শরণাগতি
একটিই গতি—শরণাগতি।
যে যেখানে আছ, যা করছ করে যাও, শেষ পর্যন্ত তোমাকে আমার কাছে আসতেই হবে। কোন হিসেবই মিলবে না, কোন পরিকল্পনাই পুরোপুরি সফল হবে না। সংসার তোমাকে কি দেবে! দেওয়ার ভান করবে। তুমিও কিছু দেবে না, তোমাকেও কিছু দেবে না। সেয়ানে সেয়ানে কোলাকুলি। কাঠে কাঠে হৃদয়হীন, প্রেমহীন জড়াজড়ি। নির্বোধ ঠোকাঠুকি। সব পরিবারই রেশন দোকানের মতো। সবাই কার্ডধারী। নির্দিষ্ট পরিমাণে শর্করা। নির্দিষ্ট পরিমাণে শ্বেতসার। আমাদের পরিমিত জীবনচর্যায় অপরিমিতির সংস্কার জন্মাতে পারে না। “স্বখাত সলিলে” ডুবে মরার নিয়তি।
কিন্তু! একটা ‘কিন্তু’ আছে। মানুষ তো আমরা। ঈশ্বরের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি। মানুষকে একেবারে নিজের মতো করে তৈরি করলেন। ‘কে তুমি?’–এই গভীর রহস্যটি তিনি গোপন রাখতে চান। মানুষ যেন জানতে না পারে, এক ভগবান আত্মবিস্মৃত কোটি-ভগবান হয়ে পৃথিবীর মায়ায় ঘুরছে। কোথায় লুকিয়ে রাখা যায় এই জ্ঞানটি। জেনে ফেললে মায়ার খেলা শেষ। রাখবেন কোথায়! দুর্গম পর্বত-কন্দরে অথবা সমুদ্রের অতলে! দেবতারা ভগবানের চেয়েও ধুরন্ধর। তাঁরা পরামর্শ দিলেন, ওটি মানুষের মধ্যেই রেখে দিন। বাইরে তোলপাড় করবে। ভিতরে খুঁজবে না। আপনি যে-মজাটা খুঁজছেন সেটা মজবে ভাল। ভগবান বললেন, তা বটে, যেমন তোমার টাকা সিন্দুকের চেয়ে চোরের পকেটে নিরাপদ। কিন্তু!
আবার কিন্তু-র কি হলো প্ৰভু!
দেখ, মানুষ খুব সহজ জীব নয়। অন্যান্য প্রাণীর মধ্যে মাত্র তিনটি পাবে— আহার, নিদ্রা, মৈথুন। জন্তুর জান্তব জগৎ। কোন কোন প্রাণীর মধ্যে প্রভুভক্তি আছে, অস্বীকার করছি না। কৃতজ্ঞতার বোধও পাবে, বেশি মাত্রাতেই পাবে, কিন্তু মানুষ বিপজ্জনক প্রাণী। একটা সাঙ্ঘাতিক চরিত্র তার মধ্যে ঢুকে গেছে, তার নাম অতৃপ্তি। সন্ধান, অনুসন্ধান। প্রকৃতিতে যা যা লুকিয়ে রেখেছি কালে সব খুঁজে বের করবে। অবশ্য তাতে আমার আনন্দই হবে। সেটা একটা বেশ মজার খেলা। রোগের আরোগ্য বের করবে। মৃত্তিকার শক্তিকে ফসল ফলাবার কাজে লাগাবে। আমার বিদ্যুতের ঝিলিক দেখে প্রকৃতি থেকে বিদ্যুৎ নিষ্কাশন করবে। দুর্গমকে সুগম করবে। নগ্নতাকে নানা বসনে ঢাকবে। বায়ুমণ্ডলকে ভৃত্যের মতো ব্যবহার করবে।
প্রভু! সে তো সবই ঘটবে মানুষের বাইরে। যে-জ্ঞানকে তারা জ্ঞান বলবে, সে তো বস্তু-জ্ঞান। সে-জ্ঞানে অর্থ থাকবে, পরমার্থ থাকবে না। সব জমিতেই ঘোড়া ছোটাবে, আসমানে কয়েক মাইল সীমায় যন্ত্রের ডানায় উড়বে, তারপর বিজ্ঞানের সাহায্যে মহাকাশে। প্রভু! এতে অনন্তের কতটুকু ধারণা হবে! কিছুই না। সুতরাং কোন ভয় নেই।
আছে আছে। এই মানুষেই এমন মানুষ কালে কালান্তরে আসবে যারা বলে দেবে। গোপন কথাটি বলে দেবে। বলে দেবে—”আপনাতে আপনি থেকো মন যেও নাকো কারো ঘরে/যা চাবি তা বসে পাবি খোঁজ নিজ অন্তঃপুরে।”
বিশ্বরচনার মূলে যে মহামায়া—তাঁর সঙ্গে যুক্তি, তর্ক, জ্ঞান, বিজ্ঞানের দ্বৈরথে কিছুই হবে না। চাই সমর্পণ। স্রষ্টা কেন চাইবেন, আমরা দুঃখে কষ্টে জর্জরিত হই? রোগ, শোক, জরা, ব্যাধিতে জীবনের আনন্দ বোঝার আগেই শেষ হয়ে যাই? তিনি চাইবেন কেন? সসীমের ধর্মই এটা। মোটরগাড়ি মানেই দুর্ঘটনা নয়। মূল সূত্র হলো গতি। সেখানে একটি রাজপথ ও একটি মাত্র গাড়িতে কোন সমস্যাই নেই। একটি রাজপথে যখন অনেক গাড়ি তখনি সমস্যা। সে-সমস্যায় স্রষ্টার ভূমিকা শূন্য। গাড়ি তখন চালকের দুনিয়ায়। সেই দুনিয়ার যাবতীয় সমস্যা সেইখানেই মুহূর্তে মুহূর্তে তৈরি হচ্ছে।
শক্তি আর আধার। ঠাকুর বলছেন, ব্রহ্মেরই শক্তি। শক্তির সৃষ্টি হলো মায়া। মায়া বাঘিনী জীব-হরিণকে নিয়ে খেলবে। বেড়াল যেমন ইঁদুরকে নিয়ে খেলা করে। মায়াতেই জন্ম-মৃত্যু, রত্ন-সিংহাসন, ছেঁড়া কাঁথা। মায়াতেই প্রেম, প্রীতি, ঘৃণা, দ্বেষ-বিদ্বেষ। মায়াতেই মালগাড়ি, গরুর গাড়ি। মায়াতেই যুদ্ধ, কামান, বোমা, সন্ধি, শান্তি। মায়াতেই সানাই বাজিয়ে সাতপাক। মায়াতেই ‘বল হরি’। এই দৃষ্টিটি লাভ করতে হলে নিজের মধ্যেই নির্দোষ বুদ্ধি দিয়ে খুঁজতে হবে ভগবানের লুকিয়ে রাখা সেই চাবিটি।
ভগবান যে-আশঙ্কাটি করেছিলেন, ঠিক তাই হলো। কালের কোন এক পাদে তিনি নিজের যে-শক্তিটিকে অবতাররূপে পৃথিবীতে পাঠাবেন, তিনি সেই একটি চাবির অসংখ্য ডুপ্লিকেট তৈরি করে মানুষের হাতে হাতে ছড়িয়ে দিয়ে মুক্তি নয় অথচ এমন একটি পথ দেখিয়ে দেবেন যাতে স্বয়ং ব্রহ্মাই ফাঁদে পড়ে যাবেন। সেই পথটি হলো ভক্তির পথ। “আমি মুক্তি দিতে কাতর নই গো, আমি ভক্তি দিতে কাতর হই।” তিনি প্রকটিত হলেন কামারপুকুরে। লীলা করলেন দক্ষিণেশ্বরে।
নতুন ওষুধ আবিষ্কারের মতো নতুন জীবনধারণ-পদ্ধতি আবিষ্কার করলেন। গুহা, কমণ্ডলু, গেরুয়া, চিমটে, জটা, রুদ্রাক্ষ, আচার-বিচার প্রথা, সংসারত্যাগ, চোখ ওলটানো—কিচ্ছু না, কিচ্ছু না। কোন কিছুর প্রয়োজন নেই। শরণাগত হও। ভক্ত হও। পায়রার গলার কাছে মটর গজগজ করে, সেইরকম কামনা- বাসনা, বিষয়ের গজগজি নিয়ে গুহাবাস, কি চারধাম ভ্রমণ, কি ঘণ্টাবাদন ও নৃত্যকরণে কাঁচাকলা হবে। পরিণতি সেই এক–কড়ায় খই ভাজা অথবা জাঁতায় গম পেষা
সংসারের যত সংসারী, আমার ছোট্ট দুটো কথা শোন। সংসারে কেঁচো হয়ে না থেকে বীরের মতো থাক। ‘পাপ, পাপ’, ‘নেই, নেই’, ‘গেল, গেল’ করো না। আগে একটা অচল, অটল ঘাত-সহ মানুষ হও। বিয়ে করেছ বেশ করেছ। প্রায় সকলেই করে। গৃহস্থাশ্রমে থাকতে গেলে সহধর্মিণীর প্রয়োজন। সন্ন্যাসী হলে আলাদা কথা। সে অতি কঠিন ব্যাপার। তোমাদের বলেছি : “সংসারে থাকবে না তো কোথায় যাবে? আমি দেখছি যেখানেই থাকি, রামের অযোধ্যায় আছি। এই জগৎসংসার রামের অযোধ্যা। রামচন্দ্র গুরুর কাছে জ্ঞানলাভ করবার পর বললেন, ‘আমি সংসার ত্যাগ করব।’ দশরথ তাঁকে বোঝাবার জন্য বশিষ্ঠকে পাঠালেন। বশিষ্ঠ দেখলেন, রামের তীব্র বৈরাগ্য। তখন বললেন, ‘রাম, আগে আমার সঙ্গে বিচার কর, তারপর সংসার ত্যাগ করো। আচ্ছা জিজ্ঞাসা করি, সংসার কি ঈশ্বর ছাড়া? তা যদি হয় তুমি ত্যাগ কর।’ রাম দেখলেন, ঈশ্বরই জীবজগৎ সব হয়েছেন। তাঁর সত্তাতে সমস্ত সত্য বলে বোধ হচ্ছে। তখন রামচন্দ্র চুপ করে রইলেন।”
তাহলে হলোটি কি? না, বুঝতে হবে, আছি কোথায়? সুখেই থাকি, দুঃখেই থাকি, শান্তই থাকি আর খেপেই থাকি, প্রাচুর্যেই থাকি আর দারিদ্র্যেই থাকি—আছি তাঁর চন্দ্রাতপের তলায়। যিনি ওঝা তিনি সর্প। যিনি পেরেক তিনিই হাতুড়ি। সংসার একেবারে ত্যাগ করার তো দরকার নেই। কি দরকার? ত্যাগ করে যাবেই বা কোথায় আর করবেই বা কি? গাঁজা খাবে! সংসার সংস্কারের ঘোলাটে চোখে আড়ে আড়ে কামিনীর রূপ দেখবে! দক্ষিণেশ্বরে এমন মর্কট সাধু বিজয়কে আমি দেখিয়েছি। ভেকধারী ভণ্ড! সারাদিন ধ্যান করবে? চেষ্টা করে দেখ, কত ধানে কত চাল! আমার জীবনের একটা ঘটনা শোন। এর মধ্যে দুটো প্রসঙ্গ পাবে। ধ্যানে বসেছি। ধ্যান করতে করতে মন চলে গেল রসকের বাড়ি! রসকে মেথর। মনকে বললুম, থাক শালা, ঐখানে থাক।
মনকে ধরবে তুমি? নিবাত-নিষ্কম্প দীপশিখা করে রাখবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা! অতই সোজা! ঐ শরণাগতি! মা, তুমি দেখাও। তোমার পাদপদ্ম ছেড়ে মন গেছে রসকের বাড়ি। মা দেখিয়ে দিলেন, ওর বাড়ির লোকজন সব বেড়াচ্ছে খোল মাত্র, ভিতরে সেই এক কুলকুণ্ডলিনী, এক ষট্চক্র! সেই চিৎ শক্তি, সেই মহামায়া চতুর্বিংশতি তত্ত্ব হয়ে রয়েছেন। ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ, ব্যোম ও রূপ, রস, গন্ধ, শব্দ, স্পর্শ; চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক; হস্ত, পদ, মুখ, পায়ু, লিঙ্গ, প্রকৃতি, মন, বুদ্ধি, অহঙ্কার
ভগবানের করুণাঘন মানবদরদী আবির্ভাবই তো অবতার। তাঁরা আসবেন। বাজারের দেওয়ালে একালের সংবাদপত্রের মতো লটকে দেবেন ভগবানের সেই গোপন দলিলটি। দেখ, জীব আর শিব এক। একই চিৎ শক্তি-রসিক, তুমি, আমি সব।
ভগবানের নিজেরই মাথা খারাপ। কথায় বলে না ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’! নিজের তত্ত্ব নিজেই ফাঁস করে দিলেন। কুরুক্ষেত্রে শ্রীকৃষ্ণ হয়ে পার্থ- সখাকে বললেন—ধ্বংস-যজ্ঞ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে : এস সৃষ্টির তত্ত্বটা তোমাকে বলেই দিই—”ইদং শরীরং কৌন্তেয় ক্ষেত্রমিত্যভিধীয়তে।/এতদ্ যো বেত্তি তং প্রাহুঃ ক্ষেত্রজ্ঞ ইতি তদ্বিদঃ।।”—হে অর্জুন, এই ভোগায়তন শরীররূপী দৃশ্যটিকে ক্ষেত্র বলা হয়। যিনি এই শরীরকে জানেন অর্থাৎ স্বাভাবিক ৰা ঔপদেশিক জ্ঞানের বিষয় করেন, ক্ষেত্র ও ক্ষেত্রজ্ঞবিদ্গণ তাঁকে ক্ষেত্রজ্ঞ বলেন। (গীতা, ১৩।২)
ক্ষেত্র দৃশ্য, অনাত্মা আর ক্ষেত্রজ্ঞ দ্রষ্টা আত্মা। অবিদ্যা ও বিদ্যা—এই হলো জ্ঞানের তফাত। শরীরকে জানতে হবে। কার শরীর? কিসের শরীর? যিনি এই শরীরকে জানেন, তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ। শরীররূপী এই দৃশ্যক্ষেত্রটি অনাত্মা। ক্ষেত্রজ্ঞ জানেন, আত্মার অধিষ্ঠান এই ক্ষেত্রেই। “ক্ষিণোতি আত্মানম্ অবিদ্যয়া, ত্রায়তে তম্ (আত্মানম্) বিদ্যয়া।”—অবিদ্যা দ্বারা আত্মাকে নাশ করে আর বিদ্যা দ্বারা আত্মাকে রক্ষা করে।
সংসারে থাক, কি শ্মশানে, কি গুহায় বিদ্যামায়ার সাহায্য নাও। ব্রহ্মেরই মায়া। আমি তো বলেছি : “তাঁর ইচ্ছা যে খানিক দৌড়াদৌড়ি হয়, তবে আমোদ হয়। তিনি লীলায় এই সংসার রচনা করেছেন। এরই নাম ‘মহামায়া’। তাই সে শক্তিরূপিণী মার শরণাগত হতে হয়। মায়াপাশে বেঁধে ফেলেছে। এই পাশ ছেদন করতে পারলে তবেই ঈশ্বরদর্শন হতে পারে।”
“যেমন রোগ, তার তেমন ঔষধ। গীতায় তিনি বলছেন, ‘হে অর্জুন তুমি আমার শরণ লও, তোমাকে সবরকম পাপ থেকে আমি মুক্ত করব।’ তোমরা তাঁর শরণাগত হও, তিনি সদ্বুদ্ধি দেবেন। তিনি সব ভার লবেন। তখন সবরকম বিকার দূরে যাবে। এ-বুদ্ধি দিয়ে কি তাঁকে বোঝা যায়? তাই বলছি, তাঁর শরণাগত হও—তাঁর যা ইচ্ছা তিনি করুন। তিনি ইচ্ছাময়। মানুষের কি শক্তি আছে!”
স্বয়ং ভগবান দেবতাদের বললেন : “দেবগণ! প্রশ্নপত্র ফাঁস করার মতো ঐ দেখ, তোমাদের শ্রীরামকৃষ্ণাবতার ভক্তির চাবি দিয়ে আমার কাছে আসার অতি সহজ দরজাটি খুলে দিয়েছে। সিক্রেট আউট—বলে দিয়েছে বেজায় কথা- ‘কখনো ঈশ্বর চুম্বক হন, ভক্ত ছুঁচ হয়। আবার কখনো ভক্ত চুম্বক হয়, তিনি ছুঁচ হন। ভক্ত তাঁকে টেনে লয়—তিনি, ভক্তবৎসল, ভক্তাধীন।
“অবতারের অবতার—অবতারী শ্রীরামকৃষ্ণ। সমস্ত শাস্ত্র শরীরধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ। প্রেমশরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ, ভক্তিশরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ, জ্ঞানশরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ, আনন্দশরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ, আহ্বানশরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ, আশ্রয়শরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ, চৈতন্যশরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ, যন্ত্রণাশরীর ধারণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ।”
“সে যে কোঠার ভিতর চোরকুঠুরি!”