তারপরও শুরু করতে হয়
“আমি রিজাইন দিব।” বলল এলিন, চোখে মুখে বিরক্তি, “আমার পক্ষে এই লোকটার আন্ডারে কাজ করা সম্ভব না।” বেশ জোরেই হাতের কফি মগটা রাখল কাঠের টেবিলটার ওপরে। ঠক করে শব্দ হল।
পাশের সোফায় বসে মাথা নাড়ল আরাফ। তারও একই সিদ্ধান্ত নাকি সে এলিনের সিদ্ধান্তের সমর্থন করল বোঝা গেল না। সোফার হ্যান্ডেলের ওপরে বসে মল্লিকাও মাথা নাড়ল। তার মাথা নাড়াটা ছিল গম্ভীর আর গাঢ়, যেন এলিনের এই সিদ্ধান্তের ভেতরে সে কোন গভীর কোন দর্শন খুঁজে পেয়েছে।
“পাগলামি করিস না। ব্রাঞ্চের ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে আমাদেরকে জানতে হবে। আর এইজন্য তোদেরকে থাকতে হবে সেখানে। কী বলেন জয়েনুদ্দীন?” সাইদুর বলল, সমর্থনের আশায় তাকালো জয়েনুদ্দীনের দিকে। জয়েনুদ্দীন মাথা নাড়লেন। তিনি একমত। কিন্তু তার এই মাথা নাড়ার ভেতরে আগের সেই আত্মবিশ্বাস নেই।
সাইদুর বাকিদের সমসাময়িক। এলিন, সাইদুর, আরাফ আর মল্লিকা একই সাথে পুলিশ একাডেমীতে ভর্তি হয়েছিল। ট্রেনিং-এ ভালো করায় স্পেশালাইজড ট্রেনিং-এর জন্য তাদেরকে সুযোগ দেওয়া হয়। তারা চারজনেই ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের ট্রেনিং-এর জন্য এপ্লাই করে। এলিন ফরেনসিক স্পেশালিস্টে ট্রেনিং শেষ করে আর বাকিরা ফিল্ড স্পেশালিস্টে। কিন্তু কবে কবে সবাই সাইদুরের ওপরে ভরসা করতে শুরু করেছে, কেউ জানে না। সাইদুর মানেই একটা আশ্বাস। আজ সেই আশ্বাসটা থেকেও নেই, এটা বাকিদেরকে বারবার নিজেদের অবস্থান নিয়ে সন্দিহান করে তুলেছে।
“দুই দুইটা রেইড হয়েছে আগারগাঁও বস্তিতে গত দুইদিনে। বেশিরভাগই খেটে খাওয়া মানুষ না হলে খুচরো হিরোইনখোর। এদেরকে ধরে তৌফিক কি প্রমান করতে চাচ্ছেন? যে তিনি খুব কাজের লোক? আরে সরকারি দলের দু তিনটা মন্ত্রীর পা চাটল আর কাজের লোক হয়ে গেল?” এলিনের রাগ মাখা কথাগুলো সবার কানে বাজল, “আর জানিস তুই? আমরা জুনিয়র বলে আমাদেরকে রেইড টিমে রাখে না!”
সাইদুর গম্ভীর মুখে জানালার বাইরে তাকালো। আকাশ পরিষ্কার। তার এই দুই রুমের ফ্ল্যাট থেকে আকাশ দেখা যায়। সকাল নয়টার দিকে যখন ওরা আসল, তখন আকাশ পরিষ্কার ছিল না। সব মেঘ যেন সাইদুরের মাথার ভেতরে জমাট বেঁধেছে। বজ্রপাত হচ্ছে মুহুর্মুহু।
মল্লিকা হাত পা নেড়ে চেড়ে কী যেন বলছিল, সাইদুর থামিয়ে দিয়ে বলল, “তোদেরকে এখন যেটা করতে হবে, সেটা হল, তৌফিক এলাহীর আস্থা অর্জন করতে হবে। তাহলে তোরা তার কাছাকাছি থাকতে পারবি। তার প্রতিটা পদক্ষেপ আমাদের জানা দরকার।”
সেটা কিভাবে?
“দাঁড়া,” সাইদুর উঠে গেল। পাশের ঘরে কিছুক্ষণ খুটখাট শব্দ, তারপর ফিরে এলো হাতে একটা কম্প্যাক্ট ডিস্ক নিয়ে। বলল, “এটার মধ্যে সৌমেন ঘোষের হত্যাকারীর অডিও ক্লিপ আছে। এটা যদি তৌফিক এলাহীকে দিস, তোদেরকে সে বিশ্বাস করবে। তোরা তার কাছাকাছি থাকতে পারবি আর সেটাই সব থেকে বেশি জরুরি।”
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। জয়েনুদ্দীন আড়চোখে দেখল। এই অডিও ক্লিপ তিনি আগেও শুনেছেন। তার চাহনির ভেতরে ‘এগুলো অযথা করছ, আমরা হেরে গিয়েছি’ ভাব।
জয়েনুদ্দীন বললেন, “আমার অভিজ্ঞতা বলছে, সুকান্তর কোন সহযোগীই আমানুল্লাহকে গুলি করে সুকান্তকে নিয়ে পালিয়েছে। এছাড়া আর কোন যুক্তিযুক্ত ব্যাখ্যা থাকার কথা না।”
“হতে পারে সৌমেন ঘোষ কাউকে ঠিক করে রেখেছিলেন। বলে রেখে গিয়েছিলেন, আমানুল্লাহ সুকান্তকে এরেস্ট করতে গেলেই গুলি করে শেষ করে দিবি।” আরাফ বলল।
মাথা নাড়ল সাইদুর। উড়িয়ে দেওয়া যায় না। হতেও পারে। কিন্তু এই মুহূর্তে প্রমাণ ছাড়া কোন রাস্তায় এগোন যাবে না। হাতে সময় খুব কম
সাইদুর বলল, “আমার মনে হয়, তৌফিক এলাহী অন্যান্য কেসের মত এটাও গোজামিল দিয়ে পার করবে। সেটা হতে দেওয়া যাবে না। তার আগেই আমরা সুকান্তকে খুঁজে বের করব। তাতে যদি তৌফিক এলাহী সাহায্য করলেন ভালো, আর না হলে আমরা নিজেরাই করব। কি বলেন জয়েনুদ্দীন?”
জয়েনুদ্দীন মাথা নাড়লেন বরাবরের মত। সবাইকে কাজে লেগে পড়তে বলার সাথে সাথে সবাই উঠে দাঁড়ালো। কাজে লাগতে হবে। ঠিক হল, প্রতিদিন সন্ধ্যায় সাইদুরের বাসায় সবাই জড়ো হবে কেসের ব্যাপার নিয়ে।
সবাই বের হয়ে গেল। সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেল। ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করার সাথে সাথে সাইদুরের মনে হল, একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলা হয়নি। সাথে সাথে আরাফকে ফোন করে বলল, “একটু ওপরে আয় তো।”
বেশ কিছুক্ষণ পরে আরাফ আসল। আর কেউ আসেনি। সবাই অফিসে চলে গিয়েছে।
পাশের ঘর থেকে ল্যাপটপটা এনে খাবার টেবিলের ওপরে রাখল সাইদুর। আরাফও চেয়ার টেনে পাশে বসল। সাইদুর একটা ফোল্ডার খুলল। অনেকগুলো এমকেভি ফরম্যাটের ভিডিও ফাইল। সাইদুর বলল, “তুই আমাকে ড্রোনের যে ভিডিও ফুটেজগুলো দিয়েছিলি, সেগুলোর পেছনে আমি বেশ কিছুটা সময় দিয়েছি।”
“বলিস কি! তারপর?”
“তারপর আর কি, তুই নিজেই দেখে নে।”
একটা ভিডিও ফাইল প্লে করল সাইদুর। বেশ ওপর থেকে শ্যুট করা হয়েছে। মানুষগুলোকে আলাদাভাবে বোঝা যাচ্ছে না। গিজ গিজ করছে। “কিছু বুঝতে পারিস?” সাইদুর প্রশ্ন করল।
আরাফ আঙুল দিয়ে একটা পয়েন্ট দেখিয়ে বলল, “এই যে এইটা যতীন এন্ড কোং। আর এই যে এইখানে বসে ছিলেন আমানুল্লাহ স্যার।”
“এ দুটো বাদে আর কিছু বুঝতে পারছিস?”
আরাফ মাথা নাড়ল। এত মানুষের ভেতরে এর বেশি কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। সাইদুর ভিডিওটা ফরোয়ার্ড করল। ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, মাঝখানের রথটা বিস্ফোরিত হল। মানুষের দৌড়াদৌড়ি, ধুলোয় আর তেমন কিছুই স্পষ্ট দেখা গেল না।
সাইদুর আঙুল দিয়ে দেখাল, “এই যে, আমানুল্লাহ স্যার সুকান্তকে নিয়ে কাভার্ড ভ্যানটার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আর এই যে কাভার্ড ভ্যানটা। এই যে যাচ্ছে।”
আরাফের গায়ের লোমগুলো দাঁড়িয়ে গেল। মাথাটা আরেকটু স্ক্রিনের দিকে এগিয়ে নিয়ে এসে নিজের অজান্তেই বলল, “তারপর?”
“তারপর আর কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। শুধু এই যে, এই মাজল ফ্ল্যাশটা ছাড়া। এই যে গুলি চলল, আমানুল্লাহ স্যার পড়ে গেলেন। তারপর ধূলায় আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না।”
আরাফ আশাহত হল। তারমানে ড্রোনের ভিডিও ক্লিপ খুব বেশি সাহায্য করতে পারছে ন। “তোর কি মনে হয়? জয়েনুদ্দীন যা বলছেন সেটা ঠিক? মানে সুকান্তের কোন সহযোগী কি তাহলে সুকান্তকে বাঁচিয়েছে? এই খুনের পেছনে আরো মানুষের হাত আছে?”
সাইদুর এলোমেলো মাথা নাড়ল। যার উত্তর হ্যাঁ হতে পারে, আবার নাও হতে পারে।
“এইটা কোন কাজ হল? তাহলে ড্রোনের ঘোড়াড্ডিম কেন ছিল ওখানে?” আরাফের স্বগোক্তি।
ভিডিও ক্লিপটা বারবার ফরোয়ার্ড আর রিওয়াইন্ড করতে করতে সাইদুর যেন গভীর চিন্তায় ডুবে গেল। আরাফের প্রশ্ন যেন শুনতেই পেল না।
তারা জানত না, কিছু রহস্য থাকা ভালো। সেই রহস্যের জট একবার খুলে গেলে সেটার শেষ মাথা গিয়ে ঠেকে একেবারে মৃত্যুতে।
****
ঢাকার অভিজাত এলাকার (যেখানে ঢুকতে বিশেষ অনুমতি নিতে হয়) বারো তলা উঁচু ভবন, হেরা টাওয়ার। বারো তলার ওপরে আজকের সন্ধ্যার স্বৰ্গ।
তৌফিক এলাহীর বাড়ির ছাদ। সুইমিং পুলে বেশ কয়েকজন অতিথি গা ডুবিয়ে বসে আছেন। এদের মধ্যে আছেন নাম করা কয়েকজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব; যারা ক্যামেরার সামনে একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে থু থু ছিটিয়ে নিন্দা করেন, তারাই এখন পাশাপাশি বসে একই রাশিয়ান এসকোর্টের সঙ্গ উপভোগ করছেন। সেই সঙ্গ যেমন বিচিত্র, তেমনই স্বর্গীয়। আর যতটা স্বর্গীয়, ততটাই নিষিদ্ধ। স্বর্গীয় জিনিস কেন জানি মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়।
ছাদের এখানে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে স্বল্পবসনা রাশিয়ান মহিলা ওয়েটার। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন দলে ভাগ হয়ে কথা বলছেন অতিথিরা; যাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তবে প্রশাসনের অনেকে আছেন, আছেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাঘব বোয়ালেরা, মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব। সাংবাদিকও বাদ যাননি। বিশেষভাবে আলোকসজ্জা করা হয়েছে ছাদটা। চারপাশের রেলিং-এ একটু পর পর নীল আর হলদে কমলা আলো জ্বলে উঠছে।
তৌফিক এলাহীর পার্টিতে একটা বিশেষ আকর্ষণ থাকে। সেটা অবশ্য পার্টির শেষে। একটা নিষিদ্ধ আকর্ষণ। এই পার্টিতে আমন্ত্রণ পাওয়া সাত জন্মের ভাগ্য। মানুষ তিনটা জিনিস কখনওই অগ্রাহ্য করতে পারে না, খাদ্য, বিপদ আর যৌনতা। এই পার্টিতে যার তিনটাই আছে। লুকানো ক্যামেরা আছে ছাদের এখানে ওখানে। যারাই এই পার্টিতে আসে, তাদের প্রতিটা কর্মকাণ্ড রেকর্ড হয়ে থাকে। বিশেষ কোন টার্গেট থাকলে, তাকে ছাদের পাশের রুমগুলোতে নিয়ে যাওয়া হয়। কাজটা অবশ্য রাশিয়ান মেয়েগুলোই করে। তারপর সেখানে যা হয় সেগুলোও রেকর্ড হতে থাকে।
পরবর্তীতে এগুলো খুব চমৎকারভাবে কাজে লাগায় তৌফিক এলাহী। বড় হওয়ার জন্য মানুষকে কৌশলে ব্যবহার করা উচিৎ- এটা সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে।
আর মাত্র কয়েক বছর, পরবর্তী ডিআইজি হবে তৌফিক এলাহী।
“গুড ইভনিং,” একটা খনখনে কণ্ঠ শুনে ধ্যান ভাঙল তৌফিকের। কণ্ঠের মালিক একজন রোগা আর ঢ্যাঙ্গা লোক। কালো স্যুট বুটে তাকে গোধুলীর কাকতাড়ুয়া বলে মনে হচ্ছে। করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই তৌফিক এলাহী মনে করার চেষ্টা করলেন ভদ্রলোককে কোথায় দেখেছেন? পার্টিতে যখন এসেছেন তখন অবশ্যই তিনি আমন্ত্রিত। অনাহূত কাউকে এই পার্টিতে আসতে দেওয়া হয় না।
তৌফিক এলাহীর জিজ্ঞাসাবোধক দৃষ্টি দেখে কাকতাড়ুয়া নিজেই নিজের পরিচয় দিল, “আমি অপরেশ পাল। ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের কর্ণধার। কেমন আছেন?
“ওহ, ওহ হো, কি অবস্থা আপনার! স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি জোরে হাত ঝাঁকিয়ে করমর্দন করলেন তৌফিক। কেমন আছেন?”
“হা হা হা… এইতো চলে যাচ্ছে। আপনি কেমন আছেন? কংগ্র্যাটস! নতুন করে পুরনো চেয়ারটা ফিরে পাওয়ার জন্য।”
তৌফিক এলাহী মৃদু হাসলেন। গ্লাসের টাকিলায় একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “থ্যাঙ্ক ইউ। আপনাদের সহযোগিতা না থাকলে এটা হত না। আমার ওপরে ওঠার সিঁড়ির ধাপগুলো তো স্বয়ং আপনারাই।”
পাশ দিয়েই একজন রাশিয়ান ওয়েট্রেস হেঁটে গেলে অপরেশ তার নিতম্বের দিকে একটা ভেজা দৃষ্টি দিতে দিতে বললেন, “যাই হোক, সামনের সপ্তাহের শুক্রবারে বাংলাদেশ প্রকাশক সমিতির আয়োজনে রাইটো-এড্রেনালিন থ্রিলার লেখক পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে। আমরা চাই আপনি চীফ গেস্ট হিসাবে সেখানে থাকেন।”
তৌফিক এলাহী বাঁকা ঠোঁটে একটা অদ্ভুত হাসি হাসলেন। তারপর বলল, “ওহ শিওর শিওর। আমি আসার চেষ্টা করব। হাতের এই দুইটা কেস শেষ হয়ে গেলেই কয়েকদিনের জন্য ঝাড়া হাত পা।”
“আচ্ছা ভালো কথা, উনার ব্যাপারটা দেখলেন? মানে, উনার হাতেই কিন্তু আমাদের অস্তিত্ব টিকে আছে। বারবার বলছি বলে রাগ করবেন না, কিন্ত মানে, বুঝতেই পারছেন।” অপরশ পাল নিচু গলায় বললেন।
কুঞ্চিত ভ্রুতে তৌফিক উত্তর দিলেন, “অবশ্যই বিরক্ত হচ্ছি। আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করছি। আমার জানা সব থেকে দক্ষ কয়েকজন হিটম্যানকে আমি কাজটা দিয়েছি। আজ পর্যন্ত আমাকে নিরাশ করেনি ওরা। আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।”
“অ্যাই,” একটা মেয়েলি কণ্ঠ ভিড়ের ভেতর থেকে ডেকে উঠল। কণ্ঠের উৎস রেইনা। ভালো নাম ছিল রেহানা, সেখান থেকে রেইনা। তৌফিকের বর্তমান গার্লফ্রেন্ড। এর আগে অবশ্য তৌফিক এলাহীর আরো দুইটা বিয়ে হয়েছিল। কোনটাই টেকেনি। রেইনা বিশিষ্ট মডেল এবং অভিনেত্রী। “কি হল?” হাত ঘড়ির দিকে ইশারা করে কি যেন বলল রেইনা, শুনতে পেল না তৌফিক এলাহী। পরক্ষণেই মনে পড়ল, পার্টিতে আসা অতিথিদের উদ্দেশ্যে তাকে কিছু বলতে হবে। “এক্সকিউজ মি” বলে অপরেশকে বিদায় দিলেন; তাড়াতাড়ি রেইনার কাছে গিয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরলেন। নিষিদ্ধ অঙ্গে আলতো স্পর্শ করে বসিয়ে দিলেন ঠোঁটে ঠোঁট।
“আমার হেরা টাওয়ারের ঈশ্বরেরা,” একহাতে রেইনা আর এক হাতে টাকিলার গ্লাস জড়িয়ে ধরে বললেন। “আমি এই টাওয়ারের খাদেম, আর উপস্থিত অতিথিদের সবাই আমার ঈশ্বর। আপনাদের সেবাই আমার ধর্ম।” চারপাশে হাততালি আর হর্ষধ্বনির শোর উঠল।
“যা হোক,” রেইনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে আবার শুরু করলেন তৌফিক। “আজকের এই পার্টি থ্রো করার একটাই কারণ, সেটা হল, অবশেষে আমরা সুকান্তকে এরেস্ট করতে সক্ষম হয়েছি। কাল সকালেই তাকে কোর্টে চালান করে দেওয়া হবে। অবশ্য আমাদের দেওয়া ছবির সাথে তার চেহারা তেমন একটা মিল নেই। কেন নেই সেটা সে কোর্টেই বলবে।”
আরেক প্রস্থ হাততালি। তবে এবারকার হাততালিতে কেমন বিভ্রান্তি মিশে গেল।
রেইনার কপালে চুমু খেয়ে তৌফিক এলাহী বললেন, “আরেকটা বড় সংবাদ হচ্ছে, আমাদের সৌমেন ঘোষ স্যারের হত্যাকারীকেও আমরা প্রমাণ সমেত গ্রেপ্তার করেছি। এটা করতে অবশ্য আমাকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়েছে।” এলিনরা তাকে অডিও ক্লিপটা দিয়েছিল, অথচ সে তাদের কথা এড়িয়ে গেল।
ভিড়ের ভেতরে একজন বলল, “কে সে? নাম কী?”
“আরে ওই যে, ইমন মোস্তাফিজের মেয়ে। কি যেন নাম, হ্যাঁ, নীরু।” বললেন তৌফিক, “আজ শনিবার, আগামী মঙ্গলবার তাকে কোর্টে নেওয়া হবে। কালকেই হত, কিন্তু আইনি কিছু জটিলতা আছে আর কি।”
“থ্রি চিয়ার্স ফর তৌফিক,” ভিড়ের ভেতরে কে একজন বলে উঠল, হাতে গ্লাসটা উঁচিয়ে ধরল তৌফিকের দিকে। সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “চিয়ার্স।”
একটা বিনয়ী মাখা হাসি হেসে তৌফিক বললেন, “সবাই অপেক্ষা করে যাবেন।” হাসিটায় আরেকটু রহস্য ঢেলে বললেন, “সিন্নির ব্যবস্থা আছে কিন্তু।”
সবাই সমস্বরে হেসে উঠল I
****
পুলিশ হেডকোয়ার্টার। রাত দশটা।
গ্রাউন্ড ফ্লোরে সব মিলিয়ে হাজত বা সেল আছে বারোটা। তারই একটাতে আছে বসে আছে নীরু। অনেকক্ষণ ধরে মশার কামড় খাচ্ছে, খেতে হচ্ছে। কারণ বেশ কয়েকবার আশেপাশের গার্ডগুলোকে একট মশার কয়েলের কথা বললেও তারা কানে তোলেনি। অনেকে খুব নোংরা ইঙ্গিত দিয়েছে। ঘেন্নায় বমি চলে এসেছে তার। কিন্তু নিজের ওপরে ঘেন্না আসেনি এখনও। সে যা করেছে, ঠিক করেছে। তার বাবার খুনি, ওই সুকান্তকে সে মারবেই যেভাবেই হোক। আজ হোক অথবা কাল। তারপর মারবে ওই অপরেশ পালের বাচ্চাকে। জানোয়ারটা তার বাবার সম্মান নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। বলেছে, তার বাবার নাকি ‘বদ জিনিসের’ নেশা ছিল। কুত্তা কোথাকার!
কিন্তু পুলিশ কীভাবে তার সব কিছু জানতে পারল? কীভাবে জানতে পারল যে সে শাঁখারীবাজারে সুকান্তকে গুলি করার জন্য যাবে? কীভাবে জানল যে সে তৈমুরকে ওখানে পাঠাবে? কেউ তো পুলিশকে জানিয়েছেই। এডভোকেট শাকিল মাহমুদকে দেখা করতে বলা হয়েছে। তিনি বলেছেন কাল আসবেন। যদি কোন প্রমাণ থাকেও, তাকে এই চৌদ্দ শিকের ভেতরে আটকে রাখার ক্ষমতা কারো নেই। দাঁতে দাঁত কামড়ে ডান বাহুতে বসে থাকা একটা মশা মারল নীরু। চিৎকার করে বলে উঠল, “ওই কুত্তার বাচ্চারা একটা মশার কয়েল দিয়ে যাহ।”
কেউ শুনল বলে মনে হল না। কেউ শুনলেও এগিয়ে আসার কথা না। দাগী আসামীদের কথা এই সমাজে না শুনলেও চলে।
হঠাৎ সামনের সেলে কাশির শব্দ হল। একটা শ্লেষ্মা মাখানো ঘড় ঘড়ে কাশি। কাশির শব্দটা এসেছে নীরুর সামনের সেল থেকে। যক্ষ্মার রোগী মনে হয়। কাশতে কাশতে একটা লোক এগিয়ে এল সেলটার গরাদের কাছে। হলওয়ের মৃদু আলোতে লোকটাকে দেখতে পেল নীরু। শীর্ণ, কঙ্কালসার একটা বৃদ্ধ। মুখ ভর্তি অগোছাল দাড়ির জঙ্গল। শনের খড়খড়ে কাঁচা পাকা চুল।
হ্যাক থুহ; এক দলা ধূসর উষ্ণ শ্লেষ্মার দলা ফেলল লোকটা। তার ভেতরে ছিটে ফোঁটা লাল রক্ত। ভবঘুরে একটা মাছি এসে স্বাদ আস্বাদন করতে সেটার ওপরে বসল।
“মা” বৃদ্ধটা বলল। কণ্ঠ শুনে মনে হল তার ভেতরে সব কিছু ভেঙে চুরে গিয়েছে। ঘড় ঘড় করে শব্দ হল।
বৃদ্ধ যে নীরুকেই মা বলেছে সেটা বুঝতে নীরুর বেশ খানিকটা সময় লাগল। সরু চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমাকে বলছেন বুড়া মিয়া?”
“হ্যাঁ। একটা প্রশ্ন করি যদি কিছু মনে না কর।” বৃদ্ধ বলল।
এই সব পুরুষ মানুষগুলার এই প্রশ্ন করা মানেই তারা খুব নোংরা আর অশ্লীল কোন প্রশ্ন করবে। বাপের বয়সী হোক আর ভাতারের বয়সী হোক, কাউকেই বিশ্বাস নেই নীরুর। এরা হচ্ছে ফিচলে শয়তান। এরা নোংরা প্রশ্ন করে মজা পায়।
অবজ্ঞার সুরে নীরু বলল, “কী?”
“তুমি বিড়ি সিগারেট খাও? খেলে একটা বিড়ি বা সিগারেট ধরাও। দেখ মশা আর থাকবে না। নিকোটিনে জোক আর মশা মরে। তামাক পোড়ানোর ধোঁয়ায় মশা কাছে আসে না। আগে মাছ ধরার সময় এইটা করতাম।” বৃদ্ধটা হাঁপাতে হাঁপাতে বলল। তার শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বোঝা যাচ্ছে।
কত্তবড় সাহস! মেয়ের বয়সী, না না, মেয়ের বয়সী না, নাতনীর বয়সী একটা মেয়েকে এই ধরণের কথা লোকটা কিভাবে বলল? আগেই জানত নীরু। এরা এমনই হয়। গলায় একটু ঝাঁঝ ঢেলে বলল, “আপনাকে জ্ঞান দিতে হবে না।” চটাস করে আরেকটা মশা মারল। যেন বুড়োটাকে কষে একটা চড় দিল।
বুড়োটা আর কথা বলল না। গরাদ ধরে কুঁজো হয়ে হাঁপাতে লাগল। জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাসে ওঠা নামা করতে থাকল পাঁজর সর্বস্ব বুক। দেখে নীরুর খানিকটা মায়া হল। মায়া ঠিক না, অপরাধবোধ। লোকটা ধমকে দিতে পারত তাকে। অথবা আরো নোংরা কিছু বলতে পারত।
হঠাৎ নীরু লক্ষ্য করল, বৃদ্ধের চোখ মুখ অস্বাভাবিক ফোলা। আর গরাদে পেঁচানো আঙুলগুলোর মাথা থেঁতলানো। শুকনো রক্ত লাল থেকে খয়েরী হয়ে গিয়েছে।
তীব্র অপরাধবোধ থেকে বাঁচতেই নীরু বলল, “বাড়ি কোথায় আপনার?” লোকটা কি যেন একটা বলতে গেল, শুরু হল কাশি। ঘড় ঘড়ে কাশি। হাপরের মত বুক ওঠা নামা করা বুকটা ভরে কয়েকবার শ্বাস নিল লোকটা। তারপর বলল, “নবীগঞ্জ”।
“নবীগঞ্জ মানে? নবীনগর? সাভার নবীনগর?”
“উঁহু। সিলেট নবীগঞ্জ।”
“হবিগঞ্জ?”
“হ, নবীগঞ্জ। হবিগঞ্জের পাশেই।”
“ওহ, কোন কেসে ধরছে? কি করেছেন আপনি?”
প্রশ্নটা শুনে বৃদ্ধ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। খুব গুরুতর কোন অপরাধ নাকি? রেপিস্ট টেপিস্ট নয়ত? এই বয়সে এই লোক রেপ কিভাবে করবে? নীরু ভাবল; বলতে গেল, থাক, বলতে না চাইলে বলতে হবে না। তার আগেই লোকটা বলল,
“আমি কিছুই করি নাই। তালতলা বস্তিতে থাকতাম। আমাকে ধরে এনেছে।”
“এমনি এমনি ধরে আনলো? পুলিশে পাগলে কামড়েছে?”
“কী জন্য ধরে আনলো সেটা পুলিশ জানে। আমাকে ধরে এনে অমানুষের মত পিটালো, মা। আমি বললাম আমার অপরাধ কি? পুলিশ কিছুই বলল না।
কেঁদে ফেলল বৃদ্ধ। দাড়ি বেয়ে চোখের পানি পড়তে লাগল শুকনো গরাদগুলোতে। কাঁদতে কাঁদতে বলল, “পিটাতে পিটাতে বলল, আমি যেন কালকে কোর্টে গিয়ে বলে যে আমিই সুকান্ত।”
নীরুর মাথায় বাজ পড়ল। এতক্ষনের জমে থাকা বিরক্তি পরিণত হল বিস্ময়ে।
“কী বলছেন আপনি!
“হ্যাঁ মা। বলল, আমি যেন বলি, কয়েকদিন তালতলায় আত্মগোপন করেছিলাম। তাই আমার এই অবস্থা। পেপারে এর আগে যে ছবিটা ছাপানো হয়েছে সেটা ভুয়া। পেপারওয়ালাদের টাকা খাইয়ে আমি ছবিটা ছাপিয়েছিলাম।”
নীরুর মাথায় তখন একগাদা প্রশ্ন। কিন্তু কোনটা আগে করবে সেটা ঠিক করতে না করতেই বৃদ্ধ বলল, “আমি ঢাকায় এসেছিলাম একটা বিশেষ কাজে। পুলিশকে একটা বই জমা দিতে। আসলে, সিলেটে বেশ কয়েকবার আমি বইটা জমা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। পুলিশ পাত্তা দেয়নি। বলেছে ঢাকার পুলিশ জানে। আমাকে এসআই অফিসে ঢুকতেই দেয়নি। তাই আমি ঢাকায় চলে আসি। বইটা কতবার যে পুলিশকে দিতে চেয়েছি, পুলিশ নেয়নি।”
কথাগুলো হাফাতে হাফাতে বলল বৃদ্ধ। আবার দমকা কাশিতে চাপা পড়ে গেল কথা। সামলে নিয়ে বলল, “বইটার সাথে একটা মানুষের জীবন জড়িয়ে আছে। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম যে বইটা আমি পুলিশের হাতে দেব। কিন্তু…” কান্না চেপে ঢোঁক গিলল।
“কার জীবন?” নীরু জিজ্ঞাসা করল।
বৃদ্ধ উত্তর দিল, “প্রণব। প্রণব নামের একজন পুলিশ। আমি তাকে বাঁচাতে পারিনি। তাকে দেওয়া কথাটাও রাখতে পারিনি।”
প্রণব কে? চেনে না নীরু। সে পাল্টা প্রশ্ন করল, “বইটাতে কি আছে?” বৃদ্ধ লোকটা বলল, “প্রণব নামের সেই ভদ্রলোক তো বলেছিলেন, এখানে, মানে ঢাকাতে নাকি অনেক খুন হচ্ছে। সেই খুনের সুরাহা করতে নাকি এই বই লাগবে। এই বইয়ে নাকি সব উত্তর আছে। হ্যা, এমনটাই তো বলেছিল।”
নীরুর মাথা কাজ করছে না। সুকান্ত, অনেকগুলো খুন- এগুলো তার কাছে পরিচিত। কিন্তু বই, প্রণব, নবীগঞ্জ- এগুলো সে প্রথম শুনছে। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “বইটা একবার দেখতে পারি?”
বৃদ্ধ লোকটা বলল, “বইটা তো আমি সবাইকে দেখাই না। বইটা অনেক দামি বই।” বলে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসে পড়ল। নীরু ভাবল, পাগল টাগল না তো আবার? পাগলদের এইরকম অনেক অদ্ভুত কাল্পনিক জিনিসপত্র থাকে। তাদের পাড়াতেই একটা পাগল ছিল, ফিফার ফুটবল বিশ্বকাপের ট্রফি নিয়ে ঘুরত। কাছে গেলেই বলল, “মাজার উপার টোফি দিয়া এট্টা বারি দিমু।”
কথোপকথন সেখানেই থেমে যেত, কিন্তু নীরুর মন মানছে না। বইটার প্রতি এক প্রবল কৌতূহল তাকে বারবার বৃদ্ধের দিকে ঠেলছে। এই কৌতূহলের কারণ কি বৃদ্ধের প্রত্যাখ্যান? নাকি বৃদ্ধের মুখের সুকান্ত আর এই কেসের কথাগুলো শুনতে থাকা। এর ভেতরে নিজের মুক্তির একটা লুকানো দরজা পাওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকলেও থাকতে পারে।
“প্লিজ, বইটা দেখান। মানে, আপনি যে খুনের কথা বলছে, সেই খুনের সাথে আমিও জড়িয়ে গিয়েছি, আমার বাবা খুন হয়েছেন। ওই জানোয়ার সুকান্ত আমার বাবাকে খুন করেছে। বইটা যদি একটু দেন।” তাড়াতাড়ি কথাগুলো বলতে গিয়ে সব গুবলেট করে ফেলল নীরু।
বৃদ্ধ বলল, “আপনি বইটা সঠিক হাতে পৌঁছে দিতে পারবেন?”
“সঠিক হাত বলতে?”
“এই ধরেন, পুলিশের কর্তা বা সেরকম কারো হাতে। আমি তো অতকিছু বুঝি না।”
নীরু রাজি। এক বাক্যে রাজি।
বৃদ্ধটা তখন গার্ডকে ডাকল। বলল টয়লেটে যাবে। গার্ড তাকে খুব নোংরা একটা গালি দিয়ে ‘খাঁচার ভিত্রেই মুততে’ বলল।
তখন নীরু বলল, “ভাই, এই বয়সের আপনার কোন বাবা, ফুফা বা চাচা থাকলে আপনি কি এইভাবে বলতে পারতেন বলেন?” নিজের গলায় এই রকম নরম কথা শুনে নীরু নিজেই অবাক হয়ে গেল। গার্ডটা বিরক্তিতে গজগজ করতে করতে বৃদ্ধকে নিয়ে টয়লেটের দিকে গেল।
কিন্তু বইটার ব্যপারে তো বৃদ্ধটা কিছু বলল না। নীরু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে লাগল। দূরে, টয়লেটের দরজা খোলার ধাতব শব্দ হল। তারপর কয়েক মুহূর্ত গেল। অন্য কিছু ঘটছে না তো? পুলিশের চর টর না তো? সেলের ভেতরে অনেক সময় আসামী সেজে পুলিশের চর বসে থাকে অন্যান্য আসামীদের কথাবার্তা শোনার জন্য। এদেরকে বলা হয় ‘দ্য থার্ড এয়্যার’, মানে তৃতীয় কর্ণ। এই বৃদ্ধটা আবার তাদের ভেতর একজন না তো?
বৃদ্ধ ফিরে আসল। তাকে সেলের ভেতর ঢুকিয়ে গার্ড তালা দিয়ে চলে গেল। বৃদ্ধ লোকটা এবার লুঙ্গির ভেতর থেকে একটা ছেঁড়া ফাটা কাগজ বের করে ছুঁড়ে দিল নীরুর সেলের দিকে। নীরুর সেলের গরাদে বাড়ি খেয়ে কাগজটা পড়ে গেল। নীরু হাঁটু গেড়ে বসে গরাদের ভেতর দিয়ে হাত গলিয়ে দিল। টেনে নিল সেই ছেঁড়া ফাটা কাগজটা। যখন সে খুলে দেখল তখন বৃদ্ধ লোকটা বলল, “এটাই সে বই।”
নীরু অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে থাকল; বলল, “ইয়ার্কি করছেন? এইটা বই? আপনি বই চেনেন? বই পড়েছেন কখনও? এইটা একটা ত্যানা ছেঁড়া ধুর…” ছুঁড়ে ফেলে দিল বইটা।
বৃদ্ধটা চিৎকার করে উঠল, “আপনি কথা দিয়েছেন যে বইটা আপনি পুলিশের হাতে দেবেন! দিতে না চাইলে ফিরিয়ে দেন, দেন!”
নীরু বইটা তুলে আড়চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকালো। লোকটা এই বইটার বদলে তার মুক্তি চাইতো বা তার থেকেও বড়ো কিছু চাইতো, সেটা চায়নি। নিচু গলায় নীরু বলল, “আচ্ছা আমি কালকে দিয়ে দেব।”
পরদিন সকালে নীরুর উকিল আসল। ওয়েটিং রুমে অপেক্ষা করলে নীরুর ডাক পড়ল।
দুজন গার্ড আসল। সাথে এলিন। একটা তীব্র ঘৃণা ভরা দৃষ্টি নিয়ে এলিনের দিকে তাকালো নীরু। একটা ক্রুর হাসি হেসে বলল, “আজকাল পুলিশগিরি বাদ দিয়ে মডেলিং শুরু করেছ মনে হচ্ছে?” একজন গার্ড তার হাতে হাতকড়া পরাতে শুরু করল।
“তোমাকে মানা করেছে কে? তুমি মানুষ খুন না করে মডেলিং শুরু কর না।” এলিন বলল।
গার্ডদুজন নীরুকে ধাক্কা দিলে সে হাঁটতে শুরু করল। হাঁটতে হাঁটতে নীরু বলল, “আমার কাছে একটা জিনিস আছে, যেটা তোমাদের কাজে লাগতে পারে।”
এলিন সরু চোখে তাকালো। এই জিজ্ঞাসাবোধক চাহনি দেখে নীরু বলল, “একটা বই।”
বই? কোন বই? ব্যাপারটা বুঝতে কিছুটা সময় লাগল এলিনের। তারপর হঠাৎ মনে পড়ে গেল আমানুল্লাহর কথা, প্রণবের কথা, বইটার কথা, প্রণবের নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার কথা। “কি বই? কোন বই?” একরকম চিৎকার করেই প্রশ্নটা করল এলিন।
নীরু বলল, “বই, বইটার নাম, কি যেন, হ্যাঁ, পাছাখানার ভূত।” এলিনের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল, বলল, “কোথায় বইটা?”
“আমার কাছেই আছে।” নীরু বলল।
“দিয়ে দাও।”
“উঁহু। বইটার বদলে আমার কিছু চাওয়ার আছে।”
“কি?”
“মুক্তি। বইটা আমি তোমকে তখনই দেব, যখন তুমি আমাকে এখান থেকে মুক্ত করবা। উইদ আউট এনি চার্জেস ওভার মাই হেড!”
নীরুর দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে বলল এলিন, “কি বলছেন আপনি জানেন? আপনি ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের চীফকে খুন করেছেন! আর আপনি বলছেন সামান্য একটা বইয়ের বদলে আপনি মুক্তি চান? আপনার মাথা ঠিক আছে? আপনি কি জানেন যে আপনাকে এইখান থেকে ছাড়াতে গেলে আমার চাকরিটার কী অবস্থা হবে?”
“যদি আপনার কাছে বইটা সামান্য মনে হয়, তাহলে আমার কিছু করার নেই। আমি ভেবেছিলাম চীফের খুনিকে ধরার চাইতে আপনার পাছাখানার ভূতকে ধরার প্রায়োরিটি বেশি হবে। যাই হোক, বইটা না চাইলে নাই।” একটা মেকী দীর্ঘশ্বাস ফেলে মেঝের দিকে তাকিয়ে বলল নীরু।
দৃষ্টি ভর্তি ঘৃণা, ক্ষোভ আর বিভ্রান্তি নিয়ে নীরুর দিকে তাকিয়ে থাকল এলিন।
লুকানো ক্ষত
ভোর ছয়টা।
ঝম ঝম করে বৃষ্টি হচ্ছে। সারারাত অসহনীয় ভ্যাপসা গরমের পরে স্বস্তির বৃষ্টি। এখনও ঢাকার ঘুম ভাঙ্গেনি। দু-একটা টাউন সার্ভিসের ফিটনেসবিহীন লক্কড় ঝক্কড় বাস চলতে শুরু করেছে। ভেজা রাস্তায় ছায়া পড়েছে লাল ওভারব্রিজের। একটা রাজনৈতিক ব্যক্তির বিজ্ঞাপন সম্বলিত ব্যানার ঝুলছে ওভারব্রিজের গায়ে। ব্যানারে সেই রাজনৈতিক ব্যক্তির হাস্যোজ্জল ছবি। এক হাতে উঁচু করে কাকে যেন আশ্বাস দিচ্ছেন। হাতের আঙুলে তিনটা সোনার আংটি। ব্যানারটার নিচেই একটা ছিন্নমূল পরিবার গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। ওভারব্রিজ থেকে লাফিয়ে পড়লেই সব দুঃখ যন্ত্রণার অবসান ঘটে যায়। কিন্তু তারা সেটা করছে না।
মগের শেষ কফিটুকু চুমুক দিতে দিতে জানালার কাছ থেকে সরে আসল সাইদুর। নির্ঘুম রাতের সাক্ষী হিসাবে লাল চোখ দুটো ফুলে আছে। সারা ঘরে নরম একটা অন্ধকার। খালি মগটা সিংকের ওপরে রাখতে রাখতে বলল, “আরাফ, খাবি কিছু?”
পাশের ঘর থেকে আরাফ বলল, “না। তুই ঘুমিয়ে নে। আপাতত আমাদের কিছু করার নেই।”
পাশের রুমে উঁকি দিল সাইদুর। আরাফ এখনও কম্পিউটারের সামনে বসে আছে। ফুটেজটা ডি-ফগ করে ঝাপসা ভাবটা কমানোর চেষ্টা করছে। এতে করি যদি খুনির চেহারা চেনা যায়। যদিও দুইজনেই জানে, এটা একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা। সারারাত তারা যতগুলো উপায় অবলম্বন করেছে, ডি-ফগিং তার একটা।
বলা উচিৎ ছিল, আরাফ রাখ ওভাবে হবে না বাদ দে; অথবা অন্য কোন ওয়ে টাই কর এটা দিয়ে হবে না। কিন্তু সাইদুর কিছুই বলল না। ক্লান্ত শরীরটা বিছানায় এলিয়ে দিল। এক মগ কফি খাওয়ার পরেও মিনিটের ভেতরে ডুবে গেল গভীর ঘুমের অতলে।
সাইদুরের ঘুম ভাঙল আরাফের ডাকে, “সাইদুর, ওঠ, শুনছিস? ওঠ।”
তড়াক করে উঠে পড়ল সাইদুর। কতক্ষণ ঘুমিয়েছে সে? দুই ঘণ্টা? তিন ঘণ্টা? আরাফের চেহারার দিকে তাকিয়ে তার বেশ খানিকটা সময় লাগল সেটা বুঝতে যে আরাফ তার ফ্ল্যাটে কি করছে।
“একটা উপায় পাওয়া গিয়েছে,” আরাফ বলল।
“কিসের উপায়?”
পাশের দেয়ালে হেলান দিয়ে আবার ঘুমিয়ে যাচ্ছিল সাইদুর, আরাফ আবার টেনে তুলল, “আরে ফুটেজ থেকে খুনির চেহারাটা বোঝার উপায়।”
সাইদুর শুনতে পেল, কিন্তু খুব একটা গুরুত্ব দিল বলে মনে হল না। সারারাত প্রায় বিশটা মত উপায় বিফলে গিয়েছে। তাই নতুন কোন উপায়ের কথা তার চোখ খোলাতে পারল না।
কিন্তু হাল ছাড়ল না আরাফও, “ফুটেজের যেটুকু অংশে মাজল ফ্ল্যাশ দেখা গিয়েছে, আমরা সেটুকু ক্রপ করে কেটে নিতে পারি। তারপর, তারপর সেই অংশটুকুর পিক্সেল রিফরমেশন করে মোটামুটি একটা চেহারা দাঁড় করাতে পারি যেটা দিয়ে অন্তত অনুমান করতে পারব খুনির চেহারা। শুনছিস তুই? সাইদুর?”
সাইদুর উঠে বসল। ঘুম মাখা গলায় বলল, “শুরু কর আমি আসছি। আরাফ নতুন উদ্যোমে সেলুলয়েড স্ক্রিনের সামনে বসে গেল।”
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী।
***
পিকআপ ভ্যান থেকে বেশ কয়েকটা কাঠের তৈরি কাঠামো নামানো হচ্ছে। এগুলো মঞ্চ সাজানোর কাজে লাগবে। ক্রিমসন পাবলিকেশন্সের লোকজন খুব ব্যস্ত। পরশু দিন অনুষ্ঠান। ভারত থেকে অতিথি আসবে। বিশেষ অতিথিদের সবাই বিশ্বভারতীর। দেশীয় লেখকরা ‘অবিশেষ’ অতিথি। আর দেশের তথাকথিত হোমরাচোমরা ব্যক্তিরা তো আসবেনই। দারুন করে সাজাতে হবে মঞ্চ।
“ওগুলো এখানে রেখো না। ওই যে সতেরো নাম্বার রুমে রেখে আসো। আরে ওই যে ড্রেসিংরুমের পাশে।” ক্রিমসনের অফিস সহকারি সেই ভদ্রমহিলা বলছেন কোথায় কোন জিনিসটা রাখতে হবে। হাতে একটা রাইটিং প্যাড আর কলম। একটা একটা করে জিনিস নামছে আর উনি রাইটিং প্যাডে টিক দিচ্ছেন।
শিল্পকলার পেছন দিকে অপরেশ পাল হাঁটাহাঁটি করছেন বেশ কিছুক্ষণ। তার কুঞ্চিত ভ্রু বলে দিচ্ছে, তিনি টেনশনে আছেন। সকাল থেকে হিরণের ফোন আসছে না। আরে ভাই, একটা দুর্ঘটনা ঘটে যেতেই পারে। বাংলাদেশে ষোল কোটি মানুষ, কেউ না কেউ হয়ত বাইরে বলে দিয়েছে ব্যাপারটা। এত সাবধানতা অবলম্বন করার পরেও যদি একটা দুটো দুৰ্ঘটনা ঘটে যায় তার দায়ভার তো আর তাদের না। তাই বলে ফোন বন্ধ করে রাখতে হবে? পকেট থেকে দামি স্মার্টফোনটা বের করলেন। তেরোবারের মত হিরণকে ফোন করলেন।
‘দুঃখিত, কাঙ্খিত নাম্বারটিতে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না…’
দুপুর দুটো থেকে আবার একটা এক্সিবিশান শুরু হবে। তার আগেই কাজগুলো গুছিয়ে ফেলতে হবে। “তাড়াতাড়ি। আর ওই পিকআপটাকে ফোন দিয়ে বল যে এই পিকআপটা আনলোড হয়ে গেলে যেন ওটা আনে। আগে আগে আনলে জ্যাম বেঁধে যাবে। কোথায় আছে এখন ওটা? মৎস ভবনের ওখানে? আচ্ছা।” ভদ্রমহিলা বলল। আরো কয়েকটা ছেলে পাওয়া গেলে ভালো হত। কাজটা আরো দ্রুত এগোত। কাল থেকে মঞ্চ সাজানোর কাজটা শুরু করতে হবে। হাতে একদম সময় নেই।
অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করবে সে, ভাবতেই ভদ্রমহিলার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সুন্দর করে সাজতে হবে। পারসোনার প্রিমিয়াম মেম্বারশিপটা অবশেষে কাজে লাগতে যাচ্ছে!
একজন যে রুখে দাঁড়ায়
আকাশি রঙের হাফহাতা শার্ট পরিহিত ভদ্রলোকটি নীরুর উকিল। এডভোকেট শাকিল মাহমুদ। তার সামনে বসে থাকা দুই রমণীর মেজাজ যে ভীষণ চড়ে আছে এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। দুজনেই খুব উঁচু গলায় কথা বলছে। ভাগ্য ভালো ওয়েটিং রুমটা সাউন্ড প্রুফ। তিনি ছাড়া আর কেউ এদের কথা শুনছে না।
“তুমি কি মনে করেছ? এই বইটা নিতে হলে তোমাকে মুক্তি দিতেই হবে? আর কোন রাস্তা নেই? ঠিক আছে। তুমি গাধার মত একটা কথা বলবা আর আমাকে সেটা শুনতে হবে?” এলিন বলল। বইটা পাওয়ার জন্য সে মরিয়া হয়ে আছে।
নীরুও ছাড়বার পাত্রী না। সে বলল, “আছে, জানি অনেক রাস্তা আছে। কিন্তু এটা সব থেকে সহজ রাস্তা। আমি জানি না কীভাবে তুমি কাজটা করবে, কিন্তু বইটা তোমাকে তোমাদের স্যারের খুনি পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারে।”
“আসল খুনি সুকান্ত। ও যখন ধরা পড়েছে তখন স্যারের খুনির ব্যাপারটাও পরিষ্কার হয়ে যাবে। ওটার জন্য বইটা খুব একটা কাজে আসবে না। বইটা লাগবে কারণ স্যার ওটা চেয়েছিলেন।”
“কে বলল তোমাকে যে সুকান্ত গ্রেপ্তার হয়েছে?” নীরু কথাটা এমনভাবে বলল যেন সুকান্তের গ্রেপ্তার হওয়ার মত মজার কথা সে অনেকদিন শোনেনি। “সুকান্তের সাথে দেখা করতে দিয়েছে তোমাদেরকে?”
এলিন আমতা আমতা করে বলল, “নান- না। এই ধরণের কেসে কোর্টে চালান না হওয়া পর্যন্ত কারো সাথে দেখা করতে দেওয়া হয় না।”
“পারলে যেভাবেই হোক একবার দেখা করে এসো। একটা ষাট সত্তর বছরের বৃদ্ধ কিভাবে সুকান্ত হতে পারে, কীভাবে এই বই লিখতে পারে, কীভাবে তার থেকে বয়সে বড় মানুষের জীবন নিতে পারে- সব বুঝে যাবে। তারপর এসে আমার সাথে কথা বল।” নীরু বলল, “এই লোকটা সিলেটের কোথায় জানি মাছ ধরত। তাকে ধরে এনে আচ্ছামত পিটিয়েছে। তাকে কোর্টে এটা স্বীকার করতে হবে যে সে-ই সুকান্ত। সে-ই এতগুলো খুন করেছে। তার কেসটা হয়ত এতক্ষণে সাজানো হয়ে গিয়েছে বুঝলে? আসল আসামী থাকল পড়ে, কোথাকার কোন ঘাটের মড়াকে এবার চিতায় তোল। হাহ! চেনা হয়ে গিয়েছে তোমাদের এই আইন কানুন।”
এলিনের ভ্রু কুঁচকে গেল। সে জিজ্ঞাসা করল, “তারমানে? আসামী বুড়ো? সত্যি বলছেন? মানে, মানে সে-ই যদি খুনি হয়, তাহলে খুনি কেন নিজের লেখা নিষিদ্ধ বইটা আপনার কাছে দেবে? মানে, মানে লোকটা আপনাকে বইটা কেন দিয়েছে?”
“লোকটা বলেছে বইটা আমি যেন একজন দায়িত্বশীন পুলিশ অফিসারকে দেই।” নীরুর গলা চড়ে গিয়েছে। ধৈর্য্য কমতে শুরু করেছে ধীরে ধীরে।
“বইটা কোথা থেকে পেয়েছে সে?” নিজেকে সংযত রেখে এলিন প্রশ্ন করল।
“প্রণব না কার কাছ থেকে জানি পেয়েছে।” একরাশ বিরক্তি নিয়ে উত্তরটা দিল নীরু।
দ্বিতীয়বারের মত আকাশ থেকে পড়ল এলিন। প্রণব স্যার দিয়েছেন? প্রণব স্যার এখনও বেঁচে আছেন? কোথায় আছেন? তিনি নিজে কেন আসলেন না? ঘূর্ণিপাকের ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে এলিন সেখান থেকে উঠে গেল। নীরু কি যেন একটা বলল মাথায় ঢুকল না তার। এই মুহূর্তে আসামীকে প্রশ্নগুলো করতে হবে।
কিন্তু সেল সেক্টরে ঢোকার মুখে দুজন গার্ড আছে। তৌফিক এলাহীর কড়া নির্দেশ, তার অনুমতি ছাড়া কেউ যেন সেল সেক্টরে না যায়।
ওয়েটিং রুম থেকে বেরিয়েই মল্লিকাকে ফোন দিল এলিন। মল্লিকা ফোন ধরল।
“হ্যালো মল্লিকা? শোন, এক কাজ কর। কন্ট্রোল রুমে যা। গিয়ে একশ তিন আর একশ চার নাম্বার সিসিটিভি ক্যামেরার রেকর্ডিং বন্ধ করে দে।”
“কেন?”
“যা বলছি কর।”
“আচ্ছা, দেখছি।”
“বুঝেছিস তো কোন দুইটা ক্যামেরা?”
“হ্যাঁ, ওই যে ঢুকতেই যে সিসিক্যাম দুইটা।”
“আরে না, ধুর, সেল সেকশনের সিসিটিভি দুইটার কথা বলছি। বন্ধ করিস না। শুধু রেকর্ডিংটা বন্ধ করিস।”
“হুম।”
মল্লিকা কি বুঝল কে জানে। যদি অন্য ক্যামেরার রেকর্ডিং বন্ধ করে আর এলিন এখন যেটা করতে যাচ্ছে, সেগুলো যদি রেকর্ড হয়ে যায়, তাহলে সব শেষ। সাইদুরকে কি একবার ফোন করে দেখবে? না থাক। এই কাজটা অন্তত সে নিজে করবে।
হৃৎপিণ্ডটাকে লাগাম দিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিল এলিন। তারপর দ্রুত সেল সেক্টরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। দূর থেকে গার্ড দুজনকে দেখা যাচ্ছে। মল্লিকাকে আরেকবার ফোন করল এলিন।
“মল্লিকা? হয়েছে? কন্ট্রোল রুমে গিয়েছিস? কেউ আছে আশেপাশে?”
“আছে তো। তিনজন আছে।”
“সাবধানে কাজ কর। যে দুইটা বললাম সেই দুইটার রেকর্ডিং বন্ধ কর।”
“কোন দুইটা বললি যেন?”
“ধুর বাল, একশ তিন আর চার।”
“আচ্ছা আচ্ছা।”
মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এলিনের। কিন্তু মেজাজ খারাপ করা যাবে না। স্বাভাবিক থাকতে হবে। যা হওয়ার হবে। ধীর পায়ে গার্ড দুজনের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল এলিন। বুকের বাম দিকে লাগানো ব্যাজটা ঠিক করে নিল। আড়চোখে একবার একশ তিন নাম্বার সিসিক্যামটার দিকে তাকালো। খোদা জানে মল্লিকা রেকর্ডিং বন্ধ করল কিনা।
“গুড মর্নিং ম্যাডাম।” গার্ড দুজন বলল।
“গুড মর্নিং,” একটা চমৎকার হাসি হেসে এলিন উত্তর দিল। তারপর ডান দিকের গার্ডের ডায়াফ্রাম বরাবর একটা লাথি, আর বাম পাশের গার্ডটার গলা বরাবর একটা রদ্দা। একটা অপ্রত্যাশিত আক্রমণ! সামলে নেওয়ার আগেই ডানপাশের গার্ডের হাতে থাকা শটগানটার বাঁট দিয়ে গার্ডটার থুতনি বরাবর একটা আঘাত করল। বামপাশের গার্ডটা ওয়াকিটকির দিকে হাত বাড়াতেই তার কাঁধের ওপরে পড়ল একটা বারো সিক্কার রদ্দা, আর চোয়াল বরাবর দুটো ঘুষি।
অচেতন গার্ড দুজনকে বাইরে রেখেই সেল সেক্টরের ভেতরে ঢুকল এলিন। সময় কম। যে কেউ এসে পড়ার আগেই বের হতে হবে। একটা একটা করে সবগুলো সেলে উঁকি দিতে লাগল এলিন। একেবারে শেষের সেলে পাওয়া গেল লোকটাকে। সেলের ভেতরের দিকে দেয়ালের সাথে হেলান দিয়ে বসে আছে। “বুড়া মিয়া? ও বুড়া মিয়া।” ডাকতে থাকল এলিন।
কোন সাড়া শব্দ নেই। ঘুমিয়ে গিয়েছে হয়ত। আরো বেশ কয়েকবার ডাকল এলিন। বেশ কয়েকবার। বাধ্য হয়ে পকেট থেকে ফোনটা বের করতে হল। ফোনের ফ্ল্যাশ লাইটটা জ্বালিয়ে যে দৃশ্যটা দেখল সেটা তার মস্তিষ্ককে মুহূর্তের জন্য অচল করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট।
বৃদ্ধ মারা গিয়েছে। মুখ দিয়ে গাঁজলা উঠে সারা শরীর হয়ে গিয়েছে।
খুব দ্রুত সেল সেক্টর থেকে বের হয়ে গেল এলিন। মল্লিকা রেকর্ডিং বন্ধ করেছে কিনা সেটা দেখতে হবে। যদি না করে থাকে, তাহলে তাকে খুনের দায়ে ফাঁসতে হবে। আর তৌফিক এলাহী যদি জানে তার আসামীর মৃত্যুর সময় এলিন সেখানে ছিল, একেবারে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে।
প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ওয়েটিং রুমের সামনে এসে দাঁড়ালো এলিন। ঘন ঘন শ্বাস প্রশ্বাস পড়ছে। হাপরের মত ওঠা নামা করছে বুক। মল্লিকা ফোন করল সে। কয়েকবার কলার টিউন বাজার পরে মল্লিকা ধরল।
“মল্লিকা? হয়ে গিয়েছে, রেকর্ডিং অন কর।”
“কিসের রেকর্ডিং? আমি তো এই মাত্র অফ করলাম, এতক্ষণ তো অনই ছিল।”
“কিহ!”
“হা হা হা। ফান করলাম। রেকর্ডিং অন করছি। হি হি হি।”
ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে গেল এলিনের। তারপরও মল্লিকাকে বিশ্বাস নেই। ফুটেজগুলো আবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে পরে- ভাবল এলিন। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে ওয়েটিং রুমে ঢুকল। নীরুকে বলল, “তুমি উইদআউট এনি চার্জেস মুক্তি পাবে। বইটা দাও, আর বল আসামীটা কোথা থেকে বইটা পেয়েছে? মানে প্রণব স্যারের সাথে তার কোথায় দেখা হয়েছে?”
শাকিল মাহমুদ উঠে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা বলতে যাচ্ছিলেন। নীরু থামিয়ে দিল, বাঁকা হাসি হেসে বলল, “গুড গার্ল!”