শর্টকাট

শর্টকাট

লাল জামা কালো প্যান্ট পরে, এক কাঁধে কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে, চুল ব্যাকব্রাশ করে বাড়ি থেকে বেরতেই দীপুর মনে হল কাজটা বোকামো হয়ে যাচ্ছে৷ ফুটপাথ থেকে দশটাকা দিয়ে কেনা চটি-বইয়ের উপর এতটা বিশ্বাস না করলেই ভালো হত৷ বিশেষ করে বইয়ের লেখকের নামটা মোটেই সুবিধের নয়—বিশ্লেষণ কর৷ ছদ্মনাম কি না কে জানে৷ তবে তার লেখা পুস্তিকাটির নাম শর্টকাট৷ দৈন!rদন জীবনের নানারকম সমস্যা সমাধানের শর্টকাট উপায় বাতলে দেওয়া আছে তাতে৷

এমনিতে রাস্তাঘাটে কোথাও বইপত্র দেখলে দাঁড়িয়ে পড়া দীপুর স্বভাব৷ কালও ট্রেন থেকে নেমে ম্যাগাজিন কিনবে বলে দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ এমন সময় চোখে পড়ল ছোটোছোটো রংচঙে বইয়ের ফাঁকে অনুজ্জ্বল পুরোনো বইখানা৷ কেমন যেন মায়া লাগল দীপুর৷ রং উঠে গেছে বলে কারও চোখ পড়ে না তাতে৷ নীচু হয়ে বইটা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখেছিল দীপু৷ ‘বিশ্লেষণ কর’ ভদ্রলোক নাকি একসময়কার নাম করা মনোবিজ্ঞানী৷ মানুষের কনসাস আর সাবকনসাস মনের যাবতীয় খুঁটিনাটি নাকি তার হাতের মুঠোয়৷ সেই জ্ঞান আর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়েই জনসাধারণের উদ্দেশে বইটা লিখেছেন তিনি৷

অন্তত গোটা কুড়ি পরিচ্ছেদে ভাগ করা আছে বইটা—‘ভূতের ভয় ছাড়ানোর উপায়৷’ ‘কাজের চাপেও মাথা ঠান্ডা রাখার উপায়’, এমনকি রাস্তাঘাটে হিসি পেলে কী করে শুধু মনের জোরে সেটাকে চেপে রাখতে হবে তারও উপায় বলা আছে৷ সূচিপত্রটা ভালো করে দেখতে দেখতে একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল দীপুর, ‘পছন্দের মানুষকে নিজের ভালোবাসার কথা জানানোর উপায়৷’

সাতাশ নম্বর পাতা থেকে শুরু হচ্ছে সেটা৷ সেই পাতাটা খুলতেই দেখল ব্যাপারটা নিয়ে দীর্ঘ প্রবন্ধ লিখেছেন বিশ্লেষণ কর৷ বলেছেন—ব্যাপারটা আমরা যতটা সহজ ভাবি ততটা সহজ নয়৷ এগোতে হবে ধীরে ধীরে৷ একটু একটু করে তার অবচেতন মনের ভিতর ঢুকে পড়তে হবে৷ এমনভাবে ঘাঁটি গেড়ে বসতে হবে যে না বলার উপায় আর থাকবে না তার৷ অবশ্য ভদ্রলোক শুধু বিশ্লেষণ করেই খান্ত হননি৷ কীভাবে মনে ভিতরে ঢুকে পড়তে হবে তার অন্তত শখানেক শর্টকাটও বলে দিয়েছেন৷ সেগুলো অক্ষরে অক্ষরে ফলো করলে ফিল্মের হিরোইন থেকে ইংল্যান্ডের রানি পর্যন্ত হ্যাঁ বলতে বাধ্য৷

দীপুর অবশ্য ফিল্মের নায়ক-নায়িকাদের উপর কোনও ঝোঁক নেই৷ বইটার গায়ে দাম লেখা ছিল কুড়ি টাকা৷ তবে পুরোনো বই বলে দশটাকাতেই দিয়ে দিল দোকানদার৷ সেদিন বইটা পকেটে ঢুকিয়েই বাড়ি এসেছিল দীপু৷ রাতের আগে খুলেও দেখেনি৷ ঘুমাতে যাবার আগে হিয়া একটা মেসেজ করেছিল, সেটা দেখেই আবার বইটার কথা মনে পড়ে গেল তার৷ তড়াক করে বিছানা থেকে উঠে খুলে ফেলল সাতাশ নম্বর পাতা৷ প্রায় এক নিঃশ্বাসে প্রথম থেকে শেষ অবধি খুঁটিয়ে পড়ে ফেলল৷ সত্যি কি কাজে দেবে বইটা? যদি হিতে বিপরীত হয়?

অবশ্য সেটা জানার একটা সহজ উপায় আছে৷ বইয়ের আঠেরো পাতায় ভূতের ভয় কমানোর উপায় লেখা আছে৷ দরজা জানলা বন্ধ করে ঘরের আলো নিভিয়ে ল্যাপটপে ভূতের সিনেমা চালিয়ে দিল সে৷

এমনিতে দীপু ভূতে খুব একটা ভয় পায় না কিন্তু কিছুদিন আগেই পাশের বাড়ির ভাড়াটে দাদু মারা গেছেন৷ এই ক-দিনে নাকি বেশ কয়েকবার বাড়ির আশপাশে দেখাও গেছে তাঁকে৷ সেই ভেবেই গা’টা ছমছম করছিল সারাদিন, তার উপরে ভূতের সিনেমা৷ খানিকটা ভয়ই লাগল তার৷

বইতে লেখা আছে যে ভূতের ভয় তাড়ানোর একমাত্র উপায় হল আরও বেশি করে ভয়ের মুখোমুখি দাঁড়ানো৷ যে ব্যাপারটা এখনও আমাদের কাছে অজ্ঞাত একমাত্র সেটাকেই ভয় পাই আমরা৷ আমাদের অবচেতন মনই ভয়ের মূর্তি তৈরি করে, আর সচেতন মন সেই মূর্তিকে ভয় পায়৷ ব্যাপারটা ভেবে দেখতে ভয়টা খানিকটা কমল দীপুর৷

বইতে লেখা আছে রাতে একা শুয়ে ভয় পেলে চাদর দিয়ে মুখ ঢাকা না দিতে৷ তাতে নাকি ভয় আরও জমাট বাঁধতে থাকে৷ ঘরের চারপাশে কিছুক্ষণ পায়চারি করল সে৷ নাঃ ভয়টা সত্যি কেটে গেছে৷ মনটা খুশি হয়ে উঠল দীপুর৷ একটা উপায় কাজ করেছে যখন তার মানে বাকিগুলোও কাজ করার সম্ভাবনা আছে৷ আরও ভালো করে সাতাশ নম্বর পাতা থেকে পড়া শুরু করল সে৷ কী করে হিয়ার মনের ভিতরে আস্তানা গাড়তে হবে সেটা গুছিয়ে জানা দরকার৷ সম্ভব হলে কাল থেকেই তাঁবু খাটানো শুরু হয়ে যাবে৷

মনে মনে দীপু ভাবল ব্যাপারটা অনেকটা এক মাসের ক্রাস কোর্সের মতো৷ একমাস খাটাখাটনি তারপর সার্টিফিকেট৷ আনন্দের চোটে হিয়ার মেসেজটা দেখতেই ভুলে গেছিল সে, এতক্ষণে মোবাইলটা টেনে নিয়ে ইনবক্সটা খুলতেই সেটা চোখে পড়ল, ‘তোর ফিজিক্স বইটা আমার কাছে রয়ে গেছে৷ কাল নিয়ে নিস৷’

সত্যি আজ সারাদিন বইটার কথা মনেই পড়েনি তার৷ ভেবেছিল রাতে একটু পড়াশোনা করবে, কিন্তু বিশ্লেষণ করের বইটা যে সত্যি কাজ করছে সেটা বোঝার পর থেকে অন্য কোন বইতে আপাতত মন বসবে না তার৷ ল্যাপটপটা বন্ধ করে আবার শুয়ে পড়ল সে৷ ঘুম কিন্তু এল না৷ এমন একখানা দুর্দান্ত কাজের বই লোকচক্ষুর আড়ালে কতদিন পড়ে ছিল কে জানে…

কিন্তু ঘুম যে আসছে না, এ কী ফ্যাসাদ হল? বিরক্ত হতে গিয়েও হল না দীপু, মনে পড়ল বইটারই এক জায়গায় লেখা ছিল, অনিদ্রা কাটানোর উপায়৷ আলো জ্বেলে আবার বইয়ের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল সে৷

আজ রাস্তায় বেরতেই কিন্তু লাল জামা আর কালো প্যান্ট কেমন যেন বেখাপ্পা মনে হল দীপুর৷ তাছাড়া এতদিন সে দু-কাঁধে ব্যাগ নিত৷ আজ টেনে টুনে পুরোনো তেরচা ব্যাগটা ঝুলিয়েছে কাঁধে৷ ব্যাকব্রাশ করেছে বলে কপালে একটু বেশি পরিমাণে হাওয়া লাগছে তার৷ কীরকম যেন অস্বস্তি হচ্ছে৷ তবে বিশ্লেষণ কর শর্টকাটে পরিষ্কার লিখেছেন যে তাঁর এই সমস্ত টোটকা প্রথম প্রথম অস্বস্তিকর মনে হলেও পরে গিয়ে সুফল দেবে৷

মোড়ের মাথায় দাঁড়িয়ে মুখ তুলে দেখার চেষ্টা করল দীপু৷ হিয়াকে এখনও দেখা যাচ্ছে না৷ এমনিতেই লেট করে মেয়েটা৷

রাস্তায় মোটামুটি লোকজনের ভিড়৷ সকাল দশটার কাছাকাছি-অফিসটাইম৷ গোটা রাস্তা জুড়ে বাস, রিক্সা, অটো আর দু-একখানা প্রাইভেট গাড়ির মেলা বসেছে৷ যে যার ইচ্ছামতো হর্ন দিচ্ছে৷ বেশিক্ষণ এখানে দাঁড়িয়ে থাকলে এমনিতেই মাথা ধরে যায়৷

রাস্তা থেকে একটু সরে এল দীপু৷ ঘড়ির দিকে তাকাল একবার৷ পকেট থেকে ফোনটা বের করল৷ কললিস্টে গিয়ে হিয়ার নম্বরটা ডায়াল করতে গিয়েও থেমে গেল৷ বইতে ফোন করা নিয়েও কিছু একটা নির্দেশ দেওয়া ছিল৷ রাতে পড়েছিল, কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে ভুলে গেছে৷ ব্যাগের পিছনের চেন থেকে বই বের করে ঊনতিরিশ পাতা খুলে জায়গাটা দেখে নিল সে৷ বড়োবড়ো অক্ষরে লেখা আছে, ‘ছেলেদের গলার আওয়াজ হবে ভারী ও ব্যক্তিত্বপূর্ণ৷ ফচকে ও অপরিণতভাব ফুটে ওঠা উচিত নয়৷’

ভারী গলাটা একবার প্যাকটিস করে নিয়ে আবার নম্বরটা ডায়াল করল সে৷ বার পাঁচেক রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে গলা শোনা গেল, ‘এই যে এসে গেছি প্রায়৷’

‘কতদূর আছিস?’ মোটা গলাটা রাখার চেষ্টা করল দীপু৷ বাড়াবাড়ি হচ্ছে কি?

‘এই তো রিকশায়৷’

‘রোজ এত দেরি করিস কেন বলতো?’

‘রাগ করিস না ভাই আমার৷ আসছি তো৷’

‘হু আয় তাড়াতাড়ি৷’

ফোনটা রাখতে যাচ্ছিল দীপু, আঙুল ছোঁয়ানোর আগেই ওপাশ থেকে আবার গলা শোনা গেল, ‘তোর ঠান্ডা লেগেছে নাকি?’

‘অ্যাঁ? কই না তো৷’

‘তাহলে গলা ভারী হয়ে গেছে কেন?’

সঙ্গে সঙ্গে কোনও উত্তর মাথায় এল না দীপুর৷ একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘বেশি ঘুমিয়ে৷ তুই আয় তাড়াতাড়ি৷’

ফোনটা রেখে এদিক ওদিক একটু ঘুরে বেড়াল দীপু৷ রিকশায় আছে বলেছে মানে এখনও বাড়ি থেকে বেরোয়নি৷ সিগারেটের দোকান দেখে একখানা সিগারেট কিনল৷ তারপর চারপাশ দেখে সেটা ঠোঁটের ডগায় রেখে আগুন ধরাতে যাবে, এমন সময় খানিক দূরে রিকশার প্যাক প্যাক শুনে সেদিকে তাকিয়েই হিয়াকে দেখতে পেল সে৷

‘ধুর ব্যাঙ৷ দশটাকা নষ্ট৷’

সিগারেটটা ফেলে দিয়ে খানিকটা এগিয়ে এল সে৷ দীপুকে দেখেই থমকে দাঁড়িয়েছে৷ রিক্সাওয়ালাকে টাকা দিতে দিতে সে বলল, ‘ব্যাপার কী রে? এসব কী পরেছিস?’

ইতিমধ্যেই দীপুর অস্বস্তিটা বাড়তে শুরু করেছে৷ তাও সেটা মুখে আসতে দিল না সে, ‘ভাবলাম অন্যরকম কিছু করে দেখি৷’

হিয়া তাকে উপর থেকে নীচ অবধি দেখতে দেখতে বলল, ‘তা বলে এমন বিনোদ খান্নার মতো চুল আঁচড়েছিস কেন? কী বিচ্ছিরি লাগছে৷’

‘বিচ্ছিরি লাগছে?’

হিয়া নিজেই হাত দিয়ে দীপুর চুল নামিয়ে দিল৷ তারপর ভেজা হাতটা জামায় মুছতে মুছতে বলল, ‘কার্টুন মনে হচ্ছে৷’

মনে মনে বেশ রাগ হল দীপুর৷ বিশ্লেষণ করের টিপস শুরুতেই তাকে গাড্ডায় ফেলেছে৷ রাস্তার ধারের বইকে বিশ্বাস না করলেই বোধহয় ভালো হত৷

‘তোর হাতে মিনিট কুড়ি টাইম হবে?’

‘আবার মিনিট কুড়ি, এমনিতেই স্যার খেপে আছে আমার উপর৷’

‘খেপে আছে কেন?’

‘সে অনেক কারণ৷’

‘তার মানে যাবি না?’

‘তা তো বলিনি৷ কিন্তু কোথায়?’

‘এই বাজার অবধি গেলেই হবে৷ তুলি কিনব৷’

‘বেশ৷ চল৷’

বাসরাস্তা থেকে খানিকটা দূর দিয়ে হাঁটতে শুরু করল দু-জনে৷ হিয়ার চেহারাটা ছোটোখাটো৷ ফ্যাকাসে রক্তহীন মুখ, রোগাটে৷ সরু ফ্রেমের একখানা চশমা পরে সে৷ এই মুহূর্তে তার এক হাতে রুমাল৷ সেটা দিয়ে থেকে থেকে মুখটা মুছে নিচ্ছে৷ রাস্তা দিয়ে গমগমে ছুটে চলা বাসের ধুলো উড়ে আসছে ওদের দিকে৷ প্যান্টটা মোটেই ফিট হয়নি দীপুর৷ একটু হাঁটতেই মনে হচ্ছে পায়ের উপর চেপে বসেছে সেটা৷

‘তোর বইটা নিয়ে নে৷ আমার ব্যাগে আছে৷’

মনে মনে কী যেন ভাবছিলু দীপু, কথাটা শুনে হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অ্যাঁ? কী বই?’

‘কাল মেসেজ পাঠালাম যে, ফিজিক্স বইটা আমার কাছে৷’

‘ও থাক এখন৷ কোচিংয়ে গিয়ে নেব৷ আমার ব্যাগ এমনিতেই ভারী৷’

‘কাল রাতে কী করছিলি বলতো? একটা রিপ্লাই অবধি দিলি না৷’

‘একটা বই পড়ছিলাম৷’

হিয়া কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল৷ এমন সময় তার মোবাইলটা বেজে উঠল৷ সেটা পকেট থেকে বের করে রিসিভ করল হিয়া৷ তারপর দ্রুত পায়ে খানিকটা এগিয়ে গেল৷ দীপু মনে মনে ভাবতে লাগল এইরকম অবস্থায় কী নির্দেশ দেওয়া ছিল বইটায়৷ ‘মেয়েটিকে অবচেতন মনে এটা বুঝিয়ে দিন যে সে আপনার কাছে অপরিহার্য নয়৷ যদি তা না বোঝাতে পারেন তাহলে আপনার গুরুত্ব কমবে বই বাড়বে না৷’

ব্যাপারটা ভেবে দেখল দীপু৷ কথাটা খারাপ নয়৷ যেটা আমরা নিশ্চিত বলে ধরে নিই সেটার প্রতি বিশেষ কোন টান জন্মায় না৷ ভাবতে ভাবতে কয়েক সেকেন্ড হাঁটার পর দীপু দেখল এতক্ষণে ফোন রেখে দিয়েছে হিয়া৷ সে তাড়াতাড়ি তার পাশে গিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ‘ভাবছি কাল থেকে আর তোর সঙ্গে যাব না৷’

‘কেন?’

উত্তরটা আগে থেকেই সে ভেবে রেখেছিল, ‘এই যে এত দেরি করিয়ে দিস৷’ হিয়া দু-সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিকই বলেছিস৷ আমার জন্য স্যারের কাছে ঝাড় খাস তুই৷’

আর কিছু উত্তর দিল না দীপু৷ বিশ্লেষণ করের কথা শুনে এখনও অবধি খারাপ বই ভালো কিছু হয়নি৷ এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে কাল থেকে হিয়ার সঙ্গেও দেখাও বন্ধ হয়ে যাবে৷

নিজেকে বড্ড বোকা মনে হল দীপুর৷ একটা চটি বইয়ের কথা শুনেই গোলমাল হয়ে গেল৷ এখনও ব্যাগের পিছনের চেনে রাখা আছে সেটা৷ কাল রাতে শর্টকাটগুলো প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছিল৷ আজ কিন্তু মাঝেমাঝেই গুলিয়ে যাচ্ছে পয়েন্টগুলো৷

‘কী বই পড়ছিলিস বললি না তো৷’

মনে মনে বইটার কথা ভাবতে ভাবতে হিয়ার কথা খেয়ালই করেনি দীপু৷ এখন মুখ তুলে বলল, ‘কী?’

‘কিছু একটা হয়েছে তোর আজ৷ কী বই পড়ছিলি?’

‘ওই একটা গল্পের বই৷’

‘কী গল্পের বই?’

বিশ্লেষণ করের বইতে লেখা ছিল মেয়েরা ভালো ইংরাজি জানা ছেলেদের পছন্দ করে৷ এদিকে দীপু চিরকালই ইংরাজিতে কাঁচা৷ সে বেশ বুঝতে পারল এইমুহূর্তে একটা ইংরাজি বইয়ের নাম বলা উচিত, কিন্তু শত চেষ্টা করেও কোনও বইয়ের নাম মনে পড়ল না তার৷ খুব ক্ষীণ একটা গল্প মনে পড়ল বটে৷ তবে সেটা মায়ের কাছে শোনা৷ কস্মিনকালেও বইটা নিজে খুলে দেখেনি৷

‘গালিভার ট্রাভেলস৷’

‘সেই লিলিপুটদের গল্পটা না? আমিও পড়েছিলাম কিন্তু মানে পড়ছে না৷ কার লেখা যেন৷’

মনে মনে প্রমাদ গুনল দীপু৷ কপাল ঘামে ভিজে উঠল তার৷ গল্পের বইটার নাম যে ঠিক ঠিক বলতে পেরেছে এই ঢের, তার উপর আবার লেখক৷ প্রথম দিনই ইংরেজি কপচানোটা কাঁচা কাজ হয়ে গেছে৷ আজ বাড়ি গিয়েই আরটিক্যাল প্রিপোজিশন থেকে শুরু করতে হবে৷ কিন্তু এখন কী হবে? দুরুদুরু বুকে সেকেন্ড গুনতে লাগল সে৷

‘এ বাবা! তোর শরীর খারাপ লাগছে নাকি? এত ঘামছিস কেন?’

‘তা খানিকটা লাগছে…’ দীপু পকেট থেকে রুমাল বের করল৷ হিয়া সেটা দেখে অবাক হয়ে বলল, ‘একী রে! তুই নিজের রুমাল ইউজ করছিস কবে থেকে? এতদিন তো আমারটা দিয়ে চালাতিস৷’

ঘাম মুছতে মুছতে দীপু বলল, ‘এক রুমাল দু-জন ইউজ করলে তাদের ঝগড়া হয়৷’

‘সে তো এমনিও হয়৷’

রুমালটা ভাঁজ করে আবার পকেটে ঢুকিয়ে হাঁটতে লাগল দীপু, হিয়াকে চিন্তিত দেখাল, ‘এমন বই পড়লি যে শরীর খারাপ করে গেল! অবশ্য কেমিস্ট্রি বইটা পড়লে আমারও করে বটে-কিন্তু তুই তো বলছিস গল্পের বই৷’

দীপু আর উত্তর দিল না৷ শখানেক শর্টকাট একসঙ্গে মনে রাখা সম্ভব নয়৷ বিশেষ করে ইংরেজিতে হোঁচট খাবার পর থেকে তার সব মেমোরি একে অপরের ঘাড়ের উপর পড়ে ঘোঁট পাকিয়ে রয়েছে৷ আর একবার বইটা খুলে ঝালিয়ে নেওয়া দরকার৷ কিন্তু হিয়া সামনে থাকলে সেটা করাও যাবে না৷

মিনিট দশেক হাঁটার পর বাজারের সামনে এসে দাঁড়াল দু-জনে৷ বেশ বড়োসড়ো বাজার৷ চাইলে এখানে ডাইনোসরের ডিম থেকে বাঘের দুধ অবধি সবকিছুই পাওয়া যায়৷ পড়াশোনার জিনিসপত্রের জায়গাটা অবশ্য ছোটো৷ সেদিকেই এগিয়ে গেল দু-জনে৷

একবার ঘড়িতে সময় দেখে নিল দীপু৷ ইতিমধ্যে দেরি হয়ে গেছে৷ হোক গে, কাল থেকে তো একাই যাবে, আর দেরি হবে না৷ একটা বইখাতার দোকানের দিকে এগিয়ে গেল হিয়া৷ সঙ্গে সঙ্গে দীপুর চোখে পড়ল দোকানটার ঠিক পাশের ছোটো চট পেতে একটা লোক ফুল বিক্রি করছে৷ নানারকম ফুল, বেশিরভাগের নামই দীপু জানে না৷ তার মধ্যে লাল গোলাপও চোখে পড়ল৷

বিশ্লেষণ করের বইতে গোলাপ নিয়ে প্রায় এক পাতা লেখা আছে— কখন দেওয়া যেতে পারে, কীভাবে দেওয়া যেতে পারে এবং দেওয়ার সময় ঠিক কী ধরনের ভাবভঙ্গি মুখে থাকবে—সব কিছু৷

দীপুর মনে হল একখানা গোলাপ এখন কিনে নিলেই ভালো হত৷ কিন্তু হিয়ার সামনে সেটা করতে গেলেও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে৷ ব্যাপারটা মাথা থেকে সরিয়ে চারপাশে তাকাল সে৷ তাদের ঠিক উলটোদিকেই একটা পাবলিক টয়লেট আছে৷ সেটা চোখে পড়তেই একটা বুদ্ধি খেলে গেল দীপুর মাথায়৷ সে হিয়ার কাঁধে একটা টোকা দিয়ে বলল, ‘তুই তুলি কেন৷ আমি একটু বাথরুম করে আসি৷’

‘আচ্ছা যা৷ দেরি করিস না৷’

‘করব না৷’

বাথরুমের দরজা বন্ধ করেই ব্যাগ থেকে বইটা বের করে ফেলল সে৷ দ্রুত চলে গেল সাতাশ পাতায়৷ চোখ বুলিয়ে শর্টকাটগুলো ঝালিয়ে নিতে লাগল৷ ইতিমধ্যেই একটা ভুল করে ফেলেছে৷ বইতে বলছে আপনারা যদি রাস্তার ডানদিক দিয়ে হাঁটেন তবে মেয়েটি থাকবে আপনার ডানদিকে৷ আর বাঁদিক দিয়ে হাঁটলে বাঁদিকে৷ দীপু ভেবে দেখল এতটা রাস্তা বাঁদিক দিয়েই হেঁটে এসেছে তারা, হিয়া ছিল তার ডানদিকে৷

মাথা নাড়তে নাড়তে সে পরের পাতা ওলটাল৷ উপরের দিকে লেখা আছে, ‘মেয়েটি আপনাকে পছন্দ করে কি না তা জানার উপায়…’

মন দিয়ে জায়গাটা পড়তে লাগল দীপু,

‘মেয়েটিকে বলুন একটি কাল্পনিক প্রজাপতির কথা ভাবতে৷ তারপর বলুন সেই প্রজাপতিতে রং করতে৷ যদি দেখেন প্রজাপতির রং সে বলছে লাল তবে নিশ্চিত হোন সে আপনাকেই পছন্দ করে৷ নীল হলে বন্ধু, হলুদ হলে ভালো বন্ধু, কমলা, সবুজ ও অন্যান্য উজ্জ্বল রং হলে আপনাকে সে কাছের মানুষ বলে মনে করে৷ যদি কালো হয় তবে মেয়েটির আশা ত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়৷’

মনে মনে দীপু ভাবল ব্যাপারটা কাজে দিতে পারে৷ আর কিছু না হোক একটা ফয়সালা অন্তত হবে৷ পয়েন্টগুলো আর একবার ঝালিয়ে নিয়ে সে বাথরুম থেকে বেরিয়ে এল৷ হিয়ার তুলি কেনা হয়ে গেছে৷ উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল সে৷ দীপু বেরিয়ে আসতেই পা চালাতে চালাতে বলল, ‘বড্ড দেরি হয়ে গেল রে, আসলে তুলিটা আজ খুব আর্জেন্ট ছিল৷’

বাজার থেকে বেরনোর আগে ফুলগুলোর দিকে আর একবার দেখে নিল দীপু৷ বিশেষ করে লাল গোলাপগুলো৷ আজকের দিনটা খুব একটা ভালো যাচ্ছে না৷ অন্তত শর্টকাট এখনও কোনও ফল দেখায়নি৷ ব্যাজার মুখে সে হিয়ার ডানপাশে গিয়ে হাঁটতে লাগল৷

বাজার থেকে স্যারের বাড়ি মিনিট দশেকের রাস্তা৷ অর্ধেকটা সময় চুপচাপই কেটে গেল৷ মাঝে এক দু-বার হিয়া জিজ্ঞেস করেছে তার শরীর ঠিক লাগছে কি না৷ দীপু মাথা নেড়ে জানিয়েছে আগের থেকে খানিকটা সুস্থ লাগছে৷ বাড়ির সামনে এসে হিয়া একটু থমকে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুই আগে যা৷ আমি তোর পরে ঢুকলে তোর উপর ঝাড় কম পড়বে৷’

‘না থাক৷ দু-জনেই খাব যখন, ভাগ করে খাব৷’

হিয়া মাথা নাড়িয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগল৷ তিনতলায় স্যারের কোচিং৷ দোতলার সিঁড়ি উঠে এসে কী যেন ভেবে দীপু বলল, ‘আচ্ছা একটা কথা বল তো৷’

‘কী কথা?’ হিয়া অল্প হাঁপাতে হাঁপাতে বলল৷

‘ধর তোকে যদি বলি একটা প্রজাপতি কল্পনা করতে?’

দীপুর দিকে এগিয়ে এল হিয়া৷ তারপর ভুরু কুঁচকে ভালো করে মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর আজ কী ব্যাপার বল তো? শরীর খারাপ না মাথাটা গেছে?’

‘কেন?’

‘লাল নীল জামা পরছিস, রুমাল নিচ্ছিস, ইংরেজি উপন্যাস পড়ছিস, আবার এখন বলছিস প্রজাপতি ভাবতে!’

‘আহা যা বলেছি কর না৷’ দীপু বিরক্ত হয়ে বলে৷

‘আচ্ছা নে, ভাবলাম৷’

‘এবার ওটায় রং কর৷’

‘যে কোনও রং?’

‘হ্যাঁ৷’

‘বেশ৷ তাও করলাম৷’

দীপু মনে মনে কিছু হিসেব করে নিয়ে বলল, ‘কী রং করলি?’

‘আলাবামা ক্রিমসন৷’

‘অ্যাঁ?’

‘অ্যাঁ কী? আলাবামা ক্রিমসন৷’

দীপুর মনে হল এর থেকে গল্পের বইয়ের নামটা সহজে তার মুখে এসেছিল৷ ‘সেটা আবার কী রং?’

‘হয় একরকমের৷ আমার আঁকার বই থাকলে দেখিয়ে দিতাম৷’

দীপুর মনে হল এর থেকে সরাসরি কালো বলে দিলে ভালো হত৷ অন্তত কিছু একটা ফয়সালা হত৷ বিশ্লেষণ কর মনোবিজ্ঞানে পিএইচডি করলেও রং নিয়ে বেশিদূর এগতে পারেনি৷ হতাশ হয়ে সে ঘরের দরজার দিকে পা বাড়াল৷

‘ভুলে গেলি তো? এক্ষুনি আবার ঝাড় খাবি৷’ পিছন থেকে বলল হিয়া৷

‘কী?’

‘ফিজিক্স বইটা৷ কাল থেকে খুলিসনি সেটা স্যারের বুঝতে একটুও দেরি হবে না৷’

‘ও হ্যাঁ৷ কই দে৷’

‘আমার ব্যাগের পিছনের চেনে আছে৷ নিয়ে নে৷’

হিয়ার পিছনে এসে ব্যাগের চেনটা খুলে ফেলল দীপু৷ বেশ কয়েকটা মোটাসোটা বই প্রথমেই চোখে পড়ল৷ নিজের ফিজিক্স বইটা টেনে বের করতেই অদ্ভুত একটা জিনিসে চোখ আটকে গেল দীপুর৷ এতগুলো ভারী বইয়ের ফাঁকে একটা পাতলা চটি বই৷ নিঃশব্দে সেটা একটু উপরে তুলতেই বইটা চিনতে পারল দীপু—শর্টকাট, লেখক বিশ্লেষণ কর৷ কিন্তু এ বইটা হিয়ার কাছে… মুহূর্তে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল তার কাছে৷ একই বইয়ের আর একটা কপি হিয়ার কাছেও ছিল৷ তবে কি বইয়ের সব ক-টা পয়েন্ট হিয়া আগে থেকেই জানত? এতক্ষণ কি তবে… বইটা রেখে দিয়ে দীপু ব্যাগের চেনটা আবার আটকে দিল৷ হিয়া মাথা নীচু করে দ্রুত তার হাতে কিছু একটা গুঁজে দিয়ে দরজার পাল্লা ঠেলে ভিতরে ঢুকে গেল৷ ঘটনার আকস্মিকতায় চমকে গেছিল দীপু৷ এতটা রাস্তা তবে সবই জানত মেয়েটা? ইস… কী বিশ্রীভাবে বোকা হয়েছে সে৷ লজ্জায় দীপুর মুখ লাল হয়ে উঠল৷ হঠাৎ হিয়ার হাতে গুঁজে দিয়ে যাওয়া জিনিসটার কথা মনে পড়ল তার৷ খবরের কাগজে মোড়া লম্বাটে কিছু একটা৷ মোড়কটা ধীরে ধীরে খুলে ফেলতেই দীপুর মুখের লাল রংটা আরও গাঢ় হয়ে উঠল৷ একটা সদ্য কেনা তাজা টকটকে লাল গোলাপ৷ হাসি মুখে গোলাপটা ব্যাগের ভিতরে ঢুকিয়ে চটি বইটা বের করে আনল সে৷ তারপর বারান্দার জানলা গলিয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিল নীচে…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *