৫
পুলিশ ব্যুরো অব স্পেশাল ইনভেস্টিগেশন বাংলাদেশ পুলিশ বিভাগের তুলনামূলক নতুন একটা ডিপার্টমেন্ট। কিন্তু নতুন হলেও অল্প সময়ের ভেতরে কাজের সাফল্য দিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর ভেতরে বেশ শক্তিশালী একটা অবস্থান তৈরি করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে তারা। এই সংস্থার যাত্রা শুরু হয়েছিল পিবিআই মানে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের একটি শাখা হিসেবে। কিন্তু অল্প সময়ের ভেতরে সাফল্য দেখানোর কারণে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ বিল পাশের মাধ্যমে তাদেরকে নিজস্ব রিসোর্সসহ একটি আলাদা ডিপার্টমেন্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে দেওয়া হয়েছে।
ডিপার্টমেন্টটার একটা বিশেষ ব্যাপার হলো, যেকোনো ধরনের ইনভেস্টিগেশন সেটা যেকোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অধীনেই থাকুক না কেন, যেখানে কোন ডিপার্টমেন্টের বাইরের এক্সপার্ট অ্যাডভাইজের দরকার হয় কিংবা কোন ডিপার্টমেন্ট সুবিধে করে উঠতে পারে না তখনই ডাক পড়ে এই ডিপার্টমেন্টের লোকদের। সেই হিসেবে এই ডিপার্টমেন্টকে এক্সপার্টদের ডিপার্টমেন্টও বলা চলে। তবে এ কারণে অনেকের মাঝে তাদের নিয়ে জেলাসিরও শেষ নেই। এই ডিপার্টমেন্টের আরও একটা বিশেষত্ব হলো এখানে প্রায় সব ধরনের বিষয় নিয়ে কাজ করা হয়।
পিবিএসআইয়ের প্রতিষ্ঠাতা প্রধান আতিকুল আলমের বন্ধু হওয়ার সুবাদে প্রফেসর জাকারিয়া এর আগেও এখানে এসেছে অনেকবার। একটা বাউন্ডারির ভেতরে বড় বড় দুটো বিল্ডিং নিয়ে তাদের অফিস। সেকশন অনুযায়ী সেগুলোতে দুই ফ্লোর করে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। বিশেষ ধরনের তদন্ত হয়ে থাকে বলে অন্যান্য সংস্থার মতো এখানে সর্বক্ষণ কাজের চাপ থাকে না বরং বিশেষ বিশেষ সময়ে যখন কাজের চাপ পড়ে তখন অবস্থা খুব খারাপ হয়ে যায়।
গাড়ি থেকে নেমে প্রথমেই প্রফেসরের মনে হলো আজ সেরকমই বিশেষ একটা অবস্থা যাচ্ছে এখানে। ড্রাইভওয়ে ভরতি নানা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার গাড়ি তো আছেই, একাধিক ভিআইপির গাড়িও দেখতে পেল প্রফেসর। এর আগে এখানে অনেকবার এলেও এমনকি ব্যস্ততম দিনেও এই জায়গার এমন চিত্র এর আগে কখনো চোখে পড়েনি প্রফেসরের। সে গাড়ি থেকে নেমে সোজা হাঁটা দিল ভবনের ভেতরের দিকে। সে ভবনের প্রবেশপথ পর্যন্ত আসা মাত্রই গাড়ি পার্ক করে চলে এলো আফসার।
“স্যার, এদিকে প্লিজ,” বলে সে প্রবেশপথের কাচের দরজাটা মেলে ধরল।
ভেতরে ঢুকে প্রথমে একটু অবাক হয়ে গেল সে। আগে এই অফিসে এত লোক সে কখনো দেখেনি। তার চেয়ে বড় কথা তাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য রীতিমতো একটা টিম অপেক্ষা করছে। যার পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আছে পিবিএসআইয়ের বেশ বড় মাপের একজন কর্মকর্তা।
“স্যার, আপনি আমার সাথে আসুন,” বলে আফসার তাকে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে গেল। তাকে হাতের ইশারায় ডেকে প্রফেসর বলে উঠল, ‘আফসার, আপনি এই হই-হট্টগোল থেকে আমাকে সরিয়ে আগে আতিকের কাছে নিয়ে চলুন। আগে ওর সাথে আমার বিস্তারিত কথা বলা দরকার।”
আফসার এক মুহূর্ত চিন্তা করে সেই কর্মকতাকে ডেকে কিছু একটা বলল। সেইসাথে আরও দুয়েকজনকে ডেকে কিছু নির্দেশনা দিয়ে প্রফেসরকে নিয়ে চলে এলো ফ্লোরের পেছনের দিকে। সেখানে তুলনামূলক ছোট একটা লিফটে করে ওরা তিনজনে রওনা দিল সপ্তম তলার দিকে
“আফসার এখানে ওয়াইফাই আছে না?” প্রফেসর জানতে চাইল আফসারের কাছে।
“জি, স্যার আছে,” আফসার হাসিমুখে বলে উঠল। “একেবারে নতুন লাগানো হয়েছে। খুবই শক্তিশালী।”
“ভেরি গুড, প্রফেসরের মুখেও ফুটে উঠল সামান্য হাসি। নিজের মোবাইল বের করে সে বলে উঠল, “পাসওয়ার্ড বলো।’
ওদের লিফট এসে থেমে গেল সপ্তম ফ্লোরে। একটা সময় ছিল যখন সরকারি অফিসের লিফটে উঠলে এলাকার ভাঙাচোরা রাস্তায় রিকশা ভ্রমণের কথা মনে পড়ে যেত। এখন সে চিত্র পরিবর্তন হয়েছে। সরকারি অফিস মানেই লারে-লাপ্পা, সে চিত্র এখন আর নেই। প্রফেসর মনে মনে একটু হেসে উঠল, মানসিক চিত্রের পরিবর্তন আদৌ হয়েছে কী!
সপ্তম তলায় এসে একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল প্রফেসর। এখানে স্বাভাবিকের তুলনায় ভিড় থাকলেও নিচে যেরকম মাছের বাজারের অবস্থা ছিল সেরকম নয়। তাকে বসিয়ে রেখে দুজনেই চলে গেল ভেতরের দিকে। কিন্তু মিনিটখানেকের ভেতরেই প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে ফিরে এলো আফসার।
“স্যার, আতিক স্যার অপেক্ষা করছেন আপনার জন্য। দুই সারি কিউবিকলের ভেতর দিয়ে হেঁটে ওরা চলে এলো আতিকুল আলমের সাজানো-গোছানো অফিসের সামনে। ওরা পৌঁছাতেই দরজার পাশে দাঁড়ানো দুজন গার্ডের একজন দরজাটা মেলে ধরল।
ভেতরে ঢুকে প্রফেসর দেখল পিবিএসআইয়ের প্রধান আতিকুল আলমের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে একটা ডায়রিতে নোট নিচ্ছে খুব স্মার্ট চেহারার একটা মেয়ে। এই রাতেও তার মুখে একতাল মেকআপ। আর টেবিলের ওপাশে বিরাট চেয়ারে বসে আছে হ্যাংলা-পাতলা চেহারার অস্বাভাবিক কালো একজন মানুষ। প্রফেসরের মনে পড়ে গেল কলেজে থাকতে আতিককে ওরা কালো মানিক ডাকত। আর সেটাকে খুব সফলভাবেই প্রমাণ করেছে সে নিজের সাফল্য দিয়ে।
আতিকের একহাতে একটা মোবাইলে আলো জ্বলছে, অন্যহাতে সে ধরে রেখেছে একটা ল্যান্ডফোনের রিসিভার। মোবাইলে কথা বলার সময়ে ল্যান্ডফোনে কল এসেছে, নাকি ল্যান্ডফোনে কথা বলার সময় মোবাইলে কল এসেছে ঠিক বোঝা গেল না। তবে তাকে দেখতে পেয়ে মোবাইল আর ল্যান্ডফোন দুটোই রেখে দাঁড়িয়ে গেল আতিকুল আলম।
“আরে জাকারিয়া, আয় আয়,” বলে সে আফসারকে দেখিয়ে বলে উঠল ওর সাথে নিশ্চই তোর পরিচয় হয়েছে। আর ও হলো, “মেয়েটাকে দেখিয়ে সে বলে উঠল, “আমাদের খুব চৌকশ একজন অফিসার মারিয়া শিকদার, ও আমার পারসোনাল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করে,” মারিয়া মেয়েটা প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে সামান্য মেকি হাসি দিল।
“তুই কিছু খাবি? চা-কফি?”
প্রফেসর মাথা নেড়ে মানা করল। অফিসের ভেতরে গরম লাগছে দেখে হাতের কাঠের বাক্সটা টেবিলে রেখে সুটের বাটন খুলে আলগা করে নিল। তারপর টাইয়ে প্যাচানো সিল্কের রুমালটা খুলে সুটের ভেতরের পকেটে রেখে বলে উঠল, “আতিক, আমাকে যত দ্রুত সম্ভব সম্পূর্ণ পরিস্থিতির ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা পেতে হবে,” সে গাঢ় কফি কালারের কাচের ওপাশ থেকে সরাসরি তাকিয়ে আছে আতিকুল আলমের দিকে। “তুই ফোনে যা বলেছিস সেটা যে খুবই অপ্রতুল তা তুই জানিস।”
ওর কথা শুনে আতিকুল আলম একটু থমকে গেল। সে চিন্তিত মুখে জানতে চাইল, “আফসার, তোকে কতটা বলতে পেরেছে?”
পেছন থেকে আফসার কাশি দিয়ে বলে উঠল, “এয়ারপোর্টে ফাত্তাহ কীভাবে ধরা পড়ল সেটুকুই শুধু বলেছি। তারপরের পরিস্থিতি—”
আতিকুল আলম একবার হাত নাড়ল, “হাউজিং থেকে এই পর্যন্ত আসতে আসতে এর চেয়ে বেশি বলা সম্ভব নয়। এক কাজ করি,” বলে সে একটু ভেবে যোগ করল, “তোর সাথে আমার যে মিটিংটা করতে হবে সেটা আমরা বোর্ড রুমে করি। ওরাও থাকুক,” বলে সে রুমে উপস্থিত দুজনকে দেখাল সেই সাথে অপারেটিং টিমের বাকি মেম্বারদেরও থাকতে বলি,” বলে সে একটা আঙুল তুলল। “সেইসাথে মিনিস্ট্রি থেকে আসা পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারিদেরকেও রাখি।”
প্রফেসর একটু বিরক্তির সাথে মাথা নাড়ল, “এত মাছের বাজার হয়ে যাবে!” সরকারি কাজের এই হলো ঝামেলা। এদের এত বেশি ডেকোরাম মানতে হয়, মাথা খারাপ হয়ে যায়। “তার চেয়ে-”
কিন্তু প্রফেসরকে কথা শেষ করতে না দিয়ে একটা হাত তুলল আতিকুল আলম। “আমি বুঝতে পারছি তুই বিরক্ত হচ্ছিস। কিন্তু এর দরকার আছে। না হলে একটা ব্লেইম গেম চলবে পরে। আর তাছাড়া তোর সেই ফাইলটার অনুমতির জন্যও এই ডেকোরামটুকু আমাকে মানতে হবে। “
প্রফেসর তাকিয়ে আছে আতিকুল আলমের দিকে। কে যেন বলেছিল, একবার যে আমলা হয় চিরকাল সে আমলাই থাকে। আতিকুল আলম এইরকম রুদ্ধশ্বাস পরিস্থিতিতেও পরবর্তীতে সম্ভাব্য পরাজয়ের হাত থেকে গা বাঁচিয়ে রাখার পরিকল্পনা ঠিক করে রাখছে। “ঠিক আছে,” মৃদু স্বরে বলে উঠল প্রফেসর। “কিন্তু দ্রুত।”
আতিকুল আলম আফসারের দিকে তাকিয়ে দুটো আঙুল তুলে দেখাল। “দু-মিনিট সময় দিলাম সবাইকে এক করার জন্য,” প্রায় সাথে সাথেই ঝড়ের বেগে কক্ষ ত্যাগ করল আফসার। মারিয়াকেও দেখিয়ে সে বলে উঠল, “প্রেজেন্টেশন সাজাও, তুমিই প্রেজেন্ট করবে,” মারিয়া কিছু না বলে একবার আতিকুল আলম আর একবার প্রফেসরের দিকে সামান্য মাথা নেড়ে বেরিয়ে গেল। তার দৃষ্টিতেও সেই একই উদ্ধত্য যেটা আফসারের চোখে ছিল, এদের সমস্যা কী! সবাই এমন কেন? মনে মনে ভাবল প্রফেসর।
মারিয়া মেয়েটা বেরিয়ে যেতেই আতিকুল আলম চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের পাশে রাখা কফি মেশিনের সামেন গিয়ে দুটো কফির কাপ ভরে নিয়ে এলো। “জাকারিয়া শোন, তোকে এই পর্যন্ত নিয়ে আসতে আমার যে কী পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে তা হয়তো কোনোদিনই আমি তোকে বোঝাতে পারব না। কিন্তু মনে রাখিস তোর ওপরে অনেক কিছু নির্ভর করছে।’
আতিকুল আলমের কথা শুনে প্রফেসর হেসে উঠল। “আমি তো ভেবেছিলাম ‘অনেক কিছু নয়, ‘সবকিছু’ই এখন নির্ভর করছে আমার ওপরে।”
আতিকুল আলমকে একটু দিশেহারা মনে হলো প্রফেসরের কথা শুনে। “দোস্ত, তুই জানিস না কী ভয়াবহ অবস্থা হবে… যাই হোক,” সে নিজেকে সামলে নিল। “মিটিঙে তো সব ব্রিফিং হবেই, তুই শুধু মনে রাখিস আজ রাতে যা ঘটতে যাচ্ছে তাতে তুই আমি বা আমরা নই এই শহরের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জীবন নির্ভর করছে। আর তাছাড়া–“
প্রফেসর কফির কাপের দিকে তাকিয়ে আছে। মনে মনে ভাবল একবার বলে, এসব বলে তুই আমাকে দুর্বল করে দিচ্ছিস। কিন্তু বলল না, কারণ এই মুহূর্তে এসব কথার কোনো মূল্য নেই। হয় সফল হবে, আর না হয় বিফল। এটাই সব কথার শেষ কথা।
“স্যার, সব রেডি,” কামরার স্লাইডিং ডোর ঠেলে হাঁপাতে হাঁপাতে বলে উঠল আফসার। কাপের ঠান্ডা কফি গলায় ঢেলে উঠে দাঁড়াল প্রফেসর। “চল।”