তো দূরের কথা।
কিন্তু গত বারোদিনের মধ্যে, যখন ও হোটেলের টাইপরাইটারটা নিয়ে লিখতে বসেছে, ও একবারও আটকায়নি। ওর মাথা ঝড়ের বেগে কাজ করেছে, আর একটার পর একটা দৃশ্য পরিষ্কারভাবে ফুটে উঠেছে ওর চোখের সামনে। ডেংকারের চরিত্রটা ও এখন আরও ভালোভাবে ধরতে পেরেছে, আর সেই অনুযায়ী নাটকের দ্বিতীয় অংকের দৃশ্যগুলো বদলে নিয়েছে। এখন ফুলে যাওয়া আঙুলটাকে দেখতে দেখতে তৃতীয় অংকের অনেকগুলো দৃশ্যগুলোও ও মনে মনে ঠিক করে নিচ্ছিল। যদি ওর লেখা এভাবে আগাতে থাকে, তাহলে জানুয়ারীর মধ্যেই ও পুরো নাটকটা শেষ করে ফেলতে পারবে।
ও নিউ ইয়র্কে একজন প্রকাশককে চেনে, ফিলিস স্যান্ডলার নামে এক মহিলা যার হবি হচ্ছে একটার পর একটা সিগারেট শেষ করা। ফিলিসই জ্যাকের আগের তিনটে গল্প ছাপানোর ব্যাবস্থা করে, এস্কোয়ারে যেটা ছাপা হয়েছিল সেটাও। জ্যাক ওকে নাটকটার ব্যাপারে জানিয়েছে। নাটকটা হচ্ছে ডেংকার নামে একজন চরিত্রের ব্যাপারে, যে যৌবনে একজন প্রতিভাবান ছাত্র হবার পরও বড় হয়ে একজন নিষ্ঠুর প্রধান শিক্ষকে রুপান্তরিত হয়। আর নায়ক হচ্ছে গ্যারি বেনসন, যে জ্যাকের নিজের ছাত্র জীবনের আদলে সৃষ্ট। নাটকের নাম : ‘দ্যা লিটল স্কুল।’ ফিলিস ওকে চিঠি পাঠিয়ে জানায় যে নাটকটা ওর পছন্দ হয়েছে। তার কয়েক মাস পর ফিলিস ওকে আরেকটা চিঠি দিয়ে জানতে চায় যে নাটকটা শেষ হচ্ছে না কেন। জ্যাক লিখে পাঠায় যে ওর মাথা কাজ করছে না। কিন্তু এখন ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছিল যে নাটকটা শেষ করা সম্ভব। গল্পটার কোয়ালিটি কিরকম, অথবা শেষ পর্যন্ত নাটকটা মঞ্চে উঠল কিনা, এসব নিয়ে জ্যাকের তেমন মাথা ব্যাথা নেই। ওর কাছে এই নাটকটা হচ্ছে ওর খারাপ সময়গুলোর একটা প্রতীক। এই নাটকটা হচ্ছে ওই সময়গুলোর প্রতিনিধি যখন ও নিজের ছেলের হাত ভেঙ্গে ফেলেছিল, যখন ওর বিয়ে প্রায় ভাঙ্গতে বসেছিল, যখন ও কোন অচেনা ছেলেকে মদের নেশায় গাড়ির ধাক্কা উড়িয়ে দেয়, যখন ও নিজের চাকরি হারায়। এই প্রতীকী গুরুত্বের কারণেই জ্যাকের জন্যে নাটকটা শেষ করা জরুরি, যাতে ও নিজেকে বলতে পরে যে ও খারাপ সময়গুলো পেছনে ফেলে এসেছে। তাই বলে ও নাটক শেষ করে উপন্যাস লেখা শুরু করবে না। আবার তিন বছর লাগিয়ে কোন কিছু লেখার ধৈর্য্য ওর আপাতত নেই। হয়তো ও এরপর ছোটগল্পের একটা সংকলন লিখবার চেষ্টা করবে।
জ্যাক আস্তে আস্তে হামাগুড়ি দিয়ে আগে ও যেখানে ছিল সেদিকে আগাতে লাগল। ও বোলতার চাকটার দিকে গভীর মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য রাখছিল, যাতে চাকের বাসিন্দারা বেরিয়ে আসতে শুরু করলে ও এক দৌড়ে মই বেয়ে নীচে নেমে যেতে পারে।
ও কাছাকাছি এসে ছাদের তক্তাগুলোর ফাঁকে উঁকি দিয়ে দেখল চাকটার কি অবস্থা।
চাকটা বিরাট সাইজের, আর ওটা এমনভাবে ছাদের ভেতরের আর বাইরের তক্তাগুলোর মধ্যে ঝুলে আছে যে দেখে মনে হচ্ছে না সহজে বের করা যাবে। জ্যাক দেখতে পেল যে ধুসর বলটার ভেতর পোকাগুলো কিলবিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এগুলো নিরীহ জাতের হলুদ বোলতা নয়, এগুলো হচ্ছে বিশাল সাইজের বদমেজাজী বোলতা। এখন শীতের প্রকোপে পোকাগুলো কিছুটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে, কিন্তু তাও জ্যাক মনে মনে নিজের কপালকে ধন্যবাদ দিল যে ওকে একটার বেশী হুল খেতে হয় নি। আর যদি গ্রীষ্মের সময় ওর এই চাকের মুখোমুখি হতে হলে ওর কি পরিণতি হত চিন্তা করে জ্যাক শিউরে উঠল। যখন এক ডজন বোলতা কাউকে ছেঁকে ধরে তখন তার এটা মনে থাকে না যে সে কোথায় দাঁড়িয়ে আছে। তখন দৌড়াতে গিয়ে ছাদ থেকে পড়ে যাওয়াটা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
জ্যাক কোথায় যেন পড়েছিল যে ৭% রোড অ্যাক্সিডেন্টের কোন কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না। কোন এঞ্জিনের সমস্যা নেই, ড্রাইভার মদ খায়নি, আবহাওয়াও সুন্দর, কিন্তু তাও গাড়িগুলো যেন নিজ ইচ্ছাতেই রাস্তা থেকে সরে এসে উলটে পড়ে থাকে। ভেতরে মৃত ড্রাইভার, আর এমন কেউ নেই যে বলতে পারবে আসলে কি হয়েছিল। একজন পুলিশ অফিসার ইন্টারভিউতে বলেছিলেন যে এধরণের দুর্ঘটনার কারণ খুব সম্ভবত কোন পোকা। একটা বোলতা বা মৌমাছি গাড়িতে ঢুকে গিয়েছিল, আর ড্রাইভার হয়তো আতংকিত হয়ে সেটাকে বের করে দেবার চেষ্টা করছিল। তখন হয়তো পোকাটা তাকে হুল ফুটিয়ে দেয়। যাই হয়ে থাকুক, তার ফল একটাই। দড়াম! গাড়ি ওলটানো, মৃত ড্রাইভার, আর রহস্যময় অ্যাক্সিডেন্ট। আর পোকাটা কিছুই হয় নি এমনভাবে ধ্বংসস্তূপ থেকে উড়ে চলে যায়। জ্যাকের মনে পড়ল যে অফিসার বলেছিলেন পোস্ট-মর্টেমের সময় মৃতদেহে কোন পতঙ্গনিসৃত বিষ পাওয়া যায় কিনা তা খুঁজে দেখতে।
এখন বোলতার চাকটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে জ্যাক আবার অন্যমনস্ক হয়ে গেল। জ্যাকের এখনও মনে হয় ওর সাথে যা যা খারাপ কিছু হয়েছে তা ওর নিজের ভুলে হয় নি, ও ছিল নিয়তির নির্দোষ শিকার। ওর কোন দোষ নেই, ওর সাথে অন্যায় করা হয়েছে। ও স্টভিংটন স্কুলে আরও বেশ কয়েকজন শিক্ষককে চিনত যারা মদ খায়, তাদের মধ্যে দু’জন তো জ্যাকের মত ইংলিশই পড়াত। কিন্তু তারা মদ খেত শুধু সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে, স্কুলে যেসব দিন ক্লাস থাকত সেসব দিনে কখনও নয়।
জ্যাক আর অ্যালের ব্যাপারটা ছিল আলাদা। ওরা মদ খেত না, মদ ওদের খেত। ওরা দু’জনই ছিল অ্যালকোহলিক। ওরা দু’জন একে অপরকে এমনভাবে টেনে ধরেছিল যেভাবে একজন ডুবন্ত মানুষ তার পাশের জনকে টেনে ধরে তাকেও ডুবতে বাধ্য করে। শুধু ওরা দু’জন যে সাগরে ডুবছিল সেটা জলের নয়, মদের।
নীচে বোলতাগুলো নিরলসভাবে নিজেদের কাজ করে যাচ্ছিল। আসছে শীতে ওদের রানি বাদে প্রত্যেকটা পোকা মারা যাবে, কিন্তু ওদের সহজাত প্রবৃত্তি ওদের কখনওই কাজ বন্ধ করতে দেবে না, যতদিন ওরা বেঁচে আছে।
জ্যাকের মদের নেশা নতুন কিছু নয়। ও কলেজের ফার্স্ট ইয়ারে থাকতে যখন প্রথম মদ খায় তখন থেকেই ওর জিনিসটার প্রতি আসক্তি জন্মে যায়। জ্যাকের এই প্রবল আসক্তির কারণ ইচ্ছাশক্তির অভাব বা চারিত্রিক দুবলতা নয়। ওর ভেতরে কোথায় যেন কিছু ভেঙ্গে গিয়েছে, বা ওর কোন অংশ অসম্পূর্ণ রয়ে গিয়েছে। সেই শূণ্যতাটাকে কোনভাবে পূরণ করবার জন্যে জ্যাক মদের সাগরে ডুব দেয়। ওকে আরও গভীরে যেতে সাহায্য করে স্টভিংটন স্কুলে পড়াবার চাপ, আর ড্যানির ভাঙ্গা হাত, যেটার কারণ আসলে ও নয়, ওর কপাল খারাপ দেখে জিনিসটা ঘটে গিয়েছিল। ওর বদমেজাজের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। সারাজীবন ধরেই ওর রীতিমত যুদ্ধ করতে হয়েছে নিজের রাগকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্যে। ওর যখন সাত বছর বয়স তখন ওকে ম্যাচ নিয়ে খেলতে দেখে এক প্রতিবেশী মহিলা ওকে প্রচণ্ড বকা দেয়। জ্যাক তারপর রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ঢিল ছুঁড়ে একটা গাড়ির জানালার কাঁচ ভেঙ্গে ফেলে। দূভাগ্যবশত, জ্যাকের বাবার চোখে পড়ে যায় এই ব্যাপারটা। সেদিনটার কথা জ্যাকের বেশ ভালো করেই মনে আছে। ওর পিঠে মোটা মোটা লাল দাগ ফেলে দিয়েছিল বাবা।
জ্যাকের মনে হল ওর পুরো জীবনটাই একটা মৌমাছির চাকের মত, যেখানে নিয়তি ওকে বারবার বিষাক্ত হুল দিয়ে দংশন করতে থাকে।
ওর চোখের সামনে জর্জ হ্যাফিন্ডের চেহারা ভেসে উঠল।
লম্বা, এলোমেলো একমাথা সোনালী চুল জর্জের চেহারায় একটা দুষ্টু সৌন্দর্য এনে দিয়েছিল। জর্জ যখন একটা জীন্সের প্যান্ট আর হাতা গুটানো শার্ট পড়ে স্কুলে আসত তখন জ্যাক ওকে একবার দেখেই বুঝে গিয়েছিল যে এ ছেলের মেয়েদের পটাতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু জ্যাকের কখনওই ওকে দেখে হিংসা হয় নি। বরং জ্যাক জর্জকে মনে মনে নিজের নাটকের নায়ক গ্যারি বেনসনের জায়গায় কল্পনা করছিল। তাই বলে জ্যাক কখনও ডেংকারের মত ওকে ঘৃণা করত না। ওর মত লোক কেন নিজের ছাত্রকে ঘৃণা করবে?
জর্জ স্কুলে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। ও ফুটবল আর বাস্কেটবল বেশ ভালো খেলত, এবং ছাত্র হিসাবে চমৎকার না হলেও খুব খারাপও ছিল না। ও ক্লাসে চেহারায় একধরণের দুষ্টু, বিস্মিত অভিব্যাক্তি নিয়ে বসে থাকত। জ্যাক এরকম চেহারা আগেও দেখেছে, আয়নায়। ও স্কুলে থাকতে ঠিক একই রকমের ছাত্র ছিল। জর্জ হ্যাফিল্ড সহজাত প্রবৃত্তিবশেই একজন প্রতিযোগী, যে পড়ালেখায় তেমন ইন্টারেস্টিং কিছু খুঁজে না পেলেও প্রতিযোগিতায় জিতবার জন্যে যে কোন কিছু করতে পারে।
জানুয়ারীতে জ্যাক নিজের ডিবেট টিমের জন্যে দু’ডজনের মত প্রার্থীকে যাচাই করে দেখে। তাদের মাঝে জর্জ হ্যাফিল্ডও ছিল। জর্জ জ্যাকের সাথে খোলাখুলিভাবে কথা বলে। ও বলে যে ওর বাবা একটা বড় ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের জন্যে উকিল হিসাবে কাজ করেন, আর উনি চান যে তার ছেলেও একই কাজ করুক। সেই উদ্দেশ্যে জর্জের বাবার খুবই শখ যে তার ছেলে স্কুলের ডিবেট টিমে থাকুক। ডিবেট কোর্টে কেস লড়ার প্র্যাকটিস হিসাবে কাজ করে। জ্যাক মার্চের শেষে সিদ্ধান্ত নেয় যে ও জর্জকে টিমে রাখবে।
তার সামনের শীতকালে একটা বড় ডিবেট কম্পিটিশন হবার কথা ছিল, আর জর্জ, একজন দক্ষ প্রতিযোগী, নিজেকে সেটার জন্যে প্রস্তুত করতে শুরু করে। ও রীতিমত সিরিয়াস পড়ালেখা শুরু করে যে বিষয়ে বিতর্ক করতে হবে তা নিয়ে, যাতে কম্পিটিশনের সময় ওর জয় কেউ ঠেকাতে না পারে। এছাড়াও ডিবেটার হিসাবে জর্জের বেশ কিছু ভালো গুণ ছিল। ও পক্ষে আছে না বিপক্ষে আছে তা নিয়ে ওর বিশেষ মাথাব্যাথা ছিল না, শুধু জেতাটাই ওর জন্যে জরুরি। তাছাড়া ও কখনও তর্কের সময় যা বলা হত সেগুলোকে অপমান হিসাবে গণ্য করত না।
কিন্তু জর্জের একটা বড় সমস্যা ছিল। ও ছিল তোতলা।
ক্লাস করবার সময় কখনও জর্জের এ সমস্যাটা হয়না, কারণ ওখানে ও সাধারণত চুপচাপ বসে থাকে আর কম কথা বলে, আর খেলার মাঠে তো নয়ই, ওখানে একটা দু’টোর বেশী শব্দ বলার দরকারও পড়ে না।
কিন্তু উত্তেজিত বিতর্কের সময় জর্জের এই সমস্যাটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠত। ও যত দ্রুত কথা বলবার চেষ্টা করত ততই বেশী তোতলাতো। আর যখন ওর মনে হত যে ও কোন প্রতিদ্বন্দীকে কোণঠাসা করে ফেলেছে তখন উত্তেজনায় প্রায় ওর কথা বন্ধ হবার মত অবস্থা হত। লজ্জাকর ব্যাপার।
“ত্-ত্-তো সে ক্-ক্-কারণেই আমি মনে ক্-ক্-করি যে এই ব্-ব্- ব্যাপারটা এত সহজ ন্-ন্-নয় বিপক্-ক্-ক্ষ দল যতটা ব্-ব্-বলছেন…’
ওর কথা শেষ হবার আগেই সময় শেষের ঘণ্টা বেজে উঠত, আর জর্জের ক্ষিপ্ত দৃষ্টি যেয়ে আছড়ে পড়ত জ্যাকের ওপর, যে ঘণ্টাটা বাজিয়েছে।
টিম থেকে অন্যান্য বাজে সদস্যদের বের করে দেবার পরও জ্যাক জর্জকে আরও কিছুদিন রাখে। ও আশা করছিল যে প্র্যাকটিসের সাথে সাথে জর্জের অবস্থার হয়তো উন্নতি হবে। কিন্তু শেষপর্যন্ত জ্যাক বাধ্য হয় ওকে বের করে দিতে। ওর সেদিনটার কথা এখনও স্পষ্ট মনে আছে। ডিবেট শেষে রুম থেকে অন্য প্রতিযোগীরা বের হয়ে যাবার পর জর্জ রাগী চেহারা নিয়ে জ্যাকের মুখোমুখি হয়।
“আপ্-আপনি ইচ্ছে করে আগে ঘু-ঘণ্টা বাজিয়েছেন!”
জ্যাক নিজের ব্রিফকেসে কাগজ গুছিয়ে রাখতে রাখতে মুখ তুলে তাকাল। “মানে?”
“আমি আমার প্-পুরো পাঁচ ম্-মিনিট পাই নি। আপনি আগেই ঘণ্টা ব্ বাজিয়েছেন। আমি ঘু-ঘড়ি দেখেছি।”
“তোমার ঘড়ি হয়তো একটু ফ্যাস্ট ছিল, জর্জ। আমি শপথ করে বলতে পারি যে আমি আগে ঘণ্টা বাজাই নি।”
“ব্-ব্-বাজিয়েছেন!”
জর্জকে এভাবে উদ্ধত, বেয়াদবীর সুরে কথা বলতে দেখে জ্যাকের নিজেরও আস্তে আস্তে মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। এমনিতেই ওর মদ ছেড়ে থাকতে জান বের হয়ে যাচ্ছিল। আগের দু’মাস এক ফোঁটা সুরা না ছোঁয়ার কারণে জ্যাকের বেশীর ভাগ সময়ই মেজাজ চড়ে থাকত। ও তাও একবার শেষ চেষ্টা করে জর্জকে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝানোর : “আমি আবারও বলছি জর্জ, আমি ঘণ্টা আগে বাজাইনি। তুমি তোতলাচ্ছিলে দেখে হয়তো তোমার মনে হয়েছে যে তুমি কথা বলবার যথেষ্ট সময় পাওনি। তুমি কি জানো ডিবেটের সময় তোমার কেন এমন হয়? ক্লাসের সময় তো তুমি স্বাভাবিকভাবেই কথা বল।”
“আমি ত্-ত্-তোতলাই নৃ-না!”
“আস্তে কথা বল।”
“আপনি চ্-চান না যে আ-আমি আপনার ট্-টিমে থাকি!”
“আস্তে কথা বল। এত উত্তেজিত হবার কিছু নেই -”
“ব্-ব্-বাল!”
“জর্জ,তুমি যদি তোমার তোতলামোকে বশে আনতে পারো, তাহলে তোমাকে টিমে নিতে আমার কোন অসুবিধা নেই। তুমি বিতর্কের বিষয় নিয়ে ভালো পড়াশোনা কর, তাই বিপক্ষ দল কখনওই তোমাকে চমকে দিতে পারে, না। শুধু তুমি তোতলাও বলে-”
“আমি কক্-কখনওই ত্-তোতলাই না!” জর্জ চিৎকার করে বলল। “দৃ- দোষ আসলে আপনার! যদি আপনার জ্-জায়গায় অ-অন্য কেউ ডিবেট টিমের দ্-দ্-দায়িত্বে থাকত—”
জ্যাকের রাগ আর একটু বাড়ল।
“জর্জ, তুমি যদি এভাবে তোতলাতে থাকো তাহলে তোমার বাবার যে স্বপ্ন তোমাকে উকিল বানাবার তা কখনওই সত্যি হবে না। ওকালতি আর ফুটবল খেলা এক জিনিস নয়। প্রতিদিন দু’ঘণ্টা প্র্যাকটিস করাই যথেষ্ট নয়। নিজের তোতলামো ঠিক না করতে পারলে কোর্টে যেয়ে কি বলবে, অ-অ- অবজেকশন ই-ই-ইয়োর অনার?”
কথাটা শেষ করবার সাথে সাথে জ্যাকের প্রচণ্ড অপরাধবোধ হল। এত নিষ্ঠুরভাবে বলা উচিত হয় নি। ছেলেটা একদমই বাচ্চা, আর জ্যাকের ওপর ওর এত রাগের কারণ নিজের অসহায়তা ছাড়া আর কিছুই নয়।
জর্জ শেষ একবার ক্রুদ্ধ দৃষ্টি ছুঁড়ল জ্যাকের দিকে। ও এখন এত উত্তেজিত যে শব্দগুলো বের হবার সময় ওর ঠোঁট কাঁপছিল। “আপন্-ন্-নি ইচ্ছা ক্-ক্-করে আগে ঘ-ঘণ্টা বাজিয়েছেন! আপনি আমাকে দে-দেখতে পারেন না ক্-কারণ আপন্-নি জানেন-”
কথা শেষ না করে জর্জ ঘুরে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেল। যাবার সময় ও এত জোরে দরজা লাগাল যে জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল।
জ্যাকের মনে রাগ আর অপরাধবোধের পাশাপাশি একটা অসুস্থ আনন্দও কাজ করছিল। জীবনে প্রথমবারের মত জর্জ হ্যাফিল্ড এমন একজন প্রতিদ্বন্দীর মুখোমুখি হয়েছে যাকে হারানো অত সোজা নয়। বাবা যতই ধনী হয়ে থাকুক, টাকা খাইয়ে তো আর তোতলামো বন্ধ করা যায়না। কিন্তু এক মুহূর্ত পরই জ্যাক আবার প্রচণ্ড লজ্জা আর অপরাধবোধে ডুবে গেল। ড্যানির হাত ভাঙ্গবার পর ওর যেমন লেগেছিল ঠিক তেমনই।
হে ঈশ্বর, আমি তো আসলে এত বড় হারামী নই, তাই না?
জর্জের পরাজয়ে ও যে অসুস্থ আনন্দ বোধ করেছে সেটা ওর নাটকের ভিলেন ডেংকারকে মানায়, জ্যাক টরেন্সকে নয়।
আপনি আমাকে দেখতে পারেন না কারণ আপনি জানেন …
ও কি জানে?
ও কি এমন জানে জর্জ হ্যাফিল্ডের ব্যাপারে যেটা দেখে ও জর্জকে ঘৃণা করবে? যে জর্জের পুরো ভবিষ্যৎ ওর সামনে পড়ে রয়েছে? যে জর্জ দেখতে হলিউডের কিশোর নায়কদের মত? যে ও যখন খেলার মাঠে বল নিয়ে টান দেয় তখন মেয়েরা সবাই গল্প ভুলে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে?
হাস্যকর। এধরণের চিন্তা ওর মাথায় আসাটাই অবিশ্বাস্য। সত্যি বলতে, জ্যাক চায় যে জর্জের তোতলামো ঠিক হয়ে যাক, কারণ ও আসলেই অন্য সবদিক থেকে একজন ভালো ডিবেটার। আর জ্যাক যদি ঘণ্টাটা একটু আগে বাজিয়েই থাকে, তাহলে তার একমাত্র কারণ ছিল এই যে জর্জকে ওভাবে তোতলাতে দেখে ওর মায়া লাগছিল।
এর সপ্তাহখানেক পর জ্যাক জর্জকে টিম থেকে বাদ দিয়ে দেয়। এবার জ্যাক মাথা ঠাণ্ডা রাখে। চিৎকার, গালিগালাজ যা করবার এবার জর্জ একলাই করে। তারও এক সপ্তাহ পরে একদিন জ্যাক স্কুলের গ্যারেজে যায় নিজের গাড়ি থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র বের করতে। যেয়ে দেখে যে ওর গাড়ির সামনের চাকার কাছে জর্জ হ্যাফিল্ড উবু হয়ে বসে আছে, আর ওর হাতের ছুরি, যেটা ইতিমধ্যে গাড়ির অন্য তিনটা চাকার দফারফা করে দিয়েছে, প্রস্তুত হচ্ছে চার নাম্বার চাকাটায় প্রবেশ করবার জন্যে।
জ্যাক রাগে অন্ধ হয়ে যায়। তারপর কি হয়েছিল তা ওর খুব ভালো করে মনে নেই। শুধু মনে আছে যে ওর গলা থেকে একটা হিংস্র গর্জন বেরিয়ে আসে আর ও জর্জকে বলে, “ঠিক আছে জর্জ, তোর যদি এত দেখবার ইচ্ছা থাকে আমি কত খারাপ হতে পারি তোকে সেটা আমি আজ দেখাচ্ছি।”
জ্যাক জবাব দেয় : “আমার কাছে আসলে ভালো হবে না বলে দিচ্ছি-”
তারপরের দৃশ্য হচ্ছে স্কুলের ফ্রেঞ্চ শিক্ষিকা মিস স্ট্রং জ্যাকের হাত ধরে টানছেন আর চিৎকার করছেন, “ওকে ছাড়ো জ্যাক! ওকে ছাড়ো, ছেলেটাকে তুমি মেরে ফেলবে!”
জ্যাক বোকার মত চোখ পিটপিট করে চারদিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে যে এতক্ষণ কি ঘটেছে। ওর গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে যে গাড়ির দরজার একজায়গায় ট্যাপ খেয়ে গেছে, আর সেখানে লাল কিছু একটা লেগে আছে, রক্তও হতে পারে, লাল রঙও হতে পারে। দাগটা রক্তের মনে হতেই জ্যাকের মন একমুহূর্তের জন্যে আবার ওর অ্যাক্সিডেন্টের রাতে ফিরে গেল,
(হে ঈশ্বর অ্যাল, আমরা কাকে যেন চাপা দিয়ে দিয়েছি)
তারপর ওর চোখ গেল জর্জের দিকে। জর্জের কপালের একটা জায়গায় কেটে গিয়েছে, কিন্তু সেটা খুব একটা সিরিয়াস কিছু বলে মনে হচ্ছিল না। কিন্তু ছেলেটার নাক থেকেও রক্ত পড়ছে, যার মানে ওর মাথার ভেতরে কোন নাজুক জায়গায় হয়তো আঘাত লেগেছে। এর মধ্যে জ্যাকের ডিবেট টিমও অকুস্থলে এসে পড়েছে, কিন্তু ওরা দরজার কাছে জড়সর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, কাছে আসবার সাহস পাচ্ছিল না।
জ্যাক মিস স্ট্রং এর হাত ছাড়িয়ে জর্জের কাছে গেল দেখতে ওর কি অবস্থা। ওকে এগিয়ে আসতে দেখে জর্জ সিঁটিয়ে গেল।
ও জর্জের বুকে একটা হাত রেখে বলল “শুয়ে থাকো, উঠবার চেষ্টা কোর না,” বলে ও মিস স্ট্রং এর দিকে ফিরল। উনি তখনও ওদের দিকে আতংকিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন। জ্যাক ওনাকে বলল, “আপনি কি যেয়ে স্কুলের ডক্টরকে ডেকে আনতে পারবেন?”
মহিলা মাথা ঝাঁকিয়ে ভেতরের দিকে ছুটে চলে গেলেন। জ্যাক এবার নজর ফেরাল নিজের ডিবেট টিমের দিকে। ও ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ভরসা দিতে চাচ্ছিল যে ও এখন ঠিক আছে, ওর রাগ চলে গিয়েছে। ওর যখন মাথা ঠাণ্ডা থাকে তখন ওর মত ভালো মানুষ এই শহরে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। ওর নিজের ছাত্ররা কি তা জানে না?
“তোমরা বাড়ি চলে যাও। আগামী সপ্তাহে দেখা হবে।”
কিন্তু আগামী সপ্তাহ আসতে আসতে ওর টিমের ছয়জন সদস্য টিম ছেড়ে দেয়। দু’জন সেদিনই, যেদিন গ্যারেজে ওরা ঘটনাটা ঘটতে দেখে। যদিও জ্যাকের তা নিয়ে বেশী মাথা ঘামাবার উপায় ছিল না, কারণ এর মধ্যে ওকে নোটিশ দিয়ে দেয়া হয়েছিল যে ও নিজেই আর বেশীদিন স্কুলে থাকবে না।
কিন্তু তারপরেও জ্যাক একফোঁটা মদ ছোঁয়নি। ওর আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশংসা করতে হয়।
আর ও জর্জকে কখনওই ঘৃণা করত না। ওর কোন সন্দেহ ছিল না সে ব্যাপারে। ওর কোন দোষ ছিল না, ওর সাথে অন্যায় করা হয়েছে।
আপনি আমাকে দেখতে পারেন না কারণ আপনি জানেন…
কিন্তু জ্যাক কিচ্ছু জানে না। কিচ্ছু না। ও ঈশ্বরের সামনে দাঁড়িয়ে শপথ করে এ কথা বলতে পারবে। ঠিক যেমন ও যখন ঘণ্টাটা এক মিনিট আগে বাজিয়েছিল ও জর্জকে দেখতে পারে না বলে নয়, জর্জের ওপর ওর মায়া হচ্ছিল বলে।
চাক থেকে দু’টো বোলতা আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল।
জ্যাক বোলতাগুলোকে উড়ে বেরিয়ে যেতে দেখে বাস্তবে ফিরে এল। কতক্ষণ ধরে ও ছাদে বসে পুরনো কাসুন্দি ঘাটছে? ও ঘড়ির দিকে তাকাল। প্রায় আধা ঘণ্টা।
জ্যাক সাবধানে মইয়ের কাছে এসে তারপর আস্তে আস্তে নেমে এল। ও ঠিক করল যে বাগ বম্ব দিয়ে সবগুলো বোলতাকে মেরে ও চাকটা ড্যানিকে দেবে নিজের ঘরে রেখে দেবার জন্যে। জ্যাকের কাছেও একটা ছিল, ছোটবেলায়। জিনিসটা ও চোখের সামনে ধরলে ভেতরে থেকে ধোঁয়া আর পেট্রলের গন্ধ ভেসে আসত।
“আমি ভালো হয়ে যাছি। আমার উন্নতি হচ্ছে।”
নিজের গলার আওয়াজ শুনে জ্যাকের ভালো লাগল। যদিও ও কথাটা জোরে জোরে বলতে চায়নি। ওর আসলেই মনে হচ্ছিল যে ওর মানসিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। ও ঠিক করল যে এখন থেকে ও চেষ্টা করবে নিয়তির অন্যায় সিদ্ধান্তগুলোর জন্যে বসে না থেকে নিজের জীবনের নিয়ন্ত্রণ নিজের হাতে নেবার।
ও নীচে নেমে বাগ বম্বটা খুঁজতে লাগল। জ্যাক ওদের দেখিয়ে দেবে। ওর বদলা নেবার সময় এসেছে।