শরতে প্রকৃতি

কই গো প্রকৃতি রানী , দেখি দেখি মুখখানি ,
কেন গো বিষাদছায়া রয়েছে অধর ছুঁয়ে
মুখখানি মলিন কেন গো ?
এই যে মুহূর্ত আগে হাসিতে ছিলে গো দেখি
পলক না পালটিতে সহসা নেহারি এ কি—
মরনে বিলীন যেন গো !
কেন তনুখানি ঢাকা শুভ্র কুহেলিকা বাসে
মৃদু বিষাদের ভারে সুধীরে মুদিয়া আসে
নয়ন – নলিন হেন গো ?

ওই দেখো চেয়ে দেখো—একবার চেয়ে দেখো—
চাঁদের অধর দুটি হাসিতে ভাসিয়া যায়।
নিশীথের প্রাণে গিয়া সে হাসি মিশিয়া যায়।
সে হাসির কোলে বসি কানন – গোলাপগুলি
আধো আধো কথা কহে সোহাগেতে দুলি দুলি।
সে – হাসির পায়ে পড়ি নদীর লহরীগন
যার যত কথা আছে বলিতে আকুল মন।
সে হাসির শিশুদুটি লতিকামন্ডপে গিয়া
আঁধারে ভাবিয়া সারা বাহিরিবে কোথা দিয়ে
সে – হাসি অলসে ঢলি দিগন্তে পড়িয়া নুয়ে ,
মেঘের অধরপ্রান্ত একটু রয়েছে ছুঁয়ে।
বলো তুমি কেন তবে
এমন মলিন রবে ?
বিষাদ – স্বপন দেখে হাসির কোলেতে শুয়ে।

ঘোমটাটি খোলো খোলো
মুখখানি তোলো তোলো
চাঁদের মুখের পানে চাও একবার।
বলো দেখি কারে হেরি এত হাসি তার !
নিলাজ বসন্ত যবে কুসুমে কুসুমময়
মাতিয়া নিজের রূপে হাসিয়া আকুল হয় ,
মলয় মরমে মরি ,
ফিরে হাহাকার করি—
বনের হৃদয় হতে সৌরভ – উচ্ছাস বয় !
তারে হেরি হয় না সে এমন হরষে ভোর ;
কী চোখে দেখেছে চাঁদ ওই মুখখানি তোর !
তুই তবু কেন কেন
দারুন বিরাগে যেন
চাস নে চা চাঁদের হাসি চাঁদের আদর !
নাই তোর ফুলবাস
নাইক প্রেমের হাস ,
পাপিয়া আড়ালে বসি শুনায় না প্রেম গান !
কী দুখেতে উদাসীনি
যৌবনেতে সন্ন্যাসিনী !
কাহার ধেয়ানে মগ্ন শুভ্র বস্ত্র পরিধান ?

এক – কালে ছিল তোর কুসুমিত মধুমাস—
হৃদয়ে ফুটিত তোর অজস্র ফুলের রাশ ;
যৌবন – উচ্ছাসে ভোর
প্রাণের সুরভি তোর
পথিক সমীরে সব দিলি তুই বিলাইয়া !
শেষে গ্রীষ্মতাপে জ্বলি
শুকাইল ফুল – কলি ,
সর্বস্ব যাহারে দিলি সেও গেল পলাইয়া !
চেতনা পাইয়া শেষে হইয়া সর্বস্ব – হারা
সারাটি বরষা তুই কাঁদিয়া হইলি সারা !
এত দিন পরে বুঝি শুকাইল অশ্রুধারা !
আজ বুঝি মনে মনে করিলি দারুন পণ
যোগিনী হইবি তুই পাষাণে বাঁধিয়া মন !
বসন্তের ছেলেখেলা ভালো নাহি লাগে আর—
চপল চঞ্চল হাসি ফুলময় অলংকার !
এখন যে হাসি হাসো আজি বিরাগের দিন ,
শুভ্র শান্ত সুবিমল বাসনা – লালসাহীন।
এত করিলি পণ
তবুও তো ক্ষণে ক্ষণ
সে দিনের স্মৃতিছায়া হৃদয়ে বেড়ায় ভাসি।
প্রশান্ত মুখের ‘ পরে
কুহেলিকা ছায়া পড়ে—
ভাবনায় মেঘ উঠে সহসা আলোক নাশি—
মুহূর্তে কিসের লাগি
আবার উঠিস জাগি
আবার অধরে ফুটে সেই সে পুরানো হাসি !

ঘুমায়ে পড়িস যবে বিহ্বল রজনীশেষে ,
অতি মৃদু পা টিপিয়া উষা আসে হেসে হেসে ,
অতিশয় সাবধানে দুইটি আঙুল দিয়া
কুয়াশা – ঘোমটা তোর দেয় ধীরে সরাইয়া।
অমনি তরুণ রবি পাশে আসি মৃদুগতি
মুদিত নয়ন তোর চুমে ধীরে ধীরে অতি !
শিহরিয়া কাঁপি উঠি
মেলিস নয়ন দুটি ,
রাঙা হয়ে ওঠে তোর কপোল – কুসুমদল
শরমে আকুল ঝরে শিশির – নয়নজল !

সুদুর আলয় হতে তাড়াতাড়ি খেলা ভুলি
মাঝে মাঝে ছুটে আসে দুদন্ডের মেঘগুলি।
চমকি দাঁড়ায়ে থাকে , ওই মুখপানে চায় ,
কাঁদিয়া কাঁদিয়া শেষে কাঁদিয়া মরিয়া যায় !
কিসের বিরাগ এত , কী তপে আছিস ভোর !
এত করে সেধে সেধে
এত করে কেঁদে কেঁদে
যোগিনী , কিছুতে তবু ভাঙিবে না পণ তোর ?
যোগিনী , কিছুতে কি রে ফিরিবে না মন তোর ?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *