শরৎচন্দ্র

শরৎচন্দ্র

বঙ্কিমচন্দ্রের পর শরতবাবুই দ্বিতীয়জন যিনি আমাদের ভাষার উপন্যাসকে মর্যাদা পূর্ণ জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন। তারপরে বাংলা উপন্যাস তার লিখনের শৈলী খুঁজে পেল। বড় বড় ঔপন্যাসিকরা এলেন। শরৎচন্দ্র সাহিত্যের যে সত্যকে বিশ্বাস করতেন, তা ছিল অতি আধুনিক। সময় থেকে এগিয়ে। আমি তাঁর উপন্যাসের পাঠক, গল্পের পাঠক, এ কিছু নতুন কথা নয়। ভারতে যতগুলি ভাষা আছে সব ভাষায় তিনি অনূদিত। ভারতের মানুষ জানে না শরৎচন্দ্র তাদের ভাষা, হিন্দি, গুজরাতি, মৈথিলি বা তেলেগু, তামিলের লেখক নন। তিনি এতই পঠিত নানা ভাষায়, নানা ভাষার মানুষ বিশ্বাসই যেন করে না শ্রীকান্ত তাদের জীবনের তাদের ভাষার উপন্যাস নয়। বিশ্বজনীনতা একে বলে। যে কারণে আমি হেমিংওয়ের ‘ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্য সি’ পড়ে দূরের মনে করি না, সেই কারণেই শরৎচন্দ্রের শ্রীকান্ত, পল্লী সমাজ, চরিত্রহীন, মহেশ, অভাগীর স্বর্গ সমগ্র ভারতীয় সমাজের লেখা হয়ে ওঠে। শরৎচন্দ্র তাঁর সাহিত্যে আর্ট ও দুর্নীতি প্রবন্ধে লিখছেন, “মানুষ তার সংস্কার ভাব নিয়েই ত মানুষ; এবং এই সংস্কার ও ভাব নিয়েই প্রধানত নবীন সাহিত্য-সেবীর সহিত প্রাচীনপন্থীর সংঘর্ষ বেধে গেছে। সংস্কার ও ভাবের বিরুদ্ধে সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায় না, তাই নিন্দা ও কটু বাক্যের সূত্রপাতও হয়েছে এইখানে। একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি। বিধবা বিবাহ মন্দ, হিন্দুর ইহা মজ্জাগত সংস্কার। গল্প ও উপন্যাসের মধ্যে বিধবা নায়িকার পুনর্বিবাহ দিয়ে কোনও সাহিত্যিকের সাধ্য নাই, নিষ্ঠাবান হিন্দুর চক্ষে সৌন্দর্য সৃষ্টি করবার। পড়বামাত্র মন তাঁর তিক্ত-বিষাক্ত হয়ে উঠবে। গ্রন্থের অন্যান্য সমস্ত গুণই তাঁর কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে…।” তিনি বলছেন বিদ্যাসাগর মহাশয় বিধবা বিবাহ বিধিবদ্ধ যখন করেছিলেন, সমাজ তাকে নেয়নি। হিন্দুর মনের ভিতরে তা প্রবেশ করেনি। অনেক গ্লানি এবং নির্যাতন সহ্য করতে হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে। কিন্তু সেই সময়ের কোনো সাহিত্য-সেবী বিদ্যাসাগরের পক্ষ অবলম্বন করেননি। হয়ত তাঁরা বিধবা বিবাহর পক্ষে ছিলেন না, কিংবা তাঁদের ভয় ছিল, পাঠক নেবে না। সমাজ-রুচির বিরুদ্ধে যাওয়ার সাধ্য হয়নি তাঁদের। ফলে এতবড় ঘটনা সামাজিকভাবে মূল্য পেল না, সাহিত্যের ভিতর দিয়ে তা গৃহস্তের অন্তঃপুরে প্রবেশ করল না। ভাবতে পারল না অন্তঃপুর। কিন্তু তাঁরা যদি উদাসীন না থাকতেন, তাঁদের সাহিত্যের কারণে নিন্দা গ্লানি তাঁদেরও সহ্য করতে হতো সত্য, পাঠকের কাছে সৌন্দর্য তখন সৃষ্টি হত না, কদর্য হতো, কিন্তু ৫০ বছর বাদের সেই কদর্যতাই হয়ে উঠত সৌন্দর্যময়। সাহিত্যের সেই রূপে মুগ্ধ হতো ভবিষ্যতের পাঠক। শরৎচন্দ্র বলছেন, “এমনই তো হয়, সাহিত্য সাধনায় নবীন সাহিত্যিকের এই ত সব চেয়ে বড় সান্ত্বনা। সে জানে আজকের লাঞ্ছনাটাই জীবনে তার একমাত্র এবং সবটুকু নয়; অনাগতের মধ্যে তারও দিন আছে; হউক সে শতবর্ষ পরে কিন্তু সেদিনের ব্যাকুল, ব্যথিত নর-নারী শত লক্ষ হাত বাড়িয়ে আজকের দেওয়া তার সমস্ত কালি মুছে দেবে।”

সাহিত্য নিয়ে এই আশ্চর্য ব্যাখ্যা যে কোনো নবীন লেখককে নতুন পথে যাওয়ার সাহস জোগাবে। আমাকে জুগিয়েছিল। পেরেছি কি পারিনি সে প্রশ্ন অবান্তর কিন্তু শরতবাবুর এই পথকেই সাহিত্যের পথ বলে মেনে নিয়েছি অবনত মস্তকে। কেমন সে পথ, শ্রীকান্ত উপন্যাসের অন্নদাদির কথা ভাবুন। ছিলেন নিষ্ঠাবান হিন্দু ঘরের কন্যা। দুই বোনের বড়টি বিধবা। ছোট, অন্নদার সঙ্গে আশ্রিত যুবকের বিবাহ হলো। একদিন আশ্রিত যুবক, অন্নদার স্বামী তার বিধবা দিদিকে হত্যা করে নিরুদ্দেশ হয়। কেন হত্যা, তা বলেননি অন্নদা। অনেকদিন পরে স্বামী আসে সাপুড়ের বেশে। তার সঙ্গে পালায় অন্নদা, ভালোবাসা ছিল। স্বামী তখন মুসলমান। তাতে কী হয়েছে, নিজের ধর্ম না ত্যাগ করে অন্নদা শাহজীর সঙ্গে গঙ্গার তীরে জীবন কাটিয়ে তো দিল। স্বামী শাহজীর মৃত্যুর পর কবর দিয়ে অন্নদা শাঁখা নোয়া ত্যাগ করে, সিঁথির সিঁদুর মুছে দেয়। ভাবুন এক সঙ্গে স্বামী স্ত্রী হয়ে বাস করছে, একজন হিন্দু, আর একজন মুসলমান। শরতচন্দ্র একশো বছর আগে যা ভেবেছিলেন, ভাবতে পেরেছিলেন, তা আমরা এখন কি ভাবতে পারি। ধর্মে ধর্মে কী বিদ্বেষ! হ্যাঁ, প্রায় এই রকম এক ঘটনা আমি শুনেছি বাংলাদেশের এক পরিবারে। স্বামী কনিষ্ঠা কন্যাকে নিয়ে ইসলাম কবুল করেছেন। স্ত্রী এবং জ্যেষ্ঠা কন্যা হিন্দুই রয়ে গেল। স্বামী মারা গেলে ইসলাম মতে জানাজা কবর ইত্যাদি সম্পন্ন হয়। স্ত্রী শাঁখা সিঁদুর ত্যাগ করে যথাবিহিত শ্রাদ্ধের কাজ করেন। অসামান্য এই জীবন। সমাজের পুঞ্জীভূত অন্ধকার এবং আর্ট, দুইয়ের ভিতরে শরতবাবুর আশ্চর্য যাতায়াত। সমাজের কথা লিখতে গিয়ে শিল্পের দিক অবহেলিত হয়নি বলে এত বছর ধরে তাঁর অনুরাগীর সংখ্যা কমেনি, বেড়ে গেছে। বেড়েই গেছে। ক্রমশ বেড়েছে কারণ তাঁর অনেক কথাই সমকালের থেকে এগিয়ে ছিল, আজ যা পড়ে মুগ্ধ হচ্ছি, অন্নদাদির কথা যেমন, তখন নিশ্চয় তত মুগ্ধতা ছিল না। নভেল পড়লে যে ছেলে গোল্লায় যায় এই কথাটি বাল্যকালে শুনেছি খুব। এখন অন্নদাদির কথা যত ভাবি, মুগ্ধতা যায় না। এই রকম স্রোতের বিপক্ষেই যাওয়াই তাঁর উপন্যাস, পল্লী সমাজ, চরিত্রহীন, গৃহদাহ আর শ্রীকান্ত তো নিশ্চয়ই। আমি ভাগলপুরে সেই গঙ্গা, সেই বট যার ঝুরি ধরে ইন্দ্র বিপুল জলোচ্ছ্বাসে ভরা গঙ্গায় নেমে গিয়েছিল, তা দেখেছি। তখন বাংলা উপন্যাসে ভারতবর্ষ আসত। শরতচন্দ্রের পর দুই বিভূতিভূষণ, সতীনাথ ভাদুড়ী, সকলের লেখায় তা ছিল। পরে তা অনেকটা হয়ে যায় ড্রয়িংরুম নভেল, কিন্তু শরতচন্দ্রের দেবদাস তার মুখ। ব্যতিক্রম তো নিশ্চয় আছে। দেশ, গ্রাম, সমাজ সব নিয়ে ব্যতিক্রম আছে। বড় বড় ঔপন্যাসিক পেয়েছি আমরা যাদের লেখায় মহাপৃথিবী ধরা পড়েছে।

এবার অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি, আর্ট, শিল্প। শরৎবাবু আর্ট বলতেই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। শ্রীকান্ত উপন্যাসে পিয়ারী বাঈ হারিয়ে গেল শ্রীকান্তর জীবন থেকে। চিঠি দিয়ে উত্তর আসে, তার ভিতরে পাটনায় পিয়ারীর বাড়ি যাওয়ার আমন্ত্রণ ছিল না। পিয়ারীর স্মৃতি মলিন হয়ে আসে। তারপর এক সন্ধ্যায়, সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা, খোলা জানালার বাইরে পূর্ণ চন্দ্র, জ্যোৎস্না। চন্দ্রাহত হয়ে শ্রীকান্ত আচমকা বেরিয়ে পড়ে পাটনার টিকিট কেটে রেলগাড়িতে চেপে বসে। পিয়ারীকে মনে পড়েছে যে। কিন্তু নেমে পড়ল পাটনার আগে ‘বাড়’ স্টেশনে। পকেটে দুয়ানি আর দশ পয়সা। সেখানে দেখা বর্ধমানের মেয়ের সঙ্গে, বিয়ে হয়েছে এতদূরে। তার দিদিরও বিয়ে হয়েছিল এখানে। ক’দিন আগে গলায় দড়ি দিয়েছে। বাবার নাম গৌরী তেওয়ারি, নিবাস রাজপুর, বর্ধমান। তাদের বর বর্ধমানে পাওয়া যায় না, তাই এত দূরে বিয়ে দিয়ে মা বাবা খালাস। খোঁজ নেয় না। দরিদ্র ঘরের মেয়ের এমনই হয়। এই মেয়েও মার খায় শ্বশুরবাড়ি। শ্রীকান্ত একটি চিঠি লিখে দেয় গৌরী তেওয়ারিকে। মেয়ের মৃত্যু সংবাদ দিয়ে, আর এক মেয়ের কষ্টের কথা লিখে। কী হয়েছিল জানে না। কিন্তু সনাতন হিন্দু সমাজের রীতিনীতি নিয়ে তিনি যে প্রশ্ন তুলেছেন এখানে তা আজও প্রাসঙ্গিক। কেবল মাত্র টিকে থাকার ভিতরে কি জীবনের সার্থকতা। এই সব আচার বিচার নাকি হিন্দু ধর্মকে টিকিয়ে রেখেছে। একশো বছর আগের কথা আর এই সময়ের কথা কি আলাদা? এতে কি আর্ট ক্ষুন্ন হয়েছে? শরৎচন্দ্রের উপন্যাস রচনার একশো বছর পার হয়েছে ২০১৭-তে। গ্রন্থাকারে শ্রীকান্ত উপন্যাসের প্রকাশকাল ১৯১৭।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

শরৎচন্দ্র
1 of 2

শরৎচন্দ্র

নর্মাল স্কুলে সীতার বনবাস পড়া শেষ হল। সমাসদর্পণ ও লোহারামের ব্যাকরণের যোগে তার পরীক্ষাও দিয়েছি। পাস করে থাকব কিন্তু পারিতোষিক পাই নি। যাঁরা পেয়েছিলেন তাঁরা সওদাগরি আপিস পার হয়ে আজ পেনসন ভোগ করছেন।

এমন সময় বঙ্গদর্শন বাহির হল। তাতে নানা বিষয়ে নানা প্রবন্ধ বেরিয়েছিল–তখনকার মননশীল পাঠকেরা আশা করি তার মর্যাদা বুঝেছিলেন। তাঁদের সংখ্যা এখনকার চেয়ে তখন যে বেশি ছিল তা নয়, কিন্তু প্রভেদ এই যে, তখনকার পাঠকেরা এখনকার মতো এত বেশি প্রশ্রয় পান নি। মাসিক পত্রিকা, বলতে গেলে, ওই একখানিই ছিল। কাজেই সাধারণ পাঠকের মুখরোচক সামগ্রীর বরাদ্দ অপরিমিত ছিল না। তাই পড়বার মনটা অতিমাত্র বিলাসী হয়ে যায় নি। সামনে পাত সাজিয়ে যা-কিছু দেওয়া যেত তার কিছুই প্রায় ফেলা যেত না। পাঠকদের আপন ফরমাসের জোর তখন ছিল না বললেই হয়।

কিন্তু রসের এই তৃপ্তি রসদের বিরলতাবশতই এটা বেশি বলা হল। বঙ্গদর্শনের প্রাঙ্গণে পাঠকেরা যে এই বেশি ভিড় করে এল, তার প্রধান কারণ, ওর ভাষাতে তাদের ডাক দিয়েছিল। আধুনিক বাংলা ভাষার প্রথম আবির্ভাব ওই পত্রিকায়। এর পূর্বে বাঙালির আপন মনের ভাষা সাহিত্যে স্থান পায় নি। অর্থাৎ ভাষার দিক থেকে দেখলে তখন সাহিত্য ছিল ভাসুরের বৈঠক, ভাদ্রবৌ ঘোমটা টেনে তাকে দূরে বাঁচিয়ে চলত, তার জায়গা ছিল অন্দর মহলে। বাংলা দেশে স্ত্রীস্বাধীনতা যেমন ঘেরাটোপ ঢাকা পাল্কি থেকে অল্পে অল্পে বেরিয়ে আসছে ভাষার স্বাধীনতাও তেমনি। বঙ্গদর্শনে সব-প্রথম ঘেরাটোপ তোলা হয়েছিল। তখনকার সাহিত্যিক স্মার্ত পণ্ডিতেরা সেই দুঃসাহসকে গঞ্জনা দিয়ে তাকে গুরুচণ্ডালি ব’লে জাতে ঠেলবার চেষ্টায় ছিলেন। কিন্তু পাল্কির দরজার ফাঁক দিয়ে সেই যে বাংলা ভাষার সহাস্য মুখ প্রথম একটুখানি দেখা গেল, তাতে ধিক্‌কার যতই উঠুক এক মুহূর্তেই বাঙালি পাঠকের মন ভুলেছিল। তার পর থেকে দরজা ফাঁক হয়েই চলেছে।

প্রবন্ধের কথা থাক্‌। বঙ্গদর্শনে যে জিনিসটা সেদিন বাংলা দেশের ঘরে ঘরে সকলের মনকে নাড়া দিয়েছিল সে হচ্ছে বিষবৃক্ষ। এর পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী থেকে দুর্গেশনন্দিনী কপালকুণ্ডলা মৃণালিনী লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি ছিল কাহিনী। ইংরেজিতে যাকে বলে রোম্যান্স। আমাদের প্রতিদিনের জীবযাত্রা থেকে দূরে এদের ভূমিকা। সেই দূরত্বই এদের মুখ্য উপকরণ। যেমন, দূরদিগন্তের নীলিমায় অরণ্য-পর্বতকে একটা অস্পষ্টতার অপ্রাকৃত সৌন্দর্য দেয় এও তেমনি। সেই দৃশ্যছবির প্রধান গুণ হচ্ছে তার রেখার সুষমা, অন্য পরিচয় নয়, কেবল তার সমগ্র ছন্দের ভঙ্গিমা। দুর্গেশনন্দিনী কপালকুণ্ডলা মৃণালিনীতে সেই রূপের কুহক আছে। তা যদি রঙিন কুহেলিকয়া রচিত হয় তবুও তার রস আছে।

কিন্তু নদী গ্রাম প্রান্তরের ছবি আর সূর্যাস্তকালের রঙিন মেঘের ছবি এক দামের জিনিস নয়। সৌন্দর্যলোক থেকে এদের কাউকেই বর্জন করা চলে না, তবু বলতে হবে ওই জনপদের চেহারায় আমাদের তৃপ্তির পূর্ণতা বেশি। উপন্যাসে কাহিনী ও কথা উভয়ের সামঞ্জস্য থাকলে ভালো– নাও যদি থাকে তবে বস্তুপদার্থটার অভাব ঘটলে দুধ খেতে গিয়ে শুধু ফেনাটাই মুখে ঠেকে, তার উচ্ছ্বাসটা চোখে দেখতে মানায়, কিন্তু সেটা ভোগে লাগে না।

বঙ্কিমচন্দ্রের গোড়ার দিকের তিনটে কাহিনী যেন দৃঢ় অবলম্বন পায় নি– তাদের সাজসজ্জা আছে, কিন্তু পরিচয়পত্র নেই। তারা ইতিহাসের ভাঙা ভেলা আঁকড়ে ভেসে এসেছে। তাদের বিনা তর্কে মেনে নিতে হয়, কেননা, তারা বর্তমানের সামগ্রী নয়, তারা যে-অতীতে বিরাজ করে, সে-অতীতকে ইতিহাসের আদর্শেও সওয়াল-জবাব করা চলে না, আমাদের সাধারণ অভিজ্ঞতার আদর্শেও নয়। সেখানে বিমলা আয়েষা জগৎসিংহ কপালকুণ্ডলা নবকুমার প্রভৃতিরা যা-খুশি তাই করতে পারে কেবল তাদের এইটুকু বাঁচিয়ে চলতে হয় যে, পাঠকদের মনোরঞ্জনে ত্রুটি না ঘটে।

আরব্য উপন্যাসও কাহিনী, কিন্তু সে হল বিশুদ্ধ কাহিনী। সম্ভবপরতার জবাবদিহি তার একেবারেই নেই। জাদুকর গোড়া থেকে স্পষ্ট করেই বলেছে, এ আমার অসম্ভবের ইন্দ্রজাল, সত্য মিথ্যা যাচাই করার দায় সম্পূর্ণ ঘুচিয়ে দিয়ে আমি তোমাদের খুশি করব– যেখানে সবই ঘটতে পারে সেখানে এমন কিছু ঘটাব, যাতে তোমরা শাহারজাদীকে বলবে, থেমো না, রাত্রের পর রাত্রি যাবে কেটে। কিন্তু যে-সব কাহিনীর কথা পূর্বে বলেছি সেগুলি দো-আঁস্‌লা, তারা খুশি করতে চায়, সেইসঙ্গে খানিকটা বিশ্বাস করাতেও চায়। বিশ্বাস করতে পারলে মন যে নির্ভর পায় তার একটি গভীর আরাম আছে। কিন্তু যে-গল্পগুলি বিশুদ্ধ কাহিনী নয় কাহিনীপ্রায়, তাদের মধ্যে মনটা ডুব-জলে সঞ্চরণ করে, তলায় কোথাও মাটি আছে কি নেই সে কথাটা স্পষ্ট হয় না, ধরে নিই যে মাটি আছে বৈকি।

বিষবৃক্ষে কাহিনী এসে পৌঁছল আখ্যানে। যে-পরিচয় নিয়ে সে এল তা আছে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে। সাহিত্য থেকে অস্পষ্টতার আবরণ এক পর্দা উঠে গেল–ক্লাসিকাল অস্পষ্টতা বা রোম্যান্টিক অস্পষ্টতা অর্থাৎ ধ্রুপদী বা খেয়ালি দূরত্ব, সীতার বনবাসের ছাঁদ বা রাজপুতকাহিনীর ছাঁদ। মনে পড়ে আমার অল্প বয়সের কথা। তখন চোখে কম দেখতুম অথচ জানতুম না যে কম দেখি। ওই কম দেখাটাকেই স্বাভাবিক বলে জানতুম, কোনো নালিশ ছিল না। এমন সময় হঠাৎ চশমা পরে জগৎটা যখন স্পষ্টতর হল তখন ভারি আনন্দ পেলুম। বিজয়বসন্তেও একদিন বাঙালি পাঠক সন্তুষ্ট ছিল, তখন সে জানত না গল্পে এর চেয়ে স্পষ্টতর জগৎ আছে। তার পরে দুর্গেশনন্দিনীতে চমক লাগল, এটা তার কাছে অভূতপূর্ব দান। কিন্তু তখনো ঠিক চশমাটি সে পায় নি, তবু দুঃখ ছিল না, কেননা, জানত না যে সে পায় নি। এমন সময়েই বিষবৃক্ষ দেখা দিল। কৃষ্ণকান্তের উইল সেই জাতেরই, সে যেন আরো স্পষ্ট।

তার পরে এলেন প্রচারক বঙ্কিম। আনন্দমঠ, দেবীচৌধুরানী, সীতারাম, একে একে আসরে এসে উপস্থিত, গল্প বলবার জন্যে নয়, উপদেশ দেবার জন্যে। আবার অস্পষ্টতা সাধু অভিপ্রায়ের গৌরবগর্বে সাহিত্যে উচ্চ আসন অধিকার করে বসল।

আনন্দমঠ আদর পেয়েছিল। কিন্তু সাহিত্যরসের আদর সে নয়, দেশাভিমানের। এক-এক সময়ে জনসাধারণের মন যখন রাষ্ট্রিক বা সামাজিক বা ধর্মসাম্প্রদায়িক উত্তেজনায় বিচলিত হয়ে থাকে সেই সময়টা সাহিত্যের পক্ষে দুর্যোগের সময়। তখন পাঠকের মন অল্পেই ভোলানো চলে। শুঁট্‌কি মাছের প্রতি আসক্তি যদি অত্যন্ত বেশি হয় তা হলে রাঁধবার নৈপুণ্য অনাবশ্যক হয়ে ওঠে। ওই জিনিসটার গন্ধ থাকলেই তরকারির আর অনাদর ঘটে না। সাময়িক সমস্যা এবং চল্‌তি সেন্টিমেন্ট, সাহিত্যের পক্ষে কচুরিপানার মতোই, তাদের জন্যে আবাদের প্রয়োজন হয় না, রসের স্রোতকে আপন জোরেই আচ্ছন্ন করে দেয়।

আধুনিক য়ুরোপে এই দশা ঘটেছে– সেখানে আর্থিক সমস্যা, স্ত্রী-পুরুষের সমস্যা, বিজ্ঞান ও ধর্মের দ্বন্দ্ব-সমস্যায় সমাজে একটা বিপর্যয় কাণ্ড চলছে। লোকের মন তাতে এত বেশি প্রবলভাবে ব্যাপৃত যে, সাহিত্যে তাদের অনধিকারপ্রবেশ ঠেকিয়ে রাখা দায়, নভেলগুলি গল্পের মালমসলামাখা প্রবন্ধ হয়ে উঠল। এতে করে সাহিত্যে যে স্তূপাকার আবর্জনা জমে উঠেছে সেটা আজকের পাঠকদের উপলব্ধিতে পৌঁচচ্ছে না, কেননা, আজ সাহিত্যের বাহিরের মাল নিয়ে তাদের মন ষোলো-আনা ভর্তি হয়ে রয়েছে। আর-এক যুগে এই-সব আবর্জনা বিদায় করবার জন্যে গাড়িতে যমের বাহন মহিষ অনেকগুলো জুৎতে হবে।

আমার বক্তব্য এই যে আর্টিস্টের, সাহিত্যিকের প্রধান কাজ হচ্ছে দেখানো, বিশ্বরসের পরিচয়ে আবরণ যত কিছু আছে তাকে অপসারণ করা। রসের জগৎকে স্পষ্ট করে মানুষের কাছে এনে দেওয়া, মানুষের একান্ত আপন করে তোলা। সীতার বনবাস ইস্কুলে পড়েছিলাম। সেটা ইস্কুলের সামগ্রী। বিষবৃক্ষ পড়েছিলুম ঘরে, সেটা ঘরেরই জিনিস। সাহিত্যটা ইস্কুলের নয়– ওটা ঘরের। বিশ্বে আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ করবার জন্যেই সাহিত্য।

বিষবৃক্ষের পর কৃষ্ণকান্তের উইলের পর অনেক দিন কেটে গেল। আবার দেখি গল্প-সাহিত্যে আর-একটা যুগ এসেছে। অর্থাৎ আরো একটা পর্দা উঠল। সেদিন যেমন ভিড় করে রবাহূতের দল জুটেছিল সাহিত্যের প্রাঙ্গণে আজও তেমনি জুটেছে। তেমনি উৎসাহ, তেমনি আনন্দ, তেমনি জনতা। এবারে নিমন্ত্রণকর্তা শরৎচন্দ্র। তাঁর গল্পে যে-রসকে তিনি নিবিড় করে জুগিয়েছেন সে হচ্ছে সুপরিচয়ের রস। তাঁর সৃষ্টি পূর্বের চেয়ে পাঠকের আরো অনেক কাছে এসে পৌঁছল। তিনি নিজে দেখেছেন বিস্তৃত করে, স্পষ্ট করে, দেখিয়েছেন তেমনি সুগোচর ক’রে। তিনি রঙ্গমঞ্চের পট উঠিয়ে দিয়ে বাঙালি সংসারের যে আলোকিত দৃশ্য উদ্‌ঘাটিত করেছেন সেইখানে আধুনিক লেখকদের প্রবেশ সহজ হল। তাদের আনাগোনাও চলছে। একদিন তারা হয়তো সে কথা ভুলবে এবং তাকে স্বীকার করতে চাইবে না। কিন্তু আশা করি পাঠকেরা ভুলবে না। যদি ভোলে সেটা তাদের অকৃতজ্ঞতা হবে। তাও যদি হয় তাতে দুঃখ নেই; কাজ সমাপ্ত হয়ে গেলে সেই যথেষ্ট। কৃতজ্ঞতাটা উপরি-পাওনা মাত্র; না জুটলেও নালিশ না করাই ভালো। নালিশের সময়ও বেশি থাকে না, কারণ সব শেষে যাঁর পালা তিনি যদি-বা দলিলগুলোকে রক্ষা করেন স্বত্বাধিকারীকে পার ক’রে দেন বৈতরণীর ওপারে।

২৭ শ্রাবণ, ১৩৩৮

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *