শব্দজাল – ১৪

১৪

নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো শব্দ করে দরজাটা খুলে যেতেই রুমের বাইরে বেরিয়ে এলো প্রফেসর। বেরোতেই দেখতে পেল তার দিকে প্রায় দৌড়ে আসছে আফসার।

“স্যার, আপনি ঠিক আছেন?” কী বলবে ঠিক বুঝতে না পেরে বোকার মতো একটা প্রশ্ন করে বসল সে।

প্রফেসর কিছু না বলে মৃদু হেসে হাতের বাক্সটা আফসারের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল, “আমি মোটেই ঠিক নেই। আমাকে ওয়াশরুমে যেতে হবে,” আফসারের পেছনে রুমের সবাই তাকিয়ে আছে তার দিকে। প্রায় সবার চোখে-মুখে খেলা করছে অসংখ্য জিজ্ঞাসা। কিন্তু কারো দিকে না তাকিয়ে সে আফসারের কাছ থেকে ওয়াশরুম কোন দিকে জেনে নিয়ে সেদিক রওনা দিল। তার আগে ফাত্তাহর জন্য রিফ্রেশমেন্টের ব্যবস্থা করতে বলে গেল।

ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বেশ কিছুক্ষণ আয়নার দিকে তাকিয়ে রইল সে। আয়নার দিকে তাকিয়ে প্রফেসরের মনে হলো, চকচকে আয়নার ভেতর থেকে ষাটের কাছাকাছি বয়সের একজন মানুষ তার দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাকব্রাশ করা একরাশ ধূসর চুল, ফরসা লম্বাটে একটা মুখের সাথে কাচাপাকা দাড়িটা অন্যরকম একট আভিজাত্য এনে দিয়েছে চেহারায়। সাবধানে ডান হাতে ধরে চশমাটা খুলে নিল সে। চশমাটা সরিয়ে দিতেই তার বয়স যেন বেড়ে গেল বেশ খানিকটা। চোখের কোণে দপদপ করতে থাকা শিরাটা যেন তার ভেতরের উত্তেজনার প্রতিফলন হয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আয়নার দিকে তাকিয়ে আনমনেই নিজেকে প্রশ্ন করল সে, “কাজটা কি ঠিক হলো, এভাবে ঝুঁকি নেওয়াটা কি ঠিক হয়েছে?”

নিজের ভেতর থেকে কোনো জবাব আসার আগেই দরজায় সামান্য নক হলো। দ্রুত চশমাটা চোখে পরে নিতেই ভেতরে প্রবেশ করল পিয়ন গোছের একজন লোক, সে জানাল আতিকুল আলম দ্রুত যেতে বলেছে তাকে। লোকটা চলে যেতেই দ্রুত ঠিকঠাক হয়ে সে রওনা দিল লাল লাইটওয়ালা অবজারভেশন রুমের দিকে। সেখানে ঢুকে দেখতে পেল সবাই চা-কফি নিয়ে ব্যস্ত। সেই সাথে চলছে আলোচনা। দ্রুত একটা কফির কাপ নিয়ে সে এগোতেই সবাই ফিরে তাকাল তার দিকে।

“জাকারিয়া, তোর কি মনে হয়? কতটুকু আগাতে পেরেছিস তুই?” আতিকুল আলম যেভাবে প্রশ্নটা করল তাতে বোঝার উপায় নেই সে কি আসলেই প্রফেসরের অগ্রগতি জানতে চাইছে, নাকি তাকে বিচার করছে, নাকি কোনো নির্দেশনা দিচ্ছে। মনে মনে আবারও বন্ধুর প্রশংসা না করে পারল না প্রফেসর। কারণ আতিকুল আলম যে সুরে কথা বলছে সেটা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় পরিস্থিতি খুব ভালো বুঝতে পারছে সে। কারণ আসলেই বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই প্রফেসর আসলে কতটা এগিয়েছে তার লক্ষ্যের দিকে। কারণ বোমা বা এসব বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো আলোচনাও হয়নি। আর যেহেতু প্রফেসর নিজে থেকেও তার পরিকল্পনার ব্যাপারে কারো সাথেই কিছু শেয়ার করেনি কাজেই এটাও বোঝা সম্ভব নয় যে আসলে তার পরের ধাপ কী হবে। এই অ্যাঙ্গেল থেকেই আতিকুল আলম বুঝতে চাইছে প্রফেসর আসলে কী করতে যাচ্ছে।

তার প্রশ্নটা শুনে প্রফেসরের ভেতরে তেমন কোনো বিকার দেখা গেল না। এক হাতে সে কফির কাপ নিয়ে অন্য হাতে ট্রে থেকে একটা স্যান্ডউয়িচ তুলে কামড় বসাল। সবার স্থির দৃষ্টি তার ওপরে নিবদ্ধ দেখে সে এটা পরিষ্কার অনুমান করতে পারল আতিকুল আলম যে প্রশ্নটা করেছে সেটা আসলে শুধু তার নিজের প্রশ্ন নয়। এই প্রশ্ন সে সম্ভবত বাকিদের কাছ থেকে শুনে শুনে তার কান পেকে গেছে গত কিছুক্ষণে। বিশেষ করে সরকারি প্রতিনিধিরা প্রফেসরকে সরাসরি কোনো প্রশ্ন না করলেও তারা সবাই ভেতর থেকে কৌতূহলি হয়ে আছে। আর এসব লোকেরা কৌতূহল পছন্দ করে না। এরা মোটা বুদ্ধির লোক। আর তাই এদের কৌতূহল মেটানোর প্রক্রিয়াটাও খুবই মোটা প্রকৃতির

“ফাত্তাহর কাছ থেকে কথা আদায় করার জন্য আমার একটা পরিকল্পনা আছে,” বলে স্যান্ডউয়িচে আবারও কামড় বসাল প্রফেসর। “কিন্তু সত্যি কথা বলতে সেটাতে আমি আসলে খুব একটা এগোতে পারিনি এখনও। “

“হেয় তো বোঝাই যায়,” প্রফেসর তার বাক্যটা শেষও করে সারতে পারল না তার আগেই সেই কুমরো মন্তব্য করে উঠল। “আপনি তো খালি কথাই কয়ে গেলেন। কথা আর কথা, এই দিয়ে হবে?”

“আমি তো আগেই বলছিলাম অন্য কোনো প্রক্রিয়ায়—” টুথপিক তার প্রশ্নটা শেষ করে সারতে পারল না তার আগেই কুমড়ো আবারও খেঁকিয়ে উঠল।

“ওই মিয়া আপনে কহন কইলেন? আমি না কইছিলাম ধইরা পিটনাইয়া—” নিজেদের মধ্যেই লেগে গেছে কুমরো আর টুথপিক।

“এক মিনিট, এক মিনিট,” প্রায় ধমকের সুরে বলে উঠল আতিকুল আলম। এমনকি তার কালো চোহারাটাও রাগে লাল দেখাচ্ছে। সে তার কফির কাপটা ডান হাত থেকে বাম হাতে নিয়ে ডান হাতের তর্জনীটা তাক করল কুমড়ো আর টুথপিকের দিকে। “আপনাদেরকে একটা ব্যাপার বুঝতে হবে। আপনারা যত বড় কর্মকর্তাই হোন না কেন আমার বন্ধু জাকারিয়া সেটার পরোয়া করে না। আরেকটা ব্যাপার আশা করি এখন থেকে অনুধাবন করবেন যে, ও এখানে এসেছে আমাদেরকে সাহায্য করতে। যখন আমরা নিজেদের কাজের কোনো কূলকিনারা পাচ্ছিলাম না, এমন একটা সময় নিজের সব কাজ ফেলে সে এসেছে আমাদেরকে সাহায্য করতে–“

“কিন্তু…”

কেউ একজন কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল আতিকুল আলম তাকে একটা হাত তুলে থামিয়ে দিল। “আমি শেষ করি। জাকারিয়া আমাদেরকে সাহায্য করতে এসেছে, ও শেষ পর্যন্ত সফল হয় কি বিফল হয় সেটা ভিন্ন ব্যাপার কিন্তু সে চেষ্টা করছে এবং আপনারাও এখন থেকে চেষ্টা করবেন যেন ও সফল হয় এবং সেভাবেই কথা বলবেন,” বলে সে ইচ্ছে করেই বিরতি দিল। “সম্ভব হলে নিজের জায়গা থেকে সাহায্য করবেন, অন্যথায় চুপ থাকবেন।”

আতিকুল আলমের কথা শেষ হওয়ার পরও সবাই চুপ হয়ে আছে। মানুষটা হঠাৎ এভাবে রেগে যাবে কেউই মনে হয় ঠিক ভাবতে পারেনি। আফসার এগিয়ে এসে আতিকুল আলমের কানেকানে কিছু একটা বলল। আফসারের কথা শেষ হতেই তৃতীয় সেই সরকারি প্রতিনিধি যাকে তুলনামূলক বুদ্ধিমান মনে হয়েছিল সে কথা বলে উঠল।

“আমি আতিক ভাইকে শতভাগ সমর্থন করি। বিশেষ করে প্রফেসর তার জায়গা থেকে যা করছেন সেটার জন্য তাকে আমি সাধুবাদ জানাই সেইসাথে আমি আশা করি আমাদের সবার তাকে সাহায্য করার জন্য উঠেপড়ে লাগা উচিত। কারণ সে কীভাবে কী করছে সেটার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো তার চেষ্টা সফল হওয়া না হওয়ার ওপরে অনেক কিছুই নির্ভর করছে।”

প্রফেসর কফি শেষ করে কাপটা নামিয়ে রেখে মৃদু গলা খাকারি দিল। এখানে আমার নিজের একটু ক্লারিফিকেশনের দরকার আছে বলে মনে হচ্ছে। আসলে আমি আজ রাতে যখন ব্যাপারটা শুনি, এমনকি এখানে যখন আসি তখনও আমার নির্দিষ্ট কোনো পরিকল্পনা ছিল না। কিন্তু আপনাদের সবাইকে আমি জানাতে চাই, আমি যখন ওই রুমে ঢুকেছি তখন নির্দিষ্ট একটা পরিকল্পনা নিয়েই প্রবেশ করেছি। এখনও,” বলে সে একটু থেমে যোগ করল। “হয়তো সরাসরি কোনো ফলাফল এখন পর্যন্ত আপনারা দেখতে পাননি কিন্তু সত্যি কথা হলো আমি আমার পরিকল্পনাতেই আছি। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়ায় ব্যাপারটা,” বলে প্রফেসর একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস নিয়ে বলে উঠল, “আজ রাতে যদি আমরা সফল না হই তবে আগামীকাল ঢাকায় যা ঘটবে সেটার প্রভাব আপনাদের কিংবা আপনাদের পরিবারের ওপরে যেমন পড়বে ঠিক একইভাবে সেটা পড়বে আমার ওপরেও। কাজেই আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টা করব,” বলে প্রফেসর আফসার আর অতিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে বলে উঠল, “এখন আমি ভেতরে ঢুকব, সময় এই মুহূর্তে সবচেয়ে মূল্যবান। তবে ভেতরে ঢোকার আগে তোমাদের দুজনার সাথে কথা আছে।”

আফসার আর আতিকুল আলমকে নিয়ে প্রফেসর চলে এলো একমুখী কাচটার একেবারে সামনে। “আতিক, বোম স্কোয়াডের কাজ কেমন চলছে? কারণ বুঝতে পারছিস তো এখানে সফলতার সম্ভবনা কতটুকু আসলে বলা যাচ্ছে না,” প্রফেসরের গলা শান্ত কিন্তু চশমার আড়ালে তার চোখের দৃষ্টিতে কী চলছে বোঝা মুশকিল।

“কাজ চলছে পুরোদমে। শুধু বোম স্কোয়াড নয় প্রতিটি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার প্রতিটি লোকের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। প্রতিটি লোকের প্রতিটা সোর্স, প্রতিটা ইনফরমারকে নামানো হয়েছে মাঠে, ধরপাকড় চলছে সমানে। ঢাকা আজকে রাতে নরকের দরজা হয়ে গেছে,” বলে একটু থেমে সে বলে উঠল, “কিন্তু একটা ব্যাপার কী বুঝতে পারছিস তোর ওপরে অনেককিছু নির্ভর করছে। দেখলি তো পরিস্থিতি, তুই যদি কিছু করতে না পারিস,” বলে আতিকুল আলম অসহায়ভাবে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, “সরি, বন্ধু তোর ওপরে আমি আসলে চাপ সৃষ্টি করতে চাইছি না কিন্তু—” ইচ্ছে করেই সে নিজের বাক্যটা শেষ না করে একবার আফসারকে দেখে নিয়ে প্রফেসরের দিকে ফিরে তাকাল।

প্রফেসর তাকিয়ে আছে কাচের ওপাশে থাকা ছোট্ট রুমটাতে উপবিষ্ট মানুষটার দিকে। টেবিলের ওপরে দুহাত রেখে একেবারে শান্ত-সৌম্যভাবে সে বসে আছে স্থির হয়ে। যদিও তার মুখটা নিচের দিকে নামানো এবং ভালো চোখটা বন্ধ কিন্তু অবয়বে ফুটে আছে সতর্কতা, তাচ্ছিল্য এবং দুনিয়াকে প্রতিনিয়ত জানানো এক দুর্বিনীত চ্যালেঞ্জ। মানুষটার দিকে তাকিয়ে প্রফেসর আনমনেই খানিকটা হেসে উঠল, “আফসার, তুমি কি বিবর্তনে বিশ্বাস করো?” প্রশ্ন করে জবাবের অপেক্ষায় না থেকে নিজেই বলে উঠল। “মানুষের বিবর্তনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখতে পাবে মানুষ আজ পর্যন্ত তার বিবর্তনের ধারায় যে কয়টা অসাধারণ সৃষ্টিকে নিজের করে নিতে পেরেছে তার মধ্যে রয়েছে বিজ্ঞান, দর্শন, কৃষ্টি… তবে আমার কাছে মনে হয় এগুলোর ভেতরে সবচেয়ে জটিল এবং সবচেয়ে সমৃদ্ধ আরেকটা জিনিস যেটা মানুষ সৃষ্টি করতে পেরেছে সেটা হলো ভাষা। এ কারণেই একজন সাইকোলজিস্ট হিসেবে ভাষা নিয়ে কৌতূহলের কোনো শেষ নেই আমার। কিন্তু কে জানত আজ রাতে এই ভাষাই হবে আমার একমাত্র অস্ত্র। নিজেকে বাঁচানোর, নিজের শহরকে বাঁচানোর, নিজের দেশের সম্মান রক্ষা করার একমাত্র অস্ত্র। “

প্রফেসর তার কাঠের বাক্সটা আফসারের হাত থেকে নিয়ে আবারও বলে উঠল, “ভাষা আর শব্দ দিয়ে আমাকে এমন এক জাল সৃষ্টি করতে হবে যে জালে আমাকে বন্দি করতে হবে পৃথিবীর সেরা ক্রিমিনালদের একজনকে। শব্দজাল! ব্যাপারটা দুরূহ, খুবই টাফ,” বলে সে মৃদু হেসে আফসার আর আতিকুল আলমের দিকে তাকিয়ে একবার নিজের হাতে পরা ঘড়িটা দেখে নিয়ে বলে উঠল, “আফসার, আমি রুমে ঢোকার পর ওই বিশেষ কফিটা আবারও পাঠিয়ে দিতে হবে,” বলে সে যোগ করল, “অ্যান্ড উইশ মি লাক, বলে সে দৃঢ় ও দীপ্ত পায়ে এগিয়ে গেল ইন্টারগেশন রুমে প্রবেশ করার দরজার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *