শরৎচন্দ্র এবং রসিকতা
একদা সুপ্রচলিত (কিন্তু এখন অনিয়মিত) লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘সাগরপারে’ পত্রিকার প্রবীণ সম্পাদক ডা. হিরন্ময় ভট্টাচার্য সম্প্রতি ডাকে আমাকে একটি ক্ষুদ্র পুস্তিকা পাঠিয়েছেন।
বইটি একটি একাঙ্ক নাটিকা, নাম ‘রসিক শরৎচন্দ্র’।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, ঠিক এই নামে হিরন্ময়বাবুর একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থও আছে। একই নামের সেই বইটি শরৎচন্দ্রের রসিকতা এবং অনুরূপ বিষয়াদি নিয়ে রম্যরচনাধর্মী প্রবন্ধের সংকলন।
ঠিক এই জাতীয় আরও অনেকগুলি বই হিরন্ময়বাবু ইতিপূর্বে রচনা করেছেন, যেমন— রসিক রবীন্দ্রনাথ, রসিক সুভাষচন্দ্র।
ভাষার প্রাঞ্জলতা এবং সরসতার গুণে তথ্যবহুল এই বইগুলি পাঠক মহলে বেশ জনপ্রিয়।
‘রসিক শরৎচন্দ্র’ নাটিকাটি নিতান্ত ক্ষুদ্র আকারের, বড়জোর তিন হাজার শব্দের। বড় বড় পাইকা হরফে ছাপা। মূল রচনাটি বড় জোর হাফ ক্রাউনের কুড়ি-বাইশ পৃষ্ঠা হবে, অর্থাৎ হাজার তিনেক শব্দ।
এই নাটিকাটি অভিনীত হয়েছিল গত বছরের গ্রীষ্মে লন্ডন শহরে কনওয়ে হলে।
‘বিশ্ববঙ্গ সাহিত্য সম্মেলন’ হয়েছিল লন্ডন শহরে। সেখানেই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে এই ‘রসিক শরৎচন্দ্র’ নাটিকাটি মঞ্চস্থ হয় আটানব্বুই সালের তেইশে মে তারিখে।
শ্রোতাদের পছন্দসই হয়েছিল নিশ্চয়ই, তা না হলে হিরন্ময়বাবু এই পুস্তিকার ভূমিকায় একথা বলতেন না যে, ‘তিন অঙ্কের একটি পূর্ণাঙ্গ নাটকের ইচ্ছে আছে।’
সে যা হোক, এই নাটিকাটি শরৎচন্দ্রের একটি অপারেশন নিয়ে। হিরন্ময়বাবু নিজে সম্ভবত ডাক্তার। এই নাটকের প্রথম দিনের অভিনয়ের অধিকাংশ কুশীলবই দেখা যাচ্ছে চিকিৎসক, নাটকের বিষয়বস্তুও ডাক্তারি সংক্রান্ত।
অল্প বয়সে, যখন শরৎচন্দ্র লেখক হননি সেই সময়ে তাঁকে হার্নিয়া অপারেশন করাতে হয়, সেই অপারেশনটি হয়েছিল একটি ছোট হাসপাতালে।
শরৎচন্দ্রের অপারেশন করতে গিয়ে সেই হাসপাতাল এক ধরনের অভাবিত গোলমালে পড়েছিল। ব্যাপারটা রীতিমতো হাসির ঘটনা।
সেই ঘটনা নিয়েই এই নাটিকা। খুব সংক্ষিপ্ত করে মূল ব্যাপারটা বলি।
কথিত আছে, অতি অল্প বয়েসেই শরৎচন্দ্র নানারকম নেশাভাং করতেন। ফলে অপারেশনের আগে যখন শরৎচন্দ্রকে ক্লোরোফর্ম দিয়ে অজ্ঞান করার কথা, তিনি আর সহজে অজ্ঞান হন না। নিয়মিত নেশা করার ফলে ওই ক্লোরোফর্মের প্রভাব নেই তাঁর ওপরে।
এখানে হাসপাতালের ডাক্তারের ডায়ালগটি তুলে দিচ্ছি—
‘হায়! হায়! বদমায়েশটা আমার চার আউন্স ক্লোরোফর্ম হজম করে ফেলল।…কত কষ্টে ভিক্ষে-সিক্ষে করে আমি হাসপাতাল চালাই। এ রকম আর কয়েকটা কেস পেলেই আমার দফা রফা—লালবাতি জ্বালিয়ে ছাড়বে।’
বলাবাহুল্য, এ গল্প শরৎচন্দ্রের নিজেরই বলা। নিজের সম্পর্কে শরৎচন্দ্র এ রকম গল্প অনেকই বলেছেন। তার সব হয়তো সত্যি নয়, নেহাতই মজা করার জন্য বলা।
শরৎচন্দ্রের কথা নয়, শরৎচন্দ্রকে নিয়ে অন্য এক শরৎচন্দ্রের কথা বলি।
শরৎচন্দ্রের সময়ে আর একজন শরৎচন্দ্র খুব বিখ্যাত ছিলেন, তিনি হলেন মুর্শিদাবাদ জেলার শরৎচন্দ্র পণ্ডিত, যিনি দাদাঠাকুর নামে সমধিক পরিচিত ছিলেন। এই দাদাঠাকুর অত্যন্ত সুরসিক ছিলেন। তিনি একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, তার নাম ‘বিদূষক’।।
সেই সময়ে শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর সঙ্গে এক সমাবেশে দাদাঠাকুর শরৎচন্দ্রের দেখা হয়েছে। শরৎচন্দ্র তাঁকে দেখে হেসে সম্বোধন করলেন, ‘এই যে ‘বিদূষক’ শরৎচন্দ্র।’
সঙ্গে সঙ্গে দাদাঠাকুর বললেন, ‘এই যে ‘চরিত্রহীন’ শরৎচন্দ্র!’