শব্দযাত্রা লেখক সংঘ – ৩

লাশের ডাক্তার 

ভদ্রলোক থামলেন। লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে পাতা উল্টালেন। বললেন, “লেখকরা মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে না, কখনও না। লেখকদেরকে জীবন দেখতে হয়। মৃত্যু দেখতে হয়। মানুষের যন্ত্রণা দেখে মুখ ফিরিয়ে নেওয়া মানুষেরা লেখক হতে পারে না। লেখককে মানুষের যন্ত্রণা দেখতে হবে। হতাশ মানুষের প্রতিকৃতি দেখতে হবে। মানুষের হাস্যজ্জল মুখ দেখতে হবে। মানুষে মানুষে কলহ দেখতে হবে। মানুষে মানুষে প্রণয় দেখতে হবে। প্রিয় অপ্রিয় সব কিছু দেখতে হবে।” 

**** 

চোখের গর্তদুটোতে মাছি বসছে। শুকিয়ে যাওয়া রক্ত আর গলে যাওয়া মনির সাদাটে অংশের ওপরে কিছুক্ষণ ঘুর ঘুর করছে। তারপর উড়ে গিয়ে হা করে খোলা মুখের ভেতরে ঢুকছে। পাংশুটে ঠোঁটজোড়ার খানিকটা কিছুতে যেন খেয়ে নিয়েছে, তেলাপোকা বা ইঁদুরে হয়ত। খাস্তা পরোটার ওপরের খোসার মত শরীরের চামড়া উঠে গিয়েছে কোথাও কোথাও। পুরো মুখমণ্ডলটাও কিসে যেন খুব বাজেভাবে ঝলসে গিয়েছে। 

টর্চের আলো পড়ার সাথে সাথে কয়েকটা তেলাপোকা নাকের ডান ফুটোর ভেতরে ঢুকে গেল। শুধু শুঁড়গুলো বাইরে বের হয়ে নড়তে থাকল। মুখের ভেতর থেকে অনেকগুলো মাছি উড়ে গেল। বেশির ভাগই ডাঁশা মাছি। 

ক্লিনিক্যাল মাস্ক পরা ভদ্রলোক টর্চের আলোটা সরিয়ে বুকের ক্ষতগুলোর ওপরে ফেললেন। কয়েকটা ধেড়ে ইঁদুর লাফিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল। নীল রঙের ক্লিনিক্যাল গ্লাভস পরা হাতের আঙুলগুলো শরীরের এখানে ওখানে ভেসে বেড়াতে লাগল। 

“কতক্ষণ আগে হয়েছে বলে মনে হয়?” পেছনে দাঁড়ানো মাঝারি উচ্চতার ভদ্রলোকটা বললেন। মুখে রুমাল চাপা দেওয়া থাকলেও বার বার থু থু ফেলছেন। ইনি এজেন্ট আমানুল্লাহ আমান। সাথে আছেন উনার অধীনে চারজন শিক্ষানবিশ এজেন্ট। সাইদুর, এলিন, আরাফ আর মল্লিকা। মাত্র দুই সপ্তাহ হল তারা জয়েন করেছে। 

ক্লিনিকাল মাস্ক পরা ভদ্রলোক মুখের ভেতরটায় টর্চের আলো ফেললেন। তারপর বললেন, “কতক্ষণ আগে না, বলেন কত দিন আগে।” 

“মানে? খুন আজকে হয়নি?” আমানুল্লাহ আমান বললেন। 

“উঁহু। নাহ। খুন মোটামুটি আরো দুইদিন আগে হয়েছে।” চিমটা দিয়ে কয়েক টুকরো চামড়া নিয়ে শুঁকে আমানুল্লাহ আমানের দিকে তাকালেন। 

আমান বললেন, “কিন্তু লাশ তো একেবারে ফ্রেশ মনে হচ্ছে। শুধু রক্ত শুকিয়ে গিয়েছে।” 

“লাশের সারা শরীরে লবণ। এই কারণে লাশটা পঁচে নাই, মমির মত শুকিয়ে গিয়েছে।” পলিব্যাগটা এভিডেন্স বক্সে রাখতে রাখতে তিনি বললেন। সারা ঘরে প্রমাণ সংগ্রহের কাজ চলছে। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের জ্যাকেট পরা এজেন্টরা খুটীয়ে খুঁটিয়ে প্রতিটা আসবাব পত্র দেখছে। যাদের ভেতরে সাইদুর, এলিন, আরাফ আর মল্লিকাও আছে। 

মাস্ক পরা ভদ্রলোকটা এজেন্ট আমানুল্লাহকে বাইরের দিকে ইশারা করলেন। দুজনেই ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ালেন। তিনতলার ব্যালকনি থেকে নিচে দাঁড়ানো এ্যাম্বুলেন্স আর ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের সিল লাগানো প্রাইভেট কারগুলো দেখা যাচ্ছে। হালকা ভিড় জমেছে। কিছুক্ষণের মধ্যে ভিড় বাড়বে। 

ভদ্রলোক মাস্ক খুলতেই দাড়ি গিজ গিজ করা মুখটা বের হয়ে এলো। ইনি জয়েনুদ্দীন। বয়স পঞ্চাশের বেশি হবে। যতটা বেশি মনে হওয়া উচিৎ তার থেকেও বেশি মনে হয় তার মুখ ভর্তি দাড়ি গোঁফ আর গোল ফ্রেমে আটকানো মোটা কাঁচের চশমার জন্য। তার অতীত সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। বেশিদিন এক জায়গায় থাকেন না। অনেকে বলে তিনি প্যারাসাইকোলজির অধ্যাপক ছিলেন, অনেকে বলে মর্গের ইনচার্জ ছিলেন। সত্য মিথ্যা যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেনি কেউ। তাই যে যা বলে সবাই সেটাই বিশ্বাস করে নেয়। তবে তার নামে কোন থানায় কখনও কোন অভিযোগ পত্র দাখিল হয়েছে এমনটা শোনা যায়নি। লোকটার চালচলন অদ্ভুত। আর তার একটা অদ্ভুত ক্ষমতাও আছে, সুরতহাল ছাড়াই তিনি বলে দিতে পারেন কিভাবে আর কখন খুন করা হয়েছিল। ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের অন্যতম বিশ্বস্ত ‘ফ্রিল্যান্স প্যারা-ফরেনসিক’। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের সাথে যুক্ত আছেন। একটা অজ্ঞান পার্টির কেস নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সিনিয়র ফিল্ড এজেন্ট প্রণবের মাধ্যমে এই লোকটার সাথে প্রথম পরিচয় আমানুল্লাহর। তাও প্রায় মাসখানেক আগে। নিরহংকার এবং স্বল্পভাষী মানুষ এই জয়েনুদ্দীন। 

“খুনি প্রফেশনাল না।” ঠোঁট উল্টে জয়েনুদ্দীন বললেন, “খুন করার উদ্দেশ্য থাকলেও খুনের মোটিভ শক্তিশালী ছিল না। খানিকটা দ্বিধা কাজ করছিল মনে। প্রতিহিংসার বশে খুন করা হয়নি এটা নিশ্চিত। পুলিশকে খবর দিলো কে?” 

আমানুল্লাহ রেলিং-এর ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, “পাশের ফ্ল্যাটে একজন বৃদ্ধা থাকেন। তার কেয়ারটেকার, মিস ফার্লিনাই পুলিশকে খবর দিয়েছে। উৎকট গন্ধ বের হচ্ছিল। যাই হোক, উনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। উনি ভোরে আসেন, রাত দশটায় চলে যান। সৈকত সারওয়ারের রুম থেকে কাউকে বের হতে বা রুমে ঢুকতে দেখেননি। আপনি চাইলে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেন।” 

“দরকার নেই। খুনি যেই হোক, সে নিজে থেকে খুন করেনি। তাকে দিয়ে খুন করানো হয়েছে। ম্যনুপুলেটিং মার্ডার।” জয়নুদ্দীন বললেন। 

“কিভাবে বুঝলেন?” আমানুল্লাহর প্রশ্ন। 

“আসেন বলছি।” জয়েনুদ্দীন ভেতরে গেলেন। আমানুল্লাহ তাকে অনুসরণ করলেন। 

লাশের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ক্লিনিক্যাল মাস্কটা পরে জয়নুদ্দীন বললেন, “শুরু থেকে বলছি। খুনি লাশের পূর্বপরিচিত ছিল। কলিংবেল শোনার সাথে সাথে লাশ দরজা খুলে দেয়।” 

আমানুল্লাহ অনিচ্ছাকৃতভাবে জয়নুদ্দীনকে মাঝখানে থামিয়ে দিলেন, “লাশ লাশ কেন বলছেন? উনার নাম সৈকত সারোওয়ার। বিশিষ্ট ফিল্ম ডিরেক্টর, প্রডিউসার আর…” 

“মৃত্যুর পরে লাশ তো লাশই। তার আর কোন আইডেন্টিটি থাকে না। কখনও শুনেছেন কোন লাশ নিজের আইডেন্টিটির জন্য লড়াই করছে? তবে আপনার আপত্তি থাকলে আমি নাম ধরেই বলছি। দয়া করে মাঝখানে থামাবেন না।” জয়নুদ্দীন বললেন। 

“যা বলছিলাম। খুনি ঘরে ঢোকার পরে সৈকত সারওয়ার খুনিকে বসতে দেন। কিছুক্ষণ কথাবার্তা হয়। তারপর সৈকত সাহেব খুনিকে হয়ত কোন ড্রিংক্স অফার করেন। খুনি বলে সে কফি খাবে। অথবা হয়ত সৈকত সাহেব তাকে সরাসরি কফিই অফার করেন। কফি মেকারটা নষ্ট, দেখতেই পাচ্ছেন। বেশ আগে থেকেই হয়ত নষ্ট। তাই তিনি গ্যাসের চুলায় পানি চাপান। খুনিও উঠে কিচেনে আসে। কিচেনেই কথাবার্তা চলতে থাকে। পানি ফুটে গেলে সৈকত সাহেব তাতে কফি দিতে যাবেন, এমন সময়েই হামলাটা করা হয়েছে। কারণ, কফি বানানোর পানিতে কফি আর চিনি দিতে হয়, পরিমাপ মত, এই সময়ে একটু বেশি মনযোগ দিতে হয়। খুনি এটা কাজে লাগিয়েছে। 

“প্রথমে ঘাড়ে লবণ মিশ্রিত কোন একটা ঘন দ্রবণ ইনজেক্ট করা হয়েছে। দ্রবণটা অনেক ঘন থাকায় সৈকতের ব্লাড প্রেসার ফল করেছে। ব্লাড প্রেসার ফল করার ফলে সে আরো বেশি দূর্বল হয়ে যায়। তারপর প্রথম আঘাতটা করা হয়েছে। আঘাতটা যখন করা হয় তখন খুনি ছিল দ্বিধাগ্রস্ত। তাই ক্ষতটা ততটা গভীর না। সৈকত সারোওয়ার ঘুরে দাঁড়ান। কিন্তু এই অতর্কিত আক্রমন, সেটা যতই ছোট হোক, তিনি সামলাতে পারেননি। হাতের কাছে খালি মগ ছিল, যেটাতে কফি ঢালা হত, সেটা দিয়েই খুনির মাথা বরাবর মারতে গিয়েছেন। লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। দেখতেই পাচ্ছেন সিংকের পাশে ভাঙা মগের টুকরো পড়ে আছে। সিংক কিন্তু চুলার একেবারেই বিপরীতে। 

“যাই হোক, সৈকতের হাতের ধাক্কায় চিনির কৌটা পড়ে দিয়েছে। চিনির ওপরে থাকা পায়ের দাগগুলো দেখলেই বুঝবেন, খুনি সিংকের কাছ থেকে সরে গিয়ে ঘুরে চুলার কাছে এসেছে। আর সৈকত সারওয়ার খুনিকে ধরতে সিংকের কাছে গিয়েছেন। খুনি চুলার ওপর থেকে ফুটন্ত গরম পানির সসপেনটা তুলে সৈকতের দিকে ছুঁড়েছে। আর গরম পানিতেই সৈকতের মুখমণ্ডলসহ চোখের মনি গলে গিয়েছে। এর পর খুনির জন্য কাজটা অনেক সহজ হয়ে যায়। সে ধারালো অস্ত্রটা নিয়ে সৈকতের পিঠে এলোপাতাড়ি অনেকগুলো আঘাত করে। যদিও অস্ত্রটা শ্বাসনালীতে বসিয়ে দিলে তাকে আর বেশি কষ্ট করতে হত না, কিন্তু যেহেতু খুনি প্রফেশনাল না, তাই সে এলোপাতাড়িভাবেই অস্ত্রটা বসিয়েছে। সৈকত অবশ্য অত সহজে হাল ছাড়েনি। খুনিকে ছিটকে পাশের কিচেন কেবিনেটের ওপরে ছুঁড়ে ফেলেছে। কেবিনেটের ভাঙা কাঁচ আর রক্ত মাখা হাতের ছাপ দেখলেই বোঝা যায় সেটা। 

“খুনি ভয় পেয়ে যায়। ধাক্কা দিয়ে আর্তনাদরত সৈকতকে ফেলে দেয়। কিচেনের প্ল্যাটফর্মের সাথে মাথা ঠুকে গেলে সে জ্ঞান হারায়। ওই যে, প্ল্যাটফর্মের ওপরে কিছু চুল আর রক্ত পড়ে আছে। ফুটন্ত গরম পানির কারণে সৈকতের চুলগুলো উঠে যেতে থাকে। সব কিছু আনাড়ির মত, কিন্তু ‘লবণের মিশ্রণ’ ইনজেক্ট করার ব্যাপারটা খুব বেশি রকমের প্রফেশনাল। তার মানে একটাই দাঁড়ায়, খুনি নিজে খুন করেনি। তাকে দিয়ে খুন করানো হয়েছে।” 

জয়নুদ্দীন অবলীলায় বলে গেল কথাগুলো। 

“তাহলে মৃত্যু হল কি করে?” আমানুল্লাহ আমান জিজ্ঞাসা করলেন। তার কপালে কুঞ্চিত চামড়ার হিজিবিজি দাগ। চোখ মুখের মাংসপেশী শক্ত। আশেপাশে ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের যারা আলামত সংগ্রহ করছিল, তারাও মন্ত্রমুগ্ধের মত এতক্ষণ জয়নুদ্দীনের কথা শুনছিল। জয়নুদ্দীনের কথা শেষ হতেই তাদের ভেতরে একজন মেয়ে ‘ওয়াক’ করে উঠল। আমানুল্লাহর চোখে গেল ঘরের এক প্রান্তে টিপয়ের এক পাশে পড়ে থাকা একটা কলমের দিকে। কলমের কালি ফুরিয়ে গিয়েছে। খুনি কি তাহলে কিছু লিখছিল? কি লিখছিল? খুনের সাথে লেখার কি সম্পর্ক। ইচ্ছে করেই কলমটা জয়েনুদ্দীনকে দেখালেন না আমানুল্লাহ। এই ব্যাপারটা নিয়ে তিনি ভাববেন। 

জয়নুদ্দীন বললেন, “কার্ডিয়াক এরেস্ট। মানে হৃদপিন্ড কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। রক্তে অতিরিক্ত লবণ মিশে যাওয়ার ফলে হার্ট রেট কমে যায়। ব্লাড প্রেসার ফল করে। সৈকত অচেতন হয়, সেই চেতনা আর ফেরেনি।” 

নেমে এল এক নাতিদীর্ঘ নীরবতা। 

“কিন্তু ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে তো সে বিষও ইঞ্জেক্ট করতে পারত। সেটা করেনি কেন?” আমানুল্লাহ জিজ্ঞাসা করলেন। 

জয়েনুদ্দীন ভ্রু কুঁচকে গেল। বললেন, “সেটাই তো বুঝতে পারছি না আমানুল্লাহ সাহেব। মনে হচ্ছে সম্ভবত খুনির প্রফেশনালিজমের অভাবের কারণেই এমনটা হয়েছে।” 

“আর একটা প্রশ্ন” আমানুল্লাহ বললেন, “খুনী কি একজন মেয়ে ছিল? কারণ ভিকটিমের শরীরে লম্বা কয়েকটা চুল পাওয়া গিয়েছে। হয়ত ধস্তাধস্তির সময় কয়েকটা চুল ছিঁড়ে গিয়েছে। 

জয়েনুদ্দীন মুচকি হেসে বললেন, “যদি সব বলে দিলাম তো আপনাদের কাজ কী? ওটা আপনারাই বের করেন। ওটা নিয়ে কিছু বলার থাকলে নিশ্চয়ই বলতাম।” 

আমানুল্লাহ আবার বললেন, “কিন্তু সরু ধারালো অস্ত্রটা কি সেটা তো অন্তত বলবেন? 

“কলম” জয়নুদ্দীন বললেন। 

প্রতিশোধ 

আরেক দফা পৃষ্ঠা উল্টালেন ভদ্রলোক। এবার খস খস করে শব্দ হল। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে বললেন, “রহস্যময়তার মুখোমুখি হওয়া জরুরী। লেখক যত বেশি রহস্যময়তার মুখোমুখি হবে, তত ভালো সে লিখতে পারবে। এখন আপনাদের মধ্যে থেকে কেউ বলেন, এই প্রকৃতির সব থেকে বড় রহস্যময় সৃষ্টি কি?” 

একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “নারী।” 

ভদ্রলোক বললেন, “যদি কোন নারীর কাছে আপনি কোন কিছু আশা করে বসেন, তাহলেই সে আপনার কাছে রহস্যময়ী হয়ে উঠবে। আপনার মাকে কি আপনার রহস্যময়ী মনে হয়? নিশ্চয়ই না। আপনার স্ত্রীকে কি আপনার রহস্যময়ী মনে হয়? না। আপনার কাছে এরা খুব সাদাসিধে মানুষ। কিন্তু যখনই আপনি একজন অপরিচিত নারীর কাছে কিছু আশা করবেন, সেটা ভালোবাসা হতে পারে বা সেটা অন্য কিছু হতে পারে, তখনই সেই নারী আপনার কাছে রহস্যময়ী হয়ে উঠবে। নারীদের ভেতরে রহস্যের কিছু নেই। আর কেউ?” 

“মানুষের মন” ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বলে উঠল। 

ভদ্রলোক উত্তর দিলেন, “নিজের মন নাকি অন্যের মন? যদি নিজের মন নিজের কাছেই রহস্যময় মনে হয়, তাহলে বুঝতে হবে, আপনি নিজের কাছে নিজেই এখনও অজ্ঞ। নিজেকে এখনও ঠিকমত চিনতে পারেননি। আর মন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত মানুষের চাইতে ভয়ানক কিছুই নেই। আর অন্যের মন হলে বুঝতে হবে, আপনার কমন সেন্সের অভাব আছে। আপনার মন যেভাবে একটা জিনিস ব্যখা করবে, আরেকজনের মন হয়ত সেভাবে ব্যখা নাও করতে পারে। আর সেটা যদি হয়, তাহলে তাকে আপনার রহস্যময় মনে হবে। নিজের মন দিয়ে অন্যকে বোঝার চেষ্টা করলে এই দুনিয়ার সবাইকে রহস্যময় মনে হবে।” 

আর কোন উত্তর আসলো না ভিড়ের মধ্যে থেকে। ভদ্রলোক নিজেই নিজের প্রশ্নের উত্তর দিলেন, “প্রকৃতি নিজেই একটা রহস্য। একে যে দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখা করা যাক না কেন, এ কখনওই একই রূপে আবির্ভূত হবে না। ধার্মিকদের কাছে প্রকৃতি একরকম, অধার্মিকদের কাছে এক রকম, আস্তিকদের কাছে এক রকম, নাস্তিকদের কাছে আরেকরকম, বিজ্ঞানের কাছে এক রকম, দর্শনশাস্ত্রের কাছে আরেকরকম। কোনভাবেই প্রকৃতির আসল রূপ নির্ধারন করা সম্ভব হয়নি, হবেও না।” 

**** 

জায়গাটা অচেনা মনে হচ্ছে। আবছায়া আলো আঁধার। যতই যাওয়া হচ্ছে, ততই আলোর পরিমাণ কমছে। বাড়ছে অন্ধকার। মনে হচ্ছে, এই সন্ধ্যা নেমে গেল, আবার মনে হচ্ছে, কেবল সূর্য উঠল বলে। আশেপাশে গাছপালা। খুব দূর থেকে কেউ ডাকছে। মাটিটাও কেঁপে কেঁপে উঠছে একটু পর পর। শুধু শুধু মাটি না, মনে হচ্ছে আকাশটাও কেঁপে উঠছে। হঠাৎ কিসে যেন ধাক্কা দিতেই সুকান্ত ঝপ করে গভীর পানিতে পড়ে গেল। 

জ্ঞান ফিরল সুকান্তের। কপালের ডান দিকটা প্রচণ্ড ব্যথায় দপ করে উঠল। মুখ দিয়ে চাপা গোঙানি বের হয়ে এল। খক খক করে কেশে উঠল সে। 

চোখ খুলেও মনে হল চোখ বন্ধই করে আছে সে। ধাতস্ত হতে কিছুটা সময় লাগল। তারপর কয়েকবার চোখ খুলে আর বন্ধ করে পুরো ব্যাপারটা বুঝতে আরো কিছুটা সময় লাগল তার। সে যেখানে আছে সেই জায়গাটাই অন্ধকার। ডান দিকের চোখের পাতা ভারি। সম্ভবত ফুলে গিয়েছে। 

পায়ের নিচে মাটি নেই বুঝতেই সুকান্ত চমকে উঠল। তারপর বুঝল, তাকে উল্টো করে ঝুলিয়ে হাত আর পা শক্ত করে একটা লোহার টেবিলের সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে। শ্বাসনালীতে পানি ঢুকে গিয়েছে। উল্টো করে বাঁধার ফলে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছে। ঠাণ্ডা লোহার টেবিলের স্পর্শ তাকে কিসের যেন একটা কথা মনে করিয়ে দিল। 

সারা শরীর থেকে পানি চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে। কাছেই কোথাও ‘ঢপ’ করে প্লাস্টিকের বালতি রাখার শব্দ হল। বালতি ভর্তি পানি ছুঁড়েই তার জ্ঞান ফেরানো হয়েছে। 

ক্রিইইচ করে কিসের যেন শব্দ হল। সম্ভবত লোহার চেয়ার টানার শব্দ। জ্ঞান ফেরার সাথে সাথে যে বুক ঘড়ফড়ানিটা ছিল, সেটা আস্তে আস্তে কমতে লাগল। পুনরায় সজাগ হল অলফ্যাক্টরি স্নায়ু। নোনা একটা গন্ধ নাকে আসল। 

“নাম কী?।” অন্ধকারের কোন এক জায়গা থেকে একটা গলা শোনা গেল। নারী কণ্ঠ। সুকান্ত বুঝতে পারল না কি বলা উচিৎ। মাথার ভেতরে অনেক প্রশ্ন। কেন তাকে ধরে আনা হল? ধরে আনা হলে তার অপরাধ কি? সিএনজিতে আসলে কি হয়েছিল? নিজের মাথার ভেতরেই এত প্রশ্ন, নারী কণ্ঠ তার অস্থিরতা আরো বাড়িয়ে দিল। 

“ওই কুত্তার বাচ্চা নাম বল” খেঁকিয়ে উঠল সেই একই নারী কণ্ঠ। উত্তর না পেয়ে এবার তার গলায় ঝরে পড়ল তীব্র ক্রোধ। “তৈমুর, দাও তো একটা কুত্তার বাচ্চাটারে। দাও! মুখের ওপরে দাও। কুত্তার বাচ্চা মুখ খোলে না ক্যান?” খনখনে গলায় বলে উঠল নারী কণ্ঠ। 

সঙ্গে সঙ্গে অন্ধকারের ভেতর থেকে সুকান্তের চোয়ালে একটা ঘুষি পড়ল। ঘন অন্ধকারেও ঝিল মিল করে সর্ষে ফুল ফুটে উঠল চোখে। নোনতা স্বাদে ভরে গেল মুখ। 

“নাম বল? নাম বলতে বললাম না তোকে? ভদ্র ভাষায় হবে না বুজছি।” নারী কণ্ঠটা বলল। সুকান্ত বিড়বিড় করে নিজের নাম বলল। চোয়ালে অসহনীয় যন্ত্রণা। 

“তুই-ই তাহলে সেই চোর? চোরের বাচ্চা চোর। অন্যের হয়ে বই লিখে দিস। তোকে অনেক খুঁজেছি। গত তিনদিন তোকে শকুনের মত খুঁজেছি। আমার বাবাকে খুন করে ভেবেছিস পার পেয়ে যাবি?” নারী কণ্ঠটা কথা শেষ করতে পারল না। রাগে গজ গজ করতে লাগল। “সবাই জানে আমার বাবা আত্মহত্যা করেছে। আমিও সবাইকে সেটাই বলেছি। পুলিশ, মিডিয়া, সবাইকে। কিন্তু আমি জানি আমার বাবা আত্মহত্যা করেনি। উনাকে খুন করেছিস তুই।” 

পিপাসায় গলা শুকিয়ে গিয়েছে সুকান্তের। মাথা কাজ করছে না। মেয়েটা উঁচু গলায় চিৎকার করে কি বলছে সব কিছু শুনেও কিছুই যেন বুঝতে পারছে না সুকান্ত। তবে ‘আত্মহত্যা’ কথাটা কবে যেন শুনেছে বলে মনে হল তার। মাথার ভেতরটা তালগোল পাকিয়ে না থাকলে এতক্ষণে হয়ত বুঝতে পারত মেয়েটা কি নিয়ে কথা বলছে। কিন্তু আবার ঘুষি খাওয়ার ভয়তে ভেতরের সব শক্তি এক করে বলল, “নাম কি আপনার বাবার?” 

“কতবড় সাহস! খুন করে আবার ঢং করতেছে! আমার বাবার নাম জানো না? ঢং কর? তৈমুর, কুত্তার বাচ্চাটাকে আরেকটা দাও।” খেঁকিয়ে উঠল নারী কণ্ঠ। 

সুকান্ত এবার চিৎকার করে উঠল। “আমি কাউকে খুন করিনি। সত্যি আমি কাউকে খুন করিনি। থামেন প্লিজ। প্লিজ থামেন।” মুখের নোনতা তরল শ্বাসনালীর দিকে যেতেই আবার কাশির দমক উঠল। 

“আমার বাবার জন্য তুই চারটা বই লিখে দিয়েছিস। সেগুলো সবগুলো বেস্টসেলার হয়েছে। তোর হিংসা হয়েছে। আমি জানি তোর হিংসা হয়েছে। আমার বাবার খ্যাতি দেখে তোর হিংসা হয়েছে। তুই টাকাও খেয়েছিস, আবার বাবার খ্যাতি দেখে হিংসাও করেছিস।” মেয়েটা উন্মাদের মত চিৎকার করে কথাগুলো বলল। 

তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা আর মেয়েটার ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। 

কি বলা উচিৎ, সুকান্ত ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বলল, “আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমি টাকার বিনিময়ে বই লিখি ঠিক আছে, কিন্তু যাদের জন্য বই লিখি তাদের সাথে আমার সরাসরি কোন দেখা হয় না। না আমি তাদের নাম জানি, না আমি তাদের সম্পর্কে পরে খোঁজ নিতে যাই। সত্যি বলছি। তবে আপনার বাবার ব্যাপারে আমি কিছুটা জানি। আপনার বাবা আমাকে দিয়ে একটা বই লেখাতে চেয়েছিলেন। আর সেই জন্য একটা পেনড্রাইভও পাঠিয়েছিলেন।” একবারে অনেকগুলো কথা বলায় গলা ধরে এলো। আবার শ্বাস কষ্ট শুরু হল। 

মেয়েটা কান্না জড়ানো গলায় বলল, “কিসের পেনড্রাইভ?” 

“এভাবে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। আমাকে খুলে দেন প্লিজ। আমি সব বলছি। প্লিজ।” সুকান্ত মিনতি করে বলল। উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার ফলে মাথায় রক্ত চাপ বাড়ছে। ব্যথায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। শিরাগুলো যেন রক্তের চাপে ফেটে যাবে। 

অন্ধকারে ফিসফিসানির শব্দ হল। মেয়েটারই কণ্ঠ বলে মনে হল। তারপর একটা পায়ের শব্দ এগিয়ে এলো সুকান্তের দিকে। প্রথমে হাতের দড়ি, তারপর পায়ের দড়ি খুলে দেওয়া হল। ধপ করে মেঝেতে পড়ল সুকান্তের শরীর। 

ইচ্ছা করলেও সুকান্ত এখন পালাতে পারবে না। অনেকক্ষণ উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখার ফলে তার পায়ে রক্ত সঞ্চালনে ব্যাঘাত ঘটেছে। ঝি ঝি ধরেছে পায়ে। 

একটা চেয়ারে পিছমোড়া করে বেঁধে ফেলা হল তাকে। তারপর নারী কণ্ঠটা বলল, “পেনড্রাইভ নিয়ে কি যেন বলছিলি?” 

হঠাৎ করে সোজা হয়ে বসায় মাথা থেকে বেশ খানিকটা রক্ত নেমে গেল আর নেমে যাওয়ার সাথে সাথে মাথা ঘুরে উঠল সুকান্তের। ব্যথাটা ঘাড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। ঝিম ধরা মাথা নিয়ে, প্রায় শুকিয়ে যাওয়া জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ভিজিয়ে নিয়ে সুকান্ত বলল, “আমার কাছে যত কন্ট্রাক্ট আসে, তার সবগুলো সুভাষদা আনে। গত পরশুদিনের আগের দিন সুভাষদা এমনই একটা কন্ট্রাক্ট নিয়ে আমার কাছে এসেছিলেন। বলছিলেন, খুব দ্রুত একটা বই লিখে দিতে। একটা নন ফিকশন বই। কিন্তু টপিক কি সেটা বলেননি। কন্ট্রাক্টের সব তথ্য পাঠিয়ে দেবেন বলেছিলেন। পাঠিয়ে দিয়েছিলেনও। কিন্তু সুভাষদা জানান, সেইদিনই দিবাগত রাতে কন্ট্রাকটর ভদ্রলোক আত্মহত্যা করেছিলন। ভদ্রলোক একটা পেনড্রাইভ আর একটা ছোট্ট চিরকুট পাঠান। চিরকুটে লেখাছিল যে, বইটা দ্রুত না লেখা হলে অনেকজন মারা যাবে।” 

থামল সুকান্ত। কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে নিল। মুখের ভেতরের নোনতা স্বাদটা এখনও আছে। তারপর বলল, “এর বেশি আমি আর কিছুই জানি না।” 

কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর নারী কণ্ঠ জিজ্ঞাসা করল, “কিভাবে বিশ্বাস করব যে আমার বাবা আপনাকে চিরকুট আর পেনড্রাইভ পাঠিয়েছে?” 

তুই থেকে সরাসরি আপনি? সুকান্ত একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। এর মানে হয়ত এরা এদের ভুল বুঝতে পারছে। সে বলল, “এই মুহূর্তে আমার কাছে কোন প্রমাণ নেই। চিরকুট আর পেনড্রাইভ, দুইটাই আছে সুভাষদার কাছে।” কোন উত্তর পাওয়া গেল না। সে তাই প্রশ্ন করল, “আপনার কেন মনে হল যে আপনার বাবাকে আমি খুন করেছি?” 

প্রশ্নে কাজ হল বলে মনে হল। ঘটাং করে একটা শব্দ হল। কেউ একজন সার্কিট ব্রেকারের সুইচ অন করল বলে মনে হল। সাথে সাথে আলোকিত হয়ে গেল জায়গাটা। হঠাৎ আলোতে সুকান্তের চোখজোড়া সরু হয়ে গেল। চোখের সহ্যক্ষমতা স্বাভাবিক হতেই সে একজন মেয়েকে দেখতে পেল। তার থেকে কয়েক গজ দূরে দাঁড়িয়ে আছে। শ্যামলা। মাঝারী গড়ন। পরণে ফতুয়া আর জিন্স। এই মেয়েটাই এতক্ষণ কথা বলছিল হয়ত- ভাবল সুকান্ত। আর একজন মাঝারী উচ্চতার লোককেও দেখতে পেল সে। এই লোকই হয়ত তৈমুর। যার হাতের ঘুষি খেতে হয়েছে একটু আগে। সুকান্ত আশেপাশটা দেখে বোঝার চেষ্টা করল জায়গাটা কোথায়। মাছের আঁশটে গন্ধ আর নোনা গন্ধ নাকে আসছে। কোল্ড স্টোরেজ। 

“আমার বাবার নাম ইমন মোস্তাফিজ।” মেয়েটা বলল। 

“নাম শুনেছি।” 

“উনি গত পরশুদিন খুন হয়েছেন। হোটেল মুন-এ। এমনিতে আমরা ময়মনসিংহ থাকি। বাবা মাঝে মধ্যেই বাড়ি থেকে কাউকে কিছু না বলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। ফিরে আসার পরেও আমাদেরকে কখনও বলেননি কোথায় গিয়েছিলেন, কেন গিয়েছিলেন। প্রথম প্রথম আমাদের খুব চিন্তা হত। মা মারা যাওয়ার পরে আস্তে আস্তে আমি এটাকে স্বাভাবিকভাবে নিয়েছি। তাই স্বাভাবিকভাবেই, বাবা যে এভাবে এখানে এসে হোটেল মুনে উঠবেন- আমি জানতাম না। পরে জানলাম বাবার লাশ পাওয়া গিয়েছে।” 

সুকান্ত খেয়াল করল, বাবার মৃত্যু সংবাদটা অবলীলায় আর খুব স্বাভাবিক গলায় বলল মেয়েটা। বাবার মৃত্যুর মত সংবেদনশীল একটা ব্যপারে একটা মেয়ের যতটা আবেগী হওয়া উচিৎ, মেয়েটা তার এতটুকু আবেগী হল না। কেন? মেয়েটা কি কঠিন মনের অধিকারিণী? নাকি নিজের আবেগ লুকাতে বদ্ধ পরিকর? 

“আপনি কিভাবে জানলেন, মানে আমি বলতে চাচ্ছি যে, আপনার কেন মনে হল যে আপনার বাবা খুন হয়েছেন?” 

“বাবা বামহাতি ছিলেন। কিন্তু বাবার মৃতদেহটা ডান হাতে রিভলভার ধরেছিল।” 

“রিভলভার মাথায় ঠেকিয়ে আত্মহত্যা করেছেন?” 

“বললাম না বাবা আত্মহত্যা করেননি।” 

“সরি। কিন্তু, মানে, আসলে রিভলভারটা কার?” 

“বাবার।” 

“তাহলে সমস্যা কোথায়? উনার রিভলভার দিয়ে উনি আত্মহত্যা করেছেন।” 

মেয়েটা এবার একটু কঠিন দৃষ্টিতে সুকান্তের দিকে তাকালো। তারপর বলল, “বাবাকে কেউ খুন করেছে। বেশ কয়েকমাস আগে থেকেই বাবা একটা লাইসেন্স করা পিস্তল নিয়ে ঘোরা শুরু করে। বাবার মনে হতে থাকে তাকে কেউ খুন করতে চায়। বাবা আমাকেও সেই কথা কয়েকবার বলেছেন।” কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে আবার বলল, “বাবাকে কেউ হয়ত খুন করতে যায়, আর বাবা রিভলভার হাতে নেন নিজেকে বাঁচানোর জন্য। কিন্তু, সেটা যাই হোক।” 

চুপ হয়ে গেল মেয়েটা। এই প্রথম মেয়েটার গলাটা ধরে এল বলে মনে হল সুকান্তের। সুকান্ত বলল, “আপনার বাবা আপনাকে কোন পেনড্রাইভ বা কোন বইয়ের কথা বলেছেন কখনও? বা এমন কিছু, যা খুব গোপন? কোন মানুষের নাম? বা এরকম কিছু?” 

“না। বাবা আমাকে এইরকম কিছুই বলেননি। তিনি চাপা স্বভাবের মানুষ ছিলেন। ব্যবসার কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। লেখালেখির ব্যাপারও আমাদের সাথে শেয়ার করতেন না।” মেয়েটা বলল। 

“আপনি কিভাবে জানলেন যে আপনার বাবার কয়েকটা বই আমি লিখে দিয়েছি? আমি নিজেই জানি না আমি কার কার বই লিখে দিয়েছি।” 

“সেটা আপনার না জানলেও চলবে। একটা মেয়ে ওয়ারড্রোবে তার স্বামীর কাপড়ের ভাঁজে একটা মহিলার সাথে তোলা ছবি খুঁজে পান। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন মহিলা বহু আগে মারা গিয়েছে। কিন্তু ছবির ওপরের তারিখ বলছে ছবিটা কয়েকদিন আগে তোলা। এই মৃতা মহিলাকে খুঁজতে গিয়েই মেয়েটা একটা মহাবিপদে পড়ে। এইরকম একটা উপন্যাস আমার বাবার নামে বের হয়েছিল। বইটা আপনি লেখেননি? তারপর, ওই যে, আরেকটা আছে না? কি জানি? হ্যাঁ, ওই যে একটা ছেলে সমুদ্রের ধারে গিয়ে কিছু পায়ের ছাপ খুঁজে পায় যা মানুষের না, আবার তার পরিচিত কোন প্রাণীরও না। সেই ছাপটা আস্তে আস্তে পাশের পাহাড়ি বনের ভেতরে হারিয়ে গিয়েছে। ছেলেটা পায়ের ছাপ অনুসরণ করে বনের ভেতরে হারিয়ে যায়। এরকমই তো কিছু একটা ছিল। এগুলো আপনার লেখা না? আমি যখন জানলাম যে আপনিই আমার বাবার হয়ে বই লিখে দিয়েছেন তখন আমি তৈমুরকে বলি আপনাকে অনুসরণ করতে। ও বেশ কয়েকদিন আপনার গতিবিধি লক্ষ্য করার পরে যেদিন জানতে পারি যে বাবা খুন হয়েছেন, সেদিন ভেবে নেই যে আপনিই বাবাকে হিংসা করে খুন করেছেন। তাই তৈমুরকে নিয়ে সিএনজিতে করে অপেক্ষা করি আপনার প্রেসের সামনে। আপনি বের হতেই আপনাকে তুলে নেই। আপনার সিটের সামনের লোহার গ্রিলটাতে একটা ন্যাকড়া ঝুলিয়ে রাখা হয় যাতে এনেস্থেসিক মাখানো ছিল। তৈমুর ব্রেক করতেই আপনি ন্যাকড়াটার ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। আর বাকিটা আপনি দেখতেই পাচ্ছেন।”

সুকান্ত আমতা আমতা করতে লাগল। আসলেই এগুলো তারই লেখা। বেশ কয়েকবছর আগে লেখা। সুভাষদাকে পাণ্ডুলিপি দিয়েছিল। মোটা অংকের টাকাও পেয়েছিল। কিন্তু, ক্লায়েন্ট যে ইমন মোস্তাফিজ, সেটা তো সে জানত না। 

মেয়েটা চাপা রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “আমার তো মনে হয়, বাবা যে মাঝে মাঝে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতেন তার একমাত্র কারণ আপনি। বাবা আপনার সাথেই দেখা করতে যেত। আর সেই সুযোগে আপনি বাবাকে খুন করেছেন। বলেন ঠিক কি না?” 

“না না। আমি আপনার বাবার নাম শুনেছি অনেকবার। কিন্তু মুখোমুখি কখনও দেখা হয়নি। আমি তো বারবার বলছি যে আমি যাদের জন্য লিখে দেই তাদের কারো সাথে আমার দেখা হয় না।” সুকান্ত বলল। তার চোয়াল অবশ হয়ে যাচ্ছে মাঝে মাঝে, তাই কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। 

“আমি জানতে চাই ঐ পেনড্রাইভে বাবা কী এমন তথ্য রেখেছেন? কোথায় সেইটা?” 

“সুভাষদার কাছে।” সুকান্ত বলল। 

“চলেন।” মেয়েটা বলল। তারপর পাশে দাঁড়ানো লোকটাকে বলল, “তৈমুর। উনারে খুলে দাও। সিএনজিতে তোল। ক্লিনিকে ড্রেসিং করানোর পরে আমাকে ফোন দিবা। তারপর, কি যেন নাম বললেন, সুভাষ?” সুকান্ত মাথা নাড়ল। “সুভাষের ওখানে রওনা হবা। আমার মনে হয় পেনড্রাইভটাতেই সব প্রশ্নের উত্তর আছে।” 

পেনড্রাইভটা যে এনক্রিপ্ট করা আছে সেটা সুকান্ত বলল না। বলল, “একটা কথা জানতে পারি?” 

মেয়েটা বলল, ”কী?” 

“আপনার সাথে আপনার বাবার সম্পর্ক কেমন ছিল?” 

প্রশ্নটা শুনে মেয়েটার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ অন্যদিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “সেটা না জানলেও চলবে।” 

তৈমুর যখন সুকান্তের হাতের বাঁধন খুলে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করছিল তখন সুকান্ত নিচু গলায় বলল, “আপনার নামটা জানা হয়নি।” 

মেয়েটা জিন্সের পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে অন্ধকারে হারিয়ে যেতে যেতে বলল, “নীরু”। 

হারানো বইটা 

আকাশে মেঘ জমেছে। গুমোট গরম। বাতাস নেই একেবারে। বৃষ্টি হবে। অথবা ঝড়। 

গাড়িটা গ্যারেজে রেখে হাত ঘড়ি দেখলেন আমানুল্লাহ। রাত দশটা সাতচল্লিশ। নাহ, আজকেও দেরি হয়ে গিয়েছে। গাড়ি লক করে গ্যারেজের দরজা নামালেন তিনি। তারপর দরজা খুলে বসার ঘরে ঢুকতেই তন্দ্রানীলাকে আবিষ্কার করলেন ডিভানের ওপরে। বুকের ওপরে আলগোছে একটা বই পড়ে আছে উপুড় হয়ে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে কোন একটা শিশু তন্দ্রানীলার বুকের ওপরে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। 

ফ্যানটা খুব আস্তে আস্তে ঘুরছিল। যাতে তার ঘোরার শব্দে তন্দ্রানীলার ঘুম ভেঙে না যায়। 

মেয়েটাকে দেখে খুব মায়া হল আমানুল্লাহর। মা মরা মেয়েটাকে তিনি ‘সশরীরে’ মানুষ করতে পারেননি। বেশ কয়েকজন আয়া আর বেশ কয়েকজন কাজের বুয়ার হাতে মেয়েটা মানুষ হয়েছে। কাজের চাপে তিনি মেয়েটাকে সময় দিতে পারেননি। অপরাধ জগতের নোংরা যেন গায়ে না লাগে এই জন্য নিজেও তন্দ্রানীলার কাছ থেকে দূরে দূরে থেকেছেন। দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এখন দুজন দুজনের কাছে নিতান্তই অপরিচিত মানুষ হয়ে গিয়েছন। এমনকি দুই মাস হল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান থেকে মাস্টার্স শেষ করল মেয়েটা- এই তথ্যও তিনি জানতেন না। ডিপার্টমেন্টের সভাপতি তাকে ফোন করে জানিয়েছেন যে তার মেয়ে ডিস্টিঙ্কশন লেটারসহ গোল্ড মেডেল পেয়ে তার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেছে। শুনে তার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। মেয়েটার এই সফলতায় তার মত খুশি কেউ হওয়ার কথা না, কিন্তু তার এই সফলতায় নিজের অবদান স্বীকার করতে না পারার মত দুর্ভাগা আর কেউ নেই। 

সারাদিন বাড়িতেই কাটছে তন্দ্রানীলার, বইয়ের পাতায় সাঁতার কেটে কেটে। ঘর ভর্তি বই। রান্নাঘরের কেবিনেটগুলোর দুইটা কেবিনেটেই বই ভর্তি করে ফেলা হয়ে গিয়েছে। কিভাবে একজন এত বই পড়তে পারে? শূন্যতায় থাকা মানুষদের ভেতরে ধৈর্য্য ধারণের একটা অদ্ভুত ক্ষমতা তৈরি হয়ে যায়। তন্দ্রানীলারও তাই হয়েছে। মিতভাষী মেয়েটা সময়ের সাথে সাথে নিজের ভেতরে আস্তে আস্তে গুটিয়ে গিয়েছে। 

কাজের বুয়া একজন আসে। সে-ই রান্না বান্না করে দিয়ে যায়। আমানুল্লাহ তার নাম জানেন না। তন্দ্রানীলার সাথে তার দূরত্ব বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থা হয়েছে যে ইচ্ছা করলেও আর সেই আগের ‘নীলা’কে খুঁজে পান না তিনি। তবে আজকাল তন্দ্রানীলার পছন্দের টপিকগুলো নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করা। এই যেমন বই। কিন্তু তারপরেও যেন মনে হয়, তন্দ্রানীলা দায়ে পড়ে সেই সব কথার উত্তর দেয়। কোন মানুষের কাছাকাছি যাওয়ার দুটো উপায়। এক, তার কথা মন দিয়ে শোনা; আর দুই, তাকে প্রশ্ন করা। তিনিও এই দুটো উপায় অবলম্বন করার চেষ্টা করেন। চেষ্টা সব সময় সফল হয় না। তন্দ্রানীলা সব প্রশ্নের উত্তর দেয় না। 

মেয়েটার বিয়ে দেওয়ার কথা মাঝে মাঝে ভাবেন আমানুল্লাহ। কাজের চাপে সেই ভাবনাটা আর গভীরে যেতে পারে না। মেয়েটার বয়স তো থেমে নেই। 

তন্দ্রানীলা কী খেয়েছে? না খেয়ে থাকলে তাকে ডাকা উচিৎ। তাকে নিয়েই খেতে বসা উচিৎ। বেশিরভাগ দিন আমানুল্লাহর ফিরতে ফিরতে এত দেরি হয়ে যায় যে তন্দ্রানীলা তাকে ছাড়াই রাতের খাবার খেয়ে নেয়। আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরেছেন। আজ মেয়েটাকে সাথে নিয়েই খাওয়া উচিৎ। 

তন্দ্রানীলার সোফার পাশেই মেঝেতে একটা ডায়েরি পড়ে থাকতে দেখলেন আমানুল্লাহ। একটা বেগুনী রঙের কভারে মোড়া ডায়েরি। তন্দ্রানীলার ডায়েরি সন্দেহ নেই। মেয়ের ডায়েরি পড়া একেবারেই উচিৎ না- জানেন তিনি। কিন্তু কি মনে করে এক দূর্দমনীয় কৌতূহল তাকে ডায়েরিটা খুলতে বাধ্য করল। 

বাবার স্টাডিতে আজ একটা ফাইল দেখলাম। ফাইলটা একেবারে ওপরেই ছিল। আমি কিউরিয়াসলি কয়েক পাতা পড়লাম। নতুন খুন। নতুন খুনি। কিন্তু খুনগুলোর বর্ণনা কেন যেন আমার কাছে খুব পরিচিত মনে হল। কোথায় যেন পড়েছি? ও হ্যাঁ, বহু আগে, তখন কেবল এসএসসি শেষ হয়েছে, তখন আমি একটা বই পেয়েছিলাম নীলক্ষেতে ঈশ্বর আংকেলের দোকানে। চিকন একটা বই। ফিনফিনে পাতলা কাগজের মলাট। বইটার নাম ছিল ‘পাছাখানার ভূত’। ‘ছাপাখানার ভূত’ এর আক্ষরিক অনুবাদ হয় ‘Ghost of the printing press’. ইংরেজীতে এরকম একটা ফ্রেজই আছে, ‘ scratch the press, এর মানে হল, ছাপার ভুল। ছাপার ভুলগুলোকে ইংরেজরা মজা করে বলত, এটা ছাপাখানার ভূতে করেছে। লেখক তাই রসিকতা করে বইয়ের নামটাই ভুল করে লিখেছিলেন ‘পাছাখানার ভূত’। বইটা ভর্তি ছিল জঘন্য খুনাখুনিতে। বইটার প্রধান চরিত্র পাছাখানার ভূত। সে প্রকাশক, চলচ্চিত্র পরিচালক আর ভূত লেখকদেরকে খুন করতে থাকে। রূপকথার বইয়ের মত করে লেখা পুরো বইটা। প্রকাশক, পরিচালক আর ভূত লেখকদেরকে পৌরাণিক প্রাণীর রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই যেমন ড্রাগন, শঙ্খচূড় সাপ, কালো পঙ্খিরাজ, আগুনের তৈরি ষাঁড়, দৈত্যাকার ক্যাকটাস –এইসব আরকি। পুরো বইটা কয়েকটা গল্পে ভাগ করা ছিল। এক একটা গল্পে ছাপাখানার ভূতটা এক একটা প্রানীকে এক এক ভাবে খুন করতে থাকে। এক একটা অভিযানের শেষে এক একটা প্রাণী খুন হয়। ছাপাখানার ভূতটার অস্ত্র ছিল একটা ফাউনটেন পেন। ঝর্না কলম। সেইটা দিয়ে সে প্রাণীগুলোকে হত্যা করত। বইটা এতই জঘন্য ছিল, যে আমি পুরোটা পড়ে শেষ করতে পারিনি। তার কিছুদিন পরেই শুনি, বইটা নাকি পুলিশ খুঁজছে, যে দোকানেই পাচ্ছে, রাস্তায় জমা করে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে। দেওয়াই উচিৎ। এমন জঘন্য বই কেউ লেখে? সেই ঘটনার অনেকদিন পরে অবশ্য বইটা বেশ কয়েকবার খুঁজেছি, পাইনি। ঈশ্বর আঙ্কেল অবশ্য পরে বলেছিলেন মুনশী মোয়াল্লেম নামে এক ভদ্রলোকে কাছে থাকতে পারে। পরে আমি কত… 

তারমানে তন্দ্রানীলা স্টাডিতে ঢুকেছিল! চমকে উঠলেন আমানুল্লাহ। তার পেশাগত অন্ধকার থেকে মেয়েটাকে খুব সাবধানে আগলে রাখতে চেয়েছেন। কিন্তু তন্দ্ৰানীলা আজ কেন স্টাডিতে ঢুকল? ওখানে কত গোপন ফাইল আছে। হাইলি কন্ট্রোভার্শিয়াল ফাইল। কত বীভৎস খুন। কত বীভৎস খুনের বর্ণনা! 

তাড়াতাড়ি স্টাডি রুমের তালা খুলে লাইট জালালেন তিনি। লকার খুলে হোলস্টারে মোড়া রিভলভারটা রাখতে রাখতে সেগুন কাঠের ভারি টেবিলটার ওপরে রাখা ফাইলটা একবার নেড়ে চেড়ে দেখলেন। মেয়েটা এমনভাবে ফাইলটা রেখে দিয়েছে যেন কেউ না বুঝতে পারে যে ফাইলটা কেউ নাড়াচাড়া করেছিল। এর মানে তিনি যদি ডায়েরিটা না পড়তেন তাহলে বুঝতেই পারতেন না যে তার স্টাডিতে তার অনুমতি ছাড়া কেউ ঢুকেছিল! 

কয়েকটা বিড়ালের পায়ের ছাপ চোখে পড়ল। ধূলার ওপরে বেশ কয়েকটা ছাপ। এর মানে পোষা বিড়াল নিমিটাও এসেছিল? 

“বাবা?” 

চমকে পেছনে তাকালেন আমানুল্লাহ। দরজার কাছে তন্দ্রানীলা দাঁড়িয়ে আছে। মেয়ের কণ্ঠটা শুনে এত চমকে যাওয়ায় নিজেকে খুব ছোট মনে হল তার। নিজেকে সামলাতে গিয়ে বোকার মত হেসে ফেললেন। বললেন, “হ্যাঁ নীলা। বল। ঘুম ভেঙে গেল নাকি? ওমন করে অসময়ে কেউ ঘুমায়? খাইছো?” তন্দ্ৰানীলা মাথা নাড়ালো। সে খায়নি। আমানুল্লাহ ডান হাতে ধরা ডায়েরিটা কোন রকমে নিজের প্যান্টের ভাঁজে লুকালেন। 

“চল চল, খেয়ে নিই। ভাত-টাত খোল। আমি আসছি।” ব্যস্ত হয়ে আমানুল্লাহ বললেন। রান্নাঘরে খুটখাট শব্দ হতে শুরু করল। তিনি শোয়ার ঘরে গিয়ে পোষাক বদলাতে লাগলেন। কিন্তু মনের ভেতরে খচ খচ করতেই থাকল। আজ তন্দ্রানীলা ঢুকে ফাইল পড়েছে, কাল এই ফাইল কোনভাবে হারিয়ে গেলে? তাছাড়া লকারে মাঝে মধ্যে লোডেড রিভলভার থাকে। নাহ, কাজটা একেবারেই ঠিক করেনি মেয়েটা। 

আপাতত মাথা থেকে চিন্তাটা দূর করতে চাইলেন তিনি। কিন্তু জড়িয়ে যাওয়া ক্যাসেটের মত চিন্তাটা মাথার ভেতরে ঘুরতে থাকল। একটা অস্বস্তিকর অস্থিরতা বাড়তে লাগল সেকেন্ডে সেকেন্ডে। পোশাক বদলে নিচে নেমে এলেন। খাবার টেবিলে খাবার সাজিয়ে তন্দ্রানীলা বিরস মুখে বসে আছে। চেয়ার টেনে বসতে বসতে একবার টেবিলটার ওপরে চোখ বুলিয়ে নিলেন তিনি। কিসের একটা ভাজি, হলুদ ডাল, ইলিশ মাছ ভাজি আর আলু ভর্তা। 

“বুয়া এসেছিল?” আমানুল্লাহ স্বাভাবিকভাবে জিজ্ঞাসা করলেন। 

“না।” তন্দ্ৰানীলা বলল। 

“তাহলে রান্না কে করল?” আমানুল্লাহ অবাক হয়ে বললেন। যদিও জানেন রান্না কে করেছে, তারপরেও জিজ্ঞাসা করলেন। 

“হোটেল থেকে আনিয়েছি।” তন্দ্ৰানীলা ভাবলেষহীনভাবে বলল। 

আমানুল্লাহ ধাক্কামতো খেলেন। তিনি আশা করেছিলেন মেয়েটা হয়ত নিজে হাতে রান্না করেছে। মেয়েটার কাছে নিজেকে কেন জানি শিশু লাগে আমানুল্লাহর। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারেন না। কিন্তু আজ যেভাবেই হোক, মেয়েটার সাথে সরাসরি কথা বলতে হবে। 

তন্দ্রানীলা দুই চামচ ভাত আর একটু ভর্তা তুলে দিল। তারপর এক টুকরো মাছ। 

কাঁচের জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে কয়েক ঢোঁক পানি খেল তন্দ্রানীলা। আমানুল্লাহ কয়েক নলা ভাত মুখে দিয়েছেন এরই মধ্যে। এত চমৎকার রান্না কোন হোটেলে হয় সেটা জানতে ইচ্ছা করছে। সাধারণত হোটেলের রান্নায় মসলা বেশি হয়। অনেকবার জাল দেওয়ার ফলে মসলা ঘন হয়ে যায়। তখন মসলাটা তীব্রভাবে মুখে ধরে। কিন্তু এই তরকারিতে মসলাটা খুব চমৎকারভাবে মিশে গিয়েছে। খুব বেশি আঁচে জাল দেওয়া হয়নি। আবার কম আঁচেও জাল দেওয়া হয়নি। একেবারে ঠিকঠাক। 

আমানুল্লাহ ঢকঢক করে পানি খেয়ে অনিচ্ছাকৃতভাবে একটা ঢেঁকুর তুললেন। মনযোগ আকর্ষনের চেষ্টা। রান্না আসলেই চমৎকার হয়েছে। এতক্ষণ ধরে যে প্রশ্নটা করবেন ভাবছিলেন সেটা করেই ফেললেন, “স্টাডিতে কেন ঢুকেছিলে তন্দ্রানীলা? চাবি কোথায় পেলে?” 

তন্দ্রানীলা এঁটো প্লেটগুলো উঠাচ্ছিল। প্রশ্নটা শুনে খুব সহজভাবেই উত্তরটা দিল, “নিমি তালা খুলে তোমার স্টাডিতে ঢুকেছিল। আমি ওকে বের করে আনার জন্য ওখানে গিয়েছিলাম। তারপর তোমার টেবিলের ওপরে ফাইলটা পাই। পড়ে ফেলি। যদি অন্যায় কিছু করে থাকি তাহলে সেটা একেবারেই অনিচ্ছাকৃতভাবে আর তার জন্য আমি সরি।” 

“নিমি তালা খুলেছে?” আমানুল্লাহ অবাক হয়ে বললেন। একটা বিড়াল তালা খুলে একটা ঘরে ঢুকেছে, এটা বিশ্বাসযোগ্য কথা না। 

“হ্যাঁ।” তন্দ্রানীলার সোজাসাপ্টা উত্তর। আমানুল্লাহ আর কথা বাড়ালেন না। তন্দ্রানীলা মিথ্যা বলার মত মেয়ে না। কিন্তু সে যে কথাটা বলছে সেটা সত্যি বলেও মানা যাচ্ছে না। 

“এর পরে আমার স্টাডিতে আমার অনুমতি ছাড়া না ঢুকলে অনেক খুশি হব তন্দ্রানীলা। ওখানে এমন অনেক কিছু আছে যা তোমার জন্য প্রযোজ্য না।” বেসিনে হাত ধুতে ধুতে বললেন আমানুল্লাহ। 

ম্যাঁও। 

চমকে পাশে তাকালেন তিনি। নিমিকে দেখতে পেলেন। মূর্তির মত জানালার কার্ণিশে বসে আছে। ধূসর রঙের বিড়ালটা এক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। তিনি নিজের ঘরে চলে গেলেন। মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে। 

তন্দ্ৰানীলা এঁটো প্লেটগুলোতে থাকা মাছের কাঁটাগুলো প্লাস্টিকের ঢাকনায় রাখতেই নিমি এগিয়ে এলো। চাটতে লাগল মাছের কাঁটা। 

রান্না তন্দ্রানীলাই করেছে। বাজারও সে-ই করেছে। সারাদিন খুব যত্ন করে সময় নিয়ে সে এগুলো করেছে। ইচ্ছা ছিল, বাবা ফিরলে বলবে, “বাবা আমি এগুলো আমার রান্না করা। দেখো তো ঠিকমত মসলা টসলা হয়েছে কিনা। তুমি তো আবার মসলা একটু এদিক ওদিক হলে খেতে পার না।” কিন্তু বাবাকে তাহলে সে কেন বলল যে সব কিছু হোটেল থেকে আনা হয়েছে? বাবার অনুমানকে মিথ্যা প্রমাণ করে নিজেকে বড় করে দেখানো? নাকি নিছক রসিকতা। 

হোটেল থেকে ভাত তরকারি আনার ব্যাপারটা মিথ্যা হলেও নিমির ব্যাপারটা সত্যি। সন্ধ্যার দিকে তন্দ্রানীলা দেখে, বাবার স্টাডি খোলা। নিমি বাবার টেবিলের ওপরে একটা ফাইলের পাশে বসে আছে। নিমিকে নিয়ে বের হয়ে দরজায় তালা লাগায় তন্দ্রানীলা। কিন্তু বাবাকে কি একবার বলা উচিৎ না, যে তিনি লুকিয়ে তার ডায়েরি পড়েছেন এটা একেবারেই ঠিক না। নাহ, থাক। হতে পারে বাবা স্টাডিতে ঢুকে অন্য কোনভাবে জেনেছেন ব্যাপারটা। 

ঢং করে শব্দ হল। সাড়ে এগারটা। জ্বলজ্বলে চোখে ঘড়িটার দিকে তাকালো নিমি। 

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *