জয়েনুদ্দীন পুরাণ
আমানুল্লাহর কেবিন।
পড়ন্ত বিকেলের হলদে রোদ এসে পড়েছে টেবিলের ওপরে। আকাশ মেঘলামত হয়েছিল একটু আগে, বৃষ্টি হয়নি। বাইরে পুরো হলুদ হয়ে গিয়েছে। তারওপরে ভ্যপসা গরম। আমানুল্লাহর কেবিনটা অবশ্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। শোঁ শোঁ করে দেড় টনের একটা এসি চলছে। বাইরের তাপমাত্রা পঁয়ত্রিশ হলেও ভেতরে বাইশ ডিগ্রী সেলসিয়াস। তারপরেও হাঁশফাঁশ করছেন তিনি। শান্তি পাচ্ছেন না। নিজের চেয়ার ছেড়ে থাইগ্লাসের টানা জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। দৃষ্টি দূরের ভবনের ছায়াগুলোতে।
হাতের এত কাছে জানোয়ারটাকে পেয়েও ধরা গেল না। এতগুলো পুলিশ, অথচ সামান্য একটা প্রেসের টাইপিস্টকে ধরতে পারল না? এরা কি খেয়ে চাকরি করতে এসেছে? এখন পর্যন্ত সেই জানোয়ারটার খোঁজ করতে পারল না কেউ। আরে! তুই যদি কোন অপরাধ না করে থাকিস, তো পালাচ্ছিস কেন? নিজের অবস্থান পরিষ্কার করে বল? সৌমেন ঘোষের কানে কথাটা পৌঁছেছে কিনা জানা যায়নি, তবে ঝড়ের আগে যে নিস্তব্ধতা নেমে আসে, সৌমেন ঘোষ সেই রকম নিস্তব্ধ হয়ে আছেন। এবার যদি ডাক পড়ে আমানুল্লাহর, তাহলে সেটা হবে খুব বড় ধরনের একটা দুঃসংবাদ।
প্রণবের খোঁজ নেই। আজ প্রায় তিন দিন হয়ে গেল সে সিলেটে গিয়েছে। মোবাইল বন্ধ। হবিগঞ্জের সদর থানার ওসিকে বেশ কয়েকবার ট্রাই করেছেন তিনি। তিনি কোন হদিস টদিস দিতে পারেননি। তবে সিলেটের সদর থানার ওসি অবশ্য বলেছেন প্রণব নাকি হবিগঞ্জের ওদিকে গিয়েছেন। কিন্তু কোথায় গিয়েছেন, জানেন না। তিনি ফোর্স পাঠাচ্ছেন এনকুয়েরি করার জন্য। প্রণবের মত একজন অভিজ্ঞ এজেন্টকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই, তারপরেও চিন্তা হচ্ছে। চিন্তা বাড়ছে।
ওদিকে তন্দ্রানীলা মেয়েটাকে নিয়েও ঝামেলার মধ্যে আছেন। ভালো একটা পাত্র দেখে বিয়ে দিয়ে দিতে চাচ্ছেন, সে রাজি না। তার মধ্যে আজকাল অনেকটা সময় বাইরে থাকে সে। কোথায় থাকে কি করে কিচ্ছু বলে না। স্টাডিতে তিনি অবশ্য ফিঙ্গার প্রিন্ট লক বসিয়েছেন। কিন্তু তারপরেও ভেতরে খুত খুত করে আমানুল্লাহর। রাতে বাড়ি ফেরেন, মেয়েটা একটা কথাও বলে না। রোবটের মত চলাফেরা। চিন্তা হওয়ার আরেকটা কারন, দিনদিন মেয়েটা যেমন অস্থির, তেমন মন মরা হয়ে যাচ্ছে। সেদিন ভীষণ কষ্টে মেয়েটাকে চড় মারা থেকে নিজেকে সংবরণ করেছেন। ডায়েরি পড়েছি বলে এমন করছ? কেন আমি তোমার বাবা না? তোমার ডায়েরি পড়ার অধিকার নেই আমার? আমি যদি তোমার অনুমতি না নিয়ে তোমার স্টাডিতে ঢুকতাম, তাহলে কেমন লাগত?
হাতের সিগারেটটা হাতেই পুড়ে যাচ্ছে। এই বদঅভ্যাসটা কোনভাবেই পিছু ছাড়ছে না।
“আসব?” দরজা খুলে জয়েনুদ্দীনের প্রশ্ন।
“আসেন আসেন।” আমানুল্লাহ বললেন। নিজের চেয়ারে গিয়ে বসলেন, বললেন, “বসেন।” কালো রেক্সিনে মোড়া চেয়ার দুটোর একটা টেনে নিয়ে বসলেন জয়েনুদ্দীন। জয়েনুদ্দীন নামের এই লোকটাকে নিয়ে প্রথমে খুত খুত করত মনের ভেতরে। মনে হত, এই লোকটা কি কোনভাবে খুনের সাথে জড়িত? তারপরে শেষের দুটা খুনের সময় লোকটা আমানুল্লাহর সাথেই ছিলেন। একেবারে আমানুল্লাহর পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পেনড্রাইভটা পাওয়ার পরে অবশ্য সব ধোঁয়াশা কেটে গিয়েছে। এখন শুধু সুকান্তকে গ্রেপ্তার করতে হবে। তারপর বাকি ধোঁয়াশা কেটে যাবে। কেন সে ইমন মোস্তাফিজকে খুন করল। আর কেনই বা অপরেশ তাকে ইমন মোস্তাফিজের খুনের ইনভেস্টিগেশন করতে নিষেধ করছিলেন। সব খুনের পেছনেই নে ওই সুকান্তই জড়িত, এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
“কি খাবেন? কফি বলব?” আমানুল্লাহ জিজ্ঞাসা করলেন।
“হ্যাঁ তা বলতে পারেন। ব্ল্যাক এন্ড নো সুগ্যার।”
আমানুল্লাহ ইন্টারকমে দুইটা কফি আনতে বললেন। তারপর জয়েনুদ্দীনের দিকে ঘুরে বসতে বসতে বললেন, “তারপর? কেমন আছেন?”
“আছি ভালোই। স্টেডিয়ামের এদিকে এসেছিলাম, ভাবলাম দেখা করে যাই। আসলে, আমার মনে হয়, চুপচাপ বসে না থেকে সুকান্তের খোঁজে আমাদেরই বেরিয়ে পড়া উচিৎ। যতক্ষণ ও ধরা না পড়ছে, খুন কিন্তু হতেই থাকবে।”
“তা একটা কথা বলেছেন। কিন্তু কথা হল যে, পুরো ঢাকা তো বটেই, ঢাকার আশেপাশের যতগুলো জায়গায় ও যেতে পারে, মোটামুটি সবগুলো জায়গাতেই এনকুয়েরি চলছে। কিন্তু ছেলেটা স্ট্রেঞ্জ, বুঝলেন? ওর ব্যাকগ্রাউন্ড ইনভেস্টিগেট করা হয়েছে। দুই দুইবার নাকি সুইসাইড করতে গিয়েছিল।”
“কবেকার ঘটনা এটা?”
“এক বছর আগে। ছেলেটা এভাবে খুন করছে কেন বলেন তো?”
“আমার যতদূর মনে হচ্ছে, ক্ষোভ। ঘোস্ট রাইটিং করে সে টাকা পেয়েছে, কিন্তু সম্মান তো আর পায়নি। যশ-খ্যাতি কে না চায় বলেন? তাছাড়া আজকালকার লেখকরা তো যশ-খ্যাতি বলতে পাগল। ইয়াং ছেলে। লেখালেখি করেছে, টাকা পেয়েছে কিন্তু ফেম পায়নি। তাই হয়ত ও এমনটা করছে। হতাশা বুঝলেন।”
“সুভাষকে তাহলে কেন মারল?”
“ওই যে, ইমন মোস্তাফিজ পেনড্রাইভে ওর দুরভিসন্ধি ফাঁস করে দিতে সুভাষের কাছে দিয়েছিল, এইজন্য। পেনড্রাইভটা ও খুঁজেছিল। আর এইজন্যই সুভাষের সারা ঘর ছিল এলোমেলো। কিন্তু সে ওটা পায়নি। তার আগেই হয়ত অন্য কেউ চলে এসেছিল। সুকান্ত পালিয়েছে।”
“অন্য কেউটা কে?
“সেই সিএনজিওয়ালা। তার খোঁজ পাওয়া গেল?”
“খোঁজ চলছে। আপনি এতো চমৎকার এনালাইসিস কিভাবে করেন আমাকে বলবেন? মানে, এই যে, এত চমৎকারভাবে সম্পূর্ন ক্রাইমটা সিকোয়েন্স বাই সিকোয়েন্স ব্যাখ্যা করেন, কীভাবে সম্ভব এটা?”
“তেমন কিছু না। পুরোটাই অবজারভেশন। মন দিয়ে দেখা। আশেপাশের সবটা মন দিয়ে দেখা, আর নিজেকে খুনির জায়গায় কল্পনা করা। তারপর, সব থেকে খারাপ কি ঘটতে পারে আর খারাপ কি ঘটেছে সেটা দেখা, যেমন ধরেন কেউ ভিক্টিমের মাথায় আঘাত করে খুনটা করেছে, তাহলে আমি দেখার চেষ্টা করি, কেন সে মাথাতেই আঘাত করল? কেন ঘাড়ে বা পিঠে বা অন্য কোথাও আঘাত করল না? কিন্তু সত্যি বলতে কি জানেন, এই ছেলেটা আমাকে অনেক বিভ্রান্ত করে দিয়েছিল।”
“কে? সুকান্ত?”
“হ্যাঁ। আমি ওর মোটিভ এখনও বুঝতে পারিনি। যারা বীভৎসভাবে খুন করে, তারা আসলে অন্যদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে চায়। দেখাতে চায় যে তারা কতটা ভয়ানক। যেমন কংসচক্রের কয়েকটা খুনের কথা তো জানেনই। ওরা চেইন স’ দিয়ে কয়েকটা মানুষকে শরীরের মাঝ বরাবর কেটে দুইভাগ করে ফেলে রেখে গিয়েছিল কুষ্টিয়ার মিলপাড়া স্টেশনের ওয়েটিং রুমে। এগুলো আসলে ত্রাস সৃষ্টি করা। কিন্তু এই ছেলেটা, সে খুনগুলো করেছে এলোপাথাড়িভাবে, মানে, সে কোন ত্রাস সৃষ্টি করতে চায় না, কিন্তু তার ভেতরে কোথায় যেন একটা ক্ষোভ আছে। আর ক্ষোভটা কি সেটা তো বললামই। এই জন্যই কিন্তু ও কলম দিয়ে খুনগুলো করেছে।”
“বুঝলাম। ওকে এরেস্ট করার পরপরই সেটা জানা যাবে। আচ্ছা, আমি তো শুনেছি, আপনি আগে প্যারাসাইকোলজির অধ্যাপক ছিলেন। কথাটা কি সত্যি?”
“আরে নাহ। প্যারাসাইকোলজি দিয়ে দুনিয়া চলে? আপনিই বলেন, আপনি হিপনোটিজমে বিশ্বাস করবেন? আপনি টেলিপ্যাথিতে বিশ্বাস করবেন? প্রি-কগনিটিভ ভিশন আজকাল কেউ বিশ্বাস করে? তারপর ওই যে, কি সব বলে না, আগে থেকে মৃত্যু টের পাওয়া, পূর্ব জন্মের কথা মনে পড়া, এগুলো আসলে স্রেফ মিডিয়ার মাল মসলা ছাড়া আর কিছু না।
“বিশ্বাস করে না এর মানে এই না যে সেগুলো একেবারে ফেলে দেওয়ার মত। হতে পারে সেগুলোরও আলাদা ব্যাপার-স্যাপার আছে।”
কফি আসল। জয়েনুদ্দীন কফিতে চুমুক দিলেন। বললেন, “তা ঠিক আছে। কিন্তু সায়েন্স আজকাল নিজেই নিজের ভুল প্রমাণ করেছে। সায়েন্স দিয়ে এগুলো প্রমাণ করা যায় না, এগুলো বিশ্বাস। সরল মনের বিশ্বাস।”
“তাহলে আপনি এই যে ক্রাইম সিন এনালাইসিস করে যে খুনির অনুমান করেন, এইটা কি?”
“ওই যে বললাম, এনালাইসিস। বিচার বিশ্লেষণ।”
“কীভাবে এত সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করা শিখলেন।”
“আমার জন্ম হয়েছে পঞ্চগড়ের ওইদিকে। মা স্কুল মাস্টার ছিলেন। বাবা মারা গিয়েছিলেন আমার জন্মের আগে। শুনেছি তিনি কাঠ চেরাইয়ের কাজ করতেন। জলপাইগুড়িতে তার একটা কারখানা ছিল। তো আমি যেখানে জন্ম নেই সেটা ছিল আধা শহর আধা গ্রাম। সেখানকারই এক স্কুলে, মানে আমার মা যেই স্কুলে চাকরি করতেন সেই স্কুলে পড়াশোনার শুরু। কলেজে উঠে ফটিক নামের এক ছেলের সাথে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ওর পাল্লায় পড়েই আমি বাজি ধরা শিখি। ফটিক আবার খুব ফুটবল খেলত।”
“কী ধরা?”
“বাজি ধরা।”
“আচ্ছা। তারপর?”
“আমাদের ওখানে শীতকালে সীমান্তের ওই দিকে, মানে তখন তো আর এরকম কাঁটাতার ছিল না, সত্তরের দশকের কথা বলছি, তখন দেশ কেবল স্বাধীন হয়েছে। তো, শীতের ওইদিকে ক্রিকেট ম্যাচ হত। ওখান থেকেই বাজি ধরা শুরু। এই বলটা কি হবে? চার, ছক্কা, সিঙ্গেল, আউট নাকি নো বল? ওই ক্রিকেটে যেরকম বাজি টাজি ধরা হয় আর কি। আমি, কীভাবে কীভাবে দু এক মাসের ভেতরেই তুখোড় বাজিকর হয়ে গেলাম বুঝলেন। দু তিন টাকা করে প্রতি ম্যাচেই জিততাম। একটা নেশার মতো হয়ে গেল।”
“তারপর?”
“ছোটবেলা থেকে অভাবে অভাবে বড় হয়েছি। মাকে তপ্ত রোদের ভেতরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতে দেখেছি। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু চাইতে পারিনি। একটা ক্রিকেট ব্যাট চাইতে পারিনি। একটা সাইকেল চাইতে পারিনি। তো এই যে টাকাগুলো হাতে আসতে লাগল, আমি আমার সেই চাওয়াগুলো পূরণ করতে শুরু করলাম।”
“কীভাবে?”
“তখন ফুটবলের খুব পসার। আবাহনী, মোহামেডান তো ছিলই, তার ওপরে আঞ্চলিক লীগেও প্রচুর খেলা টেলা হত। কলেজ পার করে ওই ফুটবল খেলার ওপরে বাজি ধরতাম। শুক্রবারে ঢাকায় যে খেলাগুলো হত সেগুলো বিটিভিতে দেখাত, সেগুলোতে বাজি ধরতাম। আমার এনালাইজিং পাওয়ার ততদিনে বেশ পোক্ত হয়ে গিয়েছে। প্লেয়ার দেখেই বলে দিতে পারতাম, কে আজ কটা গোল করবে। কোন দল জিতবে। তো, হঠাৎ জলপাইগুড়ি থেকে কয়েকজন লোক এসে খুঁজতে…”
ল্যান্ডলাইন বেজে উঠল। “এক সেকেন্ড” বলে আমানুল্লাহ জয়েনুদ্দীনকে থামিয়ে দিলেন। রিসিভার তুললেন।
“স্যার, ফিল্ড এজেন্ট সাইদুর কথা বলবে। তিন নাম্বার লাইনে আছেন।”
তিন প্রেস করে আমানুল্লাহ বললেন, “সাইদুর সাহেব বলেন।”
“স্যার, ঢাকায় প্রাইভেট সিএনজির সংখ্যা ষোল হাজার। বেশিরভাগই নিউজ এজেন্সির। তবে একটা অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, ইমন মোস্তাফিজের একটা প্রাইভেট সিএনজি আছে।”
“ওটা ট্র্যাক করেন। আর ইমন মোস্তাফিজের বাড়ির ওপরে টুয়েন্টিফোর সেভেন নজর রাখেন। আর খোঁজ করেন কোন নিউজ এজেন্সি সুভাষের ওপরে ব্যতিক্রমধর্মী কোন ধরনের নিউজ বের করার চেষ্টা করছে কিনা। আমার মনে হচ্ছে, কোন সাংবাদিক হয়ত ওখানে খুনের সময় উপস্থিত থাকতে পারে। কি হয় না হয় আমাকে জানাবেন।”
“শিওর স্যার।”
লাইনটা কেটে গেল। “তারপর?” রিসিভার রাখতে রাখতে বললেন আমানুল্লাহ।
জয়েনুদ্দীন আবার শুরু করলেন, “তো জলপাইগুড়ি থেকে কয়েকজন লোক এসে খুঁজতে শুরু করল আমাকে। যেদিন খুঁজতে লাগল ঠিক তারপর দিন আবার এপার ওপার, মানে বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত প্রীতি ম্যাচ। সীমান্তের ওইদিকে একটা মাঠে খেলা হবে। লোকগুলো আমার কাছে এসে আমার নামধাম জানল। ওরাও বাজিকর। ওরাও বাজি ধরবে। বাজির বিষয় ছিল, কোন প্লেয়ার সব থেকে বেশি গোল করবে। ওরা একটা অদ্ভুত শর্ত রাখল।”
“কি শর্ত?”
“যদি আমি জিতি, তাহলে আমি কোন প্রাইজ মানি পাব না। বদলে আমি যেন আজীবন মোটা অংকের টাকা রোজগার করতে পারি সেই ব্যবস্থা তারা করবে। আমাকে আর পেছনে তাকাতে হবে না। আর যদি হারি, তাহলে যে প্লেয়ারের ওপরে বাজি ধরছি, ওকে খুন করে ফেলা হবে। আমি বড় বিপদে পড়েছিলাম। লোভ আর ভয়, দুটোই আমাকে ঘিরে ধরেছিল। একদিকে ফটিক, আমার সব থেকে কাছের বন্ধু, তার মৃত্যুভয়, অন্যদিকে এই অভাবে জড়ানো জীবন থেকে মুক্তির স্বাদ। আমাকে জিততেই হত। আমি বাজি ধরলাম। ফটিকের ওপরেই বাজি ধরলাম। ও নিয়মিত প্লেয়ার না, তারপরেও ওর ওপরেই বাজি ধরলাম। কিন্তু…”
জয়েনুদ্দীন ঘামতে শুরু করলেন। কপাল আর নাকের ডগায় বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করল। গোল কাঁচের চশমাটা খুলে রাখলেন টেবিলের ওপরে। পুড়ে যাওয়া সিগারেটের ফিল্টারটা এশট্রেতে ফেলে আমানুল্লাহ জিজ্ঞাসা করলেন, “ফটিক হেরে গেল? ওকে খুন করা হল আর আসামী হলেন আপনি।”
“ফটিক জিতে গেল। পুরো ম্যাচে বাংলাদেশ একাদশ গোল করল তিনটা। তিনটাই ফটিকের। আর ভারত একাদশ গোল করল একটা। তিন বাই একে বাংলাদেশ জিতে গেল। ফটিক প্রাইজমানি পেল। কিন্তু ওই লোকগুলো, মানে যারা জলপাইগুড়ি থেকে এসেছিল আর কি, ওরা বলল, ফটিকের সাথে আর কখনও দেখা করা যাবে না। সেই রাতেই আমরা সীমান্ত পেরিয়ে জলপাইগুড়ি রওনা হলাম। মায়ের সাথেও দেখা হল না।
“তারপর?”
“জলপাইগুড়ি গিয়ে জানতে পারি, লোকগুলো মাওবাদী। ত্রিপুরা মেঘালয়ে সেইসময় বিদ্রোহ ওরাই করছিল। ওদের তখন টাকার দরকার। তো ওরা বলল, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, বিধাননগর, এইদিককার গ্রামগুলোতে ওরা মেলার আয়োজন করত। সেখানে হাউজি খেলার ব্যবস্থা থাকত। হাউজি বুঝেছেন তো?”
“হুম, জুয়া।”
“হুম, জুয়া। ওখানে প্রাইজমানি হিসাবে টাকা দেওয়া হত। কিন্তু টাকার চাইতেও অনেক বড় কিছু থাকত। জুয়ার গ্র্যান্ডপ্রাইজ থাকত এক সুন্দরী মহিলা। হাউজি বোর্ডের মাঝখানে বসানো হত স্বল্পবসনা সুন্দরী মহিলাকে। এই জুয়া খেলার পুরোটাই ছিল প্রতারণা। পুরোটাই ধাপ্পাবাজি। গ্রামের অশিক্ষিত লোকগুলো ওই সুন্দরী মহিলাকে পাওয়ার আশায় সারা রাত তাস খেলায় বাজি ধরত। পুরো ব্যাপারটা আমি নিয়ন্ত্রণ করতাম। আমি বুঝতে পারতাম, কার কাছে কোন তাস আছে, সেই তাস অনুযায়ী আমি আমার হাতে আরো তিন চারটা চোরা তাস লুকিয়ে রাখতাম। এভাবেই অশিক্ষিত লোকগুলো সারারাত বাজি ধরে যত টাকা জিতত, ততই ওই মহিলাকে পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ত। ভোর রাতের দিকে সব খুইয়ে তারা বাড়ি ফিরত। অবশ্য হ্যাঁ, ব্যাপারটা বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য আমাদের নিজের কিছু লোক থাকত। ওদেরকে ইচ্ছা করেই জিতিয়ে দিতাম আমি। ওরা সেই মহিলাকে নিয়ে তাঁবুর ভেতরে ঢুকে যেত। সবাই বিশ্বাস করত, যে আসলেই ওই মহিলাকে পাওয়া যায়। কিন্তু এটা ছিল মরীচিকা।”
“তারপর?”
“তারপর, তারপর একদিন সেই ভদ্রমহিলা মারা গেলেন। মারা গেলেন মানে, অনেকেই বলল আত্মহত্যা, আবার অনেকেই বলল খুন। পুলিশ আসলো। আমার কাছে তখন অনেকগুলো টাকা। পুরো এক সপ্তাহের মেলার টাকা। আমার কাছে তখন দুটো পথ খোলা, এক, আমি টাকাগুলো নিয়ে পালিয়ে যেতে পারি, দুই, আমি টাকাগুলো নিয়ে দূরে চলে যেতে পারি। অনেক দূরে। জলপাইগুড়ির পাহাড়ি বনগুলোতে একবার হারিয়ে যেতে পারলে বাপের সাধ্য নেই ধরবে। কয়েকদিন গা ঢাকা দিয়ে আবার বাংলাদেশে ফিরে যাব- এরকমই উদ্দেশ্য ছিল।”
আমানুল্লাহর ভ্রু কুঁচকে গেল। এতক্ষণ যে মনোযোগ দিয়ে তিনি জয়েনুদ্দীনের কথাগুলো শুনছিলেন সেই মনোযোগে ছেদ পড়ল। মাথায় আরেকটা বিষয় ঘুরপাক খাচ্ছে। খচ খচ করছে। কিছুতেই জয়েনুদ্দীনের কথায় আর মন বসছে না।
“আমি চলে গেলাম। টাকাপয়সা, মানে তখনকার সময়ে প্রায় মনে করেন দুশো রুপি! ওই নিয়ে আমি জঙ্গলে হারিয়ে গেলাম। সাঁওতালদের একটা গ্রুপের সাথে মিশে গেলাম। ওরা আমাকে ‘গুদ্র বঙ্গা’ বলে ডাকত। গুদ্র বঙ্গা কি জানেন তো? ওই যে, সাঁওতালদের একটা বন দেবতা। বামন, দুই তিন ফিট উঁচু। গভীর বনের মধ্যে মৃত মানুষের ধন সম্পত্তি পাহারা দেয় অনেকটা ওদের মত। তো আমি ততদিনে মানুষকে অনেকখানি পড়তে শিখে গিয়েছি। মানুষের দুর্বল দিকগুলো আমি ততদিনে অনেক সহজে খুঁজে বের করতে শিখে ফেলেছি। আমি জ্ঞানটা কাজে লাগালাম। বনের ধারে, আসামের ওইদিকে ছোট ছোট গ্রাম ছিল। সেখানে হাত দেখা শুরু করলাম। হাত দেখতে আসা মানুষ এমনিতেই দুর্বল মনের অধিকারী হয়। তাদেরকে সহজেই পড়া যায়। তারা খুব সহজেই নিজের গোপন জায়গাগুলো প্রকাশ করে ফেলে। ভালোই টাকাপয়সা রোজগার হচ্ছিল। কিন্তু একদিন আমি ধরা পড়ে গেলাম। মাওবাদির একটা গ্রুপ আমাকে চিনে ফেলল। ঘিরে ফেলল চারদিক থেকে। আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আমার দুইজন সাঁওতাল পুরুষের মৃত্যু হল। ওরা আমাকে ধরে আবার জলপাইগুড়ি ফিরিয়ে আনল।”
“হুম।”
“ওদের এরিয়া ভিত্তিক যে লিডার ছিল তাকে বলা হত ‘মাস্টার’। সেই মাস্টারের সাথে সেটাই আমার প্রথম পরিচয়। ওরা আমাকে বলল, তুই তো মানুষের মন পড়তে পারিস, ভবিষ্যত দেখতে পারিস? বল একটু পরে কাকে তোর সামনে আনা হবে? আমি বললাম, আমার মাকে। কীভাবে বুঝলাম বুঝতে পারলেন তো?”
“না। বুঝতে চাচ্ছি না। তারপর কি হল বলেন।”
“তারপর ওরা আমাকে কাঁচের দেয়াল দিয়ে দুভাগ করা একটা ঘরে আনল। সেই ঘরের একপাশে আমার মাকে চেয়ারের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে, আর আমাকে কাঁচের আরেকপাশে আনা হয়েছে। আমি অনেকদিন পরে আমার মাকে দেখলাম। চেয়ারে শুকনো কঙ্কালসার এক বৃদ্ধা বসে আছে। মাথায় শনের মত পাকা চুল। আমি এই মানুষটার অংশ, আর এই মানুষটাকেই আমি ফেলে এসেছি একা। আমার ভেতরটায় এক তীব্র অপরাধবোধ পাক খেতে শুরু করল। তারপরেও…”
“তারপরেও কি?”
“ওরা আমাকে বলল, তোমার মাকে আঘাত করা হবে। ঠিক কোথায় আঘাত করা হবে এটা যদি বলতে পারো তাহলে তোমার মাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর তোমার ব্যপারে পুন:র্বিবেচনা করা হবে। একটা লোক বেল্ট হাতে নিয়ে আমার মায়ের চেয়ারের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা জানত না যে আমি তাকে আর আমার মাকে দেখছি। আমি প্রাণপণে লোকটাকে প্রেডিক্ট করার চেষ্টা করলাম। লোকটার প্রতিটা মুভমেন্ট। লোকটার চাহনি। আমার মনে হল, লোকটা হাতের বেল্টটা দিয়ে মায়ের বাম হাতে মারবে। কিন্তু আমি আমার মাকে প্রেডিক্ট করতে পারিনি। আমার মা একটা ভুল কাজ করে বসলেন। লোকটার মুখে থু থু ছিটিয়ে দিলেন। আর লোকটা…”
“লোকটা আপনার মায়ের মুখে একটা চড় কষে দিল। এই তো?”
“হুম।”
“তারপর?”
“তারপর সাথে সাথে আমার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটা মায়ের দিকে পিস্তল তাক করে ট্রিগার চেপে দিল। ঝন ঝন করে কাঁচ ভেঙে পড়ল। মা মারা গেলেন। মায়ের মৃত্যুর আগে আমি মাকে কিছুই বলতে পারলাম না। আমার মা, একা একা থেকে একা একাই চলে গেলেন, শুধু আমার পাপের কারণে। আমার ভুলের কারণে অনেকগুলো প্রাণ চলে গিয়েছিল।”
আমানুল্লাহ বুকের ভেতরে থাকা চাপা একটা নিঃশ্বাস ফেললেন। জয়েনুদ্দীনের চোখে মুখে এক অদ্ভুত আবেগ দেখতে পেলেন। এই মানুষটাকে তিনি মানুষ বলে মনে করতেন না। মনে করতেন, এটা একটা যন্ত্র, যেটা খুব সহজেই খুনীকে সনাক্ত করতে সাহায্য করে। এর বেশি কিছু না। কিন্তু এই মানুষটা আজ আবেগের বশবর্তী হয়ে নিজের অন্ধকার অতীত তার সামনে খুলে ধরবেন, তিনি ভাবতে পারেননি।
“কী করলেন তারপরে?”
“তারপরে লোকটার সাথে ধস্তাধ্বস্তি শুরু হয়। আমার কাঁধে একটা গুলি লাগে। দ্বিতীয় লোকটার মাথা ঢুকে যায় দেয়ালে। সে অচেতন হয়ে পড়ে। আর পিস্তলধারী লোকটার এলোপাতাড়ি গুলিতে সে নিজেই আহত হয়। আমি কোনমতে বের হয়ে আসি ওদের সেই বাংকার থেকে। পালিয়ে আসি। সব ছেড়ে পালিয়ে আসি। সেই পাহাড়, সেই জলপাইগুড়ি, সেই ঝর্ণা, সাঁওতাল, আমার অতগুলো পাপের টাকা, সব ফেলে আমি বাংলাদেশে পালিয়ে আসি কোনরকমে। তখন স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছে দেশে। অস্থির সময়। সেই অস্থির সময়েই আমি ঢাকায় চলে আসি। ঢাকায় অনেক মানুষ। মিশে যেতে সুবিধা হবে। হারিয়ে যেতে সুবিধা হবে। আমি ভিড়ের ভেতরে মিশে গেলাম। চানখাঁরপুলে একটা আতরের দোকানে পার্টটাইম হাত দেখা শুরু করলাম। তারপর কত দিন এখানে ওখানে ঘুরেছি। কিন্তু আর কখনও কোন অন্যায় করিনি। মানুষকে ম্যানিপুলেট করার চেষ্টা করিনি। পরে একদিন এক এজেন্ট, ওই যে প্রণবদা, উনিই আমার কাছে হাত দেখাতে আসলে আমি বললাম যে সে মঙ্গলবার মারা যাবে। সে বলল মানুষ কখন মারা যায় সেটা আপনি বুঝতে পারেন? আমি বললাম হ্যাঁ পারি। আসলে কি জানেন, আমাদের সব ভয় হচ্ছে ‘অনিশ্চয়তা’। মৃত্যু ভয় আরেক অনিশ্চয়তা। কখন মৃত্যু হবে, কীভাবে হবে, খুব কষ্ট পেয়ে মরতে হবে নাকি? এই যে ভয়। আবার ঈশ্বরকে ভয়। কারণ সেখানেও অনিশ্চয়তা। সে কি আসলেই আছে, নাকি নেই। থাকলে সে আমাকে কি শাস্তি দেবে? নাকি পুরষ্কার দেবে? এভাবে আমাদের সব ভয়ের মূল হচ্ছে অনিশ্চয়তা। পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় কারণ আমরা অনিশ্চিত প্রশ্নকে ভয় পাই। কোন কিছুতে নিশ্চিত হয়ে গেলে মানুষ আর তাতে ভয় পায় না, তখন সেটা নিয়ে সে আফসোস করে। অতীত নিশ্চিত, তাই সেটা নিয়ে যত আফসোস। ভবিষ্যত অনিশ্চিত, সেটা নিয়ে যত ভয়, অনিশ্চয়তার ভয়।”
“তো কি বললেন? কত দিন আগের ঘটনা?”
“এইতো মাস খানেক আগে। সে-ই প্রথম আমাকে আপনাদের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টে অস্থায়ীভাবে কাজ করার অফার করল।”
আমানুল্লাহ মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “আমাকে বিশ্বাস করে নিজের অতীতের পাপের কথা স্বীকার করার জন্য ধন্যবাদ। আজকাল কাউকে ভরসা করতে পারি না জানেন? কেউ নিজের পাপের কথা স্বীকার করে নিজেকে মহৎ প্রমাণ করার জন্য, কেউ স্বীকার করে করুণা পাওয়ার জন্য, আর কেউ স্বীকার করে অন্যের মনে ভয় সৃষ্টি করার জন্য। আপনার ভেতরে কোনটাই আমি দেখিনি। আপনি কথা দেন, যদি আমি কখনও এই চেয়ারটাতে নাও থাকি, আপনি একইভাবে এই ডিপার্টমেন্টের মানুষগুলোকে সমানভাবে আপনার মেধা দিয়ে সাহায্য করে যাবেন। আমি খুব তাড়াতাড়িই আমাদের ব্রাঞ্চে একটা পাকাপোক্ত জায়গা করে দেওয়ার ব্যবস্থা করছি। মেধা আর অভিজ্ঞতার মূল্য সব সময়ই সবার থেকে বেশি।”
জয়েনুদ্দীন নতমস্তকে মাথা নাড়ল। তার চোখে এমন কিছু একটা আছে যা তিনি এখন আমানুল্লাহকে দেখাতে চাচ্ছেন না।
আমানুল্লাহ বললেন, “কিন্তু একটা বিষয় বুঝলাম না…….”
মোবাইল বেজে উঠল। সাইদুর। আমানুল্লাহ কল রিসিভ করতেই সাইদুর বললেন, “স্যার, ইমন মোস্তাফিজের বাড়ির বেশ কয়েকটা কর্ণারে রেডিও ভয়েস ট্র্যাকিং ডিভাইস লাগানো হয়েছিল। সেখান থেকে মিস নীরুর কিছু কথা শোনা গিয়েছে। যেটা থেকে কিছু খুবই গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানতে পেরেছি স্যার।”
চেয়ারে সোজা হয়ে বসতে বসতে আমানুল্লাহ বললেন, “বল।”
“কাল শাঁখারীবাজারে সুকান্ত আসবে। আর সেখানে ওকে খুন করার পাঁয়তারা করা হচ্ছে। আমি পুরো ক্লিপটা আপনাকে মেইল করছি স্যার।” সাইদুর বলল।
“পাঠাও।”
জয়েনুদ্দীন বললেন, “আজ তাহলে উঠি আমানুল্লাহ সাহেব, নাকি?”
“বসেন বসেন, জরুরি ব্যাপার আছে।” আমানুল্লাহ ডেস্কটপের স্ক্রিনে চোখ রাখতে রাখতে বললেন। ক্লিং করে শব্দ হল।
ওয়ান আনরিড মেইল। ক্লিক করলেন আমানুল্লাহ। মেইলের সাথে একটা ফাইল এটাচড করা। একটা দুই মিনিটের অডিও ক্লিপ। প্লে করা হল। একটা নারী আর একটা পুরুষ কণ্ঠের কথোপকথন। নারী কণ্ঠটা অবশ্যই নীরুর। পুরুষ কণ্ঠটা কার?
“সুকান্তের কাছে পেনড্রাইভটা আছে। আমি জানি ও-ই সুভাষ নামের ওই লোকটাকে খুন করে পেনড্রাইভটা হাতিয়েছে। ওতে আমার বাবার গোপন ইনফরমেশন আছে। সুকান্তকে গুলি করে মারব আমি, আই সোয়্যার। আমার বাবাকে খুন করে পার পেয়ে যাবে ভেবেছে? পেনড্রাইভটা দিক বা না দিক, ওকে আমি মারবই।”
“প্ল্যান কি ম্যাডাম?”
“কাল দুপুর বারোটার দিকে শাঁখারীবাজারের বিষ্ণু মন্দীর থেকে তিনটা রথ বের হবে। সুকান্ত ঠিক দুপুর একটার দিকে যতীন এন্ড কোং এর সামনে এসে দাঁড়াবে।”
“এতটা শিওর কিভাবে হচ্ছেন?”
“আমি জানি ও আসবে। আসবেই। ও চাইবে না ওর জন্য বাচ্চা মেয়েটার কোন ক্ষতি হোক।”
“আচ্ছা তারপর?”
“তুমি ওর পাশে দাঁড়াবে। ওর কাছ থেকে পেনড্রাইভ চাইবে। ওকে বলবে, ওর ঠিক বুক বরাবর আমার স্নাইপার রাইফেলটা তাক করা আছে। পেনড্রাইভ দিলে বেঁচে যাবে, আর না দিলে ওখানেই ওকে শেষ করে দেওয়া হবে। ওর সাথে সর্বোচ্চ চার পাঁচ মিনিট কথা বলবা। তারপর ও পেনড্রাইভ দিক বা না দিক ব্যাপার না, তুমি ভিড়ের ভেতরে মিশে যাবা, বাকিটা আমি দেখব।”
“ওকে ম্যাডাম।”
“দ্যাট বাস্টার্ড উইল হ্যাভ টু সে গুডবাই।”
অডিও ক্লিপটা শেষ হয়ে গেল।
ভেতরে এক আদিম উত্তেজনাকে বশে আনতে আনতে আমানুল্লাহ একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। তারপর জয়েনুদ্দীনের দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রস্তুত হয়ে নেন। কালকেই আমাদের এই কেসের শেষ দিন।”
এবং একটা ফাঁদ পাততে চাই
রাত আটটা।
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের কনফারেন্স রুম। কবরের মত নিস্তব্ধ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক নীরব ঝড় বয়ে যাচ্ছে। প্রায়ান্ধকার রুমটা প্রজেক্টরের আলোকিত পর্দার আলোতে কিছুটা আলোকিত হয়েছে। লালবাগ থানার ওসি, চকবাজার থানার ওসি, এন্টি টেরোরিজম এন্ড ক্রাইম ইউনিটের চীফ- সবাই মূর্তির মত বসে আছেন। এদের ভেতরে খুব বেমানান একজন বসে আছেন, জয়েনুদ্দীন। যার কোন পরিচয় নেই এই ব্রাঞ্চে। তারপরেও আমানুল্লাহ তাকে এই মিটিং-এ থাকতে বলেছেন। কেউ অবশ্য জয়েনুদ্দীনের ব্যপারে কৌতূহল দেখায়নি, জয়েনুদ্দীনও কারো সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে যাননি। মোটামুটি সবাই এসে গিয়েছেন।
শুধু দুইজন এখনও এসে পৌঁছাননি।
আরো দশ মিনিট পরে স্টেজের পাশের দরজাটা খুলে গেল। দুজন মানুষের ছায়া স্টেজের ওপরে উঠে দাঁড়ালো। একটা ছায়ার হাতে বেশ কিছু ফাইল। দুজনে নিচু গলায় কথা বলল। তারপর একজন নেমে এসে দর্শক সারির একেবারে সামনের সারিতে বসল। ইনি সৌমেন ঘোষ।
আর অনেকগুলো ফাইল হাতে যে ছায়াটা স্টেজে দাঁড়িয়ে থাকল, সে এজেন্ট আমানুল্লাহ।
“গুড ইভনিং” আমানুল্লাহ বললেন। ভূমিকা টপকে তিনি আসল কথায় গেলেন।
“আপনারা নিশ্চয় জানেন যে সম্প্রতি ঢাকায় বেশ কয়েকজন প্রকাশক, লেখক আর সিনেমার ডিরেক্টর খুন হয়েছেন। সবগুলো খুনই একটা বিশেষ ধরণের কলম দিয়ে করা হয়েছে।” প্রজেক্টরের আলোকিত স্ক্রিনে একটা কলমের ছবি ভেসে উঠল। একটা ধারালো ফলা বসানো আছে নিবের জায়গায়।
“এই কলমের ফলাটা ড্রিল মেশিনের মত ঘোরানো যায়। এই মার্ডার ওয়েপন দিয়ে বেশ কয়েকটা খুন হয়েছে। মার্ডার ওয়েপন পাওয়া গেলেও খুনিকে আমরা ধরতে পারিনি।”
প্রজেক্টরের আলোকিত স্ক্রিনে একজন গোবেচারা যুবকের চেহারা ভেসে উঠল।
“এই হল খুনি। নাম সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। জন্ম চাঁদপুরে। বাবা রমাকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় নিখোঁজ। একবার জেলও খেটেছে। কেন খেটেছে তার কাগজপত্র পাওয়া যায়নি। দুইবার সুইসাইড এটেম্পটও করেছে। এর প্রেসের ডেস্ক থেকে উদ্ধার করা কলম আর মৃত ইমন মোস্তাফিজের পেনড্রাইভে রেখে যাওয়া তথ্যানুযায়ী আর কোন সন্দেহ থাকে না যে এই-ই খুনি। খুনের মোটিভ অবশ্য এখন পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে ধারণা করা হচ্ছে, ছেলেটা যেহেতু ঘোস্ট রাইটার, তাই যশের মোহে আর হতাশার বশবর্তী হয়ে হয়ত সে এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।”
প্রজেক্টরের স্ক্রিনে ইমন মোস্তাফিজের সেই পেনড্রাইভ ওপেন করা হল। সেখানকার যাবতীয় তথ্য কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে স্ক্রল করে দেখানো হল। আমানুল্লাহ এবার লম্বা একটা নিঃশ্বাস নিলেন। আবছায়া দর্শকদের ওপরে চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, “যাই হোক, আমরা বেশ ইতিমধ্যে একবার সুকান্তকে ধরতে গিয়েও ধরতে পারিনি। কেন পারিনি সেটার কারণ দর্শিয়ে একটা রিপোর্টও আমি সম্মানিত সৌমেন স্যারের কাছে জমা দিয়েছি। কিন্তু এবার একটা চমৎকার সুযোগ এসেছে সুকান্তকে গ্রেপ্তার করার।”
কিছুক্ষণ বিরতি নিয়ে হাতের ফাইলগুলো পাশের ডায়াসের ওপরে রাখলেন আমানুল্লাহ। তারপর বললেন, “বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি যে আগামীকাল শাঁখারীবাজারে সে উপস্থিত হবে। দুপুর বারোটা থেকে একটার ভেতরে। আরো পরিষ্কার করে বলতে গেলে, ওকে ওখানে খুন করা হতে পারে। ওর বিপদ। ও যদি খুন হয়ে যায় তাহলে অনেক প্রশ্নের উত্তর জানা যাবে না। আমরা ওকে জীবিত ধরতে চাই। তাই আমি আপনাদের সাহায্য চাই ওকে গ্রেপ্তার করার জন্য।” ইচ্ছা করেই নীরুর ফোনালাপটা উহ্য রাখলেন তিনি।
এই প্রথম দর্শক সারি থেকে কেউ কথা বলে উঠল, “কি ধরনের সাহায্য?” সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সৌমেন ঘোষ কথাটা বলেছেন।
“আমার পুরো প্ল্যানটা আমি বলছি। যতীন এন্ড কোং নামে একটা বাদ্যযন্ত্রের দোকান আছে শাঁখারীবাজারে। সেখানেই সুকান্ত আসবে। সুকান্ত এক ভদ্রলোকের সাথে দেখা করবে। আমরা সর্বোচ্চ চার পাঁচ মিনিট সময় পাব। এর মধ্যেই আমাদের সুকান্তকে ধরতে হবে। লোকটা বের হওয়ার সাথে সাথে কিন্তু সুকান্তকে মেরে ফেলার আগে। কেন মেরে ফেলবে সেটা জানা যায়নি। তবে, যতীন এন্ড কোং এর আশেপাশেই কোথাও একজন স্নাইপার অপেক্ষা করবে ওকে গুলি করার জন্য। তাই সাবধান থাকতে হবে।”
এইটুকু বলে আমানুল্লাহ প্রজেক্টরে একটা ম্যাপ দেখিয়ে বললেন, “শ্রী শ্রী রক্ষাকালী মন্দির থেকে রথ বের হবে সকাল দশটায়। আমাদের পুরো টিম তিনটা ভাগে ভাগ হয়ে থাকবে। প্রথম দল আগে থেকেই যতীন এন্ড কোং-এর আশেপাশে থাকবে। দ্বিতীয় দলটা যতীন এন্ড কোং-এর চারটা দোকান পরেই লক্ষ্মী নারায়ন শাঁখা ভান্ডারের সামনে একটা পিকআপ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে। এই যে এইখানটায়। ওটাই হবে আমাদের গেটওয়ে ভেহিক্যাল। ওটাতে করেই আমরা সুকান্তকে নিয়ে ঘি পল্লী দিয়ে বের হয়ে যাব। ঘি পল্লীর রাস্তাটা সেদিন মোটামুটি একটু হলেও ফাঁকা থাকবে। আর একটা টিম যতীন এন্ড কোং এর আশেপাশে যে চারটা সরু গলি আছে সেই গলির মুখে আলাদা আলাদাভাবে অবস্থান করবে, যাতে সুকান্ত পালিয়ে যেতে না পারে। আমার একার পক্ষে হাতে গোনা কয়েকজন এজেন্টকে নিয়ে কাজটা করা একটু রিস্কি হয়ে যায়।”
“আপনি স্নাইপারের কথা বলছিলেন।” সৌমেন ঘোষ বললেন।
“ও হ্যাঁ, যতীন এন্ড কোং এর আশেপাশে যতগুলো উঁচু বিল্ডিং আছে সবগুলো আমার এজেন্টরা সার্চ করবে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, যতক্ষণ পর্যন্ত না সুকান্ত যতীন এন্ড কোং-এ ঢুকছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা স্নাইপারকে এরেস্ট করতে পারব না। তাহলে পুরো প্ল্যানটা ভেস্তে যাবে। স্নাইপার যেই হোক, তাকে যদি এরেস্ট করতেই হয়, তাহলে সেটা সুকান্তকে এরেস্ট করার পরে। সুকান্ত ইজ আওয়ার মেজর প্রায়োরিটি।” আমানুল্লাহ বললেন।
সৌমেন ঘোষ কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। তারপর পরিষ্কার গলায় বললেন, “মানে আপনি পুরো ট্রুপকে একটা স্নাইপিং টার্গেট প্র্যাক্টিস জোনের ভেতরে ফেলতে চাচ্ছেন এই তো?”
কথাটা বুঝতে আমানুল্লাহর কিছুটা সময় লাগল। যখনই বুঝতে পারলেন, তখনই বললেন, “না না, আমি সেটা করতে চাচ্ছি না।”
“তাহলে কি চাচ্ছেন? স্নাইপারটা যে সুকান্তকে বাদ দিয়ে আমাদের ট্রুপকে গুলি করবে না তার নিশ্চয়তা কি? নিশ্চয়তা আপনি দেবেন?”
“স্যার, আমি যতদূর জানি, জীবন বাজি রেখে জনগনের সেবা করাটাই আমাদের কাজ। এই যে সুকান্ত, সে যতক্ষণ না গ্রেপ্তার হবে, ততক্ষণ মানুষ মরতেই থাকবে। মানুষ খুন হতেই থাকবে। এর জন্য এতটুকু ঝুঁকি তো আমাদের নেওয়া উচিৎ।”
“এই মিশনে অনেকগুলো আনসার্টেইন পয়েন্ট আছে। প্রথমত, সুকান্ত ওখানে আসবে সেটার নিশ্চয়তা নেই। আছে? আমার অভিজ্ঞতা বলছে নেই। আর সুকান্তই যে খুনি তার স্ট্রং কোন এভিডেন্স আমি দেখতে পাচ্ছি না। দ্বিতীয়ত, সুকান্ত যতীন এন্ড কোং-এ এসে যে একটা অকারেন্স করবে না, একটা দুর্ঘটনা ঘটাবে না তার নিশ্চয়তা নেই। হঠাৎ করে একটা বম্ব ব্লাস্ট হলে আপনি কি করবেন অতগুলো মানুষের ভিড়ের ভেতরে? কাকে বাঁচাবেন? তৃতীয়ত, আমি যেটা একটু আগে বললাম, স্নাইপারের গুলিতে যদি আমাদের কেউ হতাহত হয় তখন?”
“একটু রিস্ক তো থাকবেই স্যার। কিন্তু সুকান্তকে যদি আমরা গ্রেপ্তার করে ফেলি…”
“আমি এই কাজটার জন্য কোন ইউনিট দিয়ে আপনাকে সাহায্য করতে পারব না আমানুল্লাহ সাহেব।”
সৌমেন ঘোষ উঠে চলে গেলেন। বাকিরা নিজেদের ভেতরে নিচু গলায় কথা বলতে লাগল। আমানুল্লাহ পায়ের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। সাজানো কথাগুলো আর সাজানো নেই। বন্দীশালা থেকে ছাড়া পাওয়া পলাতকের মত পালিয়ে গিয়েছে যেন। বেশ কিছুক্ষণ এভাবেই গেল। চাপা গুঞ্জনে।
আমানুল্লাহ বললেন, “আপনাদের মতামত?”
সৌমেন ঘোষ সবগুলো ব্রাঞ্চের মাথা। তার উঠে চলে যাওয়া মানে পরোক্ষভাবে বলে যাওয়া, তোমরাও উঠে চলে এস। একটা অদৃশ্য আদেশ। সেই আদেশ বাকিরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে, স্বাভাবিক। সেটাই হল। সবাই উঠে চলে গেল। আমানুল্লাহ শুধু একজনকেই দর্শক সারিতে পেলেন, জয়েনুদ্দীনকে।
জয়েনুদ্দীন উঠে আসলেন স্টেজে। আমানুল্লাহর কাঁধে হাত রেখে বললেন, “আমরা নিজেরাই এটা হ্যান্ডেল করতে পারব। চিন্তা করবেন না। যে কজন এজেন্ট আছে, তাদের সবাইকে ডেকে পাঠান। সুকান্তকে আমরাই ঠিক করে ফেলতে পারব। সৌমেন ঘোষের, আমি যতদূর জানি সামনে একটা পুলিশ প্রশাসন প্যানেল নির্বাচন। নির্বাচনে উনি চেয়ারম্যান পদে দাঁড়াচ্ছেন। ভবিষ্যতে যদি ডিআইজির পদটা পেয়ে যেতে পারেন এই আশা আর কি। তিনি কোন ব্রাঞ্চের কারো মনে কষ্ট দিতে চাচ্ছেন না ঠিক এই কারণেই। প্রমোশনের নির্বাচনে তাকে নির্বাচিত হতেই হবে। তাই হয়ত তিনি সরে আসলেন। ব্যাপার না।”
আমানুল্লাহ অনেক কথা বলতে চেয়েছিলেন। কিছুই বললেন না। মাথা নেড়ে বললেন, “চলেন।”