শহরের বর্ষা-বসন্ত
গালিব এখন দিল্লিতে।
এই শহরে তিনি স্থায়ীভাবে বাস করার জন্য এসেছেন। নিজের ইচ্ছায় আসেননি। তাঁকে আনা হয়েছে। বিবাহের সম্পর্ক ধরে তিনি এসেছেন।
আগ্রা ছেড়ে আসার সময় মন খারাপ হয়েছিল। দু’মাস ধরে দিল্লির অলিগলি, বাজার, পথঘাট, নদীর ধার, জামা মসজিদ, লালকেল্লা ইত্যাদি নানা স্থানে ঘুরেছেন। কিন্তু মন-খারাপ কাটিয়ে উঠতে পারেননি। গলার কাছে বড় একটা পাথর আটকে আছে। নামবে না, সরছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় তাঁর নিজের কিছু করার নেই। অদৃশ্য সুতো তাঁকে বেঁধে রেখেছে।
এখন পর্যন্ত দিল্লি তার কাছে একটি ধূসর শহর। শহরের চারদিকে ছাই ছড়ানো। পায়ে পায়ে সেই ছাই ওড়ে। আর কবুতরের ডানায় আটকে থাকা ছাইয়ের রেণু ঢেকে দেয় সূর্যোদয় আর সূর্যাস্ত। ঠিকমতো বোঝা যায় না দিনের আলো এবং রাতের অন্ধকার।
অথচ তার চোখ দিল্লির শরীরে লেগে থাকা রঙের বাহার খোঁজে। যে রঙ তিনি শৈশব এবং কৈশোরে আগ্রা শহরে দেখেছিলেন। আগ্রার যমুনা নদী, তাজমহল, আগ্রা ফোর্ট এবং ঘুড়ি ওড়ানোর অসীম আকাশ তাঁর পক্ষে ফেলে আসা কঠিন ছিল। কিন্তু সেই কঠিনকে মানতে হয়েছে তাঁকে।
কারণ প্রয়োজনের তাড়না কঠিন জিনিস। প্রয়োজনের তাগিদে রক্তের সম্পর্কের পরিবার ছেড়ে আর একটি পরিবারের ছত্রছায়ায় নিজের জায়গা মেনে নিতে হলো তাঁকে। বিবাহ-সূত্র এই বন্ধনের সেতু। সেই সেতুতে পা রেখেই দিল্লি শহরে বাঁচতে আসতে হলো।
এই শহরে খানিকটা থিতু হওয়ার পরে তিনি ভাবলেন, যে শহরে প্রাণের টানে আসা হয় না সেটা কি বাসের উপযোগী শহর? নাকি সেই শহর একটি কারাগার? আর যে বিবির বন্ধন তাঁকে দেয়া হলো তার নাম কি প্রেম নাকি বেড়ি?
তাহলে কি দাঁড়ালো? পায়ে বেড়ি পরিয়ে একজন কিশোর কবিকে বন্দী করে আনা হয়েছে কারাগারে। কারণ তাঁকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব নিয়েছেন কয়েকজন মুরুব্বী। এদের একজন তাঁর শ্বশুর। তিনিও কবি।
এক সূর্যোদয়ের সময়ে তিনি শহরটাকে কারাগার বলে ঘোষণা করলেন। প্রথমে নিজের কাছে, পরে অন্যদের কাছে। কারাগারের বন্দীকে যে বেড়ি পরিয়ে আটক করা হলো তাঁর নাম—উমরাও বেগম।
তিনি দু’হাত ঊর্ধ্বে তুলে বললেন, ওহ্ দিল্লি!
আগ্রায় মুশায়রায় যোগ দেয়ার সুযোগ হয়েছিল। দিল্লি শহরে মুশায়রার আসর আছে, কিন্তু তাঁর যাওয়ার সুযোগ এখনো হয়নি। শ্বশুর বলেছেন সুযোগ করে দেবেন। চাচাশ্বশুর নওয়াব আহমদ বখশ প্রভাবশালী ব্যক্তি। দেখা যাক কি হয়। লালকেল্লার সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে খুঁজে ফেরেন মুশায়রার আসর। আগ্রা-বাসের সময় লেখা রুবাই বুকের ভেতরে গুঞ্জরিত হয়। নতুন ভাবনা আসে মাথায়। গজলের পক্তি আবৃত্তি করতে করতে পার হয়ে আসেন চাঁদনি চক। পৌঁছে যান যমুনার তীরে। দেখতে পান ধূসর শহরটা যমুনার জলে কালো ছায়া ফেলেছে। শহরের শরীরজুড়ে অন্ধকার। একই সঙ্গে তিনি অনুভব করেন তাঁর বয়স বেড়েছে। তিনি যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছেন।
ওহ্ দিল্লি! এই শহরে তিনি এখন যৌবনের আনন্দে মাতোয়ারা। শহরটি তার ধূসরতা নিয়ে কবির চোখে ধূসর মাধুর্যে পরিণত হলো। বন্দিজীবন এবং বয়সের সঙ্গে কবিতার যৌবন নিয়ে তিনি নতুন চোখে দেখতে শুরু করলেন দিল্লিকে।
ভাবলেন এই হোক তাঁর শেষ ঠিকানা। যমুনার তীরে দাঁড়িয়ে দেখতে পান দিগন্তে নেমে আসা আকাশের গায়ে সেঁটে আছে শৈশবের ছেঁড়া ঘুড়ির টুকরো। সেই টুকরো বিশাল ক্যানভাসে পরিণত হয়ে তাঁর যৌবনের সময়কে চিত্রিত করে। সেখানে গেঁথে থাকে হাজার হাজার পঙ্ক্তি— তাঁর রচিত গজলের পক্তি এবং শের।
তিনি আনন্দের সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, ওহ্ দিল্লি!
.
একদিন বিকেলবেলা তাঁর শ্বশুর ইলাহি বখশ আত্মীয়পরিজনের সামনে ঘোষণা দিলেন, আগামীকাল উমরাও আর মির্জা নওশার বাসর। এখন থেকে ওরা স্বামী-স্ত্রীর জীবনযাপন করতে পারবে।
পরদিন ধুমধাম করে আয়োজন হয়। দিনভর চলতে থাকে নানা কাজ। বাড়িতে মণ্ডা-মিঠাই আসতে থাকে। বোঝাই হয়ে যায় ঘর। কোর্মা-পোলাও রান্না হয়। উমরাওয়ের বিছানায় নতুন চাদর বিছানো হয়। বদলে যায় বালিশের কভার। দরজা-জানালার পর্দা। নতুন পর্দায় বাতাস ছুঁয়ে যায়। দুরন্ত বাতাসের চপল আবেগ। ঝোলানো পর্দায় চমৎকার কারুকাজ। উমরাও নিজে পছন্দ করে দিয়েছেন।
সারাদিন বাড়িতে আটকে থাকতে হলো গালিবকে। বাড়িতে তাঁকে মির্জা নওশা বলে ডাকে সবাই। কিন্তু নামটি তাঁর একটুও পছন্দ নয়। শুনলে মেজাজ খারাপ লাগে। তারপরও সয়ে থাকেন। ভাবেন, এখনো নামটা ঝেড়ে ফেলার সময় হয়নি। কবিতা লিখে যখন বড় হবেন তখন বাদ দেবেন।
তাঁর জন্য নতুন জামাকাপড় এসেছে। বেশ জমকালো পছন্দসই। তাঁরও ভালো লাগলো দেখে। মৃদু হেসে ভাবলেন, এটি পরলে তাঁর দিক থেকে দৃষ্টি ফিরবে না কারো। এমনিতেই দিল্লিতে তাঁর পরিচিতি হয়েছে শহরের সুদর্শন যুবক হিসেবে।
মাঝে মাঝে হেঁটে গেলে কানে আসে প্রশংসার ধ্বনি।
বাহ্, শাহেনশাহ একজন।
মনে হয় লালকেল্লার যুবরাজ।
মুঘল সম্রাটের পুত্র যেন।
তিনি মনে মনে হাসেন।
কুফরি চাঁদ পোশাক নিয়ে এসে বলে, বিকেলে এই পোশাক পরবেন মির্জা নওশা।
আমি একা পরবো?
না, আমি এসে পরতে সাহায্য করবো। বিশেষ করে নাগরা জুতাতো আমাকে পরিয়ে দিতে হবে।
ঠিক হ্যায়। বহুৎ আচ্ছা। তিনি খুশি হয়ে বলেন।
.
অভিজাত পরিবারের সন্তান হিসেবে তাঁর এই অহমবোধ আছে। অহমবোধ প্রকাশ করতে তিনি পছন্দও করেন। মনে করেন এটি প্রকাশ না করলে নিজের অবস্থান দৃঢ় থাকবে না। জন্মসূত্রে যে আভিজাত্য পেয়েছেন তাকেতো ধুলায় নামাতে পারেন না।
আপনি কিছু খাবেন?
হ্যাঁ, মণ্ডা-মিঠাই আর বেদানার রস।
জাফরানি শরবত?
এখন না।
শামী কাবাব? আপনি খুব পছন্দ করেন।
এটাও এখন না। পরে। আমি বলবো তোমাকে।
আপনি এখন কি করবেন?
দাবা খেলবো।
একা?
বন্ধুরা কেউ না এলে একাই তো।
আচ্ছা।
বেরিয়ে যায় কুফরি চাঁদ। আবার কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে খাবার ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে। সবকিছু সাজিয়ে দিয়ে বলে, আর কিছু মির্জা নওশা?
কুফরি চাঁদ তুমি শাদী করেছো?
দশ বছর হলো করেছি।
বালবাচ্চা আছে?
দু’টা বেটি আর একটা বেটা আছে।
বহুৎ আচ্ছা। শুনে খুশি হলাম।
পকেট থেকে একমুঠো টাকা বের করে কুফরিকে দিয়ে বললেন, আমার খুশির দিনে তোমাকে বকশিশ কুফরি চাঁদ। তোমার বালবাচ্চাকে জামা-কাপড় কিনে দেবে।
খুশিতে লাল হয়ে যায় কুফরি চাঁদের মুখ। টাকা নিতে নিতে বলে, শুকরিয়া মির্জা নওশা।
কুফরি চাঁদ চলে যাবার পরও গালিব পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। পকেট বোঝাই টাকা। সকালে শ্বশুর তাঁকে দিয়েছে। অবশ্য সবই তার প্রাপ্য টাকা। তিনি ভাতা হিসেবে পান।
তিনি জানালার পাশে এসে দাঁড়ালেন। খুব মন খারাপ হয়ে গেলো। দেখা যাচ্ছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, হেঁটে যাওয়া মানুষের সারি, ছোটখাটো দোকানপাট। মনে পড়লো আগ্রায় অনুষ্ঠিত বিয়ের দিনের কথা। কিশোর বয়সে বিয়ে হয়েছিল। তেমন কিছু বোঝার বয়স ছিল না তখন। সেটা ছিল বিয়ের দলিল মাত্র। সামাজিক স্বীকৃতি।
আজ তাঁকে বিবাহিত জীবনের ছাড়পত্র দেয়া হচ্ছে। তাঁর আর উমরাওর জন্য একটি বিছানা সাজানো হয়েছে। যখন খুশি তখন দু’জনে ওই বিছানায় ঘুমুতে পারবেন। এবং অন্য আরও অনেক কিছু করার অনুমতি আছে। যা মন চায়, তা।
তারপরও বুকটা কেমন ধুকপুক করে। আনন্দ খুঁজে পাচ্ছেন না।
মনে হচ্ছে উমরাও তাঁর জীবনের বেড়ি। রেশমি সুতোর বাঁধন নয়, একদম লোহার তৈরি বেড়ি। তারপরও আজ তার একটি আনন্দের দিন।
আম্মার কথা মনে হয়। ভাই ইউসুফ এবং বোন ছোটি বেগমের কথাও মনে হচ্ছে। মনে পড়ে আগ্রার অন্যতম অভিজাত ধনী নানাজান খাজা গোলাম হুসেন খাঁকে। ওহ্! কি তাঁর শান-শওকত! আম্মাজান সেই কালেমহলে থাকেন। এতোকিছু ভাবনার পরও তার মন খারাপ কাটে না। মন ভার হয়ে থাকে। দিল্লিতে আসার পরে সমাজে নিজের অবস্থান আরও বেশি করে বুঝতে পারছেন। বুঝতে পারছেন যে আত্মীয়স্বজনের বিত্তবৈভব যতোই থাকুক না কেন, তা দিয়ে অভাব থাকে না, কিন্তু মর্যাদা নেই। আনন্দও মেলে না। স্বস্তিতো নয়ই। যে ছেলে অকালে বাবা আর চাচাকে হারায় তাঁর জীবনের খুঁটিতে জোর থাকে না।
গালিব জানালার শিকে মাথা রাখলেন। চোখ জলে ভরে উঠলো। পিতা আবদুল্লাহ বেগ খাঁ মারা গেছে তার পাঁচ বছর বয়সে।
চাচা নসরুল্লা খান ভাইয়ের পরিবারের দায়িত্ব নিলেন। ভালোই কাটছিল দিন। কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু দুর্ভাগ্য এমনই যে তিনিও মারা গেলেন।
গালিব জানালার কাছ থেকে সরে এলেন। ঘরে পায়চারি করলেন। দাবার ছকে ঘুঁটি সাজালেন, কিন্তু মন বসাতে পারলেন না। দু’হাতে মাথা চেপে ভাবলেন, যার পারিবারিক শেকড় থাকে না, তার মতো দুর্ভাগা আর কেউ হতে পারে না।
আমি সেই দুর্ভাগাদের একজন। আভিজাত্যের বড়াই আছে, কিন্তু শেকড়ে মাটি নাই, সেটা বড়ই আলগা। শেকড়ে মাটি দিয়ে নিজেকেই ভরতে হবে নিজের জায়গা জমিন।
মির্জা নওশা!
বুক ধড়ফড়িয়ে ওঠে। ঠিক মায়ের কণ্ঠ যেন।
আম্মাজান!
গালিব চারদিকে তাকান। বুঝতে পারেন, তাঁরা তো আগ্রাতে আছেন। আজ এই খানাপিনার রাতে তাদের কোনো দাওয়াত নেই। তাঁর শ্বশুর তাদের নিয়ে আসার ব্যবস্থা করেননি। আর একজনের পুত্রের দায় নিজেই পালন করছেন বলে এই অবহেলা। তাঁর নাকের বাঁশি ফুলে উঠে—অভিমানে এবং ক্ষোভে। খানিকটুকু রাগেও। যে রাগ শেষ পর্যন্ত উমরাওয়ের ওপর গড়ায়।
আম্মাজান আমি ভালো আছি। এ বাড়িতে আজ একটি আনন্দের দিন পালিত হচ্ছে। আমার পায়ের বেড়ি আজকে আরও শক্ত হবে। আম্মাজান আপনি আমার জন্য একটুও ভাববেন না। আমি আপনাকে দেখতে আসবো।
বাইরে টুনটুন শব্দ হয়।
গলায় ঘুণ্টিবাঁধা খচ্চরগুলো পিঠে মালের বোঝা নিয়ে চলে যাচ্ছে। তিনি আবার পকেটে হাত রাখেন। টাকা স্পর্শ করেন। আজ থেকে যে পারিবারিক জীবন তাঁর হতে যাচ্ছে তার জন্য তাঁর কোনো দায় নেই। যে অর্থ তিনি ভাতা পান, তা দিয়ে দিব্যি রাজার হালে চলে যায়। তিনি বিলাসী যুবক, টাকা ওড়াতে ভালোবাসেন। দিল্লি শহরের নানা কিছুর প্রতি আকৃষ্ট হতে শুরু করেছেন। এখানে তাওয়ায়েফ – মুক্ত নারীরা আছে। তিনি তাঁদের কাছে যেতে পারেন। যাবেনও। দুই-একজনের বৈঠকখানায় সময় কাটিয়ে এসেছেনও।
চাচা নসরুল্লাহ খায়ের মৃত্যুর পরে পারিবারিক জায়গীর ব্রিটিশ সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল। বরাদ্দ করেছিল পেনসন। তখন তিনি অনাথ বালক। তার ভাগে বরাদ্দ পড়েছিল বছরে সাতশ টাকা। সে সময়ে তাঁর অভিভাবক হয়েছিলেন নানাজান। ঝিরকা ও লোহারুর নওয়াব আহমদ বখশ খান গালিবের বরাদ্দের চেয়েও বেশি অনুদান তাঁকে দেন। দিল্লিতে বাস করেন গালিবের ফুপু। তিনি তাঁকে অর্থ দেন। আগ্রায় মা যে পিতার সম্পত্তি লাভ করেছেন সেখান থেকেও টাকা আসে। আলোয়ারের মহারাজা তাঁকে একটি গ্রাম দান করেছিলেন। সেই তালরা নামের গ্রাম থেকেও ভালই আয় হয়।
এইসব হিসেব করে বুঝে নিলেন পরিবার টানতে তাঁর কোনো অসুবিধা হবে না। স্বাধীনভাবে নিজের ইচ্ছেমতো জীবন কাটিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন। সুতরাং কবিতা ছাড়া তাঁর আর কিছু চাইবার নাই।
বিকালেই নতুন পোশাকে সেজেগুজে মেহমানদের অপেক্ষা করতে লাগলেন। একে একে বিভিন্নজন আসতে শুরু করেছে। প্রত্যেকেরই মুগ্ধ দৃষ্টি পড়ে তাঁর ওপর। তিনি বিনম্র ভঙ্গিতে সালাম দেন।
সাবাশ! বহুৎ খুবসুরত। মাশাল্লাহ।
অনেকের মুগ্ধ উচ্চারণ তাঁর দু’কান ভরে বাজে।
সন্ধ্যার পরপরই খানাপিনা করে চলে যায় সবাই। বেশকিছু স্বর্ণ মুদ্ৰা উপহার পান তিনি।
রাতে উমরাওয়ের ঘরে তাঁকে নিতে আসে বাড়ির কয়েকজন দাসী। ওদের পরিচিত মুখগুলো আজ ভীষণ রহস্যময়। মিটিমিটি হাসিতে ওরা অন্যরকম, অচেনা। যেন ওদের সঙ্গে এটি মির্জা নওশার নতুন দেখা।
একজন হাসিমুখ উঁচু করে বলে, তবিয়ত আচ্ছা তো?
জরুর। বহুত আচ্ছা।
খিলখিল হাসিতে ভেঙে পড়ে ওরা। একজন উমরাওয়ের ঘরের দরজা খুলে দেয়। বাতাসে দুলে ওঠে পর্দা। এই পর্দাগুলো কেনার আগে উমরাওয়ের কাছে আনা হয়েছিল পছন্দের জন্য। গালিব মনে মনে প্রশংসা করে বলেন,
সুন্দর পছন্দ করেছে।
খাটের ওপর বসে আছেন উমরাও। জড়োয়া গয়না আর রেশমি ঘাঘরার জৌলুসে ফুটে আছে ও। বিয়ের সময় গালিবের বয়স ছিল তেরো। উমরাওয়ের এগারো। এখন দুজনে যৌবনপ্রাপ্ত। উমরাওয়ের হাসিতে বিদ্যুৎছটা, যেন আলোর রশ্মির ঝিলিক তুলে পেরিয়ে যাবেন যে কটা বছর বাঁচবেন তার সবকটা দিন।
গালিব খাটের কাছে এগিয়ে আসতেই উমরাও বলেন, বারান্দায় পানি রাখা আছে, আমাদেরকে ওজু করতে হবে।
ওজু? কেন? আমি দুপুরে গোসল করেছি। একদম পবিত্র আছি।
কণ্ঠস্বরে বিরক্তি ঝরে পড়ে।
উমরাও ভুরু কুঁচকে বলেন, ওজু তো করতেই হবে। নফল নামাজ পড়তে হবে। আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করতে হবে। নেকবন্দ বান্দাই আল্লাহ পাকের অসীম দয়া লাভ করে।
গালিব কথা বললেন না। ঘরের আর একপাশে গিয়ে ঘুমুনোর পোশাক পরতে লাগলেন। তার আগে বিরক্তির সঙ্গে ঝলমলে পোশাক খুলে মেঝেতে ছুঁড়ে ফেলেছেন।
উমরাওয়ের কাছে এসে বললেন, আমি কিছু স্বর্ণ মুদ্রা উপহার পেয়েছি। সেগুলো তোমাকে দিতে চাই।
আপনি পোশাকগুলো ওইভাবে ফেললেন যে?
আমার ইচ্ছা।
পোশাকগুলো আমার আব্বাজান কিনেছেন।
তুমি গুছিয়ে রাখো।
আমি কি আপনার দাসী?
তাহলে বাড়ির দাসীদের ডাকো।
এখন এই ঘরে ওদের আসার হুকুম নাই।
তাহলে কাল সকালে করবে।
দাসীরা কালকে যখন দেখবে যে পোশাকগুলো মেঝেতে পড়ে আছে ওরা এই কথা সবাইকে বলে দেবে।
বলে দিলে দেবে। ওদের যা খুশি তা ওরা করবে। আমার কি বলার আছে?
আব্বাজান এই কথা শুনলে দুঃখ পাবেন।
গালিব গলার স্বর উঁচু করে বলেন, তাহলে তুমি গুছিয়ে ফেলো।
হায় আল্লাহ, আমার এমন বদনসীব।
উমরাও বেগম কাপড়গুলো গোছাতে শুরু করেন। গালিব দূরে দাঁড়িয়ে তার কান্নার ফোঁস ফোঁস শব্দ শুনতে পান। বিরক্তিতে তার মেজাজ খচে থাকে। দুপদাপ করে উমরাওয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলেন, আমি তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করেছিলাম বিবি।
স্বর্ণ মুদ্রা?
হ্যাঁ। মুদ্রাগুলো নেবে কিনা জানতে চেয়েছিলাম।
মুদ্রাগুলো আপনি ওইখানে রাখেন। আমি নামাজ পড়ে নেবো।
এখন নিতে অসুবিধা কি? আমি দিতে চেয়েছি।
চাইলেই আমার নিতে হবে নাকি?
হ্যাঁ হবে। এটা আমার হুকুম।
আমি দাসী না যে হুকুম পালন করবো।
উমরাও গালিবের মুখোমুখি দাঁড়ান।
গালিব স্ত্রীর এই ঔদ্ধত্যে বিস্মিত হন। যতোদিন তাঁরা দু’জনে আলাদা থাকতেন পরিবারের মুরুব্বিদের হুকুমে, ততোদিন তাঁর এক ধরনের অবাধ স্বাধীনতা ছিল। স্ত্রীর সঙ্গে এমন মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ না থাকায় বিতণ্ডাও হয়নি। এখন বুঝতে পারছেন জীবনযাত্রা অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। আজকে যখন শরীর নিয়ে উৎসব পালনের কথা, তখনই সংঘাতের সূত্রপাতের শুরু। উমরাও গলার স্বর আর এক ডিগ্রি উঁচু করে বললেন, আমি আগে নামাজ পড়বো। আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করবো।
তাহলে তুমি নামাজ পড়। আমার ঘুম পাচ্ছে।
ঘুম! উমরাও তীব্র দৃষ্টিতে তাকান।
তুমি তো জানো বিবি আমি ঘুমাতে ভালোবাসি।
আপনাকে আমি এতো বছর নামাজ পড়তে দেখিনি। ভেবেছি আমরা যখন সংসার করতে শুরু করবো তখন থেকে আপনি নামাজ পড়বেন।
তাহলে আমি আমার ঘরে চলে যাই?
উমরাও দু’হাত দিয়ে গালিবকে বাধা দিয়ে বলেন, আপনি নিজের ঘরে গেলে আমার আব্বা দুঃখ পাবেন।
আচ্ছা ঠিক আছে। আমি আজ রাতে এখানে থাকবো। কিন্তু প্রতিদিন না। যখন খুশি হবে তখন
হায় আল্লাহ আমার এমন বদনসীব।
গালিব বিছানার ওপর থেকে মখমলের চাদরটা টান মেরে উঠিয়ে মেঝেতে ছুঁড়ে দেন। তারপর বিছানায় ওঠেন। বালিশ টেনে শুতে শুতে বলেন, নামাজ পড়ে তাড়াতাড়ি আসো। নইলে তোমার আব্বাজান আবার দুঃখ পাবেন।
উমরাও বিস্ময়ে-বিমূঢ় হয়ে চেঁচিয়ে বলেন, কি বললেন?
গালিব কথা বলেন না। কোলবালিশ টেনে নিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে স্ত্রীকে পৃষ্ঠদেশ দেখান। উমরাও এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে থেকে নিজের পোশাক বদলিয়ে নামাজ পড়তে যান। গালিবের চোখে ঘুম নামার আগে তিনি ভাবলেন, এমন ধর্মপরায়ণ বিবি নিয়ে তিনি কতটা এগোতে পারবেন? এতো রক্ষণশীল মানুষ কি তাঁর স্বাধীনতা সহ্য করবেন? তিনি দ্বিধা নিয়ে চোখ বুজে থাকেন। তাঁর ঘুম আসে না। দিনভর তিনি ভেবেছেন আজ একটি আনন্দের দিন। কিন্তু কীভাবে পুরো বিষয়টির উত্তেজনা থিতিয়ে গেলো, বরং আনন্দের বদলে নিরানন্দে তিনি নিজেকে ডোবালেন। তিক্ত হয়ে গেলো শারীরিক সম্পর্কের সূত্র।
হাঃ শ্বশুরবাড়ি। হাঃ, নতুন আনন্দ।
কতোদিন কাটালেন দিল্লি শহরে! কতো নিষিদ্ধ আনন্দের স্বাদ একটু একটু করে পেতে শুরু করেছেন! উমরাও এর বাইরে এক পবিত্র চিন্তার মধ্যে আছে। যে স্ত্রীকে তাঁর এসবের বাইরে রাখতে হবে তাঁর শরীরের সবটুকু পাওয়া হবে কি!
হাঃ, ইলাহী বখশ খান! তিনি মঅরুফ ছদ্মনামে লেখেন। আর আমার তখলুস আসাদ। দেখা যাবে পাল্লা কার ভারী হয়। মঅরুফ অর্থ প্রসিদ্ধ, আসাদ অর্থ সিংহ।
গালিব ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন উমরাও তখনো জায়নামাজে। দু’হাত তুলে দোয়া মাঙছেন।
গালিব আবার ঘাড় ফেরালেন। ভাবলেন, কবি মারুফ তাঁকে স্নেহের দৃষ্টিতে দেখেন। ছেলের মতো আদর করেন। শ্বশুরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক অনেক উদার। খানিকটা বন্ধুত্বের মতো। তাঁকে নির্দিষ্ট সময়ে ভাতা দিতে কোনো কার্পণ্য করেন না।
মাঝে মাঝে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে বলেন, নাও, খরচ করো। এই বয়সে অর্থ ব্যয় করা শিখতে হয়। এই বয়সে অর্থ ব্যয় করতে না পারলে মন ক্ষুদ্র হয়ে থাকে। ক্ষুদ্র মন নিয়ে বড় গজল লেখা যায় না।
গজল! ওহ গজল! গজলই জীবনের সবচেয়ে বড় সঙ্গী। বিছানার সঙ্গী গজলের জায়গা কখনো নিতে পারে না। বিছানার সঙ্গী গজলের মতো মায়াবী হতে পারে না। বরং শরাব আর তাওয়ায়েফদের রঙিন নেশার মধ্যেই গজলের পক্তি খোলে বেশি। এর মধ্যে দু’একজন তাওয়ায়েফের সঙ্গে তো তার দেখা হয়ে গেছে। ওদের হাত ধরে ঘুঙুরের ঝঙ্কার শোনা হয়ে গেছে। উমরাও আর কিইবা দিতে পারবে তাকে।
তাওয়ায়েফের ভাবনার মাঝে তাঁর চোখ বুজে আসে। তন্দ্রার আচ্ছন্নভাব কেবল লাগতে শুরু করেছে তখন অনুভব করলেন পিঠে উমরাওয়ের হাত।
ঘুমিয়েছেন?
তিনি সাড়া দেন না। ভাবেন, উমরাও আর একটু এগিয়ে আসুক। ঘুমিয়েছেন?
তিনি পাশ ফেরেন।
উমরাও মৃদু হেসে বলেন, নামাজ পড়ে আমার মন অনেক শান্ত হয়েছে।
খোদাতালার কাছে কি দোয়া চাইলে?
যেন শান্তির সংসার পাই। যেন সৎ ভালো মানুষ স্বামী পাই। স্বামী যেন নেকবান হন।
এটুকু বলে উমরাও থামলে তিনি তার হাত মুঠিতে ধরে বললেন, আর কিছু চাওনি? বালবাচ্চা চাওনি?
চেয়েছি।
বেটা না বেটি?
বেটাও চেয়েছি, বেটিও চেয়েছি।
কয়জন চেয়েছো?
দশজন।
দশজন? গালিব উঠে বসেন।
উমরাও মৃদু হেসে বলেন, আপনি কয়জন চাইতেন?
আমি, আমি সাতজন চাইতাম।
আমিও এখন থেকে সাতজন চাইব। আল্লাহ যেন আমাদের দুজনের ইচ্ছা পূরণ করেন।
গালিব মৃদু হেসে তাঁকে বুকে টানেন।
এভাবেই শারীরিক সম্পর্কের সূচনা, প্রেম থেকে নয়—প্রয়োজন থেকে। প্রয়োজন যৌনজীবন এবং বংশরক্ষার। সংসার গড়ে তোলার আদিম এবং অকৃত্রিম বাসনা থেকে। তারপরও দুজনে দুই জমিনের বাসিন্দা রয়ে গেলেন। যেটুকু কাছে আসা দরকার সেটুকুই কেবল।
ভোর হলো। ঘুম ভাঙলে গালিব দেখলেন উমরাও তাঁর দিকে পিঠ ফিরিয়ে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে আছেন। হাঁটু মোড়ানো, বুকের কাছে জড়ো করা। হাত দু’টো হাঁটুর সঙ্গে লাগানো। তিনিও উমরাওয়ের দিকে পিঠ ফিরিয়ে শুয়ে ছিলেন। দুজনের পিঠ দুজনের সঙ্গে লেগেছিল। তিনি উমরাওয়ের ঘুম না ভাঙিয়ে উঠে পড়লেন। বেশ ভালো ঘুম হয়েছে। শরীর ঝরঝরে লাগছে। ঘরের মেঝেতে দাঁড়িয়ে স্ত্রীকে দেখলেন। দিল্লি শহরে আসার পরে স্ত্রীকে ভেবেছিলেন পায়ের বেড়ি, আজকের রাতের পরেও সে ধারনা তাঁর ভাঙলো না। তিনি বুকের ভেতরে এই চাপা অনুভব নিয়ে দরজা খুললেন। দিনের স্নিগ্ধ বাতাস গায়ে মাখলেন। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অপরূপ ভোর দেখলেন। কিন্তু বুকের ভেতর থেকে কারাগার এবং পায়ের বেড়ি শব্দগুলো উড়িয়ে দিতে পারলেন না। দেখলেন সেগুলো স্থায়ী হয়ে আছে। তিনি স্ত্রীর ঘরের দরজা টেনে দিয়ে বহির্মহলে নিজের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। পেছনে ফিরে একবার তাকালেন।
আজ থেকে অন্দরমহলে যাতায়াত অবাধ হয়ে গেলো। তবে শ্বশুরবাড়িতে আর নয়। নিজের বাড়ি করতে হবে। একটি ভাড়া বাড়ি খুঁজে দেখা দরকার। শুনলেন বাতাসে ভাসছে শের :
‘রও মে হ্যায় রখশ—এ উমর কঁহা দেখিয়ে থমে
ন হাথ বাগ পর হ্যায়, ন পাও হ্যায় রকা সে।
ছুটে চলেছে জীবনের ঘোড়া, কে জানে কোথায় থামবে
না আছে হাতে লাগাম, না পা আছে রেকাবে।’
.
সাত দিনের মাথায় আগ্রা থেকে ছেলেবেলার বন্ধু কানহাইয়ালাল এলো বেড়াতে। বন্ধুকে জড়িয়ে ধরে গালিব উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন।
কেমন আছো বন্ধু?
ভালো খুব ভালো। যমুনা নদীর স্রোতের মতো ভালো আছি।
ছোটবেলায় আমরা এভাবেই কথা বলতাম।
তোমাকে জিজ্ঞেস করলে তুমি বলতে—
থাম, থাম আমি বলি। গালিব হাসতে হাসতে বলেন, আমি বলতাম ঘুড়ি ওড়ানোর মতো ভালো আছি। আর বংশীধর বলতো, আমি দাবা খেলার মতো ভালো আছি।
দু’বন্ধু হাসিতে ঘর ভরিয়ে ফেলে।
আমাদের স্মৃতিগুলো এখনও ভীষণ তাজা।
আমাদের স্মৃতিগুলো খুব সুন্দর।
এসো আমরা দাবা খেলি। গালিব দাবার ঘুঁটি সাজান।
কানহাইয়ালাল দাবার বোর্ডের অপর পাশে বসে। বলে, দাবা খেলা আমাদের নেশার মতো ছিল।
আমাদের মধ্যে পাকা ওস্তাদ ছিল বংশী।
ও এখনো রোজ দাবা খেলে। মাঝে মাঝে খেলায় বসলে ওর রাতও চলে যায়।
কানহাইয়ালাল দাবার ঘুঁটি জড়ো করে রাখে বোর্ডের ওপর।
খেলবে না?
না। আমরা গল্প করবো।
তখন বাড়ির ভেতর থেকে খাবার আসে দুজনের জন্য। নানারকম খাবার। কানহাইয়ালাল হাসতে হাসতে বলে, বাব্বা এতো খাবার! তুমি কি রোজ খাও বন্ধু?
খাই তো। গোশত না খেলে আমার হয় না। গোশতো আমার রোজ চাই। সেজন্য এমন টগবগে সুন্দর চেহারা হয়েছে। তোমার দিকে তাকালে চোখ ফিরতে চায় না। তোমার বিবি কি বলে?
ও আর বলবে কি। ও তো আমার পায়ের বেড়ি। সেজন্য এই শহর আমার কারাগার।
কিন্তু আমি তো দেখেছি তুমি অনেক স্বাধীনতা ভোগ করো। যতোবার দিল্লি এসেছি ততোবারই দেখেছি তোমার স্বাধীনতার শেষ নাই।
স্বাধীনতা! পায়ে বেড়ি থাকলে স্বাধীনতা থাকে না।
থাক, এসব কথা। এসো খাওয়া-দাওয়া করি আর ছোটবেলার কথা বলি।
দু’জনে রুটি-মাংস খায়। নানারকম হালুয়া খায়। ফল খায়। শরবত খায়। মনের সুখে খেয়েদেয়ে কানহাইয়ালাল রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বলে, অনেকদিন পরে পেটপুরে ভালো ভালো খাবার খেলাম। তুমি খুব সুখে আছ বন্ধু।
বেশিদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকবো না।
কেন?
এখন নিজের সংসার আলাদা করতে হবে তো। বিবি বলেছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ভাড়া করতে।
বাড়ি ভাড়া করলে খাওয়া-দাওয়ার কমতি হওয়ার তো কথা নয়। তখন তোমার বিবি রাঁধবে।
হ্যাঁ, রাঁধবে তো। বাল-বাচ্চা হবে। সংসার ভরে উঠবে। বলেই হাসেন গালিব। সঙ্গে কানহাইয়াও হাসে। হাসতে হাসতে বলে, তোমার কবিতা তো থাকবে সংসারে? নাকি কবিতা লেখা ছেড়ে দেবে?
কবিতাই আমার সঙ্গী। যেখানেই যাই কবিতা আমার সঙ্গে থাকবে। অন্য যা কিছুই হারাই না কেন, কবিতা কখনো হারাবো না বন্ধু।
মনে আছে ঘুড়ি ওড়ানো নিয়ে তুমি আট-নয় বছর বয়সেই কবিতা লিখেছিলে।
ঘুড়িগুলো আকাশে এলোমেলোভাবে ওড়ে। ঘুড়ির কোনো ঠিকানা থাকে না। তা নাহলে যাদের হাতে নাটাই থাকে তাদের ইচ্ছামাফিক ঘুড়িগুলো ঘুরপাক খায়। যেন নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে ওড়াউড়ি। সুতোর টান যার হাতে তার হাতেই ধরা থাকে ঘুড়ির পায়ের বেড়ি। ঘুড়ি উড়ানো বেশ মজার খেলা ছিল কানহাইয়া।
তোমার কাছে তা শুধু খেলা ছিল না, ছিল কবিতাও। মনে আছে তোমার সেই মসনবীর দুটি পঙ্ক্তি?
কোনটা বলো তো, ভুলে গেছি।
ঘুড়ি ওড়া দেখে তুমি লিখেছিলে :
‘আমার বন্ধু আমার গলায় একটা সুতো বেঁধে দিয়েছে
তার ইচ্ছে মতো নিয়ে যায় যেখানে খুশি।’
হ্যাঁ, হ্যাঁ মনে পড়েছে। আমি তো ওই মসনবীর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আহ বন্ধু তুমি আমাকে গভীর আনন্দ দিলে, হারানো জিনিস ফিরে পাওয়ার আনন্দ। মনে হচ্ছে আমি যেন সাত রাজার ধন মানিক পেয়েছি।
এই দেখো তোমার উর্দু কবিতাটি আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি।
কানহাইয়া কবিতাটি পকেট থেকে বের করে গালিবকে দেয়। পুরনো কাগজটি দু’হাতে ধরে গালিব চুমু দেয়। এরপর নিজের লেখার খাতার ভেতরে ঢুকিয়ে রাখে।
এবারে আমার দিল্লি আসা সার্থক হয়েছে মির্জা নওশা। তোমার এমন পূর্ণ খুশি মুখ আমি আগে দেখিনি।
গালিব বন্ধুকে জড়িয়ে ধরেন। তার গভীর আন্তরিক স্পর্শ কানহাইয়াকে অভিভূত করে। তিনি বুঝতে পারেন কবিতার সঙ্গেই মির্জা নওশার প্রেম বেশি। জীবনের বাকিটুকু কবিতাকে কেন্দ্র করেই ঘুরপাক খায়। ও কি পারবে নিজেকে এভাবে ধরে রাখতে? কানহাইয়া দ্বিধা কাটিয়ে ভাবে, পারবে। পারবে বলেই ওর সময় ওকে ছেড়ে এগিয়ে যাচ্ছে। মনে মনে বলে, বন্ধু তুমি ভালো থাকো।
দু’টো দিন হাওয়ার বেগে উড়ে যায়। অনেক রাত পর্যন্ত দুজনের দাবা খেলা চলে। গালগল্প চলে। একসময় খেলা বন্ধ করে গালিব শের লেখেন। বন্ধুকে পড়ে শোনান। তারপর বন্ধুকে বলেন, আমার বাপদাদার হাতে ছিল তলোয়ার। আমি সেটাকে কলম বানিয়েছি। আমার সামনে যুদ্ধ নাই, রক্তপাত নাই, মৃত্যু নাই। আমার কলমে আছে প্রেম। প্রেম দিয়ে জয় করবো দুনিয়া।
আগ্রা ফেরার পথে কানহাইয়ার মনে হলো ছোটবেলার বন্ধু মির্জা নওশাকে এবার অন্যরূপে দেখা হলো। ও আর আগের মির্জা নাই। ও এখন সামনেই এগিয়ে যাবে। আর পেছন ফিরে তাকাবে না।
বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় গালিব ওকে বলেছেন, আগ্রায় গিয়ে আম্মাজানকে বলো আমি শিঘ্রি তাঁকে দেখতে আসবো। আম্মা যেন আমার জন্য দোয়া করেন।
.
কানহাইয়া কালেমহলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে শুনতে পায় কান্নার শব্দ। সে চমকে ওঠে। যে মাকে ছেলের খবর দেয়ার জন্য এসেছে সে খবর কি দেয়া হবে না? মা কি তার ছেলের জন্য আর অপেক্ষা করে নেই?
ভেতরে ঢুকে আত্মীয়-পরিজনের ভিড় দেখে বুঝল, তার আশঙ্কা সত্যি। মির্জা নওশা মাকে হারিয়েছেন। কানহাইয়াকে দেখে বাড়ির একজন পরিচারক এগিয়ে এলো।
আপনি না দিল্লি গিয়েছিলেন? কবে এলেন?
আজকে। এক্ষুণি। মির্জা নওশার খবর দিতে এসেছিলাম তাঁর আম্মাজানকে।
তিনি আজ ফজরের আজানের সময় ইন্তেকাল করেছেন। আছরের সময় জানাজা হবে।
কানহাইয়ালাল নিজের সঙ্গেই বলে, আজ থেকে আগ্রা তোমার জন্য অন্ধকার হয়ে গেলো বন্ধু। তুমি আর ঠিকমতো যমুনা নদী দেখতে পাবে না।
ঘুড়ি ওড়ানোর শৈশবটি কি মনে রাখতে পারবে?
কানাহাইয়ালাল দু’হাতে চোখ মুছতে মুছতে বাড়ি ফেরে। অনেক রাতে গালিবকে চিঠি লিখতে বসে।
.
একদিন নওয়াব আহমদ বখ্শ খাঁ নিজেই বললেন, ছেলেটি তো বেশ লিখছে। শেরগুলো চমৎকার। বাদশাহর দরবারে ওর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। দু’একবার মুশায়রায় বসতে পারলে জ্ঞানী-গুণীজনের চোখে পড়বে। বাদশাহর নজরেও পড়বে।
ইলাহি বখশ খান গালিবের প্রশংসা শুনে খুশি হন। তিনি জানেন আহমদ বখশ পারবে গালিবের একটা ব্যবস্থা করতে। দরবারে আহমদের ভালো প্রভাব আছে। নওয়াব আহমদের আশ্বাসে গালিব তো ভীষণ খুশি। নিজে নিজে ঠিক করলেন ভালো করে ফারসি ভাষা শিখবেন। আগ্রায় তার ওস্তাদ ছিলেন আবদুস সামাদ। তিনি তাঁকে ভাষাটা শিখিয়েছিলেন। খোদ পারস্য থেকে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু কবিতা লেখার মতো ভাষাজ্ঞান হয়নি তাঁর। আরও ভালো করে শিখতে হবে।
গালিবের এমন ইচ্ছার কথা শুনে ইলাহি বখশ সঙ্গে সঙ্গে সায় দিয়ে বললেন, তুমি ঠিকই চিন্তা করেছো।
আব্বাজান আমার মাতৃভাষা তো তুর্কি, সেজন্য ফারসি ভালো করে শেখা দরকার।
হ্যাঁ, তা ঠিক। তাছাড়া ইসলামি দুনিয়ার সাহিত্যের ভাষা ফারসি। ইসলামি দুনিয়ার জ্ঞানীগুণীর সামনে তোমার গজল পৌঁছাতে হলে ফারসিতে লিখতে হবে। হিন্দুস্থানের সরকারি ভাষাও ফারসি। সেজন্যও ভাষাটা ভালো করে শেখা দরকার।
ঠিক বলেছেন আব্বাজান।
আমি তোমার জন্য একজন শিক্ষক ঠিক করে দেবো। দেখবো তিনি যেন তোমাকে দর্শন, চিকিৎসা, তর্কশাস্ত্র ইত্যাদিও শেখান।
গালিব শ্বশুরের সামনে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেও মনে মনে বলেন, আমি কবিতার জন্য ফারসি শিখতে চাই। কবিতাই আমার শেষ কথা।
.
কয়েকদিনের মধ্যে মুহম্মদ মুয়াজুম তাঁর শিক্ষক নিযুক্ত হলেন। শুরু হলো নতুন জীবন। মনপ্রাণ দিয়ে শেখার চেষ্টা করেন। ফারসি ভাষার কবি শওকত বুখারি, অসীর ও বেদিল তার প্রিয় কবি হয়ে গেলেন। বিশেষ করে বেদিল হলেন সবার মধ্যে বেশি পছন্দনীয়। তিনি নিজে নিজে তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন। ফারসি কবিতার জন্য অনুসরণ করলেন বেদিলকে। তাঁর আসল নাম অনুযায়ী কবিতার তখল্লুস হলো আসাদ। ফারসি কবিতার শব্দ ও শৈলী উর্দু কবিতায় ব্যবহার করার ফলে বেশ ভিন্ন প্রয়োগ ঘটলো। তিনি দেখলেন তাঁর কবিতার ভক্ত যেমন তৈরি হলো, তেমনি নিন্দুকও। তাঁর মজাই লাগলো। দিল্লির জ্ঞানীগুণীর দৃষ্টিতে তাঁর কবিতা পড়েছে, এটাই ঘটনা। ফারসি শেখার পাশাপাশি কবিতার এই নতুন যাত্রায় তাঁর দিন বাতাসের বেগে ধেয়ে চলে।
কিন্তু গোল বাধে অন্দরমহলে।
স্বামী ঠিকমতো তাঁর ঘরে আসেন না! মাঝে মাঝে রাতগুলো বহির্মহলে নিজের ঘরে কাটিয়ে দেন। গালিব হাত-পা নেড়ে বোঝানোর ভঙ্গিতে বলেন, বিবি আমার এখন অনেক কাজ।
কাজ? উমরাও চোখ কপালে তোলেন। অভিজাত পরিবারের আবার কাজ কি? তাঁদের চাকর-নফররা কাজের জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকবে
গালিব গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, কবিতাও লিখে দেবেন?
কবিতা? উমরাও চোখ গরম করেন। অভিজাতরাও কবিতা লেখেন। চাকর-নকররা কবিতা লেখে শুনলে আব্বাজান কষ্ট পাবেন। আব্বাজানও কবি।
গালিব হাসলেন। উমরাও বিরক্তির স্বরে বলেন, সংসারে আপনার মন নাই।
মন থাকবে না কেন? মন অবশ্যই আছে।
আপনি বেহিসাবে টাকা খরচ করেন।
টাকা খরচ করতে আমি ভালোবাসি। দরকার হলে আমি ঋণ করে ঘি খাবো।
আমাদের সংসারে মেহমান আসছে। সন্তানের জন্য খরচ আছে।
উমরাও লাজুক ভঙ্গিতে বলেন।
গালিব দু’হাতে উমরাওয়ের হাত ধরে বলেন, ওর জন্য ভাবতে হবে না। সন্তানের খরচ আমি ঠিকই রাখবো।
সন্তানের খবরে আপনি খুশি তো?
খুশি, খুশি। ভীষণ খুশি।
কিন্তু আপনি ওর দিকে ঠিকমতো নজর দিচ্ছেন না।
তোমার কি খেতে ইচ্ছা করছে বলো আমাকে।
উমরাও অন্যদিকে মুখ ঘোরান। তাঁর আর কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। মানুষটি গত তিন দিন তাঁর কাছে আসেননি। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নিজের ফারসি শিক্ষা, নিজের কবিতা। ইদানীং শুনতে পান তিনি তাওয়াফদের ঘরে যাতায়াত করেন। সত্যি-মিথ্যা আল্লাহ মালুম। মিথ্যা হলে উড়া উড়া খবর তার কাছে আসবেইবা কেন?
কি হলো এমন চুপ হয়ে গেলে যে?
আমার আলাদা করে কিছু খেতে ইচ্ছা করছে না। আমি তো সবই খাচ্ছি। যখন যা চাই আম্মাজান নিয়ে আসেন।
আচ্ছা, ঠিক আছে আমি তোমার জন্য আম নিয়ে আসবো।
না, না, লাগবে না।
তুমি আঁতকে উঠলে কেন?
উমরাও নিম্নকণ্ঠে বলেন, আমি আম খেতে ভালোবাসি না।
আজ রাতে আমি তোমার সঙ্গে থাকবো।
আমার শরীর ভালো লাগছে না। আম্মাজান একজন দাসীকে আমার ঘরে ঘুমাতে বলেছেন।
ওহ, আচ্ছা।
গালিব আর কথা না বলে বেরিয়ে আসেন। বুঝতে পারেন উমরাওয়ের মনের সুতো কোথাও কেটে গেছে। ওটা এখন গোত্তা খাওয়া ঘুড়ির মতো কোথাও মুখ থুবড়ে পড়বে।
কয়েকদিন পরে বন্ধু হুসাম-উদ-দৌলা খুশিতে উচ্ছ্বসিত হয়ে গালিবের বাড়িতে এলেন। তিনি নিজেও কবি। গালিবের কবিতার ভক্ত। তার কবিতার নতুন কাব্যরীতি হুসামকে মুগ্ধ করে। তিনি গালিবের কবিতা সে সময়ের একজন শ্রেষ্ঠ গজল রচয়িতা মীর তকী মীরকে দেখাতে লক্ষ্ণৌতে নিয়ে যান। তিনি কবিতা পড়ে উচ্ছ্বসিত হন। বলেন, এই ছেলের একজন ওস্তাদ মিললে ও অসাধারণ কবি হবে। নাহলে ও হয়তো পথ হারিয়ে ফেলতে পারে।
ওহ, মীর তকী মীর! আমার প্রিয় কবি।
গালিব হুসামকে জড়িয়ে ধরেন।
আমি খুব খুশি বন্ধু, তুমি আমার কবিতা মীর তকী মীরকে দেখাতে নিয়ে গেছো। আমি তার মূল্যবান মত পেয়ে আস্থা পাচ্ছি। এখন অনায়াসে বলতে পারবো :
হৈঁ অওর-ভী দুনিয়া-মেঁ সুখনবর বহুঃ অচ্ছে।
কহতে হৈ কেহ গালিব-কা অন্দাজ-এ বঁয়া অওরা
‘দুনিয়াতে খুব ভালো কবি আরও আছেন
লোকে বলে গালিবের বলার ভঙ্গিই আলাদা ॥’
হা হা হাসিতে উচ্ছ্বাস ছড়ান তিনি।
মীর তকী বলেছেন ওস্তাদ পেলে তুমি সিধে রাস্তায় থাকবে।
যে কবির এতো ভালো বন্ধুরা আছে তাঁর ওস্তাদ লাগে না। আমি পারবো বন্ধু।
তাহলে চলো তাওয়াফদের বৈঠকখানায় জমিয়ে আড্ডা দেবো।
তুমি শরবত আর ফল খাও। আমি পোশাক বদলে আসছি।
তুমি তো বন্ধু পোশাক-বাহাদুর হয়েছো।
আমি তো সবার থেকে আলাদা হতে চাই। অন্যরা যে পোশাক পরে আমি তা পরবো কেন? শহরের সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে বন্ধু। বলবে, হ্যাঁ গালিবই পারে নিজেকে অন্যদের চেয়ে অন্যরকম রাখতে।
হুসাম মৃদু হেসে শরবতের গ্লাস মুখে তোলে।
গালিব অন্য ঘরে যান।
তাঁর নিজস্ব ধারার কলাহ টুপি, পায়জামা ও মিহি সুতার কুর্তা পরেন। গায়ে সুগন্ধী মাখেন। ভাবেন তাওয়াফদের তন্বী শরীর আর টানা চোখের অপার বিস্ময় বিমুগ্ধতা তাকে ঘিরে উপচে পড়ে। তিনি আলোড়িত। সেই সঙ্গে শরাব তাঁর তৃষ্ণা মেটায়। জীবনের মাধুর্য তো তিনি বুঝতে শিখে গেছেন। তবে কেন উপভোগ করবেন না। নিজের শের বলতে থাকেন গুনগুনিয়ে :
‘তুমি যেন আমার কাছেই থাকো
যখন আর কেউ থাকে না ॥’
এই তো বছর কয়েক আগে যখন তিনি একা একা পথে হাঁটতেন, যখন পালকির ব্যবহার তেমন বাধ্যতামূলক ছিল না, তখন একজন মুরশিদ তাকে বলেছিলেন, শোনো, সবকিছু নিষেধের পক্ষে আমি না। বিধিনিষেধ জীবনের অনেক আনন্দ নষ্ট করে। শোনো মিয়া, বুঁদ হয়ে যেতে আমি বারণ করি না। বারণ করা উচিত বলে মনে করি না। নেশা করো, ইচ্ছামতো পান করো, খাও, মজা করো—আনন্দে ডুবে যাও। মনে রেখো আনন্দ করার কৌশল শিখতে হবে। ভুল করা চলবে না। মনে রেখো বুদ্ধিমান মাছি মধুতে বসে না। কারণ মধু তাকে ডুবিয়ে দিতে পারে। আটকে গেলে ওড়ার সাধ্য থাকে না। বুদ্ধিমান মাছি বসে মিছরিতে।
আহ্, কি গভীর উপদেশ। আমি তো তার উপদেশ মতো চলতে শিখেছি। আমি জানি তাওয়াফদের কাছে কতোটুকু যেতে হবে, কতোটুকু হবে না। আমি জানি উমরাও আমার পায়ের বেড়ি–স্বাধীনভাবে হাঁটতে পারি না— পা আটকে যায়। তারপরও ওকে নিয়েই তো আমার সংসার। কিন্তু আমার আনন্দ উদযাপনের কোনো জায়গা বাদ দিয়ে আমার সংসার না।
সেদিন অনেক রাতে বাড়ি ফিরলেন পুরো মাতাল হয়ে। মাতাল হয়ে বাড়ি ফেরা সেদিনই প্রথম।
.
কয়েকদিন পরে সন্তান প্রসব করলেন উমরাও বেগম।
বাড়িতে আনন্দের জোয়ার।
ইলাহি বখশ খুশি হয়ে বললেন, মির্জা নওশা তুমি পিতা হয়েছো। আল্লাহর কাছে শোকর আদায় করো।
আমি তো নামাজ পড়ি না আব্বাজান।
নফল নামাজ পড়ে শোকর আদায় করো। আমি তো জানি তুমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ো না।
গালিব আর কথা না বাড়িয়ে শ্বশুরের সামনে থেকে সরে গেলেন। ঘরে ফিরে ভাবলেন, তিনি একটি শের লিখবেন। কিন্তু সন্তান লাভের আনন্দ প্রকাশের জন্য তাঁর কোনো শের বা মসনবী মাথায় এলো না। তিনি দোয়াত- কলম রেখে দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।
কুফরি চাঁদ রেকাবি ভর্তি মণ্ড-মিঠাই নিয়ে এলো। বললো, হুজুর খান।
খাবো? আমি তো এখনো বাচ্চার মুখ দেখিনি।
বাড়ির দাসীরা কখন আপনাকে বাচ্চার মুখ দেখাবে, কে জানে। দু’চার পাঁচ দিন তো চলেই যাবে।
এতোদিন পর? আজ দেখতে পাবো না?
মনে হয় না। এ বাড়ির নিয়ম তো এমনই। তবে আপনার শ্বশুর আপনাকে ছেলের মতো ভালোবাসেন। তিনি ইচ্ছা করলে আগে দেখাতেও পারেন। আল্লাহ মালুম। বাচ্চার জন্য দোয়া করেন হুজুর।
দোয়া! হ্যাঁ দোয়া তো করছি।
নামাজ পড়েন। মিঠাই খান হুজুর।
কুফরি চাঁদ মিষ্টি বোঝাই রেকাবি রেখে চলে যায়।
গালিব গালে হাত দিয়ে বসে থাকেন। ভাবেন, সংসারে নতুন মানুষ এসেছে। এবার নিজের ঘর গোছাতে হবে। শ্বশুরবাড়িতে আর বেশি দিন থাকা ঠিক নয়। কথাবার্তায় শুনতে পাচ্ছেন তাঁর চাচা-শ্বশুর নওয়াব আহমদ বখশ খান নওয়াবী ছেড়ে দেবেন। তখন হয়তো নওয়াব হবেন তাঁর বড় ছেলে শামস- উদ্-দিন। আমিন-উদ্-দিন ও জিয়া-উদ্-দিন তার বৈমাত্রেয় ভাই। এই দুই ভাইয়ের সঙ্গে শামস-উদ-দিনের সম্পর্ক ভালো না। গালিবের বন্ধুত্ব আমিন ও জিয়ার সঙ্গে। শুধু বন্ধুত্ব বললে কম বলা হবে, প্রবল ঘনিষ্ঠতা দু’ভাইয়ের সঙ্গে বেশি। তারাও তাকে ঘনিষ্ঠ আপনজন মনে করে। নিজেরা যে জ্ঞানের চর্চা করে তার সাথী মনে করে। মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে প্রবল আড্ডা হয়। সে আড্ডা মন ভরিয়ে দেয় গালিবের। নিজেকেই বলেন, কবিতার আড্ডার চেয়ে আর বড় কি আছে তার জীবনে!
মিষ্টি খেতে পারছিলেন না। ভাবলেন সন্তানের মুখ না দেখে মিষ্টি খাবেন না।
মনও খারাপ হয়ে থাকলো। কিছু লিখতে পারলেন না।
বিকালে তাঁর জন্য একটা সুন্দর কুর্তা নিয়ে এলো জিয়া-উদ্-দিন।
হাসিমুখে বললেন, পিতা হওয়ার উপহার। পিতা হওয়ার গৌরব নিয়ে আনন্দ করুন মির্জা নওশা। যান, কুর্তাটা পরে আসুন।
আপনার বোন কোনো উপহার পাবে না?
পাবে, নিশ্চয়ই পাবে। ওর জন্য মোতির মালা এনেছি। আমার স্ত্রী নিজের হাতে মালাটি পরিয়ে দেবে বলে নিয়ে গেছে। আমাদের পরিবারে একজন নতুন শিশু ও এনেছে।
গালিব হাসতে হাসতে অন্য ঘরে গিয়ে নতুন কুর্তা পরে এলেন।
জিয়া-উদ্-দিন উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন, বাহ, খুবসুরত। মির্জা নওশা আপনার সৌন্দর্য ফেটে পড়ছে। আপনি যখন কলাহ টুপি, মিহি নয়নসুখের কুর্তা পরে কোনো মুশায়রায় যান, তখন পালকি থেকে নামার সময় দাঁড়িয়ে থাকা সবাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। কারো দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরতে চায় না। যতোক্ষণ আপনার ওপর ধরে রাখা যায় ততোক্ষণ আপনার ওপরই থাকে।
গালিব মৃদু হেসে চুপ করে থাকেন।
জিয়া আরও বলেন, আল্লাহ আপনাকে শারীরিক সৌন্দর্য দিয়েছে, আবার কবিতার মেধা দিয়েছে। আপনি আল্লাহর কাছ থেকে সব পেয়েছেন। শোকর গোজারি করবেন মির্জা সাহিব।
গালিব এবারও চুপ করে থাকেন।
কুফরি চাঁদ রেকাবিভরা মণ্ডা-মিঠাই নিয়ে আসেন। জিয়া-উদ্-দিন ছোট রেকাবিতে মিষ্টি নিয়ে বলেন, আসুন বাচ্চার জন্য দোয়া করি
এবার আর গালিব মিষ্টি না খেয়ে পারলেন না। বেশ অনেকগুলো মিষ্টি খেয়ে ফেললেন। তারপর আফসোস করে বললেন, এখনো বাচ্চার মুখই দেখিনি।
দেখবেন, দেখবেন। এতো তাড়া কিসের। আমি তো আমার সন্তানকে দেখেছি দিন পনেরো পরে।
হা-হা করে হাসে জিয়া। গালিব হাঁ করে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকেন। জিয়ার হাসির শব্দ তার কানে মধুর ধ্বনি তোলে। জিয়া ফারসি এবং উর্দু ভাষায় লিখছে। উপন্যাস লেখার চিন্তা করছে। কবিতা লিখছে। ও শুধু কবি না, ও অনেককিছু হতে চায়। ইতিহাস, ভূগোল, নৃ-তত্ত্ব, শব্দজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ে জানার জন্য পড়াশোনা করেন। এতো মনোযোগী লোক তার চারপাশে নেই। তিনি নিজেও তো এতো পড়াশোনা করেন না। বই কেনেন না। ধার করে বই আনেন।
কি ভাবছেন মির্জা নওশা?
কিছু না।
সন্তানটি কবে দেখবেন এই চিন্তা মাথায়?
তাও না।
তাহলে কি? আচ্ছা আমি যাই।
জিয়া-উদ্-দিন চলে যাবার পরও গালিব বসে থাকেন। গালিব জানেন, জিয়া তার চাইতে ভালো ফারসি জানেন। গালিব ঠিক করলেন জিয়ার সম্মানে কসীদা লিখবেন। সুন্দর কসীদা, যেন নওয়াব জিয়া-উদ্-দিন ওই কসীদা পড়ে ধন্য হয়ে যায়।
কালির দোয়াত আর কলম খুলে বসলেন। কিন্তু লেখা হলো না। বুঝলেন, মাথা কাজ করছে না।
কয়েকদিন পরে খবরটি তাঁকে দিলেন ইলাহি বখশ খাঁ
ভোররাতে মারা গেছে তোমার সন্তানটি।
মারা গেছে? কি অসুখ করেছিল?
কোনো অসুখ করেনি।
অসুখ করেনি? আর আমার বাচ্চাটি মরে গেলো?
বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান গালিব। কাঁদতে পারেন না, চিৎকার করেন না। ক্রোধও প্রকাশ করতে পারেন না।
এখন আমি অন্দরমহলে যাবো।
ইলাহি বখশ কিছু বলার আগেই তিনি স্ত্রীর ঘরে আসেন। দু’হাতে দরজার খসখস সরান। মেঝেতে রাখা হয়েছে মৃত শিশুকে। পাশে উমরাও জায়নামাজের ওপর উপুড় হয়ে পড়ে কাঁদছেন।
কয়েকজন দাসী নিস্তব্ধ বসে আছে। তাঁকে দেখে উঠে দাঁড়ায়। গালিব মৃত শিশুর পাশে হাঁটু গেঁড়ে বসে মাথায় হাত রাখেন। তাকিয়ে থাকেন ওর মুখের দিকে। বোঁজা চোখ, মাথাভর্তি চুল।
একজন দাসীর দিকে তাকিয়ে বলেন, ওকে কেন ঢেকে রাখা হয়নি?
প্রত্যেকে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তাঁর কণ্ঠস্বর শুনে উমরাও জায়নামাজের ওপর উঠে বসেন।
গালিব বলেন, তুমি তো আমাকে ডেকে ওকে দেখাতে পারতে বিবি?
আমার তবীয়ত ঠিক ছিল না।
উমরাও দুহাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে দেন। গালিব নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। উমরাওয়ের শরীর ভাল ছিল না এ খবর কেউ তাঁকে দেয়নি। বহির্মহল-অন্দরমহলের টানাপোড়েনে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি শ্বশুরবাড়ির বিধিনিষেধ উপেক্ষা করা। ঘরে ফিরতে ফিরতে ভাবলেন, তিনি নিজে কি নিজের কবিতা, মুশায়রা ইত্যাদি নিয়ে একটু বেশি ব্যস্ত না? হয়তো তাই। সেটিও একটি কারণ হতে পারে। তিনি বুকের ভেতরে ভার বোধ করলেন। সেদিন সন্তানের লাশ দাফন করে ফিরে আসার পরে নিজেকে একজন নিঃস্ব মানুষ বলে মনে করলেন তিনি। লিখলেন শের :
‘আহত চোখের নৈরাশ্যের মহিমা জানে না আকাশ;
হেমন্তহীন বসন্ত বিফল দীর্ঘশ্বাসের মধ্যেই জন্ম নেয় ॥’
রাতে উমরাওয়ের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে দেখলেন ভেতর থেকে দরজা বন্ধ। আজ এতো তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গেলো উমরাও? বোধহয় শরীর খারাপ।
মৃদুস্বরে ডাকলেন, বিবি।
ভেতর থেকে কোনো সাড়া আসে না। দরজায় টুকটুক শব্দ করলেন।
দরজা খুললো একজন দাসী।
হুজুর। বেগম সাহেব ঘুমিয়ে গেছেন। বলেছেন, রাতে যেন ডাকাডাকি না করি। অনেক কান্নাকাটি করেছেন। কাঁদতে কাঁদতে-
আচ্ছা, ঠিক আছে। এখন যাচ্ছি। সকালে আসবো।
দরজায় টাঙানো ভারি খসখসের আড়ালে দাসী বন্ধ করে দেয় দরজা। সেই শব্দ তাঁর মস্তিষ্কে আঘাত করে। তিনি খুব বিপন্ন বোধ করেন। বালিশে মুখ গুঁজে রাখলে রাত কাটে না। চারদিকে অন্ধকার গাঢ় হয়ে থাকে। ভাবলেন, দ্বিতীয় সন্তানটি আবার কবে আসবে?
.
দিন পনেরোর মাথায় ইলাহি বখশ তাঁকে ডেকে বললেন, মির্জা নওশা আমার এই বংশলতিকাটা নকল করে দাও।
জ্বী, আচ্ছা।
তিনি বংশলতিকার কপিটি হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন। তিনি জানেন তাঁর শ্বশুর কবি ও ধর্মগুরু। বিভিন্ন লোককে শিষ্য করেন। শিষ্য সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার কারণে তিনি তাঁর বংশলতিকা নানা তথ্যসহ শিষ্যদের মাঝে বিতরণ করেন। যাতে তাঁর ব্যাপারে শিষ্যদের মনে কোনো ভ্রান্তি না থাকে। বংশলতিকার এক কপি সবাইকে দিতেন। সেজন্য তালিকা নকলের প্রয়োজন পড়ে।
তালিকা নকল করতে গালিব বিরক্ত বোধ করলেন। তিনি তামাশা করার জন্য এমনভাবে নকল শুরু করলেন যেন তাঁর শ্বশুর বুঝতে পারেন যে এই কাজটি তাঁকে করতে দেয়া ঠিক হয়নি। লতিকার প্রথম নামটি লিখে দ্বিতীয় নামটি বাদ দেন। এভাবে পুরো লতিকার সব নাম লিখলেন না। লিখলেন একটি বাদ দিয়ে আর একটি। নকলের এমন তামাশা দেখে ইলাহি বখশ তো রেগে আগুন।
ধমক দিয়ে বললেন, এ কি করেছো? এটা কেমন তামাশা হলো?
গালিব শ্বশুরের ক্রোধ গায়ে না মেখে স্বাভাবিকভাবেই বললেন, বংশ লতিকা নিয়ে আপনি কিচ্ছু ভাববেন না আব্বাজান। আসলে এই লতিকা তো খোদাতালা পর্যন্ত পৌঁছানোর একটা মই। মই বাওয়া তো সহজ কাজ। মাঝখান থেকে যে একটা সিঁড়ি সরিয়ে নিয়েছি এতে কিছু আসবে যাবে না। কারণ মানুষ তো লাফিয়ে লাফিয়ে উপরে উঠতে পারে।
খামোশ, মির্জা নওশা।
গালিবের নকল করা কাগজটি তিনি টুকরো টুকরো করে ছিঁড়ে ফেলেন।
তোমাকে কাজটি দেয়াই আমার ভুল হয়েছে। অন্য যে কেউই আমাকে কাজটি করে দেবে।
ইলাহি বখশ হনহন করে চলে যান। গালিব স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। ভাবলেন, বেঁচে গেলাম। এমন একটি কাজ আমাকে দ্বিতীয়বার করতে হবে না। ওহ, বড় বাঁচা বেঁচে গেছি। কি যে ঝামেলায় পড়তাম এই বোঝা টানতে হলে।
ইলাহি বখশ একদিন আসাদ নামের একজনের একটি শের পড়ে একটু অবাক হলেন। খানিকটা হতাশও। মির্জা নওশা এমন দুর্বল একটি শের লিখেছে তা তিনি ভাবতে পারলেন না। তিনি তাঁর বৈঠকখানায় গালিবকে ডাকলেন।
আমাকে ডেকেছেন আব্বাজান?
হ্যাঁ, বোস। আমার খুব মন খারাপ হয়ে গেছে তোমার এমন একটি দুর্বল শের পড়ে।
গালিব শুকনো মুখে শ্বশুরের সামনে বসেন। তিনি আরও বলেন, কবি ফজলে হক বলেছে তোমার লেখার দুর্বোধ্যতার কারণে সমালোচনা হচ্ছে। তুমি তো জানো ফারসিতে অসাধারণ দখল আছে ফজলে হকের। ও ভবিষ্যতে পণ্ডিত হবে। ভালো কবিও হবে সন্দেহ নেই।
আমি তাঁর গুণমুগ্ধ।
বেশ বেশ। ওর সঙ্গে আলোচনা করে নিজের কবিতার সংশোধন করবে।
জ্বী, ঠিক আছে। আমার কোন শেরটির কথা আপনি বলছিলেন—
শোন, আমি তোমাকে পড়ে শোনাচ্ছি। ইলাহি বখশ পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে পড়লেন :
‘আসাদ তুমনে বনাই যে গজল খুব
আর ও শের রহমৎ হ্যায় খুদা কী।
আসাদ যে গজল তুমি বানালে
সে যে করুণাময় ঈশ্বরের দান!’
এটি খুবই দুর্বল শের আসাদ, খুবই খারাপ।
গালিব দৃঢ়তার সঙ্গে বললেন, এটা আমার লেখা নয়। কখনোই না। এই আসাদ নিশ্চয়ই অন্য কেউ হবে।
এটা তো আরো খারাপ কথা। এই বাজে শের তোমার নামে চলে যাবে।
গালিব উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলেন, হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বলেছেন। আমার মনে হয় এটা আরও এমন হবে যে আমার ভালো লেখাগুলো ওর নামে চলে যাবে।
ইলাহি বখশ মাথা নেড়ে বললেন, ঠিক, ঠিক বলেছ। আমার মনে হয় তোমার নিজের অন্য একটি তখলুস ঠিক করতে হবে।
গালিব এক মুহূর্ত ভেবে বললেন, আমি এখন থেকে আমার ছদ্মনাম রাখবো গালিব।
ইলাহি বখশ নিজেই উচ্চারণ করলেন, গালিব। শব্দটা শ্রুতিমধুর মনে হলো। তিনি আবার উচ্চারণ করলেন, গালিব, গালিব। গালিব মানে বিজয়ী। ভালোই হবে, গালিবই রাখো। ভালোই শোনাচ্ছে।
আপনার পছন্দ হয়েছে?
এ নিয়ে আর বলার কিছু নাই। গালিবই শেষ কথা। এই নামেই তোমার খ্যাতি হবে। তুমি বিজয়ী হবে।
গালিব খুশি হয়ে নিজের ঘরে এলেন।
রাতে উমরাও তাঁকে গভীর আগ্রহে কাছে টানেন। দু’জনের বুকের ভেতরে সন্তান হারানোর কষ্ট। দুজনের বুকের ভেতরে হাহাকারের উত্থালপাতাল। দু’জনে দু’জনকে জড়িয়ে ধরে চোখ মোছেন। একসময় গভীর রাতের মায়ারি পরশ দু’জনকে স্বস্তি দেয়।
মাস দু’য়েক পরে খবর হয় উমরাও গর্ভবতী হয়েছেন।
গালিব সেদিন কুফরি চাঁদকে বলেন, আমার জন্য একটা বাড়ি খুঁজতে হবে কুফরি চাঁদ।
এখান থেকে চলে যাবেন?
যাওয়াই তো উচিত। আর কতোদিন শ্বশুরবাড়িতে থাকবো। অনেক বছর থেকেছি।
কুফরি চাঁদ মাথা নাড়েন।
এই মহল্লাতেই বাড়ি দেখবো হুজুর?
দেখতে পারো। বিল্লিমাঁরো মহল্লা আমার ভালোই লাগে। তাছাড়া আমার বিবি হয়তো ওর আব্বাজানের বাড়ির কাছে থাকতে পছন্দই করবে।
কুফরি চাঁদ চলে গেলে গালিব ভাবলেন, তার জুয়াখেলার আড্ডাটা বিল্লিমাঁরোতেই জমে উঠেছে। নতুন জায়গায় গেলে আর একটি আড্ডা গড়ে তোলার হাঙ্গামা অনেক। কোতোয়ালি পুলিশ তো চোখে চোখে রাখে। ইলাহি বখশ প্রভাবশালী মানুষ। তিনি একদিকে কবি, অন্যদিকে ধর্মগুরু। তাঁর অনেক শিষ্য। সবাই তাঁকে পীরের মতো মানে। যাহোক, এভাবে সুযোগ নেয়া তাঁর ঠিক নয়। তিনি নিজেকে শাসন করলেন। তিনি খাঁটি কবি বলে অনায়াসে তাঁর তখলুস ঠিক করে দিয়েছেন। তিনি এখন মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব!
একই সঙ্গে তাঁর মনে হলো দূরকিজানের কথা। চমৎকার গজল গায়। অপূর্ব কণ্ঠস্বর। তেমন বিনয়ী এবং সুন্দরী। তিনি তাঁকে ডোমনি বলে ডাকেন।
তিনি কৃতজ্ঞচিত্তে খোদাতালার মহিমার কথা স্মরণ করলেন। ভাবলেন, খোদাতালা দুরকিজানকে নিজের হাতে তৈরি করেছেন এবং শুধু এই গালিবের জন্য। সেজন্য দুরকিজান তাঁর প্রেমে মুগ্ধ। নিজের শের নিজেকেই শোনালেন:
‘মনে পড়ে যায় কতো অতৃপ্ত বাসনার ক্ষতচিহ্ন বুকে রয়েছে;
হে ঈশ্বর, আমার কাছ থেকে পাপের হিসাব চেয়ো না ॥’
একটি শের গেয়ে নিজেকে শান্ত করতে পারলেন না। গাইলেন আরও একটি :
‘ফুলবাগিচার রূপ দেখতে চাই, আবার ফুল তুলতেও চাই—
হে বসন্তের স্রষ্টা, আমার মন পাপী।’
গুনগুন করতে করতে পায়চারি করলেন। কতোটা সময় কেটে গেলো হিসাব করতে পারলেন না। কতোটা সময় কখন যায় সে হিসাব রাখা কঠিন 1 কতোটা সময় নিজের খুব আপন হয়ে ওঠে সে হিসেবেও মেলে না। বড় যন্ত্রণা, বড় টানাপোড়েনে দিনের আয়ু ফুরোয়। শুধু জেগে থাকে গজল। তাঁর প্রিয় কবিতা এবং বুকের ভেতরে আলো জ্বালিয়ে রাখা গভীর এবং অন্তবিহীন সময়।
সে সময়ে ফজলে হক আসেন। তিনি এসেছেন ইলাহী বখশের কাছে। কিন্তু তাকে শিষ্য পরিবেষ্টিত দেখে গালিবের ঘরে আসেন।
কেমন আছেন মির্জা নওশা?
আমি ভালোই আছি, শুধু সন্তান হারানোর বেদনা বুকের ভেতরে ক্ষতের মতো টিকে আছে। আপনি কেমন আছেন?
আমি ভালোই আছি। কিন্তু কতোদিন ভালো থাকতে পারবো তা জানি না।
এটা তো আমিও বলতে পারি। আমরা কেউ জানি না কতোদিন ভালো থাকবো।
মির্জা নওশা পৃথিবীর নিয়ম এমন।
মাফ করবেন হজরত, আমার এই ডাক নামটি একদম পছন্দ না। কেউ আমাকে এই নামে ডাকুক তা আমি চাই না। আপনি আমাকে মির্জা বলে ডাকবেন।
জরুর। যে নামে ডাকতে বলবেন সে নামেই ডাকবো। কবির নামে কি আসে যায়। কবির কবিতাই বলবে কবির আসন কোথায়।
জরুর। ইদানীং দেখতে পাচ্ছি মুশায়রায় আমার কবিতা তেমন সাড়া জাগাতে পারছে না। শ্রোতাদের কাছ থেকে প্রথমদিকে যেমন বাহবা পেয়েছি এখন তেমন পাচ্ছি না।
মির্জা আপনার কবিতার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে। আপনি উর্দু কবিতায় প্রচুর ফারসি শব্দ ব্যবহার করছেন।
বেশি হচ্ছে কি?
সবাই তাই বলছে। সেজন্য আপনার কবিতা শ্রোতার মনে দাগ কাটতে পারছে না।
আপনি কি মনে করছেন হজরত?
আমারও এমন লাগছে। আপনি তো জানেন কবিতা দুর্বোধ্য হলে তা শ্রোতার হৃদয়ে তেমন সাড়া জাগায় না। শ্রোতার মনের সঙ্গে কবিতার দূরত্ব তৈরি হয়। আমি এ কথাটি আপনাকে বলতাম। আমার মনে হয় আপনি নিজে আবার নতুন করে ভাবুন।
গালিব চুপ করে থাকেন। মন খারাপ হয়। তাঁর উর্দু কবিতার একটি দীওয়ান করবেন বলে কবিতা গোছাচ্ছেন, কিন্তু পাঠক যদি তাঁর কবিতার সংকলনটি গ্রহণ না করে তাহলে কেমন হবে!
কি ভাবছেন মির্জা?
আমার উর্দু গজলগুলো দিয়ে একটি দীওয়ান করার কথা ভাবছি হজরত। আপনি আমাকে সহযোগিতা করবেন?
করবো, জরুর করবো। গজল বাছাইয়ের সময় আমাকে দেখাবেন। আমি দুর্বোধ্য গজলগুলো আলাদা করে দেবো।
এটা আমার খুব দরকার। আপনার কাব্যশাস্ত্রে দখল অসাধারণ। আপনি সহযোগিতা করলে দীওয়ানটি নিয়ে আমার চিন্তা নেই।
ঘাবড়াবেন না। শান্ত মনে এগোন। সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এখন যাই।
ফজলে হক চলে গেলে গালিব অস্থিরতা অনুভব করেন। কিছুতেই নিজের মন খারাপ অবস্থা থেকে বের হতে পারেন না। ভাবেন দুরকিজানের কাছে যাবেন। ওর সুরেলা কণ্ঠে নিজের গজল শুনলে হয়তো মনটা শান্ত হবে। চুপচাপ বেরিয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে।
মধ্যরাত পর্যন্ত দূরকিজানের গজল শুনলেন। তারই লেখা। ইদানীং তার লেখা গজল ছাড়া দুরকিজান গায় না। গালিব শরাব নিয়ে বসেন। দুরকিজান গাইছেন :
‘দিল-এ নাদাঁ তুঝে হুয়া কেয়া হ্যায়?
আখির ইস দর্দ কী দওয়া কেয়া হ্যায়?…
ওরে অবুঝ মন তোর কি হয়েছে?
এ ব্যথার নিরসন কোথায় রয়েছে?’
গভীর নিমগ্নতায় গেয়ে যায় তাওয়াফ। এটি তার পেশা। গালিবের প্রেমে পড়ে সে পেশা ভুলতে বসেছে। মাঝে মাঝে অন্য তাওয়াফরা তাকে গালমন্দ করে। বলে, বাইজির পেশা প্রেমে পড়া নয়। প্রেম দিয়ে ক্ষুধা মিটবে না। কিন্তু দূরকিজান কারো কথায় কান দেয় না। সে গালিব ছাড়া কিছু বোঝে না। গালিব তো সাধ্যমতো ওকে ভরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। এরজন্য তার কোনো আক্ষেপ নেই। প্রয়োজনে ধার করবে।
রাত হয়ে গেলে দূরকিজান গালিবের হাত টেনে ধরে বলে, বাড়ি যান হজরত।
বাড়ি!
হ্যাঁ, বাড়ি যেতে হবে।
যদি না যাই? আমাকে থাকতে দেবে না?
এখানে থাকা যাবে না হজরত। উঠুন।
দুরকিজান তাঁকে টেনে ওঠায়। দরজার বাইরে এগিয়ে দেয়। যতোক্ষণ গালিব চলে যেতে থাকেন ততোক্ষণ ও দাঁড়িয়ে থাকে। গালিব জানে ও দাঁড়িয়েই থাকবে। তারপরও তিনি পেছন ফিরে তাকাবেন না। এটুকু তাঁর সঞ্চয়।
বাড়ির সামনে এসে দেখলেন কুফরি চাঁদ দাঁড়িয়ে আছে।
কি হয়েছে কুফরি?
আপনার জন্য বসে আছি।
যাও, ঘুমুতে যাও।
খাবেন না?
গালিব নিজের ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন। কাপড় বদলানোরও সময় হলো না। বিছানায় গড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘুম এলো।
.
কয়েকদিন পরে এক মুশায়রার আসরে জ্ঞানীগুণীজনের সামনে অপদস্ত হলেন। খেয়াল করলেন তাঁর আগে যারা কবিতা পড়লেন তারা সবাই খানিকটা ভিন্ন ঢঙে নিজেদের উপস্থাপন করলেন। আজ যেগুলো পড়া হলো দেখা গেলো সেগুলোর অর্থে গোঁজামিল আছে, শব্দও ভারী ভারী। যেন বেশ আড়ম্বর করে লেখা হয়েছে কবিতাগুলো এবং খানিকটা উদ্দেশ্য নিয়েও। গালিব শঙ্কিত বোধ করেন। যখন দেখতে পান উপস্থিত শ্রোতারা তালি দিয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছেন তখন খুবই মুষড়ে পড়েন। বুঝতে পারেন আজকের পরিবেশ তাঁকে নাজেহাল করার জন্য সাজানো। তাদের কেউ কেউ তাঁর দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন আর বাহবা ধ্বনি দিচ্ছিলেন।
বেশ ধৈর্য ধরে তিনি বসে আছেন। ভাবছেন, এই বুঝি তাঁকে পড়ার জন্য ডাকা হবে। তেমনটিই হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তার আগেই হাকিম আগা জান আইশ উঠে দাঁড়ালেন।
হাতে ধরা কাগজটি নাড়তে নাড়তে বললেন, আমি মির্জা গালিবকে নিয়ে একটি কবিতা লিখেছি। পড়তে চাই।
পড়ুন, পড়ুন।
সবাই হাততালি দিয়ে আগা জানকে স্বাগত জানালেন।
আগা জান পড়তে শুরু করলেন;
‘সে কাব্য অর্থহীন, যা বোঝেন শুধু কবি
আনন্দ তো হবেই, যদি অন্যে পায় সে ছবি।
মীরকে বুঝি, মির্জাকেও, কিন্তু গালিব যা লেখেন
ঈশ্বর তাকে রক্ষা করুন, তিনিই জানেন কে বোঝেন!’
আগা জানের কবিতা শুনে সবাই হর্ষধ্বনি করে। নানা কথা বলে অর্থহীন কবিতাকে তুলোধুনো করে। গালিব নিশ্চুপ বসে থাকেন। অপমানে, অবজ্ঞায় তিনি বাকরুদ্ধ হয়ে যান। মুশায়রার আসরে কেন তাঁকে অপমান করা হলো? সবার থেকে আলাদা ভয়ে ভিন্নমাত্রার কবিতা লিখলেই বিদ্রুপ করতে হবে? এভাবে সামনে বসিয়ে? সবাই মিলে এক হয়ে? প্রবল দুঃখ এবং ক্রোধ তাঁকে একাকার করে ফেলে। তিনি আসর ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরতে থাকেন। দিল্লির পরিচিত রাস্তাকে নিষ্ঠুর বলে গাল দেন। পালকি থেকে নেমে রাস্তায় পায়চারি করেন। আবার পালকিতে ওঠেন।
বেশ রাত হয়েছে। তাঁর দু’চোখ বেয়ে জল গড়ায়। ভাবলেন, প্রথমে নিজেকে শান্ত করবেন চোখের জল দিয়ে ধুয়ে। তারপর নিজের প্রতিজ্ঞা পূরণ করবেন কবিতার শক্তি দিয়ে।
বৃষ্টি নেমেছে। ধুয়ে যাচ্ছে দিল্লির ধুলিমলিন রাস্তা। তিনি দু’হাতে চোখের জল মুছলেন। দিল্লি আসার পরে চোখে অনেক স্বপ্ন জমেছে। বাদশাহর দরবারে কবিতা পড়বেন, বড় একটা জায়গা হবে সেখানে। সে আশাও পূরণ হয়নি এখনো। নওয়াব আহমদ বখশ খান বাদশাহর দরবারে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি। তারপরও কিছু হলো না।
আজ দিল্লির কবিমহলে এভাবে হেনস্তা হলেন? তাহলে কি। না, পরাজয়ের কথা ভাবলে চলবে না। বিজয়ী তাঁকে হতেই হবে। তাওয়াফদের কণ্ঠে তাঁর গজল ধ্বনিত হয়। এইসব বাইজি তাঁর গজল পৌঁছে দিচ্ছে শহরের নামজাদা ব্যক্তিদের কানে। তারা তো ইচ্ছে করে শুনতে না চাইলেও শুনছে তাঁর গজল। একজন গাইতে শুরু করলে তাদের না শুনে উপায় নেই।
তিনি পালকি ঘুরিয়ে দুরকিজানের বাড়ির দিকে নিতে বললেন। এখন এটিই তার আশ্রয়স্থল। দরজার বাইরে থেকেই তিনি শুনলেন তাঁর গান ভেসে আসছে ঘরের ভেতর থেকে।
‘কোই উম্মীদ বর নহী আতী
কোঈ সুরত নজর নহী আতী।’
সুরেলা কণ্ঠ তাঁর হৃদয়ে জলের ধারায় প্রবেশ করে। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মৃদু শব্দ করেন দরজায়। দূরকিজান দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়। বলেন, আপনি?
তোমার কাছেই এসেছি আশ্রয় খুঁজতে।
কি হয়েছে আপনার?
বসতে দেবে না?
আসুন, আসুন।
গালিব ঘরে ঢুকে বসলে দুরকিজান একটি পরিষ্কার ওড়না এনে তাঁর মাথা- মুখ মুছিয়ে দিয়ে এক গ্লাস শরাব এনে দেয়।
আপনার মুখ দেখে মনে হয় আজ আপনি অনেক কষ্ট পেয়েছেন।
হ্যাঁ, ডোমনী, আজ দিল্লির গুণীজনেরা আমার গজল নিয়ে উপহাস করেছে।
উপহাস?
দুরকিজান গালিবের পায়ের কাছে বসে।
আজ আমি তোমার কাছে থাকবো ডোমনী। তোমার বুকে মুখ রেখে আজ আমি ঘুমাবো। বল তুমি না করবে না?
না, আমি না করবো না। আজ আমি গান গেয়ে আপনাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব। আমি বৃষ্টিকে বলবো, বৃষ্টি আজ রাতে তুমি এই কবির জন্য শরাব হও।
গালিব বিস্ময়ে চেঁচিয়ে বলেন, দুরকিজান, তুমি আমাকে এতো ভালোবাস!
আহ, ভালোবাসা! কারো কোনো উপহাস আপনাকে ছুঁতে পারবে না। আমি সব উপহাস আমার গজলের সুরে শুষে নেবো।
আহ্ ভালোবাসা, ভালোবাসা!
আমি পালকির বেহারাদেরকে বলি দিনের আলো শুরু হওয়ার আগে আপনাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে।
বলো। গালিব গদিতে পিঠ ঠেকিয়ে হেলান দিয়ে বসেন। শরাবের পেয়ালায় চুমুক দেন। বেজে ওঠে দুরকিজানের সঙ্গীত। সুরের লহরী ছড়াতে থাকে ঘরের ভেতরে। গালিবের বুকের ভেতরে ধ্বনিত হয় দুরকিজানের ভালোবাসার কণ্ঠস্বর, আপনি যদি কখনো দুঃখ পান আমার কাছে আসবেন। আমি আপনার দুঃখ নিজের বুকে নেবো। দুঃখ আপনাকে ছুঁতেই পারবে না।
ওহ, ডোমনি! গালিব চোখ বোজেন।
সুরের ইন্দ্রজাল প্রদীপের মৃদু আলোয় মায়াবী হয়ে ওঠে। গালিব ভাবেন, কোথাও এমন স্বর্গ থাকে বলেই তো বেঁচে থাকার মতো দুঃখ থেকে বেরিয়ে আসা যায়। আহ্, আজ আমার জীবনে তেমন গভীর রাত উপস্থিত হয়েছে। এ রাতের সবটুকু সুধা আমি ভোগ করবো। কেউ আমাকে উপহাস করে আর ঘায়েল করতে পারবে না।
গালিব তাকে বুকের মধ্যে টানলেন। আর সে দু’ঠোঁটে মুছে দিল গালিবের গড়িয়ে পড়া চোখের জল। গালিব বললেন :
‘চোখের জল প্রেমকে করেছে আরো নির্ভীক
আর হৃদয় হয়েছে নির্মল ও পবিত্র।।’
বাইরে রাতজাগা পাখির ডাক মিলিয়ে গেলো দিল্লির বিশাল আকাশে। মেঘহীন আকাশ থেকে বৃষ্টির ঝরেপড়া আর নেই।
বাইরে চমৎকার স্নিগ্ধ বাতাস বইছে। ঘুলঘুলির ছোট পথে ছুটে আসছে ঘরে। তখন প্রদীপ নেভানো হয়েছে। সরিয়ে রাখা হয়েছে শরাবের শূন্য পেয়ালা।
.
মাসখানেকের মধ্যে বাড়ির ব্যবস্থা হয়ে যায়। গালিব উঠে আসেন নিজের ঠিকানায়। বিল্লিমাঁরো মহল্লায় কাসিম জান গলিতে তাঁর বাড়ি। নিরিবিলি। ছিমছাম। উমরাও বেগম পছন্দ করেছেন। তাঁর প্রসবের সময় ঘনিয়েছে বলে বাড়ি গোছানোর তদারকি ঠিকমতো করতে পারছেন না। দাস-দাসীদের দেখিয়ে দিচ্ছেন।
কয়েকদিন পরে তিনি একটি মৃত সন্তান প্রসব করলেন।
গালিব নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন। উমরাওয়ের বুকফাটা কান্নার শব্দ তিনি আর শুনতে চাইলেন না।
কয়েক মাস পরে খবর পেলেন তাঁর ছোট ভাই মির্জা ইউসুফ পাগল হয়ে গেছে। তিনি গিয়ে দেখলেন পাগলামির তেমন বড় কোনো মাত্রা নেই। চুপচাপ বসে থাকে, অন্যমনস্ক হয়ে যায়। কখনো রেগে ওঠে।
তিনি খুব কাছে বসে ডাকেন, ইউসুফ ইউসুফ।
চমকে তাকান ইউসুফ। আপ্রাণ চেষ্টা করেন তাঁকে চেনার, কিন্তু পরক্ষণে মুখ ঘুরিয়ে ফেলেন। গালিব ভাইয়ের হাত ধরেন। অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকেন। একসময় ইউসুফ ঝটকা মেরে হাত ছাড়িয়ে নেন। তারপর উঠে চলে যান।
আজিও এসেছেন তার সাথে। কবিতা লেখেন। উমরাওয়ের চাচাতো ভাইয়ের ছেলে। গালিব তাকে খুব ভালোবাসেন। আজিফও গালিবের ভক্ত। কোথাও একসঙ্গে যাওয়ার সুযোগ পেলে সুযোগ ছাড়েন না।
ইউসুফ উঠে চলে গেলে গালিবের পিঠে হাত রেখে আজিফ বলেন, মির্জা সাহেব চলেন যাই।
যাবো? কোথায়?
বাড়িতে যাবেন।
সেখানে আমার সন্তান নেই আজিফ।
কাউকে কাউকে এভাবে দুর্ভাগ্যের মোকাবেলা করতে হয়।
দুঃখ পাওয়া কি আমার ভাগ্য?
দুঃখ সবাইকে পেতে হয় মির্জা সাহেব। আপনি তাঁর থেকে বাদ যাবেন কেন? আপনি কি খোদাতালার প্রিয় বান্দা?
আমাকে এমন আঘাত দিচ্ছো কেন আজিফ?
আপনার মন শক্ত করার জন্য। আপনাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। আপনার ভেঙে পড়া চলবে না।
আমার পাঁচ বছর বয়সে আব্বা মারা গেছেন। আমি তো সেই শৈশব থেকে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়েছি। আমার আর নতুন করে উঠে দাঁড়ানো কি?
চলুন।
আজিফ হাত ধরে টানে। গালিব ওর হাত শক্ত করে ধরে বাড়ির বাইরে আসে। ইউসুফের স্ত্রী পর্দার আড়ালেই ছিল। সামনে আসেনি। মেয়ে দুটিকেও দেখা হলো না। শুধু কাজের লোক। গালিব দু’হাতে চোখ মুছলেন। এভাবেই জীবন চলে যায়।
এভাবে জীবনের রশিতে গিটঠু পড়ে।
.
নয় মাস জীবিত থাকার পরে তাঁর তৃতীয় বাচ্চাটি মারা গেলো।
সেদিন বিকেলে আকাশে ঘন কালো মেঘ ছিল। ঝড়ো বাতাস ছিল। বৃষ্টি ছিল না। হয়তো বৃষ্টি হতে পারে এমন একটি আভাস ছিল। তিনি জানালার ঘুলঘুলি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েছিলেন। মাথায় ভীষণ দুশ্চিন্তা।
দেখতে পাচ্ছেন তাঁর সামনে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘনিয়ে উঠেছে। এদিকে শরাব এবং তাওয়াফদের পেছনে অনেক টাকা উড়িয়েছেন। ঋণ হয়েছে অনেক। এর মাঝে এই অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিলে দিন চালানো মুশকিল হবে।
তখন কাল্লু মিয়া ঘরে ঢোকে।
হুজুর।
কেমন আছে আমার বাচ্চা? জ্বর কমেছে? হাকিমের কাছ থেকে যে দাওয়াই আনা হয়েছে, তা কি আছে, নাকি শেষ হয়েছে?
কাল্লু মিয়া নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে থাকে।
কথা বলছো না কেন কাল্লু মিয়া? হাকিমকে ডেকে আনতে হলে যাও ডেকে নিয়ে এসো। নাকি আমাকে যেতে হবে হাকিমের কাছে?
না, না আপনার যেতে হবে না হুজুর।
তাহলে কি বলতে এসেছো তুমি?
বাচ্চা মারা গেছে।
মারা গেছে?
কাল্লু মিয়া দু’হাতে মুখ ঢাকে।
এমন আকস্মিক আঘাতে বিমূঢ় হওয়ার মতোও অবস্থা ছিল না তাঁর। তিনি কাল্লু মিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, কি বললে?
কাল্লু মিয়ার মুখ থেকে কথা বের হয় না। যেন কতো কাল আগে ও কথা শিখেছিল এখন তা ভুলে গেছে। হাজারবার চেষ্টা করেও মনে করতে পারছে না। ও বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকে।
গালিব আবার চিৎকার করে বললেন, কি বললে? তারপর হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। কেঁদেকেটে শান্ত হওয়ার পরে ভাবলেন তিনি এক পথ হারানো নাবিক। কেবলই পথ খোঁজার চেষ্টায় ক্লান্ত এবং বিপর্যস্ত।
কাল্লু মিয়া তাকে কাঁদতে দেখে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়েই ছিল।
তিনি তাঁকে বললেন, যাও সবাইকে খবর দাও।
তারপর নিজে অন্দরমহলে গেলেন।
মৃত সন্তান বুকে জড়িয়ে বসে আছেন উমরাও বেগম। গালিবকে দেখে পাগলের মতো বললেন, না, না ওকে আমি দেবো না। কারো কাছেই দেবো না।
উদ্ভ্রান্ত উমরাওকে কি বলবেন তিনি? চারপাশে দাসীরা দাঁড়িয়ে আছে। একজন বলে, হুজুর আপনি চলে যান। বেগম সাহেবাকে আমরা দেখবো।
তিনি ফিরে এলেন নিজের ঘরে।
বুকের ভেতরে হাতুড়ির শব্দ হয়। তিনি দাঁড়িয়ে পড়েন ঘরের মাঝখানে। তিনি দুঃখ পেলে ছুটে যান তাওয়াফদের কাছে। তাঁর জন্য শরাব আছে। উমরাও দুঃখ পেলে কি করেন? তাঁর কি আছে? নিজেকেই উত্তর দেন, ওর নামাজ আছে। কুরআন পাঠ আছে।
বৃষ্টি মাথায় করে আমিনউদ্দিন, জিয়াউদ্দিন, জয়নাল এলো। সঙ্গে আরও কেউ কেউ। জয়নাল এসে ওর ফুপুর কোল থেকে শিশুটিকে নিলো। ও যখন দু’হাত বাড়িয়ে বাচ্চাটি চাইলো উমরাও একটুও আপত্তি করে না। ওর কোলে দেয়। বলে, সাবধানে নিও। ব্যথা পায় না যেন।
না, ফুপি আমি একটুও ব্যথা দেবো না।
কোথায় দিয়ে রাত পার হয়ে গেলো তার হিসেব করলেন না গালিব। নির্ঘুম কেটে গেলো সময়। বাচ্চার দাফন করে আত্মীয়রা চলে গেছেন। বাড়ি আবার সুনসান। বাড়িতে যারা আছে তাদের কারো কণ্ঠে কোনো শব্দ নেই।
সকালে হালুয়া আর রুটি নিয়ে এলো কাল্লু মিয়া, হুজুর।
গালিবের নির্ঘুম দৃষ্টিতে ক্লান্তি নেই।
হুজুর আপনি রাতে ঘুমাননি।
আমার তো ঘুম পাচ্ছে না কাল্লু মিয়া।
একজন পাওনাদার এসেছে টাকার জন্য।
ও জানে আমার বাচ্চাটি মারা গেছে?
আমি তাকে বলেছি।
তারপরও দাঁড়িয়ে আছে?
বলেছে, টাকা না দিলে যাবে না।
গালিব টাকার ছোট ঝুলিটি ঝেড়ে যা পেলেন তা কাল্লু মিয়ার হাতে দিলেন। বললেন, এটা নিয়ে ওকে যেতে বলো। পরে আবার দেবো।
একটু পরে শুনতে পেলেন পাওনাদারের চেঁচামেচি। এতো অল্প টাকা নিয়ে সে যাবে না। গালিব ঘরে বসে চিৎকার শুনলেন। একটি মৃত শিশুর স্মরণে যে বাড়িটি এতোক্ষণ নিঃশব্দ ছিল সে বাড়ি এখন পাওনাদারের উচ্চকণ্ঠে বিব্রত। কাল্লু মিয়া লোকটির হাত ধরে বাড়ির বাইরে বের করে দিতে চাইলে সে ঘুষি মারলো। তারপরও কাল্লু মিয়া কিছু বললো না দেখে গালিব খুশি হলেন। মনে মনে বললেন, এখন চিল্লাচিল্লি করার সময় নয়।
সময় যে কখন কীভাবে কার পক্ষে কাটবে কেউ তা জানে না। যেমন কাটেনি মুঘল সম্রাটদের। গত কয়েকদিন ধরে তিনি ইতিহাসের নানাকিছু জানার চেষ্টা করছেন। কারণ দরবারে স্থান পাওয়ার আগে তিনি যদি ইতিহাসটা ঠিকমতো জানতে পারেন সেটা তাঁর অবস্থান তৈরিতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন। যদিও তাঁকে দরবারে জায়গা করে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে মাত্র, কিন্তু এখনো তেমন কিছু হয়নি। হতেই হবে। সম্রাটের দরবারে তাঁকে যেতেই হবে। দরবারের সভাসদদের একজন হয়ে।
কতোদিন বাড়ির বের হলেন না। খেলেন, ঘুমুলেন। উমরাওয়ের সঙ্গে সময় নিয়ে কথা বললেন। উমরাও জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি এতো পড়েন?
পড়ি না, খাই।
কি খান? রুটিরুজি।
সেটা আবার কি?
সামনে আমাদের খারাপ সময় আসছে বিবি ।
শুনেছি নওয়াব বদল হবে।
তখন আমার ভাতা নিয়ে ঝামেলা হতে পারে।
জানি। এসব ভাবলে আমারও ঘুম আসে না।
তুমি বেশি ভেবো না বিবি।
আপনাকে নিয়েই তো বেশি সমস্যা। আপনি জুয়াখেলা ছেড়ে দেন। তাহলে আর দেনা করতে হবে না।
আহ্ বিবি, এসব কথা থাক।
উমরাওকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বইয়ের ওপর ঝুঁকে পড়েন। একজন থেকে বই ধার করে এনেছেন। সময়মতো বই ফেরত দিতে বলেছেন তিনি। বইটাতে তেমন কিছু নেই, এরচেয়ে বিভিন্নজনের কাছে চিঠি লিখে নানাকিছু জানতে হবে। বুড়োদের জিজ্ঞেস করেও নানা বিষয় জানা যাবে। তাঁর শ্বশুরও অনেক কথা বলতে পারবেন।
ইলাহি বখশ বলতে থাকেন মুঘল সাম্রাজ্যের টুকরো টুকরো খবর।
ঘটনার টানাপোড়েনের ইতিহাস আমরা জানবো না তো কে জানবে মির্জা নওশা, ইলাহি বখশ গালিবের দিকে তাকিয়ে বলেন, নানা কথা আমরা বড়োদের কাছে শুনেছি, আর বাকিটা তো আমরা নিজেরা দেখেছি।
আমি জানি আমার জন্মের সময় মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ অবস্থা ছিল।
আওরঙ্গজেব সাম্রাজ্যের যে বিস্তার ঘটিয়েছিলেন সেই সীমানা কমিয়ে দেয়া হয়েছিল দিল্লি ও তার আশেপাশে।
কি কারণে এটা করা হয়েছিল?
তোমার জন্মের কয়েক বছর আগে সম্রাট শাহ আলম অন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তিনি গোলাম কাদিরের কাছে বন্দি অবস্থায় ছিলেন। গোলাম কাদির ছিল রোহিলা বর্গের সেনাপ্রধান। তিনি কিছুকালের জন্য দিল্লি দখল করেছিলেন।
গালিব মাথা নেড়ে বলেন, শুনেছি তিনি তা বেশি দিন ধরে রাখতে পারেননি।
হ্যাঁ, অল্প দিনের মধ্যেই মারাঠাদের হাতে তার পতন হয়। মারাঠারা ছিল রোহিলা সেনাদের চেয়ে অনেক বেশি কঠোর। অভিজাতদের লোকের সামনে অপমান করতে তারা বেশ আনন্দ পেতো।
গালিব মৃদু হেসে বলেন, জন্মের সময়ের বাতাস আমার শরীরে লেগে আছে।
উঁহু, তা লেগে নেই। তোমার জন্ম হয়েছে আগ্রায়।
আগ্রায় হলেও বাতাস তো সব দিকেই বয়। সেজন্যই আমার এতো কষ্ট। ইলাহি বখশ হাসতে হাসতে বলেন, তোমার ব্যক্তিগত কষ্ট দিয়ে ইতিহাসের কিছু যাবে আসবে না মির্জা বখশ। সবাইকে নিজের মতো করে বেঁচে থাকার জায়গা তৈরি করতে হয়। আমি তোমাকে সংক্ষেপে কয়েকটি কথা বলি শোন।
তোমার জন্মের সময় মুঘল সম্রাটই ছিল ক্ষমতার অধীশ্বর। কিন্তু বক্সারের যুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ব্রিটিশরা সম্রাটের কাছ থেকে বাংলার দেওয়ানী নিয়ে নেয়।
এভাবেই চলেছে অনেক বছর।
আস্তে আস্তে ব্রিটিশরা ক্ষমতালোভী হয়ে ওঠে। কিন্তু যেহেতু সম্রাটই ছিলেন আইনত সার্বভৌম, সেজন্য তড়িঘড়ি করে কোনোকিছু না ঘটিয়ে তারা কৌশল অবলম্বন করে।
ইলাহী বখশ হাতের কাছে রাখা গ্লাস থেকে পানি পান করেন। গালিবের মধ্যে জানার আগ্রহ তীব্র হয়ে উঠেছে।
মুঘল সম্রাটের অবস্থা ক্রমাগত নাজুক হয়ে পড়তে থাকে। কিন্তু তাদের গ্রহণযোগ্যতা ছিল অনেক বেশি। তাই তারা চেষ্টা করছিল ব্রিটিশদের অনুমোদিত সম্রাটের সম্মানজনক ভূমিকাটুকু যেন ঠিক থাকে।
কারণ সাধারণ মানুষের কাছে সম্রাট ছিল এই দুনিয়ায় সবার চেয়ে উঁচুতে। তার নামেই জাদু ঘটে যায়। তিনি পৃথিবীকে শাসন করার জন্য সাধারণের কাছে এসেছেন। সে জন্য ব্রিটিশরা একটু সাবধানে পা ফেলছে। কারণ সাধারণের মনোভাব উপেক্ষা করার সাধ্য ব্রিটিশদের নাই।
তাছাড়া লালকেল্লার চার দেয়ালের মধ্যে সম্রাটের রক্ষা ব্যবস্থা ভীষণ মজবুত। কোনো ফুটো নেই যে পিঁপড়ে ঢুকবে। সম্রাট ও তার পরিবার বিচারব্যবস্থা দিয়েও সুরক্ষিত।
সম্রাটের দরবারে অনুমতি ছাড়া ব্রিটিশরা ঢুকতেও পারে না।
ব্রিটিশরা আস্তে আস্তে সাম্রাজ্য দখল করছে। একদিন ওরা পুরো ক্ষমতা পেয়ে যাবে। এই তো?
ভবিষ্যতই তা বলবে। তবে সাধারণ মানুষের কাছে সম্রাটের যে সম্মান তা যদি সম্রাট ধরে রাখতে না পারেন তাহলে আমাদের ভাগ্যে কি আছে তা আমরা জানি না।
আব্বাজান আমি চাই না মুঘল সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের হাতে চলে যাক।
আমিও চাই না।
দুজনেই এমন একটি বাসনার কথা বলার পরে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন।
ইলাহি বখশ একটুক্ষণ পরে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেন, একবার এমন একটি গল্প চালু হয়েছিল লোকের মুখে মুখে। একবার একজন মানী ব্যক্তি সম্রাটের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি পেয়েছিলেন। কিন্তু সম্রাটের সামনে পৌঁছানোর আগেই তিনি ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছিলেন। ঘেমে নেয়ে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। শেষে তিনি কোনো রকমে দেখা করে বাঁচেন।
গালিব শব্দ করে হাসেন। শ্বশুরের দিকে তাকিয়ে বলেন, আমার এমন অবস্থা হবে না। আমি সাহসের সঙ্গে সম্রাটের দরবারে উপস্থিত হতে পারবো।
মাশআল্লা আমারও তাই বিশ্বাস। তাছাড়া কোনো কবির বুক ভয়ে কাঁপবে এটা আমি ভাবতেই পারি না। ভাবতেও শরম লাগে।
আমার যাবার সুযোগ হলে আপনি আমার জন্য শরমের ভাগী হবেন না। শুকরিয়া মির্জা আসাদুল্লাহ খান গালিব।
শ্বশুরের এমন সম্বোধনে গালিব লজ্জা পেয়ে মুখ নিচু করেন।
সে দিনের ঘটনা তোমাকে সবটা বলিনি মির্জা নওশা। সেই ব্যক্তি পরে বলেছিলেন, আমি কি করে ভাববো যে পৃথিবীর সম্রাটের সামনে যাওয়ার ডাক পাবো। সম্রাটের সামনে যাওয়ার আহ্বান আমার কাছে মৃত্যুর মতো মনে হয়েছিল। যখন ছোপদার আমাকে হাঁক দিয়ে বললো, সম্মানের সঙ্গে এগিয়ে যান, এখন আপনি পৃথিবীর সম্রাটের দ্বারস্থ। তিনি দীর্ঘ আয়ু লাভ করুন এবং তাঁর সমৃদ্ধি ঘটুক। যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শনসহ আপনি প্রবেশ করুন এবং তাঁকে অভিবাদন করুন।
গালিব উদগ্রীব কণ্ঠে বলেন, তারপর?
ইলাহি বখশ দম নেয়ার জন্য থেমেছিলেন। মৃদু হেসে বলেন, সেই ব্যক্তি দরবারের আদব-কায়দা শিখেই এসেছিলেন। তিনি প্রথামত নত হয়ে সম্রাটকে সাত সেলাম জানিয়ে কুর্নিশ করেছিলেন।
সেদিন সবকিছু ঠিকঠাক মতো শেষ করেছিলেন সেই ব্যক্তি, কিন্তু বিষয়টি আমরা শুনেছিলাম কৌতুকের সঙ্গে। সবাই খুব মজা পেয়েছে এই ঘটনা শুনে।
কিন্তু এখন আপনি আমাকে বললেন, ব্রিটিশ ও মুঘল সম্রাটের অবস্থা ব্যাখ্যা করে। আমি জানতে পারলাম তুলনামূলক অবস্থা হিসেবে।
সাবাস, মির্জা সাবাস। আমি তোমাকে বিষয়টি বোঝাতে পেরেছি।
আর কোনো ঘটনা আছে? মনে পড়ে?
শুনেছিলাম একটি ঘটনা। একবার এক ইংরেজকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর প্রধান হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছিলেন সম্রাট। সেই সেনাপ্রধান সম্রাটকে নজরানা দিতে গিয়েছিলেন। তার সঙ্গে আরও কয়েকজন ছিলেন। সবাই একে একে সম্রাটকে অভিবাদন করেছিলেন। তারপরে স্বর্ণমুদ্রা উপঢৌকন দিয়েছিলেন। সম্রাট ওদের দিকে তাকিয়েও দেখেননি।
সম্রাটের দরবারের জৌলুস কমে এলেও তাদের আত্মমর্যাদা প্রখর আছে। এটাই আমাকে খুশি রাখছে।
হ্যাঁ, মির্জা নওশা, অভিজাত মুসলমানদের জন্য মুঘল সম্রাট এখনও বেহেশত। এভাবে যদি থাকে তাহলেও আমরা মনে করবো আমরা ভালো আছি।
আমার গজল নিয়ে আমি কবে দরবারের মুশায়রায় যেতে পারবো?
ধৈর্য ধরো মির্জা নওশা।
শ্বশুরের উপদেশে গালিবের মন খারাপ হয়। তাঁরতো ধৈর্য ধরতে ভালো লাগছে না। দিল্লির বাইরে লক্ষ্ণৌতেও তাঁর কবিতার খ্যাতি পৌঁছেছে। মীর তকী তাঁর প্রশংসা করেছেন। তারপরও কি বাদশাহর দরবারে পৌঁছার সময় হয়নি?
বাড়ি ফেরার পথে আবার মীর তকীর উপদেশের কথা মনে হলো। একজন ভালো ওস্তাদ তাঁকে সঠিক পথ দেখাবে, কিন্তু তাঁর ওস্তাদ দরকার নেই। তিনি মনে করেন তিনি সঠিক পথে আছেন। তাঁর অভিজ্ঞতাই তাঁর ওস্তাদ। জীবনের কাছ থেকেই তিনি দর্শনের শিক্ষা পেয়েছেন। তাঁর দুঃখ আছে, কারাগারের বন্দী জীবনের অনুভব আছে, প্রেম আছে, আর্থিক কষ্ট আছে, আভিজাত্যের অহংকার আছে—এতো কিছুই তো একজন কবির ওস্তাদ। কবির আবার একজন ওস্তাদ লাগবে কেন, যে তাঁকে সারাক্ষণ শেখাতে থাকবে, উপদেশ দেবে? না, আমি ঠিক পথেই আছি।
গালিব পালকি থামিয়ে তুফতার বাড়িতে নামলেন। তুতা তখন বৈঠকখানায় বসে আরও অনেকের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলেন। গালিবকে দেখে সহাস্যে বললেন, কি খবর মির্জা সাহেব? ভালো আছেন তো?
জরুর, ভালো আছি।
বসুন। আপনি এসে আমাদের আড্ডা জমজমাট করে দিলেন। পকেটে গজল আছে তো?
পকেটে আজ গজল নেই। আমি হযরত ইলাহি বখশের কাছে মুঘল সাম্রাজ্যের দিনকালের কাহিনী শুনতে গিয়েছিলাম।
হ্যাঁ, আপনার শ্বশুর কবি মঅরুফ তো এসব বিষয় ভালো জানেন।
দরবারের জৌলুস কমে এসেছে, নজরানাও কমে এসেছে, সম্রাটের দেয়া খিলাও সস্তা দামের হয়ে পড়েছে।
তুফতা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কিন্তু এখন পর্যন্ত সম্রাটই সর্বেসর্বা। তিনি সর্বময় কর্তৃত্বের অধিকারী।
মারহাবা! মারহাবা!
গালিব ছাড়া বাকিরা হর্ষধ্বনি করে। যেন এটি একটি আনন্দদায়ক ঘটনা। গালিব চুপ করে থাকেন।
তুফতা জোর দিয়ে বলেন, সম্রাট এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার উৎসে আছেন। এখনো যে কোনো উৎসবের সময় তাঁকে সাত রকম শস্য, প্রবাল, রুপা দিয়ে ওজন করা হয়। অবশ্য আর্থিক সংকটের কারণে আর আগের মতো হীরে-জহরৎ, সোনা দিয়ে ওজন করা হয় না।
তুফতা থামতেই আর একজন বয়সী মানুষ বলেন, এখনো বকরি-ঈদের দিন তাঁর নামে উট জবাই করা হয়। তার জন্মদিন দেওয়ানী-আম-এর সরকারি উৎসবের দিন। তিনি অসুস্থ হলে তাঁর জন্য প্রার্থনার আয়োজন করা হয়।
তুফতা গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, আমরা এখনো সম্রাটের শাসন চাই। এই হিন্দুস্থানে সম্রাটই শাসনের ক্ষমতায় থাকবেন।
মারহাবা, মারহাবা। বহুৎ আচ্ছা বাৎ।
এবার গালিবও অন্যদের সঙ্গে হর্ষধ্বনি করেন। সম্রাটের আর্থিক দুর্বলতার দিকটি তাঁর মন খারাপ করে দিলেও সবার হর্ষধ্বনি তাঁকে উৎফুল্ল করে। তিনি মনের জোরও পান।
তুফতা আবার বলেন, আগে সম্রাটের কাজকর্ম সাধারণ মানুষকে জানানোর জন্য কাগজ প্রকাশ করা হতো। এখন আর সেটা করা হচ্ছে না। সাধারণ মানুষ এখনও তাকে পীর ও মুরশিদ মনে করে। তিনি সাধারণ মানুষের আধ্যাত্মিকতার গুরু। দিল্লির বাইরেও তাঁকে এভাবেই দেখা হয়। দিল্লির ছোট ছোট রাজ্যের শাসকদের, এমনকি মারাঠের ব্যবহৃত মুদ্রাতে সম্রাট শাহ আলমের নাম খোদাই করা আছে।
যে বয়সী ব্যক্তি আগে কথা বলেছিলেন তিনি আবার বলেন, এই একই প্রথা গোয়ালিয়রেও প্রচলিত ছিল। ওদের মুদ্রায় মুঘল সাম্রাজ্য ব্রিটিশদের হাতে চলে যাবার পরও দ্বিতীয় আকবরের নাম মুদ্রিত ছিল।
গালিব উৎফুল্ল কণ্ঠে বলেন, ইতিহাসের নানা কিছু জানার চেষ্টা করছিলাম বেশ কিছুদিন ধরে। আজ অনেককিছু জানা হলো। শুকরিয়া তুফতা। এখন যাই?
আমাদেরকে গজল না শুনিয়ে যাবেন?
সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঠিক করলেন তাঁর কবিতা নিয়ে যেসব সমালোচনা হচ্ছে এদের সামনে আজ তার একটু জওয়াব দেবেন।
মনে মনে নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে আবৃত্তি করলেন :
‘প্রশংসার কাঙাল আমি নই
পুরস্কারের জন্যও নই লালায়িত
কবিতা যদি অর্থবহ নাও হয়
তবে আমার সত্যি কিছু যায় আসে না।’
একটু থেমে আবার বললেন :
‘কপাল আমার। রচনাগুলো যে সত্যিই জটিল।
সেগুলি পড়ে খ্যাতিমান ও লব্ধ-প্রতিষ্ঠ
কবিরা বলেন, সোজা গড়নে লেখ!
কিন্তু আমার পক্ষে যে সবচেয়ে কঠিন
সহজ চালে কিছু লেখা।’
তিনি থামলে অন্যরা বললেন, মারহাবা, মারহাবা। তুফতা মৃদু হেসে বাহবা দিয়ে বললেন, মির্জা সাহেব আমার মনে হয় আপনার মনে আরও কিছু পঙ্ক্তি আছে।
আছে, আছে, বলে তিনি বললেন,
‘শব্দের জাদুকরী সম্ভার থেকে
সঠিক চয়ন গালিবই করতে পারে।’
আবৃত্তি শেষ করার সঙ্গে সঙ্গে আবার তুমুল করতালিতে ভরে গেলো ঘর। গালিবের মুখে পরিতৃপ্তির হাসি খেলে যায়। এখানকার শ্রোতারা তাঁকে আঘাত করার জন্য মুখিয়ে নেই। এরা হৃদয় দিয়ে তাঁকে অভিনন্দিত করেছে। গালিবের মনে হয় তাঁর মাথা আকাশ সমান উঁচু হয়ে গেলো। আনন্দের শেষ নেই আর।
তুফতা গালিবকে বুঝতে পারেন। গালিব কিসের জবাব দিলেন তাও বুঝতে পারেন। তিনি খুশি হন এই ভেবে যে কবিকে দুঃখ থেকে পরিত্রাণ দেয়ার এটিই সহজ উপায়। নইলে কবি দুঃখের আগুনে পুড়তেই থাকেন।
পালকিতে ওঠার সময় তিনি তুতাকে বলেন, শুকরিয়া ।
তুফতা খুশি হয়ে তাঁর দুহাত জড়িয়ে ধরেন। গালিবের বুকের ভেতর থেকে সব ভার নেমে যায়। তিনি প্রবল শক্তিতে নিজের ভেতরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। পালকিতে বসে মুখে মুখে বলতে থাকেন :
‘যদি আগুন জোরদার হয়
আমি তাকে দ্বিগুণ বাড়াতে পারি
বুঝতে পারি মৃত্যুকেও
খোলা তলোয়ারের রশিতে
নিক্ষেপ করতে পারি নিজের শরীর
খেলা করি ছোরাছুরি নিয়ে আর-
চুম্বনে স্পর্শ করি তীক্ষ্ণমুখ তীরগুলিকে।’
তিনি অনবরত বলে যেতে থাকেন নিজের রচিত শের নিজেকেই। পালকির ভেতরে তাঁর কণ্ঠস্বর গুনগুন ধ্বনি তোলে। তিনি নিজের ভেতরে মগ্ন হতে থাকেন।
পালকি এসে থামে বাড়ির দরজায়। তিনি পালকি থেকে নামতে ভুলে যান।
বেহারারা ডাকে, হুজুর। তিনি সাড়া দেন না।
হুজুর আমরা বাড়িতে এসে গেছি। তিনি সাড়া দেন না।
কাল্লু মিয়া হাঁটু গেঁড়ে বসে ডাকে, হুজুর নামুন
আমিতো নামতেই চাই। আমাকে তোমাদের বলতে হবে কেন?
আপনি তো নামছেন না হুজুর।
তোমরা যাও আমি নামবো। আমার যখন মনে হবে তখন।
পালকির ভেতরে গরম লাগবে হুজুর। হাতপাখা আনবো?
না, আমি ভালো আছি। এখন আমার মাথার ভেতরে গজলের বর্ষা। তুমি যাও কাল্লু মিয়া।
কাল্লু মিয়া সরে যায়। দূরে গিয়ে বসে থাকে। শুনতে পায় গালিবের কণ্ঠস্বর :
‘আকাঙ্ক্ষায় আক্রান্ত এই হৃদয়
এখানে যে, আর একটুও জায়গা নেই
যেখানে পূর্ণতা আসতে পারে;
তবুও ঝিনুকের মধ্যে গর্জন করে চলে
সেই অশান্ত এক সমুদ্র—’
এই একটি পক্তি রচনা করার জন্য তিনি পালকির ভেতর বসে আছেন-তিনি নিজে এক অশান্ত সমুদ্র। পালকির মতো ঝিনুকে বসে গর্জন করছেন। ওহ, কবিতা!
তিনি পালকির বাইরে পা বাড়ান। শরীর বেরিয়ে আসে। এক ঝলক ঠাণ্ডা বাতাস তাঁকে স্নিগ্ধ করে দেয়। তিনি বুকভরে শ্বাস টানেন। তিনি আকাশের দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে বলেন, দেখো আমার প্রিয় দিল্লি শহর, দেখো বর্ষা-বসন্ত ঋতু, আমি ওদের উপহাসের প্রতিশোধ নিয়েছি।
আমাকে উপহাস করে এমন সাধ্য এ শহরের কারো নেই।
তখন তিনি দেখতে পান মেঘের ফাঁকে সূর্যের চিকন আলোর রেখা। কালুর দিকে মুখ ফিরিয়ে বলেন, কাল্লু আমি ঘরে যাচ্ছি। বেহারাদের এই ঝিনুকটা সরিয়ে নিতে বলো।
কাল্লু হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। বুঝতে পারে না যে পালকি কীভাবে ঝিনুক হয়! শুধু দেখতে পায় দীর্ঘদেহী সুদর্শন মানুষটি নিজের বাড়িতে ঢুকছেন। দিল্লি শহরের মানুষেরা তাঁকে চেনে।
এই চেনা মানুষটির স্নেহছায়ায় তার দিন কাটে ভেবে কাল্লুর মুখে বিজয়ীর হাসি ফুটে ওঠে।