মৃত লেখকের অভিশাপ
“যথারীতি পৃষ্ঠা উল্টালেন ভদ্রলোক। বললেন, “লেখকদেরকে সকল আসক্তির উর্ধ্বে থাকতে হবে। কোনভাবেই কোন রকমের আসক্তিতে জড়ানো যাবে না। কারণ, যেকোন ধরনের আসক্তি দৃষ্টিভঙ্গিকে মেঘাচ্ছন্ন করে দিতে পারে। অনেকেই বলে, একজন ধূমপায়ীর বেদনা বুঝতে গেলে, ধূমপান করতে হবে, এটা ঠিক না। ধূমপান করে ধূমপায়ীর কষ্ট হয়ত অনুধাবন করা যাবে, কিন্তু অধূমপায়ীর সুখ সম্পর্কে ততই কম জানা যাবে। লেখকরা কোন মাদক নয়, বরং সাধারণ মানুষদেরকে সেবন করবে। তাদের অভিজ্ঞতা সেবন করবে। তাদের সুখ দুঃখকে দেখবে পাখির চোখে।”
***
একটু পরেই কেবিনেটের মিটিং। তার অধীনে যেকজন এজেন্ট শিক্ষানবিসের কাজ করছে তারা থাকবে, সিনিয়র ফিল্ড এজেন্ট প্রণব থাকবেন আর থাকবেন জয়েনুদ্দীন। একটু পরে বলতে আধ ঘণ্টা পরে। লাঞ্চটাইম মাত্র শেষ হয়েছে। রোজকার মত আমানুল্লাহ ক্লান্তিমাখা ঠোঁটে কফির মগ ছুইয়েছেন দুই মিনিটও হয়নি। এরই মধ্যে ইন্টারকম বেজে উঠল।
আমানুল্লাহ রিসিভার তুলতেই ওপাশে অফিস সহকারী জয়নালের কণ্ঠ শোনা গেল।
“জয়নাল? বল।”
“স্যার, সৌমেন স্যার আপনাকে একটু ডেকে পাঠিয়েছেন।”
সৌমেন ঘোষ। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের নির্বাহী কর্মকর্তা, চীফ। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের যতগুলো শাখা আছে- সব তিনিই পর্যবেক্ষণ করেন। রাশভারি লোক। স্বল্পভাষী। লম্বা একটা সময় পুলিশ ট্রেনিং ইউনিটের সাথে যুক্ত ছিলেন। তার অধীনে ট্রেনিং নেওয়া এক জওয়ান হঠাৎ করেই একবার আত্মহত্যা করার ফলে তাকে ট্রেনিং ইউনিট থেকে ডিসচার্জ করে ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চে শিফট করা হয়। কাউকে দ্বিতীয় সুযোগ দেন না এই ভদ্রলোক; কখনও দেননি। সাধারণত নিজের সাব-অরডিনেটদেরকে চিঠি দিয়ে ওয়ার্ক অফ অর্ডার পালন করে থাকেন। কিন্তু কাউকে যদি সরাসরি দেখা করতে বলেন, এর মানে, হয় সেই মানুষটার জন্য অসম্ভব ভালো কোন খবর আছে, অথবা অসম্ভব কোন খারাপ খবর।
“কখন দেখা করতে বলেছেন?” আমানুল্লাহ যতটা পারা যায় শান্ত গলায় বললেন।
“আধ ঘণ্টার মধ্যে স্যার। উনি উনার কেবিনেই আছেন।” জয়নাল বলল।
আধ ঘণ্টা পরে কেবিনেটের মিটিং। গত কয়েকদিন যে চার পাঁচটা খুন হয়েছে সেগুলোর সুরাহা করতে হবে। মিটিং-এ সেই বিষয়েই কথা হবে। এখন এই মুহূর্তে কিভাবে সৌমেন ঘোষের সাথে দেখা করবেন তিনি? মেজাজটা টকে গেল। একেবারে ওপরের চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলো কি সব সময়ই এইরকম হয়?
কফির কাপ থাকল পড়ে। আমানুল্লাহ ছুটলেন সৌমেন ঘোষের কেবিনের দিকে। না জানি কি বলেন ভদ্রলোক। নিজের কাজে তো কোন ত্রুটি রাখেননি তিনি। যতটা পেরেছেন হোমিসাইড ডিপার্টেমেন্টটা সুন্দর করে গুছিয়ে চালানোর চেষ্টা করছেন। তাহলে কি কোন সুসংবাদ? ভেতরে ফুটতে থাকা এক গাদা প্রশ্নের বুদবুদি নিয়ে লিফটের ছয় নাম্বার বাটনটা চাপলেন তিনি।
চাপা শব্দে লিফট ওপরে ওঠা শুরু করল।
সৌমেন ঘোষের কেবিন ছয় তলায়। দক্ষিণ দিকে। কাঁচ দিয়ে ঘেরা। দরজার পাশেই নীল হায়াসিন্থ ফুলের গাছ লাগানো আছে টবে। সৌমেন ঘোষের অফিস সহকারী আমানুল্লাহকে দেখেই বলল, “ভেতরে যান। স্যার আছেন।”
আমানুল্লাহ মাথা নেড়ে সৌজন্যসূচক একটা হাসি দেওয়ার চেষ্টা করলেন। যান্ত্রিক হাসি বলে মনে হল। তিনি দরজায় নক করতেই ভেতর থেকে শোনা গেল, “হুঁ, খোলা।” আমানুল্লাহ ভেতরে ঢুকলেন। সৌমেন ঘোষ একটা ফাইল পড়ছিলেন। “ভালো আছেন আমানুল্লাহ সাহেব?” ফাইলটা টেবিলের ওপরে আলগোছে রাখতে রাখতে বললেন সৌমেন, “বসুন।”
আমানুল্লাহ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললেন, “জি, ভালো আছি। আপনার কি অবস্থা স্যার?”
সৌমেন ঘোষ চেয়ারটা আরেকটু সামনে টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললনে, “আছি ভালো।” তারপর আর কোন সৌজন্য নেই। সরাসরি বললেন, “আপনার আগে হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টটা কার অধীনে ছিল জানেন তো?”
“জানি স্যার। তৌফিক এলাহীর অধীনে।”
“তৌফিক এলাহীর সময় কোন কেসের ফাইল এক সপ্তাহের বেশি টেবিলে পড়ে থাকেনি এটা জানেন?”
“জানি স্যার।”
“তিন তিনটা গুরুত্বপূর্ণ মানুষ খুন হয়ে গেল অথচ আপনি একটা প্রাইমারি স্টেপও নিতে পারছেন না কেন জানতে পারি? তৌফিক এলাহী সাহেব টরেন্টোতে ট্রেনিং-এর জন্য না গেলে আপনাকে এই দায়িত্বটা দেওয়া হত না হয়ত। সত্যি বলতে একরকম বাধ্য হয়েই আপনাকে দায়িত্বটা দেওয়া। কিন্তু আপনি দায়িত্বের চার আনাও পালন করতে পারছেন না আমানুল্লাহ সাহেব। না কোন এরেস্ট। না কোন চার্জ শীট। কি হচ্ছে এগুলো?”
“আজ কেবিনেটের মিটিং-এ আমি সবাইকে নিয়ে তদন্ত শুরু করব স্যার। অযথা নিরপধরাধ লোকদেরকে গ্রেপ্তার করে হয়রানি করে তো কোন লাভ হবে না স্যার। যদিও আমি কয়েকজন সাক্ষীকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্যও পেয়েছি। মোটামুটি শিওর হয়েই আমি এগোতে চাচ্ছি, স্যার।”
“এতদিনেও তদন্ত শুরু করেননি কেন জানতে পারি?”
“আমি ভেবেছিলাম এগুলো বিচ্ছিন্ন খুন। কিন্তু সবগুলো খুন একটা আরেকটার সাথে যুক্ত হবে মনে হচ্ছে।”
“মনে হচ্ছে? মনে হচ্ছে কেন?”
“কারণ ভিক্টিমদের সবাই কোন না কোনভাবে লেখালেখির সাথে যুক্ত। ইভেন সৈকত সারওয়ার, ওই যে ফিল্ম ডিরেক্টর ভদ্রলোক, উনিও আগে লেখালেখিই করতেন। পরে চিত্রনাট্য লেখা শুরু করেন, তারপরে ডিরেক্টর। ইমন মোস্তাফিজ, যিনি আত্মহত্যা করেছেন, তিনিও লেখক। আমার মনে হচ্ছে খুনি একজন না স্যার।”
“খুনি যদি কয়েকজনই হয় তাহলে তাদের যেকোন একজনকে ট্রেস করতে এত সময় লাগছে কেন?”
“কারণ প্রতিটা খুন খুব পার্ফেক্টলি করা হয়েছে, স্যার। প্রমাণ আমরা পেয়েছি তা না। কিন্তু যা পেয়েছি তা দিয়ে খুব বেশি এগোন যাচ্ছে না। তাছাড়া…”
জয়েনুদ্দীনের ব্যপারে বলতে যাচ্ছিলেন আমানুল্লাহ। কিন্তু থেমে গেলেন। এমনিতেই তার কাজের ব্যপারে প্রশ্ন উঠেছে, এখন সৌমেন ঘোষ যদি শোনেন যে ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের বাইরের কাউকে দিয়ে তিনি তদন্তে নেমেছেন, তাহলে তার জন্য নির্ঘাত একটা না একটা শাস্তি পেতে হবে।
“তাছাড়া?”
“না বলছিলাম যে, তাছাড়া উপযুক্ত লোকজনেরও অভাব স্যার। এই জন্য সময় লাগছে। তবে আপনি চোখ বন্ধ করে আমার ওপরে আস্থা রাখতে পারেন।”
সৌমেন ঘোষ তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে আমানুল্লাহর দিকে তাকালেন। যেন বোঝার চেষ্টা করছেন আসলেই এই মানুষটাকে বিশ্বাস করা যায় কিনা।
রুমে শুধু এসি চলার চাপা ঘর ঘর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। আমানুল্লাহ টেবিলের ম্যাটের দিকে তাকিয়ে আছেন, আর সৌমেন তাকিয়ে আছেন আমানুল্লাহর দিকে।
“ঠিক আছে। আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে আমি এই খুনগুলোর সুরাহা দেখতে চাই। না হলে আরো অনেক লোক আছে, তাদের হাতে কেসগুলো হ্যান্ডওভার করব আর আপনার বিশ্রামের ব্যবস্থা করব। এমনিতেও, আপনার ভেতরে পরনির্ভরশীলতা বেশি। পরনির্ভরশীলদের ওপর বেশি কিছু আশা করা যায় না। খেয়ালীপনা বাদ দিয়ে একটু প্র্যাকটিক্যাল হলে আমার মনে হয় ভালো কিছু করতে পারবেন। আসতে পারেন এখন।” টেবিলের ওপরকার ফাইলটা তুলে নিতে নিতে বললেন সৌমেন ঘোষ। প্রতিটা কথা শুকনো কাঠে কুঠারের আঘাতের মত শোনাল।
আমানুল্লাহ বের হয়ে আসলেন রুম থেকে। মাথা ফাঁকা হয়ে গিয়েছে। একজন জুনিয়রের সাথে তাকে তুলনা করা হয়েছে- ভাবতেই এত বছরের পেশাদারিত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেললেন তিনি। কে কিভাবে কেস সলভ করত তা ভালো করেই জানেন আমানুল্লাহ। খেটে খাওয়া দু তিনটা রিক্সাওয়ালা তা নাহলে রেলওয়ের বস্তি থেকে দু’তিনটা হিরোইনখোর ধরে এনে সংবাদ সম্মেলন করে আসামী বানিয়ে দিলেই কেস সলভ হয়ে যায় না। কিন্ত সৌমেন যদি সেরকম চান, সেরকমই হবে। শুধু একজনকে ধরতে পারলে হয়, ব্যস, ওখানেই কেস সলভ। ওখানেই কেস ডিসমিসড।
আমানুল্লাহকে জোর পায়ে হেঁটে যেতে দেখে ফারহান মুগ্ধ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকল। এত চমৎকার একটা মানুষ! এই মানুষটা কী ছোটবেলা থেকেই এত চমৎকার? একটা বিস্ময়ভরা মুহূর্ত পার করে ফারহান আবার নিজের কাজে ফিরে গেল। ধীরে ধীরে পরমুগ্ধতা রূপ নিল বিষাক্ত আত্মঘৃণাতে। সে এতো নিচ কেন? একটা কাজও কেন সে ঠিক মত করতে পারে না।
লম্বা একটা দম নিলেন আমানুল্লাহ। লিফটে উঠে তিন নাম্বার বোতাম চাপ দিলেন তিনি।
****
মিটিং রুমে ঢুকতেই সবাই উঠে দাঁড়ালো। আমানুল্লাহ একটা চেয়ার সরিয়ে খানিকটা জায়গা করে নিলেন। তারপর লম্বা টেবিলটাকে ঘিরে যতজন মানুষ বসে আছে, তাদের প্রত্যেকের দিকে তাকিয়ে একটা কৃত্রিম হাসি হাসার চেষ্টা করলেন। লম্বা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “আমরা আজকে একটা গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্যে এখানে এসেছি। কাজটা কি সেটা মনে হয় ব্যাখ্যা না করলেও চলবে। সময় নষ্ট না করে আমি আসল আলোচনায় যেতে চাচ্ছি। প্রথমেই ক্রিমিনোলজি স্পেশালিস্ট জয়েনুদ্দীনের কথা শুনব।”
জয়েনুদ্দীন উঠে দাঁড়ালেন। কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলেন। সবার দিকে চোখ বুলিয়ে বললেন, “আমার যতদূর মনে হচ্ছে, খুনি একজন না। খুনি কয়েকজন। খুনের মোটিভ বোঝা যাচ্ছে না। যেমন, বোসপাড়ার যে খুনটা হল সেটা নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। যে খুনি, তার সাথে আরও দুইজন ছিল। হয় খুনি পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়েছে, নয়ত সিএনজিতে- যেভাবেই পালাক, তাদের একজন খুনিকে ধাওয়া করেছে, আর একজন পালিয়েছে; কেন পালালো সেটা স্পষ্ট না।”
আমানুল্লাহ আরো কয়েকজনের মতামত শুনলেন। শোনার পরে বললেন, “সিএনজিটার কোন খবর পাওয়া গিয়েছে?”
এজেন্ট সাইদুর বলল, “না, স্যার। কেউই ঠিক মত সিএনজির নাম্বারটা বলতে পারেনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেছি। তবে যতদূর মনে হয়েছে, সিএনজিটা প্রাইভেট। ভাড়ায় চালানো সিএনজি না। তাই ঢাকা শহরে যত প্রাইভেট সিএনজি আছে, সবগুলোকে মোটামুটি কয়েকটা ক্লাসে ফেলে এগোনোর চেষ্ঠা করছি। সময় লাগবে।” আমানুল্লাহ আনমনেই যেন মাথা নাড়লেন। এসির টেম্পারেচার আঠারো। তারপরেও তার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমছে।
“প্রণব” আনমনেই যেন বলে উঠলেন।
“স্যার?” প্রণব উঠে দাঁড়ালেন।
“বইটার কোন খবর পেয়েছেন?” আমানুল্লাহ বললেন।
“পেয়েছি স্যার। আপনার টেবিলে আমি রেখে এসেছি ফাইলটা। বইটার প্রথম কয়েক পাতার ফটোকপি পাওয়া গিয়েছে নীলক্ষেতের একটা দোকানে। অনেক ঝামেলা করে ম্যানেজ করতে হয়েছে। আর মুনশী মোয়াল্লেম নামে একজন আছেন। নীলক্ষেতে একটা দোকান ছিল। তাও অনেক আগে। এখন আর বইয়ের দোকানটা নেই। গ্রামের বাড়ি হবিগঞ্জে চলে গিয়েছেন বলে শুনেছি। আপনি যদি বলেন তো আমি হবিগঞ্জে একবার গিয়ে খোঁজ নিতে পারি।”
আমানুল্লাহ হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললেন, “আচ্ছা। একবার গিয়ে খোঁজ নেন তো। বইটা আমি একবার দেখতে চাই।”
ফরেনসিক স্পেশালিস্ট এলিন দাঁড়িয়ে বললেন, “জয়েনুদ্দীন সাহেব যা যা বলেছেন ফরেন্সিকেও ঠিক সেগুলোই পাওয়া গিয়েছে স্যার। সুভাষ সরকারকে কলম দিয়েই খুঁচিয়ে মারা গিয়েছে।”
এরপরে রুমের সবাই যেন কথা বলা ভুলে গেল। সবাই অপেক্ষা করছে আমানুল্লাহর পরের প্রশ্নের জন্য। আমানুল্লাহ দাঁড়িয়ে আছেন সেই প্ৰথম থেকে। বসেননি একবারও।
হঠাৎ আইটি অফিসার সানাউল উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “পেনড্রাইভটা এনক্রিপ্টেড ছিল। যদি বলেন তো দেখাই?”
এ কথা শোনার পরে পুরো রুম যেন প্রাণ ফিরে পেল। সবাই নড়ে চড়ে বসল।
জ্বলে উঠল প্রজেক্টরের লাইট। সামনের সাদা পর্দায় ভেসে উঠল ল্যাপটপের ডেস্কটপের স্ক্রিন। কার্সরটা সোজা একটা ফাইলের আইকনে গিয়ে থামল। আইকনে ক্লিক করতেই একটা পিডিএফ ফাইল খুলে গেল। সেখানে লেখাঃ
“সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়। ভূত লেখক। আমাকে বেশ কয়েকবার হত্যার হুমকি দিয়েছে। ঘোস্ট রাইটিং-এর মাধ্যমে আমি তাকে দিয়ে তিনটা বই লিখিয়ে নেই। সুভাষ সরকারের মাধ্যমে কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী তাকে বই প্রতি ত্রিশ হাজার টাকাও দেই। কিন্তু বই প্রকাশের কয়েকদিনের মাথায় সে আরো টাকা চেয়ে বসে। সুভাষকে কিছু না জানিয়ে সে সরাসরি আমার সাথে দেখা করতে চায়। টাকা না দিলে আকারে ইঙ্গিতে আমাকে খুন করার হুমকি দেয়। যদিও সুভাষকে আমি কিছুই জানাইনি। কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে আমি একটা রিভলভার নিতে বাধ্য হই। আমি সব প্রমাণ সহ এই পিডিএফ ফাইলটা তৈরি করেছি। আমি চাই, আপনি এগুলো লিখে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করেন। আমি আমাদের কন্ট্রাক্টের ফটোকপিও এটার সাথে যোগ করেছি…”
আর কিছু পড়তে হল না। আমানুল্লাহ চেয়ারের হাতল খামচে ধরে বললেন, “সুকান্তকে খুঁজে বের কর, জলদি।”
ঠিক সেই সময়েই ফোন এলো, আরো একজন লেখক খুন হয়েছেন; আধ ঘণ্টা আগে। জয়েনুদ্দীন আর আমানুল্লাহ দুজন দুজনের দিকে অসহায় দৃষ্টি বিনিময় করলেন।
****
ক্রিমসন পাবলিকেশনের অফিস।
ঝাঁ চকচকে ওয়েটিং রুম। কোণায় একটা সিরামিকের টবে লাইলাক ফুলের গাছ লাগানো আছে। মিষ্টি একটা গন্ধ ভেসে আসছে গাছটা থেকে। দেয়ালে আর্নেস্ট হেমিংওয়ে, স্যার আর্থার কোনান ডয়েল, সত্যজিৎ রায় আর শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি টানানো। গত এক ঘণ্টা ধরে এই দৃশ্যপটই ভাসছে নীরুর চোখের সামনে। এসির চাপা শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই আপাতত। একটু আগে টেলিফোন বাজার শব্দ ছিল। এখন নেই।
আরো পনের মিনিট এভাবেই বসে থাকতে হল নীরুকে। পাশের দরজাটা খুলে একজন মহিলা বলল, “মিস নীরু?”
নীরু মাথা নাড়ল।
“আসেন” ভদ্রমহিলা দরজা খুলে দিল।
নীরু ভেতরে ঢুকল। ছোটখাট একটা হলওয়ে। হলওয়ের শেষ মাথায় একটা দরজা। ভদ্রমহিলা সেই দরজাটার দিকে ইশারা করে বললেন, “যান, অপরেশ স্যার ভেতরে আছেন।”
নীরু গট গট করে দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজার পাশে লেখা, অপরেশ পাল, প্রকাশক, ক্রিমসন পাবলিকেশন। নীরু নক না করেই ধাক্কা দিয়ে দরজাটা খুলে ঢুকে পড়ল।
সেগুন কাঠের ভারি টেবিলটার ওপারে একটা রিভলভিং চেয়ারে বসে ছিলেন অপরেশ পাল। হালকা পাতলা মানুষ। নীরুকে দেখেই উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, “নীরু!”
কোন সৌজন্যের ধার না ধেরে নীরু বলল, “এক ঘণ্টা বসে ছিলাম আমি অপরেশ সাহেব।”
“কি বলছ! এক ঘণ্টা! মানে?”
“এক্টিং করার কোন প্রয়োজন নেই।”
“এক্টিং না, আমি তো নীলিমাকে বললাম তুমি আসলে যেন সরাসরি আমার এখানে পাঠিয়ে দিতে। যাই হোক, খুবই সরি। নীলিমা এত ব্যস্ত থাকে আজকাল। আমারও এতটুকু সময় থাকে না হাতে। সামনে এওয়ার্ড সেরিমনি আছে। সেই নিয়ে খুব ব্যস্ত সবাই।”
“ভদ্রতা দেখার জন্য আমি আসিনি। একটা প্রশ্নের উত্তর জানতে এসেছি।”
“আসো আসো, আগে বস। ড্রিংক্স কি বলব বল।”
“ছ্যাবলামীটা অন্য কোথাও দেখাবেন। এখন বলেন, বাবাকে কেন মনোনয়ন দেয়ার পরেও বাদ দেওয়া হল?”
প্রশ্নটা শুনে অপরেশ কেমন যেন ভ্যবা চ্যাকা খেয়ে গেলেন। তিনি কথা খুঁজে পেতে পেতেই নীরু আবার বলল, “বাবার শেষ বইটা আপনার এখান থেকেই বের হয়। আমার জানা মতে বাবা সেই বইটার জন্য রাইটো- এড্রেনালিন এওয়ার্ডের জন্য আরো দুইজনের সাথে মনোনয়নও পেয়েছিলেন বলে জেনেছিলাম। হঠাৎ বাবাকে মনোনয়ন থেকে বাদ দেওয়া হয়। কেন?”
“আসলে নীরু, মনোনয়ন তো আমি করি না। আমাদের বিজ্ঞ বিচারকদের একটা কমিটি আছে, উনারা করেন। উনারাই প্রধানত এটা ঠিক করেন। তাছাড়া, তোমার বাবা, মানে ইমন সাহেব তো সুইসাইড করলেন, তাই…..”
“আমার বাবা সুইসাইড করেননি। আমি জানি আপনিই আমার বাবাকে খুন করেছেন। আমি জানতে চাই কেন, কেন আমার বাবাকে খুন করলেন?”
চিৎকার করে কথাগুলো বলল নীরু। নীরুর চিৎকার শুনে দুইজন সিকিউরিটি গার্ড দৌড়ে আসল। অপরেশ পাল ওদেরকে ইশারায় শান্ত হতে বললেন। তারপর নীরুর দিকে তাকিয়ে বললেন, “দেখ নীরু, তোমার বয়স কম। এখন তুমি যাকেই দেখবে তাকেই মনে হবে যে সে তোমার বাবার খুনি। ইউ আর ইন আ গ্রেভ শক। আমি জানি, এই বয়সে সত্যিটা গ্রহন করা কতটা কঠিন। কিন্তু সবাইকে দোষারোপ করে তুমি কতদূর যাবে? ইমন সাহেব আমার খুব কাছের লোক ছিলেন। আমি উনাকে খুব ভালো করেই চিনতাম। উনি বেশিরভাগ সময়েই হতাশায় ডুবে থাকতেন, এন্টি ডিপ্রেসেন্ট খেতেন। খেতেন কিনা বল?”
নীরু রাগে ফুঁসতে লাগল। গলার রগ ফুলিয়ে বলল, “এন্টি ডিপ্রেসেন্ট খাওয়া মানেই সুইসাইড করা না জানোয়ারের বাচ্চা কোথাকার। তোকে দেখে নেব আমি। তুই খুনি। তুই বাবাকে খুন করেছি। কেন করেছিস সেটাও আমি বের করব।”
অপরেশ ইশারা করতেই গার্ড দুজন নীরুকে ধরে বাইরে নিয়ে গেল। অপরেশ বললেন, “মাথা ঠাণ্ডা হলে আরেকদিন এসো নীরু। কথা হবে।” দরজা বন্ধ হয়ে গেল। অপরেশ বিড় বিড় করে বললেন, “ইডিয়ট, বাপের মতই ইডিয়ট।”
দূর্ভাগ্যের কাছে ধরা পড়ে যাওয়া
সন্ধ্যা নামছে। জ্বলে উঠছে নিশাচর ল্যাম্পপোস্ট। কুয়াশার মত অন্ধকার জমছে শহরের এখানে ওখানে। অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে শিকারীরা। নিশাচর পেঁচাদের দল নিষিদ্ধ জায়গাগুলোতে ভিড় জমাতে শুরু করেছে। রতন জানে, কোন অন্ধকারে কাকে পাওয়া যাবে। আর কোন অন্ধকার কাকে গ্রাস করে নিয়েছে।
রতন অনেক রাত পর্যন্ত প্রেস পাড়ার অন্ধকার গলিতে ঘুর ঘুর করে। আজকেও করছিল, কয়েকটা খালি চায়ের কাপ নিয়ে। এদিকটায় একটা ছোট একটা প্রেস আছে। ওদের ওখানে দুটো চায়ের কাপ আছে। দেখতে হবে।
গলির মুখে আসতেই দেখল, দুই ভ্যান ভর্তি পুলিশ। এলোমেলোভাবে নামছে, সুকান্তর প্রেসের ঠিক সামনেই। ভ্যানের আশেপাশে যে সাধারণ লোকগুলোকে দেখা যাচ্ছে, সেগুলো আসলে সাদা পোশাকে পুলিশ। এরা মানুষের মুখের দিকে তাকায়, সাধারণ মানুষের মত মাটির দিকে তাকায় না। এদেরকে চেনে রতন। ভালো করেই।
ভিড়ের ভেতরে মিশে গেল রতন। পুলিশ এসেছে- এই খবরটা একটা মানুষের জানা খুব দরকার। এই মুহূর্তেই জানা দরকার।
মানুষটাকে আজ বিকালেই ঘুর ঘুর করতে দেখেছে সে। প্রেস পাড়ার এদিকে ওদিকে। একটা সানগ্লাস আর পুরনো বেসবল ক্যাপ দিয়ে একটা মোটামুটি ছদ্মবেশ ধারণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু রতন ঠিকই চিনেছে মানুষটাকে। মানুষটাকে সে অনেকদিন থেকেই সে একটা কথা বলতে চাচ্ছে, যেটা তার জানা খুব দরকার।
লোকটা ‘গুটেনবার্গ প্রিন্টিং টাওয়ারের ছাদের ওপরে বসে ছিল। টিনের তৈরি এসির ঢাকনার পেছনে। রতন যখন ছাদে উঠল, তখন আশেপাশে দেখে নিল আর কেউ তাকে অনুসরণ করছে কিনা।
ধীর পায়ে ছাদের দরজার কাছে দাঁড়িয়ে রতন ডাকল, “সুকান্তদা, ও সুকান্তদা শুনতেছ?”
কোন উত্তর নেই। জানে সুকান্ত কাউকে আঘাত করবে না। সেরকম হলে নিজেই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে মারা যাবে। তাই রতন নিজের অবস্থানটা আরেকটু পরিষ্কার করে নিল- “সুকান্তদা। একটা জরুরী কথা আছে। আমি জানি তুমি এইহানেই আছ। পুলিশ আইছে। তুমারে খুজতেছে মনে হয়। শুনতেছ সুকান্তদা?”
“চলে যা, রতন।” রাতের বাতাসে ভেসে এলো সুকান্তের কণ্ঠ।
রতন বলল, “আমি তোমারে এট্টা জায়গার ঠিকানা দিতেছি। ঐহানে আমার এক খালা থাহে। উনারে আমার নাম কইলে তোমার আর কিছুছু হইব না। তুমি তাতারি যাও, সুকান্তদা।”
রতন দেখল, টিনের ঢাকনার আড়ালে সুকান্ত উঁকি দিচ্ছে। দেখার চেষ্টা করছে রতনের সাথে আর কেউ আছে কিনা। রতন বলল, “আমার লগে কেউ নাই সুকান্তদা। কিন্তু সুমায় কম। তুমি জলদি যাও। বেশি দেরি হয়ে গেলে আর যাবার পারবা নানে।” একবার পেছনের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে নিল সিঁড়ি ধরে কেউ এগিয়ে আসছে কিনা।
সুকান্ত এবার ধীরপায়ে আস্তে আস্তে আড়াল থেকে বের হয়ে আসল। ফ্যাকাশে মুখ। পরনে নিক্সন পট্টি থেকে কেনা পুরনো শার্ট আর পুরনো গ্যাবার্ডিনের প্যান্ট। কোন অপরাধ করে ফেলা শিশুর মত সুকান্ত কি যেন একটা বলতে গেল, রতন থামিয়ে দিয়ে বলল, “কি করছ না করছ পরে দেহা যাবেনে”।
হাত ধরে সে সুকান্তকে দরজার পাশে রাখা কার্টনগুলোর আড়ালে নিয়ে গেল। কঙ্কালসার শীর্ণ হাতদুটো সুকান্তের কাঁধে রেখে বলল, “কাঠালবাগানে আমার এক খালা থাহে। তুমি উহানে যাও। বাড়ির নাম নিরবান। বুজছ? গিয়া বলবা ম্যাডাম আনানসি আছে, আমি পাঠাইছি। যাও। দেরি কইরো না। ম্যাডাম আনানসি, খিয়াল থাকপে?”
সুকান্ত উদভ্রান্তের মত রতনের দিকে তাকালো। সামান্য এক চায়ের দোকানের ‘এসিসটেন’- সে তার জীবন বাঁচাচ্ছে, এটা যেন সুকান্ত মানতে পারছে না।
রতন বলল, “উত্তর দিকের যে রাস্তাটা আছে, সেইটা দিয়া যাও। আমি এদিকটা সামলাইতেছি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই এলাকা ছাইড়া দিবা। ঠিক আছে? আর অন্ধকার দিয়া যাইব্যা। টুপি কই?” সুকান্ত থতমত খেয়ে টুপিটা ব্যাকপকেট থেকে বের করে মাথায় দেয়। “এইত্ত। এহন যাও। পরে কথা হবে। আমি সেইরাম হইলে পারে অইহানে একপাক আসতেছি। তুমি আগে নামো। তারপর আমি নামতেছি। আর মানুষের মুখের দিকে তাকাবা না। দাঁড়াও। দাঁড়াও এট্টা ব্যবস্থা করতেছি।” রতন বলতে বলতে একটা সিগারেট বের করে সুকান্তের মুখে দিল। সুকান্ত ধুমপান করে না। রতন বোঝাল, সিগারেট খেতে খেতে গেলে কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। বেশি কিছু না, শুধু একটু ঠোঁটে ধরে থাকলেই হবে।
সুকান্ত দুই ঠোঁট দিয়ে সিগারেটটা চেপে ধরল। তারপর সিঁড়ি ধরে নিচে নেমে গেল। রতন পেছনে থেকে বলল, “মুবাইল খুইল না। বন্ধ রাইখো।’ কিছুক্ষণ থেমে বলল, “আমারে মাফ কইরা দিও সুকান্তদা।”
তর তর করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকল সুকান্ত।
পুরো প্রেসপাড়া ততক্ষণে ঘিরে ফেলেছে পুলিশ। সবগুলো প্রবেশপথ বন্ধ করে ফেলা হয়েছে ব্যারিকেড দিয়ে। শুরু হয়েছে প্রত্যকেটা প্রেসে তল্লাশী। একটা নেভি ব্লু হ্যারিয়ার এসে থামল। দরজা খুলে বের হয়ে আসলেন আমানুল্লাহ আর জয়েনুদ্দীন। “প্রতিটা প্রেস সার্চ কর। আর সুকান্ত যে প্রেসে কাজ করত সেই প্রেসটা পুরোটা ঘিরে ফেলো। তল্লাশী না হওয়া পর্যন্ত কেউ বের হবে না।”
সারি সারি পুলিশ ঘিরে ফেলল সুকান্তের প্রেস।
সুকান্ত ততক্ষণে গুটেনবার্গ প্রিন্টিং টাওয়ার থেকে বের হয়ে এসেছে। বাইরে ভিড়। লোকে লোকারণ্য। কয়েকটা পুলিশের সারির পেছন দিয়ে উত্তরের রাস্তার দিকে হাঁটা শুরু করল। পুলিশ তাকে কেন খুঁজছে? জানে না সুভাষদাকে সে খুন করেনি? তাহলে কেন তাকে পুলিশ এভাবে খুঁজছে? দুপুরে হোটেলে ভাত আর ছোট মাছ খেতে খেতেই টিভিতে নিজের ছবি দেখতে পায় সে। ধরিয়ে দিন। সে নাকি তিন খুনের আসামী। কিন্তু কিভাবে? হিসাব মেলেনি। সে দ্রুত তার কিছু জিনিসপত্র নিতে প্রেসে চলে এসেছে। বিকাল পর্যন্ত অপেক্ষা করেছে প্রেসের শিফট বদালাবার জন্য। শিফট বদলানোর সাথে সাথে পুলিশ চলে এসেছে।
আকাশে মেঘ ডাকতে শুরু করেছে। ভ্যাপসা গরম। ঘামে ভিজে জব জব করছে শার্ট। বেজবল ক্যাপটার কার্ণিশটা আরেকটু নামিয়ে দিয়ে আড়চোখে দেখে নিল আশপাশটা। প্রেসে প্রেসে তল্লাশী শুরু হয়েছে। প্রেসের পিওনগুলোকে বাইরে এনে চড়-থাপ্পড় দিচ্ছে পুলিশ। ভিড়ের ভেতরে দুজন পুলিশকে এগিয়ে আসতে দেখেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়ল। ঠোঁটে ধরা সিগারেটটা দুই আঙুলের ফাঁকে এমনভাবে ধরল যেন একটু পরেই সে সিগারেটটা ধরাবে।
ওদিকে আমানুল্লাহ সুকান্তের প্রেসের মালিককে জিজ্ঞাসা করলেন, “সুকান্ত এসেছিল?”
প্রেসের মালিক মাথা নেড়ে বললেন, “না, আসেনি।”
আমানুল্লাহ হাল ছেড়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ জয়েনুদ্দীন বললেন, “ও কোথায় বসে একটু দেখা যায়?”
মালিক মাথা নেড়ে সুকান্তের ডেস্কের দিকে হাঁটা শুরু করলেন। আমানুল্লাহ ভেতরে ভেতরে ভীষণ চিন্তার ভেতরে আছেন আর একটা ব্যাপারে। বিকাল থেকে তন্দ্রানীলা ফোন ধরছে না। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরেও কোন সাড়া নেই। মেয়েটা কোথাও কি বেরিয়েছে নাকি? এদিকে এই কাজ রেখে বাড়িও যেতে পারছেন না। “প্রণব বলছেন?” মোবাইলটা কানে ধরে বললেন আমানুল্লাহ।
“বলছি স্যার” ওপাশ থেকে প্রণব বলল।
“দেখেন তো তন্দ্রানীলাকে ফোনে পাচ্ছি না। বাসায় কেউ নেই নাকি ও বেরিয়েছে।” আমানুল্লাহ বললেন।
“দেখছি স্যার।” বললেন প্রণব।
সুকান্তের ডেস্কটা সেরকমই আছে। কীবোর্ডের ওপরে শুধু ধুলো জমেছে। ক্লিনিক্যাল গ্লাভস পরতে পরতে জয়েনুদ্দীন জিজ্ঞাসা করলেন, “গত কয়দিন আসেনি ও?”
মালিক বললেন, “আজকে আসেনি শুধু।”
জয়েনুদ্দীন মাথা নাড়লেন। একটা একটা করে জিনিস বের করে চেক করতে লাগলেন। কয়েকটা পুরনো কাগজের বান্ডেল। একটা পুরনো কীবোর্ড, সম্ভবত নষ্ট। ফ্লুইডের খালি শিশি। কয়েকটা বলপয়েন্ট পেন। কি মনে করে পুরনো কীবোর্ডটা হাতে নিয়ে কয়েকবার বাজালেন। খড় খড় করে শব্দ হল। “একটা স্ক্রু ড্রাইভার দেখি।” জয়েনুদ্দীন বললেন। কে একজন একটা স্ক্রু ড্রাইভার এনে দিল। কয়েক মিনিটের ভেতরে পুরনো কীবোর্ডটা খুলে ফেললেন জয়েনুদ্দীন।
ভেতর থেকে বের হয়ে এল একটা ফাউন্টেন পেন। রক্ত মাখা। নিবের জায়গায় বসানো তীক্ষ্ণ আর ধারালো ফলা। পাওয়া গেল, ‘একটা কলম কিভাবে এতটা মারাত্মক অস্ত্র হতে পারে?’ প্রশ্নের উত্তর।
জয়েনুদ্দীন আর আমানুল্লাহ দুজন দুজনের দিকে তাকালেন। জয়েনুদ্দীনের চোখের ভাষা পড়তে আমানুল্লাহর বেশি সময় লাগল না। সুকান্ত আশেপাশেই আছে, আর ও এই জিনিসটা নিতে আসবে। ওয়াকিটকিটা বের করে আমানুল্লাহ বললেন, “অল ইউনিট কপি, ও প্রেস পাড়াতেই আছে। একটা লোককেও বের হতে দিও না। অল ইউনিট আই রিপিট, কালপ্রিটটা প্রেস পাড়াতেই আছে। ওভার।”
গুড় গুড় করে মেঘ ডাকল। ঝম ঝম করে নামল বৃষ্টি।
ভিড়ের ভেতরে শুরু হল দৌড়াদৌড়ি। হুড়োহুড়ি। এলোমেলো হৈচৈ। বৃষ্টি থেকে বাঁচতে মানুষজন সব আশেপাশের ফুটপাথে জড় হতে শুরু করল।
এই সুযোগ। সুকান্ত জোর পায়ে হাঁটা দিল। পুলিশের ভ্যান থেকে হ্যান্ডমাইকে সবাইকে শান্ত হতে বলা হল। কিন্তু কেউ শান্ত হল বলে মনে হল না। সুকান্ত ভিড়ের ভেতরে দ্রুত মিশে গিয়ে বামদিকের একটা গলিতে ঢুকবে- এমন সময়ে একজনের সাথে ধাক্কা লাগল। সুকান্ত আড়চোখে তাকিয়েও দেখল না। একজন পুলিশ। ছাতা খুলতে ব্যস্ত। পুলিশটা ছাতা খুলে সুকান্তকে থামতে বলল। কাঁধে হাত দিতে যাবে, এমন সময়েই সুকান্ত পুলিশটাকে ধাক্কা মেরে অন্ধকার গলির মধ্যে ঢুকে পড়ল।
“ওই! ওই! ওই থাম” পুলিশটা ছাতা সামলাতে সামলাতে ওয়াকিটকিতে হড়বড় করে কি একটা বলা শুরু করল। সেগুলো শোনার সময় নেই। অন্ধকার গলি ধরে ছুটতে শুরু করল। অন্ধের মত। বৃষ্টি পড়ছে তখনও, মুষলধারে। পুলিশটাকে ধাক্কা মারাটা বড্ড ভুল হয়ে গিয়েছে।
“অল ইউনিট কপি, মল্লিক প্রকাশনীর পাশের গলিতে একজন সাসপেক্ট পালানোর চেষ্টা করছে, ওভার।” ওয়াকিটকিতে ভেসে এলো। তীক্ষ্ম কন্ঠে বেজে উঠল পুলিশের গাড়ির সাইরেন।
ওই তো গলির শেষ মাথা। পড়িমড়ি করে ছুটছে সুকান্ত। যেভাবেই হোক, উত্তরের রাস্তাটা ধরতেই হবে। উত্তরের রাস্তা পার হলেই ওপারে রেললাইন। তার ওপারে বস্তি।
সুকান্ত ছুটছে। বৃষ্টির পানি চিরে ছুটছে। চোখে মুখে বৃষ্টির পানির ছিটা এসে ফুটছে বরফের সূঁচের মত।
“গলির শেষ মাথায় ব্যারিকেড দিয়ে দাও।” আমানুল্লাহ মোবাইলে কাকে যেন বললেন। তারপর নিজেই হ্যারিয়ারে চেপে বসলেন। ওয়াকিটকিতে বললেন, “অল ইউনিট। গুলি চালাবে না। পায়েও না। আই রিপিট কোন গুলি না। যতক্ষণ ওকে ধরা যাচ্ছে না, ততক্ষণ ওকে অনুসরণ করতে থাক।” হ্যারিয়ার স্টার্ট দিতেই পেছনের দরজা খুলে জয়েনুদ্দীন উঠলেন। বৃষ্টিতে বেশ ভিজে গিয়েছেন। গাড়ি চলতে শুরু করল। আমানুল্লাহ বললেন, “কি মনে হয়? সুকান্ত?” জয়েনুদ্দীন নিরুত্তর
গলির মুখে ব্যারিকেড টানতে শুরু করল পুলিশ। হ্যান্ডমাইকে বলা হল সেই আদিম ঘোষণা, “পুরো এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে। পালানোর চেষ্টা না করে নিজেকে পুলিশের কাছে সমর্পন কর।” সুকান্ত জন্তুর মত হাঁপাতে লাগল। বৃষ্টির পানি ঢুকে গিয়েছে নাকে মুখে। প্রতিটা নিঃশ্বাস যেন এক একটা ফাঁসির দড়ির মত মনে হচ্ছে। দ্রুত কিছু একটা করতে হবে। পেছনে তাকালো সুকান্ত। বের হওয়ার পথ বন্ধ দুদিকেই। গলিতে ঢোকাটা হয়েছে সব থেকে বড় ভুল চাল।
হ্যারিয়ারটা দানবের মত এসে দাঁড়াল গলির শেষ মাথায়। একজন শুকনো মতন পুলিশ একটা ছাতা নিয়ে দৌড়ে এলো। আমানুল্লাহর মাথায় ধরল ছাতাটা। আমানুল্লাহ নেমে এলেন। পুলিশ ভ্যান থেকে হ্যান্ডমাইকটা নিয়ে এগিয়ে গেলেন। ব্যারিকেডের কাছে দাঁড়িয়ে বললেন, “পালানোর চেষ্টা বৃথা সুকান্ত। তোমাকে দুই দিক থেকেই ঘিরে ফেলা হয়েছে। আত্মসমর্পন করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। তোমার কাছে আমরা সুবিবেচনা আশা করব।”
আশেপাশেই কোথাও বাজ পড়ল। ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। অন্ধকারে ডুবে গেল চারপাশ। উত্তরের রাস্তায় জ্যাম লেগে গিয়েছে, কারণ ওদিকে ব্যরিকেড দেওয়া।
বৃষ্টি পড়তে লাগলো আরো জোরে।
আমানুল্লাহ ওয়াকিটকিতে বললেন, “কপি, ইউনিট টু’কে বলছি, গলির দুই মাথা থেকে এপ্রোচ কর। কোনভাবেই গুলি চলবে না। ওভার।”
রায়ট শিল্ড আর ব্যাটন নিয়ে কুড়িজন পুলিশ গলির অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
প্রণবের ফোন আসল। আমানুল্লাহ রিসিভ করতেই বললেন, “স্যার, তন্দ্রানীলা ম্যাডাম একটু বেরিয়েছিলেন এই মাত্র ফিরলেন। কোন সমস্যা নেই।”
****
সুকান্ত আকাশের দিকে তাকালো। দুইটা ভবন খাড়া হয়ে উঠে গিয়েছে আকাশে। পলকে পলকে বিদ্যুৎ চমকে আলোকিত করছে কংক্রিটের দেয়াল দুটোকে। বিদ্যুৎ চমকানোর ওই আলোতেই দেয়ালে ঝুলতে থাকা লোহার সিঁড়িটা চোখে পড়ল সুকান্তের। প্রেসের এমার্জেন্সি এক্সিট। আগুন টাগুন লাগলে বা অন্য কোন দুর্ঘটনা হলে এই সিঁড়ি দিয়েই সবাই নামে।
সুকান্ত দেরি করল না। দু তিনবারের চেষ্টায় লাফ দিয়ে সিঁড়ির শেষ মাথাটা ধরে ফেলল। গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে নিজেকে টেনে তুলল সে। বিদ্যুৎ চমকাতেই থেমে যেতে হল তাকে। কারণ, দেখতে পেল, রায়ট শিল্ড নিয়ে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে পুলিশ।
কয়েকধাপ সিঁড়ি লাফিয়ে লাফিয়ে উঠে আবার থেমে যায় সুকান্ত। বিদ্যুৎ চমকানোর আলোয় তাকে দেখে ফেলতে পারে পুলিশ- এই ভয়ে থেমে যেতে হচ্ছে। কমে গিয়েছে বৃষ্টির গতি। বেড়েছে বাতাসের গতি। শোঁ শোঁ করে বয়ে যাচ্ছে গলির ভেতর দিয়ে।
লোহার সিঁড়িতে শব্দ যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে রাখতে নিজের অজান্তেই নিজেকে ভবনের ছাদে নিজেকে আবিষ্কার করল সুকান্ত। এতক্ষণে সুকান্ত বুঝেছে, গরম কড়াই থেকে জলন্ত উনুনে লাফিয়ে পড়েছে সে। এদিক ওদিকে তাকিয়ে কোন একটা উপায় বের করার চেষ্টা করল।
বিদ্যুৎ চমকে উঠল। চোখে পড়ল ইলেক্ট্রিসিটির ঝুলে থাকা তার, ছাদের কিনারা থেকে কয়েক গজ দূরে। লাফিয়ে পড়লে ধরে ফেলা যাবে। ইলেক্ট্রিসিটি আসেনি এখনও। অন্ধকারে ঢুবে আছে চারিদিক। এই মুহূর্তে যদি সে লাফিয়ে পড়ে? তাহলে হয়ত উত্তরের রোডে পৌঁছানো যেতে পারে।
কিন্তু যদি হঠাৎ ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসে? মারা যাবে সুকান্ত। তাতে কার কি এসে যাবে? তার জন্য কে কাঁদবে? সুভাষদা কাঁদত। হয়ত কাঁদত। কিন্তু সে তো নেই। কোন পিছুটানও নেই।
সুকান্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল। পেছনে শোনা গেল লোহার সিঁড়িতে নির্মম বুটের এলোমেলো আওয়াজ।