শয়তানের কাছে বিক্রি
তা বয়েস আমার হয়েছে বই কী! দেদার বয়েস! সেদিন যে-জন্মদিনটা গেল, তেরো পেরল আমার সেইদিনই। কোনোদিন বোধ হয় ভুলতে পারব না সে-দিনটা। কারণ ওইদিনই আমি চাকরিতে ভরতি হলাম এ্যাপলওয়াল হাউসে।
লেক্সহো পর্যন্ত ওমনিবাসে এসেছি, সেখানে এসে দেখি একটা শে আমার জন্য এসে রয়েছে এ্যাপলওয়াল থেকে। শে-গুলো এক রকমের এক-ঘোড়ার সরু গাড়ি, গরিবেরাই ওতে চড়ে, যখন হাঁটবার ক্ষ্যামতা আর থাকে না দেহে। কোচম্যানটা বুড়ো, এসেই নিজের নাম বলল জন মালবেরি। আমাকেও বলতে হল আমার নাম— এ্যালিস এ্যালিসন।
‘তা নামটা তো ভালো!’— ঘাড়টা ঈষৎ কাত করল মালবেরি, ‘তোমার পিসির নামের চাইতে ভালো। শাটার্স! এও কী একটা নাম নাকি? অবিশ্যি নামের অর্থ তার স্বভাবের সঙ্গে মিলে গিয়েছে, মুখ তার আজও ”শাট”, কালও ”শাট”। কুলুপ আঁটা মুখ যাকে বলে। তা, তুমি আবার পিসির নিন্দে শুনে রাগ করছ না তো?’
‘আমি সে পিসিকে মোটে দেখিইনি কোনোদিন!’— জবাবটা যে মোটেই লাগসই হল না, তেরো বছরের বয়স্ক মহিলার পক্ষে ওর চেয়ে কায়দাদুরস্ত একটা মুখরোচক জবাব নিশ্চয়ই দিতে পারা উচিত ছিল। এটা সঙ্গে সঙ্গেই মাথায় এসে গেল আমার। লজ্জাই পেলাম খানিকটা। মালবেরি বুঝল সে-লজ্জাটা, আর তা যাতে কাটিয়ে উঠতে পারি চটপট, এই মতলবেই বোধ হয় দু-দুটো আপেল কিনে এনে দিল আমাকে, ‘এখানকার আপেল মন্দ নয়, খেতে খেতে চলো। ওখানে তোমার খাবার তৈরিই রয়েছে— পিসির ঘরে, আঙুরের কেক, মাংসের চপ, হাফ-দুধের চা, ওখানে আমরা খাই-দাই ভালো—’
শে চলেছে ট্যাঙ্গোস ট্যাঙ্গোস। আমি জানালা দিয়ে ঘোলাটে জ্যোছনার দিকে চেয়ে আছি, আর আপেল খাচ্ছি। ভাবছি আর ভাবছি। তেরো বছরের মানুষের ভাবনার কি অন্ত থাকে নাকি? বিশেষ যখন তার মা-বাপ কেউ না-থাকে, মানুষ হতে হয় দাদা-বউদির কাছে। ভুল বলে ফেলেছি, মানুষ হতে আমার বাকি নেই কিছু। কিন্তু দেশের কী যে পোড়া রীতিনীতি, একটা চাকরি আমাকে এতদিন কেউ দেয়নি, দাদা-বউদি চেষ্টাও করেনি আমায় একটা কিছু কাজে ঢুকিয়ে দেবার।
এবারের এই যে চাকরিটা, এ্যাপলওয়ালে, এ তো বলতে গেলে দৈবাৎ পাওয়া। জন্ম-জীবনে শাটার পিসিকে দেখিনি, সে হঠাৎ চিঠি লিখে বসল দাদাকে, ‘যদি এ্যালিসকে কাজে ঢোকাতে চাও, এক্ষুনি পাঠিয়ে দাও। কাজ বলতে স্রেফ বসে থাকা, মাইনে তিন পাউন্ড, খাওয়া-দাওয়া রাজবাড়ির মতো। আমার চোখে চোখে থাকবে সারাক্ষণ।’
বউদির মত ছিল না, ও আমাকে ভালোবাসে বেজায়, চোখের আড়াল করতেই চায় না। দাদাই পাঠাল, ‘ঘরকুনো হয়ে থাকা ভালো নয়, দুনিয়াটা ঘুরেফিরে দেখুকই না। বিশেষ পিসির ছেলেপুলে নেই, পয়সাকড়ি আছে, ওর সঙ্গে লেগে থাকলে আখেরে—’
আমার নিজেরও যথেষ্ট আগ্রহ দুনিয়াটা ঘুরেফিরে দেখার, কাজেই ভোটে বউদিকে হারিয়ে দিয়ে আমি এসে পড়েছি এ্যাপলওয়ালের দোরগোড়ায়। দেখা যাক অজানা-অচেনা পিসিটিই বা কীরকম, আর কী জাতীয় চাকরিই বা তিনি জোগাড় করেছেন আমার জন্য।
‘এসে গেছি—’ একসময় বলে উঠল মালবেরি, আর আমি জানালা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দিলাম। ঘোলাটে জ্যোছনায় কর্মস্থানটাকে যথাসম্ভব দেখে নেবার জন্য।
কী বিরাট বাড়ি! কী বিশাল মহীরুহ বাড়িটার হাতায়! অনেক দিনের ইমারত, তাতে সন্দেহ নেই। বেমেরামত নয়, তা ঠিক, কিন্তু এমন বিটকেল সাদা-কালোর পালটা-পালটি রং যাদের পছন্দ, তারা কী ধরনের মানুষ, আমি বুঝতে পারলাম না। একনজর দেখে নিয়েই মনে ধারণা করে বসলাম— এ-বাড়ির বাসিন্দাদের মনগুলো প্রধানত কালোই। যে-দিকটাতে কালিমা ফুটে বেরুবার পথ পায় না, সেই দিকেই জাহির হয় একটা উদাসীন সাত-শুন্যি সাদা, যা-হবার-হোক-গে মনোভাব। পরে বুঝেছিলাম আমার সেই তেরো বছরের মগজের কল্পনা খুব বেশি ভুল বোঝায়নি আমাকে সেদিন।
হলঘরেতেই পিসির সঙ্গে দেখা। বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ হবে। লম্বা, ছিপছিপে, ফ্যাকাশে মুখ, কালো চুল, লম্বা সরু দু-খানা হাতে কালো দস্তানা। দেখলাম কম কথা বলেন পিসি, কিন্তু যা বলেন, তা অন্য সবাই শিরোধার্য করে নেয়। এ-বাড়ির কর্ত্রীই তাঁকে বলা যায়, যদিও বাস্তবে তিনিও মাইনে-করা লোক ছাড়া অন্য কিছু নন।
পিসি নিজের ঘরে নিয়ে গেলেন আমাকে। প্রথমেই বসিয়ে দিলেন খেতে। বাড়ির ডিনার শেষ হয়ে গিয়েছে, মালবেরি যা বলেছিল, আমার খাবার পিসি নিজের ঘরে আনিয়ে রেখেছেন। যা বলেছিল মালবেরি বুড়ো— সেই আঙুরের কেক, মাংসের চপ আর আর্ধেক দুধ-আর্ধেক চা-মেশানো একটা উপাদেয় পানীয়। বুঝলাম, বাড়ির বেতনভুক শ্রেণির এইটিই সার্বজনীন খাদ্য রাত্রি বেলার, তা-নইলে মালবেরি কী করে সবগুলো পদের নাম করল আমার কাছে?
আমি খাচ্ছি, পিসি সামনে বসে আছে। জানতে চাইছে দেশের সব কথা। দুঃখধান্দা কিছু নয় সেই বহুদিনের ফেলে-আসা বাপের বাড়ির জন্য। একটা মৃদু কৌতূহলমাত্র। নিজের সহোদর ভাই, অর্থাৎ আমার স্বর্গীয় বাবার উপর খুব বেশি দরদ যে ছিল, এমন তো মনে হল না তাঁর কথাবার্তায়। তবু, তাঁর তেরো বছরের মেয়েকে কাজে ঢুকিয়ে নেবার জন্য নিজে যেচে এতখানি মেহনত কেন করলেন পিসি, বুঝে উঠতে পারলাম না।
যাহোক, ওসব কথা শেষ হল একসময়, চলে এলেন আমার এই চাকরির প্রসঙ্গে। ‘কাজটি খুব সোজা, বুঝেছ এ্যালিস, স্রেফ চেয়ারে বসে থাকা, আমাদের মনিবনীর ঘরে। বয়েস হয়েছে তাঁর, জ্ঞানগম্যি খুব যে বেশি আছে, তা নয়। তাঁর উপরে একটু নজর রাখা। যাতে হঠাৎ লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে না-পড়েন বা ওইরকম অন্য কিছু না-করে বসেন। সেরকম দেখলে দৌড়ে এসে আমাকে বা মিসেস উইভার্নকে ডেকে নিয়ে যাওয়া, এই তোমার কাজ।’
যা শুনলাম, কাজ সত্যিই কিছু নয়। স্রেফ বসে থাকা, বসে বসে আমি গল্পের বই পড়তে পারি, সেলাইফোঁড় করতে পারি, এক পত্তন ঘুমিয়েও—
না, ওইটি পারি না। ঘুমোনো চলবে না। নজর রাখতে হবে মনিবনীর উপরে। বুড়ো মানুষ, জ্ঞানগম্যি খুব নেই। হঠাৎ খেয়ালের বশে বিছানা থেকে নেমে পড়তে পারেন, নামতে গিয়ে আছাড় খেতে পারেন, আছাড় খেয়ে হাত-পা ভাঙতেও পারেন—
না, ঘুমোনো চলবে না আমার। সারাদিন আমার পালা ওঁকে পাহারা দেওয়ার, লাঞ্চের পর একঘণ্টা ছুটি একটু বাইরের হাওয়া গায়ে লাগাবার জন্য। প্রকাণ্ড হাতা, মস্ত বাগান, বেড়াবার জায়গা কিছু কম নেই। বেড়িয়ে নাও, তার পরই আবার এসে চেয়ার দখল করে বসে যাও। মনিবনী সকালেও যেমন, বিকালেও তেমন। শুয়েই আছেন, শুয়েই আছেন। ডিনারের আগে পর্যন্ত আমার ডিউটি। তারপরে মিসেস উইভার্ন এসে দখল করবেন আমার জায়গা। না, চেয়ারে নয়। ওঁর জন্য আলাদা একটা ছোটো বিছানা পড়বে এই ঘরেরই এক কোণে। তিনি ওই ঘরেই রাত্তিরে শয়ন করেন। জেগেই থাকেন— আন্দাজ করলাম। তা না-হলে, রাত্রেও তো মনিবনী নেমে পড়তে পারেন, নেমে পড়তে গিয়ে—
কিন্তু ও কথা মাথায় ঢোকামাত্র মাথা থেকে বেরিয়ে গেল। পিসি এ আবার কী বলছেন? ‘ভয় নেই কিছু, আমি তো এই ঘরেই থাকি। ভয় কিছু নেই।’
আমি কান খাড়া করে উঠলাম। ‘ভয় কীসের?’ জিজ্ঞাসা করলাম অবাক হয়ে। সত্যিই ভয়ের কথা উঠছে কেন, তা আমি বুঝতে পারছি না। সকাল আটটা থেকে সন্ধ্যে আটটা। বনে জঙ্গলে নয়, ঘরের ভিতর। সাপ বাঘ নিয়ে কারবার নয়, একটা জ্যান্ত মানুষ পাহারা দেওয়া আমার কাজ। ভয়টা কোন দিক থেকে আসতে পারে, পারছি না বুঝতে।
বলেছি— তেরো বছরের পাকা মাথা। ভয়ের কথা কেন ওঠে? নিশ্চয়ই অন্য কেউ ভয় পেয়ে থাকবে। চট করে সেই কথাই পিসিকে জিজ্ঞাসা করে বসলাম, ‘ভয় কেউ-কেউ পায় বুঝি?’
অবাক! অবাক! এই নির্দোষ প্রশ্নেই দপ করে জ্বলে উঠলেন পিসি, ‘ওঃ, এর মধ্যে শোনা হয়ে গেছে কান ভাঙানি? ওই মালবেরি বুঝি? আসতে আসতে সাতকাহন করে আজগুবি আজগুবি গল্প বলেছে বুঝি? ওটাকে না-তাড়ালে চলছে না আর।’
আমি তটস্থ। নিরীহ মালবেরির জন্য। সে তো সাতকাহন চুলোয় যাক, এককাহনের গল্পও শোনায়নি আমাকে! সে ছিল কোচ-বাক্সে! আমি ছিলাম ঘেরার মধ্যে! গল্প বলার সুযোগ ছিল কোথায়? ‘না, না, মালবেরি কিছু বলেনি, একদম কিছুই না। আমি এমনিই কথার-কথা বলছিলাম একটা—’
পিসি আর কথা বাড়াল না। খাওয়া আমার হয়ে গিয়েছিল, আমায় নিয়ে চলল— কোথায়, আমি থাকব, তাই দেখাবার জন্য। ওর ঘরের পাশেই, ছোটোখাটো সুন্দর একখানা ঘর, যা যা দরকার হতে পারে একটা ছোটো মেয়ের, থুড়ি, তেরো বছরের একটি ভদ্রমহিলার— সবই সাজানো রয়েছে টেবিলে, তাকের উপর, আয়না পর্যন্ত রয়েছে একপাশে। কৃতজ্ঞতায় ভরে গেল অন্তর। পিসির দরদ আছে আমার উপর। আমি সুখেই থাকব এখানে।
পথের কষ্টে শ্রান্তই ছিলাম, শোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুমোলামও সারা রাত অঘোরে, ঘুম যখন ভাঙল, কোনো ঘরের বড়ো ঘড়িতে টং টং করে সাতটা বাজছে। উঠে পড়তে হয়। পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিতে হবে। সারা দিনের মতো তৈরি হয়ে গিয়ে বসতে হবে মনিবনীর ঘরে। বসবার আগে খেয়ে নিতে হবে প্রাতরাশ। কাজ অনেক।
খুট খুট করে দরজায় কে টোকা দিচ্ছে। ভাবলাম, পিসিই বুঝি। তাড়াতাড়ি খুলে দিলাম দরজা। ভয় না-থাক, আমি তবু ভিতর থেকে আগল বন্ধ করে শুয়েছিলাম রাত্রে।
দরজা খুলতেই চমক খেলাম একটা। পিসি তো নয়! একটা মেয়ে! আমারই বয়সি মেয়ে, থুড়ি মহিলা একটি। কে গা?
কথা সেই কইল। ‘আমি এক্ষুনি চলে যাচ্ছি। মালবেরি শে নিয়ে আসছে এক্ষুনি। ভাবলাম— যাওয়ার আগে তোমাকে একবারটি দু-চক্ষু মেলে দেখে যাই।’
‘তা বেশ করেছ, ধন্যবাদ’— বললাম আমি, ‘কিন্তু মানুষটা কে তুমি? যাচ্ছই বা কোথায়?’
‘আমি ফ্রেডা’— বলল ও, ‘তুমি যে কাজ করতে এসেছ, সেই কাজেই আমি ছিলাম এ বাড়িতে। বেশিদিন ছিলাম না, মোটমাট সাতদিন। আর পারলাম না। ভয় করে বড়ো। পালিয়ে যাচ্ছি তাই।’
ব-টে! ভয় তাহলে আছে সত্যিই। ‘ভয়টা কী?’— জিজ্ঞাসা করলাম ওকে।
‘কী যে, তা বোঝাতে পারব না।’ জবাব দিল ফ্রেডা— ‘অন্তত দুই কথায় পারব না বোঝাতে ও ঘরে গিয়ে বসলেই দেখবে ভয় একটা করছে। ওই বুড়ি মনিবনী— এরা সব বলে— শয়তানের কাছে নিজেকে ও বিক্রি করে বসে আছে। যাই ভাই, তোমার পিসি যদি আমায় এখানে দেখে ফ্যালে—’
‘দাঁড়াও, দাঁড়াও।’ ফিসফিস করে বলি তবু, ‘তোমার আগেও ভয় পেয়েছে কেউ?’
‘কেমন করে জানব? আমি যেমন তোমার সঙ্গে যেচে আলাপ করে গেলাম, আমার সঙ্গে সুজান তো তেমন যায়নি। হ্যাঁ, আমার আগে ছিল সুজান। তার আগে ক্লারা— অনেক— অনেক— কেউ সাতদিনের বেশি টেকেনি— যাই ভাই! বাইবেল আছে? না-থাকে তো, মালবেরিকে দিয়ে কিনিয়ে নাও, কাছে রেখো—’
নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেল ফ্রেডা। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে রইলাম দুই মিনিট। একটা অদম্য ঝোঁক মাথায় এসেছে, মালবেরির শে-তে চড়ে আমিও পালাই ফ্রেডার সঙ্গে। সাতদিনের বেশি কেউ টেকে না যে চাকরিতে, আমিই বা তাতে কয়দিন টিকব? হ্যাঁ, বাইবেল আমার আছে, বাড়ি থেকেই এনেছি। শয়তানের কাছে যে নিজেকে বিক্রি করেছে, দরকার হলে তার সঙ্গে আমি লড়াই করতে পারব। সে লড়াইয়ের যা হাতিয়ার তা সঙ্গেই আছে আমার।
না, পালাব না। উড়ো কথায় ভয় পেয়ে প্রথম চাকরিটা যদি শুরু করার আগেই ছেড়ে দিই, তাহলে আমার তেরো বছর বয়সকেই ধিক! সত্যিই টিকতে যদি না-পারি, চলে যাব। কিন্তু তার আগে টিকবার একটা চেষ্টা তো করতে হবেই!
গুটি গুটি এগিয়ে চললাম পিসির ঘরের দিকেই। ফ্রেডার কথা? না, ঘুণাক্ষরেও কাউকে বলেছি না যে, ওর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল এক মিনিটের জন্য।
না, তা বলছি না। কিন্তু এই পিসিমাটি কীরকম পিসি, তা বুঝতে পারছি না। যেখানে সাতদিনের বেশি টিকতে পারে না কোনো মেয়ে, ভয় থেকে পালিয়ে যায় চাকরি ছেড়ে, সেখানে নিজের ভাইঝিকে এনে কাজে ঢোকানো, এটা কীরকম ব্যাপার? বেশ দেখা যাচ্ছে, কেউ টিকছে না দেখে এমন একজনকে উনি পাকড়ে এনেছেন, যার উপরে ওঁর জোর চলবে কিছুটা। থাকতে না-চাইলেও ধরে রাখতে পারবেন জোর করে। ছিঃ—
কিন্তু দেখা যখন হল, মনের ভাব আমার মুখে প্রকাশ পেল না একটুও। তেরো বছর আমায় অনেক শিখিয়েছে। ধাপ্পা দিতে আমিও জানি। পিসির যোগ্য ভাইঝি।
কাজের জায়গায় গিয়ে বসলাম। বাপ! কী ঘর! এত বড়ো একখানা ঘরই আমি দেখিনি। আর এমন রং-চং, এত ছবির বাহার, এমন দামি আসবাব, আর সব কিছুর উপরে আলোর এত ঝলকলানি। একটা ঝাড়লণ্ঠন ঝুলছে, বত্রিশটা মোম জ্বলছে তাতে এই দিনের বেলাতেও। এ আলো বেশি দিন চোখে লাগলে চোখ অন্ধ হয়ে যাবে আমার। অবশ্য সেকথা মনে হইতেই হাসিও পেল দারুণ। বেশিদিন? ফ্রেডারা সাতদিনে পালিয়েছে। আমিই বা কয়দিন থাকতে পারব?
পিসি গদি-আঁটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়েছে আমায়, সামনে টিপয়ে এক গাদা ছবির বই। চাকরি করতে এসেছি, না, আমিরি করতে? অতিভক্তি চোরের লক্ষণ। এই অতি-সমাদর ভিতরের নোংরামিকে লঘু করে দেখাবার চেষ্টা ছাড়া আর কী?
বৃহৎ ঘরের মাঝখানে বৃহৎ পালঙ্ক। নীল রেশমি মশারিতে ঘেরা বিছানা। তার ভিতর মনিবনী শুয়ে আছেন। উঠছেন না তো বটেই, নড়াচড়া পর্যন্ত টের পাচ্ছি না ভদ্রমহিলার। এক একবার সন্দেহ হচ্ছে— মরেই গেছেন বুঝি উনি। কিন্তু মিসেস উইভার্নের নিশ্চিন্দিভাব দেখে বুঝতে পারি, সে সন্দেহ বাজে। উনি অন্তত একবার করে আসছেন ফি-ঘণ্টায়। চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিয়ে এক মিনিটের মধ্যে চলে যাচ্ছেন আবার। দেখে যাচ্ছেন যে সব ঠিক আছে কিনা।
লাঞ্চের আগে পর্যন্ত ঠায় বসে রইলাম চেয়ারে, পালঙ্কের উপরে জীবনের লক্ষণ কিছুমাত্র চোখে দেখলাম না। কানে শুনলাম না। নিশ্বাস? পড়ছে হয়তো বুড়ির, কিন্তু তা এত মৃদু যে ঘরের এ কোণ থেকে আমার কানে পৌঁছোবার কথাই নয়।
বেলা একটায় মিসেস উইভার্ন ঘরে এসে ঢুকলেন, আমার ছুটি দেড় ঘণ্টার জন্য। লাঞ্চে আধ ঘণ্টা, বেড়ানো বলে এক ঘণ্টা। আমি যেন কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। খেলাম পেট ভরে, বেড়ালাম আশ মিটিয়ে। তারপরে ফিরে এলাম আমার কর্মস্থানে।
মিসেস উইভার্ন এই দেড় ঘণ্টার সদব্যবহার করেছেন— এইটিই আমার অনুমান। বিছানা থেকে তুলে মনিবনীর প্রসাধন, বেশ পরিবর্তন, ভোজনাদি সব সমাপন করিয়েছেন। না-করিয়ে থাকলে ওভাবে ঘাড় নেড়ে আমায় বিদায়সম্ভাষণ জানাবেন কেন? সে ঘাড় নাড়ার কোনো অর্থ যদি থাকে, তবে তা এই যে তাঁর কাজ তিনি করেছেন। যতই দুরূহ কাজ হোক, সন্তোষজনকভাবেই তা সমাধা হয়েছে।
মিসেস উইভার্ন চলে গেলেন। আমায় বলে গেলেন, হুঁশিয়ার থাকতে। এখন আর উনি চটপট আসছেন না। লাঞ্চ হয়নি এখনও ওঁর। লাঞ্চের পরে বিশ্রাম ও অবশ্য চাই। মোটাসোটা মানুষ, আয়েশ ভালোবাসেন, গল্প ভালোবাসেন, খেয়েদেয়ে আরাম করবেন ঘণ্টা দুই অন্তত। তা উনি করুন গিয়ে। আমি ততক্ষণ একবার ছবির বইয়ের পাতার দিকে তাকাই, আর একবার তাকাই অদূরের ওই রহস্যাবৃত পালঙ্কের পানে। ওর ভিতরে কী আছে, দেখতে ইচ্ছে হয় বড়ো। পিসি বলেছে, মনিবনীর বয়েস হয়েছে। ফ্রেডা বলেছে, মনিবনী শয়তানের কাছে বিক্রি করেছেন নিজেকে। এহেন মানুষটা নিশ্চয়ই দেখবার মতো মানুষ।
দেখতে দোষ কী? দেখার অসুবিধাই বা কী? খুব সম্ভব মনিবনী ঘুমোচ্ছেন। সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া শক্ত নয়। নিশ্বাসের শব্দ এখানে বসে আমি পাচ্ছি না, তা ঠিক। কিন্তু খাটের পাশে গিয়ে দাঁড়ালে, কান পেতে শুনলে অবশ্যই শোনা যাবে তা। আর নিশ্বাসটা কীভাবে বইছে, তা শুনলে কে আর না-বোঝে যে মানুষটা ঘুমন্ত, না-জাগন্ত?
জাগন্ত বুঝলে পায়ে পায়ে ফিরে আসব, ঘুমন্ত বুঝলে—
আমি পায়ে পায়ে নিঃশব্দে এসে পালঙ্কের পাশে দাঁড়িয়েছি। শুনছি। অতিক্ষীণ শব্দ নিশ্বাসের। তবে ঘুমন্ত মানুষেরই নিশ্বাস যে ওটা, তাতে সন্দেহ নেই। এইবার তাহলে—
বলো কী? যার চাকরি করব, তার চেহারাটা দেখে রাখব না?
দেখবই। অন্তত একবার, এক মিনিটের জন্য হলেও দেখব। আমি নীল রেশমি মশারি আস্তে করে একটুখানি উঁচু করলাম। তারপর আর একটু, আরও— আরও একটু—
উঁকি দিচ্ছি সেই ফাঁক দিয়ে। ওই যে আমার মনিবনী— মাদাম এ্যাপলওয়াল।
একী মানুষের মুখ? যেটা দেখেছি? লম্বা লম্বা চোখা চোখা হাড়ের উপরে হলদে রুক্ষ চামড়া একখানা চাপানো, এখানে গর্ত, ওখানে গর্ত সেই চামড়ায়। চোখের পাতা আধ-বোজা। চোখের সাদা অংশটা আধখানা বেরিয়ে পড়েছে সেই আধবোজা পাতা থেকে। ভ্রু নেই। চুল আছে কিনা বোঝা যায় না, কারণ মাথায় একটা এক ফুট উঁচু রেশমি টুপি, তুর্কি ধাঁচের।
আর সারা অঙ্গ? কিছু বোঝবার যো নেই। সাটিনে ভেলভেটে সারা অঙ্গ মোড়া। রামধনুর সাত রং পাশাপাশি মেলা বসিয়েছে সেই পোশাকটায়। পা-দু-খানাতেও লাল উলের মোজা। অনাবৃত শুধু ভদ্রমহিলার হাতের পাতা দু-খানি। কেন তা জানি না। হয়তো নখগুলোর জন্যও হতে পারে। কোনো দস্তানা দিয়ে ও নখ ঢাকা সম্ভব নয়। হলদে হলদে নখ প্রত্যেকটা প্রায় দেড় ইঞ্চি লম্বা, তাদের ডগাগুলি কলমের নিবের আকারের। ক্রমশ সরু হয়ে এসে সূচাগ্র হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। অবাক! সেকালের বড়ো ঘরের মহিলারা কি এমনি করে রাখতেন নাকি হাতের নখকে? প্রিয়জনদের পক্ষে বিপদের কথা! যখন-তখন খোঁচা খেয়ে রক্তপাত হত নিশ্চয়ই।
দেখছি, দেখছি, দেখছি— বাহ্যজ্ঞান হারা হয়ে দেখছি। সুন্দর কিছু দেখলে মানুষ আত্মহারা হয়ে তাকিয়ে থাকে। বীভৎস কিছু দেখলেও মানুষ চোখ ফেরাতে পারে না তার দিক থেকে। যথা ফণাধর ভুজঙ্গ। এ-মূর্তিও তেমনই আমাকে যুগপৎ কাঁপিয়ে তুলছে, আবার আকৃষ্টও করছে।
কতক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম? পাঁচ মিনিট? পনেরো মিনিট? হুঁশ ছিল না। হুঁশ যখন হল, হঠাৎই হল, একটা রূঢ় আঘাত খেয়ে। আঘাতটা এল ঘুমন্ত ওই বৃদ্ধার দিক থেকেই, তিনি ঘুমের ঘোরে তীক্ষ্ন কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘কী বললি তুই? কী বললি তুই? আমি খুন করেছি ছেলেটাকে? তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে দেব না?’
আশ্চর্য কাণ্ড! সেই হতচেতনা বুড়ি তড়াক করে উঠে বসল, হাত বাড়িয়ে দিল আমাকে ধরবার জন্য। ভাগ্যিস উপস্থিত বুদ্ধি একেবারে লোপ পায়নি আমার, আমিও একলাফে পিছিয়ে এসেছি— তিন হাত।
এলে কী হবে? বুড়িও বিছানা থেকে সড়াক করে নেমে পড়েছে, নামতে গিয়ে আছাড়ও খায়নি, হাড়গোড়ও ভাঙেনি। তারপর আমি যত পিছোই, সে তত এগিয়ে আসে। এগিয়ে আসে ডান হাতের সেই সুচালো লম্বা নখগুলো বাগিয়ে। আসে আর চেঁচায়, ‘কী বললি? আমি খুন করেছি ছেলেটাকে? তোর জিভ টেনে ছিঁড়ে নেব না?’
মনিবনীর চ্যাঁচামেচি শুনেই মিসেস উইভার্ন ছুটে এল। আর ব্যাপার দেখেই দু-হাতে জাপটে ধরল বুড়িকে। উইভার্ন আমায় বলল, ‘তুমি দৌড়ে গিয়ে পিসিকে ডেকে আনো। তুমি থেকো না এখানে—’
পিসি আর মিসেস উইভার্নে মিলে বুড়িকে ঠান্ডা করে ঘুম পাড়িয়ে দিল অনেক কষ্টে। ডাক্তার এলেন। সব শুনে মাথা নেড়ে বললেন, ‘ও-বাতিক তো ওঁর অনেক দিনের, ওই ”কী বললি? আমি খুন করেছি?” বলে চীৎকার। এবারকার ব্যাপারে দেহে চোট লেগেছে খুব, যেমন বুকে তেমনি মগজে। তিরানব্বই বছর বয়েস হল। আর কতদিন জোড়াতালি দিয়ে রাখা যাবে?’
আমি উপস্থিত আছি ঘরে, তা বোধ হয় ওদের খেয়াল ছিল না। পিসি ককিয়ে উঠল, ‘অমন কথাও বলবেন না ডাক্তার! ওঁকে আপনি কোনোরকমে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলেই আমাদের এতগুলি লোকের চাকরি আছে। যেদিন উনি কবরে যাবেন, সেইদিনই ওঁর নাতি এসে বাড়িতে তালা বন্ধ করবেন, আমাদের হয়ে যাবে জবাব।’
‘তা বলে তো আর কাউকে চিরকাল বাঁচিয়ে রাখা যায় না! তিরানব্বই হল যে! মিস্টার এ্যাপলওয়াল এখন কোথায়? ওঁর নাতি?’
‘প্যারিতে, খবর দিতে বলেন নাকি?’— পিসির প্রশ্ন যেন একটা আর্তনাদ।
‘তা দেওয়া ভালো। কী হয়, বলা যায় না। তিরানব্বই হল কিনা!’
ডাক্তার চলে গেলেন। আর সেই রাত্রেই বুড়ি মারা গেল।
বাড়িসুদ্ধ লোক, অর্থাৎ মাইনে-করা কর্মচারী, নানা স্তরের—
সবাই মুষড়ে পড়ল— যেন সবচেয়ে বড়ো আপনার জন মারা গিয়েছে তাদের। আমার পিসি যেন হতজ্ঞান হয়ে গেল শোকে একেবারে। বিস্তর আয় ছিল তার এখানে। ঠিক এমন আর একটা চাকরি জোটানো শক্ত হবে তার পক্ষে।
মিস্টার এ্যাপলওয়াল, বুড়ির নাতি, এসে পৌঁছলেন দুই দিন পরে। এসেই সমাধি দিলেন ঠাকুরমার। তারপর এক মাসের নোটিশ দিলেন সব লোকজনকে। বাড়ি আপাতত তালা বন্ধই থাকবে। যতদিন না বিক্রির বন্দোবস্ত হয়। নিজে এখানে বাস করা? কদাপি না। অন্য জায়গায় গিয়ে থাকলে ঠাকুরমার বদনাম নাতিকে স্পর্শ করবে না। কিন্তু এখানে থাকলে? আড়ালে আড়ালে কে না-বলবে যে, ছেলেটাকে এই এ্যাপলওয়ালের ঠাকুরমাই খুন করেছিল?
কর্মচারীদের কাছে নোটিশের কৈফিয়ত হিসেবেই এই কথাগুলি বলছিলেন এ্যাপলওয়াল। বলতে বলতে উত্তেজিত হয়ে উঠলেন তিনি। প্রায় চেঁচিয়েই উঠলেন, ‘কী অন্যায় দেশের লোকের, বোঝো তোমরা। আমার সেই জ্যেঠা মারা গেল জলে ডুবে। জলের ধারে পোশাক পাওয়া গেল তার। দেহ পাওয়া যায়নি, তা হয়েছে কী? নদীর স্রোতে কোন মুলুকে ভেসে গিয়েছিল, কে জানে। তা দেখ, মরল সে জলে ডুবে, বদনাম হল আমার ঠাকুরমার। কোনো প্রমাণ কেউ দিতে পারল না, খামোকাই রটে গেল বদনাম যে, সতিনের ছেলেটাকে খুন করেছে মাদাম এ্যাপলওয়ালই— এটা কি বড়ো ভালো কাজ হয়েছে দেশের লোকের? এখনও! এখনও ওই মিথ্যে অপবাদ নিয়ে কানাঘুসোর অন্ত নেই এদেশে। কী সুখে আমি থাকব এখানে?’
একমাস সবাই এখানে আছি এখনও। মিসেস উইভার্নকে এক সময়ে পাকড়াও করলাম, ‘পিসিমা! ব্যাপারখানা কী হয়েছিল?’
আমার পিসির সখী হিসেবে মিসেস উইভার্নও পিসিই হয়ে গিয়েছেন আমার।
তা, মিসেস উইভার্ন স্বীকার করলেন, অপবাদ একটা আছে চিরকালই। প্রায় সত্তর বছর আগে সূত্রপাত সে অপবাদের। ওই বুড়ি যাঁকে কবর দেওয়া হল কাল, স্বামীর ঘরে আসবার দিন কতক বাদেই স্বামীর প্রথম পক্ষের ছেলেকে কোথায় যে সরিয়ে দিলেন, তার আর পাত্তা হল না। লোকে রটিয়ে দিল, সতিন কাঁটাকে খুন করে নিজের অনাগত সন্তানের পথ পরিষ্কার করে রাখলেন দ্বিতীয় পক্ষের মিসেস এ্যাপলওয়াল। অর্থাৎ হালের ওই বুড়ি। প্রমাণ পাওয়া না-যাক, রটনা থামল না, থামেনি কোনোদিন।
থামতে পারেনি আরও বুড়ির নিজেরই পাগলামির দরুন। সারাজীবনই কেমন এক হিস্টিরিয়ায় ভুগেছেন তিনি। হঠাৎ এক-এক সময় চেঁচিয়ে উঠতেন, ‘কী বললি? আমি খুন করেছি ছেলেটাকে? এরই জন্য লোকে বলাবলি করত, শয়তানের কাছে নিজেকে উনি বিক্রি করেছিলেন। এইসব কথা শোনার পরে, সেইদিনই রাত্রে—
নিজের ঘরে শুয়ে আছি। ঘুমিয়েছিলাম বটে, তবে ভেঙে গিয়েছে ঘুমটা। মনটা ভালো নেই বলেও ঘুমও ভালো হচ্ছে না। চাকরি পেয়েছিলাম, গেল চাকরিটা। আর কোনোদিন পাব কি না, ঠিক কী! মন খারাপ হওয়ার তো কারণ রয়েছে রীতিমতো!
ঘুম হচ্ছে না, তাকিয়ে আছি ঘরজোড়া অন্ধকারের দিকে। হঠাৎ এক জায়গায় অন্ধকারটা ফিকে হয়ে এল কেন? একটা লালচে আলো ফুটে উঠছে দেয়ালের ধারে। আমি ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে সেই দিকে তাকিয়ে আছি। ভয় হবে না? বাড়ির কর্ত্রী সদ্য মারা গিয়েছেন, আর অমন কর্ত্রী, যাঁর বদনাম রয়েছে এই বলে যে, তিনি শয়তানের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দিয়েছিলেন? সপত্নী-পুত্রকে খুন করেছিলেন নিজের ছেলেকে জমিদারি দেওয়াবার জন্য?
তাকিয়ে আছি, সেই লালচে আলোর ভিতরে একটা মূর্তি ফুটে উঠছে আস্তে আস্তে। সেই বুড়িটারই মূর্তি, সেই সাটিন ভেলভেটের পোশাক, সেই লম্বা তুর্কি টুপি, সেই ছুঁচোলো নখ দুই হাতে। সর্বনাশ! ভূত! বাইবেলখানা বালিশের তলাতেই আছে, সেখানি হাতে নিলাম।
ডান হাতে নখ ছাড়াও আরও একটা জিনিস, একটা চাবি। বুড়ি সেই চাবি দেয়ালের ভিতর ঢুকিয়ে দিল, আর তার পরই দেয়ালের গায়ে বেরিয়ে পড়ল একটা দরজা। খোলা দরজার ভিতর মুখ বাড়িয়ে কী যেন দেখল বুড়ি অনেকক্ষণ ধরে, তারপর দরজায় আবার চাবি বন্ধ করে দিল। লালচে আলোটা ফিকে হতে হতে ক্রমশ নিবে গেল। আর বুড়ির মূর্তিটাও অদৃশ্য হয়ে গেল ধীরে ধীরে।
সারা রাত্রি আমি কীভাবে কাটালাম, তা কেমন করে বোঝাব?
রাত ভোর হল। কাউকে কিছ না-বলে আমি সোজা চলে গেলাম মিস্টার এ্যাপলওয়ালের কাছে। পিসিকে আমার বিশ্বাস নেই। উনি কী জিনিস কীভাবে ঘুরিয়ে দেবেন, কে বলতে পারে?
এ্যাপলওয়াল আমার সব কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে রইলেন অনেকক্ষণ। তারপর আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলে এলেন আমার ঘরে, ‘ঠিক কোন জায়গায় মূর্তিটা চাবি লাগিয়েছিল দেয়ালে, দেখিয়ে দাও তো!’ আমি দেখিয়ে দিলাম। এ্যাপলওয়াল নিজেই শাবল এনে দেয়াল খুঁড়তে লাগলেন সেই জায়গায়। দেখতে দেখতে চাঙাড়ে চাঙাড়ে চুনবালি খসে পড়ল সেখান থেকে, নীচে থেকে প্রকাশ পেল একটা দরজা।
এইবার পিসিকে ডাকলেন এ্যাপলওয়াল, তাকে বললেন, ‘ঠাকুরমার কোনো গোপন চাবি কোথাও ছিল বলে তোমার জানা আছে?’
পিসি বলল, ‘কর্ত্রীর গয়নার বাক্সে একটা বড়ো চাবি দেখেছি—।’
বার করা হল সেই চাবি। আর দেয়ালের চাবির ফোকরে সে চাবি ঢুকেও গেল স্বচ্ছন্দে। এ্যাপলওয়ালের মুখটা ছাইয়ের মতো বিবর্ণ দেখলাম। সেই চাবি ঘোরাতেই দরজা খুলে গেল, আর আলো হাতে নিয়ে এ্যাপলওয়াল সেই ঘরে ঢুকলেন। ঘরের মধ্যে ঘর, দরজা ওই একটিই, জানালা নেই, কাজেই রীতিমতো অন্ধকার।
কত কালো ধুলো যে জমে আছে ঘরে। তা থাকুক, ওদিককার দেয়ালের গায়ে একটা বড়ো কাঠের সিন্দুক। তালা বন্ধ নেই তাতে। এ্যাপলওয়াল ডালা খুলে ফেললেন।
রাশিকৃত বাসনকোসন, আর তাদেরই মধ্যে একটা পুরো কঙ্কাল। আকারে ছোটো, কোনো বালকেরই কঙ্কাল।
‘এই তাহলে সেই প্রমাণ?’— বললেন এ্যাপলওয়াল, ‘অপবাদটা তাহলে অমূলক নয়। ছেলেটাকে ঠাকুরমা তাহলে খুনই করেছিলেন!’
আগের হুকুম রদ হল না। বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্তে অটল রইলেন এ্যাপলওয়াল। তবে নতুন কিছু একেবারেই তিনি না-করলেন তা নয়। আমায় দিলেন স্কুলে পাঠিয়ে। যতদিন আমি পড়ব, সব খরচই তিনি জোগাবেন।