শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – ৬

নিশি নির্বাণ 

মরচে ধরা লোহার গেটের ওপরে টিম টিম করে নানান রঙের কয়েকটা ডিমলাইট জ্বলছে। লাল। হলুদ। নীল। নীল রংটাই বেশি। বৃষ্টি শেষের হু হু করা বাতাস বয়ে যাচ্ছে। সেই বাতাসেই দুলছে লাইটগুলো। ভেজা রাস্তায় সেই লাইটগুলোর ছায়া পড়েছে। যেন অনেকগুলো জলরঙের শিশি উল্টে গিয়েছে রাস্তার ওপরে। 

জলরঙ মাড়িয়ে এলোমেলো পায়ে লোকটা এসে মরচে পড়া গেটে নক করল। একবার। দুবার। তিনবারের বার একটা গোঁফওয়ালা লোকের মুখ উঁকি দিল গেটের ওপাশে। অন্ধকারে লোকটার মুখটা ভালো করে দেখা গেল না। কর্কশ আর ফ্যাস ফ্যাসে গলায় বলল, “কিহ? কারে চায়?” 

কাঁপা কাঁপা গলায় লোকটা বলল, “ম্যাডাম আনানি, না আনানি না, আনানসি, ম্যাডাম আনানসি আছেন?” 

লোকটা খেঁকিয়ে উঠল, “ক্যান? আপনে কে?” 

“আমাকে রতন পাঠিয়েছে। নাম সৌরভ। ম্যাডাম আনানসিকে একটু বলেন।” লোকটা বলল। 

“ম্যাডাম আনানসি বলে কেউ নাই। ফুটেন। ঢং করতে আসছে।” লোকটা দরজা আটকে দিল। ঘটাং করে খিড়কি লাগানোর শব্দ হল। 

দূরে, যেখানে শহর, যেখানে আকাশের তারা দেখা যায় না- সেখান থেকে ছাড়া ছাড়া ভাবে পুলিশের গাড়ির সাইরেনের শব্দ আসছে। খুব শিগরিরই উকুন খোঁজার মত চিরুনী অভিযান শুরু হবে। আর খুব শিগরিরই তাকে লুকাতে হবে। যেভাবেই হোক। 

লোকটা আবার দরজায় নক করল। এবার আর কেউ দরজা খুলল না। ভেতর থেকে সেই লোকটা আবার কর্কশ গলায় বলল, “ভেজাল কইরেন না তো বাল। কুনখান থেইকে এইসব আসে। 

তিনতলা বাড়িটার দিকে তাকালো লোকটা। অন্ধকারে একটা মহিলা গলা শোনা গেল, “কিডা গো, রাইসুল?” 

ও আচ্ছা, দারোয়ানটার নাম তাহলে রাইসুল। 

“সাংবাদিক মনে হয়। গন্ধ শুঁকার জন্য আসছে। যাইতে বলছি, যাইতেছে না।” 

লোকটা তখন বলল, “আমাকে রতন পাঠিয়েছে, ম্যাডাম আনানসি আছেন? মানে, খুব জরুরী আর কি।” 

কোন উত্তর নেই। রাইসুল আর নারী কণ্ঠ, দুজনেই চুপ। 

কিছুক্ষণ পরে নারী কণ্ঠটা বলল, “খুইলে দাও রাইসুল। দউলুজে বসতি দ্যাও আমি দেখতিছি।” 

ঘটাং করে শব্দ হল। ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে আর্তনাদ। আর্তনাদ করতে করতে মরচে ধরা গেটটা খুলে গেল। বাড়ির আঙিনা অন্ধকার। রাইসুলের চেহারা এবারও বোঝা গেল না। শুধু বোঝা গেল, সে লুঙ্গী আর একটা হাফহাতা শার্ট পরে আছে। অন্ধকারে ডান দিকে যেতে ইশারা করে বলল, “ওইহানে গি বসেন। ক্যামেরা ফ্যামেরা আছে নি কাছ?” 

লোকটা মাথা নাড়ল। ক্যামেরা ফ্যামেরা নেই। রাইসুলের কথাটা বিশ্বাস হল না। এগিয়ে এসে লোকটাকে দুই হাত ওপরে উঠাতে বলল। লোকটা দুই হাত ওপরে উঠাল। রাইসুল সার্চ করল। পকেটে একটা পুরনো নোকিয়া বার’শ পঞ্চাশ মডেলের মোবাইল ফোন পেল। তারপর সেটা উল্টে পাল্টে দেখল। 

সার্চ শেষে লোকটা গিয়ে একটা ছোট ঘরের সামনে এসে দাঁড়াল। এটাই সম্ভবত ‘দউলুজ’ ঘর। টিমটিমে একটা ষাট ওয়াটের টাংস্টেন বাল্ব জ্বলছে। হলুদ আলোতে আলকিত হয়ে আছে পুরো ঘর। দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার। আর একটা তেল চিটচিটে টেবিল। টেবিলের ওপরে একটা ছেঁড়া ফাটা রেজিস্ট্রার খাতা। 

কিছুক্ষণ বসে থাকা। সেই কিছুক্ষণ বলতে কতক্ষণ, লোকটা জানে না। হাতে ঘড়ি নেই। মোবাইলটা বন্ধ। আশেপাশে কোন ঘড়িও নেই। রাত কয়টা হবে? দশটা? নাকি একটা? শহরটাকে একটা শ্বাপদশংকুল অরণ্য। কোন এক অজানা কারণে পুলিশ তাকে জন্তুর মত খুঁজছে। কেন খুঁজছে? জানে না সে। তার অপরাধ কি? জানে না সে। কিন্তু নিজের ভেতরে নিজেই যেন দ্বিধায় ডুবে আছে সে। তার অজান্তেই কি তাহলে কোনভাবে ভুল হয়ে গেল? তার নিজের ভুলের জন্যই কি মারা গেল কয়েকটা মানুষ? ভুলটা কি? 

জায়গাটা নিশ্চুপ। তিনতলার বাড়িটা দেখা যাচ্ছে; সে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে, রতন তাকে ঠিক কোথায় পাঠাল? কোথায়? 

একটু পরে কলাপসিবল গেট খোলার খড় খড় একটা শব্দ হল। একটা এলইডি লাইট জ্বলে উঠল। একজন মাঝবয়সী মহিলা বের হয়ে এল গেট খুলে। ধীর পায়ে ‘দউলুজ’ ঘরের দিকে এগিয়ে এলো। ভদ্রমহিলা ঘরে ঢুকতেই লোকটা উঠে দাঁড়ালো, বলল, “নমস্কার। আমি সুকান্ত। সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।” 

মহিলা মাথা নাড়লেন। মুখ ভর্তি পান। পরনে ঠাকুরবাড়ির মেয়েদের মত করে পরা মেরুন রঙের একটা শাড়ি। হাতে স্টিলের চুড়ি। ভেজা খোলা চুল। সম্ভবত একটু আগে হয়ে যাওয়া বৃষ্টিতে ভিজেছে। দউলুজ ঘরের দরজার বাইরে পিচিক করে পানের পিক ফেলে সে বলল, “আমি তো শুনল্যাম আপনের নাম সৌরভ। রাইসুলরে তো তাই ই বইললেন। 

সুকান্ত বলল, “আসলে, ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মানে, বিশ্বাস করতে…” 

সুকান্তের কথা শেষ হল না। মহিলা নিচু গলায় বিড়বিড় করে বলল, “আ মরণ।”

সুকান্ত চুপ করে গেল। ভদ্রমহিলার কথা বলার ভেতরে কেমন একটা ঔদ্ধত্য আছে। যেন তার কাছে এই জগত সংসার কিছুই না। ঘাড় বাঁকা করে সুকান্তের সাথে কথা বলছে সে। মুখের ওপরকার চুল সরিয়ে বলল, “সবাই এইখানে আইসে উইল্টোপাল্টা নাম বলে। সিডা ব্যাপান্না। মাইনষে নিজের নাম বাচাইতে কত কেছছা কাহিনীই যে করে। যাইগগে, আপনারে তো ওই লাইনের লোক মনে হঅচ্ছে না। উঁহু। আপনে তো অন্য লাইনের লোক। কারে চান?” 

“ম্যাডাম আনানসি আছেন?” 

“ক্যান? তারে কি দরকার?” 

“রতন আমাকে পাঠিয়েছে।”

“কুন রতন? ওই চায়ের সাতে বাবা বেইচে বেড়াই ওই রতন?” 

সুকান্ত মাথা চুলকালো। ‘বাবা’ যে কেউ বিক্রি করতে পারে এইটা তার জানা ছিল না। সে আমতা আমতা করে বলল, “ওই যে, চা-টা দেয়। শামীমের টি স্টলের এসিস্ট্যান্ট।” 

মহিলা এবার কিছুটা নরম হল বলে মনে হল। বাঁকা ঘাড় সোজা হল। বলল, “আসেন আমাসসাতে।” 

সুকান্ত ভদ্রমহিলার পিছু নিল। 

এক চিলতে উঠোন। কিন্তু অন্ধকারে তেমন একটা কিছু বোঝা গেল না। কলাপসিবল গেটটা পার হতে হতে সুকান্ত বলল, “আপনার নামটা যদি বলতেন?” 

মেয়েটা পেছন ঘুরে সুকান্তের দিকে না তাকিয়েই সিঁড়ি ধরে উঠতে উঠতে বলল, “ক্যান? নাম দিয়ে কি হবে?” 

সুকান্ত মিইয়ে গেল। আসলেই তো। নাম দিয়ে কী হবে তার? সে চুপ করে মহিলার পেছন পেছন অন্ধকার সিঁড়ি ধরে উঠতে লাগল। ভদ্রমহিলা উঁচু গলায় বলল, “রাইসুল গেটটা লাগায়ে দিও।” মহিলার চলাফেরার ভেতরেও কেমন যেন একটা ভারিক্কী ভাব। কোমরটা সাপের মত আঁকিয়ে বাকিয়ে হাঁটছে। 

একটা তেলচিটচিটে দরজার সামনে দাঁড়াল ভদ্রমহিলা। দরজা খুলতে খুলতে বলল, “আমিই ম্যাডাম আনানসি। ভিত্রে আসেন।” 

ঘরের ভেতরটা খুব সুন্দর করে সাজানো। রংবেরঙ্গের ডেকোরেশন লাইট ঝুলিয়ে রাখা আছে দেয়ালে। সেই আলোতে শোভা পাচ্ছে সানি লিওনি, পপি, ময়ুরী সহ আরো নাম না জানা মহিলাদের পোস্টার। যেই পোস্টার দেখে সুকান্ত আর চোখ তুলে দেয়ালের দিকে তাকাতে পারল না। ঘরের ভেতরে মিষ্টি একটা গন্ধ। এক পাশে একটা ড্রেসিং টেবিল। সাজসজ্জার সামগ্রী সাজানো আছে টেবিলের ওপরে। ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের প্রতিবিম্বের দিকে চোখ পড়ল সুকান্তের। সানগ্লাস আর বেজবল ক্যাপ- দুটোই কখন কোথায় পড়ে গিয়েছে, খেয়াল করেনি সে। 

“কী রে! হাঁ কইরে কি দেখতিছেন? নিজেরে দেখতিছেন?” এই বলে খিল খিল করে ম্যাডাম আনানসি হেসে ফেলল। হাসির সাথে সাথে ভারিক্কী ভারিক্কী ভাবটা কাঁচের মত ভেঙে পড়ল। সুকান্ত আগের মতই হাঁ করে ম্যাডাম আনানসির দিকে তাকিয়ে থাকল। 

“হাঁ কইরে তাকায়ে থাকবেন, নাকি বসপেন?” আনানসি বলল। খাটের পাশে একটা দড়িতে ঝুলতে থাকা একটা গামছা নিয়ে চুল মুছতে মুছতে সে বলল, “বসেন বসেন। জামা খুইলে বসতি চাইলে বসতি পারেন। এইখানে সবাই জামা খুইলেই বসে। সরি বসে না, শোয়।” 

সুকান্ত খুব সাবধানে খাটের ওপরে বসল। তার খুব দ্রুত কিছু একটা বলা দরকার। কেন বলা দরকার? সে জানে না। ভেতরে ভেতরে কথা হাতড়াতে হাতড়াতেই আনানসি আরেকটা কথা বলে ফেলল, “আপনারে রতন ছুঁড়া পাঠাইছে? সত্যি?” সুকান্ত মাথা নাড়ল। সত্যি। আনানসি ভেজা গামছাটা আবার দড়িতে মেলে দিতে দিতে বলল, “কেন পাঠাইছে?” 

হঠাৎ আশেপাশে কোথাও পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। শোনা গেল, আর খুব দ্রুত হারিয়েও গেল। এদিকটা নীরব। তাই সাইরেনটা অনেক তীব্র শোনালো। আনানসি দেখল, সুকান্ত চমকে উঠল। আনানসি কোথা থেকে একটা পানের বাটা বের করল। খাটের ওপরে বসতে বসতে বলল, “বুজছি। কেস। পুলিশের কেস। না?” শাড়ির আঁচল খুলে ফেলতে ফেলতে হঠাৎ কী মনে করে আঁচল আবার ঠিক ঠাক করল সে। পুরনো বদঅভ্যাস। সামনে বসে থাকা গোবেচারা ধরনের লোকটা যে অন্যদের মত শাড়ি খুলতে আসেনি, এ বিষয়ে সে নিশ্চিত। 

“ভয় নাই। আয়েস কইরে বসেন। এইটা মইসুর চাকলাদারের বিল্ডিং। চেনেন তো চাকলাদারকে নাকি? ওই যে মন্ত্রী। কিসের যেন মন্ত্রী। আরে ঐ যে, ধুরো।” বাটা থেকে পান বের করতে করতে আনানসি বলল, “এইখানে পুলিশ টুলিশের ঝামেলা নাই। এইখানে কেউ আসে না। মাঝে মইধ্যে ওই পুষা কিমিলালগুলা এইখানে আইসে লুকায় থাকে।” 

সুকান্ত শুনল। চুপ করে। 

“আপনি করেন কি?” আনানসির প্রশ্ন। 

“আমি একটা প্রেসে কাজ করি।” সুকান্তের ছোটখাট উত্তর।

আনানসি বলল, “অ”। 

সুকান্ত কি মনে সেই কথাটাই বলে ফেলল, যেটা সে কাউকে বলে না, ভুল করেও বলে না- “আর ঐ টুকটাক লেখালেখি করি।” 

কেন বলল সুকান্ত? সে কি সামনে বসা এই মেয়েটাকে মুগ্ধ করতে চাচ্ছে? কেন? এই মেয়েটাকে তার জীবন বাঁচিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে, জীবন বাঁচিয়েছে- তাই? নাকি সুকান্ত এটা বলতে চাচ্ছে যে আনানসি যার জীবন বাঁচিয়েছে সে মোটেই এলেবেলে কেউ না, বরং একজন লেখক; তার একটা সম্মান আছে। এত আত্মসম্মানবোধ তার হল কবে থেকে? 

“অ, লেখক। লেখকরা বারচুদা টাইপির হয়।” আনানসি কনুইয়ের ওপরে ভর দিয়ে শুতে শুতে বলল। “আপনে মোস্তাফিজ সাহেবরে চিনেন?” 

“কোন মোস্তাফিজ?” 

“ওই যে লিখালিখি কইত্ত। আপনের মত।” 

“ইমন মোস্তাফিজ?” 

“হ্যাঁ হ্যাঁ। হ্যাঁ। ওই যে বিজনেস কইত্ত। আবার লিখালিখিও কইত্ত।”

সুকান্তের মাথায় বাজ পড়ল যেন। এতক্ষণ নিরাপদ আশ্রয় পেয়ে যে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ঝিমিয়ে পড়েছিল, তা আবার লাফিয়ে উঠল। 

“আপনি উনাকে চেনেন?” 

“চিনি তো। মন্ত্রী সাহেবের কিরাম জানি বন্ধু হইত। বউয়ের সাতে বনিবনা হইত না। এইখানে আইসে বইসে থাকত। গল্প টল্প কইত্ত। কিন্তু ওইযে কলাম না, বারচুদা এক নম্বরের।” 

“উনি এখানেই এসে থাকত? কতদিন থাকত?” 

“কতদিন আবার! কয়েক ঘণ্টা থাইকে টাইকে আবার চইলে যাইতো। কিন্তু লোকটার একটা সমিস্যা ছিল।’ 

“কি সমস্যা।” 

“মাঝে মাঝে লিখতি পাইত্তো না। ঝিপাইতো। মুন খারাপ কইরে থাইকতো। কেমুন কইরে জানি থাইকতো। বেশিরভাগ সুমায়তেই লোকটা লিখতি চাইতো, কিন্তু লিখতি পাইত্তো না। আমাকে অনেকবার কথাগুলা বইলেছে। আমি শুদু শুনতাম। শুনাই আমাদের কাজ। আর হ্যাঁ, লোকটা মাঝে মাঝে কুন এক সমিতিতে যাইতো।” 

“সমিতি!” 

“হ্যাঁ। সমিতি। লিখালিখির সমিতি। সেইখানে গেলে নাকি লিখতি পাইত্তো। দারুন এক সমিতি নাকি। আরো অনেকেই নাকি যাইতো।” 

সুকান্তের ভেতরটা যেন দপ করে জ্বলে উঠল! 

“আর কারা কারা যেত বলেছে কিছু?” 

“নাহ। মাল মুল খায়ে মায়ে এইসব বুইলতো। আমি আর অত মন দি শুনতাম না। বইলত, সমিতি না, ওইডে নাকি সরগো। হাহ, সাধে কি আর বঅল্লাম যে লেখকরা বার…”

কথা শেষ হল না। পুলিশের সাইরেন শোনা গেল। খুব কাছে। আস্তে আস্তে শব্দটা কাছে আসতে শুরু করল। আরো কাছে আসতে শুরু করল। আরো কাছে। 

পঁ পঁ পঁ পঁ 

চলে গেল। যেমন করে কাছে এসেছিল ঠিক সেভাবেই দূরে চলে গেল। 

“আবার ভয় পাতিছেন? বললাম না ভয়ের কিছু নাই। ধরো। পুলিশ এইখানে আসপে নানে।” আনানসি বলল। হাত বাড়িয়ে মাথার কাছের একটা জানালা খুলে দিল। হু হু করে রাতের বাতাস ঢুকল ঘরটাতে। 

সুকান্ত একটু নড়ে চড়ে বসতেই আনানসি বলল, “আপনে এমুন মুখ চাপা ক্যান? কুনো কথা নাই বাত্তা নাই। সবাই আইসেই এট্টা পোশ্ন করে। আমার নাম আনানসি ক্যান? সবার নাম জুলেখা, মালেকা, সননালী, সোমা- এইসব হয়, আমার নাম এইরাম ক্যান?” পিকদানিতে পিচিক করে পিক ফেলে বলল, “আপনে তো কই জিজ্ঞেস কল্লেন না?” 

“আমি জানি আনানসি মানে কি” সুকান্ত বলল। 

“আপনে জানেন?” চোখ ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল আনানসি। 

“জানি। আনানসি হল আফ্রিকান মিথোলজির একটা মাকড়সার নাম। আনানসিকে গল্পের দেবী বলা হয়। পৃথিবীর সব গল্প তার কাছেই থাকে-এমন একটা ধারণা করা হয়। আফ্রিকান মিথোলজি অনুযায়ী ধারণা করা হয়, আগে সব গল্প ছিল আকাশের দেবী নাইমির কাছে। নাইমি একবার আনানসিকে ওসিবো নামের একটা অজগর, ওনিন নামের একটা চিতা আর স্কোরো নামের কিছু ভীমরুলকে ধরে আনতে বলল।” 

সুকান্ত থামল। পকেটে থাকা মোবাইলটার কথা মনে পড়ে গেল। প্ৰসঙ্গ পাল্টে বলল, “আমার মোবাইলটা একটু চার্জ দিতে হবে।” 

“চার্জ দিবেন? ওই যে ওইখানে চার্জার আর ফুটা আছে। ঢুকাই দ্যান।” বলল আনানসি; চোখে মুখে একটা রহস্যময় দুষ্টু হাসি। 

আনানসির দেখানো প্লাস্টিকের একটা কৌটা খুলে একটা চার্জার বের করল সুকান্ত। চার পাঁচটা চার্জার আছে। চিকন পিনের চার্জার থেকে শুরু করে চ্যাপ্টা পিনের চার্জার পর্যন্ত- সব আছে। সুকান্তের চোখে মুখে প্রশ্ন দেখেই আনানসি বলল, “কাস্টমারদের জন্যে। এক একজনের এক একরকমের পিন।” বলেই মুচকি হাসল সে। 

মোবাইল চার্জে দিয়ে সুকান্ত আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল, “প্ৰথমে আনানসি গেল ওসিবোর কাছে। ওসিবোর বউয়ের সাথে লাগিয়ে দিল তর্ক। ওসিবোর বউ বলল, আমার স্বামী সব থেকে বড় অজগর। এই পৃথিবীতে তার মত বড় অজগর আর একটাও নেই। আনানসি সেটা মানল না, তার মতে ওসিবোর চাইতেও বড় সাপ আছে পৃথিবীতে। এই তর্ক ওসিবোর কানে গেল। ওসিবো আনানসিকে মেপে দেখতে বলল। আনানসি বলল যে এত বড় সাপ লম্বায় মেপে দেখা তো অসম্ভব, ওসিবো বরং একটা খেজুর গাছের গুড়িতে পেঁচিয়ে বসুক। তাহলে সে মেপে টেপে দেখতে পারে। ব্যস। খেজুর গাছ পেঁচিয়ে ধরার সাথে সাথে ওসিবোকে নিয়ে আনানসি নাইমির কাছে হাজির হল। 

ম্যাডাম আনানসি হাই তুলতে তুলতে বলল, “তারপর?” 

“তারপর, আনানসি গেল ওনিনি নামের চিতাবাঘকে ধরতে। প্রথমে একটা ফাঁদ বানালো আনানসি। ওনিনি এসে ওই ফাঁদটাতে পড়তেই আনানসি ওকে উদ্ধার করার জন্য হাত বাড়ালো। ওনিনি হাত বাড়াতেই ওকে নিয়ে আনানসি হাজির হল নাইমির কাছে।” বলে লম্বা একটা হাই তুলল সুকান্ত। বিছানাটা যেন অনেক বেশি নরম মনে হল তার কাছে। দূর থেকে ভেসে আসা পেঁচার ডাকই রাতের গভীরতা যেন বুঝিয়ে দিল। ম্যাডাম আনানসিও ‘তারপর’ বলল না। সুকান্তের সারা শরীর যেন ধীরে ধীরে নেতিয়ে পড়তে লাগল। ম্বোরো নামের ভিমরুলটাকে কিভাবে ধরল আনানসি, সেটা আর জানা হল না। 

জানালা দিয়ে আসা রাতের বাতাসে উড়তে থাকল আনানসির চুলগুলো আরো বেশি এলোমেলো হয়ে গেল। এলোমেলো হয়ে গেলো সুকান্তের বৃষ্টিভেজা কোঁকড়া চুলগুলোও। 

সকালে উঠে সুকান্ত দেখল, সে একটা ফাঁকা ঘরে শুয়ে আছে। মেঝের এক কোণে ছেঁড়া একটা জাজিমের ওপরে। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। হাট করে খোলা দরজা দিয়ে হলুদ রোদ এসে পড়েছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। আর কিছুই নেই। ধুলো ধুসরিত মেঝেতে সুকান্ত একা। 

ম্যাডাম আনানসি, রইসুল, দেয়ালের পোস্টারগুলো, রংবেরঙ্গের লাইটগুলো- সব হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়েছে। তার চার্জে দেওয়া মোবাইল ফোনটাও নেই। মাথার ভেতরে শুধু বাজছে একটাই কথা- সমিতি। লিখালিখির সমিতি। সেইখানে গেলে নাকি লিখতি পাইত্তো। দারুন এক সমিতি নাকি। আরো অনেকেই নাকি যাইতো। 

আরো অনেকেই যাইতো- মানে কি? কারা যেত? কারা যায়? 

মৃত বইয়ের দেশে 

সামনে বসে থাকা শ্রোতাদের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন ভদ্রলোক। তারপর বললেন, “লেখকের চরিত্র হতে হবে জলের মত। সে সব কিছু ধারণ করবে, খারাপ মানুষের থেকে খারাপটা ধারণ করবে, ভালো মানুষের থেকে ভালোটা ধারণ করবে। কিন্তু শেষতক সে জলই থাকবে। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গী হতে হবে পাথরের মত। কোন কিছু তার দৃষ্টিভঙ্গীকে প্রভাবিত করতে পারবে না। সিদ্ধান্তই হবে তার জন্য সর্বশেষ সিদ্ধান্ত।” 

**** 

বিশাল একটা কালো ছায়া। ছায়াটার গায়ে জোনাকীর মত আলো জ্বলছে ঝিলমিল করে। ছায়াটা আরো বড় হচ্ছে, যেন রবারের মত টেনে কেউ লম্বা করছে। আশেপাশে যেন কিছু একটা চেপে ধরছে তাকে। দম আটকে আসছে। আলোগুলো ক্রমশ বড় হচ্ছে। আরো বড় হচ্ছে। আর ততই আটকে আসছে দম। 

বিশ্রী রকমের একটা ঝাঁকুনিতে ভেঙে গেল প্রণবের ঘুম। 

মুড়ির টিনের মত বাস। রাস্তা খারাপ, ভাঙা-চোরা। খানা খন্দে ভরা। একটু পর পরই বাস থামছে, যাত্রী উঠাচ্ছে, নামাচ্ছে। স্যাঁতস্যাঁতে আবহাওয়া। গুমোট গরম। বাসের ভেতরের ঠাঁসা ভিড়টা গরম আরো বাড়িয়েছে। এতটুকু বাতাস ঢুকছে না। দম বন্ধ হয়ে আসার মত ব্যাপার। একেবারে শেষের সিটে নিজের বিশাল শরীরটা কোনরকমের আঁটিয়ে নিয়ে গত আধ ঘণ্টা বসে আছেন এজেন্ট প্রণব। 

অনেক ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়েছেন তিনি গত পাঁচ ঘণ্টা। হবিগঞ্জে এসে সেই মুনশী মোয়াল্লেম নামের ভদ্রলোককে খুঁজেছেন। টানা একটা ঘণ্টা তার হদিস বের করতে করতে গিয়েছে। এই নাম এর আগে কেউ শোনেনি। কেউ চেনেও না এই নামে কাউকে। 

হঠাৎ প্রণবের মনে হল, লোকটা যেহেতু বইয়ের ব্যবসা করত, তাহলে বইয়ের দোকানগুলোতে খোঁজ করলে হয়ত পাওয়া যেতে পারে। এমনিতে নীলক্ষেতের বইপাড়ায় আর শাহবাগের বইয়ের দোকানগুলোতে লোকটার আনাগোনা ছিল। এখানেও হয়ত সেটাই হবে। 

সমস্যা যেটা হল, পুরো হবিগঞ্জের বাজার ঘুরে বইয়ের দোকান পাওয়া গেল না। বেশিরভাগই স্মার্টফোনের শোরুম, নয়ত ফ্লেক্সিলোডের দোকান। গার্মেন্টেসের দোকান আর জুয়েলার্স। তারওপর বেশিরভাগ লোকজন সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলছে। প্রণব কিছুই বুঝতে পারছেন না। বুঝলেও আধা খাচড়া। চড়চড়ে রোদের ভেতর ভারি শরীরটা নিয়ে মোটামুটি হাঁপিয়ে উঠলেন। দায়িত্বে অবহেলাজনিত অপরাধবোধ চাপা দিয়ে ঢুকলেন একটা রেস্টুরেন্টে। একটা মিল্কশেক অর্ডার করলেন। খালি হাতে ফিরতে হবে- ভাবতেই পুরনো অভিজ্ঞতাগুলো এসে সান্ত্বনা দিতে লাগল। এর আগেও এরকম হয়েছে। ছদ্মনামের বেনামের কত লোককে খুঁজেছেন। সাভারে এক শিশু পাচারকারীকে খুঁজে বের করেছিলেন তিনিই। মহিলা নার্সের কাজ করত, আর সাভারের বেশ কয়েকটা ক্লিনিকে নবজাতক চুরি করত। মহিলা বেশ কয়েকটা ক্লিনিকে বেশ কয়েকটা নাম নিয়ে চাকরি করেছে। এক এক ক্লিনিকে তার ঠিকানা এক এক রকম। সেই মহিলাকে খুঁজে বের করতে গিয়ে জান বের হয়ে গিয়েছিল। 

“স্যার, আপনার মিল্কশেক।” একটা কম বয়সী মেয়ে এসে মিল্কশেকের গ্লাসটা কাঁচের টেবিলটার ওপরে রাখতে রাখতে বলল। মেয়েটার ওয়েটার স্যুটের পকেটে একটা বইয়ের কপি দেখে কোন ভূমিকা ছাড়াই জিজ্ঞাসা করলেন, “আচ্ছা, একটা সাহায্য করতে পারবেন? এখানকার বইয়ের দোকানগুলো কোথায় বলতে পারেন?” 

মেয়েটা হাসল। পকেটে রাখা বইটার দিকে একবার তাকালো। তারপর বলল, “বইয়ের দোকান কিছু আছে। কিন্তু সেগুলোতে আপনি চাকর হওয়ার বই ছাড়া আর অন্য কোন বই কিন্তু পাবেন না।”

“চাকর হওয়ার বই বলতে?” মিল্কশেকে চুমুক দিতে দিতে প্রণব বললেন। 

“মানে ওই যে বিসিএস এর বই আর কি। চাকরি পাওয়ার বই, গাইড বই। মানে যে বইগুলো পড়লে আপনার সৃষ্টিশীলতাটা মরে যাবে, এই আর কি। বইয়ের দোকানে অন্য বই খুঁজলে হতাশ হবেন।” 

“সোজা কথায় বলেন, বইয়ের দোকানগুলো কোথায় পাব? পুরনো বইয়ের দোকান হলে ভালো।” প্রণব বললেন। 

“শহরের বাইরে, রামপুর যেতেই রাস্তার ডান হাতে, মানে মিউনিসিপলটি বাজারের শেষ দিকে কয়েকটা দোকান পাবেন। ওগুলোই মোটামুটি পুরনো।” 

প্রণব মাথা নাড়লেন। বিল পে করার সময় এক্সট্রা একশ টাকার একটা নোট রেখে আসলেন টেবিলে; যদিও তিনি জানেন না তিনি যা খুঁজছেন তার হদিশ মেয়েটা দিয়েছে কিনা। 

অবশেষে পাওয়া গেল; মিউনিসিপলটি বাজারের বইয়ের দোকানগুলোর বেশ কয়েকজন কর্মচারী শুনেছে মুনশী মোয়াল্লেমের নাম। লোকটা থাকে নবীগঞ্জ হাইওয়ের পাড়ে যে হাওড়, সেই হাওড়ের মাঝখানে। লোকটা পাগলাটে। পাগলাটে বললে ভুল হবে, খ্যাপাটে। বেশ কয়েক বছর আগে ঢাকায় বইয়ের দোকান ছিল। কি একটা বিষয়ে কাস্টমারের সাথে তর্কে জড়িয়ে পড়ে লোকটা। তারপর ভারি একটা বই দিয়ে সেই কাস্টমারকে আঘাত করে। একেবারে মাথায়। কাস্টমারটা আহত হয়। হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। ইন্টারনাল ব্লিডিং-এর জন্য তিনদিনের মাথায় মারা যায় সে। ব্যস! মোয়াল্লেমের জেল হয়ে যায়। বারো বছর। এমনিতে লোকটা ভালো। প্রচুর পড়ে, অনেক পড়ে। অনেক বইয়ের সংগ্রহ ছিল। শুধু ইংরেজী অথবা বাংলা না, হিন্দী, উর্দু থেকে শুরু করে ফ্রেঞ্চ ভাষারও নাকি বেশ কয়েকটা বই ছিল তার সংগ্রহে। বই ছিল তার ধ্যানজ্ঞান। এখন আছে কিনা কেউ জানে না। জেল খেটে ফিরে এসে আর ঢাকায় থাকেনি। হবিগঞ্জের পৈতৃক ভিটায় ফিরে এসেছে। কি করে, কি খায়, কেউ জানে না। কেউ ঘাঁটায় না তেমন একটা। কারণ, লোকটা খ্যাপাটে, অসামাজিক। আর নিজেকে খুব বড় মনে করে। বেশি বোঝে তো, তাই সমাজে কেউ তাকে জায়গা দেয় না। 

একটা বিশ্রী ব্রেকের কারণে থেমে সামনের সিটের সাথে ধাক্কা খেলেন প্রণব। ধ্যান ভেঙে গেল। এমন বিশ্রী ব্রেক কষার জন্য যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ খুব বাজে ভাষায় ড্রাইভারকে গালি দিল। বেশির ভাগ গালির মানে বুঝলেন না প্রণব। সিলেটি গালির মানে শুধু সিলেটিরাই বোঝে, এবং সেটাই বোঝা উচিৎ- অন্য কারো বোঝাটা জরুরি না। প্রণব দেখলেন, রাস্তার ডান পাশেই একটু ঢালু জায়গায় পানি। শুধু পানি আর পানি। ছোট ছোট ঢেউ। আকাশে কখন মেঘ জমতে শুরু করেছে খেয়ালই করেননি। 

“এইটা কি নবীগঞ্জের হাওড় ভাই?” প্রণব পাশে বসে থাকা সহযাত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন। সহযাত্রী মাথা নাড়ল। এটাই নবীগঞ্জের হাওড়। 

প্রণব তাড়াতাড়ি নেমে পড়লেন। হাতঘড়িতে তখন সময় দুপুর দুইটা সন্ধ্যার আগে আগে শহরে ফিরতে হবে তাকে। 

আকাশ আর হাওড়ের মাঝখানে চিকন সুতার মত দূরের গ্রাম আশেপাশে কোন নৌকা নেই, মাঝিও নেই। প্রণব এদিক ওদিক তাকালেন। লম্বা লম্বা গাছের সারি হাইওয়ের ধারে। সেই গাছগুলোরই একটার আড়ালে কয়েকজন ছোট ছেলেকে দেখলেন। হাফপ্যান্ট পরা, খালি গা। ইশারা করে ডাকলেন। জিজ্ঞাসা করলেন যে হাওড়ের মাঝখানে যাওয়ার কোন ব্যবস্থা আছে কি না। 

ছেলেগুলো কী বুঝলো, বুঝতে পারলেন না প্রণব। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তারা এক কঙ্কালসার বুড়োকে সাথে করে নিয়ে আসল। পরনে শুধু একটা নোংরা ছেঁড়া লুঙ্গী। পাজরের হাড়গুলো স্পষ্ট বোঝা যায়। মুখে এলোমেলো দাড়ি, যেনো কেউ খাবলা খাবলা করে ছিঁড়ে নিয়েছে। কিন্তু লোকটা শুদ্ধ উচ্চারণ শুনে অবাক হলেন প্রণব। 

“ওপারে যাবেন? কোন গ্রামে?” ভাঙা খনখনে গলায় জিজ্ঞাসা করল লোকটা। 

“মুনশী মোয়াল্লেমকে চেন? বইয়ের ব্যবসা ছিল। উনার বাড়ি এই হাওড়ের মধ্যে না?” প্রণব বললেন। 

“হ্যাঁ। মুয়াল্লেমের বাড়ি হাওড়ের মাঝখানে। শুকনা মৌসুমে হাওড়ের ভেতর দিয়ে রাস্তা থাকে। এখন বর্ষা তো, তাই রাস্তা নাই। নৌকায় যাইতে হবে। আমি নৌকা আনছি, একটু দাঁড়ান।” 

লোকটা হারিয়ে গেল। আকাশে কালো মেঘ পাক খাচ্ছে। ঝড়ো বাতাসের সাথে সাথে মেঘগুলো উড়ে কোথা চলে যাচ্ছে, বেরিয়ে যাচ্ছে আকাশের সাদা অংশ। বাতাসের সাথে সাথে আবার কালো মেঘ উড়ে আসছে কোথা থেকে। শার্টের একটা বোতাম খুলে দিয়ে প্রণব দূরের গ্রামের দিকে তাকালেন। আশেপাশে বিদ্যুৎ আসেনি। সবচেয়ে কাছের পুলিশ ফাঁড়িটাও এখান থেকে চার পাঁচ কিলোমিটার দূরে। যদিও এখন পর্যন্ত কিছু হয়নি, তারপরেও বলা যায় না। কোমরে গোজা রিভলভারটা একবার স্পর্শ করলেন আনমনেই। যদিও এটা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে না, হয়ত। 

কিন্তু প্রণব ভুলে গিয়েছেন, এই বইটার পেছনে জড়িয়ে আছে অনেকগুলো খুন, অনেকগুলো প্রাণ। 

লোকটা নৌকা নিয়ে চলে আসল। 

প্রণব নৌকায় উঠতেই ছলাত ছলাত করে নৌকা চলতে শুরু করল। আকাশ ভরা মেঘ আর ঝোড়ো বাতাস চিরে হাওড়ের ঢেউয়ে ভেসে ভেসে নৌকা চালাতে লাগল লোকটা। প্রণব বলল, “তুমি মুনশী মোয়াল্লেমকে চেন?” 

“চিনি। অনেক আগে থেকেই চিনি। উনার আব্বাকেও চিনতাম।”

“কিভাবে চেন?” 

“মাঝে মধ্যে শহর থেকে কিছু আনতে হলে আমি এনে দেই। আগে বৈশাখ চৈত্রের দিকে মানুষজন আসত উনার কাছে। উনাদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতাম। বাজার ঘাট লাগলেও আমিই নিয়ে যেতাম।” 

“যেতাম মানে?” 

“মানে চৈত্র বৈশাখ মাসে যেতাম। আর যেতাম শীতে। বর্ষা আসলে লোকটা একেবারে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। চারপাশে পানি, বেরও হন না। কারো সাথে কথাও বলেন না। কোনদিন মরে পড়ে থাকবে, কেউ জানবে না।” 

“মানুষ কেমন উনি?”

“ভালো। কিন্তু বাতিক আছে। নানা বাতিক। বাতিকে বাতিকেই লোকটা শেষ হয়ে গেল।”

“কিসের বাতিক?” 

“কি সব বাতিক। বই জমায়, পাখি দেখে, ভূত ধরে।” 

“ভূত!” 

“হ্যাঁ। ভূত। তার কাছে অনেক ভূত-টুৎ আছে। গেলেই সেইসব ভূতের গল্প শোনাবে। আধ পাগলা মানুষ তো, রগচটা। কিন্তু খুব পরহেজগার। সুফি মানুষ। উনার আব্বা খুব অত্যাচারী মানুষ ছিলেন। হাওড়ে ধানী জমি বর্গা দিতেন। কত কৃষকের জমিই যে তিনি দখল করেছেন। কি বলব আর। লাশের ওপরে লাশ পড়ে থেকেছে চৈত্র মাসে। কত মেয়েছেলে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়েছে হিজল গাছে। কেউ তুলতে আসেনি। বর্ষার বৃষ্টিতে সেইসব কঙ্কাল কোথায় ভেসে গিয়েছে। দখল করা জমিগুলাই বর্গা দিতেন। শেষ বয়সে গিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। নিজের একটা রাইফেল ছিল, সম্ভবত উইঞ্চেস্টার। আমি দেখেছি। নামটা এতোবার শুনেছি যে এখনও ভুলিনি। সেটা দিয়েই নিজের খুলি উড়িয়ে দিয়েছিলেন।” 

“লোকটা নাকি জেল-টেল খেটেছে একবার শুনেছি।” 

“খাটতেও পারে। ঢাকা শহরে যখন ছিল তখন কি করেছে না করেছে আমার জানা নাই। মানুষের সাথে মেশে নাকি খুব? একদম মেশে না। বললাম না? অসামাজিক।” 

দমকা বাতাসে নৌকা টলকে ওঠে। এমনিতেই প্রণবের ভারে নৌকা ডুবো ডুবো অবস্থা, পানি উঠছে একটু একটু করে। তার ওপর দমকা বাতাস। প্রণব নৌকা খামচে ধরলেন। 

“ভয় নাই। নৌকা ডুববে না। সাঁতার পারেন?” লোকটা বলল। প্ৰণব হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। যদিও তিনি সাঁতার পারেন না। কিন্তু এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষা, যেটা প্রণব নিজের অভিজ্ঞতা থেকে পেয়েছেন, সেটা হল, অচেনা জায়গায় অচেনা লোকের কাছে ‘কি কি পারো না’ টাইপের প্রশ্নের উত্তর কখনও দিতে হয় না। 

“সন্ধ্যার আগে আগে কাজ সারবেন। সন্ধ্যার পরে ডাকাতের উৎপাত। তাছাড়া হাওড়ে সন্ধ্যার পর থাকা ঠিক না।” লোকটা বৈঠা হাতবদল করতে করতে বলল। ডাকাতের উৎপাতের কথা প্রণব শুনেছেন। সিলেটের সদর থানার এসপি সাহেব একবার গল্প করেছিলেন। হাওড় এলাকায় প্রশাসনের লোকজন একা যায় না। যাওয়া উচিৎ না। গেলে দলবল বেঁধে যেতে হয়। একা পেলে তার মৃত্যু হয় খুব নির্মম। এদিকে এক ডাকাত আছে। নাম সাধু ডাকাত। সে নাকি তান্ত্রিক। মন্ত্র পড়ে ‘দামোরি’ নামাতে পারে। দামোরি কি, সেটা অবশ্য বলতে পারেননি এসপি সাহেব। এই দামোরিগুলোই নাকি তাকে ডাকাতি করতে সাহায্য করে। একা একা আসতে এসপি সাহেবও নিষেধ করেছিলেন। গত দুই মাসে নাকি চার পাঁচ জন পুলিশ হাওড়ের এদিকে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছে। তার মধ্যে মাত্র একজনের লাশ উদ্ধার করা গিয়েছে। বাকিদের লাশ উদ্ধার করা যায়নি। 

কিন্তু ব্যাপারটা যতটা গোপন রাখা যায় ততই ভালো। পুলিশ আনলে দশ কান হতে হতে মিডিয়া পর্যন্ত যেত। প্রণব সেটা চাননি। তাই একাই আসতে হয়েছে বাধ্য হয়ে। কিন্তু এখন কেন জানি মনে হচ্ছে, কাজটা ঠিক হয়নি। 

“সন্ধ্যার পরে হাওড়ে না থাকার আর কি কোন কারণ আছে?” 

“আছে।” 

“কি?” 

জুবায়ের আলম 

“ওই যে। ওরা আসে।”

“কারা?” 

“ওরা। সবুজ বজরা ভাসায়ে আসে। সেই বজরা পানি থেকে এক হাত উপরে ভাসতে ভাসতে আসে। ওই বজরা দেখলে হাওড় থেকে আর বের হওয়া যায় না। যে দেখে সে এই হাওড়েই আটকা পড়ে যায়। তাছাড়া, কতবার সন্ধ্যার পরে মাছ ধরতে এসে মানুষের দেহ ভেসে যেতে দেখেছি। বেশিরভাগই মেয়েছেলের দেহ। মনে হবে ডেডবডি, কিন্তু নৌকায় তুললেই সর্বনাশ।” 

প্রণব কিছুই বললেন না। কুসংস্কারে তাল দেওয়ার মত ইচ্ছা নাই। 

“কত গোরস্থান ডুবে যায় এই বর্ষাকালে। হাওড়ের নিচে ডুবে যায়। কত কি দেখি। মাঝে মাঝে মনে হয়, হয়ত চোখের ভুল। এই হাওড়ের পাড়ে মহুয়া গাছগুলোতে ওদেরকে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতে দেখেছি ভর সন্ধ্যাবেলা। পানির নিচে জোনাকির মত আলো জ্বলতে দেখেছি। পানির নিচে সোনার মূর্তিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কত লোক পানিতে লাফ দিয়েছে, আর ফিরে আসেনি। এই হাওড়, এই পানি মানুষকে যেমন টানে, তেমনই ওদেরকেও টানে।” লোকটা বলতে থাকলো। “আগে যখন শাহ পরাণের মাজারে কুরআন মজিদ পাঠ করতাম, ঠিক তখন অনেক বই পড়তাম। ওখানেই এক মাওলানা আমাকে লেখাপড়া শিখাইছিলেন। উনি আবার অনেক দেশ বিদেশ ঘুরেছিলেন। কত কাহিনী যে শুনাতেন। পরে এক মাদ্রাসায় চাকরি পেলেন। সেই মাদ্রাসাতে এক ছোট ছেলে ছাদ থেকে পড়ে মরে গেল। মাওলানাকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেল। তারপরে আর উনার খোঁজ জানি না। চলে আসলাম হাওড়ে। মাছ ধরা শুরু করলাম। ওই যে, এসে পড়ছি।” লোকটা বলল। 

দূরে একটা উঁচু দ্বীপের মত দেখা গেল। গাছে গাছে পুরো জায়গায়টা একদম ঢেকে আছে। উঁচু উঁচু গগন শিরীষ গাছগুলো বোঝা গেল। পুরো দ্বীপটাকে দূর থেকে ব্রকলির মত মনে হয়। প্রণব হাত ঘড়ি দেখলেন। কখন যে আধ ঘণ্টা পেরিয়ে গিয়েছে খেয়াল করেননি। বাতাস কমে এসেছে। মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। 

ধীরে ধীরে দ্বীপটা আরো কাছে আসল, আর আরো বড় মনে হল। সবগুলো গাছ যেন পানির ভয়ে এই দ্বীপটায় উঠে পড়েছে। লোকটা বৈঠা বাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে, শুধু বৈঠাটাকে হালের মত করে ধরে বসে আছে। বাতাসে ভেসে নৌকাটা দ্বীপের দিকে যাচ্ছে। 

নৌকা পাড়ে ভেড়ার সাথে সাথে নিজেকে যেন খুব বেশি ক্ষুদ্র মনে হল প্রণবের। পাড় ঘেঁষে ঘন বাঁশবন। তাছাড়া হিজল আর তমাল গাছও চোখে পড়ল। মহুয়া গাছের লম্বা লম্বা ডাল যেন কুঁজো হয়ে পানিতে হাত ভেজাচ্ছে। যতই দ্বীপের নৌকা কাছাকাছি যেতে লাগল, ততই মন কেমন করতে লাগল প্রণবের। লোকটা নৌকা ঘোরাচ্ছে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, “ঘোরাচ্ছ কেন?” 

“ওইদিকে একটা ঘাটমত আছে, ওইদিকে ভিড়াই। এদিক দিয়ে নামতে পারবেন না।” 

গুড় গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল। 

নৌকা ঘুরলে প্রণব একটা ঘাটের মত জায়গা দেখলেন। দূর থেকে কংক্রিটের মনে হলেও কাছে আসতেই বোঝা গেল, মার্বেল পাথরে বাঁধানো ঘাট! শ্যাওলা ধরে গিয়েছে বলে কংক্রিটের মনে হচ্ছে। ছলাত ছলাত করে ছোট ছোট ঢেউ আছড়ে পড়ছে ঘাটে। 

নৌকা পাড়ে ভিড়ল। 

প্রণব সাবধানে নৌকা থেকে নামলেন। তারপরেও বাম পা’টা পানিতে পড়ে ভিজে গেল। বরফের মত ঠাণ্ডা পানি। 

“সিঁড়ি ধরে চলে যান। এই সিঁড়ি সোজা গিয়ে উঠোনে ঠেকবে। মুয়াল্লেম মাথা খারাপ মানুষ। আগেই বলছি। আবারও বললাম। বেশি ঘাটায়েন না। আপনাকে মনে ধরলে সে এমনিই আপনার সাথে কথা বলবে। আর মনে না ধরলে বোম ফুটালেও কথা বলবে না। আমি বসছি। সন্ধ্যার আগে আগে ফিরবেন। আকাশের অবস্থা তো দেখতেই পারছেন।” 

শ্যাওলা মোড়া সাদাটে সবুজ সিঁড়ি চলে গিয়েছে ঢাল বেয়ে ওপরে। দু’পাশে নানান গাছপালায় ঢাকা বন। বাঁশ ঝাড়ের মাথা নুইয়ে পড়ে সিঁড়িটা অন্ধকারে ঢেকে ফেলেছে। 

সিঁড়ি ধরে ওপরে উঠতে লাগলেন প্রণব। ধীরে ধীরে নিচের ঘাট, নৌকা আর নৌকার ওই মাঝিটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল। অনেকদুর উঠে আসার পরে মনে হল, মাঝির নামটা জানা হয়নি। যদি কখনও ডাকতে হয়, কি নামে ডাকবে? 

সে পরে দেখা যাবে। আপাতত এগোন যাক। কোথা থেকে যেন কিইইচ কিইইচ করে শব্দ আসছে। লোহার সাথে লোহা ঘষার একটা তীক্ষ্ম শব্দ। 

ঝড়ো বাতাসে দুলতে থাকা গাছগুলোর ভেতর দিয়ে সিঁড়ি ভেঙে প্ৰণব একটা দোতলা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। বিরাট একটা কড়ই গাছ পুরো বাড়িটাকে যেন ড্রাগনের মত পেঁচিয়ে ধরে আছে। শ্যাওলা ধরা বাড়িটার সীমানা প্রাচীরের জায়গায় জায়গায় ধসে গিয়েছে। কিছু জায়গায় প্রাচীর পেঁচিয়ে গজিয়ে উঠেছে গোল্ডেন শাওয়ারের কমলা ফুল। মরিচা ধরা বুড়ো গেটটা হাট করে খোলা। বাতাসে একবার খুলছে একবার বন্ধ হচ্ছে। কিইইচ কিইইচ করে শব্দ হচ্ছে সেখান থেকেই। 

মরমর পাতা উড়ে যাচ্ছে বাতাসে। প্রণব সেই পাতা মাড়িয়ে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালেন। 

ঠিক তখনই তীক্ষ্ম একটা চিৎকার শোনা গেল। হেঁড়ে গলার চিৎকার। 

সঙ্গে সঙ্গে রিভলভারটা ডান হাতে নিয়ে নিলেন প্রণব। সেফটি ক্যাঁচ খুলে দু হাতে ধরে সামনের দিকে তাক করলেন। চিৎকার শোনা যাচ্ছে বাড়ির পেছন দিক থেকে। এরকম কিছু একটা হবে সেটা আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেছিলেন প্রণব। জোর পায়ে বাড়ির পেছন দিকে যাওয়া শুরু করলেন। একটা মার্বেল পাথরের ফোয়ারা। অযত্নে বেড়ে ওঠা গোলাপের ঝাড়। দেয়ালের সাথে ঠেশ দিয়ে দাঁড় করানো সাইকেল পেরিয়ে বাড়ির পেছন দিকে এসে দাঁড়ালেন প্রণব। যেকোন মুহূর্তে কিছু একটা হতে পারে। লম্বা লম্বা শ্বাস নিয়ে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলেন তিনি। 

চিৎকারের শব্দটা আস্তে আস্তে স্পষ্ট হচ্ছে। ইংরেজিতে কেউ চিৎকার করছে। কিন্তু কি বলছে বোঝা যাচ্ছে না। 

পেছনের একটা শুকিয়ে যাওয়া কাঠের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন প্রণব। রিভলভার পয়েন্ট করলেন ভেতরে। অন্ধকার। চিৎকারটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। গম গম করে বাজছে। চিৎকারটা এবার স্পষ্ট শোনা গেল। একটা পুরুষ কণ্ঠ, উচুস্বরে ইংরেজিতে কিছু একটা বলছে আর কাঁদছে। 

“When beggers die, there are no comet seen.” 

প্রণব ভেতরে ঢুকে আস্তে করে পেছনের দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। বাইরের ঝড়ো হাওয়ার শব্দটা কেমন চাপা পড়ে গেল। কিন্তু পুরুষ কণ্ঠটা থামল না। উঁচু গলায় বলল, “Ambitious should be made of sterner stuff. হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক ঠিক।” 

প্রণব দেখলেন, একজন লোক সাদা এক টুকরো কাপড় গায়ে পেঁচিয়ে মাঝারি সাইজের একটা হলরুমের এমাথা থেকে ওমাথা দৌড়ে দৌড়ে হাত পা নেড়ে চেড়ে কথাগুলো বলছে। বলার ভঙ্গি শুনে মনে হচ্ছে, যেন কোন কবিতা হবে। লোকটার মুখভর্তি দাড়ি। বাম হাতে ধরা একটা কাগজের রোল। কাগজের রোলটা আড়চোখে দেখছে আর চিৎকার করে কথাগুলো বলছে। 

প্রণব বোকার মত দাঁড়িয়ে থাকলেন। ডান হাতে ধরা রিভলভারটা ঝুলতে থাকল আলগোছে। এমন দৃশ্য তিনি আশা করেননি। ভেবেছিলেন হয়ত কোন খুন হচ্ছে। বা সেরকম কিছু। 

“কে? কে?” লোকটা চমকে জিজ্ঞাসা করল। 

প্রণব সাথে সাথে রিভলভারটা হোলস্টারে রেখে স্বভাবসুলভভঙ্গিতে বললেন, “আমি প্রণব। প্রণব হালদার। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ। সিনিয়র ফিল্ড এজেন্ট। আপনি মুনশী মোয়াল্লেম?” 

সশ্মশ্রু বৃদ্ধ হাতের রোল করা কাগজটা দেখিয়ে বলল, “না আমি জুলিয়াস সিজার। জুলিয়াস সিজারকে চেনেন? শেক্সপিয়ারের জুলিয়াস সিজার।” 

“আমি মুনশী মোয়াল্লেমের কাছে এসেছিলাম। একটা বইয়ের ব্যপারে খোঁজ করতে এসেছিলাম।”

“কী?” 

“একটা বইয়ের ব্যপারে খোঁজ করতে এসেছিলাম।” 

লোকটা হো হো করে হেসে উঠল। নাটকীয় হাসি। কৃত্রিম হাসি। হাসি থামিয়ে দাঁত কামড়ে কামড়ে বলল, “বই আজকাল কেউ পড়ে নাকি? আপনি পড়েন? কিসের বই? ব্যাঙ্ক জব প্রশ্ন ব্যাঙ্ক? স্বামী স্ত্রীর মধুর মিলন? বেহেশত পাওয়ার একশ একটা কৌশল? ১০১ টি প্রেমের এসএমএস সমগ্র? হুঁ?” 

“বইটার নাম ‘পাছাখানার ভূত’।” 

বইয়ের নামটা শোনার পরে বৃদ্ধ হঠাৎ আনমনা হয়ে গেল। কিছুক্ষণ এলোমেলোভাবে এদিক ওদিক তাকালো। বৃদ্ধকে চুপ করে থাকতে দেখে প্রণব আবার বললেন, “তাই বলছিলাম, আপনি যদি মুনশী মোয়াল্লেম হন, তাহলে আপনার সাথে একটু কথা ছিল।” 

হাতের রোল করা কাগজটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বলল লোকটা, “আমিই মুনশী মোয়াল্লেম। আসেন আমার সাথে।” 

এই বৃদ্ধই তাহলে মুনশী মোয়াল্লেম। 

মুনশী পাশের একটা দরজা খুলে ভেতরে গেলেন। প্রণব অনুসরণ করলেন। দরজা খুলতেই একটা সিঁড়ি। অনেক পুরনো সিঁড়ি। এতক্ষণে উত্তেজনায় খেয়াল করেননি প্রণব। এখন খেয়াল করলেন, সিলিং-এ কড়ি বর্গা। কাঠের হাতল, কাঠের সিঁড়ি। দেয়ালে কোন চারপেয়ে প্রাণীর কঙ্কাল। হয়ত মহিষের। সবগুলো জানালা দরজা আটকানো। স্যাঁতস্যাঁতে একটা গন্ধ। যেন পুরনো কোন বইয়ের দোকানে ঢুকেছেন। 

সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতেই মোয়াল্লেম একটা ঘরের দরজার দিকে ইশারা করে বললেন, “বসেন ওই ঘরে গিয়ে।” 

“হাতে সময় কম। আকাশের অবস্থা ভালো না। ঝড় আসছে। আমি একটু কথা বলেই চলে যাব।” 

“তো আপনি এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলবেন? আমি কি বলেছি কথা বলব না?” 

মুনশীর বাঁকা কথায় একটু দমে গেলেন প্রণব। এগিয়ে গেলেন ঘরটার দিকে। আদ্যিকালের রঙিন কাঁচ লাগানো দরজা। ধূলায় ঢেকে ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই প্রণব যা দেখলেন, তা বিস্ময়কর। মেঝে থেকে সিলিং পর্যন্ত শুধু বই আর বই। ধূলায় মোড়া বইগুলো যেন ছোট ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ঘুমাচ্ছে। ওপরের ঘুলঘুলি দিয়ে একটু আলো আসছে। আলো-আঁধারীর ভেতরে হঠাৎ কোথা থেকে যেন ঘুঘুর ডাক শুনলেন। মেঝেতে পড়ে থাকা বইগুলো বাঁচিয়ে সামনে যেতেই কয়েকটা হাঁচি দিলেন তিনি। তারপর আবার ঘুঘুর ডাক। ডাকটা ঘরের মধ্যে থেকেই আসছে। একটু এগিয়ে যেতেই বইয়ের ভাঁজে বিশাল একটা গম্বুজ খাঁচা দেখতে পেলেন। খাঁচায় আটকানো একটা ধূসর রঙের পেঁচা। ঢুলু ঢুলু চোখে প্রণবের দিকে তাকাচ্ছে। 

“ওর নাম মিনার্ভা।” 

প্রণব ঘাড় ঘুরিয়ে দরজার দিকে তাকালেন। মোয়াল্লেমের হাতে ধরা দুইটা গ্লাস। গ্লাস নিয়ে ঘরের ভেতরে এসে কোথা থেকে একটা চেয়ার বের করলেন। এক কোণায় একটা জানালা খুলে দিলেন। দমকা বাতাস ঘরে ঢুকল। বৃষ্টি হচ্ছে ঝম ঝম করে। প্রণব শুনতে পেলেন, কোথা থেকে যেন গ্রামোফোনে গান হচ্ছে। বেগম আখতারের ‘আবকে সাভান ঘার আজা’। 

“কী হল? বসেন। গান তো? আমার বাবার গান শোনার শখ ছিল। উনারই গ্রামোফোনে গান হচ্ছে।” মাথা নেড়ে বললেন মোয়াল্লেম। একটা বইয়ের স্তুপের ওপরে বসতে বসতে বললেন, “এখন বলেন বইটার নাম কোথা থেকে শুনলেন?” 

পুরনো কাঠের চেয়ারটাতে বসতে বসতে প্রণব বললেন, “কোথায় শুনেছি সেটা বড় কথা না, এই মুহূর্তে বইটা কোথায় পাওয়া যাবে সেটাই বড় ব্যাপার।” 

“আমি যখন প্রশ্নটা করেছি তখন সেটা অবশ্যই অনেক বড় ব্যাপার। আর আপনিও উত্তরটা দিতে বাধ্য।” 

প্রণব হকচকিয়ে গেলেন। কথার খেই হারিয়ে ফেললেন। এমনটা আশা করেননি। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের লোক শুনে বুড়ো থেকে ছোড়া সবাই গড়গড় করে কথা বলতে শুরু করেছে। সামনে বসা এই বুড়োটার মত কেউ কৈফিয়ত চায়নি। 

“কী হল? আপনার হাতে সময় কম। তাই তাড়াতাড়ি করলে আপনারই মঙ্গল।” 

“বেশ কয়েকটা খুন হয়েছে ঢাকায়। কয়েকজন প্রকাশক, লেখক আর সিনেমার পরিচালক খুন হয়েছেন। সেই খুনের সাথে এই বইটার সম্পর্ক আছে বলে মনে করা হচ্ছে। মানে, যে এই বইয়ের লেখক, তাকেই আমরা সন্দেহ করছি। অবশ্য, অবশ্য সুকান্ত নামে একজনকে সন্দেহ করা হচ্ছে যদি সেটা…” 

“কে সুকান্ত?” 

“প্রেসে কাজ করে।”

মোয়াল্লেম আবার সেই নাটকীয় হাসি দিলেন। হো হো করে হাসি। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, “এই বইয়ের লেখক কে জানেন?”

প্রণব বলল, “সেটা জানতেই এসেছি। আপনি চেনেন তাকে? “ মোয়াল্লেম হঠাৎ কেমন যেন হয়ে গেলেন। খোলা জানালা দিয়ে দূরের হাওড় দেখা যাচ্ছে। সবুজ গাছপালাগুলো পাগলের মত দুলছে আর ভিজছে। সেদিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “সে পিশাচ। সে মানুষ না। সে একাই একটা সৈন্যদল। সে একাই একশটা মস্তিষ্কের হিসাব করতে পারে এক মুহূর্তে।” 

প্রণব শরবতের গ্লাস নিতে নিতে বললেন, “নাম কি উনার?” 

মোয়াল্লেম নিরুত্তর। কাঁপা কাঁপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন বাইরে। দূরে, অনেক দূরে। হাতের গ্লাসের দিকে তাকিয়ে প্রণব ভাবলেন, শরবত খাওয়া উচিৎ কি উচিৎ না। কিন্তু শরবতের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ কিছু ব্যাপার চলছে এখানে। মূর্তির মত মোয়াল্লেম বসে আছে। হঠাৎ করেই লোকটার চোখে পানি টলমল করতে দেখলেন তিনি, বললেন, “মোয়াল্লেম সাহেব?” 

মোয়াল্লেম অমনি লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন। চোখ পাকিয়ে প্রণবের দিকে তাকিয়ে বললেন, “বলেন তো একজন লেখক কেন লেখে? হ্যাঁ? কেন লেখে? বলেন?” 

প্রণব কিছুক্ষণের জন্য চমকে উঠলেও নিজেকে সামলে নিলেন। কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন, “লেখার জন্য লেখে। অনেকে, অনেকে লেখে, মানে অনেক কারণ আছে। আমি লেখক না, জানি না।” 

মোয়াল্লেম জানালার পুরনো গরাদগুলো ধরে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “তলস্তয় কেন লিখেছিল জানেন? তার ধারণা ছিল, এই পৃথিবীতে তার মতই আরো একজন তলস্তয় আছে, যে তার লেখা পড়ে তার সাথে একদিন দেখা করতে আসবে। লেখকরা কত খেয়ালেই যে লেখে, কি আর বলব।” হঠাৎ চিৎকার করে মোয়াল্লেম বলল, “কিন্তু, কিন্তু ছাপাখানার ভূতের যে লেখক, সে বইটা লিখেছিল রাগ থেকে, হতাশা থেকে। যন্ত্রণা থেকে, ক্ষোভ থেকে। লোকটার ভেতরের যন্ত্রণাটা যদি কেউ দেখতে পারত, তাহল বুঝত, এক একজন লেখক কি যন্ত্রণা বয়ে নিয়ে বেড়ায় আজীবন। এক একটা শব্দ এক এক ফোঁটা রক্তের মত। আপনি কখনও দেখেছেন কোন লেখককে? আমি দেখেছি।”

“আপনি কিভাবে চেনেন লেখককে?” 

“আরে আমি আর ও একসাথে ফাইট করেছি সেভেনটি ওয়ানে! পাশাপাশি দাঁড়িয়ে পাকিস্তানি জানোয়ার মেরেছি। গ্রেনেড ছুঁড়েছি। হাতের তালু ঘেমে গিয়েছে, ওর লুঙ্গিতে হাত মুছেছি। এক প্লেটে পোকা পড়া ছাতা পড়া বুটের ডাল খেয়েছি আর ওকে চিনব না! তখনকার ইত্তেফাকে লেখা পাঠাত, বুঝলেন? কয়েকটা ছাপাও হয়েছিল। সাহিত্যের প্রতি ছেলেটার ভীষণ টান ছিল। আলাদা একটা ভালোবাসা ছিল। কলেজ পেরিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলায় ভর্তি হবে বলেছিল। আমার কাছে কতো গল্প করত- এই করবে ওই করবে। একটা মেয়েকেও মনে ধরেছিল ওর, ফরেনার। খ্রিস্টান মিশনারী চার্চে নার্সের চাকরি করত। বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠে একটা চাকরি জুটিয়ে নেওয়ার ধান্দায় ছিল। চাকরি জুটিয়ে মেয়েটাকে বিয়ে করবে। তারপর অনার্স পাশ করে গ্রামে ফিরে যাবে। তারপর সারাজীবন লেখালেখি করবে। ফ্রেঞ্চ শিখছিল একা একা! তলস্তয় অনুবাদ করবে। অস্থির সময় লেখকের জন্ম দেয় বুঝলেন। সেভেনটি ওয়ানের সেই অস্থির সময়টায় জন্ম নিল ওর ভেতরের লেখক সত্ত্বা। শরবতটা ধরে বসে আছেন কেন? খান? যাই হোক, সময়টা খুব অস্থির ছিল জানেনই তো। শেখ সাহেব স্ট্রাইক ডেকে দিয়েছেন। সবার মধ্যেই একটা স্বাধীন স্বাধীন ভাব। বিহারীরা ইট্টু ইট্টু করে দেশ ছাড়ছে। থমথমে একটা ভাব। কোন কিছুর জন্মের সময়টাই অস্থির। সে মানুষের জন্ম বলেন আর দেশের জন্ম। একটা নতুন দেশ জন্ম নিচ্ছে, একটা নতুন লেখক জন্ম নিচ্ছে, তো সময়টা অস্থির হবে না? এর মধ্যে ওর সেই প্রেমিকা, মানে ফরেনার মেয়েটা এসে বলল, তাকে দেশে ফিরতে হবে। ওর বাবার অসুখ। কিন্তু ও যে মেয়েটাকে ভালোবাসে, সেটা মেয়েটা জানত না। ও সেদিনই বলল ওর মনের কথা। বলল, গেলে যাক, কিন্তু ফিরে যেন আসে আবার। ও অপেক্ষা করবে। 

“ও টা কে? ওই লেখকের নাম কী?” 

“লেখকের নাম? আরে লেখকের আবার আলাদা নাম কি হ্যাঁ? লেখকের নাম লেখকই। লেখকদের কোন আইডেনটিটি থাকে না হে। লেখক ইজ আ কমন নাউন। যে লেখক নিজের নাম নিয়ে, নিজের আইডেন্টিটি আঁকড়ে পড়ে থাকে সে আবার লেখক নাকি?” 

খুব ক্ষেপে গিয়ে কথাটা বললেন মোয়াল্লেম। কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ল আশেপাশে কোথাও। মোয়াল্লেম আবার শুরু করলেন। প্রণব আর ঘাটালেন না। কথা বলে যাচ্ছে যাক, পরে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করা যাবে। 

“ফরেনার মেয়েটা বলল যে সে দু’মাসের মধ্যে ফিরে আসবে। তা কবে ফ্লাইট? তিনদিন পরে। যেদিন কথা হল, ঠিক তার পরদিন রাত্রে শুরু হল অপারেশন সার্চলাইট। কী বীভৎস! বীভৎস সে নির্মমতা। আমি নিজে দেখেছি। কী দেখেছি জানেন? রোকেয়া হলের সামনে ট্রাক দাঁড়িয়েছিল। সেই ট্রাকের চাকায় লেগে থাকা নাড়ি ভুঁড়ি। আহ। তো আমি আর ও আমার মেসে উঠেছি। চানখাঁরপুলের ওদিকে…

প্রণব একবার ঘড়ি দেখে নিলেন। বিকাল পাঁচটা। সন্ধ্যা নামল বলে। তাড়াতাড়ি বের হতে হবে। এই পাগলের প্রলাপ কখন শেষ হবে বোঝা যাচ্ছে না। 

…কোনরকমে পালিয়ে কুষ্টিয়া গেলাম। সেখানে ইয়াকুব ভাই থাকত। ইয়াকুব ভাই আমাদেরকে মেহেরপুরের ফতেহপুর দিয়ে বর্ডার পার করিয়ে দিলেন। তখনও ও লিখেছে। রাস্তায় কোথাও থামলে লিখেছে। বাসের ছাদে বসেছি, তখন লিখেছে। পাতার পর পাতা। পাতার পর পাতা। ভারতে গিয়ে রক্তিমদার হাত ধরে কৃষ্ণনগর চলে গেলাম ট্রেনিং নিতে। গেরিলা ট্রেনিং। তখনও ও লিখেছে। কৃষ্ণনগরেই শৌভিক গোমেজ নামে এক ছেলের সাথে পরিচয় হয়। সে খ্রিস্টান মিশনারীতে কাজ করত। ওকে সেই ফরেনারের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ও জানাল, সেই মেয়েকে হানাদারেরা ধরে নিয়ে গিয়েছে। বেঁচে আছে না মারা গিয়েছে কেউ জানে না। শৌভিকও না। ও সেটাও লিখল। কাঁদতে কাঁদতে লিখল। দাঁতে দাঁত চেপে ছেলেটার বোবা কান্না। এখনও আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। তারপর আমি, ও আর শৌভিক মিলে সাতক্ষীরায় একটা রেজিমেন্টে যোগদান করলাম। হাতে অস্ত্র। পেটে ক্ষিদা, মনে আগুন। আর ওর হাতে কলম। সেই যে কলম ধরেছে আর ছাড়েনি। দেখা গেল ফ্রন্টে বসেছি, সন্ধ্যার দিকে প্রচুর গোলাগুলি হয়েছে। সন্ধ্যায় বৃষ্টি নামায় সব বন্ধ। মাঝখানে নদী। এপারে আমরা, ওপাশে ওরা। দুজনেই জানি দুজনে আছি, কিন্তু কেউ কিছু বলছি না, ও তার মধ্যেও লিখেছে। অন্ধকারে লিখেছে। শৌভিক মারা গেল বরিশালের একটা অপারেশনে। অনেকে অবশ্য বলেছে শৌভিক সুইসাইড করেছিল আতঙ্কে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি না। ও সেটাও লিখেছে।” 

“তারপর?” 

“তারপর, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে, কত কিছু দেখেছি সেই অস্থির সময়ে, ও সব লিখেছে। সব। তারপর আস্তে আস্তে যুদ্ধ শেষ হল। যে যার ঘরে ফিরে গেল। স্বাধীনতা ছাড়া কেউ কিচ্ছু নিয়ে যেতে পারেনি, শুধু ও নিয়ে গেল কয়েক দিস্তা কাগজ। সেগুলো সে ছাপাবে, এই উদ্দেশ্য। কয়েক মাস ঢাকার আর্মানিটোলায় থাকা আমার এক বন্ধু খবর দিল, সেই ফরেনার মেয়েটাকে নাকি ও খুঁজে পেয়েছে চট্টগ্রামে কোন ক্যাম্পে। ভীষণ অসুস্থ। আমরা দুইজন গেলাম। মেয়েটা মরে বেঁচে আছে। খুবলে খেয়েছে শকুনে। শেষে ও পালিয়ে গিয়ে কোন এক মহিলা এতিমখানায় আশ্রয় নিয়েছিল। ওকে দেখেই মেয়েটা বলল, বাড়ি যাব। ওকে জড়িয়ে ধরে মেয়েটার সে কি কান্না। আমি ততক্ষণে টাকা জোগাড় করতে শুরু করেছি। পুরনো অনেক বই ছিল, সেগুলো বেঁচে দেব ঠিক করেছি। আর ও ওর সেই পাণ্ডুলিপিটা নিয়ে প্রকাশকের দরজায় দরজায় দৌড়াদৌড়ি করছে। ও কিছু চায় না, শুধু এই কটা কাগজের বিনিময়ে হলেও ওকে যদি কোন প্রকাশক যদি দুটো পয়সা দেয়, তাহলে মেয়েটাকে দেশে ফেরানোর বন্দোবস্ত করানো যেতে পারে। তখন কোন এক প্রকাশক, নাম মনে নেই, ওকে পঞ্চাশ টাকা দিয়ে বলল, ছাপানো হোক, বাকিটা পরে দেবে। ও তাতেই খুশি। ওদিকে মেয়েটা ধুকছে। এতদিনে ওর অসুস্থ বাপটা বেঁচে আছে কিনা তাও জানে না। রেডক্রস থেকেও কোন খবর আসছে না। আমি এর ওর কাছ থেকে ধার করলাম। তারপরেও প্লেনের টিকিটের টাকার মত অত টাকা হয় না। একমাসের মাথায় বই বের হল ওর। বইটা খুব বিক্রি হল। খুব। ওই সময়ে বই পড়ার মত মনমানসিকতা কারো নেই, তারপরও বিক্রি হল। কিন্তু প্রকাশক টাকাপয়সা আর দিল না। বিদেশে না কোথায় গিয়ে বসে থাকল। ওর বই কলকাতার বইমেলাতেও দারুন বিক্রি হল। কিন্তু প্লেনের টিকিটের টাকার অভাবে মেয়েটাকে আমরা আর বাড়ি ফেরত পাঠাতে পারলাম না, মেয়েটা মারা গেল। ও সেটাও লিখল। লিখে হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে কর্ণফুলির জলে ভাসিয়ে দিল। আমাকে কতদিন বলেছে জানেন? বলেছে, যুদ্ধ একদিন শেষ হবে, এই অসুস্থ প্রতিযোগীতা একদিন শেষ হবে, আর সেদিন আমি আমার লেখালেখির কাছে ফিরে যাব। ওই যে ফরেনার মেয়েটা ছিল না, ওকে নিয়ে নিয়ে অনেক দূরে চলে যাব। এই জাতীয়দাবাদের উর্ধ্বে, এই ধর্মের নাগালের বাইরে, মানুষের অশ্রু থেকে বহুদুরে। একদিন আসবে, আমাকে আমার লেখালেখি থেকে কেউ আলাদা করতে পারবে না। একটা শিশির মোড়া শান্ত কুয়াশার সকাল শুরু হবে লেখালেখি দিয়ে। এইসব বলতে বলতেই ছেলেটা কোথায় যে হারিয়ে গেল। আপনি ছেলেটাকে দেখেননি, দেখলে জানতেন, কি অসীম অভিমান নিয়ে ছেলেটাকে হারিয়ে যেতে হয়েছে। আমি ততদিনে কাঁটাবনের ওইদিকে ছোট খাট একটা বইয়ের দোকান খুলেছি। মেয়েটা মারা যাওয়ার পর থেকে ওর সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকল। ও অবশ্য মেয়েটাকে নিয়ে পরে অনেক লিখেছিল। অনেক। মেয়েটার দেশ ছিল ইটালি। সেখানে যোগাযোগ করার ইচ্ছা ছিল ওর। কিন্তু তখন তার নিজের পেটেই ভাত জুটছে না। ইচ্ছা ছিল মেয়েটাকে নিয়ে আর একটা বই বের করবে। কিন্তু লেখাটা এক সিনেমার ডিরেক্টর হাতে পেয়ে বললেন তিনি এটা নিয়ে সিনেমা বানাতে ইচ্ছুক। বুঝলেন? বই না কিন্তু, সিনেমা। সিনেমা বানানো হল। সেই সিনেমাতে চিত্রনাট্য লিখে কে একজন পুরস্কারও পেল, কিন্তু ও কিছুই পেল না। একেবারে কিচ্ছু না। নিজের সৃষ্টিকে এভাবে অন্যের হাত ধরে চলে যেতে দেখে রাগে দুঃখে ক্ষোভে হতাশায় অন্ধ হয়ে গেল ও। ওর সারা জীবনের কিছু ভগ্নাংশ দিয়ে কতজন উপরে উঠে গেল, আর ও পড়ে থাকল সেই অন্ধকারে। তাই ঠিক করল নিজের উদ্যোগেই বই বের করবে। বেনামে একটা বই বের করল। 

“কী বই?” 

“পাছাখানার ভূত। এই বইটাই ছিল তার প্রতিশোধ। যন্ত্রণা লাঘবের একমাত্র উপায়। নিজের মনের জমে থাকা কষ্ট আর ক্ষোভ দিয়ে সে এই বইটা লিখে ফেলল। বইয়ের পাতায় পাতায় ছিল খুন, বীভৎসতা আর প্রিয়জন হারানোর কষ্ট।” 

কড় কড় করে বাজ পড়ল। কেঁপে উঠলেন প্রণব। ঝড় বাড়ছে। আলো কমে আসছে। এই ঝড় আরো বাড়বে। তিনি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, “বইটা আছে আপনার কাছে? থাকলে দেন। হাতে সময় একেবারেই নেই। আর পরবর্তীতে যদি আবার কোন এনকুয়েরির প্রয়োজন হয়, আপনাকে হয়ত থানায় যেতে হতে পারে। তাই পুলিশের অনুমতি ছাড়া আপনি কোথাও যাবেন না। বইটা দেন।” 

মোয়াল্লেম হঠাৎ ক্ষেপে উঠল, লাফ দিয়ে একটা বইয়ের স্তূপের ওপরে লাফ দিয়ে উঠে বলল, “মুনশী ইজ আ স্লেভ অফ নান বাট অনলি টু হিমসেলফ। আমি কোথায় যাব না যাব সেটা বলবে মুনশী, সমাজের কথা মত আমাকে কেউ চালাতে পারেনি, পারবেও না। কোন শুমুন্দির সাহস…” 

চুপ করে গেলেন মোয়াল্লেম। হঠাৎ কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন কি যেন। কান পেতে শোনার চেষ্টা করলেন প্রণবও। ঝড়ো বাতাস ছাপিয়ে কে যেন চিৎকার করছে। কাউকে যেন ডাকছে। প্রণব জানালার দিকে এগিয়ে যেতেই মোয়াল্লেম বাঁধা দিলেন; বললেন, “খবরদার, জানালার বাইরে দেখবেন না। একদম না। এইখানে অনেক কানাভুলো আছে। কানাভুলো চেনেন? সাহায্যের জন্য চিৎকার করে এরা। তারপর কাছে গেলে পানিতে চুবিয়ে মারে। আপনি কখনও দেখেছেন কানাভুলো?” 

প্রণব অবাক হয়ে এই উন্মাদ পাগলাটে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। 

**** 

শশী মাঝির ভেতরটা খুব আনচান করছে। এইরকম ঝড় আর এইরকম বৃষ্টি সে বহুদিন দেখেনি। ঘাটের কাছে সে আর বসে থাকতে পারছে না। বাঁধা নৌকাটা শোলার নৌকার মত দুলছে। ওদিকে আশেপাশের বাঁশের ঝাড় থেকে মিট মিট করে আলো জ্বলতে দেখেছে একটু আগে। আলোগুলো আস্তে আস্তে কাছে আসছে। এটা খুব ভালো লক্ষণ না। এটা এই হাওড়ের অভিশাপের লক্ষণ। 

সে সাহেব সাহেব বলে বেশ কয়েকবার চিৎকার করেছে। ভদ্রলোকের নামটাও জানে না। কাজেই নাম ধরেও ডাকতে পারছে না। বিপদ। খুব বড় বিপদ সাহেবের। সাথে তারও। 

আজ সন্ধ্যা নেমেছে যেন এক অভিশাপকে সাথে নিয়ে। 

“সাহেব, ও সাহেব, তাড়াতাড়ি চলে আসেন।” আরেক দফা চিৎকার করল শশী। যদিও সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, এই উত্তাল হাওড়ে এই মুহূর্তে নৌকা নিয়ে নামা অসম্ভব।” 

তারা বন্দী। 

***

“আমি রিভলভার বের করতে বাধ্য হব। বলেন বইটা কোথায় আছে?” প্রণব বললেন। 

মোয়াল্লেম বললেন, “বলব না বললাম তো। বইটা অনেক আগেই মরে গিয়েছে। তাই বইটা খুঁজে লাভ নাই। বইয়েরা মারা গেলে তাদের খোঁজ কেউ করে না।” 

“পাগলামি করার সময় নেই,” বাধ্য হয়ে রিভলভারটা বের করে বললেন প্রণব, “আমি এক থেকে তিন পর্যন্ত গুনব। এর মধ্যে আমাকে বলতে হবে বইটা কোথায় আছে।” 

এক 

দুই 

হঠাৎ জানালার বাইরে, নিচের হিজল গাছের অন্ধকারে কি যেন চকমক করে উঠল। প্রণব খেয়াল করলেন না, কিন্তু মোয়াল্লেমের চোখে এড়াল না। মুচকি হেসে বললেন, “ও বই আপনি এখান থেকে নিয়ে যেতে পারবে না। ওটা অভিশপ্ত বই। ও বইয়েই আমাকে খেয়েছে। আপনাকেও খাবে। তাও যদি নিতে চান, এই বাড়ির দক্ষিণে ত্রিশ গজ পরে একটা বাঁশ বাগান আছে। ওখানে আমাদের পারিবারিক গোরস্থান। ওখানেই এই বইয়ের লাশটা আছে।” 

প্রণব বাইরে তাকালেন। অন্ধকার নেমে গিয়েছে। সাথে ঝড়ো হাওয়া।

কিন্তু কিছু করার নেই। 

প্রণব তার বিশাল শরীরটা নিয়ে অন্ধকারে নেমে এলেন। বেগম আখতারের গজল শোনা যাচ্ছে এখনও। একটা বেলচা হলে ভালো হত বা মাটি খোড়ার মত কিছু। খুব দ্রুত সিলেটের ওসি সাহেবকে ফোন করতে হবে। কিন্তু এই ঝড় বাদলের মধ্যে নেটওয়ার্ক পাওয়া গেল না। বাধ্য হয়ে মোবাইলের আলো জ্বালিয়েই খুঁজতে শুরু করলেন। একটা বেলচা, অথবা খন্তা। যা কিছু পাওয়া যায়। 

বেলচা পাওয়া গেল। নিচের তলায়। সিঁড়ির নিচে। 

ছপ ছপ করে কাদার ভেতরে পা ফেলে ছুটলেন প্রণব। আর তখনই দেখতে পেলেন বাড়ির চারপাশে ঝিলমিল করে আলো জ্বলছে জোনাকীর মত। কিন্তু আলোগুলো আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে। অতকিছু দেখার সময় নেই। মাঝিটা কোথায় গেল? ওকে ডাকতে হবে। 

দক্ষিণ দিক কোনটা? উদ্ভ্রান্তের মত আকাশের দিকে তাকালেন প্রণব। হঠাৎ দুপুরের কথা মনে পড়ল তার। 

ঘন বাঁশবন। ঘন, আরো ঘন। আর পিছলা মাটি। মুঠোফোনের আলোও যেন এক অন্যরকম অন্ধকার। কোথায় যাচ্ছেন জানেন না। কিন্তু মৃত্যু জানে, প্রণব তার দিকেই এগিয়ে আসছেন। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *