শরীফন

শরীফন

কাসিম বাড়ি পৌঁছল। ডান পায়ের মাংসপেশিতে বিঁধে থাকা গুলির অসহ্য যন্ত্রণা।

দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল তার স্ত্রীর লাশ! তার চোখ দিয়ে রক্তক্ষরণ শুরু হল। মাথা ঘুরে গেল তার। কুঠার হাতে পাগলের মতো বেরিয়ে সে হয়তো চারদিকের উন্মত্ত নরহত্যায় যোগ দিত; কিন্তু হঠাৎ তার মনে পড়ে গেল শরীফনের কথা। শরীফন তার মেয়ে।

‘শরীফন, শরীফন’…জোর গলায় সে ডাক দিল।

সামনের দালানের দুটো দরজাই বন্ধ। মেয়ে ভয়ে ভেতরে লুকিয়ে আছে ভেবে কাসিম দরজার কাছে গেল। পাল্লায় মুখ লাগিয়ে আবার ডাকল, ‘শরীফন, শরীফন, আমি! আমি আব্বা!’

কোনো উত্তর নেই।

কাসিম গায়ের জোরে দরজায় ধাক্কা দিতেই পাল্লা দুটো খুলে গেল। সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল দালানের ভিতর। নিজেকে সামলে উঠতে যাবে এমন সময় তার পায়ে যেন কিছু একটা ঠেকল…কাসিম ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার করে উঠল…

এক গজ দূরে এক যুবতীর মৃতদেহ। শরীরে একটা সুতোও নেই। ফর্সা ধবধবে নিটোল শরীর। অনাবৃত দুটি স্তন ঊর্ধ্বমুখী।

কাসিমের শরীর কেঁপে উঠল। তার বুক ফেটে আকাশভেদী আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু বাদ সাধল যেন তালাবন্ধ দুটো ঠোঁট। চোখ দুটো আপনিই বুজে গেছিল। তবু সে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলল। গোঙানির মতো তার গলা থেকে বেরোল, ‘শরীফন…!’

বোঁজা চোখে দালানের এদিক ওদিক হাতড়ে যা কাপড়চোপড় পেল তাই শরীফনের দেহের উপর ফেলে দিয়ে সে বেরিয়ে গেল। ফিরেও দেখল না শরীফনের শরীর আদৌ তাতে ঢাকল কিনা।

বাইরে পড়ে থাকা স্ত্রীর লাশও তার আর চোখে পড়ল না। চোখের সামনে তখন শুধু অনাবৃত শরীফনের নিষ্প্রাণ দেহ। বাড়ির এক কোণে পড়ে থাকা কুঠার তুলে নিয়ে সে পাগলের মতো বেরিয়ে পড়ল।

পায়ে বিঁধে থাকা গুলির কষ্ট, প্রিয় স্ত্রীর মৃতদেহ—সব ঝাপসা। চোখের সামনে শুধুই শরীফন। অনাবৃত নিষ্প্রাণ শরীফন! সেই দৃশ্য তীরের ফলার মতো তার বুককে দীর্ণবিদীর্ণ করে তুলল।

কুঠার হাতে কাসিম জনশূন্য বাজারের মধ্যে দিয়ে ফুটন্ত লাভার মতো এগিয়ে চলল।

মোড়ের কাছে তার সংঘর্ষ বাঁধল এক শিখ যুবকের সঙ্গে। কাসিমের অতর্কিত প্রচণ্ড আক্রমণে সেই যুবক মাটিতে লুটিয়ে পড়ল, প্রবল ঝড়ে উপড়ে যাওয়া গাছের মতো।

গরম তেলে জলের ছিটের মতো কাসিমের রক্ত তখন টগবগ করে ফুটছে…তড়-তড়-তড়-তড়…।

চলতে চলতে সে দূরে দেখতে পেল কয়েকজন লোককে। রাস্তার অন্যদিকে। জ্যা-মুক্ত তীরের মতো সে ছুটে গেল তাদের দিকে। লোকগুলো ওকে ছুটে আসতে দেখে একসঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, ‘হর হর মহাদেব!’

উত্তরে অকথ্য খিস্তি করতে করতে কাসিম কুঠার নিয়ে তাদের আক্রমণ করল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তিনজন ধরাশায়ী হল। বাকিরা ততক্ষণে পালিয়ে গেছে। কাসিম তখনো হাওয়ায় কুঠার চালিয়ে যাচ্ছে। বোধহয় তার চোখ তখনো বন্ধ। কুঠার ঘোরাতে ঘোরাতে হঠাৎ একটা লাশের উপর হোঁচট খেয়ে সে পড়ে গেল। ভাবল কেউ বোধহয় তাকে আক্রমণ করেছে। এই ভেবেই সে দ্বিগুণ জোরে গালাগালি দিতে লাগল, ‘মেরে ফেল আমায়, মেরে ফেল!’

বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল। কোনো আক্রমণের আভাস না পেয়ে চোখ খুলে সে দেখল, রাস্তায় শুধু সে আর তিনটে লাশ।

কয়েক মুহূর্ত সে চুপ করে বসে রইল। সে হয়ত সত্যিই মরে যেতে চাইছিল। এমন সময় শরীফনের মৃতদেহটা হঠাৎ চোখের সামনে ভেসে ওঠায় সে সোজা হয়ে দাঁড়াল আর জ্বলন্ত বারুদের মতো কুঠার হাতে এগিয়ে চলল।

সামনের সব বাজার জনহীন। একটা গলিতে ঢুকে সে দেখল যে সেটা মুসলমানদের গলি। ফুটন্ত লাভার মুখ অন্যদিকে ঘুরে গেল।

যেতে যেতে একটা লোকালয়ে তার হঠাৎ চোখে পড়ল একটা ছোট বাড়ি, সামনে হিন্দিতে কিছু একটা লেখা। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। কাসিম পাগলের মতো তার উপর কুঠার চালাল। দরজাটা টুকরো টুকরো হতে বেশি সময় লাগল না। ভেতরে ঢুকে কাসিম গলায় যথাসম্ভব শক্তি এনে চিৎকার করে গালাগালি করতে লাগল, ‘কে আছে ভেতরে? বাইরে বেরো, বাইরে বেরো শালা!’

সামনের দালানের দরজায় একটা ক্ষীণ শব্দ হল।

কাসিম তখনো চিৎকার করে চলেছে।

কিছুক্ষণের মধ্যে দালানের দরজাটা খুলে গেল। একটি মেয়ে উঁকি মারল।

কাসিমের গলা দিয়ে আওয়াজ বেরোচ্ছিল না। তবু সে ঘড়ঘড় করে জিগ্যেস করল, ‘তুমি কে?’

মেয়েটি শুকনো মুখে ভীত গলায় কেঁপে কেঁপে উত্তর দিল, ‘হিন্দু…’

কাসিম বুক চিতিয়ে উঠে দাঁড়াল। জ্বলন্ত চোখে তাকাল মেয়েটির দিকে। চোদ্দো-পনেরো বছর বয়স হবে। কাসিম হাত থেকে কুঠার ফেলে দিয়ে বাজের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর। তাকে টানতে টানতে দালানে নিয়ে গিয়ে উন্মত্তের মতো তার কাপড়চোপড় ছিঁড়তে শুরু করল। অসহায় কাপড়ের টুকরোগুলো ধোনা তুলোর মতো হাওয়ায় উড়ে এদিক-ওদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

প্রায় আধঘণ্টা ধরে চলল কাসিমের প্রতিশোধ। মেয়েটি মাটিতে পড়েই জ্ঞান হারিয়েছিল। তাই কোনো বাধাও এল না, কোনো আর্তনাদও শোনা গেল না।

যখন কাসিমের হুঁশ ফিরল, চোখ খুলে দেখল তার হাত দুটো মেয়েটির গলা চেপে ধরে আছে। একঝটকায় হাত সরিয়ে নিয়ে সে উঠে বসল।…

এক গজ দূরে এক যুবতীর মৃতদেহ। শরীরে একটা সুতোও নেই। ফর্সা ধবধবে নিটোল দেহ। অনাবৃত দুটি স্তন ঊর্ধ্বমুখী।

কাসিমের চোখ দুটো আপনিই বুজে গেল। সে দু’হাত দিয়ে নিজের মুখ ঢেকে ফেলল। তার ঘর্মাক্ত শরীর তখন বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেছে। ভিতরের ফুটন্ত লাভা জমে পাথর।

কিছু সময় পরে তলোয়ার হাতে একটি লোক বাড়ির ভেতর ঢুকল। ঢুকেই তার চোখে পড়ল দালানে আরেকজন লোক। চোখ বন্ধ। কাঁপা কাঁপা হাতে মেঝের উপর পড়ে থাকা কিছু একটা জিনিসকে কম্বল দিয়ে ঢাকছে।

‘তুমি কে? এখানে কী করছ?!’

কাসিম চমকে উঠে চোখ খুলল। কিন্তু কিছু ঠাহর করতে পারল না।

সশস্ত্র লোকটা চিৎকার করে উঠল, ‘কাসিম!!!’

কাসিম আবার চমকে উঠল। অল্প দূরে দাঁড়ানো লোকটাকে সে চেনার চেষ্টা করল, কিন্তু বৃথা সে চেষ্টা!

সশস্ত্র লোকটা সন্ত্রস্ত গলায় তাকে জিগ্যেস করল, ‘কাসিম, তুমি??? তুমি এখানে?…তুমি এখানে কী করছ?’

কাসিম কাঁপা হাতে মেঝের দিকে ইশারা করে শূন্য গলায় বলল, ‘শরীফন!’

লোকটা তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল। কম্বল সরিয়েই সে কেঁপে উঠল। তার চোখ দুটো আপনিই বুজে গেল। হাত থেকে তলোয়ার মেঝেতে পড়ে গেল। দু’হাত দিয়ে মুখ ঢেকে সে চিৎকার করে উঠল, ‘বিমলা, বিমলা…!’

চিৎকার করতে করতে টলোমলো পায়ে সে দরজা দিয়ে পাগলের মতো বেরিয়ে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *