নিয়তির প্রহেলিকা
একটা চাপা শব্দ হল কোথায় যেন। ভদ্রলোক থামলেন, থামতে বাধ্য হলেন। বোঝার চেষ্টা করলেন, শব্দটা কোথা থেকে আসছে। কিছুক্ষণ বিরতি। শব্দটা যখন দ্বিতীয়বার আর হল না, ভদ্রলোক আবার পৃষ্ঠা ওল্টালেন। বললেন, “লেখকের কাছে সব থেকে গুরুত্বপুর্ণ বিষয় হল- অভিজ্ঞতা। জীবনের প্রতিটি অভিজ্ঞতাই মানুষকে কিছু বলতে চায়। যারা সেটা বুঝতে পারে আর ব্যাখ্যা করতে পারে- তারা দার্শনিক, যারা সেটা লিখতে পারে- তারা লেখক আর যারা এগুলো পাশ কাটিয়ে যায়- তারা সাধারণ মানুষ। কাজেই অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা জরুরী। একজন লেখকের জন্য তো বটেই। আর এই জন্য নিজেকে বিচিত্র পরিস্থিতির ভেতরে ফেলতে হবে। বিচিত্র কষ্টের স্বাদ নিতে হবে। বিচিত্র মানুষের কাছে যেতে হবে। বিচিত্র মানুষের কষ্টও যেমন বিচিত্র, তেমনই সুখও- দুটোই লেখককে আস্বাদন করতে হবে।”
****
“আজকে শুক্রবার। সুভাষদা আজ বাড়িতেই থাকবে।” সুকান্ত বলল। সিএনজির পেছনের সিটে বসে গ্রিলের বাইরেটা দেখার চেষ্টা করল সে। কথাটা যেন নিজেকে নিজেই বলল। ভোরের আলো ফুটছে। আস্তে আস্তে পরিষ্কার হচ্ছে চারপাশ। শনশন করে ভোরের পূবালী বাতাস বয়ে যাচ্ছে।
“সুভাষদার বাড়ি কোনটা?” তৈমুর জিজ্ঞাসা করল। সে চালকের আসনে বসে আছে। যাত্রীর আসনের গেটে বাইরে থেকে তালা মেরে রেখেছে সে, যেন সুকান্ত কোথাও পালিয়ে যেতে না পারে।
জায়গাটা পুরাতন বোস পাড়া। শহর থেকে কিছুটা বাইরে। হিন্দুদের বসবাস এদিকটাতে বেশি। বড় বাড়ি খুব কমই আছে। বেশিরভাগই একতলা আর দোতলা। সবগুলো বাড়িই পুরনো। এখানকার সময় যেন সাতচল্লিশ সালেই থমকে গিয়েছে। বিকালবেলা ছেলেরা রাস্তার মাঝখানে স্ট্যাম্প পুঁতে ক্রিকেট খেলে। বাড়ির মহিলারা বাড়ির সামনে জটলা করে গল্প গুজব করে। সন্ধ্যার সময় গুনে গুনে আটবার শাঁখ বাজে প্রায় সবগুলো বাড়িতে। তারপরই সব শুনশান।
“কি হল? বলেন কোন বাড়িটা?” তৈমুর খেঁকিয়ে উঠল। সুকান্ত আমতা আমতা করে বলল, “আমি এদিকটায় কখনও আসিনি। ওই সামনের চায়ের দোকানটা খুলছে, ওখানে একটু শুনে নেন সুভাষ সরকার কোন বাড়িটায় থাকে।
ভ্ররর করে সিনএনজিটা স্টার্ট নিলো। এগিয়ে গেলো চায়ের দোকানটার দিকে। একটা খুনখুনে বুড়ো কুঁজো হয়ে দোকান খুলছিল। দোকানের সামনে তিনটা কুকুর শুয়ে ছিল, সিএনজি আসতে দেখেই ঘেউ ঘেউ করে ডাকা শুরু করল ওরা। তৈমুর কুকুরের ঘেউ ঘেউ উপেক্ষা করেই জিজ্ঞাসা করল, “ও মুরুব্বি, সুভাষ সরকারকে চেন? কোন বাড়িতে থাকে বলতে পারবা?”
মুরুব্বি খুব ধীর পায়ে সিএনজির দিকে এসে বলল, “পেরেসে কাজ করে ঐ সুভাষ তো?”
সুকান্ত পেছন থেকে বলল, “হ্যাঁ হ্যাঁ উনিই।” বৃদ্ধ কেমন করে যেন তাকালো। যেন তাকে খুব অদ্ভুত কোন প্রশ্ন করা হয়েছে। সে একটু উঁকি দিয়ে সিএনজির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল।
“সোজা গিয়ে একটা বাড়ি আছে। বাড়িসসামনে মাধবীলতার গাছ আছে। পরেশদের বাড়ি। ওই বাড়িন নিচেত্তলায় থাকে।”
সিএনজি সোজা গেল। রাস্তাগুলো গলির মত। সরু। একটু আবছা অন্ধকার। বৃদ্ধের চাহনি মোটেই ভালো লাগেনি। কি যেন ছিল চাহনিটায়। সুকান্তের ভেতরে একটা চাপা অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করল।
মাধবীলতায় মোড়া একটা লোহার গেটের সামনে সিনএনজিটা থামল। দোতলা বাড়ি। অনেক পুরনো। বড় বড় জানালা। বাড়ির একটা পাশ টিনের ছাউনি দেওয়া আছে। তৈমুর সিএনজির স্টার্ট বন্ধ করে প্যান্টের পেছন থেকে রিভলভার বের করে বলল, “কোন ধরনের ঝামেলা করার চেষ্টা করবেন না। মনে রাখবেন আমি আপনাকে সাহায্য করতে এসেছি। উল্টা-পাল্টা কিছু হলে তার ফলাফল ভালো হবে না। যাই হোক, আপনি ভেতরে যাবেন। আমি বাইরে সদর দরজার কাছে আছি। আপনি পেনড্রাইভ আর চিরকুটটা নিয়ে বের হয়ে আসবেন। বেশি কথা বাড়ানোর দরকার নেই। যদি দেখি আপনি দশ মিনিটের ভেতরে ফিরছেন না, তাহলে আমি ভেতরে ঢুকব। আর সেটা অবশ্যই ভালো হবে না। পেনড্রাইভ কার কাছে সেটা আমি জানি। কাজেই আপনাকে মেরে ফেললে আমাদের খুব বেশি কিছু আসবে যাবে না। জিনিসটা বুঝতে পারলেন?” সুকান্ত মাথা নাড়ল। সে জিনিসটা বুঝেছে। ঢুকে গেল বাড়ির ভেতরে।
পেনড্রাইভটা নিয়ে সুকান্ত যদি পালিয়ে যায়? তাহলে কে ঠেকাবে? তৈমুর? লোকটা শক্ত সমর্থ আছে। হাতে রিভলভারও আছে। মেয়েটা যে আসলেই ইমন মোস্তাফিজের মেয়ে তার প্রমাণ কি? তাছাড়া, এই মেয়েটার কাছে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করাটা কেন জরুরী? সে কে? পেনড্রাইভটা ভুল মানুষের হাতে পড়তে দেওয়া যাবে না। মনে মনে ঠিক করল পেনড্রাইভটা নিয়ে সে পালাবে। যেভাবেই হোক। সোজা চলে যাবে বাড্ডা। তারপর সেই পুরনো বন্ধুর কাছে পেনড্রাইভটা ডিক্রিপ্ট করে দেখবে এটাতে কি আছে। পেনড্রাইভটা তার কাছেই পাঠানো হয়েছিল, অন্য কারো কাছে না। কাজেই অন্য কারো দেখার চেয়ে তার অধিকার সবার আগে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকেই একটা ছোট্ট আঙিনা চোখে পড়ল। একপাশে কলপাড়। ছোট্ট একটা চৌবাচ্চা। চৌবাচ্চার পাশে একটা খড়ের ছাউনি। ছাউনির ভেতরে জমাট অন্ধকার। সুকান্ত উঁকি দিয়ে দেখল, একটা দরজা আছে ছাউনির ভেতরে। আস্তে করে দরজার হুড়কো খুলে উঁকি দিতেই বুঝতে পারল, এটা বাড়ির পেছনের দরজা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে। এদিক দিয়েই বের হয়ে যাওয়া যাবে।
বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটা শুরু হয়ে গিয়েছে। নিঃশ্বাস বন্ধ করে সে বাড়িটার দিকে তাকালো। তিনটা দরজা চোখে পড়ছে। এর মধ্যে কোনটাতে নক করলে সুভাষদাকে পাওয়া যাবে? তিন চার মিনিট পার হয়ে গিয়েছে এতক্ষণে। যা করার দ্রুত করতে হবে।
নিচতলার একটা কাঠের দরজায় নক করল সুকান্ত। একবার। দুবার। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে তিনবার। চতুর্থবারের বার দোতলায় ওঠার সিঁড়ির মুখে জমাট অন্ধকারে কি যেন নড়তে দেখল। “কেউ আছেন ওখানে? আমি সুভাষদাকে খুঁজছিলাম।” সে বলল।
হঠাৎ দোতলা থেকে লাফ দিয়ে ‘কি যেন একটা’ সুকান্তের ঘাড়ের ওপরে পড়ল।
ভারি কিছু। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ভারি জিনিসটার নিচে চাপা পড়ে গেল সুকান্ত। ভোরের আবছায়াতে জিনিসটা কি বুঝে ওঠার আগেই সিঁড়ির অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসল একজন মানুষের অবয়ব। বিদ্যুৎ বেগে দৌড় দিল চৌবাচ্চার দিকে।
গায়ের ওপর থেকে ভারি জিনিসটা সরাতে গিয়ে সুকান্ত বুঝল, এটা একটা মৃতদেহ। মানুষের মৃতদেহ। বালির বস্তার মত ভারি। হাতে স্পর্শ পেল চটচটে আঠালো তরলের। রক্ত। ঈষদুষ্ণ রক্ত।
ভোরের আলোয় সুকান্ত দেখতে পেল, এটা সুভাষদার লাশ। নিথর। নিস্তব্ধ।
কয়েক মুহূর্ত লাগল নিজেকে গুছাতে। এরকম কিছু আশা করেনি সুকান্ত। ঘটনার আকস্মিতায় সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গেল মাথার ভেতরে। সুকান্ত পালিয়ে যাওয়া লোকটার পিছু নিল। মানুষটা ততক্ষণে চৌবাচ্চার ওপরে দাঁড়িয়ে পাঁচিল টপকে দৃষ্টি সীমানার বাইরে চলে গিয়েছে। তৈমুরও বাড়ির ভেতরে ঢুকল। ধপ করে কিছু একটা পড়ার আর দৌড়াদৌড়ির শব্দ সে ও শুনেছে।
“ঐ থাম। ঐ”, চিৎকার করে উঠল তৈমুর। পেছনের দরজা দিয়ে পলায়নপর সুকান্তের দিকে রিভলভার তাক করল। ট্রিগার টিপতে এক সেকেন্ডও লাগল না। হঠাৎ চোখ পড়ল উঠোনে পড়ে থাকা নিথর দেহটার দিকে। মুহূর্তের জন্য কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে গেল সেও।
গলির বাড়ির বাকি বাসিন্দারের ঘুম ভেঙে গিয়েছে। আস্তে আস্তে দরজাগুলো খুলে যেতে শুরু করেছে। আশপাশ থেকে ঘুম জড়ানো কণ্ঠস্বর শোনা যাচ্ছে। তৈমুরের চোখে মুখে এই প্রথম আতঙ্ক ফুটে উঠল। রিভলভার হাতে একজন মানুষের সামনে একটা লাশ, আর রিভলভার থেকে একটু আগেই চালানো হয়েছে গুলি- এর মানে খুব পরিষ্কার।
****
লোকটাকে দেখতে পেল সুকান্ত। দুই বাড়ির মাঝখানের সরু জায়গা দিয়ে কোনরকমে দৌড় দিচ্ছে। সুকান্তের মাথার ভেতরে একটাই চিন্তা খেলে গেল, লোকটাকে ধরতে হবে। যেভাবেই হোক। ছুটল সুকান্ত। পায়ের সস্তা স্যান্ডেলটা খুলে তীব্র বেগে ছুটল।
লোকটা একটা বাড়ির আড়ালে চলে গিয়েছে। দূর থেকে যেটুকু বোঝা যাচ্ছে, একটা কালো মাফলারে মুখ আর মাথা মুড়িয়ে নিয়েছে। এর চেয়ে আর বেশি কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
সুকান্ত দুই হাতে দুই পাশের পুরনো বাড়িগুলোর দেয়ালগুলোতে ধাক্কা দিয়ে সামনে এগোতে শুরু করল। সাপের শরীরের মত শীতল দেয়ালগুলো যেন আস্তে আস্তে সুকান্তের দিকে সরে আসছে। ধীরে ধীরে আরো সরু হয়ে যাচ্ছে যেন গলিগুলো।
ভোরের আলো ফুটে গিয়েছে। সেই রোদেই লোকটা ঝলসে উঠল সুকান্তের চোখে। খালি গা আর পরনে জিন্স। হাচড়ে-পাচড়ে একটা বাড়ির ছাদে ওঠার চেষ্টা করছে। সুকান্ত চিৎকার করে উঠল, “খুনি… খুনি।” কিন্তু আশেপাশে কোন সাড়া নেই।
বাড়ির ছাদে উঠে যেতেই লোকটাকে হারিয়ে ফেলল সুকান্ত। আরো জোরে পা চালাল। লোকটা একেবারে বাঁশের মত চিকন। সরু গলিগুলো অবলীলায় পার হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সুকান্তের জন্য সেটা একটু হলেও কঠিন। তাছাড়া বেশ কয়েকটা পাঁচিল টপকাতে হয়েছে তাকে। বুকের ভেতর থেকে অনেকখানি বাতাস বেরিয়ে যাচ্ছে। হাপরের মত ওঠা নামা করছে বুক। গলা শুকিয়ে যাওয়ার ফলেই হয়ত মাথা ব্যথা করছে। জ্বলতে শুরু করেছে চোখ।
যতই সময় যাচ্ছে, ততই লোকটার সাথে দূরত্ব বাড়ছে। কমে যাচ্ছে লোকটাকে ধরার সম্ভাবনা। চোখের সামনে সুভাষদার নিথর দেহটা ভেসে উঠল। শরীরের শেষ শক্তিটুকু দিয়ে আরো জোরে দৌড় দিল সুকান্ত। আরো জোরে, আরো।
হঠাৎ সামনে একটা বিরাট পাঁচিল পড়ল। এই পাঁচিল সুকান্তের পক্ষে টপকানো দুঃসাধ্য। এদিক ওদিক তাকাতে লাগল সে। বাম দিকে একটা বাগান আছে। ওটার শেষ মাথায় একটা শিশু গাছ চোখে পড়ল। গাছটা পার হতে পারলেই লোকটাকে পাওয়া যেতে পারে।
কিছুক্ষণ হাচড়ে-পাচড়ে গাছে ওঠার চেষ্টা করতেই সুকান্ত বুঝতে পারল, সে গাছেও উঠতে পারবে না। কনুই আর কবজির কাছে ছড়ে গেল। বাধ্য হয়ে আবার আগের জায়গায় ফিরে গেল সে। তারপর বাম দিকে দৌড় দিল। সময় কম। খুব কম।
বাম দিকে দৌড় দিতেই একটা মোড় এলো। আর কিছুক্ষণের ভেতরেই আবিষ্কার করল, এটা একটা কানাগলি।
বিষাক্ত এক হতাশায় ডুবে গেল সে। খুনি হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে।
পেছনে ফিরে গেলে তৈমুর তাকে ছেড়ে দেবে না। সব কিছু গুছিয়ে বলার আগেই হয়ত গুলি করে বসবে। তাহলে সুকান্ত এখন কি করবে?
জানোয়ারের মত হাঁপাতে লাগল সে। হৈচৈয়ের কারণে এতক্ষণে আসল জিনিসটাই ভুলে গিয়েছে। পেনড্রাইভ। পেনড্রাইভটার কথা মনে পড়তেই সুকান্ত দেয়াল ধরে নিজেকে টেনে তুলল। পেনড্রাইভটা কি খুনি নিয়ে গেল নাকি? ঐ একটা জিনিসই ছিল যেটা থেকে বোঝা যেত ইমন মোস্তাফিজ কি বলতে চাচ্ছিলেন। ওটাই ছিল সব রহস্য সমাধানের একমাত্র উপায়।
সৰ্বনাশ!
আরো গাঢ় অন্ধকারে
চিনি ছাড়া আদা চায়ের কাপটায় চুমুক দিতে দিতে আমানুল্লাহর ভ্রু আরো কুঁচকে গেল। ফাইলটা আরো কাছে নিয়ে কী যেন একটা দেখতে লাগলেন তিনি। চায়ের কাপটা টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে ইন্টারকমের রিসিভার হাতে নিলেন। চোখ আটকে থাকল ফাইলের পাতায়।
“ফরেনসিক এনালিস্ট এলিনকে একটু পাঠাও তো।” আমানুল্লাহ বললেন।
কিছুক্ষণ পরে একটা মোটা কাঁচের চশমা পরা মেয়ের মাথা উঁকি দিল দরজা দিয়ে। বলল, “আসতে পারি স্যার?” আমানুল্লাহ মাথা নাড়লেন।
এলিন ভেতরে ঢুকে বলল, “স্যার?”
আমানুল্লাহ বললেন, “ফরেনসিক রিপোর্টে এগুলো কী লিখেছ? লাশের কাছে যে চুল পাওয়া গিয়েছে সেটা মানুষের চুল না? ওটা উইগ থেকে পাওয়া গিয়েছে?”
এলিন বলল, “জি স্যার। ওটাতে বায়োলজিক্যাল কোন এলিমেন্ট পাওয়া যায়নি। ওটা পলেস্টারের ফাইবার দিয়ে বানানো উইগের চুল, স্যার। কাজেই ডিএনএ পাওয়ার প্রশ্নই আসে না।”
আমানুল্লাহর কুঞ্চিত ভ্রুর খাঁজ আরো গাঢ় হল। তিনি বললেন, “ইমন সাহেবের লাইসেন্স করা রিভলভারটার ব্যপারে কোন খোঁজ নেওয়া হয়েছে?”
“হয়েছে স্যার। আর্মস রেগুলেশন এক্ট এর সবগুলো শর্ত মেনেই ওটা কিনেছিলেন তিনি। বেআইনি কিছুই পাওয়া যায়নি।”
আমানুল্লাহ বললেন, “অস্ত্র কেনার উদ্দেশ্য কি বলা ছিল?”
“স্যার, ফর্মে লেখা ছিল, তিনি নিজের ও নিজের পরিবারের নিরাপত্তার জন্য রিভলভারটি কিনছেন। রিভলভারের ফাইলটা বিকেলের মধ্যে পাঠিয়ে দেব, স্যার।”
আরেক চুমুক চা খেয়ে আমানুল্লাহ বললেন, “আচ্ছা, যেতে পার।”
এলিন চলে গেল।
সৈকত সারওয়ারের ওখান থেকে খুনির কোন ধরনের চিহ্নই পাওয়া যায়নি। ফরেনসিকের ফাইল সেটাই বলছে। কিন্তু এটা তো ক্রিমিনোলজির প্রিন্সিপ্যালের বাইরে চলে যাচ্ছে। খুনি যত পেশাদারই হোক, কোন না কোন প্রমাণ তো রেখে যাবেই। এতটা নিখুঁত খুন কেউ কিভাবে করে?”
হঠাৎ কথাটা মনে পড়ে গেল। আবার ইন্টারকমের রিসিভার তুললেন, “প্রণবকে একটু পাঠাও তো।”
প্রণব হাজির হল ঠিক চার মিনিটের মধ্যে। সিনিয়র ফিল্ড এজেন্ট তিনি। পুরুষ্ঠ গোঁফে ঢেকে থাকে ওপরের ঠোঁট আর নাকের দুটো ফুটো। ভারি শরীর নিয়ে রুমে ঢুকতেই আমানুল্লাহ বললেন, “প্রণব, একটা কাজ করেন তো। পাছাখানার ভূত নামে কোন বই যদি পান, তাহলে একটু ম্যানেজ করেন তো। বইটা নাকি বেশ কয়েক বছর আগে নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছে। লেখক বা প্রকাশক কাউকেই নাকি খুঁজে পাওয়া যায়নি। বইটা ম্যানেজ করেন, আর বই সম্পর্কে যতগুলো পুলিশ ফাইল আছে সবগুলো সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করেন। আর খোঁজ নিয়ে দেখেন, মুনশী মোয়াল্লেম নামে এক ভদ্রলোককে খুঁজে পান কিনা। তিনি পুরনো বই সংগ্রহ করেন।”
প্রণব মূর্তির মত বলল, “জি স্যার।”
প্রণব চলে যাওয়ার পরে গতরাতের কথা মনে পড়ল আমানুল্লাহর। স্টাডির তালা খুলে নিমির ঢুকে পড়া। তন্দ্রানীলার ফাইল পড়া। এত ফাইল থাকতে কেন তন্দ্রানীলা ওই ফাইলটাই পড়ল? আর কেন এত আগ্রহ নিয়ে সে ‘পাছাখানার ভূত’ বইটার কথা বলল? ভেতরে ভেতরে ভীষণ অস্থির বোধ করতে লাগলেন তিনি। জেগে থাকা অবস্থাতেই যেন তাকে বোবায় ধরেছে। নিমির মূর্তির মত বসে থাকার দৃশ্যটা ঝলসে উঠল চোখের সামনে। হিসাবটা অনেক কঠিন হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে।
ইন্টারকম বেজে উঠল।
“আমানুল্লাহ বলছি।”
“স্যার, বোসপাড়ায় একটা খুন হয়েছে।”
“জয়েনুদ্দীনকে খবর দাও। আমি বের হচ্ছি।” খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন আমানুল্লাহ।
নিজের কেবিন থেকে বের হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই একজন লোক কাঁচুমাচু হয়ে সালাম দিল। আমানুল্লাহ যথারীতি আলগোছে মাথা নাড়লেন।
****
বেশ বেকায়দায় পড়ে আছে সুভাষ সরকারের লাশ। ঘাড়টা মটকে গিয়েছে; ঘুরে গিয়েছে তিনশ বিশ ডিগ্রী কোণে। ডান হাতটা পেটের নিচে চাপা পড়েছে। হঠাৎ দেখলে কাপড়ের পুতুল বলে মনে হবে। জমাট বাঁধা টমেটো সসের মত রক্তের ভেতরে পড়ে আছে লাশটা। আঁশটে গন্ধ ছুটেছে।
ভিড় ঠেলে আমানুল্লাহ আসলেন। পেছনে পেছনে এলো আরো কয়েকজন এজেন্ট। এইবার কয়েকজন পুলিশও এসেছে সাথে। তবে তারা ভিড় সামলাতে ব্যস্ত। ভিড়ের ভেতরে বেশিরভাগই মহিলা। নাকে মুখে শাড়ি চাপা দিয়ে সাগ্রহে লাশের দিকে তাকিয়ে আছে। পুলিশ আসতে দেখেই সবাই মিলে কি যেন একটা বলা শুরু করল। কিন্তু এলোমেলো কোলাহল ছাড়া কিছুই শোনা গেল না।
জয়েনুদ্দীন আসলেন সবার শেষে।
বাড়ির আঙিনা হলুদ টেপ দিয়ে ঘিরে ফেলা হল। ক্রিমিনাল সিন, ডোন্ট ক্রস।
আমানুল্লাহ ক্লিনিক্যাল মাস্ক পরে লাশের দিকে তাকাতেই শিউরে উঠল সারা শরীর। তীক্ষ্ম কিছু দিয়ে মোরব্বার মত খোঁচানো হয়েছে মানুষটাকে।
জয়েনুদ্দীন ভাবলেশহীন। ক্লিনিক্যাল মাস্ক আর গ্লাভস পরে লাশটার কাছে গেলেন। জমাট রক্তে জুতার সোলের ছাপ পড়ল। লাশটাকে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলেন, একটু ঝুঁকে শুকলেন লাশটাকে। তারপর দোতলার বারান্দার দিকে তাকালেন। একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন এজেন্টকে ডেকে বললেন, “দোতলায় যাওয়া যাবে কি না দেখো তো।” এজেন্টটা আমানুল্লাহর কাছে অনুমতি চাইতে গেলেন।
আমানুল্লাহর কাছে তখন বোসপাড়া থানার ওসি দাঁড়িয়ে আছেন। হাত পা নেড়ে চেড়ে বলছেন, “এই বাড়িতে দুই ঘর পরিবারের বাস। সুভাষ দোতলার কোনার ঘরটায় ভাড়া থাকতেন। সাবলেট আর কি।”
“সাবলেট বলতে?” আমানুল্লাহ বললেন।
”সাবলেট বলতে, দোতলার মাঝখানের দুইটা ঘর নিয়ে সপরিবারে থাকতেন মনিচরণ ঘোষাল। উনারাও ভাড়া থাকতেন। নিচতলায় থাকতেন বাড়ির আসল মালিক, বিষ্ণুমোহন সার্নাল।” ওসি সাহেব বললেন। উনি আরো কিছু বলতেন।
আমানুল্লাহ তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “বাড়ির মালিককে একটু ডাকেন কথা বলব।” ওসি সাহেব মাথা নেড়ে সরে গেলেন। এজেন্ট এসে দোতলায় ওঠার অনুমতি চাইতেই আমানুল্লাহ মাথা নেড়ে অনুমতি দিলেন।
বিষ্ণুমোহন সার্নাল আমানুল্লাহর সামনে দাঁড়াতেই হড়বড় করে কথা বলতে শুরু করল, “সকালে একটা ভোঁতা শব্দ শুনি। গুরুত্ব দেই নাই। পরে যখন গুলির শব্দ শুনতে পাই, তখন তাড়াতাড়ি উঠে দরজা খুলতেই দেখি সদর দরজা খুলে এক লোক দৌড়ে বেরিয়ে গেল। আমরা তো চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করি।”
“আমরা বলতে?” আমানুল্লাহ বললেন। “আমরা বলতে আমি আর আমার ওপরের ভাড়াটিয়া। আমরা সদর দরজা দিয়ে বের হতেই দেখি একটা সিএনজি চলে গেল। খুনি ওই সিএনজিতে করেই এসেছিল অফিসার।” হঠাৎ কণ্ঠ আর্দ্র হয়ে গেল তার। “আর কাউকে দেখেননি?” লোকটা মাথা নাড়লেন, আর কাউকে দেখেননি তিনি। কান্না মাখা গলায় বললেন, “খুব মিশুকে লোক ছিল সুভাষ, খুব। কোন লোকের সাথে লাগতে দেখিনি। কথায় বলে না, ঠাকুর ভালো ফুলগুলোকেই আগে তুলে নেন।”
আমানুল্লাহ বললেন, “সিএনজিটার নাম্বার খেয়াল করেছিলেন?”
বিষ্ণুমোহন মাথা নাড়লেন, দেখেননি।
আমানুল্লাহ ওসি সাহেবকে ডেকে শহরের সবগুলো সিএনজি আর সিএনজি চালকদের ব্যপারে খোঁজ করতে বললেন। তারপর বিষ্ণুমোহনের দিকে ঘুরে বললেন, “আপনাদেরকে একটু থানায় যেতে হবে আমার সাথে। ওখানে কিছু কথা বলে আপনাদেরকে আবার বাড়িতে নামিয়ে দিয়ে যাব।’ বিষ্ণুমোহন কিছুই বললেন না। ফিছ ফিছ করে কাঁদতে লাগলেন।
জয়েনুদ্দীন দোতলার বারান্দা থেকে লাশটা দেখলেন। তিনি যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন ঠিক সেখান থেকেই ফেলা হয়েছে লাশটাকে। কিন্তু লাশটাকে নিচে কেন ফেলল খুনি? নাকি ভিকটিম একাই লাফ দিয়েছে? নাহ। যে মুহূর্তে লাশটাকে ফেলা হয়েছে সেই মুহূর্তে লাশটার নিজে থেকে লাফ দেওয়ার সামর্থ্য থাকার কথা না। তিনি এজেন্টটাকে বললেন, “সুভাষের ঘর কোনটা?” বারান্দার একেবারে শেষ মাথার দরজাটার দিকে আঙুল তুলল এজেন্ট। হঠাৎ জয়েনুদ্দীনের চোখ গেল আঙিনার কোণায় চৌবাচ্চাটার দিকে। চোখজোড়া সরু হয়ে গেল তার। কিছু না বলে সুভাষের দরজার দিকে হাঁটা শুরু করলেন।
আমানুল্লাহ সিঁড়ি ধরে উঠে আসলেন। পেছনে পেছনে উঠে আসলেন ওসি সাহেব। ওসি সাহেব বললেন, “ভিকটিমের ঘর সার্চ করে ফেলেছি।”
“এরই মধ্যে ঘর সার্চ করে ফেললেন!” আমানুল্লাহ বললেন।
“হ্যাঁ। যা কিছু পাওয়া গিয়েছে সেগুলো সব এভিডেন্স বক্সে রেখে দিয়েছি। আনবো?”
আমানুল্লাহ মাথা নাড়লেন। এই মুহূর্তে জয়েনুদ্দীনের কি বলে সেটা আগে শুনতে হবে।
সুভাষের ঘরের মেঝেতে আর বুক শেলফে রক্তের ছিটা। সারা ঘরে বইপত্র ছড়ানো ছিটানো। যেন ঝড় বয়ে গিয়েছে। দেয়ালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতে আঁকানো একটা প্রতিকৃতি। নিচে ছোট্ট করে স্বাক্ষর করা, চন্দন। প্রতিকৃতিতে রক্তের ছিটা লেগেছে। ঘরের মেঝেতে এলোমেলোভাবে রক্তের ছিটা। কয়েক জায়গায় ছোপ ছোপ রক্ত।
জয়েনুদ্দীন ক্লিনিক্যাল মাস্কটা খুলে ফেললেন। বারান্দায় এসে রেলিং-এর ওপরে হেলান দিয়ে দাঁড়ালেন। আমানুল্লাহ বললেন, “কিছু বুঝতে পারলেন?”
“লোকটা খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে। খুনি এলোপাতাড়িভাবে অস্ত্র চালিয়েছে।” জয়েনুদ্দীন একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন।
“ঠিক আগের খুনটার মত?” আমানুল্লাহর প্রশ্ন
“হ্যাঁ” জয়েনুদ্দীনের ছোট্ট জবাব।
“খুনি প্রথমে দরজায় নক করে। নক করার কিছুক্ষণ পরে খুনি দরজা খোলে। খুনি সুভাষের পূর্বপরিচিত। তাই দরজা খোলার সময় খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি খুনিকে। দরজার কাছে ঝাপটাঝাপটির কোন চিহ্ন নেই। খুনি প্রথমে চেয়ারটাতে বসে। ওই যে ঐ বেতের চেয়ারটাতে। সুভাষ বসে খাটে। বেশ কিছুক্ষণ দুইজনের ভেতরে কথা হয়। কথার বিষয় বস্তু যা ছিল তা নিয়ে দুজনের ভেতরে একটা টেনশন কাজ করছিল। এশট্রেতে জমে থাকা বেশ কয়েকটা সিগারেটের ফিল্টারই তার প্রমাণ। ওগুলো এক-দেড় ঘণ্টার বেশি পোড়ানো হয়নি। যাই হোক, এক পর্যায়ে হয়ত দুজনের ভেতরে তর্ক শুরু হয়। আর খুনি তর্কের ভেতরেই অস্ত্র দিয়ে সুভাষের গলায় অথবা গলার আশেপাশে প্রথম আঘাতটা করে। কারণ ওই জায়গাটাতে রক্তের চাপ থাকে সব থেকে বেশি। কোন একটা শিরা কেটে যাওয়ার ফলে ফিনকি দিয়ে রক্ত ছিটকে পড়ে ঘরের মেঝেতে আর বইয়ে। সুভাষ পড়ে যায়। খুনি এলোপাতাড়িভাবে আরো কয়েকটা আঘাত করে। আঘাত করার পরে সুভাষ অচেতন হয়ে পড়ে। কিন্তু খুনি ভাবে সুভাষ মারা গিয়েছে। সে কিছু একটা খুঁজতে থাকে। এলোমেলো ঘরটাই তার প্রমাণ। এরই মধ্যে সুভাষ চেতনা ফিরে পায়। সে আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোতে থাকে। ওই যে, রক্তের দাগটা দেখলেই বোঝা যাবে। সেই সময়ে হয়ত সে সাহায্যের জন্য কাউকে ডেকেছিল। তাই খুনি রাগের মাথায় তীক্ষ্ম অস্ত্র দিয়ে সুভাষের গাল ফুটো করে দেয়। এবারকার এলোপাতাড়ি আঘাতে সুভাষের মৃত্যু নিশ্চিত হয়। তারপর সে চলে যায়। কিন্তু লাশটাকে এভাবে বারান্দা থেকে ফেলে দেবে কেন? জয়েনুদ্দীন নিজেকেই যেন নিজে প্ৰশ্ন করলেন।
“বাড়ির লোকজন খুনিকে পালাতে দেখেছে একটা সিএনজিতে করে।” আমানুল্লাহ বললেন, “কিন্তু বিষ্ণমোহন যে বলল ওরা গুলির শব্দ শুনেছে? নাহ, কোথাও একটা ঝামেলা হচ্ছে জয়েনুদ্দীন।”
জয়েনুদ্দীন এবার এগিয়ে এসে বললেন, “চৌবাচ্চার পাশের দরজাটা কি সব সময় খোলাই থাকে?”
আমানুল্লাহ এতক্ষণ খেয়াল করেননি। খুনি সদর দরজা দিয়ে পালিয়েছে। কাজেই ওই দরজাটার দিকে সেভাবে চোখ পড়েনি।
“কেন বলেন তো?” আমানুল্লাহ বললেন।
“না এমনি” জয়েনুদ্দীন বললেন।
আমানুল্লাহ তারপর গম্ভীর মুখে নিচে নেমে গেলেন। সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে বললেন, “জয়েনুদ্দীন সাহেব, এবারের মার্ডারের ওয়েপনটাও কি ……”
“হ্যাঁ, কলম।”
আমানুল্লাহ বারান্দার রেলিং-এর ওপরে ভর দিয়ে আশেপাশের বাড়িগুলোর ছাদ দেখার চেষ্টা করলেন। বেশিরভাগ ছাদেই কৌতূহলী মানুষের ঢল। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলেন তিনি- খুনি কি এমন খুঁজছিল? কি এমন থাকতে পারে সুভাষের কাছে? সেটা কি সে পেয়েছে? নাকি সেটা না নিয়েই পালিয়েছে?
ওসি সাহেব ছোট্ট একটা পলিব্যাগ নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ওপরে উঠে আসলেন। আমানুল্লাহর দিকে বাড়িয়ে ধরলেন সেটা। বললেন, “ভিকটিমের খাটের নিচের কাঠ সরিয়ে এইটা পাওয়া গিয়েছে।”
কি ওটা?
একটা পেনড্রাইভ।
আর্টেমিসের পরিকল্পনা
একটা ভোঁতা শব্দ হল আবার। তবে এবারকার আওয়াজটা একটু জোরেই হল। ভদ্রলোক কান পাততেই শব্দটা থেমে গেলো। পৃষ্ঠা উল্টালেন তিনি। আবার বলতে শুরু করলেন, “লেখকের মনের ভেতরে একটা চাপা আগুন থাকা বাঞ্ছনীয়। এমন এক আগুন, যা নিভবে না। কিন্তু সেটা সাবধানে সংরক্ষণ না করলে সবাইকে জ্বালিয়ে দেবে। যেমন রুশো আর ভলতেয়ারের ভেতরের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল পুরো ফ্রান্স। যে লেখক যত সাবধানে সেই আগুন বয়ে নিয়ে বেড়াবে- তার লেখা ততটাই তপ্ত হবে। লেখককে নিজের আগুনে পুড়তে হবে।”
***
ফ্রিজ খুলে বরফের কেসটা খুঁজতে লাগল নীরু। ফ্রিজের ভেতরের জ্বলে ওঠা আলোতে আলোকিত হয়ে উঠল ক্ষুরধার তীক্ষ্ণ মুখটা। ডান দিকের ড্রয়ার থেকে বরফের কেসটা নিয়ে ড্রইং রুমে আসল। একটা তোয়ালে এনে তাতে সবগুলো বরফ ঢালল। কড় কড় করে শব্দ হল। তোয়ালেটা মুড়িয়ে পুঁটলির মত করে বাড়িয়ে ধরল তৈমুরের দিকে।
“আগেই বলছিলাম ম্যডাম, ওই সুকান্ত শয়তানটাই স্যারকে খুন করছে। আমি সাত বছর স্যারের বডিগার্ড হিসাবে কাজ করেছি। বুঝতে পারি কে শয়তান আর কে ফেরেশতা।” বরফ ভর্তি গামছার পুঁটলিটা কাঁধে চেপে ধরতে ধরতে বলল তৈমুর। তাড়াতাড়ি করে দরজা দিয়ে বের হয়ে আসতে গিয়ে কাঁধের মাংসপেশীতে খুব বাজেভাবে ধাক্কা খেয়েছে। থেঁতলে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। “আমি জানতাম কিছু একটা হবেই। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ভেতরে ধুপধাপ শব্দ হতেই দৌড়ে গিয়ে দেখি সুকান্ত একটা লাশ ফেলে রেখে বাড়ির পেছন দরজা দিয়ে পালাচ্ছে। আমি গুলিও চালিয়েছিলাম পা বরাবর। অন্ধকারে সুবিধা করতে পারিনি।” বলল তৈমুর।
নীরু সব কথা শুনল। একটা কাঁচের গ্লাসে গ্রিন টি রাখা ছিল। একটা বরফের কিউব তুলে নিয়ে সেটাতে দিয়ে আলতো করে চুমুক দিল। গ্লাসটা ঝাকিয়ে ভালো করে বরফটা গুলাতে গুলাতে প্রশ্ন করল, “পেনড্রাইভটা পাওয়া গিয়েছে?”
তৈমুর বলল, “না। গুলির শব্দ শুনে বাড়ির বাকিদের ঘুম ভেঙে যায়। আমি রিস্ক নিতে পারিনি। চলে এসেছি। আমার যতদূর মনে হয় সুকান্তের কাছেই পেনড্রাইভটা আছে। ওই জানোয়ারটাই লোকটাকে মেরে পেনড্রাইভটা নিয়ে পালিয়েছে।”
ঠং করে কাঁচের গ্লাসটা টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে বলল নীরু, “ওইটুকু সময়ের ভেতরে কাউকে মেরে আবার পেনড্রাইভ নিয়ে আসাটা কঠিন। তবে, কি যেন নাম বলছিল? সুভাষ না? হ্যাঁ, যেহেতু সুভাষ ওর পরিচিত ছিল, তাই খুন করে পেনড্রাইভ নিয়ে পালিয়ে যেতে বেশি সময় লাগার কথা না।”
“আমিও তো সেটাই বলছি ম্যডাম।”
“কিন্তু গুলি চালানোটা তোমার ঠিক হয়নি তৈমুর। এটা নিয়ে অনেক ঝামেলা হবে। এরকম যেন আর না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবা।”
“জ্বি ম্যাডাম।”
গ্লাসের শেষ গ্রিন টি টুকু গলায় ঢেলে নীরু বলল, “ওকে বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে। আগে জানলে কোল্ড স্টোরেজের ভেতরেই শেষ করে দিতাম। ওই জানোয়ারটা অনেকদিন ধরেই বাবার খ্যাতির প্রতি হিংসা করত। যদি জানতাম ও বাবাকে এইভাবে খুন করবে…” ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিয়ে রাগ চাপা দিল সে। তারপর বলল, “আমি যখন আর্মিতে ছিলাম, তখন আমাদেরকে একটা বিষয় শেখানো হত। সব সময় এটা চিন্তা করতে হবে, শত্রু কি চায়। শত্রুর পরের পদক্ষেপ কেমন হবে। শত্রুর পরের পদক্ষেপ কি সেটার অনুমানের ওপর নির্ভর করে যুদ্ধে জয়ের সম্ভাবনা। যত স্ট্র্যাটেজিই ফলো করা হোক না কেন, শত্রুর গতিবিধি না জানতে পারলে কিছুই হবে না। যদি ওর কাছে পেনড্রাইভটা থাকেই, তাহলে প্রথমে ও কোথায় যাবে? বাবা কি এমন তথ্য ঐ পেনড্রাইভের মধ্যে রেখে গিয়েছে? সময় কম তৈমুর। ওর কাছে যদি পেনড্রাইভ থাকে, তাহলে ও সেটা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নষ্ট করে ফেলার চেষ্টা করবে। কারণ, ও জানত, বাবা ওই পেনড্রাইভের ভেতরে ওর যত অপকর্মের কথা লিখে রেখে গিয়েছে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর কাছ থেকে পেনড্রাইভটা উদ্ধার করতে হবে তৈমুর।” চাপা রাগে কাঁচের গ্লাসটা আঁকড়ে ধরল সে। নখগুলো সাদাটে হয়ে গেল। অনেক কষ্টে নিজের রাগ সংবরণ করছে সে।
তৈমুর বরফের পুঁটলিটা হাত বদল করতে করতে বলল, “ওকে কোথায় পাওয়া যেতে পারে ম্যডাম?”
কাঁচের গ্লাসটা দেয়ালে ছুঁড়ে মারল নীরু। চিৎকার করে এতক্ষণের চেপে রাখা রাগের বহিঃপ্রকাশ করল সে। গলা চিরে তীক্ষ্ম চিৎকার বেরিয়ে এলো। বলল, “তুমি ওকে পালাতে কেন দিলে তৈমুর!” জেদ মাখানো রাগে থর থর করে কাঁপতে লাগল নীরু।
ড্রইংরুমে নেমে এলো রাজ্যের নীরবতা।
নীরু ভেতরের ঘরে চলে গেল। রাগ লুকাতে। অথবা অন্য কোন কারণে।
তৈমুর নিরুত্তর। হয়ত সে ও তার ভুল বুঝতে পেরেছে। যে মানুষটার বডিগার্ড ছিল সে, তাকে তো বাঁচাতে পারলই না, সেই মানুষটার আততায়ীকেও কে পালাতে দিল। এই তার হাতের নিশানা? কয়েকগজ দূরের একটা টার্গেট সে মিস করল? হঠাৎ পাশের টি’পয়ের রাখা ফটো ফ্রেমের ওপরে রাখা একটা ছবিতে চোখ পড়ল।
নীরুর ছবি, সেনাবাহিনীর ইউনিফর্মে। হাতে ধরা একটা স্নাইপার রাইফেল। তের বছর আগের ছবি এটা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অন্যতম সেরা স্নাইপার ছিল সে। দুটা শান্তি রক্ষা মিশনেও অংশ নেয়। কিন্তু দুই বছর আগে কোন এক কারণে তাকে সেনাবাহিনী থেকে ডিসচার্জ করা হয়েছিল। কেউ বলে, রগচটা স্বভাবের কারণে তাকে ডিসচার্জ করা হয়। কেউ বলে সে নিজেই অব্যহতি পত্র দিয়ে সেনাবাহিনী থেকে বের হয়ে আসে। কিন্তু কেন সে সেনাবাহিনী ছেড়ে আবার সাধারণ মানুষের জীবনে ফিরে এলো, এটা একটা রহস্য।
নীরুর পায়ের শব্দ পেতেই সোজা হয়ে বসল তৈমুর। টেবিলের ওপরে একটা লেখার প্যাড আর একটা কলম রাখতে রাখতে বলল খুব স্বাভাবিক গলায় বলল, “মন দিয়ে শোন। প্ল্যানটা বলি।”
****
একটা বাড়ির ছাদের ওপর থেকে সব দেখতে পেয়েছিল সুকান্ত। পুলিশ আর ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের লোকজনে ভরে গিয়েছিল পুরো বাড়িটা। চোখের সামনে সব শেষ হতে দেখাটা সহজ না। সুভাষদার লাশটাকে সাদা স্ট্রেচারে তুলে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটা দেখে বুকের ভেতরটা যেন শ্মশানের আগুনের মত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। রমাকান্তের পরে এই মানুষটাকেই সে বাবা বলে মেনে এসেছে। হাতে ধরে এই মানুষটাই তো তাকে কাজ দিয়েছিল, কাজ শিখিয়েছিল। তার জীবনের দুঃখ, আনন্দ, অভিমান আর ক্ষণস্থায়ী রাগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই মানুষটা। আঁকড়ে ধরেছিল সে মানুষটাকে। এতগুলো বছর এই লোকটা তাকে কাজ এনে দিয়েছে, একবারের জন্যও কমিশন চায়নি; বলেনি- সুকান্ত, তোরে কাজ আইন্যা দেই বদলে আমারে কিছু দে।
কিন্তু মানুষটাকে বাঁচাতে পারল না সুকান্ত। লেখক হয়ে সে কত গল্পের কত উপন্যাসের চরিত্রকে অবলীলায় জীবন দান করেছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে তাকে মেনে নিতে হয়েছে প্রিয়জন হারানোর পরাজয়। নীহারিকা, রমাকান্ত, লক্ষমন্ত; আর আজ সুভাষ। রাগে ক্ষোভে কাঁধ আর গলার ক্ষতটা যেন জ্বলে উঠল দপ করে। দাঁতে দাঁত চেপে চোখের পানি ফেলা ছাড়া সুকান্তের আর কি করার আছে?
সুভাষদা যে বাড়িতে থাকত সেই বাড়ির বারান্দা থেকে এক মাঝবয়সী ভদ্রলোক ছাদের দিকে তাকাতেই সুকান্ত সরে গেল। এই মুহূর্তে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে যেভাবেই হোক। সরু সিঁড়িটা দিয়ে নামতে নামতে নিজেকে বোঝাল সে। খুনি যদি পেনড্রাইভ নিয়ে থাকে, তাহলে যত দ্রুত সম্ভব সেটা উদ্ধার করতে হবে। যেহেতু খুনি সুভাষদাকে খুন করেছে, সেহেতু সে পেনড্রাইভটাও নিয়েছে। ওটা না পাওয়া পর্যন্ত অনেকগুলো জীবন এভাবে ঝরে যাবে।
তোলপাড় হতে থাকা ভেতরটা নিয়ে সুকান্ত ভিড়ের ভেতরে হারিয়ে গেল।