তবু একজন যে হাল ধরে
সৌমেনের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হল তেইশে আষাঢ়। প্রবল বৃষ্টির জন্য ঠিক সময়ে অন্তেষ্টিক্রিয়া শুরু করা গেল না। বৃষ্টি কমার অপেক্ষাতে সোয়া এক ঘণ্টা দেরি হয়ে গেল। চিতার কাঠ ভেজা। পুরোহিত ঘিয়ের সাথে সামান্য পেট্রল ঢেলে মন্ত্রপাঠ শুরু করলেন। মৃতদেহকে চিতার ওপরে শোয়ানো হল। জ্বালিয়ে দেওয়া হল চিতা।
চড় চড় করে চিতা জ্বলতে লাগল।
অন্তেষ্টিক্রিয়াতে এসে সৌমেন ঘোষের স্ত্রী মিসেস সুলতা ঘোষ আরেকজন ভদ্রমহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলেন। কে উনি? পরে জানতে পারেন, উনি আসলে সৌমেনের দ্বিতীয় স্ত্রী, বিশিষ্ট সংবাদ পাঠিকা, মিসেস নবনীতা ঘোষ। সুলতা মূর্ছা গেলেন।
উপস্থিত কারো ভেতরে তেমন একটা শোক দেখা গেল না। উঁচু পদের চেয়ারগুলোতে বসা মানুষগুলো মারা গেলে তার জন্য মানুষ শোক পালন করে না। শোক পালনের অভিনয় করে এই আশায়, চেয়ারটা যদি পাওয়া যায়। তাছাড়া বাঙালির এরোগেন্স দেখানোর ওই একটাই রাস্তা, শোক প্ৰকাশ।
সব কিছু ছাপিয়ে কিন্তু একটা প্রশ্ন গুন গুন করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মুখে মুখে, আমানুল্লাহর লাশটা তাহলে কোথায়?
হ্যাঁ, শাঁখারীবাজার ট্র্যাজেডিতে উদ্ধার করা মৃতদেহগুলোর ভেতরে আমানুল্লাহর লাশ পাওয়া যায়নি।
****
কালিদাস সরণী। চামড়া পট্টি। সন্ধ্যা সাতটা।
নাড়ি উল্টানো গন্ধে ডুবে আছে পুরো এলাকা। বাতাস নেই। আকাশ মেঘলা কিন্তু বৃষ্টি হবে বলে মনে হচ্ছে না।
ফরেনসিক স্পেশালিস্ট এলিন, ফিল্ড এজেন্ট সাইদুর আর আরাফ বেশ কিছুক্ষণ একটা বাড়ি খুঁজছেন। সাতাশ নাম্বার বাড়ি। বাড়ির নাম ধাম নেই। কিন্তু বাড়ির সামনে একটা ফুচকাওয়ালা বসে। সেই ফুচকাওয়ালার দোকানের নাম ‘লাবনী ফাশ ফুট চটপটি হাউজ’।
এদিকটা গোলমেলে। পিঁপড়ের বাসার মত হাজারটা অলিগলি এদিক সেদিক দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে। আরাফ অনেকক্ষণ ধরে চা খাওয়ার অফার করছে কিন্তু এলিন আর সাইদুর বেশ সিরিয়াস। তাদের চা খাওয়ার ইচ্ছা নেই আপাতত। তাই আরাফের চা খাওয়া হচ্ছে না। আমানুল্লাহর মৃত্যুতে তিনজনেরই মন খারাপ। কী যেন একটা চেপে বসে আছে ঘাড়ের ওপরে। অভিভাবকহীনতার একটা অন্যরকম যন্ত্রণা। এতদিন শুধু ‘কী করতে হবে’ বললেই তারা কাজটা করতে পেরেছে। ‘কিভাবে করতে হবে’ সেটা আমানুল্লাহই ভেবেছেন। কিন্তু এখন, ‘কী করতে হবে’ আর ‘কীভাবে করতে হবে’ সবটাই তাদেরকেই ভাবতে হচ্ছে। এদিকে গতকালকেও একজন প্রকাশক খুন হয়েছেন। গলায় এলোপাতাড়ি কলম চালিয়ে ড্রিল মেশিন দিয়ে মাথা ফুটো করে দেওয়া হয়েছে। তারপর লাশটা ছয়তলার ছাদের ওপর থেকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। সিনিয়র কেউ এখনও ডোমেস্টিক হোমিসাইড ডিপার্টমেন্টের চীফ হয়ে আসেননি। আজ দুই ঘণ্টা মিটিং হয়েছে। শেষ হয়েছে বিভ্রান্তি দিয়ে; স্বাভাবিক। সৌমেন ঘোষ নেই। নেই আমানুল্লাহ। কিছুই ঠিকভাবে হচ্ছে না। পুরো ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চটাই এলোমেলো করে দিয়েছে ‘শাঁখারীবাজার ট্র্যাজেডি’।
“কি মনে হয়? রাজি হবেন?” এলিন আর সাইদুরকে জিজ্ঞাসা করল আরাফ।
“চেষ্টা করি। ডিপ্লোমেসিটা ঠিকঠাক মত করতে পারলে রাজি হবেই বা কেন? তাছাড়া উনিই তো একমাত্র উইটনেস আমানুল্লাহ স্যারের মৃত্যুর। উনিই একমাত্র দেখেছিলেন যে স্যারের গুলি লেগেছে।”
একটা ফ্লেক্সিলোডের দোকানে গিয়ে সাইদুর জিজ্ঞাসা করল, “ভাই, এদিকে সাতাশ নাম্বার বাড়িটা কোন দিকে?”
টেবিলের ওপাশে বসে থাকা একটা শুকনো মত লোক বলল, “হোজা চয়ে যান। ইদিক দিই ছোজা গিইয়ে বাম দিকে দেওবেন এট্টা গলি চয়ে গিইচে। ওকোনেই মন্দির আচেট্টা। ওটারই কয়েব্বাড়ি পরে সাতাছ নাম্বার।”
সাইদুর মাথা নেড়ে চলে যাচ্ছিল। আরাফ আবার প্রশ্ন করল, “কতদূর এখান থেকে? রিক্সা টিক্সা নিতে হবে নাকি?”
“আরে না না। পাঁচ মিনিটের রাস্তা।” লোকটা হাত নেড়ে বলল।
সোজা রাস্তাটা আরো বেশি ঘিঞ্জি। চামড়ার গন্ধটা কমে গিয়ে বাতাসে এখন কড়া ধূপ ধুনোর গন্ধ। মানুষের গা বাঁচিয়ে তিনজন এগিয়ে যেতে লাগল ‘বাম দিয়ে যাওয়া গলি’টার দিকে। লোকটা বলল পাঁচ মিনিটের রাস্তা, কিন্তু গলিটা পাওয়া গেল দশ মিনিট হাঁটার পরে।
মন্দিরে ভজন হচ্ছে, “বনো মালী তুমিইই, পরজনোমে হইও রাঁধা… কাঁদিও কাঁদিওও…”
অন্ধকার গলিটায় ঢুকে পড়ল তিনজন। গলির মাঝাখানে টিমটিম করে একটা ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। একটা কুকুর ঠায় বসে আছে ল্যাম্পপোস্টের নিচে। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে যেন একটা কুকুরের মূর্তি বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন নড়া চড়া নেই।
“মন্দিরের কয়েকবাড়ি পরে সাতাশ নাম্বার,” এলিন বলল। মানে মনে করিয়ে দিল আরকি।
হঠাৎ পাশের একটা বাড়ির কাঠের দরজা খুলে এক বৃদ্ধ গালাগালি করতে করতে একটা সাইকেল নিয়ে বের হয়ে আসছে দেখে সাইদুর প্রশ্ন করল, “এদিকে সাতাশ নাম্বার বাড়ি কোনটা?”
গুল খাওয়া ভাঙা গলায় জড়িয়ে টড়িয়ে লোকটা গালাগালি করছিল, “হোই মাগী। জমি বেইচিছি, তোজ্জমি বেইচিছি হৈ? আমাজ্জমি বেইচি আমি মদ খাই গাঁজা খাই আমাট্টাকা দি খাই। তোর ভাইয়ের মত ঘজ্জামাই থাকি নাকি হুঁ? কতা বুলতাসবি তো এদ্দোম লাখি দি মাজা ভেইঙ দেবো চুতমারানি কুনানকার!”
সাইদুর এগিয়ে গিয়ে সাতাশ নাম্বার বাড়িটা কোন দিকে জিজ্ঞাসা করতেই লোকটা খড়খড় করে বেজে উঠল, “আমাড় পুটকিড় মদ্দ্যে!”
তিনজনকে অন্ধকারে রেখে লোকটা সাইকেল চড়ে হারিয়ে গেল। তিনজন হা করে তাকিয়ে থাকল।
আরো কিছুক্ষণ খোঁজাখুঁজি চলল। অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে খোঁজা। প্ৰায় পনের মিনিট পরে গলির একেবারে শেষ মাথায় একটা ফুচকাওয়ালার ঠেলাগাড়ি চোখে পড়ল। হ্যাঁ। এটাই ‘লাবনী ফাশ ফুড’। খরিদ্দার নেই। সস্তা স্পিকারে খন খন গান বাজছে, “দিল ধাড়াক ধাড়াককে কেহরা হা হ্যায় তু ভি…”। ওটার পেছনেই দরজা। দরজা দিয়ে ঢুকতে যাওয়ার সময় ফুচকাওয়ালা জিজ্ঞাসা করল, “কাকে চাই?”
“জয়েনুদ্দীন আছেন?” এলিন বলল
“ও, সেই জ্যোতিষ ঠাকুর?” তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল লোকটা।
তিনজনে মাথা নাড়ল।
সাইদুর বলল, “আপনার পরিচয়?”
“আমি এই বাড়িরই মালিক। সন্ধ্যার পরে ফুচকাওয়ালা।”
“আছেন উনি। বের হতে তো দেখিনি। আছেন মনে হয়। যান। দেখেন।”
দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল তিনজন। উঠোনের এক কোণায় একটা এনার্জি সেভিং বাল্ব জ্বলছে। ঠিক মাঝখানে একটা তুলসি গাছ। ওটা পার হতেই একটা উঁচু রোয়াক। রোয়াকের পাশেই একটা ছোট্ট দরজা। বাড়ির ভেতরে কড়া ধূপের গন্ধ। সাইদুর গিয়ে কাঠের দরজাটায় নক করল।
দুবার নক করল।
তিনবারের বার ভেতর থেকে একজন বলল, “কেহ?” তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। তারপর আরাফ বলল, “আমরা। ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চ থেকে আসছি। আমানুল্লাহ স্যারের এপ্রেনটিস। জরুরি কথা ছিল। খোলেন।”
খড়াক করে দরজা খুলে গেল। একটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরিহিত জয়েনুদ্দীন উদয় হলেন। তারপর খুব নিচু গলায় বললেন, “আসো। ভেতরে আসো।”
তিনজন ভেতরে গেল। ঘরে একটা ষাট ওয়াটের টাংস্টেন বাল্ব জ্বলছে। ঘরের একটা কোণায় চৌকি, আরেকটা কোণায় শুধু বই। বইয়ের কলাম। কলামের ওপরে একটা ছোট আয়না। প্যারাস্যুট নারিকেল তেলের শিশি। দেয়ালে একটা বিশাল হাতের তালুর ছবি। সেখানে নানা রকমের হস্তরেখা নির্দেশ করা আছে দাগ কেটে। ছবির নিচে লেখা,
‘যে যত কাজ করবে, তার মুষ্টি তত বদ্ধ থাকবে, তার হস্তরেখা তত গাঢ় হবে, তার ভাগ্য তত সুপ্রসন্ন হবে- সিসেরো।’
বেশ মলিন কণ্ঠে তিনজনকে বসতে বললেন জয়েনুদ্দীন। চোখে চশমা না থাকায় চোখগুলো কেমন জড়ো হয়ে গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে। বসতে বললেন। কিন্তু বসার জায়গা কোথায়? তিনজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। সারা ঘরে বই আর পুরনো কাগজপত্র। জয়েনুদ্দীন হয়ত বিষয়টা বুঝতে পারলেন। কয়েকটা বিশাল সাইজের বই এনে শানের মেঝেতে ফেললেন। তারপর বললেন, “বসো। চা খাবে?”
“না। আমরা কিছু কথা বলেই চলে যাব।” সাইদুর বলল।
চিরুনী দিয়ে জয়েনুদ্দীন চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললেন, “বল কি কথা?”
সাইদুর এলিন আর আরাফের মুখের দিকে তাকালো। এলিন আর আরাফ ইশারায় বলল, বল বল তুই বল।
“আসলে, আমানুল্লাহ স্যারের একচুয়ালি কী হয়েছিল আমাদেরকে বলবেন একটু?”
“আমি অনেকবার বলেছি। কী কী হয়েছিল, আমি কী কী দেখেছি সব বলেছি। পুলিশকে বলেছি। ডিবির ইনভেস্টিগেটররা এসেছিল তাদেরকে বলেছি।”
“যদি আরেকবার বলতেন।”
জয়েনুদ্দীন চিরুনীটা রেখে লুঙ্গীর কোঁচা শক্ত করে বাঁধতে বাঁধতে চৌকির ওপরে বসলেন। তারপর বললেন,
“আমি কাভার্ড ভ্যানের ড্রাইভিং সিটে বসেছিলাম। হঠাৎ হৈ চৈ শুরু হল। কেন হৈ চৈ হচ্ছে বুঝতে পারলাম না। আমানুল্লাহ সাহেবকে বেশ কয়েকবার ফোন দিলাম। ফোন ধরলেন না। কথা ছিল আমানুল্লাহ সাহেব ফোন করলেই আমি ভ্যানটা নিয়ে যতীন এন্ড কোং-এর সামনে গিয়ে দাঁড়াবো। কোন রেসপন্স নেই। তাই আমিও কিছু করতে পারছিলাম না। এগোব? নাকি চুপ করে বসে থাকব? কি করব? ভাবছি। চারপাশের হট্টগোল দেখে আমিও অস্থির হয়ে গিয়েছি। একটু পরেই শুনলাম বিকট একটা বিস্ফোরণের শব্দ। ধূলায় চারপাশ ঢেকে গিয়েছে। কিছুই দেখতে পারছি না। শুধু মানুষ আর মানুষ। মানুষের চিৎকার। হঠাৎ ভিড়ের ভেতরে দেখতে পেলাম, আমানুল্লাহ সাহেব আসছেন। কাঁধে ভর দিয়ে আছে সুকান্ত। হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই ছেলেটা, আমানুল্লাহ সাহেব ছবি দেখিয়েছিলেন। দুজনেই রক্তে মাখামাখি। নামবো? নেমে গিয়ে সাহায্য করব? নাকি ভ্যানটাই এগিয়ে নিয়ে যাব? ভাবতে ভাবতেই আমানুল্লাহ সাহেব পড়ে গেলেন। কেন পড়ে গেলেন? কারণটা বুঝলাম যখন আমি গুলির শব্দ শুনলাম। ভিড়ের ভেতরে আমি প্রথম গুলির আওয়াজটা শুনিনি। শুনলেও খেয়াল করিনি। আমি নেমে পড়লাম। ভিড়ের ভেতর মানুষের কনুইয়ের ধাক্কা খেতে খেতে এগিয়ে গেলাম পাগলের মত। গিয়ে দেখি, মানুষটা পড়ে আছে। সুকান্ত নেই।”
“তারপর? স্যারের লাশটা?”
“লাশটাকে চোখের সামনে পদদলিত হতে দেখছিলাম। কিন্তু ভিড়ের বিপরীতে যে একটু এগিয়ে যাব। সেটা আর হচ্ছিল না। প্রাণপণে এগিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলাম আমি। ধূলার কারণে চোখও পুরোপুরি খুলতে পারছিলাম না। কিন্তু যখন কোনরকমে জায়গাটায় পৌঁছালাম, আমানুল্লাহকে আর পেলাম না। শুধু চাপ চাপ রক্ত পড়ে আছে। কিন্তু লোকটার লাশটা একেবারে গায়েব।”
এলিন মাথা নাড়ল, “হ্যাঁ, সেখানে আমানুল্লাহ স্যারের রক্ত পাওয়া গিয়েছে। কিন্তু স্যারের লাশটা গেল কোথায়?”
“সেটা তো আমারও প্রশ্ন।” জয়েনুদ্দীন বললেন।
সাইদুর বলল, “আপনার কী মনে হয়? সুকান্তই স্যারকে খুন করেছে? আপনি তো এ বিষয়ে জানবেন।”
“আমি কি চেষ্টা করিনি ভাবছ? কিন্তু আমানুল্লাহর রক্ত মানুষ পাড়িয়েছে। পুরো জায়গাটা একেবারে এলোমেলো। আমি অনেক চেষ্টা করেছি, আজকে সারদিন তো ওখানেই ছিলাম। কিন্তু খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। তবে হ্যাঁ, সুকান্ত খুন করতে পারে। যতক্ষণে আমি ওখানে যাব ততক্ষণে হয়ত আমানুল্লাহকে খুন করে পালিয়েছে। কিন্তু তাতে তো আমানুল্লাহর লাশের কোন সুরাহা হচ্ছে না।”
“সৌমেন স্যারকে কে গুলি করেছে সেটা জানি, মিস নীরু। কিন্তু রথ বিস্ফোরণ হল, সেটা কে করল? আপনার কি মনে হয়?” সাইদুর বলল। আরাফ চুপচাপ বসে আছে। বইটার ওপরে বসে থাকতে তার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। সে উঠে দাঁড়ালো। তারপর বইগুলো নেড়ে চেড়ে দেখতে লাগল।
“দেখ, পুলিশ প্রশাসনের ভেতরে অনেক রকমের কোন্দল আছে। তোমরা নতুন, জানো না সেভাবে। কার্যসিদ্ধির জন্য এখানে কেউ কেউ নিজের বউকে পর্যন্ত অন্যের হাতে তুলে দিয়েছে, এমন নজিরও আছে। আমি নিজে তার সাক্ষী। তাই কে কোন উদ্দেশ্যে বিস্ফোরণটা ঘটিয়েছে কে জানে? আমি বিস্ফোরণের জায়গাটায় যাইনি। আমাকে যেতে দেয়নি আর কি।” জয়েনুদ্দীন বললেন।
“যেতে যেন দেওয়া হয়, সেই সুযোগ নিয়েই এসেছি আমরা।” এলিন বলল, “আগামীকাল ডিআইজি মহোদয় আসবেন।”
“কে? ওই যে লোকটা একজন সংবাদ পাঠিকাকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছিল?”
কথা শুনে এলিন কিছুটা বিব্রত বোধ করল। বিব্রত বোধ করল সাইদুর আর আরাফও। এলিন কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, “কালকের মিটিং-এ ঠিক হবে এই সিরিয়াল কিলিং-এর কেসটা কার হাতে যাবে। তো আমরা আপনার নাম সুপারিশ করেছি। কারণ, এই কেসটার ব্যপারে আপনি যতটা জানেন ততটা আর কেউ জানে না। তাই বলছিলাম…”
“অসম্ভব! কি বলছ! আমি ডিটেক্টিভ ব্রাঞ্চের হয়ে কাজ করব!” জয়েনুদ্দীন নড়ে চড়ে বসলেন, “না না। ধর্ম, রাজনীতি আর মাদক- এই তিন বিষাক্ত জিনিস থেকে আমি নিজে থেকে বহুদিন হল দুরে রেখেছি। বাকিটা জীবন তাই রাখতে চাই। আমি এর ভেতরে জড়াতে চাই না। আজ আমানুল্লাহ গিয়েছেন, কাল যে আমি যাব না তার নিশ্চয়তা কি বল?”
“কিন্তু, অসহায় মানুষগুলোর কথা তো একবার ভাবেন? সুকান্তকে গ্রেপ্তার না করা পর্যন্ত আরো কত মানুষ মারা যাবে ভেবে দেখেছেন একবার? কায়সার আবেদীনের কেস আর ইমন মোস্তাফিজের কেসটাও চাপা পড়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকটা কেস এই একটা মানুষের সাথে সংযুক্ত আর সেটা হল সুকান্ত।”
“এই গুরুভার আমার ওপরে চাপিও না। সুকান্তকে ধরার অনেক লোক আছে। অনেক। সোয়াট টিম আছে। পুলিশ আছে। বিদেশ থেকে অস্ত্রটস্ত্র আমদানি হচ্ছে সব এই সুকান্তের মত অপরাধীদেরকে ধরার জন্যই তো। নাকি জনগনের টাকায় জনগণকেই শাসন করার জন্য এই অস্ত্র আনছে সরকার? তারপর পুলিশের হাতে সেই অস্ত্র দিয়ে জনগণকে শায়েস্তা করছে? আমাকে এই নোংরামিতে জড়িয়ো না। প্রণবের অনুরোধে অনেকটা জড়িয়ে পড়েছি আমি। আর না। প্লিজ।”
“যে আসবে সে আবার শুরু থেকে কেসটা শুরু করবে। সেটা ভালো হবে না। তার আগেই সুকান্তকে ধরতে হবে। প্লিজ। আমাদের কথাটা একটু হলেও রাখেন। সুকান্ত গ্রেপ্তার হয়ে গেলে আপনাকে আর বিরক্ত করব না।”
জয়েনুদ্দীন ঝিম ধরে বসে থাকলেন। বাম হাতটা একবার দাড়ির ভেতরে বুলিয়ে নিলেন। তারপর হঠাৎ আরাফের দিকে তাকিয়ে উঠে গেলেন। বললেন, “বইগুলোতে ভীষণ ধূলা। নেড়ো না। সারা ঘর ধূলা হয়ে যাবে।”
আরাফ হাতের বইটা নামিয়ে সরে আসল।
সাইদুর এলিনকে চোখে চোখে কি যেন ইশারা করল। এলিন হ্যান্ডব্যাগ খুলে একটা কার্ড বাড়িয়ে ধরে বলল, “কার্ডটা রাখেন। সাইদুরের কন্ট্যাক্ট নাম্বার দেওয়া আছে। কাল সকাল দশটায় মিটিং। আপনার সিদ্ধান্তটা কাল সকালের ভেতরে জানাবেন। হ্যাঁ-না যে কোন একটা জানাবেন।”
জয়েনুদ্দীন হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলেন। নেড়ে চেড়ে কার্ডটা দেখতে লাগলেন।
সাইদুর বলল, “আজ তাহলে উঠি। রাত হয়ে যাচ্ছে।”
“চা-টা খেলে না তোমরা।” জয়েনুদ্দীন বললেন।
“আরেকদিন এসে খাবো।” আরাফ বলল।
তিনজনে যখন বের হয়ে আসল তখন পেছন থেকে জয়েনুদ্দীন বললেন, “আচ্ছা শোন, তোমরা আমার বাড়ির ঠিকানা পেলে কোথা থেকে?”
“প্রণব স্যারের ডেস্কের জার্নালে লেখা ছিল,” সাইদুর বলল।
“উনার কোন খোঁজ পাওয়া গিয়েছে?” জয়েনুদ্দীনের প্রশ্ন।
“এখন পর্যন্ত তো না,” আরাফ বলল।
এলিন হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, “আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞাসা করব?”
জয়েনুদ্দীন বললেন, “কী?”
“আপনি জানতেন আমানুল্লাহ স্যার মারা যাবেন?”
“সত্যি বলতে কি, সৌমেন ঘোষকে আমার ভালো লাগেনি জানো। তোমরা আবার এগুলো বাইরে বল না। আমার সব সময়েই মনে হত সৌমেন ঘোষ আমানুল্লাহ সাহেবকে পথ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। আমার কেমন কেমন যেন লাগত সব সময়। মনে হত আমানুল্লাহ সাহেব খুব বড় একটা বিপদের মধ্যে আছেন। আমি তাকে বলেওছি কয়েকবার। উনি শোনেননি।”
এলিন মাথা নাড়ল। তিনজন বিদায় নিয়ে চলে গেল।
কালিদাস সরণীর মোড়ে এসে অবশেষে তিনজন তিন কাপ চায়ের অর্ডার করল। এলিন আদা দিয়ে কড়া চা চিনি কম, আরাফ দুধ চা চিনি যাতামাতা দিলেই হল আর সাইদুর লেবু চা লিকার কম চিনি ছাড়া।
আরাফ বলল, “সেদিন কিন্তু আমি ড্রোনের স্ক্রিনে অপরেশকে দেখেছি বুঝলি? স্যারকে বললাম। স্যার বলল নজর রাখতে। নজর রাখছিলাম কিন্তু সৌমেন স্যারকে খুঁজতে গিয়ে অপরেশ হারিয়ে গেল।”
এলিন বলল, “বলিস কি! অপরেশ, মানে যেই লোকটা এই কেসটা থামাতে বলেছিল!”
ইতিবাচক মাথা নাড়ল আরাফ।
সাইদুর হঠাৎ লাফিয়ে উঠে বলল, “ড্রোনের পুরো ভিডিও ফুটেজটা আছে তোর কাছে!”
আরাফ বলল, “হ্যাঁ আছে তো। কেন?”
এলিনের চোখেও প্ৰশ্ন।
“আরে ব্যাটা, ওইটা এনালাইসিস করলেই তো বের হয়ে যায় আমানুল্লাহ স্যারকে কে খুন করেছে, আর আমানুল্লাহ স্যারের ডেড বডিটাই বা কোথায় আছে। ওটাতে সব রেকর্ড হয়েছে না? বিস্ফোরণের সময় আমরা তো সবাই প্রায় আশেপাশের বিল্ডিংগুলোর ভেতরে ছিলাম, কিন্তু ড্রোনে তো সব উঠেছে নাকি?”
এলিন আর আরাফ লাফিয়ে উঠল। তাই তো! এটা তো মাথায় আসেনি। শোক পালন করতে গিয়ে মাথার নিউরনগুলো ধোঁয়াটে হয়ে গিয়েছে। তিনজনই হড় বড় করে কথা বলতে লাগল। কখন যে চাওয়ালা, “মামা চা লন” বলল কেউ খেয়ালই করল না।
সেই রাতেই খুন হলেন আরো একজন প্রথিতযশা লেখক, নাম প্ৰদীপ ভৌমিক।
তীর্থ
ঢাকা শহর তো ঘুমায় না, রাত দুটোর পরে একটু ঢুলুনি দেয়। এখন রাত আড়াইটা, আধ ঘণ্টা আগে থেকে ঢুলুনি শুরু হয়েছে।
রাতের প্রেসপাড়া শব্দের গোরস্তান। কয়েকটা কুকুর আর ঢাকা শহরের সাথে ঢুলতে থাকা কয়েকজন নাইটগার্ড ছাড়া আর কেউ নেই। বেশিরভাগ প্রেসই এখন বন্ধ। ব্যস্ততা শুরু হয় জানুয়ারিতে। ফেব্রুয়ারির বইমেলা যখন হয় তখন। তাই সুনশান। হঠাৎ হঠাৎ সরু রাস্তাগুলোতে শেষ রাতের বাতাস ঢুকে পড়ে পথ ভুল করে। রাস্তায় পড়ে থাকা ছেঁড়া কাগজ, পলিথিন, ‘গোপন রোগের শেফা’র লিফলেট আর সিগারেটের ফিল্টার উড়ে যায়।
এমনি এক ঢুলুনির সময়ে খোলা হয় ‘তীর্থ’। এখানে লালিক, হাইল্যান্ড পার্ক ডিস্টিলারি, রিচমন্ড থেকে শুরু করে বাংলা পর্যন্ত পাওয়া যায়। মোটামুটি সস্তায়। প্রেসের কুলি মজুর থেকে শুরু করে সম্পাদক, লেখক সবাই এই ‘তীর্থের যাত্রী’ হয়েছে অন্তত একবার হলেও। তবে কাউন্টার আলাদা। প্রতিটা লেখককেই কোন না কোন মানব সমাজের অন্ধকার দিকটার এক চুমুক চেখে দেখতে হয়। আর এটা সেই জায়গা, যেখানে যত ইচ্ছা অন্ধকার পান কর, কেউ কিছু বলবে না।
গলির শেষ মাথায়, যেখানে ডাস্টবিনের ময়লা ঘাঁটছিল কয়েকটা কুকুর- সেখানে একটা লম্বা ছায়া পড়ল। ল্যাম্পপোস্টটা আড়াল হয়ে গেল। কুকুরগুলো ময়লা ঘাটা বাদ দিয়ে ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে শুরু করল। তারপর কি মনে করে আবার ময়লা খোঁজায় মন দিল।
ছায়াটা একটু এগিয়ে গিয়ে সাইনবোর্ডটার দিকে তাকালো। নিয়ন আলোতে জ্বল জ্বল করছে ‘শ্রী শ্রী পরেশ ট্র্যাভেল এজেন্সী’। শাটার নামানো। এই ট্র্যাভেল এজেন্সীর পেছনেই ‘তীর্থ’। এদিক ওদিক তাকিয়ে পাশের গ্রিলের বেড়াটা একহাতে ভর দিয়ে টপকালো ছায়াটা। তাল সামলাতে না পেরে ভোঁতা একটা শব্দ করে পড়ে গেল রাস্তার ওপরে। তারপর অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে লোহার দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল। কিছুটা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হাঁটতে লাগল ছায়াটা।
পরেশ পুরকায়স্থর প্রধানত ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্যবসা। তবে বিদেশ থেকে দামি দামি বই ব্ল্যাক করে। মানে বুক স্মাগলার। ট্যারিফ ফাঁকি দিয়ে বইগুলো কিছুটা কম দামে বিক্রি করে। তাতে ট্যারিফের যে টাকাটা বেঁচে যায় সেটা পরেশের পকেটেই থেকে যায়। শাহাবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে একটা বইয়ের দোকানও ছিল পরেশের; নাম ‘কাগজের সাম্পান’। এছাড়াও সে একজন বিশিষ্ট আদম ব্যবসায়ী। বিদেশে শ্রমিক ‘এক্সপোর্ট’ থেকে শুরু করে বিদেশী ‘গার্লফ্রেন্ড ইম্পোর্ট’-সবই করে থাকে সে। ফকিরাপুলে একটা নিজস্ব হোটেল আছে তার। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে অবশ্য সে বেশ কয়েক মাস মুখভর্তি দাড়ি রেখে পাগড়ি পরে চরমোনাই পীরের আস্তানায় জিকির আসগারে ব্যস্ত ছিল।
ভেতরটা গুমোট। নিকোটিনের গন্ধে দম আটকে আসার মত অবস্থা। এখানে ওখানে কয়েকটা সিলিং ফ্যান ঢুলছে। এক্সজস্ট ফ্যানগুলো ঘুরছে তার চেয়েও আস্তে। আবছায়া আলো আঁধারিতে ছোট ছোট এখানে ওখানে ছড়ানো ছিটানো টেবিল। দেখে মনে হবে খালি। কিন্তু টেবিলগুলোতে বসে আছে বিশিষ্ট লেখক, সম্পাদক, প্রুফ রিডার আর ইনটেলেকচুয়ালরা। কিছু কিছু টেবিল দখল করে আছে কিছু আর্টিস্ট; প্রচ্ছদশিল্পী। সবাই খুব নিচু গলায় কথা বলছে। খুব নিচু গলায় হাসছে। এলোমেলো দু’চারটে কথা টেবিল থেকে ছিটকে আসছে, ‘ও কথা বল না ও কথা বল না, সুনীলের লেখার ভেতরে জীবন বোধটা নেই, নাহ, একদম নেই, বুদ্ধদেব বসুর ভেতরে কিন্তু আছে। মানে কম্পেয়ার করলে কিন্তু বেশিই আছে।’
কাউন্টারের পাশেই একটা সস্তা ফ্রেমে ঝুলছে রে ব্র্যাডবেরীর লেখালেখি বিষয়ক উক্তি, ‘You must stay drunk on writing so reality can not destroy you.’ অর্থাৎ, তোমাকে লেখালেখির নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতে হবে যেন বাস্তবতা তোমাকে ধ্বংস করতে না পারে।
ছায়াটা ধীরপায়ে কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেল। এক মোটাসোটা লোক বসে আছে। টাক মাথা। গালে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। কাউন্টারের ওপরে রাখা হলুদ আর কালো রঙের একটা টেবিল ফ্যান ঘুরছে ভ্রররর করে। দূর থেকে শুনলে মনে হবে ভ্রমরের গুঞ্জন। মোটাসোটা লোকটা জিজ্ঞাসা করল, “কি দোবো?” কাউন্টারের ওপরে জ্বলতে থাকা বাল্বের আলোতে পরিষ্কার ছায়ার মুখটা দেখা গেল।
সুকান্ত।
“পরেশ কাকা আছে? দেখা করতাম।” সুকান্ত বলল।
লোকটা বলল, “পরেশদা ব্যস্ত আছে। কী দরকার?”
“খুব জরুরী দরকার। পরেশ কাকাকে একটু বল সুকান্ত দেখা করতে চায়।”
সুকান্তকে মন দিয়ে দেখতে লাগল লোকটা। মদ খেয়ে ফুলে যাওয়া দুটো কুতকুতে চোখ দিয়ে সুকান্তের মাথা থেকে পা পর্যন্ত কয়েকবার দেখল। তারপর ঘোৎ করে ডেকে উঠল, “ওই মন্টু, মন্টু দাদাকে গিয়ে বলতো যে সুকান্ত না ফুকান্ত কে জানি এসছে দেখা করবে।”
গুলির ক্ষতটা এখনও দগ দগ করছে। সস্তা শার্টের নিচে ব্যান্ডেজে মোড়া থাকলেও তীক্ষ্ম একটা ব্যথার মাধ্যমে জানান দিচ্ছে। ক্ষতটার চারপাশের চামড়ায় টান ধরেছে; বারুদের বিষক্রিয়া। তেজগাঁও রেললাইন বস্তিতে রমেলা খালার কাছে গিয়ে বের করে নিতে হয়েছে গুলিটা। পিঠ আর ঘাড়ে ছড়ে যাওয়া জায়গাগুলোও ব্যান্ডেজ করে নিতে হয়েছে। কিন্তু এখনও মাংসপেশীতে তীব্র ব্যথা আছে।
কিছুক্ষণ পরে একটা বামন আসল। মোটা লোকটা বলল, “সার্চ কর।” বামনটা একটা প্লাস্টিকের টুল আনল। তার ওপরে দাঁড়িয়ে সুকান্তকে সার্চ করতে লাগল। বগল, বুক, পেট, বিশেষ করে কোমর আর উরু- তারপর নাঁকি সুরে বলল, “আসেন।”
কাউন্টারের পেছনে একটা দরজা। সেটা ঠেলে ভেতরে ঢুকল মন্টু। সুকান্তও পেছন পেছন গেল। একটা ছোট্ট হলওয়ে। হলওয়ের একেবারে শেষ মাথায় একটা ভারি কাঠের দরজা। মন্টু পকেট থেকে এক খন্ড পাথর বের করল। সেটা দিয়ে দরজায় বিশেষ কায়দায় কয়েকটা বাড়ি আর কয়েকবার ঘষে অদ্ভুত একটা শব্দ করল বামনাকৃতির লোকটা।
দরজা খুলে গেল। হাফহাতা শার্ট পরা একজন ভুঁড়িওয়ালা লোক দরজা খুলে দিল। লোকটার বাম হাতে গ্লক-১৯ মডেলের অটোমেটিক মেশিন পিস্তল। এক সেকেন্ড ট্রিগার চেপে ধরে রাখলে হ্যান্ড শাওয়ারের ঝর্ণার মত গুলির ঝর্ণা বের হয়ে সামনের সব কিছু ঝাঁঝরা করে দেবে। দরজায় আরো এক দফা তল্লাশী চলল সুকান্তের। ভুঁড়িওয়ালা সুকান্তের গোপন জায়গায় হাত দিয়ে একটা নোংরা হাসি দিল। লোকটার মুখ দিয়ে যেন পচা মাংসের গন্ধ বের হয়ে এল। সুকান্ত নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল।
ছোট্ট রুম। তাপানুকূল। ঘো ঘো করে এসির নাক ডাকার শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। রুমের অর্ধেকটাই জুড়ে আছে একটা টেবিল। টেবিলের ওপরে অনেক ফাইল পত্র। কয়েকটা ম্যাগাজিন। দুইটা এশট্রে। আরো কি কি সব জিনিসপত্র সুকান্ত অত কিছু খেয়াল করতে পারল না। তার আগেই টেবিলের অপর প্রান্তে বসে থাকা বেঁটে খাটো লোকটার ওপরে চোখ পড়ল তার। ইনিই পরেশ পুরকায়স্থ, বলে দিতে হল না তাকে। ধ্যাবড়া নাকের নিচে সরু গোঁফ। মাথায় চুল কম। নিচের ঠোঁটটা মোটা। গলায় তার থেকেও মোটা সোনার চেইন। শার্টের অর্ধেক বোতাম খোলা। বুকের কাঁচা পাকা লোমগুলো উঁকি দিয়ে সুকান্তকে দেখল। সুকান্তের দিকে তাকিয়েই বলল, “কিরে, সুকান্ত? তোর নামে কি শুনছি এগ্লা?” এমনভাবে বলল যেন সুকান্তের সাথে কতদিনের পরিচয়, “বস বস।”
একটা চেয়ার টেনে নিয়ে সুকান্ত বসল।
”তোরে তো পুলিশ খুঁজতেছে শুনলাম। রাইটার মাইরা বেড়াইতাছোছ শুনলাম। কাহিনী কি?”
“আমি কাউকে খুন করিনি কাকা। সত্যি বলছি আমি কাউকে খুন করিনি।”
“ধুস তোর পুরান কথা। এগ্না সব্বাই বলে। আমিও বলছি এককালে। নিজেরে ফিরিশতা ভাবা ক্রিমিনালের পোরথম লক্ষণ। তো আমার এইখানে কি? তোরে তো আমার লাইনের লোক বলে মনে হয় না। কখনও নামই শুনি নাই তোর।”
“কাকা, সংবাদে কি বলেছে না বলেছে আমি জানি না। কিন্তু সত্যি বলছি আমি খুন করিনি। কাউকে খুন করিনি।”
পরেশ তার রিভলভিং চেয়ারটা কিছুটা ঘুরিয়ে উল্টো দিকে থাকা কয়েকটা খবরের কাগজ ছুঁড়ে ফেলল সুকান্তের সামনে। খবরের কাগজগুলো নেড়ে চেড়ে দেখল সুকান্ত। প্রায় সবগুলোর প্রথম পাতাতেই তার ছবিসহ খুনের বৃত্তান্ত। সে একগুঁয়ের মত বলল, “এগুলো মিথ্যা পরেশ কাকা।”
“মানলাম তুই খুনি না, তাইলে যে আসল খুনে সে তোরে মারে না ক্যান?”
প্রশ্নটা যেন তীরের মত বিঁধল সুকান্তের কানে। আসলেই তো। নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার একমাত্র উপায় দোষীকে খুঁজে বের করা। সুকান্তের মাথায় তো এটা আগে আসেনি। তাড়া খাওয়া জন্তুর মত সে শুধু পালিয়ে বেড়িয়েছে এই গলি থেকে ওই গলি। পেছন ফিরে দেখার কথা তার মাথাতে আসেনি।
সুকান্তকে মূর্তির মত বসে থাকতে দেখে পরেশ একটা চুরুট ধরালো। তারপর নাক দিয়ে এক রাশ ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “কোথায় কাজ করিস?”
“প্রেসে। আলী প্রিন্টিং প্রেসে।”
“ওই মহসিন চাচার প্রেসে?”
“জ্বি।”
“বহু পুরান প্রেস তো। কদ্দিন কাজ করতেছছ?”
“বছর তিনেক।”
“অ। তো বল। কি চাস? শেল্টার চাছ? সেরেন্ডার করবি পুলিশের কাছে? নাকি? নাকি লয়ার চাছ? কোনটা? পয়ছা কড়ি দিবার পারুম না আগে কইতাছি। হাত টান চলতাছে।”
“না না। মানে, আমি, মানে আপনি যদি একটু ইন্ডিয়ার পাসপোর্ট আর ভিসার ব্যবস্থা করে দেন, খুব উপকার হয়। পুলিশের পেছনে ঢালার মত টাকা আমার কাছে এই মুহূর্তে নাই। কয়দিন যদি ইন্ডিয়াতে গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারি, পরিস্থিতি শান্ত হলে তখন আসব।”
পরেশের ভ্রু কুঁচকে গেল। চুরুটে লম্বা একটা টান দিয়ে সে বলল, “পয়ছা কড়ি কিছু আছে?”
সুকান্ত মাথা নাড়ল। নেই। তবে কথাটা আংশিক সত্যি। পয়সা সুকান্তের আছে। দুটো ব্যাংকে প্রায় তিন লাখ মত টাকা আছে। সুভাষদাই সেগুলো দেখা শোনা করতেন। সুকান্ত বৈষয়িক মানুষ না। সুভাষদার জীবদ্দশায় কখনও জানতেও চায়নি টাকার কি অবস্থা কেমন কি। কিন্তু আজ টাকাগুলোর অভাব কিছুটা হলেও বোধ হচ্ছে। কিন্তু এই মুহূর্তে পরেশকে বুঝিয়ে বলার মত ধৈর্য নেই সুকান্তের।
“তাহলে তো সমস্যা। পয়ছা ছাড়া ভগবান ভি আখ খোলে না। যাই হোক, ফিরভি উপায় একটা আছে।”
“কি উপায়?” সুকান্ত জানতে চাইল। একটু আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
“কাল মোংলা পোর্টে, না না কাল না, পরশু, পরশুদিন মোংলা পোর্টে দুইটা বইয়ের ক্রেট আছবে। ক্রেটে কিছু রেয়ার কিতাব থাকবে। কিতাবগুলা এন্টিক, তাই কিমাতভি সেইরকম। কালকাত্তার এক অকছানে কিনে লিয়েছিলাম। ওসব কিতাব লিয়ে বোর্ডার ক্রস করতে গেলে বহুত পয়ছা বেরিয়ে যেত। তাই শিপে তুলে দিয়েছি। পরশু আসবে। তো…”
চুরুটটা এশট্রেতে ডলে দিয়ে সুকান্তকে বললেন, “ড্রিংক্স দিতে বলব? ভোদকা ইয়া ওয়াইন?”
সুকান্ত মাথা নাড়ল। সে নিজেই এখন ড্রিংক্স যাকে এই মহাজীবন একটু একটু পান করছে, ফুরিয়ে গেলেই শূন্য দেহটা গোরস্তানে ফেলে দেবে।
পরেশ আবার বলা শুরু করল, “তো, তোর কাম হচ্ছে, শিপের নিচে মাছ ধরার নৌকা নিয়ে তুই আর আমার এক লোক ওয়েট করবি। জাহাজে আমার লোক আছে। উরা কিতাবগুলা দড়ি দিয়ে লাবিয়ে দেবে, তোরা সেগুলা মাছ রাখা শোলার ক্রেটের ভেতর করে লিয়ে আসবি। ক্রেটে বরফ আর মাছ টাছ দিয়ে ছব রেডি করাই থাকবে আগে থেকে।”
“বরফ আর মাছের পানিতে বইগুলো তো ভিজে যাবে।”
“আরে না না, কিতাবগুলা সুন্দর করে প্যাকেট করা থাকবে। কেউ বুজবার ভি পারবে না। তো তুই যদি এই কামটা করে দিছ, আমি তোর ব্যাপারটা ভেবে দেখব।”
সুকান্তের কপাল ঘামতে শুরু করল। কাজটা সামান্যই। ধরা পড়ার ভয় নেই। থাকলেও তার জানার কথা না। কারণ এই কাজ সে আগে করেনি। কখনও করবে বলেও ভাবেনি। এই মহাজীবন তাকে আর কি কি দেখাবে কে জানে। এই যে চতুষ্পদ জীবনযাপন সে করছে গত কয়েক সপ্তাহ, এটা কি সে কখনও ভেবেছিল? একেবারে অদেখা সিনেমার মত একের পর এক সিন হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সিনেমার টিকিটটার দাম অনেক বেশি। এতদূর যখন চলে এসেছে তখন আরেকটু ঝুঁকি নিলে দোষ কি?
“না কাকা” সুকান্ত বলল। “কাজটা করব না। আমি আর নিতে পারছি না। একটু শান্তির জন্য একটা পূণ্যই যথেষ্ট, কিন্তু একটু অশান্তির জন্য একটু পাপ-চিন্তাই যথেষ্ট। আর না।”
“তা’লে আর কি, দেখ কি করবি। তুই আমার এখানে আসলি, ছাহায্য চাইলি, আমি আমার দিকটা তোকে পরিছকার করে বললাম। এই দুনিয়ায় কোন কিছু ই তো ফ্রি না। নাকি? ভগবান তোকে ফ্রি তে স্বর্গ দেবে? দেখ যদি মন পাল্টাছ তো আছিছ।” পরেশ রিভলভিং চেয়ারটা ডানে বামে দোলাতে দোলাতে বলল।
সুকান্ত চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পায়ের নিচটা কেমন যেন দুলছে। যেন সে একটা কার্পেটের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে, কেউ কার্পেটটা ধরে আস্তে আস্তে টানছে। একটা সময় কার্পেটের একেবারে প্রান্তে পৌঁছে যাবে সে। আর তারপর পতন।
মাথা নিচু করেই বের হয়ে আসল সুকান্ত। মন্টুকে দেখল হলওয়ের শেষ মাথায় অন্ধকারে দাঁড়িয়েছে আছে। কাউন্টারের পেছনের দরজাটা খুলে দিল। সুকান্ত আবার তীর্থে পদার্পন করল।
হঠাৎ একটা হৈ চৈ শোনা গেল। ধাক্কাধাক্কি। কথা কাটাকাটি। সুকান্ত কাউন্টারের একপাশে দাঁড়িয়ে দেখতে পেল, একেবারের কোণার দিককার একটা টেবিলে, কয়েকজন মিলে হৈ চৈ করছে। একটু কাছে যেতেই বুঝতে পারল, দুজন হাতাহাতি করার চেষ্টা করছে আর বাকিরা সেটা থামাতে ব্যস্ত।
“এই হিরণ, হিরণ থামো, থামো বলতেছি। ওই ওরে বাইরে নিয়ে যা।”
“কলিজার ভেতর পা ভরে দেব আমি চিনিস আমাকে শুওরের বাচ্চা চিনিস আমাকে? হিরণ পাশা, আমি হিরণ পাশা বুঝলি? বাংলাবাজার আমি চালাই বে চুতিয়া শালা”
“সোহেল, সোহেল ছেড়ে দে, মাতালের কথায় কান দিস না, হি ইজ ড্রাংক এন্ড নট হ্যাজ কন্ট্রোল অন হিমসেলফ, ছেড়ে দে, রাত হয়েছে চল ফিরি”
“দুটো বই বের হয়েছে তো পা মাটিতে পড়ছে না না? কি মনে করছিস কি নিজেকে শালা ইয়ান ফ্লেমিং মারাতে আসে বাল কোথাকার!”
“হিরণ পাগলামি করো না চল দেখি, বাদ দাও, চল, অনেক হয়েছে”
“কে ড্রাংক? তোর মায়ের নাং ড্রাংক শালা, চিনি না মনে করছ? হ্যাঁ? লোক দিয়ে বই লিখিয়ে নিজের নামে ছাপাও চুতিয়া শালা, সব শালাকে চিনি। সব শালা লেখা মারাতে আসে, আমি নিজে লিখি নিজে ছাপাই। অন্যের লেখার মা কে চুদবা না বে নিজে লিখে তারপর মারাতে আসবি, হ্যাত, গায়ে হাত দিবি না…”
এলোমেলো কথাগুলো কানে আসতে লাগল। ভিড়টা থেকে কিছুটা দুরে দাঁড়িয়ে সুকান্তের বুঝতে অসুবিধা হল না, মাতালের মত জড়িয়ে যাওয়া কণ্ঠটা হিরণের। এবার রাইটো- এড্রেনালিনের পুরস্কার যাবে যার নামে এবার দেওয়া হবে। হিরণের মুখের ভাষা শুনে গায়ে কাঁটা দিল।
তিন চারজন মিলে হিরণকে তীর্থের বাইরে বের করে দিয়ে আসল। সেই সরু গলিটায়। সুকান্তও পিছন পিছন বেরিয়ে আসল। পাশের ডাস্টবিনগুলোর আড়ালে লুকালো। এর মধ্যে কখন বৃষ্টি হয়ে গিয়েছে! রাস্তা ভেজা।
হিরণ হাত পা ছুড়াছুড়ি করতে করতে একজনের চোয়ালে বেমাক্কা একটা ঘুষি কসে দিল। ‘ইরিম্মা!” বলেই লোকটা বসে পড়ল। বাকিরা বলল, ‘ফেলে দেহ। ফেলে দেহ শালাকে।’ আক্ষরিক অর্থেই ভেজা রাস্তাটায় ফেলে দিল হিরণকে। হিরণ তখনও গালাগালি করে যাচ্ছে। একজন বলল, “হিরণদা চল তোমাকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি।”
হিরণ ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়ে অশ্রাব্য একটা গালি দিয়ে বলল, “কেউ ছুবি না আমাকে, আই এম জিজাজ ক্রাইস্ট, কেউ আমার সাথে আসবি না।” ভিড় পাতলা হয়ে গেল। লোকগুলো নিচু গলায় গুজ গুজ করতে করতে ভেতরে চলে গেল।
টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো হিরণ। তারপর দু পাশের দেয়াল ধরে ধরে এগোতে শুরু করল। নিচে গলায় কি সব বলতে লাগল সুকান্তের কান পর্যন্ত গেল না। সুকান্তও পিছু নিল মাতাল হিরণের। কেন নিল? জানে না সুকান্ত।
একটু সামনে হিরণ। একটু পেছনে সুকান্ত। হিরণ মাঝে মাঝে নিচু গলায় গান গাচ্ছে, “ইফ ইউ মিস দিস ট্রেন আই এম অন, ইউ উইল নো দ্যাট আই হ্যাভ গন…” হোঁচট খেতে খেতে, দেয়াল ধরে, টলতে টলতে এগিয়ে যাচ্ছে। সুকান্ত বারবার পিছনে তাকাচ্ছে। তীর্থ থেকে কেউ বের হয়ে আসলে যদি জিজ্ঞাসা করে এখানে কি? বা কোন পুলিশ! পুলিশের কথা মনে পড়তেই সারা শরীর কেঁপে উঠল সুকান্তের।
কিছুদূর গিয়েই ভোঁতা একটা শব্দ করে হিরণের শরীরটা পড়ে গেল ভেজা রাস্তার ওপরে। মরে গেল নাকি! সুকান্ত দৌড়ে গিয়ে তরুনের নার্ভ চেক করল। সারা শরীরে পচা মাংসের মত উৎকট গন্ধ। ছিহ। নাহ, মরেনি। অচেতন হয়ে গিয়েছে। কোন রকমে হিরণকে টেনে উঠাল সুকান্ত। তারপর একটা হাত নিজের কাঁধের ওপরে তুলে নিয়ে এগোতে লাগল।
কী করা যায় এখন? বাড়ি পৌঁছে দেবে হিরণকে? নাকি? নাকি সেদিনকার সেই অপমানের প্রতিশোধ নেবে? কেউ নেই আশেপাশে। রাত কটা হবে? সাড়ে তিনটা? রাস্তার পাশে পড়ে থাকা ওই পাথরটা দিয়ে যদি মাথাটা ছেঁচে দেওয়া যায়? কেউ জানবে না। পাথরটা বুড়িগঙ্গার বুকে ফেলে দিলেই ল্যাঠা চুকে যাবে।
হিরণের পকেটটা একবার হাতড়ে দেখল সুকান্ত। যদি কিছু পাওয়া যায়। টাকা পয়সা বা অন্য কিছু।
পাওয়া গেল; মানিব্যাগ। কয়েকটা ভিজিটিং কার্ড। আর একটা আইডি কার্ড। সবগুলো বের করে নিজের পকেটে নিয়ে নিল সুকান্ত। তারপর গলির মুখে একটা দোকানের সামনে হিরণকে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে বসিয়ে রেখে কি একটা খুঁজতে লাগল মানিব্যাগে।
হঠাৎ ঘর ঘর করে একটা শব্দ শুনতে পেল সুকান্ত। গাড়ি আসছে। অন্ধকার থেকে উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কিসের গাড়ি।
একটা পুলিশ ভ্যান। এদিকেই এগিয়ে আসছে। খুব ধীরে।
হৃৎপিণ্ডটাকে যেন একটা বরফের হাত খামচে ধরল। কাঁধ আর ঘাড়ের মাংসপেশী শক্ত হয় গেল সুকান্তের। বিপদ। গলির ভেতরে পালাতে গেলে ভেজা রাস্তায় ছপ ছপ করে শব্দ হবে। আর গলির বাইরে গেলে তো কথাই নেই। নিজেকে শান্ত রাখার জন্য যুদ্ধ শুরু হল। হিরণকে এই অবস্থায় তার সাথে পেলে কি হবে ভাবতেই পারছে না সে।
ভ্যানটা এগিয়ে আসছে।
কী করবে? গলির ভেতরে দৌড় দেবে?
আরো এগিয়ে আসছে ভ্যানটা। একেবারে গলির মুখে এসে সামনের জানালা থেকে একজন পুলিশ টর্চ জ্বালাল। টর্চের আলোক বৃত্তটা ধীরে ধীরে গলির ভেতরে আসতে লাগল। আর কয়েক ইঞ্চি। বুক ভরা শ্বাস নিয়ে আত্মসমর্পনের সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সুকান্ত।
কিন্তু আলোকবৃত্তটা সুকান্তের অন্ধকারের দিকে গেল না। সোজা গলির মধ্যে চলে গেল। একজন পুলিশ বলে উঠল, “পরেশ টাকা পয়সা দিচ্ছে ঠিক মত? এইদিকেই না পরেশের ঠেক?” আরেকজন কি বল বুঝতে পারল না সুকান্ত।
ভ্যানটা চলে গেল। ধীরে ধীরে।
বুকের ওপর থেকে পাথর নেমে গেল সুকান্তের। সারা শরীর কাঁপতে লাগল হিস্টিরিয়া রোগীদের মত। স্বাভাবিক হতে কিছুটা সময় লাগল তার। তারপর কাঁপা হাতে মানিব্যাগে লেখা ঠিকানাটা পড়ল।