শয়তানের সঙ্গে সাক্ষাৎকার
।। এক ।।
সেদিন ময়দানের কাছে হঠাৎ শয়তানের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। প্রথমে চিনতে পারিনি। ঈশ্বর শুনেছি মানুষের রূপ ধরে দেখা দেয়। মাথার পেছনে একটা জ্যোতির্বলয় থাকে। এই যা তফাত। শয়তানও যে মানুষের চেহারা ধরতে পারেন, জানা ছিল না। ছবিতে যে শয়তান দেখেছি, তাঁর মাথায় একজোড়া শিং থাকে। দুপায়ে জুতোর বদলে থাকে ক্ষুর।
যাই হোক, ধারণা আমার বদলে গেল। শয়তান অবিকল মানুষের মতো দেখতে। ঘটনাটা বলি। একটি মানুষ আমার সামনে-সামনে, রাইট অ্যান্ড লেফট থুতু ফেলতে-ফেলতে চলছে। যারা খইনি খায়, অনেকটা তাদের কায়দায়। পিচিক রাইট, পিচিক লেফট। দু-একজন ওভারটেক করে চলে যেতে গিয়ে থুতু সিঞ্চিত হলেন। হলেও গ্রাহ্য করলেন না। তাঁরা, মনে হয়, রিয়েল ক্যালকেসিয়ান। কলকাতার অধিকাংশ মানুষই সিদ্ধ পুরুষ। নির্বিকার, উদাসীন, দেহবোধশূন্য। যাঁরা নিত্য বড়বাজার অঞ্চলে চলাফেরা করেন, তাঁরা হলেন পরমহংস।
শয়তান চলেছেন সামনে-সামনে, আমি চলেছি ঠিক পেছনে। ওভারটেক করার সাহস হচ্ছে না। লাগাতার থুতু-বৃষ্টি চলেছে। প্রতিবাদ করার ইচ্ছে থাকলেও, সাহসে কুলোচ্ছে না। আজকাল প্রতিবাদ করা মানেই লাশ পড়ে যাওয়া। ব্রাহ্মণী বিধবা। হালফিল দেখলেই হল, চারটে চোর একটা পুলিশকে বেঁধে নিয়ে চলেছে। পেটাতে-পেটাতে। কী ব্যাপার, ভাই?
আর বলবেন না, মশাই। সবে পাইপ বেয়ে উঠছি, ব্যাটা মধ্যযুগের পুলিশের মতো ‘চোর চোর’ বলে চিল্লে মেজাজটাই খিঁচড়ে দিলে।
এঁকে এখন কী করবেন?
তলপেটে গোটাকতক কোঁতকা মেরে ফাটকে ভরে দি। কাল সকালে চালান করে দেব।
প্রতিবাদ চলে না। চলছে-এ না-আ, চলবে-এ না-আ। ন্যাশন্যাল অ্যানথেমের মতো, এই জাতীয় মন্ত্রটিরও একটি সুর আছে। ঊর্ধ্বাঙ্গ সামনে পেছনে দুলিয়ে দুলিয়ে ওই মন্ত্রটিকে ছাড়তে হয়। সব স্তব্ধ। রাজা ক্যানিউট জানতেন না। জানলে সমুদ্রের ঢেউও স্তব্ধ হয়ে যেত। অন্য কোনও ব্যাপারে প্রতিবাদ মানেই ক্যাপিটেল পানিশমেন্ট। ধর্ষণ! নো প্রতিবাদ। টিজিং! মনে করো, হরির লুঠের বাতাসা গায়ে এসে লাগছে। ছেনতাই! এক ধরনের সোস্যালিজম। তোমার ছিল, এখন আমার হল। চারিয়ে দাও। যখন জ্ঞান আর উপদেশ ছাড়া কিছুই পাওয়া যায় না, তখন কেড়েই নিতে হবে। উঁচুতলার জল নীচুতলায় আসুক। সব সমান হয়ে যাক এইভাবে।
সব প্রতিবাদ এখন উৎপাদন কেন্দ্রে। ফুটপাথে সারি বেঁধে দাঁড়াও। তারপর চিল্লে যাও চলছে না, চলবে না। প্রতিবাদ অফিস ছুটির সময়, কলকাতার কয়েকটি বাঁধা পথে। এই প্রতিবাদে তেমন কোনও পার্সোন্যাল রিস্ক নেই। বড়জোড় দু-চারটে পটকা ফাটবে, স্টকে টিয়ারগ্যাস থাকলে, এক কি দু-রাউন্ড চলবে। ঢালধারী পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে গরু তাড়াবে। বেশ একটু ছোটাছুটি হবে। কলকাতায় সম্পদের মধ্যে বেড়েছে ইট আর পাথরের ঐশ্বর্য, আর বেড়েছে হকার এবং পেভমেন্ট ডোয়েলার। শহরজীবনে এই তিনটি সম্পদই আমাদের প্রয়োজন। এশটাব্লিশমেন্টের বিরুদ্ধেই আমাদের প্রতিবাদ। প্রতিবাদের ভাষা আর সুর বেশ সেট করে গেছে। ওদিকে যেমন ‘কার হল গো’। এদিকে তেমনি চলছে-না, চলবে-না। কন্ঠের ব্যায়ামের সঙ্গে, শুধুই বাহুর আস্ফালন। এর সঙ্গে ইটপাটকেল ছুঁড়তে পারলে, ভালো বোলার তৈরির সম্ভাবনা কেউ ঠেকাতে পারবে না। পুলিশের তাড়ায় অফিস ছুটির পর একটু দৌড়োদৌড়ি স্বাস্থ্যের পক্ষেও ভালো। হার্ট, লাঙস, ডাইজেসটিভ সিসটেম জোরদার হবে। এ সবই যে ফিজিক্যাল এডুকেশনের আওতায় পড়ে, সেই কথাটাই আমরা ভুলে যাই। যাঁরা আবার গ্রাম থেকে শহরে আসেন, তাঁরা শুধু গদির ব্যাবসায় ‘লিভিং অ্যাডভাটাইজমেন্ট’ মনে করলে ভুল হবে। এই আসা আর যাওয়াটা পড়ে ন্যাশন্যাল এডুকেশন স্কিমের আওতায়। কলকাতায় এসে দেখে যাও, শহর কী করে নোংরা করতে হয়, ভাঙতে হয়, চুরতে হয়। আইন কাকে বলে, প্রশাসন কী বস্তু! ট্র্যানস্পোর্ট নেটওয়ার্ক কী জিনিস! রাষ্ট্রীয় পরিবহণ কেমন বস্তু। পশুতে আর মানুষে তফাত কতটুকু। বিবর্তন কাকে বলে। বাঁদর সত্যিই মানুষের পূর্বপুরুষ ছিল কি না। বিজ্ঞাপনের কলকাতা আর বাস্তব কলকাতায় ফারাক কতটা! নানাবিধ জ্ঞান সঞ্চয় করে, কাঁচা পাঁউরুটি আর গোটা দুই সিঙ্গাপুরী কলা খেয়ে গ্রামের মানুষ গ্রামে ফিরে চলো। জিনিসের দাম কমল কি না, ট্যানা ঘুচে পরনে ফিরিঙ্গি জামা উঠল কি না, গ্রামে বিদ্যুৎ এল কি না, খরায় সেচের জল মিলল কি না, সবুজ বিপ্লব হল কি না, দপ্তরে ফাইল নড়ল কি না, বিনা তেলে যন্ত্র চলে কি না, জানার দরকার নেই। দুটি ডাণ্ডা, একটি ঝাণ্ডা, কপালে আণ্ডা, বেড়ে যাও গণ্ডা গণ্ডা। তারপর সেই এক ভরসা, জিভ দিয়েছেন যিনি, আহার দেবেন তিনি।
হকারও খুব প্রয়োজনীয় জিনিস। বড়দেরও তো ব্যায়াম চাই। লোকলস্কর, সাঁজোয়া বাহিনী নিয়ে মাঝে-মাঝে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বুলডোজার দিয়ে আটচালা ভূমিসাৎ করো। সবই ওই এক কারণে। তোমায় নতুন করে পাব বলে, হারাই ক্ষণে ক্ষণ, আমার ভালোবাসার ধন। রাজা-রাজড়ার দাবা খেলা। হিউম্যান ঘুঁটি। ফুটপাতের ছক। রাজা যে চালই দিন, তিনিই জিতবেন। তারপর আড়াই চালে আবার ফিরে এসো। দাবায় খেলোয়াড় দু-পক্ষ। দর্শক অনেক। বেশ লাগে দেখতে। আর পেভমেন্ট ডোয়েলার্স ফিলমের জন্যে ডকটরেট থিসিসের জন্যে অবশ্যই প্রয়োজন। ফিলমের ফোরেন প্রাইজ পেতে হলে ফুটপাতে নামতেই হবে। কী ইনটেলেকচ্যুয়াল, কি কমার্শিয়াল ক্যামেরাকে এক ঝলক ফুটপাথে আছড়ে পড়তেই হবে। সেকস আছে, শোষণ আছে। ভায়োলেন্স আছে, ভারচু আছে। পলিটিকস আছে, ট্রিকস আছে। বিশ্বরূপ আছে। বিদেশে দেখাবার মতো এদেশে আর কী আছে!
যাক, শয়তানের পেছন-পেছন হাঁটতে-হাঁটতে কোথা থেকে কোথায় চলে এলুম! অবশেষে প্রতিবাদ নয়, পেছন থেকে বিনীত কণ্ঠে বললুম, স্যার আপনি কী ওয়ার্মসে ভুগছেন? এত কণ্ঠধারা নিক্ষেপ করছেন চতুর্দিকে। এক ডোজ ‘সিনা’ খেয়ে দেখতে পারেন। তখনও আমি কিন্তু জানি না, কার সঙ্গে কথা বলছি!
।। দুই ।।
শয়তান একটা গাছ দেখিয়ে বলল, সিট ডাউন।
ভীষণ ভয় পেয়ে গেলুম। কী জানি বাবা, এ আবার কার পাল্লায় পড়লুম। তেমন তো কিছু বলিনি! প্রাোটেস্টও করিনি। অ্যান্টি-ইনস্টিটিউশন কথাবার্তাও বলিনি! বুক গুড়গুড় করছে। মাল নিজ দায়িত্বে রাখুনেরও মতো, প্রাণও এখন যার-যার নিজের দায়িত্বে রাখার রেওয়াজ চলেছে।
শয়তান ধপাস করে বসে পড়ে বললে, সিট ডাউন।
কেন, স্যার?
ভয় পেলে চাকরিজীবী মানুষ স্যারই বলে। শয়তান বললে, বসতে বলেছি বসবে, বেশি দেয়লা করবে না। তোমাকে কিঞ্চিৎ ট্রেনিং দিয়ে যাই।
আপনি কে স্যার?
আমি শয়তান।
সেই শয়তান, যে আমাদের আপেল খাইয়েছিল? সাপের মতো দেখতে!
সবই জানো তাহলে?
ইয়েস স্যার?
পকেটে মালকড়ি আছে?
সামান্য। শেষ মাসে যা থাকা উচিত।
হিসেব চাইনি, আমি তোমার স্ত্রী নই। পঞ্চাশ গ্রাম বাদাম কিনে আনো। বিফলে যাবে না। তোমাকে কিছু শয়তানি শিখিয়ে দেব।
কিছু-কিছু অলরেডি জানি, প্রভু।
সে জানা তোমার জানাই নয়। হাতুড়ে বিদ্যা। ট্রেনিং ছাড়া প্রাোফেস্যানাল শয়তান হওয়া যায় না। অ্যামেচারের যুগ শেষ হয়ে গেছে।
বাদাম নিয়ে এসে দুজনে মুখোমুখি বসলুম। চারটি বাদাম হাতের তালুতে ফেলে দেখতে-দেখতে শয়তান বললে, এই দ্যাখো, এই হল তোমার ভগবানের রাজত্ব, কিংডাম অফ গড। ফিফটি পারসেন্ট পচা। এটা যদি সেন্ট পারসেন্ট শয়তানের রাজত্ব হত, তাহলে একশোটার মধ্যে একশোটাই পচা হত বা ভালো হত। তোমাদের ভগবান হলেন ভেজাল, সম্রাট। সেই কোন শৈশব থেকেই তোমাদের অঙ্ক শেখালেন, একজন ব্যবসায়ী পঁয়তাল্লিশ টাকা মণ দরে দশ মণ চালের সঙ্গে পঁয়ত্রিশ টাকা দরের বিশ মণ চাল মিশিয়ে চল্লিশ টাকা দরে বিক্রি করলে কত লাভ হবে! করোনি এমন অঙ্ক?
ইয়েস স্যার!
তবে! শয়তানের পাঠশালে এমন অঙ্ক নেই। আচ্ছা, বাজে বকে সময় নষ্ট করে লাভ নেই। তোমার ফাউন্ডেশনটা আগে দেখেনি, কী কী শয়তানি জানো?
স্যার, আমি ঠিক গুছিয়ে বলতে পারব না, একটু এলোমেলো হয়ে যাবে, তাছাড়া এগুলো শয়তানির মধ্যে পড়ে কিনা, আপনিই বলতে পারবেন, কারণ আপনি পাকা শয়তান। প্রথমে একটা শয়তানির কথা বলি, সরতে বললে না সরা। এই জাতের শয়তানির লেবেল দিতে পারেন, সরতে বললে না-সরা।
বা:, সেটা কী ধরনের জিনিস? আমি তো শুনিনি!
এটা আমরা বাড়ির চেয়ে বাইরেই ব্যবহার করি বেশি। বাসের বা ট্রামের পাদানিতে, অথবা আর একটু ওপরের ধাপে, গেটের মুখে, ফুটপাতে, বাজারে, এমনকী, মন্দিরে মায়ের মূর্তির সামনে, দোকানের কাউন্টারে। পাদানিতে উঠে দাঁড়িয়ে পড়লুম। পেছনে চিৎকার, দাদা উঠুন না, কী হল দাদা, উঠুন না। এমনি যদিও বা উঠতুম, তাগাদায় ব্যাদড়া ছেলের মতো খিচড়ে গিয়ে পেছনের সঙ্গে ন্যাজে খেলতে লাগলুম। আমার সামনে যিনি আছেন, তিনিও আমার সঙ্গে ওই একই খেলা খেলছেন, তার মানে শয়তানির রিলে। এরপর পেছন থেকে আসে দাওয়াই-এর রিলে। শিরদাঁড়ায় এক খোঁচা, ওঠ ব্যাটা। এই প্রসঙ্গে একটা প্রশ্ন প্রভু, এই শহরের যানবাহন ব্যবস্থা কি আপনি চালাচ্ছেন?
না রে, ভাই, ওটা খোদ ভগবানের ডিপার্টমেন্ট। আমার রাজত্বে পাপ নেই, ফলে নরকও নেই।
আর একটা ছোট্ট শয়তানির কথা বলি। অফিসে আর রেস্তোরাঁয় এটা আমরা পরস্পর পরস্পরের ওপর প্রয়োগ করি। ওয়াশ বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে হাত ধুচ্ছি তো ধুচ্ছিই, নাক ঝাড়ছি তো ঝাড়ছিই, সামনের আয়নায় মুখ দেখছি তো দেখছিই। শেষে পকেট থেকে চিরুনি বের করে চুলের কেয়ারি হচ্ছে তো হচ্ছেই। ঠিক ওই সময়টিতে পৃথিবীতে যে দ্বিতীয় কোনও প্রাণী থাকতে পারে, আমরা ভুলেই যাই। একটাই অসুবিধে, এই শয়তানি ব্যুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। এই মুহূর্তে যে ঘুঘু দেখাল, পর মুহূর্তে সে-ই আবার ফাঁদ দেখল। ট্রেনের টয়লেটে এর প্রয়োগ আরও ব্যাপক, আরও বেশি মানুষকে এইভাবে বিব্রত করা যায় বলে, অনেক তৃপ্তিদায়ক। রেস্তোরাঁতে অকারণে আসন আটকে রেখে আমরা বেশ মজা পাই। ঢোকার মুখে একজোড়া প্রেমিকা-প্রেমিকা দাঁড়িয়ে। জুলজুল করে তাকাচ্ছে, কখন একজোড়া আসন খালি হয়! চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি দেখে বলে উঠল, ওই যে, ওই জায়গাটা খালি হবে। কানে এল। মুচকি হেসে, চুমুক আরও প্রলম্বিত করে ফেললুম। যতক্ষণ আসন আটকে রাখা যায়। শেষে আবার আর-এক কাপ চায়ের অর্ডার দিয়ে, খেবড়ে বসে রইলুম। একে বলে, বাড়া ভাতে ছাই টেকনিক।
শয়তান ফুঁ দিয়ে বাদামের খোসা উড়িয়ে আমার কোল ভরিয়ে দিয়ে বললে, এটা কোরো না?
অবশ্যই করি। সিগারেটের ছাই ঝেড়ে দি কালো প্যান্টে। আগে ‘সরি’ বলতুম প্রথামত, ইদানীং তাও আর বলতে হয় না। সুযোগ পেলেই ধোপদুরস্তবাবুর প্যান্টের তলার দিকে জুতোর স্ট্যাম্প মেরে দি। প্রতিবাদ এলেই বলি, ‘ওরকম হবে মশাই, না পোসায় ট্যাকসি করে যান।
।। তিন ।।
সেই মনুষ্যরূপী শয়তান বললেন, দুরকমের শয়তানি আছে, এক হল ছিঁচকে আর এক হল ডাকাতে। অনেকটা চোরের মতো। ছিঁচকেরা কোনওদিন ডাকাত হতে পারে না। মশা কোনওদিন ভীমরুল হতে পারবে?
আজ্ঞে না। কিন্তু, মশাকে আপনি, আন্ডার এস্টিমেট করবেন না প্রভু। সন্ধেবেলা যখন ঘরে এসে ‘ত্রাহি ত্রাহি’ ডাক ছাড়িয়ে দেয়। ভীমরুলের বাবা। ছেলেবেলায় পড়েছি, বড় যদি হতে চাও ছোট হও তবে।
না হে বৎস, ও শিক্ষায় বিশেষ কাজ হবে না। ও হল তোমাদের ভগবানের কু-শিক্ষা। বড়র জাতই আলাদা। ছুঁচো কোনওদিনই হাতি হতে পারবে না। ও সবই জন্মসূত্রের ব্যাপার, ছুঁচোর বাচ্চা ছুঁচোই হবে, হাতির বাচ্চা হাতিই।
আপনি তো প্রভু, দেহের আকার-আকৃতির কথা বলছেন! দেহ দিয়ে কি আর শয়তানি হয়? শয়তানি হল ভেতরের জিনিস। আমাদের ভেতরে, প্রভু, আপনিও যেমন আছেন, আপনার ঘোর শত্রু ঈশ্বরও তেমনি আছেন। একাধারে দুই বীর তাল ঠুকছেন। সেদিক থেকে আমরা বর্ণসঙ্কর। পিয়োর শয়তান, পিয়োর ভগবান আজও চোখে পড়ল না। পিয়োর ঘি যেমন হয়ই না, পিয়োর সরষের তেল আর মিলবে না।
শোনো, হবে না বলে কোনও কথা নেই। চেষ্টায় সবই হয়। বংশের ধারাই পালটে যায়। তোমরা মাছের চাষ করো, ফল আর ফুলের চাষ করো, শয়তানির চাষ কোনওদিন করেছ?
আজ্ঞে না।
চাষ না করলে ভালো ফসল হয়? ভালো জমিতে, ভালো বীজ, তারপর ভালো সার। ফসলের চেহারাই পালটে যায়। আড়াই হাত বেগুন, ধামার মতো ফুলকপি। শোনো বৎস! জমি আমি তৈরি করে ফেলেছি। স্বাধীনতার সার দিয়ে, রাজনীতির বোনমিল দিয়ে, লাঙল মেরে রেখেছি। তোমরা হলে সেই বীজ, শয়তানির সম্ভাবনা নিয়ে ছটফট করছ।
তা প্রভু চাষ থেকে কী ধরনের ফসল উঠবে?
সে তোমাদের মত ল্যাংমারা ছিঁচকে শয়তান নয়। তাদের চালচলন, হাবভাব, কাজকর্ম মশার কামড় নয়, একেবারে বাঘের থাবা।
তাঁরা কী করবেন, হুজুর?
তাদের আমি ভালো ভালো পোস্টে বসাব। বড় বড় নেতা করে দেব।
প্রভু, তাঁরা লোডশেডিং, কী জলবন্ধ, আরও ব্যাপকহারে করবেন? মানে সব বন্ধটন্ধ করে, ভেঙেচুরে কোম্পানি লাটে তুলে দেবে?
লাটে তুলে দিলে তো সব হয়েই গেল! শয়তানের রাজত্বে কোনও পরিণতি নেই। উত্থানও নেই, পতনও নেই। তালগোল পাকানোই হল কাজ। এমনভাবে জড়ভট্টি করে দাও, সব সাপের ছুঁচো গেলা হয়ে বসে থাক। আমার রাজত্বে কি পাবে জানো, এখানে আছে ওখানে নেই, তোমার আছে আমার নেই, তখন ছিল এখন নেই। যেমন; উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবে।
লোডশেডিং। মাইলের পর মাইল এলাকা অন্ধকারে পড়ে আছে। প্রথম-প্রথম অস্বস্তি লাগত। এ কী ব্যাপার! সব সভ্যদেশেই শহর এলাকায় রাতে আলো জ্বলে। শুধু জলে না, রোশনাই ছোটে। বিদ্যুতের অভাবে সুদৃশ্য গ্যাসের আলোর ব্যবস্থা শ-খানেক বছর আগেও ছিল। যে কালে মানুষ চাঁদে ছুটছে, পার্ক স্ট্রিটে ডিসকো নাচছে, কথায়-কথায় বউকে তালাক দিচ্ছে, ডিভোর্স-মামলা ঠুকছে, স্প্রিং-লাগানো ছুরি খুলে বুকে বসাচ্ছে, পেখমমেলা মটোর চেপে আসেমব্লিতে গিয়ে গণতন্ত্রের খড়ম পেটাচ্ছে, সে যুগে রাতে, মানুষকে চাপ-চাপ অন্ধকারের ব্যবস্থা দিলে, প্রথম-প্রথম মানুষ বিক্ষুব্ধ হবেই। তারপর সয়ে যায়। শরীরের নাম মহাশয়, যা সওয়াবে তাই সয়, কিন্তু গোদের ওপর বিষফোঁড়া হলে কেমন হয়?
সেটা কী প্রভু?
এ টাচ অফ লারসেনির মতো, এ টাচ অফ শয়তানি। আ: সে যে কী জ্বালাদার জিনিস গো! লোডশেডিং-এর পর আলো এল। জনপদ হাসছে। হঠাৎ একটা ফেজ উড়ে গেল।
ও, স্যার, প্রায়ই আমার এলাকায় হয়। চারপাশে সব বাড়িতে আলো ফুটফুট করছে, আমরা বসে আছি অন্ধকারের দ্বীপে। বসে-বসে দেখছি সামনের বাড়িতে টিভি নাচছে নীল পর্দায়, আর জ্বলে-জ্বলে উঠছি।
অ্যায়, একে বলে অ্যাটিস্টিক শয়তানি। আর জিনিসটায় শয়তানির সৌন্দর্য কোথায় জানো! লোডশেডিং হলে তোমার জানা আছে, ছ’ঘণ্টা হোক, সাত ঘণ্টা হোক, আলো একসময় আসবে, ফেজ উড়ে গেলে আলো আসবে তখন, যখন সেই মহাপ্রভুরা দয়া করে আসবেন, কাঁধে মই নিয়ে।
উ: সে এক সাসপেন্স। তারপর ওঁরা যা করেন, প্রভু, সে হল-ন দেবায়, ন হবিষায়! আর-একটা ফেজে ঢুকিয়ে দিলেন। সারা এলাকার আলো মোমবাতির মতো হয়ে গেল। টিংটিং করে জ্বলতে লাগল। তারপর আবার লোডশেডিং এসে অন্ধকারে ভাসিয়ে দিয়ে গেল। এরকম কেন হয়, প্রভু?
আরে বোকা, ওইটাই তো আমার কেরামতি। যেমন ধরো, জল ছাড়া বাঙালির চলে না, দিলুম বাহাত্তর ঘণ্টা জল বন্ধ করে। কিছু বললেই বলব, ভেবে দ্যাখো বাঙালি, সাহারার মানুষ সারা জীবনে এক ভিস্তি জল পায় কি না সন্দেহ! চান করবে, চান? পশু-জগতের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, গরুর মা গরুর বাচ্চাকে চেটে পরিষ্কার করে দেয়। বেড়ালের মা বেড়ালকে চাটে। তোমরাও এবার থেকে পারস্পরিক চাটাচাটি করে, টেরি কেটে অফিসে যাও কি মিছিলে যাও।