অশুভ আবিষ্কার
প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি আমরা, একটু পরেই আমাদের প্রধান কার্যক্রম শুরু হবে। যাই হোক” পৃষ্ঠা উল্টে লোকটা বললেন, “ভান করা ব্যাপারটা লেখকদের জন্য একটা অভিশাপ। এই অভিশাপ থেকে দুরে থাকতে হবে। পাঠকের কাছে লেখক কখনওই ভান করবে না। সে যেটা বিশ্বাস করে, সেটাই সে লিখবে। তার মতামত, তার চিন্তাচেতনা কখনোই অন্যের কথা ভেবে পরিবর্তিত বা পরিমার্জন করে লিখবে না। সে যা, ঠিক সেভাবেই পাঠকের কাছে উপস্থিত করবে।”
***
“সালা, আমার দুঃখ…… কেউ বোঝে না। আমার যে কি ব্যথা…… আরে, আমি লিখব আমার মতন…… পাবলিক কি খাবে না খাবে…… সেই ভেবে আমি লিখব নাকি আরে আজব তো…… বই চলছে না চলবে না, তো চলবে না……তাই বলে আমার লেখা আমি লিখব না নাকি……. উঁ…”
সুকান্তের গায়ে হেলান দিয়ে কথাগুলো বলছে হিরণ। সিএনজি ছুটে চলেছে শ্যামলীর দিকে। মৎস্যভবন পার হল মাত্র। হু হু করে রাতের বাতাস কেটে বেরিয়ে যাচ্ছে সিএনজিটা। সিএনজিটা পেতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে সুকান্তকে। ভয় ছিল, সিএনজিওয়ালাদের কাছে তার ছবি দেওয়া আছে। সিএনজি নিতে গেলে একটা বড় ধরণের ঝুঁকি নেওয়া হয়ে যাবে। তাছাড়া আর উপায়ও নেই। কারণ এত রাতে সিটি সার্ভিসের বাস চলে না।
প্রেসপাড়া পার হয়ে তলস্তয় মোড় পর্যন্ত আসতে হয়েছে। তারপর বাহাদুর শাহ পার্কের দিকে কিহুদূর হেঁটে আসছে হয়েছে। তারপর সিএনজি পাওয়া গিয়েছে। সিএনজি ঠিক করতে গিয়ে সেই সেদিনকার কথা মনে পড়ে গিয়েছিল সুকান্তের। কিন্তু উপায় তো নেই।
হিরণের মানিব্যাগে ঠিকানা লেখা আছে শ্যামলীতে। চার নাম্বার রোড, সাত নাম্বার বাড়ি।
“আমার লেখা ভালো হইছে কি খারাপ হইছে আমি বুজবো…… পাঠক কে? হ্যাঁহ?…… পড়ে তো ওই ব্যংক জব নাইলে বিসিএসের বাল…… আমার লেখা ও কি বুজবে…… ফেসবুকের ফলোয়ার দেখছে সালারা আবার কথা বলতে আসে……আমি রাইটার বেসসালা…”
কিছুক্ষণ পর পর চেতনা হারাচ্ছে, আবার চেতনা ফিরে পেলে বক বক করে বকছে হিরণ।
সিএনজিওয়ালাটা বারবার পেছন দিকে তাকাচ্ছে। ওভাবে তাকাচ্ছে কেন লোকটা? সুকান্তের নিঃশ্বাস প্রায় বন্ধ হয়ে আসল। তাহলে কি এই লোকটার কাছেও তার ছবি দেওয়া আছে? হাতের কাছে শক্ত কিছুই নেই যে উল্টাপাল্টা কিছু হলে সেটা দিয়ে প্রতিরোধ করা যাবে।
“ভাই, বমি টমি ভিত্রে কইরেন না য্যান দেইখেন।” সিএনজিওয়ালা বলল।
সুকান্ত বলল, “দেখব, আপনি চলেন।”
কল্যাণপুর পার হওয়ার একটু পর হিরণকে সোজা করে বসাতে বসাতে সুকান্ত বলল, “ভাই সিএনজিটা ভেতরে নেবেন।”
“বিশ টাকা ধইরা দিবেন।” সিএনজিওয়ালা বলল।
ঠিকানা অনুযায়ী সিএনজিটা থামল। একটা দোতলা বাড়ি। পুরনো কিন্তু বেশ শৌখিন। বারান্দাগুলোতে শৌখিন ইনডোর প্ল্যান্টের সারি। হিরণের মানিব্যাগ থেকে টাকা বের করে ভাড়া মিটিয়ে দিল সুকান্ত। তারপর হিরণের শরীরটা টেনে বাড়ির ভেতরে ঢুকল।
কোন তলায় থাকে হিরণ? ওপরে? নাকি নিচে? ভাড়া বাসা মনে হচ্ছে। নাকি হিরণদের নিজের বাসা? নিচতলার বারান্দাটা গ্রিলে ঘেরা। কোন বারান্দাতেই আলো নেই। হিরণের পকেট থেকে এক গোছা চাবি বের করল। বেশ কয়েকটা চাবি আছে। একটা একটা করে নিচের বারান্দার তালাতে ঢুকাতে লাগল। যদি খোলে তো ভালো না হলে এখানেই হিরণকে ফেলে রেখে চলে যাবে।
তালা খুলল।
হিরণকে কাঁধে করে ভেতরে ঢুকল সুকান্ত। অন্ধকার ঘর। ঘরের ভেতরে অদ্ভুত একটা গন্ধ। হিরণকে কোথায় রাখা যায়? অন্ধকার হাতড়ে একটা কাঠের হাতল মত কি একটা হাতে বাঁধল। সেটার ওপরে ভর দিতেই হুড়মুড় করে হিরণকে নিয়ে পড়ে গেল সুকান্ত। কনুইয়ে খুব লাগল।
আগে লাইট জালাতে হবে। দেয়াল ধরে ধরে সুইচ খুঁজতে লাগল সুকান্ত। বেশি আওয়াজ করলে আশেপাশের লোকজন চোর বলে সন্দেহ করবে। গণপিটুনিও দিতে পারে। সাবধানে পা ফেলতে লাগল সুকান্ত
সুইচবোর্ড হাতে বাঁধল অবশেষে। একটা একটা করে সুইচ চাপতেই লাইট জ্বলে উঠল।
ছোট্ট একটা ঘর। খাট নেই, ফ্লোরিং বেড করা। হিরণকে বেডের ওপরে শুইয়ে দিয়ে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করল সুকান্ত। পানির পিপাসা পেয়েছে। ফ্রিজ আছে কিনা খুঁজতে লাগল সুকান্ত।
পুরো বাসাটা ঘুরে দেখল সুকান্ত। ছোট্ট ডাইনিং স্পেস। সব মিলিয়ে দুইটা রুম। পাশের রুমেই ছোটখাট একটা ফ্রিজ রাখা। সেটা খুলে একটা কাঁচের পানির বোতল অর্ধেক শেষ করে ফেলল। তারপর পাশেই রাখা কোকের বোতলটা থেকে কয়েক ঢোঁক কোকও খেল। পলিথিনে মোড়া পাউরুটি আর বোতলে রাখা জ্যাম খেলো। কতদিন পর নিজেকে স্বাধীন মনে হল সুকান্তের। আহ! সকাল হলেই তাকে চলে যেতে হবে। মানে সকাল হওয়ার আগেই চলে যেতে হবে। না হলে ঝামেলা হয়ে যাবে। কিন্তু, যদি সে এই রকম একটা বাসায় থাকতে পারত। যেখানে একটা ফ্রিজ থাকবে। সারি সারি বোতল থাকবে। বোতলে সাজানো থাকবে কোল্ড ড্রিংক্স। গরমকালের রাতগুলোতে জানালার পাশে বসে চুমুক দিয়ে কোল্ড ড্রিক্স খাবে সে।
কোকের বোতলটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো সুকান্ত। একটা লেখার টেবিল চোখে পড়ল। সুন্দর। সাজানো গোছানো। কোকের বোতলটায় চুমুক দিতে দিতে টেবিলটার দিকে এগিয়ে গেল সে। ল্যাপটপ রাখা আছে। একটা কিবোর্ড আছে পাশে। টেবিলের থাকের ওপরে খাতা রাখা আছে কয়েকটা। কাঠের কলমদানিতে কলম। ফটোফ্রেমে দুজন মহিলার ছবি। নেড়েচেড়ে সবকিছুই দেখতে লাগল সুকান্ত।
হঠাৎ পেছনে ঘোৎ করে একটা শব্দ হল। সুকান্ত চমকে পেছনে তাকালো। হিরণ ঘুমের ঘোরে কিছু একটা বলছে। বাইওে কোথাও কুকুর ডেকে উঠল। ভেসে আসল কোন এক রাত জাগা পাহারাদারের কন্ঠে গাওয়া গান।
সুকান্ত আবার জিনিসপত্রগুলো দেখায় মন দিল। খাতাগুলো আস্তে আস্তে দেখতে লাগল। বোতলের কোকটুকু শেষ। আর কিছু আছে নাকি ফ্রিজে? ভয়ানক ক্ষিদে পেয়েছে তার। উঠে গিয়ে পাউরুটিগুলো আনতে হবে।
হঠাৎ ড্রয়ার চোখে পড়ল সুকান্তের। টেনে খুলল সেটা। ড্রয়ারের ভেতরে খুব যত্ন করে রাখা কিছু হ্যান্ডবিল। ছোট্ট একটা প্যাডে কিছু নোটস। কয়েকটা ফটোগ্রাফ। হ্যান্ডবিলগুলো তুলে নিল সুকান্ত। কিছুর একটা বিজ্ঞাপন।
.
আপনি কি রাইটার্স ব্লকে ভুগছেন?
হতাশায় ডুবে আছেন? লেখালেখি এগোচ্ছে না?
চিন্তা নেই। আমরা আছি আপনার পাশে।
‘শব্দযাত্রা লেখক সঙ্ঘ’
(আমাদের কোন শাখা নেই)
.
‘আপনি কী রাইটার্স ব্লকের দুঃসহ যন্ত্রণায় ভুগছেন? ইচ্ছা থাকলেও কোনভাবেই লিখতে পারছেন না? আপনার জন্যই আমরা অপেক্ষা করছি। রাইটার্স ব্লক কাটানোর পাশাপাশি আমরা আপনাকে দিচ্ছি আরো কিছু বিশেষ সুযোগ সুবিধা যাতে করে আপনার লেখনি কলম আরো শাণিত হয়। আমরা প্রমাণ করব, লেখকেরা জন্মায় না, লেখকরা তৈরি হয়। আমরা বিভিন্ন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আপনাকে একজন দক্ষ লেখক হিসাবে গড়ে তুলব।
মাত্র দশ হাজার টাকা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করে আপনিও শুরু করুন এই চমৎকার শব্দযাত্রা। যোগাযোগ…
বাকি অংশটুকু ছেঁড়া।
ভ্রু কুঁচকে গেল সুকান্তের। ম্যাডাম আনানসির সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। কারা যায় সেই সমিতিতে? এই কি সেই সমিতি? এটাই কি সেই সংঘ? যেটাতে ইমন মোস্তাফিজও যেতেন নাকি? সব কেমন ঘোলাটে লাগছে। কোথায় যেন সবটা মিলতে মিলতেও মিলছে না। হ্যান্ডবিলগুলো এত যত্ন করে রাখারই বা কি আছে? নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে প্রশ্নের বন্যা বয়ে গেল সুকান্তের মাথার ভেতরে।
কয়েকটা নোটস ছিল। সেগুলোতে কি লেখা বুঝতে পারল না সুকান্ত। হাতের লেখা খুব খারাপ। খুব দ্রুত লেখা হয়েছে সেগুলো বোঝা যাচ্ছে। আরেকটা খাতায় পয়েন্ট দিয়ে কী কী সব লেখা। সেগুলোও পড়া গেল না।
ফজরের আজান পড়ল। রাত ফুরিয়ে গিয়েছে। বেরোতে হবে তাকে। ফ্লোর বেডের ওপরে হিরণ ঘুমাচ্ছে, শিশুর মত গুটিসুটি মেরে। বমি করে বিছানার বেশ খানিকটা ভিজিয়ে ফেলেছে। তার মধ্যেই ঘুমিয়ে আছে।
আকাশ পরিষ্কার হতে শুরু করেছে।
ফ্রিজ থেকে কয়েকটা পাউরুটি নিয়ে সুকান্ত বেরিয়ে পড়ল। সুকান্তের পিছু নিল অমীমাংসিত প্রশ্নগুলো।
দাবায় এবার ঘোড়ার চাল
“আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা, যেটা আগে বলিনি” ভদ্রলোক বললেন, “প্রতিটা অক্ষর, প্রতিটা শব্দ লেখার সাথে সাথে লেখকের আয়ু কমতে থাকে। প্রতিটা অক্ষরের সাথে সাথে লেখক ক্ষয়ে যেতে থাকে। এই ক্ষয় যেন অর্থবহ হয় সেটা সব সময় লেখককে মাথায় রাখতে হবে। শব্দের অপচয়, আবেগের অপচয়, জীবনের অপচয়- এগুলো একজন লেখকের জন্য মহাপাপ।”
***
“দু’দুটো কেসের হিয়ারিং-এর ডেট চলে গিয়েছে, পুলিশ প্রশাসন এখন পর্যন্ত একজনকেও হাজির করতে পারেনি। আসামী গ্রেপ্তারের নাম করে পুলিশ আর কত কালক্ষেপন করবে? এই দেশের বিচার ব্যবস্থার দীর্ঘসূত্রিতাকে পুঁজি করে বিচারের নামে এই প্রসহন আর কতদিন চলবে? মার্টিন লুথার কিং বলেছেন, যেকোন জায়গার অন্যায় আসলে সারা পৃথিবীর ন্যায়ের জন্য হুমকি। আমরা সম্পাদক ও লেখক সমাজ পরিবার পরিজন নিয়ে সব সময় একটা আতংকের ভেতরে দিন যাপন করছি। কায়সার আবেদীন, ইমন মোস্তাফিজ, সৈকতের মত মেধাবী মানুষগুলো খুন হল অথচ আসামী নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর পুলিশ প্রশাসন নির্লজ্জের মত সেটা অস্বীকার করছে- এটা কি ধরণের তামাশা? অবিলম্বে যদি এই রক্তপিপাসু জানোয়ারকে গ্রেপ্তার না করা হয় তাহলে আমরা লেখক সম্পাদক সমিতি আরো বড় ধরণের আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।”
ভদ্রমহিলা হাতের মাইক্রোফোনটা পাশেরজনের হাতে দিল। আরে পাশের লোকটা তো…!
আরাফ ঘাড় উঁচু করে লোকটাকে আরেকবার দেখতে চাইল। হঠাৎ জানালার সামনের দুই জন হিজড়া হাজির হল, “এ্যই ছেক্সি, দেহ। দে দে দে।” জানালার কাঁচে আঙুলের আংটি দিয়ে ঠক ঠক করে কয়েকটা বাড়ি দিল। চট চট করে দুই হাতে তালি বাজিয়ে পেছনের জানালার দিকে গেল একজন।
হোন্ডা সিআরভি গাড়িটা এখন প্রেসক্লাবের সামনে। সকাল আটটা সাত। ভীষণ জ্যাম। আরাফ বসেছে সামনের সিটে, এলিন আর সাইদুর পেছনে। প্রেসক্লাবের সামনে সুকান্তের গ্রেপ্তার আর বিচারের দাবিতে ‘লেখক- প্রকাশক মৈত্রী সমিতি’র মানববন্ধন শুরু হয়েছে। আট দশজন হবে সর্বসাকুল্যে। অনেকে হয়ত এসে পৌঁছায়নি। আরাফ দেখল এক স্বাস্থ্যবতী হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে কথাগুলো বলল। কিন্তু ভদ্রমহিলার পাশেরজনকে দেখে অনেক চেনা চেনা মনে হল তার।
ধূর ঘোড়াড্ডিম- মনে মনে বলল আরাফ। হিজড়া দুজন নাছোড় বান্দা- “ওই নেংটির পোলা, দিবি, না কাপড় তুলতে অইব? অই!”
“সাইদুর খুচরা আছে?” আরাফ বলল।
সাইদুর কান থেকে হেডফোন খুলতে খুলতে বলল, “কী?”
“ওদেরকে খুচরা টাকা থাকলে দিয়ে দাও তো।” আরাফ বলল। একটা দশ টাকার নোট বের করে জানালা নামিয়ে হিজড়াদের দিকে বাড়িয়ে দিল।
হিজড়া দুটো সরে গেল।
আরাফ এবার মাথা উঁচু করে লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল। অপরেশ পাল। ক্রিমসন পাবলিশার্সের প্রকাশক। লোকটা কিছুক্ষণ মাইক্রোফোনটা ধরে থাকল, তারপর পাশেরজনের হাতে দিয়ে দিল।
“অপরেশ পালকে দেখতেছিস?” আরাফ বলল।
এলিন বলল, “হ্যাঁ। লোকটা কি বলে শোনার ইচ্ছা ছিল।” কিন্তু অপরেশ পাল কিছুই বলল না। ঢ্যাঙ্গা মানুষটা গম্ভীর মুখ করে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকল।
গাড়ি এগোতে লাগল আস্তে আস্তে। কয়েকজন ফকির আসল। চিরুনী আর ব্যাগ বিক্রেতা আসল। কয়েকজন পপকর্ণ বিক্রেতাও আসল। সাইদুর নড়ে চড়ে বসতে বসতে বলল, “এই মুহূর্তে আমাদের টাস্কগুলো কী কী?”
এলিন বলল, “সৌমেন ঘোষের খুনিকে বের করা, আমানুল্লাহ স্যারের খুনিকে বের করা আর স্যারের লাশটা খুঁজে বের করা, বিস্ফোরণ কে ঘটালো সেটা খুঁজে বের করা আর সুকান্তকে খুঁজে বের করা।”
“এর মধ্যে সৌমেন স্যারের খুনি কে সেটা আমি জানি,” সাইদুর বলল। “প্রমাণ হিসাবে ফোন কলের রেকর্ডটাও আছে।”
“কে?” আরাফ বলল।
“ইমন মোস্তাফিজের মেয়ে, নীরু মোস্তাফিজ।”
এলিন আর আরাফ দুজনেই একসাথে না না এইটা অসম্ভব সে কেন সৌমেন ঘোষকে গুলি করতে যাবে আন্দাজে উল্টাপাল্টা কথা বলতে লাগল।
সাইদুর বলল, “আসলে উদ্দেশ্য ছিল সুকান্তকে গুলি করা। সম্ভবত সুকান্তকে গুলি করতে গিয়েই গুলিটা মিস করে আর গিয়ে লাগে সুকান্তের পাশে দাঁড়ানো সৌমেনের বুকে। চল আমি ফোন রেকোর্ডিং দেখাচ্ছি।”
পঁ পঁ পঁঅঅঅ
তীব্র হর্ণ বাজিয়ে একটা কড়া ব্রেক কষল গাড়ির ড্রাইভার। ব্রেকের থেকেও কড়া কিছু গালি দিল সামনের মোটরসাইকেল আরোহীকে। মোটর সাইকেল আরোহীও উল্টো কিছু একটা বলল যেটা কিছু শোনা গেল না। তারপর আবার গাড়ি চলতে লাগল আগের গতিতে।
সাইদুর আবার আগের প্রসঙ্গে ফিরে গেল, “যাই হোক, বাকিগুলো আমার মনে হয় ড্রোনের ক্লিপ্স থেকে জানা যেতে পারে। আজ মিটিং শেষে আমরা ক্লিপ্সগুলো নিয়ে বসব।”
“ভালো কথা, জয়েনুদ্দীন কি পরে যোগাযোগ করেছিলেন?” আরাফ বলল।
সাইদুর নেতিবাচক মাথা নাড়ল। তিনি যোগাযোগ করেননি। মিটিং শুরু হওয়ার আর মোটামুটি দুই ঘণ্টা আছে। এর মধ্যে হয়ত তিনি যোগাযোগ করতেও পারেন। কিন্তু তিনি যদি না আসেন? তাহলে?
“যোগাযোগ করবেন। এখনও হাতে সময় আছে।” সাইদুর বলল। গাড়ি ততক্ষণে কার্জন হল পার হচ্ছে।
“এটা কি আমরা জয়েনুদ্দীনকে জানাব?” আরাফ বলল।
প্রশ্নটা শুনে মনে হল এলিন আর সাইদুর বেশ বিভ্রান্ত বলে মনে হল। কিছুক্ষণ ভেবে এলিন বলল, “যদি তিনি আমাদেরকে সাহায্য করতে চান, আমরা তাকে একটা সারপ্রাইজ দিতে পারি। মানে, আমরা ক্লিপ্স এনালাইসিস করে যা কিছু পাই সেগুলো আমরা তাকে একবারে জানাব।”
প্রস্তাবটা মনে হল সাইদুর আর আরাফের পছন্দ হয়েছে। এটা করলে আসলেই তারা প্রমাণ করতে পারবে যে তারা একেবারে জয়েনুদ্দীনের ওপরে নির্ভরশীল না। আমানুল্লাহর কাছ থেকে তারা নির্ভরশীলতার শিক্ষাটা নেয়নি।
****
পুলিশ হেডকোয়ার্টার।
নীচতলার ১০৭ নাম্বার রুম। সম্মেলন কক্ষ। ডাইনোসরের ডিমের মত বিশাল টেবিলটার চারপাশে পুলিশ আর ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের এজেন্টদের ভিড়। চেয়ার টানাটানি শব্দ। পিয়নরা সবার সামনে একটা করে আধা লিটারের পানির বোতল রাখতে ব্যস্ত। দরজায় কয়েকজন সাংবাদিক ভিড় করছে। ঢোকার চেষ্টা করছে। পারছে না।
এজেন্ট মল্লিকা করিডোরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নতমস্তকে ফেসবুক ঘাঁটছিল। হঠাৎ এলিনের ডাকে মাথা তুলল। এলিন, সাইদুর আর আরাফ দৌড়াতে দৌড়াতে আসছে। সাইদুর আর আরাফকে স্যুট আর টাইয়ে তো দারুন লাগছে। নিজের ওড়নাটা একটু ঠিক ঠাক করে নিয়ে এগিয়ে গেল।
“কি রে? এত দেরি করলি যে?” মল্লিকা বলল।
এলিন কি বলল বোঝা গেল না।
মল্লিকা বলল, “আরে শোন শোন, আরে দাঁড়া।”
“এখন কোন ফাইজলামি না মল্লিকা প্লিজ, এমনিতেই দেরি হয়ে গিয়েছে।” সাইদুর বলল।
মল্লিকা বলল, “আরে, ওই যে, কি যেন, আমানুল্লাহ স্যারের মেয়ে এসেছে, কথা বলবে।”
সাথে সাথে তিনজন দাঁড়িয়ে গেল। কি যেন নাম- মনে করার চেষ্টা করল সাইদুর। যাই হোক, কোথায় উনি? জানতে চাইল এলিন। মল্লিকা হাত দিয়ে দেখাল, ওইদিকে। চারজনে সেদিকে গিয়ে দেখল, করিডোরের একেবারে শেষ মাথায় তন্দ্রানীলা দাঁড়িয়ে আছে।
কি বলা উচিৎ, ভেবে পেল না চারজন। তন্দ্রানীলা হয়ত বুঝল ব্যাপারটা। তাই সে-ই প্রথম কথা বলল, “কি খবর আপনাদের?”
চারজনে শুকনো কাঠ কাঠ হাসি দিল। মাথা নেড়ে জানালো যে তাদের খবর মোটামুটি ভালোই। ভদ্রতাবশত আরাফ প্রশ্ন করল, “আপনার কি অবস্থা?”
তন্দ্রানীলা চট করে মাথা নামিয়ে ফেলল। মাথা ঝাঁকিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করল, সে ভালো আছে; অন্তত ভালো থাকার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন।
“আমরা খুব সরি। খুবই সরি। আসলে আমরা থাকা সত্ত্বেও স্যার ওভাবে, মানে, যা হয়েছে তার সম্পূর্ণ দায়ভার আমাদের।”
“না না, সেটা না। আমার বাবা তার দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই মারা গিয়েছেন। আমি কারো ওপরে দায়ভার চাপাতে আসিনি। আমি শুধু বলতে চাই যে, বাবার মত আর কেউ যেন আর না মারা যায়।”
“সুকান্তকে ধরতে আমরা আমাদের সাধ্যেরও অতীত করব। আপনি চিন্তা করবেন না। খুব তাড়াতাড়িই ওকে আমরা গ্রেপ্তার করে ফেলব, কথা দিচ্ছি। সাইদুর বলল।
“আপনি আমার কথা বুঝতে পারেননি হয়ত। আমি বলছি যে, আমার বাবার মত আর কেউ যেন না মারা যায়।
“মানে, মানে আপনি কেস বন্ধ করে দিতে বলছেন?”
চারজনে হাঁ করে তন্দ্রানীলার দিকে তাকিয়ে থাকল। তন্দ্রানীলা খুব ধীরে ধীড়ে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “এই কেসটা কখনও শেষ হবে না। সুকান্তকে আপনারা কখনও ধরতে পারবেন না। ওকে ধরা অসম্ভব।”
“কী বলছেন আপনি! আমানুল্লাহ স্যার, মানে আপনারা বাবা তো ওই জানোয়ারটাকে প্রায় ধরেই ফেলেছিল।” এলিন বলল।
তন্দ্রানীলা গোঁয়ারের মত মাথা নেড়ে বলল, “সরি, আমি হয়ত ইমোশনালি কথা বলে ফেলছি। যাই হোক, আসি।”
সাইদুর কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই তন্দ্রানীলা ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করতে করতে চলে গেল। রেখে গেল একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ- এই কেস কখনও শেষ হবে না।
চারজনে আইডি কার্ড দেখিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকল। চারজনে পাশাপাশি চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
মল্লিকা নিচু গলায় সাইদুরকে জিজ্ঞাসা করল, “জয়েনুদ্দীন কোথায়? কি অবস্থা উনার? কিছু বলছেন পজিটিভ নেগেটিভ?”
হাত ঘড়িটা দেখতে দেখতে সাইদুর মাথা নাড়ল। দশটা বারো। এখনও কোন খবর নেই উনার। আসবেন না নাকি?
পুলিশ কমিশনার ঢুকলেন আরো বিশ মিনিট পরে। সবাই অবাক হয়ে তাকাল এর ওর দিকে। আসার কথা ছিল তো ডিআইজি’র। পুলিশ কমিশনার কেন? সবাই উঠে দাঁড়ালো। গুঞ্জন থেমে গিয়ে নেমে এলো নীরবতা।
পুলিশ কমিশনারের পেছন পেছন আরও দুইজন ভদ্রলোক ঢুকলেন। প্রথমজনের উচ্চতা স্বাভাবিক বাঙালি উচ্চতার চেয়ে একটু বেশি। তামাটে বর্ণের ক্লিন শেভড মুখোমন্ডল। আর তার পেছন পেছন আসলেন স্বাস্থ্যবান একজন ভদ্রলোক। টেবিলের একেবারে শেষ মাথায় গিয়ে তিনজন বসলেন।
“প্লিজ সিট ডাউন।” পুলিশ কমিশনার চেয়ারে বললেন।
সবাই যে যার চেয়ারে বসল।
“গুড মর্নিং। আজ আসলে ডিআইজি স্যারের আসার কথা ছিল। ব্যস্ততার কারণে তিনি আসতে পারেননি। যাই হোক, যে কেসগুলো নিয়ে আজকের মিটিং সেগুলো আপনারা হয়ত জানেন। তারপরেও আমি আরেকবার বলছি। শাঁখারীবাজার ট্র্যাজেডি আর সম্প্রতি ঘটে যাওয়া লেখক সম্পাদকদের সিরিয়াল কিলিং কেসগুলোর সম্মিলিত কেস। প্রথমেই পরিচয় করিয়ে দেই, আমার বাম পাশে বসে আছেন তৌফিক এলাহী। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের সাবেক ডোমেস্টিক হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের প্রধান। সম্প্রতি কানাডা থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরেছেন তিনি। আর আমার ডান পাশে বসে আছেন মেজর জেনারেল মহিউদ্দীন হক ফিরোজ। MRAU এর নির্বাহী প্রধান এবং DGFI এর কাউন্টার টেরোরিজমের চীফ এডভাইজার।” বলে থামলেন কমিশনার।
উপস্থিত সবার ভেতরে একটা গুঞ্জন তৈরি হল। ইনিই সেই বিখ্যাত ফিরোজ হক! সাইদুররা নিজেদের ভেতরে নিচে স্বরে কথা বলতে লাগল!
কমিশনার কথা বলতে শুরু করলেন। হঠাৎ গেটের একজন গার্ড এসে এদিক ওদিক তাকাতে লাগল। তারপর সাইদুরের কাছে এসে সাইদুরের কানের কাছে মুখ নিয়ে নিচু গলায় বলল, “গেটে এক বুড়ো ঝামেলা করছে। বলছে আপনি নাকি আসতে বলেছেন।”
সাইদুর তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। এলিন, আরাফ আর মল্লিকার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বাইরে গেল।
জয়েনুদ্দীন এসেছেন!
করিডোর ধরে সাইদুর এগিয়ে গেল গেটের দিকে। গেটের বাইরে জয়েনুদ্দীন দাঁড়িয়ে আছেন। গম্ভীর মুখে দাড়িতে হাত বুলাচ্ছেন। সাইদুরকে আসতে দেখেই হই হই করে এগিয়ে আসলেন, “এই সাইদুর, দেখো না আমাকে ঢুকতে দিচ্ছে না। বার বার বলছি…” সাইদুর হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে হাসি মুখে ভেতরে আসার জন্য ইশারা করলেন।
“আপনার আশা তো আমরা ছেড়েই দিয়েছিলাম প্রায়।” একশ ওয়াটের একটা হাসি দিয়ে সাইদুর বলল। জয়েনুদ্দীন ঘন মোচের নিচে মুচকি হাসলেন। দুজন পাশাপাশি জোর পায়ে হেঁটে গেলেন সম্মেলন কক্ষের দিকে। সাংবাদিকদের ভিড়টার ভেতর দিয়ে দুজন রুমের ভেতরে ঢুকলেন। এবার আর কেউ আইডি দেখতে চাইলো না। জয়েনুদ্দীনকে দেখে এলিন, আরাফ আর মল্লিকা শিশুতোষ হাসি দিল। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে জয়েনুদ্দীনকে পাশেই বসালো সাইদুর।
কমিশনার কথায় আবার মনোনিবেশ করা যাক।
“ডিআইজি মহোদয় এবং আইজিপি মহোদয়ের সাথে কথা বলে আমি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে, শাঁখারীবাজার ট্র্যাজেডির কেসটা হ্যান্ডেল করবেন ফিরোজ হক সাহেব। উনার ওপরে আমরা চোখ বন্ধ করে আস্থা করতে পারি।”
সাইদুররা প্রমাদ গুনল। কেসটা সামরিক ডিপার্টমেন্টে চলে গেলে একেবারে তাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে। সিনিয়র ডিটেক্টিভ এজেন্টরাই DGFI এর কোন কেসে নাক গলানোর অনুমতি পায় না, সেখানে তাদের মত জুনিয়ররা চুনোপুটি। দাম-ই দেবে না। নিঃশ্বাস বন্ধ করে পরবর্তী সিদ্ধান্তটা শোনার অপেক্ষায় থাকল তারা চারজন।
“আর সিরিয়াল কিলিং-এর সম্মিলিত কেসটা হ্যান্ডেল করবেন তৌফিক এলাহী।”
বাজ পড়ল সাইদুরদের মাথায়! এলিন আর মল্লিকা বিস্ফোরিত চোখে আরাফ আর সাইদুরের দিকে তাকালো। কি হল এটা! তৌফিক এলাহী ঘুষখোর লোক। তাছাড়া এর আগে নিরপরাধ লোকজনকে টর্চার করে ভুয়া কেসে ফাঁসিয়ে দেওয়ার রেকর্ড আছে। তার অধীনে যতগুলো লোক কাজ করেছে তাদের অনেকেই পদত্যাগপত্র দিয়ে চাকরি ছেড়ে দিয়েছে; মানসিক চাপে আর অত্যাচারে।
সাইদুরকে খোঁচা মেরে এলিন বলল,”তুই কিছু একটা বল।” ভেতরের অস্থিরতাটা চাপা দিয়ে সাইদুর মাথা নাড়ল। জয়েনুদ্দীন প্রতিক্রিয়াহীনভাবে কমিশনারের দিকে তাকিয়ে আছেন।
“এই দুটো কেস দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। দুটো কেসই এখন সরকারের জন্য খুবই ক্রুশিয়াল ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই, উপস্থিত সকল পুলিশ এবং ডিটেক্টিভ এজেন্টকে তাদের সর্বোচ্চটা দেওয়ার জন্য বলা হচ্ছে। কারো কোন কিছু বলার আছে?” কমিশনার বললেন।
সাইদুর উঠে দাঁড়ালো। সবার দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা শ্বাস নিল। বলল, “স্যার, আমি ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের ডোমেস্টিক হোমিসাইড ডিপার্টেমেন্টের নবিশ সাইদুর রহমান। আমানুল্লাহ স্যারের অধীনে আমি কাজ করছিলাম। আমার একটা প্রস্তাবনা আছে।”
“হুম। বলেন?”
“স্যার, লেখক সম্পাদক সিরিয়াল কিলিং-এর কেসটা আমানুল্লাহ স্যার হ্যান্ডেল করছিলেন। আমরা চারজন তার সাথে ছিলাম। আর এই কেসটাতে বিশেষভাবে সহযোগীতা করেছেন জয়েনুদ্দীন নামের একজন ভদ্রলোক। মূলত তার হাত ধরেই আমরা কেসগুলো সলভ করতে পেরেছি এবং সুকান্তই যে এই কেসের মুল আসামী- সেটাও বের করতে পেরেছি। এই কেসে তার অবদান অনেক। তাই আমার আমি বিনীতভাবে অনুরোধ করছি, যদি এই কেসের ভারটা জয়েনুদ্দীনের হাতে দেন, তাহলে হয়ত কেসটা আরো ভালোভাবে আর আরো দ্রুত সলভ করা সম্ভব হবে।”
পুরো রুমটায় নীরবতা নেমে এলো।
সামনে রাখা পানির বোতলটায় কয়েক চুমুক দিয়ে কমিশনার বললেন, “জয়েনুদ্দীনের অফিশিয়াল কোয়ালিফিকেশন কি?”
এর উত্তর সাইদুরের কাছে নেই। জয়েনুদ্দীনের দিকে তাকিয়ে প্রাণপনে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করল। হঠাৎ জয়েনুদ্দীন নিজেই উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “আমি একজন শখের ক্রিমিনোলজিস্ট। তাছাড়া হাত-টাত দেখি। আর, আমি এজেন্ট আমানুল্লাহ হত্যার প্রধান সাক্ষী।”
কমিশনার আর তৌফিক এলাহীর ভ্রু কুঁচকে গেল। শুধু ফিরোজ হক বললেন, “আপনি এজেন্ট আমানুল্লাহর মার্ডার স্পটে ছিলেন? আপনি দেখেছেন আমানুল্লহকে খুন হতে?”
জয়েনুদ্দীন মাথা নাড়ল; সে দেখেছে।
ফিরোজ হক আমানুল্লাহ মার্ডার কেসের ফাইলটা চাইলেন। লালবাগ থানার ওসি চেয়ার থেকে উঠে গিয়ে ফাইলটা দিয়ে আসলেন ফিরোজ হকের হাতে। ফিরোজ হক উল্টে পাল্টে ফাইলটা দেখলেন। তারপর কমিশনারকে নিচু গলায় কিছু একটা বললেন।
সাইদুর কিছু একটা বলতে ইশারা করল, জয়েনুদ্দীন বুঝতে পারলেন না। সাইদুর তখন বাধ্য হয়ে নিজেই উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “সৈকত হত্যা, সুভাষ হত্যার মত এই কেসের সাথে সংশ্লিষ্ট সবগুলো কেসেই উনি আমাদের সাথে ছিলেন। উনার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী উনি আমাদেরকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেছেন এতদিন যেটা আমি আগেও বললাম। যদি কেসটা উনার অধীনে আমরা হ্যান্ডেল করি, আমার বিশ্বাস কেসটা অনেক দ্রুত সলভ হবে।”
“আপনার বিশ্বাস অবিশ্বাসে সিস্টেম চলে না। কি নাম বললেন যেন?” তৌফিক এলাহী বলে বসলেন। রুমে নেমে এল একটা গাঢ় নিস্তব্ধতা। কমিশনার সাহেবের অনুমতি ছাড়া কেউ প্রশ্ন করতে পারে, কিন্তু কেউ কথা বলবে- এমনটা কেউ আশা করেনি।
সাইদুর নিজের নাম বলল।
“সরি স্যার যে আমি অনুমতি না নিয়ে কথা বলেছি, বলতে বাধ্য হলাম।”
ফিরোজ হক মন দিয়ে ফাইলের পাতা উল্টে যাচ্ছেন।
কমিশনারের অনুমতি না নিয়েই তৌফিক আবার বলতে শুরু করলেন, “একজন সাসপেক্টকে কেসের সুপারভাইজার বানাতে বলছেন কোন আন্দাজে আমাকে বলবেন? সে একজন কেসের সাসপেক্ট, একজন সাক্ষী, আর তার হাতেই আপনি কেস সলভ করার দায়িত্ব দিতে বলছেন!”
“স্যার, আমি বলতে চেয়েছি যে, কেস আমরাই সল্ভ করব। উনি শুধু আমাদেরকে গাইড করবেন। এই মুহূর্তে, যেহেতু আমরা জুনিয়র, আমানুল্লাহ স্যারের আন্ডারে কাজ শিখছিলাম, তাই এই মুহূর্তে উনি আমাদেরকে একটু সাহায্য করবেন।”
“এটা আইন বহির্ভূত। সাক্ষীকে কখনও কেসের ভার দেওয়া হয় না, হয়নি। এটা কমন সেন্স।”
“কোনটা আইন তাহলে স্যার? যেটা দিয়ে জনগণের অধিকার আদায়ের বদলে জনগণকে শাসন করে চিপে রক্ত বের করে নেওয়া যায় সেইটা আইন?”
রুমে যেন একটা বজ্রপাত হলো। তৌফিক এলাহী এখন সবগুলো ব্রাঞ্চের অঘোষিত চীফ। তার সামনে এমন বেমাক্কা কথা শুধু চাকরি খোয়ানোর শামিল না, জরিমানা হতে পারে, এমননি জেলও! এলিন, মল্লিকা দু’পাশ থেকে সাইদুরকে টেনে বসাতে চাইল।
আরাফ ফিস ফিস করে বলল, “দোস্ত সরি বলে বসে পড়, দোস্ত প্লিজ দোস্ত দোহাই লাগে।”
সাইদুর বসল না। গট গট করে রুম থেকে বের হয়ে গেল।
ফিরোজ হক তখনও মন দিয়ে ফাইলের পাতা উল্টাচ্ছেন।
কমিশনার গলা খাঁকারি দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেন। কিছুক্ষণ পরে সিদ্ধান্ত হল, তৌফিক এলাহীই হচ্ছেন ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রধান। আগামী মাসের বার্ষিক সম্মেলনে পাকাপাকিভাবে কাউকে দায়িত্ব দেওয়া হবে। ততদিন পর্যন্ত তৌফিকই ভরসা। আকর্ণ বিস্তৃত হাসি নিয়ে তৌফিক জয়েনুদ্দীনের দিকে তাকালেন। এলিন, মল্লিকা আর আরাফ পরিষ্কার বুঝতে পারল, তাদের কপালে বিরাট শনি আসছে। এই শনির বলয় থেকে বের হওয়ার কোন উপায় নেই।
সম্মেলনের বাকিটা সময় দ্রুত বিচার ট্রাইবুন্যালের উকিলেরা তদন্তের ফাঁক ফোঁকর নিয়ে কথা করল। এজেন্ট প্রণবের অন্তর্ধান নিয়ে কোন কথাই উঠল না। আমানুল্লাহ বা সৌমেনকে নিয়েও খুব সিরিয়াস কিছুই কেউ বলল না। যেন সবাই এই মানুষগুলোর মৃত্যু মেনে নিয়েছে। তৌফিক এলাহী আশ্বাস দিলেন, সাত দিনের ভেতরে আসামী গ্রেপ্তার হয়ে যাবে। আরে এইসব ফিচকে সিরিয়াল কিলার। নেটফ্লিক্সের সাইকো-থ্রিলার দেখে দেখে কপি করার চেষ্টা করছে। এইগুলা ধরা কোন ব্যাপারই না। ফিরোজ হক ছোট করে বললেন, তিনি যথাসাধ্য করবেন।
সম্মেলন শেষ হল বিকালের দিকে।
সম্মেলন শেষে ড্রোনের ফুটেজ নিয়ে আর বসা হল না। এলিন চুপ। মল্লিকা বিরস মুখে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিল। আরাফের ভ্রু কুঁচকে থাকল। কেউই যেন বলার মত কিছুই খুঁজে পেল না।
জয়েনুদ্দীন শুধু বললেন, “যাই, পরে কথা হবে।” বলে চলে গেলেন।
পরদিন সকালে জানা গেল, সাইদুরকে এক মাসের জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছে। আর আগামী সাত দিনের ভেতরে এমন ‘শিষ্টাচার বহির্ভূত’ আচরণ করার কারণ দর্শিয়ে চিঠি দিতে বলা হয়েছে।
আঁধারের যাত্রী
ভদ্রলোক পৃষ্ঠা উল্টালেন। গলা খাঁকারি দিয়ে গলাটা পরিষ্কার করে নিলেন। বললেন, “একজন লেখকের লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হবে শুধুমাত্র নিজের কথাগুলো বলা। যদি কেউ খ্যাতির লোভে লেখে, তাহলে একটা বাজারি বেশ্যা আর তার ভেতরে কোন পার্থক্য থাকবে না। আর যদি কেউ রেভুল্যুশান ঘটানোর জন্য লেখে, তাহলে তার আর একজন সস্তা মাথামোটা রাজনীতিবিদদের ভেতরে কোন পার্থক্য থাকবে না। লেখক নিজের কথা জানাবে, তারপর সেই কথার ফলাফল পাঠকের ওপরে ছেড়ে দিতে হবে।”
****
এরকম আগেও হয়েছে। হিরণ মদ খেয়ে বাড়ি ফিরেছে। বারান্দার দরজা খুলে রেখেই বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছে। মাঝে মাঝে বমিও করেছে। সকালে উঠেই সব ভুলে গিয়েছে; ঠিক ফাঁদ থেকে ছাড়া পাওয়া বলগা হরিণের মত।
আজকেও এই খোলা বারান্দার দরজা, বিছানায় বমির ছিটে ফোঁটা- এগুলো নতুন কিছু না হিরণের কাছে। তবে ফ্রিজ থেকে পাউরুটি আর কোক খেয়ে ফেলাটা নতুন। হয়ত খেয়েছে নেশার মাথায়, তাতে কি হয়েছে?
এই বদ অভ্যাসটা হিরণের ছিল না আগে। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে লেখার ঝোঁক উঠল। কেন আর কিভাবে উঠল মনে করতে পারে না সে। ওই ফেসবুকে একটু কি না কি লিখল, সামহোয়ার ইন ব্লগে একটু লেখালেখি করল, লোকে হাত তালি দিল- ওই পর্যন্তই। কিন্তু আস্তে আস্তে সে আবিষ্কার করল, প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া থেকে সে অনেক দূরে চলে এসেছে। যেটা তার প্ল্যাটফর্ম, সেটাকেই সে ভুলে যাচ্ছে, প্ল্যাটফর্মটা থেকে আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে। একটা অদ্ভুত আর তীক্ষ্ম অস্তিত্বহীনতায় ভুগতে শুরু করল সে। ক্লাসে সে কারো সাথে মিশতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে রঙিন জীবনে কোন মেয়ে তার কাছে আসছে না। হিরণও যেতে পারছে না কোন মেয়ের কাছে। অস্তিত্বহীনতা থেকে তীব্র আত্মভিমান, আর সেখান থেকেই পরিবার থেকে দূরে সরে যাওয়া শুরু। লুইস ডি সাল্ভার (Louis De Salva) সেই অমোঘ বাণীটাও তাকে নিশির ডাকের মত ডাকতে থাকল- যদি তুমি লিখতে চাও, তোমাকে কিছু না কিছু ত্যাগ করতে হবে। এবং প্রায়শই সেই ত্যাগগুলো হয় অনেক বড় কোন ত্যাগ।
লেখালেখির শুরুটা ওই অস্তিত্বহীনতা থেকে বাঁচার একটা আদিম ইচ্ছা থেকেই। ফেসবুকে যে খুচরো লেখালেখিগুলো সে করত, সেগুলোতে পড়তে শুরু করল ‘সিরিয়াসনেস’ এর ছাপ। লোকে বাহবা দিল। এক একটা লাইক হিরণকে যেন মনে করিয়ে দিত, সে বেঁচে আছে। কোথাও না কোথাও তো তার একটা গ্রহণযোগ্যতা আছে। সেটা বাস্তব জীবন না হয়ে ভার্চুয়াল জীবনেই হল, খারাপ কি? এভাবেই পরিবার আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে দূরে সরতে সরতে লেখালেখির জগতে ঢুকে পড়ল হিরণ পাশা। দুটো বই বের করে ফেলল। কিন্তু ফেসবুকের লেখালেখি আর বাস্তব জীবনের লেখালেখিতে পার্থক্য আছে। সেটা হিরণ জানত না। কখনও জানার চেষ্টাও করেনি। সামান্য একটা বিষয়েই সে স্ট্যাটাস দেয়। নিজের বিদ্যা জাহির করতে চায়, আর সবটার পেছনে একটাই কারণ, নিজের অস্তিত্বহীনতার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি। পরিবারও হিরণের লেখালেখি খুব একটা ভালো চোখে দেখত না। আরে এটা একটা অনিশ্চিত যাত্রা। এই রাস্তায় এক প্লেট ভাতের নিশ্চয়তা নেই। অস্কার ওয়াইল্ড আর এডগার এলান পো এর মত লেখকরা ছেঁড়া পকেটে মারা গিয়েছেন। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দারিদ্র্যে দারিদ্রে জর্জরিত হয়ে বলেই গিয়েছেন যে একমুঠো অন্নের ব্যবস্থা না করে কেউ যেন লেখক হতে না আসে। হারমান মেলভিল, আমেরিকার সাহিত্যে সর্বকালের সেরা সাহিত্যিক মানা হয় যাকে, মবি ডিক লিখে তিনি বিপুল অর্থের মালিক হয়েছিলেন। কিন্তু পাহাড় সমান ঋণের বোঝা নিয়ে তাকে চলে যেতে হয় না ফেরার দেশে। লেখকের যাত্রাটাই এরকম। পতিতাবৃত্তির মত। যতদিন গতর আছে, ততদিন তোমাকে পাঠক গ্রহন করবে। গতর থাকবে না, তোমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেবে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে। কিন্তু শেষমেশ ওই গতরটাই মনে রাখবে তারা, তোমাকে মনে রাখবে না।
এত কিছুর পরে বই দুটোও সেভাবে চলল না। আবার সেই অতল হতাশার গহ্বরে। নিজেকে খুঁজতে গিয়ে বারবার হিরণ হারিয়ে ফেলছে। সস্তা বিষয় ঘাঁটতে গিয়ে নিজের কাজগুলোই সস্তা হয়ে যাচ্ছে চোখের সামনে কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না। কোন রকমে একটা সিজিপিএ আর বেশ কয়েকটা ব্যাকলগ নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করলেও পরিবারের কাছে আর ফিরে গেল না সে। পল থেরোর (paul theroux) সেই বাণী থাকে পরিবারের কাছে ফিরতে দিল না- ‘যেকোন যুবক যে লেখক হতে চায় তার প্রতি আমার একটাই উপদেশঃ গৃহ ত্যাগ কর।’
গৃহত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসল হিরণ। একটা বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোন রকমে এমবিএটা করবে। কারণ সেখানে চাপ কম। কিন্তু লেখালেখি পুরোদমে চলতে লাগল। কিন্তু শেষমেষ সে যেই উদ্দেশ্যে লেখালেখি করছিল, সেটা পূরণ হল না। সে বরাবরই অস্তিত্বহীনতাই ভুগতে লাগল। এই অবসাদ আর এই অসীম হতাশার কথা তার প্রকাশক কিংবা সমসাময়িক লেখক লেখিকারাও জানত। কিন্তু আগ বাড়িয়ে কেউ এই মানুষটাকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসত না।
অবশেষে একদিন, মানে এক সন্ধ্যায় হিরণ একটা হ্যান্ডবিল পেলো। হ্যান্ডবিলের সাথে স্ট্যাপলার করা একটা ভিজিটিং কার্ড। সেখানে লেখা, ‘শব্দযাত্রা লেখক সংঘ’।
রিকশার ঝাকুনিতে ধ্যান ভাঙল হিরণের।
রিকশা রিং রোড পার হচ্ছে হচ্ছে। হাত ঘড়িতে সময়টা দেখে নিল। রাত দশটা। এখনও আধ ঘণ্টা আছে, ব্যাপার না। তাড়াহুড়ার কিছু নেই। রিক্সাওয়ালাকে ডানে রাখতে বলে হিপপকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করল। দুটো সিগারেট কিনতে হবে।
দুটো বেনসন সুইচ কিনে আবার রিক্সায় উঠল হিরণ। আজ আর তীর্থে যাওয়া যাবে না। কদিন যাক, তারপর আবার ঢুঁ মারা যাবে।
রিক্সাওয়ালা ঘাড় ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসা করল, “মামা কুন রুডে যাইবেন?”
ফস করে ম্যাচ জ্বালিয়ে সিগারেট ধরাতে ধরাতে বলল, “তেরো নাম্বার রোড।”
রিংরোডের কেএফসির পাশের গলি দিয়ে রিক্সা ঢুকে পড়ল। আলো আর চাকচিক্য কমে গেল। মানুষজন ঘরে ফিরছে। আর ঠিক এই সময়টাতেই নিশাচর পরভোজী শিকারীদের বের হওয়ার সময়।
আদাবরের মেইন রোড ঘুরে তেরো নাম্বার রোডে ঢুকে পড়ল রিক্সা।
একটা গাছপালা ঘেরা বাড়ির সামনে রিক্সা থামাতে বলল হিরণ। ষাট টাকা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে লোহার গেটটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।
ঠিক তার একটু দূরে রিক্সা থামালো সুকান্ত। ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল গাছ পালা ঘেরা অন্ধকারে ডুবে থাকা বাড়িটার দিকে। লোহার গেটটার এক পাশে একটা পকেট গেট আছে। ওটা দিয়েই ঢুকল নাকি হিরণ? সুকান্তও ঢোকার সিদ্ধান্ত নিল। কিন্তু হঠাৎ খেয়াল করল, গেটের ওপারে গার্ড আছে। কি কি দেখালে ঢুকতে দেয় দেখা উচিৎ ছিল।
গেটের ওপরে মাঝারী সাইজের পুরনো একটা সাইনবোর্ড- সূর্যমুখের হাসি পরিবার পরিকল্পনা সেন্টার’।
জোর জবরদস্তি করে ঢুকতে যাওয়া ঠিক হবে না। অন্য রাস্তা বের করতে হবে।
প্রাচীরের ধার ঘেঁষে হাঁটতে লাগল সুকান্ত। একবার রাস্তার উল্টোদিকে তাকাল। কয়েকটা ওয়েল্ডিং-এর দোকান আছে মনে হচ্ছে। কিন্তু সেগুলো বন্ধ। প্রাচীরের দিকে তাকালো সুকান্ত। খুব বড় প্রাচীর না। কিন্তু প্রাচীরের ওপরে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া আছে। লাফ দিয়ে উঠলেও খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না।
নানান চিন্তা সুকান্তের মাথার ভেতরে গিজ গিজ করতে লাগল। আচ্ছা কোনভাবে সে না হয় ভেতরে গেল, তারপর বের যদি হয়ে আসতে না পারে? ভেতরে কি হচ্ছে না হচ্ছে কে জানে? সাধারণ কোন কিছু হচ্ছে না এবিষয়ে নিশ্চিত। তা হলে গার্ড থাকত না। নাহ।
যা হয় হোক। আগে ভেতরে তো যাওয়া যাক।
একটু দূরে একটা ট্রাক দেখতে পেল সুকান্ত। রাস্তার পাশেই পার্ক করা আছে। আর তার মাথার ওপরেই রাস্তার ওপরে ঝুলে থাকা ডালপালা। ব্যস। ট্রাকটার কাছে গিয়ে সিটের ওপরে হেলান দিয়ে মোবাইল টিপতে থাকা ড্রাইভারকে একটা একশ টাকার নোট ধরিয়ে দিয়ে বলল, “একটু সামনে নামিয়ে দেবেন ভাই?” ড্রাইভার তো রাজিই হবে না প্রথমে। তাকে রাজি করাতে সুকান্তের আরো কিছুটা সময় গেল। তারপর ট্রাকের রডের ওপরে উঠে বসল। বেশ উঁচু আছে। লাফিয়ে না পড়া গেলেও ওপরের গাছের ডালগুলো ধরা যাবে। কেউ সন্দেহ করবে না।
ঘড় ঘড় করে বুড়ো ট্রাকটা চলতে শুরু করল আস্তে আস্তে। আরেকটু, আরেকটু, ব্যস, লাফিয়ে একটা গাছের ডাল ধরে ফেলল সুকান্ত। ঝুলে পড়ল। হাচড়ে পাচড়ে কোন মতে ডালটা খামচে ধরে দোল খেতে লাগল। দুলুনিটা থামার অপেক্ষা করল কিছুক্ষণ। এই মুহূর্তে গার্ড চলে আসতে পারে। ঝুঁকি নিয়ে লাভ নেই। ডালটা বাঁকা হতে শুরু করল। যেকোন সময় ভেঙে যাবে। আর সেটা শাপে বর হল সুকান্তের জন্য। ডালটা বাঁকা হতে হতে প্রাচীরের ভেতরের দিকে নিয়ে ফেলল সুকান্তকে।
ছেড়ে দিল ডালটা, সুকান্ত ধপ করে পড়ল শক্ত মাটির ওপরে। ক্ষতস্থানগুলোতে আগুন ধরে গেল যেন। হাঁটুতে যেন কেউ সুঁচ ফুটিয়ে দিল বলে মনে হল। কয়েক ইঞ্চি গড়িয়ে গিয়ে একটা ঝোপের পাশে গিয়ে থামল সুকান্তের শরীরটা। অত উঁচু থেকে লাফ দেওয়াতে মস্তিষ্কেও ধাক্কা লাগল। আশেপাশে কি হচ্ছে না হচ্ছে মুহূর্তের জন্য বুঝতে পারল না সুকান্ত।
সম্বিৎ ফিরে পেতেই প্রথমে যে চিন্তাটা মাথায় আসল সেটা হল, কেউ শুনে ফেলল না তো? অন্ধকার। গাছপালায় চারপাশ ঢেকে আছে। মাটি আর থেঁতলে যাওয়া গুল্মের গন্ধ। কিছুক্ষণ পড়ে থাকল সুকান্ত। বোঝার চেষ্টা করল, আওয়াজ শুনে কেউ এগিয়ে আসছে কিনা।
কেউ এগিয়ে আসছে না। এই গভীর অন্ধকারে শুধু সুকান্ত।
আস্তে আস্তে মাথা তারপর শরীরটা টেনে তুলল সুকান্ত। প্রাচীরের ওপাশ থেকে ল্যাম্পপোস্টের ভেজা আলো চোখে পড়ল। এই আলোর ওপরে ভরসা করে এগিয়ে যাওয়া যাবে না। কোন রকমে হাতড়ে সামনে এগিয়ে যাওয়া শুরু করল সুকান্ত। কয়েকটা গাছ, গাছের শীতল শরীর ঠেকতে লাগল আঙুলে। পায়ের নিচে ছোট খাটো ঝোপ। একটু যাওয়া, একটু থেমে শোনার চেষ্টা করা আশেপাশে কেউ আছে কিনা। একটা ঘোর অনিশ্চয়তার দিকে যাত্রা।
কিছুদূর এগোনোর পরে একটা ক্ষীণ আলোর রেখা চোখে পড়ল।
দূর থেকে দেখে সুকান্ত বুঝল, কয়েকটা জানালা, আর একটা দরজা। সেগুলোতে আলো জ্বলছে।
এখানে হিরণ কি করে? কোন বন্ধু বাড়ি? নাকি? তাহলে গেটে পরিবার পরিকল্পনা ক্লিনিক লেখা আছে কেন? যাওয়া না যাওয়ার সিদ্ধান্তহীনতায় কেটে গেল কিছুটা সময়। একটা গাছের গুড়িতে ভর দিয়ে দম নিতে লাগল।
হারানোর যা আছে সেটা হল নিজের জীবন। এটা হারিয়ে গেলে তাকে আর ভুগতে হবে না। এই না চাইতেই পাওয়া জীবনের শেষটুকু দেখার জন্য অপেক্ষা সুকান্তের অনেকদিনের। তাই অন্য সব বিপদ আর সুসময়ের মত নির্লিপ্ততার সাথে সে এগিয়ে গেল বাড়িটার দিকে।