শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – ৭

একটা গোপন কথা ও একটা প্রকাশ্য অপচয় 

পুরনো পাঁচিলটা এমনিতেই শ্যাওলা ধরা। তারওপরে বৃষ্টি হয়ে আরো —পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। ছায়ামূর্তিটা কয়েকবার হাচড়ে-পাছড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু পাঁচিলের গোড়ায় জমা পানিতে বারবার পা পড়ায় ছপছপ করে শব্দ হচ্ছে। আশেপাশে কেউ নেই। এত রাতে কারো থাকার কথাও না। কুকুরগুলোও নেই। তারপরেও ছায়ামূর্তিটা বারবার এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কারণ মোড়ের পুলিশের ভ্যানটা যে এই বাড়িটার ওপরেই নজর রাখছে, জানে সে। ইলেকট্রিসিটি নেই। ইলেকট্রিসিটি আসা মাত্রই তাকে স্পষ্ট দেখা যাবে পাশের ল্যাম্পপোস্টের আলোতে। কাজেই যা করতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। 

তৃতীয়বারের চেষ্টা সফল হল। ছায়ামূর্তিটা পাঁচিল টপকে বাড়ির ভেতরে ঢুকে পড়ল। ধপ করে ভোঁতা একটা শব্দ হল। আরেকবার এদিক ওদিক দেখে নিল। নাহ। গাঢ় অন্ধকারে কোন সাড়াশব্দ নেই। অনুমানের ওপরে ভর করে সামনে এগোতে লাগল সে। বামে পাঁচিলের গা ঘেঁষে গোলাপের চারা লাগানো টবের সারি। ডান দিকে সরু একটা গলিমতন চলে গিয়েছে বাড়িটার সামনের দিকে। 

বিদ্যুৎ চমকালো। ক্ষণিকের আলোতে নিশ্চিত হয়ে নিল, অনুমান ঠিকই আছে। কিন্তু বাড়ির সামনের দিকে যাওয়া যাবে না। পেছন দিক দিয়েই কোনরকমে ওপরে উঠতে হবে। পাইপ আছে। এই বৃষ্টির ভেতরে পিচ্ছিল পাইপ দিয়ে ওপরে ওঠা যাবে না। কিন্তু এছাড়া উপায় কি? 

উপায় একটা আছে। উত্তর দিকে একটা পুরনো আম গাছ আছে। ওটাতে কোনরকমে উঠতে পারলে তিনতলা পর্যন্ত ওঠা যাবে। বাকিটা পরে দেখা যাবে নাহয়। 

বিদ্যুতের ক্ষণিক আলোই আপাতত ভরসা। ভেজা আমগাছটার শরীর ভেজা এনাকোন্ডার শরীরের মতই ঠাণ্ডা আর পিচ্ছিল। এতটুকু পা হড়কালে মৃত্যু, আর কোন মতে বেঁচে গেলে পক্ষাঘাৎ অথবা শিবঘর। ছায়ামূর্তিটা অনন্যোপায় হয়ে উঠে পড়ল গাছটায়। 

বৃষ্টি থামার লক্ষন নেই। 

ধীরে ধীরে, খুব ধীরে ধীরে উঠছে ছায়ামূর্তিটা। অনেকক্ষণ ভিজে থাকার ফলে আঙুলগুলোর চামড়া কুঁচকে গিয়েছে, তাই ভালো গ্রিপ পাওয়া যাচ্ছে। শক্ত করে আঁকড়ে ধরে ধরে এগোচ্ছে সে। 

মাঝামাঝি জায়গায় গিয়ে হঠাৎ থেমে যেতে হল তাকে। সবগুলো ডালই খাড়া হয়ে ওপরে উঠে গিয়েছে। এই ডালগুলোতে চড়া প্রায় অসম্ভব। হাত দিয়ে ভর দিয়ে তাও একটু পরখ করে দেখল চড়া যায় কিনা। 

চড়া যায়, যদি কেউ আত্মহত্যা করতে চায়। 

ঠিক তখনই দুটো ঘটনা ঘটল, বিদ্যুৎ চমকে পুরো আকাশ আলোকিত হয়ে গেল আর সেই আলোতে পাশের দোতলার বারান্দা থেকে একটা নারী কণ্ঠ বলে উঠল, “সুকান্তদা! আপনি গাছে উঠে কি করছেন?” 

সুকান্ত চমকে উঠল। বরফের মত জমে গেল মুহূর্তের ভেতরে। নোভা দেখে ফেলেছে। এখন সে বাসার সবাইকে জানাবে। পুলিশ ডাকবে। গাছ থেকে লাফ দিয়ে পালানোর অবস্থায় নেই এখন। লাফ দিলেই মৃত্যু নয়ত পক্ষাঘাত। বাধ্য হয়ে চুপ করে গাছের ডাল ধরে বসে থাকল সে। 

নোভা কিছুই করল না। বরং যা করল, তা সুকান্তের অনুমানের বিপরীত। গলা নামিয়ে বলল, “সুকান্তদা, আস্তে আস্তে নেমে আসেন। ভয় পেয়েন না। আমি কাউকে জানাবো না। খুব আস্তে আস্তে নেমে আসেন। আমি গেট খুলে দিচ্ছি।” 

সুকান্ত আস্তে আস্তে নিচে নেমে এলো। আগের থেকেও বেশি সাবধানে। বাড়ির পেছনের লোহার গেটটা খোলার শব্দ হল। সুকান্ত দরজার কাছে দাঁড়াতেই দেখল, নোভা দাঁড়িয়ে আছে। “কি হল? আসেন?” বলল নোভা। সুকান্ত ভেতরে গেল। 

“আমি নিচের ঘরটা খুলে দিয়েছি। আপাতত বসেন। আর এই যে গামছা দিয়ে গা হাত পা মোছেন। একটা লুঙ্গি আর গেঞ্জি দেওয়া আছে। আমি আসছি। জরুরী কথা আছে।” বলল নোভা। মুখে গামছা বললেও বাড়িয়ে দিল একটা সবুজ তোয়ালে। সুকান্ত অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে পাশের একটা ঘরে ঢুকল। টিম টিম করে একটা মোমবাতি জ্বলছে। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে নোভা বলল, “শব্দ করবেন না।” 

সুকান্ত অন্ধকারে কাপড় ছেড়ে অন্ধকারেই লুঙ্গি আর গেঞ্জিটা পড়ল। হয়ত নোভার বাবার। মিনিট পাচেকের মধ্যেই নোভা নেমে আসলো। হাতে এক কাপ চা। আস্তে করে দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে বলল, “বসেন। চা নেন। এবার বলেন তো, আপনি এত ঝুঁকি নিয়ে আবার এই বাড়িতে কেন আসলেন?” সুকান্ত কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা নিল। এক চুমুক চা খেল। কিন্তু কিছুই বলল না। মেয়েটার জন্য মায়া লাগছে। খুব চেষ্টা করছে স্বাভাবিক থাকতে। 

“আপনি জানেন? আমাদের বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টা পুলিশ নজরদারি চলছে? আপনাকে দেখলেই একটা বিশ্রী ব্যাপার হবে?” নোভা ফিসফিস করে ঝাঁঝাল প্রশ্নটা করল। 

“জানি” সুকান্তের ছোট উত্তর। 

“তাহলে কেন এসেছেন?” 

“তার আগে তুই বল, তুই তো জানিস আমি খুনি, তাহলে আমাকে দেখে চেচিয়ে উঠলি না কেন?” 

“আমি জানি আপনি খুন করেননি। 

“করতেও তো পারি।” 

“ইয়ার্কি রাখেন। বলেন কেন এসেছেন?” 

“তার আগে বল, তুই এত রাতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে করছিলি কী?” 

“আমার ইনসমনিয়া আছে। ঘুম আসে না। মাইগ্রেনের ব্যথা শুরু হওয়ার আগে এমন হয়। এখন আপনি আমার কথা উত্তর দেবেন?” 

“আমার কিছু জিনিস আছে ওপরের ঘরটায়। ওগুলো নিতে এসেছি। ওগুলো নিয়ে দূরে কোথাও হারিয়ে যাব রে। অনেক দূরে কোথাও।”

“ওরা এত লোক রেখে আপনাকে কেন সন্দেহ করছে বলেন তো। আপনার কী মনে হয়?” 

“সুভাষদার, মানে যে লোকটা আমাকে, মানে আমার খুব কাছের একজন মানুষ, ওই মানুষটার খুন হওয়ার সময় আমি ওখানে ছিলাম। আমি খুনিকে ধাওয়া করি। হয়ত ওইখান থেকেই পুলিশ কোনভাবে আমাকে সন্দেহ টন্দেহ করেছে। আমি জানি না কেন পুলিশ আমাকে ধরার জন্য কুকুরের মত ছুটে বেড়াচ্ছে।” 

“গতকালকে পেপারওয়ালা এসে একটা খবর দিয়েছে, জরুরী খবর। “ “পেপারওয়ালা! মানে হকার? কি খবর?” 

“একজন আপনার সাথে দেখা করতে চায়। পেনড্রাইভ না কি যেন নিয়ে জরুরি কথা আছে নাকি।”

সুকান্তের পুরো শরীর কেঁপে উঠল। পেনড্রাইভ! পেনড্রাইভ তো খুনির কাছে আছে! তাহলে সুভাষদার খুনিই কি তার সাথে যোগাযোগ করতে চাইছে? কিন্তু কেন? পেনড্রাইভটা ডিক্রিপ্ট করতে হবে? এই জন্য? নাকি অন্য কোন কারণ? নাকি এটা কোন চাল? তাকেও কি ফাঁদে ফেলে খুনি খুন করতে চায়? 

মুহূর্তের ভেতরে একগাদা কথা মাথায় আসল সুকান্তের। যদি সত্যিই কোন জরুরি খবর থাকে তো একটা হকার কেন এসে এটা জানাবে? 

“সুকান্তদা, বলেছে, যদি আপনি কখনও ফেরেন, তাহলে যেন আপনাকে বলি। পরশুদিন রথ যাত্রা। ওইদিন শাঁখারীবাজারে যতীন এন্ড কোং নামের দোকানের সামনে আপনাকে দেখা করতে বলেছে।” 

“আর কিছু বলেছে?” 

“বলেছে।” 

“কি?” 

“বলেছে, যদি না যান, ওরা ধরে নেবে, ধরে নেবে যে আমি আপনাকে পুরো ব্যাপারটা বলিনি। তাই তখন আমাকেও…”

“তোকেও কি?” 

“ক্ষতি করে দেবে আমার। খুব বাজে রকমের একটা ক্ষতি করে দেবে।”

“তুই ওদেরকে বলবি আমি আসিনি।” 

“সেটা কি বলব বলে ভাবিনি ভাবছেন? আমাদের এই বাড়ির চারপাশে সাতটা ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা লাগানো আছে। ওরাই লাগিয়েছে। দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু ওরা বলেছে লাগিয়েছে। আমার জন্য হলেও আপনি ওদের সাথে দেখা করেন সুকান্তদা। আমার কিছু না করতে পারলেও বাবা আছে। বাবাকে যদি ওরা…” 

কথা শেষ করতে পারল না নোভা। সুকান্ত অন্ধকারে মাথা নাড়ল। নোভা বলল, “কি হল? বলেন? যাবেন?” 

সুকান্ত চায়ের শেষ চুমুকটা দিয়ে বলল, “যাব। তার আগে আমার জিনিসগুলো আমাকে নিতে হবে।” নীহারিকার একটা ছবি আছে ট্রাংকে। যদি আর কখনও আসা না হয়? নিয়ে যাওয়া উচিৎ। ওই একটাই মাত্র ছবি আছে নীহারিকার। ওই একটা মাত্র ছবি আছে যেটা দেখলে সুকান্ত বুঝতে পারে যে সে এখনও বেঁচে আছে। 

নোভা বলল, “সিঁড়িঘরের দরজা খুলে দিচ্ছি। আসেন।” 

সুকান্ত বলল, “ধন্যবাদ নোভা। আর আমি খুব দুঃখিত, যে তোদেরকে এর ভেতরে জড়িয়ে ফেললাম।”

নোভা মাথা নেড়ে বলল, “সাবধানে থাকবেন সুকান্তদা। খুব সাবধানে থাকবেন।” 

কিন্তু মৃত্যুর ডাকের কাছে সব সাবধানতা মিথ্যা হয়ে যায়। 

***

থ্যচ থ্যাচথ্যাচ… 

বেলচার মরচে ধরা ফলাটা মাটি তুলছে। প্রণবের ভারি শরীর বৃষ্টিতে ভিজে একাকাকার। গায়ের শার্ট আর জুতো খুলে ফেলেছেন তিনি। মেদবহুল সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর গ্যাবার্ডিনের প্যান্টটা ভিজে গায়ের সাথে লেপ্টে গিয়েছে। মাটি খোড়ার পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, কিন্তু ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের ফিল্ড ওয়ার্কারদের এমন কিছু কাজ করতে হয় যা তারা স্বপ্নেও ভাবেনি। 

বৃষ্টি ধরে এসেছে কিছুটা। কিন্তু ঝড়ো বাতাস কমেনি, বরং বেড়েছে। মাটি ভেজা থাকায় খুব বেশি বেগ পেতে হচ্ছে না অবশ্য। আশেপাশে যেন এক অস্বস্তিকর নীরবতা। আর গাঢ় অন্ধকার। ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলতে থাকা মোবাইলটা কোন রকমে মুখে ধরে আছেন প্রণব। মুখের লালায় সেটা পিচ্ছিল হয়ে গিয়েছে। চোয়ালে শুরু হয়েছে ব্যথা। 

আলোগুলো এগিয়ে আসছে বাঁশবনের ভেতর দিয়ে। বড় হয়ে। কি ওগুলো? আলেয়ার আলো? প্রণব জানেন না। এই মুহূর্তে সেটা না জানলেও চলবে। 

ঢক করে একটা শব্দ হল। বেলচাটা কোন কিছুর সাথে বিঁধেছে। বেলচা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে প্রণব দুই হাতে মাটি সরানো শুরু করলেন। হাতে কাঠের মত কি যেন একটা বাঁধল। বাম হাতে লালা মাখানো মোবাইলটা ধরে ডান হাতে কফিনের ওপরকার মাটি সরাতে শুরু করলেন। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে কফিনটা খুলে ফেললেন। কড় কড় করে পচে যাওয়া কাঠ ফাটার শব্দ হল। 

হঠাৎ কাছেই খস খস করে একটা শব্দ হল। শেয়াল? হবে হয়ত, প্ৰণব ভাবলেন। 

মোবাইলের ফ্ল্যাশ লাইটের আলোটা কফিনের ভেতরে ফেললেন। পলিথিনে মোড়া সারি সারি বইয়ে কফিন ভর্তি। পুরনো বইয়ের গন্ধ নাকে এসে ধাক্কা দিল প্রণবের। সাথে ন্যাপথলিনের পুরনো গন্ধ। বইগুলো এমনভাবে রাখা আছে, ঠিক যেন কোন মৃতদেহ সংরক্ষন করা হয়েছে এই কফিনের ভেতরে। এর মধ্যে পাছাখানার ভূত বইটা কোনটা? 

এলোপাথাড়িভাবে বইগুলো বের করে ফেলতে লাগলেন। বেশিরভাগ বই-ই পেপারব্যাক। হার্ডকভার খুব কমই আছে। এক একটা বই বের করে ফ্ল্যাশ লাইটের আলোতে নাম দেখতে লাগলেন। বহু পুরনো পুরনো বই। ইবনে খালদুনের আল মুকাদ্দিমা, শাহনামা, জীবনান্দ দাসের রূপসী বাংলা। এছাড়া নাম শোনেননি কখনও এমন অনেক বই দেখলেন প্রণব। আর্যদের যৌনজীবন। পর্তুগীজদের দেবতারা। নীলচাষের কারিগরেরা। বেশিরভাগ বইয়েই ছাতা ধরে গিয়েছে। পৃষ্ঠাগুলো নরম নরম। 

কয়টা বাজে? মোবাইলের স্ক্রিনের আলো জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন তিনি। সন্ধ্যে সাতটা। কিন্তু চার্জ আর মাত্র বারো পার্সেন্ট আছে। এতক্ষণ ফ্ল্যাশ লাইটের আলো জ্বালিয়ে রাখার ফলে চার্জ ফুরিয়ে গিয়েছে অনেকখানি। এই আলোটুকু নিভে গেলে কৃষ্ণগহ্বরের ভেতরে পড়বেন তিনি। 

তাড়াতাড়ি আরো কয়েকটা বই বের করার পরে বইটা পাওয়া গেল। পাছাখানার ভূত। পৃষ্ঠাগুলো একেবারেই ত্যানার মত পাতলা হয়ে গিয়েছে। কভারে একটা ছোট ছেলের হাতে একটা বড়সড় ঝর্না কলম। খুব অস্পষ্ট। 

বইয়ের নিচে কিছু একটা আছে, চোখে পড়ল প্রণবের। শুকনো পাতা? খয়েরী রঙের? কি ওটা? কৌতূহলী হয়ে আরো কয়েকটা বই সরাতেই বের হয়ে আসল একটা মানুষের মৃতদেহ। মমি করা। শরীরের মাংসপেশী শুকিয়ে লেপ্টে গিয়েছে হাড়ের সাথে। যেন মৃতদেহটাকে শিকে ঝুলিয়ে ঝলসানো হয়েছে। 

প্রণবের সমস্ত ইন্দ্রিয় শন শন করে উঠল। পালাতে হবে। এখান থেকে পালাতে হবে। 

হাচড়ে-পাছড়ে নরম মাটির ওপর ভর দিয়ে কোনরকমে উপরে উঠলেন প্ৰণব। 

“যা খুঁজছিলি, পেয়েছিস?” ভরাট গলায় কে যেন জিজ্ঞাসা করল। আশেপাশে গাঢ় অন্ধকার। প্রণব কিছুই দেখতে পেলেন না। বইটা প্যান্টের পকেটে গুঁজে মুহূর্তের ভেতরে রিভলভার হাতে নিয়ে নিলেন। তাক করলেন অন্ধকারে। একটা মিষ্টি টোন দিয়ে মোবাইলটা বন্ধ হয়ে গেল। চার্জ শেষ ওটার। 

“কে? কে? ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের ফিল্ড অফিসার প্রণব বলছি। নিজের পরিচয় দাও।” যথা সম্ভব শান্ত গলায় বললেন প্রণব। 

“আমি সাধু। সবাই সাধু ডাকাত বলে ডাকে। আমাকে না দেখতে পাওয়াটা সৌভাগ্যের, আর দেখতে পাওয়াটা দুর্ভাগ্যের ব্যাপার।” অন্ধকারের ভেতর থেকে গমগমে কণ্ঠে উত্তর আসলো। 

“হাত ওপরে তুলে সামনে আসো। আমাকে গুলি করতে বাধ্য করো না। আমি সরকারী কাজে এখানে এসেছি।” প্রণব এক পা এগিয়ে গেলেন। ঠাণ্ডা বাতাসে শীত লাগছে। কেঁপে উঠলেন। এই মুহূর্তে তিনি দ্বীপের কোথায় আছেন জানেন না। অন্ধকারে শত্রুর অবস্থান না জানা বিপদ, কিন্তু অন্ধকারে নিজের অবস্থান না জানা আরো বড় বিপদ। তিনি সেই ‘আরো বড় বিপদে’ পড়েছেন। 

“সরকার? কেমন সরকার? যে সরকার শুকনো মৌসুমে এসে ট্যাক্স আদায় করতে ছাড়ে না, লিজ দেওয়া জমির খাজনা আদায় করতে ছাড়ে না, আর ভরা মৌসুমে যখন তিস্তার বাঁধ খুলে দেওয়া হয়, আমরা ডুবে মরি, ফসল ডুবে যায়, দিনের পর দিন পানি বন্দী হয়ে থাকি, ঘরে চাল থাকে না, পেটে ভাত থাকে না, আমাদের ফলানো ধান থেকে হওয়া চালই আমাদেরকে চড়া দামে কিনতে হয়, তখন যে সরকার মুখ তুলেও চায় না, সেই সরকার? যেই সরকার স্থানীয় নির্বাচনের আগে ভোট ভিক্ষা চায়, আর ভোটের পরে তাদের পোষা কুকুরগুলো আমাদের দিকেই লেলিয়ে দেয়, সেই সরকার? হাওড়ে কোন সরকার নেই। হাওড়ে কোন প্রশাসন নেই। এখানে আমরাই প্রশাসন। এখানে ঈশ্বর নেই, এখানে ক্ষুধাই ঈশ্বর। যার ক্ষুধা বড়, তার ঈশ্বর তত বড়।” ভরাট কণ্ঠে কথাগুলো বলল সাধু ডাকাত। 

“আমাকে চলে যেতে দাও। সরকারের অনেক দায়বদ্ধতা থাকে, এতগুলো মানুষের প্রতি নিখুঁতভাবে দায়বদ্ধতা পালন করা মুখের কথা না। এই নিয়ে এখন তর্ক করতে চাচ্ছি না। চলে যেতে দাও না হলে আমাকে বাধ্য হয়ে ড্রাস্টিক ডিসিশান নিতে হবে। আমি প্রশাসনের কাজ করতে এসেছি, আমাকে আমার কাজ করতে দাও।” রিভলভারটা আরো শক্ত করে ধরতে ধরতে বললেন প্রণব। 

হঠাৎ হাততালির শব্দ। প্রণব ট্রিগার চাপার আগেই, সেকেন্ডেরও ভগ্নাংশে অন্ধকার চিরে একটা তীর এসে বিঁধল প্রণবের পিঠে। তীব্র ব্যথায় বাঁকা হয়ে গেলেন প্রণব। দুই হাতের ওপরে ভর করে মাটির ওপরে বসে পড়লেন। এই মুহূর্তে লড়াই করা মানে জীবন খোয়ানো। যেভাবেই হোক, তাকে বেঁচে ফিরতে হবে, আর এই বইটা আমানুল্লাহর হাতে দিতে হবে। 

“প্রশাসনের লোকেরা এখান থেকে বেঁচে ফিরে যেতে পারবে না। যে-ই এসেছে, তাকে জীবন্ত অবস্থায় চামড়া ছাড়িয়ে রোদে শুকিয়ে কবর দেওয়া হয়েছে। তোরা এসি রুমে বসে আইন বানাস, একবারও ভেবে দেখিস যে আইনগুলো বানান সেগুলো শুধু অপরাধীর জন্ম দেয়, অপরাধ কমায় না। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার আগে একবারও কি তোরা অপরাধীকে নিজের ভুল বুঝতে দিস? দিস না। একটা অশিক্ষিত লোক মানুষ ঠকিয়ে ভোটে জিতে, তোদের ওই ধূসর বিল্ডিংটায় বসে শুধু ‘হাঁ’ আর ‘না’ বলে, ওরা আইনের কি বোঝে? অশিক্ষিতদের বানানো আইনে আমরা চলি না। তোদের আইন আর তোদের ধর্ম শুধু তোদেরকে ‘হাঁ’ আর ‘কবুল বলতে শিখিয়েছে। আর কিছুই শেখায়নি। আমার সাথে তোর দেখা হয়ে গেল, এটা তোর দুর্ভাগ্য।” 

খুব কাছেই পায়ের শব্দ শুনতে পেলেন প্রণব। এগিয়ে আসছে। রিভলভারটা শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে গুলি ছুঁড়লেন। আরো একটা গুলি। পর পর দুটো গুলি। একজন না একজনকে তো ঘায়েল করতেই হবে। 

স্যাঁত করে আরো একটা তীর এসে বিঁধল প্রণবের বাম হাতে। বিষ পিঁপড়ার কামড়ের চেয়েও জ্বালাময় যন্ত্রণা! প্রণব দুই হাতের ওপরে ভর দিয়ে দাঁতে দাঁতে চেপে উঠে দাঁড়ালেন। আশেপাশে বড় বড় আলো চোখে পড়ল তার। একটু আগে যে আলোগুলো জোনাকীর আলো বলে মনে হচ্ছিল, আসলে সেগুলো টর্চের আলো। চারিদিক থেকে তাকে ঘিরে ফেলা হয়েছে। 

জীবনের শেষ সম্ভাবনাটুকু বুকে নিয়ে প্রণব দৌড় দিলেন। যে দৌড় তিনি কখনও দেননি। কোথায়, কোন দিকে? জানেন না। শুধু জানেন, দৌড়ালেই আজকের মত বেঁচে যেতে পারেন তিনি। 

গাছ, ঝোপঝাড় পেরিয়ে ছুটছেন। এড্রেনালিন তাকে বারবার বলছে, বাঁচতে হলে ছুটতে হবে। পেছনে সরসর করে শব্দ হচ্ছে। ধেয়ে আসছে মৃত্যু। মেদবহুল শরীরটা প্রতিনিয়ত বিদ্রোহ করছে। হাঁপিয়ে উঠেছেন তিনি এরই মধ্যে। পালাচ্ছেন, কিন্তু পালিয়ে কতদূর যাবেন? সাঁতার পারেন না। 

তাহলে? বিদ্ধ তীরে ক্ষততে যন্ত্রণায় তিনি কেঁপে কেঁপে উঠছেন। রক্তক্ষরণ হচ্ছে ভীষণ। 

এই দ্বীপে তিনি বন্দী। 

ঘন বাঁশ ঝাড়ের ভেতর দিয়ে অন্ধের মত ছুটছেন প্রণব। হঠাৎ একটা ছায়া তাকে জাপটে ধরল। দুজনেই পড়ে গেলেন মাটিতে। প্রণব আতঙ্কের বশে রিভলভারটা দিয়ে ছায়াটার মাথায় আঘাত করতে যাবেন ঠিক এই মুহূর্তে ছায়াটা বলে উঠল, “সাহেব সাহেব, আমি, আমি শশী মাঝি।” 

প্রণব জিজ্ঞাসা করলেন, “কোথায় ছিলে তুমি? শশী, বিপদ, সাধু ডাকাত…” 

শশী বলল, “চিন্তা নাই। আপনি আমার সাথে চলেন। আগে কাদা মেখে নেন সারা গায়ে। তারপর আমি দেখতেছি।” 

প্রণব গড়াগড়ি দিতে পারবেন না। পিঠে আর হাতে বড় বড় দুটো তীর বিঁধে আছে। শশী তীর দুটো বের করতে গেলে প্রণব না করলেন। তীর বের করলে রক্তক্ষরণ আরো বেশি হবে। শশী প্রণবকে কাদা মাখিয়ে দিলেন। তারপর প্রণব শশীর কাঁধে ভর দিয়ে এগোতে শুরু করলেন। দৌড়। জীবনের জন্য দৌড়। প্রণব একবার পকেটে হাত দিয়ে দেখে নিলেন বইটা আছে কিনা। হ্যাঁ আছে। 

বাঁশবাগানের শেষ মাথায় সেই জোনাকীর আলো। বড় বড় হয়ে ঠিক প্রণবদের দিকেই এগিয়ে আসছে। আরো বড় বড় হয়ে। প্রণবদের আর বুঝতে বাকি থাকল না, তারা ধরা পড়ে গিয়েছেন। ঘিরে ফেলা হয়েছে তাদেরকে। 

পকেট থেকে বইটা বের করে শশীর দিকে বাড়িয়ে দিলেন প্ৰণব, বললেন, “শশী, যেভাবেই হোক, যেভাবেই হোক তুমি এই বইটা সিলেটের সদর থানার ওসিকে দিবা। খুব ভালো হত যদি এসপিকে খবরটা দিতে। তারপর ঢাকায় ডিবির অফিসে পাঠানোর কথা বলবা। বলবা আমি পাঠাইছি। প্লিজ, যাও। আমি সকাল পর্যন্ত টিকে থাকার চেষ্টা করব। তুমি রাত্রের মধ্যে ফোর্স পাঠাতে বলবা। আমি এদেরকে দেখছি।” উত্তেজনায় গুছিয়ে কথাগুলো বলতে পারলেন না তিনি। হাঁপরের মত ওঠা নামা করছে বুকটা। 

শশী বইটা হাতে নিয়ে বলল, “আপনি এইখানে থাকলে মারা পড়বেন। আপনি সাধু ডাকাতরে চিনেন না। ওই আলোগুলা দেখছেন না? ডামোরি। ওইগুলা ডামোরি।” 

“ডামোরি না, ওগুলো মানুষ। আর ওগুলো টর্চের আলো। তুমি যাও। দেরি কর না। আমি রিভলভার ফায়ার করলেই তুমি ঝোপের মধ্যে লুকিয়ে পড়বা। ওরা আমার পেছনে ধাওয়া করলে তুমি নৌকার কাছে চলে যাবা।” 

শশী বাধ সাধল, “আপনাকে মেরে ফেলবে সাহেব। আপনি চেনেন না ওদের।” 

প্রণব খেঁকিয়ে উঠলেন, “যাও যাও তাড়াতাড়ি।” 

গান ফায়ার হল। ইচ্ছা করেই সাধু ডাকাতের দলের দৃষ্টি আকর্ষন করলেন প্রণব। শশী সাঁতার জানে। গরীব মানুষ, সে ভরসার দাম দেবে। সে পালাতে পারবে। অন্ধকারে যদি কোনরকমে লুকিয়ে সকাল পর্যন্তও থাকা যায়, তাহলেই তিনি বেঁচে যাবেন। 

খুব কাছেই সরসর শব্দ শুনলেন। শব্দটা ঠিক কোন দিক থেকে বোঝার আগেই পেটে এসে তৃতীয় তীরটা বিঁধল। প্রণব মাটিতে পড়ে গেলেন। হাতের রিভলভারটাতে এখনও তিনটা গুলি আছে। কাঁপা কাঁপা হাতে রিভলভারটা তুলে ধরলেন তিনি। ঠিক তখনই একটা ধারালো কুঠারের কোপ পড়ল প্রণবের হাতের কবজিতে। এক অমানুষিক চিৎকার বের হয়ে এলো গলা চিরে। 

“অনেক হয়েছে। মোয়াল্লেমের বাড়িতে এরে নিয়ে চল। ছাল ছাড়ানোর ব্যবস্থা করতে হবে। গায়ে চর্বি দেখছ! জনগণের টাকায় চর্বি বানিয়েছে।” সাধু ডাকাতের কণ্ঠ শোনা গেল। প্রণব মনে প্রাণে মৃত্যুকে ডাকতে শুরু করলেন। কিন্তু যে মৃত্যুকে ডাকে, তার প্রতি মৃত্যুর একটা অনীহা চলে আসে। 

মোয়াল্লেমের বাড়ি থেকে বেগম আখতারের গজলের সাথে সাথে এক নির্মম আর্তনাদ শোনা গেল। রাতের অন্ধকার চিরে সেই আর্তনাদ শুনতে পেল শশীও। সে তখন প্রায় পাড়ের কাছাকাছি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *