শাঁখটিয়ার আতঙ্ক

শাঁখটিয়ার আতঙ্ক

বর্ধমান জেলার রায়না থানার অন্তর্গত বেডুল গ্রামের গুহ পরিবারের একটি ছেলের চমকপ্রদ এক কাহিনীকে নিয়ে এই গল্প। ছেলেটির নাম তারাপদ। সময়টা তখন চৈত্রের শেষ।

গ্রামবাংলা মেতে উঠেছে গাজনে, চড়কে। কোথাও বা হরিবাসর বসেছে। কোথাও হচ্ছে যাত্রাগান। তা এইরকম সময়ে এক রাতে তারাপদ গিয়েছিল যাত্রা দেখতে। অনেক রাতে যাত্রা যখন শেষ হল তখন দলবেঁধেই বাড়ি ফিরছিল ওরা। এমন সময়ে হঠাৎ প্রকৃতির ডাকে রয়ে যেতে হল ওকে।

সঙ্গীসাথী যারা ছিল তারা বলল, “তোমাকে একা পথের মাঝখানে ফেলে রেখে যাই কী করে আমরা? তার চেয়ে আমরা বরং অপেক্ষা করি, তুমি একটু তাড়াতাড়ি সেরে নাও।”

তারাপদ বরাবরই ডাকাবুকো। বলল, “কোনও প্রয়োজন নেই। গ্রামের কাছাকাছি যখন এসে গেছি তখন আর ভয় কী? তা ছাড়া চোর ডাকাত এলেও সুবিধে হবে না কিছু। কী আর আছে আমার?”

“না, ঠিক তা নয়, আসলে রাতবিরেতের ব্যাপার তো! যদি অন্য কিছু, মানে ওইসবের একটু বদনাম আছে কিনা এই গাঁয়ের।”

“সোজা কথায় ভূতপ্রেতের কথা বলছ? ওইসবে আমার ভয়ও নেই, বিশ্বাসও নেই। থাকলেও ওরা আমার কিছুই করতে পারবে না।”

সবাই জানত তারাপদ সাহসী ছেলে। তাই বলল, “আমরা তা হলে যাই?”

তারাপদ বলল, “স্বচ্ছন্দে।”

ওরা চলে গেল। তারাপদ নিশ্চিন্ত মনে মাঠে কাজ সেরে পাশেরই একটা বড় পুকুরে গিয়ে নামল। পুকুরটা শাঁখটিয়ার মধ্যে পড়ে। মাছে ভর্তি এই পুকুর। বড় বড় রুই, কাতলা, কালবাউসে ভর্তি পুকুরটা। আর এই পুকুরের মাছের স্বাদও খুব।

তারাপদ যখন জলে নেমেছে ঠিক তখনই দেখতে পেল মস্ত একটা মাছ ঘাই দিল পুকুরের জলে।

পুকুরের চারপাশে বড় বড় আমগাছ ও বাঁশবন থাকায় কী মাছ সেটা বুঝতে পারল না। তবে অনুমান করল, আট-দশ কেজি ওজনের কাতলা মাছ একটা। মাছটা আবার ঘাই দিল।

এবারও একেবারে ডাঙার কাছে, তারপর হঠাৎই ওর গায়ে গা ঠেকিয়ে পিছলে সরে গেল।

তারাপদ জলে হাত-পা ধুয়ে ওত পেতে রইল মাছটাকে বাগে পাওয়ার জন্য। ও ঠিক করল, যেভাবেই হোক মাছটিকে ও ধরবেই। এই পুকুরের মাছ একটা ধরতে পারলে খাওয়াটা যা হবে তা কল্পনা করেও তৃপ্তি পেল।

মাছ যদি জলে থাকে তা হলে শুধু হাতে তাকে ধরতে যাওয়া বোকামি ছাড়া কিছু নয়। তবু সব জেনেও তারাপদ শুরু করল দাপাদাপি। তারপর যা হওয়ার নয় তাই হল। হঠাৎ মাছটা ঘাই মেরে ডাঙায় উঠে ছটফট করতেই তারাপদ ঝাঁপিয়ে পড়ল সেটার ওপর। আর ঠিক তখনই একজোড়া টর্চের আলো এসে পড়ল ওর গায়ে।

তারাপদর মুখ শুকিয়ে গেল ভয়ে। নিশ্চয়ই যাদের পুকুর তাদেরই কেউ।

তবু ও ভাল করে তাকিয়ে দেখল কেউ কোথাও নেই। ও দেখল, একটা গোরু ঘাটের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে একভাবে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। অন্ধকারে তার চোখ দুটো কী সাংঘাতিক রকমের জ্বলছে। এই দেখে ও নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারল না। এমন নাকি হয়? রাত্রিবেলা চতুষ্পদ জন্তুদের চোখ জ্বলে ঠিকই, কিন্তু এইভাবে?

যাই হোক, তারাপদ মাছটাকে নিয়ে যখন কোনওরকমেই সেই ঘাটের সিঁড়ি দিয়ে উঠতে পারল না তখন বাধ্য হয়েই আঘাটায় উঠতে গেল। এবারে আরও ভয়ঙ্কর দৃশ্য।

ও দেখল, একটা কুকুর অগ্নিদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে এগিয়ে আসছে এক পা, এক পা করে। আর কুকুরের চোখ দুটো দিয়ে নানান রঙের আলো বেরিয়ে এসে অন্ধকারে রঙের খেলা খেলে হারিয়ে যাচ্ছে।

তারাপদর বুক কেঁপে উঠল এবার।

সে যত এগিয়ে আসে কুকুরও এগিয়ে আসে তত। ভাবটা এই, ডাঙায় উঠলেই ছিঁড়ে ফেলব একেবারে।

তারাপদ তবুও দমবার পাত্র নয়।

সে আবার অন্যদিক দিয়ে ওঠবার চেষ্টা করল। কিন্তু কী জ্বালা! এখানে একটা কালো বিড়াল। তারও চোখের অবস্থা একই রকম।

তবু ও মাছটাকে বুকে নিয়ে উঠতে গেল বাঁশবনের দিকে। এখানে আবার অন্য দৃশ্য। একটা শেয়াল ‘হুক্কা হুয়া, হুক্কা হুয়া’ করে ডেকে উঠে আকাশের দিকে মুখ করতেই তার মুখ দিয়ে আগুনের হলকা ছুটতে লাগল।

তারাপদ জানে এগুলোকে বলে উল্কামুখী শেয়াল। ও এবার নির্ভয়ে ডাঙায় উঠল। তারপর এক হাতে মাছটাকে বুকের মধ্যে আঁকড়ে রেখেই মাটির একটা ঢ্যালা নিয়ে ছুড়ে মারল শেয়ালটাকে। যেই না মারা শেয়ালটা অমনই খ্যা, খ্যা করে মানুষের গলায় হেসে পালিয়ে গেল সেখান থেকে।

কিন্তু এই বাঁশবন পার হবে কী করে?

ওর কেবলই মনে হতে লাগল কারা যেন চারদিক থেকে দোল খাচ্ছে সেই বাঁশবাগানের ভেতরে। কেউ যেন ওর কানের পাশ দিয়েই সোঁ সোঁ করে বেরিয়ে যাচ্ছে।

এবার দারুণ ভয় পেয়ে গেল তারাপদ। ও বুঝতে পারল যে, সে কখনও যা বিশ্বাস করত না তা বিশ্বাস না করে আর উপায় নেই। সত্যি-সত্যিই সে আজ এই মুহূর্তে ভূতের পাল্লায় পড়ে গেছে।

যখন মনের অবস্থা ঠিক এইরকম, তখনই তারাপদ দেখতে পেল একজন বয়স্ক মানুষ লণ্ঠন হাতে বাঁশবাগানের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছেন। কিন্তু এই রাতবিরেতে বাঁশবনের ভেতরে কেন? ওঁরও কি ভূতের ভয় নেই? অথবা সাপখোপের?

তারাপদ চেঁচিয়ে ডাকল তাঁকে, “এই যে শুনছেন?”

মানুষটি কোনও সাড়াশব্দ না দিয়েই চলতে লাগলেন। কালা নাকি? শুনতে না পান তবু একজন চলমান মানুষ তো! ও দ্রুত পা চালিয়ে ধরে ফেলল তাঁকে।

তারাপদ কাছে গিয়ে বলল, “আমি আনগুনোয় গিয়েছিলাম যাত্রা শুনতে। তারপর হঠাৎ প্রকৃতির ডাকে আটকে গিয়ে ভূতের পাল্লায় পড়ে যাই। আমাকে একটু দয়া করে বাঁশবনটা পার করে দেবেন?”

মানুষটি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ কিছু না বলে একই ভাবে পথ চলতে লাগলেন। চলছেন তো চলছেনই। বাঁশবন আর শেষ হয় না। পথও ফুরোয় না।

তারাপদর অবস্থা তখন শোচনীয়। ইতিমধ্যে হঠাৎ সে দেখল, তার বুকে যেটা আছে সেটা আসলে মাছের বদলে তার কঙ্কালটা। দেখামাত্রই শিউরে উঠল সে। সঙ্গে সঙ্গে কাঁটাসার মাছটাকে ছুড়ে ফেলে দিল মাটিতে। মাছটা তখন আবার পূর্বরূপ ফিরে পেয়ে জীবন্ত হয়ে হঠাৎ ঘাই মেরে শূন্যে লাফিয়ে ছিটকে পড়ল পুকুরের জলে।

তারাপদ দেখল এতক্ষণ ধরে এত হেঁটেও সে কিন্তু পুকুরপাড়েই আছে।

মাছটা জলে পড়তেই চলমান মানুষটি থমকে দাঁড়িয়ে লণ্ঠনটা আবার তুলে ধরে পুকুরের দিকে তাকিয়ে বললেন, “যাঃ, বেঁচে গেল ওটা।”

সেই আলোয় খুব কাছ থেকে লোকটির মুখের দিকে তাকিয়েই এবার শোচনীয় হয়ে উঠল তারাপদর অবস্থা।

ওর শিরদাঁড়ার ওপর দিয়ে যেন একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল তখন।

কাঁপা কাঁপা গলায় তারাপদ বলল, “এ কী সিধুজেঠু আপনি?” “চিনতে পেরেছিস তা হলে?”

“আপনি এখানে কেন?”

“এখানে ছাড়া কোথায় থাকব বল? এই বাঁশবাগানেই তো আমাকে সাপে কামড়েছিল। এর পাশেই তো খালধারে পোড়ানো হয়েছিল আমাকে। সেই থেকেই এখানে আছি।”

তারাপদ তখন প্রাণের দায়ে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটেছে। এক সময় বাঁশবন পার হয়ে পীরবাবার থানের কাছে চলে এল। অনেক আগে এখানে এক বৃদ্ধ ফকির থাকতেন। এখন তিনি নেই। তবে ভগ্ন স্থানটুকু আছে। কতকগুলো পোড়া মাটির ঘোড়া আরও কীসব যেন আছে। ও সেইখানে এসে হাঁফাতে লাগল।

এদিকে সেই গোরু, কুকুর আর উল্কামুখী শেয়ালটা পিছু পিছু এসেছে ওর। আর নানারকম ভাবে দেহটাকে ছোট-বড় করে চোখের মণিতে আলোর খেলা দেখিয়ে ভয় দেখাচ্ছে।

তারাপদ বুঝল, এদের হাত থেকে আজ ওর কোনওরকমেই পরিত্রাণ নেই। তাই কাতরভাবে সেই পীরবাবার কাছে মাথা কুটে বলতে লাগল, “পীরবাবা গো, আমাকে রক্ষা করো। এই প্রেতের কবল থেকে তুমি না বাঁচালে কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। আমার শত অপরাধ ক্ষমা করো, তুমি আমাকে রক্ষা করো।”

বলার সঙ্গে-সঙ্গে দেখা গেল এক অদ্ভুত ব্যাপার। কোথা থেকে যেন এক ঘোড়সওয়ার এসে হাজির হল সেখানে। তার হাতে তীক্ষ্ণ তরবারি। সে এসেই বলল, “কে ডাকে আমায়? কে তুই?”

“আপনি কে?”

“তুই কে আগে বল?”

“আজ্ঞে, আমি তারাপদ। গুহদের বাড়ির ছেলে। বেডুল গ্রামে থাকি। আনগুনোয় যাত্রা শুনতে গিয়েছিলাম, এমন সময়—।’ “”

“আর ভয় নেই। আমি এসে গেছি।”

তারপদর চোখের সামনে তখন এক ভয়ানক দৃশ্য। সেই ঘোড়সওয়ার রূপকথার রাজপুত্রের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল গোরু, কুকুর আর শেয়ালের ওপর।

গোরুর আকৃতি তখন হাতির মতো বিশাল। কুকুরের চেহারা ঘোড়ার মতো। আর শেয়াল! সে কখনও বাড়ে কখনও কমে।

সে কী ভয়ানক যুদ্ধ! সেই যুদ্ধে কেউ কাউকেই পরাস্ত করতে পারে না।

অবশেষে একসময় হার মানতে হল। গোরু, কুকুর আর শেয়াল নিপাত গেল তিনজনেই।

ঘোড়সওয়ারের আকৃতি তখন অন্যদের চেহারার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তালগাছের মতো।

একটু একটু করে দিনের আলো ফুটে উঠছে তখন। রণক্লান্ত ঘোড়সওয়ার একহাতে কপালের ঘাম মুছে বলল, “আর কোনও ভয় নেই তোর। যা, চলে যা।”

তারাপদ বিগলিত হয়ে বলল, “আপনি কে?”

“যা বলছি।”

সেই কণ্ঠস্বরে তারাপদ ভয়ে ভয়ে তাকাল ঘোড়সওয়ারের দিকে। আর কী আশ্চর্য! ওর চোখের সামনেই ভোরের আবছা আলো-অন্ধকারে একটু একটু করে মিলিয়ে গেল ঘোড়সওয়ার।

তারাপদও ঘরে ফিরে এল। তবে সেই থেকে সে আর কখনও রাতদুপুরে একা শাঁখটিয়া দিয়ে যাওয়া-আসার চেষ্টা করেনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *