1 of 2

শয়তান

শয়তান

এক

পৃথিবীতে আশ্চর্য ঘটনা ঘটে অনেক, কিন্তু সে-সব ঘটনায় বিশ্বাস করে এমন লোক খুব বেশি পাওয়া যায় না।

আমার জীবনেও একবার একটা ঘটনা ঘটেছিল, তা শুধু আশ্চর্য নয়— অত্যাশ্চর্যও বটে! তোমাদের কাছে সেই কথাই আজ বলব। বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয়, বিশ্বাস করো; বিশ্বাস না করলেও দুঃখিত হব না।

সরকারি কাজে আমি তখন হাজারিবাগ অঞ্চলের এক জায়গায় থাকি। একটা মানুষখেকো বাঘের অত্যাচারে সেখানকার লোকেরা পরিত্রাহি ডাক ছাড়ছিল। বারে বারে দেশি-বিলাতি বহু শিকারির গুলি হজম করে সে বেঁচে আছে। লোকে বলে, সে বাঘটা নাকি সাধারণ বাঘ নয়— বাঘের আকারে হিংস্র অপদেবতা! কেউ কেউ নাকি চোখের সামনে তাকে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে দেখেছে! তাকে মানুষের ভাষায় কথা কইতে শুনেছে— এমন লোকেরও অভাব নেই! বনের ভিতরে বসে সে নাকি মেয়েমানুষের মতন আর্তনাদ করত। তার সেই কান্নাকে মানুষের কান্না ভেবে যে বনের ভিতরে ঢুকত, সে আর ফিরে আসত না। লোকে তাই তাকে ‘শয়তান’ বলে ডাকত। শয়তানকে দেখলেই চেনা যেত, কারণ তার ল্যাজ ছিল না। হয়তো বনের ভিতরে অন্য জন্তুর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়েই ল্যাজের গৌরব থেকে সে বঞ্চিত হয়েছিল। কিন্তু লোকের বিশ্বাস, শয়তানের এই লাঙ্গুলহীনতাই তার অলৌকিকতার মস্ত প্রমাণ। বাঘের ল্যাজ নেই, তাও কখনো সম্ভব?

এ-সব গল্প যে মিথ্যে তাতে আর ভুল নেই। মানুষখেকো বাঘেরা প্রায়ই চালাক হয়। বড়ো বড়ো শিকারিও তাদের বধ করতে পারে না। তাই তাদের নামে এমনি সব গল্প শোনা যায়। বৃক্ষ বিশেষের আশ্চর্য শিকড়ের গুণে মানুষ বাঘের রূপ ধরতে পারে, এমন গল্পও শুনেছি। কিন্তু আধুনিক যুগে নিতান্ত মূর্খ ভিন্ন আর কেউ এসব গল্প বিশ্বাস করবে না।

শয়তান যে সাধারণ বাঘ, একদিন তার প্রমাণ পেলুম।

বন্ধু হরিশের সঙ্গে সন্ধ্যার আগে হরিণ মেরে ফিরে আসছি। আমাদের পিছনে পিছনে আসছিল মরা হরিণটাকে কাঁধে করে দুজন কুলি, আর বাঘের মতোই বড়ো আমার শখের কুকুর ‘টাইগার’। বনের একটা মোড় ফিরতেই সামনে দেখি, পথের ওপরে বিড়ালের মতন কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে মস্তবড়ো একটা বাঘ। তার ল্যাজ নেই!

পিছনের কুলিরা রুদ্ধশ্বাসে, অস্ফুটস্বরে একসঙ্গে বলে উঠল— ‘শয়তান!’

পরমুহূর্তেই আমরা দুজনেই একসঙ্গে বন্দুক ছুড়লুম!

শয়তান লাফিয়ে দাঁড়িয়ে উঠেই আবার পড়ে গেল, আর নড়ল না।

এত সহজে শয়তানকে ঘায়েল করে আমাদের আনন্দের আর সীমা রইল না। কুলি দুজনও মনের খুশিতে ধেই-ধেই নাচ শুরু করে দিলে! আশপাশের গাঁয়ে সে খবর তখনি ছড়িয়ে পড়ল। দলে দলে লোক দেখতে এল শয়তানকে। অনেকে তার মৃতদেহের ওপরে কিল-চড়-লাথি বৃষ্টি করে মনের ঝালও ঝেড়ে নিলে। অনেক কষ্টে তাদের থামিয়ে জন কয়েক কুলির সাহায্যে শয়তানের দেহ তুলে আবার নিজেদের বাসার দিকে রওনা হলুম।

দুই

খানিক দূর যেতেই, বিরাট এক ক্রুদ্ধ দৈত্যর মতো সারা আকাশ জুড়ে একখানা মিশমিশে কালো মেঘ ছুটে এল ভীষণ ঝোড়ো নিশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে। শহরে বসে তোমরা এই মেঠো বুনো ঝড়ের কল্পনাও করতে পারবে না।

দেখতে দেখতে পরেশনাথ পর্বতের আকাশভেদী চূড়া ধুলো-মেঘের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল, বনের গাছগুলো পাগলের মতন মাটির ওপরে বার বার মাথা কোটবার চেষ্টা করতে লাগল, আর যেন কার বিপুল ফুৎকারে সারা পৃথিবীর আলো কাঁপতে কাঁপতে নিবে গেল! খানিক তফাতেই একখানা পুরোনো বাংলো ছিল, আমরা তাড়াতাড়ি তার ভিতরে গিয়ে আশ্রয় নিলুম। ঝড়ের পর এল বৃষ্টি— সন্ধ্যার অন্ধকারকে সঙ্গে করে।

বুঝলুম, আজ আর বাসায় ফেরা হবে না। কারণ এখান থেকে আমার বাসা অন্তত পাঁচ মাইল তফাতে। মাঝে আবার নদী আছে। সেই পাহাড়ে-নদী বৃষ্টিধারায় পুষ্ট হয়ে এতক্ষণে দ্বিগুণ হয়ে উঠেছে নিশ্চয়।

কুলিরাও চলে যেতে চাইলে— বখশিশের লোভও গ্রাহ্য করলে না।

তারা দুটো কারণ দেখলে। প্রথমত শয়তানের মৃতদেহের সঙ্গে তারা রাত্রিবাস করতে নারাজ। দ্বিতীয়ত এই বাংলোয় আগে এক সাহেব থাকত, কারা নাকি তাকে খুন করেছিল। সেই থেকেই এই বাংলোয় কোনো মানুষ বাস করতে পারে না। সেই বৃষ্টিতেই কুলিরা বাংলো ছেড়ে পালাল।

শিকারি মানুষ, সবরকম বিপদের জন্যেই সর্বদা প্রস্তুত থাকতে হয়। সঙ্গে লণ্ঠন এনেছিলুম, তাই জ্বাললুম। ব্যাগের ভিতরে তখনও কয়েক টুকরো পাঁউরুটি আর খানিকটা ‘গোয়াভা জেলি’ ছিল। তার দ্বারা আমার, হরিশের আর ‘টাইগারে’র নৈশ আহার শেষ করতে হবে। উপায় কী? আমরা যে খোলা মাঠে নেই, এখন এইটুকুই পরম সান্ত্বনার কথা।

মাঝের হলঘরে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলুম। ঘরখানা প্রকাণ্ড— দেয়ালে দেয়ালে উইদের রাজত্ব, সমস্ত দরজা-জানলাই ভাঙা, মেঝেতে পুরু ধুলোর প্রলেপ। তার ওপরে নানা জীবজন্তুর পায়ের দাগ— বাঘের, ভাল্লুকের, শেয়াল-কুকুরের! এখানে-ওখানে হাড় পড়ে আছে, কোনো কোনো হাড় মানুষের বলেও সন্দেহ হল। বুঝলুম, মানুষের বাড়ি আজ বাঘ-ভাল্লুকের আস্তানায় পরিণত হয়েছে। বললুম, ‘হরিশ, এখানেও আমরা নিরাপদ নই। যেকোনো মুহূর্তেই বাঘ-ভাল্লুকের সঙ্গে আবার দেখা হতে পারে, বন্দুকে টোটা ভরে তৈরি হয়ে থাকো।’

হরিশ আমার কথামতো কাজ করতে করতে বললে, ‘আজ রাত্রে দেখচি ঘুমের দফা রফা!’

শয়তান আর হরিণের দেহ দুটো ঘরের কোণে এনে রাখলুম।

তিন

আকাশের অন্ধকারকে ছ্যাঁদা করে জলধারা অশ্রান্তভাবে গড়িয়ে পড়ছে পৃথিবীর বুকের ওপর। বিদ্যুৎ-সাপগুলো কিলবিল করে ক্রমাগত চলে যাচ্ছে শূন্যতার এধার থেকে ওধার পর্যন্ত। বৃষ্টি-বাণে আহত অরণ্যের কান্নায় চারিদিক পরিপূর্ণ।

‘টাইগার’ এই পোড়োবাড়ির ভাঙা ঘর মোটেই পছন্দ করলে না। ঘরময় ছড়ানো হাড়গুলো সে আগে শুঁকে-শুঁকে অনেকক্ষণ ধরে পরীক্ষা করলে। তারপর ওপরদিকে মুখ তুলে কীসের ঘ্রাণ নিতে লাগল— যেন কোনো অদৃশ্য বিভীষিকার সন্ধান পেয়েছে! ‘টাইগার’ সাহসী কুকুর, বাঘ দেখলে ও ডরায় না। কিন্তু সে আজ অত্যন্ত ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল। পেটের তলায় ল্যাজ ঢুকিয়ে একবার এখানে একবার ওখানে গিয়ে বসে পড়ে। আবার উঠে কান খাড়া করে যেন কার পদশব্দ শোনে! আমি তাকে ডাকলুম, সে কিছুতেই কাছে এল না। থেকে থেকে চমকে ওঠে, আর হা-হা করে হাঁপায়!

হরিশ আশ্চর্য হয়ে বললে, ‘টাইগার এমন করচে কেন? ও কী দেখেচে?’

আমারও মনে ওই একই প্রশ্ন!… চারিদিকে তাকিয়েও সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেলুম না। বলেছি মস্ত ঘর। আমার এই ছোটো লন্ঠনের আলোতে সে ঘরের অন্ধকার দূর হয়নি। হঠাৎ মনে হল, দেয়ালের ওপর দিয়ে যেন একটা লম্বা ছায়া দুলতে-দুলতে সরে যাচ্ছে…

হরিশের একখানা হাত চেপে ধরে বললুম, ‘দেখ, দেখ!’

টাইগার ঊর্ধ্বমুখে অস্বাভাবিক, তীক্ষ্ন, শিয়ালের মতো স্বরে কাঁদতে লাগল।

হরিশ বললে, ‘কী? কী দেখব?’

‘ওই ছায়াটা?’

‘কোথায়?’

‘ওই যে! দেয়ালের ওপরে দুলছে!’

‘তুমিও পাগল হলে নাকি? ওখানে তো কিছুই নেই!’

চোখ রগড়ে চেয়ে আমিও আর কিছু দেখতে পেলুম না। নিজের ভ্রম বুঝে লজ্জায় চুপ করে রইলুম।

বাইরের বনের ভিতর থেকে একটা বাঘ ক্রমাগত গর্জন করতে লাগল। হয়তো শয়তানেরই বউ! বনে বনে স্বামীকে খুঁজে-খুঁজে ডেকে-ডেকে বেড়াচ্ছে!… গর্জনটা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে গেল।

হঠাৎ মনে হল আমার কানে কানে কে যেন কথা কইলে!

রোমাঞ্চিত দেহে আমি হরিশের কাছ ঘেঁষে সরে বসলুম।

আমার মুখের ভাব দেখে হরিশ বললে, ‘আবার কী হল?’

‘কে আমার কানে কানে কথা কইলে?’

‘সুরেন, তোমার মাথা বোধ হয় খারাপ হয়ে গেছে! তুমি যে এমন ভীতু তা জানতুম না!’

তার ধিক্কার শুনে মনটাকে আবার শক্ত করে চাঙ্গা করে তোলবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু কেন জানি না, বুকের ছমছমানি কিছুতেই আজ থামতে চাইলে না। খালি মনে হয়, আমার চারিপাশে দিয়ে আজ সেইসব পা চলে বেড়াচ্ছে যেসব পা চললে কোনো শব্দ হয় না। আমার চারিপাশে সব অদৃশ্য চোখ! আমরা তাদের দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু তারা আমাদের দেখতে পাচ্ছে! কী অসোয়াস্তি। ওদের চোখ এড়াই কেমন করে?

বললুম, ‘হরিশ, এ বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ি চলো। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলেই আমি সত্যি-সত্যি পাগল হয়ে যাব!’

হরিশ বললে, ‘কুলিদের বাজে কথা তোমার মনের ওপরে কাজ করচে। তুমি শান্ত হও। এরকম পোড়োবাড়িতে এলে অকারণেই গা একটু ছমছম করে বটে, কিন্তু ও কিছু নয়।’

‘কিন্তু টাইগারও অমন কাতরাচ্চে কেন? সে তো কুলিদের কথা বোঝেনি!’

‘টাইগার হচ্ছে অবোধ জন্তু, মিছামিছি ভয় পেয়েচে। সে ভয় পেয়েচে বলে তুমিও ভয় পাবে? তুমি যে মানুষ।’

চার

এবারে সত্যি-সত্যিই ঘরের বাইরেকার দালানে দ্রুত পদশব্দ হল। শব্দটা একটা দরজার কাছে এসে, আবার দূরে চলে গেল।

হরিশ বললে, ‘কোনো জন্তুর পায়ের শব্দ।’ কিন্তু আমার মন বললে, কোনো জন্তুর পায়ের শব্দ নয়!

জীবনে আমার মনের ভিতরে এমন অলৌকিক ভাবের উদয় হয়নি। ভাগ্যে সঙ্গে হরিশ আছে, নইলে আমার অবস্থা কী হত কে তা বলতে পারে?

হাতঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলুম, রাত বারোটা। হরিশ খাবারের ‘বাস্কেট’ বার করে বললে, ‘অনেক রাত হয়েচে। এসো, এইবারে আমরা খেয়ে নিই।’

আমি বললুম, ‘তুমি একলা খাও! আজ আমার ক্ষিধে নেই।’

—ঠিক সেই সময়ে, খুব কাছেই আবার বাঘের ঘন ঘন চিৎকার শুরু হল।

শয়তানের সঙ্গিনী কি খোঁজ পেয়েই এখানে এসে হাজির হয়েছে?

হরিশ বললে, ‘বন্দুক নাও! বাঘটা ভেতরে আসতে পারে!’

খুব দীর্ঘ, করুণ ও অস্বাভাবিক এক চিৎকার করে বাঘের ডাক থামল। সঙ্গে-সঙ্গে ভাঙা জানলা দিয়ে ঝটপট করে ঘরের ভিতরে কালো কুচকুচে কী-একটা ঢুকে পড়ল।

হরিশ বললে, ‘বাদুড়।’

তারপরেই দরজার চৌকাঠের ওপরে এসে দাঁড়াল মস্তবড়ো একটা কালো-কুৎসিত বিড়াল। বাদুড়টা ঘরের চারিদিকে চক্রকারে উড়তে লাগল আর কালো বিড়ালটা ল্যাজ তুলে ক্রমাগত ডাকতে লাগল, ম্যাও! ম্যাও! ম্যাও! ম্যাও!

বাদুড়টা হঠাৎ গোঁত্তা খেয়ে শয়তানের মৃতদেহের ওপরে গিয়ে পড়ল। তারপর দুই ডানা বিস্তার করে সেইখানেই স্থির হয়ে রইল— একটা মূর্তিমান অভিশাপের মতো!

টাইগার আবার দাঁড়িয়ে উঠল এবং ভয়ানক এক আর্তনাদ করে আমার পায়ের কাছে ছুটে এসে ধুপ করে পড়ে গেল। কাঁপতে-কাঁপতে তার গায়ে হাত দিয়ে দেখি, সে মরে গেছে!

হরিশ সবিস্ময়ে বললে, ‘সুরেন! দেখ, দেখ!’

ওঃ! কী সে দৃশ্য!

যাকে আমরা স্বহস্তে গুলি করে মেরেছি, যার মৃতদেহ এতগুলো কুলি কাঁধে করে বয়ে এনেছে, যে মরে এতক্ষণে একেবারে কাঠ হয়ে গিয়েছিল— সেই শয়তান এখন আমাদের চোখের সামনেই চার পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার দুটো চক্ষু আগুনের দুটো গোলার মতন দাউ দাউ করে জ্বলছে আর জ্বলছে! সে চোখটা যেন আমাদের ভস্মসাৎ করে দিতে চায়। বাইরে আবার বাঘ ডাকতে লাগল।

শয়তান ঘরের ভিতর থেকে বেরিয়ে গেল ধীরে ধীরে।

বাদুড় আর কালো বিড়ালকেও আর দেখতে পেলুম না। চিৎকার করে আমি মাটির ওপরে পড়ে গেলুম।

পাঁচ

সেই সপ্তাহেই দরখাস্ত করে অন্য দেশে বদলি হয়েছি— পাছে শয়তানের সঙ্গে আবার দেখা হয়!

হরিশের মতে, আমাদের বন্দুকের গুলিতে শয়তান মরেনি, মূর্ছিত হয়ে পড়েছিল মাত্র। হতেও পারে। না হতেও পারে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *