শরণার্থী

শরণার্থী

স্থান: আরাবল্লী গিরিসঙ্কটের দক্ষিণ প্রান্তে ঊষর অসমতল ভূমির মাঝখানে ক্ষুদ্র দুর্গাকৃতি একটি শৈলগৃহ। আশেপাশে অন্য গৃহ নাই।

কাল: ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে একটি চৈত্র সন্ধ্যা। সূর্য অস্ত গিয়াছে; পাহাড়ের কোলে ছায়া, কিন্তু শিখরে এখনও আলো আছে।

দৃশ্য: উক্ত দুর্গাকৃতি শৈলগৃহের বহিঃকক্ষ। কক্ষটি মঞ্চের অগ্রভাগ হইতে বহুদূর পর্যন্ত পশ্চাতে চলিয়া গিয়াছে, যেরূপ লম্বা তদনুপাতে চওড়া নয়। পশ্চাতের দেয়ালে লোহার সাঁজোয়া মণ্ডিত একটি বৃহৎ দ্বার। বর্তমানে উহা বন্ধ আছে। কক্ষের দেয়াল চৌকশ পাথর দিয়া তৈরি। দেয়ালের স্থানে স্থানে ঢাল তলোয়ার প্রভৃতি অস্ত্র ঝুলিতেছে। বাম দিকের দেয়ালে ঘুলঘুলির মতো কয়েকটি গবাক্ষ, এগুলি দিয়া বাহিরে তীর বা বন্দুক ছোঁড়া যায়, বাতায়ন হিসাবে ইহাদের বিশেষ সার্থকতা নাই। দক্ষিণ দিকের দেয়ালে একটি সাধারণ আকৃতির দরজা গৃহের অন্দর মহলের সহিত যোগসাধন করিয়াছে।

ঘরটি ছায়ান্ধকার। তবু অস্পষ্টভাবে দেখা যায়। ঘরের মাঝামাঝি স্থানে মোটা গদি। তার উপর রঙিন আস্তরণ পাতা হইয়াছে। আস্তরণের উপর মোটা মোটা তাকিয়া, রূপার পানদান, গুলাব-পাশ। চারিটি ধাতুনির্মিত দীপদণ্ড আস্তরণের চারি কোণে দণ্ডায়মান, কিন্তু তাহাদের শীর্ষে এখনও দীপ জ্বলে নাই। কক্ষে কেহ নাই।

অন্দরের দরজা দিয়া একটি যুবতী প্রবেশ করিল। নববধূর বেশ। সর্বাঙ্গে বস্ত্রালঙ্কার ঝলমল করিতেছে। সুন্দর মুখে নিবিড় রস-তন্ময়তার আবেশ। একটি জ্বলন্ত প্রদীপ দুই হাতে ধরিয়া সে কক্ষে প্রবেশ করিল। ঘরটি যেন আচমকা হাসিয়া উঠিল।

যুবতী ধীরপদে গিয়া শয্যাস্তরণের তিন পাশের তিনটি প্রদীপ জ্বালিল, চতুর্থ দীপদণ্ডের উপর হাতের প্রদীপটি রাখিল। এতক্ষণে কক্ষটি সম্পূর্ণরূপে আলোকিত হইল।

যুবতী দাঁড়াইয়া আপন মনে একটু হাসিল। হাসিটি অন্তর্নিবিষ্ট। আজ তাহার স্বামী আসিবেন। প্রথম প্রিয় সমাগম। |

একটি বৃদ্ধা অন্দরের দিক হইতে প্রবেশ করিলেন। মাথার পাকা চুল পিছনের দিকে গুটিকার আকারে বাঁধা, নাকে নথ; কোমর একটু ভাঙিয়াছে, কিন্তু এখনও বেশ শক্ত-সমর্থ আছেন। ইনি যুবতীর পিতামহী।

বৃদ্ধা: বলি হ্যাঁ লা গৌরি, তোর মরদের এ কী আক্কেল। আমার রান্নাবান্না সব শেষ হয়ে গেল এখনও তার দেখা নেই।

যুবতী সলজ্জ হাসিয়া বৃদ্ধার পাশে আসিয়া দাঁড়াইল।

গৌরী: দিদি, আজ কি কি রান্না করেছ বলনা।

বৃদ্ধা: কি কি রান্না করেছি? এই ধর না খাসীর শিক্‌ কাবাব—বন-বরার কালিয়া—। কিন্তু তোকে বলব কেন? তোর জন্যে তো রাঁধিনি। যার জন্যে রেঁধেছি সে এলে তাকে বলব।

গৌরী: না দিদি, বলনা।

বৃদ্ধা: বলব না। তুই রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেই পারতিস কি রেঁধেছি না রেঁধেছি। তোর কি আর সময় ছিল! সারাদিন সাজগোজ নিয়েই ব্যস্ত। তা দেখি কেমন সেজেছিস।

বৃদ্ধা ঘুরিয়া ফিরিয়া নাতিনীর সাজসজ্জা পরিদর্শন করিলেন, তারপর অঙ্গুলিদ্বারা তাহার চিবুক স্পর্শ করিয়া চুম্বন করিলেন।

বৃদ্ধা: মরে যাই। কোথায় লাগে ইন্দ্রসভার অপ্সরা। আজ নাতজামাই এসে যখন তোকে দেখবে, আমার ছত্রিশ ব্যঞ্জনের দিকে আর ফিরেও তাকাবে না।

গৌরী আঁচল দিয়া মুখ ঢাকিল।

বৃদ্ধা; তোর তো লজ্জা হবেই। বিয়ের পর এই প্রথম সোয়ামীর সাক্ষাৎ। এই এক বছর ধরে তুই তো তীর্থের কাগ হয়ে আছিস, সেও তীর্থের কাগ। আজ কি আর আমার রান্না তোদের মুখে রুচবে। চুমু খেয়েই পেট ভরে যাবে।

গৌরী বৃদ্ধার দিকে পিছন ফিরিয়া দাঁড়াইল।

বৃদ্ধা: আচ্ছা আচ্ছা, আর ঠাট্টা করব না। তোকেই বা কি বলব, তোর ঠাকুদা যেদিন আমাকে বাপের বাড়ি থেকে নিতে এল সেদিন কি আমার আহার-নিদ্রার কথা মনে ছিল। কত কালের কথা। তখনও রাজপুতানায় মোগল পা দেয়নি, আরাবল্লীর পাহাড় ঘেরা আমাদের এই ছোট্ট জায়গীর স্বাধীন ছিল (নিশ্বাস)—কিন্তু আজ কী হল বল দেখি? সেই দুপুরবেলা তোর বাপ জামাইকে এগিয়ে আনবার জন্যে দুর্গের সব লোক-লস্করকে পাঠিয়ে দিয়েছে আর এখনও কারুর দেখা নেই। তোর বাপই বা গেল কোথায়? তাকে দেখছি না।

গৌরী: বাবা—বোধ হয়—ছাতে গেছেন।

বৃদ্ধা: ছাতে গেছে দেখবার জন্যে ওরা আসছে কিনা!—[জানালা দিয়া উঁকি মারিয়া] বাইরে এখনও একটু আলো আছে—তা আমিও যাই দেখিগে, নাতজামাইয়ের আর কত দেরি। তুইও চলনা। তোর মন ছটফট করছে বুঝতে পারছি—

ভিতর দিকের দরজা দিয়া একটি মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি প্রবেশ করিলেন। কাঁচাপাকা গোঁফ ও গালপাট্টা। মাথায় পাগড়ি নাই, বাবরি চুল কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে; গায়ে পুরা-আস্তিনের কুর্তা, পরিধানে খাটো ধুতি, পায়ে নাগরা। ইনি মোগল বাদশাহ আকবরের অধীনস্থ জায়গীরদার, বৃদ্ধার পুত্র এবং গৌরীর পিতা। নাম রতন সিং। বর্তমানে তাঁহার ললাটে উদ্বেগের ভ্রূকুটি। বৃদ্ধা পুত্রের দিকে আগাইয়া গেলেন—

বৃদ্ধা: হ্যাঁ বাবা রতন সিং, ছাত থেকে কিছু দেখতে পেলে? ওরা আসছে?

রতন সিং: না মা, এখনও কারুর দেখা নেই। উত্তর দিকের ঘাট দিয়ে ওদের আসবার কথা কিন্তু ওদিকে জনমানব নেই। কী হল কিছু বুঝতে পারছি না—এদিকে রাত হয়ে এল। কিছুক্ষণ পরে অন্ধকার হয়ে যাবে—কৃষ্ণপক্ষের রাত, আকাশে চাঁদও নেই–

উদ্বিগ্নভাবে গুম্ফের একপ্রান্ত টানিতে লাগিলেন। গৌরীর চোখে আশঙ্কার ছায়া পড়িল। বৃদ্ধা ব্যাকুল হইয়া উঠিলেন—

বৃদ্ধা: তবে কি হবে বাবা রতন সিং!

রতন সিং: ভাবনা হচ্ছে। কিছুদিন থেকে একদল মোগল সৈন্য আরাবল্লীর সঙ্কটে সঙ্কটে প্রতাপ সিংকে খুঁজে বেড়াচ্ছে—তারা যদি—

গৌরী এতক্ষণ সঙ্কুচিতভাবে একপাশে দাঁড়াইয়া ছিল, এখন উৎসুক চোখ তুলিয়া চাহিল—

গৌরী: চিতোরের মহারাণা প্রতাপ সিং!

রতন সিং: হ্যাঁ। মোগলেরা চিতোর কেড়ে নিয়েছে, রাণা প্রতাপ এখন পাহাড়ে জঙ্গলে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। আকবর শা ঘোষণা করেছেন, প্রতাপ সিংকে যে ধরতে পারবে সে এক লক্ষ আসরফি পুরস্কার পাবে।

গৌরী: শঙ্কর করুন মহারাণাকে যেন কেউ স্পর্শ করতে না পারে।

রতন সিং: [করুণ হাসিয়া] পাগলি! তোর বাপ মোগলের গোলাম আর তুই রাণা প্রতাপের জয়গান করিস!

গৌরী: রাজস্থানে রাণা প্রতাপের জয়গান করে না এমন রাজপুত কেউ আছে বাবা?

রতন সিং: কিন্তু তোর স্বামীও যে মোগলের দলে!

গৌরী নতমুখে কিন্তু দৃঢ়স্বরে বলিল—সে আমার ভাগ্য। পার্বতী আমার স্বামীকে নিতে পারেন কিন্তু ভাগ্য নিতে পারেন না।*

রতন সিং নিশ্বাস ফেলিলেন।

রতন সিং: ঠিক কথা। যাই, ছাতের ওপর মশাল জ্বেলে দিই। অন্ধকার হয়ে গেছে, ওরা যদি আসে, দূর থেকে মশাল দেখে পথ চিনতে পারবে—

রতন সিং ভিতরের দ্বারের দিকে পা বাড়াইয়াছেন এমন সময় বহির্দ্বারে শব্দ হইল, কেহ দ্বারে করাঘাত করিতেছে। রতন সিং চকিতে ফিরিয়া দাঁড়াইলেন।

বৃদ্ধা: ঐ বুঝি ওরা এল!

রতন সিং: কিন্তু—ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ তো শুনিনি। [আবার দ্বারে আঘাত হইল]—তোমরা অন্দরে যাও, আমি দেখছি।

বৃদ্ধা ভিতরের দ্বার দিয়া প্রস্থান করিলেন; গৌরী দ্বার পর্যন্ত গিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। রতন সিং দেয়াল হইতে একটি তলোয়ার লইয়া সদর দ্বারের কাছে গেলেন।

রতন সিং: কে?

দ্বারের বাহির হইতে অস্পষ্ট আওয়াজ আসিল—

কণ্ঠস্বর: আমি বিপন্ন পথিক, রাত্রির জন্য আশ্রয় চাই।

রতন সিং: বিপন্ন পথিক! তুমি একা?

কণ্ঠস্বর: আমি একা। যদি রাজপুত হও, আমাকে একরাত্রির জন্যে আশ্রয় দাও।

রতন সিং: তুমি রাজপুত! তোমার নাম কি?

ক্ষণেক নীরবতার পর আগন্তুক হ্রস্বকণ্ঠে নাম বলিল।

রতন সিং বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত চমকিয়া উঠিলেন—

রতন সিং: প্রতাপ সিং! মহারাণা প্রতাপ সিং—

রতন সিং স্তম্ভিতবৎ দাঁড়াইয়া রহিলেন। গৌরীর দুই চক্ষু উজ্জ্বল হইয়া উঠিয়াছিল; সে ছুটিয়া গিয়া পিতার কাছে দাঁড়াইল—

গৌরী: বাবা! মহারাণা প্রতাপ সিং—দোর খুলে দাও বাবা।

রতন সিং: [বিভ্রান্তভাবে] দোর খুলে দেব—কিন্তু—কিন্তু—

গৌরী: বাবা, রাণা প্রতাপ সিং একরাত্রির জন্যে তোমার আশ্রয় চাইছেন—

রতন সিং: কিন্তু—আমি—

গৌরী: তুমি না খোলো, আমি খুলে দিচ্ছি—

গৌরী দ্বারের জিঞ্জির হুড়কা খুলিতে প্রবৃত্ত হইল। রতন সিংয়ের হাত হইতে তলোয়ার ঝনাৎ শব্দে মেঝেয় পড়িয়া গেল, তিনি আবার তাহা তুলিয়া লইলেন। দ্বার খুলিলে প্রতাপ সিং প্রবেশ করিলেন এবং আবার দ্বারের জিঞ্জির হুড়কা লাগাইয়া দিলেন। রতন সিং ও গৌরীর দৃষ্টি প্রতাপের উপর নিবদ্ধ; তিনজনে কক্ষের মধ্যস্থলে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

প্রতাপের পরিধানে সাধারণ বেশ, যোদ্ধৃবেশ নয়। মস্তকে শিরস্ত্রাণ নাই, সাধারণ কাপড়ের পাগড়ি। এমন কি কোমরে তরবারি পর্যন্ত নাই। গোঁফ এবং গালপাট্টায় পাক ধরিয়াছে কিন্তু মুখের চর্ম শিথিল হয় নাই। মুখের ও দেহের গঠন দৃঢ়, চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। পাকা গোঁফের প্রমাণে তাহাকে মধ্যবয়স্ক বলা যাইতে পারে, কিন্তু মেদবর্জিত প্রাণসার দেহে প্রৌঢ়ত্বের চিহ্নমাত্র নাই। তাঁহার বাঁ হাতের তর্জনীতে একটি আংটি, আংটিতে কালো রঙের একটা প্রকাণ্ড মণি।

কিয়ৎকাল নিঃশব্দে দৃষ্টি-বিনিময় হইল। গৌরীর চোখে চাপা উত্তেজনার সঙ্গে বাষ্পোৎফুল্ল আনন্দ। রতন সিং নিজেকে অনেকটা সামলাইয়া লইয়াছেন, তাঁহার দৃষ্টিতে কঠিন অসন্তোষ। প্রতাপের চোখে ক্লান্তির সহিত মিশ্রিত সতর্ক অনুসন্ধিৎসা।

প্রথমে রাণা প্রতাপ সিং কথা কহিলেন—

প্রতাপ সিং: রতন সিং, তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি, হলদিঘাটের যুদ্ধে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল।

রতন সিং: হ্যাঁ, আমি মোগলের পক্ষে লড়েছিলাম। রাণা, তুমি আমার দুর্গে কেন এলে?

প্রতাপ সিং: নিরুপায় হয়ে তোমার দুর্গে এসেছি। আজ দু’দিন ধরে একদল মোগল সৈন্য আমাকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ঘোড়া ছেড়ে দিয়ে আমি পায়ে হেঁটে পালিয়ে বেড়াচ্ছি, গুহায় লুকিয়ে রাত কাটিয়েছি। কিন্তু আমার আর শক্তি নেই—মোগলেরা আমাকে চার দিক থেকে ঘিরে ধরেছে। তাই আজ রাত্রির অন্ধকারে গা-ঢাকা দিয়ে তোমার আশ্রয় নিতে এসেছি।

রতন সিং: আমি কি করে তোমাকে আশ্রয় দেব? আমি মোগলের গোলাম।

প্রতাপ সিং: তুমি রাজপুত।

গৌরী এই সময় পিতার পাশে আসিয়া মিনতির সুরে বলিল—

গৌরী: বাবা—

রতন সিং: তুই চুপ করে থাক গৌরি!

গৌরী নতমুখে চুপ করিল, প্রতাপ এতক্ষণে গৌরীকে ভাল করিয়া দেখিলেন—

প্রতাপ সিং: এটি তোমার মেয়ে?

রতন সিং: হ্যাঁ, আমার মেয়ে। ওর স্বামীও তোমার বিপক্ষে রাণা।

প্রতাপ সিং: (ঈষৎ হাসিয়া) কিন্তু ও বোধহয় আমার বিপক্ষে নয়।

গৌরী: (গাঢ় স্বরে) না, মহারাণা।

প্রতাপ সিং: তবে তুমিই আমাকে আশ্রয় দাও কল্যাণী। তুমি নারী—আর্তের বেদনা তুমি যেমন বুঝবে তোমার বাবা তেমন বুঝবেন না।

গৌরী: বাবা—

রতন সিং হাত তুলিয়া গৌরীকে নিবারণ করিলেন—

রতন সিং: রাণা, আমি রাজপুত। কিন্তু আমি আকবর শা’র নিমক খেয়ে স্বজাতির বিরুদ্ধে লড়েছি, এখন যদি আবার তোমাকে আশ্রয় দিয়ে আকবর শা’র সঙ্গে নিমকহারামি করি তাহলে আমার ধর্ম কোথায় থাকবে?

প্রতাপ সিং: তোমার ধর্ম তুমি জাননা। তাহলে আমাকে আশ্রয় দেবে না?

রতন সিং: রাণা, তুমি নিরস্ত্র, আমার হাতে তলোয়ার আছে। আমি যদি তোমাকে বন্দী করে মোগলের হাতে সমর্পণ করি এক লক্ষ আসরফি পুরস্কার পাব। কিন্তু তা আমি চাই না। তুমি চলে যাও—আমি পারব না আশ্রয় দিতে।

গৌরী বাপের পায়ের কাছে নতজানু হইল।

গৌরী: বাবা—উনি ক্ষুধার্ত তৃষ্ণার্ত—ওঁকে এমনভাবে দুর্গ থেকে বিদায় করে দিও না—

রতন সিংয়ের মনের মধ্যে ভীষণ দ্বন্দ্ব চলিতেছিল, তিনি হঠাৎ রাগিয়া উঠিলেন—

রতন সিং: তুই কিছু বুঝিস না গৌরি। এক ফোঁটা মেয়ে, তোর এসব কথায় থাকবার দরকার কি। আমি যদি রাণাকে আশ্রয় দিই আর মোগল সৈন্য আমার দুর্গ তল্লাস করতে আসে তখন কি হবে বল দেখি। আকবর শা কাউকে ক্ষমা করবে না, আমার ঝাড়গুষ্টি উচ্ছেদ করে দেবে। তোর বড় ভাই মোগল ফৌজে কাজ করে, তার পর্যন্ত গদান যাবে। এসব ভেবে দেখেছিস?

গৌরী উঠিয়া দাঁড়াইল। কিছুক্ষণ কথা হইল না, তারপর প্রতাপ শান্ত কণ্ঠে কহিলেন—

প্রতাপ সিং: রতন সিং, তোমার দুর্গের কোনও গুপ্তকক্ষে আমাকে লুকিয়ে রাখতে পারো। মোগলেরা যদি তল্লাস করতে আসেও, আমাকে খুঁজে পাবে না।

রতন সিং: আমার ছোট দুর্গ, লুকিয়ে রাখবার জায়গা নেই। মোগলেরা তো একদণ্ডেই ধরে ফেলবে।

প্রতাপ সিং: মোগল পল্টনে আমার চেহারা অনেকেই চেনে না; আমি অনেকবার নিজের মিথ্যে পরিচয় দিয়ে মোগলকে ফাঁকি দিয়েছি। দুর্গে তোমার লোক-লস্কর আছে, আমি লস্কর সেজে তাদের মধ্যে লুকিয়ে থাকতে পারি।

রতন সিং: আমার লোক-লস্কর কেউ দুর্গে নেই, তারা আমার জামাই মঙ্গল সিংকে এগিয়ে আনতে গেছে। দুর্গে আছি কেবল আমি, আমার মা আর আমার মেয়ে।

প্রতাপ নিজের হাতের আংটি চোখের কাছে আনিয়া দেখিলেন—

প্রতাপ সিং: তাহলে—?

রতন সিং: আমাকে ক্ষমা কর রাণা।

গৌরী চোখে আঁচল দিল। বৃদ্ধা হন্তদন্তভাবে প্রবেশ করিলেন।

বৃদ্ধা: বাবা রতন সিং, আমি ছাতে গিয়েছিলাম। দক্ষিণ দিক থেকে মস্ত একদল ঘোড়সওয়ার মশাল জ্বালিয়ে এদিকে আসছে—

রতন সিং: বোধ হয় মঙ্গল সিং এতক্ষণে এল।—কিন্তু দক্ষিণ দিক থেকে—মস্ত দল—!

বৃদ্ধা: হ্যাঁ, অন্তত দু’শ সওয়ার।

প্রতাপ সিং: বোধ হয় মোগল ফৌজ।

রতন সিং তরবারি শয্যাস্তরণের উপর ফেলিয়া দ্রুত গিয়া গবাক্ষের ছিদ্রপথে উঁকি মারিয়া দেখিতে লাগিলেন। প্রতাপও গিয়া আর একটি গবাক্ষপথে দৃষ্টি প্রেরণ করিলেন। বৃদ্ধা গৌরীর কাছে গিয়া নীরব সংকেতে প্রতাপের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলেন। দুইজনে নিম্নস্বরে কথা হইতে লাগিল। তারপর বৃদ্ধা সংকেতপূর্ণ ঘাড় নাড়িয়া প্রস্থান করিলেন।

প্রতাপ প্রথমে গবাক্ষ হইতে ফিরিলেন।

প্রতাপ সিং: মোগল সৈন্যই বটে।

রতন সিংও ফিরিলেন।

রতন সিং: ওরা দুর্গ ঘিরে ফেলেছে। এখন আর পালাবারও পথ নেই রাণা।

প্রতাপ আংটি খুলিয়া হাতে লইলেন।

প্রতাপ সিং: এখন আমার একমাত্র বন্ধু—এই আংটি। আমি মোগলের হাতে ধরা দেব না।

রতন সিং ছুটিয়া গিয়া প্রতাপের হাত ধরিলেন। অন্য দিক হইতে গৌরী ছুটিয়া গিয়া অন্য হাত ধরিল।

রতন সিং: রাণা, বিষ খেও না, বিষ খেও না—তুমি যদি মরে যাও রাজপুতানায় আর মানুষ থাকবে না—আমি তোমাকে বাঁচাব—মোগলকে দুর্গে ঢুকতে দেব না—

প্রতাপ সিং: ঢুকতে না দিলে তারা দোর ভেঙে ঢুকবে—আর উপায় নেই রতন সিং—

গৌরী আগ্রহভরে প্রতাপকে কিছু বলিতে গেল, তারপর লজ্জায় নতমুখী হইয়া ধীরে ধীরে বলিল—

গৌরী: উপায় আছে মহারাণা—

প্রতাপ সপ্রশ্ন নেত্রে গৌরীর পানে চাহিলেন।

রতন সিং: কী—কি উপায় গৌরি!

গৌরী অধোমুখে থামিয়া থামিয়া বলিল—

গৌরী: বাবা, তোমার জামাইয়ের আজ আসবার কথা তিনি আসেননি, এসেছেন রাণা প্রতাপ সিংহ—যদি মোগল সৈন্যদের বলা হয়—যে—যে—দুর্গে কেবল তোমার জামাই আছেন—

গৌরী থামিয়া গেল। রতন সিং বুঝিতে পারিয়া দু’হাতে নিজের মাথা চাপিয়া ধরিলেন। প্রতাপ প্রস্তাব শুনিয়া চমকিত হইয়াছিলেন, ক্ষণেক চিন্তা করিয়া তিনি দুঃখিতভাবে মাথা নাড়িলেন, নিজের গোঁফ ও গালপাট্টায় আঙুল বুলাইয়া বলিলেন—

প্রতাপ সিং: মোগলেরা কিন্তু ধরে ফেলবে। আমার পাকা গোঁফ পাকা চুল—

গৌরী ক্ষণিকের জন্য একবার প্রতাপের দিকে চোখ তুলিল।

গৌরী: ও আমি ঠিক করে দেব মহারাণা।

রতন সিং: ভাবতে পারছি না—ভাবতে পারছি না। এছাড়া আর তো উপায়ও নেই। গৌরি, তুই অভিনয় করতে পারবি?

গৌরী: পারবো বাবা।

এই সময় বহির্দ্বারে প্রবল ঠক্‌ঠক্ শব্দ হইল। যেন অনেকগুলা লোক তরবারির মুঠ বা বল্লমের কুঁদা দিয়া আঘাত করিতেছে।

রতন সিং দুই হস্ত ঊর্ধ্বে উৎক্ষিপ্ত করিলেন, চাপা গলায় বলিলেন—

রতন সিং: এসে পড়েছে—ওরা এসে পড়েছে! গৌরি, যা, রাণাকে তোর শোবার ঘরে নিয়ে যা—

গৌরী প্রতাপের হাত ধরিয়া অন্দরের দ্বারের দিকে লইয়া চলিল—

গৌরী: আসুন মহারাণা—

তাহারা দ্বারের নিকট পর্যন্ত পৌঁছিলে রতন সিং ছুটিয়া গিয়া গৌরীর কানে বলিলেন—

রতন সিং: শোবার ঘরের দোর ভিতর থেকে বন্ধ করে দিস—ওরা যখন দোরে ধাক্কা দেবে তখন দোর খুলিস—

গৌরী ঘাড় হেলাইয়া প্রতাপকে লইয়া প্রস্থান করিল।

রতন সিং ফিরিয়া আসিয়া তরবারি তুলিয়া লইলেন। দ্বারে মুহুর্মুহু ধাক্কা পড়িতেছিল, এখন কর্কশ কণ্ঠস্বর শোনা গেল—

স্বর: দোর খোলো নইলে দোর ভেঙে ফেলব।

রতন সিং দ্বারের কাছে গিয়া দাঁড়াইলেন।

রতন সিং: কে? কে তোমরা? কী চাও?

স্বর: আমরা মোগল ফৌজ। দোর খোলো।

রতন সিং: মোগল ফৌজ! এত রাত্রে কী দরকার?

স্বর: দরকার আছে—দোর খোলো।

দ্বারে এত ভীষণ শব্দ হইতে লাগিল যে মনে হইল এখনি দ্বার ভাঙিয়া পড়িবে।

রতন সিং: খুলছি—খুলছি—!

তিনি দ্বার খুলিয়া দিলে দশ বারো জন সশস্ত্র মোগল সৈনিক ঢুকিয়া পড়িল, কয়েকজনের হাতে মশাল। রতন সিং তলোয়ার হাতে রুখিয়া দাঁড়াইলেন। সৈনিকদের পিছনে খোলা তলোয়ার হাতে মোগলদের সেনানায়ক প্রবেশ করিলেন। দীর্ঘকায় বয়স্থ পুরুষ। দাড়ি আছে; চোখের দৃষ্টি সন্দিগ্ধ ও সতর্ক। তাহাকে দেখিয়া রতন সিং তরবারি নামাইলেন।

রতন সিং: আরে এ কি! এ যে ফৌজদার মুস্তাফা সাহেব। আসুন—আসুন। আমি ভাবলাম এত রাত্রে কে এল? ভয় হয়েছিল, হয়তো মোগল ফৌজের নাম করে একদল ডাকাত আমার দুর্গে ঢুকতে চায়।

হাসিতে হাসিতে রতন সিং নিজের তলোয়ার দেয়ালে ঝুলাইয়া রাখিলেন।

মুস্তাফা কিন্তু আপ্যায়িতে ভুলিলেন না, তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রতন সিংকে নিরীক্ষণ করিয়া গম্ভীর স্বরে বলিলেন—

মুস্তাফা: বন্দেগি জায়গীরদার সাহেব। রাত্রে আপনাকে বিরক্ত করতে এসেছি, মাফ করবেন—

রতন সিং: না না, সে কি কথা। আপনি এসেছেন এ তো আমার সৌভাগ্য। তবে কিনা, আজ আমার দুর্গে কেউ নেই, কি করে আপনাকে খাতির করব ভেবে পাচ্ছি না। আসুন—বসতে আজ্ঞা হোক—

রতন সিং আস্তরণ নির্দেশ করিলেন। মুস্তাফা কিন্তু বসিলেন না, হঠাৎ বিস্ময়ভরে প্রশ্ন করিলেন—

মুস্তাফা: দুর্গে কেউ নেই!

রতন সিং: আজ্ঞে না। কেবল আমরা চারজন। চাকরবাকর লোক-লস্কর সব বাইরে গেছে।

মুস্তাফা: তাই নাকি! চারজন কে কে আছেন?

রতন সিং: আমি, আমার বুড়ি মা, আমার মেয়ে আর জামাই। এ ছাড়া আর কেউ নেই। কিন্তু কী ব্যাপার বলুন দেখি ফৌজদার সাহেব। আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে গুরুতর কিছু ঘটেছে।

মুস্তাফার কণ্ঠস্বর একটু নরম হইল।

মুস্তাফা: গুরুতর ব্যাপারই ঘটেছে। আপনি জানেন, চিতোরের প্রতাপ সিং পালিয়ে বেড়াচ্ছে, কিছুতেই তাকে ধরা যাচ্ছে না। দু’দিন আগে আমি সন্ধান পাই প্রতাপ সিং এই বনস্কণ্ঠ অঞ্চলে লুকিয়ে আছে। আজ আমার একদল সৈন্য গিরি-সঙ্কটের মধ্যে তাকে দেখতে পায়—কিন্তু ধরতে পারে না। ঠিক সন্ধ্যার আগে সে আপনার এই দুর্গের কাছাকাছি এসে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায়। আমার সন্দেহ হয়েছিল, সে হয়তো আপনার দুর্গে এসে লুকিয়ে আছে—

রতন সিং: সে কি কথা। আমি শাহেনশা আকবার শা’র জায়গীরদার, প্রতাপ সিং আসবে আমার দুর্গে। যদি আসত তাহলে তো ভালই হত ফৌজদার সাহেব। তাকে বন্দী করতাম আর সম্রাটের কাছ থেকে এক লক্ষ আসরফি পুরস্কার পেতাম।

মুস্তফা: হুঁ—প্রতাপ সিং তাহলে এখানে আসেনি। যা হোক, আমি একবার দুর্গ তল্লাস করে দেখতে চাই।

রতন সিং: স্বচ্ছন্দে দেখুন। আমার দুর্গে এখন আমি আর আমার জামাই ছাড়া অন্য পুরুষ নেই।

মুস্তাফা: জামাই—। আপনার জামাই কবে এসেছে?

রতন সিং: আজ এসেছে। এই দেখুন না—[দীপসজ্জিত শয্যাস্তরণ দেখাইলেন]—নতুন জামাই—আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে এসেছে—

মুস্তাফা: তা আপনার লোক-লস্করকে এ সময় বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন কেন?

রতন সিং: তাদের শিকারে পাঠিয়েছি ফৌজদার সাহেব। বুঝতেই তো পারছেন, নতুন জামাই এসেছে, তাকে তো আর শাক-রুটি খাওয়ানো যায় না। তাই আমার লোক-লস্করকে বন-বরা মারতে পাঠিয়েছি।

ফৌজদার মুস্তাফা সাহেব বন-বরার নামে নাসিকা একটু কুঞ্চিত করিলেন। তরবারি কোষবদ্ধ করিতে করিতে বলিলেন—

মুস্তাফা: হুঁ—বুঝতে পারছি প্রতাপ সিং এখানে নেই, তবু কর্তব্য করতে হবে। (সৈন্যদের) তোমরা দুর্গ তল্লাস কর—একদল ছাতে যাও—দ্যাখো প্রতাপ সিং কোথাও লুকিয়ে আছে কি না।—

সৈন্যগণ মশাল লইয়া ভিতরের দিকে প্রস্থান করিল। কক্ষে কেবল রতন সিং ও ফৌজদার মুস্তাফা রহিলেন।

রতন সিং: ফৌজদার সাহেব, আপনি নিজের কর্তব্য করছেন, এবার আমাকে আমার কর্তব্য করতে দিন।—আসুন—এই তক্তে বসুন—পান খান—

রতন সিং ফৌজদারের হাত ধরিয়া আস্তরণে বসাইলেন। পান-দান তাঁহার সম্মুখে রাখিলেন, গুলাব-পাশ লইয়া তাঁহার মাথায় গোলাপ জলের ছিটা দিলেন। ফৌজদার পান লইয়া মুখে দিলেন—

রতন সিং: আমার গরিবখানায় আপনি এসেছেন কিন্তু আপনাকে যে খানা-পিনা করতে বলব সে সাহস আমার নেই—তবে যদি আপনি দয়া করে কিছু মুখে দেন—আমার মা নিজের হাতে নতুন জামাইয়ের জন্য অনেক রান্নাবান্না করেছেন—দুটো কাবাব—

মুস্তাফা: জায়গীরদার সাহেব, আপনার সৌজন্যেই আপ্যায়িত হলাম। কিন্তু আমি মুসলমান, আপনার বাবুর্চিখানায় হারাম রান্না হয়; আমার পক্ষে আপনার বাড়িতে খাওয়া অসম্ভব। পান খেয়েছি এই যথেষ্ট।

রতন সিং: এই জন্যেই তো অনুরোধ করতে সাহস হচ্ছিল না। তা যাক ও কথা।—আচ্ছা, ফৌজদার সাহেব, আপনারা যে প্রতাপ সিংকে খুঁজে বেড়াচ্ছেন, তার চেহারা আপনাদের জানা আছে তো?

মুস্তাফা: সেইখানেই মুশকিল হয়েছে। দূর থেকে তাকে অনেকেই দেখেছে, কিন্তু স্পষ্ট তাকে কেউ দেখেনি। তাছাড়া, আমাদের চোখে সব রাজপুতের চেহারাই একরকম। প্রতাপ সিং বয়স্ক লোক, এই বিশ্বাসে অনেক লোককে ধরেছি কিন্তু শেষ পর্যন্ত ছেড়ে দিতে হয়েছে।—আচ্ছা রাও সাহেব, আপনি নিশ্চয় প্রতাপ সিংকে ভালভাবেই দেখেছেন।

রতন সিং: দেখেছি—হলদিঘাটের যুদ্ধে তাকে মুখোমুখি দেখেছি—

মুস্তাফা: তাহলে—আপনি যদি আমাদের সঙ্গে থাকেন তাহলে প্রতাপ সিংকে সনাক্ত করার কোনও বাধা থাকবে না—এক লক্ষ আসরফি পুরস্কারও আপনি পাবেন—

রতন সিং: ফৌজদার সাহেব, আমি দিল্লীশ্বরের গোলাম, শাহেনশা যদি হুকুম করেন নিশ্চয়ই প্রতাপ সিংকে সনাক্ত করব।

মুস্তাফা: আমি কালই সম্রাটের কাছে আর্জি পাঠাব—

এই সময় অন্দরের দিকে একটু উচ্চ বাক্যালাপের আওয়াজ শোনা গেল, তারপর গৌরী ঈষৎ বিস্রস্ত বসনে ছুটিয়া প্রবেশ করিল—

গৌরী: বাবা—এ কি। এরা কারা!

ফৌজদারকে দেখিয়া গৌরী থমকিয়া দাঁড়াইল। ফৌজদার ও রতন সিং উঠিয়া দাঁড়াইলেন—

রতন সিং: কি হয়েছে মা গৌরি!

গৌরী ফৌজদারের দিকে সসঙ্কোচে চাহিয়া অস্ফুট স্বরে বলিল—

গৌরী: আমরা—ঘরে ছিলাম—হঠাৎ দোরে ধাক্কা পড়ল। দোর খুলে দেখি, একপাল সৈন্য—

রতন সিং: কোনও ভয় নেই মা, ওরা বাদশাহী সৈন্য, প্রতাপ সিংকে খুঁজতে এসেছে—

গৌরী অবাক হইয়া চাহিল।

গৌরী: প্রতাপ সিং—কোথায় প্রতাপ সিং—!

এই সময় প্রতাপ সিংকে অগ্রে লইয়া সৈন্যদল ভিতর দিক হইতে ফিরিয়া আসিল। প্রতাপের চেহারা দেখিয়া অবাক হইয়া যাইতে হয়। মাথায় উষ্ণীষ নাই, কজ্জল-কৃষ্ণ কেশ কাঁধ পর্যন্ত পড়িয়াছে; গোঁফ ও গালপাট্টাও ভ্রমর-কৃষ্ণ: চোখে কাজল। পরিধানে মলমলের ধুতি ও আঙরাখা, গলায় মালা। মনে হয় পঁচিশ-ত্রিশ বছরের বরবেশী যুবা।

সৈনিকদের মধ্যে একজন বলিল—

সৈনিক: হজরৎ, দুর্গ আগাপস্তলা খুঁজে দেখেছি। ইনি ছাড়া অন্য মরদ নেই—

ফৌজদার প্রতাপের দিকে একদৃষ্টে চাহিয়া তাহার দিকে অগ্রসর হইলেন, গৌরীও যেন স্বামীর নিরাপত্তা সম্বন্ধে শঙ্কিত হইয়া প্রতাপের কাছে ঘেঁষিয়া দাঁড়াইল।

রতন সিং: বাবা মঙ্গল সিং, ইনি মোগল ফৌজদার—এঁকে তসলিম কর।

প্রতাপ মাথা ঝুঁকাইয়া করতল বুকের সম্মুখে কয়েকবার আন্দোলিত করিয়া অভিবাদন করিলেন।

প্রতাপ ও গৌরী পাশাপাশি দাঁড়াইয়া, সম্মুখে ফৌজদার। তিনি হাত নাড়িয়া সৈনিকদের বাহিরে যাইতে ইশারা করিলেন। তাহারা প্রস্থান করিল। ফৌজদার যুগলমূর্তির পানে চাহিয়া স্নিগ্ধ হাসিলেন।

মুস্তাফা: রাও সাহেব, এরাই আপনার মেয়ে আর জামাই?

রতন সিং: জি হ্যাঁ।

মুস্তাফা: আমারও এমনি মেয়ে জামাই আছে। এক বছর হল তাদের বিয়ে হয়েছে—

রতন সিং: এদেরও এক বছর হল বিয়ে হয়েছে জনাব।

মুস্তাফা: আমার মেয়ে জামাই দিল্লীতে আছে। কত দিন তাদের দেখিনি।—তোমরা হাতে হাত দিয়ে দাঁড়াও—আমি দেখি।

গৌরী ও প্রতাপ পরস্পর হাত ধরিয়া ঘেঁষাঘেঁষি দাঁড়াইলেন। গৌরীর চোখে লজ্জা-নিবিড় বিভ্রম, প্রতাপের অধরে কৌতুক হাস্য।

মুস্তাফা: (কতকটা আত্মগতভাবে) যোদ্ধার জীবন বড় নীরস, বড় নির্মম—আজ এদের দু’জনকে দেখে আমার প্রাণ ঠাণ্ডা হল—জীবনে মাধুর্য আছে, রস আছে যেন ভুলেই গিয়েছিলাম—

ফৌজদার তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলিলেন।

মুস্তাফা: বহুৎ আচ্ছা। এবার তোমরা যাও নিজের মহলে বিশ্রাম কর গিয়ে।—জায়গীরদার সাহেব, আপনাদের অনর্থক হয়রান করলাম কিছু মনে করবেন না।

রতন সিং: না না, সে কি-কথা—

মুস্তাফা: এবার আমরা যাই। সম্রাটকে আপনার কথা জানাবো—বন্দেগি।

রতন সিং: বন্দেগি জনাব।

প্রতাপ সিং: বন্দেগি জনাব।

গৌরী: বন্দেগি জনাব।

ফৌজদার সদর দরজার দিকে চলিলেন, রতন সিং ও প্রতাপ সঙ্গে গেলেন। আর একবার বন্দেগি বিনিময় হইল; ফৌজদার নিষ্ক্রান্ত হইলেন। রতন সিং দ্বার বন্ধ করিলেন, তারপর শয্যাস্তরণের পাশে আসিয়া মাথায় হাত দিয়া বসিলেন। প্রতাপ তাঁহার কাঁধে হাত রাখিলেন।

প্রতাপ সিং: কি রতন সিং, অনুতাপ হচ্ছে?

রতন সিং: (উঠিয়া) হচ্ছে রাণা, একটি সজ্জনকে ঠকিয়ে লজ্জা হচ্ছে।—কিন্তু কিছু আসে যায় না—তোমার প্রাণরক্ষা তো হয়েছে।

এই সময় দু’জনেরই দৃষ্টি পড়িল, গৌরী প্রস্তরমূর্তির মতো স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে; মুখে হাসি নাই, চোখে দুরবগাহ বিয়োগ বেদনা। তাঁহারা ত্বরিতে তাহার কাছে আসিয়া দাঁড়াইলেন।

রতন সিং: গৌরি!

গৌরী অপরিসীম বিষণ্ণতার সুরে বলিল—

গৌরী: কি বাবা?

রতন সিং: আর ভয় নেই, ওরা চলে গেছে। তুই আজ রাণার প্রাণ বাঁচিয়েছিস গৌরি।

গৌরী অবসন্ন চোখে প্রতাপের পানে চাহিল। প্রতাপ গাঢ়স্বরে বলিলেন—

প্রতাপ সিং: গৌরি, মোগলের কাছে আমার জীবনের মূল্য এক লক্ষ আসরফি, কিন্তু আমি জানি আমার জীবনের মূল্য কপর্দকও নয়। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ কিন্তু প্রতিদান দেবার শক্তি আমার নেই। আমি আজ নিঃস্ব রাজ্যহারা—

গৌরী: রাণা, প্রতিদান দেবার শক্তি আপনার আছে। কিন্তু—বাবা, তুমি একবার ভেতরে যাও—দিদি হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছেন—তাঁকে এখন জাগিও না। আমি মহারাণাকে একটা কথা বলব—

রতন সিং উৎকণ্ঠিতভাবে একবার দু’জনের মুখের পানে চাহিলেন, তারপর নীরবে প্রস্থান করিলেন।

গৌরী: মহারাণা, এবার প্রতিদান দাও—

প্রতাপ সিং: কী প্রতিদান চাও বল।

গৌরী: তোমার হাতের ওই আংটি।

প্রতাপ সবিস্ময়ে আংটির পানে চাহিলেন, তারপর আবার গৌরীর মুখের পানে দৃষ্টি তুলিলেন।

প্রতাপ সিং: এ আংটি তুমি কি করবে?

গৌরী: আমার দরকার আছে।

প্রতাপ সি: কি দরকার?

গৌরী: তা কি বুঝতে পারোনি মহারাণা?

প্রতাপ সিং: কিন্তু—কেন? কেন গৌরি?

প্রতাপ ব্যাকুলভাবে গৌরীর স্কন্ধে হাত রাখিলেন, গৌরী একটু সরিয়া গিয়া তাঁহার করস্পৰ্শ হইতে মুক্ত হইল।

গৌরী: মহারাণা, আমার এ মন, আমার এ দেহ আর আমি আমার স্বামীকে দিতে পারব না।

প্রতাপ স্তম্ভিত হইয়া চাহিয়া রহিলেন।

প্রতাপ সিং: কিন্তু আমি তো তোমার কোনও অমর্যাদা করিনি। অভিনয় যেমনই করি, মনের মধ্যে তোমাকে কন্যার মতোই দেখেছি—

গৌরী: তুমি রাজর্ষি, তোমার মন আগুনের মতো নিষ্পাপ। কিন্তু আমি যে নারী মহারাণা।

প্রতাপ সিং: আমি বুঝতে পারছি না—

গৌরী: তুমি বুঝবে না। সারা জীবন শুধু দেশের জন্য যুদ্ধ করেছ, তুমি নারীর মন বুঝবে না।—দাও—আমার প্রতিদান দাও—(হাত বাড়াইল)।

প্রতাপ সিং: গৌরি—তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ আর আমি তোমার হাতে বিষ তুলে দেব?

গৌরী: দাও।

প্রতাপ আর কথা বলিলেন না, ব্ৰজের মতো দৃঢ় মুখ লইয়া আংটি খুলিয়া গৌরীর হাতে দিলেন।

গৌরী: (আংটি দেখিতে দেখিতে) বোধ হয় নরকে যাব। কিন্তু নরকে গিয়েও আমার এইটুকু সান্ত্বনা থাকবে যে নিজের প্রাণ দিয়ে তোমার প্রাণ বাঁচাতে পেরেছি।

গৌরী ভূমিষ্ঠ হইয়া প্রতাপকে প্রণাম করিল।

গৌরী: বিদায় মহারাণা—

প্রতাপ শুধু চাহিয়া রহিলেন।

গৌরী: আমি নিজের ঘরে যাচ্ছি—বাবা যদি জিজ্ঞাসা করেন—

সহসা বাহিরের দ্বারে প্রবল করাঘাত হইল, একজনের উচ্চ কণ্ঠস্বর শোনা গেল—

স্বর: দোর খোলো—দোর খোলো—মঙ্গল সিং এসেছেন—

প্রতাপ চমকিয়া দ্বারের দিকে পা বাড়াইলেন। গৌরী আর্তস্বরে বলিয়া উঠিল—

গৌরী: না না; এখন দোর খুলো না—আমাকে আগে মরতে দাও—

গৌরী ছুটিয়া চলিয়া গেল। প্রতাপ নিশ্চল দাঁড়াইয়া রহিলেন।

বহির্দ্বারে করাঘাত উত্তরোত্তর বাড়িতে লাগিল।

৯ কর্তিক ১৩৬২

* রাজস্থানের মেয়েলি প্রবাদবাক্য।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *