শহর কলকাতায় ঈশ্বরের পদচারণা
গৌতম বসুমল্লিক
ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের কথা। কলকাতাকে কেন্দ্র করে বাংলায় তখন নবযুগের সূচনা হয়েছে। দেওয়ান রামমোহন রায় স্থায়ীভাবে কলকাতায় এসে বসবাস আরম্ভ করেছেন। দেশীয় ছেলেদের ইংরিজি ও আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করতে তাঁরই উদ্যোগে কতিপয় বাঙালি সমাজপতি ও ইংরেজ শিক্ষাবিদের সহায়তায় গরানহাটায় স্থাপিত হয়েছে হিন্দু কলেজ। সেই কলেজ আবার কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত সংস্কৃত কলেজের সঙ্গে বাড়ি ভাগাভাগি করে উঠে এসেছে কলেজ স্ট্রিটে। চিৎপুরে রামমোহনের উদ্যোগে পৌত্তলিকতাবিরোধী একেশ্বরবাদী উপাসনার জন্য স্থাপিত হয়েছে ব্রাহ্ম সমাজ। রামমোহন নিজে লিখছেন কুসংস্কারবিরোধী নানা গ্রন্থ, প্রকাশ করছেন পত্র-পত্রিকা। এমনই এক সময়ে কলকাতা থেকে প্রায় পঞ্চাশ মাইল দূরে হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রামে এক দরিদ্র টুলো পণ্ডিতের ঘরে জন্ম হল এক শিশুর। নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
কলকাতা-পর্বের সূচনা
পণ্ডিত বংশ হলেও পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সংসারের প্রয়োজনে দীর্ঘকালই কলকাতাবাসী। সেখানে সওদাগরি অফিসে তিনি চাকরি করতেন। মাতা ভগবতীদেবী নিতান্তই গৃহবধূ। ঈশ্বরচন্দ্রের শৈশব এবং বাল্যকাল কাটে বীরসিংহ গ্রামেই। সেখানকার কালীকান্ত পণ্ডিতের পাঠশালাতেই বালকের বিদ্যারম্ভ। আট বছর বয়সে পাঠশালার পাঠ শেষ করার পর, গুরুমশাই কালীকান্তর পরামর্শে ঠাকুরদাস পুত্রকে কলকাতায় নিয়ে এলেন উচ্চতর পাঠগ্রহণের জন্য।
গোড়ার দিকে কয়েকবার বাসা বদল করলেও ঠাকুরদাস শেষ অবধি থিতু হয়েছিলেন তাঁর পিতা রামজয় তর্কভূষণের পরিচিত বড়বাজার অঞ্চলের ধনী গৃহস্থ ভাগবতচরণ সিংহের বাড়িতে। ১৮২৮-এর নভেম্বর মাসে পুত্রকে নিয়ে ঠাকুরদাস উঠলেন সেই বাসাবাড়িতেই। সেই প্রথম ১৮২৮-এর নভেম্বর মাসে ঈশ্বরচন্দ্রের কলকাতায় আসা। তারপর থেকে ১৮৯১-এর ২৯ জুলাই মৃত্যু পর্যন্ত দীর্ঘ ৬৩ বছরের কলকাতা বাসপর্বের ৪৯ বছরই তিনি কাটিয়েছেন বিভিন্ন ভাড়াবাড়িতে বা অন্যের অতিথি হয়ে। জীবনের শেষ চোদ্দো বছর শুধু তিনি বাস করেন বাদুড়বাগানের নিজস্ব বাড়িতে।
একটা ছাড়া ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কলকাতার বাসস্থানগুলো এখন সবই প্রায় বিস্মৃত। পিতা ঠাকুরদাসের ভাড়া নেওয়া ১৩ দয়হাটা স্ট্রিটের (এখনকার নাম দিগম্বর জৈন টেম্পল রোড) বাড়িতে প্রথম তাঁর আসা। ঈশ্বরচন্দ্রের অনুজেরাও সেখানে থেকেছেন দীর্ঘদিন। সিংহ পরিবারের থেকে সে বাড়ি একসময় যায় বড়বাজার মল্লিক পরিবারের একটা শাখার হাতে। বড়বাজার অঞ্চলে এক সরু গলির ভিতরের সেই বাড়িটি ছিল কিছুকাল আগেও। তবে বসতবাটি হিসেবে নয়, লঙ্কার গুদাম হিসেবে। সম্প্রতি সে বাড়ি রূপান্তরিত হয়েছে এক বহুতলে।
এখানে একটা কথা বলে নেওয়া প্রয়োজন। বিদ্যাসাগরের নিজের লেখা অসমাপ্ত আত্মজীবনী তো বটেই, ভাই শম্ভুচন্দ্র বিদ্যারত্ন সহ অন্যান্য জীবনীকারদের কোনও লেখাতেই বড়বাজারের বাড়ির ঠিকানা উল্লেখ করা নেই। বাড়ির ঠিকানা নির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করেন রাধারমণ মিত্র। তাঁর লেখার সূত্র ধরেই, ১৩ নম্বর দয়হাটা স্ট্রিটের বাড়ি আমরা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাড়া নেওয়া বাসাবাড়ি হিসেবে গ্রহণ করেছি, যেখানে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বাল্যের বেশ কিছু বছর বসবাস করেছেন।১,২
ঈশ্বরচন্দ্রর জীবনে এই বাড়ির প্রভাব অনেক। একে তো মাত্র আট বছরের গ্রাম্য বালক, মা-ঠাকুমার কোল ছেড়ে দূর দেশে পড়তে এসে ভীষণভাবেই একাকিত্বে ভুগতেন, তার উপর ঠাকুরদাস ছিলেন কঠোর নিয়মের মধ্যে থাকা এক পিতা। পান থেকে চুন খসলেই বালক ঈশ্বরচন্দ্রর পিঠে পড়ত চড়চাপড়। ওই অবস্থার মধ্যে বালকের একমাত্র আশ্রয় ছিল ভাগবতচরণের বিধবা কন্যা রাইমণি। গোপাল নামে ঈশ্বরচন্দ্রর সমবয়সি এক পুত্র ছিল রাইমণির। তিনি নিজের পুত্রের মতো কিংবা হয়তো তার থেকে কিছু বেশিই স্নেহ করতেন বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে। পরিণত বয়সে আত্মস্মৃতিতে ঈশ্বরচন্দ্র লিখেছেন, ‘… কনিষ্ঠা ভগিনী রাইমণির অদ্ভুত স্নেহ ও যত্ন আমি কস্মিনকালেও বিস্মৃত হইতে পারিব না। তাঁহার একমাত্র পুত্র গোপালচন্দ্র ঘোষ আমার প্রায় সমবয়স্ক ছিলেন। পুত্রের উপর জননীর যেরূপ স্নেহ ও যত্ন থাকা উচিত ও আবশ্যক, গোপালচন্দ্রের উপর রাইমণির স্নেহ ও যত্ন তদপেক্ষা অধিকতর ছিল, তাহার সংশয় নাই। কিন্তু আমার আন্তরিক দৃঢ বিশ্বাস এই, স্নেহ ও যত্ন বিষয়ে, আমায় ও গোপালে রাইমণির অণুমাত্র বিভিন্ন ভাব ছিল না।’২
বড়বাজারের বাড়িতে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ঠাকুরদাস বউবাজার অঞ্চলে ‘হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়-এর গলি’-র (এখনকার নাম হিদারাম ব্যানার্জি লেন) ১৫ নম্বর বাড়ি ভাড়া নেন। পরে ওই বাড়িরই বিপরীত দিকের ৫৪ নম্বর বাড়ির ‘বহির্বাটী’ অংশ ভাড়া নেন মাসিক আট টাকা ভাড়ায়।৩ ওই বাড়ি দু’টিও আজ বিস্মৃতির অতলে। ১৫ নম্বর বাড়িটি দ্বিধাবিভক্ত। একটা অংশে রয়েছে একটা ওষুধের দোকান। ঠিক কোন অংশে বিদ্যাসাগরেরা থাকতেন আজ আর তা নির্ধারণ করা যায় না। আর ৫৪ নম্বর বাড়িটিও এ-বি-সি-ডি… অংশে বিভক্ত হয়ে যাওয়ায় ‘বহির্বাটী’ অংশটিকে আলাদা করে চিহ্নিত করা যায় না। অঞ্চলের বাসিন্দাদের কেউ কেউ একদা এই পাড়ায় বিদ্যাসাগর থাকতেন বলে শুনে থাকলেও তা নিয়ে আগ্রহ বা কৌতূহল কারও নেই।
শিক্ষাজীবন : সংস্কৃত কলেজ পর্ব
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সঙ্গে সংস্কৃত কলেজের সম্পর্ক দীর্ঘকালের। হুগলি জেলার বীরসিংহ গ্রাম থেকে আট বছর বয়সে কলকাতায় পড়াশোনা করতে এসে ভরতি হয়েছিলেন সংস্কৃত কলেজে। পরে সেখানেই চাকরি করতে ঢোকেন। একসময় সেখানকার সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত হন। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ হওয়া বাংলার শিক্ষাজগতে এক যুগান্তকারী ঘটনা। সংস্কৃত শিক্ষাকে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার যে রীতি সে যুগে প্রচলিত ছিল তাকে ভেঙে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত শিক্ষাকে সর্বসাধারণের জন্য মুক্ত করে দেন। সে বিবরণে যাবার আগে সংস্কৃত কলেজ বিষয়ে কিছু আলোচনা করে নেওয়া যেতে পারে।
১৮২৪-এর ১ জানুয়ারি। বেঙ্গল গভর্নমেন্টের জুনিয়র সেক্রেটারি হোরেস হেম্যান উইলসনের প্রাথমিক প্রস্তাব অনুসারে ৬৬ বউবাজার স্ট্রিটের ভাড়াবাড়িতে কোম্পানির সরকারের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হল সংস্কৃত কলেজ। এদেশের মুসলমানদের আরবি-ফারসি শিক্ষার জন্য ১৭৮১ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল কলকাতা মাদ্রাসা। তার প্রায় তেতাল্লিশ বছর পরে ওই কোম্পানির উদ্যোগেই এদেশের বর্ণহিন্দু ব্রাহ্মণ-বৈদ্যক সম্প্রদায়ের সংস্কৃত শিক্ষার জন্য তৈরি হল সংস্কৃত কলেজ। ছাত্রসংখ্যা বাড়তে থাকায় কলেজের নতুন ভবনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিল। ইতিমধ্যে বছর সাতেক আগে, ১৮১৭-য় শহরের অভিজাতদের সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে ইংরিজি এবং পাশ্চাত্য ধারার শিক্ষার জন্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া হিন্দু কলেজও স্থানাভাবে নতুন ভবন খুঁজে চলেছে কিন্তু বিশাল পরিমাণ অর্থ খরচ করে নতুন ভবন তৈরির সামর্থ্য তখন নবগঠিত হিন্দু কলেজের ছিল না। তাই স্থির হল, হিন্দু কলেজকেও সরকারি তত্ত্বাবধানে এনে গোলদিঘির ধারে ফাঁকা জমিতে দুই কলেজের নতুন বাড়ি হবে। গোলদিঘি বা কলেজ স্কোয়ারের অনেক জমির মালিকই ছিলেন ডেভিড হেয়ার। তাঁর কাছ থেকে ৫০০ টাকা কাঠা দরে ২ বিঘে এবং আরও কিছু জমি কিনে মোট ৫ বিঘে ৭ কাঠা জমির ওপর ওই ১৮২৪-এরই ২৫ ফেব্রুয়ারি ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন হল কলেজ ভবনের। এক লক্ষ কুড়ি হাজার টাকা খরচ করে বার্ন কোম্পানি দু’বছর তিন মাসের মধ্যে তৈরি করে ফেলল কলেজ ভবন। ১৮২৬-এর ১ মে মহাসমারোহে খুলে দেওয়া হল হিন্দু-সংস্কৃত কলেজ ভবনের দরজা।৪
নবনির্মিত ভবনের দ্বারোদ্ঘাটনের ঠিক তিন বছর এক মাস পর, ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ১ জুন হুগলি জেলার জাহানাবাদ পরগনার আরামবাগ মহকুমার অন্তর্গত বীরসিংহ গ্রামের বাসিন্দা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র ঈশ্বরচন্দ্র সংস্কৃত কলেজে ভরতি হলেন। কর্মসূত্রে ঠাকুরদাস দীর্ঘকালই কলকাতাবাসী। থাকতেন, আগেই উল্লেখ করেছি, বড়বাজার অঞ্চলের দয়হাটা স্ট্রিটে সিংহবাবুদের বাড়িতে ঘর ভাড়া নিয়ে। সেখানেই এনে তুললেন বালক ঈশ্বরচন্দ্রকে। গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষ করে বছর খানেক আগেই তিনি ছেলেকে কলকাতায় এনেছিলেন কলেজে ভরতির জন্য, কিন্তু শরীর অসুস্থ হওয়ায় সে যাত্রায় আবার গ্রামে ফিরে যেতে হয় ঈশ্বরচন্দ্রকে। পরের বছর তিনি সংস্কৃত কলেজের ব্যাকরণ শ্রেণিতে ভরতি হলেন।
বড়বাজার অঞ্চলের দয়হাটা স্ট্রিট থেকে কলেজ স্ট্রিটের গোলদিঘির দূরত্ব খুব-একটা বেশি না হলেও যাত্রাপথটা যে খুব সুগম ছিল তা নয়। বাস-ট্রাম তো দূরের কথা, আজকের প্রশস্ত হ্যারিসন রোড বা সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ তখন তৈরি হয়নি। রাস্তার ধারে ফুটপাথের ধারণাও তখন ভবিষ্যতের গর্ভে। ধনী অভিজাতরা পালকি, ঘোড়ার গাড়ি চড়লেও মাসিক দশ টাকা বেতনের মল্লিকবাবুদের দোকান-কর্মচারী ঠাকুরদাসের পুত্রের পক্ষে তা সম্ভব ছিল না। পায়ে হেঁটেই যাতায়াত করতেন তিনি। গোড়ায় কিছুদিন ঠাকুরদাস ছেলেকে দিয়ে-আসা নিয়ে-আসা করতেন, পরে ঈশ্বরচন্দ্র একা একাই যাতায়াত করতেন। বছর এগারো-বারো বয়স থেকে একা একা যাতায়াত করলেও ঈশ্বরচন্দ্র কিন্তু ‘রাখাল’ হয়ে যাননি, আবার তিনি সেই অর্থে একেবারে ‘গোপাল’ও ছিলেন না। সংস্কৃত কলেজে পড়তে আসতেন বেশিরভাগ টুলো পণ্ডিত ঘরের মেধাবী ছাত্ররা। তাদের পক্ষে খুব-একটা উচ্ছন্নে যাওয়া বোধহয় সম্ভব ছিল না খানিকটা আর্থিক এবং খানিকটা সামাজিক কারণেই। উলটো দিকে পাশের বাড়ির ‘আংরেজি’ পড়া বড়লোকের ছেলেদের পক্ষে সে সম্ভাবনা ছিল অনেকটাই বেশি।
নিজস্ব ভবনে উঠে আসার মাসেই হিন্দু কলেজে আরও একটা পরিবর্তন এসেছিল। ওই ১৮২৬-এর মে মাসেই হিন্দু কলেজে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিয়ো। ইউরেশিয়ান পরিবারের ওই মেধাবী শিক্ষক পড়াশোনাকে নীরস পাঠ্যবই আর সিলেবাসের গণ্ডিতে আবদ্ধ রাখার ঘোর বিরোধী ছিলেন। অল্পদিনেই বিপুল জনপ্রিয়তা পেলেন তিনি ছাত্রদের কাছ থেকে।
গোলদিঘির পুরো উত্তর পাড় জুড়ে তৈরি দুই ভিন্ন মতাদর্শের কলেজের যৌথ ভবনের সদর দরজা কেবল একটাই, কিন্তু বাকি সব আলাদা। হিন্দু কলেজে পড়তে আসবে দেশের অভিজাতদের সন্তানরা। ধর্মে শুধু হিন্দু হতে হবে, অন্য কোনও জাতিগত পরিচয় সেখানে বাধা নয়। বন্দ্যোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায়দের মতো ব্রাহ্মণ বা ঘোষ, বসু, দত্তর মতো কায়স্থ অর্থাৎ, তথাকথিত উচ্চবণের্র হিন্দুর পাশাপাশি মল্লিক, বসাক বা অন্য কোনও তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু সন্তানও হিন্দু কলেজে প্রবেশাধিকার পাবে অর্থ, কৌলীন্য বা আভিজাত্যের কল্যাণে। উলটো দিকে, সংস্কৃত কলেজ শুধু ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্যদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কাজেই কলেজ ভবন এক হলেও ওই দুই শ্রেণির একত্র মেলামেশা সে যুগের নিরিখে একেবারেই নিষিদ্ধ। তাই সদর পথ এক হলেও গোটা ভবন পাঁচিল ও লোহার বেড়া দিয়ে ভাগ করা হিন্দু এবং সংস্কৃত দুই কলেজের জন্যে।
এদেশের ছাত্রদের ইংরেজি শিক্ষা দেবার ব্যাপারে সবথেকে উদ্যোগী ছিলেন রামমোহন রায়। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানও অনেক। তবু ‘বিধর্মী’ হিসেবে খ্যাত হওয়ায় কলেজ প্রতিষ্ঠার সময়ে তিনি অন্তরালেই থেকে যান। রামমোহনের স্বপ্ন ছিল, এদেশের যুব সম্প্রদায় সামাজিকভাবে কূপমণ্ডূকতা ছেড়ে যুক্তিবাদী হয়ে উঠুক। তাঁর সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতেই যেন আবির্ভূত হয়েছিলেন ডিরোজিয়ো। ১৮২৮-এ তিনি যখন মুক্তচিন্তার প্রসারে ছাত্রদের জন্য ‘অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করলেন, ঠিক তার পরের বছরেই পাশের বাড়িতে পড়তে এলেন রামজয় তর্কভূষণের নাতি (পৌত্র) ঈশ্বরচন্দ্র। ডিরোজিয়োর গুটি কয়েক ছাত্র যখন গোটা বাংলায় হইহই ফেলে দিয়েছেন, সমাজে কু-নিন্দার ঝড় বয়ে চলেছে, ঠাকুরদাস-পুত্র তখন ঘাড়-মুখ গুঁজে মুখস্থ করে চলেছেন মুগ্ধবোধ ব্যাকরণের কঠিন সমস্ত সূত্রাবলি। নাস্তিকতা সহ বহুবিধ ‘অপরাধে’ কূপমণ্ডূক বাংলার হিন্দু সমাজপতিরা যখন ডিরোজিয়োকে হিন্দু কলেজ থেকে তাড়ালেন, ঈশ্বরচন্দ্রের বয়স তখন মাত্র এগারো বছর! আর রামমোহন? তিনি তখন ইংল্যান্ডে গিয়েছেন সেখানকার পার্লামেন্টে মোগল সম্রাটের হয়ে দাবিদাওয়া জানাতে। অপমানিত ডিরোজিয়ো অবশ্য বেশিদিন আর বেঁচে থাকেননি। ১৮৩১-এর ২৬ ডিসেম্বর তিনি প্রয়াত হলেন কিন্তু ভবিষ্যতের জন্য তৈরি করে গেলেন এক ভিন্ন চিন্তার পরিবেশ।
ঈশ্বরচন্দ্র যে বছর সংস্কৃত কলেজে ভরতি হলেন, সে বছর, অর্থাৎ ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে আইন করে সতীদাহ প্রথা রদ করা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র যখন সংস্কৃত কলেজের জুনিয়র বিভাগে পড়ছেন তখন হিন্দু কলেজে ডিরোজিয়ো-যুগের সূচনা। ১৮৩৩-এ যখন কলকাতা সদর দেওয়ানি আদালতের নামকরা উকিল রাজনারায়ণ দত্তের পুত্র মধুসূদন দত্ত হিন্দু কলেজের জুনিয়র বিভাগে ছাত্র হয়ে ঢুকলেন তখন ঈশ্বরচন্দ্র ব্যাকরণ শ্রেণির পাঠ শেষ করে সাহিত্য শ্রেণিতে পড়ছেন। কিছু কালের মধ্যেই পাশের বাড়ি হিন্দু কলেজে আরম্ভ হল মধুসূদন যুগ। অত্যন্ত মেধাবী মধুসূদন পোশাক-পরিচ্ছদ-বিলাসব্যসনে, বাক্পটুতায়, বুদ্ধিদীপ্ততায় সহপাঠীদের কাছে এক বিস্ময় হিসেবে গণ্য হতেন। ফারসি গজলও যেমন গাইতে পারতেন উদাত্ত গলায়, তেমনই শেক্সপিয়র-বায়রন থেকে মুখস্থ বলে যেতেন অনর্গল। সে খবর কি কোনওভাবেই পৌঁছত না সংস্কৃত কলেজের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ছাত্র ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের কানে? ছাত্রবয়সে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে মধুসূদন দত্তর সখ্য ছিল, এমন কথা কেউ বলেননি, স্বয়ং ঈশ্বরচন্দ্র বা মধুসূদন কেউই নয়। জীবনীকারেরাও তেমন কিছু লেখেননি। কিন্তু পরবর্তীকালে এই দুই যুগপুরুষের মধ্যে প্রগাঢ় সখ্য তৈরি হয়েছিল।
৪ ডিসেম্বর ১৮৪১। ‘শ্রীযুক্তকোম্পানীসংস্থাপিতবিদ্যামন্দিরে’ ১২ বছর ৫ মাস শিক্ষান্তে ‘বিদ্যাসাগর’ উপাধি লাভ করে ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর’ নামে পরিচিত হলেন। ওই পরিচিতিই তিনি বহন করে গেছেন আজীবন, শুধু তা-ই নয়, আজও এদেশের বহু মানুষ তাঁর পারিবারিক বন্দ্যোপাধ্যায় পদবি জানেন না, তাঁকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর রূপেই চেনেন।
কর্মজীবন: ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ পর্ব
সংস্কৃত কলেজ থেকে উত্তীর্ণ হওয়ার এক মাসের মধ্যেই, ওই ১৮৪১-এর ডিসেম্বর মাসের ২৯ তারিখে মাসিক ৫০ টাকা বেতনে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে সেরেস্তাদার বা প্রধান পণ্ডিতের পদে চাকরিতে ঢুকলেন। ওই পদে তিনি ছিলেন ১৮৪৬-এর এপ্রিল পর্যন্ত। লর্ড ওয়েলেসলি-র শাসনকালে কোম্পানির কর্মচারীদের এখানকার ভাষা ও রীতিনীতি শেখাবার জন্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ স্থাপিত হয়। কিছুকাল আগেও যেটা এ রাজ্যের প্রধান সরকারি কার্যালয় ছিল, সেই রাইটার্স বিল্ডিংস-এর এক অংশেই ছিল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ। এর একটা সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন লর্ড ওয়েলেসলি। প্রাচ্যদেশে অক্সফোর্ড-কেমব্রিজ-এর মতো একটা আবাসিক বিদ্যালয় তৈরির উদ্দেশ্যে তিনি পাঁচটা সুন্দর বাগানবাড়ি কেনেন গার্ডেনরিচ অঞ্চলে। সেগুলোকে বিদ্যালয় হিসেবে সাজিয়ে তোলার আগেই ক্লাস আরম্ভের উদ্দেশ্যে মধ্য কলকাতায় একটা বাড়িও লিজ নেওয়া হল। কিন্তু শেষমেশ আপাত পরিত্যক্ত রাইটার্স বিল্ডিংসকেই বেছে নেওয়া হল ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ভবন হিসেবে।৫
১৮০০ খ্রিস্টাব্দের ২৪ নভেম্বর সরকারিভাবে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের কাজ আরম্ভ হয়। তবে বিদ্যাসাগর যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের চাকরিতে ঢোকেন তখন কলেজের পূর্বগরিমা অস্তমিতপ্রায়। বস্তুত, ১৮০০ থেকে ১৮১৫-১৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ বাংলা গদ্য সাহিত্যের অভিভাবকের ভূমিকা পালন করে এসেছিল। রামমোহন রায়ের কলকাতায় স্থায়ীভাবে বসবাসের পর থেকে এবং প্রায় সমকালে কলকাতায় একাধিক পত্র-পত্রিকা ও গ্রন্থ প্রকাশ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের কর্তৃত্ব নিতে আরম্ভ করে। ফলে ১৮৪১-৪২ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগর যখন ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে পড়াতে আসছেন তখন ওই কলেজ নেহাতই সাহেব কেরানিদের দেশীয় ভাষা ও রীতিনীতি শেখার ইস্কুল মাত্র। বিদ্যাসাগর ছাড়াও উইলিয়াম কেরি, রামরাম বসু, মদনমোহন তর্কালঙ্কার প্রমুখ পণ্ডিত ওই কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। ছাত্রদের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের একটা সমৃদ্ধ লাইব্রেরি গড়ে তোলা হয়েছিল। পরে ওই কলেজ উঠে গেলে সেখানকার বইপত্র দান করে দেওয়া হয় ‘ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরি’-তে। ওই গ্রন্থাগার পরবর্তীকালে প্রথমে ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরি ও তারপরে ন্যাশনাল লাইব্রেরি বা জাতীয় গ্রন্থাগারে রূপান্তরিত হয়।
ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে মাত্র সাড়ে পাঁচ বছর চাকরি করলেও ওই সময়কালে বিদ্যাসাগর কঠোর পরিশ্রম করে ইংরিজি ও হিন্দি ভাষা শিক্ষা করেন। ওই কলেজের জন্যই তিনি বাসুদেব চরিত নামে একটা বই রচনা করেন। বাসুদেব চরিত দিয়েই ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাংলা রচনার সূত্রপাত।
কর্মজীবন : সংস্কৃত কলেজ পর্ব
১৮৪৬-এর এপ্রিল মাসের ২২ তারিখ তিনি আবার পা রাখলেন তাঁর নিজের শিক্ষায়তনে। ৫০ টাকা মাসিক বেতনে সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদক পদে যোগদান করলেন তিনি। কিন্তু সে চাকরি বেশিদিন টিকল না। সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মতবিরোধে ১৮৪৭-এর জুলাই মাসেই ইস্তফা দিলেন সংস্কৃত কলেজের চাকরিতে। প্রায় বছর দুয়েক বেকার থাকার পর ১৮৪৯-এর ১ মার্চ আবার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে এলেন হেড রাইটার ও কোষাধ্যক্ষ হয়ে। বিদ্যাসাগরের মতো অসামান্য প্রতিভাধর এবং সেইসঙ্গে দক্ষ লোককে সংস্কৃত কলেজে নিয়ে আসার জন্য কোম্পানির শিক্ষাবিভাগ উদ্যোগী হল। তাই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রায় এক বছর ন’মাস কাটানোর পর, ১৮৫০-এর ডিসেম্বরের ৫ তারিখে বিদ্যাসাগরকে আবার সংস্কৃত কলেজে ফিরিয়ে আনা হল সাহিত্যের অধ্যাপক পদ দিয়ে। শর্ত ছিল পরে তাঁকে কলেজের অধ্যক্ষ করতে হবে। অবশ্য তারজন্য তাঁকে বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মতবিরোধ তো আগে থেকেই ছিল, এই পর্বে তা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছল। এই বিরোধে সরকারের সমর্থন রইল বিদ্যাসাগরের দিকেই। বাধ্য হয়ে রসময় দত্ত পদত্যাগ করলেন। পূর্বেকার মাসিক ১০০ টাকা বেতনের সম্পাদক ও মাসিক ৫০ টাকা বেতনের সহকারী সম্পাদক পদ তুলে দিয়ে মাসিক ১৫০ টাকা বেতনের নতুন অধ্যক্ষের পদ তৈরি করে সেখানে বসানো হল ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে। সেই সময়ে ওই কলেজেরই একতলার একটা ঘরে তিনি কিছুকাল বাস করেছিলেন। এমনকী ওই ঘরের সামনের জমিতে অস্থায়ী আখড়া করে কুস্তি অভ্যাস করতেন বলেও তাঁর জীবনীকারদের লেখা থেকে জানা যায়। তিনি ছাড়াও দ্বারকানাথ বিদ্যাভূষণ, শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, তারাশঙ্কর তর্করত্ন প্রমুখ পণ্ডিতরা ওই কুস্তির আখড়ায় যোগ দিতেন।
সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে বিদ্যাসাগর ছিলেন মাত্র সাত বছর তিন মাস। ওই অল্প সময়ের কার্যকালে তিনি সংস্কৃত কলেজের নিয়ম-কানুনের প্রভূত পরিবর্তন করেন। ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও প্রথমে কায়স্থ ও সমগোত্রীয় উচ্চ বর্ণের এবং পরে সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাত্রের জন্যই কলেজের দরজা খুলে দেন। কঠিন মুগ্ধবোধ ব্যাকরণ পড়া বন্ধ করে দিয়ে নিজের লেখা বাংলায় সহজ সংস্কৃত ব্যাকরণের উপক্রমণিকা ও ব্যাকরণ কৌমুদী পড়ানোর ব্যবস্থা করলেন। কলেজের ছাত্রদের জন্য ২ টাকা প্রবেশমূল্য ধার্য করলেন। পরে মাসিক বেতন দেবার ব্যবস্থাও চালু হয়। গোড়ার দিকে সংস্কৃত কলেজে কিছুকাল ঐচ্ছিক ইংরিজি পড়ানোর ব্যবস্থা থাকলেও তা তুলে দেওয়া হয়েছিল। বিদ্যাসাগর পুনরায় তা ফিরিয়ে আনলেন এবং কলেজের ইংরিজি বিভাগকে ঢেলে সাজালেন। সেইসঙ্গে গণিত বিভাগেও প্রাচীন সংস্কৃত গণিতের চর্চা বন্ধ করে ইংরিজি গণিতবিদ্যার প্রবর্তন করলেন। সে যুগে রবিবারে সংস্কৃত কলেজ বন্ধ থাকত না। প্রতিপদে ও অষ্টমীতে সংস্কৃত পড়া নিষিদ্ধ তাই মাসে ওই ৪ দিন কলেজ বন্ধ থাকত। দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও পূর্ণিমায় নতুন পাঠ হত না, শুধু সংস্কৃত রচনা শিক্ষা বা অনুবাদ করতে শেখানো হত। বিদ্যাসাগর প্রতিপদ, অষ্টমী এসব দিনের ছুটি তুলে দিয়ে রবিবারে সাপ্তাহিক ছুটি চালু করেন। সেই সময়ে প্রায় সমস্ত ইস্কুল-কলেজেই ইংরেজদের অনুকরণে শীতকালে বেশি ছুটি দেওয়া হত। কিন্তু প্রবল গরমে ছাত্রদের অসুবিধার কথা ভেবে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে গ্রীষ্মের ছুটি প্রবর্তন করেন। ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১১ মার্চ তিনি সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ পদে ইস্তফা দেন। সেই সময় অবশ্য সংস্কৃত কলেজ (এবং হিন্দু কলেজও) এই জায়গায় ছিল না। সিপাই বিদ্রোহের জন্য সরকার থেকে কলেজ ভবনের দখল নেওয়া হয়েছিল বলে উভয় কলেজই বউবাজার স্ট্রিটের দুটো বাড়িতে সাময়িকভাবে উঠে যায়। ১১০ নম্বর বউবাজার স্ট্রিটের একটা বাড়ি পঁচাত্তর টাকায়, ১৩১ নম্বর বউবাজার স্ট্রিটের আর একটা বাড়ি চল্লিশ টাকায় এবং ৯২ নম্বর বউবাজার স্ট্রিটের আরও একটা বাড়ি তিরিশ টাকায় ভাড়া নেওয়া হয় কলেজের জন্য।৬
কর্মজীবন: ব্যাবসা পর্ব
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রধান পরিচয় শিক্ষাবিদ এবং সমাজ সংস্কারক হলেও ব্যবসায়ী হিসেবেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত সফল। আগেই উল্লেখ করেছি, ১৮৪৬-এর অগস্ট-এ মাসিক পঞ্চাশ টাকা বেতনে বিদ্যাসাগর সংস্কৃত কলেজে সহকারী সম্পাদক পদে নিযুক্ত হন। সেই সময় কলেজের সম্পাদক রসময় দত্তের সঙ্গে মতপার্থক্যর কারণে বিদ্যাসাগর পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগপত্র গৃহীত হল। জনশ্রুতি আছে, সেই সময়ে রসময় দত্ত নাকি আড়ালে বলতে লাগলেন, ‘বিদ্যাসাগর যে চাকরিটা ছেড়ে দিলে, এখন খাবে কী?’ কথাটা বিদ্যাসাগরের কানে পৌঁছতে দেরি হল না। তিনি বললেন, ‘রসময়বাবুকে বলো, বিদ্যাসাগর আলু-পটল বেচে খাবে।’
না, বিদ্যাসাগরকে আলু-পটল বেচতে অবশ্য হয়নি, তার কারণ সংস্কৃত কলেজে চাকরি পাওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই তিনি কলেজেরই এক সহকর্মীর সঙ্গে যৌথভাবে একটা ছাপাখানা প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘যৎকালে আমি ও মদনমোহন তর্কালঙ্কার সংস্কৃত কলেজে নিযুক্ত ছিলাম, তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে সংস্কৃতযন্ত্র নামে একটা ছাপাখানা সংস্থাপিত হয়। ঐ ছাপাখানায় তিনি ও আমি সমাংশভাগী ছিলাম।’ বিদ্যাসাগর ও তর্কালঙ্কার উভয়েই ছিলেন গরিব টুলো-পণ্ডিত ঘরের সন্তান। ব্যাবসার মূলধন তাঁদের ছিল না, তাই জনৈক নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের কাছ থেকে ৬০০ টাকা ধার করে কেনা হল ছাপাখানার যন্ত্রপাতি। অল্প দিনের মধ্যেই ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্রদের জন্য ভারতচন্দ্র রচিত অন্নদামঙ্গল ছাপাবার বরাত পেল ওই ‘সংস্কৃতযন্ত্র’, যার পোশাকি নাম ‘সংস্কৃত প্রেস’। বিদ্যাসাগর নিজে কৃষ্ণনগর গিয়ে রাজবাড়ির সংগ্রহ থেকে অন্নদামঙ্গল-এর আদি পুথি সংগ্রহ করে বই ছাপলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ একাই কিনে নিল একশো কপি বই। লভ্যাংশের টাকায় শোধ হল নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের ঋণের টাকা। সেই শুরু। তারপর থেকে প্রাচীন সাহিত্যের হারিয়ে যাওয়া বহু পুথি, গ্রন্থ বিদ্যাসাগর-তর্কালঙ্কারের উদ্যোগে ছাপা হতে লাগল সংস্কৃত প্রেস থেকে।
প্রথম দিকে শুধু পুরনো বই-ই ছাপা হত, এরপর তাঁরা নিজেরাই বই লেখায় উদ্যোগী হলেন। অবশ্য সে যুগে সেটাই ছিল পুস্তক প্রকাশনার ধারা। তখন বইপাড়া বলতে বটতলা অঞ্চলকে বোঝানো হত। এখনকার চিৎপুর-গরানহাটা অঞ্চল ঘিরেই ছিল সেই বটতলা। তার বাইরেও পটলডাঙা, বউবাজার প্রভৃতি অঞ্চলেও গ্রন্থ মুদ্রণ ও প্রকাশনার ব্যাবসা ছিল। সংস্কৃত প্রেসও সেই ধারার অনুসারী হল। ১৮৪৯-এ প্রকাশ পেল মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা-র প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ, পরের বছর তৃতীয় ভাগ। শুরু থেকেই জনপ্রিয় হয় শিশুশিক্ষা। ১৮৯০-এর মধ্যে ওই বইয়ের প্রথম ভাগের মোট ১৪৯টি সংস্করণ প্রকাশ করতে হয়েছিল আর তৃতীয় ভাগের সংস্করণ হয় ১৪১টি। পরে ওই বইয়ের আরও দু’টি ভাগ প্রকাশ পায়। মদনমোহন নয়, সে বই দু’টির লেখক ছিলেন যথাক্রমে বিদ্যাসাগর ও রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
১৮৫৫-এ প্রকাশিত হল বাংলা শিশুশিক্ষার জগতে অন্যতম শ্রেষ্ঠ তথা ‘বেস্টসেলার’ বই বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয়-এর প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ। প্রথম দু’ বছরের মধ্যে বর্ণপরিচয়-এর ৯টি সংস্করণে ৫৩ হাজার কপি প্রচারিত হয়েছিল, ১৮৯০ পর্যন্ত বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগের সংস্করণ হয় ১৫২টি এবং দ্বিতীয় ভাগের ১৪০টি। ১৮৫৬-এ বিদ্যাসাগরের কথামালা প্রকাশ পায়। ১৮৯০ পর্যন্ত সে বইয়েরও সংস্করণ হয় ৫১টি।
এই হিসেব হিমশৈলের চূড়া মাত্র। মদনমোহন তর্কালঙ্কারের শিশুশিক্ষা এখন আর ততখানি গুরুত্ব না পেলেও বর্ণপরিচয় বাংলা ভাষায় প্রকাশিত সব ধরনের বইয়ের হিসেব গুলিয়ে দিয়েছে। অন্যান্য বইগুলির কথা বাদ রাখলেও সংস্কৃতযন্ত্র বিক্রি করে দেওয়া পর্যন্ত বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় ও কথামালা-র বিক্রি তাঁর প্রকাশনাকে অর্থে-বিত্তে ভরিয়ে দিয়েছিল।
সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ থাকাকালীন তিনি কলেজ স্ট্রিট ও হ্যারিসন রোড সংযোগের উত্তর-পশ্চিম কোণের একটা ঘরেও বাস করেছেন কিছুকাল। এরপর কিছুকাল তিনি বাস করেন মেছুয়াবাজার স্ট্রিটের একটা বাড়িতে। বন্ধু মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সঙ্গে বিদ্যাসাগর যে বাড়িতে ‘সংস্কৃত প্রেস’ ও ‘সংস্কৃত প্রেস ডিপোজিটরি’ নামে ছাপাখানা ও প্রকাশন সংস্থা খুলেছিলেন, তার কার্যালয় ৬৩ আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িটিতেও বিদ্যাসাগর বাস করেছেন কিছুকাল। সে বাড়ি এখন ধ্বংসস্তূপ। গঙ্গার তীরে হীরালাল শীলের যে বাগানবাড়িতে বিদ্যাসাগর কিছুকাল বাস করেন, সেটিও সঠিকভাবে চিহ্নিত নয়।৭
ভারতের ইতিহাসে প্রথম বিধবাবিবাহের ঘটনা ঘটেছিল বিদ্যাসাগরের পরম-ভক্ত রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ১২ সুকিয়া স্ট্রিটের (অধুনা ৪৮এ কৈলাস বোস স্ট্রিট) বাড়িতে। উনিশ শতকের সমাজ আন্দোলনের অন্যতম পীঠস্থান রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সিমুলিয়ার ১২, সুকিয়া স্ট্রিটের (বর্তমান ঠিকানা ৪৮এ, কৈলাস বসু স্ট্রিট) বাড়িটি আজও রয়েছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে। এখন থেকে ঠিক একশো পঞ্চাশ বছর আগে, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় এই বাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল হিন্দু বাল্যবিধবাদের পুনর্বিবাহের প্রথম বিবাহ অনুষ্ঠানটি।
‘বাংলার নবজাগরণ’-এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঘটনা এই ‘বিধবাবিবাহ’, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তিও বটে। খাটুরার বিখ্যাত কথক রামধন তর্কবাগীশের ছেলে শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের বিয়ে। কনের নাম কালীমতী। বর্ধমান জেলার পলাশডাঙার ব্রহ্মানন্দ মুখোপাধ্যায়ের দশ বছর বয়সি বিধবা কন্যা কালীমতী। বিবাহের উদ্যোক্তা আর কেউ নন, স্বয়ং বিদ্যাসাগর। ওই প্রথম বিধবাবিবাহ উপলক্ষে রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি ভারতের ইতিহাসে এক অভিনব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে পড়ে।৮
গৃহকর্তা রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন বিদ্যাসাগরের একজন পরম ভক্ত। বড়বাজারে ১৩, দয়হাটা স্ট্রিটের ভাড়া-করা বাসাবাড়ি ছেড়ে ঠাকুরদাস-ঈশ্বরচন্দ্ররা ভাড়া নেন বউবাজারের হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের গলির (উচ্চারণ বিভ্রাটে বর্তমানে সেটি হিদারাম ব্যানার্জি লেন নামে পরিচিত) ১৫ নম্বর বাড়ি। কিছুকাল পরেই উঠে আসেন ওই গলিরই ৫৪ নম্বর বাড়িতে। সেখানে থাকাকালীন গৃহস্বামী হৃদয়রাম বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৌত্র রাজকৃষ্ণের সঙ্গে সখ্য তৈরি হয় ঈশ্বরচন্দ্রের, যা বজায় ছিল আজীবন। বিদ্যাসাগরের সাহচর্যে রাজকৃষ্ণও হয়ে উঠেছিলেন একজন সমাজ সংস্কারক। কিন্তু তাঁদের রক্ষণশীল পরিবারে তা নিয়ে অশান্তি তৈরি হওয়ায় রাজকৃষ্ণ ১৮৪৮/৫০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সুকিয়া স্ট্রিটের এই বাড়িটি কিনে উঠে আসেন। প্রায় সমসাময়িক কালে ঈশ্বরচন্দ্রও স্থাপন করেছেন ‘সংস্কৃত প্রেস’ নামে এক ছাপাখানা, যার কার্যালয় ছিল, রাজকৃষ্ণের বাড়ি থেকে সামান্য দূরে। আর বিদ্যাসাগর সেই সময় চাকরি করেন কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলের সংস্কৃত কলেজে। ফলে বিদ্যাসাগরের সমাজ সংস্কারমূলক নানা কর্মকাণ্ডের আখড়া হয়ে ওঠে রাজকৃষ্ণের সুকিয়া স্ট্রিটের এই বাড়ি। সেই সূত্র ধরে সে যুগের হিন্দু সমাজপতি ও রক্ষণশীলদের ভ্রুকুটি অগ্রাহ্য করেই রাজকৃষ্ণের বাড়িতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল প্রথম বিধবাবিবাহ।
তৎকালীন সুকিয়া স্ট্রিটের ১২ নম্বর বাড়িতে যে প্রথম বিধবাবিবাহের আসর বসেছিল, তা নিয়ে বিতর্ক নেই, বিতর্ক সে বাড়ির বর্তমান অবস্থান ও ঠিকানা নিয়ে। শ্রীপান্থ লিখেছেন, ‘নিমন্ত্রণপত্রে জানা গেল, বিবাহ-বাসর ‘‘সিমুলিয়ার সুকেস স্ট্রিটের ১২ সংখ্যক ভবন”। সুকিয়া স্ট্রিটের ওই বিশেষ খণ্ডটির নাম আজ বদল হয়ে গেছে। এখন তার পরিচয় কৈলাস বসু স্ট্রিট। প্রতিদিন বহু লোকের আনাগোনা সেখানে। কিন্তু তাঁদের অতি অল্পজনই চেনেন সেই ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংখ্যক ভবনটি। কারণ, আজ আর তার সংখ্যা দশের ঘরে নেই। নামবদলের মতো কালের নড়াচড়ায় বদলে গেছে তার পরিচয়-অঙ্কটিও। সুতরাং যদি এরই মধ্য থেকে কেউ বাংলাদেশের প্রথম বিধবাবিবাহ বাসরটি খুঁজে পেতে চান, তবে জিজ্ঞেস করে এদিক সেদিক ঘুরে তাঁকে দাঁড়াতে হবে ‘‘৪৮ এ’’ এবং ‘‘৪৮ বি’’ নম্বর আঁটা যমজ বাড়িটির সামনে।’৯
শুধু শ্রীপান্থই নন, পরবর্তীকালে সুনীল মুন্সীর ঠিকানা কলকাতা গ্রন্থে বা রাধারমণ মিত্রও কৈলাস বসু স্ট্রিটের ৪৮ সংখ্যক বাড়িকেই অতীতের ১২ নম্বর বলে নির্দিষ্ট করেছেন।১০
সম্প্রতি শেখর ভৌমিক এক নিবন্ধে সেই সময়কার স্ট্রিট ডিরেক্টরি ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে জানিয়েছেন, ৪৮ নয়, এখনকার ঠিকানা অনুযায়ী ৩২ নম্বর কৈলাস বসু স্ট্রিটের বাড়িই ছিল সেকালের ১২ নম্বর সুকিয়া স্ট্রিট আর সেখানেই বসেছিল প্রথম বিধবা বিবাহের আসর। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিদ্যাসাগর কিছুকাল বসবাস করেছিলেন এই বাড়িটিতেও।১১
কর্মজীবন : মেট্রোপলিটন ইন্স্টিটিউশন পর্ব
শঙ্কর ঘোষ লেনে একটা পুরনো বাড়িতে কয়েকজন শিক্ষাব্রতীর উদ্যোগে ১৮৫৯-এ শঙ্কর ঘোষের বাড়ি ভাড়া নিয়ে (যদিও তখন সে বাড়ির মালিক ছিলেন খেলাৎচন্দ্র ঘোষ) ‘মেট্রোপলিটন ট্রেনিং স্কুল’ নামে একটা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়েছিল। কিছুকাল পরে সেটির নাম হয় ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’। স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক ছিলেন কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। পরের বছর বিদ্যালয়ের কমিটিতে আসেন রাজকৃষ্ণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সাংবাদিক কৃষ্ণদাস পাল প্রমুখ এবং সভাপতি হন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই সদস্যদের মধ্যে মনোমালিন্যের কারণে ঠাকুরদাস চক্রবর্তী ও আরও কয়েকজন সদস্য ওই স্কুল থেকে বেরিয়ে এসে ১৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের বাড়ি ভাড়া নিয়ে ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং অ্যাকাডেমি’ নামে পালটা একটা স্কুল তৈরি করেন। আর পুরনো ‘ক্যালকাটা ট্রেনিং স্কুল’ বিদ্যাসাগরের সম্পাদনায় চলতে থাকে সমান্তরালভাবে।
বিদ্যাসাগর দায়িত্ব নেওয়ায় স্কুলের পঠনপাঠন ভালভাবে চললেও সমস্যা এল অন্যভাবে। যে বাড়িতে ক্লাস হত সেটার খুবই ভগ্নদশা। স্কুল কমিটি মাসিক ৫০ টাকা ভাড়া দিত। মালিক খেলাৎচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে চুক্তি হল, তিনি বাড়ি সারিয়ে দেবেন, পরিবর্তে মাসিক ১০০ টাকা ভাড়া দেওয়া হবে। বাড়ি সারানো হলেও তা বিদ্যাসাগরের মনোমতো হল না। সামান্য সংস্কার করে পরিবর্তে দ্বিগুণ টাকা ভাড়া হিসেবে তিনি দিতে অস্বীকৃত হলেন। খেলাৎচন্দ্র মামলা করলেন স্কুলের বিরুদ্ধে। এইসব গণ্ডগোলের জেরে স্কুলের পড়াশোনা যখন বন্ধ হবার উপক্রম তখন (১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ) বিদ্যাসাগর সুকিয়া স্ট্রিটে ২৩ নম্বর বাড়ি ভাড়া করে স্কুলকে স্থানান্তরিত করলেন এবং নতুন নাম দিলেন ‘মেট্রোপলিটন ইন্স্টিটিউশন’। ছাত্রসংখ্যা বাড়ায় গৃহসমস্যা মেটাবার জন্য আমহার্স্ট স্ট্রিট ও গুরুপ্রসাদ চৌধুরী লেনে দুটো আলাদা জায়গা ভাড়া নেওয়া হলেও কলেজ চালাবার সমস্যা তাতে আরও বেড়েই গেল। ইতিমধ্যে সুকিয়া স্ট্রিটের বাড়ির মালিক বাড়ি ছেড়ে দেওয়ার নোটিশ দিয়েছেন। এমন এক জটিল অবস্থায় বিদ্যাসাগর নিজের সম্পত্তি বন্ধক রেখে টাকা ধার করে, ওই শঙ্কর ঘোষ লেনেই বর্তমান ‘মেট্রোপলিটন ইন্স্টিটিউশন’ ও ‘বিদ্যাসাগর কলেজ’ (এই নামকরণ অবশ্য অনেক পরে হয়েছিল)-এর জন্য জমি কিনে ইন্স্টিটিউশনের নিজস্ব ভবন তৈরি করান। ১৮৮৭-র জানুয়ারি মাসে এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ভবনের দ্বারোদ্ঘাটন হল। অনাড়ম্বর, তার কারণ ঢাকঢোল পিটিয়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠান করতে যে ৪০০ বা ৫০০ টাকা খরচ হত, সেই টাকা দিয়ে বিদ্যাসাগর দরিদ্র ছাত্রদের বৃত্তিদানের ব্যবস্থা করেন।১২
শেষজীবন
বিদ্যাসাগর প্রথম জীবনে নিজে বসবাসের জন্য কোনও বাড়ি না তৈরি করলেও শেষ বয়সে তাঁর বিপুল গ্রন্থসম্ভার রাখার জন্যই ১৮৭৬-এ মধ্য কলকাতায় ২৫ বৃন্দাবন মল্লিক লেনে (এখনকার ঠিকানা ৩৬ বিদ্যাসাগর স্ট্রিট) এক খণ্ড জমির উপরে একটা দোতলা বাড়ি তৈরি করেন। জীবনের শেষ চোদ্দো বছর তিনি কাটিয়েছেন এই বাড়িতেই। এই বাড়িতেই ‘সাগর দর্শন’ করতে এসেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ।
মেরি কার্পেন্টারের সঙ্গে উত্তরপাড়া বালিকা বিদ্যালয় পরিদর্শন করে ফেরবার পথে গাড়ি উলটে বিদ্যাসাগর যকৃতে আঘাত পান। মাস খানেকের চিকিৎসায় সে যাত্রায় রক্ষা পেলেও ওই আঘাত থেকেই তাঁর শারীরিক ক্ষয় আরম্ভ হয়। অনুমান করা হয়, ওই আঘাতের কারণেই তিনি যকৃতের ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন। অবশেষে, ১৮৯১-এর ২৯ জুলাই (১৩ শ্রাবণ, ১২৯৮ বঙ্গাব্দ) এই বাদুড়বাগানের বাড়িতেই মারা যান বিদ্যাসাগর।১৩
রাত দুটো বেজে আঠারো মিনিট নাগাদ বিদ্যাসাগরের মৃত্যু হয় আর ভোর চারটে নাগাদ বাদুড়বাগানের বাড়ি থেকে মেট্রোপলিটন কলেজ হয়ে নিমতলা মহাশ্মশানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অন্ত্যেষ্টির জন্য। অত ভোররাতেও হাজার হাজার মানুষ শবানুগমন করেছিলেন। শ্মশানঘাটে বহু মানুষ উপস্থিত হয়েছিলেন জীবিতকালে কিংবদন্তিতে পরিণত হওয়া মানুষটার প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানাবার জন্য।
বিদ্যাসাগরের মৃত্যুর পরে তাঁর সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ‘বিদ্যাসাগর এস্টেট’ নামে একটা ট্রাস্ট গঠিত হলেও তা একসময় দেনার দায়ে জর্জরিত হয়ে পড়ে। সেই সময়ে বিদ্যাসাগরের মহামূল্য গ্রন্থসংগ্রহ লালগোলার মহারাজ নিলামে কিনে নেন। পরে ওই বইগুলির অধিকাংশই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদে রাখা হয়। অল্প কিছু বিদ্যাসাগর কলেজে রয়েছে। গ্রন্থ সংগ্রহ রক্ষা পেলেও, বিদ্যাসাগরের ওই বাসভবনটি কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ক্রমেই জীর্ণ হয়ে পড়ে এবং একসময় সেটি দুষ্কৃতীদের আড্ডায় পরিণত হয়। দীর্ঘকাল ওই অবস্থায় থাকার পরে সেটি সরকারের দখলে আসে এবং সংরক্ষিত হয়। সিকি শতাব্দী আগে রাজ্য সরকার বাড়িটিকে অধিগ্রহণ করে বিদ্যাসাগর মহিলা কলেজের হাতে তুলে দেয় ব্যবহার ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য। সংস্কারের জন্য রাজ্য সরকার অনেক টাকা অনুদানও দেয় সেই সময়ে। ওই টাকায় বাড়িটির আগাগোড়া সংস্কার করে ঠিক হয়েছিল এখানে বিদ্যাসাগর বিষয়ক প্রদর্শশালা গড়ে তোলা হবে। পরে সেই বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রক থেকে অনুদানও এসেছিল। কিন্তু দেওয়াল-জোড়া বিদ্যাসাগরের জীবনপঞ্জি সংক্রান্ত কিছু ভিনাইল প্রিন্ট, হাডসন অঙ্কিত বিদ্যাসাগরের একটা তৈলচিত্র আর ক্ষেত্রমোহন ভাস্কর নির্মিত বিদ্যাসাগরের একটা কাঠের মূর্তি ছাড়া আর কিছুই নেই সেখানে। তার বদলে বর্তমানে এখানে খোলা হয়েছে একটা কম্পিউটার শিক্ষণকেন্দ্র। আর পুরো বাড়িটি জুড়েই রয়েছে ‘ইন্দিরা গাঁধী মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়’-এর (ইগনু) কার্যালয়।
স্মৃতিরক্ষা: মূর্তি স্থাপন
১৮৯১ খ্রিস্টাব্দের ২৯ জুলাই তারিখে প্রয়াণ ঘটেছিল বিদ্যাসাগরের। মৃত্যুর এক মাসের মাথায় কলকাতার টাউন হলে আয়োজিত এক স্মরণসভায় তাঁর স্মৃতি রক্ষার জন্য মূর্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মূর্তি বসিয়ে স্মৃতি রক্ষার এই রীতি তখন এদেশে এসে গিয়েছে পুরোমাত্রায়। ব্রিটিশরাই এর স্রষ্টা। তখনও পর্যন্ত প্রায় ৩০টির মতো মূর্তি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে শহরের নানা জায়গায়, যার মধ্যে ব্রিটিশ রাজন্যবর্গ ছাড়াও ছিল রমানাথ ঠাকুর, প্রসন্নকুমার ঠাকুর, কালীকৃষ্ণ দেব, কৃষ্ণদাস পালের মতো কৃতবিদ্য ভারতীয়দের মূর্তি। তবু বিদ্যাসাগরের মূর্তিস্থাপন একাধিক কারণে শহর কলকাতার মূর্তি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ।
বিদ্যাসাগরের আগে প্রতিষ্ঠিত ব্রিটিশ ও ভারতীয়দের সমস্ত মূর্তিই গড়া হয়েছিল ইউরোপে, সেখানকার শ্বেতপাথর দিয়ে এবং শিল্পীরা প্রত্যেকেই ইউরোপীয়। কিন্তু বিদ্যাসাগরের স্বদেশি শিল্পপ্রীতি ও স্বাবলম্বী মতাদর্শের কথা স্মরণ করে জয়পুরের শ্বেতপাথর কেটে গড়া হয়েছিল তাঁর মূর্তি। নির্মাণ করেন বারাণসীর শিল্পী দুর্গা মিস্ত্রি। সেই দিক থেকে বিচার করলে বিদ্যাসাগরের মূর্তিই কলকাতায় বসানো ভারতীয় উপাদানে গড়া, ভারতীয় শিল্পীর তৈরি প্রথম মূর্তি।
জোড়াসনে বসা বিদ্যাসাগরের ওই মূর্তিটি প্রথমে বসানো হয় সংস্কৃত কলেজের দক্ষিণে। মূর্তির পাদপীঠে খোদিত প্রশস্তি-শ্লোকটি রচনা করেন কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ নীলমণি মুখোপাধ্যায়। ১৮৯৯-এর ২৮ মার্চ মূর্তির আবরণ উন্মোচন করেন লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার জন উডবার্ন। মূর্তিটা অবশ্য বেশি দিন ওই জায়গায় ছিল না। আট বছর পরে, ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে মূর্তিটিকে সেখান থেকে সরিয়ে কলেজ স্কোয়ারের পশ্চিম প্রবেশ পথে স্থাপন করা হয়। আজও সেখানেই আছে মূর্তিটি।
সংস্কৃত কলেজ থেকে স্থানান্তরের পর কলেজ কর্তৃপক্ষ বিদ্যাসাগরের আর একটা মূর্তি প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এবারে আর ভারতীয় শিল্পী নয়, মূর্তি গড়ার ভার দেওয়া হয় এভাঞ্জেলিনো বইস-কে। তিনি ইতালির লোক তবে থাকতেন কলকাতাতেই। অবিকল দুর্গা মিস্ত্রির মূর্তির মতো দেখতে শ্বেত পাথরের ওই মূর্তি বসানো হয়েছিল সংস্কৃত কলেজের বর্তমান প্রবেশপথের পূর্ব দিকে। বইস-এর গড়া বিদ্যাসাগরের ওই দ্বিতীয় মূর্তিটার কোনও খোঁজ এখন আর পাওয়া যায় না। সত্তরের দশকে কলেজ স্কোয়ারে বসানো বিদ্যাসাগরের প্রথম মূর্তির সঙ্গে এটাও দুষ্কৃতী-হামলার শিকার হয়েছিল। মূর্তিটা এমনই ক্ষতিগ্রস্ত হয় যে কলেজ কর্তৃপক্ষ সেটিকে প্রকাশ্য স্থান থেকে সরিয়ে ফেলে। ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে বিদ্যাসাগরের মৃত্যুশতবর্ষের সময় পর্যন্ত মূর্তিটা কলেজের একটা গুদাম ঘরে পড়েছিল বলে জানা যায়, কিন্তু বর্তমানে কোথায় সেটি কেউ জানে না, কলেজ কর্তৃপক্ষও আগ্রহী নয় ‘ভাঙা মূর্তি’ নিয়ে মাথা ঘামাতে। একটা অসমর্থিত সূত্রের খবর অনুযায়ী জানা গেছে, মৃত্যুশতবর্ষের সময়ে ওই ভাঙা মূর্তি কোনও এক ভাস্করকে দেওয়া হয়েছিল সংস্কারের জন্য, কিন্তু পরবর্তীকালে কেউই আর তার খোঁজ রাখেনি।
বইস-এর মূর্তি ভেঙে যাবার পর ওই জায়গায় বসানো হয়েছে বিদ্যাসাগরের তৃতীয় একটা মূর্তি। সেটাও শ্বেত পাথরের তৈরি, রূপকার প্রমোদগোপাল চট্টোপাধ্যায়। এখনও সংস্কৃত কলেজের বর্তমান প্রবেশপথের পূর্ব দিকে রয়েছে ওই মূর্তি। উল্লেখ্য, প্রমোদগোপাল চট্টোপাধ্যায়ের গড়া সেই মূর্তিও দুষ্কৃতী-হামলার শিকার হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে সেটার সংস্কার করা সম্ভব হয়েছিল।
বীরসিংহ গ্রামের এক সূত্রধর শিল্পী ক্ষেত্রমোহন ভাস্কর কাঠের কাজ করতে এসেছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেনের আরামবাগের বাড়িতে। সেখানে একটা কাঠের গুঁড়ি পড়ে থাকতে দেখে তা দিয়ে শুধু থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে তৈরি করেন বিদ্যাসাগরের চেয়ারে-বসা পূর্ণাঙ্গ মূর্তি। এ ছাড়াও বিদ্যাসাগরের নিজের প্রতিষ্ঠা করা শঙ্কর ঘোষ লেনের মেট্রোপলিটন ইন্স্টিটিউশনের কলেজ বিভাগ অর্থাৎ, এখনকার বিদ্যাসাগর কলেজে রয়েছে ভাস্কর সুনীল পালের তৈরি আবক্ষ মূর্তি। ওই প্রতিষ্ঠানের স্কুল বিভাগ এবং মেট্রোপলিটন ইন্স্টিটিউশনের অন্যান্য শাখাগুলিতে রয়েছে একটা করে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের আবক্ষ মূর্তি। বিদ্যাসাগরের নিজের বাদুড়বাগানের বাড়ি ও কালীঘাট পার্কেও রয়েছে তাঁর আবক্ষ মূর্তি। এ ছাড়া কালীঘাট রোড ও হাজরা রোডের সংযোগে একটা বাড়ির দোতলার বারান্দার নীচে আলাদা বেদি নির্মাণ করে বসানো আছে পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি। সে মূর্তির রূপকার কৃষ্ণনগর-ঘূর্ণীর কার্তিকচন্দ্র পাল।১৪
টীকা ও সূত্রনির্দেশ
১. রাধারমণ মিত্র, কলিকাতা দর্পণ ১, তৃতীয় সংস্করণ/ পঞ্চম মুদ্রণ (কলকাতা: সুবর্ণরেখা, ২০০৮), পৃ. ৪৪; এবং কলিকাতা দর্পণ ২, প্রথম সংস্করণ (কলকাতা: সুবর্ণরেখা, জানুয়ারি ২০০৩), পৃ. ৭৬।
২. বিনয় ঘোষ, বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ (কলকাতা: ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, প্রথম ওরিয়েন্ট লংম্যান সংস্করণ, ১৯৮৪), পৃ. ৫৬-৫৭।
৩. কলিকাতা দর্পণ ২, পৃ. ৭৬।
৪. যোগেশচন্দ্র বাগল, কলিকাতার সংস্কৃতি-কেন্দ্র (কলকাতা: শ্রীগুরু লাইব্রেরি, প্রথম সংস্করণ, আষাঢ় ১৩৬৬ ব.), পৃ. ২৬-৩৩।
৫. বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ, পৃ. ১১১।
৬. করুণাসাগর বিদ্যাসাগর, পৃ. ১৩৬-১৪৯।
৭. কলিকাতা দর্পণ ২, পৃ. ৭৭।
৮. বিহারীলাল সরকার, বিদ্যাসাগর, (কলকাতা: নবপত্র প্রকাশন, শোভন সংস্করণ, মাঘ ১৪২২ ব.), পৃ. ১৪৮-৪৯।
৯. শ্রীপান্থ, ‘সুকেস স্ট্রিটের দ্বাদশসংখ্যক ভবন’, কলকাতা (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., প্রথম সংস্করণ / সপ্তম মুদ্রণ, জুলাই ২০১২), পৃ. ৩৭৪।
১০. কলিকাতা দর্পণ ২, পৃ. ৭৬।
১১. শেখর ভৌমিক, ‘ইতিহাসে বাড়ি বদল’, আনন্দবাজার পত্রিকা, রবিবাসরীয় নিবন্ধ, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৮।
১২. প্রশান্তকুমার পাল, রবিজীবনী প্রথম খণ্ড, (কলকাতা: আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি., দ্বিতীয় সংস্করণ / পঞ্চম মুদ্রণ), পৃ. ৫৩-৫৪; এবং রথীন মিত্র, ‘বিদ্যাসাগর মহাশয় ও মেট্রোপলিটন কলেজ’, বিদ্যাসাগর কলেজ: স্মৃতিধন্য ১২৫ বছর, বিদ্যাসাগর কলেজ দ্বারা প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশ, জুলাই ২০০৫, পৃ. ৭৯-৮৬।
১৩. উদয়ন মিত্র, ঈশ্বরচন্দ্র : এক নক্ষত্রের প্রয়াণ (কলকাতা: সোপান, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০১৬), পৃ. ৪৫।
১৪. কমল সরকার, কলকাতার স্ট্যাচু (কলকাতা: পুস্তক বিপণি, দ্বিতীয় প্রকাশ, জুলাই ২০১৭), পৃ. ১০৮-১১২; এবং গৌতম বসুমল্লিক, ‘বিদ্যাসাগর এই শহরে যেমন আছেন’; আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা উত্তর ক্রোড়পত্র, ২৯ জুলাই ২০০৬, পৃ. ৭।