শাঁসালো জর্মনি

শাঁসালো জর্মনি

এ রকম ধন-দৌলতের ছড়াছড়ি আমি এ জীবনে কখনও দেখিনি।

ত্রিশ-বত্রিশ বছর ধরে ইয়োরোপ যাওয়া-আসা করছি। সবকিছু দেখেশুনে মনে হয়েছে, ধনদৌলত এবং তার বণ্টনব্যবস্থা সুইটজারল্যান্ডেই সবচেয়ে ভালো। ১৯২৯-৩০ সালের কথাই ধরুন। ইংল্যান্ডের তখন প্রচুর কলোনি, বিস্তর দৌলত বিদেশ থেকে আসছে। সুইটজারল্যান্ডের কলোনি নেই; সে পয়সা কামায় মালপত্র রপ্তানি করে। কিন্তু ইংল্যান্ড বেশি ধনী হওয়া সত্ত্বেও তার সে ধনের অনেকখানি চলে যায় গুটিকয়েক পরিবারের হাতে, কিন্তু সুইটজারল্যান্ডে সে ধনের ভাগ-বাটোয়ারা হয় অনেক বেশি ধর্মানুমোদিতরূপে। সে দেশেও লক্ষপতি কোটিপতি আছে, কিন্তু দেশের অধিকাংশ ধনের হিস্যা পায় আপামর জনসাধারণ।

ফ্রান্স খুব ধনী দেশ নয়। কিন্তু সন্তুষ্ট, পরিতৃপ্ত দেশ।

আর জর্মনি যেন জুয়াড়ির দেশ। কখনও তার সামনে দোহুদো টাকা আর কখনও সে লাটে উঠি-উঠি করছে। কখনও রেস্তোরাঁ-কাবারে গমগম করছে, কখনও রাস্তায় রাস্তায় মেয়ে-মন্দ কাজের সন্ধানে ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়াচ্ছে।

এমনই যখন তার দুর্দিন প্রায় চরমে, তখন, ১৯২৯ সালে, প্রথম আমি জর্মনি যাই। তার দুরবস্থা চোখে পড়ল কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটাও লক্ষ করলুম যে, এরা একদিন রীতিমতো ধনী ছিল। ঘরের আসবাবপত্র সেই প্রাচীন দিনের খানদানি মজবুত চালে তৈরি এবং রুচিসঙ্গত। ওয়ালপেপার পর্দা, টেবলক্লথ পুরনো হয়ে এসেছে বটে কিন্তু স্পষ্ট দেখা যায় এগুলো দামি এবং একদা এরা বিদেশির চোখ ঝলসে দিয়েছে। ১৯২৯-এ কিন্তু রিপুকর্মের পালা।

আর ১৯৬২-তে দেখি–দাঁড়ান, একটা গল্প মনে পড়ে গেল।

বাঙলায় যখন বলি, অমুক কাকের ছানা কিনেছে- তার অর্থ সে দু হাতে পয়সা ওড়াচ্ছে। জর্মনে বলা হয়, সে জানালা দিয়ে পয়সা ছুড়ছে।

এ দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী সম্বন্ধে নানা রকমের আহাম্মুখের কেচ্ছা শুনতে পাওয়া যায়। জর্মন ভাষাভাষী দেশগুলোতে আহাম্মুখের রাজার নাম পডি।

ল্যান্ডলেডির সঙ্গে রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে পডি দেখে এক দুদিনের চ্যাংড়া ছোকরা জব্বর দামি একখানা স্পোর্টস মোটর হাঁকিয়ে যাচ্ছে। পলডি শুধাল, কে ও? ল্যান্ডলেডি বলল, রেখে দিন ওর কথা। বাপ মরেছে। ছোকরা দেদার টাকা পেয়েছে। এখন জানালা দিয়ে পয়সা ছুড়ছে।

পলডি বেজায় উত্তেজিত হয়ে বার বার শুধায়, কোথায় থাকে সে? ঠিকানা কী?

এবার জর্মন গিয়ে দেখি, সবাই জানালা দিয়ে টাকা ছুড়ছে। কুড়োবার লোক নেই।

এইটুকু বললেই যথেষ্ট, জর্মনির কুত্রাচ কোনও রেলস্টেশনে আর পোর্টার, মুটে নামক নিরতিশয় প্রয়োজনীয় প্রাণীটি নেই। আমারই চোখের সামনে আমারই আড়াই-মণী ইয়া লাস ভাতিজা নামল এক ঢাউস সুটকেস নিয়ে। মুটে নদার। ওপারে যেতে হবে ওভারব্রিজের উপর দিয়ে। বাবাজি সুটকেস টানছে আর বলছে, দুটো সুটকেসে ভাগাভাগি করে নিয়ে এলে তবু না হয় ব্যালান্সড হয়ে চলতে পারতুম। বাবাজি ওপারে যখন পৌঁছলেন তখন পিঠের ঘাম কোটের বাইরে চলে এসেছে হামবুর্গে সে সন্ধ্যায় টেম্পারেচার ছিল পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মাঝামাঝি। ধকল কাটাতে বাবাজিকে খেতে হয়েছিল তিন লিটার বিয়ার। অবশ্য জর্মনিতে বিয়ার সস্তা।

আর দাসী-চাকরাণী? তবে শুনুন।

সবসুদ্ধ আটটি পরিবারে ডিনার-লাঞ্চের নিমন্ত্রণ খেয়েছি– কারও বাড়িতে দাসী দূরে থাক, একটি হেলপিং হ্যান্ডও দেখতে পাইনি। কেন নেই, প্রথম প্রশ্ন শুধালে পর আমার অধ্যাপকের বিধবা বলেন, মেড়? তা রাখা যায় বই কি চারশো পাঁচশো টাকা মাইনে। তাঁকে একখানা ঘর দিতে হবে– রেডিয়োটা অবশ্য তিনি নিজেই আনবেন। সিনেমায় ক-দিন যাবেন, ছুটি ক-দিন দিতেই হবে সেটাও আগেভাগে ঠিক করে নেওয়া হবে, পাকাপোক্ত। তার পর তিনি নেমে এলেন ঘরের কাজে– নখে ঝাঁ-চকচকে নেলপালিশ, এইমাত্র লাগানো হয়েছে, এখনও পেন্টের গন্ধ বেরুচ্ছে। তাই কাজ করেন অতি সন্তর্পণে, পাছে বার্নিশে জখম লাগে। খানিকক্ষণ বাদে দেখবে তিনি নেই। বিবি আপন কামরায় গেছেন সিগারেট খেতে।

সেটা দিনে ক-বার হয়, না হয়, সে তোমার কপাল! তার ওপর মোটা দড় কাজ তিনি করবেন না– যেমন মনে কর জানালার শার্সিগুলো জল দিয়ে ধুয়ে পোছা। তার জন্যে সপ্তাহে একবার করে তোমাকে অন্য লোক আনতে হবে। কী হবে অতসব বয়নাক্কার ভিতর গিয়ে।

***

ট্যাক্সিওয়ালাকে শুধালুম, ওটা কী হে? দেখি হামবুর্গের মতো শহরে– যেখানে কি না প্রতি ইঞ্চি জমি মহামূল্যবান– সেখানে এক জায়গায় হাজারখানেক মোটর গাড়ি দাঁড়িয়ে।

বলল, সেকেন্ডহ্যান্ড কার। একটা কিনবেন? মাত্র হাজার থেকে আরম্ভ। গত বছর, জোর আগের বছরের মডেল। টিপটপ কন্ডিশন। ট্যাঙ্ক পেট্রলে ভর্তি। দুটি কথা কইবেন, সাঁ করে তেড়ে হেঁকে বেরিয়ে যাবেন।

বলতে না বলতে সে ঢুকে গেছে ওই মোটরের মেলায়। ওর কথা ঠিক। গাড়িগুলো যেন কাল-পরশু কেনা। আমি শুধালুম, তা গাড়িগুলো এই খোলা-মেলায় জলঝড় খাচ্ছে?

বলল, ওই তো, স্যার, রগড়। হামবুর্গে গাড়ি পাবেন সহজে– গারাজ পাবেন খুব যদি কপালের জোর থাকে। তার পর শুধাল, আপনার দেশে হাল কী রকম?

আমি বললুম, আমাদের দেশে অনেক লোক পূর্বজন্মে বিশ্বাস করে।– পূর্ব-জন্মটা কী চিজ সেটা তাকে বুঝিয়ে বলতে হল। শেষ করলুম এই বলে, সেই পূর্বজন্মে যদি অশেষ পুণ্য করে থাকো, তবে এ জন্মে তোমার কপালে মোটর থাকলে থাকতেও পারে। মোটরই যখন নেই তখন গারাজের তো কথাই ওঠে না।

পরের ঘটনা, কিন্তু এই সুবাদে বলে ফেলি। এর কিছুদিন পর গিয়েছি সেই বন শহরে যেখানে ছাত্রজীবনের কয়েক বছর কাটিয়েছিলুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে যেতে দেখি, সামনে অগুনতি মোটর। আমার সতীর্থ– এখন নামজাদা স্লিস্টার সঙ্গে ছিল। শুধালুম, পরবটরব আছে নাকি রে? হার আডেনাওয়ার এলেন নাকি? তিনি না কাছেপিঠে কোথায় যেন থাকেন?

শুধাল, কেন?

ওই যে অত মোটরগাড়ি।

সে তো স্টুডেন্টদের।

বলে কী! ত্রিশ-বত্রিশ বছর পূর্বে বন্ বিশ্ববিদ্যালয়ের শ-তিনেক অধ্যাপকদের ক-জনের মোটরগাড়ি আছে আমরা আঙুলে গুনে বলতে পারতুম। আর আজ!

হামবুর্গে ফিরে যাই।

আমার এক প্রবীণ বন্ধু ছিলেন আমার চেয়ে বছর পনেরো বড়। তিনি যুদ্ধের পর গত হন। উঠেছিলুম তাঁরই বিধবার বাড়িতে। তারই এক মেয়ে কথায় কথায় বলল, জানেন, আজকাল এ দেশে অনেক ছেলেমেয়ে স্টুডেন্ট থাকাকালীনই বিয়ে করে ফেলে। কাগিন্নি চললেন মোটর হাঁকিয়ে কলেজে যেমন মনে করুন মেডিকেল কলেজ। পিছনের সিটে একটি বাচ্চা, কোলে আরেকটি। কলেজে পৌঁছে ছোটটি রাখলেন ধাইয়ের জিম্মায়, অর্থাৎ ক্ৰেশে। বড়টা গেল বাগানে খেলতে।

 ওদের খেলার জন্য নাকি স্পেশাল বাগান আছে। সত্যি আছে কি না সেটা আমি চোপ করার সুযোগ পাইনি। তবে একথা সত্য, এখন বেশকিছু ছেলেমেয়ে পাঠ্যাবস্থাতেই বিয়ে করে।

বললুম, আগে তো এরকম ছিল না, এখনই-বা হল কী করে?

বলল, আগে বাপ-মায়ের এত টাকা ছিল কোথায় যে ছেলেকে বলবে, তুই বিয়ে কর। নাতি পোষার পয়সা আমার আছে। আমিও বলি, সেই যখন বিয়ে করবেই একদিন, তখন শুকিয়ে শুকিয়ে পুঁইডাটাটি হয়ে যাবার কী প্রয়োজন?

আমার মনে পড়ল এক বিয়েতে স্বৰ্গত ইন্দিরা দেবী একটা জোয়ান ছোকরাকে বললেন, দেখ দিকিনি, ছেলেটা কী রকম বুদ্ধিমানের মতো বিয়ে করে ফেলল। তোরা যে পিত্তি না চটিয়ে খেতে পারিসূনে।

কিন্তু এস্থলে বলে রাখা ভালো, জর্মনিতে কোনও ছেলেই বিয়ে করে বউ নিয়ে বাপের সঙ্গে থাকে না– ভিন্ন বাসা বাঁধে।

অতএব বাপ দুটো সংসার পুষবে! এন্তের টাকা না থাকলে পারে কেডা?

কিন্তু ইতোমধ্যে আমার মাথার ভিতর দিয়ে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। তবে কি এই ভারতবর্ষে বাল্যবিবাহে আমরা পৌঁচেছিলুম এই পদ্ধতিতেই ধাপে ধাপে! কারণ জানি, অতি প্রাচীন যুগে এদেশে বাল্যবিবাহ ছিল না। তার পর বোধহয় হঠাৎ একদিন ধনদৌলত বেড়ে যায় আজ যেরকম জর্মনিতে। তখন আমরাও ছেলেছোকরাদের বিয়ে দিতে লাগলুম, তারা নিজের পায়ে দাঁড়াবার পূর্বেই। আস্তে আস্তে, ধাপে ধাপে করে গৌরীদান!

এ পৃথিবীতে নতুন কিছুই নেই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *