মৃতদের মিছিল
ডায়াসের একপাশে রাখা পানির গ্লাসটায় একটু চুমুক দিয়ে আবার পাতা ওল্টালেন ভদ্রলোক। শীতল আর গম্ভীর গলায় বললেন, “ঘৃণার ক্ষেত্রে লেখকদেরকে হিসেবী হতে হয়। কারণ, লেখক যাকে ঘৃণা করে- ধীরে ধীরে সে সেই মানুষটাতেই পরিণত হতে থাকে। কাজেই, কাকে ঘৃণা করা হচ্ছে, সেটা লেখককে ভেবে দেখতে হবে। ঘৃণিত মানুষটাই সবসময় লেখকের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকে, যতই তার একাধিক ভালোবাসার মানুষ থাক না কেন।”
****
কোন মেঘ ডাকাডাকি নেই, হঠাৎ করেই ঝমঝম করে বৃষ্টি নামল। সাথে দমকা বাতাস। প্রেসের সামনে রাখা ভ্যান আর পিকআপ ট্রাকের ওপরে রাখা কাগজের রিমগুলো ঢাকার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। বৃষ্টি হওয়ার আগেই পলিথিন আর ছেঁড়া কাগজের টুকরো উড়তে লাগল এলোমেলোভাবে। রিমের কভার হিসাবে ব্যবহার করা বাঁশ কাগজগুলো উড়ে প্রেসের ভেতরে ঢুকে পড়ল। রতনকেও দেখা গেল চায়ের কাপ টাপ রেখে কাগজ ঢাকার জন্য দৌড়াদৌড়ি করছে। নীল আর সাদা পলিথিনে মুহূর্তের ভেতরে পুরো জাগায়টা ভরে গেল। যেন আর্জেন্টাইন সাপোর্টাররা মরীচিকার মত জয়ের আশায় ভিড় করেছে।
সুকান্ত কীবোর্ডের সামনেই বসে ছিল। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ শুনতেই দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল রাত সাড়ে আটটা বেজে গিয়েছে। লম্বা একটা আড়মোড়া ভেঙে দুই হাতে মুখমন্ডলটা ঘষে নিল। শিফট প্রায় শেষ। বাড়ি ফিরতে হবে। বৃষ্টি নামলে ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। কাছে ছাতা টাতা নেই। তাছাড়া কায়সার আবেদীনের খুনের ঘটনায় বইপাড়া শুনশান। প্রেস পাড়াতেও তার ছায়া পড়েছে। যেন সবাই জানে কে খুনি, কিন্তু কেউ বলছে না- এমন একটা ভাব।
হঠাৎ সুভাষদাকে দেখতে পেল সুকান্ত। হাত নেড়ে ইশারা করছে। অসময়ে সুভাষদাকে আসতে দেখে একটু অবাকই হতে হল। কন্ট্রাক্টটা কি ক্যানসেল হয়ে গেল নাকি? নাকি জরুরি অন্য কিছু?
“সুকান্ত” সুভাষদার মেঘলা গলায় বলল, “একটু ওদিকে চল তো। কথা আছে।”
প্রেসের পেছন দিকটাই গিয়ে সুভাষদা বলল, “কাল তোকে একটা কন্ট্রাক্টের কথা বলেছিলাম না?” সুকান্ত মাথা নাড়ল। মনে আছে। “হোটেল মুনে আজ সেই ক্লায়েন্টের লাশ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত যটুকু শুনছি, সুইসাইড কেস। এর বেশি কিছুই জানতে পারিনি।” সুকান্তের ভ্রু কুঁচকে গেল। দিন গড়াতে না গড়াতেই আরেকটা মৃতদেহ?
যদিও উচিৎ না, তারপরেও সুকান্ত ক্লায়েন্টের নাম জানতে চাইল। “না রে। নাম জিজ্ঞাসা করিস না। বলতে পারব না।” সুভাষ খুব সংকোচ নিয়েই কথাটা বলল, “তবে হ্যাঁ, ক্লায়েন্ট আমাকে একটা পেনড্রাইভ পাঠাইছিল। সকালেই হাতে পাইছি।”
“কী আছে ওতে? বইয়ের তথ্য?”
“হ্যাঁ। আজ সকালে ফোন দিয়ে ক্ল্যায়েন্ট লোকটা হোটেল মুনে যাইতে কল। আমি গেলাম। সাথে একটা চিঠি। চিঠিতেই সব লেখা আছে।”
“অদ্ভুত তো” সুকান্ত একটা কাগজের রিমের ওপরে বসতে বসতে বলল। গুড়-গুড় করে মেঘ ডেকে উঠল বাইরে। বৃষ্টি মনে হয় জোর দিয়েছে। কিন্তু এখান থেকে বৃষ্টির শব্দ পরিষ্কার শোনা যাচ্ছে না।
সুকান্ত গলাটা নামিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “চিঠিটা আছে নাকি তোমার কাছে?”
গালের খোঁচা-খোঁচা কাঁচা-পাকা দাড়িগুলো চুলকে সুভাষ এদিক-ওদিক তাকালো। তারপর সুকান্তের ডান বাহু ধরে কাগজের রিমগুলোর আড়ালে নিয়ে গেল। পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা অফসেট কাগজ বাড়িয়ে ধরল সুকান্তের দিকে। সুকান্ত খুব সাবধানে কাগজটা খুলল।
“পেনড্রাইভটা যত্নে রাখবেন। যে বিষয়ে বইটা লেখার কথা ছিল তার সব তথ্যই এটাতে আছে। খুব সাবধানে রাখবেন। আর বইটা যেভাবেই হোক ছাপবেন। কালের কলম প্রকাশনীর আবেদীন ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে। তিনি সব ব্যবস্থা করে দেবেন। আপনি শুধু পান্ডুলিপিটা তৈরি করার ব্যবস্থা করবেন। বই বের না হওয়া পর্যন্ত আরো অনেক মানুষের জীবন ঝরে যাবে অকালে।”
কোন সই স্বাক্ষর নেই। ছোট একটা চিরকুট।
সুকান্তের মাথার ভেতরটা দপদপ করতে লাগল। তারমানে এই ভদ্রলোক কি কায়সার আবেদীনের সাথে যোগাযোগ করেছিলেন? তিনি কি জানতেন যে কায়সার আবেদীন খুন হবেন? তাহলে তিনি নিজেই বা আত্মহত্যা কেন করবেন? সব কিছু গুলিয়ে গেল। মনে হল, দম আটকে আসছে তার। সুভাষ একটা গোল্ড লিফ সুইচ ধরাতে ধরাতে বলল, “কিছু বুঝলি?” সুকান্ত পাল্টা প্রশ্ন করল, “পেনড্রাইভটা এনেছ?”
খুব আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল সুভাষ, এনেছে। “আসো আমার সাথে। দুজনে এসে কম্পিউটারের সামনে বসল। প্রেসের ভেতরটা একটু ফাঁকা। বেশিরভাগই বাইরে গিয়েছে বৃষ্টি দেখতে দেখতে একটা সিগারেট খাওয়ার জন্য। তারপরও এদিক-ওদিক দেখে নিল সুকান্ত। দেয়াল ঘড়ি বলছে, শিফট শেষ হতে আর দশ মিনিট।
পেনড্রাইভটা ইউএসবি পোর্টে ঢোকানোর সাথে সাথে একটা ডায়ালগ বক্স ভেসে উঠল কম্পিউটারের সেলুলয়েড স্ক্রিনে। Error 404: Encrypted Device. “কি বলতেছে?” সুভাষ জিজ্ঞাসা করল।
সুকান্ত কিছুক্ষণ কম্পিউটারের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “মনে হচ্ছে পেনড্রাইভের মধ্যেকার তথ্যগুলো এনক্রিপ্ট করা আছে।”
“মানে?” সুভাষ চেয়ারটা আরেকটু সামনের দিকে টেনে বসল। তার চোখে মুখে জিজ্ঞাসা।
“মানে ক্লায়েন্ট ভদ্রলোকটা এই পেনড্রাইভটা বেহাত হওয়ার ভয় করছিল। তাই এর ভেতরের ডাটাগুলো এনক্রিপ্ট করে রেখেছে। যাতে বেহাত হলেও যে কেউ যেন এটা পড়তে না পারে।”
সুভাষের চোখে মুখে এখন হতাশা, “এখন উপায়? চিঠিতে তো লিখছে যে এই বইটা বাইর না কত্তে পাল্লে অনেক মানুষ মইরা যাবে। ক্যান মরবে, ক্যামনে মরবে নাকি কেউ মাইরা ফেলবে সেইডাও লিখে নাই। কি যে ফ্যারে একটা পল্লাম।”
সুকান্ত কোন উপায় পেল না আপাতত। সে সামান্য টাইপিস্ট। ফাইল ডিক্রিপ্ট করতে পারবে না, সেটাই স্বাভাবিক। পরিচিত এমন কেউ নেই যাকে দিয়ে এটা ডিক্রিপ্ট করা যায়।
কিন্তু সৃষ্টিকর্তার হাতে তো অত সময় নেই।
মূর্তির মত সেলুলয়েড স্ক্রিনের সামনে বসে থাকল সুকান্ত আর সুভাষ।
*****
ফ্ল্যাশের আলো জ্বলে উঠল কয়েকবার। ফটোগ্রাফার কয়েকটা ছবি তুলে সরে গেল। যার ছবি তোলা হল, সে সেভাবেই থেকে গেল, যেভাবে ছবি তোলার জন্য পোজ দিয়েছিল। নিথর, মাথা হেলে আছে ডান পাশে। মাথার বামপাশের অর্ধেকটা নেই। পেছনের টাইলসে মোড়া দেওয়ালে নরম থকথকে মগজের খানিকটা এখনও লেগে আছে। টাইলসের পিচ্ছিল দেয়াল বেয়ে নিচের মেঝে পর্যন্ত নিচে নেমে এসেছে। খুলির খানিকটা ভগ্নাংশ ছিটকে পড়েছে পাশের বাথরুমের আয়নাতে।
বাথরুমের মেঝে থেকে শুরু করে দেয়াল, সবকিছু রক্তে মাখামাখি। সাদা টাইলসের এখানে ওখানে রক্তের ছিটা।
ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এজেন্ট আমানুল্লাহ আমান এক দৃষ্টিতে মৃতদেহটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ছোট ছোট নিঃশ্বাস আর কপালের গভীর ভাঁজই বলে দিচ্ছে যে তিনি চিন্তিত। আর সেই ভাঁজে জমছে শরতের শিশিরবিন্দু। এখনও আলামত সংগ্রহের কাজ শুরু হয়নি।
ডিটেকটিভ ব্রাঞ্চের একজন জুনিয়র এজেন্ট এসে বলল, “স্যার, ভদ্ৰলোক খুব বিখ্যাত একজন লেখক। নাম ইমন মুস্তাফিজ…”
“নাম জানি। লেখক পরিচয়টাও জানি। বাকিটা বল।” আমানুল্লাহ বললেন।
“ওহ, আচ্ছা। গতকাল ইনি হোটেল মুনে উঠেছিলেন। ব্যাগ রেখে কিছুক্ষণ পরে বাইরে যান। বাইরে থেকে ফিরে আসার পরে বেশ কয়েকবার রুম সার্ভিস উনাকে লাঞ্চ করার জন্য ডেকেছিল। সাড়া না পেয়ে বেশ কয়েকবার ফিরে যায়। সন্ধ্যাবেলা বাধ্য হয়ে পুলিশ ডেকে রুমের দরজা ভেঙে দেখা যায়, উনার লাশ পড়ে আছে।”
এজেন্ট আমানুল্লাহমাথা নাড়লেন। মূলত এক্সপোর্ট ইম্পোর্টের ব্যবসা করতেন। আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের শোরুম ছিল তার। একটা বইয়ের দোকান ছিল স্টেশন বাজারে। বেশিরভাগই পুরনো বই-টই পাওয়া যেত। নিজেও টুকটাক লেখালেখি করতেন স্থানীয় পত্রিকাতে। ব্যবসার পাশাপাশি লেখালেখিরও ইচ্ছা ছিল। কিন্তু কোন লেখাই তেমন একটা সাড়া ফেলত না। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ‘আঁধারের আততায়ী’ নামে একটা একটা রহস্য উপন্যাসও লিখে ফেলেছিলেন কাউকে না জানিয়ে। মুখ থুবড়ে পড়েছিল সেটা। আঁধারের আততায়ীর পরে আরো কয়েকটা বই বের করেছিলেন, কিন্তু সেগুলোও সাড়া ফেলেনি।
হঠাৎ করেই নিরুদ্দেশ হয়ে যান এই ভদ্রলোক। একমাত্র মেয়ে আর স্ত্রী কোনভাবেই জানতে পারেননি তিনি কোথায়। থানায় মিসিং ডায়েরি করা হল। পরিচিত সবখানেই খোঁজা হল। প্রায় এক বছর নিরুদ্দেশ থাকার পরে হঠাৎ করেই তিনি আবার ফিরে এলেন। এই একটা বছর তিনি কোথায় ছিলেন, কেউ তাকে অপহরণ করেছিলেন কিনা- কিছুই বলেননি তিনি। কিচ্ছু না। কিন্তু তিনি যতই মুখ বন্ধ করে থেকেছেন, ততই হৈচৈ বেড়েছে। ফিরে আসার ছয়মাস পরে তিনি আবার আরেকটা বই লিখে ফেলেন। এবারের বইটার নাম ছিল ‘অনাহূত’। ক্রাইম থ্রিলার। এই বইটা বাজারে হৈচৈ ফেলে দেয়। চার দিনের ভেতরে এর প্রথম সংস্করণ শেষ হয়ে যায়। উনার মত একজন অখ্যাত লেখকের হাত থেকে এমন থ্রিলার কেউ কখনও চিন্তাই করেনি। কেউ ভাবতেই পারেনি ইমন মুস্তাফিজের মতন একজন ব্যবসায়ী এত চমৎকার একটা থ্রিলার লিখে ফেলবেন।
তারপরের দুইটা বই লিখে আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। খ্যাতি আর অর্থ তাকে ঠিক এমন জায়গাতে বসিয়ে দিয়েছিল যেখানে প্রতিটা
লেখক সচেতন মনে না হোক, অবচেতন মনেও একবার বসতে চান। এতকিছু আমানুল্লাহ জানেন কারণ তার একমাত্র মেয়ে তন্দ্রানীলা এই ভদ্রলোকের লেখার খুব বড় ভক্ত। ইমন মোস্তাফিজের সম্পর্কে বিস্তারিত কথা তার মুখেই শুনেছেন তিনি।
কিন্তু হঠাৎ করে এমন আত্মহত্যার উদ্দেশ্য কি?
নিথর দেহটা দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে পড়ে আছে। ডান হাতে রিভলভারটা শক্ত করে ধরা। হয়ত মৃত্যুর সময় প্রচণ্ড শকের কারণে মাংসপেশী শক্ত হয়ে গিয়েছে। তাই রিভলভারটা হাত থেকে খুলে পড়ে যায়নি। রিভলভারটা চাইনিজ বেরেটা, না দেখেই বলে দিতে পারেন আমানুল্লাহ। কংসচক্রের হাত ধরে এই জিনিস ভিয়েতনাম আর মায়ানমার হয়ে প্রতিবছর দেশে চোরাচালান হয়। রিভলভারটা মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার চেপেছিলেন। তারপর যা হওয়ার তাই হয়েছে। মস্তিষ্ক কিছু বুঝে ওঠার অনেক আগেই সবকিছু শেষ।
কিন্তু খটকা থেকেই যাচ্ছে, হঠাৎ করে এমন আত্মহত্যার উদ্দেশ্য কী? একজন এজেন্টকে ডেকে বললেন, “খোঁজ নিয়ে দেখ তো ইমন সাহেবের কোন লাইসেন্স করা ব্যক্তিগত রিভলভার ছিল কিনা।” এজেন্টটা মাথা নেড়ে চলে গেল।
ফারহান তানভীর পুলিশের কন্সট্যাবল। আমানুল্লাহর পেছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। এমনিতে সে উচ্চাকাঙ্খী না। কিন্তু বেশ কয়েকবছর পুলিশে থাকার পরেও তার ওপরের পদে বসে থাকা মানুষগুলোর প্রতি একটা মোহ যায়নি। যেন প্রমোশন পেয়ে চেয়ার না, প্রমোশন পেয়ে সে চেয়ারে বসে থাকা মানুষটা হতে চায়। কতদিনের অপেক্ষা, আমানুল্লাহ স্যার একটু হেসে বলেন, “কি খবর ফারহান? ভালো আছেন?” ফারহান তাতেই খুশি। তার তো পরিবার নেই। পুলিশ ব্যারাকের ঘরটায় চারজন গাদাগাদি করে থাকে। কিন্তু এই কুশল জিজ্ঞাসের সময়টুকুও মনে হয় ওপরের চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলোর নেই। শুধু এইটুকুর জন্যই ফারহান চেয়ারে বসে থাকা মানুষগুলোর পায়ের কাছে বসে থাকে।
আমানুল্লাহ পেছনে ঘুরতেই সালাম দিল ফারহান। আমানুল্লাহ আলগোছে মাথা নাড়লেন।
পকেটে থাকা সেলফোনটা বেজে উঠল। আমানুল্লাহ ফোন বের করলেন। সদর থানার ওসি ফোন করেছে।
“হ্যাঁ সারওয়ার বল।”
“স্যার। আপনাকে একটু আসতে হবে। সৈকত সারওয়ার মার্ডার হয়েছেন।”
“সৈকত সারওয়ার মানে ওই যে বিশিষ্ট…”
“হ্যাঁ হ্যাঁ উনিই। স্যার তাড়াতাড়ি আসেন।”
আততায়ী
“ইনারে চিনো সুকান্ত?” রওশন ভাই একটা বই এগিয়ে দিলেন। সুকান্ত অপেক্ষা করছে কখন চা আসে। রওশন ভাই কাকে যেন চা আনতে বলেছেন। অনেকক্ষণ হয়ে গিয়েছে চা আসছে না দেখে ভেতর ভেতর উসখুস করছে সে। প্রথম কারণ মাথা ধরেছে প্রচণ্ড। চা-টা খেলে ভালো লাগত। দ্বিতীয় কারণ, দেরি হয়ে যাচ্ছে। বেশি দেরি হলে সিটি সার্ভিসের লাস্ট বাসটা মিস হয়ে যাবে।
“চিনো ইনারে?” আবার একই প্রশ্ন। তাই বাধ্য হয়ে সুকান্তকে বইটা হাতে নিয়ে দেখতে হল। যীশুর অশ্রু। লেখক হিরণ পাশা। ফ্ল্যাপকভার উল্টে লেখকের ছবিটা দেখল সে। চশমা পরিহিত এক ভদ্রলোকের ছবি। মুখে হাসি। “চিনি ভাই। নাম শুনেছি। সামনাসামনি পরিচয় হয়নি।” সুকান্ত বলল।
“দূর্দান্ত বুঝলে, দূর্দান্ত। ক্রিমসন থেকে দুটো থ্রিলার এসেছে উনার, দুটোই দূর্দান্ত। নেক্সট ইয়ারে দেখা যাক যদি আমাদেরকে দুটো বই বের করার সুযোগ দেন। ক্রিমসন ছাড়া উনি নাকি আবার লেখেন না। তা অবশ্য না-ই লিখতে পারেন। ব্লুমসবেরি ছাড়া তো হ্যারি পটার বের হত না নাকি বল?” রওশন ভাই বললেন।
সুকান্ত একটু পড়ে দেখার চেষ্টা করল; এটা তার ফরমায়েশী লেখাগুলোর একটা কি না। এলোমেলোভাবে কয়েক পৃষ্ঠা পড়ার পরে বুঝল, এটা তার ফরমায়েশি লেখা না। তারমানে এই ভদ্রলোকও তার ক্লায়েন্টদের ভেতরে একজন নন।
সুকান্ত ভদ্রতাবশত জিজ্ঞাসা করল, “তা ভালোই বিক্রি হচ্ছে ভাই?”
রওশন ভাইয়ের কথার আগুনে দু ফোঁটা ঘি পড়ল। তিনি বললেন, “বিক্রি হচ্ছে মানে! পাঁচ দিনে প্রথম সংস্করণ শেষ। চিন্তা করতে পার?”
সুকান্ত আনমনে মাথা দুলালো। মাথা ব্যথা বাড়ছে। চায়ের কথা কি আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া উচিৎ? না থাক। অভদ্রতা করে লাভ নাই।
“এক একটা সিন, এক একটা খুনের সিকুয়েন্স এমনভাবে লিখছেন, মনে হয় বাস্তব। গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যায়!” রওশন ভাই বললেন, “প্রতিটা সিন যেন চোখের সামনে ভাসে। মনে হয় যেন লেখক নিজেই খুনটা করছেন।” এইটুকু বলে খানিকটা হাসলেন রওশন ভাই। সম্পাদক হিসাবে অমায়িক আর এই সহজসরল মানুষটা সুকান্তের খুব প্রিয়। তার অন্যান্য নানাবিধ গুণের ভেতরে একটা, তিনি লেখকদের ঠিকঠাক মত টাকা দেন। যদি টাকা না দিতে পারেন, অফিসে ডেকে দু কাপ চা খাইয়ে তারপর মিষ্টি করে বলেন, “বুঝলেন ভাইসাহেব। টানাটানি। দু সপ্তাহ পরে এই গরীবরে একটু দেখা দিয়েন।”
“হ্যাঁ, তো যেই জন্য ডাকা তোমারে।” রওশন ভাই চেয়ার ছেড়ে উঠে পাশেই রাখা স্টিলের আলমারি খুললেন। তারপর কয়েকটা পুরনো কাগজ বের করে টেবিলের ওপরে রাখতে রাখতে বললেন, “এগ্লা একটু কম্পোজ করে আইনো তো।”
কি মনে করে সুকান্ত জিজ্ঞাসা করল, “থ্রিলারের বাজার ভালোই চলছে নাকি ভাই?”
“হ্যাঁ। অনেকদিন পরে মনের মত কিছু থ্রিলার পাচ্ছি।” রওশন ভাই বললেন। তারপর অতি উৎসাহের সাথে দুটো বইও বের করে আনলেন পাশের বুকশেলফ থেকে। চকচকে মলাট। ঝকঝকে প্রচ্ছদ।
“এই দেখ। মধ্যরাতের খুনী, মৃত্যুদন্ডের দলিল, মমির প্রতিশোধ, জঙ্গলে একলা” অনেকগুলো বই রাখতে রাখতে বললেন তিনি, “সবগুলোই চমৎকার। খুনের সিন, ক্লাইম্যাক্স- সব একেবারে যেন জ্যান্ত। পড়লেই গায়ে কাঁটা দেয়। এত জ্যান্ত কিভাবে লেখে কে জানে। সবগুলাই ক্রিমসন বের করেছে।”
বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখার উৎসাহবোধ করল না সে। এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। “তো আজকে উঠি ভাই” টেবিলের ওপরকার কাগজগুলো নিতে নিতে বলল সুকান্ত। প্রেসে গিয়ে রতনকে এক কাপ চা দিতে বলতে হবে। বোঝায় যাচ্ছে চা আর আসবে না।
হঠাৎ দরজা খুলে একজন উঁকি দিল। চেহারাটা একটু আগেই সুকান্ত দেখেছে ‘যীশুর অশ্রু” নামের বইটার ফ্ল্যাপ কভারে। হিরণ পাশা। অনুমতি না নিয়েই ঢুকে পড়ল ছেলেটা। একটা চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “কি অবস্থা রওশন ভাই? ভালো আছেন?”
“এরে আল্লা! হিরণ নাকি! বস বস। কী সর্বনাশ!” বলতে বলতে করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিলেন রওশন ভাই।
“আজকাল ফেসবুকের পোস্টে লাইক টাইক দেন না ব্যাপার কী? ফলোয়ার কতজন হইছে শুনছেন তো?”
“ফেসবুকে যাওয়া হয় না আগের মত। কিন্তু ফেসবুকে গেলে তো একবার হলেও আপনার টাইমলাইন থেকে চুঁ মেরে আসি। তাছাড়া সবাই জানে ফেসবুকে এখন আপনার কত্ত ফলোয়ার। হওয়ারই কথা। যার হাত দিয়ে এত চমৎকার থ্রিলার বের হয়, তার ফলোয়ার বেশি হবে না তো কি আমার হবে? নাকি সুকান্ত? ওহ, পরিচয় করিয়ে দেই, এ হল সুকান্ত। আমাদের প্রেসের টাইপিস্ট।” রওশন বললেন। বয়সে সুকান্ত আর হিরণ প্রায় সমান, তারপরেও রওশন ভাই একজনকে তুমি আর একজনকে আপনি সম্বোধন করলেন। দুজনেই লেখক, একজন খ্যাতির মোহে লেখে, আর একজন অর্থের জন্য।
হিরণ তেমন একটা পাত্তা দিল না। মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে মাথা নাড়ল। বলল, “আজকাল টাইপিস্ট লাগে আর? জানতাম না। যাই হোক, যে জন্য আসা আর কি…”
সুকান্ত উঠে দাঁড়ালো। ব্যথায় মাথা ফেটে যাচ্ছে। “আজ তাহলে আসি রওশন ভাই।” বলল সে।
“আরে বসো বসো। এক কাপ চা খেয়ে যাও।”
“না ভাই। আরেকদিন আসব।”
আজ যদি সুকান্ত অন্যের হয়ে বই না লিখে নিজে বই লিখত, তাহলে কি আজ রওশন ভাই তাকে ঠিক এমন সম্মান করতেন? নাকি এর থেকেও বেশি করতেন? এক কাপ চা হয়ত ঠিক পাওয়া যেত। যাই হোক, সে নাম প্রকাশ করলেও লেখক, নাম প্রকাশ না করলেও লেখক। সব মানুষই তো লেখক। সবাই মনে মনে লেখে। আনমনে লেখে, সচেতন মনে লেখে কেউ নিজের গোপন কথা লেখে, কেউ না বলা কথা লেখে, কেউ ক্ষোভের কথা লেখে- সেগুলো অন্যেরা পড়তে পারে না তাই। এর মানে কি তারা লেখক না? তারা আরো বড় লেখক। মনের কথা হুবহু কজনই বা লেখায় ফুটিয়ে তুলতে পারে?
প্রেসে ফিরে রতনকে তাড়াতাড়ি এক কাপ চা দিতে বলতেই ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় সুকান্তকে ধাক্কা দিয়ে গভীর চিন্তায় ফেলে দিল। ইমন মোস্তাফিজ লোকটা কী নিয়ে বই লিখতে চাচ্ছিল যার জন্য তাকে আত্মহত্যা করতে হল? পেনড্রাইভটাতে কি এমন আছে যা এনক্রিপ্ট করে দিতে হল? লোকটা সম্পর্কে জানতে হবে। লোকটা এর আগে কোন বই লিখলে সেটা নিয়েও স্টাডি করতে হবে। কাল রওশন ভাইয়ের কাছে আরেকবার যেতে হবে, তাহলে যদি কিছু জানতে পারা যায়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কানের কাছে ফিসফিস করে বলে গেল, “হাতে সময় কম, অনেক মানুষের প্রাণ চলে যাবে যদি এই বই লেখা না হয়।”
“এই লন। মাথা ধরছেনি?” রতন চায়ের কাপ বাড়িয়ে ধরেছে। কাপের কিনারায় ঘন সর্দির মত কনডেন্স মিল্ক লেগে আছে। চায়ের ওপরে ঘন ফেনা। কন্ডেন্স মিল্কটুকু চেটে খেয়ে সুকান্ত চায়ে চুমুক দিল। তাড়াতাড়ি শেষ করতে হবে চা। সাড়ে নয়টা বেজে গিয়েছে। বাসায় ফিরতে হবে। সিটি সার্ভিসের বাসটা মিস হয়ে গেলে বিপদ।
সিটি সার্ভিসের বাস ছেড়ে গিয়েছে বিশ মিনিট আগে। যদিও আজ দশ মিনিট লেট ছিল ওটা। ফাঁকা রাস্তায় অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকল সুকান্ত। এটাই লাস্ট ট্রিপ। এর পরে আর কোন বাস নেই। কাউন্টারে বসে থাকা কিশোরটা চলে যেতে যেতে বলল, “ছেনজি ধরে চইলা যান। শওরের অবস্থা বালো না। বেশিখন রাস্তায় থাইকেন না।”
“কেন?” সুকান্ত জিজ্ঞাসা করল।
“তিনটে ফকিরের লাশ পাওয়া গ্যাসে কাইলক্যা। ম্যাচাকার অবস্থা।”
সুকান্ত আরো কিছু শুনতে চাচ্ছিল। তার আগেই ছেলেটা সব গুছিয়ে নিয়ে অন্ধকারে হারিয়ে গেল।
ফকির খুন হওয়া কোন বড় ব্যাপার না। মাঝে মাঝে এলাকা ভাগাভাগি নিয়ে এদের ভেতরে দ্বন্দ্ব হয়। খুনখারাপিও হয়। খুচরা ছিনতাইকারীরাও মাঝে মাঝে দু একজনকে মেরে সব লুটে নেয়। কিন্তু খা-খা করা এই রাজপথে কথাগুলো শুনে সুকান্তের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। ষষ্ঠ ইন্দ্ৰিয় ওখানেই দাঁড়িয়ে ছিল, সুকান্তের পাশে। কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল সেটা, তার আগেই একটা সিএনজিকে আসতে দেখা গেল প্রকাশনী পাড়ার ওইদিক থেকে। হয়ত বলতে চাচ্ছিল, পেনড্রাইভটার সাথে এই প্রত্যেকটা মৃত্যু সম্পর্কিত।
সিএনজির ভাড়া দেওয়ার মত আর্থিক সংগতি সুকান্তের নেই। তাই তাকিয়ে থাকা ছাড়া উপায় নেই। ভ্ররর ভ্ররর করে এগিয়ে আসছে সিএনজিটা। শেয়ারে যাবে, এমন বিশ্বস্ত কাউকে পাওয়া যাবে না এই মুহূর্তে।
হঠাৎ সুকান্তকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সিএনজিটা থামল। সিএনজি চালক মাথা বের করে জিজ্ঞাসা করল, “যাবেন নিহি ভাইজান?” সুকান্ত কিছুটা আশ্বস্ত হল। যদিও তার যাওয়ার ইচ্ছা নেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তের ডাক কে-ই বা অবজ্ঞা করতে পেরেছে আজ পর্যন্ত?
সুকান্ত যাবে ধরেই নিয়ে খনখনে গলায় চালক জিজ্ঞাসা করল “কদ্দুর যাইবেন?” সিএনজির ভেতরটা অন্ধকার। তাই ভালো করে চালকের মুখ দেখা যাচ্ছে না।
“উপশহরের ওইদিকে।” সুকান্ত বলল। ভালো করে লক্ষ্য করতেই দেখল ভেতরে একজন আরোহী আছে। কিন্তু অন্ধকারে তারও মুখ দেখা যাচ্ছে না। এত রাতে এইভাবে একা একজন আরোহীর সাথে সিএনজিতে যেতে সুকান্তের মন সায় দিল না।
“আরে ভয় নাই। উডেন। আপায় সরকারের মোড়ে নাইমা যাইব।” সুকান্ত ইতস্তত করছে দেখে চালক বলল। আরোহী তারমানে মহিলা? নাহ। সুকান্ত এদিক ওদিকে তাকালো। আরেকটু পরে সিএনজিও পাওয়া যাবে না।
বাধ্য হয়ে সিএনজিতে উঠে পড়ল সে। মহিলা বাম দিকে সরে গিয়ে তাকে জায়গা করে দিল।
সিএনজির ভেতরে মিষ্টি একটা গন্ধ। রজনীগন্ধা ফুল গোলাপজলে ভেজালে যেমন গন্ধ হয় তেমন। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় সুকান্তকে যেকোন মুহূর্তের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলল। মহিলার হাতের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। রুমাল দেখলেই সতর্ক হয়ে যেতে হবে। ধারালো কিছু বের করলে সাথে সাথে হাতের কবজি চেপে ধরতে হবে। কামড় দিতে পারে। কাজেই উল্টাপাল্টা কিছু হলেই মুখে দুই ঘা বসিয়ে দিতে হবে মহিলার। কিন্তু যদি মহিলার আরো সাঙ্গ পাঙ্গ থাকে? তারা যদি সিএনজি থামিয়ে উঠে পড়ে? এটা ভেবে ভেতরে ভেতরে মিইয়ে গেল সুকান্ত।
সিএনজি এগিয়ে যাচ্ছে। ফাঁকা রাস্তা। তাই গতিও বেশি। রাস্তার ধারের ল্যাম্পপোস্টগুলো পেছন দিকে হারিয়ে যাচ্ছে। দরজার গ্রিলের ভেতর দিয়ে শোঁ শোঁ করে রাতের বাতাস ঢুকছে। সুকান্ত আড়চোখে মহিলার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার খোঁচাচ্ছিল- যেকোন মূহুর্তে একটা কিছু হয়ে যেতে পারে। কিন্তু সেটা কি- সুকান্ত জানে না। সুকান্তের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ও বলতে পারল না।
দশ মিনিটেও যখন কিছু হল না, তখন সুকান্তের মস্তিষ্ক পেনড্রাইভটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেল। মাংসপেশিগুলো শিথিল হতে শুরু করল। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় চুপ হয়ে গেল। নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হয়ে আসল। বাতাসের শব্দ আর সিএনজির এক ঘেয়ে এরর এরর শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।
পেনড্রাইভটা ডেক্রিপ্ট করাতে হবে যত দ্রুত সম্ভব। সুভাষদা দায়িত্ব নিয়েছে। যদি কালকের ভেতরে কিছু না হয় তাহলে সুকান্ত নিজেই কিছু একটা করবে। তার অনেক পুরনো একজন বন্ধু আছে, নাম রাসিক। সফটওয়্যার ডেভেলপার। এক্সবিট নামের একটা কোম্পানীতে চাকরি করে। বাড্ডায় অফিস। ওর কাছে গেলে নিশ্চয় ও ফেরাবে না। ডিক্রিপ্ট করতে না পারুক, কোন একটা উপায় হয়ত বলতে পারবে।
সিএনজির এক ঘেয়ে দুলুনিতে তন্দ্রা এসে গেল। নাহ, ঘুমানো যাবে না। কোনভাবেই না। এই তো চলে এসেছি। নিজেকে বোঝাল সুকান্ত। বাসায় পৌঁছেই ছাদের ওপরের চৌবাচ্চা থেকে এক বালতি পানি তুলে গোসল করতে হবে। তারপর সামনের হোটেল থেকে আসা ভাত তরকারি খেয়ে ঘুম। মাথার কাছের জানালাটা খুলে দিতে হবে। রাতের দখিনা বাতাস আসবে। কাঁথা মুড়ি দিয়ে শান্তির একটা ঘুম হবে।
ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আবার কিছু একটা যেন বলতে যাচ্ছিল।
হঠাৎ কড়া একটা ব্রেক। সুকান্ত ছিটকে সামনের গ্রিলের সাথে ধাক্কা খেল। গ্রিলের সাথে ঝুলতে থাকা একটা ন্যাকড়াতে মুখ পড়তেই সব অন্ধকার। অচেতন হওয়ার আগে তীব্র একটা ব্যথা অনুভব করল সে।
****
পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে বের হচ্ছেন কেবল, রাত প্রায় এগারটা, ঠিক এই সময়েই রিসিপশন থেকে ইন্টারকম থেকে ফোন আসল আমানুল্লাহর কাছে। আরেকটা নতুন খুন হয়ত। রিসিভার তুললেন। ওপাশ থেকে জানানো হল, একজন দেখা করতে এসেছেন। ভিআইপি; কে ভিআইপি?
নিচে নেমে দেখলেন, ক্রিমসন পাবলিশার্সের মালিক অপরেশ পাল। ঢ্যাঙ্গা শরীরটা রিসিপশনের ডেস্কের ওপরে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আর রিসিপশনের মেয়েটা খুব আগ্রহ নিয়ে কিসে যেন অটোগ্রাফ নিচ্ছে। আমানুল্লাহকে দেখেই উঠে দাঁড়ালো মেয়েটা। অপরেশও তাকালেন আমানুল্লাহর দিকে।
“আদাব। কেমন আছেন?” অপরেশ বললেন। করমর্দনের জন্য বাড়িয়ে দিলেন হাত। লম্বাটে মুখটায় ফুটে উঠল অমায়িক হাসি। আমানুল্লাহও হাত বাড়ালেন, কিন্তু সেটা অনিচ্ছায়। কঙ্কালসার আঙুলগুলো তার হাতের ভেতরে নরম কেঁচোর মত কিলবিল করে উঠল।
আমানুল্লাহ বললেন, “ভালো আছি। এই অসময়ে? জরুরী কিছু?”
“পুলিশদের আবার সময় অসময় কি? ডাক্তার আর পুলিশ- এদের সব সময়ই সময়, আবার সব সময়ই অসময়।” হাসতে হাসতে বললেন অপরেশ।
আমানুল্লাহর ভীষণ বিরক্ত লাগল। মানে কি? ডাক্তার আর পুলিশেরা মানুষ না? তাদের বিশ্রামের প্রয়োজন নেই? কিন্তু মুখে কিছুই বললেন না। আলগোছে মাথা নাড়লেন।
অপরেশ বললেন, “আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। সেগুলো বলেই বিদায় নেব। বেশি সময় নেব না। কোথায় বলা যায়?”
“আপনি কি এখন কথা বলেই বাড়ি ফিরবেন?” আমানুল্লাহ বললেন।
“হ্যাঁ। অফিস থেকেই ফিরছিলাম। তো ভাবলাম আপনাকে কথাটা বলেই যাই। কেন বলেন তো?”
“আমিও ফিরব। চলেন আপনাকে নামিয়ে দেই। গাড়িতেই কথা হবে।”
“বেশ বেশ। তাও হয়। মাচ অবলাইজড স্যার। হা হা হা হা।”
দুজনেই পার্কিং লটে বেরিয়ে এলেন। এই বেশ ভালো হল, আমানুল্লাহ মনে মনে ভাবলেন; কোথাও দাঁড়িয়ে কথা বলতে ধরলে হয়ত এক ঘণ্টা পার করে দিত লোকটা। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। গাড়ির লক খুলতে খুলতে বললেন, “থাকেন কোথায় আপনি?”
“এইতো গুলশান ২। ৫৯ নাম্বার রোডে একটা ফ্ল্যাট নিলাম।”
আমানুল্লাহ প্রমাদ গুনলেন। সর্বনাশ! তিনি থাকেন সিদ্ধেশ্বরীতে। এখন মতিঝিল ঘুরে আবার গুলশান যেতে যেতে তো ভোর হয়ে যাবে!
“আপনি থাকেন কোথায়?” অপরেশ জিজ্ঞাসা করলেন।
“এই তো, কাছেই। সিদ্ধেশ্বরীতে।”
ঘর ঘর করে গাড়ি স্টার্ট হল। “ওহ, তাহলে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। আমাকে মতিঝিলে নামিয়ে দিলেই হবে। আমি গাড়ি পাঠাতে বলছি। সন্ধ্যার দিকে আপনার বৌদি আবার একটু বেরিয়েছিল তো গাড়ি নিয়ে।” আমানুল্লাহ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন।
অপরেশ একটা বেনসন অফার করতে যাচ্ছিলেন আমানুল্লাহকে। কি ভেবে আর করলেন না। বললেন, “যে কারণে আসা। আপনার কাছে আমার একটা রিকুয়েস্ট আছে।”
“কি রিকুয়েস্ট?”
“আশা করব আপনি রিকুয়েস্টটা রাখবেন। রিকুয়েস্ট বললে আসলে ভুল হবে। মনে করেন, এটা আমার আবদার। বড় ভাইয়ের কাছে ছোট ভাইয়ের আবদার।”
“কি আবদার?”
“ইমন মোস্তাফিজের কেসটা আপনি ইনভেস্টিগেট করবেন না।”
আমানুল্লাহ শক খেলেন বলে মনে হল। খুব কষ্ট করে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করলেন। স্বাভাবিকভাবে, রাস্তা থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, “কেন?”
“কারণ লোকটা ভালো না। মানে, লোকটাকে আমি চিনতাম আর কি। সব সময় ড্রিংক্সের ওপরে থাকত। তার ওপরে মেয়েছেলের বদঅভ্যাস ছিল। মাঝখানে মেন্টাল ব্রেক ডাউন হয়েছিল লোকটার বুঝলেন? এন্টি ডিপ্রেসেন্ট খেত।”
“ইনভেস্টিগেশান বন্ধ করার এগুলো কোন কারণ হতে পারে না। যতক্ষন না আমরা নিশ্চিত হচ্ছি যে এটা সুইসাইড কেস ততক্ষণ আমাদেরকে তদন্ত চালিয়ে যেতেই হবে। আফটার অল, ভালো হোক খারাপ হোক, লোকটা এদেশের নাগরিক।”
গুলিস্তানের বিষাক্ত জ্যাম ঠেলে গাড়ি তখন এগোচ্ছে।
“নাগরিক, কিন্তু ক্রিমিনাল।”
“ক্রিমিনাল বলতে?”
“ক্রিমিনাল বলতে, লোকটা ড্রিংক করত। বউটাকে তো পিটিয়েই মেরে ফেলেছে।”
“সেটা অনেক আগের ঘটনা। তাছাড়া উনার স্ত্রীর মৃত্যুর ব্যপারে উনার হাত আছে এমন কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলে জানি।”
“আমি লোকটাকে কাছ থেকে দেখেছি। একেবারে এরোগেন্ট। উচ্ছৃঙ্খল। মাথা খারাপ টাইপের লোক ছিল। যাকে তাকে যা তা বলত।”
“আপনি এটা বলার জন্যই এসেছেন?”
“বলতে পারেন।”
আমানুল্লাহ আর কথা বললেন না। জ্যাম ঠেলে পল্টন মডেল থানার পেছন দিক দিয়ে গাড়িটা এগিয়ে যেতে থাকল মতিঝিলের দিকে। গাড়ির ভেতরে এক অস্বস্তিকর নীরবতা। অপরেশ মনে মনে একটা উত্তর আশা করছেন।
গাড়িটা মতিঝিলের মোড়ে দাঁড় করিয়ে আমানুল্লাহ বললেন, “আমি কি কখনও আপনাকে বলেছি যে, অপরেশ সাহেব, অমুক বইটা ছাপাবেন না?”
অপরেশ হে হে করে বিভ্রান্তি মাখানো হাসি দিল।
“বলিনি। তাহলে আপনার কি উচিৎ হচ্ছে আমাকে বলা যে আমি কোন কেসটা ইনভেস্টিগেট করব আর কোন কেসটা করব না?” আমানুল্লাহ বললেন খুব স্বাভাবিক এবং ভাবলেষহীন কণ্ঠে। “এটা আমাদের কাজ। আমাদের দুজনের দুরকম কাজ। তাই দুরকম কাজ নিয়েই দুজনের থাকা উচিৎ। তাই না?”
অপরেশ কিছুই বললেন না। বোকা বোকা হাসি হেসে মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “আপনার সাথে কথা বলে খুব ভালো লাগল আমানুল্লাহ সাহেব। আপনার যুক্তিটা চমৎকার ছিল। আই এম সরি। রিয়েলি ভেরি সরি। আসলে… বাদ দেন। একদিন আসেন না আমার বাসায়? আরো কথা হবে। হুম?”
আমানুল্লাহ মাথা নাড়লেন।
অপরেশ গাড়ির দরজা খুলে বের হয়ে গেলেন। কাকে যেন ফোন করলেন। ড্রাইভারকে হয়ত।