বিপদের ঘনত্ব
“সামনে উপবিষ্ট অতিথিবৃন্দ এই বর্ষার বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় আপনাদেরকে জানাই একরাশ স্নিগ্ধ কদমফুলের শুভেচ্ছা। আপনাদেরকে আমাদের মাঝে পেয়ে আমরা সত্যিই আনন্দিত এবং একই সাথে ভাগ্যবান। গুটি গুটি পায়ে চলতে থাকা শিশুর মত ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের আতিথেয়তা যে আপনারা গ্রহন করবেন, তা আমরা কল্পনাও করতে পারিনি। আমরা কৃতজ্ঞ। খুব শীঘ্রই আমাদের মাঝে উপস্থিত হবেন আমাদের শ্রদ্ধেয় ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের কর্ণধার অপরেশ পাল। তার উদ্বোধনী বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হবে আমাদের আজকের আয়োজন, যার জন্য আমরা এতক্ষণ ধৈর্য্য ধরে সাগ্রহে বসে আছি। তারপর আমাদের মধ্যে উপবিষ্ট গুণীজনদের বক্তৃতার মাধ্যমে শুরু হবে স্বল্পদৈর্ঘ্য মতবিনিময়। তারপর মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, যেটাতে অংশগ্রহন করবেন দুই বাংলার বিশিষ্ট শিল্পীবৃন্দ। এবং সব শেষে ক্রিমসন পাবলিকেশন্স নিবেদিত রাইটো-এড্রেনালিন পুরষ্কার বিতরনী।”
অফিস সহকারী মহিলাটি থামল। অতিথিদের দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল তাদের প্রতিক্রিয়া। ভালোই হয়েছে মনে হয়, নাকি?- নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করল সে। যাই হোক, এখনও তো সময় পড়ে আছে।
হঠাৎ মঞ্চের এক পাশে অপরেশ পালকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ভদ্রমহিলাটি বলল, “এখন মঞ্চে উপবিষ্ট হচ্ছেন ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের কর্ণধার শ্রদ্ধেয় অপরেশ পাল।”
অপরেশ পাল মঞ্চে উঠলেন। তার সাথে একজন তরুণী। নতমস্তকে সে অপরেশ পালের ডান পাশে দাঁড়ান।
অপরেশ পালের চোখে মুখে চাপা উদ্ভ্রান্তি। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলরুমটাতেও তার কপাল আর নাকে জমে উঠেছে শিশিরের মত ঘাম। লম্বা কয়েকটা শ্বাস নিয়ে মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়ালেন। অতিথিদের দিকে একবার চোখে বুলিয়ে নিলেন। হাতড়ে কথা খোঁজার চেষ্টা করছেন যেন। জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে নিয়ে বললেন, “কেউ নড়বেন না। সবাই যে যার সিটে বসে থাকেন। এই মেয়েটার শরীরে বম্ব বাঁধা আছে। কেউ বাইরে বের হওয়ার চেষ্টা করলেই মৃত্যু। একটু পরে গানবাজনা শুরু হবে। চুপ করে বসে সবাই গান শুনবেন।”
কথা শেষ করেই পাঞ্জাবীর পকেট থেকে একটা রিভলবার বের করলেন। পাশে দাঁড়ানো অফিস সহকারী ভদ্রমহিলাকে গুলি করলেন। কান ফাটানো শব্দটা পুরো হলরুমে প্রতিধ্বনিত হল। ভদ্রমহিলা কাটা কলা গাছের মত পড়ে গেল মঞ্চের ওপরে।
এলোমেলো চিৎকারে ভারি হয়ে গেল হলরুম। পাশে দাঁড়ানো তরুণীটাও কেঁপে উঠল, ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করল। অপরেশ তরুণীকে খামচে ধরে মেয়েটার জামা তুলতেই তরুণীর শরীরে বাঁধা বম্ব দেখা গেল। নেমে এলো নিস্তব্ধতা। নিকৃষ্ট দুঃস্বপ্নের নিস্তব্ধতা। কয়েকজন মহিলা অতিথির মুখ চাপা কান্নার শব্দ যোগ হল তার সাথে।
****
ঝম ঝম করে বৃষ্টি নেমেছে।
পুলিশ ঘিরে ফেলেছে শিল্পকলা একাডেমী। আশেপাশের সবগুলো রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে তীব্র যানজটের। বেশ কয়েকটা সংবাদমাধ্যমের গাড়ি এসে ভিড় করেছে পুলিশ ব্যারিকেডের সামনে। সংবাদমাধ্যম কর্মীরা ঢোকার চেষ্টা করছে। কিন্তু পুলিশ ঢুকতে দিচ্ছে না। ছোট বড় ছাতায় পুরো জায়গাটা ভরে গিয়েছে।
হঠাৎ ওয়াকিটকি খড় খড় করে উঠতেই রেইনকোর্ট পরিহিত পুলিশগুলো তৎপর হয়ে উঠল। ব্যারিকেডের সামনে ভিড় করা গাড়িগুলোকে সরাতে শুরু করল। একটু পরেই তীক্ষ্ম সাইরেন বাজিয়ে উপস্থিত হল পুলিশের তিনটা ভ্যান। একটা ছাতা নিয়ে ছুটে এলো একজন পুলিশ। জীপের দরজা খুলে কমিশনার সাহেব বের হয়ে আসতেই ছাতা ফুটিয়ে তার মাথার ওপরে ধরল সে। আমানুল্লাহর মাথার ওপরেও একজন পুলিশ ছাতা ধরতে যাচ্ছিল, আমানুল্লাহ হাত নেড়ে না করে দিলেন।
রমনা থানার ওসি ছুটে এলেন। বললেন, “স্যার, ভেতরে প্রায় একশ জন মত আছে। একটু কম বেশি হতে পারে। সবাইকে জিম্মি করে রাখা হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভেতরে কারো সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে যেটুকু জানা গিয়েছে, ভেতরে নাকি বম্ব আছে।” কঠিন মুখে আমানুল্লাহ শুনলেন কথাটা। ওসি আরো বললেন, “স্যার, ভারতীয় হাইকমিশন থেকে চাপ আসছে। ভেতরে প্রায় ত্রিশজন মত লেখক আছেন। বাংলাদেশেরও প্রায় পঞ্চাশ ষাটজন মত আছেন। সব মিলিয়ে খুব ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন স্যার।”
আমানুল্লাহ বললেন, “কোন ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশান না। বম্বটা কোথায় কীভাবে আছে সেটা জানার চেষ্টা করেন। সেটা জানা হয়ে গেলেই বম্ব ডিফিউজিং ইউনিটকে পাঠান। আর ভেতরে কয়জন অস্ত্রধারী ক্রিমিনাল আছে সেটা জানান। পারলে যেকোন ভাবে ভেতরে একটা ছোটখাট ক্যামেরা পাঠান। যেভাবেই হোক। ভেতরের ব্যাপারটা জানতে পারলে পুরোটা সহজ হয়ে যাবে।” ওসি সাহেব মাথা নাড়লেন। দৌড়ে চলে গেলেন।
আমানুল্লাহ ভিজতে লাগলেন। হঠাৎ তার সেলফোনে একটা কল আসলো। আননোন নাম্বার। আমানুল্লাহ কল রিসিভ করলেন। ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ খড় খড় করে একটা শব্দ হল। তারপর একটা পরিচিত গলা বলে উঠল, “আমানুল্লাহ সাহেব। আমি চলে যাচ্ছি। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আমাকে এত চমৎকার এডভেঞ্চার, এত চমৎকার কিছু অভিজ্ঞতা দেওয়ার জন্য। আমি লেখক। অভিজ্ঞতার কাঙ্গাল আমি। আপনার কাছে আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকব। যাই হোক, আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা না করে মেয়েটার জীবন বাঁচান। একটু পরে আপনার ফোনে একটা ভিডিও যাবে। সেটা দেখে নিয়েন। ভালো থাকবেন।”
আমানুল্লাহকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়েই এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলল জয়েনুদ্দীন। তারপর লাইন কেটে দিল। আমানুল্লাহ কয়েকবার কল করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু নাম্বার বন্ধ দেখাল। কিছুক্ষণ পরে একটা এমএমএস আসলো। একটা ভিডিও। ভিডিও অন করতেই গায়ের রক্ত পানি হয়ে গেল আমানুল্লাহর।
ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মঞ্চের ওপরে কয়েকজন বসে গান গাচ্ছে। আর মঞ্চের একেবারে মাঝখানে বসে আছে একটা মেয়ে। তার গায়ে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধা আছে একটা জ্যাকেট; একটা বম্ব লাগানো জ্যাকেট। তারপর একজন লোককে স্ক্রিনে দেখা গেল। লোকটা বলল, “একটা হেলিকপ্টার পাঠান, ঠিক রাত দশটার ভেতরে। আমি যতক্ষণ নিরাপদ থাকব, এই মানুষগুলোও নিরাপদ থাকবে। আমি হেলিকপ্টারে ওঠার আগ পর্যন্ত এরা আমার হাতে জিম্মি থাকবে। আর হেলিকপ্টার থেকে নামা পর্যন্ত নিরাপদ থাকবে আপনার মেয়ে। খুব বড় ভুল করেছেন আমানুল্লাহ। হিরণকে খুন না করলে হয়ত এত কিছু হত না। এই মানুষগুলো মারা গেলে এদের সবার হাতে রক্ত কিন্তু আপনার হাতেই লেগে থাকবে।”
ভিডিওটা শেষ হয়ে গেল।
মেয়েটা আর কেউ না, তন্দ্রানীলা। লোকটা আর কেউ না, অপরেশ পাল।
ভিডিওটা কমিশনারকে দেখালেন তিনি।
আমানুল্লাহর সামনে এখন দুইটা রাস্তা খোলা, হয় নিজের মেয়েকে বাঁচাতে হবে, অথবা নিজের মেয়েকে কুরবানি দিয়ে জয়েনুদ্দীনকে ধরতে হবে।
সৃষ্টিকর্তা মানুষের সামনে এত কঠিন কঠিন বিকল্প কেন রাখেন?
তবু শেষ চেষ্টা
একটা রবীন্দ্র সংগীত শেষ হল কোন হাততালি ছাড়া। মৃত্যু বর্ণগন্ধহীন। আর মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা, তা আরো শুধু বর্ণহীনই না, একেবারে নিকষ কালো। পুরো হলরুমের সবাই নিশ্চুপ। কেউ কোন কথা বলছে না। সবার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে মোবাইল ফোন। যারা কেড়ে নিয়েছে, তাদেরকে আয়োজক বলে ভুল করেছিল অতিথিরা। আসলে এরা সবাই ‘শব্দযাত্রা লেখক সংঘের সদস্য’।
একেবারে সামনের সারির মাঝামাঝি একটা চেয়ারে বসে আছে অপরেশ পাল। তার আশেপাশে রিভলবার হাতে দাঁড়িয়ে আছে লেখক সংঘের বেশ কিছু সদস্য। যারা অপরেশ পালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। তার নিশ্চুপ বসে থাকাটা যেন কিছুটা অস্বাভাবিক। তিনিও কি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছেন? তার বাম হাত একটা কালো রিমোট নিয়ে খেলায় ব্যস্ত। অন্যদের জীবন তার হাতে, এটাই কি তার নীরবতার কারণ? নাকি তিনিও অন্যদের মতই মৃত্যু পথযাত্রী?
মঞ্চের মাঝখানে মূর্তির মত বসে আছে তন্দ্রানীলা। তার মধ্যে কোন অনুভূতি আছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না। মঞ্চের নীলাভ আলোতে তাকে দেবী বলে মনে হচ্ছে।
নাচের দলটা মঞ্চের পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। এই দলের ভেতরে একজন মেয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করছে একটা বিশেষ ঘটনা ঘটার। মেয়েটার নাম মল্লিকা। আজ এক ভারতীয় বান্ধবীর নিমন্ত্রণে এখানে এসেছিল সে। নিছক বান্ধবীর সাথে নাচ করবে এটাই ছিল উদ্দেশ্য। দুপুরের দিকে এলিন ফোন করলেও তাই বের হতে পারেনি। কিন্তু এইখানে এতকিছু হবে সে কল্পনাতেও ভাবেনি। এই পরিস্থিতি সে এড়িয়ে যেতে পারবে না। এটা তাকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে এক অদেখা জীবনের সামনে। এই মুহূর্তে তাকেই কিছু একটা করতে হবে।
অপরেশ পাল ইশারা করলেন। সাথে সাথে একটা নাচের দল মঞ্চে উঠে পড়ল। গান শুরু হল। ছয় সদস্যের নাচের দলটা হাত পা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে নাচতে শুরু করল।
তাদেরই একজন একটা ছোট্ট চিরকুট ফেলল মঞ্চের মাঝখানের বসে থাকা তন্দ্রানীলার কোলে, বাকিরা এই দৃশ্যটা আড়াল করল একটা রাজহাঁসের মূদ্রার মাধ্যমে।
কাঁপা হাতে চিরকুটটা খুলল তন্দ্ৰানীলা,
‘আমি মল্লিকা। আপনার পরিচিত। রিমোটটা পড়লেই দৌড় দেবেন।’
রাজহাঁস সরে গেল। তাড়াতাড়ি চিরকুটটা ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে ফেলল তন্দ্রানীলা। বিষণ্নতা সরে গিয়ে তার মুখে ফুটে উঠল এক আতঙ্ক। অনিশ্চয়তার আতঙ্ক।
কখন রিমোটটা পড়বে? কখন তাকে দৌড় দিতে হবে? কোন দিকে দৌড় দেবে সে?
****
ডিআইজি এসেছেন পনেরো মিনিট হল। কিছুক্ষণ আগেই পুলিশ কমিশনারের সাথে তার সংক্ষিপ্ত মিটিং শেষ হয়েছে। হাতে সময় কম। তাই তিনি থাকতে পারলেন না। যা করার পুলিশ কমিশনারকে করতে হবে। কিন্তু মিটিং-এর সারমর্ম শুনে আমানুল্লাহর মাথা বাজ পড়ল। পুলিশ কমিশনার বললেন, সোয়াট কমান্ডো টিম ছাদের ওপর থেকে ব্রিচ করবে। সিলিং ভেঙে ভেতরে ঢুকে ওরা একশন নেবে।
আমানুল্লাহ বললেন, “আপনারা পাগল হয়েছেন? ডিআইজি স্যার আসলেন, অথচ আমার সাথে একবার দেখা করলেন না পর্যন্ত? এই কাজটা করলে কী হবে আপনি ভাবতে পারেন? পুরো হলরুম উড়ে যাবে। বোমা ফাটাতে ওদের এক মুহূর্ত লাগবে।” নিজের একমাত্র মেয়ের কথা ইচ্ছা করেই গোপন রাখলেন। ব্যক্তিগত স্বার্থ টানা যাবে না এখানে।
পুলিশ কমিশনার একগুয়ের মত বললেন, “কিন্তু এটা ছাড়া তো উপায় নেই আমাদের। ওরা ভেতরে কয়জন আছে। কি অবস্থায় আছে আমরা কিছুই জানি না। এটাই একমাত্র পথ ভেতরে ঢোকার। রাত দশটা বাজতে মাত্র দুই ঘণ্টা বাকি। হ্যান্ডমাইকের মাধ্যমে ওদের সাথে নেগোশিয়েট করার অনেক চেষ্টা করা হয়েছে, কোন লাভ হয়নি। ওরা ওদের জায়গায় অনড়। তাছাড়া…..তাছাড়া, রাত দশটার মধ্যে কিছু না হলে সেনাবাহিনী হ্যান্ডেল করবে এটা।”
আমানুল্লাহ একটা চাপা অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলেন। কমিশনার জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনার কাছে কোন বেটার প্ল্যান আছে? থাকলে বলতে পারেন।”
ভেতরটা ছটফট করতে লাগল আমানুল্লাহর। তার কাছে কোন বেটার আইডিয়া নেই। এতদূর এসে শেষমেষ হেরে যেতে হবে, হার মেনে নিতে হবে। মেয়েটাকেও হয়ত হারাতে হবে।
****
নাচ শেষ করে নাচের দলটা নেমে যেতে শুরু করল। হঠাৎ মল্লিকা বলে উঠল, “কৃতজ্ঞতা স্বরুপ আমরা ছয়জন, ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের কর্ণধার, শ্রদ্ধেয় এবং আমাদের প্রাণপ্রিয় অপরেশ পালকে কিছু বলতে চাই।”
ছয়জনেই দাঁড়িয়ে পড়ল। দুইজন মঞ্চ থেকে নেমে দাঁড়ালো। যেন যা বলার ও-ই বলুক আমার বলার ইচ্ছা নাই। অপরেশ পালের আশেপাশে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডগুলো হাত নেড়ে না না করতেই অপরেশ পাল তাদেরকে থামিয়ে দিলেন। ইশারায় বললেন, “কি বলবা বল।”
মল্লিকা বলল, “মাইক্রোফোন কই?”
একজন গার্ড একটা মাইক্রোফোন এনে দিল।
কয়েকবার মাইক্রোফোনে হাত দিয়ে বাড়ি মারল। ঠোঁট উল্টিয়ে বলল, “হয় না তো।” বলার সাথে সাথে মাইক্রোফোনকে আলগোছে অপরেশ পালের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল, “দেখেন তো কি হয়েছে।”
অপরেশ পাল সেটা ধরার জন্য উঠে দাঁড়ালেন। তার মুখ বরাবর মাইক্রোফোনটা উড়ে এলে হাত থেকে রিমোটটা ফেলে দিয়ে খপ করে মাইক্রোফোনটা ধরলেন। আর মঞ্চের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা দুইজনের ভেতরে একজন ছুটে গিয়ে রিমোটটা কুড়িয়ে নিল।
পুরো ব্যাপারটা হল মুহূর্তের ভেতরে।
বুঝতে সময় লাগল এক সেকেন্ড। দ্বিতীয়তম সেকেন্ডেই দৌড় দিল তন্দ্রানীলা। কোথায়? জানে না। হয়ত মঞ্চের পেছন দিকে। হয়ত মঞ্চের সামনের দিকে।
****
“প্লিজ স্যার, আর একটু অপেক্ষা করেন প্লিজ। অন্য কোন উপায় বের করা যায় কিনা দেখি না। এতগুলো লোকের জীবন শেষ হয়ে যাবে। ভারতীয়দের একজনের কিছু হলে ইন্ডিয়ান এম্ব্যাসী আমাদের ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।” আমানুল্লাহ বললেন। তার চোখে মুখে চাপা উৎকণ্ঠা। সোয়াট টিম এরই মধ্যে শিল্পকলার আঙিনাতে প্রবেশ করতে শুরু করেছে। আর ব্রিচ টিম হেলিকপ্টার নিয়ে হলরুমের অনেক ওপরে অবস্থান করছে। এই মুহূর্তে যে কোন কিছু ঘটে যেতে পারে। আর যাই ঘটুক না কেন, তার ফলাফল পড়বে তন্দ্রানীলার ওপরেও।
কমিশনার খানিকটা বিরক্ত হয়ে বললেন, “অন্য উপায় ভাবার মত সময় হাতে নেই। তা ছাড়া, দু একজন ইন্ডিয়ানের জন্য যদি সবার জীবন বাঁচে তাতে ক্ষতি কি?”
আমানুল্লাহ আর সামলাতে পারলেন না, চিৎকার করে বললেন, “স্যার আমার মেয়ে আছে ওখানে।”
একটা অপার্থিব অবিশ্বাসভরা দৃষ্টিতে আমানুল্লাহর দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, “আপনি আগেন বলেন নাই কেন?”
****
সোয়াট টিম ছাদে নামতে শুরু করেছে। বড় বড় চারটা ফুটো করতে হবে। তারপর কাঁদুনে গ্যাস আর এনেস্থেটিক গ্যাস ছাড়তে হবে। ভেতরের হলরুমটার যে আকার, তাতে এইভাবে ছাড়া আর অন্য কোন উপায় নেই।
ছাদ ফাটাতে গিয়ে যেন প্রাণহানি না ঘটে সে জন্য বেশ কয়েকটা জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে যেখানে মানুষ কম থাকে। যেমন মঞ্চের পাশে, মঞ্চের পেছনে। তারপরেও যদি দু একটা প্রাণহানি ঘটে সেটা মেনে নিতে হবে ‘কোল্যাটেরাল ড্যামেজ’ হিসাবে।
সোয়াট টিমের কমান্ডার ইশারায় বিস্ফোরক লাগাতে বললেন।
****
রিমোটটা নিয়ে নাচের দলের সদস্য ছেলেটা দৌড় দিল। এমন পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত ছিল না কেউই। আশেপাশের অস্ত্রধারী গার্ডগুলো থতমত খেয়ে গেল। গুলি না ছুঁড়ে তারা ছেলেটার পেছন পেছন দৌড় দিল।
গার্ডদের কেউই পেশাদার গার্ড না। তাদের হাতে জোর করে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয়েছে- বুঝতে পারল মল্লিকা। এতে তার সাহস কিছুটা হলেও বাড়ল। অপরেশ পাল ক্ষ্যাপা কুকুরের মত তেড়ে আসল মল্লিকার দিকে। বুক ভরে একটা শ্বাস নিল সে। এখন অপরেশ পাল গুলি করলেও তার আফসোস নেই। পরিস্থিতি প্রমাণ করে দিয়েছে, মল্লিকা একজন সফল এজেন্ট।
ঠিক তখনই পর পর চারটা বিস্ফোরণে ঝুর ঝুর করে ঝরতে শুরু করল কংক্রিটের গুঁড়ো। টং টং করে শব্দ করে কি যেন পড়তে শুরু করল হলরুমের মেঝেতে।
হলরুমটা ধোঁয়ায় ভরে যেতে শুরু করল। গ্রাপল হুকে করে নেমে আসতে শুরু করল সোয়াট টিমের সদস্যরা।
****
তন্দ্রানীলা দৌড়াচ্ছে। দৌড়াচ্ছে কোন কিছু না ভেবেই। সে কি মারা গিয়েছে? মারা গিয়েই সে দৌড়াচ্ছে? এতক্ষণে তো রিমোটটা উদ্ধার করে ফেলার কথা অপরেশ পালের। তারপর বম্বটা ফাটিয়ে দেওয়ার কথা। এত দেরি কেন করছে?
যে কোন মুহূর্তে বম্বটা ফেটে যেতে পারে। তারপরও দৌড়াতে হবে তাকে।
দৌড়াতে দৌড়াতে হলওয়ে ধরে একটা দরজা দেখতে পেল সামনে। ধাক্কা দিতেই সশব্দে খুলে গেল সেটা। পেছন থেকে এলোমেলো কয়েকটা গুলি এসে লাগল পাশের দেয়ালের। তন্দ্রানীলা ছুটে বের হয়ে গেল।
বাইরে অন্ধকার। গাঢ় অন্ধকার। কিন্তু প্রচুর শব্দ। পুলিশের সাইরেন, মানুষের কোলাহল। কোন দিকে যাবে সে? পেছনের কারা যেন দৌড়ে আসছে। ডান দিকেই দৌড় দিল সে। ভারি জ্যাকেটটা তার শরীর কামড়ে ধরেছে, ধরছে। ঘামে জব জব করছে শরীর। শরীর পরিষ্কার জানিয়ে দিল- আর বেশিদূর সে এগোতে পারবে না।
পেছনে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। গুলি চলবে আর একটু পরেই। মৃত্যু যখন এতো কাছে, তখন এত কষ্টের দরকার কি? শরীর ছেড়ে দিল। নরম ঘাসের ওপরে পড়ে গেল তন্দ্রানীলা। দুটো হাত তাকে টেনে তুলল। অন্ধকারে হাতের মালিকের মুখ দেখতে পারলো না সে। শুধু কয়েকটা গুলির শব্দ আর পেছনে ভোঁতা শব্দ।
জ্ঞান হারানোর আগে তন্দ্রানীলা শুনতে পেলো, “ম্যাডাম, আমরা। আমি সাইদুর, চিনতে পারছেন? জ্যাকেটের রিমোটটা কোথায়?”
***
সোয়াট টিম রাবার বুলেট ব্যবহার করেছে। অস্ত্র হাতে যাদেরকেই দেখেছে, তাদের ওপরই সেটা প্রয়োগ করেছে। অপরেশ পালকে গ্রেপ্তার করেছে, সে একটা কলমের মত অস্ত্র দিয়ে আত্মহত্যা করার চেষ্টা করছিল। গোলাগুলিতে সাতজন অতিথি আহত হয়েছে। একজন বাদে কারো অবস্থা তেমন গুরুতর না। সবাইকে আস্তে আস্তে বের করে আনা হয়েছে। প্ৰায় চার তিন ঘণ্টার উৎকণ্ঠা ভরা সময় কাটিয়ে সবাই আবার তারা ভরা আকাশের নিচে এসে দাঁড়িয়েছে।
শুধু একজনের নিথর লাশ পাওয়া গিয়েছে মঞ্চের ওপরে।
মল্লিকার লাশ।
****
আমানুল্লাহ তখন ব্যস্ত। বারবার সোয়াট টিমের সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছেন। হঠাৎ একজন কন্সটেবল এসে বললেন, “স্যার, স্যার, আপনার মেয়ে।” আমানুল্লাহ ছুটে বের হয়ে আসলেন অস্থায়ী টেন্টটা থেকে।
দেখলেন, দুজন ছেলের কাঁধে ভর দিয়ে তন্দ্রানীলা ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। ছেলে দুটোকে তিনি চেনেন। সাইদুর আর আরাফ। তিনজনকে তিনি একসাথে জড়িয়ে ধরলেন। এই জড়িয়ে ধরাটা কেমন শিশুসুলভ। কোন অভিভাবকত্ব নেই এখানে। এক পথ হারানো শিশু যেন এই তিনজনকে খুঁজে পেয়ে আনন্দে জড়িয়ে ধরেছে।
“স্যার, আপনাকে, আপনাকে আবার ফিরে পাবো ভাবতে পারিনি। মানে, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না,” সাইদুর বলল।
তন্দ্রানীলাকে বুকে জড়িয়ে ধরে সাইদুরের কাঁধে হাত দিয়ে হেসে বললেন, “আমি চলে না গেলে তোমরা এই কদিনে যা শিখেছ, তা শিখতে পারতে?”
আরাফ কি যেন একটা বলতে গেল, গিয়ে কেঁদে ফেলল, আনন্দের কান্না।
তন্দ্রানীলাকে এম্বুলেন্সে তুলে দিয়ে তিনজন এগিয়ে গেল অতিথিদের দিকে। আরাফ অতি উৎসাহ নিয়ে বলল, “স্যার, ড্রোন ফুটেজ থেকে আমরা জেনেছি যে জয়েনুদ্দীনই আপনাকে গুলি করেছিল। তারপর কি হয়েছে, তা অবশ্য আমরা জানতে পারিনি।” আমানুল্লাহ সবটা বললেন। সাভার থেকে শুরু করে শিল্পকলা- সবটা। এও বললেন, জয়েনুদ্দীন পালিয়ে গিয়েছে। এই পরিস্থিতিটা সামলে উঠলেই তাকে খুঁজতে বের হবেন।
সাইদুর বলল, “কিন্তু স্যার সুকান্ত কোথায়?”
গম্ভীর মুখে আমানুল্লাহ বললেন, “বলব, সব বলব।”
তারপর ভিড়ের ভেতরে তিনজন হারিয়ে গেলেন। মল্লিকার লাশটা যখন বের করে আনা হচ্ছিল তখন, সাইদুর আর আরাফ যেন কিছু সময়ের জন্য পাথর হয়ে গেল। এই মেয়েটাকে চিনতে তারা বরাবরই ভুল করে এসেছে।
মানুষকে চিনতে আমরা বরাবরই ভুল করি, যতক্ষণ না মৃত্যু তাদেরকে গ্রাস করে। মৃত্যুই আমাদেরকে মানুষ চিনিয়ে দেয় চোখে আঙুল দিয়ে।
যবনিকার উত্তরমালা
এই বুড়ো পৃথিবীতে কিছুই নতুন থাকে না। আজকের দগদগে ক্ষত কাল পুরনো হয়ে যায়। সব থেকে কাছের মানুষগুলো তাল মিলিয়ে চলতে না পারলে তারাও পুরনো হয়ে যায়। একটা সময় পুরনো যা কিছু, হয়ে যেতে থাকে স্মৃতি। মহাকালের গ্রাসে সব কিছু ধীরে ধীরে ফিকে হয়ে যেতে থাকে। তারপরও জীবনের এত সমারোহ, বেঁচে থাকার প্রবল আকুতি- এগুলোই প্রমাণ করে মানুষ কতটা বোকা, কতটা পাগল। হ্যালুসিনেশান? বেঁচে থাকার ইচ্ছাটা হ্যালুসিনেশান বলছেন? দু একজন যদি একটা জিনিস হ্যালুসিনেট করে, সেটা পাগলামি। কিন্তু গোটা দুনিয়ার সবাই যদি একই জিনিস হ্যালুসিনেট করে, সেটাকেই আমরা বাস্তবতা বলি। এই তো?
বুড়ো পৃথিবীর আরেকটা নতুন দিনে আমানুল্লাহর কাছেও এই কেসটা ঠিক যেন একটা হ্যালুসিনেশান, একটা বিভ্রম। ঝলমলে রোদ খেলা করছে হাসপাতালের আঙিনায়। সবুজ মেহগনি গাছের পাতাগুলোতে চিকচিক করছে জমে থাকা বৃষ্টির পানি। এত মানুষের কোলাহল। এত মানুষের হৈ চৈ। শাহাবাগের মোড়ে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভেজা, হঠাৎ ফুরিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে মনে পড়া, এই যে হোঁচট খেতে খেতে বেঁচে থাকা, ঘুম থেকে উঠে প্রিয় মুখটা খোঁজার বদলে স্মার্টফোনের স্ক্রিনে ঘড়ি দেখা, এই কৃত্রিম সমাজে একটু অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই- এগুলো সব কি তাহলে হ্যালুসিনেশান? তাহলে সত্যিকারের বাস্তব কোনটা? মৃত্যু?
ভ্রররর ভ্রররর…… ভ্রররর ভ্রররর
সেলফোনটা ভাইব্রেট করে জানান দিচ্ছে, কল এসেছে। স্ক্রিনে লেখা, সাইদুর।
ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেললেন আমানুল্লাহ। গাড়ির ভেতরে কতক্ষণ বসে আছেন এভাবে? জানেন না। আজ একটু আগেভাগে অফিসে পৌঁছানোর কথা তার। অনেক প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে তাকে। গত দুইদিনে জয়েনুদ্দীনের কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি। শেষ যে কলটা সে আমানুল্লাহকে করেছিল, সেটা করা হয়েছিল আমিন বাজারের ভাগাড় থেকে। দুটো কাভার্ড ভ্যান আর পুলিশগুলোর লাশ পাওয়া গিয়েছে সেখানে। একটা কাভার্ড ভ্যান নিরুদ্দেশ। সেটাও খুঁজে পাওয়া যায়নি।
হাসপাতালের দিকে একবার তাকালেন। গত দুইদিন শ্বাসকষ্ট আর নির্ঘুম তেতাল্লিশটা ঘণ্টা কাটিয়ে তন্দ্রানীলার অবস্থার উন্নতি হতে শুরু করেছে। কড়া এনেস্থেসিয়া দেওয়া হয়েছে। শকটা কাটিয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। এলিনের অবস্থাও মোটামুটি ভালো। হাতটা রিকভার করেছে। কিন্তু এখনও কয়েকবার ড্রেসিং করতে হবে। শেষমেশ ক্ষতস্থানের দাগটা মুছবে না- এটাই যা দুঃখ। মাঝখান থেকে শুধু মল্লিকা ছেড়ে চলে গেল সবাইকে। তিনি যেমন সুকান্তের দিয়ে যাওয়া জীবনটা যাপন করছেন, ঠিক সেরকম তন্দ্রানীলাও যাপন করছে মল্লিকার দিয়ে যাওয়া জীবন।
ভ্রররর…ভ্রররর
আরেক দফা বাজতে শুরু করল সেলফোনটা। সাইদুরের কল।
ইচ্ছা করেই কল রিসিভ করলেন না আমানুল্লাহ। কতই তো ফোন ধরলেন। আজ না হয় ফোন ধরলেন না। তারপরও এই স্বার্থপর বুড়ো পৃথিবীটা ঘুরেই যাবে ক্লান্তিহীনভাবে। বার বার এমন জয়েনুদ্দীনদের জন্ম হবে। বার বার আমানুল্লাহকে হয়ত ফিরে আসতে হবে।
কালো হ্যারিয়ারটা বের হয়ে গেল হাসপাতালের গেট থেকে।
****
পুলিশ হেডকোয়ার্টারের হলরুমটায় সারি সারি চেয়ার বসানো হয়েছে। সংবাদ মাধ্যমের কর্মীরা খুব আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছেন আমানুল্লাহর জন্য। আগ্রহে অপেক্ষা করছেন পুলিশ কমিশনার আর ডিআইজি মহোদয়।
প্রায় দশ মিনিট পরে আমানুল্লাহ প্রবেশ করলেন। মাথায় ছোট ছোট চুল গজিয়েছে। মাথার ওপরকার বড় ক্ষতটা অনেকটাই ঢেকে গিয়েছে কাঁচা পাকা চুলে। একটা অ্যালুমিনিয়ামের লাঠিতে ভর দিয়ে খানিকটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে থাকা মানুষটাকে চট করে যেন চেনা যায় না। ক্যামেরার ফ্ল্যাশ ঝলসে উঠল। আমানুল্লাহ কোন ভূমিকা ছাড়াই মঞ্চে উঠে দাঁড়ালেন। ডায়াস অগ্রাহ্য করে দাঁড়ালেন মঞ্চের মাঝখানটায়। সাইদুর আর আরাফ এগিয়ে যেতে গেলে আমানুল্লাহ ইশারায় না করলেল, প্রজেক্টরটা অন করতে বললেন। কিছুটা সময় নিলেন। রুমে নেমে এলো পিনপতন নিস্তব্ধতা। বেজে উঠল সেই পুরনো আমানুল্লাহর কণ্ঠস্বর, “অপেক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ। আমি বেশি সময় নেব না। এই কেসটার একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যা যা হয়েছে সেটাই আমি ব্যাখ্যা করব। ধন্যবাদ।” খুব সাদামাটা সূচনা। যেন খুব তাড়া তার।
পকেট থেকে একটা পেনড্রাইভ বের করলেন। ডেস্কের ওপরে রাখা কম্পিউটারটায় সেটা ঢুকাতেই প্রজেক্টরে ফুটে উঠল একটা ডক ফাইল। যেটার শিরোনাম, ‘শব্দযাত্রা লেখক সংঘ’। একটা চাপা গুঞ্জন উঠল হলরুমটাতে।
এটাই হল আসল পেনড্রাইভ যেটা ইমন মোস্তাফিজ সুভাষের হাত দিয়ে সুকান্তের কাছে পৌঁছে দিতে চাচ্ছিলেন। গতকালকেই এটা ডেক্রিপ্ট করা হয়েছে।” আমানুল্লাহ বললেন। পুলিশ ডিপার্টমেন্টের বেশিরভাগ লোকজন হৈচৈ শুরু করল- না এইটা ক্যামনে হল? আমরা তো ইমন মোস্তাফিজের আসল পেনড্রাইভটা দেখেছি যেইটা সুভাষের বাড়ি থেকে আপনিই উদ্ধার করেছিলেন।
“তাহলে পুরো ব্যাপারটা প্রথম থেকে বলি।” আমানুল্লাহ বলতে শুরু করলেন। তার চোখে মুখে যেন একটা পুরাতন ক্লান্তি। একটা অবসাদ, যার কারণ হতে পারে জয়েনুদ্দীনের পলায়ন, হতে পারে নিজের মেয়ের জন্য মল্লিকার আত্মত্যাগ। কিছুক্ষণ পায়চারী করে বললেন, “এই শহরে লেখক আছেন অনেকে। আমি তেমন বইটই পড়ি না, আমার মেয়ে পড়ে। তারপরও যতটুকু জানি, লেখকরা যে জিনিসটাকে সব থেকে বেশি ভয় পান, সেটা হল ‘রাইটার্স ব্লক’। যার হয়নি, সে বুঝবে না। যেহেতু আমি লেখক না, আমার কখনও রাইটার্স ব্লক হয়নি, কাজেই আমার না বোঝাটাই স্বাভাবিক। তো, এই রাইটার্স ব্লক আতঙ্ককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে একটা প্রতিষ্ঠান। যার নাম, ‘শব্দযাত্রা লেখক সংঘ’। এই প্রতিষ্ঠানের কাজ ছিল, বই পাড়ায় কিংবা প্রেস পাড়ায় ঘুরে ঘুরে রাইটার্স ব্লকে ভোগা লেখকদেরকে খুঁজে বের করা। এই লেখকেরা বেশিরভাগ সময়েই অস্তিত্বহীনতার সংকটে ভোগেন। তাই এদেরকে কিছু সময়ের জন্য ‘স্পেশাল’ ফিল করানো হত। তাদেরকে ‘রাইটার্স ব্লক পুন:র্বাসন কার্যক্রমের’ লোভ দেখিয়ে ডেকে নিয়ে যাওয়া হত সেখানে। তারপর তাদের মগজ ধোলাই করা হত।”
“কীভাবে?” নড়ে চড়ে বসতে বসতে পুলিশ কমিশনার মহোদয় বললেন।
“এই প্রতিষ্ঠানের কর্তা ছিল জয়েনুদ্দীন। এখানে বলে রাখা দরকার, জয়েনুদ্দীন বহু আগে একটা বই লিখেছিল। যেই বইটার নাম ‘পাছাখানার ভূত’। জয়েনুদ্দীনের আসল নাম সাবদেল। জয়েনুদ্দীন তার ছদ্মনাম। এই বইটাতে সে প্রকাশক আর লেখকদের প্রতি তার প্রতীকী ক্ষোভ প্রকাশ করে। এই বই অবশ্য পরে নিষিদ্ধ ঘোষিত করা হয়। কিন্তু সেই সময়ে সাবদেল ওরফে জয়েনুদ্দীনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে এই সাবদেল, জয়েনুদ্দীন নাম নিয়ে প্রণবের মাধ্যমে আমাদের পুলিশ ডিপার্টমেন্টের কাছাকাছি চলে আসে। প্রথম দিকে পুলিশের অন্যান্য সোর্সের মত কাজ করলেও পরে সে ক্রিমিনোলজিস্টের ভূমিকা পালন করতে থাকে। এর ফলে পুলিশের চাদরের নিচে থেকেই সে করতে থাকে এক একটা জঘন্য খুন।” আমানুল্লাহ বললেন। বইটা সবার সামনে তুলে দেখান তিনি।
সাথে সাথে আরাফ বলে ওঠে, “আরে এই বই তো আমি জয়েনুদ্দীনের বাসায় দেখেছি। এটা উল্টে পাল্টে দেখতে যাব ঠিক সেই সময়েই শয়তানটা বলল — বইগুলোতে অনেক ধূলা, সরে আসো’।
আমানুল্লাহ আলগোছে মাথা নাড়লেন। বইটা পেতে তাকে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। আদালতে আবেদন করে নীরুকে রিমান্ডে নিতে হয়েছে। থার্ড ডিগ্রী না দেওয়া পর্যন্ত সে বইটা দিতে রাজি হয়নি।
“আমরা যতদূর জানি যে, লোকটা পোস্টমর্টেম ছাড়াই খুনের ব্যপারে অনেক কিছু বলে দিতে পারত, এমনকি খুনির মোটিভও।” ডিআইজি সাহেব বললেন।
আমানুল্লাহ মাথা নাড়লেন, “না, সে পারত না। সে শুধু সেই খুনগুলোই ব্যাখ্যা করতে পারত, যেগুলো তার শিষ্যরা করত।”
“মানে?” সবার প্রশ্ন।
“শব্দযাত্রা লেখক সংঘে লেখকদেরকে মগজধোলাই করত জয়েনুদ্দীন। তাদেরকে বোঝাত, লেখকের প্রথম এবং প্রধান সম্পদ হচ্ছে অভিজ্ঞতা। অভিজ্ঞতাই পারে রাইটার্স ব্লক কাটাতে। এছাড়া লেখালেখির ব্যাপারে তার নানান হিংস্র উপদেশ এই সংঘের সদস্যদেরকে খেপিয়ে তুলত এক অদ্ভুত উন্মাদনায়।”
কিছুক্ষণ বিরতি। কেউ ‘তারপর’ বলার আগেই আমানুল্লাহ আবার শুরু করলেন, “এই সংঘের সদস্য লেখকেরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, মৃত্যুর কাছাকাছি গেলে নতুন জীবন পাওয়ার মত তারা আবার নতুন করে লিখতে পারবে। তারা সেই অনুযায়ী কাজও আরম্ভ করেছিল। মোটা অংকের টাকা দিয়ে সদস্য হতে হত এই সংঘের। সভা বসত আদাবরের এক পরিত্যাক্ত গীর্জাতে। সেখানে প্রতি সপ্তাহে একজন অভাগাকে হাজির করা হত, যাকে কয়েকজন সদস্য নির্মমভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারত, আর বাকি সদস্যরা সেই খুনের বর্ণনা লিখত। তাদের কাছে এটা ছিল একধরণের ‘প্র্যাক্টিক্যাল ওয়ার্কের’ মত। মাঝে মাঝে কিছু সদস্য সংঘের অনুমতি নিয়ে অন্যান্য লেখক আর সম্পাদককেও খুন করত। খুনগুলোর মাঝখানে মাঝখানে গ্যাপ থাকত, তাই খুনগুলো তেমন গুরুত্ব পেত না। ঠিক যেভাবে ডিরেক্টর সৈকত খুন হয়েছেন, ঠিক সেভাবেই খুন হয়েছেন আরো অনেকেই। তাদের যন্ত্রণাদায়ক মৃত্যু দৃশ্যও নির্বিকারভাবে লিখেছে এই শব্দযাত্রার মানসিক বিকারগ্রস্ত লোকগুলো।
“কিন্তু হঠাৎ শব্দযাত্রা লেখক সংঘের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়ায় তাদেরই একজন সদস্য, ইমন মোস্তাফিজ। ভীষণ জেদী আর ঘাড় ত্যাড়া এই লোকটা ব্যক্তিগত জীবনেও ছিল ভয়ানক উচ্ছৃংখল। এই লোকটাই একসময় এই সংঘের ভীত নড়িয়ে দেয়। কিভাবে? বলছি। ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের অপরেশ পাল এই প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত ছিল। যারা এই সংঘের সদস্য ছিল, তারা সবাই এই পাবলিকেশন্সের মাধ্যমে বই প্রকাশের সুযোগ পেত। অন্যান্য লেখকেরা, প্রকাশকেরা খুন হচ্ছে এতে ক্রিমসনের লাভ হতে শুরু করল। কারন এতে তারা বইয়ের বাজারে একচেটিয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করছিল। প্রতিবছর প্রকাশিত বইগুলোর মধ্যে থেকে একজনকে রাইটো-এড্রেনালিন পুরস্কার দেওয়া হত। নমিশন লিস্ট থেকে একজনকে বাছাই করে এই পুরস্কার দেওয়া হত আর কি। কিন্তু এই বছর, ইমন মোস্তাফিজকে নমিনেশন লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়। সে ক্ষেপে যায়। অপরেশ পালকে হুমকি দেয় সব কিছু ফাঁস করে দেবে বলে। হুমকিটা বাস্তবে পরিণত হয় যখন সে দেখে, তার জায়গায় হিরণ পাশা নামে আরেকজন জুনিয়র লেখককে নেওয়া হয়েছে। রাগে দুঃখে ক্ষোভে সে এই গোপন সংঘের সব তথ্য কালের কলম প্রকাশনীর প্রকাশক কায়সার আবেদীনকে দিয়ে দেয়। এই তথ্যটা জয়েনুদ্দীন জেনে যান। নিজ হাতে খুন করেন কায়সার আবেদীনকে। কেসটাকে ঘোলাটে করার জন্য একটা চিরকুটে লেখেন, ‘পাছাখানার ভূতকে ঘাটিও না’। যাই হোক, কায়সার আবেদীনের খুন ইমন মোস্তাফিজকে ভয় পাইয়ে দেয়। তিনি ঢাকার একটা হোটেলে গা ঢাকা দেন। ঠিক করেন, কোন ঘোস্ট রাইটারকে দিয়ে লেখাটা প্রকাশ করাবেন। প্রুফ রিডার সুভাষ সরকারের সাথে যোগাযোগ করেন। পেনড্রাইভে করে সব তথ্য সুভাষ সরকারের হাতে তুলে দেন। কিন্তু বিধিবাম। সুভাষ সরকারের খুব পুরনো বন্ধু আমাদের এই জয়েনুদ্দীন। সহজ সরল সুভাষ এই ইমন মোস্তাফিজের দেওয়া পেনড্রাইভের কথা জয়েনুদ্দীনকে বলে দেন। জয়েনুদ্দীন সুভাষের কাছ থেকে হোটেলের ঠিকানা জেনে নেয়। তারপর তাকে খুন করে। খুনটা এমনভাবে করে, যেন মনে হয় আত্মহত্যা। এমনিতেও ইমন মোস্তাফিজ উচ্ছৃঙ্খল লোক ছিলেন। কাজেই তার আত্মহত্যাটা পুলিশের কাছে স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু…”
হলরুমের ভেতরে কি যেন একটা দেখে থেমে যান আমানুল্লাহ। মনযোগ বিঘ্নিত হয় কিছুক্ষণের জন্য। তারপর তিনি আবার শুরু করেন, “কিন্তু পেনড্রাইভটা তো উদ্ধার করতে হবে। ওটাতে সব গোপন তথ্য আছে। বাধ্য হয়ে জয়েনুদ্দীন সুভাষকে খুন করে। আমার অবশ্য তখনই একবার সন্দেহ হয়েছিল জয়েনুদ্দীনকে।”
পুলিশ কমিশনার ডান পায়ের ওপরে বাম পা তুলতে তুলতে জিজ্ঞাসা করলেন, “কীভাবে?”
“আমরা তখন তাকে ভিকটিমের নাম বলিনি, অথচ সে আগে থেকেই সুভাষ সুভাষ বলে যাচ্ছে। অনেক দিনের বন্ধুত্বে এই জিনিসটা হয়। তাছাড়া, সুভাষের ঘরের এশট্রেতে রাখা সিগারেটের ফিল্টার দেখিয়ে বলেছিল, খুনি আর সুভাষের ভেতরে টেনশন কাজ করছিল। সে এও বলেছিল, খুনি সুভাষের বন্ধু। দুজন বন্ধু একসাথে আড্ডা দিলেও তো অনেক সিগারেট খাওয়া হয়। টেনশনেই যে দুজন বন্ধু একসাথে সিগারেট খায় তা তো না। এই ছোট্ট ছোট্ট ব্যাপারগুলো তখন খেয়াল করিনি। কিন্তু এগুলোই যে এক একটা বড় পয়েন্ট, এটা বুঝতে আমার বেশ দেরি হয়ে যায়। যাই হোক, তারপর যে চালটা জয়েনুদ্দীন চালে সেটা আরো পেঁচালো।”
টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে পানি খেয়ে আবার শুরু করলেন, “অপরেশ পাল যখন আমার কাছে এসে ইমন মোস্তাফিজের কেসটা বন্ধ করার অনুরোধ করে ব্যর্থ হল, তখন জয়েনুদ্দীন এই পেঁচালো চালটা চাললো। সে সব খুনের দায়ভার খুব চমৎকারভাবে দিয়ে দিল সুকান্তের ঘাড়ে। সুভাষের কাছে থাকা আসল পেনড্রাইভটা সরানোর সময় সে একটা নকল পেনড্রাইভ সেখানে রেখে দেয়। সেই পেনড্রাইভের তথ্যগুলো এমনভাবে সাজায়, যাতে আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হই, সুকান্তই খুনি। এমনকি সুকান্ত যখন পুলিশের ভয়ে পলাতক, তখন ছদ্মবেশে তার প্রেসে গিয়ে মার্ডার ওয়েপন হিসাবে ধারালো ফলা লাগানো কলম পর্যন্ত রেখে দিয়ে আসে সুকান্তের কীবোর্ডের ভেতরে। এর ফলে সুকান্তের প্রতি আমাদের সন্দেহ আরো দৃঢ় হয়। আর আমরাও গাধার মত জয়েনুদ্দীনের কথা বিশ্বাস করতে থাকি। এমনকি সে একদিন আমার বাড়ির, আমার নিজের স্টাডিতে ঢুকে এই কেসের ফাইল নেড়েচেড়ে দেখে। আমি ভেবেছিলাম আমার মেয়ে হয়ত স্টাডি খুলেছে, কিন্তু পরে যখন আমি আমার বাসার সামনের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজটা দেখি, তখন পুরো ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়। জয়েনুদ্দীন স্টাডিতে ঢুকেছে, আমার মেয়ে সেখানে যাওয়ার আগেই আমাদের পোষা বিড়ালটা সেখানে যায়। জয়েনুদ্দীন বিড়ালটাকে দেখে সটকে পড়ে। পরে তন্দ্রানীলা, মানে আমার মেয়ে স্টাডিতে গিয়ে দেখে, বিড়ালটা টেবিলের ওপরে বসে আছে, স্টাডি হাট করে খোলা।”
তারপর দর্শকদের দিকে এগিয়ে গিয়ে আমানুল্লাহ বললেন, “মুভি ডিরেক্টর সৈকতকেও এই শব্দযাত্রার কেউ একজন খুন করেছিল। জয়েনুদ্দীন বার বার বলছিল, যে খুনি প্রফেশনাল না। কথাটা সত্যি। কারণ শব্দযাত্রার কেউই প্রফেশনাল খুনি ছিল না। জয়েনুদ্দীন জানতেন কে খুন করেছেন, কিন্তু সেই সময়ে সেটা স্বাভাবিকভাবেই জানা সম্ভব হয়নি। খুনির শরীরে বিষের পরিবর্তে লবণ পুশ করার একটাই কারণ ছিল, ভিকটিমকে তিলে তিলে মরতে দেখা। আর সেই মৃত্যু দৃশ্যের বর্ণনা লেখা। এই কারণেই সেদিন সৈকতের ফ্ল্যাটে একটা কালি ফুরিয়ে যাওয়া কলম পাই। জয়েনুদ্দীন বলেছিল, হয়ত খুনির প্রফেশনাল না, এই কারণে হয়ত সে বিষের বদলে লবণ পুশ করেছে, আসলে এটা ইচ্ছা করেই পুশ করা হয়েছিল। যে চুলটা পাওয়া গিয়েছিল সেটা ছিল একটা উইগের নকল চুল। দূর্ভাগ্যজনকভাবে সৈকতের খুনি কে সেটা জানা যায়নি। জয়েনুদ্দীনকে গ্রেপ্তার করলে হয়ত জানা যাবে কোন একদিন।”
“জয়েনুদ্দীন যেদিন আমাকে তার অতীত জীবনের কথা বলছিল, আমি বুঝতে পারিনি সে মিথ্যা বলছে। এটাই লেখক হিসাবে তার স্বার্থকতা। লেখকরা চমৎকার ধোঁকাবাজ আর মিথ্যাবাদী হয়। সহজ সরল মানুষ লেখক হতে পারে না। অতীত জীবনের কথা বলার এক পর্যায়ে সে বলল যে সে একটা জুয়া খেলার হিসাবরক্ষক হিসাবে কাজ করত। তো সেই জুয়া খেলায় এক নারী খুন হয় আর তাকে বাধ্য হয়ে পালাতে হয়। আমার প্রশ্ন হল, যদি সে সত্যি সত্যিই আগেভাগে খুন হওয়ার কথা জানতে পারার ক্ষমতা রাখে, তাহলে সে এই মহিলার খুনের কথা কেন জানতে পারল না?”
পুরো হলরুমটাই পিনপতন নিস্তব্ধতা। শুধু কাগজের ওপরে কলম ঘষার খস খস শব্দ।
“এই ঘটনা থেকেই আমার সন্দেহ গাঢ় হতে শুরু করে। আমি জয়েনুদ্দীনের বিরুদ্ধে একশান নিতাম, ঠিক এমন সময়েই সুকান্তকে ধরার একটা সুবর্ণ সুযোগ আসে। একটা নিশ্চিত লক্ষ্য ছেড়ে একটা অনিশ্চিত লক্ষ্যের জন্য ছোটা তখন আমার জন্য পাগলামি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। কিন্তু এই পাগলামিটা করলে কেসটা হয়ত তখনই শেষ হয়ে যেত। যাই হোক, আমি সুকান্তকে ধরার জন্য একটু সাহায্য চেয়েছিলাম, কিন্তু সেই সাহায্য করেনি কেউ। সৌমেন স্যার তো ডিরেক্ট আমাকে না করে দিলেন। আমি আমার জুনিয়র ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়েই কাজে নেমে পড়লাম বাধ্য হয়ে। উদ্দেশ্য ছিল, সুকান্তকে ধরেই জয়েনুদ্দীনের ব্যাপারটা দেখব। কিন্তু, হয়ত জয়েউনুদ্দীন আঁচ করতে পেরেছিল আমার সন্দেহ। বুঝতে পেরেছি, সুকান্ত ধরা পড়ে গেলে দোষ চাপানোর মত আর কেউ থাকবে না। তাছাড়া সুকান্তকে গ্রেপ্তার করার পরে ওদের সব কার্যকলাপের তদন্ত শুরু হত নতুনভাবে। এক ঢিলে দুই পাখি মারল জয়েনুদ্দীন। আমাকে গুলি করে সে নিজের রাস্তা পরিষ্কার করল, সাথে সুকান্তকে ঢাল হিসাবে ব্যবহার করার রাস্তাটাও খোলা রাখল। সুকান্ত শুধু নিজের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল সেবার। শাঁখারীবাজারের পুরো ব্যাপারটা ঘোলাটে করার জন্যই জয়েনুদ্দীনই রথে বম্ব সেট করে। আর ডিজিএফআইয়ের রিপোর্টও সেটাই সমর্থন করে। তারাও এই প্রমাণই পেয়েছে।”
আমানুল্লাহ কয়েকটা ফাইল বের করলেন; বললেন, “এগুলোতে সব আছে। শুধুমাত্র পরিস্থিতি ঘোলাটে করার জন্য এতগুলো মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার ব্যাপারটা আমারও প্রথমে বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এই তদন্তের ফাইলগুলো আমার সেই ভুল ভেঙেছে।” কিছুক্ষণ থেমে তারপর আবার বললেন, ”জয়েনুদ্দীন আমাকে গুলি করলেও আমাকে খুন করবে বলে গুলি করেনি। আমাকে নিয়ে ওর আরো প্ল্যান ছিল। ভিড় হট্টগোলের ভেতরে শব্দযাত্রার বেশ কিছু সদস্য আমার দেহটাকে সরিয়ে ফেলে। কীভাবে সরিয়ে ফেলে আমি জানি না। আমাকে নিয়ে যাওয়া হয় আদাবরের সেই পরিত্যাক্ত গীর্জাতে। অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয় আমার ওপরে। ওদের একটাই দাবি, আমাকে ইমন মোস্তাফিজের কেসটা বন্ধ করতে হবে। আমি রাজি হইনি। অনেক চেষ্টার করেও ওদের কারো মুখ আমি দেখতে পাইনি। শুধু একদিন জয়েনুদ্দীন আর অপরেশ পালকে কথা বলতে দেখে ফেলি। আমি জানতাম, ওরা আমাকে জীবিত ছেড়ে দেবে না। তারপর ওরা একদিন আমাকে মঞ্চে তোলে। কথা ছিল, হিরণ পাশা আমাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারবে, আর সেই দৃশ্য বাকিরা লিখবে। সেদিন বাঁচার আর কোন উপায় থাকত না। যদি না সুকান্ত আসতো, আমি আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম না। জানি না কিভাবে সুকান্ত জানলো যে আমি ওখানে আছি, কিন্তু সেদিন নিজের জীবন দিয়ে আমাকে বাঁচিয়েছিল।” আমানুল্লাহ বললেন। ডান হাতের তালু দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন।
“আমি পালিয়ে বেঁচেছিলাম সেদিন। কিন্ত তৌফিক এলাহী আর অপরেশ পাল মিলে ভাড়াটে খুনি পাঠায় আমাকে খুন করতে। আমি হাজারীবাগের ওইদিকে লুকিয়ে থাকি বেশ কয়েকদিন। তারপর কয়েকদিন গাবতলীর ওইদিকে। এভাবে তাড়া খাওয়া পশুর মত আমি পালিয়ে বেড়াতে থাকি। একটা সুযোগের অপেক্ষায় কেটে যায় আমার প্রায় দুই সপ্তাহ। দুই সপ্তাহ পরে যখন শুনি রাইটো-এড্রেনালিন পুরস্কার দেওয়ার তারিখ ঠিক করা হয়েছে, আমি আমার সুযোগ পেয়ে গেলাম। হিরণকে ডেকে নিলাম সাভারে। হিরণ আমাকে খুন করার উদ্দেশ্যেই সেখানে এসেছিল। আমাকে খুন করলে তার দুটো লাভ। এক, সংঘের কাছে সে হিরো বনে যাবে রাতারাতি। আর দুই, তার পথের কাঁটা সরে যাবে। কারণ, তার যে খ্যাতি ছিল, তার সবটা ধ্বসে যেত যদি শব্দযাত্রা লেখক সংঘের কেলেঙ্কারি ফাঁস হত। আমি এই দুটো পয়েন্টকেই কাজে লাগালাম। এতক্ষণ যা যা বলেছি, তার বেশির ভাগই তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। গত দুইদিনের তদন্তে সেগুলো সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছে। যাই হোক, হিরণকে আমি খুন করিনি। আমি তাকে অনেক বুঝিয়ে শুনিয়ে এই বলে আশ্বস্ত করেছিলাম, যে তার কোন ভয় নেই। তার জীবনের নিরাপত্তা পুলিশ দেবে। কিন্তু ছেলেটার জীবনের ভয়ের থেকে বেশি ছিল ফেসবুকে ফলোয়ার হারানোর ভয়। পোস্টে লাভ রিয়েক্ট হারানোর ভয়। সে আত্মহত্যা করে। এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা আমার সামনে একটা দরজা খুলে দেয়। এই খুনের ঘটনা প্রকাশ করার সাথে সাথে জয়েনুদ্দীন এখানে আসতে পারে, আবার নাও আসতে পারে। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। এলিনের সাথে জয়েনুদ্দীন আসলো। যখনই বুঝে গেল হিরণ আত্মহত্যা করেছে, সাথে সাথে তার কাছে পুরো ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গেল। সাভার থানার ওসিকে খুন করে সে এলিনের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আমি ওই সময়ে না গেলে হয়ত এলিনকে সেদিন বাঁচানো সম্ভব হত না।”
একজন সংবাদ কর্মী হাত তুললেন।
“হুম?” আমানুল্লাহ বললেন।
সাংবাদিক ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করলেন, “চার্চ থেকে পালানোর পরে আপনি সরাসরি পুলিশের কাছে কেন গেলেন না? কেন শুধু শুধু পালিয়ে বেড়ালেন? ডোমেস্টিক ক্রাইম এনালাইসিস চীফ হিসেবে সেটাই কি ভালো ছিল না?”
“দেখেন, আমরা বিভিন্ন সময়ে আপনাদের কাজের খোরাক যুগিয়েছি। কিন্তু কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা, কে সত্যিই ভালো মানুষ, কোনটা খারাপ মানুষ- এটা বিচার করার সময় হয়ত আপনাদের কখনও হয়নি। এটা স্বাভাবিক। ভালো-খারাপ ন্যায়-অন্যায় বিচার করা আপনাদের কাজ না। তবে, আপনারা হয়ত জানেন না তৌফিক এলাহী কেমন মানুষ। এই ফাইলে কিছু রাশিয়ান মহিলার ফোন নাম্বার আছে। তাদের কাছে তৌফিক এলাহীর ব্যপারে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন কেন আমি পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছি। হ্যাঁ, সুযোগ ছিল। পুলিশে হয়ত আমি ফিরে আসতে পারতাম। কিন্তু তৌফিক এলাহী কখনওই এই খুনগুলোর সুষ্ঠ তদন্ত হতে দিতেন না। কারণ অপরেশ পালের কাছ থেকে তিনি মোটা অংকের টাকা ঘুষ খেয়েছেন।”
পুরো রুমটায় একটা চাপা গুঞ্জনের ঢেউ বয়ে গেল।
“কিন্তু জয়েনুদ্দীনের পালিয়ে যাওয়াটা কি পুরো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ব্যর্থতা না?” সাংবাদিক ভদ্রমহিলার প্রশ্ন।
বোতল থেকে আরেক ঢোঁক পানি খেয়ে আমানুল্লাহ আবার বললেন, “জয়েনুদ্দীন কীভাবে পালালো আমি জানি না। আমার উচিৎ ছিল ওর সাথে ফিজিক্যালি থাকা। অপরেশ পালকে গ্রেপ্তারের তাড়াহুড়োয় যে এত বড় ভুল হয়ে যাবে, আমি ভাবিনি। সব ঠিক করে শেষে এসে সব ভুল হয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ দায়ভার আমি নিচ্ছি। এটা পুলিশ ডিপার্টমেন্টের ব্যর্থতা না। এটা আমার ব্যর্থতা।”
“কিন্তু আসলে কে এই জয়েনুদ্দীন?” পুলিশ কমিশনার প্রশ্ন করলেন।
আমানুল্লাহ যেন বহুল আকাঙ্খিত প্রশ্নটা পেয়েছেন বলে মনে হল। গলায় একটু বেশি সিরিয়াসনেস ঢেলে বললেন, “আসলে, আমি যতদূর তার অতীত নিয়ে তদন্ত করেছি, সেটুকুতে জেনেছি, লোকটা রহস্যময়। আ স্ট্রেঞ্জ ম্যান। একাত্তরে ফাইট করেছে বলে জেনেছি। মাঝে তার একটা বইও বের হয় একটা প্রকাশনী থেকে। কিন্তু সেই প্রকাশক তাকে যথাযথ সম্মানী দেয়নি বলেও শুনেছি। কিন্তু তারপর কোন এক অজানা কারণে তার অনেকগুলো টাকার দরকার হয়। অনেকের কাছে টাকা ধার চেয়েছে। সেটা না পাওয়ায় শেষমেষ ভিক্ষাও চাইতে শুরু করে অনেকের কাছে। সেই টাকা না পেয়েই কিনা কে জানে, লোকটা কেমন যেন হিংস্র হয়ে যায়। এত স্বল্প সময়ে আমার সবটা জানা সম্ভব হয়নি। কিন্তু পরবর্তীতে আরো তদন্ত করলে হয়ত আরো জানা যাবে।” বুকের ভেতরে চেপে রাখা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “প্রণব হয়ত সেই অজানা কাহিনীটুকু উদ্ধার করে ফেলেছিলেন…”
হলরুমে একটা নিস্তব্ধতা নেমে এলো। কলমের খসখসানি থেমে গেলো। শুধু শোনা গেল ক্যামেরা চলার চাপা বৈদ্যুতিক শব্দ।
ডিআইজি সাহেব মঞ্চে গেলেন। আমানুল্লাহকে সাধুবাদ জানালেন। এটা চিরাচরিত সৌজন্যতা। তারপরে তিনি বললেন, “তৌফিক এলাহীর ব্যাপারটা তো আপনারা সবাই জানেন। তার অধীনে যে সাক্ষী মৃত্যুর কেসটা না মেটা পর্যন্ত আমানুল্লাহই ডিবি’র চীফ পদে দায়িত্ব পালন করবেন। আর জয়েনুদ্দীনকে যত দ্রুত গ্রেপ্তার করার দায়িত্বটাও আমি তার দায়িত্বশীল কাঁধটাকেই দিচ্ছি।”
সবাই হাততালি দিল। হাত তালি দিলেন কমিশনার। যেন খুব চমৎকার কোন সিনেমা শেষ হল এই মাত্ৰ।
একটা কাষ্ঠল হাসি দিলেন আমানুল্লাহ। তারপর বললেন, “আমি ইস্তফাপত্র তৈরি করে রেখেছি স্যার। এই অধমের পক্ষে আর কোন দায়িত্বই আর পালন করা সম্ভব হবে না হয়ত। তন্দ্ৰানীলা বিদেশের কোন এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার জন্য আবেদন করেছে, হয়ে যাবে। হয়ে গেলে আমরা দুজন চলে যাব।”
কথাটা শুনে সাইদুর আর আরাফ যেমন বজ্রাহত হল, তেমনই বজ্ৰাহত হলেন ডিআইজি। পুলিশ কমিশনারের ভ্রুও কুঁচকে গেল। তিনি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই আমানুল্লাহ বললেন, “মেয়েটা হাসপাতালে আছে, যদি অনুমতি দেন, আমি এখন আসি? পরে এসে রিজাইন পেপার জমা দিয়ে রিভলভার আর ব্যাজটা সারেন্ডার করে যাব।”
সাইদুর আর আরাফের সাথে কোন কথা না বলে, প্রশ্ন নিয়ে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদেরকে পেছনে ফেলে আমানুল্লাহর কালো হ্যারিয়ার বের হয়ে গেল পুলিশ হেডকোয়ার্টার থেকে।
পুনশ্চ
সাত বছর পেরিয়ে গিয়েছে।
না, জয়েনুদ্দীনের খোঁজ পাওয়া যায়নি। এই সাতবছরে লেখক-প্রকাশক হত্যার ফাইলটা আরো অনেকগুলো কেস ফাইলের নিচে চলে গিয়েছে। আরো অনেক ধুলো জমেছে সেটার ওপরে। ফাইলের বেশ খানিকটা অংশে ঘুণ ধরেছে।
অপরেশ পালের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে তিন বছর আগে। তৌফিক এলাহীকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। বেশ কয়েকটা কেসও হয়েছিল তার নামে। কিন্তু হেরা টাওয়ারের সেই ফুটেজগুলোর জোরে ব্ল্যাকমেইলিং করে তিনি কোনমতে বেঁচে যান। এখন তাকে নাকি আমেরিকার ওহাইও স্টেটের কলম্বিয়ানা কাউন্টির কোন এক মসজিদে ইমামতি করতে দেখা যায়। দাড়ি আর পাগড়িতে তাকে আর চেনার উপায় নেই।
এফবিআইয়ের চাকরিটা পাওয়ার দুই মাসের মধ্যেই এলিন আমেরিকাতে পাড়ি জমায়। ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র এজেন্ট সে। মাঝে মাঝে ভার্জিনিয়ার কোয়ান্টিকোতে ট্রেনার হিসাবেও তাকে দেখা যায়। হাতের সেই দাগটা এখনও আছে। বহন করে বেড়াচ্ছে তার বীরত্ব। সাইদুর আর আরাফ দেশেই থেকে গিয়েছে। দুজনেই এখন সিনিয়র ফিল্ড এজেন্ট। আরাফ বিয়ে করলেও সাইদুর এখনও অবিবাহিত।
নীরুর বিশ বছরের জেল হয়েছে। দেশের কোন এক জেলার কোন এক জেলের কোন এক সেলে সে একলা দিন কাটাচ্ছে। সম্প্রতি তার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। চিকিৎসা চলছে। রিমান্ডে নেওয়ার পরে শশী মাঝির বরাতে তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী সিলেটের নবীগঞ্জে অপারেশন চালানো হয়। মুনশী মোয়াল্লেমের সেই বাড়ি খুঁজে পাওয়া যায়। খুঁজে পাওয়া যায় কফিন বন্দী লাশ আর জীবন্ত মমি বানানো সতেরটা মৃতদেহ, আর ভেতরে সিনিয়র ফিল্ড এজেন্ট প্রণবের একটা। কিন্তু মুনশী মোয়াল্লেমকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সাধু ডাকাত গ্রেপ্তার হয়েছে কিনা? দৈনিক সময়ের কণ্ঠের ২০১১ সালের ২৩শে ফেব্রুয়ারীর সংখ্যাটা একটু ভালো করে ঘাঁটলেই জানা যাবে।
আর আমানুল্লাহ? সেদিনের সেই সংবাদ সম্মেলনের পরে তাকে আর দেখা যায়নি। দেখা যায়নি তন্দ্রানীলাকেও। কোথায়, কোন দেশের কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সে শিক্ষকতা করছে, নিমি কত বড় হয়েছে- সেগুলোর কিছুই জানা যায়নি। সব মানুষকে তো আর ফেসবুকে খুঁজে পাওয়া যায় না।
সম্প্রতি একজন ডিটেক্টিভ এজেন্টের আত্মজীবনী বের হয়েছে, নাম- The Detective who lived. পেপার ব্যাক, প্রচ্ছদে একটা বিড়ালের ছায়ার ছবি।
বইয়ের লেখক, সুকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়।
.
“লেখালেখির ব্যপারে কারো উপদেশ কখনও খুব বেশি গুরুত্বসহকারে নেবেন না।”
—লে গ্রসম্যান
-শেষ-